কালো শালওয়ার – সাদত হাসান মান্টো
দিল্লি আসার আগে সে থাকত আম্বালা ফৌজি ক্যাম্পের কাছে। জনাকয়েক গোরা সৈনিক তার খদ্দের। তাদের সঙ্গে মেলামেশা করে দশ-পনেরোটি ইংরেজি কথা সে আয়ত্ত করতে পেরেছিল। সাধারণ আলাপ-আলোচনায় এসব কথা প্রয়োগ করত না কখনও। কিন্তু দিল্লি এসে অবধি ব্যবসা যখন একেবারেই মন্দা, তখন প্রতিবেশিনী তমন্চা জানকে একদিন সে বলল, ‘দিস্ লাইফ ভেরি ব্যাড।’ অর্থাৎ এ জীবন বড় দুর্বিষহ। কারণ, এখানে পেট ভরার উপায়টুকু পর্যন্ত নেই।
আম্বালা-ক্যাম্পে তার ব্যবসা ভালোই চলত। কষে মদ খেয়ে গোরারা আসত তার কাছে। তিন-চার ঘণ্টার মধ্যেই আট-দশটি গোরার মনোতুষ্টি ঘটিয়ে বিশ-ত্রিশ টাকা উপায় করে নিতে পারত সহজেই। দেশি খদ্দেরের চাইতে গোরারাই বরং ভালো। গোরাদের কথা সুলতানা খুব কমই বুঝত। আর এই না-বুঝতে পারাটাই শাপে বর ছিল তার পক্ষে।
গোরারা কসেশন চাইলে মাথা নাড়িয়ে সে বলে দিত, ‘সায়েব, তোর কথা কিছুই বুঝি-টুঝি না।
আর, বেশিরকম হেস্তনেস্ত করতে চাইলে মাতৃভাষায় খুব খানিক গালাগালি দিত সে। তবু বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকলে বলত, ‘সায়েব, তুই একটা আস্ত প্যাচা, হারামজাদা, শুয়োর। বুঝলি?’
কড়া গলায় না-বলে কথাগুলো বলত খুব নরম করে। আর, তার পরই ফিক্ করে হেসে দিত। তাই-না দেখে হেসে ফেলত গোরারাও। সুলতানার তখন মনে হত, হ্যাঁ, সত্যি সত্যি তারা প্যাঁচাই বটে।
কিন্তু দিল্লি এসে অবধি কেউ তার ছায়া মাড়ায়নি। গোরা না, কেউ না। ভারতের এই বিরাট শহরটিতে তিন মাস হল তার আসা। সুলতানা শুনেছে, এই শহরেই নাকি বড়লাট থাকেন। গ্রীষ্মকালে তিনি যান শিমলায়
একজনও আসেনি, একথা ঠিক নয়। এসেছে। এই তিন মাসে মাত্র ছ’জন। আল্লা সাক্ষী, মিথ্যে নয়– ছয়টি খদ্দেরের কাছে সে কামাই করেছে সাড়ে আঠারোটি টাকা। তিন টাকার বেশিতে কেউ রাজিই হতে চায়নি। সুলতানা প্রথম পাঁচজনকে রেট বলেছিল দশ টাকা। কিন্তু কী আশ্চর্য, তাদের প্রত্যেকেই জবাব দিয়েছে, তিন টাকার বেশি এক পয়সাও দিতে পারবে না।
কেন জানি তাদের সবাই একবাক্যে সুলতানাকে তিন টাকার যোগ্যি বলেই মনে করল। তাই ছয়জনের জন এলে সে নিজেই বলল, ‘দ্যাখো বাপু, এক টাইম থাকতে হলে তিন টাকা লাগবে। এক আধলাও কম হবে না। থাকতে হয় থাকো, নাহয় চলে যাও।’
কথা শুনে লোকটি আর তর্ক না করে মেনেই নিল।
অন্য কামরায় গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে লোকটা কোট খুলছে– সুলতানা তার কাছে হাত পাতল, ‘একটা টাকা দাও দিকিনি দুধের জন্যে।’
বাড়তি এই একটা টাকার দাবি মানল না সে। কিন্তু কী মনে করে পকেট থেকে নতুন রাজার একটা চকচকে আধুলি বের করে দিল। টুপ্ করে আধুলিটা নিয়ে সুলতানা ভাবল, যাগ্ গে, যা এল তাই সই।
পুরো তিন মাসে মাত্র সাড়ে আঠারো টাকা।
বাসাভাড়া মাসে বিশ টাকা। বাসা নয়, মালিকের ভাষায় ওটার নাম ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাটের পায়খানাটা চমৎকার। শেকল ধরে একটুখানি টান দিলেই সমস্ত ময়লা ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যায়। আর, সে কী হড়হড় গড়গড় শব্দ! বাব্বাহ্। প্রথমদিকে সুলতানা রীতিমতো ভয় পেয়ে যেত এই শব্দ শুনে। প্রথম যে দিন সে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে আসে এই পায়খানায়, সেদিন তার মাজায় ভয়ংকর ব্যথা। তাই, ওঠার সময় ঝোলানো শেকলটা ধরে উঠতে গেল। সে ভেবেছিল ওঠার সুবিধের জন্যই বুঝি-বা এই বিশেষ ব্যবস্থাটি করা হয়েছে। উঠতে যাতে কষ্ট না হয়, তার জন্যই বুঝি-বা শেকলের ব্যবস্থা। কিন্তু যেই-না উঠতে যাওয়া, অমনি হঠাৎ উপরে কিসের যেন ভীষণ শব্দ আর সঙ্গে সঙ্গে বেজায় হইচই করে নিচের দিকে পানির বন্যা। ভয়ে আঁতকে উঠে সুলতানা শেষপর্যন্ত চেঁচিয়েই ফেলেছিল।
অন্য কামরায় খোদাবখ্শ ফোটোগ্রাফির যন্ত্রপাতি ঠিক করছিল। একটা পরিষ্কার বোতলে রাখতে যাচ্ছিল হায়ড্রো কুইনিয়ন। এমন সময় সুলতানার চিৎকার শুনে সে ছুটে এল। বাইরে থেকে তাকে শুধোল, ‘বলি হল কী? তুমিই চ্যাঁচাচ্ছ নাকি?’
