প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড

৪.০৬ হোটেলটার অবস্থা খারাপের দিকে

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

১.

১৮২৩ সালের পর থেকে যখন মঁতফারমেলে থেনার্দিয়েরদের হোটেলটার অবস্থা খারাপের দিকে যেতে থাকে, যখন তারা ছোটখাটো অনেক দেনায় ডুবে যায় তখন তাদের পর পর দুটি পুত্রসন্তান হয়। এই নিয়ে তাদের মোট সন্তানসংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচ অর্থাৎ দুটি মেয়ে আর তিনটি ছেলে। এতগুলো ছেলের ব্যয়ভার বহন করা সত্যিই তাদের পক্ষে কঠিন। মাদাম থেনার্দিয়ের তাই অদ্ভুতভাবে তার শেষ দুটি পুত্রসন্তানের হাত থেকে অব্যাহতি পেয়ে গেল।

‘অব্যাহতি পেল’ কথাটা এইজন্য বলা হল যে মাদাম থেনার্দিয়ের ছিল এমনই একজন নারী–যার স্নেহ-মমতার ভাণ্ডারটা খুবই সীমিত। মাদাম থেনার্দিয়ের শুধু তার মেয়েদের ভালোবাসত। মেয়েদের অতিক্রম করে তার মাতৃস্নেহ আর বেশি দূরে প্রসারিত হতে পারত না। সমগ্র পুরুষজাতির ঘৃণাটা শুরু হয় তার পুত্রসন্তানদের কেন্দ্র করে।

লা ম্যাগনন নামে যে মেয়েটির নাম উল্লেখ করেছি, সে আগে মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করত এবং সে পর পর দুটি বছরের মধ্যে দুটি পুত্রসন্তান প্রসব করে মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের কাছে পাঠিয়ে দেয় তার কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। আমরা এটাও জানি যে মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ ছেলে দুটিকে ম্যাগননের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে তাদের ভরণপোষণের জন্য প্রতি মাসে এক একটি ছেলের জন্য আশি ফ্রাঁ করে দেবার ব্যবস্থা করেন। ম্যাগনন তখন কোয়ে দে সেলেস্তিনে অঞ্চলে নদীর ধারে একটা বাড়িতে বাস করতে থাকে। একবার মহামারীতে দুটি ছেলেই একদিনে মারা যায়। ফলে দারুণ বিপদে পড়ে ম্যাগনন। ছেলে দুটির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে প্রতি মাসে একশো ষাট ফ্ৰাঁ তার বন্ধ হয়ে যাবে। মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ ছ’ মাস অন্তর একবার করে এসে দেখে যান ছেলে দুটিকে। তখন লা ম্যাগনন যে অঞ্চলে থাকত, থেনার্দিয়েররাও সেই অঞ্চলে থাকত। ম্যাগননের দুটি ছেলে দরকার। পথনার্দিয়েরদের আছে দুটি অবাঞ্ছিত ছেলে–ম্যাগননের ছেলে দুটি যে বয়সের ছিল সেই একই বয়সের। থেনার্দিয়েররা তাদের শেষ সন্তান দুটিকে ম্যাগননকে দিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেল। তার জন্য শুধু প্রতিটি ছেলেপিছু মাসে দশ ফ্র করে ভাড়া চাইল। ম্যাগননও তাতে রাজি হয়ে গেল। তাতে তার কোনও লোকসান নেই। কারণ ওই ছেলে দেখিয়েই সে গিলেনৰ্মাদের কাছ থেকে আগের মতোই টাকা পেয়ে যেতে লাগল। গিলেনৰ্মাদ ছেলে দুটিকে দেখে কিছু বুঝতেই পারলেন না। সন্দেহ করার মতো কিছু খুঁজে পেলেন না। এরপর লা ম্যাগনন র‍্যু দ্য ক্লোশেপার্সে অঞ্চলে চলে যায় নতুন বাসা নিয়ে।

যতই হোক, মা হিসেবে ছেলে দুটোকে ম্যাগননের হাতে তুলে দেবার পর থেনার্দিয়েরপত্নী একটু মৃদু আপত্তি তুলেছিল। বলেছিল, এভাবে নিজেদের সন্তানকে ত্যাগ করা উচিত হবে না।

থেনার্দিয়ের তখন গম্ভীরভাবে বলেছিল, আঁ জ্যাক রুশো এর থেকেও খারাপ জিনিস করেছিলেন।

তার স্ত্রী তখন বলেছিল, কিন্তু যদি মনে কর পুলিশ টের পায়? এটা তো অবৈধ কাজ।

থেনার্দিয়ের তখন বলেছিল, গরিবদের ছেলেমেয়েদের কে খবর রাখে? কে বলছে পুলিশদের? আমি যা করেছি ঠিক করেছি।

লা ম্যাগনন তখন ক্লোশেপার্সে অঞ্চলে একজন ইংরেজ মহিলার সঙ্গে যৌথভাবে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকত। ভালো সাজপোশাক করত। চোর হিসেবে বদনাম ছিল সেই ইংরেজ মহিলার।

থেনার্দিয়েরদের ছেলে দুটি কিন্তু ম্যাগনেনের কাছে ভালোভাবেই মানুষ হতে লাগল। ম্যাগনন তাদের ভালো খাওয়া-পরার কোনও অভাব রাখত না। খাওয়া-পরার এমন সচ্ছলতা তারা তাদের বাবা-মার কাছে কখনই পেত না। তারা যখন বাড়ি থেকে চলে আসে তাদের ভাইবোনেরা তখন কিছু মনে করেনি। বড় বোন এপোনিনে বা বড় ভাই গাভ্রোশে কোনও প্রতিবাদ করেনি তাদের বাবা-মার কাছে। উকট দারিদ্র্য তাদের মনগুলোকে এমন ভয়ঙ্করভাবে উদাসীন করে তোলে যে তারা কেউ কারও খবর রাখত না।

