চতুর্থ পরিচ্ছেদ
১.
ধীরে ধীরে বিষাদের ছায়া ঘন হয়ে উঠতে লাগল তাদের জীবনে। এই দুঃখ আর বিষাদের জন্য তাদের একমাত্র সান্ত্বনা আর আনন্দের উৎসস্থল ছিল গরিব-দুঃখীদের অন্ন ও বস্ত্রদান। কসেত্তে যখন জাঁ ভলজাঁ’র সঙ্গে গরিব-দুঃখীদের বস্তিতে গিয়ে খাদ্য, টাকা-পয়সা ও পোশাক-আশাক দান করত তখন সে-ও প্রচুর আনন্দ পেত। তাদের দু জনের মধ্যে যে অন্তরঙ্গতার উত্তাপটা চলে গিয়েছিল, এই সব জনসেবামূলক কাজের মধ্য দিয়ে সেই উত্তাপটা আবার ফিরে পেত তারা। কত দুস্থ লোককে সাহায্য দান করত তারা। কত গরিব ছেলেমেয়েদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলঁত। এমনি এক সময়েই এপোনিনের কাছে চিঠি পেয়ে জনদ্ৰেত্তে’র বাড়িতে যায় তারা।
জনদ্ৰেত্তে’র বাসায় সে রাতের ঘটনার পরদিন সকালে জাঁ ভলজাঁ বাঁ হাতে এক ক্ষত নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। তার হাতটা ফুলে যায়। তার খুব জ্বর হয়। সে এক মাস ধরে শয্যাগত হয়ে থাকে। কিন্তু কোনও ডাক্তার ডাকেনি। কসেত্তে তার সেবা করতে থাকে। কসেত্তে যেমন তার সেবা করে আনন্দ পায় ভলজাঁ তেমনি তার সেবা পেয়ে আগেকার সেই হারানো সুখ ফিরে পায়। কসেত্তে যখন পরম নিষ্ঠার সঙ্গে তার সেবা করত তখন সে তার দিকে তাকিয়ে থেকে মনে মনে বলে উঠত, আমার এই অসুখ, এই আঘাত। পরম উপকার করেছে আমার। আমি সত্যিই ভাগ্যবান।
তার বাবা অসুস্থ থাকায় কসেত্তে তার বাবার কটেজেই সারাদিনের মধ্যে বেশির ভাগ সময় কাটাত। তার বাবার বিছানার পাশ বসে ভ্রমণের বই পড়ে আনন্দ পেত সে। যেন এক নবজন্ম লাভ করল ভলজাঁ। লুক্সেমবুর্গ বাগান, সেই অচেনা অদ্ভুত যুবক, কসেত্তে’র ভাবান্তর আগে যে সব কথা ভেবে কষ্ট পেত মনে, সে সব কথা মন থেকে সরে গেল তার। সে তখন মনে মনে বলতে লাগল, আমি বোকা, এসব আমার মনের কল্পনা মাত্র।
নতুন সুখের মত্ততায় জনদ্ৰেত্তেই যে থেনার্দিয়ের এ নিয়ে আর বেশি ভাবল না সে। তা নিয়ে বেশি মনঃকষ্ট পেল না। তাদের কথা ভাবতে গেলে শুধু একটা দুঃখই হয়। তারা বড় দুরবস্থার মধ্যে আছে। তারা এখন জেলখানায় আছে। সুতরাং তারা এখন আর কারও কোনও ক্ষতি করতে পারবে না।
কসেত্তে ব্যারিয়ের দু মেনের ঘটনার কথা উল্লেখ করেনি।
কনভেন্টে থাকাকালে সিস্টার মেফতিলদে কসেত্তেকে কিছু গান শিখিয়েছিল। কসেত্তে এক একদিন সন্ধের সময় যখন ভলজাঁ’র কাছে তার কটেজে বসে থাকত তখন প্রাণ খুলে গান করে ভলজাঁকে প্রীত করত।
