জুয়াড়ি – গোলাম আব্বাস
পুলিশ এত সাবধানে হানা দিয়েছিল যে, তাদের একজনও পালাতে পারল না। পালাবে কোন্ দিকে? আড্ডায় যাওয়ার একটাই সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি পুলিশ আগে থেকেই দখল করে বসেছিল। বাকি থাকে জানালা। কোনও বাহাদুর জানের পরোয়া না-করে যদি জানালা দিয়ে লাফিয়েও পড়ত, তা হলে প্রথমত, তার হাঁটু আস্ত থাকত না; আর যদি ধরেও নেওয়া যায় যে, বেশি চোট সে পেল না, তা হলেও পালাবার সুযোগ সে পেত না; কারণ আধ ডজন পুলিশের সিপাই নিচেই বাজারে আড্ডার ঘরটিকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছিল। অতএব, তারা সব-কজন জুয়াড়ি, সংখ্যায় দশজন — ধরা পড়ে গেল।
ঘটনাক্রমে, সেদিন যেসব জুয়াড়ি আড্ডায় এসেছিল, তাদের মধ্যে দু-একজন পেশাদার জুয়াড়ি বাদে বাকি সবাই কখনও-সখনওর শখের খেলুড়ে। এমনিতে তারা সম্মানি আর অবস্থাপন্ন লোক। তাদের মধ্যে একজন ছিল কন্ট্রাক্টর, একজন সরকারি কর্মচারী, একজন মহাজনের ছেলে, একজন লরি-ড্রাইভার, আর একজন চামড়ার কারবারি।
তাদের মধ্যে দু জন নির্দোষ লোকও ছিল। একজন হচ্ছে মনসুখ পানঅলা। সে কদাচিৎ খেলত বটে, কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় সে ওখানে খেলার উদ্দেশ্য নিয়ে যায়নি আদৌ। দোকানে এক বন্ধুকে বসিয়ে রেখে সে দশটাকার নোটের ভাংতি নিতে এসেছিল। ভাংতি নেওয়া হয়ে গিয়েছিল, তার পর সে চলেও যাচ্ছিল, এমন সময় এক খেলুড়ের পাতির ওপর তার নজর গিয়ে পড়ল। সেই পাতি ছিল অসম্ভবরকমের ভালো। সেই খেলুড়ে কী চাল চালে, তাই দেখার জন্যে সে সামান্য একটু দাঁড়িয়েছিল, আর তখনই পুলিশ এসে হাজির। ব্যস্, আর যায় কোথায়।
অন্যজন এক বৃদ্ধ দলিল-লেখক। সে কন্ট্রাক্টরকে খুঁজতে খুঁজতে আড্ডা পর্যন্ত এসে হাজির। কন্ট্রাক্টরের সঙ্গে তার অনেক দিনের পরিচয়। সে চাইছিল, কন্ট্রাক্টর তার ছেলেকেও একটা কোনও ছোটখাটো কন্ট্রাক্টারির কাজ জুটিয়ে দিক। দলিল-লেখক কন্ট্রাক্টারকে কদিন থেকে এমন জায়গা নেই, যেখানে খোঁজ করেনি। শেষে যদি তাকে পেল তো এমন জায়গায় যে, সেখানে খেলার মধ্যে না তার সামান্য ফুরসত ছিল, না এত লোকের সামনে মনের কথা খুলে বলার উপায় ছিল। কন্ট্রাক্টর খেলায় একেবারে মশগুল। আর দলিল-লেখক ভাবছিল, আহা, যদি এখন এই খেলা একটুক্ষণের জন্য বন্ধ হয়ে যায় আর বাকি সবাই উঠে একটু বাইরে চলে যায়! কিন্তু তেমন কোনও সম্ভাবনা সে দেখতে পেল না। আর, ওদিকে কন্ট্রাক্টরও খেলেই চলেছে ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা ধরে। শেষে দলিল-লেখক নিরাশ হয়ে চলে যাওয়ার কথাই ভাবছিল। এমন সময় পুলিশ এসে জুয়াড়িদের সঙ্গে তাকেও ধরে নিয়ে গেল।
ওই দু জন নির্দোষ হওয়ার পক্ষে বহু প্রমাণ উপস্থিত করল, কিন্তু কোনও কথাই শুনল না পুলিশ। বাকি সবাই পুলিশের এই আকস্মিক হানায় এমন হতভম্ব হয়ে পড়ল যে, কারও মুখ থেকে একটা রা সরল না। সিপাইরা আগে খুব সাবধানে সবাইকে আড্ডা থেকে নিচে নামাল। তার পর তাদের চারদিকে দেখে পাহারা দিয়ে পায়ে হাঁটিয়ে নিয়ে গেল থানায়।