কিন্তু গর্বোর বাড়িতে থেনার্দিয়েররা যখন পুলিশের হাতে ধরা পড়ে তখন প্যারিস পুলিশ শহরতলির অন্য সব বস্তি অঞ্চলে ব্যাপক খানাতল্লাশি করে কুখ্যাত চোর, দাগি গুণ্ডাদের সব ধরপাকড় করে। তখন লা ম্যাগনন ও তার বাসার সেই ইংরেজ মহিলাটিও গ্রেপ্তার হয়। ম্যাগননের আশ্রিত সেই ছেলে দুটি তখন রাস্তায় খেলা করে বেড়াচ্ছিল। তারা হঠাৎ বাসায় ফিরে এসে দেখে ঘর বন্ধ। পাড়ার একজন তাদের হাতে একটা ঠিকানা লেখা একটুকরো কাগজ দিয়ে বলে এই ঠিকানাটা নিয়ে র‍্যু দ্য সিসিলেত্তে যাও।

সেখানে মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের ভূসম্পত্তি দেখাশোনা করার জন্য একজন লোক। থাকত। এই লোকের মারফত লা ম্যাগননকে টাকা পাঠাতেন মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ। কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। জোর বাতাস বইছিল বড় ছেলেটি কাগজের টুকরোটা হাতে শক্ত করে ধরে থাকলেও একসময় মুঠোটা একটু আলগা হতেই কাগজটা হাওয়ায় উড়ে যায়। অন্ধকারে তারা আর খুঁজে পেল না কাগজটা। ফলে নিরাশ্রয় ও সহায়সম্বলহীন হয়ে পথে পথে ঘুরতে লাগল ছেলে দুটি।

.

২.

প্যারিসে বসন্তকালে মাঝে মাঝে এক একদিন জোর ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে থাকে। ক্রমে সে হাওয়া ঝড়ের রূপ নিয়ে বসন্তের সব উল্লাসকে মাটি করে দেয়। একেবারে জমিয়ে না দিলেও কনকনে ঠাণ্ডায় হাড় কাঁপিয়ে দেয়। কেউ কোনও ঘরের দরজা-জানালা খুলে রাখতে পারে না।

এই ধরনের এক ঝড়ের আঘাতে জর্জরিত এক সন্ধ্যায় থেনার্দিয়েরদের বড় ছেলে গাভ্রোশে একটা শাল গাঁয়ে জড়িয়ে শীতে কাঁপতে কাঁপতে একটা চুলকাটার সেলুনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। শীতে কাঁপতে থাকলেও হাসি-খুশির ভাবটা ঠিক মুখে ছিল তার। মেয়েদের একটা শাল কোথা থেকে কোনওরকমে জোগাড় করে শীতের প্রকোপটা কাটাতে থাকে সে।

উপর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল গাভ্রোশে গাউনপরা একটি মেয়ের চুল কাটা দেখছিল। কিন্তু তার নজর ছিল সামনে রাখা দুটো সাবানের ওপর। সে শুধু ভাবছিল দুটো কি একটা সাবান তুলে নিয়ে গিয়ে শহরের অন্য প্রান্তের কোনও নাপিতকে বিক্রি করে কিছু পয়সা পাবে। এই ভাবে সাবান চুরি করে সেই পয়সায় সে রাতের খাওয়া সেরেছে। এ ব্যাপারে তার একটা কৌশলগত প্রতিভা আছে এবং সে নিজে গর্বের সঙ্গে বলত কাঁচির উপর কাঁচি চালাতে সে ওস্তাদ।

তার নজর যখন সাবানের ওপর ছিল এবং সে চুরির কথা ভাবছিল, তখন আপন মনে বলছিল, মঙ্গলবার, আজ কি মঙ্গলবার? তার মানে আজ শুক্রবার, তার মানে মঙ্গলবারের পর থেকে খাওয়া হয়নি তার।

কিন্তু সেলুনের নাপিত চুল ছাঁটার কাজ করতে করতে সাবানের ওপর আর চোর ছেলেটার ওপর কড়া নজর রাখছিল। এদিকে গাভ্রোশে যখন সাবান দুটোর দিকে সতৃষ্ণ নয়নে তাকিয়ে ছিল, ভালো পোশাকপরা দুটো ছেলে দোকানে ঢুকে কী বলতে লাগল। তাদের মধ্যে ছোট ছেলেটি বিপন্নভাবে কাঁদতে থাকায় তার কথা বোঝা যাচ্ছিল না এবং বড় ছেলেটির দাঁতগুলো শীতে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে থাকায় তারও কথা বোঝা যাচ্ছিল না। দোকানের মালিক ছেলে দুটিকে দোকান থেকে তাড়িয়ে দিল।

ছেলে দুটি বেরিয়ে চলে যাচ্ছিল। গাভ্রোশে তাদের পিছু পিছু গিয়ে বলল, কী হয়েছে তোমাদের?

বড় ছেলেটি বলল, আমাদের শোবার কোনও জায়গা নেই।

গাভ্রোশে বলল, এই কথা! এজন্য কাঁদবার কোনও দরকার নেই। আমার সঙ্গে এস।

ছেলে দুটি গাভ্রোশের কথাটা মেনে নিল। সে যেন তাদের চোখে একজন মহামান্য আর্কবিশপ। তারা কান্না থামিয়ে তার অনুসরণ করতে লাগল। গাভ্রোশে তাদের সঙ্গে নিয়ে র‍্যু সেন্ট আঁতোনে হয়ে বাস্তিলের দিকে যেতে লাগল। কিন্তু যাবার সময় এক একবার পেছন ফিরে দোকানটার দিকে তাকাচ্ছিল।

পথে যেতে যেতে গাভ্রোশে দেখল একটি মেয়ে ঝাঁটা হাতে কোথায় যাচ্ছে। সে বলল, মাদাম, তুমি কি এই বঁটাটা নিয়ে পালাচ্ছ?

এমন সময় পাশ দিয়ে যেতে থাকা চকচকে জুতোপরা একটি লোকের জুতোতে জল ছিটিয়ে দিল।

লোকটি চিৎকার করে বলল, শয়তান ছেলে কোথাকার! গাভ্রোশে শাল থেকে মুখটা বার করে বলল, মঁসিয়ে আমার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ করছেন?

