পঞ্চম পরিচ্ছেদ
১.
এদিকে মাসকতক আগে কসেত্তে’র মনের যে বেদনাটা তীব্র ছিল, আজ সেটা ধীরে ধীরে কমে আসতে লাগল। যৌবনের স্বাভাবিক প্রাণচঞ্চলতা, বসন্তের উন্মাদনা, তার বাবার প্রতি ভালোবাসা, পাখির গান আর ফুলের উজ্জ্বলতা এক স্নিগ্ধ বিস্মৃতির প্রলেপ বুলিয়ে দিচ্ছিল যেন তার মনের ওপর। তবে কি তার মনের মধ্যে গোপনে জ্বলতে থাকা অতৃপ্ত প্রেমের আগুনটা নিবে গিয়েছিল একেবারে, না সেটা একরাশ ছাই-এর অন্তরালে তখনও জ্বলছিল? কিন্তু সে যাই হোক, সে কোনও বেদনার আঘাত অনুভব করতে পারছিল না তার মনে। একদিন মেরিয়াসের কথাটা মনে হতেই সে ভাবল, আর আমি তার কথা ভাবি না।
কয়েকদিন পর কসেত্তে তাদের বাগানের গেটের কাছ থেকে দেখল সুদর্শন যুবকবয়সী এক অশ্বারোহী সামরিক অফিসার রাস্তা দিয়ে ঘোড়ায় চেপে যাচ্ছে। তার পোশাকটা ছিল বেশ চকচকে, মুখে মোচ, চমৎকার চুল, সুন্দর নীল চোখ, কোমরে তরবারি। তার উদ্ধত অহঙ্কারী চেহারাটা ছিল মেরিয়াসের একেবারে বিপরীত। সে তখন একটা সিগারেট খাচ্ছিল। কসেত্তে ভাবল তাদের পাড়ায় র্যু দ্য বেবিলনের ব্যারাক বা সৈন্যনিবাসে যে সেনাদল আছে ওই অশ্বারোহী যুবক সেই সেনাদলের অন্তর্গত।
পরদিন সেই নির্দিষ্ট সময়ে সেই অশ্বারোহী যুবককে দেখতে পেল কসেত্তে। তার পর থেকে রোজই সে দেখতে পেত তাকে একই সময়ে। ক্রমে সেই সেনাদলের অন্যান্য অফিসারেরাও লক্ষ করল ওই অঞ্চলে ঝোপে-ঝাড়ে ভর্তি অযত্নলালিত অব্যবহৃত একটা বাগানের মধ্যে একটি সুন্দরী তরুণী দাঁড়িয়ে থাকে ঠিক যখন তাদের লেফটেন্যান্ট থিওদুল গিলেনৰ্মাদ সেই পথে যায়।
সেই সব অফিসারেরা একদিন থিওদুলকে বলল, তোমার ওপর মেয়েটার নজর পড়েছে। থিওদুল তখন তার উত্তরে বলল, কিন্তু যেসব মেয়ে আমার দিকে তাকায় তাদের দিকে তাকাবার মতো সময় কোথায় আমার?
এদিকে মেরিয়াস তখন কসেত্তেকে দেখতে না পেয়ে গম্ভীর হতাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিল! সে শুধু তখন মনে মনে এই কথা বলছিল, মরার আগে তাকে যদি একবার দেখতে পেতাম। কিন্তু যখন কসেত্তে এই যুবক অফিসারের দিকে তাকিয়ে থাকত তখন যদি তাকে সেই অবস্থায় মেরিয়াস একবার দেখত তা হলে ঘটনাস্থলেই মারা যেত মেরিয়াস।
কিন্তু এতে দোষটা কার? কারওরই না। মেরিয়াস ছিল এমনই এক যুবক যে একবার দুঃখে পড়লে সে দুঃখকে আলিঙ্গন করে থাকে, তাকে বুকে রেখে লালন করে চলে, কিন্তু কসেত্তে দুঃখকে গভীরভাবে অনুভব করার পর তার থেকে মুক্ত করে ফেলে নিজেকে। বেশিদিন সে দুঃখের সঙ্গে জড়িয়ে রাখে না নিজেকে।
কসেত্তে’র মনের অবস্থাটা তখন ছিল কোনও নারীসত্তার পক্ষে সত্যিই বিপজ্জনক। সে মন ছিল উদ্দাম এবং বন্ধুবিহীন। আসলে নিঃসঙ্গ কোনও তরুণীর মন হচ্ছে আঙুরলতার মতোই। আঙুরলতা যেমন সামনে কোনও মর্মরমূর্তি বা কোনও পান্থশালায় স্তম্ভ বা কোনও গাছকে হাতের কাছে পেলেই তাকে জড়িয়ে ধরে, তরুণীর নিঃসঙ্গ মনও তেমনি হাতের কাছে পুরুষকে একবার ভালো লেগে গেলেই তাকে জড়িয়ে ধরতে চায়। ধনী-গরিব যাই হোক, যেসব তরুণীর মা থাকে না তাদের বিপদ আরও বেশি। ধন বা ঐশ্বর্য কাউকে কখনও কোনও ভুল-ত্রুটির হাত থেকে বাঁচাতে পারে না। অনেক সময় কোনও যুবকের সঙ্গে মিশতে গিয়ে গরমিল দেখা দেয়। দু জনের আত্মায় মিল হয় না। বাইরের চেহারা ও বেশভূষা নয়, পুরুষদের মনই হচ্ছে নারীদের আশ্রয়স্থল। অনেক সময় দেখা যায় বংশগৌরবহীন এক অচেনা অজানা যুবক বাইরে নিঃস্ব হয়েও অন্তরের দিক থেকে কত উন্নত চিন্তা ও ভাবসম্পদে পরিপূর্ণ, এক মর্মরমূর্তির মতোই প্রস্তরকঠিন এক দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত তার চরিত্রগৌরব, অথচ আবার কোনও বিত্তবান ঐশ্বর্যবান যুবককে বাইরে দেখতে যা-ই মনে হোক, অন্তরের দিক থেকে কত নিঃস্ব, কত দীনহীন সে; কত সব হিংস্র চিন্তাভাবনা আর উদ্ধত আবেগ আর অনুভূতিতে সে অন্তর কত পরিপূর্ণ–যেন আঙুরলতার দ্বারা আলিঙ্গিত যে কোনও পান্থশালার কাষ্ঠস্তম্ভ।
কিন্তু কসেত্তে’র অন্তরের অবস্থাটা সত্যি সত্যিই কেমন ছিল? আসলে তার প্রেমাবেগটা যেন তখন ঘুমিয়ে ছিল তার অন্তরের গভীরে। তার অন্তরের উপর দিকে কিছু তরল আবেগের অশান্ত অস্থির চঞ্চলতা থাকলেও তার প্রকৃত প্রেমসত্তাটি এক গভীরতর প্রদেশে স্তব্ধ হয়ে ছিল এক প্রশান্ত গাম্ভীর্যে। সেই সুদর্শন যুবক অফিসারের কথাটা সে তার মনের উপরিপৃষ্ঠে ভাবলেও তার সে মনের গভীরে কি মেরিয়াসের স্মৃতিটার তখনও কিছু অবশিষ্ট ছিল? সে হয়তো নিজেই তা জানত না।
এমন সময় একটা বিশেষ ঘটনা ঘটল।
.