অবশ্য, ভাগ্য ভালো, তখন বেশ রাত হয়েছে। কুয়াশার জন্য বেশি লোকের নজর তাদের ওপর পড়েনি। আর, এরা কোটের কলার বা পাগড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে দ্রুত পা চালিয়ে অল্পসময়ে থানায় গিয়ে উঠল। সেখানে দারোগা সাহেবের নির্দেশে সবাইকে বন্ধ করে রাখা হল গারদে।
গারদের নির্জনতায় যখন তারা মজা-দেখা মানুষের বিদ্রূপভরা চোখ, সিপাইদের কড়া দৃষ্টি আর কঠোর ধমক থেকে রেহাই পেল, আর চেনাজানা মানুষের চোখে চোখ পড়ে যাওয়ার ভয় থাকল না, তখন সবার আগে তাদের সবার মনোযোগ আড্ডার মালিকের ওপর গিয়ে পড়ল। সে-ও সবার সঙ্গে গারদে আটকা পড়েছে। প্রত্যেকে তাকেই সর্বনাশের হেতু বলে মনে করতে লাগল। তাই, যত রাগ গিয়ে পড়ল তার ওপর। এই লোকটা যদি সতর্ক থাকত, তার ঘরটাকে অমন হাট করে না-রাখত, জানা নেই শোনা নেই, একে-ওকে-তাকে ঢুকতে না-দিত, আড্ডার বাইরে একজনকে নজর রাখার জন্য বসিয়ে রাখত, তাছাড়া পুলিশের লোকের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখত, তা হলে তাদের আজ পড়তে হত না এই কঠিন দুর্দশার মুখে।
আড্ডার মালিকের নাম যে কী ছিল, আল্লাই জানেন। সবাই তাকে ‘নিক্কো’ বলে ডাকে। মাঝারি লম্বা, ক্ষীণ শরীর। বড় বড় চোখে সুর্মা টানা। ছোট ছোট পাকা গোঁফ। মুখে বসন্তের আধো-আধো দাগ। অতিরিক্ত পান খাওয়ার ফলে দাঁত কাঁচে লাল। কোঁকড়া চুল সবসময় আমলা তেলে চোবানো। বাঁ-দিকে টেরি কাটা, ডানদিকের চুল কপালে ভিড় জমানো। গায়ে মখমলের কোর্তা, তাতে সোনার বোতাম। গলায় ছোট একটি সোনার তাবিজ–কালো ডোরে ঝোলানো। তার গায়ের কোর্তা প্রায়শ পরিষ্কারই থাকে, কিন্তু ধুতি থাকে ময়লা, শীতকালে এই পোশাকের উপর থাকে জরি-পাড়ের পুরনো এক লাল দোশালা। তার চলনে-বলনে হুলোবেড়ালের ফুর্তি। একজন পুরনো ঘাগু জুয়াড়ি যতটুকু সময়ে একবার তাস ফেঁটে বেঁটে দিতে পারে, সেই সময়ে সে অন্তত দুবার তাস ফাঁটা-বাঁটা শেষ করে।
এই হানার জন্য নিক্কো আগে থেকেই তৈরি ছিল। পুলিশের হানা দেওয়ার সময় থেকে নিয়ে এখন পর্যন্ত সে দুই ঠোঁট এক করে চুপ মেরে ছিল। এতবড় ঝক্কি-ঝামেলায় তার আচরণ যেন একটা তৃতীয় ব্যক্তির সমান। কিন্তু এবার যখন চারদিক থেকে তার ওপর তীব্রদৃষ্টির আক্রমণ শুরু হল, তখন সে নড়েচড়ে বসে যেন আত্মপক্ষ সমর্থনের ভঙ্গিতে নীরবে একটি মধুর হাসি ছাড়ল। সেই হাসির মধ্যে যেন কিছু গোপন কৌতুক লুকিয়ে রয়েছে। সেই হাসি তার ঠোঁটে লেগে থাকল অনেকক্ষণ ধরে। সে ধীরে-সুস্থে নিশ্চিন্তভাবে সবার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল। তার পর গভীর আত্মবিশ্বাসের সুরে বলল, ‘আপনারা একদম চিন্তা করবেন না। আমি আপনাদের একেবারে ঠিক কথাটি বলছি, আপনাদের মাথার একটি চুলও খসা যাবে না। আমার ওখানে গত পাঁচবছরে এমন কাণ্ড আর কখনও হয়নি। কী বলে, আপনারা এটাকে ঠাট্টা ধরে নিন গো বাবু, ঠাট্টা।
জুয়াড়িরা সবাই নিক্কোর এই কথা শুনল। কিন্তু তাতে কারও রাগ একবিন্দুও পড়ল না। কেউ ঘাড় নাড়ল, কেউ মুখ ঘুরিয়ে নিল।
কন্ট্রাক্টর বলল, ‘হুঁ, ঠাট্টা ধরে নেব –না? আহা, প্রাণ জুড়িয়ে দিলে!’
চামড়ার কারবারি লাফিয়ে উঠে বলল, ‘তোবা তোবা! তুমি তো ভারি মজার লোক হে! এখানে লাখ টাকার ইজ্জত ধুলোয় গড়াগড়ি যাচ্ছে, আর তুমি বলছ কি না ঠাট্টা?’
