০৮.
ভেগাস থেকে বিকেলে ফিরল মাইকেল কর্লিয়নি।
লিমুসিন গাড়ি নিয়ে উঠানে ঢুকল রকো ল্যাম্পনি। স্বামীকে তুলে আনার জন্যে এয়ারপোর্টে যাবে কে। বেড়িয়ে বা কাজ সেরে কোথাও থেকে মাইকেল ফিরলে তাকে নিয়ে আসার জন্যে এয়ারপোর্টে যাবেই ও, কেউ বাধা দিয়ে রাখতে পারে না তাকে। কাছে মাইকেল না থাকলে সাঙ্ঘাতিক অসহায়, নিঃসঙ্গ বোধ করে ও তাছাড়া বাড়িটা তো একটা গা ছমছম দুর্গের মত, মাইকেলের উপস্থিতি ছাড়া দম বন্ধ হয়ে আসতে চায় তার।
মাইকেলের নতুন বডিগার্ড অ্যালবার্ট নেরিকে প্লেন থেকে নামতে দেখল কে। তারপর দেখা গেল মাইকেলকে। সবার শেষে মাইকেলের ঠিক পিছনেই!দেখা যাচ্ছে টম হেগেনকে। মাইকেলের মুখের দিকে অপলক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল কে। সাথে সাথে ধরতে পারল, মাইকেলের মুখটা শুকনো, বোধহয় মন খারাপ। মনে মনে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল কে। চোখের দৃষ্টি গিয়ে পড়ল সামনের লোকটার ওপর। অ্যালবার্ট ননরিকে তেমন পছন্দ হয় না কে-র.। ওকে দেখলেই লুকা ৰাসি নামে সেই ভয়ঙ্কর লোকটার কথা মনে পড়ে যায় ওর। এর চেহারার মধ্যেও ফুটে আছে, আশ্চর্য একটা চাপা হিংস্র ভাব। তাকালেই কেন যেন নিজের অজান্তে শিউরে ওঠে কে।
মাইকেল প্লেন থেকে নেমে কয়েক পা মাত্র এগিয়েছে, হঠাৎস্যাৎ করে পিছিয়ে গেল নেরি, দ্রুত মাথা ঘুরিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে নিচ্ছে চারদিকটা। এয়ারপোর্টে যারা উপস্থিত রয়েছে তাদের একজনও তার চোখ ফাঁকি দিতে পারল না। কে-কে সেই দেখতে পেল প্রথম। মাইকেলের কাঁধে একটা হাত রাখল সে, কিন্তু ঠোঁট নেড়ে কিছু বলল না। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে কে-কে দেখতে পেল মাইকেল।
এক ছুটে স্বামীর আলিঙ্গনের ভেতর গিয়ে ঢুকল কে। দ্রুত একটা চুমো খেয়ে স্ত্রীকে সরিয়ে দিল মাইকেল। পাখি যেভাবে ডানা মেলে দিয়ে বাচ্চাকে আড়াল করে রাখে ঠিক তেমনি আড়াল করে রেখেছে মাইকেলকে টম হেগেন। অ্যালবার্ট নেরি এরই মধ্যে অদৃশা হয়ে গেছে। লিমুসিনে প্রথমে চড়ল: মাইকেল। তারপর কে। সবশেষে হেগেন। কে জানতেই পারল না যে নেরি আরও দুজন লোকের সাথে। অপর একটা গাড়িতে চড়ে ওদের অনুসরণ করে সোজা উঠানে এসে কল
মাইকেলের কাজকর্ম কেমন হলো, এ-ধরনের কোন প্রশ্ন কখনও জিজ্ঞেস করে না কে। ভদ্রতা দেখিয়ে জানতে চাইলেও মাইকেল অস্বস্তি বা অপ্রতিভ বোধ করতে পারে ভেবে মৌন থাকার নীতিই গ্রহণ করেছে সে। জানে, প্রশ্ন করা হলে ভদ্রতা রক্ষা করার স্বার্থে উত্তর না দিয়ে পারবে না মাইকেল। কিন্তু প্রাঙ্গটা তুললেই হয়তো দুজনেরই মনে পড়ে যাবে যে ওদের দাম্পত্য জীবনে মস্ত একটা নিষিদ্ধ এলাকা আছে, সেটা চিরকালই নিষিদ্ধ থেকে যাবে। তবে এ নিয়ে আজকাল আর মন খারাপ করে না কে। কিন্তু মাইকেল আজ নিজেই জানাল, রাতেই ওকে বাবার সাথে দেখা করতে হবে, ভেসে যা যা ঘটেছে সব এখুনি জানাতে হবে ডনকে। মনটা সত্যি সত্যি আজ খারাপ হয়ে গেল কে-র। কথাটা মুখ ফুটে মাইকেলকে জানাতেও দ্বিধাবোধ করল না সে।
বিশ্বাস করো, খারাপ আমারও লাগছে, সান্তনা দেবার সুরে বলল মাইকেল, ঠিক আছে, কাল তোমাকে আমি নিউ ইয়র্কে নিয়ে যাব। ছবি দেখাব। ডিনার খাওয়াব। খুশি? কে-র পেটে একটা হাত রেখে ধীরে ধীরে চাপড় মারছে মাইকেল। ও এখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। বাচ্চা হলেই তো আবার তুমি আটকা পড়ে যাবে বাড়ির ভেতর। আই বাপ! তুমি দেখছি যত না আমেরিকান তার চেয়ে বেশি ইতালীয়। জোড়া বছরে জোড়া বাচ্চা।
আর তুমি? ঝাঁঝের সাথে বলল কে। তুমি তো যত না ইতালীয় তার চেয়ে বেশি আমেরিকান। বাইরে থেকে ফিরে একটা দিন বাড়ি থাকবে, তা না, আবার কাজের ভেতর নাক ওজতে ছুটছ। শুধু ব্যবসা আর ব্যবসা। ঘরে যে আরও একজন। আছে, সে কথা ভুলে গেলেই তো পারো। কথায় কঁঝ থাকলেও, বলার সময় হেসে ফেলেছে কে। আই, জবাব দাও, ঠিক কখন পাব তোমাকে বিছানায়? বেশি দেরি করলে কিন্তু ভাল হবে না।
মাঝরাতের আগেই পাবে, মুচকি হেসে বলল মাইকেল। কিন্তু তাই বলে রাত জেগে বসে থেকো না আবার।
না, থাকব না!
.