বসন্ত এল। বাগানটা ফুল আর কচি কিশলয়ে এমনভাবে ভরে উঠল যে তা দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে একদিন কসেত্তেকে বলল, তুমি বাগানে মোটেই যাও না। আমি চাই তুমি সেখানে গিয়ে মাঝে মাঝে বেড়াও।
কসেত্তে বলল, তা হলে আমি নিশ্চয় যাব সেখানে।
তার বাবাকে খুশি করার জন্য একা একাই বাগানে বেড়াত কসেত্তে। রাস্তা থেকে গেট দিয়ে তাকে দেখে ফেলে এই ভয়ে ভলজাঁ বাগান দিয়ে বড় একটা যেত না।
ভলজাঁ’র হাতের ক্ষতটা এক বিরাট পরিবর্তন এনেছিল দু জনের জীবনধারায়। কসেত্তে যখন দেখল ধীরে ধীরে সেরে উঠছে ভলজাঁ এবং ক্রমে সে মনে মনে হালকা হয়ে উঠছে তখন সে মনে এমন একটা তৃপ্তির অনুভূতি লাভ করছিল, যার কথা সে ভালোভাবে বুঝতেই পারছিল না। তখন মার্চ মাস। বসন্ত শেষ হয়ে আসছিল। শীত বিদায় নেবার সঙ্গে সঙ্গে তা আমাদের মনের অনেক দুঃখ নিয়ে যায়। দেখতে দেখতেই মার্চ গিয়ে এপ্রিল এল। গ্রীষ্মের সকালগুলো বড় মনোরম, শৈশবকালের মতোই আনন্দময়। এই সময় সকালবেলায় আকাশ, মেঘ, মাঠ, বন, গাছপালা, ফুল প্রভৃতি থেকে এমন এক মায়াময় আলোকরশ্মি ঝরে পড়ে, যা আমাদের অন্তরকে স্পর্শ না করে পারে না।
কসেত্তে’র বয়স তখন কম থাকায় এপ্রিল মাসের এই ঐন্দ্রজালিক আবেদনে তার অন্তর ঠিকমতো সাড়া দিতে পারছিল না। কিন্তু সে ঠিক বুঝতে না পারলেও এ মাসের আলো তার মন থেকে ছায়াচ্ছন্ন বিষাদের অনেকখানি তার অগোচরেই অপসারিত করে ফেলেছিল, যেমন মধ্যাহ্নে উজ্জ্বল আলো গুহার অনেক অন্ধকার সরিয়ে দেয়। কসেত্তে’র মনে তখন সত্যিই কোনও দুঃখ ছিল না। সে তার মনের এই রূপান্তরের কথা ঠিক বুঝতে না পারলেও প্রায়দিন প্রাতরাশের পর যখন তার বাবাকে কিছুক্ষণের জন্য বাগানে বেড়াতে নিয়ে যেত এবং তার বাবার সঙ্গে পায়চারি করতে করতে তার বাবার ক্ষত হাতটায় হাত বোলাত তখন সে সত্যিই খুব আনন্দ পেত।
তার এই আনন্দের আবেগটা তার গাল দুটোতে তার দেহের স্বাস্থ্য আর মনের সুখের উজ্জ্বলতার প্রতীক হয়ে ফুটে উঠত যখন ভলজাঁ তখন তা দেখে আনন্দের আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠত। সে ভাবত, আমার ক্ষতটা সত্যিই আমাকে ভাগ্যবান করে তুলেছে। এ কথা ভাবতে গিয়ে সে থেনার্দিয়েরদের প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুভব না করে পারত না।
ভলজাঁ একেবারে সেরে উঠলে সন্ধের সময় সে একা একা আবার পথে পথে ঘুরে বেড়াত আগের মতো।
কিন্তু প্যারিসের নৈশ নির্জন রাজপথে কেউ ঘুরে বেড়ালে কোনও ঘটনার সম্মুখীন হবে না কোনওদিন, এটা ভাবাই যায় না।
.
২.
