নবম পরিচ্ছেদ
১.
৫ জুন ১৮৩২
বিপ্লবের মধ্যে কী আছে? একদিক দিয়ে সব আছে, আবার কিছুই নেই। বিপ্লব হল এক বিশাল অগ্নিকাণ্ডের অকস্মাৎ প্রজ্বলন, এক অনিয়ন্ত্রিত অসংযত শক্তির ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ক্রিয়া, এক প্রবল ঝড়ের মত্ততা। এ ঝড় চিন্তাশীলদের মাথা, স্বপ্নালু মানুষদের মন, আর গরিব-দুঃখীদের আত্মাগুলোকে প্রবলভাবে নাড়িয়ে দেয়। প্রজ্বলিত করে দেয় তাদের ধূমায়িত আবেগগুলোকে। যত সব-অন্যায়-অবিচারকে ন্যায়ে পরিণত করার জন্য যেন মানুষ চিৎকার করে।
এই বিপ্লব কোথায় নিয়ে যায় মানুষকে?
বিপ্লব মানুষকে নিয়ে যায় রাষ্ট্র আর আইনের বিরুদ্ধে, সমাজের মুষ্টিমেয় মানুষের সম্পদ আর অহঙ্কারের বিরুদ্ধে।
প্রতিহত আত্মপ্রত্যয়, উত্তপ্ত ক্রোধাবেগ, অবদমিত হিংসাবৃত্তি, অপ্রদর্শিত বীরত্ববোধ, অন্তরের অন্ধ উত্তাপ, পরিবর্তনের প্রতি কৌতূহল ও প্রবণতা, অপ্রত্যাশিতের প্রতি এক উগ্র আগ্রহ, দীর্ঘসঞ্চিত হতাশা, ভাগ্যের নিষ্ঠুর বিধান সম্বন্ধে এক আত্মম্ভরী বিশ্বাস, অলস স্বপ্ন, অবরুদ্ধ উচ্চাভিলাষ, এক বিক্ষুব্ধ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মুক্তির পথ রচনার এক আশান্বিত প্রয়াস এইগুলো হল বিপ্লবের উপাদান। যারা অলস, অকর্মণ্য, যাদের কোনও আত্মবিশ্বাস বা কোনও আদর্শে বিশ্বাস নেই, যারা শ্রমের থেকে ভাগ্যের ওপর বেশি নির্ভর করে, যাদের নিজস্ব কোনও ঘরবাড়ি নেই এবং আকাশে ভাসমান মেঘেদের মতো ঘুরে বেড়ায়, তারা সবাই বিপ্লবে যোগদান করে। রাষ্ট্র, ব্যক্তিজীবন ও ভাগ্যের বিরুদ্ধে যারা এক ক্রুদ্ধ বিদ্বেষ পোষণ করে অন্তরে তারাও আকৃষ্ট হয় বিপ্লবের প্রতি। বিপ্লব হচ্ছে সামাজিক আবহাওয়ার মধ্যে গড়ে ওঠা এক ধরনের ঘূর্ণিবায়ু–যা সব কিছুকেই চূর্ণ-বিচূর্ণ করে উড়িয়ে দিতে চায়, সবল ও দুর্বল সবাইকে আঘাত করতে চায়। সে ঘূর্ণিবায়ু যেন একদল মানুষকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে তাদের দিয়ে আর একদলকে ধ্বংস করতে চায়। বিপ্লবের ঘূর্ণিবায়ু বিপ্লবীদের এক অসাধারণ ও রহস্যময় শক্তি দান করে, তাদের সকলকে এক ধ্বংসের যন্ত্র ও অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগ করে। বিপ্লব সামান্য এক ছোট্ট পাথরখণ্ডকে কামানের গোলায় পরিণত করে, সামান্য এক শ্রমিককে সেনাপতিতে রূপান্তরিত করে। বুর্জোয়াদের ঐক্যবদ্ধ করে তোলে।
