3 of 4

৪.০৮ চরসের নেশায়

এক শহরে এক জেলে বাস করতো। লোকটির জাত-ব্যবসা ছিলো মাছধরা। কিন্তু সর্বজনের কাছে সে পরিচিত ছিলো চরসখোর হিসেবে।

সারা দিনে রাতে মাত্র তিনবার সে চরস সেবন করতো। খুব সকালে কাজে বেরোবার আগে, বাসি পেটে একবার। একবার ভর দুপুর বেলায় এবং আর একবার সূর্য পাটে বসার সময় খেত

সে। এর বেশি সে একবারও খেয়ে পয়সার অপচয় করতে না কখনও।

সে বলতো, এটা তার নেশা নয়। সারা দিন গাধার মতো খাটার ক্ষমতা জোগায় এই চরস। শরীরে যেমন তাগদ জোগায়। মনও স্ফূর্তিতে থাকে। কাজে কখনও কুঁড়েমি লাগে না। এমন কি কোনও কোনও দিন সে ভূতের মতোও খেটে প্রচুর মাছ ধরে আনে।

কখনও-সখনও সন্ধ্যাবেলায় মাত্রাটা একটু বাড়িয়ে খেতো। তারপর টিমটিমে একটা ফুপি জ্বালিয়ে নেশায় বুদ হয়ে বসে বসে ঝিমাতো। আর বিড় বিড় করে আপন খেয়ালে কি যেন সব আওড়াতো।

এই রকম এক সন্ধ্যার কথা শুনুন : সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে এসে খানিকটা মাত্রা চড়িয়ে সে চরস সেবন করে চোখ বুজে দাওয়ায় বসে কল্পনার ইন্দ্রজাল বুনে চলেছিলো। কিছুক্ষণ পর একবার নয়ন মেলে তাকিয়ে দেখে ফুটফুটে জ্যোৎস্নালোকে আঙ্গিনা ভরে গেছে। জেলের প্রাণে বসন্ত জেগে ওঠে। পায়ে পায়ে সে রাস্তায় নেমে আসে। নিশুতি-নির্জন রাত। কোথাও কোনও জনমানবের সাড়া শব্দ নাই। শুধু চাঁদের আলোর ঢেউ খেলে যাচ্ছে সর্বত্র।

জেলের মনে খুশির বন্যা উপছে পড়ে। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় সে তার নিত্য সঙ্গী নীলের ধারে এসে উপস্থিত হয়।

মাথার ওপর পূর্ণচাদের মেলা। নীলে নিথর জল। ঘাটে ঘাটে মাঝিমাল্লারা নৌকা নোঙর করে নিদ্রামগ্ন। নদীর পাড়ে নদী এবং প্রকৃতির অপরূপ মনোহর শোভায় অভিভূত হয়ে পড়ে সে! হঠাৎ

তার নজর চলে যায় নদীর অতলে। স্বচ্ছ জলে চাঁদের ছায়া পড়েছিলো। জেলে অবাক হয়ে ভাবে, হায় বাপ, আসমানের চাঁদ নদীর জলে নেমে মাছের সঙ্গে খেলায় মেতেছে? এ মওকা তো ছাড়া যায় না। চাঁদমামাকে এবার কজায় পেয়েছি, পালাবে কোথায়? প্রায় ছুটতে ছুটতে সে ঘরে ফিরে এসে জালটা কাঁধে তুলে নিয়ে আবার নীলের পথে ছুটে যায়।

মনে আশঙ্কা ছিলো, হয়তো ফিরে গিয়ে দেখবে চাঁদমামা চলে গেছে! কিন্তু না; তখনও সে তেমনি মধুর হাসি ছড়িয়ে জলের তলাতেই দুলছে। সেই নীল নির্জন গভীর নিশুতি রাতে কাঁধ থেকে জালটা নামিয়ে হাতে বাগিয়ে ধরে সহজাত দক্ষতায় বৃত্তাকারে ছড়িয়ে ফেলে। মনে আশা, চাঁদকে সে জালের ঘায়ে জড়িয়ে ফেলবে! কিন্তু একটু পরে গুটিয়ে তোলার পর সে হতাশায় ভেঙ্গে পড়ে।