লোকটি বলল, হ্যাঁ, তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছি।

গাভ্রোশে বলল, দুঃখিত। আজ কোনও অভিযোগ করে ফল হবে না, কারণ অফিস বন্ধ হয়ে গেছে।

আরও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে গাভ্রোশে দেখল পথের ধারে একটি দরজার সামনে একটি ভিখারিণী মেয়ে শীতে কাঁপছে। তার স্কার্টটা এত ছোট যে তার হাঁটু দুটো বেরিয়ে ছিল। সে পথ হাঁটতে পারছিল না।

গাভ্রোশে মেয়েটির কাছে গিয়ে তার গা থেকে শালটা খুলে তাকে দিয়ে বলল, এই নাও।

এবার তার মাফলারটাই গলায় জড়ানো থাকল। আর কোনও শীতবস্ত্র রইল না। মেয়েটি গাভ্রোশের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। চরম দারিদ্র্যের সময়ে মানুষ যেমন তার ভাগ্যের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ করতে পারে না, তেমনি তার উপকারীকে কোনও ধন্যবাদ দিতে পারে না।

এমন সময় বৃষ্টি নামল। গাভ্রোশে আক্ষেপ করে বলতে লাগল, বারে! আবার বৃষ্টি পড়ছে। কালো আকাশটা ভালো কাজের জন্য আমাকে এইভাবে শাস্তি দিচ্ছে। এভাবে বৃষ্টি পড়লে আমাকে তো শালটা আবার ফিরিয়ে নিতে হবে।

কিন্তু দেখল মেয়েটি শালটা তখন শীতে কাতর হয়ে গায়ের উপর জড়িয়ে ধরল।

ছেলে দুটোকে নিয়ে আবার এগিয়ে যেতে লাগল গাভ্রোশে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা লোহার রড দিয়ে ঘেরা জানালাওয়ালা একটি ঘরের সামনে এসে পড়ল। গাভ্রোশে বুঝল ওটা একটি রুটির দোকান।

গাভ্রোশে ছেলে দুটিকে জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের খাওয়া হয়েছে?

আজ সকাল থেকে আমরা কিছু খাইনি।

তোমাদের বাবা-মা নেই?

আমাদের বাবা-মা আছে, কিন্তু কোথায় আছে তা জানি না। তাদের খুঁজে পাইনি।

গাভ্রোশে বলল, কুকুররাও অনেক কিছু পায়। তোমাদের বাপ-মা’র পাত্তা নেই? তাদের খবর জান না? এটা খুব খারাপ। যাই হোক, আমাদের কোথাও কিছু খেতে হবে।

আর কোনও কথা সে তাদের জিজ্ঞাসা করল না। কারও ঘরছাড়া হওয়াটা তার কাছে এমন কোনও নতুন ব্যাপার নয়। বড় ছেলেটি হঠাৎ বলল, আমাদের মা আজ আমাদের পাম সানডের সাজসজ্জা দেখাতে নিয়ে যেতেন।

গাভ্রোশে বলল, তাই নাকি?

আমার মা একজন সম্ভ্রান্ত মহিলা এবং তিনি ম্যাদময়জেল মিসের সঙ্গে বাস করেন।

গাভ্রোশে বলল, এখনও হয়নি? কি?

তখনও তারা রুটির দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। গাভ্রোশে এক শান্ত তৃপ্তি আর একটা গর্বের ভাব নিয়ে বলল, ভাবনার কিছু নেই। আমার কাছে যা আছে তাতে তিনজনের খাওয়া হয়ে যাবে।

এই বলে সে তার পকেট থেকে একটা স্যু বার করল। তার পর সে ছেলে দুটোকে দোকানের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে সেই স্যুটা কাউন্টারের উপর রেখে বলল, কই দোকানদার, পাঁচ সেন্তিমের মতো রুটি দাও।

দোকানদার একটা পাউরুটি আর একটা ছুরি হাতে তুলে দিল।

গাভ্রোশে বলল, আমরা তিনজন আছি, তিন পিস রুটি দাও।

তার পর সে যখন দেখল দোকানদার একটা সস্তা বাজে রুটি বার করেছে তখন সে তার নাকের উপর একটা আঙুল ফ্রেডারিক দি প্রেটের নস্যি নেওয়ার রাজকীয় ভঙ্গিতে রাগের সঙ্গে বলল, এটা কী?

দোকানদার তার কথাটার মানে বুঝতে পেরে বলল, কেন, রুটি, ভালো সেকেন্ড ক্লাস একটা রুটি।

গাভ্রোশে বলল, তার মানে কালো রুটি, জেলখানার রুটি। আমি চাই ভালো সাদা রুটি। আমি পয়সা দেব।

দোকানদার মুচকি হেসে একটা সাদা রুটি তুলে নিয়ে কাটতে কাটতে তার খরিদ্দারদের দিকে সহানুভূতির সঙ্গে তাকাল। তা দেখে রেগে গেল গাভ্রোশে। বলল, আমাদের পানে ওভাবে তাকাচ্ছ কেন?

রুটিটা কেটে দোকানদার গাভ্রোশের হাতে সেটা দিয়ে পয়সাটা তুলে নিল।  গাভ্রোশে নিজে ছোট একটা টুকরো নিয়ে বড় টুকরো ওদের দিয়ে দিল। ছেলে দুটো গ্রোগাসে খেতে লাগল। দোকানদার তাদের দিকে রাগের সঙ্গে তাকাতে গাভ্রোশে তাদের বলল, বাইরে চল।

এই বলে সে তাদের নিয়ে বাস্তিলের দিকে যেতে লাগল আবার।

কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পর ছোট ছেলেটা একটা আলোকিত দোকান দেখে তার কাছে গিয়ে তাকাতে লাগল। গাভ্রোশের রাগ হলেও সে আপন মনে বলল, ছেলেমানুষ, জ্ঞান নেই।

রুটিটা খাওয়া তাদের হয়ে গেলে র‍্যু দে ব্যালে পার হয়ে তারা লা ফোর্স জেলখানার সামনে এসে হাজির হল।

একজন বলল, গাভ্রোশে তুই?