বিপ্লবের কতকগুলি ভালো দিকও আছে। বিপ্লব যদি দুর্বল হয়, যদি কোনও রাষ্ট্রের সরকারকে উচ্ছেদ করতে না পারে তা হলে সে বিপ্লব সরকারের হাতকে শক্তিশালী করে তোলে, পুলিশের পেশিকে শক্ত করে আর সেনাবাহিনীর নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করে। বিপ্লব যেন বলবৃদ্ধিকারী এক ব্যায়াম। কোনও মানুষ যেমন গাত্রমর্দনের পর চাঙ্গা হয়ে ওঠে তেমনি বিপ্লবের পর রাষ্ট্রশক্তি পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে।
কিন্তু তিরিশ বছর আগে বিপ্লব সম্বন্ধে মানুষের ধারণা অন্যরকম ছিল। ১৮৩১ সালের জুলাই বিপ্লবে যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়, তা সে বিপ্লবের পবিত্রতাকে নষ্ট করে দেয়। জনগণের মনের অবরুদ্ধ আবেগ মুক্তি পায় এ বিপ্লবে। এ বিপ্লব প্রথমে এনে দেয় মুক্তিচেতনা; কিন্তু হাঙ্গামার পর তা ভয়াবহ হয়ে ওঠে মানুষের কাছে। বিপ্লবের অশুভ দিকগুলো প্রকট হয়ে ওঠে। প্রথমত হাঙ্গামা মারামারির ফলে দোকানপাট বন্ধ থাকে, চারদিকে আতঙ্ক ছড়ায়। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে আর্থিক অনটনে দেউলে হয়ে পড়ে মানুষ। ধনীরা আতঙ্কিত হয়ে উঠে টাকা মূলধনে খাটাতে চায় না, জনগণও সঞ্চয় করতে পারে না। ফলে মূলধনে টান পড়ে, শিল্পের অবনতি ঘটে। সর্বত্র নিরাপত্তাবোধের এক ব্যাপক অভাব দেখা যায়। বিভিন্ন শহরে প্রতিবিপ্লবী শক্তি মাথা তুলে ওঠে। তাছাড়া প্রচুর আর্থিক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। হিসাব করে দেখা যায় বিপ্লবের প্রথম তিন দিনে একশো কুড়ি মিলিয়ন ফ্ৰাঁ ক্ষতি হয় ফ্রান্সে। কোনও নৌযুদ্ধে কোনও দেশের বিপর্যস্ত নৌবাহিনীর ষাটটি যুদ্ধজাহাজ বিধ্বস্ত হলে এই পরিমাণ ক্ষতি হয়।
তবে রাজপথে বিপ্লবজনিত হাঙ্গামা হয় যখন, যখন জনগণ রাস্তার মুখগুলো বন্ধ করে দিয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে তখন তা যুদ্ধের মতো দেখতে লাগে। সেনাবাহিনী গৃহযুদ্ধের সময় বড় সংকটে পড়ে। দেশের লোকের বিরুদ্ধেই অস্ত্র ধারণ করতে হয় তাদের। এই হাঙ্গামা একদিকে যেমন জনগণের দুঃসাহস বাড়িয়ে দেয় তেমনি বুর্জোয়াদের সাহস ও মনোবল কেড়ে নেয়।
কিন্তু এই রক্তপাতের কী প্রয়োজন ছিল? এই রক্তপাত দেশের অগ্রগতিকে ব্যাহত করে দেশের ভবিষ্যৎকে অন্ধকার করে দেয়। দেশের সৎ ও সুন্দরমনা লোকদের জীবনকে অশান্ত করে তোলে। মোট কথা, এ বিপ্লব বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এতক্ষণ আমরা বিপ্লবের ফলের কথা বললাম। এবার তার কারণ সম্বন্ধে কিছু বলব।
.
২.