সুলতানার বুক তখনও ভয়ে দুরুদুরু কাঁপছে। বলল, ‘এটা কি ছাই পায়খানা, না অন্যকিছু? রেলগাড়ির শেকলের মতো এটা আবার কী ঝুলিয়ে রেখেছে? মাজায় ব্যথা, তাই ভাবলাম, এটা ধরেই উঠব। ও মা, উঠব কী, টান পড়তেই সে কী মহা হইচই!’
কাণ্ড দেখে খোদাবখ্শের হাসি যেন থামতেই চায় না। শেষে এখানকার পায়খানার সব রহস্যই উদ্ঘাটিত করে দিয়েছিল সুলতানার কাছে। বলেছিল, ‘শেকলটা আর কিছু না, শুধু ময়লা পরিষ্কার করার জন্যে।’
খোদাবখ্শ আর সুলতানার মধ্যে পরিচয় হওয়ার ব্যাপারটা বেশ একটু লম্বাচওড়া।
খোদাবখ্শের বাড়ি রাওয়ালপিন্ডি। এন্ট্রান্স পাস করার পর সে লরি চালানো শেখে। চার বছর অবধি লরি চালায় রাওয়ালপিন্ডি থেকে কাশ্মির সীমান্তের মধ্যে। কাশ্মিরে আলাপ হয় একটি মেয়ের সঙ্গে। মেয়েটিকে ইলোপ করে সে লাহোর নিয়ে আসে। লাহোরে কোনও কাজকামের খোঁজ না-পাওয়ায় মেয়েটিকে দেহব্যবসায় বসিয়ে দেয় সে। দু-তিন বছর এমনি করে কেটে যায়।
হঠাৎ একদিন মেয়েটি পালিয়ে যায় আর-একজনের সঙ্গে। খোদাবখ্শ টের পায়, সে এখন আম্বালায়। তারই খোঁজে আম্বালা এসে খোদাবখ্শ পেল আর-একটি মেয়ের সন্ধান। সে-ই এই সুলতানা। সুলতানার ভালো লাগল খোদাবখ্শকে। তাই তার সঙ্গে একটা সম্পর্কও গড়ে উঠল অনায়াসেই।
সুলতানার ব্যবসা বেশ জমে উঠল। খোদাবখ্শই যেন এর জন্য দায়ী। মেয়ে মাত্রই একটু সহজবিশ্বাসী। তাই, সুলতানা ভাবতে পারল, খোদাবখ্শ বড় সুলক্ষুনে। খোদাবখ্শ তার কাছে এসেছে বলেই তার আজ এত উন্নতি। তাই ওকে খুব সম্মানের চোখেই দেখতে লাগল সে।
খোদাবখ্শ লোকটাও পরিশ্রমী। বসে খাওয়া তার ধাতে সয় না। তাই একটা ফোটোগ্রাফারের সঙ্গে সে আলাপ করে নেয়। রেলস্টেশনের বাইরে বসে লোকটা মিনিট ক্যামেরায় ফোটো তুলত। তারই কাছে ফোটো তোলা শিখছে খোদাবখ্শ। সুলতানার কাছ থেকে ষাটটা টাকা নিয়ে একটা ক্যামেরাও কিনেছে। তার পর, জোগাড় করেছে একটা পর্দা, দুটো চেয়ার আর ছবি ধোয়ার সব জিনিসপত্তর।
কাজ ভালোই চলছিল। শেষে একদিন আম্বালা ফৌজি ক্যাম্পের ধারে তার দোকান উঠে এল। এখানে ছবি তুলত গোরারা। মাসখানেকের মধ্যেই অনেক কয়জনা গোরার সঙ্গেই তার আলাপ জমে উঠল। তাই সুলতানাকে সে নিয়ে এল সেখানে। খোদাবখশের মাধ্যমেই জনকয়েক গোরা নিয়মিত খদ্দের বনে গেল সুলতানার। তার আয়টাও আগের চাইতে বেড়ে গেল দ্বিগুণ।
কানের দুল আর সাড়ে পাঁচ তোলা ওজনের আটটা কাঁকন বানাল সুলতানা। দশ-পনেরোটা ভালো ভালো শাড়ি, ঘর-সাজানোর মতো ফার্নিচার– তা-ও এল। মোটকথা, আম্বালা ক্যাম্পের ওখানে আরাম-আয়াসের কোনওরকম ত্রুটিই ছিল না।
কিন্তু হঠাৎ করে খোদাবখ্শের মাথায় কী দুর্বুদ্ধি গজাল, দিল্লি আসতে চাইল সে। সুলতানাই-বা আপত্তি করে কেমন করে। খোদাবখ্শই যে তার জীবনের সকল উন্নতির মূলকথা। তাই সে খুশিমনেই রাজি হল দিল্লি আসতে। বরং সে ভাবল, এত বড় শহর– যেখানে কি না লাট সাহেবের বাস সেখানে ব্যবসা নিশ্চয় আরও ভালো জমবে। সখীদের মুখেও দিল্লির খুব প্রশংসা শুনেছে সে। তাছাড়া, দিল্লিতে নেজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগা-শরিফ, মনে-মনে যাঁর প্রতি তার অগাধ শ্রদ্ধা। তাই ভারী জিনিসপত্তর বিক্রি করে দিয়ে খোদাবখ্শের সঙ্গে সুলতানা দিল্লি চলে এল।