একদিন সন্ধ্যাবেলায় দেখা গেল গাভ্রোশের সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি। আগের দিনও তার কিছু খাওয়া হয়নি। ক্রমেই সে ক্লান্ত ও দুর্বল হয়ে পড়ছিল। তাই সে ঠিক করল আজ রাতে যেখান থেকে তোক কিছু খাবার জোগাড় করতেই হবে। সালপ্রেত্রিয়ের পার হয়ে নির্জন পথ দিয়ে হেঁটে চলেছিল সে। সে পথে কোনও লোক দেখা না গেলেও সে ভাবল কোথাও কিছু পড়ে থাকলে দেখতে পাবে সে। হাঁটতে হাঁটতে সে বুঝল অস্টারলিৎস অঞ্চলে এসে পড়েছে।
আগে একবার এই অঞ্চল দিয়ে বেড়াবার সময় গাভ্রোশে একটা পুরনো বাগান দেখেছিল। সেই বাগানে একজন বয়োপ্রবীণ লোক একজন মহিলার সঙ্গে প্রায়ই বেড়াত। সে দেখেছে সেই বাগানে একটা আপেলগাছ আছে আর একটা চালাঘর আছে। সেই চালাঘরেও হয়তো গাছ থেকে পেড়ে আপেল জমা করে রাখা হয়েছে। আপেল এক ভালো খাদ্য, প্রাণশক্তির উৎস। যে আপেল একদিন আদমের স্বর্গচ্যুতি ঘটিয়েছিল, সেই আপেলই আজ গাভ্রোশের প্রাণ বাঁচাতে পারে। বাগানটার বাইরে এক নির্জন গলিপথ আছে। সে অঞ্চলে বাড়িঘর বেশি না থাকায় বাগানের পাশে পথের ধারে আগাছার ঝোঁপঝাড় গজিয়ে উঠেছে।
গাভ্রোশে যখন বাগানটার কাছে গিয়ে পৌঁছল তখন প্রায় সন্ধে হয়ে গেছে। কিন্তু বাগানটার পাঁচিলের কাছে আসতেই সে বাগানের ভেতর মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। সে গেটের পাশ থেকে উঁকি মেরে দেখল বাগানের ভেতর একটা বড় পাথরের উপর একজন বুড়ো লোক বসে আছে, আর তার সামনে একজন বৃদ্ধা মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। গাভ্রোশে সেইখানে থমকে দাঁড়িয়ে তাদের কথাবার্তা শুনতে লাগল।
মহিলাটি বলল, মঁসিয়ে মেবুফ।
গাভ্রোশে ভাবল, ‘মেবুফ’ নামটা কী খারাপ!
বৃদ্ধ লোকটি কোনও উত্তর না দেওয়ায় বৃদ্ধা আবার ডাকল, মঁসিয়ে মেবুফ!
এবার বৃদ্ধ মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, কী বলছ মেরে প্লুতার্ক?
গাভ্রোশে ভাবল মহিলাটির নাম তা হলে প্লুতার্ক।
বৃদ্ধা মহিলাটি বলল, মঁসিয়ে মেবুফ, বাড়িওয়ালা ভাড়া চাইছে। কিসের ভাড়া?
ওরা তিন কোয়ার্টারের ভাড়া পাবে আপনার কাছ থেকে।
তা হলে আর তিন মাস পরে চার কোয়ার্টার পুরো হবে।
ওরা বলছে আপনাকে বাড়ি থেকে বার করে দেওয়া হবে।
তা হলে আমাদের চলে যেতে হবে।
তাছাড়া কাঠের দোকানদার বলছিল কাঠের বাকি দাম না মেটালে আর কাঠ দেবে না। কিন্তু জ্বালানিকাঠ না পেলে কী করে আগুন জ্বালাব শীতে?
সূর্যের রোদ আছে।
মাংসের দোকানের মালিক বলছিল সে আর মাংস দেবে না।
শুনে খুশি হলাম। মাংস আর আমার সহ্য হচ্ছে না। বড় গুরুপাক।
কিন্তু কী খেয়ে আমরা বাঁচব?
কেন, রুটি খেয়ে।
কিন্তু রুটিওয়ালার সেই এক কথা। সে-ও আর ধারে রুটি দেবে না।
ভালো।
কিন্তু কী খেয়ে জীবন ধারণ করব আমরা?
তা হলে কিছু আপেল খেয়ে থাকব।
কিন্তু মঁসিয়ে, এভাবে আমাদের টাকা ছাড়া চলতে পারে না।
আমার টাকা নেই।
বৃদ্ধা এবার বৃদ্ধ লোকটিকে সেইভাবে একা রেখে চলে গেল। বৃদ্ধ একা একা সেইখানে বসে ভাবতে লাগল। এদিকে গাভ্রোশেও তখন ভাবছিল। তখন অন্ধকার ঘন হয়ে উঠছিল বাগানে। গাভ্রোশে নিঃশব্দে চোরের মতো বাগানে ঢুকে মেবুফে’র পেছনের দিকে একটা ঝোঁপের ধারে এক জায়গায় তার শোবার জায়গা খুঁজছিল। হঠাৎ সে দেখল অন্ধকারে দুটো ছায়ামূর্তি বাগানের দিকে গলি থেকে এগিয়ে আসছে।
সে দেখল দু জন লোকের মধ্যে প্রথম লোকটি বয়োপ্রবীণ। তাকে ভদ্রলোক বলেই মনে হয়। দ্বিতীয় লোকটির বয়স কম। সে একটা কোট আর টুপি পরেছিল। সে প্রথম লোকটিকে অনুসরণ করছিল। গাভ্রোশে দ্বিতীয় লোকটিকে চিনতে পারল, সে তপার্নেসি। গাভ্রোশে লুকিয়ে রইল এক জায়গায়। সে বুঝতে পারল মঁতপার্নেসি শিকারের খোঁজে বেরিয়েছে এবং প্রথম লোকটিকে তার শিকার হিসেবেই অনুসরণ করছে। তার প্রথম লোকটির প্রতি দয়া হল। কিন্তু কী করবে সে? তার মনে হল সে যদি বয়স্ক লোকটিকে উদ্ধার করতে যায় তা হলে দু জনকেই মঁতপার্নেসি খেয়ে ফেলবে, তাদের দুজনকেই ছুঁড়ে ফেলে দেবে।
গাভ্রোশে যখন এই সব ভাবছিল তখন মঁতপার্নেসি প্রথম লোকটিকে আক্রমণ করল পেছন থেকে। যেন কোনও হিংস্র বাঘ একটা গাধার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
গাভ্রোশে চিৎকার করে উঠল। কিন্তু দেখল প্রথম লোকটি মঁতপার্নেসিকে মাটিতে ফেলে দিয়ে তার বুকের উপর হাঁটু দিয়ে পাথরের মতো বসে পড়েছে।
গাভ্রোশে এটা আশা করতে পারেনি। বয়স্ক লোকটি শুধু মঁতপার্নেসির আক্রমণকে প্রতিহত করতে পারেনি, মঁতপার্নেসিকে মাটিতে ফেলে দিয়ে তার উপর বসে পড়েছে। মঁতপার্নেসি নিস্পন্দ হয়ে পড়ে আছে যেন সে মরে গেছে। বয়স্ক লোকটি কোনও কথা বলল না। সে উঠে দাঁড়িয়ে মঁতপার্নেসিকে বলল, ওঠ।
মঁতপার্নেসি উঠে দাঁড়াল। কিন্তু তখনও তাকে ধরে ছিল বয়স্ক লোকটি। মঁতপার্নেসি প্রচণ্ড রাগ আর লজ্জার সঙ্গে এমনভাবে তাকাচ্ছিল যেন মনে হবে একটা ভয়ঙ্কর নেকড়ে একটা সামান্য ভেড়ার দ্বারা নিগৃহীত হচ্ছে। ঘটনাটা অপ্রত্যাশিতভাবে উল্টে যাওয়ায় খুশি হয়েছিল গাভ্রোশে।
বয়োপ্রবীণ লোকটি মঁতপার্নেসিকে বলল, তোমার বয়স কত?
আমার বয়স উনিশ।
তুমি স্বাস্থ্যবান এবং বলবান। কেন তুমি কাজ করো না?
আমার ভালো লাগে না।
তুমি কী করো?
আমি ভবঘুরে হয়ে ঘুরে বেড়াই।
বাজে কথা বলো না। তোমাকে কোনও সাহায্য করতে পারি? তুমি কী হতে চাও?
চোর।
তার পর দু জনেই চুপ হয়ে গেল। বয়স্ক লোকটি কী ভাবতে লাগল। সে তখনও মঁতপার্নেসিকে ধরে ছিল। মঁতপার্নেসি নিজেকে ছাড়াবার জন্য হাত-পা ছুঁড়ছিল। অন্ধকার ঘন হয়ে ছিল তাদের চারদিকে। বয়স্ক লোকটি মঁতপার্নেসিকে সেইভাবে ধরে এক বক্তৃতা দিয়ে চলল। সে বলতে লাগল, আলস্যই তোমার জীবনকে মাটি করে দিয়েছে। তুমি বলছ তুমি ভবঘুরে। কিন্তু তোমাকে খেটে খেতেই হবে। জীবনের পথ তোমায় পরিবর্তন করতে হবে। তুমি সদ্ভাবে জীবনযাপন করতে চাও না। পরিশ্রম করতে চাও না। পরিশ্রমসহকারে কাজ করে জীবিকার্জন করাই মানুষের ধর্ম। তুমি যদি কাজ করে জীবিকা অর্জন না করে তা হলে তোমাকে নিগ্রোদের মতো ক্রীতদাস হতে হবে। তোমাকে হয় মাঠে লাঙল দিয়ে জমি চাষ করতে হবে অথবা নৌকার দাঁড় বাইতে হবে অথবা জ্বলন্ত চুল্লির সামনে দাঁড়িয়ে লোহা পেটাতে হবে। কাজ না করে চুরি করে জীবিকা জোগাড় করতে হলেও তোমাকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে। দড়ির সাহায্যে জানালা দিয়ে কোনও বাড়িতে ওঠানামা করতে হবে অথবা ঘরের দরজার তালা ভাঙতে হবে। তার জন্য যন্ত্রপাতি জোগাড় করতে হবে। চুরি করার জন্য যত কলাকৌশলই দেখাও না কেন, তার পুরস্কার হচ্ছে জেলে যাওয়া। এটাই তোমার ভবিষ্যৎ। আলস্য আর সস্তা আনন্দের জীবন ফাঁদের মতো তোমার জীবনকে গ্রাস করবে। তুমি বিনাশ্রমে ভালো খাবার, পানীয় আর নরম বিছানা চাও, কিন্তু তার পরিবর্তে পাবে শুধু কালো শক্ত রুটি, জল আর কাঠের তক্তা। তাছাড়া অনেক সময় বনে-জঙ্গলে তোমাকে জন্তু-জানোয়ারের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হবে। নিজের ওপর একটু দয়া করো ছোকরা। তুমি ভুল পথে যাচ্ছ। এইভাবে কুড়ি থেকে জীবন শুরু করে দেখতে দেখতে তোমার বয়স বার্ধক্যে উপনীত হবে। তোমার মাথার চুল পেকে যাবে। অপরাধমূলক কাজ হল সবচেয়ে কঠোর শ্রমের কাজ। আমার কথা শোন। সৎ জীবনযাপন তার থেকে অনেক ভালো। ঠিক আছে, তুমি আমার কাছ থেকে কী চাইছিলে? টাকার থলে? এই নাও?
লোকটি তার টাকার থলেটা পকেট থেকে বার করে পার্নেসির হাতে দিতেই সে সেটা কত ভারী তা পরীক্ষা করে দেখে তার কোটের পকেটে ভরে দিল। তার মনে হল সে যেন সেটা চুরি করে নিয়েছে।
এরপর লোকটি শান্তভাবে তার পথে চলে গেল। এই বয়স্ক লোকটি কে তা বুঝতে আশা করি পাঠকদের কষ্ট হবে না।
মঁতপার্নেসি তার পথের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর বলল, বৃদ্ধ বাঁচাল। গাভ্রোশে একটু দূরে একটা ঝোঁপের আড়ালে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিল। সে বুঝল মঁসিয়ে মেবুফ এখনও হয়তো সেই পাথরটার উপর বসে ঝিমোতে ঝিমোতে ঘুমিয়ে পড়েছে। মঁতপার্নেসি তখনও আচ্ছন্নের মতো সেখানে দাঁড়িয়ে গভীরভাবে কী ভাবছিল। গাভ্রোশে ধীর পায়ে মঁতপার্নেসির পেছনে এসে তার টেলকোটের পকেট থেকে টাকার থলেটা তুলে নিল। মঁতপার্নেসি তা টের পেল না।
এবার গাভ্রোশে মেবুফ যেখানে পাথরটার উপর বসে ঘুমোচ্ছিল সেখানে চলে গেল। সে তার সামনে পায়ের কাছে টাকার থলেটা ফেলে দিয়ে নিঃশব্দে পালিয়ে গেল।
থলেটা মেবুফে’র পায়ের উপর পড়তেই জেগে উঠল সে। থলেটা কুড়িয়ে নিয়ে সে সেটা খুলে দেখল তার মধ্যে ছটা নেপোলিয়ঁ বা স্বর্ণমুদ্রা আছে।
আনন্দের উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে মেবুফ সেগুলো মেরে প্লুতার্কের হাতে দিয়ে বলল, এই থলেটা নিশ্চয় স্বর্গ থেকে পড়েছে। এটা ঈশ্বরের দান।