১৮৩২ সালের ঘটনাবলিকে ঐতিহাসিকরা কিভাবে বিচার করবেন? এ ঘটনাবলিকে বিপ্লব না বিদ্রোহ না গণবিক্ষোভ, কী অ্যাখ্যা দেওয়া যাবে? বাইরে থেকে দেখে এ ঘটনাকে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বলে মনে না করে লোকে তাকে বিপ্লব হিসেবেই শ্রদ্ধা করতে থাকে। অনেকে বলতে থাকে এ ঘটনাবলি ১৮৩০ সালের শেষ প্রতিধ্বনি। অত্যুপ্ত মস্তিষ্কে কল্পনাগুলো একবার উত্তপ্ত হলে তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডা হতে চায় না। বিপ্লব কখনও অকস্মাৎ শেষ হয়ে যায় না। অনেক ভাঙাগড়া ও উত্থানপতনের পর সে বিপ্লব প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
১৮৩২ সালের বসন্তকালে কলেরা মহামারীরূপে দেখা দেয়। তিন মাস ধরে এই মহামারী গোটা শহরজুড়ে তাণ্ডব চালিয়ে বহু লোকের প্রাণ সংহার করলেও এবং বহু লোকের মনোবল ভেঙে দিলেও এক বিরাট গণবিক্ষোভের জন্য যেন প্রস্তুত হয়ে ছিল প্যারিস নগরী। এ সমগ্র নগরী অগ্নিগর্ভ এক দাহ্য বস্তুর মতো শুধু এক ফুলিঙ্গের অপেক্ষায় স্তব্ধ হয়ে ছিল। এই বছরের জন্য জুন মাসে জেনারেল ল্যামার্কের মৃত্যুই হল। সেই স্ফুলিঙ্গ। ল্যাৰ্মাক ছিলেন খ্যাতিমান এক কাজের লোক। তিনি সম্রাট নেপোলিয়নের অধীনে যুদ্ধক্ষেত্রে সেনানায়ক হিসেবে এবং রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার যুগে আইনসভার। সদস্য হিসেবে যোগ্যতার পরিচয় দেন। তিনি ছিলেন যেমন বাগ্মী তেমনি সাহসী বীর। একদিন সেনানায়ক হিসেবে যিনি প্রভুত্বের সঙ্গে আদেশ দান করতেন আজ তিনিই জনগণের স্বাধীনতার প্রবক্তারূপে তাদের দাবি তুলে ধরেন। সমরকুশলী ল্যামার্ক ছিলেন অপরাজেয় বীর; সেনাপতি হিসেবে স্বয়ং নেপোলিয়নের পরেই তার স্থান ছিল। ওয়াটারলু যুদ্ধে পরাজয়ের জন্য মর্মাহত হন তিনি। অথচ সম্রাট নেপোলিয়নের পতনের পর দেশে রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর জনগণের অধিকার এবং স্বাধীনতার জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠেন তিনি। তাই তার মৃত্যুর দিনে সমগ্র জাতি শোকাহত হয়ে ওঠে। এই শোক থেকে জ্বলে ওঠে বিদ্রোহের আগুন।
৫ জুন সারাদিন ধরে চলে রোদ-বৃষ্টির খেলা। পূর্ণ সামরিক মর্যাদাসহকারে বিরাট সমারোহে জেনারেল ল্যামার্কের শবযাত্রা গোটা শহর পরিভ্রমণ করে। সরকার থেকে অনেক নিরাপত্তারও ব্যবস্থা নেওয়া হয়। দুটি পদাতিক বাহিনী ও দশ হাজার জাতীয় রক্ষীবাহিনীর সদস্য তরবারি হাতে শবানুগমন করছিল। শবাধার বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল একদল যুবক। শববাহীদের পেছনেই ছিল অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসারদের এক মিছিল। তাদের সকলের হাতে ছিল লরেল গাছের একটি করে ছোট ডাল। সবশেষে ছিল