নিক্কো বলল, ‘শেখজি, রাগ হল কেন। ওই-যে আমি বললাম, আপনাদের একটা চুলও খসা যাবে না। দেখবেন, গোঁফে তা দিতে দিতে বেরিয়ে যাব– হেঁ হেঁ, গোঁফে তা দিতে দিতে বেরিয়ে যাব।’
কন্ট্রাক্টর বলে উঠল, ‘থাম্ ব্যাটা গল্পবাজ কাঁহিকা।’
ক্ষুণ্ণ আওয়াজে নিক্কো বলল, ‘গল্পবাজ? আমি? ঠিক আছে, যা মন চায় বলে নিন। কিন্তু আমি ফের বলছি– আপনাদের একজনেরও গায়ে আঁচড়টি পর্যন্ত লাগবে না।’
সরকারি অফিসের অ্যাকাউন্টেন্ট লোকটি এমনিতে জুয়াকে ভীষণ ঘৃণার চোখেই দেখে। কিন্তু মাঝে মাঝে যখন তার বউ ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যায়, তখন ওই জুয়ার আড্ডা ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়ার থাকে না। অফিস ছুটি হলে সে সোজা ওইদিকে পা বাড়ায়। প্রতিবারই হারে, আর নিজেকে গালাগালি করে। প্রতিজ্ঞা করে, আর কখনও ও-পথে হাঁটবে না। কিন্তু পরদিন আড্ডায় গিয়ে হাজির হয় সেই-ই সবার আগে। এই ভদ্রলোক নিক্কোর কথা শুনে ইনিয়ে-বিনিয়ে বিলাপ শুরু করলেন, ‘আরে ভাই, আমার তো সর্বনাশ হয়ে গেল। আমি সরকারি চাকুরে –আমার আর এক কানাকড়িরও ইজ্জত থাকল না। হায়, আমার বউ-বাচ্চার কী হবে! হায়, নিক্কো আমার সর্বনাশ করে দিল!’
নিক্কো বলল, ‘আহ্ মালেক সাহেব, আমার কথা শোনো…!’
বাধা দিয়ে মালেক সাহেব বলে চললেন, ‘ছাই, শোনার আর কী আছে? হায়, কুক্ষণে আমি তোমার মুখ দেখেছিলাম নিক্কো! ভাই রে, আমি হলাম গিয়ে সরকারি চাকুরে। যদি আমার আপিসের লোকের কানে গিয়ে একবার পড়ে, তো বদনামের একশেষ। আরে, চুলোয় যাক তোমার বদনামি। পনেরো বছরের চাকরি আমার হাতছাড়া হয়ে যাবে। হায়, আমার বিবি-বাচ্চার কী হবে গো!
মহাজনের ছেলে, যে টাকা কামানোর এই সহজ আর মজাদার পদ্ধতি সদ্য আয়ত্ত করেছিল, এতক্ষণ বেশ গম্ভীরভাবে বসেই ছিল। কিন্তু মালেকের এই বিলাপ শুনে এবারে একবারে হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিল। তার দিকে মনোযোগী হল সবাই।
নিক্কো বলল, ‘ধৈর্য ধরো, ছোট শাহজি, ধৈর্য ধরো। তুমি যে দেখি ভাই একেবারে মেয়েলোকের মতো কাঁদতে শুরু করলে–অ্যাঁ? মরদের মতো বুকে সাহস আনো। আরে ভাই, তাছাড়া, ব্যাপারও তো এমন কিছু নয়।’
মহাজনের ছেলে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমার বাবা যদি জানতে পারে, তা হলে একেবারে ঘর থেকে বের করে দেবে।
নিক্কো বলল, ‘আরে ভাই, ছাড়ো ওসব কথা– কেউ তোমাকে ঘর থেকে বের করে দেবে না।
মালেক বলে উঠল, ‘নিক্কো, এ কেমনধারা কাজ তোমার বলো দেখি?’
নিক্কো খুব জোর দিয়ে বলতে লাগল, ‘মালেক সায়েব, আপনি একটুও চিন্তা করবেন না। আপনি আমার কথা বিশ্বাস করুন। আমি আপনাকে বলেছি-না, আপনার গায়ে একটুখানি আঁচড় পর্যন্ত লাগবে না। এমনভাবে কাজ হাসিল করব, যেন মাখনের ভেতর থেকে চুল বের করে আনছি।’
মালেক শোকার্ত কণ্ঠে বলল, ‘হয়েছে ভাই, হয়েছে– এবার থামো। যদি এতই তুমি কাজের লোক, তা হলে পুলিশকে ঢুকতে দিলে কেন?’
নিক্কো বলল, ‘মালেক সাহেব, আমার কথা বিশ্বাস করুন, আমি আপনাকে সত্যি বলছি, আপনার একটি চুলও খসা যাবে না। আসল ব্যাপার কী জানেন, থানার দারোগা আমার আপন লোক। বুঝলেন কিছু? ও আমার খুব খয়ের খাঁ। আপনাদেরও কিছুটি বলবে না। যদি কিছু বলে, তখন আমার মুখের উপর থুতু ছুঁড়ে মারবেন, হ্যাঁ।’
নিক্কোর এই কথা শুনে যত জুয়াড়ি এক মুহূর্ত নীরবে কী ভাবতে লাগল। কেউ কেউ ডুবতে ডুবতে খড়কুটো ধরে বাঁচতে চাওয়ার মতো তার কথা বিশ্বাস করতে চাইল; আবার কারও কারও চেহারা দেখে মনে হল, তারা নিক্কোর কথা বিশ্বাস করা উচিত কি না সে-ব্যাপারে কিছু ঠিক করতে পারছে না। তবে একথা পরিষ্কার বোঝা গেল যে, তাদের রাগ পড়ে আসছে ক্রমশ।
চামড়ার কারবারি শেখজি বলে উঠল, ‘দ্যাখো নিক্কো, এক-আধশো টাকা কিছু নয়– কিন্তু আমার ইজ্জত যেন রক্ষা পায়। এমনিতে ব্যাপার তো এমন কিছুই নয়। আর, খোদ আমার বোনাই হচ্ছে গিয়ে পুলিশের সাব-ইনসপেক্টর। কিন্তু, তোবা তোবা– এটা কাউকে বলার মতোন একটা কথা হল, বলো?’
নিক্কো ভরসা দিয়ে বলল, ‘শেখজি, আপনি একটুও চিন্তা করবেন না। আমি সেই যে বলেছি না, আপনি এটাকে ঠাট্টাই ধরে নিন। আমার দোস্ত মাঝে মাঝে অমন একাধটুকু দিল্লাগি করেই থাকে।’
‘কে?’ মনসুর পানঅলার মুখ থেকে এই প্রশ্ন সবেগে বেরিয়ে এল। সে তার বিপদে এত বড় বড় সব ব্যক্তিকে সাথিরূপে পেয়ে এতক্ষণ যেন নিজের দুঃখ ভুলেই গিয়েছিল।
‘ওই যে আপনার থানার দারোগা সাহেব বাহাদুর– আর কে।’ ওই কথা বলে নিক্কো হেসে ফেলল।
লরি-ড্রাইভার এককোণে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে নিক্কোকে খেয়াল করে দেখছিল। এখন তার একেবারে কাছে এসে, তার চোখে চোখ রেখে অত্যন্ত ভদ্রগলায় বলতে লাগল, ‘দ্যাখো নিক্কো, আমাকে সাতসকালে লরিতে শুকনো ফল বোঝাই করে অনেক দূরে নিয়ে যেতে হবে। ঠিকাদার আমার অপেক্ষায় থাকবে। যদি বাপু তোমার সত্যি এখানে কোনও চেনাজানা থাকে, তো এমন কোনও উপায় করো, যাতে সকাল হওয়ার আগেই আমি এখান থেকে খালাস পাই।’
এমনিতেই জুয়াড়িরা সব শেষপর্যন্ত ধীরে ধীরে নিক্কোর কথায় কান দিতে আরম্ভ করছিল, কিন্তু লরি-ড্রাইভার যে-সুরে নিক্কোর সঙ্গে কথা বলল, তাতে সে স্পষ্টতই নিক্কোর সঙ্গীদের কাছে নিক্কোর কদর বাড়িয়ে দিল। নিক্কোও সেটা অনুভব করল এবং নিজের এই সাফল্যে তার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। অবশ্য লরি-ড্রাইভার যে ভদ্রশ্রেণি থেকে আলাদা হয়ে নিজের একার জন্য নিবেদন পেশ করেছে, সেটাকে কেউ ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারল না, বরং সেটাকে লরি-ড্রাইভারের স্বার্থপরতা আর ছোটলোকির পরিচয় বলেই বিবেচনা করল সবাই।
ইতোমধ্যে নিক্কোর গলায় আরও বেশি আত্মবিশ্বাস জমে উঠেছে। সে খুব সম্ভ্রমের সঙ্গে লরি-ড্রাইভারকে বলল, ‘মীর্জাজি, ভাই রে, অত ভেবো না, অত ঘাবড়িয়ো না– তারও ব্যবস্থা হয়ে যাবে।‘
হঠাৎ দলিল-লেখক ফুঁসে উঠে বলল, ‘ব্যবস্থা হবে, না ছাই হবে। মিরজা, তুমিও দেখছি ওই হামবাটার কথায় কান দিতে শুরু করলে। যে ভোগান্তিতে পড়েছ, তাতে বাপু তোমার নিজেকেই ভুগতে হবে।’
নিক্কো দলিল-লেখকের এই অপ্রত্যাশিত আক্রমণ ক্ষিপ্রভাবে প্রতিরোধ করল। সে খলখলিয়ে হাসতে লাগল। তার পর বলল, ‘নাও, বড়মিয়ার কথা শোনো। উনি বলছেন, ব্যবস্থা নাকি হবে না। আরে বাপু, এখানে যে হর্ মাস মাল-কড়ি খাওয়ানো হচ্ছে, তার কী? ভাইসব, আপনারা শুনুন, আমি আবার বলছি, এটাকে আপনারা ঠাট্টাই ধরে নিন। আমি হিন্দুর মাইরি আর মুসলমানের কসম খেয়ে বলছি, কারও একটা সামান্য চুলও খসা যাবে না। ব্যাপারটা হচ্ছে, থানার দারোগা– আপনাদের আমি আর কী বলব—’
বলতে বলতে সে হেসে ফেলল। তার পর আবার বলল, ‘বলেছি না, উনি আমার আপন লোক? এই– আপনারা আর ছাড়া পেলেন বলে। কিন্তু হ্যাঁ, কাউকে বলবেন-টলবেন না যেন কথাটা। তা হলে কিন্তু সব ফেঁসে যাবে, এই বলে দিলাম। আমাকে কিন্তু তখন দোষ দিতে পারবেন না। আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে– মানে– থানার দারোগা– আপনাদের কাছে আর লুকোনো কেন– মানে, আমার সঙ্গে আত্মীয়তা রয়েছে। শুনলেন তো? কী বড়মিয়া, এবার শান্তি হল মনে? এইটুকু বোঝেন না, যদি এইরকম ধারা ব্যাপার না থাকবে, তো গেল পাঁচবছর ধরে এই এতবড় শহরে এতবড় কারবার আমার চলছে কেমন করে?’
নিক্কো চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। ততক্ষণে তার ইজ্জতের ইমারত আগের থেকেও বেশি দৃঢ় হয়ে উঠছে।
এই জুয়াড়িদের মধ্যে একজন ছিল, যার চেহারায় দুঃখ বা চিন্তার কোনও চিহ্ন দেখা যায়নি। এতসব কাণ্ডর মধ্যেও সে চুপচাপ বসে। সে একটা আটাশ বছরের কৃশ, ক্ষীণাঙ্গী যুবক। পোশাক-আশাক আর হাবভাব থেকে তাকে চমৎকার বেপরোয়াই মনে হচ্ছে। অনেকদিন আগে একবার এই লোকটা বোকার মতো চাল চেলে একটা মোটা অঙ্কের টাকা হেরে বসেছিল। ব্যস্, সেইদিন সে প্রতিজ্ঞা করেছিল, যেদিন সেই হেরে যাওয়া টাকা আবার জিতবে, সেদিন থেকে সে আর কখনও জুয়ার নাম মুখে নেবে না। আড্ডায় আসার এক ঘণ্টা আগে সে কোনও পার্কে গিয়ে বসে ভালো করে খেলার পরিকল্পনা ছকে নেয়। নানারকমের চাল পর্যন্ত মনে-মনে ঠিক করে রাখে। খেলেও খুব সাবধানে। কখনও মাথা গরম করে না বা উত্তেজিত হয় না। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তার হারা টাকার পরিমাণ প্রতিদিন বেড়েই চলেছে আর সেইসঙ্গে তার ঋণের পরিমাণও।
এই লোকটার মনে জেল, জরিমানা বা অপমানের জন্য চিন্তা একটুও ছিল না। অবশ্য একটা দুশ্চিন্তা তার ছিল। সেটা হচ্ছে, এরা হল গিয়ে সব ভীতুমার্কা লোক– এ যাত্রা বেঁচেই যাক আর ফেঁসেই যাক, হয়তো এরা আর আড্ডামুখো হবে না। আর, আড্ডামুখো না হলে তার হেরে যাওয়া টাকাগুলো আর উশুল হবে না কোনওদিন।
এদিকে নিক্কো অবস্থা সম্পূর্ণ আয়ত্তে এনে ফেলেছে। যদিও রাত কাবার হওয়ার আগে সে যে খালাস পাওয়ার কোনওরকম ব্যবস্থা করতে পেরেছে, এমন নয়; তবু সে প্রত্যেককে কোনও-না-কোনওভাবে বিশ্বাস করিয়ে ছেড়েছে যে, থানার দারোগা তার নিকট না হলেও দূরের কোনও আত্মীয় তো বটেই– তাই সকাল হলেই তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে। সুতরাং, সবাই মেঝের উপর, সিপাইরা যে পুরনো, ছেঁড়া, দুর্গন্ধযুক্ত কম্বল এনে দিয়েছিল, তাই বিছিয়ে শুয়ে পড়ল হাত-পা ছড়িয়ে।
‘ওহো, বিরাট ভুল হয়ে গেছে!’ নিক্কো হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠল। তার পর বিছানা ছেড়ে উঠে বসল।
অন্ধকারে সব জুয়াড়ি জিগ্যেস করল, কী হল, কী হল –কোনও খারাপ খবর নয় তো?
নিক্কো বলল, ‘ভাই, যদি জানতাম এখানে রাত কাটাতে হবে, তা হলে তো সঙ্গে তাস নিয়ে আসতাম আর সারারাত মজা করে খেলতাম। যদি বলেন তো এখনি কোনও সিপাইকে পাঠিয়ে দিয়ে তাস আর মোমবাতি আনিয়ে নি?’
‘না না বাবা, কাজ নেই– থাক্!’ অনেকেই একসঙ্গে আপত্তি করে উঠল।
নিক্কো, একদম বেপরোয়া হয়ে বলতে লাগল, ‘আপনারা জানেন না– তা হলে কিন্তু ভারি জোর তামাশাখানা হত। সকালবেলা যখন থানার দারোগাকে শোনাতাম, সেও খুব হাসত।’
পরদিন বেলা ন’টার কাছাকাছি একজন সিপাই এসে গারদের দরোজার বাইরে ছিদ্রের কাছে দাঁড়িয়ে উঁচুগলায় হাঁক পাড়ল, ‘এ জুয়াড়ি, তোমরা ওঠো! দারোগা সাহেবের সামনে তোমাদের হাজিরা হবে –ওঠো!’
জুয়াড়িয়া অনেকক্ষণ থেকেই এই হুকুমের প্রতীক্ষায় ছিল। সবার দৃষ্টি একসঙ্গে নিক্কোর ওপর গিয়ে পড়ল। নিক্কো চোখ বেঁকিয়ে বিশেষ ঢঙে হাসল।
পাঁচ মিনিট পর এই দশজন মানুষকে থানার ছোট মাঠটিতে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট, তার পর আধঘণ্টা পার হয়ে গেল, কিন্তু থানার দারোগা সাহেবের ছায়া পর্যন্ত দেখা গেল না। এই এতক্ষণ ধরে নিক্কো সর্বক্ষণ ইয়ার্কি-মশকরা, রসিকতা আর হাসি-ঠাট্টা দিয়ে তার সাথিদের মশগুল রেখেছিল। কিন্তু এক ঘণ্টা যখন পার হয়ে গেল, অথচ থানার দারোগা সাহেবকে দেখা গেল না, তখন সব জুয়াড়ি ঘাবড়ে গেল। তাদের মুখের হাসি গেল মিলিয়ে। সবার মুখ কালো হয়ে উঠল। একটা দুর্ভাবনা আর সন্দেহের স্রোত তাদের ওপর দিয়ে বয়ে গেল। দুশ্চিন্তায় মুখ কালো করে তারা বারবার নিক্কোর দিকে অনুসন্ধানের দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল –উত্তরে নিক্কো প্রত্যেককে হাত দিয়ে সবুরের ইশারা করতে লাগল। ইতোমধ্যে দু-তিনজন সিপাই জুয়াড়িদের কাছ দিয়ে টহল দিয়ে চলে গেছে আর নিক্কো প্রত্যেককে ‘খানসাহেবজি! খানসাহেবজি!’ বলে ডেকে চেষ্টা করছে দৃষ্টি আকর্ষণের। কিন্তু তারা না নিক্কোর ডাকের জবাব দিয়েছে, না তার দিকে ফিরে তাকিয়েছে।
শেষে যখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের দু ঘণ্টা কেটে গেল আর তাদের পা ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইল, তখন একটা কালো গাড়ি থানায় এসে ঢুকল। সেই গাড়ি থেকে থানার দারোগা সাহেব বেরিয়ে এলেন। আর, তাঁর সঙ্গে কয়েকজন সিপাই। দারোগা সাহেবের হাতে কাগজপত্র আর সিপাইদের ঘাড়ে বন্দুক। খালিহাতে তাদের ফিরতে দেখে মনে হল, যে কাজ নিয়ে তারা সাতসকালে বেরিয়েছিল, সে কাজে তারা সফল হয়নি– আর সেই কাজ নিশ্চয়ই খুব জরুরি, জবরদস্ত কাজ। তাই দারোগা সাহেবকে বড় চিন্তিত দেখাচ্ছে।
নিক্কো দূর থেকেই দারোগা সাহেবকে দেখে উছলে উঠল। বলল, ‘ওই-যে এসে গেছে আমার আপন লোক। ব্যস্, আর ভয় নেই– দু-তিন মিনিটেই সব ঝামেলা চুকে যাবে।‘
এইকথা বলে নিক্কো দূর থেকেই থানার দারোগাকে লম্বা একটা সালাম ঠুকল। দারোগা সাহেব হয় তাকে দেখতেই পেলেন না, কিংবা জ্ঞাতসারেই তার দিকে নজর ফেরালেন না। তার পর, তিনি চলে গেলেন পুলিশ-ব্যারাকের দিকে।
দলিল-লেখক বিদ্রূপভরা আওয়াজে বলল, ‘নিক্কো, আমি বুঝতে পারছি, দারোগা তোমাকে দেখতে পাননি, না হলে নিশ্চয় তোমার সালামের জবাব দিতেন।
নিক্কো বলল, ‘আরে, কী যে বলো মিয়া- দারোগা আমার সালামের জবাব দেবেন নাকি? আর বাপু, তিনি এখন রোয়াবে আছেন, রোয়াবে। কী বুঝলে? থানার দারোগাগিরি, কী বলে, তোমার চাট্টিখানি কথা নয়। দেখছ-না, আমাদের সঙ্গে যদি ভদ্রভাবে কথা বলছেন তো সিপাইগুলোকে কেমন তম্বি করছেন। আর এই সিপাই হারামজাদারা যে কী চিজ, সে তো দেখছই। ওরা হচ্ছে ভেল্কিঅলাদের বাঁদর। যতক্ষণ চোখের সামনে লাঠি রয়েছে, ডুগডুগির তালে তালে নাচবে। আর যেই ভেল্কিঅলা একটু ঢিলে দিয়েছে, তো অমনি লেগে যাবে, মুখ ভ্যাঙচাতে তখন বাঁদর মাথায় চড়বে।’
পাঁচ মিনিট পর দারোগা সাহেব কয়েকজন সিপাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ব্যারাক থেকে বেরিয়ে এলেন। জুয়াড়িদের পাশ দিয়ে হেঁটে থানার ফটকের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। তার পর, সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই সিপাইদের সঙ্গে কথায় মগুল হয়ে পড়লেন।
এদিকে থানার অফিসঘরে টেলিফোন বেজে উঠল। একটু পরেই একজন সিপাই ছুটতে ছুটতে দারোগা সাহেবের কাছে গেল। দারোগা সাহেব যখন চলে যাচ্ছিলেন, তখন নিক্কো তাঁকে আর একবার সালাম ঠুকল। দারোগা সাহেব মুখ ঘুরিয়ে তার দিকে তাকালেন, তার পর দ্রুত পা চালিয়ে, চলে গেলেন অফিসের দিকে।
নিক্কো বিজয়ীর ভঙ্গিতে বলল, ‘বলেছিলাম না, আমার সালামের জবাব দেবে না? কী, জবাব দিল?’
সব জুয়াড়ি চুপ করে থাকল।
নিক্কো আবার বলতে লাগল, ‘একদিনের কথা। থানায় শুধু ও আর আমি রয়েছি ধারে-কাছে কোনও সিপাই ছিল না। তখন কী হল, শোনো। এত মজার মজার কথা শোনাল যে, হেসে একেবারে পেট ফুলে গেল।’
প্রায় আধঘণ্টা ধরে থানার দারোগা সাহেব অফিসের ভেতরেই রইলেন। এরা আবার অসহিষ্ণু হয়ে উঠল। এমন সময় সকালের সেই সিপাই অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা এদের কাছে এসে কঠোর গলায় বলতে শুরু করল, ‘এ জুয়াড়ি, তোমরা শোনো। দারোগা সাহেবের হুকুম, তোমরা সবাই যার যার ধুতি-পাজামা খুলে মাটির উপর এক লাইনে উবু হয়ে শুয়ে পড়ো। তার পর, একদিক থেকে একজন করে উঠে প্রত্যেককে দশ ঘা করে জুতো লাগাও। জুতো লাগানো হলে অন্যদিকে উবু হয়ে শুয়ে পড়ো। মোট কথা, এইভাবে সবাই সবাইকে একে একে দশ ঘা করে জুতো লাগাও।’
দারোগা সাহেবের এই আদেশ এতই অপ্রত্যাশিত যে, সব জুয়াড়ি হতভম্ব হয়ে গেল। তার পর, সেই অবস্থায় তাকিয়ে রইল সিপাইয়ের মুখের দিকে।
‘প্যাচার মতো সব আমার মুখের দিকে দেখছ কী? হুকুম যদি বুঝতে পেরে না-থাকো, তো আর একবার শুনিয়ে দি?’
এইকথা বলে জবাবের অপেক্ষা না করে সেই কথাগুলোই সিপাই আবার বলে গেল। তখন দলিল-লেখক আর মনসুখ পানঅলা পাগলের মতো ছুটে গিয়ে সিপাইয়ের পায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। তারা সমস্বরে কাকুতি-মিনতি করে বলল, ‘খান সাহেব, আমরা একেবারে নির্দোষ। এরা সবাই সাক্ষী, আমরা একদম কোনও দোষ করিনি। পুলিশ যখন এল, তখন আমরা খেলছিলামও না–আর খেলার মতলবে সেখানে আমরা যাইনি। আমরা নির্দোষ। খোদা জানেন, আমরা বিলকুল নির্দোষ।’
সিপাই বলল, ‘আমার কিছু করার নেই– দারোগা সাহেবের এই হুকুম।’
ওরা আবার বলল, ‘খানসাহেবজি, বড্ড মেহেরবানি হয় যদি আপনি আমাদের তরফ থেকে হুজুরের কাছে একটু হাতজোড় করে বলেন, আমরা দুজনা বিনাদোষে ধরা পড়েছি। এঁরা সবাই তার সাক্ষী।’
সিপাই বলল, ‘আমি সাক্ষী-টাক্ষী বুঝি-না, বাপু –দারোগা সাহেব সক্কলের জন্যে এই হুকুম দিয়েছেন। হ্যাঁ, আর একটা কথা। উনি বলেছেন যদি ওরা রাজি না হয় তা হলে ওদের সবাইকে আবার গারদে পুরতে হবে। দ্যাখো বাপু, দেরি করা চলবে না। আমাকে এক্ষুনি দারোগা সাহেবের সঙ্গে বাইরে যেতে হবে। গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। তোমরা যদি দেরি করো, তা হলে তোমাদের আবার গারদে বন্ধ করে দিয়ে যাব।’
দলিল-লেখক আর মনসুখ দুজনে নিরুপায় হয়ে আবার লাইনে গিয়ে দাঁড়াল। তাদের এই পরিণাম দেখে কোনও জুয়াড়ির আর মুখ-খোলার সাহস হল না। দুশ্চিন্তায় আকুল হয়ে তারা পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতে লাগল। কী করা যায়, তাদের মাথায় তা আসছে না। তাদের চোখ বারবার নিক্কোর ওপর পড়ছে। নিক্কো তাদের দিকে তাকিয়েও দেখছে না। তার দৃষ্টি থানার অফিসঘরের দেয়ালের দিকে। সেই দৃষ্টি বুঝি দেয়াল ভেদ করে থানার দারোগাকে খুঁজে বের করতে চাইছে।