ডন কর্লিয়নির লাইব্রেরি।
পরামর্শ সভা বসেছে। উপস্থিত রয়েছেন ডন নিজে, মাইকেল, টম হেগেন, কার্লো, দুই ক্যাপোরেজিমি ক্লেমেঞ্জা আর টেসিও।
পরিবেশে আগের সেই আন্তরিক হৃদ্যতার ছোঁয়া নেই। কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে উঠেছে আবহাওয়াটা। এর আগে ডন তার আধা অবসশ্রহণের কথা ঘোষণা করেছেন, জানিয়েছেন পারিবারিক ব্যবসার দায়িত্ব মাইকেলের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। সেইদিন থেকেই থমথম করছে পরিবেশটা। তার অবশ্য একাধিক কারণও আছে।
মাফিয়া পরিবারগুলোর জন্যে একটা বিশেষ নিয়ম আছে, সে নিয়ম কর্লিয়নি পরিবারের জন্যেও প্রযোজ্য, তা হলো, পারিবারিক ব্যবসা পরিচালনার ভার উত্তরাধিকার সূত্রে বাপের কাঁধ থেকে ছেলের কাঁধে নাও বর্তাতে পারে। অন্য কোন পরিবার হলে এখানকার পরিস্থিতি অন্যরকম হত, হয়তো ক্লেমেঞ্জা বা টেসিও হত পরবর্তী ডন, বর্তমান ডন অবসর নেয়ার সাথে সাথে সেই হত সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। নিদেনপক্ষে ওদেরকে যার যার আলাদা পরিবার গড়ে তোলার স্বাধীনতা দেয়া হত। সেটাই নিয়ম। উপযুক্ততা থাকা সত্ত্বেও কাউকে দাবিয়ে রাখার নীতি সাধারণত অবলম্বন ক্লরা হয় না।
পরিবেশটা ঠাণ্ডা মেরে যাবার আরেকটা কারণ হলো, ডন কর্লিয়নি শান্তি চুক্তি করার পর থেকে কর্লিয়নিদের শক্তি কমতে শুরু করেছে। আজ আর কেউ কর্লিয়নি। পরিবারকে সর্বশ্রেষ্ঠ, বা সবচেয়ে ক্ষমতাবান বলে দাবি করে না। নিউ ইয়র্কের সেরা। পরিবার, সবচেয়ে প্রতিপত্তিশালী বলতে এখন একমাত্র বার্জিনি পরিবারকেই বোঝায়, এ নিয়ে কোন তর্ক ওঠে না। টাটাগ্লিয়াদের সাথে জোট বেঁধে তারাই এখন কর্লিয়নি পরিবারের আসনটা দখল করে নিয়ে শ্রেষ্ঠ পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে! কর্লিয়নিদের ক্ষমতা এখানে সেখানে যাও বা এক-আধটু আছে, সেসব জায়গাতেও ছোঁ মেরে নিজেদের আধিপত্য কায়েম করে নিচ্ছে তারা। কর্লিয়নিদের জুয়ার ব্যবসার ওপর হানা দেয়া একটা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানেই একটু দুর্বলতা দেখছে, সেখানেই নিজেদের বুকমেকার ঢুকিয়ে দিচ্ছে তারা।
ডন অবসর নিতে যাচ্ছেন, খবরটা শুনে বার্জিনি আর টাটাগ্লিয়ারা তো আনন্দে। কাল বাজাচ্ছে। সবার ধারণা যত ক্ষুরধার বুদ্ধিমানই হোক মাইকেল কর্লিয়নি, বাপের মত দুর্জয় প্রভাবশালী হয়ে উঠতে এখনও এক যুগ সময় লাগবে ছোকরার। কর্লিয়নি পরিবারের অবস্থা যে পতনের দিকে, এব্যাপারে কারও মনে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।
এসব ছাড়াও বেশ কয়েকটা বড় বড় দুর্ভাগ্যের শিকার হতে হয়েছে কর্লিয়নি পরিবারকে। শেষ পর্যন্ত প্রমাণ হয়ে গেল ফ্রেডি কর্লিয়নি হাবাগোবা টাইপের হোটেলওয়ালা আর মেয়েদের স্ক্রীতদাস ছাড়া কিছু নয়। ইতালীয় ভাষায় একটা শব্দ আছে যেটার অনুবাদ সম্ভব নয়, তবে কথাটার কাছাকাছি মানে হলো, জুন চোষা পেটুক খোকা–এককথায় পৌরুষহীন।
অবশ্য সর্বনাশ যা হবার তা আগেই হয়ে গিয়েছিল। কর্লিয়নিদের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য সনির মৃত্যু। নিউ ইয়র্কের পাঁচ পরিবারের মধ্যে এমন কেউ ছিল না যে ভয় করত না সনিকে। ভয়ঙ্কর একটা প্রাকৃতিক শক্তি বলে মনে করত সবাই তাকে, তাচ্ছিল্য করার সাহস পেত না। তবে, এ-কথা ঠিক, ড্রাগস ব্যবসায়ী সলোযো আর পুলিশ ক্যাপটেন ম্যাকক্কাস্কিকে খতম করার জন্যে ছোট ভাই মাইকেলকে পাঠিয়ে বোকার মত একটা কাজ করেছিল সে। তখনকার পরিস্থিতিতে ওটা একটা প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত বলে মনে হলেও দূরদর্শী পরিকল্পনার দিক থেকে ওটা ছিল একটা গুরুতর ভুল। সনি এই ভূল না করলে রোগশয্যা থেকে উঠে আসতে হত না ডন কর্লিয়নিকে। তাছাড়া, দীর্ঘ দুবছরের অভিজ্ঞতা আর বাপের কাছ থেকে হাতে কলমে শিক্ষা পাওয়ার সুযোগ, এই দুটো জিনিস থেকে বঞ্চিত হতে হত না মাইকেলকে! শুধু সনি নয়, অনেক আগে এরচেয়েও অনেক বড় একটা ভুল করেছিলেন ডন নিজে। এটাই তার জীবনের একমাত্র ভুল। একজন আইরিশ লোককে কনসিলিয়রির পদে বসানো উচিত হয়নি তাঁর। ধৃর্তামি বা চাতুর্যের দিক থেকে কোন আইরিশের সাধ্য কি একজন সিসিলিয়র সমান হয়। অন্তত আর সব পরিবারগুলো তাই বিশ্বাস করত, ফলে কর্লিয়নিদের চেয়ে বার্জিনি-টাটাগ্লিয়াদেরকেই বেশি তোয়াজ করে আসছিল তারা। আর মাইকেল কর্লিয়নি সম্পর্কে ওদের ধারণা। হলো, প্রাণ চাঞ্চল্য আর শক্তির দিক থেকে সনির সাথে ওর তুলনাই হয় না। সনি ছিল ভয়ঙ্কর, তার ভয়াবহতা মাইকেলের মধ্যে কোনদিনই দেখা যাবে না। তবে, মাইকেলের বুদ্ধিসুদ্ধি বেশি, তাও বাপের সমান নয়। কর্লিয়নি পরিবারের উত্তরাধিকারী হিসেবে মাইকেল মোটামুটি মাঝারি মানের। ওকে তেমন ভয় না করলেও চলবে।
শক্তি তো কমেছেই, সেই সাথে আরও একটা কারণে কর্লিয়নিদের সম্মানও কমে গেছে বেশ খানিকটা। ডন শান্তি চুক্তি করায় সবাই তাকে দুর্বল ভাবল। তার কূটনীতিকে শ্রদ্ধা করলেও, ছেলের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিলেন না বলে এদের রাজ্যে কর্লিয়নিদের মর্যাদা একেবারে ধুলোয় লুটিয়ে পড়ল। সবাই বিশ্বাস করুল, ডনের এ ধরনের কূটনীতির মূল কারণ দুর্বলতা।
আজ যারা ডন কর্লিয়মির লাইব্রেরিতে জড়ো হয়েছে তারা সবাই এসব ব্যাপার বিশদভাবে জানে। শুধু তাই নয়, এদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো সে-সব বিশ্বাসও করে।