গাভ্রোশে বলল, মঁতপার্নেসি তুমি?

লোকটা বলল, মঁতপার্নেসিই, তার চোখে নীল রঙের চশমা থাকলেও তাকে চিনতে পারল গাভ্রোশে। সে বলল, তোমার কোটটা পুলটিসের মতো দেখালেও তোমার চশমাটার জন্য তোমাকে প্রফেসর বলে মনে হচ্ছে। চমৎকার।

মঁতপার্নেসি বলল, খুব একটা খারাপ দেখায় না।

তখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। মঁতপার্নেসি তাদের রাস্তা থেকে সরিয়ে একটা বাড়ির গাড়ি-বারান্দার তলায় গিয়ে দাঁড়াল। ছেলে দুটি হাত ধরাধরি করে তাদের পিছু পিছু গেল। মঁতপার্নেসি বলল, জান আমি কোথায় যাচ্ছি?

গাভ্রোশে বলল, ফাঁসির কাঠে।

বোকা কোথাকার, আমি যাচ্ছি বাবেতের সঙ্গে দেখা করতে।

সত্যিই তুমি বাবেতের কাছে যাচ্ছ?

হ্যাঁ সত্যি।

কিন্তু আমি তো জানতাম সে জেলে আছে।

হ্যাঁ জেলে ছিল। কিন্তু ওকে যেদিন কনসার্জারিতে বদলি করা হয় সেদিন সকালে প্যারেডের সময় ও পালিয়ে যায়।

গাভ্রোশে বাবেতের চাতুর্যের প্রশংসা করে বলল, সত্যিই ও একটা শিল্পীর মতো। মঁতপার্নেসি বলল, শুধু তাই নয়।

মঁতপার্নেসির কাছে খাপে ভরা একটা ছোরা ছিল। খাপ থেকে সেটা দেখা যাচ্ছিল। গাভেশে বলল, তুমি দেখছি মারপিটের জন্য তৈরি হয়ে যাচ্ছ।

মঁতপার্নেসি গম্ভীরভাবে বলল, বলা যায় না, তৈরি থাকা ভালো।

গাভ্রোশে বলল, আসলে তুমি কী করতে চাও?

প্রসঙ্গটা পাল্টে দিয়ে মঁতপার্নেসি বলল, ইতোমধ্যে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেছে। দিনকতক আগে এক সন্ধেবেলায় আমি পথে একটা ভদ্রলোককে ধরি। সে আমাকে বেশ কিছু নীতি-উপদেশ দেওয়ার পর টাকার একটা ব্যাগ আমাকে দিয়ে যায়। কিন্তু পরমুহূর্তে দেখি ব্যাগটা আমার পকেট থেকে উধাও হয়ে যায়।

গাভ্রোশে বলল, শুধু নীতি-উপদেশগুলো রয়ে যায়।

মঁতপার্নেসি তাকে বলল, কিন্তু তুমি কোথায় যাচ্ছ?

আমি এই ছেলে দুটোর শোয়ার ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি।

শোয়ার ব্যবস্থা? কোথায়?

আমার বাসায়।

 তোমার আবার বাসা আছে নাকি?

হ্যাঁ আছে।

কোথায়?

এলিফ্যান্ট।

মঁতপার্নেসি আশ্চর্য হয়ে বলল, এলিফ্যান্ট?

হ্যাঁ, বাস্তিলের এলিফ্যান্ট। কিন্তু এতে অবাক হবার কী আছে?

মঁতপার্নেসি বিস্ময়ের ঘোরটা কাটিয়ে উঠে বলল, ঠিক আছে, বাসাটা কী রকমের?

গাভ্রোশে বলল, খুব ভালো বাসা। ব্রিজের তলার মতো নয়। বেশ আরামদায়ক বাসা।

কিন্তু কী করে তোক সেখানে?

সে ব্যবস্থা করেছি।

তুমি কি বলতে চাও সেখানে একটা ফুটো আছে ঢোকার মতো?

না, দু পা দিয়ে উঠতে হয়। তবে এই বাচ্চা দুটোর জন্য একটা মই জোগাড় করতে হবে। আমার তো মাত্র দু সেকেন্ড সময় লাগে।

মঁতপার্নেসি তাদের পানে তাকিয়ে হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে বলল, কোথা থেকে ওদের জোটালে?

গাভ্রোশে বলল, একটা নাপিত তার দোকান থেকে আমায় উপহার দিয়েছে।

মঁতপার্নেসি বলল, তুমি তা হলে আমাকে দেখেই চিনতে পেরেছিলে?

কথাটা বলেই সে পকেট থেকে পালক আর তুলো জড়ানো দুটো জিনিস বার করে নাকের দুটো রন্ধ্রে ঢুকিয়ে দিল।

গাভ্রোশে বলল, এতে তোমার মুখটা একটু পাল্টে গেছে।

মঁতপার্নেসি এবার গাভ্রোশের কাঁধের উপর একটা হাত রেখে বলল, তোমাকে এটা বলতে বাধ্য হচ্ছি, এটা বাজার নয়। বাজার হলে এবং আমার কুকুর, ছোরা আর আমার প্রেমিকা কাছে থাকলে আমি এত কথা বলতাম যে তুমি খুশি হয়ে আমাকে দশ স্যু দিতে।

এটা সাংকেতিক কথা। একথা শুনে সচকিত হয়ে চারদিকে তাকাল গাভ্রোশে। দেখল অদূরে একটা পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। সে মঁতপার্নেসিকে হাত দিয়ে নাড়া দিয়ে বলল, এখন আমি যাচ্ছি। ছেলে দুটোকে নিয়ে যেতে হবে। আমি নিচের তলায় থাকি। রাত্রিতে দরকার হলে আমার খোঁজ করবে।

মঁতপার্নেসি বলল, ধন্যবাদ।

এরপর দু জন দু দিকে চলে গেল। মঁতপার্নেসি চলে গেল গ্রেভের দিকে আর গাভ্রোশে চলে গেল বাস্তিলের দিকে। গাভ্রোশে ধরেছিল বড় ছেলেটার হাত আর বড় ছেলেটা ধরেছিল ছোট ছেলেটার হাত।