ছাত্র আর জনতা। জনতা বিভিন্ন দলে বিভক্ত ছিল এবং প্রতিটি দলে একজন করে নেতা ছিল। একজন লোক দুটি পিস্তল হাতে সব দল দেখাশোনা করছিল। জনতার মধ্যে শৃঙ্খলা ছিল। পথের দু ধারে সব বাড়ির বারান্দা, ছাদ, জানালা ও গাছগুলো লোকের ভিড়ে ভর্তি ছিল। তবে জনতার মধ্যে প্রতিটি লোকের হাতে লাঠি, তরবারি প্রভৃতি অস্ত্র ছিল। এই সশস্ত্র জনতার মিছিল দেখে দর্শকরা আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিল।
আগে হতে বিক্ষোভের আভাস পেয়ে সরকারি কর্তৃপক্ষও প্রস্তুত ছিল। প্লেস লুই পঞ্চদশ নামে এক জায়গায় অশ্বারোহী বাহিনীর চারটি দল শবযাত্রা অনুসরণ করতে থাকে। অশ্বারোহী সৈন্যদের প্রত্যেকের হাতে গুলিভরা বন্দুক ছিল। সংকেত পাওয়া মাত্র গুলি করার জন্য প্রস্তুত ছিল তারা। সেনাবাহিনীর বাকি দলগুলোও সেনানিবাসে সজাগ ছিল। শহরে মোট সৈন্যসংখ্যা ছিল চব্বিশ হাজার। এ ছাড়া শহরের বাইরেও সেনাবাহিনীর কয়েকটি দল প্রস্তুত হয়ে ছিল। তাদের সংখ্যা ছিল তিরিশ হাজার।
জনতার মিছিলের মধ্যে নানারকম গুজব ছড়িয়ে পড়ছিল। কয়েকজন লোক বলে বন্দুক কারখানার দু জন কর্মী জনতাকে ঢুকতে দেবার জন্য গেট খুলে রাখবে। লোকগুলোর পরিচয় কেউ জানতে পারেনি। জনতার মধ্যে অনেকের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল তারা লুটপাট করার জন্য প্রস্তুত হয়ে ছিল এবং তারা দুষ্ট প্রকৃতির লোক।
শবযাত্রা বুর্ভোদ হয়ে বাস্তিলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে বৃষ্টি এলেও জনতার ভিড় কমেনি কিছুমাত্র। পথে ছোটখাটো কয়েকটি ঘটনাও ঘটে। ভেঁসোম কোলামের কাছে শব্যাত্রাটি আসতেই একটি বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা রাজতন্ত্রী একজন ডিউককে লক্ষ্য করে পাথর ছোড়ে জনতার একটি অংশ। একটি পতাকা হতে জুলাই রাজতন্ত্রের প্রতীকস্বরূপ মুরগিটিকে ছিঁড়ে ফেলে পতাকাটি পা দিয়ে মাড়িয়ে দেওয়া হয়। পোর্তে সেন্ট মার্তিনে একজন পুলিশ সার্জেন্টকে তরবারি দিয়ে আঘাত করা হয়। এক পলিটেকনিক স্কুলের ছাত্ররা মিছিলে এসে যোগদান করার সঙ্গে সঙ্গে প্রজাতন্ত্র দীর্ঘজীবী হোক’ ধ্বনি দিয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানানো হয়। প্লেস দ্য লা বাস্তিলে বিরাট এক দর্শকল মিছিলে যোগদান করে।
শবযাত্রা এবার বাস্তিল পার হয়ে ক্যানেলের ধার দিয়ে গিয়ে একটা ছোট সেতু পার হয়ে পঁত দ্য অস্টারলিস দুর্গের সামনের মাঠে এসে থমকে দাঁড়ায়। সেই মাঠ থেকে শুরু করে জনতার মিছিল কোয়ে বুদো, বুলভার্দ, বাস্তিল ও সেন্ট মার্কিন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এবার শবাধারের চারদিকে একটি ব্যুহ রচনা করে জনতাকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। লাফায়েত্তে