দিল্লি এসে একটা ছোটমতো ফ্ল্যাট নিল বিশ টাকা ভাড়ায়। ওরা দুজনেই এখন এই ফ্ল্যাটের বাসিন্দা।
একই ধরনের অনেক বাড়ির লম্বা একটা সারি রাস্তার ঘুরপাকের সঙ্গে তাল রেখে এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে। মিউনিসিপ্যাল কমিটি বিশেষভাবে বেশ্যাদের জন্যই তৈরি করে দিয়েছে এগুলো। যেন শহরের যেখানে-সেখানে বিক্ষিপ্তভাবে এই নোংরামি প্রশ্রয় না পায়। নিচের তলায় দোকান, উপরে বাসোপযোগী ফ্ল্যাট।
সবগুলোরই ডিজাইন যেহেতু একইরকমের, তাই গোড়ার দিকে নিজের ফ্ল্যাটখানা খুঁজে বের করতে হিমশিম খেতে হয়েছে সুলতানাকে। কিন্তু লভিটায় নতুন সাইনবোর্ড লাগার পর থেকে নিজের ফ্ল্যাট খুঁজে বের করার একটা উপায় হয়েছে। ‘এখানে ময়লা কাপড় ধোলাই করা হয়’–এই সাইনবোর্ডখানা পড়ে তবে সুলতানা নিজের ফ্ল্যাট খুঁজে বের করে।
ফ্ল্যাট খুঁজে বের করার এমনি আরও অনেক চিহ্ন পাওয়া গেছে, যেমন বড় বড় হরফে লেখা– ‘কয়লার দোকান’, আর এখানেই থাকে তার অন্যতম সখী হিরাবাঈ। হিরাবাঈ মাঝে মাঝে রেডিওতে গান গায়। যেখানটায় লেখা রয়েছে, ‘এখানে ভদ্রমহোদয়গণের উৎকৃষ্ট থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা রহিয়াছে’– সেখানে থাকে তার অন্য সখী মুক্তা। ফিতার কারখানার উপরতলায় থাকে আনওয়ারি। এই কারখানারই মালিক শেঠজির সে ঝি। রাত্রে কারখানাটার ওপর নজর রাখতে হয় বলে শেঠজি আনওয়ারির কাছেই রাত্রিবাসের একটা ব্যবস্থা করে নিয়েছেন।
এক মাস কেটে যাওয়ার পরেও যখন খদ্দের জোটে না, সুলতানা তখন নানা কথা বুঝিয়ে মনকে সান্ত্বনা দেয়। ভাবে, দোকান খোলার সঙ্গে সঙ্গেই কি আর খদ্দের জোটে! একটু সময় লাগবে বইকি। কিন্তু দেখতে দেখতে আরও এক মাস পেরিয়ে গেল। সুলতানার মনে তখন সংশয়ের কুজ্বটিকা।
একদিন সে বলল, ‘ব্যাপার কী বলো দেখি, খোদাবখ্শ! দু মাস হল আমরা এখানে বাসা বেঁধেছি। একটা মরা মাছিও তো মুখে বসল না। ধরে নিচ্ছি, বাজার আজকাল খুব খারাপ। তাই বলে পুরো দু মাসে একটাও খদ্দের জুটবে না!’
খোদাবখ্শও অনেকদিন থেকেই ব্যাপারটা ভাবছে। ভেবে কিছুই কূলকিনারা করতে পারেনি বলেই মৌন সে। কিন্তু এখন সুলতানা যখন নিজেই কথাটা পেড়ে বসেছে, তখন আর চুপ থাকা যায় না। বলল, ‘আমিও অনেকদিন থেকেই ভাবছি, সুলতানা। মনে হয়, যুদ্ধের হুজুগে পড়ে সবাই যার যার ভাবনাচিন্তায় ব্যস্ত; তাই এ-মুখো কেউ হতে চায় না। তাছাড়া, এমনও হতে পারে– ‘
কথা শেষ হওয়ার আগেই সিঁড়ি ভাঙার শব্দ ভেসে এল। সচকিত হয়ে উঠল ওরা দুজনেই। একটু পরেই কড়া নড়ে উঠল। খোদাবখ্শ লাফিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল। ভেতরে ঢুকল একটি লোক। এই লোকটিই সুলতানার প্রথম খদ্দের। তিন টাকায় তার সঙ্গে ফয়সালা হয়েছে। এরপর এসেছে আরও পাঁচ জন। অর্থাৎ তিন মাসে ছজন। ছয়জনের কাছে সুলতানা পেয়েছে মাত্র সাড়ে আঠারো টাকা।
ফ্ল্যাটের ভাড়া মাসে বিশ টাকা। কিন্তু এছাড়াও খরচ রয়েছে। পানির ট্যাক্স, ইলেকট্রিক বিল, ঘর-সংসারের আরও অনেক টুকিটাকি খরচ। খাওয়া-দাওয়া, কাপড়-চোপড়, ওষুধ-পথ্য– এসব তো রয়েছেই। অথচ, আয় কিছুই নেই। তিন মাসে সাড়ে আঠারো টাকা এসে থাকলে তাকে কি আর আয় বলা যায়!
সুলতানার দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। আম্বালায় তৈরি-করা সাড়ে পাঁচ তোলা ওজনের আটটা কাঁকন একে একে খসে গেল। সর্বশেষ কাঁকনটির পালা এলে বলেছিল, ‘আমার একটা কথা রাখবে? চলো, আমরা আবার আম্বালা ফিরে যাই। এখানে থেকে আর কী হবে, বলো? আমার আর মোটেও ভালো লাগছে না। ওখানে তোমার ব্যবসাটা বেশ চলছিল। যাগ গে, যা হবার হয়েছে। এখন আর এখানে থেকে কাজ নেই। এই কাঁকনটা বিক্রি করে দিয়ে এসো। জিনিসপত্তর আমি সব গুছিয়ে রাখছি। আজ রাত্রের গাড়িতেই রওনা হতে চাই।’
সুলতানার হাত থেকে কাঁকনটা নিয়ে খোদাবখ্শ বলল, ‘না, সুলতানা। আমরা আম্বালা ফিরে যাচ্ছিনে। দিল্লিতে থেকেই যা হোক কিছু একটা করতে হবে। দেখে নিও, তোমার সব কাঁকন আবার ফিরে আসবে। আল্লার ওপর ভরসা রেখো। তিনি সব করতে পারেন। আমাদের একটা ব্যবস্থাও নিশ্চয় তিনি করবেন।’
সুলতানা মৌন। এমনি করে শেষ কাঁকনটাও হাত থেকে চলে গেল। গয়নাহীন হাতটার দিকে তাকাতে গিয়ে তার দুঃখ হল খুব। কিন্তু উপায় কী। হাতের চাইতে পেটের পরিচর্যার ব্যবস্থাটাই আগে করতে হবে বইকি।
পাঁচ মাস পেরিয়ে গেছে। ব্যয়ের চেয়ে আয়ের পরিমাণ তখন আরও কমে এসেছে। সুলতানার এখন দুর্ভাবনার পরিসীমা নেই। খোদাবখ্শ এখন সারাদিনমান বাসামুখো হতে চায় না। সে জন্যও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত সুলতানা। দু-তিনটি প্রতিবেশিনী অবশ্যি রয়েছে। ইচ্ছে করলেই তাদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করা যায়। কিন্তু অষ্টপ্রহর তাদের কাছে গিয়ে বসে থাকাটা কেমন খারাপ লাগে তার। তাই আস্তে আস্তে তাদের সঙ্গে মেলামেশা একেবারেই বন্ধ করে দিতে হয়। সারাদিন নির্জন কামরায় বসে সে মুহূর্ত গোনে। একান্তই কিছু করার না থাকলে বসে বসে সুপুরি কাটে, নাহয় ছেঁড়া কাপড় সেলাই করে। কখনও-বা বাইরের বারান্দায় রেলিঙের পাশে দাঁড়িয়ে রেল-শেডের ইঞ্জিনগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা, উদ্দেশ্যহীনভাবে
রাস্তার অন্য পাশে মাল-গুদাম। এককোনা থেকে আর এককোনা পর্যন্ত বিস্তৃত। ডান দিকে লোহার ছাদের নিচে বিরাট বিরাট গাঁট সবসময়ই পড়ে থাকে। তাছাড়াও রয়েছে নানানরকমের মালপত্তর। বাঁ-দিকে খোলামাঠ। অসংখ্য রেললাইন সেখানে। রোদ পেয়ে রেলের পাটিগুলোকে চিকচিক করতে দেখলে সুলতানা শুধু শুধু নিজের হাতের দিকেও তাকিয়ে নেয় একবার। দেখে, কেমন করে লোহার পাটিগুলোর মতোই তার হাতের নীলচে শিরাগুলোও দাঁত বের করে রয়েছে। খোলা মাঠটার উপর দিয়ে ইঞ্জিন আর বগি হরদম চলছেই। কখনও আসছে, কখনও যাচ্ছে। ইঞ্জিন আর বগির ছিক্ছিক্, ঝিঁঝিক্ শব্দে এ অঞ্চলটা চব্বিশ ঘণ্টা মুখর।
সাতসকালে উঠে বারান্দায় এসে যখন সে দাঁড়ায়, তখন অদ্ভুত লাগে সামনের দৃশ্য। আবছা কুয়াশা ঠেলে ইঞ্জিন থেকে ভক্তক্ করে গাঢ় কালো ধোঁয়া বেরুতে থাকে। তার পর, আকাশটার দিকে মোটা মানুষের মতো হয়ে উঠতে থাকে একটু একটু করে। ইঞ্জিনের নিচের দিক থেকেও এমনি ধোঁয়া বেরোয়। কিন্তু সে ধোঁয়া মিলিয়ে যায় একনিমিষে। মাঝে মাঝে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে গিয়ে দু-একটা বগিকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয় ইঞ্জিন। তখন সুলতানার মনে হয়, তার অবস্থাও এমনি। কারা যেন তাকে জীবনের পাটিতে টেনে নিয়ে এসে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়েছে। এখন সে একা-একাই চলছে ঠিক ওই বগিগুলোর মতো। আর সেই ইঞ্জিনগুলো এখন কোথায়, কে জানে। তার পর হয়তো এমন একদিন আসবে, যখন একা-একা চলার এই খাপছাড়া গতি আস্তে আস্তে নিঃশেষিত হয়ে যাবে। হঠাৎ থেমে পড়বে সে। থামবে এমন এক জায়গায়, যেখানে তার ভালোমন্দ জানতে চাইবার মতো কেউই আর থাকবে না।
উদ্দেশ্যহীনভাবে এমনি ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা রেললাইনের দিকে তাকিয়ে থেকে সে শুধু চিন্তা করে। অবশ্যি চিন্তাটা মাঝে মাঝে অন্যদিকেও মোড় নেয়।
আম্বালা-ক্যাম্পে থাকার সময় একেবারে স্টেশনের কাছেই ছিল তার বাসা। কিন্তু রেললাইন, ইঞ্জিন কিংবা ট্রেনের বগি দেখে কখনও এসব ভাবনা তার মনে জাগেনি।
সুলতানা এখন মনে করে, এসব কথা ভাবা আর মাথাটাকে খারাপ করে ফেলা একই কথা। তাই, এর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই এখন আর সুলতানা বারান্দায় দাঁড়ায় না। খোদাবখ্শকে সে কয়েকবারই বলেছে, ‘দ্যাখো, আমার ওপর একটু দয়া করো। দিনের বেলায় বাসায় থেকো। রুগীর মতো আর কতক্ষণই-বা একা একা পড়ে থাকি, বলো!’
কিন্তু নানা টালবাহানা করে সুলতানার প্রস্তাব এড়িয়ে গেছে খোদাবখ্শ। সে বলেছে, ‘বাইরে কিছু টাকাপয়সা রোজগারের ধান্দায় সারাদিন ঘুরছি। আল্লা চাহেন তো খুব শিগগিরই একটা হিল্লে লেগে যাবে, দেখো।’
পুরো পাঁচটি মাস গত হয়েছে। এ পর্যন্ত কারুরই হিল্লে লাগেনি– না সুলতানার, না খোদাবখ্শের।
মহরমের মাস এল বলে। কিন্তু কালো কাপড় কেনার মতো পয়সার একান্তই অভাব। মোখতার লেডি-হেমিল্টনের নতুন ডিজাইনের একটা কোর্তা বানিয়েছে। আস্তিন তার কালো জর্জেটের। তারই সঙ্গে খাপ-খাওয়ানোর মতো কালো সাটিনের শালওয়ারও রয়েছে তার কাছে। শালওয়ারখানা কালো কাজলের মতো চিক্মিক্ করে। আনওয়ারি কিনেছে রেশমি জর্জেটের বিরাট একটা সুন্দর ঝকঝকে কালো শাড়ি। সে বলেছে, শাড়ির নিচে পরবে ধপধপে সাদা পেটিকোট। এটা নাকি নতুন ফ্যাশান। এইসঙ্গে আনওয়ারি এনেছে কালো মখমলের একজোড়া নরম জুতো। এতকিছু দেখে সুলতানার মনে বিষাদের ক্লান্তি নেমেছে। মহরম উদযাপনের জন্য এত হরেকরকমের পোশাক খরিদ করার দুঃসাহস পোষণ করতেই পারে না সে।
আনওয়ারি আর মোখতারের কাছে এতসব পোশাকের সমারোহ দেখে বাসায় ফিরে সুলতানা ভাবতে বসে। মনে হয় যেন হৃৎপিণ্ডের মধ্যে ফোঁড়া গজিয়েছে একটা।
সারাটা বাসা আগের মতোই তেমনি নীরব। খোদাবখ্শও অভ্যেসমতো অনুপস্থিত। অনেকক্ষণ অবধি কোলবালিশটা মাথার নিচে দিয়ে শতরঞ্চির উপর সে শুয়ে ছিল। এমনি অনেকক্ষণ একইভাবে শুয়ে থাকায় ঘাড়ে যখন ব্যথা ধরল, তখন আস্তে আস্তে উঠে এসে বারান্দায় দাঁড়াল।
সামনে রেললাইনের উপর শূন্য বগিগুলো বোকার মতো দাঁড়িয়ে। একটাও ইঞ্জিন নেই। সন্ধে হয়-হয়। রাস্তায় একটু আগে পানি ছড়িয়ে গেছে। তাই ধুলো-ধোঁয়ার স্বল্পতা। রাস্তা দিয়ে যারা চলছে, তাদের অনেকেই এখন কাজকর্ম শেষ করে বাড়িমুখো। কিন্তু ওদেরই একজন হঠাৎ চলতে চলতে থমকে দাঁড়িয়ে সুলতানার দিকে ঘাড় উঁচু করে তাকাল। সুলতানা অভ্যেসমতো একবার ব্যবসায়ী-হাসির একটু আমেজ বুলিয়ে নিল ঠোঁটের কোনায়। তার পরই অন্যমনস্ক হয়ে গেল। কারণ, সামনের লাইনে ততক্ষণে ইঞ্জিন এসে গেছে একটা। নিষ্পলক দৃষ্টিতে সে চেয়ে থাকে ইঞ্জিনটার দিকে। চিন্তা করে, ইঞ্জিনটাও কালো পোশাক পরে রয়েছে। মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে। সাত-পাঁচ ভাবনার জঞ্জাল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সে আবার রাস্তার দিকে দৃষ্টি দিল। লোকটাকে তখনও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওর মনে আশার আলো জ্বলে উঠল। লোকটি প্রলুব্ধ দৃষ্টিতে তার পানে তাকিয়ে রয়েছে। হাতের ইশারায় তাকে ডাক দিল সুলতানা। লোকটা এদিক-ওদিক একবার সতর্ক দৃষ্টি মেলে নরম করে বলল, ‘কোন্ দিক দিয়ে আসব?’
সুলতানা তাকে রাস্তা বাতলে দিল। একটু ইতস্তত করল সে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই চটপট করে এল উপরে।
শতরঞ্চির উপর তাকে বসতে বলল সুলতানা। বসে পড়ার পর কথাবলার সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই সুলতানা বলল, ‘কেন, আসতে ভয় করছিল নাকি নাগরের?
লোকটা হাসল। তার পর বলল, ‘তুমি কেমন করে বুঝলে? কই, না তো, ভয় করবে কেন?’
‘আমার তো তাই মনে হল। অনেক ভেবেচিন্তে তবে যেন উপরে এলে!’
ভুল বুঝেছ। তা না। আমি দেখছিলাম অন্যকিছু। দেখছিলাম, একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা লোককে কলা দেখাচ্ছে। দৃশ্যটা আমার বেশ ভালোই লাগছিল। একটু পরে বারান্দায় একটা সবুজ বাল্ব জ্বলে উঠল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তাই দেখলাম। সবুজ আলো আমার খুব ভালো লাগে।’
চারপাশে নজর বুলিয়ে লোকটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু দেখছিল। তার পর, উঠে দাঁড়াল হঠাৎ।
সুলতানা জিগ্যেস করল, ‘যাচ্ছ নাকি?’
‘না। তোমার বাসাটা একটু দেখতে চাই। চলো তোমার কামরাগুলো আমাকে দেখিয়ে আনবে।’
সুলতানা ঘুরে ঘুরে তিনটি কামরায়ই দেখাল লোকটাকে। লোকটি চুপচাপ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু দেখে আগের কামরায় আবার ফিরে এল। তার পর হঠাৎ করেই ঘোষণা করল, ‘আমার নাম শঙ্কর।‘
সুলতানা এই প্রথম ভালো করে শঙ্করের দিকে তাকাল। ওর হাবভাব কেমন যেন অদ্ভুত। মাঝারি গোছের শরীরখানা। মুখের আদল সাধারণ। কিন্তু অস্বাভাবিক উজ্জ্বল চোখদুটি। মাঝে মাঝে যেন অতিরিক্তরকম আলো ঠিকরে পড়ছে সে-চোখ থেকে। শক্ত-সমর্থ স্বাস্থ্যবান শরীর। কানের কাছে দু-চারটি চুলে পাক ধরেছে। পরনে ছাইরঙের গরম প্যান্ট। সাদা শার্ট। শার্টের কলার উপর দিকে উঠিয়ে রাখা।
শতরঞ্চির উপর বসে থাকার মধ্যে এমন একটা নিশ্চয়তা, যেন শঙ্করের বদলে সুলতানাই তার খদ্দের। ব্যবসায়ী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এটা ক্ষতিকর মনে করে সুলতানা ভাবিত হয়ে উঠল। তাই শঙ্করকে সে বলল, ‘বলো, এখন কী করতে হবে?’
শঙ্কর এতক্ষণ বসেই ছিল, এখন শুয়ে পড়ল, ‘আমি কী বলব, তুমিই বলো না! তুমিই তো আমাকে ডেকেছ।’
সুলতানা অবাক হয়ে গেল কথা শুনে। মুখে তার রা সরল না।
তখন লোকটা আবার উঠে বসল, ‘বুঝেছি। তা হলে আমিই বলছি, শোনো। ধরো আমাদের দুজনের মধ্যেই ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছে। তবে, আমার বেলায় অন্য কথা। যারা এখানে এসে কিছু দিয়ে যায়, আমি তাদের দলের নই। ডাক্তারদের মতো আমাকেও ফি দিতে হয়। একবার আমাকে ডেকে কাজ আদায় করে নিলে ফি আমাকে দিতেই হবে।
সুলতানা ঘাবড়ে গেল কথা শুনে। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই সামলে নিয়ে হাসতে হাসতে বলল, ‘তুমি কী কাজ করো?’
শঙ্কর জবাব দিল, ‘তোমরা যা করো, তাই।’
‘কী কাজ সেটা?’
‘তুমি কী করো?’
‘আমি– আমি– আমি তো কিছুই করিনে।’
‘তা হলে আমিও কিছুই করিনে।’
‘এটা একটা কথা হল? একটা কিছু করো নিশ্চয়?’ ‘তুমিও কিছু-একটা করো নিশ্চয়।’
‘হায়-হায় করি।’
‘আমিও হায়-হায় করি।’
‘তা হলে এসো, আমরা দুজনেই এখন হায়-হায় করি।’
‘আমি প্রস্তুত। তবে হায়-হায় করার জন্যে আমি কখনও কাউকে দাম দিই না।’
‘মাথা খারাপ নাকি তোমার? এটা কি লঙ্গরখানা পেয়েছ?’
‘আর আমিও কিন্তু ভলান্টিয়ার নই।’
একটু থেমে সুলতানা বলল, ‘ভলান্টিয়ারটা আবার কী জিনিস?’
‘শুয়োরের ছা।’
‘আমিও তা হলে শুয়োরের ছা নই।’
‘কিন্তু তোমার সঙ্গে খোদাবখ্শ বলে যে লোকটা থাকে, সে নিশ্চয় শুয়োরের ছা।’
‘কেন?’
‘কারণ কয়েকদিন থেকে সে একটা ফকিরের কাছে যাচ্ছে ভাঙা কপালের দাওয়াই আনতে। অথচ সে ব্যাটার নিজের কপালই একেবারে মরচে ধরে যাচ্ছেতাই।’ শঙ্কর হাসল।
সুলতানা বলল, ‘তুমি হিন্দু। তাই আমাদের ফকির-দরবেশদের নিয়ে ঠাট্টা করতে পারছ।’
শঙ্কর আবার হাসল, ‘এখানে বসে হিন্দু-মুসলমানের প্রশ্ন ওঠানোর কোনও মানে হয় না। এটা পতিতালয়। এখানে ঠাকুর-পুরুত, ফকির-দরবেশ সবার মূল্যই সমান।’
‘ওসব বাজে কথা রাখো। থাকবে কি না তাই বলো।’
‘থাকব-না কেন! তবে আগে যা বলছি, সেই শর্তে।’
সুলতানা উঠে দাঁড়াল। দরোজার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘যাও, তবে পথ দ্যাখো!’
শঙ্কর নিশ্চিন্ত মনে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ল। প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘প্রায়ই এই রাস্তায় আমাকে দেখতে পাবে। দরকার পড়লে ডেকো। বিশ্বাস করো, আমি খুব কাজের লোক। এতটুকু ফাঁকি পাবে না আমার কাছে।’
শঙ্কর চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ পর্যন্ত তার কথাই ভাবল সুলতানা। কালো পোশাকের কথা এখন সে ভুলেই গেছে।
সুলতানার মনের বোঝা অনেকখানি হালকা করে দিয়েছে শঙ্কর। শঙ্কর যদি আম্বালায় আসত, যে আম্বালায় তার সুখ-সমৃদ্ধির অন্ত ছিল না– তা হলে শঙ্করকে সে অন্যদৃষ্টিতে দেখত। কিন্তু এখানে অন্যরকম দিনকাল। এখানে শান্তি নামক পদার্থটি পলাতক। তাই শঙ্করের কথা তার খুব ভালো লেগে গেছে।
সন্ধ্যায় খোদাবখ্শ ফিরে এলে সে বলল, ‘আজকে সারাটা দিন কোথায় ছিলে?’
খোদাবখ্শ ক্লান্তিজড়িত কণ্ঠে জবাব দিল, ‘পুরনো কেল্লার কাছ থেকে আসছি। দিনকয়েক থেকে এক ফকির সেখানে এসে আস্তানা গেড়েছেন। তাঁর কাছে রোজই যাই।’
‘কিছু বলেছেন তিনি?’
‘না। এখনও তিনি মেহেরবানি করেননি। কিন্তু সুলতানা, তুমি দেখে নিও, আমার এত পরিশ্রম বিফল যাবে না। আল্লা চান তো নিশ্চয় সুফল ফলবে।’
কান্নায় ভেঙে পড়ে সুলতানা বলল, ‘সারাটা দিন তুমি পালিয়ে পালিয়ে থাকো, আর আমি থাকি খাঁচায় বন্দি হয়ে। একটুখানি নড়াচড়া করার জোটুকু পর্যন্ত নেই। মহরম এসে গেছে। আমার কালো কাপড়ের কথা কি তুমি একটিবার ভেবেছ? ঘরে একটি কানাকড়ি নেই। কাঁকন কটা একে একে বিক্রি করে দিলাম। তুমি বলো, এখন কী করব। এমনি করে ফকিরের পিছনে আর কতদিন ঘুরে ঘুরে মরবে? দিল্লি এসে অবধি আল্লাতালাও যেন আমাদের ওপর বিরূপ হলেন। আমার কথা শোনো। এক-আধটা ব্যবসা-ট্যাবসা করো। নইলে কেমন করে চলবে, বলো!’
খোদাবখ্শ শতরঞ্চির উপর ক্লান্ত শরীরটাকে বিছিয়ে দিয়ে বলল, ‘কিন্তু তার জন্যেও তো টাকা দরকার। আল্লার দোহাই, তুমি আর অমন করে কান্নাকাটি কোরো না। আমি আর সহ্য করতে পারছিনে। আম্বালা ছেড়ে এসে সত্যিই বড় ভুল করেছি। কিন্তু আল্লার ওপর ভরসা রেখো। তিনি যা করেন, ভালোর জন্যেই করেন। হয়তো আর কিছুদিন কষ্ট করার পরই –‘
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সুলতানা বলল, ‘যাই হোক, একটা কিছু করো! চুরি করে হোক, ডাকাতি করে হোক– আমার জন্যে শালওয়ারের কাপড় কিছুটা এনে দাও। আমার কাছে সাদা কোর্তা আছে একটা। ওটায় কালো রঙ দিয়ে নিলেই হবে। সাদা একটা ওড়নাও রয়েছে। সেই-যে দীপালির দিন এনে দিয়েছিলে। কোর্তার সঙ্গে সেটাও রাঙিয়ে নিলেই চলবে। শুধু একটা শালওয়ারেরই যা অভাব। যেমন করেই পারো জোগাড় করো! আমার জানের কসম, শালওয়ার একটা এনে দাও!’
খোদাবখ্শ উঠে বলল, ‘তুমি শুধুশুধু বিরক্ত করছ। কোত্থেকে আনব বলো? বিষ কিনবার পয়সাও যে এখন আমার কাছে নেই।’
‘তা আমি জানি না। যেখান থেকে হোক, যেমন করে হোক, সাড়ে চার গজ কালো কাপড় আমার চাই।’
‘দোয়া করো, আজ রাত্রেই যেন দু-তিনটি খদ্দের জুটে যায়।
‘তার মানে তুমি কিছুই করতে চাও না। তাই না? অথচ, ইচ্ছে করলে এ-কাজ তুমি সহজেই করতে পারো। কতই-বা আর লাগত! যুদ্ধের আগে বারো আনা ছিল সার্টিনের গজ। এখন বড়জোর পাঁচ সিকে। সাড়ে চার গজ কাপড়ে এমন আর কী বেশি খরচ পড়বে! ত
‘আচ্ছা, দেখছি চেষ্টা করে।’ খোদাবখ্শ উঠে পড়ল, ‘এখন আর মনখারাপ কোরো না। আমি চট করে হোটেল থেকে খাবার নিয়ে আসছি।’
হোটেল থেকে খাবার এনে দুজনে তাই গিলল কোনওরকমে। তার পর শুয়ে পড়ল।
সকালবেলায় বিছানা থেকে উঠে খোদাবখ্শ রওনা দিল পুরনো কেল্লার দিকে। সুলতানা একলা পড়ে থাকল বিছানায়। কিছুক্ষণ শুয়ে শুয়ে আইঢাই করল, কিছুক্ষণ ঘুমাল, কিছুক্ষণ উঠে টহল দিল ইতস্তত।
দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে কোর্তা আর ওড়নাটা নিয়ে নিচে দিয়ে এল লন্ড্রিতে। ধোলাই ছাড়া কাপড়-রাঙানোর কাজও হয় সেখানে। তার পর ঘরে ফিরে এসে সুলতানা ফিল্মের পত্রিকা পড়তে লাগল। ইতঃপূর্বেই সে দেখেছে, এমন ছবির কাহিনি আর গান রয়েছে তাতে। পড়তে পড়তে আবার ঘুম এল তার। চারটে বাজলে তবে ঘুম ভাঙল। গোসলটা সেরে নিয়ে, একটা গরম চাদর গায়ে জড়িয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। প্রায় এক ঘণ্টা এমনি করে একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকল সে।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। রাস্তায় আর দোকানে আলো জ্বলেছে। জৌলুশ চারদিকে। একটু একটু শীত পড়েছে। কিন্তু সুলতানার তেমন খারাপ লাগছে না শীতটা। রাস্তায় পায়েহাঁটা লোকজন আর গাড়ি-ঘোড়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। হঠাৎ শঙ্করকে দেখতে পেয়ে সে চমকে উঠল। রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে ঘাড় উঁচু করে তেমনি সুলতানার দিকে তাকিয়ে সে হাসছে। সুলতানা অজ্ঞাতসারে হাতটা একবার নাড়ল। শঙ্কর উপরে এসে গেলে সুলতানা চিন্তিত হয়ে পড়ল। কোন্ কথাটা বলবে তার সঙ্গে– চিন্তা এই সমস্যা নিয়ে।
অথচ, সে তাকে ডাকতে চায়নি। শুধুশুধু হাতছানি দেওয়ার কী এমন দরকারটা ছিল!
ওদিকে শঙ্কর নিতান্ত নিশ্চিন্ত। এটা যেন তারই নিজের বাড়ি। প্রথমদিনের মতোই আজও সে কোলবালিশটা মাথার নিচে রেখে শুয়ে পড়ল। নিশ্চিন্ত মনে।
সুলতানাকে কিছুই বলতে না দেখে শঙ্কর নিজেই কথা পাড়ল, ‘হাজার বার এমনি করে তুমি আমায় ডাকতে পারো, আবার হাজার বার ফিরিয়েও দিতে পারো– আমি কিছুই মনে করব না।‘
সুলতানা দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বলল, ‘না, বোসো। আজকে আর আমি তোমাকে ফিরে যেতে বলব না।’
মুখের মধ্যে স্বভাবসিদ্ধ হাসি ফুটিয়ে শঙ্কর বলল, ‘তা হলে আমার শর্ত তুমি মেনে নিচ্ছ বলে মনে করতে পারি।’
সুলতানা হাসল, ‘কিসের শর্ত? কোন্ শর্ত? আমাকে তুমি বিয়ে করতে চাও নাকি?’
‘বিয়ে? কী যে বলো! আমরা কি আর বিয়ে করার লোক! বিয়ে কি আর আমাদের পোষায়! বাদ দাও যতসব বাজে কথা। এখন কিছু কাজের কথা হোক।’
‘তুমিই বলো-না, কী বলব।’
‘তুমি মেয়েমানুষ। এমন কিছু বলো, যাতে মনে একটু ফুর্তি পাই। এই দুনিয়ায় ব্যবসায়ী কথাটাই সবকথা নয়। ব্যবসা ছাড়াও আরও অনেককিছুই রয়েছে বলবার মতো, শুনবার মতো।’
এমন কথা সুলতানা আর কখনও শোনেনি। তাই শঙ্করকে খুব ভালো লেগে যায় তার। সে বলল, ‘আমার কাছে কী চাও তুমি?’
‘সবাই যা চায়, তাই। তার চাইতে বেশি কিছু না।’ শঙ্কর উঠে বসল।
‘তা হলে আর পাঁচজনের সঙ্গে তোমার তফাতটা কোথায়?’
‘অনেক অনেক তফাত –আকাশের সঙ্গে পাতালের যেমন তফাত। তবে, তোমার-আমার মধ্যে কোনও তফাত নেই। তাছাড়া, এমন অনেক কথা আছে, যা বোঝানো যায় না, নিজের থেকেই বুঝে নিতে হয়।’
সুলতানা কিছুক্ষণ চিন্তা করল শঙ্করের কথাটা। তার পর না-বুঝেই বলল, ‘আমি বুঝেছি। ‘
‘তা হলে বলো, এখন কী করতে চাও।’ শঙ্কর উঠে দাঁড়াল। এমনি শুধুশুধু হাসতে থাকল সে। তার পর আবার বলল, ‘আমার নাম শঙ্কর! ভারি অদ্ভুত নাম, তাই না? এসো, ভিতরে যাই।’
শঙ্কর আর সুলতানা শতরঞ্চি-বিছানো কামরাটায় এসে ঢুকল। ওরা দুজনেই হাসছে। কে জানে, কিসের এই কলকণ্ঠ হাসি।…
.
শঙ্কর যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। এমন সময় সুলতানা বলল, ‘শঙ্কর, আমার একটা কথা রাখবে?’
শঙ্কর বলল, ‘কথাটাই আগে শুনি।’
‘তুমি হয়তো ভাববে, আমি দাম উশুল করতে চাই। কিন্তু–’
‘বলোই-না, থামলে কেন?’
–তুমি তো জানোই, মহরম এসে গেছে। কিন্তু আমার কাছে এমন পয়সা নেই যে, একটা কালো শালওয়ার তৈরি করতে পারি। আমার পানে কেউ তো মুখ তুলে চাইল না। একটা কোর্তা আর ওড়না ছিল, তাই রঙ করতে দিয়েছি।’
‘মানে, তুমি বলতে চাও, আমার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে শালওয়ার তৈরি করবে, তাই না?’
সুলতানা সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘না, না, আমি তা বলতে যাব কেন? সম্ভব হলে তুমিই একটা শালওয়ার যদি এনে দিতে!’
শঙ্কর হাসল, ‘আমার পকেটে পয়সা-কড়ি খুব কমই থাকে। তবু চেষ্টা করব। মহরমের পয়লা তারিখে শালওয়ার পেয়ে যাবে। কেমন, এখন খুশি তো?’
সুলতানার দুলদুটির দিকে তাকিয়ে সে আবার বলল, ‘দুলদুটি আমাকে দিতে পারো, সুলতানা?’
‘এ নিয়ে তুমি কী করবে? চাঁদির মামুলি দুল বৈ তো আর না। বড়জোর টাকা পাঁচেক দাম।’
‘আমি তো তোমার কাছে দুলদুটোই চেয়েছি। দাম শুধোইনি। বলো, দেবে?’
‘এই নাও।’ দুল খুলে শঙ্করকে দিয়ে দিল সুলতানা। দুলদুটি চলে যাওয়ায় মনে-মনে দুঃখ হল তার। কিন্তু শঙ্কর এতক্ষণে চলে গেছে সেখান থেকে।
সুলতানা আদৌ ভাবতে পারেনি, শঙ্কর তার কথা রাখবে। আট দিন পরে, মহরমের ঠিক এক তারিখে, সকাল ন’টায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে সুলতানা দরজা খুলে দেখল, শঙ্কর।
খবরের কাগজের মোড়কটা সুলতানার হাতে তুলে দিয়ে শঙ্কর বলল, ‘সার্টিনের শালওয়ার। এক-আধটু লম্বা হতে পারে। এখন তা হলে চলি, কেমন?
যেমন তাড়াতাড়ি আসা, তেমনি চলে যাওয়া। প্যান্টের ভাঁজ ভেঙে গেছে অনেক জায়গায়। চুলগুলো এলোমেলো ছড়ানো। যেন এখনই বিছানা ছেড়ে উঠে এসেছে সে। সুলতানা মোড়কটা খুলে ফেলল। সার্টিনের কালো শালওয়ার। আনওয়ারির কাছে যেমনটি দেখে এসেছে।
শঙ্করের কাছে ব্যবসায়ী পরাজয়ের কথা, দুল হারানোর কথা একনিমিষে সে ভুলে গেল। শালওয়ারটা পেয়ে আর শঙ্করের প্রতিশ্রুতি রক্ষা দেখে সুলতানা ভুলে গেল সমস্ত দুঃখ-বেদনার কথা।
দুপুরবেলায় লন্ড্রি থেকে নিয়ে এল রাঙানো কোর্তা আর ওড়নাখানা। কোর্তা, ওড়না, শালওয়ার পরে সবে দাঁড়িয়েছে, এমন সময় দরজায় আবার খট খট শব্দ।
আনওয়ারি ভেতরে ঢুকে কাপড় তিনটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কোর্তা আর ওড়নাখানা তো রঙ করিয়েছ। কিন্তু শালওয়ারটা দেখছি নতুন। কবে বানালে?’
সুলতানা বলল, ‘আজ সকালেই দিয়ে গেল দরজি।’ আনওয়ারির কানের ওপর চোখ পড়তেই সে আবার বলল, ‘দুলজোড়া কোথায় পেলে?’
আনওয়ারি বলল, ‘আজই আনিয়েছি।’
তার পর, সুলতানা আর আনওয়ারি–দুজনেই চুপ মেরে গেল কিছুক্ষণের জন্য।
অনুবাদ : নেয়ামাল বাসির