মাইকেলকে কার্লো যে অপছন্দ করে তা নয়, কিন্তু কেমন যেন ভয় করে। অবশ্য সনিকে যেমন ভয় করত, মাইকেলকে তার একশো ভাগের এক ভাগও ভয় করে না। এ-কথা ক্লেমেঞ্জার বেলাতেও খাটে। সলোযো আর পুলিশ ক্যাপটেন ম্যাকক্লাস্কিকে খুন করার সময় মাইকেল যে বাহাদুরি দেখিয়েছিল, ক্লেমেঞ্জা সেটার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেও, তার ধারণা ডন হবার জন্যে যে কঠোর মনোভাব দরকার, তা মাইকেলের নেই। ওর মনটা বড় নরম! অনেকদিন থেকেই আশা করে আছে ক্লেমেঞ্জা, অনাদা ভাবে নিজের পরিবার প্রতিষ্ঠা করার অধিকার দেয়া হবে। তাকে। কিছুদিন আগে তার সেই আশাটা আরও বেড়ে উঠেছিল। নিজের সামাজ্য কিভাবে গড়ে তুলবে সে-সম্পর্কে নানা পরিকল্পনা নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেছিল সে। কিন্তু কিভাবে যেন সেটা টের পেয়ে গেলেন ডন কর্লিয়নি, তাই আভাসে ইঙ্গিতে জানিয়ে দিলেন, তা হবার নয়। অপরদিকে, গড ফাদারকে এত বেশি শ্রদ্ধা ভক্তি করে ক্লেমেঞ্জা যে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করার কথা ভাবতে পর্যন্ত পারে না সে।
যদি না গোটা পরিস্থিতিটা একেবারে অসহ্য হয়ে ওঠে।
মাইকেল সম্পর্কে এদের সবার চেয়ে ভাল ধারণা পোষণ করে টেসিও। তুলনায় এদের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান সে, সেটাই এর কারণ। মাইকেলের ভেতর অদ্ভুত একটা শক্তির অস্তিত্ব অনুভব করে সে। মাইকেল সেটাকে অত্যন্ত কৌশলে গোপন করে রাখে, সাধারণ কাউকে জানতেই দেয় না সেই গোপন শক্তির অস্তিত্ব। এটা বাপের কাছ থেকে পেয়েছে ও। ডন কর্লিয়নির পুরানো শিক্ষা-বন্ধুরা যেন তোমাকে, তোমার গুণকে খাটো করে দেখে, আর শত্রুরা যেন তোমার দোষ-ত্রুটি বড় করে দেখে।
মাইকেল সম্পর্কে অবশ্য ডন কর্লিয়নির মনে কোন সংশয় নেই। তার সম্পর্কে টম হেগেনের মনেও নেই কোন বিভ্রান্তি; মাইকেল আবার কর্লিয়নি পরিবারকে তার পুরানো শ্রেষ্ঠ আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে, এই বিশ্বাস আছে বলেই অবসর নিয়েছেন ডন, তা না হলে কখনোই সরে দাঁড়াতেন না। আর ওর বুদ্ধি এবং মোগ্যতা সম্পর্কে সবচেয়ে ভাল খবর রাখে টম হেগেন। কেননা, সেই তো গত দুবছর ধরে মাইকেলকে প্রশিক্ষণ দেবার দায়িত্ব পালন করে আসছে। পারিবারিক ব্যবসার অত্যন্ত জটিল নীতিমালা আর হিসাবগুলো এক নজর দেখেই সব কিছু বুঝে নেয় মাইকেল, ব্যাপারটা লক্ষ করে বিস্মিত না হয়ে পারে না হেগেন। ছেলেটা ঠিক যেন একেবারে বাপের মতই হয়েছে।
মাইকেল সম্পর্কে ক্লেমেঞ্জা আর টেসিওর ধারণা আলাদা হলেও, ওরা দুজনেই এর ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে আছে। অসন্তুষ্ট হবার কারণও আছে ওদের। দুটো দলকেই ভেঙে একেবারে ছোট করে দিয়েছে মাইকেল, তাছাড়া, সনির দলটাকেও নতুন করে গড়েনি আর।
খুব কম লোক নিয়ে মাত্র দুটো দল রয়েছে এখন কর্লিয়নিদের। দল ছোটো করাটাকে আত্মহত্যার সামিল বলে যনে: রক্লেমেঞ্জা আর টেসিও। বিশেষ করে বর্তমান পরিস্থিতিতে তো এই পদক্ষেপ আত্মঘাতীক উম্মত্ত প্রয়াস ছাড়া আর কিছুই নয়, কেননা কর্লিয়নিদের সামাজ্যে বাৰ্জিনি-টাটাগ্লিয়ারা হরহামেশাই অনধিকার প্রবেশ করে যেখানে যা পাচ্ছে খাবলা মেরে নিয়ে যাচ্ছে। আজকের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে এই সব ভুল সংশোধন করা হবে বলে আশা করছে ওরা।
প্রথমে ভেগাস যাত্রার ফলাফল ব্যাখ্যা করল মাইকেল। শেয়ার বিক্রি করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে মো গ্রীন, এই কথার পিঠে একটা আশ্বাসবাণী জুড়ে দিল ও, তবে, এবার এমন একটা প্রস্তাব দেয়া হবে তাকে, প্রত্যাখ্যান করার কথা ভাবতেই পারবে না সে। একটু থেমে একে একে সবার দিকে একবার করে তাকাল ও, তারপর শুরু করল, কর্লিয়নি পরিবারকে পশ্চিমে তুলে নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত হয়েছে, একথা সবাই তোমরা জানো। ভেগাসের স্ট্রিপে চারটে হোটেল আর ক্যাসিনোর মালিকানা নিচ্ছি আমরা। তবে, এখুনি রাতারাতি সব কিছু নিয়ে উঠে যাচ্ছি না। সব কিছু গুছিয়ে নিতে বেশ একটু সময় লাগবে। ক্লেমোর দিকে সরাসরি তাকাল মাইকেল, বলল, পীট, তোমাকে আর টেসিওকে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি আমি, তোমরা শুধু একটা বছর কোন রম প্রশ্ন না তুলে, কোন আপত্তি না জানিয়ে আমার কথামত কাজ করো। বছরের শেষ দিকে কর্লিয়নি পরিবার থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে যার যার নিজের পরিবার প্রতিষ্ঠিত করবে তোমরা। সকৌতুক হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল মাইকেলের চেহারা। আশা করি এ-কথা না বললেও চলবে যে তোমরা আলাদা পরিবার গড়ে তুললেও আমাদের বন্ধুত্ব আর প্রাতির সম্পর্কটা চিরকালই বজায় থাকবে। সে যাক, আসল কথায় ফিরে আসি অনুরোধটা আবার তোমাদের করছি আমি। এই একটা বছর চোখ-কান বুজে আমার নির্দেশ মেনে চলো তোমরা। মনে কোরো না অন্য কিছু ভাবছি আমি। তা ভাবলে তোমাদেরকে, বাবার প্রতি তোমাদের আনুগত্যকে অপমান করা হয়, সেটা আমি জানি। কিন্তু এই একটা বছর অন্ধের মত অনুসরণ করো আমাকে, এই আমি চাই! জানি, অনেক ব্যাপারে দুশ্চিন্তা আছে তোমাদের। কিন্তু সম্পূর্ণ নিশ্চয়তা দিয়ে বলছি, এমন সব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, যার ফলে তোমরা যে-সমস্যাগুলোর সমাধান হচ্ছে না বলে মনে করছ সেগুলোরও সুষ্ঠু সমাধান হয়ে যাবে। একটু ধৈর্য ধরে থাকে, ব্যাস, তোমাদের কাছ থেকে আর কিছু চাই না আমি।
আমার একটা বক্তব্য আছে, মুখ খুলল টেসিও। মো গ্রীন তোমার বাবার সাথে দেখা করে কথা বলতে চাইছে, বেশ তো, বলুক না, তাতে অসুবিধেটা কোথায়? ডন কবে কাকে রাজি করাতে পারেননি, বলো? ওঁর যুক্তির সামনে কেউ কোনদিন দাঁড়াতে পেরেছে?