শেষবারের মতো ল্যামার্ককে বিদায় দিয়ে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। তার ভাষণ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে কালো পোশাকপরা লাল পতাকা হাতে এক অশ্বারোহী সৈনিক শবাধারের কাছে এসে তাদের সেনাপতিকে কী বলতেই সেনাপতি শবযাত্রা ছেড়ে সঙ্গে সঙ্গে চলে যায়। বুলভার্দ বুর্দো থেকে অস্টারলিস পর্যন্ত বিস্তৃত জনতার ভিড় থেকে গর্জনশীল সমুদ্রতরঙ্গের মতো এক বিক্ষুব্ধ ধ্বনি উত্তাল হয়ে উঠল। শবাধারবাহী যুবকেরা ল্যামার্কের কফিন লাফায়েত্তের জন্য গাড়ি থেকে নামানোর পর আবার সেটি গাড়ির উপর তুলে দিল।
এমন সময় আর এক অশ্বারোহী বাহিনী এসে সেতুর মুখটা বন্ধ করে দেয়। তারা শুধু সরে গিয়ে লাফায়েত্তের গাড়িটা থামার জন্য পথ করে দেয়। অশ্বারোহী বাহিনী আর জনগণ মুখোমুখি হয়। মেয়েরা মিছিল থেকে পালিয়ে যেতে থাকে ভয়ে।
তখন কিসের থেকে ঘটনার সূত্রপাত হয় তা কেউ ঠিক করতে পারবে না। যখন দুটো বিশাল মেঘ মুখোমুখি জমা হয় তখন অন্ধকার হয়ে ওঠে চারদিক। কোনও প্রত্যক্ষদর্শী বলে আর্সেনান থেকে বিল বাজিয়ে গুলি করার আদেশ দেওয়া হয় সেনাবাহিনীকে। আবার অনেকে বলে একটি যুবক নাকি এক সৈনিককে ছোরা দিয়ে আক্রমণ করে প্রথমে আর সেই থেকে ঘটনার সূত্রপাত হয়।
সহসা তিনটি গুলি বর্ষিত হয়। প্রথম গুলিটিতে শোনেল নামে সেনাবাহিনীর এক অফিসার মারা যায়, দ্বিতীয়টিতে কাছাকাছি একটি বাড়ির জানালা বন্ধ করার সময় এক বৃদ্ধা মারা যায় আর তৃতীয়টি একজন সামরিক অফিসারের ব্যাজে লাগে। এইভাবে ঘটনার সূত্রপাত হয়। তখন সেতুর ওদিক থেকে আর এক সেনাবাহিনী এগিয়ে আসতে থাকে। জনতা সৈন্য ও পুলিশবাহিনীর উপর ইট-পাথর ছুঁড়তে থাকে আর পুলিশ ও সৈন্যরা গুলিবর্ষণ করতে থাকে। মুহূর্তের মধ্যে শহরের অন্য সব জায়গাতেও হাঙ্গামা ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
.
৩.
কোনও গণ অভ্যুত্থানের প্রথম ঢেউয়ের মতো এমন আশ্চর্যজনক ঘটনা আর কিছু হতে পারে না। সব জায়গায় একই সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে সে ঢেউ। মনে হয় সে ঢেউ যেন ফুটপাত থেকে বেরিয়ে এল অথবা আকাশ থেকে পড়ল। কোথাও দেখা যায় শৃঙ্খলাবদ্ধ অভিযান, আবার কোথাও-বা দেখা যায় স্বতঃস্ফূর্ত গণবিক্ষোভের চরম বিশৃঙ্খলা। অনেক সময় দেখা যায় হঠাৎ কোথা থেকে এক নবাগত এসে বিক্ষুব্ধ জনতাকে নেতৃত্ব দিয়ে খুশিমতো যেদিকে সেদিকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। তখন দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে যায়। পথচারীরা ছুটে পালাতে থাকে এস্ত পদক্ষেপে। রাস্তার ধারে যে কোনও রুদ্ধ দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে তার মধ্যে আশ্রয় নেবার জন্য।
জুলাই বিপ্লব শুরু হওয়ার মিনিট পনেরো’র মধ্যেই এই ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকে। বেততানেরি অঞ্চলে এক কাফেতে কুড়িজনের এক যুবকদল ঢুকে কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনরঙা একটা পতাকা নিয়ে বেরিয়ে এল। তাতে লেখা ছিল ‘প্রজাতন্ত্র অথবা মৃত্যু। তিনজন সশস্ত্র লোক তাদের সামনে এসে নেতৃত্ব দিচ্ছিল। তাদের একজনের হাতে একটা বন্দুক, একজনের হাতে একটা তরবারি আর একজনের হাতে একটা বর্শা ছিল। বুলভার্দ সেন্ট মার্তিনে এক অস্ত্র কারখানা লুট হয়। র্যু বোবুর্গে ও আগে দুই জায়গায় মোট তিনটি বন্দুকের, দোকানও লুণ্ঠিত হয়। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যে জনতার হাতে ২৩০টি বন্দুক, চৌষট্টিটি তরবারি ও তেষট্টিটি পিস্তল আসে। এ ছাড়া আরও কিছু আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দেওয়া হয় জনতার হাতে। অনেক যুবক বাড়িতে বাড়িতে কার্তুজ তৈরি করতে শুরু করে দেয়। র্যু দ্য পেরিতে বাড়ি নির্মাণরত এক রাজমিস্ত্রি বন্দুকের গুলি লেগে মারা যায়। রাস্তার আলোর কাঁচগুলো ভেঙে ফেলা হয়, অনেক গাছ উপড়ে ফেলা হয় ও আসবাবপত্র টেনে বার করে আনা হয়। এই সব কিছু দিয়ে পথের মোড়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। ব্যারাক থেকে সৈন্যরা বেরিয়ে এসে রাজপথে মার্চ করে যেতে লাগল। জাতীয় রক্ষীবাহিনীগুলোও পথে পথে মার্চ করে যেতে লাগল।
এদিকে বিভিন্ন ছাত্রাবাস থেকে ছাত্ররাও বেরিয়ে আসতে লাগল একযোগে। বিক্ষুব্ধ জনতা এক একটি বাড়িকে খালি করে দুর্গের মতো ব্যবহার করতে লাগল। আগে যে জনতা ইট-পাথর ছুঁড়ে লড়াই করত এখন তারা বন্দুক নিয়ে লড়াই করতে লাগল। সন্ধে ছটার সময় প্যাসেজ দ্যু’র সামনে সেনাবাহিনী ও বিপ্লবী জনতার রীতিমতো লড়াই চলতে লাগল।
কোনও কোনও সেনারা কুণ্ঠাবোধ করছিল। তারা ভাবছিল ১৮৩০ সালের জুলাই বিপ্লবে যে সব সেনাবাহিনী নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে লড়াই থেকে বিরত থাকে তারা বিপ্লবের পর পুরস্কৃত হয়। এই কুণ্ঠার জন্য তাদের মনোবল ভেঙে যায়। সরকার পক্ষের সৈন্যবাহিনী পরিচালনার ভার ছিল দু জন সেনাপতির হাতে। তাদের নাম হল জেনারেল লোবাউ আর জেনারেল বোগদ। এদের দু জনের মধ্যে লোবাউ ছিল পদমর্যাদার দিক থেকে বড়। সেনাবাহিনী জাতীয় রক্ষীবাহিনী আর পুলিশবাহিনীর সঙ্গে একযোগে রাস্তায় মার্চ করে এগিয়ে এসে বিপ্লবীদের ঘাঁটিগুলো পরিদর্শন করছিল।
যুদ্ধের মন্ত্রী মার্শাল সুলত একজন বড় যোদ্ধা ছিলেন এবং তিনি অস্টারলিৎস যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু সারা শহরজুড়ে এই ব্যাপক গণবিক্ষোভ দেখে ভয় পেয়ে যান।
.
৪.
গত দু বছরের মধ্যে একাধিক গণঅভ্যুত্থান দেখেছে প্যারিস। তাই বিপ্লবের সময় অন্যান্য জেলা বা প্রদেশের থেকে সবচেয়ে নির্বিকার থাকে প্যারিস। বিপ্লবের ব্যাপারে তার পূর্বঅভিজ্ঞতা থাকার ফলে পথে সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিপ্লবী জনতার লড়াই দেখেও প্যারিসের লোকরা বলে, এ হাঙ্গামা হচ্ছে, এমন কিছু না। দোকানপাট সাধারণত খোলাই থাকে, তবে কোনও দোকানদার যখন দেখে হাঙ্গামার স্রোত সেদিকে এগিয়ে আসছে তখন দোকান বন্ধ করে চলে যায়। একজন দর্শক আর একজনকে নির্বিকারভাবে বলে, সেন্ট মার্তিনে গোলমাল হচ্ছে। অনেকে আবার হাঙ্গামার অনতিদূরে দাঁড়িয়ে হাসাহাসি ও গল্পগুজব করে। ১৮৩১ সালে রাজপথে এক জায়গায় যখন একটা বিয়ের শোভাযাত্রা যাচ্ছিল তখন দু পক্ষই গুলিবর্ষণ থামিয়ে পথ করে দেয়। ১৮২৯ সালে ১২ মে তারিখে র্যু সেন্ট মার্তিনে যখন একজন বৃদ্ধ মদের বোতলভরা একটা হাতে-টানা গাড়িকে নিয়ে যাচ্ছিল তখন সে সরকারি ও বিপ্লবীদের মাঝখান দিয়ে যাবার সময় দাঁড়িয়ে তার গাড়ি থেকে মদের বোতলগুলো নিয়ে দু পক্ষের যোদ্ধাদের মধ্যে ভাগ করে দেয়। এটাই হল প্যারিসের গণঅভ্যুত্থানের বৈশিষ্ট্য, যা অন্য কোনও রাজধানীতে পাওয়া যায় না। প্যারিস একই সঙ্গে ভলতেয়ার আর নেপোলিয়নের শহর।
কিন্তু ১৮৩২ সালের জুন মাসে ভিন্ন ব্যাপার দেখা গেল। সমগ্র প্যারিস শহর ভীষণভাবে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। এমনকি যে সব অঞ্চলে কোনও হাঙ্গামা বা লড়াই হয়নি, সেই সব অঞ্চলের লোকরাও ঘরের জানালা ও দোকানপাট বন্ধ করে রাখত। সাহসী লোকেরা অবশ্য যন্ত্রের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। দু একজন পথচারী রাস্তা দিয়ে চলে যায়। চারদিকে নানারকম গুজব ছড়াতে লাগল। শোনা গেল বিপ্লবীরা ব্যাঙ্ক দ্য ফ্রান্স দখল করে নিয়েছে। সাহসী লোকরা সবাই অস্ত্র জোগাড় করে লড়াইয়ে নেমে পড়ল। যারা ভীরু কাপুরুষ তারা লুকিয়ে পড়ল। লোবাউ ও বোগ এক পরিকল্পনা করল –সেনাবাহিনীর চারটি দল চারদিক থেকে বিপ্লবীদের মূল ঘাঁটি আক্রমণ করবে। সে চারটি দিক হলো, বাস্তিল, পোর্তে সেন্ট মার্তিন, প্লেস দ্য গ্রেভয়ার আর লে হ্যালে। কিন্তু সেনাবাহিনীকে প্যারিস শহর ছেড়ে শ্যাম্প দ্য মার্সে চলে যেতে হবে। শহরে কখন কী হবে তা কেউ বলতে পারে না। মার্শাল সুত-এর কুণ্ঠাটা ক্রমশ অস্বস্তিকর হয়ে উঠল। কেন তিনি বিপ্লবীদের ঘাঁটিগুলোকে অবিলম্বে আক্রমণ করলেন না? তিনি হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেন।
সেদিন সন্ধ্যায় শহরের কোনও থিয়েটার খুলল না। পুলিশপাহারা বেড়ে গেল পথে পথে। পুলিশ সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করতে লাগল। পথচারীদের আটক করে তাদের কাছে অস্ত্র আছে কি না দেখতে লাগল। রাত্রি নটার মধ্যেই আটশো লোককে গ্রেপ্তার করা হল। সমস্ত জেলখানা, বিশেষ করে কনসাজারি জেলখানাটা একেবারে ভরে গেল। অনেক জেলখানায় বন্দি বিপ্লবীদের উঠোনে ফাঁকা জায়গায় রাখা হল। ঘরে রাখা সম্ভব হল না তাদের।
বাড়িতে মা ও স্ত্রীরা তাদের লোকদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল ভয়ে ভয়ে। কে কখন বাড়ি ফিরবে তার ঠিক নেই। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন দল রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারা চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘সবাই বাড়ি চলে যাও।’ লোকে তাড়াতাড়ি করে তাদের আপন আপন বাড়ির দরজা-জানালা সব বন্ধ করে দিল। কখন গুলিবর্ষণ শুরু হবে তার জন্য স্বাসরুদ্ধ হৃদয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। দেখতে দেখতে গোটা প্যারিস শহরটা বিপ্লবের লাল আগুনের আঁচে রাঙা হয়ে উঠল।