জালটা কাঁধে তুলে আবার সে বাড়ির পথ ধরে।

কিছু দূর আসার পর রাস্তার পাশের নালার জলে আবার সে চাঁদটা দেখতে পেয়ে নেচে ওঠে, ওরে মামা, তুমি হালা এইখানে পালিয়ে এয়েছে। দাঁড়াও দেখছি।

খুব সন্তর্পণে আবার সে জালটাকে ছড়িয়ে ফেলে নালাটার উপর। দুটি কুকুর শুয়েছিলো নালার ধারে। হঠাৎ জালে ঢাকা পড়ে তাদের নিদ্রা ছুটে যায়। জাল থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য হুড়পাড় করতে থাকে তারা। জেলে ভাবে মোটা মাছ বেঁধেছে। খুব কায়দা কসরত করে সে জালটাকে গুটাবার চেষ্টা করে কিন্তু জাঁদরেল কুকুর দুটোর দাপটের কাছে সে টিকে থাকতে পারবে কেন। ওরা ওকে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে যায় নালার জলে। জেলে নাকানি চোকানি খেতে থাকে।

—কই গো, কে আছ, সাচ্চা মুসমলান, বাঁচাও, বাঁচাও!

তার চেঁচামেচি চিৎকারে আশেপাশে বাড়ির প্রহরীরা ছুটে আসে! চরসখোরের কাণ্ড দেখে হেসে লুটোপুটি খেতে থাকে।

ওদের তামাসা দেখে জেলের হাড়-পিত্তি জ্বলে যায়।

—তোমরা তো বড় বেল্লিক বদমাইশ হে, এইভাবে শয়তান আমাকে বেকায়দায় ফেলে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে, আর তোমরা মুসলমানের বাচ্চা হয়ে কিনা দাঁত বের করে হাসছো? তোমরা কী এক বাপের জন্ম?

জেলের কথায় প্রহরীরা ক্ষেপে ওঠে। লোকটা জাতে মাতাল হলেও গালিগালাজ-এর বেলায় তো বেশ টনটনে আছে।

দাঁড়াও, তোমার ওষুধের ব্যবস্থা করছি। জেলেকে ধরে আচ্ছা করে ঠেঙিয়ে টানতে টানতে কাজীর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে হাজির করলো ওরা।

রাত্রি শেষ হয়ে এলো। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

সাতশো আটানব্বইতম রজনী :

আবার সে বলতে শুরু করেঃ

আল্লাহর কী মহিমা, কাজী সাহেবও চরস-এ বুদু হয়ে ঝিমচ্ছিল তখন। ঐ নেশার ঝোকেও তিনি বুঝতে পারলেন, প্রহরীরা যাকে ধরে এনেছে সে তারই মতো এক চরসোর।

জেলেকে রেখে প্রহরীদের বিদায় করে দিলেন তিনি। তারপর নফরদের বললেন, এ্যাঁই, মেহমানের খানাপিনা এবং শোবার ব্যবস্থা করে দে। দেখিস, যেন কোনও অসুবিধে না হয় ওর।

খুব চৰ্য্য চোষ্য করে খেয়ে দেয়ে গরম বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়লো জেলে এবং এক ঘুমে বাকী রাত এবং পরের দিনটাও কাবার হয়ে গেলো।

সন্ধ্যাবেলায় কাজীর চাকর এসে ডেকে তুললো জেলেকে।

-সাহেব আপনাকে সালাম জানিয়েছেন, মালিক। কা

জীর সামনে দাঁড়াতেই তিনি বুকে জড়িয়ে ধরলেন জেলেকে।

—তুমি আমার বুকের কলিজা, আমার ভাই, এস, মৌতাতে বসা যাক।

দুই চরসখোর বসে চরস খেয়ে নেশায় ঝুঁদ হয়ে রইলো কিছুক্ষণ। চাকর এসে খবর দিলো রাতের খানা দেওয়া হয়েছে টেবিলে।

কাজী সাহেব জেলের হাত ধরে টেনে তোলেন, চলো ভাইসাব, খানা-পিনা সেরে দিই।

খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে আবার ওরা দু’জনে মুখোমুখি বসলো। আরও খানিকটা চরস গলাধঃকরণ করে নেশাটাকে রঙদার করে দিতে চাইলো।

এরপরেই শুরু হলো আসল মজা। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাত্রাতিরিক্ত মাদকের ক্রিয়াকাণ্ড আরম্ভ হয়ে গেলো।

