অষ্টম পরিচ্ছেদ
১.
যেদিন মেরিয়াস তার দাদুর সঙ্গে দেখা করতে যায় সেইদিন বিকাল চারটের সময় জাঁ ভলজাঁ শ্যাম্প দ্য মার্সের ছায়াচ্ছন্ন ঢালু জায়গাটায় একা একা বসেছিল। সতর্কতার জন্যই হোক অথবা নির্জনতার প্রতি তার স্বাভাবিক প্রবণতার জন্যই হোক অথবা অভ্যাস পরিবর্তনের এক অবচেতন ইচ্ছার বশেই হোক আজকাল সে কসেত্তেকে নিয়ে বাইরে বেড়াতে যেত না। সেদিন তার পরনে ছিল শ্রমিকের মতো একটা আলখাল্লা, ধূসর রঙের একটা পায়জামা আর টুপি। আগেকার উদ্বেগ সব কেটে যাওয়ায় আজকাল কসেত্তে’র সঙ্গে তার সম্পর্কটা ভালোই চলছিল।
একদিন সে যখন বুলভার্দ দিয়ে হেঁটে কোথায় যাচ্ছিল তখন থেনার্দিয়েরকে সে দেখতে পায়। কিন্তু তার পোশাকটা অন্য ছিল বলে তাকে চিনতে পারেনি থেনার্দিয়ের। এরপর সে আরও কয়েকবার দেখতে পায় থেনার্দিয়েরকে। সে বুঝতে পারে আজকাল ওই অঞ্চলে ঘোরাফেরা করছে থেনার্দিয়ের। থেনার্দিয়েরই তখন তার পক্ষে যত সব বিপদ আর ভয়ের একমাত্র কারণ এই ভেবে সে এক বড় রকমের সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে।
তাছাড়া প্যারিস শহরের রাজনৈতিক অবস্থা অশান্ত হয়ে পড়ায় পুলিশ আন্দোলনকারীদের ধরপাকড় করার জন্য সজাগ ও সতর্ক হয়ে ওঠে এবং তার ফলে ভলজাঁ’র ওপর তাদের নজর পড়তে পারে।
এইসব চিন্তা যখন তাকে ভাবিয়ে তুলেছিল তখন একদিন সকালবেলায় একটি ঘটনা তার মানসিক অস্বস্তি বাড়িয়ে তোলে। একদিন সকালবেলায় সে হঠাৎ বাগানে গিয়ে পাঁচিলের গাঁয়ে ছুরি দিয়ে খোদাই করা একটা ঠিকানা দেখতে পায় ১৬, র্যু দ্য লা ভেরিয়ের। এর দ্বারা সে একটা জিনিস বুঝতে পারল, বাগানের বাইরের কোনও লোক নিশ্চয় ঢুকেছিল। এ বিষয় নিয়ে অনেক ভাবনা-চিন্তা করলেও কসেত্তেকে বলল না কোনও কথা। কারণ তাতে সে ভয় পেতে পারে।
অনেক ভাবনা-চিন্তা করার পর সে ঠিক করে প্যারিস এবং ফ্রান্স ছেড়ে সে ইংল্যান্ড চলে যাবে। সে কসেত্তেকে বলে দেয় এক সপ্তার মধ্যে সব যেন গুছিয়ে নেয়। আজ সে শ্যাম্প দ্য মার্সের নির্জন ঘাসের উপর একা বসে থেনার্দিয়ের, পুলিশ, বাগানের পাঁচিলে দেখা ঠিকানা, পাসপোর্ট বার করার সমস্যা প্রভৃতির কথা ভাবছিল।
সে যখন একমনে এই সব কথা ভাবছিল তখন তার পেছনে একটা লোকের ছায়া দেখতে পেল। সে মুখ ঘুরিয়ে দেখতে যেতেই তার হাঁটুর উপর একটা ভাজ করা কাগজ পড়ে যায়। সে উঠে পড়ে কাগজটা খুলে দেখে, চলে যাও এখান থেকে’,–এই কথাটা লেখা আছে।
চারদিক তাকিয়ে সে কোনও লোককে দেখতে পেল না। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে আবার চারদিকে তাকিয়ে সে দেখল তার মতো শ্রমিকের পোশাক পরা একটা লোক খালের ধারে ঘোরাঘুরি করছে।
ভলজাঁ চিন্তান্বিত অবস্থায় তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে গেল।
.
