যখন মোবারক ও সুজাত-আলির মধ্যে এইরূপ তর্কবিতর্ক চলিতেছে, তখন এদিকে পাংসা স্টেশনে একখানি ট্রেন আসিয়া লাগিল। তাহার একটি কাম্রা হইতে তিন ব্যক্তি ব্যস্তভাবে নামিয়া পড়িল-মুন্সী জোহিরুদ্দীন, ডিটেক্টিভ দেবেন্দ্রবিজয় এবং উকীল হরিপ্রসন্ন।
ফরিদপুর জেলার উত্তর-পূর্ব্বভাগে পাংসা অবস্থিত। সেখান হইতে একমাইল দূরে মনিরুদ্দীনের বাগান-বাটী। স্টেশন ত্যাগ করিয়া তখনই তিনজনে সেই বাগানের দিকে চলিলেন।
পথিমধ্যে দেবেন্দ্রবিজয় উকীল হরিপ্রসন্ন বাবুকে বলিলেন, “সেই ভাঙ্গা ছুরিখানি খুনের রাতে মজিদ খাঁর বাসাতেই ছিল-মজিদ খাঁ তাহা সঙ্গে করিয়া বাহির হ’ন্ নাই, এরূপ স্থলে এই ছুরিদ্বারা দিলজান যে খুন হয় নাই, আপনি এখন হামিদা দ্বারা প্রমাণ দিতে চেষ্টা করিবেন; কিন্তু তাহাতে আপনি কতদূর কৃতকার্য্য হইবেন, বলিতে পারি না। ঐ ছুরি দিলজান সঙ্গে লইয়া বাহির হইয়াছিল; আর মজিদ খাঁই মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে দিলজানের নিকট হইতে ঐ ছুরি কাড়িয়া লইয়াছেন, ইহা যখন স্পষ্ট জানা যাইতেছে-পরে স্পষ্টরূপে প্রমাণীকৃতও হইবে, তখন হামিদার কথা কতদূর টিকিবে তাহা আপনি সহজেই বুঝিতে পারিতেছেন। মজিদ খাঁর নিকটে যখন ছুরিখানি পাওয়া যাইতেছে, তখন ঐ ছুরিতেই দিলজান খুন হইয়াছে, ইহা খুবই সম্ভব; ইহাতে সন্দেহের কিছুই নাই।”
হরিপ্রসন্ন ববু বলিলেন, “এ সংসারে লোকও আনেক আছে-ছুরিও অনেক আছে।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তাহা সত্য; কিন্তু ঐ ছুরিখানিই যখন দিলজানের সেই বিষাক্ত ছুরি বলিয়া জানা যাইতেছে-এবং যখন বিষাক্ত ছুরিই দিলজানের মৃত্যুর কারণ, তখন কে বিশ্বাস করিবে, দিলজান অন্য একখানা ছুরিতে খুন হইয়াছে?”
হরিপ্রসন্ন বাবু বলিলেন, “সকলই প্রমাণের উপরে নির্ভর করিতেছে। বেশই বুঝা যাইতেছে, একটা দুর্গম রহস্যের ভিতরে সকলই প্রছন্ন রহিয়াছে।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “আমারও তাহাই অনুমান-আমরা একটা দুর্লঙ্ঘ্য রহস্য-ব্যুহের চারিদিক্ বেড়িয়া, অন্ধের ন্যায় ঘুরিয়া বেড়াইতেছি; ভেদ করিয়া যাইবার পথ এখনও খুঁজিয়া পাই নাই। আমার বোধ হয়, সেদিন রাত্রিতে মজিদ খাঁর সহিত সৃজান বিবির যে সকল কথোপকথন হইয়াছিল, তাহা যদি এখন কোন রকমে জানিতে পারা যায়, তাহা হইলে সহজে আপনা হইতে সত্যাবিষ্কার হইয়া পড়ে, আর কোন গোল থাকে না।”
মুন্সী সাহেব বলিলেন, “বুঝিয়াছি, আপনাদের মনে ধারণা, আমার স্ত্রীর দ্বারাই দিলজান খুন হইয়াছে।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “যতক্ষণ সৃজান বিবির সহিত দেখা না হইতেছে, ততক্ষণ আমাদিগের ধারণা কতদূর সত্য, বুঝা যাইতেছে না।”
যথাসময়ে তাঁহারা সেই বাগানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সুন্দর সাজান বাগান। তখন সন্ধ্যার তরল অন্ধকারে চারিদিক্ আছন্ন হইতে আরম্ভ হইয়াছে। সম্মুখে স্বচ্ছ জলপূর্ণ নীল দীর্ঘিকা সেই তরল অন্ধকরে গভীর নীলবর্ণ দেখাইতেছে। তাহার বক্ষে পার্শ্বস্থিত প্রেতবৎ বড় বড় গাছগুলার দীর্ঘতর প্রতিবিম্ব আসিয়া পড়িয়াছে-এবং ঝিল্লিমন্দ্রে চারিদিক্ মুখরিত। দীর্ঘিকার অপর পারে একখানি সুন্দর ছোট দ্বিতল বাটী। সেই বাটীর উপরিতলস্থ দুই-একটি কক্ষে দীপ জ্বলিতেছে। এবং উন্মুক্ত গবাক্ষ-পথ দিয়া সেই দীপলোক নিকটবর্ত্তী দেবদারুশ্রেণীর উপরে আসিয়া পড়িয়াছে। সকলে সেই বাটী-অভিমুখে চলিলেন। দ্বার-সম্মুখে আসিয়া একজন ভৃত্যকে দেখিতে পাইলেন।
দেবেন্দ্রবিজয় সেই ভৃত্যকে বলিলেন, “মনিরুদ্দীন সাহেবকে সাথ, একদফে মোলাকাৎ কর্না চাহিয়ে; তুম জলদী খবর দেও।”
ভৃত্য বলিল, “সাহাব খানা-পিনা কর্কে বারা বাজাকে ট্যরেণ্মে সহর্মে চলা গ্যয়া।”
হরিপ্রসন্ন বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “মল্লিক সাহাব কো সাথ্ যো বিবি সাহাব অ-রহা, উন্নে অযবি কাঁহা হৈ? সাহাবকে সাথ্ তো গ্যয়া নেহি?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “বিবি সাহেব আর কোথায় যাইবেন, এইখানেই আছেন। (ভৃত্যের প্রতি) আব্বি তুম্ বিবি সাহাব্কী খবর দেও।”
ভৃত্য সঙ্কুচিতভাবে কহিল, “হুজুর, আব্বি সাহাব্কী সাথ্ কেঁও কর-”
দেবেন্দ্রবিজয় বাধা দিয়া বলিলেন, “জল্দি খবর দেও, ন্যহিতো তুম্হারা বিবি সাহাব্কী বহুৎ মুস্কিল হোগা!”
অনন্যোপায় ভৃত্য তাঁহাদিজকে নিম্নতলস্থ একটি কক্ষে লইয়া গিয়া বসাইল। এবং ‘বিবি সাহেবের’ নিকটে সংবাদ লইয়া উপরিতলে উঠিয়া গেল।
ঘরটি ছোট-টেবিল, কৌচ, আল্মারী, চেয়ার ও ছবিতে সুন্দররূপে সাজান। এক কোণে একটা বড় টেবিল-হার্মোনিয়ম রহিয়াছে, তাহার পার্শ্বে বাঁয়া তবলা, মৃদঙ্গ, সারঙ্গ, সেতার, এস্রাজ-কয়েকটা বাদ্যযন্ত্র পড়িয়া রহিয়াছে।
সকলে নীরবে সেই ছোট ঘরটিতে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করিতে হইল না। কক্ষের বাহিরে কাহার মৃদু পদধ্বনি শুনা গেল। তখনই পার্শ্ববর্ত্তী একটি কক্ষের দ্বারসম্মুখস্থ পর্দ্দা উঠিয়া দীর্ঘাবয়বসম্পন্না, চারুচন্দ্রবদনা একটি সুন্দরী দ্বারপথে বিস্ময়োদ্বিগ্নমুখে দাঁড়াইল।
দেবেন্দ্রবিজয় ও হরিপ্রসন্ন বাবু বিস্মিতভাবে মুন্সী সাহেবের মুখের দিকে চাহিলেন। ইচ্ছা – পলাতক পত্নীর পুনাবির্ভাবে মুন্সী সাহেব কি ম্করেন, দেখিবেন।
মুন্সী সাহেব রুষ্ট সিংহের ন্যায় গর্জ্জিয়া উঠিলেন, “পিশাচী-সয়তানী” বলিতে বলিতে লাফাইয়া সেই রমণীর সম্মুখীন হইলেন। সহসা যেন একটা কি বাধাপ্রাপ্ত হইয়া, চকিত দুই পদ পশ্চাতে হটিয়া জড়িতকণ্ঠে বলিলেন, “তুমি-তুমি-তুমি-ত সেই সৃজান নও।”
রমণীও বিস্মিতভাবে স্মিতমুখে কহিল, “আমি! আমি কেন সৃজান হইতে যাইব? আমি নই-আপনাদের ভুল হইয়াছে।”
দেবেন্দ্রবিজয় ও হরিপ্রসন্ন বাবু উভয়ে বিদ্যুৎপৃষ্টের ন্যায় দাঁড়াইয়া উঠিলেন। সমস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে তবে তুমি?”
রমণী কহিল, “দিলজান।”