২.
সেবার এপ্রিল মাসের প্রথম পক্ষে একবার অল্প কিছুদিনের জন্য বাইরে বেড়াতে গেল ভুলজা। আমরা জানি ভলজাঁ মাঝে মাঝে এমনি করে দু তিন দিনের জন্য বাইরে যেত। কিন্তু কোথায় কী জন্য যেত তা কসেত্তে জানত না। সেদিন ভলজাঁ যাবার সময় বলে গেল তার ফিরতে দু দিন কি তিন দিন দেরি হবে। এবার সে একটা গাড়িতে করে কসেত্তেকে নিয়ে লা প্ল্যানশের পর্যন্ত গেল। তার পর গাড়ি থেকে নেমে সে কোথায় চলে গেল। গাড়িটা কসেত্তেকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এল। সংসারখরচের টাকাপয়সায় টান পড়লেই ভলজাঁ এইভাবে চলে যেত মাঝে মাঝে।
ভলজাঁ চলে যেতে কসেত্তে সন্ধ্যাটা তার ঘরেই একা একা কাটাত। একঘেয়েমিটা কাটাবার জন্য এক একসময় সে পিয়ানো-অর্গানটা বাজিয়ে গান করত। গান শেষ করে ভাবত সে।
একদিন সন্ধ্যার সময় হঠাৎ সে বাগানে কার পদশব্দ শুনতে পেল।
তখন রাত্রি দশটা বাজে। তার বাবা তখন বাড়িতে ছিল না এবং তুস তখন শুয়ে পড়েছে। কসেত্তে একটা বন্ধ জানালার ধারে গিয়ে কান পেতে শব্দটা শোনার চেষ্টা করল।
সেই পদশব্দ শুনে কসেত্তে বুঝল কেউ খুব ধীর পায়ে আসছে। কসেত্তে এবার তার শোবার ঘরে ছুটে গিয়ে বন্ধ জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে দৃষ্টি চালিয়ে দেখতে লাগল। সেদিন ছিল জ্যোত্মারাত। পূর্ণ চাঁদের আলোয় সব কিছু দেখা যাচ্ছিল।
কিন্তু কোনও লোককে দেখতে পেল না কসেত্তে। সে জানালাটা খুলে দিল। দেখল বাগানে কোনও লোক নেই। গেটের ওপারে রাস্তাটাও একেবারে জনশূন্য।
কসেত্তে ভাবল, আসলে ওটা কারও পদশব্দ নয়, তার মনের ভুল। সে ওয়েবার রচিত যে কোরাস গানটা গেয়েছে একটু আগে সেই গানের দ্বারা সৃষ্ট এক ভয়াবহ আবেশ থেকেই এ ধারণা হয়েছে। সে গান শুনে শ্রোতাদের মনের মধ্যে এমন এক ভয়াল মায়াময় অরণ্যের ছবি ভেসে ওঠে যেখানে ঘনায়মান সন্ধ্যার অন্ধকার অদৃশ্যপ্রায় শিকারিদের পায়ের দ্বারা দলিত পাতা আর হাত দিয়ে ডালপালা ভাঙার এক ভুতুড়ে শব্দ হয়।
পরদিন গোধূলিবেলায় সন্ধ্যার কিছু আগে একা একা বেড়াচ্ছিল কসেত্তে। তার মনে সাহসের অভাব ছিল না। ভবঘুরে জীবনের অনেক অভিজ্ঞতা আছে তার জীবনে। সে কপোত নয়, সত্যিই সে লার্ক। লার্ক পাখির মতোই দূর আকাশের অনিশ্চিত অজানা শূন্যতায় অনেক ঘুরে বেড়িয়েছে সে। সে যখন বেড়াতে বেড়াতে এলোমেলোভাবে চিন্তা করছিল তখন তার কেবলি মনে হচ্ছিল কে যেন বাগানের মধ্যেই তার আশেপাশে গাছের গুঁড়ির আড়ালে চলাফেরা করছে সতর্কিত পদক্ষেপে। গতকাল রাতে যে পদশব্দ শুনেছিল এ শব্দ ঠিক তেমনি। আবার ভাবল, হাওয়ায় গাছের ডালে ডালে ঘর্ষণের ফলেই হয়তো এ শব্দ হচ্ছে।
বাগান থেকে বেরিয়ে বাড়িতে ফিরে আসার জন্য সে যখন উঠোনটা পার হচ্ছিল তখন হঠাৎ ভয়ে চমকে উঠল সে। তার নিজের ছায়ার পাশে আর একটা মানুষের ছায়া দেখল সে। সে ছায়ামূর্তির মাথায় ছিল একটা টুপি। মূর্তিটা তার পেছনে কয়েক পা দূরে তারই দিকে এগিয়ে আসছিল।
চলতে চলতে থেমে গেল কসেত্তে। ছুটে পালাল না বা ভয়ে চিৎকার করল না। স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে তার অনুসরণকারী ছায়ামূর্তিটাকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু আশ্চর্য! কাউকে দেখতে পেল না। সে আবার বাগানে ফিরে গিয়ে সাহসের সঙ্গে খোঁজ করতে লাগল। কিন্তু এবারও কাউকে দেখতে পেল না। তবে কি গতকালকার মতো এটাও তার মনের ভ্রান্তি! আবার এটা ভূতও নয়; ভূতেরা কখনও গোল টুপি পরে না মাথায়।
পরদিনই বাড়ি ফিরে এল ভলজাঁ। সে এলে তাকে এ কথাটা বলল কসেত্তে। সে বলল, বোকা মেয়ে কোথাকার! মুখে এ কথাটা বললেও মনে মনে কিছুটা বিচলিত হয়ে উঠল সে।
ভলজাঁ তখনি বাগানে গিয়ে গেটটা ভালো করে পরীক্ষা করল। কিন্তু দেখল সেটা ঠিকই আছে।
সে রাতে মোটেই ঘুমোল না কসেত্তে। সারারাত জানালার ধারে বসে জেগে কাটাল। এক সময় আবার সেই পদশব্দটা শুনতে পেল।
বদ্ধ জানালার ফুটোটার ভেতর দিয়ে সে দেখল বাগানের মধ্যে একটা লোক মোটা একটা লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। কসেত্তে ভয়ে চিৎকার করতে যাচ্ছিল এমন সময় এক ঝলক চাঁদের আলো লোকটির উপর পড়তেই সে দেখল তার বাবা। বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল কসেত্তে। ভাবল, তার বাবা কথাটা শুনে খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছে।
কসেত্তে রাত্রিবেলায় তার ঘরের জানালার ফুটো দিয়ে দেখল পর পর দুটো রাত ভজ জেগে বাগানে ও বাড়ির সারা উঠোনটায় পাহারা দিয়ে কাটাচ্ছে।
তৃতীয় রাত্রিতে রাত্রি প্রায় একটার সময় হঠাৎ তার বাবার ডাকে ঘুম ভেঙে গেল কসেত্তে’র। তার বাবা উঠোন থেকে এক উচ্চ হাস্যরোলের সঙ্গে তার নাম ধরে ডাকছে। বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে ড্রেসিং গাউনটা পরে জানালার ধারে গিয়ে জানালাটা খুলে দাঁড়াল। দেখল তার বাবা উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। তার বাবা তাকে বলল, আমি তোমাকে ডাকছিলাম এই জন্যে যে সব ঠিক আছে। ওই ছায়াটার দিকে তাকিয়ে দেখ।
এই বলে সে পাশের বাড়ির একটা চিমনির ছায়া দেখাল যে ছায়াটা উঠোনের ঘাসের উপর পড়েছে এবং সেটা দেখতে টুপিপরা একটা লোকের মতো দেখাচ্ছে।
কসেত্তেও হাসতে লাগল। পরদিন সকালে প্রাতরাশ খাবার সময় ক’দিন আগে দেখা সেই ভুতুড়ে ছায়াটা সম্বন্ধে হাসাহাসি করতে লাগল দু জনে। সে আর এ নিয়ে ভাবল না। সে ভেবে দেখল না সে সেদিন যখন ছায়াটা দেখে তখন চাঁদ আকাশে আজকের মতো এই একই জায়গায় ছিল কি না এবং সে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলো ছায়াটা কেন সরে যায় সেখান থেকে। মোট কথা, বাগানে সেদিন কোনও অচেনা লোক বাইরে থেকে ঢুকেছিল এই ধরনের চিন্তাটা সে সরিয়ে দিল তার মন থেকে।
কিন্তু দিনকতক পর আবার একটা ঘটনা ঘটল।
.
৩.
বাগানে রাস্তার দিকের রেলিং-এর ধারে পাথরের একটা বসার জায়গা ছিল। সেটা রাস্তা থেকে রেলিং-এর ভেতর দিয়ে হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া যেত। একদিন সন্ধ্যার সময় কসেত্তে সেখানে একা একা বসে ছিল। ভলজাঁ তখন বাড়িতে ছিল না। কোথায় বেড়াতে বেরিয়েছিল। পাথরের বেঞ্চটার পাশে একটা ঝোঁপ ছিল। তখন এপ্রিল মাস। কসেত্তে তখন সন্ধ্যায় তার মার কথা ভাবছিল। তার মনে হচ্ছিল তার মা’র প্রেতাত্মা এই বাগানের ছায়ার মধ্যে কোথায় যেন অদৃশ্য অবস্থায় লুকিয়ে আছে।
স্নিগ্ধ শীতল বাতাস বইছিল। শিশিরভেজা ঘাসের উপর দিয়ে বাগানটায় ঘুরে ঘুরে পায়চারি করে বেড়াতে লাগল। সে ভাবল আরও মোটা জুতো না পরলে তার ঠাণ্ডা লাগবে। তার সর্দি হবে।
এরপর আবার সেই পাথরের বেঞ্চের উপর বসল কসেত্তে। বসতে গিয়ে তার চোখ পড়ল তার সামনে একটা বড় পাথর পড়ে রয়েছে, অথচ এ পাথর কিছুক্ষণ আগেও ছিল না। পাথরটা নিশ্চয় নিজে থেকে এখানে আসেনি, কেউ সেটা বাইরে থেকে এনেছে। কিন্তু দেখার সঙ্গে সঙ্গেই সত্যিই ভয় পেয়ে গেল সে। পাথরটার বাস্তবতা সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নেই তার। কিন্তু পাথরটাকে সে ছুঁল না। সে ছুটে তার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। বাগানের দিকের বাড়ির দরজাটাও তার আগে বন্ধ করে দিয়ে এসেছে। সে তুসাঁকে বলল, বাবা ফিরে এসেছেন?
এখনও আসেননি ম্যাদময়জেল।
ভলজাঁ যেদিন নৈশভ্রমণ করতে যায় সেদিন ফিরতে রাত হয় তার।
কসেত্তে বলল, ঘরের জানালাগুলো বিশেষ করে বাগানের দিকের জানালা-দরজাগুলো ঠিকমতো বন্ধ করে দাও তো? ঠিকমতো খিলগুলো এঁটে দাও তো?
তুঁসা বলল, অবশ্যই ম্যাদময়জেল। কসেত্তে জানত না এ কর্তব্যে কোনওদিন অবহেলা করে না তুসা।
কসেত্তে বলল, জায়গাটা বড় নির্জন।
তুঁসা বলল, কথাটা সত্যি। বিশেষ করে মঁসিয়ে যখন বাড়িতে থাকেন না তখন আমাদের খুবই ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। কেউ আমাদের খুন করলেও কেউ দেখবার নেই। রাত্রিবেলায় হঠাৎ উঠে হয়তো দেখবে ঘরে একজন লোক ঢুকে আছে। তুমি চিৎকার করলে হয়তো তোমার গলা কেটে ফেলবে।
কসেত্তে বলল, তালাচাবি সব ঠিক আছে তো?
সে রাতে এত ভয় পেয়ে গিয়েছিল কসেত্তে যে সে তুসাঁকে বাগানে পাথরটাকে দেখে আসতে পর্যন্ত বলল না। সারা বাড়িটার দরজা-জানালাগুলোর খিল-কপাট ঠিকমতো বন্ধ করা হয়েছে কি না, তা ভালো করে দেখে নিয়ে শুতে গেল কসেত্তে। কিন্তু সে রাতে ঠিকমতো ঘুম হল না।
পরদিন সকালে রোদ উঠতে তার মনে হল হয়তো সেদিনের সেই পদশব্দ শোনার মতো এটাও এক ভ্রান্তি। রাত্রির ভয় দিনের আলোতে উবে গেল। তবু কিছুটা বেলার পর বাগানে গিয়ে সেই পাথরটাকে একবার দেখতে গেল কসেত্তে। পাথরটা বড়, তবু দিনের আলোতে সাহস পেয়ে পাথরটা সরাবার চেষ্টা করল সে। পাথরটা সরাতেই তার তলায় খামেভরা একটা চিঠি দেখতে পেল। খামটার উপর কোনও ঠিকানা লেখা নেই আর আঁটাও নেই। খামটা খুলে তার ভেতর ভাঁজ করা কাগজটা খুলে পড়তে লাগল কসেত্তে। আর কোনও সাধারণ কৌতূহল নয়, এবার একটা আশঙ্কা দানা বেঁধে উঠল তার মনে। কিন্তু দেখল কাগজ নয়, একটা ছোট নোটবই। সেই নোটবইটাতে বিভিন্ন দিনে সুন্দর হস্তাক্ষর লিখিত কয়েকটি করে ছত্র রয়েছে। কিন্তু সে অনেক খুঁজেও যার লেখা তার কোনও নাম খুঁজে পেল না। কসেত্তে উজ্জ্বল আকাশটার পানে তাকাল। বাগানের অ্যাকেসিয়া ফুলগুলোকে একবার দেখল। মাথার উপর একটা বাড়ির ছাদে একদল পায়রা কূজন করছিল, কিন্তু সব কিছুর থেকে চোখ দুটো সরিয়ে এনে নোটবইটার উপর নিবদ্ধ করল সে। সে বুঝল যে-ই লিখুক এগুলো নিশ্চয় তার জন্য লেখা হয়েছে, কারণ এটা তারই জন্য তার বাগানে এনে রাখা হয়েছে। সুতরাং এগুলো অবশ্যই পড়ে দেখতে হবে।
.
৪.
কসেত্তে পড়ে দেখতে লাগল।
সমগ্র বিশ্ব একটি আত্মার মধ্যে এসে কেন্দ্রীভূত হয়েছে এবং সেই আত্মা প্রসারিত হতে হতে ঈশ্বরের কাছ পর্যন্ত চলে গেছে এই আত্মাই হল প্রেম।
প্রেম হচ্ছে নক্ষত্রমণ্ডলের প্রতি দেবদূতদের অভিবাদন।
অতৃপ্ত প্রেম অন্তরকে বিষাদে কত আচ্ছন্ন করে তোলে।
যে প্রেমময় আত্মা সারা জগৎকে পরিব্যাপ্ত করে আছে, সে আত্মার অনুপস্থিতিতে কী বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়। প্রিয়তমাই ঈশ্বরে পরিণত হয় একথা কত সত্য। ঈশ্বর এই জগতের সব বস্তু আত্মার জন্যই সৃষ্টি করেছেন আর সেই আত্মা সৃষ্ট হয়েছে প্রেমের জন্য।
লিলাক ফুলে সজ্জিত টুপির নিচে মিষ্টি মুখের সামান্য একফালি হাসি আমাদের আত্মাকে স্বপ্নের এক সৌধচূড়ায় পাঠিয়ে দিতে পারে।
সব বস্তুর আড়ালে ঈশ্বর আছেন লুকিয়ে। সব জড়বস্তু কালো, মানুষ এমনই এক বস্তু যা অস্বচ্ছ–এদের কারওর মধ্যে দিয়ে ঈশ্বরকে দেখা যায় না। কোনও মানুষকে ভালোবাসা মানেই তাকে স্বচ্ছ করে তোলা।
এমন কিছু চিন্তা আছে, যা প্রার্থনা ছাড়া আর কিছুই নয়। এমন কিছু মুহূর্ত আসে যখন আমাদের দেহ যে ভঙ্গিতেই থাক না কেন, আমাদের আত্মা যেন নতজানু হয়ে প্রার্থনা করে।
বিরহী প্রেমিকরা অসংখ্য কল্পনার প্রলেপ দিয়ে তাদের বিচ্ছেদবেদনার উপশম করার চেষ্টা করে। তারা তখন পরস্পরকে চিঠি লিখতে না পারলেও তারা তাদের প্রেমাস্পদের কাছে পাখির গান, ফুলের গন্ধ, শিশুর কলহাসি, সূর্যের আলো, বাতাসের দীর্ঘশ্বাস, নক্ষত্রগুলোর জ্যোতি বিশ্বসৃষ্টির সকল সৌন্দর্যের উপাদান দিয়ে তাদের প্রেমের উপাসনা করে তারা। ঈশ্বরের সকল সৃষ্ট বস্তুই প্রেমের সেবা করার জন্যই সৃষ্ট হয়েছে। সকল বস্তুকে রূপান্তরিত করার মতো শক্তি প্রেমের আছে।
হে বসন্ত, তুমিই আমার চিঠি হয়ে তার কাছে যাও।
অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সমন্বয়ে কালের যে অনন্তত্ব সে অনন্তত্বের সব ফাঁক সব শূন্যতা একমাত্র প্রেমই পূরণ করে দিতে পারে। অনন্তত্বের মতো প্রেমও অফুরন্ত।
প্রেম ও আত্মার প্রকৃতি একই। আত্মার মতোই প্রেমও এক স্বর্গীয় জ্যোতি, অনাবিল, অবিভাজ্য ও অক্ষয়। এক আগ্নেয় লিঙ্গের মতো অমর অনন্ত এই প্রেম আমাদের অন্তরে বাস করে। কোনও পার্থিব শক্তি তাকে সীমাবদ্ধ, খণ্ডিত বা তার আগ্নেয় তেজকে নির্বাপিত করতে পারে না। এই প্রেমের উত্তপ্ত জ্যোতিকে আমাদের অস্থিমজ্জায় অনুভব
করে পারি না আমরা; তার উজ্জ্বলতা মর্ত্যলোক হতে প্রসারিত হয়ে চলে যায় সুদূর স্বর্গলোকের গভীরে।
হে আমার প্রেম, দুটি অন্তর্ভেদী দৃষ্টির সম্মিলিত উপাদানে গড়া দুটি আত্মার এক বিশুদ্ধ আবেগ, আমার উপাস্য দেবতা, তুমি কি আসবে না আমার জীবনে? আমার বহু আকাক্ষিত সুখকে কি সম্ভুত করে তুলঁবে না আমার জীবনে? আমরা দু জনে নির্জনে কত বেড়াব, কত উজ্জ্বল সুখের দিন উপভোগ করব! দেবদূতের পাখা থেকে ঝরে পড়া কয়েকটি বিরল মূহূর্ত সমৃদ্ধ করে তুলঁবে আমাদের দুজনের জীবনকে।
প্রেমিক-প্রেমিকার মিলনের আনন্দকে শুধু দীর্ঘায়িত করা ছাড়া ঈশ্বর তাদের আর কোনও উপকার করতে পারেন না। প্রেম মানুষের আত্মাকে যে অবিচ্ছিন্ন সুখের নিবিড়তা দান করে তা ঈশ্বরেরও অসাধ্য। ঈশ্বর স্বৰ্গকে পূর্ণতা দান করেন, প্রেম পূর্ণতা দান করে মানুষের জীবনকে।
আমরা নক্ষত্রের দিকে তাকাই প্রধানত দুটো কারণে। একটা কারণ এই যে তা কিরণ দান করে, আর একটা কারণ তা দুর্গম রহস্যময়। কিন্তু আমাদের পাশে যে নারীকে পাই তার জ্যোতি নক্ষত্রের জ্যোতির থেকে কম হলেও তার রহস্যময়তা আরও বেশি।
বাতাস না হলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যাই আমরা। কিন্তু প্রেমের অভাবে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়ে আমাদের আত্মা।
প্রেম যখন দুটি ভিন্ন জীবনের ধাতুকে বিগলিত ও বিমিশ্রিত করে এক সুমহান ঐক্যবোধে উন্নীত করে, একমাত্র তখনি জীবনের আসল রহস্যটি ধরা পড়ে। প্রেম হচ্ছে একই ভাগ্যের দ্বারা চালিত দুটি জীবনের এক মিলিত সত্তা, একই আত্মার দুটি পাখা। প্রেম মানেই আত্মার পাখায় ভর দিয়ে আকাশ পরিক্রমা করে বেড়ানো।
যেদিনই কোনও নারী তোমার পাশ দিয়ে যেতে যেতে তার চোখের আলো অথবা মুখের হাসি দান করবে তোমাকে সেদিনই নিজেকে হারিয়ে ফেলবে তুমি, তুমি প্রেমে পড়ে যাবে তার। তোমার সমস্ত চিন্তাশক্তিকে তোমার প্রেমাস্পদের ওপর এমনভাবে কেন্দ্রীভূত করবে যে সে তোমার কথা ভাবতে বাধ্য হবে।
প্রেম যা শুরু করে, একমাত্র ঈশ্বরই তা সম্পন্ন করতে পারেন।
কোনও একটি হারানো দস্তানা বা রুমাল পেয়ে প্রেমিকা হতাশায় ডুবে যেতে পারে অথবা আবেগের তরঙ্গদোলায় দুলতে পারে। তবে প্রেমের অনন্তত্বের জন্য চাই অন্তহীন দুর্মর আশা। প্রেম অণু থেকেও ক্ষুদ্রতর ও মহৎ হতে মহত্তর দুটি উপাদানে গড়া।
যদি পাথর হও তো চুম্বনের মতো আকর্ষণশক্তিসম্পন্ন হও, যদি গাছপালা হও তা হলে প্রাণচঞ্চলতায় ফেটে পড়; আর যদি মানুষ হও তা হলে প্রেমময় হয়ে ওঠ।
প্রেম কখনও তৃপ্ত হয় না। প্রেমিকরা সুখ পেলে চায় স্বর্গোদ্যান আর স্বর্গলাভ করতে চায় ঈশ্বর।
প্রেমের মধ্যেই আছে সব কিছু। প্রেমের মধ্যেই আছে স্বর্গের সুখ। মর্ত্যের দুঃখ আর অনাবিল দেহতৃপ্তির আবেগ।
‘সে কি এখনও লুক্সেমবুর্গ বাগানে বেড়াতে যায়?’…’না মঁসিয়ে’… ‘এই গির্জায় কি সে উপাসনা করতে আসে?’… ‘সে এখানে আর আসে না’…’সে কি বাড়িতে থাকে?’…’না, সে অন্যত্র চলে গেছে’…‘কোথায় গেছে তারা?’…‘তা তো বলে যায়নি।’
নিজেরই আত্মার ঠিকানা না জানাটা কত দুঃখের।
প্রেমের কিছু শিশুসুলভ দিক আছে। অন্য সব আবেগের কতকগুলি ক্ষুদ্রতা বা নীচতা আছে। যে আবেগ আমাদের ক্ষুদ্র করে তোলে তা লজ্জার বস্তু; তাকে আমরা ধিক্কার দিই; কিন্তু যে প্রেম আমাদের শিশুর মতো সরল করে তোলে তাকে জানাই শ্রদ্ধা।
একটা আশ্চর্যজনক ব্যাপার ঘটে গেছে, তুমি সেটা জান কী? আমি অন্ধকারে ডুবে আছি। একজন আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাবার সময় আমার জীবনের সূর্যটা নিয়ে গেছে।
হায়, এক সমাধিগর্ভের ভেতরে দু জনে পাশাপাশি শুয়ে থাকাটাই আমার কাছে অনন্তত্ব। জানি, প্রেমের জন্য কষ্ট পাচ্ছ তুমি, তবু ভালোবেসে যাও। প্রেমের জন্য মৃত্যুবরণ করা মানেই অমর হয়ে থাকা।
প্রেম! আলো আর অন্ধকারের মিশ্রিত উপাদানে গড়া জীবনের এক অদ্ভুত রূপান্তর, যা বেদনার মাঝেও এনে দেয় আনন্দের এক গভীর আবেগ।
পাখিরা কত সুখী! তাদের বাসা আছে বলেই কণ্ঠে গান আছে তাদের।
প্রেম হচ্ছে স্বর্গ থেকে বয়ে আনা এক মুক্ত বাতাস।
জীবন মানেই ভাগ্যনির্দিষ্ট এক অজানিত পরিণতির পথে শত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে এগিয়ে চলা। মানুষ যতদিন বেঁচে থাকে ততদিন সে জীবনের সব কিছুর মধ্যে অনন্ত বা অসীমকে দেখে; মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই সব অনন্ত শান্ত হয়ে যায়। শেষ বা সীমা বলে যদি কিছু থাকে তা হলে মানুষ তা একমাত্র মৃত্যুতেই দেখতে পারে। ভালোবেসে দুঃখ বরণ করে যাও। আশা ত্যাগ করো না কখনও। যারা শুধু দেহকে ভালোবাসে, রূপ আর চেহারাকে ভালোবাসে, মৃত্যু এসে সে সব কেড়ে নেয় তাদের কাছ থেকে। তাই আত্মাকে ভালোবেসে যাও তুমি, যা কেউ কেড়ে নিতে পারবে না কোনওদিন।
আমি পথে একজন গরিব কপর্দকহীন প্রেমিককে দেখলাম। তার টুপিটা পুরনো, জামা জীর্ণ। তার জুতোর ভেতরে কাদা ঢুকছে, কিন্তু পবিত্র নক্ষত্রলোকে পরিপ্লাবিত হচ্ছে তার আত্মা।
ভালোবাসা পাওয়াটা আশ্চর্যের ব্যাপার হতে পারে, কিন্তু ভালোবাসতে পারাটা মহত্তর ব্যাপার। ভালোবাসার আবেগই মানুষকে প্রকৃত বীরত্ব দান করতে পারে। প্রেমাবেগসমৃদ্ধ কোনও আত্মাই যা কিছু অপবিত্র ও ক্ষুদ্র তাকে প্রত্যাখ্যান করে ত্যাগ করে যা কিছু পবিত্র ও মহান তাকে বরণ করে নিতে পারে। কোনও হীন অশুভ চিন্তা তখন তার মনে বাসা বাঁধতে পারে না, হিমবাহের মধ্যে যেমন কোনও কাঁটাগাছ জন্মাতে পারে না। চিরপ্রশান্ত যে মহান আত্মা পৃথিবীর যত সব দুঃখবেদনার আবেগানুভূতি, ঘৃণা, মিথ্যাচার, অহঙ্কার থেকে মুক্ত হয়ে অরণ্যচ্ছায়ার প্রান্তভাগ ছাড়িয়ে মেঘমালার সীমা অতিক্রম করে সুদূর আকাশমণ্ডলের গভীরে বিরাজ করে, সে আত্মা কখনও মর্ত্যলোকের ভাগ্যচক্রের লীলাচঞ্চলতাকে অনুভব করতে পারে না, যেমন কোনও পর্বতশৃঙ্গ ভূমিকম্পকে অনুভব করতে পারে না।
যে কখনও সূর্যকে ভালোবাসেনি, কখনও কোনওভাবে উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারে না তার জীবন।
.
৫.
চিঠিটা ক্রমশই ভাবিয়ে তুলঁতে লাগল কসেত্তেকে। চিঠিটা পড়া তার শেষ হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই সেই অশ্বারোহী অফিসার ঘোড়ায় চড়ে বাগানের গেটটার পাশ দিয়ে চলে গেল। রোজ এই সময়েই সে যায়। আজ তাকে দেখে ঘৃণায় নাকটা কুঞ্চিত হয়ে উঠল তার।
নোটবই-এর পাতাগুলো নেড়েচেড়ে দেখল কসেত্তে। হাতের লেখাটা বেশ ভালো। তবে কালিটা বিভিন্ন পাতায় বিভিন্ন রকমের দেখা যাচ্ছে কোথাও ঘন কালো, কোথাও কালিটা পাতলা। সব কিছু পড়ে তার মনে হল যে এসব লিখেছে সে ভাবনা-চিন্তা করে সাজিয়ে-গুছিয়ে কিছু লেখেনি, মন থেকে ঝড়ে পড়া এলোমেলো চিন্তাগুলো আবেগের সঙ্গে লিখে ফেলেছে সে। এ ধরনের পাণ্ডুলিপি জীবনে এর আগে কখনও পড়েনি কসেত্তে। প্রতিটি ছত্রই এক অপূর্ব ঐশ্বর্যে মণ্ডিত হয়ে তার চোখের সামনে ভাসছিল। সেই দুর্বোধ্য লেখাগুলোর সব অর্থ সে বুঝতে না পারলেও সে লেখা এক নতুন চেতনা, এক নতুন উপলব্ধি এনে দিচ্ছিল তার অন্তরে। সে কনভেন্টে ছাত্রী থাকাকালে তার শিক্ষিকারা আত্মা সম্বন্ধে অনেক কিছু বলেছে; কিন্তু তারা কখনও পার্থিব প্রেম-ভালোবাসার কথা বলেনি। এ যেন আগুনে কয়লা ফেলার হাতাটার কথা না বলে আগুনের কথা বলা। এই পনেরো পাতার লেখাটা আলোকিত এক নতুন জগতের পথ খুলে দিল যেন। প্রেমের স্বরূপ ও দুঃখবেদনা, জীবন, ভাগ্য, অনন্ত, আদি, অন্ত –এই সব কিছুর অর্থ নতুন করে তলিয়ে দেখতে লাগল সে। এই লেখাগুলোর অন্তরালে লেখককে যেন দেখতে পাচ্ছে। তার আবেগপ্রবণ, উদার, সরল প্রকৃতি, আর বিরাট দুঃখ এবং বিরাট আশা প্রতিটি ছত্রে মূর্ত হয়ে উঠেছে। তার বন্দি অন্তরের মাঝে এক গভীর আবেগ ঢেউ খেলে খেলে যাচ্ছে। এই পাণ্ডুলিপিটা চিঠি ছাড়া আর কী? অথচ কোনও নাম-ঠিকানা নেই, তারিখ বা স্বাক্ষর নেই। চিঠিটা জরুরি, কিন্তু কোনও দাবি নেই। অথচ, এর প্রতিটি কথা সত্য; সত্যের উপাদানে রচিত রহস্যময় এক ধাঁধাপাখাওয়ালা কোনও দেবদূতের দেওয়া যেন এক অভ্রান্ত প্রেমের নিদর্শন, যা কোনও কুমারী পড়বে। এতে মিলনের সংকেত আছে, কিন্তু সারা পৃথিবীর মধ্যে সে মিলনের কোনও স্থানের নির্দেশ নেই। কোনও এক প্রেতের হাতে লেখা এক ভুতুড়ে চিঠি, যা কোনও কাল্পনিক এক কুমারীর উদ্দেশ্যে লিখিত হয়েছে। এক শান্ত অথচ আবেগপ্রবণ এক অচেনা ব্যক্তি মৃত্যুর মাঝে দাঁড়িয়ে তার প্রিয়তমার কাছে মানুষের ভাগ্যনির্দিষ্ট পরিণতি এবং জীবন ও প্রেমের এক রহস্যকে তুলে ধরেছে। সে যেন এক পা সমাধির মধ্যে রেখে একটা আঙুল আকাশের পানে তুলে ধরে এই চিঠি লিখেছে। কাগজের উপর যে ছত্রগুলো লেখা হয়েছে। তা যেন আত্মা থেকে কতকগুলি বৃষ্টিফোঁটার মতো ঝরে পড়েছে।
কিন্তু এ চিঠি কোথা থেকে এসেছে? এর লেখক কে? এ চিঠি নিশ্চয় কোনও পুরুষের কাছ থেকে এসেছে। এ চিঠি পড়তে পড়তে যেন কসেত্তের চোখে দিনের উজ্জ্বল আলো ফুটে উঠল। তার সব দুঃখ দূর হয়ে গেল। এক অনির্বচনীয় আনন্দ আর বেদনার ঢেউ খেলে যেতে লাগল তার অন্তরে। এ হল সেই যুবক, যে এখানে এসেছিল। ঝোঁপের ধারে তার হাতটা এগিয়ে এসেছে। কসেত্তে যখন তাকে ভুলে গিয়েছিল, তখন সে তাকে খুঁজে বার করেছে। কিন্তু সে কি সত্যি সত্যিই ভুলে গিয়েছিল তাকে কখনই না। সে যে ভুলে। গেছে–এই কথাটা ক্ষণিকের জন্যও পাগলের মতো বিশ্বাস করেছিল। সে তাকে প্রথম থেকেই ভালোবেসে এসেছে। তার প্রেমের আগুনটা স্তিমিত হতে হতে নিবে গিয়েছিল হয়তো। কিন্তু এখন বুঝল সে আগুন নিবে যায়নি একেবারে, বরং সে আগুন তার অন্তরের গভীরে আরও প্রবলভাবে জ্বলে এসেছে এবং সে আগুন আজ এই মুহূর্তে আবার বাইরে ফেটে পড়েছে। সে আগুনের শিখায় তার সমগ্র সত্তা আলোকিত হয়ে উঠেছে। অপর একটি আত্মা থেকে একটি জ্বলন্ত দেয়াশলাইয়ের কাঠি অকস্মাৎ যেন তার আত্মার মধ্যে এসে পড়ে। তাতে তার সেই আপাত নির্বাপিত আগুনটা জ্বলে ওঠে। নোটবইয়ে লেখা শব্দগুলোর দিকে তাকিয়ে কসেত্তে মনে মনে বলে উঠল, আমি তাকে কত ভালো করে চিনি, এই সব কথা আমি আগেই তার চোখের দৃষ্টিতে পড়েছি।
পর পর তিনবার চিঠিটা পড়া শেষ হতেই কসেত্তে পাথরের উপর কার জুতোর শব্দে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল লেফটেন্যান্ট থিওদুল গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তাকে দেখে কসেত্তে’র মনে হল লোকটা মোটা, দেখতে খারাপ, বেয়াদব, আর ঘৃণ্য। তাকে কোনও একটা কিছু ছুঁড়ে মারার ইচ্ছা হল তার।
বাগান থেকে তখনি বাড়ির ভেতরে চলে এল কসেত্তে। শোবার ঘরে ঢুকে নোটবইটা আবার পড়ল সে। সেটা যেন মুখস্থ করে ফেলল। তার কথা ভাবতে লাগল। অবশেষে সে নোটবইটা চুম্বন করে তার পোশাকের ভেতর বুকের মাঝে লুকিয়ে রাখল। সব কিছু স্থির করে ফেলল সে। সে আবার অতৃপ্ত প্রেমের এক গভীরতার আবেগের গভীরে ডুবে গেল। স্বর্গীয় সুখের এক অন্তহীন দিগন্তু আবার উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তার সামনে।
সেদিন থেকে দিনরাত কী ভাবতে লাগল কসেত্তে। কিন্তু কিছুই চিন্তা করত না, শুধু অজস্র কল্পনা ভিড় করে আসতে লাগল তার মনে। স্পষ্ট করে কিছুই অনুমান করতে পারত না সে, এক অস্পষ্ট ও কম্পমান আশার অস্থির আলোয় বিভ্রান্ত হয়ে পড়ত সে। কোনও বিষয়েই সে নিশ্চিত হতে পারত না। কোনও কিছু এক দৃঢ় প্রত্যাখ্যানের সঙ্গে সরিয়ে দিতেও পারত না মন থেকে। এক ম্লানিমা ছড়িয়ে পড়ল তার সারা মুখে আর এক মৃদু কম্পন খেলে যেতে লাগল তার সারা দেহে। এক একসময় সে যেন স্বপ্ন দেখত জেগে জেগে এবং মনে মনে বলত, এটা কি সত্যি? তখন সে তার পোশাকের তলায় নোটবইটা তার বুকের উপর চেপে ধরে তার স্পর্শ অনুভব করত। জাঁ ভলজাঁ যদি তখন তার চোখ-মুখের পানে একবার তাকাত তা হলে তা দেখে ভয়ে কেঁপে উঠত সে। সে ভাবত, হ্যাঁ, সে-ই, এ চিঠি এসেছে তার কাছ থেকে। সে আরও ভাবত নিশ্চয় কোনও দেবদূত বা স্বর্গীয় বা ঐশ্বরিক সুযোগের মধ্যস্থতাই তাকে আবার ফিরিয়ে এনেছে তার কাছে।
.
৬.
সেদিন সন্ধ্যায় ভলজাঁ বেরিয়ে গেল বাইরে এবং কসেত্তে তার পোশাক পাল্টে সাজতে লাগল। সে যুবতী মেয়েদের এমন একটা গাউন পরল যা পরলে ঘাড় আর বুকের কাছটা দেখা যায়। কেন সে এই সাজসজ্জা করছে, তা সে নিজেই জানে না। সে কি কোনও অতিথির প্রতীক্ষায় আছে? না।
সন্ধ্যা হয়ে আসতেই সে বাগানে চলে গেল। তুস তখন বাড়ির পেছন দিকে রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত ছিল। বাগানের নিচু ডালগুলোকে সরিয়ে সেই পাথরের বেঞ্চটায় গিয়ে বসল। দেখল সেই বড় পাথরটা তখনও পড়ে রয়েছে। সে যেন কৃতজ্ঞতার এক নিবিড় আবেগে হাত বুলাতে লাগল পাথরটায়। সহসা সে যেন পেছনে কার পদশব্দ শুনতে পেল। সে পেছন ফিরে তাকিয়েই চমকে উঠল।
হ্যাঁ, সেই যুবক। তার মাথায় টুপি ছিল না। তার মুখখানা স্নান এবং চেহারাটা রোগা রোগা দেখাচ্ছিল। তার কালো পোশাকটা অন্ধকারে দেখাই যাচ্ছিল না। তার চোখের দৃষ্টিটাও আচ্ছন্ন ছিল গাছের ছায়াতে। তার অতুলনীয় মুখসৌন্দর্যের অন্তরালে মৃত্যুর ছায়া, তার পলায়মান আত্মার ছায়া উঁকি মারছিল, যা দেখে মনে হচ্ছিল সে কোনও প্রেমূর্তি না হলেও সে যেন কোনও জীবন্ত মানুষ নয়। সে তার টুপিটা ঝোঁপের ধারে ফেলে দিয়েছিল।
মূৰ্ছিতপ্রায় কসেত্তে কোনও কথা বলতে পারল না। সে ধীর পায়ে যুবকের দিকে এগিয়ে গেল। তার চোখ-মুখ সে ঠিক দেখতে না পেলেও সে চোখে বিষাদের সঙ্গে এক ধরনের উত্তপ্ত আবেগ ফুটে ছিল।
কসেত্তে একটা গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে না দাঁড়ালে পড়ে যেত।
এরপর যুবকটি কথা বলতে শুরু করল। তার কণ্ঠস্বর এত মৃদু ছিল যে গাছপালার মর্মরধ্বনিকে ছাপিয়ে উঠতে পারল না তা। যুবক বলতে লাগল, এখানে আসার জন্য আমাকে ক্ষমা করবে। আমার মনে বড় কষ্ট, আমি আর থাকতে পারলাম না, তাই না এসে পারলাম না। আমি বেঞ্চের নিচে যে চিঠিটা দিয়ে গিয়েছিলাম সেটা পড়েছ? তুমি হয়তো আমাকে চিনতে পেরেছ? তুমি ভয় পেও না। অনেক দিন আগের কথা হলেও তোমার হয়তো মনে আছে, তুমি লুক্সেমবুর্গের বাগানে আমার দিকে তাকিয়েছিলে। আর একদিন তুমি আমার পাশ দিয়ে চলে গিয়েছিলে। ঘটনা দুটো ঘটেছিল প্রায় এক বছর আগে ১৬ জুন আর ২ জুলাই তারিখে। তার পর আর দেখা পাইনি তোমার। তুমি র্যু দ্য লোয়েস্তের বাড়িতে কিছুদিন ছিলে। আমি তা লক্ষ করেছিলাম। কিন্তু পরে সেখান থেকে চলে