সিপাই আবার বলল, ‘দ্যাখো বাপু, তোমরা কিন্তু দেরি করছ। আমাকে বাধ্য হয়ে তোমাদের তা হলে গারদেই বন্ধ করে দিতে হবে।’
এই কথার ওপরও জুয়াড়িরা ইতিউতি করছে, এমন সময় হঠাৎ মাটিতে কারও দড়াম করে পড়ার আওয়াজ শোনা গেল।
সে নিক্কো। নিক্কো ততক্ষণে ধুতি খুলে মাটির উপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছে। তাকে ওই অবস্থায় দেখে মনসুখও সাহসে বুক বাঁধল। সেও নিক্কোর অনুসরণ করল। অ্যাকাউন্টেন্ট মালেক এদিক-ওদিক দেখছিল, এমন সময় সিপাই এসে পেছন থেকে ঘাড়ে ধরে তাকে জবরদস্তি নিচে বসিয়ে দিল। সে তখন নিরুপায় হয়ে নিজের পাতলুনের বোতাম খুলে ফেলল।
সিপাইয়ের এই ব্যবহার দেখে তখন অন্যান্য জুয়াড়ি আপনাআপনি মাটিতে শুয়ে পড়ল। শুধু চামড়ার কারবারি শেখজি রইলেন দাঁড়িয়ে। তাঁর দুইচোখে অশ্রু টলমল করে উঠল। তাঁর চেহারা দেখে বোঝা গেল, তিনি কী সাংঘাতিক মনঃকষ্ট ভোগ করছেন। তাঁর হাত বারবার কোমরবন্ধে গিয়ে ঠেকছে, কিন্তু গিয়ে আটকে থাকছে সেখানেই।
এইরকম সম্মানিত ও ভদ্র-চেহারার মানুষটিকে এইভাবে শোক করতে দেখে সিপাইজির মনে লাগল। সে সেখান থেকে ইচ্ছা করে সরে গেল। শেখজি মন শক্ত করলেন। পাগড়ির আঁচলে চোখ মুছলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের চারদিকে দেখলেন। শেষে একান্ত বাধ্য হয়ে তিনিও থানার দারোগার হুকুম তামিল করলেন।
একপ্রান্তে ছিল লরি-ড্রাইভার। সর্বপ্রথম তারই জুতো মারার পালা। সে উঠে দাঁড়ালে নিক্কো জোরে গলা ঝাড়ল। তার পর বলল, ‘মীর্জাজি, সামলে। সবাই বলতে গেলে আপন লোক, হ্যাঁ। দেখে মনে হবে খুব জোরে হাত পড়ছে, কিন্তু — বুঝলে কথা?–’
লরি-ড্রাইভারের মাত্র পাঁচ পর্যন্ত গোনা হয়েছিল, এমন সময় সেই সিপাই থানার অফিসঘর থেকে বেরিয়ে হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিল। কাছে এসে সে বলল, ‘দারোগা সাহেব বলছেন, তোমরা যদি ঠিকভাবে জুতো না-চালাও, তা হলে, আমি আমার সিপাইদের দিয়ে জুতো লাগাব।’
এই কথা বলে আবার চলে গেল।
জুয়াড়িরা ভেবে দেখল, নিজেরা আসে জোরে জোরে জুতো খাওয়াই ভালো। সেই অনুসারে, বিশ মিনিটের মধ্যে প্রত্যেককে প্রত্যেকের দশ জুতো করে মারা হয়ে গেল। তখন তারা সবাই উঠে দাঁড়িয়ে কাপড় ঝেড়েঝুড়ে পরে নিল। তা করতে করতে সেই সিপাই আবার এসে বলল, ‘যাও, এবারের মতো দারোগা সাহেব তোমাদের মাফ করে দিলেন। যাও, আর কখনও জুয়ো খেলো না।’
এরা সব থানা থেকে এমনভাবে বেরুল, যেন নিজের কোনও অতি নিকট-আত্মীয়কে কবর দিয়ে গোরস্তান থেকে বেরুচ্ছে। থানা থেকে বেরিয়ে তারা চুপচাপ মাথা হেঁট করে একশো গজের মতো হেঁটে গেল। তার পর নিক্কো হঠাৎ খুব জোরে হেসে উঠল। এত জোরে হাসতে লাগল যে, হাসতে হাসতে তার কোমর বেঁকে গেল। তখন সে বলল, ‘কী! দেখলে? না চালান, না মোকদ্দমা, না জেল, না জরিমানা। বলেছিলাম না– এটাকে তোমরা ঠাট্টাই ধরে নাও।’
অনুবাদ : নেয়ামাল বাসির