কুড়ি বছর আগে বাস্তিল দুর্গের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে কাঠ ও চুনবালির পলেস্তারা দেওয়া চল্লিশ ফুট উঁচু একটা হাতি ছিল। নেপোলিয়নের আমলে নির্মিত এই হাতিটার গাঁয়ে প্রথমে সবুজ রঙ দেওয়া হয়েছিল। রোদবৃষ্টিতে সে রংটা চটে যায় একে একে। রাত্রির শান্ত অন্ধকারে এই বিরাট হাতির মূর্তিটা বিশাল প্রেতমূর্তির মতো এক নারকীয় ঐশ্বর্যে দীপ্তিমান হয়ে উঠত যেন। পরে হাতিটার পরিবর্তে ব্রোঞ্জের এক বিরাট স্টোভ বসল বাস্তিল দুর্গের সামনে। এট যেন সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থার ওপর বুর্জোয়া শিল্পোন্নয়নের জয়ের প্রতীক।

সেই হাতিটার আধভাঙা মূর্তিটার সামনে এসে গাভ্রোশে ছেলে দুটিকে বলল, ভয় করো না।

সে প্রথমে ছেলে দুটিকে নিয়ে বেড়াটা পার হয়ে ভেতরে গেল। তার পর যে মই দিয়ে রাজমিস্ত্রিরা কাজ করত সেই মইটা এনে হাতির মূর্তিটার সামনের পা দুটোর উপর লাগিয়ে দিয়ে বলল, এই মই দিয়ে উঠে হাতির পেটটার কাছে যে ফাঁক রয়েছে সেই ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকে যাও।

গাভ্রোশের ওপর আস্থা ছিল ছেলে দুটির। কারণ সে তাদের আজ সন্ধের সময় রুটি দিয়েছে খেতে। তাদের শোবার জায়গা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবু মইয়ে উঠতে বললে তারা বিহ্বল হয়ে তাকাতে লাগল গাভ্রোশের দিকে।

গাভ্রোশে তাদের বলল, কী! সাহস হচ্ছে না? কী করে উঠতে হয় দেখাচ্ছি।

এই বলে সে মই ছাড়াই হাতিটার পা ধরে তার পেটের কাছে ভেতরে ঢুকে গেল। তার পর নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলে দুটিকে মুখ বার করে বলতে লাগল, এবার তোমরা ওঠ।

বড় ছেলেটিকে আগে উঠতে বলল সে। বড় ছেলেটি মই দিয়ে ভয়ে ভয়ে উঠতে লাগল। সে তার কাছে কোনওরকমে যেতেই গাভ্রোশে তার হাত ধরে টেনে ভেতরে ঢুকিয়ে নিল তাকে। তার পর সে নিচে নেমে পাঁচ বছরের ছোট ছেলেটিকে কোলে তুলে নিয়ে মইয়ের উপর উঠিয়ে দিয়ে তার পেছনে উঠতে লাগল। এইভাবে সে ছেলেটিকে ঠেলা দিতে দিতে তাকে হাতিটার পেটের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে আনন্দে হাততালি দিতে লাগল। তখন বৃষ্টির বেগ বেড়ে গেছে।

যেসব ভদ্রলোক বাস্তিল দুর্গের পাশ দিয়ে দিনের বেলায় যেতে যেতে সম্রাট নেপোলিয়ন পরিকল্পিত ও নির্মিত হাতির মূর্তিটাকে অপ্রয়োজনীয় বলে মন্তব্য করত তারা জানত না সেই অবজ্ঞাত অবহেলিত মূর্তিটা রাতের অন্ধকারে কয়েকটি নিরাশ্রয় পিতৃমাতৃহীন শিশুকে ঝড়বৃষ্টি ও তুষারপাতের কবল থেকে রক্ষা করে আশ্রয় দান করে তার নিরাপদ গর্ভে। যে মূর্তিটি নিজেই এক বিশালকায় ভিক্ষুকের মতো দেশবাসীর কাছ থেকে এক সযত্ন দৃষ্টি ভিক্ষা করে নীরবে, সেই মূর্তিটিই কয়েকটি অনাথ ভিক্ষুক বালককে আশ্রয় দান করে সকলের অলক্ষে অগোচরে।

ভেতরটা অন্ধকার। গাভ্রোশে লাইটার দিয়ে আলো জ্বালল। সেই আলোয় তেলমাখা একটা বাতি ধরিয়ে সেই ধূমায়িত আলোয় ভেতরটা আলোকিত করে রাখল। গাভ্রোশে একটা কাঠ দিয়ে ফাঁকটা বন্ধ করে দিয়ে বলল, আমি চাই বাইরে থেকে দারোয়ান যেন দেখতে না পায়, তাই মুখটা বন্ধ করে দিলাম।

ছোট ছেলেটি অস্বস্তি অনুভব করে তার দাদাকে অনুযোগের সুরে কী বলায় রেগে গেল গাভ্ৰাশে। সে বলল, কী ভালো লাগছে না? তবে তুলিয়েরে বরফ আর বৃষ্টির মধ্যে শোবে? আমি কোনও রাজাউজির নই। নাকোঁদা বন্ধ করে শুয়ে পড়।

ভেতরে অনেকটা জায়গা ছিল। মাথার উপরটা কড়ি-বরগাওয়ালা ঘরের ছাদের মতো। নিচেটা মেঝের মতো। হাঁটতে পারা যায়। তার মধ্যে গাভ্রোশের বিছানা ছিল। বিছানা বলতে খড়ের তোষক আর একটা পশমি কম্বল। বেশ গরম। গাভ্রোশে আবার উপদেশ দানের ভঙ্গিতে বলতে লাগল, বাইরে এখন অন্ধকার, চাঁদ নেই আকাশে, কিন্তু এখানে আলো আছে। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে, কিন্তু এখানে বৃষ্টি নেই। বাইরে লোকের ভিড়, কিন্তু এখানে কেউ তোমাদের বিরক্ত করবে না। আর কী চাও তোমরা?