মাইকেল নয়, টেসিওর প্রশ্নের উত্তর দিলেন ডন নিজেই। বললেন, এসবের মধ্যে কিন্তু আমি নেই। তোমরা তো জানোই, আমি অবসর নিয়েছি। তারপরও যদি মাইকেলের ব্যাপারে নাক গলাই, ওকে অসম্মান করা হয়। তাছাড়া, বিশেষ করে ওই লোকটার সাথে কথা বলার কোন ইচ্ছে আমার নেই।
ফ্রেডির চড় খাওয়া সম্পর্কে একটা গুজব টেসিওর কানেও গেছে, সেটা এখন মনে পড়ে গেল তার। কেমন যেন সন্দেহ জাগল মনে। কথা আর না বাড়িয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল সে। ব্যাপারটা মোটামুটি আঁচ করতে পারছে, সম্ভবত এরই মধ্যে খরচের খাতায় নাম উঠে গেছে মো গ্রীনের। কর্নিয়নি পরিবার তাকে আর রাজি করাতে চায় না।
কার্লো মুখ খুলল এরপর, মাইকেলের কথা যেন ঠিক ধরতে পারেনি সে। কর্লিয়নি পরিবার তবে কি তাদের নিউ ইয়র্কের সমস্ত ব্যবসা উঠিয়ে দেবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে?
মাথা দুলিয়ে মাইকেল বলল, হ্যাঁ। জলপাই তেলের ব্যবসাটাও বিক্রি করে দিচ্ছি আমরা। সবটা নয়, কারণ যতটুকু পারা যায় ক্লেমেঞ্জা আর টেসিওকে দিয়ে দেয়া হচ্ছে। তবে…ভাল কথা, কার্লো, তুমি আবার তোমার চাকরির কথা ভেবে দুশ্চিন্তা কোরো না। তোমার জন্যে ভাল একটা ব্যনস্থার কথা ভেবে রেখেছি আমি। তুমি মানুষ হয়েছ নেভাডায়, ওখানকার লোকজন আর হালচাল সম্পর্কে তোমার মত অভিজ্ঞতা আর কারও নেই–সুতরাং তোমার যদি আপত্তি না থাকে, আমি আশা করে আছি আমরা এখানে শিকড় গেড়ে বসলে তুমিই হবে আমার ডান হাত।
চেয়ারে হেলান দিয়ে আরাম করে বসল কার্লো। আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে তার চেহারা। যাক, ভাবছে সে, এতদিনে তাহলে ভাগ্য খুলল। এই ধরনের কিছু একটার আশাতেই তো অপেক্ষা করে ছিল সে, সেই আশাতেই তো কর্লিয়নি পরিবারের নিরস মেয়েটাকে বিয়ে করেছে। এখন তার হাতে ক্ষমতা আসবে।
কনসিলিয়রির পদে টম হেগেন আর থাকছে না, বলে চলেছে মাইকেল। ভেগাসে ওকে আমি আমাদের উকিল হিসেবে চাই। দুমাসের মধ্যে সপরিবারে ওখানে চলে যাচ্ছে ও, ওখানেই পাকাপাকি ভাবে বসবাস করবে। শুধু আইন, তাছাড়া অন্য কোন বিষয়ে মাথা ঘামাবে না ও। আমার কথার অর্থ সবাই বুঝতে পারলে কি? তার মানে, এখন থেকে কেউ কোন কাজ নিয়ে ওর কাছে যাবে না বোমরা। টমের ব্যাপারে কোন ইঙ্গিত দেবার জন্যে কথাগুলো বলছি আমি তা ভেব না কেউ। প্রত্যেকের জন্যে আলাদা আলাদা ব্যবস্থা করেছি, শুধু সেগুলো জানিয়ে দিচ্ছি। টমকে এখানে আমার কোন দরকার নেই। আর যদি পরামর্শেরই দরকার হয়, বাবা তো রয়েছেই, তার চেয়ে ভাল পরামর্শ কে আর দিতে পারবে আমাকে?
হেসে ফেলল সবাই।
কিন্তু শেষ কথাটা ঠাট্টার সুরে বললেও, মাইকেলের মূল বক্তব্য বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না কারও, ক্ষমতাশূন্য হয়ে গেল টম হেগেন। এক কথায়, বাদ দেয়া হলো তাকে। প্রত্যেকে একবার চোরা চোখে ওর দিকে তাকাল।
ভাবের কোন চিহ্নমাত্র নেই টম হেগেনের চেহারায়।
সাঙ্ঘাতিক মোটা ক্লেমেঞ্জা নড়েচড়ে বসে ভারি গলায় জানতে চাইল, তার মানে, এক বছর পর আমরা যে যার নিজেরটা বুঝে নিয়ে সরে যাব, তুমি ঠিক এই কথাটাই বলতে চাইছ, নাকি?
সৌজন্য দেখাতে কার্পণ্য করল না মাইকেল। এক বছর নাও লাগতে পারে। তার আগেই সব ব্যবস্থা করে ফেলার সুযোগ পাবে তোমরা। তবে, আমাদের মধ্যে কেউ যদি চাও চিরকাল কর্লিয়নি পরিবারের সাথে থেকে যাবে, তাতেও কোন বাধা। নেই। কিন্তু আমাদের ক্ষমতার কেন্দ্র এবং উৎস হবে পশ্চিমে, সেখানে তোমরা হয়তো নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে পারবে না। আমার তো মনে হয় স্বাধীনভাবে। পরিবার গড়লেই ভাল করবে তোমরা।
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে আবার মুখ খুলল টেসিও। তাই যদি হয়, তাহলে দলে নতুন লোক ভর্তি করার অনুমতি দাও আমাকে। বেজন্মা শয়তান বার্জিনিয়া আমার এলাকায় ঢুকে রোজই থাবা মারছে। ভদ্রতা কাকে বলে তা একটু শিখিয়ে দেয়া দরকার ওদেরকে।
এদিক ওদিক মাথা নাড়ল মাইকেল। না, বলল ও। দল বড় করে লাভ নেই কোন। বাবা মারছে, মারুক, মারতে দাও-কোনরকম অস্বাভাবিক তৎপরতা দেখাতে যেয়ো না। ভেব না তোমাদেরকে অসহায় বা দুর্বল অবস্থায় এখানে ফেলে রেখে যাব আমরা। সবদিক বিবেচনা করে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, তোমাদের সমস্ত সমস্যা মিটিয়ে দেয়া হবে আমরা চলে যাবার আগেই।
কিন্তু টেসিওকে এত সহজে সন্তুষ্ট করতে পারল না মাইকেল। ওকে অসন্তুষ্ট করলে ঝুঁকি নেয়া হয়ে যায়, এ-কথা জানা সত্ত্বেও ঝুঁকিটা নিল টেসিও। মাইকেলের দিকে তাকালই না, সরাসরি ফিরল ডনের দিকে। বলল, গড ফাদার, অপরাধ হয়ে গেলে মাফ কোরো আমাকে। কিন্তু দীর্ঘ দিনের বন্ধুত্বের দায়িত্বের কথা মনে রেখে কথাটা আমাকে বলতেই হচ্ছে। আমি মনে করি, নেভাডায় চলে যাবার ব্যাপারে তুমি আর তোমার ছেলে ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছ। তোমাদের পেছনে যদি এখানের জোবাল শক্তি না থাকে সেখানে গিয়ে সাফল্যের আশা করো কি করে? শক্তি আর সাশ্য, একটাকে বাদ দিয়ে আরেকটাকে কল্পনা করা যায় না। তাছাড়া, তোমরা এখন না থাকলে বার্জিনি আর টাটাগ্লিয়া জোটের সাথে কোনমতেই এটে উঠব না আমরা। পীট আর আমি একেবারে পানিতে পড়ে যাব। এই আমি বলে রাখছি, দেখো, দুদিন আগে আর পরে, শেষ পর্যন্ত ওদের হাতের মুঠোয় গিয়ে পড়তে হবে আমাদের। ওদের বশ্যতা স্বীকার করাও যা, আত্মসমর্পণ করাও তাই, কিছুদিন পর আমাদের অস্তিত্বই থাকবে না। একটু দম নিল টেসিও। তারপর আবার বলল, বাৰ্জিীন লোকটাকে আমি সহ্যই করতে পারি না। কিন্তু সেটা প্রসঙ্গ নয়। আমি বলতে চাই, একান্তই যদি কর্লিয়নি পরিবারকে জায়গা বদল করতে হয়, সেটা যেন আমাদের জোর আছে বলেই করা হয়, দুর্বলতার জন্যে নয়। ঠিক এই মুহূর্তে আমাদের উচিত ক্লেমেঞ্জা আর আমার দল দুটোকে নতুন করে গড়ে তোলা, সৈনিকের সংখ্যা আরও বাড়ানো, তারপর অন্তত স্টেটেন আইল্যান্ডের হারানো জায়গাগুলোকে আবার কজা করা।
শান্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন ডন কর্লিয়নি। বললেন, আমি ওদের সাথে শান্তি চুক্তি করেছি, মনে নেই? একবার কথা দিয়েছি, সে কথা আমি আর ভাঙতে পারব না।
কিন্তু টেসিওকে কার সাধ্য থামায় আজ। শান্তি চুক্তি করেছ, কিন্তু তারপরও কি বার্জিনিয়া তোমাকে কম খুঁচিয়েছে? সবাই জানে, ওদের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে আছি আমরা। শান্তি চুক্তি লঙ্ঘন করার জন্যে এর চেয়ে বড় কারণের দরকার হয় না। তুমি কথার খেলাপ করতে চাও না, বেশ, নাই করলে–কিন্তু মাইকেল যদি পরিবারের নতুন নেতা হয়ে থাকে, ওদের বিরুদ্ধে সে কেন ব্যবস্থা নিতে পারবে না? মাইকেল যদি কোন পদক্ষেপ নেয়, তার দায়দায়িত্ব তো আর তোমাকে বইতে হবে না।
তীক্ষ্ণ গলা শোনা গেল মাইকেলের। চেহারাটা শান্ত দেখাচ্ছে ওর, কিন্তু আশ্চর্য একটা কর্তৃত্বের ভাব ফুটে উঠেছে চোখে-মুখে। নেতাসুলভ একটা কাঠিন্য লক্ষ করল সবাই ওর কণ্ঠস্বরে। একটু ধৈর্য ধরো, তোমার সব প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবে তুমি। একটু আগেই তো বললাম, সব দিক বিবেচনা করে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। দুশ্চিন্তা করার কোন কারণই নেই তোমার। আমার মুখের কথা যদি যথেষ্ট বলে মনে না হয়, তোমার ডনকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো।
এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে টেসিও, বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে সে। ডনকে এখন কিছু জিজ্ঞেস করতে যাওয়া মানে মাইকেলের শত্রুতা অর্জন করা। শ্রাগ করল সে, বলল, নিজের জন্যে নয়, কর্লিয়নি পরিবারের ভালর জন্যেই কথাটা বলছিলাম আমি। নিজের ব্যবস্থা করে নিতে কোন অসুবিধে হবে না আমার।
ডনকে প্রশ্ন না করে মাইকেলের সম্মান রক্ষা করেছে টেসিও, তাতে খুশি হয়ে আন্তরিকতার সাথে হাসল মাইকেল। তোমাকে আমি কোনদিন অবিশ্বাস করিনি, টেনিও। আজও করছি না। কিন্তু আমি চাই, তুমিও আমার ওপর বিশ্বাস রাখো। এ তো জানা কথা যে তোমার বা পীটের সমান কোনদিনই হতে পারব না আমি। দিন্তু অবসর নিলেও, হাজার হোক বাবা তো বেঁচে রয়েছেন, চাইলে সব রকম পরামর্শই তো তার কাছ থেকে নিতে পারব, ঠিক কিনা? তুমি যেরকম ভয় পাচ্ছ সেরকম দুরবস্থায় পড়ব না আমরা-পরিণাম সবার জন্যেই ভাল হবে, দেখো।
এর খানিক পরই শেষ হয়ে গেল বৈঠক। আজকের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হলো, দুই ক্যাপোরেজিমি যার যার আলাদা পরিবার প্রতিষ্ঠা করার অনুমতি পাবে। ঠিক হয়েছে, ব্রুকলিনের জুয়ার আড্ডাগুলো আর জাহাজঘাটা থাকবে টেসিওর দখলে, ক্লেমেঞ্জা পাবে লং আইল্যাণ্ডে ঘোড়দৌড় জুযায় কর্লিয়নি পরিবারের অংশ আর ম্যান হাটনের জুয়ার আড্ডাগুলো।
ক্যাপোরেজিমিরা বিদায় নিয়ে চলে গেল, কিন্তু দুজনের কেউই পুরোপুরি সন্তুষ্টি বোধ করছে না। মাইকেলের কথা কতটুকু বিশ্বাস করা যায় সে-ব্যাপারে সংশয় রয়েছে ওদের মনে।
ক্যাপোরেজিমিরা চলে যাবার পরও লাইব্রেরি রুমে থেকে গেল কার্লো। তার ধারণা, এতদিনে তাকেও পরিবারের একজন বলে মনে করার সময় হয়েছে। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরেই টের পেল সে মাইকেল এখনও ঠিক তা মনে করছে না। ডন, হেগেন এবং মাইকেলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ক্ষুণ্ণ মনে সেখান থেকে বেরিয়ে। এল সে। তাকে দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিল অ্যালবার্ট নেরি। আলোকিত উঠান পেরোবার সময় হঠাৎ একবার পিছন ফিরে তাকাল কার্লো, দেখল, এখনও তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নেরি।
এতক্ষণে পরিবেশটা ঘরোয়া হয়ে এল। দীর্ঘদিন একই পরিবারে আছে এরা, হৃদয়ের টান আছে পরস্পরের প্রতি, এক সাথে হলে অদ্ভুত একটা স্বস্তিবোধ করে। তিনজনই। ডনকে অ্যানিসেট ঢেলে দিল মাইকেল, হেগেনের হাতে ধরিয়ে দিল হুইস্কি ভর্তি গ্লাস। আজকাল এমনিতে মদ-টদ খায় না বললেই চলে, তবু নিজেও আজ একটু হুইস্কি নিল মাইকেল।
এবার বলো, মাইকেল। প্রথম মুখ খুলেই সরাসরি জানতে চাইল টম হেগেন, সব কাজ থেকে আমাকে কি মনে করে বাদ দিচ্ছ তুমি?