যাও। একদিন ওদিনের খবরের কাগজ পড়তে পড়তে তোমার মতো টুপিপরা একটি মেয়েকে দেখে তার পিছু পিছু ছুটেছিলাম, কিন্তু পরে দেখলাম, তুমি নও। অবশেষে আমি এই রাত্রিকালেই তোমার কাছে এসেছি। কিন্তু ভাবনার কোনও কারণ নেই, কেউ আমাকে দেখেনি। আমি প্রায়ই এসে সন্ধের সময় তোমার জানালার দিকে তাকিয়ে থাকি। আমি এখানে নিঃশব্দে পদচারণা করি যাতে তোমার কোনও অসুবিধা না হয়। একদিন সন্ধেবেলায় আমি তোমার পেছনেই ছিলাম। কিন্তু তুমি ঘুরে দাঁড়াতেই আমি লুকিয়ে পড়ি। একদিন তোমার গান শুনে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। জানালা দিয়ে ভেসে আসা তোমার গান শুনলে কি তোমার কোনও ক্ষতি হয়? আমার কাছে তুমি এক দেবদূত। তুমি আমাকে মাঝে মাঝে আসতে দেবে। এখানে। আমি মরতে বসেছি। তুমি যদি জানতে কত ভালোবাসি তোমায়! এত কথা। বলার জন্য আমাকে ক্ষমা করবে তুমি। জানি না কী বলছি, হয়তো তোমাকে আমি বিরক্ত করে তুলঁছি।
ওমা! এই বলে প্রায় মূৰ্ছিত হয়ে সেখানেই বসে পড়ল কসেত্তে।
কিন্তু সে বসার আগেই যুবকটি তাকে ধরে ফেলল। তাকে নিবিড়ভাবে দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল।
কসেত্তেকে জড়িয়ে ধরে থাকার সময় যুবকটি কাঁপছিল। তার মনে হচ্ছিল কুশায়াভরা তার মাথাটার মধ্যে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। তার মনে হল সে একই সঙ্গে এক ধর্মীয় কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে অধর্মাচরণ করছে। তবে যে সুন্দরী তরুণীর দেহটি তার নিবিড় আলিঙ্গনের মধ্যে ধরা আছে তার জন্য কোনও দেহগত কামনা অনুভব করছিল না সে।
কসেত্তে যুবকটির একটা হাত টেনে নিয়ে তার বুকের উপর চাপিয়ে রাখল। যুবকটি তার পোশাকের মধ্যে নোটবইটার অস্তিত্ব বুঝতে পেরে বলল, তা হলে কি তুমি আমাকে ভালোবাস?
কসেত্তে ক্ষীণকণ্ঠে বলল, অবশ্যই, তুমি তা জান।
তার কণ্ঠটা এত ক্ষীণ ছিল যে তা শোনাই যাচ্ছিল না। কথাটা বলেই সে তার মাথাটা যুবকের বুকের মধ্যে খুঁজে দিল। যুবকটিকে তখন বিজয়ী বীরের মতো মনে হচ্ছিল।
যুবকটি তখন বেঞ্চটার উপর বসল। কসেত্তে তার পাশে বসল। কেউ কোনও কথা বলল না। আকাশে তারা ফুটে উঠছিল একটা-দুটো করে। তাদের ঠোঁট দুটো এক সময় মিলিত হল। কেমন করে এই চুম্বনকার্য সমাধা হল তা জানে না তারা। যেমন করে পাখিরা গান গায়, বরফ গলে যায়, গোলাপের পাপড়িগুলো একে একে খুলে যায়, যেমন করে পাহাড়ের চূড়ায় অন্ধকার গাছপালার আড়ালে দুধের মতো সাদা ভোরের আলো। ফুটে ওঠে, তেমনি নিঃশব্দে এক অমোঘ প্রাকৃতিক নিয়মের বশেই যেন তাদের ঠোঁট দুটি চুম্বনে নিবিড় হয়ে ওঠে।
দু জনেই যেন কাঁপছিল। তারা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ছিল। শৈত্যনিবিড় রাত্রি আর বেঞ্চটার কনকনে ঠাণ্ডা, শিশিরভেজা ঘাস আর মাটির স্যাঁতসেঁতে ভাব, কোনও কিছুরই খেয়াল ছিল না তাদের। তারা দু জনে দু জনের হাত ধরে দু জনের দিকে তাকিয়ে ছিল।
যুবকটি বাগানে কী করে এল সেকথা জিজ্ঞাসা করেনি কসেত্তে। তার মনে হল এটা যেন খুবই একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। মাঝে মাঝে তাদের হাঁটু দুটো ঠেকে যাচ্ছিল আর তাদের দেহ দুটো কেঁপে উঠছিল। এবার কসেত্তে কী বলতে গেল আমতা আমতা করে। তার ঠোঁট দুটো আর গলার স্বরটা কাঁপছিল, যেন ফুলের পাপড়ির উপর বৃষ্টির ফোঁটা ঝরে পড়ছিল।
শান্ত ও নক্ষত্রখচিত রাত্রি বেড়ে উঠছিল তাদের মাথার উপর। অশরীরী আত্মার মতো তারা নিজেদের সব কথা, তাদের স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-বেদনা ও ব্যর্থতার কথা বলল। তাদের দু জনের মধ্যে দেখা না হলেও দূরে থেকে হতাশার মাঝেও কিভাবে পরস্পরকে ভালোবেসে এসেছে সেকথাও বলল। তাদের যৌবন ও প্রেমের উত্তাপে বিগলিত হয়ে সরল বিশ্বাসে তাদের অন্তরের সব গোপন কথা বলল একে একে। এক ঘণ্টার মধ্যেই তারা যেন তাদের অন্তর বিনিময় করল নিজেদের মধ্যে। একে অন্যের আত্মায় সমৃদ্ধ হয়ে উঠল।
তাদের সব কথা বলা হয়ে গেলে কসেত্তে যুবকটির কাঁধের উপর মাথাটা রেখে বলল, তোমার নাম কী?
আমার নাম মেরিয়াস। তোমার নাম?
কসেত্তে।