যে জায়গায় বিছানাটা পাতা ছিল সে জায়গাটা গুহার মতো, গুঁড়ি মেরে ঢুকতে হয়। দাঁড়াতে পারা যায় না। ছেলে দুটি ঢুকলে দুটো বড় পাথর মুখটার কাছে চাপিয়ে দিল যাতে বাইরে থেকে সহজে কেউ ঢুকতে না পারে। তার হাতে একটা বড় ইঁদুরের লেজ ছিল।

বড় ছেলেটি শুয়ে গাভ্রোশেকে বলল, ওটা কী জন্য?

গাভ্রোশে বলল, ইঁদুর তাড়াবার জন্য। এখন চুপ করে থাক।

গাভ্রোশে ছোট ছেলেটার গায়ের উপর কম্বলটা টেনে চাপিয়ে দিলে সে বলল, বেশ গরম।

গাভ্রোশে বলল, জার্দিন দে প্ল্যান্তে যে চিড়িয়াখানা আছে সেখানে গেলে অনেক কিছু পাওয়া যায়। সেখানে গিয়ে দেয়াল বেয়ে উঠে জানালা দিয়ে হাত বাড়ালেই হল। এই কম্বলটা বাঁদরের ঘর থেকে আর এই খড়ের তৈরি পুরু তোষকটা এনেছিলাম জিরাফের ঘর থেকে।

একটু থেমে গাভ্রোশে আবার বলতে লাগল, জন্তু-জানোয়ারদের এইসব আছে। তাদের কাছে থেকে এগুলো নিলে তারা কিছু মনে করে না। তাছাড়া দেয়াল বেয়ে উঠলে কেই-বা দেখছে, কেই-বা সরকারকে গ্রাহ্য করে।

বড় ছেলেটি বলল, তুমি পুলিশকে ভয় করো না?

পুলিশ? পুলিশকে তো আমরা বলি কপস্।

সকালে গাভ্রোশে তাদের মতো এক ভবঘুরে, নিঃস্ব এবং নিরাশ্রয় একটি বালক। হলেও ছেলে দুটির মনে হল অতিপ্রাকৃত শক্তিধারী সে এক আশ্চর্য পুরুষ। অথচ তার মুখে সব সময় হাসি লেগেই আছে।

গাভ্রোশে বলল, দেখ কেমন বিছানা। ভালো লাগছে তো?

বড় ছেলেটি বলল, খুব ভালো।

গাভ্রোশে আত্মপ্রসাদ লাভ করল। সে এবার বড় ছেলেটিকে বলল, আচ্ছা, আচ্ছা, তোমরা তখন কাঁদছিলে কেন? তোমার ছোটভাই না হয় কাঁদতে পারে, কিন্তু তুমি তো বড়, তুমি কাঁদছিলে কেন?

বড় ছেলেটি বলল, আমরা বাড়িতে ঢুকতে পাইনি। আমাদের থাকার কোনও জায়গা ছিল না।

গাভ্রোশে বলল, ঠিক আছে। আর কোনও কান্নাকাটি করবে না কখনও। এবার থেকে তোমরা আমার কাছেই থাকবে। আমি তোমাদের দেখাশোনা করব। গ্রীষ্মকালে আমি তোমাদের নদীতে স্নান করতে নিয়ে যাব। উলঙ্গ হয়ে বালির চরে ছুটে বেড়াব। ধোবানীদের বিরক্ত করব। আমি তোমাদের থিয়েটার ও অপেরাতে নিয়ে যাব। কোম্পানির সঙ্গে আমার জানা-শোনা থাকায় আমি টিকিট পাই। শ্যাম্প এলিসিতে একটা লোক আছে, তাকে জীবন্ত কঙ্কালের মতো দেখায়। আমি তোমাদের তাকে দেখাতে নিয়ে যাব। তার পর তোমাদের গিলোটিন দেখাব, যাতে ফাঁসি হয়। ঘাতক মঁসিয়ে স্যামসনকেও দেখাব।

ঝড়ের বেগ বেড়ে গেল বাইরে। মাঝে মাঝে বজ্রগর্জন হচ্ছিল। হাতির মূর্তিটার উপরে সশব্দে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো পড়ছিল। আবার একটা বজ্রগর্জন হল। ছেলে দুটো ভয় পেয়ে এমনভাবে চমকে উঠল যে তাদের পা লেগে বিছানার চারদিকে তারের জালটা ছিঁড়ে যেত আর একটু হলে। ইঁদুরের উৎপাত হতে রক্ষা পাবার জন্য তার বিছানাটা সরু তারের জাল দিয়ে ঘিরে রাখার ব্যবস্থা করে গাভ্রোশে।

গাভ্রোশে বাতির আলোটা নিবিয়ে দিতেই ইঁদুরগুলো কিচকিচ শব্দ করে ছুটে বেড়াতে লাগল। আলো থাকায় এতক্ষণ চুপ করে ছিল তারা। বড় ছেলেটি তখন নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিল। ছোট ছেলেটি বলল, মঁসিয়ে, এ কিসের শব্দ?

গাভ্রোশে বলল, বড় ইঁদুর।

আবার কিছুক্ষণ পর ছোট ছেলেটি বলল, মঁসিয়ে, আপনি বিড়াল রাখেন না কেন?

রেখেছিলাম একটা, তাকে ইঁদুরগুলো খেয়ে ফেলেছে।

আমাদের তা হলে খাবে না?

না, তারের জাল আছে। তাছাড়া আমি আছি। কোনও ভয় নেই।

এই বলে গাভ্রোশে তার একটা হাত বাড়িয়ে ছোট ছেলেটির গায়ের উপর রাখল। বড় ছেলেটি তাদের দু জনের মাঝখানে শুয়েছিল।

কথার শব্দ পেয়ে ইঁদুরগুলো একটু চুপ করে ছিল। তারা ঘুমিয়ে পড়লে ইঁদুরগুলো আবার দাপাদাপি শুরু করে দিল। কিন্তু ওদের ঘুম আর ভাঙল না।

শেষরাতের দিকে সেন্ট আঁতোনে থেকে বাস্তিলের কাছে পাহারারত পুলিশদের দৃষ্টি এড়িয়ে একজন ছুটে এসে হাতির মূর্তিটার পেটের কাছে ক্রিকিকু এই সাংকেতিক শব্দ করে ডাকতে লাগল। তা শুনে গাভ্রোশে ভেতর থেকে প্রবেশপথের কাঠ-পাথর সরিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। বলল, ঠিক আছে।

লোকটি হল মঁতপার্নেসি। সে গাভ্রোশেকে দেখে বলল, আমাদের এখন সাহায্য চাই। তুমি চলে এস।

গাভ্রোশে বলল, আমি তৈরি।

আর কোনও কথা না বলে বেরিয়ে পড়ল মঁতপার্নেসির সঙ্গে। পথে দেখল তরকারি বোঝাই কতকগুলি গাড়ি বাজারের দিকে যাচ্ছে। কেউ তাদের দিকে লক্ষ করল না।

.

৩.

সে রাতে লা ফোর্স জেলখানায় একটা ঘটনা ঘটেছিল। সেদিন বাবেত, কুঁজ, গুয়েলমার আর থেনার্দিয়ের–এই চারজন মিলে জেল থেকে পালিয়ে যাবার এক চক্রান্ত করে। বাবে সেদিন সকালেই জেল থেকে পালিয়ে যায়, মঁতপার্নেসি সেকথা গাভ্রোশেকে বলেছিল। থোর্দিয়েরকে একটা নির্জন ঘরে রাখা হয়েছিল। ব্রুজ একটা দড়ি আর পেরেক জোগাড় করে। তার সঙ্গে গুয়েলমারের দেখা হয়।

সেই সময় জেলখানার একদিকের ভাঙা ছাদটা মেরামত করা হচ্ছিল বলে তাদের পালানোর একটা সুযোগ এসে পড়ে। সেই ছাদ দিয়ে ব্রুজ পালিয়ে যায়। প্রয়েলমারও বেরিয়ে যায়। সেইদিন সকালে বাবেত আগেই জেল থেকে পালিয়ে যায়। তখন তারা মঁতপার্নেসির সঙ্গে এক চক্রান্ত করে থেনার্দিয়েরকে মুক্ত করার জন্য। তারা ঠিক করে গভীর রাতে জেলখানার ধারে গিয়ে অপেক্ষা করবে। ব্রুজ কুশলী, তার বুদ্ধি আছে, আর গুয়েলমারের শক্তি আছে। রাত্রিতে জোর বৃষ্টি নামায় ব্রুজ বলে, আজ রাতে পালাবার সুবর্ণ সুযোগ আছে। ব্রুজের হাতে একটা লম্বা মোটা দড়ি আর পেরেক ছিল। ঐজ আর গুয়েলমার বাবেত আর মঁতপার্নেসির সঙ্গে মিলিত হয়। তারা বৃষ্টির মধ্যেই জেলখানার ধারে এসে জড়ো হয়।

এদিকে থেনার্দিয়ের সে রাতে একটুও ঘুমোয়নি। তার কাছে এক বোতল মদ ছিল ঘুমের ওষুধ মেশানো। সেটা সে জেলখানার লোকদের পয়সা দিয়ে আনিয়েছিল। তার পায়ে পঞ্চাশ পাউন্ড ওজনের লোহার বেড়ি ছিল। রোজ রাত চারটের সময় একজন পাহারাদার দু জন পুলিশ নিয়ে এসে থেনার্দিয়েরকে একটা কালো পাউরুটি, একগ্লাস জল আর কিছু মদ দিয়ে যায়। দু ঘণ্টা অন্তর প্রহরী বদলি হয় রাতে। থেনার্দিয়ের ইঁদুর তাড়াবার জন্য একটা লোহার শিক কাছে রাখার জন্য অনুমতি চেয়ে নেয়।

রাত দুটোর সময় থেনার্দিয়েরের ঘরের সামনে প্রহরী বদলি হয়। আগেকার অভিজ্ঞ কড়া প্রহরীর বদলে আসে একজন যুবক বয়সী প্রহরী। দু ঘণ্টার মধ্যে দেখা যায় সেই যুবক অনভিজ্ঞ প্রহরী উপুড় হয়ে ঘুমে অচেতন হয়ে আছে তার জায়গায় আর থেনার্দিয়ের ঘরের মধ্যে নেই। কী করে সে পা থেকে লোহার বেড়ি খুলে সেই তিনতলা বাড়িটার ছাদে চলে যায়, তা কেউ বুঝতে পারেনি এবং তা ব্যাখ্যা করে বোঝানো যাবে না। যে মুক্তিকামনার প্রবলতায় বন্দির কাছে যে কোনও খাড়াই পাহাড় একটা সংকীর্ণ নালায় পরিণত হয়, লৌহকঠিন গরাদ ওঠে অশক্ত কাঠ, সাধারণ শক্তিহীন মানুষ হয়ে ওঠে কুশলী ব্যায়ামবিদ, নির্বুদ্ধিতা পরিণত হয়ে ওঠে বুদ্ধিতে, বুদ্ধি প্রতিভায়, সেই মুক্তিকামনার প্রবলতা থেনার্দিয়েরকে পেয়ে বসেছিল কি না, তা ঠিক জানা যায়নি।

থেনার্দিয়ের এক ছাদ থেকে আর এক ছাদে লাফ দিয়ে দিয়ে শেষে জেলখানার প্রাচীরের মাথায় গিয়ে হাজির হয়। প্রাচীরটা ছিল দশ ইঞ্চি চওড়া। তিনতলার সমান উঁচু। তখন তার অবস্থা হয়ে ওঠে চলৎশক্তিহীন। সে সটান শুয়ে পড়ে তার উপর। সে তখন বিমূঢ় হয়ে ভাবতে থাকে যদি আমি এর থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ি তাহলে অবশ্য আমার মৃত্যু ঘটবে আর যদি লাফ না দিয়ে এখানেই থাকি তা হলে আমি অবশ্যই ধরা পড়ব। রাত চারটের সময় প্রহরী বদল হলেই তার পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা চোখে পড়বে। তখন বিরাট হৈ-চৈ পড়ে যাবে গোটা জেলখানায়। পাগলা ঘণ্টা বেজে উঠবে। বন্দুকধারী সিপাইরা ছোটাছুটি করবে চারদিকে।