মুহূর্তের জন্যে চমকে উঠল মাইকেল কর্লিয়নি। কিন্তু দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল; ভেগাসে তুমিই তো হবে আমার ডান হাত। সিদ্ধান্ত হয়েছে, ওখানে আমরা প্রতিটি বিষয়ে অত্যন্ত কড়াকড়িভাবে আইন মেনে চলব, তাই ঘাগু একজন আইন-উপদেষ্টা দরকার হবে আমার। এই পদের জন্যে যাকে-তাকে নির্বাচন করা চলে না, কারণ তাকে বিশ্বস্তও হতে হবে। আমার জানামতে দুটো ব্যাপারেই তুমি সবার সেরা। তাই ওই পদে তোমাকে নির্বাচন করেছি। এর চেয়ে সম্মানজনক আর গুরুত্বপূর্ণ পদ আর কি হতে পারে?
ম্লান একটু হাসি ফুটল হেগেনের মুখে। তুমি আমার কথা ধরতে পারোনি, বলল সে। আমি রকো ল্যাম্পনির কথা বলছি। আমাকে না জানিয়ে গোপন একটা দল গড়ছে সে। আমি আলবার্ট নেরির কথা বলছি। ক্যাপোরেজিমিদের বা আমার মাধ্যমে নয়, তুমি নেরির সাথেও সরাসরি কাজকারবার করছ। রকো কি করছে তা তুমি জানো না, এ আমি বিশ্বাস করি না।
রকো ল্যাম্পনি দল গড়ছে তা তুমি জানলে কিভাবে? নিচু গলায় জানতে চাইল মাইকেল।
শ্রাগ করল হেগেন। চিন্তিত হবার কিছু নেই, ব্যাপারটা ফাস হয়ে যায়নি, আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। আমি কিভাবে জানলাম? একটু হাসল হেগেন। এমন একটা পদে বসে আছি আমি, যেখানে বসে থাকলে না চাইলেও সমস্ত খবর চলে আসে আমার কাছে। জীবিকার আলাদা ব্যবস্থা করে দিয়েছ তুমি রকোকে, স্বাধীনতাও দিয়েছ বেশ অনেকটা! ফলে খুদে একটা সামাজ্য পেয়ে গেছে হাতে। সায়াজ্যটা পরিচালনার জন্যে লোক দরকার হচ্ছে তার। কিন্তু যে-লোককেই চাকরি দিচ্ছে সে, প্রত্যেকের বিশদ পরিচয় এসে পৌচাচ্ছে আমার হাতে। যে-লোক যে পদের জন্যে উপযুক্ত, রকে। তাকে তার চেয়ে ভাল পদে বসাচ্ছে, বেতন আর অন্যান্য সুবিধেও দিচ্ছে অস্বাভাবিক বেশি রকম। অবশ্য, নেরির ব্যাপারটা অন্যরকম। ওকে বেছে নিয়ে অত্যন্ত বুদ্ধিমানের কাজ করেছ তুমি। ওর কাজে কোন। খুত নেই। এক কথায় চমৎকার।
মন খারাপ করে মাইকেল বলল, তোমার চোখে ধরা পড়ে গেছে, তার মানে নিশ্চয়ই কাজে খুঁত আছে ওর। না, আমি ওকে বেছে নেইনি, কৃতিত্বটা বাবার।
বেশ, বলল হেগেন। কিন্তু আমাকে কেন বাদ দেয়া হচ্ছে?
ধীরে ধীরে হেগেনের দিকে তাকাল মাইকেল। কোনরকম কুণ্ঠা দেখা গেল না। এর মধ্যে, শান্ত ভাবে কিন্তু সরাসরি স্পষ্ট গলায় বলল, যুদ্ধকালীন উপদেষ্টা হবার যোগ্য তুমি নও, টম। যে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছি আমরা, পরিস্থিতি তাতে সঙ্গীন হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। আমাদেরকে হয়তো শেষ পর্যন্ত লড়তে হতে পারে। তা যদি হয়, তোমার মন্ত্রণা কাজে লাগবে না আমাদের। তাছাড়া, কে জানে কি হয়, তোমাকে বিপদের সামনে থেকে সরিয়ে দিতে চাই আমরা।
লাল হয়ে উঠেছে হেগেনের মুখ কথাগুলো যদি ডন বলতেন শ্রদ্ধার সাথে মেনে নিত সে। কিন্তু এইরকম একটা চরম সিদ্ধান্ত মাইকেল কিভাবে নেয়?
বেশ, একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে বলল হেগেন। কিন্তু একদিক থেকে টেসিওর সাথে আমিও একমত। আনারও ধারণা, ভুল নিয়মে কাজ করছ তুমি। শক্তি আছে বলে নয়, করছ দূর্বল বলে। এর পরিণাম কখনও ভাল হয় না। বার্লিনিকে চিনতে ভুল কোরো না। সে একটা হিংস্র নেকড়ে বাঘ, তোমাদেরকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করার জন্যে যখন ঝাঁপিয়ে পড়বে, অন্য পরিবারগুলো থেকে কেউ তোমাদেরকে সাহায্য করার জন্যে একটা আঙুল তুলবে না।
এতক্ষণে মুখ খুললেন ডন। তোমাকে জানানো দরকার, টম, সিদ্ধান্তটা মাইকেলের একার নয়। পরামর্শটা আমিই ওকে দিয়েছি। এমন কিছু কাজ করার দরকার হতে পারে, যার দায়-দায়িত্ব নিতে রাজি নই আমি। তোমার কথা যদি ওঠে, তোমাকে আমি কখনোই অযোগ্য কনসিলিয়রি বলে মনে করিনি। সান্তিনোর আত্মা শান্তি পাক, তাকে আমি অযোগ্য ডন বলে মনে করতাম। মনটা ভাল ছিল, কিন্তু আমি শয্যাশায়ী হবার পর পরিবারের নেতা হবার যোগ্যতা তার ছিল না। তারপর, কে জানত ফ্রিডোর মগজের সাথে মেয়েদের আঙুলে সুতো বাধা থাকবে? দেখো, টম, মন খারাপ কোরো না। মাইকেলের ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রাখি আমি, তোমার ওপরও রাখি। কিন্তু তোমার অজ্ঞাত কয়েকটা কারণে কিছু ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা। রয়েছে, সে-সবের মধ্যে তোমার জড়িয়ে পড়া উচিত হবে না বলে মনে করেছি। আমরা। ভাল কথা, মাইকেলকে আমি আগেই বলেছিলাম, ল্যাম্পনি দল গড়ছে, এটা তোমার কাছে লুকিয়ে রাখা যাবে না। তোমার ওপর আমার কতটা আস্থা, বুঝতে পারছ তো?
বিশ্বাস করো, হেসে ফেলে বলল মাইকেল, আমি কল্পনাও করিনি যে তোমার চোখে সব ধরা পড়ে যাবে।
সান্তনা দেয়া হচ্ছে তাকে, বুঝতে পেরে একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল হেগেন। মাইকেলের দিকে তাকাল সে। বল, ভেবে দেখো, আমি হয়তো কোন সাহায্যে আসতে পারি।
দৃঢ় ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল মাইকেল। না, টম, বলল ও, তোমাকে বাদ দেয়া হয়েছে।
নিঃশব্দে হুইস্কিটুকু শেষ করল হেগেন। তারপর বিদায় নেবার জন্যে উঠে দাঁড়াল। যাবার আগে নরম গলায়, কিন্তু ক্ষীণ বিপের সুরে বলল, তুমি প্রায় তোমার বাবার মতই কৌশলী হয়ে উঠেছ, মাইকেল। কিন্তু একটা বিষয় শিখতে এখনও বাকি আছে তোমার।
কি সেটা? ভদ্রতার খাতিরে জানতে চাইল মাইকেল।
কিভাবে না বলতে হয়।
গম্ভীর হয়ে উঠল মাইকেল। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ঠিকই ধরেছ। কথাটা মনে রাখব আমি।
চলে গেল হেগেন। রসিকতার ছলে বাবাকে প্রশ্ন করল মাইকেল, সবই তাহলে আমাকে শিখিয়েছ তুমি, শুধু একটা ছাড়া? এবার শেখাও, কিভাবে না বললে খুশি হয় মানুষ?
ডন উঠে গিয়ে তার মস্ত ডেস্কের পিছনে, রিভলভিং চেয়ারটায় আরাম করে বসলেন। গোপন মন্ত্রটা হলো, যাদেরকে তুমি ভালবাস, তাদেরকে না বলা যায় না, অন্তত বারবার নয়। তবু যদি উপায় না থাকে, না বলতেই হয়, সেক্ষেত্রে নিয়ম হলো, কথাটা এমন ভাবে বলবে তুমি তে যেন সেটা হা এর মত লাগে। অথবা তাকে দিয়ে না-টি বলিয়ে নিতে হয়। কাজটা অপ্রীতিকর, তাই একটু সময় নিতে হয়, বেশ একটু কষ্ট স্বীকার করতে হয়। কিন্তু আমি সেকেলে মানুষ, তোমরা নতুন যুগের নতুন মানুষ, আমার কথায় কান দিয়ো না।
হাসল মাইকেল। বলল, ঠিক। কিন্তু টমকে বাদ দেয়ার ব্যাপারে তুমি আমাকে সমর্থন করছ তো?
ওকে কোনভাবেই এর মধো জড়ানো চলে না, মাথা নেড়ে বললেন ডন।
এবার তোমাকে একটা কথা বলতে চাই আমি, মৃদু কণ্ঠে বলল মাইকেল। কথাটা জানাবার সময় হয়েছে তোমাকে। যা করতে যাচ্ছি, তা বধু অ্যাপলোনিয়া আর সনির বদলা নেবার জন্যে নয়। কাজটা করাই উচিত। বার্জিনিদের সম্পর্কে টেসিওর কথাটাই ঠিক।
উপর নিচে মাথা দোলালেন ডন। ঠাণ্ডা হলে প্রতিশোধ জিনিসটা মিঠে হয়। শান্তি না করলে তুমি জীবিত অবস্থায় বাড়ি ফিরে আসতে পারবে না, এটা আমি জানতাম। সেজন্যেই তো শান্তি চুক্তি করতে হলো। কিন্তু তারপরও বাৰ্জিনিরা চেষ্টা করুল দেখে সত্যি অবাক হয়ে গেছি আমি। সম্ভবত শান্তি চুক্তির আগেই তোমাকে সরাবার একটা ব্যবস্থা করা হয়ে গিয়েছিল, পরে সেটাকে আর সময় পায়নি রদ করার। তোমাকেই ওরা মারতে চেয়েছিল, ডন টমাসিনোকে নয়–ঠিক জানো তো?
ভাবটা ওই কমই দেখাতে চেয়েছিল। যেন ডন টমাসিনোকেই মারতে চেয়েছে ওরা, বলল মাইকেল। মোট কথা ওদের তরফ থেকে কোন খুঁত ছিল না কাজে। আমি মারা গেলে তুমি পর্যন্ত টের পেতে না বা সন্দেহ করতে না। কিন্তু আমি বেঁচে যাওয়ায় সব ভেস্তে গেল ওদের। আমি নিজের চোখে পালিয়ে যেতে দেখেছি ফ্যাৱিষযিয়োকে।
রাখালটার খবর পেয়েছে ওরা? জানতে চাইলেন ডন।
আমি পেয়েছি, বলল মাইকেল। বছরখানেক আগে। নতুন নাম নিয়েছে, জাল পাসপোর্ট, ভুয়া পরিচয়। চুটিয়ে ব্যবসা করছে ফ্যাব্রিযযিয়ো।
নিঃশব্দে উপরে-নিচে মাথা দোলালেন ডন। খানিক পর বললেন, তাহলে আর অপেক্ষা করার দরকার নেই। কবে রওনা হবে তুমি?
তোমাদের বউমার ডেলিভারি না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাই, বলল মাইকেল। কিন্তু তার আগেই টমকে আমি ভেগাসে গুছিয়ে বসা অবস্থায় দেখতে চাই। গোলমাল যদি কিছু ঘটেই, তার সাথে যেন ওর কোন সম্পর্ক না থাকে। এখন থেকে এক বছর পর, ধরো।
ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নিলেন ডন কর্লিয়নি। সাদা দেয়ালের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে মৃদু গলায় জানতে চাইলেন, কিভাবে কি করবে সব ঠিক করেছ?
কিন্তু এর মধ্যে তুমি থাকবে না, নরম সুরে বলল মাইকেল। যা ঘটবে তাতে তোমার কোন দায়-দায়িত্ব থাকবে না। সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিচ্ছি আমি। এমন কি ভেটো দেবারও অধিকার পাচ্ছ না তুমি। অন্তত এই ব্যাপারে তা যদি করতে চাও, পরিবার ছেড়ে বেরিয়ে চলে যাব আমি। এর মধ্যে তোমার কোন ভূমিকা থাকবে না।
অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলেন ডন কর্লিয়নি। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, বেশ, তবে তাই হোক। বোধহয় সেজন্যেই অবসর নিয়েছি আমি, সে জন্যেই স্ব দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছি তোমার হাতে। একটা জীবনে যা যা করণীয় ছিল আমার, তার সবগুলো করেছি। অতিরিক্ত আরও কিছু দায়িত্ব এখনও হয়তো কাঁধে নিতে পারি, কিন্তু এখন আর সে মন নেই। তাছাড়া, মুহূর্তের জন্যে অন্যমনস্ক হয়ে উঠে আবার প্রসঙ্গে ফিরে এলেন তিনি, এমন কিছু কর্তব্যও থাকে যেগুলোর ভার মানব-শ্রেষ্ঠও নিতে পারে না! বেশ। তবে তাই হোক।
.
বছর শেষ হবার আগেই কে অ্যাডামস্ কর্লিয়নি তার দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম দিল। এটাও পুত্রসন্তান। খুব সহজেই প্রসব করে কে, গোলমাল হয় না। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরলে রাজেন্দ্রাণীর মত অভ্যর্থনা করা হলো তাকে।
খোকার পরার জন্যে সুন্দর এক সেট কাপড় দিয়েছে কনি কর্লিয়নি। কাপড়গুলো রেশমের, সেলাই করা হয়েছে ইটালিতে। খুবই দামী জিনিস কনি তার ভাইবউকে জানাল, অনেক খুঁজেপেতে বের করেছে ওগুলো কার্লো।তোমার ছেলের জন্যে অসাধারণ একটা উপহার চাই, তাই সমস্ত নিউ ইয়র্ক টুডে এটা আবিষ্কার করেছে ও! আমার চোখে তো ভাল জিনিস পড়লই না।
মৃদু হেসে ধন্যবাদ জানাল কে। তখুনি মনে মনে ঠিক করে ফেলল এত বড় একটা আনন্দের কথা অবশ্যই জানাতে হবে মাইকেলকে। কর্লিয়নি পরিবারে এসে সে-ও পুরোপুরি সিসিলিয়ান বনে গেছে।
ওই বছরই মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ফলে মারা গেল নিনো ভ্যালেন্টি। নিনোকে নায়ক করে যে ছবিটা তৈরি করেছে জনি ফন্টেন সেটা মুক্তি পাবার পরপরই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল, ট্যাবলয়েড পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় বড় বড় হরফে ছাপা হলো ওর মৃত্যু সংবাদ। সদ্য মুক্তি পাওয়া ছবিটা রাতারাতি অসামান্য জনপ্রিয়তা লাভ করল। সমালোচকরা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করল, নিনোর অভিনয় প্রতিভার তুলনা হয় না। খবরের কাগজগুলো লিখল, বন্ধুর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সমস্ত দায়িত্ব জনি ফন্টেন নিয়েছে। সমাধিস্থ করার দিন পরিবারের লোকজন আর নিনো ভ্যালেন্টির ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা ছাড়া আর কেউ উপস্থিত থাকবে না। এক সাংবাদিক তো বেপরোয়া সাহস দেখিয়ে এতদূর পর্যন্ত দাবি করল যে জনি ফন্টেন নাকি এক সাক্ষাৎকারে তার কাছে স্বীকার করেছে, বন্ধুর মৃত্যুর জন্যে সেই দায়ী। তার উচিত ছিল বন্ধুকে ডাক্তারের হাতে তুলে দেয়া। কিন্তু সাক্ষাৎকারটা এমন চতুর ভাষায় লেখা হয়েছে, জনির কথাগুলো কোন মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় স্পর্শকাতর নিরীহ দর্শকের আত্মগ্লানির মত শোনাচ্ছিল। নিনো ছিল তার বাল্যবন্ধ, সেই বাল্যবন্ধুকে সে শ্রেষ্ঠ তারকা পর্যন্ত বানিয়ে দিয়েছিল–সবই স্বীকার করল, একজন বন্ধুর জন্যে এর বেশি আর কি করা যায়।
ক্যালিফোর্নিয়ায় সমাধিস্থ করা হলো নিনোকে। কর্লিয়নি পরিবারের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত হলো শুধু ফ্রেডি। আর এল লুসি মানচিনি, ডুলস সীগল। ডন কর্লিয়নি নিজে আসতে চেয়েছিলেন, কিন্তু হঠাৎ করে হার্টের অসুখটা বেড়ে গেল, ডাক্তাররা এক মাস বিছানা থেকে নামতে বারণ করায় তার আর আসা হয়নি। প্রকাণ্ড একটা ফুলের রীদ পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি। নেরিও এল পশ্চিমে, সম্ভবত পারিবারিক ব্যবসার নতুন পরিচালক মাইকেল কর্লিয়নির প্রতিনিধি হিসেবে।
সমাধিস্থ করা হয়ে গেল নিনোকে। এর দুদিন পরের ঘটনা। চিত্রতারকা। প্রণয়নীর বাড়ি থেকে বেরুচ্ছে মো গ্রীন, এই সময় কে যেন তাকে গুলি করে মেরে ফেলল। এর প্রায় এক মাস পর আবার নিউ ইয়র্কে দেখা গেল অ্যালবার্ট নেরিকে। ক্যারিবিয়ান সাগরের বেলাভূমিতে দীর্ঘ ছুটি কাটিয়ে এসেছে সে, শরীরটাকে রোদে পুড়িয়ে একেবারে কার্লো করে এনেছে।
মাইকেল কর্লিয়নি তাকে অভ্যর্থনা করল হাসিমুখে। দুএকটা প্রশংসার কথা বলে তাকে জানাল, এখন থেকে নেরি বাড়তি কিছু ভাতা পাবে! ইস্ট সাইডের একটা বুক মেকারের ঘাটির সবটুকু আয়। সবাই জানে, তাও চাট্টিখানি কথা নয়।
অ্যালবার্ট নেরি মহাখুশি। এই রকম একটা জগৎই দরকার তার, যেখানে কর্তব্যপালনের পরিবর্তে মুনাফা পাওয়া যায়। কর্লিয়নি পরিবারের সাথে বসবাস করতে পেরে সন্তুষ্ট সে।
সম্ভাব্য সব ঘটনার জন্য সতর্কতা অবলম্বন করেছে মাইকেল কর্লিয়নি। সবচেয়ে আগে নিশ্চিত, নিচ্ছিদ্র করেছে নিজের নিরাপত্তা। ওর পরিকল্পনাতেও কোন খুঁত নেই কোথাও; ধৈর্য ধরে বসে আছে ও, মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বছরের পুরোটা সময় প্রস্তুতি নেবে। কিন্তু পুরো একটা বছর কপালে জুটল না ওর। অপ্রত্যাশিতভাবে ভাগ্যই বাধা দিল ওকে। গড ফাদার নিজে, মহান ডন স্বয়ং, পরিকল্পনা রদবদল করতে বাধ্য করলেন মাইকেলকে। ছেলে শর্ত দিয়েছিল, তার পরিকল্পনায় নাক গলাতে পারবেন না তিনি। কিন্তু আশ্চর্য এক চাল চেলে ছেলের পরিকল্পনায় নিজের খানিকটা অবদান রাখলেনই ডন।