২.
বিষণ্ণ মনে তার মাতামহের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল মেরিয়াস। সে অনেক আশা নিয়ে গিয়েছিল সেখানে, কিন্তু ফিরে এল এক নিবিড় হতাশা নিয়ে। থিওদুলের কথাটা কোনও ছাপ ফেলতে পারল না তার মনের ওপর। কোনও সন্দেহ জাগল না কারও ওপর। যৌবনবয়সে কোনও সন্দেহ দানা বাঁধতে পারে না মানুষের মনে। সন্দেহ খানিকটা বৃদ্ধ বয়সের ব্যাপার। ওথেলো’র মনে যে সন্দেহ জাগে সে সন্দেহ ক্যান্ডিভার মনকে স্পর্শ করত পারেনি।
নিজের অন্তরের ক্ষতটার মধ্যে মনটাকে গুটিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে পথ হেঁটে চলেছিল সে।
বেলা দুটোর সময় সে কুরফেরাকের বাসায় গিয়ে পোশাক পরেই তার বিছানার উপর শুয়ে পড়ল। তার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মন নিয়ে অস্বস্তিকর এক ঘুমের মধ্যে ঢলে পড়ল সে। ঘুম ভাঙলে দেখল ঘরের মধ্যে কুরফেরাক, এঁজোলরাস, ফুলি আর কমবেফারে উত্তেজিতভাবে কথাবার্তা বলছে।
কুরফেরাক মেরিয়াসকে বলল, জেনারেল ল্যামার্কের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগদান করতে যাবে না?
কথাটার মানে সে বুঝতে পারল না।
কুরফেরারা ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার কিছুক্ষণ পরে মেরিয়াস একা বেরিয়ে গেল। বেরোবার সময় তার পকেটের মধ্যে জেভার্তের দেওয়া সেই গুলিভরা পিস্তলটা নিল। সেটা সে কেন নিল, তা বোঝা গেল না।
সারাদিন উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াল মেরিয়াস। দু এক পশলা বৃষ্টি হল পথে। কিন্তু সেদিকে কোনও খেয়াল ছিল না তার। সে সেন নদীতে কখন একবার স্নান করল, তা ও বুঝতে পারল না। তার মাথার মধ্যে আগুন জ্বলছিল। সে আগুন তার সব চেতনা ও বুদ্ধিকে যেন গ্রাস করে। তার মনে তখন কোনও আশা বা ভয় ছিল না। তার মনে। তখন একটা চিন্তাই স্পষ্ট হয়ে বিরাজ করছিল, আজ সন্ধ্যা ছ টার সময় সে কসেত্তে’র কাছে যাবে। এই একটি ঘটনার মধ্যেই তার মনের সব চেতনা যেন নিহিত ছিল, তার পর সব কিছুই অন্ধকার। বুলভার্দ দিয়ে যাবার সময় মাঝেমধ্যে তার মনে হচ্ছিল শহরে কোথায় গোলমাল হচ্ছে। আশ্চর্য হয়ে সে ভাবতে লাগল, তবে কি লড়াই চলছে নাকি?
রাত্রি ন টা বাজতেই র্যু প্লমেতের বাড়ির বাগানের গেটের সামনে এসে হাজির হল সে। দীর্ঘ আটচল্লিশ ঘণ্টা পরে সে কসেত্তে’র সঙ্গে দেখা করতে চলেছে। আবার সে কসেত্তেকে দেখতে পাবে।
গেটটা পার হয়ে সে বাগানের মধ্যে ঢুকে পড়ল। কিন্তু দেখল কসেত্তে যেখানে বসত সেখানে সে নেই। মেরিয়াস বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল জানালাগুলো বন্ধ। কোথাও কোনও আলো নেই। গোটা বাড়িটা পরিত্যক্ত বলে মনে হচ্ছে। একই সঙ্গে ভয় ও দুঃখে পাগলের মতো হয়ে গেল মেরিয়াস। সে পাগলের মতো একটা ঘরের বন্ধ জানালার উপর ঘা দিয়ে কসেত্তে’র নাম ধরে ডাকতে লাগল। বলতে লাগল, কসেত্তে, কোথায় তুমি?’ কিন্তু কোথাও কারও কোনও সাড়া-শব্দ পেল না। সমস্ত বাড়িটাকে স্তব্ধ অন্ধকার এক সমাধি-স্তম্ভের মতো মনে হচ্ছিল মেরিয়াসের।
অবশেষে সে বাগানে ফিরে এসে পাথরের যে বেঞ্চটার উপর কসেত্তের পাশে বসে কতদিন কত সময় কাটিয়েছে, সেই বেঞ্চটার দিকে একবার তাকাল। যে প্রেম একদিন তাকে কত আনন্দ, কত তৃপ্তি দান করেছে, এই হতাশার মাঝেও সে প্রেমের জন্য নিজেকে ধন্য মনে করতে লাগল সে। কসেত্তে চলে গেছে। জীবনে কোনও অবলম্বন রইল না তার। মৃত্যু ছাড়া আর তার কোনও গতি নেই।
সহসা রাস্তা থেকে তার নাম ধরে কে ডাকল, মঁসিয়ে মেরিয়াস!
মেরিয়াস মুখ তুলে তাকাল। বলল, কে ডাকে?
আপনিই কি মঁসিয়ে মেরিয়াস?
হ্যাঁ।
মঁসিয়ে মেরিয়াস, আপনার বন্ধুরা র্যু দ্য লা শাঁব্রেরিতে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।
কণ্ঠস্বরটা এপোনিনের বলে মনে হল মেরিয়াসের। সে ছুটে গিয়ে গেট থেকে বেরিয়ে গেল। গেট থেকে বেরোবার সময় তার মনে হল একজন অচেনা যুবক ছুটে পালিয়ে গিয়ে অন্ধকারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
.
৩.
গাভ্রোশের দেওয়া জাঁ ভলজাঁ’র টাকার থলেটা কোনও কাজে লাগেনি মঁসিয়ে মেরুফের। প্রথমে সে থলেটা স্বর্গ থেকে পড়েছে বলে বিশ্বাস করলেও এ বিশ্বাস টেকেনি। সে বিশ্বাস করতে পারেনি আকাশের নক্ষত্ররা স্বর্ণমুদ্রা লুইয়ে পরিণত করেছে। টাকার থলেটা তাই সে সোজা থানায় নিয়ে গিয়ে জমা দেয়। সে থলের কোনও দাবিদার না পাওয়া গেলেও সে মেবুফে’র কোনও কাজে লাগেনি।
মেবুফে’র আর্থিক অবস্থার নিম্নগতি অব্যাহত ছিল। নীলচাষে কোনও লাভ হয়নি। কোনও দিকেই আর্থিক অবস্থার কোনও উন্নতি হল না তার। মেরে প্লুতার্কের মাইনের সঙ্গে সঙ্গে বাড়িভাড়াও প্রচুর বাকি পড়ে গেছে। এ অবস্থায় পড়ে সে তার ফুলের প্লেট, অনেক লেখা ও ছবি একে একে বিক্রি করে দিল। এরপর বাগানে বা জমিতে কাজ করা ছেড়ে দিল মেবুফ। পর পর সব কাজে লোকসান হওয়ায় কাজে উৎসাহ কমে যায়। তার জমি পতিত পড়ে থাকে। এখন ডিম-মাংস বাদ দিয়েছে। এখন রুটি আর আলুই তাদের খাদ্য। বাড়ির আসবাবপত্র সে সব বিক্রি করে দিয়েছে। অনেক বই সে বিক্রি করে দিলেও দামি কিছু বই রেখে দিয়েছে এখনও। তার শোবার ঘরে কোনও আগুন ছিল না। বাতি না কিনে অন্ধকারে বসে থাকত সন্ধের পর থেকে; তার পর অন্ধকারেই শুতে যেত। তার বই-এর আয় থেকেই কোনওরকমে অতি কষ্টে দিন চলত। তার বাড়িতে কোনও প্রতিবেশী আসত না। পথে কেউ কথা বলত না তার সঙ্গে। তবু তার মুখের ওপর থেকে শিশুসুলভ সেই শান্ত সরলতার ভাবটি মুছে যায়নি আজও। কোনও বইয়ের ওপর চোখ পড়লেই আজও চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার। ১৮৪৪ সালে তার লেখা ‘ভায়োজেনেস’ বইটির যখন নতুন সংস্করণ ছাপা হয় তখন হাসি ফুটে ওঠে তার মুখে। বই-রাখা কাঁচের আলমারিটা আজও বিক্রি করেনি সে।
একদিন সকালে মেরে পুর্ক তাকে বলল, আজ খাবার কেনার পয়সা নেই।
খাবার মানে একটা ছোট পাউরুটি আর চার-পাঁচটা আলু।
ধারে কিনতে পারবে না?
আপনি জানেন, ওরা ধার দেবে না।
কাঁচ লাগানো বইয়ের তাক থেকে একটা বই বার করে সেটা নাড়াচাড়া করতে করতে অনেকক্ষণ ধরে ভাবতে লাগল মেবুফ। পিতামাতা সন্তানকে বিক্রি বা বলি দিতে গেলে প্রবল দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে অন্তর, মেবুফে’রও তাই হচ্ছিল। যাই হোক, অনেকক্ষণ পর সে একটা বই নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে দু ঘণ্টা পর ফিরে এসে বই বিক্রির তিরিশ স্যু টেবিলের উপর রাখল। বলল, এতে রাতের খাবার হয়ে যাবে।
এর পর থেকে প্রায় রোজই একটা করে বই বিক্রি করে সেই পয়সায় তাদের খাবার কেনা হত। সে রোজই বই বিক্রি করতে যায় দেখে পুরনো বই কেনার দোকানদার তাকে বইয়ের দাম কম দিত। যে একটি বই মেবুফ সেই দোকান থেকে কুড়ি ফ্রাঁ দিয়ে কিনেছিল সেই বই আজ তাকে মাত্র কুড়ি স্যুতে বিক্রি করতে হল। দেখতে দেখতে এক এক করে তার সব বই বিক্রি হয়ে গেল। শুধু রয়ে গেল তার লেখা একটি বই ভায়োজেনেস লার্তিয়াস।
মেবুফ হর্টিকালচার সোসাইটির সদস্য ছিল। তার আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যাওয়ায় সোসাইটির সভাপতি কৃষিমন্ত্রীকে সেকথা জানান। কৃষিমন্ত্রী স্বীকার করেন, মঁসিয়ে মেবুফ সত্যিই উদ্ভিদবিদ্যায় পণ্ডিত এবং সপ্রকৃতির লোক। তার জন্য আমাদের কিছু করা উচিত।
পরদিন মেবুফ মন্ত্রীর বাড়িতে রাতের খাওয়ার জন্য এক নিমন্ত্রণপত্র পেল। রাত্রিতে সে অতি কষ্টে জামা কেচে পরিষ্কার করে বই বিক্রির টাকায় গাড়িভাড়া খরচ করে মন্ত্রীর বাড়িতে গেল। কিন্তু তার দীনহীন পোশাক দেখে বাড়ির দারোয়ান বা কোনও লোক তাকে ঢুকতে বলল না। প্রায় দুপুররাত পর্যন্ত বাড়ির বাইরে এক নিষ্ফল প্রত্যাশায় অপেক্ষা করার পর ফিরে এল মেবুফ।
এরপর মেরে প্লুতার্কের অসুখ করল। কিন্তু ঘরে পয়সা নেই। খাবার বা ওষুধ কেনার মতো কোনও পয়সাই নেই। সেদিন ছিল ১৮৩২ সালের ৪ঠা জুন। অবশেষে মেবুফ তার ভায়োজেনেস লার্তিয়াস নামে সবচেয়ে প্রিয় বইটি বগলে নিয়ে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। র্যু সেন্ট জ্যাক থেকে সেই বই বিক্রি করে সে একশো ফ্রাঁ নিয়ে এল। প্লুতার্কের বিছানার পাশের টেবিলে টাকাগুলো রেখে নীরবে শুতে চলে গেল সে।
পরদিন সকালে সে তার অবহেলিত বাগানটার একদিকে সেই পাথরটার উপর বসল। বিকালের দিকে রাস্তার গোলমালের শব্দে চমকে উঠল মেবুফ। বাগানের পাশ দিয়ে এক মালিকে চলে যেতে দেখে সে জিজ্ঞাসা করল, কিসের গোলমাল হচ্ছে?
মালী বলল, হাঙ্গামা হচ্ছে।
কী জন্য?
লোকে লড়াই করছে।
কোথায়?
আর্সেনানে।
মেবুফ ঘরের ভেতর গিয়ে বইয়ের খোঁজ করতে লাগল। কিন্তু কোনও বই না পেয়ে টুপিটা মাথায় চাপিয়ে বেরিয়ে গেল শহরের পথে।