কাজী সাহেব এক এক করে সব সাজ-পোশাক খুলে ফেললেন। জেলেও দেখাদেখি ন্যাংটো হয়ে দাঁড়ালো। তারপর শুরু হলো ওদের উদ্দাম নৃত্য। শুধু নাচ নয়, অপূর্ব সঙ্গীত-লহরীতেও আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুললো দু’জনে। ভাগ্যে ধারে কাছে গাধারা কেউ ছিলো না।

রাত তখন নেহাত কম নয়। নাচের তাণ্ডব চলেছে অন্দরে। কিন্তু পথচারীরাও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল সব।

সুলতান এবং তার উজির নৈশ পরিক্রমায় বেরিয়েছেন। ঘুরতে ঘুরতে এক সময় এঁরা কাজীর বাড়ির সামনে এসে পড়েন। ওদের পরনে বণিকের ছদ্মবেশ। উজিরকে সঙ্গে নিয়ে সুলতান ভেজানো দরজা ঠেলে উঁকি দিয়ে দেখলেন, কাজী সাহেব এবং অন্য একটি লোক একেবারে উলঙ্গ হয়ে নানা ঢং-এ নেচে চলেছে এবং রসভ-কণ্ঠের লহরা তুলছে।

সুলতান এবং উজির ভিতরে ঢুকতে কাজী সাহেবরা নৃত্যগীত বন্ধ করে এগিয়ে এলো সামনে।

—আসুন, আসুন, আসতে আজ্ঞা হোক। আমার কী সেই ভাগ্য, অধমের গরীবখানায় আপনাদের পায়ের ধুলো পড়লো।

কাজী সাহেব বিন্দুমাত্র লজ্জিত বা সঙ্কুচিত না হয়ে এগিয়ে এসে সুলতানকে সাদর সম্ভাষণ জানালেন।

সুলতান আসন গ্রহণ করলে, কাজী সাহেব জেলেকে নিয়ে আবার রসকলি নৃত্য-সঙ্গীতে উদ্দাম হয়ে উঠলেন।

কাজী সাহেবের দেহের বর্ণ সোনার মতো। কিন্তু তাঁর সঙ্গীটি ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণের। সুলতান উজিরের কানে কানে ফিসফিস করে বললেন, দেখছো, আমাদের কাজীর গায়ের রঙটাই শুধু ফর্সা, কিন্তু আসল বস্তুটি তার সাথীর তুলনায় ধানি লঙ্কা!

-কী? কানে কানে গুজুর গুজুর করছো কী তোমরা? জেলেটা প্রায় ক্ষেপে উঠলো, জান, আমি কে? এই শহরকা সুলতান। চুপসে বসে নাচ দেখ আমাদের। কোনও রকম গুজ গুজ ফুস ফুস করবে না, বুঝলে? এ আমার হুকুম। যদি এরপরে ফের এই রকম বেয়াদপি করতে দেখি, তবে তোমাদের দুজনারই গর্দান নেব আমি। মনে থাকে যেন, আমি হচ্ছি সুলতান, আর আমার এই সঙ্গীটি হচ্ছে আমার উজির। তামাম দুনিয়াটা আমার হাতের মুঠোয়। জালাখানা গুটাবো আর সব খলবল করে উঠে এসে লুটিয়ে পড়বে আমার পায়ের ওপর। বাবা, যে সে কথা নয়, আমি হচ্ছি আরব দুনিয়ার একচ্ছত্র অধিপতি। আমার হুকুমে বাঘে ছাগলে একঘাটে পানি খায়।

সুলতান এবং উজির বুঝলেন, ওঁরা দুই চরসখোরের সামনে এসে পড়েছেন। উজির জিজ্ঞেস করলো, তা মহামান্য সুলতান, কতদিন হলো এখানকার সুলতান হয়েছেন। এর আগে যিনি মসনদে ছিলেন, তিনি গেলেন কোথায়?

বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে তৎক্ষণাৎ জেলে জবাব দেয়, তাকে আমি বিদায় করে দিয়েছি।

-আপনি বিদায় দিলেন আর তিনি চলে গেলেন?