থেনার্দিয়ের যখন সব এই সাতপাঁচ ভাবছিল তখন হঠাৎ সে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল, বাইরের দিকে জেলখানার প্রাচীরের তলায় অর্থাৎ যার মাথায় সে ছিল, একে একে চারজন লোক এসে জড়ো হল। তারা চোরদের পরিভাষায় যে সব সাংকেতিক কথাবার্তা বলছিল তার কিছু কিছু তার কানে আসতেই থেনার্দিয়ের তাদের চিনতে পারল। বুঝল তারা হল ব্রুজ, বাবেত, গুয়েলমার আর মঁতপার্নেসি অর্থাৎ তার হবু জামাই।

ব্রুঁজ বলল, থেনার্দিয়ের হয়তো পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছে।

মঁতপার্নেসি বলল, বন্ধুকে বিপদে ফেলে রেখে চলে যাওয়া উচিত নয়।

তারা অনেকক্ষণ সেইখানে দাঁড়িয়ে থেকেও কোথাও থেনার্দিয়েরকে দেখতে পেল না।

থেনার্দিয়ের তাদের চিনতে পারলেও চিৎকার করে ডাকতে পারল না পাছে জেলখানার প্রহরীরা তা শুনতে পায় এই ভয়ে। তার পকেটে দড়ির একটা ছেঁড়া টুকরো ছিল। সেটা বুদ্ধি করে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য তাদের পায়ের কাছে ফেলে দিল

থেনার্দিয়ের। সঙ্গে সঙ্গে ব্রুজ বলল, এটা আমারই দড়ির একটা অংশ।

মঁতপার্নেসি তখন বলল, তা হলে হোটেলমালিক এই পাঁচিলটার উপরেই আছে। থেনার্দিয়ের তার মাথাটা বাড়িয়ে দিতেই তাদের চোখ পড়ল তার ওপর।

মঁতপার্নেসি ব্রুজকে বলল, তোমার কাছে যে দড়ি আছে তার সঙ্গে এটাকে বেঁধে যোগ করে ছুঁড়ে দাও। ও সেটা ওখানে কিছুতে জড়িয়ে দেবে।

থেনার্দিয়ের বলল, আমি ঠাণ্ডায় জমে গিয়েছি। আমার দেহ অসাড় হয়ে গেছে। আমি নড়তে পারছি না।

ব্রুঁজরা নিচেয় থেকে বলল, আমরা তোমাকে ধরে নেব। তুমি শুধু দড়ি ধরে নেমে পড়বে। তার পরই তোমার দেহটাকে তাপ দিয়ে গরম করে তুলঁব আমরা।

কিন্তু আমার হাত দুটো শীতে জমে গেছে।

দড়িটা আটকে দাও।

পারব না।

মঁতপার্নেসি বলল, আমাদের একজনকে উপরে যেতে হবে।

বাবেত বলল, কোনও বয়স্ক লোক নয়, একটা ছেলে হলে ভালো হয়।

ব্রুজ বলল, ঠিক বলেছ। একটা ছেলে চাই।

তখন মঁতপার্নেসি বলল, ঠিক আছে, আমি আনছি।

এই বলে সে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে গাভ্রোশের কাছে চলে যায়।

কিছুক্ষণের মধ্যেই গাভ্রোশেকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে মঁতপার্নেসি। গাভ্রোশে এসেই বলে, আমাকে কী করতে হবে?

মঁতপার্নেসি বলল, চিমনি দিয়ে ওই পাঁচিলটার উপর উঠে এই দড়িটা ওখানে যে একটা জানালা আছে তার সঙ্গে বেঁধে দিতে হবে।

গুয়েলমার গাভ্রোশেকে বলল, তুমি যে বাচ্চা, এই বড়মানুষের কাজটা পারবে?

গাভ্রোশে একবার সব কিছু দেখে নিয়ে এমন একটা ভাব দেখাল যাতে মনে হবে এটা তার কাছে কিছুই না। সে বলল, আমি যা পারব তা তোমাদের মতো বড় মানুষরা পারবে না।

গাভ্রোশে উঠে গিয়ে থেনার্দিয়েরের কাছাকাছি গিয়ে ভোরের আলোয় তার মুখ তার দাড়ি দেখে চিনতে পারল উপরের বন্দি লোকটি তার বাবা। তবু সে মুখে কিছু বলল না। সে তার কাজ করে নেমে এল। থেনার্দিয়েরও কয়েক মিনিটের মধ্যেই নেমে এল।

গাভ্রোশে সেইখানে একটা পাথরের উপর বসে একটু অপেক্ষা করল। তার বাবা তাকে কিছু বলে কি না তা দেখতে লাগল। কিন্তু কিছু বলল না দেখে সে উঠে বলল, এই তো, আমার আর কিছু করার নেই তো? আমি তা হলে যাচ্ছি।

থেনার্দিয়ের বলল, এবার আমরা কার মাথা খাব?

ব্রুজ বলল, র‍্যু প্লামেতে একটা কাজ আছে। সেখানে একটা বড় বাড়িতে দু জন মহিলা থাকে। বাগানের গেটটা মরচে পড়া। তোমার মেয়ে এপোনিনে বাড়িটা দেখেছে।

থেনার্দিয়ের বলল, সে বোকা নয়। যা করবার ঠিক করবে।

গাভ্রোশে চলে গেল।

অন্য সবাই বিভিন্ন দিকে চলে গেল। বাবেত থেনার্দিয়েরকে বলল, ওই ছেলেটাকে ভালো করে দেখেছ?

থেনার্দিয়ের বলল, দেখেছি বলে তো মনে হয় না।

আমার মনে হয় ও তোমার ছেলে।

সে কী! ঠিক বলছ তো?

এই বলে সেখান থেকে চলে গেল থেনার্দিয়ের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *