এক সময়ে কাইরোয় একটি সাংঘাতিক চতুর রমণী বাস করতো। চোখের পলকে এমন ভেল্কী সে লাগিয়ে দিতে পারতো যার তুলনা মেলা ভার।
একজন ইসলামী চারটি মেয়েকে শাদী করে ধর্ম রক্ষা করতে পারে। কিন্তু কে কবে শুনেছে, একটি নারী একাধিক স্বামী-সহবাসে ভোগবাসনা তৃপ্ত করেছে?
আমাদের এ কাহিনীর নায়িকা সেই জাতের এক মেয়ে। একই সঙ্গে দুটি পুরুষকে স্বামীরূপে গ্রহণ করে সে দু’জনকেই তুষ্ট করতো।
এদের একজনের নাম হারাম। লোকটা চোর। সারারাত ধরে পরস্ব অপহরণ করাই তার একমাত্র পেশা। সুতরাং রাতে সে বাড়ি থাকতো না। লোকের ঘরে সিঁদ কাটতে কাটতে তার সারারাত কাবার হয়ে যেত। সকালবেলায় বাড়ি ফিরে বৌকে নিয়ে শুয়ে পড়তো সে। সারাদিন সহবাস নিদ্রায় কাটিয়ে আবার সন্ধ্যায় নিজের ধান্দায় বেরিয়ে যেত।
অন্যজন পকেটমার। সুতরাং তার কার্যকলাপ ছিলো প্রকাশ্য দিবালোকে। হাটে বাজারে, জনসমাগমে তার ছিলো গতিবিধি। দারুণ দক্ষতায় হাত-সাফাই করে অন্যের পয়সা-কড়ি হাতিয়ে নিতে ভারি ওস্তাদ ছিলো সে। সারাটা দিন ধরে সে শিকার-সন্ধানে টো টো করে ঘুরে বেড়াতো, আর ফিরে আসতো সন্ধ্যাকালে। কারণ তখন তো আর পথে ঘাটে মানুষ চলে না। খানা-পিনা সেরে সে পরমা সতী স্বাধ্বী’ বৌকে নিয়ে শুয়ে পড়তো।
এইভাবে দিন কাটতে থাকে। দিনে দিনে মাস, মাসে মাসে বছরও অতিক্রান্ত হয়ে যায়।
একদিন চোরটা বৌকে সোহাগ করতে করতে বলে, এখানে কোতায়ালের বড় উৎপাত আরম্ভ হয়েছে। লোকটা ভীষণ কড়া। মনে হচ্ছে, এ শহরে আর চুরির ব্যবসা চালানো যাবে না। সিপাইগুলো আর নাকে তেল দিয়ে ঘুমাতে পারে না আজকাল। বড্ড মুশকিলে পড়েছি। রাতের পর রাত চলে যাচ্ছে। আমদানি হচ্ছে না বিশেষ কিছুই। তাই ভাবছি বিবি, দু একদিনের মধ্যে অন্য কোনও শহরে চলে যেতে হবে কাজের ধান্দায়।
সন্ধ্যায় পকেটমার আকিল শূন্য হাতে ফিরে এলো। চতুরা বৌ জিজ্ঞেস করে, কি গো, এমন মনমরা হয়ে পড়ে রইলে কেন? কী হয়েছে?
বৌকে বুকে জড়িয়ে আকিল বলে, না এ শহরে আর এ ব্যবসা চলবে না, খানকীর ছেলে এই নতুন কোতোয়ালটার জ্বালায় কিছুই সুবিধে করতে পারছি না। সিপাইরা সব সময় পিছনে পিছনে লেগেই থাকে। ভাবছি, অন্য কোনও শহরে চলে যাব। এভাবে রুজি-রোজগার বন্ধ হয়ে থাকলে খাব কী?
দুষ্টা রমণী পকেটমারের বুকে মাথা গুজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে, বিদেশে চলে গেলে তোমাকে ছেড়ে একা একা কী করে থাকবো আমি?
আকিল সান্ত্বনা দিতে দিতে বলে, আহা আমি কি চিরকালের মতো যাচ্ছি নাকি। কিছু। মোটামুটি মালকড়ি বানাতে পারলেই আবার চলে আসবো। তাহলে আর দেরি করে লাভ নাই। কাল রাতেই আমি রওনা হয়ে যাবো। তুমি আমার জামাকাপড় আর কিছু পথের খানা বেঁধে-হেঁদে ঠিক করে রেখ, কেমন?
পরদিন সকালে হারাম এসে বলে, খোচড় পিছনে লেগেছে। শালারা বোধ হয় আমাকে শ্বশুর ঘরে না পাঠিয়ে ছাড়বে না। তবে আমারও নাম হারাম। কেমন করে চোখে ধুলো দিয়ে পালাতে হয় দেখিয়ে দিচ্ছি। বিবিজান, তুমি আমার জিনিসপত্র বাঁদা-ছাঁদা করে দাও। হ্যাঁ সঙ্গে কিছু খানা আর রেস্ত দিও। আজ বিকেলেই আমি এ শহরের বুকে লাথি মেরে রওনা হবো।
ছলনাময়ী কেঁদে ভাসিয় দেয়, আমার কী হবে গো? তোমাকে ছাড়া একটা দুপুর আমি ঘুমাতে পারি না, কেমন করে আমি বাঁচবো?
হারাম একটু কড়া ধাঁচের লোক, আঃ। শুভকাজে যাওয়ার সময় প্যান প্যান করে বাধা দিও না তো! আমি মরে যাচ্ছি—না, চিরকালের মতো ছেড়ে যাচ্ছি? ভয় নাই, তোমার স্বামী তোমারই থাকবে। তা সে বেহেস্তের ডানাকাটা হুরী এসে দাঁড়ালেও এ বান্দা মুখ তুলে তাকাবে না তার দিকে।
মেয়েটা লাস্যময় কটাক্ষ করে, সত্যি বলছ? তোমাদের পুরুষ মানুষকে বাপু বিশ্বাস নাই। আর তোমাদেরই বা কী দোষ দেব বলল। আজকাল দুষ্টু মেয়ে-মানুষগুলোই যত বেহায়া। একটা শক্ত সমর্থ খুবসুরত মরদ দেখতে পেলে আর কথা নাই! কী ভাবে তাকে নষ্ট করতে হয় তার সব ছলাকলাই তাদের মুখস্ত।
হারাম বলে, যাও যাও, এখন নিজের কাজে যাও তো। তুমি কি ভাব, তুমি ছাড়া দুনিয়ার আর সব মেয়েছেলেই বদ?
সারাদিন ধরে অনেকবার রতি-বিহার করে সন্ধ্যার আগেই হারামকে রওনা করে দেয় মেয়েটা। আর সন্ধ্যার পরে আসে আকিল। তাকেও খাইয়ে-দাইয়ে, বার-কয়েক সহবাস শেষে শেষ রাতের দিকে বের করে দেয় বাড়ি থেকে।
নিয়তি অলক্ষ্যে হাসছিলো।
সারাদিন পথ চলার পর সন্ধ্যার প্রাক্কালে এক ছোট্ট শহরের উপান্তে এসে সেখানকার একমাত্র সরাইখানায় আশ্রয় নেবার জন্য ঢুকে পড়ে আকিল। সরাইখানাটি ছোট্ট। একটি মাত্র ঘর। কোন রকমে একটা রাতের মতো মুসাফির পথিকরা এখানে রাত্রি বাস সেরে চলে যায়।
পকেটমার আকিল দেখলো, যাত্রী বলতে তখন পর্যন্ত আর মাত্র একজন এসে উঠেছে তার আগে। বিদেশে মানুষ বেশি মিশুকে হয়ে ওঠে। কথায় কথায় আলাপ পরিচয় হয় দু’জনের। আকিল জিজ্ঞেস করে, ভাই সাহেব দেখছি গা এলিয়ে পড়ে আছেন, খুব ক্লান্ত বুঝি?
লোকটি ঈষৎ হালকা হাসি টেনে বলে, ক্লান্ত হবো না? সেই কাইরো থেকে একটানা হেঁটে আসছি। পা দু’খানা টনটন করছে! উফ!
আকিল বলে, আমারও সেই দশা। আমিও কাইরো থেকেই হেঁটে আসছি। যাক ভালোই হলো, আল্লাহ বহুত মেহেরবান, তা না হলে এই নির্জন অন্ধকার রাতটা একা একাই কাটাতে হতো। জানেন তো পয়গম্বর বলেছেন, পথের সব চেয়ে বড় সম্বল হচ্ছে সঙ্গী। যাক, আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে বড় আনন্দ হলো। আসুন ভাইসাব হাতে হাতে মেলাই। আজ আমাদের যে দোস্তী এখানে তৈরি হলো, তা যেন জীবনের কোনও অবস্থাতেই নষ্ট না হয়।
দু’জনে হাতে হাত রাখলো। আলিঙ্গনাবদ্ধ হলো।
আপনারা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পেরেছেন, অন্যজন হারাম। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ তারা এই পান্থশালায় এক সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
হাত মুখ ধুয়ে দু’জনে খানা খেতে বসে। আকিল বলে, দোস্ত, আজ আমার যা আছে তাই দু’জনে খাবো, আসুন। – হারাম বলে, ঠিক আছে আমারটাও বের করছি। সবই একটু একটু করে খাওয়া যাবে। বাকী যা থাকবে কাল আবার দুজনে একসঙ্গে খাবো। আকিল তার প্যাঁটরা থেকে চাপাটি, সবজী, চাটনী প্রভৃতি যা যা বের করে, হারামও ঠিকঠিক সেই সব খাবারই বের করে তার ঝুলি থেকে। দু’জনেই অবাক হয়ে দু’জনের মুখের দিকে তাকায়। তারপর হেসে ফেলে।
আশ্চর্য ব্যাপার তো! ভাবলাম আপনার খানা আর আমার খানা হরেক কিসিমের হবে। তা না, আপনিও যা যা এনেছেন আমিও দেখছি সেই সবই এনেছি।
এই বলে হারাম একটা ছোট পুঁটলীতে বাঁধা একটা নাস্তার কৌটো বের করে। তার মধ্যে ছিলো ভেড়ার টেংরীর ঝোল। ওরা এ খাবারটাকে পায়া’ বলে।
আর কী আশ্চর্য, আকিলও একটা কৌটো খুলে ঠিক অবিকল ঐ রকম ভেড়ার পায়া বের করে।
এবার দু’জনেরই বিস্ময় চরমে ওঠে।
—আল্লাহ আকবর, একি কাণ্ড! আচ্ছা আপনি এসব খানা কোত্থেকে এনেছেন?
আকিল জিজ্ঞেস করে। হারাম বলে, আমার বিবি বানিয়ে দিয়েছে সব। কিন্তু আপনারগুলো?
অকিল বলে, আমার খানাও তো আমার বিবি বানিয়ে দিয়েছে?
-কোথায় থাকেন আপনি?
আকিল বলে, কাইরোর বিজয় দরজার কাছে!
হারাম অবাক হয়ে বলে, আমিও তো ওখানেই থাকি!
এরপর দুইনচ্ছার এক এক করে দু’জনের খুটিনাটি সব পরিচয় জেনে নেয়। দু’জনেই বুঝতে পারে নষ্ট মেয়েছেলেটা তাদের কী আশ্চর্য কুশলতায় প্রতারণা করে এসেছে এতো কাল।
দু’জনেই ক্রোধে ফেটে পড়ে, আমরা দুজনেই এতদিন একটা মেয়ের কাছে বোকা বনেছি, দোস্ত। এর উচিত সাজা তাকে দিতে হবে।
হারাম বলে, মাথা গরম করবেন না, ভাইসাব। চলুন ঘরে ফিরে যাই। আগে কৈফিয়ত তলব করে দেখি, সে কী বলতে চায়।
দু’জনে একসঙ্গে এসে দাঁড়ালো তাদের বাড়ির দরজায়। মেয়েটি ভাবতে পারেনি, এইভাবে তার দুই স্বামী একজোট হয়ে তাকে আক্রমণ করবে কোনও দিন। বাঁচবার আর কোনও পথ নাই দেখে ছলনাময়ী হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে দু’জনের পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ে।
–আমি অবলা নারী, না বুঝে লোভে পড়ে তোমাদের দু’জনকেই শাদী করে ফেলেছিলাম। বিশ্বাস কর, তোমাদের কাউকে ঠকাবার কোনও মতলব ছিলো না আমার। এবারকার মতো
আমাকে ক্ষমা করে দাও, সোনারা!
হারাম এবং আকিল দু’জনেই মেয়েটিকে সত্যি সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছিলো। তাই তার কান্নায় বিগলিত হয়ে দু’জনেই তাকে ক্ষমা করলো।
মেয়েটি মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো। ওরা বললো, দেখ বিবিজান, এতদিন যা হবার হয়ে গেছে। কিন্তু সব জানাজানি হওয়ার পর তো আর এ ব্যবস্থা মেনে নিয়ে আমরা দুজনেই তোমার স্বামী হয়ে থাকতে পারি না। যে-কোনও একজনকে বেছে নিতে হবে তোমাকে। এবং এখুনি।
ধূর্ত শয়তানীটা ভাবে, দেহের তাগদ দু’জনেরই জব্বর। একজনকে খুশি করলে আর একজনের মাথায় খুন চেপে যাবে। এবং তার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম যে মৃত্যু—তা সে সহজেই অনুমান করতে পারে।
অনেকক্ষণ ধরে মেয়েটিকে নীরব থাকতে দেখে দু’জনেরই ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। হারাম চিৎকার করে ওঠে, কী চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলে কেন? মুখ খোল। একজনকে বেছে নিতে হবে তোমাকে। এবং এখুনি। ঝটপট সাফসাফ বলে দাও। আমাদের অত সময় নাই।
মেয়েটি চোখের জল মুছতে মুছতে বলে, এ বড় কঠিন সমস্যা, একমাত্র খোদা ছাড়া কেউ আমাকে বাঁচাতে পারবে না। এখন আমি কী বলি বলো তো। তোমাদের দু’জনই আমার বড় ভালোবাসার ধন। কাকে ছেড়ে কাকে নিতে চাইবে আমি?
-ওসব আমরা জানি না, দু’জনের একজনকে বাছাই করে নিতে হবে তোমাকে। এবং তার জন্যে আর বেশি সময় দিতে পারবো না আমরা।
মেয়েটি বলে, এতো দাঁড়িপাল্লায় ওজন করে বোঝার বস্তু নয়। কী করে ঠিক করবো, কার দিকে আমার মন বেশি ঝুঁকতে চায়?
-ওসব ফালতু কথা আমরা শুনতে চাই না। সাফসাফ বাতাও—আভি।
মেয়েটি এবার চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। না না, আমি পারবো না। আমার মহব্বতের চোখে তোমরা দুজনেই সমান। তিল মাত্র ফারাক করতে পারছি না কাউকে। এখন তোমাদের মধ্যে গুণে বুদ্ধিতে কে বড় বলতে পারবো না। একমাত্র সেইভাবেই হয়তো দু’জনকে আলাদা করা সম্ভব হতে পারে। আমার মনে হয়, তোমরা তোমাদের নিজের নিজের কেরামতি দেখাও আমাকে। যার বুদ্ধি বেশি হবে তাকেই আমি ধরে রাখবো। কী, আমার কথা তোমাদের পছন্দ হয়?
—চমৎকার।
দুজনেই একসঙ্গে লাফিয়ে ওঠে। তা হলে আজ থেকেই পাট শুরু করা যাক। যে বেশি বুদ্ধি খাটিয়ে চুরি বিদ্যার পরীক্ষায় পাশ করবে তাকেই সে গ্রহণ করবে। কিন্তু কে আগে শুরু করবে? তাও ঠিক হলো। ভাগ্য পরীক্ষা করে। আকিল প্রথম সুযোগ পেলো।
সুতরাং হারামকে সঙ্গে নিয়ে আকিল বাজারে আসে। এক ইহুদী সুদখোর স্যাকরাকে দেখিয়ে বলে, এই লোকটাকে ভালো করে চিনে রাখ। দোকানে দোকানে ঘুরে ঘুরে এই বুড়োটা টাকা ধার দিয়ে সোনাদানা বন্ধক নিয়ে বেড়ায়। ওর কাঁধে যে ঝোলাটা দেখছো-ওটা ভর্তি আছে সোনার
মোহর আর অলঙ্কারে। তুমি দেখ, ওটা আমি কেমন করে ছিনিয়ে নিই কুত্তার বাচ্চাটার কাছ থেকে।
তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। ইহুদীটা হাতে একটা চিরাগ বাতি নিয়ে পথ চলছিলো! আকিল ঝড়ের বেগে তাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় ইহুদীকে ঈষৎ ধাক্কা মেরে তার হাতের বাতিটা ফেলে দিয়ে কাঁধের ঝুলিটাকে সোপার্ট করে অন্ধকার গলির মধ্যে অদৃশ্য হয়ে পড়ে পলকের মধ্যে। ইহুদীটার চিৎকার চেঁচামেচিতে আশে-পাশের মানুষজন ছুটে আসে। কিন্তু আকিল ততক্ষণে পগারপার। মাঝখান থেকে নিরীহ এক গো-বেচারাকে সামনে দেখতে পেয়ে ইহুদীটা তাকেই চোর ঠাউরে দেখিয়ে দিতেই জনতার বেধড়ক প্রহারে আধমরা হয়ে গেলো সে।
আকিল হাসতে হাসতে হারামের কাছে ফিরে এসে বাহাদুর গর্বে বুক ফুলিয়ে বলে, কেমন দেখলে, দোস্ত?
এমন চমৎকার হাত সাফাই, তারিফ না করে উপায় কী? হারাম বলে, একদম যাদুকা খেল দেখিয়ে দিলে বন্ধু! বহুৎ সুক্রিয়া।
আকিল বললো, আরে দাঁড়াও দোস্ত আসল খেলা এখনও শুরু হয়নি।
-কী রকম?
হারাম অবাক হয়ে প্রশ্ন করে। আকিল বলে, ইহুদীর এই থলেটা হজম করা কী অত সোজা ভেবেছ নাকি। ব্যাটাচ্ছেলে এখনি কোতয়ালীতে এজাহার দেবে না? তারপর সিপাই সান্ত্রীরা সারা শহর তোলপাড় করে খুঁজতে থাকবে। তখন? তখন আমি এসব রাখবো কোথায়, শুনি?
হারাম বলে, হঁ, কথাটা তে ভাববার মতো।ও ব্যাটা জাতে ইহুদী। অন্যের রক্ত চুষে খায়। জান থাকতে ওর একটা কানাকড়ি হাতিয়ে নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা শক্ত। তা কী করবে?
আকিল বলে, দাঁড়াও খুলে দেখি আগে, কী কী মাল আছে ভেতরে।
একটা ঝোপের আড়ালে এসে ঝোলাটা খুলে উপুড় করে দিলো আকিল। এক গাদা সোনার মোহর। নেড়ে চেড়ে দেখলো, মোহর ছাড়া অন্য কোনও বস্তু নাই। দশটা মোহর তুলে নিয়ে সে হারামের হাতে দিয়ে বলে এগুলো ট্যাকে গুঁজে রাখ তো!
তারপর নিজের হাতের আকিল নাম খোদাই করা একটা তামার আংটি খুলে ঐ মোহর গুলোর সঙ্গে থলেয় পুরে যেমনটি বাঁধা ছিলো সেই ভাবে বেঁধে আকিল বললো চলো, ইহুদীটার পিছনে ধাওয়া করে লোকটাকে ধরতে হবে।
হারাম কিছুই আন্দাজ করতে পারে না। বলে, কেন? ওর পিছনে যেও না। দেখলে তো তোমাকে ধরে ফেলবে?
আকিল বলে, আরে, এসো না। খেলাটা কেমন জমে দেখ।
ইহুদীটা তখনও বাজার ছেড়ে বেশি দূর যায়নি, হন হন করে ওকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে থলেটা ওর কাঁধের ওপর চাপিয়ে দিয়ে পলকে উধাও হয়ে গেলো আকিল।
হারানো ধন ফিরে পেয়ে ইহুদীর সে কি আনন্দ। কে ছেনতাই করেছিলো, কে ফেরত দিয়ে গেলো সে দিকে ওর কোনও কৌতূহল নাই তখন। শুধু ইষ্ট দেবতার উদ্দেশ্যে বার বার কৃতজ্ঞতা জানাতে থাকলো সে।
সবে কয়েক পা এগিয়েছে, এমন সময় সামনে থেকে এসে ইহুদীর কামিজ চেপে ধরলো আকিল, হু হু বাবা, আমার থলে চুরি করে হাওয়া হবে ভেবেছিলে? দাঁড়াও বিধর্মী শয়তান, তোমার শয়তানী আমি আজ শেষ করে দেব।
ইহুদী তো অবাক। কী বলবে কিছুই ভেবে পায় না প্রথমে।
-এ তুমি কি বলছো বাবা, মানুষ চিনতে ভুল করেছ মনে হচ্ছে।
–ভুল করেছি তোমার মতো শকুনিকে চিনতে কারো ভুল হয় না আরুনের মত বাচ্চা। ন্যাকামী করা তোমার আমি ভুলিয়ে দিচ্ছি। এইভাবে প্রত্যেক দিন তুমি এই শহরের কত মানুষের সর্বনাশ করো ইজরায়েল সন্তান?কাঁধের ওপর দেখছি জলজ্যান্ত আমার থলেটা, আবার বলছে, মানুষ চিনতে ভুল করেছি আমি। তোমার বাঁদর-মুখ মনে রাখার কোনও প্রয়োজন নাই আমার। আমি আমার থলেটা তো চিনতে পারছি। চলো, কাজীর কাছে চলো, আমি নিজে হাতে তোমাকে সাজা দিতে চাই না। যা করার আইন মোতাবেক তিনিই করবেন।
কাজীর কথা শুনে ইহুদীর প্রাণ তুড়ুক করতে শুরু করে। বে-আইনি সুদেখাটানো টাকা, সরকারের দপ্তরে জমা পড়লে আর কী তা উদ্ধার করা যাবে? তার অনেক রকম কাকুতি-মিনতি করতে থাকে লোকটা।
দোহাই বাবা, কাজী কোতয়ালে টেন না, বিশ্বাস কর, আমার পয়গম্বর, আব্রাহাম, আইজাক, জ্যাকব এর নামে শপথ করে বলছি, এ থলে আমার। তুমি ভুল করেছ।
–ভুল করেছি! ওরে শয়তান সুদখোর, চোর, আমি ভুল করেছি। তুমি এই ভাবে সাধু সাজবার চেষ্টা করে পার পেয়ে যাবে ভেবেছ? চ—আর কোনও ওজর শুনতে চাই না তোর। চুরি করার সাজা তোকে আজ পেতেই হবে।
আকিলের চেঁচামেচি চিকার হুঙ্কারে আমার পাশের দোকান-বাড়ি থেকে অনেক ছেলে ছোকরা বয়স্ক বৃদ্ধ সবাই ছুটে এলো।
—কী, কী হয়েছে?
আকিল বলে এই বিধর্মী শয়তান চোরটা আমার থলেটা চুরি করে পালাচ্ছিল। ছুটতে ছুটতে এসে আমি ধরেছি। ওকে কাজীর কাছে নিয়ে যাবো, কিন্তু ব্যাটা যাবে না কিছুতেই। তা আমি কী ছাড়বো নাকি?
একে ইহুদী তায় চোর, সুতরাং জনতা রোষে সোচ্চার হয়ে ওঠে। ব্যাটাকে জ্যান্ত কবর দিয়ে দাও।
এদিক-ওদিক থেকে দু’চারটে চড়-চাপড়ও পড়তে থাকে। আকিল বলে, ভাই সব, আমরা সাচ্চা মুসলমান, অন্য ধর্মের কাউকে প্রহার করা আমাদের পক্ষে সঙ্গত হবে না। তার চেয়ে কাজীর কাছে নিয়ে চলুন লোকটাকে। আইনে যা সাজা পাওয়ার তাই সে পাবে।
আকিলের বিজ্ঞজনোচিত বক্তৃতায় সকলেই অনুধাবন করলো উচিত অনুচিত যে কারণেই হোক কোনও ইহুদীর গায়ে হাত ওঠালে ইহুদী মুসলমানে সংঘাত বেধে যেতে পারে।
ইহুদীটাকে প্রায় জোর করেই কাজীর কাঠগড়ায় হাজির করা হলো। কাজী প্রশ্ন করলো, কী ব্যাপার, কী হয়েছে? এই বৃদ্ধ ইহুদীকে ধরে এনেছো কেন তোমরা?
আকিল বলে, ধর্মাবতার, লোকটা চোর। এই দেখুন এর কাঁধে আমার থলেটা! ওটা চুরি করে পালাচ্ছিল, আমি দৌড়ে এসে পাকড়াও করেছি। আপনি এর বিচার করুন।
ইহুদী বলে, এসব মিথ্যে কথা, মালিক, এ থলে আমার। এতে আমার পয়সা কড়ি আছে। কাজী প্রশ্ন করে, কত টাকা আছে তোমার থলেয়?
—জী হুজুর পাঁচশো সোনার মোহর নিয়ে আমি আমার এক মহাজনের কাছে যাচ্ছিলাম–
-মিথ্যে কথা, হুজুর। বিলকুল বানানো কথা। লোকটা শুধু চোরই না—অসৎ মিথুক। ডাহা। মিথ্যে কথা বলছে সে।
কাজী বললো, ঠিক আছে তুমি তো বলছো থলেটা তোমার?
-কোনও সন্দেহ নাই, ধর্মাবতার।
-তা হলে তুমিও বলল, থলেয় কী কী জিনিস আছে?
আকিল তিন মাত্র না ভেবে বলে, সোনার মোহরই, তবে পাঁচশো নয়, চারশো নব্বইটি স্বর্ণমুদ্রা আছে ওতে। এছাড়া আমার আর একটি মূল্যবান জিনিসও আছে ওর মধ্যে।
কাজী এবং ইহুদী আকিলের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়। আকিল বলে, আমার নাম লেখা একটা তামার আংটিও থাকার কথা থলেয়। এই আংটিটার আর্থিক। মূল্য কিছুই নয় কিন্তু আমার কাছে ওটা কোনও কারণে। অমূল্য বস্তু। জানি না চোরটা থলে থেকে ওটা সরিয়ে। ফেলেছে কিনা।
ইহুদী বলে, বিশ্বাস করবেন না হুজুর, একেবারে আষাঢ়ে গপ্পো—
কাজী গম্ভীর হয়ে ইহুদীকে বলে, থলেটা খুলে সব বের কর, দেখি।
সামনের টেবিলের উপর থলেটা উজাড় করে ঢালা হলো। চকচকে মোহরগুলের মধ্যে তামার আংটিটাও বর্ণভেদেই পৃথক হয়ে নজরে পড়লো সকলের। মোহরগুলো গুণে দেখা গেলো চারশো নব্বই—আকিলের কথাই অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেলো। কাজী রায় দিলো, মোহর সুদ্ধ থলেটা আকিলকে দিয়ে দাও আর চোর ইহুদীটাকে পঁচিশ ঘা বেত লাগাও।
মোহরের থলেটা নাচাতে নাচাতে হারামের সঙ্গে আকিল পথে বেরিয়ে আসে। হারাম বলে, বহুৎ বড়িয়া ওস্তাদ কা খেল দেখালে দোস্ত। জবাব নাই।
আকিল বলে, আমার কাজই বুদ্ধির খেলা। এভাবে কত লোককে বোকা বানিয়ে অকূলে ভাসিয়েছি তার ঠিক নাই। যাই হোক, এবার দোস্ত তোমার কেরামতি দেখতে হয়। হাজার হলেও তুমি জাতে সিঁদেল চোর। বুকের পাটা দশ হাত না হলে অন্যের ঘরে ঢোকা যায়?
হারাম মুচকি হাসে। বলে, চলো আজ, তোমাকে একটা জিনিস দেখাই।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা সুলতানের প্রাসাদের পিছনে এসে পড়ে। হারাম বলে দাঁড়াও একটু। আমি একখানা রশি নিয়ে আসি।
আকিলকে দাঁড় করিয়ে রেখে ক্ষণকালের জন্য হারাম অদৃশ্য হয়ে যায়। তারপর এক বাণ্ডিল রশি এনে বলে, আমরা প্রাসাদের ওপরে উঠে যাবো। আমি একাই যেতাম কিন্তু মজাটা দেখাবার জন্য তোমাকেও সঙ্গে নিতে হবে। এসো, আমার পিছনে পিছনে দড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এসো। কোনও ডর নাই।
ভয়ে আকিলের হাত পা কাঁপতে থাকে। কিন্তু অদম্য কৌতূহল এড়াতে না পেরে হারামের পিছনে পিছনে সেও দড়ি বেয়ে প্রাসাদের ছাদে উঠে যায়। তারপর হারামকে অনুসরণ করে করে কখনও নিচে নেমে কখনও ডাইনে ঘুরে কখনও বাঁয়ে চলে এক সময় ওরা একটা দামী পরদা ঝোলানো ঘরের সামনে এসে থামে।
পরদাটা ফাঁক করে হারাম দেখে নেয় ঘরের মাঝখানে একটা সোনার পালঙ্কে এলিয়ে পড়ে আছে সুলতান। আর তার পায়ের কাছে ঢুলুঢুলু চোখে বসে একটি কিশোর নফর পা টিপছে আর বিড়বিড় করে কী যেন বলছে, বোঝা যাচ্ছে না।
হারাম বললো, দোস্ত তুমি এখানেই দাঁড়িয়ে দেখ। আমি ভিতরে ঢুকছি।
আকিলের বুক ধড়াস ধড়াস করতে থাকে। সর্বনাশ যদি জেগে ওঠে সুলতান?
হারাম পা টিপে টিপে ছেলেটির পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। নিদ্রাচ্ছন্ন কিশোর তখন যন্ত্রচালিতের মতো সুলতানের পায়ে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। একখানা রুমাল দিয়ে ছেলেটার মুখ বেঁধে ফেলে হারাম। তারপর পিছমোড়া করে দড়ি দিয়ে বেঁধে দেওয়ালের একধারে ফেলে রাখে।
এরপর হারাম ছেলেটার জায়গায় বসে সুলতানের পা টিপতে আরম্ভ করে। সুলতানও নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলো। তবু পায়ের ওপর কড়া হাতের স্পর্শ পেয়ে ঘুমজড়িত কণ্ঠেই বলে, কীরে অত জোরে জোরে টিপতে আরম্ভ করলি কেন?
হারাম বাচ্চাদের মতো গলা নকল করে বলে, জাঁহাপনা, একটা কিসসা শোনাবো?
সুলতান চোখ না খুলে আধো আধো ঘুমের ঘোরেই বলে, বেশ তো, বলো না।
হারাম বলতে থাকে?
এক শহরে দুই বন্ধুবাস করতো। ওদের একজনের নাম হারাম আর একজনের নাম আকিল। হারাম-এর ব্যবসা চুরি করা। আর আকিল হাত সাফাই করে পকেট মেরে লোক ঠকিয়ে খায়।
এরপরে আকিল কী করে এক ইহুদীর থলে হাত সাফাই করে হাতিয়ে নিয়ে তার মধ্যে নিজের হাতের তামার আংটি রেখে দিয়ে কাজীর কাছে প্রমাণ করেছিলো, থলেটার প্রকৃত মালিক আকিল—ঐ ইহুদী নয়, তা বললো। এরপর হারাম তার কেরামতি দেখাবার জন্য দোস্ত আকিলকে প্রাসাদের পাঁচিল টপকে ভিতরে নিয়ে এলো। তার উদ্দেশ্য সুলতানের প্রাসাদে ঢুকে সে তাকে কিসসা শোনাবে। এবং এমনি তার বুদ্ধি আর সাহস, করলোও সে তাই। সুলতান তার পালঙ্কে শুয়ে এলিয়ে পড়ে আছেন, আর তার পায়ের কাছে বসে পা টিপছে এক ঘুম-কাতর ছোকরা নফর। তাকে কায়দা করে সরিয়ে দিয়ে সে সুলতানের পায়ের কাছে বসে ছেলেটির গলা নকল করে সুলতানকে কিসসা শুনিয়ে দোস্তকে অবাক করে দিলো। এখন বলুন তো জাঁহাপনা, ওদের দুই বন্ধুর মধ্যে কে বড়?
সুলতান ঘুম জড়ানো স্বরেই বললো, কেন? ঐ হারাম? কাজিকে না হয় কঁকি দেওয়া সম্ভব, কিন্তু সুলতানকে ফাঁকি দেবার হিম্মৎ কার হতে পারে?
এরপর হারাম বন্ধুকে সঙ্গে করে প্রাসাদের বাইরে নেমে আসে।
পরদিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে সুলতান দেখলো, তার পেয়ারের ছোকরা বান্দা মুখ বাঁধা অবস্থায় দেওয়ালের পাশে পড়ে রয়েছে। বাঁধন খুলে দিলে সে গতরাত্রের স্বচক্ষে দেখা সব কাহিনী শোনালো সুলতানকে। সুলতান অবাক হলেন, সে কি রে, আমি তো ভেবেছিলাম, তুই আমাকে কি শোনাচ্ছিস। বহুৎ তাজ্জব কি বাত—
দরবারে এসে সুলতান উজিরকে বললো, সারা শহরে তাঁড়া পিটে জানিয়ে দাও সবাইকে, হারাম নামে কে আছে সে এসে নির্ভয়ে আমার সঙ্গে দেখা করুক। আমার প্রাসাদের সুরক্ষা ভেদ করে কাল রাতে সে আমার ঘরে ঢুকেছিলো। কি সাহস, ভাব একবার, আমি ইনাম দিতে চাই। ওকে একবার সামনে হাজির হতে বলো।
সেইদিনই হারাম সুলতানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলো। সুলতান ওর বুদ্ধি এবং সাহসের প্রশংসা করে বললো, আমি খুব খুশি হয়েছি। আজ থেকে তোমাকে আমার সার সলতানিয়তের কোতোয়ালদের সর্দার পদে বহাল করলাম।
সুচতুরা আকিলকে বোঝালো, বুদ্ধি এবং সাহসের জোরে হারাম আজ অনেক বড় হয়ে গেছে। সুতরাং শর্তমতো হারামই আমাকে পাওয়ার অধিকারী। তুমি কিছু মনে দুঃখ রেখ না সোনা, যদিও আমি তার ঘরের বিবি হয়ে যাচ্ছি কিন্তু মনে-প্রাণে তোমাকেও আমি ভালোবাসি ভালোবাসবো।
রাত্রি প্রভাত হয়ে এলো। শাহরাজাদ বললো, গল্পও শেষ হলো রাতও ফুরিয়ে গেলো। আজ এখানেই শেষ। কাল আবার নতুন কিসসা শুরু করা যাবে।