–সঙ্গে সঙ্গে। এক তিল দেরি করলেন না। যেই আমি বললাম, এবার তোমার দিন ফুরিয়ে গেছে, তুমি কেটে পড়, অমনি সে আভূমি আনত হয়ে আমাকে কুর্ণিশ জানিয়ে বললো, আমি তো আপনারই জন্যে পথ চেয়ে এই মসনদ আগলে বসে রয়েছি, জাঁহাপনা। আপনার মসনদ আপনি নিন। আমাকে রেহাই দিন এই গুরুদায়িত্ব থেকে। বাদশাহীতে আমার কোনও মোহ লিপ্সা নাই। এতোবড় হুকুমতের গুরুদায়িত্ব আমার ঘাড়ে পর্বতপ্রমাণ ভারি বোঝা হয়ে আছে এতো কাল। এতো দায়িত্ব আমি আর পালন করতে পারছি না।

সুলতান আর হাসি চাপতে পারেন না। কিন্তু ওদের সামনে প্রাণ খুলে হাসার উপায় নাই। গর্দান যাবে। সুতরাং উজিরকে ইশারা করে টুক করে রাস্তায় নেমে পড়েন তিনি।

গল্পটা এখানেই শেষ নয়। পরদিন সকালে সুলতান কাজী সাহেব এবং তার অনুচরটাকে তলব করলেন।

কাজী এবং জেলে এসে হাজির হলো দরবারে। সুলতান কাজীকে উদ্দেশ্য করে বললেন।

কাজী সাহেব, আপনি আমার আদালতের বিচারক। মহামাননীয় ব্যক্তি। কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায়, এই বিধান আমরা চাই আপনার কাছে। কিন্তু একটা কথা বলি, নিশুতি রাতে পাড়া-প্রতিবেশী এবং পথচারীদের কানের তালা ফাটানো সঙ্গীত শুনিয়ে শান্তি ভঙ্গ করার বিধান আপনার কোন আইনে আছে? নিজের বাড়ির অন্দরে চরস খেয়ে সঙ্গী সাথী নিয়ে উদ্দাম হয়ে নাচন-কোদন করাই কি আপনার মতো প্রাজ্ঞ বিচারপতির সাজে?

কাজী সাহেব বুঝতে পারেন গতরাতের ছদ্মবেশী বণিকদ্বয় স্বয়ং সুলতান ‘এবং তার উজির ছাড়া কেউ নয়। সঙ্গে সঙ্গে সে সাষ্টাঙ্গে লুটিয়ে পড়ে

সুলতানের মসনদের সামনে। -দোহাই হুজুর, আমার গোস্তাকি মাফ করুন। না জেনে আমি আপনার যথাযোগ্য সম্মান করতে পারিনি। তখন চরসের নেশায় কি বলতে কি বলেছি আপনাকে, এখন আমার কিছুই মনে নাই। আপনি বিশ্বাস করুন, জাঁহাপনা। যা-ই বলে থাকি, আমি বলিনি, বলেছে আমার নেশা—চরস। সেই কথা ভেবে অধমকে রেহাই করে দিন এবারের মতো।

জেলেটার নেশা তখনও কাটেনি। চোখ দুটো চেষ্টা করেও খুলে রাখতে পারছে না সে।

কিন্তু কাজীর কথায় সে উত্তপ্ত হয়ে উঠলো, আরে, অত কাচুমাচু করার কী আছে? আমরা কী চুরি করেছি, না ডাকাতি করেছি। ইচ্ছে হয়েছে নেশা করেছি।

তারপর সুলতানকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে আপনি এখানে আপনার প্রাসাদে সুলতান হয়ে তখতে বসে আছেন। খুব ভালো। কিন্তু আমিই বা কম কিসে আপনার তুলনায়? কাল রাতে আমাদের প্রাসাদে আমরা সুলতান উজির ছিলাম। সেখানে আপনারা তো আমার প্রজার সমান।

সুলতান মজা পান।

—তোমার কথা একশোবার খাঁটি। আমি আমার তখতে, তুমি তোমার ডেরায় সুলতান। তাহলে এসো দোস্ত, আমরা দুজনেই সুলতান হয়ে এক সঙ্গে বসবাস করি।

জেলে গম্ভীরভাবে বলে, আপনার প্রস্তাব আমি বিবেচনা করে দেখতে পারি। কিন্তু তার আগে আমার উজিরকে সব গুনাহ থেকে রেহাই দিতে হবে।

সুলতান হাসতে হাসতে বললেন, ঠিক আছে, তোমার সম্মানে আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম।

এরপর আর একটা কাহিনী শুরু করে শাহরাজাদ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *