চতুর্থ খণ্ড
৪.০১ শতাব্দীর মোড়
ইতিমধ্যে শতাব্দীর মোড় ঘুরেছে, অষ্টাদশ শতক নিঃশব্দে আত্মসমর্পণ করেছে ঊনবিংশ শতকে, এমন নিঃশব্দে যে দুয়ের তরঙ্গতালে প্রভেদ বোঝবার উপায় নেই। মহাখুধিতে বড় বড় জাহাজগুলো হয়তো তেমন দোল খায় না, কিন্তু আমাদের ক্ষুদ্র কাহিনীটির ডিঙিখানা অসহায়ভাবে দোদুল্যমান, তরঙ্গ-তালের পরিবর্তনে আমাদের কাহিনীর নায়ক-নায়িকারা অষ্টপদ ও বিচলিত।
অষ্টাদশ শতক ভারতের ইতিহাসে অ্যাডভোরের যুগ। মারাঠা, ফরাসী ও ইংরেজ পরস্পরকে শিকার করবার চেষ্টায় নিযুক্ত ছিল। শতাব্দী শেষে দেখা গেল অ্যাডভেঞ্চারে জয়ী হয়েছে ইংরেজ। ক্লাইভ সকলের সেরা। অ্যাডভেঞ্চারার না হলে ক্লাইভ বারো শ মাত্র গোরা সৈন্য নিয়ে পঞ্চাশ হাজার নবাবী সৈন্যের সম্মুখীন হত না। ওয়ারেন হেস্টিংস অ্যাডভেঞ্চার যুগের লোক, কিন্তু তার মধ্যেই বোধ করি প্রথম অ্যাডভেঞ্চারার ও শাসক সমভাবে মিশেছিল হেস্টিংসের বিদায়ের সঙ্গে ইংরেজের অ্যাডভেঞ্চার যুগের শেষ, তখন স্থায়িত্বের দায়িত্বের প্রসঙ্গ দেখা দিয়েছে। প্রথম লক্ষণ পারমানেন্ট সেটমেন্ট বা জমিদারদের চিরস্থায়ী রাজস্বের বন্দোবস্ত। যুগ-বদলের চিহ্ন সূরেখায় টানা যায় না। তার জন্যে খানিকটা জায়গার প্রয়োজন। হেস্টিংসের বিদায়ের পর থেকে কর্নওয়ালিসের দ্বিতীয়বার আগমন পর্যন্ত সেই সীমান্তের ব্যাপ্তি, অ্যাডভেঞ্চাব ও রীতিমত শাসনে মিশল। মাঝখানে ওয়েলেসলি। সেকালের ইংরেজ ব্যবসায়ীদের বিদ্রুপ করে বলা হত নবাব। তারা যদি নবাব হয় তবে ওয়েলেন্সি বাদশাহ। তার মত অপ্রতিহত প্রতাপক্ষমতার চূড়ায় অধিষ্ঠিত থাকাকালে ঔরঙ্গজেবও ভোগ করেছেন কিনা সন্দেহ। তার হাতেই প্রথম যথার্থভাবে বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ড হয়ে উঠল। ওয়েলেসলিই প্রথম নিঃসংশয়ে বুঝেছিল এদেশে ইংরেজের আর অ্যাডভেঞ্চারের নয়, স্থায়ী শাসকের। ক্লাইভের মত নবকৃষ্ণ মুণীর সহায়তায় তার আর প্রয়োজন ছিল না; কোনরকমে কুড়িয়ে-বাড়িয়ে বারো শ গোরা সৈন্য যোগাড় করে দাবা খেলায় ‘হারি কি মারি’ মনোভাব তার ছিল না; হেস্টিংসের মত ফার্সি ও লাটিন শ্লোক রচনার ফাঁকে রাজকার্য চালনার সময় তার ছিল না; সার জন শোর বা কর্নওয়ালিসের মত ক্ষুদে জমিদারের পেট টিপে গুড় আদায় করবার মনোভাবও তার ছিল না; তার কারবার হাতী ঘোড়া রাজরাণী নিয়ে; সেগুলোও আবার দাবাখেলার নয়, প্রকাণ্ড বাস্তবের। আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত সাম্রাজ্য স্থাপিত হওয়ার আগে সাম্রাজ্যের রস ইংরেজের দেহে চালিয়ে দিয়ে তাদের মাতিয়ে তুলল ওয়েলেসলি। ওয়েলেন্সির সময়ে সাম্রাজ্যবাদের সূচনা।
আঠারো শতকের ইংরেজ রাজপুরুষগণ এ রসে বঞ্চিত ছিল বলে দেশী বিদেশী সরকারী বেসরকারী সকলের সঙ্গে অবাধে মিশত। ওয়েলেসলি সকল সম্বন্ধ ছিন্ন করে নবনির্মিত বিপুল প্রাসাদের নিঃসঙ্গ নৈভৃত্যে একাকী বসে রইল, অমনি অন্যান্য রাজপরুষরাও বন্ধন ছিন্ন করতে উদ্যত হল। দ্বিতীয়বার আগমন করে কর্নওয়ালিস ওয়েলেসলি-শাসনের রাজকীয় আড়ম্বরের পেখম গুটিয়ে ফেলল, অমনি চারিদিকে খরচ কমাবার সাড়া পড়ে গেল। কিন্তু এ সমস্তর চেয়েও গুরুতর পরিবর্তন ঘটছিল ভিতরে ভিতরে।
ইউরোপের নীতিবর্জিত অষ্টাদশ শতকের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ছিল Reason, প্রধান পুরোধা ভলতেয়ার।
নীতিবর্জিত Reason-এর আবহাওয়া এদেশের শ্বেতাঙ্গ সমাজেও পরিব্যাপ্ত ছিল। তাই হলে বলে কৌশলে ইংরেজের পক্ষে এদেশ জয় করা সম্ভব হয়েছিল; Cosmo politan উদার ভাব শ্বেতাঙ্গ সমাজে ছিল বলেই এদেশীয়দের সঙ্গে তাদের মেলামেশার পথ বন্ধ হয় নি, অ্যাডভেঞ্চারের মনোবৃত্তি সে পথ সুগম করেছিল, সাম্রাজ্য-দখলকারের উদ্মা সে পথকে তখনও বিঘ্নিত করে নি। তাই জনের পক্ষে রেশমীকে বিবাহ করবার চিন্তা সহজ ছিল। অষ্টাদশ শতকের শ্বেতাঙ্গ সমাজ ছিল ধর্মবিষয়ে উদাসীন, পাত্রীরা প্রশ্রয় পায় নি রাজপুরুষদের কাছে। টমাস নিজেই স্বীকার করেছে কুড়ি বৎসরের প্রচেষ্টাতেও একটা নেটিভ দীক্ষিত করতে পারে নি। বস্তুত প্রথম ব্যাপটিস্ট মিশন স্থাপিত হয়েছিল শ্রীরামপুরে, কোম্পানির রাজত্বের বাইরে।
কিন্তু ক্রমে আবহাওয়ার পরিবর্তন দেখা দিল। সাম্রাজ্য-দখলের রস যতই ইংরেজকে মাতিয়ে তুলল ততই তারা দেশীয় সমাজ থেকে পৃথক হয়ে পড়তে লাগল; এতদিন যা ছিল প্রকাণ্ড অ্যাডভেঞ্চার, তা পরিণত হল রাজাপ্রজা সম্বন্ধে। সেই সঙ্গে দেখা দিতে লাগল ধর্ম সম্বন্ধে গোঁড়ামি। অ্যাডভেঞ্চারারদের যুগ গিয়ে এল রীতিমত শাসক ও পাদ্রীদের যুগ। উনিশ শতকের ফৌজী জেনারেল কর্নেলের সঙ্গে মানবজীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা শুরু করল। হিদেন প্রজার আত্মার সদগতি সম্বন্ধে শাসক ও সৈনিকগণ চিন্তিত হয়ে উঠল। যে-সব কারণে সিপাহী বিদ্রোহ ঘটেছিল এই দুশ্চিন্তা তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান। রাজা ও প্রজায় ধীরে ধীরে যে ব্যবধান ঘটেছিল, সিপাহী বিদ্রোহের পরিণামে তা দুস্তর হয়ে উঠল। শতাব্দীর প্রারম্ভে এসব প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে নি বটে, কিন্তু শুরু হয়ে গিয়েছিল তার প্রভাব।
পালা বদল শুরু হয়ে গিয়েছে। পুরনো যুগের বড় বড় ছয় ঘোডর গাড়িগুলো রেসকোর্স ও ময়দান থেকে ক্রমে অদৃশ্য হতে লাগল। নবাবের দল বুঝেছিল তাদের পালা শেষ হল। অবশেষে একদিন সরকারের ডাক পড়ে হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে দেবার জন্যে। খরচের অঙ্ক বিপুল, তবু সমস্ত চুকিয়ে দিয়েও যা হাতে থাকে তাতে বিলাতে নবাবী চালে চলা সম্ভব, দু-একটা পার্লামেন্ট সদস্যপদ ক্রয় করাও অসম্ভব নয়। অতএব জাহাজে স্থানের সন্ধান পড়ে যায়–সুযোগ বুঝে কাপ্তেনরা ভাড়া দেয় বাড়িয়ে, হাজার পাউণ্ড একজনের ভাড়া।
লর্ড কর্নওয়ালিসের কলকাতায় দ্বিতীয়বার পদার্পণ যুগান্তের স্পষ্ট তারিখ। জাহাজঘাটায় লোকজন, গাড়িঘোড়া, হাতী, উট, সৈন্য-সামন্তের মস্ত দঙ্গল। বিভ্রান্ত কর্নওয়ালিস পার্শ্ববর্তী সেক্রেটারিকে শুধায়, রবিনসন, এসব ব্যাপার কি?
হুজুরকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে যাওয়ার জন্যে পাঠিয়েছে লর্ড ওয়েলেসলি।
সৌজন্যের চরম—কিন্তু এত কি আবশ্যক ছিল? পায়ের ব্যবহার কি আমি ভুলে গিয়েছি।
কর্নওয়ালিস পদব্রজে এল গভর্নমেন্ট হাউসে।
নূতন গভর্নমেন্ট হাউসের (বর্তমান বাড়ি) ইট কাঠ পাথরের অরণ্যে দিশেহারা কর্নওয়ালিস সেক্রেটারিকে বলল, আমার শয়নগৃহটা খুঁজে পাওয়া এক সাধনার বিষয়।
পরদিন নূতন লাটসাহেব অশ্বারোহণে একটিমাত্র সোয়ার নিয়ে প্রাতর্জমণে বের হল। বাদশা ওয়েলেসলির স্থলে গভর্নর কর্নওয়ালিস। নূতন যুগ আরম্ভ হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু নব্যবঙ্গ যারা গড়বে তারা কোথায়? রাধাকাও দেব ষোল বছরের কিশোর। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের যুবক রামমোহন পাটনা-ভাগলপুর-কলকাতায় অনিশ্চিতভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটু পা রাখবার স্থানের সন্ধানে। মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার বাগবাজারের টোলে অধ্যাপনায় রত। কেরী, রামরাম বসু শ্রীরামপুরে বাইবেলের প্রথম বঙ্গানুবাদের পুফ দেখছে। আর বাকি সকলে তখনও দূর ও অনতিদূর ভবিষ্যতের গর্ভে নিহিত।
.
৪.০২ প্রতিক্রিয়া
চণ্ডী ধড়মড় করে জেগে উঠে মৃত্যুঞ্জয়কে ধাক্কা দিল, মিত্যুঞ্জয়, ওঠ ওঠ, ঘাটে এসে নৌকো লেগেছে।
মৃত্যুঞ্জয় জেগে উঠে বলল, কোন ঘাট?
বোধ হয় বাগবাজার হবে, বলে চণ্ডী।
ও মাঝি, মাঝি, তোমরা সব ঘুমুলে দেখছি!
ডাকাডাকিতে মাঝিরা জেগে ওঠে। একজন বলে, ঘুমোই নি কর্তা, একটু শুয়েছিলাম।
মাঝিরা ডাকে, ও সর্দার, জাগ।
পাইকরা জেগে ওঠে। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিল।
তখন চণ্ডী ডাকতে শুরু করে, মাসি, আর কত ঘুমুবে, এবার জাগ!
মোক্ষদা জেগে উঠে ধাক্কা দেয়, রেশমী, ওঠ!
ধাক্কা খেয়ে বালিসটা সরে যায়—কই রে, কোথায় গেলি?
রেশমী নেই। রেশমী মনে করে একটা বালিস জড়িয়ে ধরে নিশ্চিন্তে শুয়ে ছিল মোক্ষদা। মোজদা চীৎকার করে ওঠে, ও চণ্ডী, আমার রেশমী গেল কোথায়?
অ্যাঁ, সে বেটী আবার পালাল নাকি? চমকে ওঠে চণ্ডী।
সত্যই রেশমী কোথাও নেই।
চণ্ডী গর্জে ওঠে, বুড়ি, এ তোর কারসাজি। তুই তাকে পালিয়ে যেতে দিয়েছিল।
বুড়ি পাল্টে গর্জে ওঠে, যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা! কত বছর পরে বুকের ধনকে ফিরে পেয়ে আমি পালিয়ে যেতে দেব! মুখ সামলে কথা বলিস চী।
চণ্ডী দমে না, বলে, দাঁড়া ডাইনী, তোর শয়তানি বের করছি। বল কোথায় গেল ও বেটী!
নৌকার এ-কোণে ও-কোণে খোঁজ পড়ে যায়—কিন্তু যা নেই তা পাওয়া যায় না।
মোক্ষদা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে, কোথায় গেল আমার বুকের ধন।
তখন চণ্ডী গিয়ে পড়ে মাঝিদের ঘাড়ে। তোরা পাহারা দিস নি কেন?
মাঝিরা বলে, পাহারা দেওয়ার জন্যে আছে তো পাইকরা-আমরা মাঝি, নৌকা ঠিক ঘাটে এনে লাগিয়ে দিয়েছি।
এই তোদের ঠিক ঘাট হল? গর্জায় চণ্ডী।
তখন সকলে মিলে পড়ে পাইকদের ঘাড়ে। পাইকরা বলে, পাহারা দেওয়া আমাদের কাজ নয়, তোমরা জেগে থাকলেই পারতে।
তখন মাঝির দল, পাইকের দল ও চণ্ডীতে মিলে পরস্পরের ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেষ্টা শুরু হয়ে যায়।
রেশমীর পরিণাম মৃত্যুঞ্জয় জানত, তাই তার অন্তর্ধানে সে খুব দুঃখিত হয় নি। সে বলল, বক্সী মশাই, জলে গিয়ে পড়ে নি তো?
কুমীর না হাঙর যে জলে পড়বে! বেটী পালিয়েছে। নাঃ, বেটী দু-মন্তর জানে। তিন-তিনবার পালাল আমার হাত থেকে।
মোক্ষদা কাঁদতেই থাকে।
রেশমীর অন্তর্ধানের দোষ কেউ ঘাড়ে নিতে রাজী না হওয়ায় অবশেষে এক সময়ে কলহ থামল।
চণ্ডী বলে উঠল, ও মাঝি, এ পাড়া তো তোদের চেনা, একবার খুঁজে দেখ না।
এ কি তোমার জোড়ামউ গা নাকি! কোথায় কোন দিকে গিয়েছে, কোথায় খুঁজতে যাব আমরা। তারা স্রেফ জবাব দেয়।
তার পরে যে সমস্যা দেখা দেয় সেটা সত্যই গুরুতর।
চণ্ডী হতাশভাবে বলে, তবে এখন মোতিবাবুকে গিয়ে কি বলব?
মৃত্যুঞ্জয় বলে, প্রকৃত অবস্থা বললেই হবে। মাঝি ও পাইকরা সমস্বরে আপত্তি করে ওঠে, ভোগের নৈবিদ্যি পালিয়েছে শুনলে আমাদের মাথা আস্ত থাকবে না।
তা হলেই তোদের উচিত শিক্ষা হয়।
তুমি চুপ কর তো বীমশাই। অমন করলে আমরা সবাই মিলে হলফ করে বলব। যে, তোমাদেরই যোগসাজসে মেয়েটা পালিয়েছে। তখন বুঝবে কত ধানে কত চাল।
চণ্ডী মোতি রায়কে চিনত, নরম হল; বলল, তাহলে কি বলা যায় সবাই মিলে স্থির কর।
তখন সকলে মিলে রোমাঞ্চকর এক উপন্যাস রচনা করল। স্থির হল, মোতিবাবুকে বলতে হবে যে, তারা মেয়েটাকে ছিনিয়ে নিয়ে রওনা হয়েছে এমন সময়ে সাহেবদের চার-পাঁচখানা নৌকা এসে তাদের ছিপ ঘেরাও করল। তারা এই ক-জনে আর কি করবে, অন্য পক্ষে যে পঁচিশ-ত্রিশজন লোক, সাহেবই জন কুড়ি-পনেরো। কেড়ে নিয়ে গেল মেয়েটাকে।
সেই কথা বলাই স্থির হল। তখন মৃত্যুঞ্জয় মোক্ষদাকে নিয়ে বাসাবাড়ি চলে গেল, আর সবাই চলল মোতিবাবুর বাড়ির দিকে।
যথাবিহিত সুর, স্বর, অশু, কম্প ও হলফ সহকারে উপন্যাসটি নিবেদিত হল মোতিবাবুর সমীপে।
সমস্ত শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মোতিবাবু বলল, এই পাদ্রীগুলোর আস্পদ্দা খুব বেড়ে উঠেছে দেখছি।
সবাই বুঝল তাদের মাথা এবারের মত বেঁচে গেল।
মোতিবাবু বলল, আচ্ছা তোমরা যাও, দেখি আমি কি করতে পারি।
রেশমী গেল কোথায় চিন্তা করতে করতে চণ্ডী ফিরে চলল।
.
ওদিকে জন ও রামরাম বসুদের নৌকা জোড়ামউ পোহল। গাঁয়ের মধ্যে ঢুকে তারা রেশমীর সন্ধানে প্রবৃত্ত হল। সাহেব দেখে সবাই মিথ্যার আশ্রয় নিল। সকলে একবাক্যে বলল, রেশমী নামে কোন মেয়েকে তারা চেনে না।
আর চণ্ডী বক্সী?
চণ্ডী বক্সী? ও নামটাও কেউ শোনে নি!
তার বাড়ি কোথায় বলতে পার?
মানুষটার নামই শোনে নি, বাড়ি কেমন করে বলবে?
মোক্ষদা বুড়িকে চেন?
মোক্ষদাকে কেউ চেনে না, তবে মুক্তিদা বুড়িকে কেউ কেউ চিনত বটে, তা তার অনেক কয় বছর হল মৃত্যু হয়েছে।
এ গাঁয়ের নাম জোড়ামউ তো বটে?
পাঁচজনে তাই তো বলে, তবে বামনুডিহি নামেও গ্রামটা চলে।
রাম বসু বুঝল সবাই আগাগোড়া মিথ্যা বলছে। দুর্বলের অস্ত্র মিথ্যা। কিন্তু নিরুপায়। রেশমীর সন্ধান পাওয়া গেল না। রাম বসু জনদের বোঝাল, আমার মনে হচ্ছে ওরা এদিকেই আসে নি, কলকাতায় গিয়েছে।
রাম বসু বলল, তোমরা ফিরে যাও, আমি দু-চার দিন এদিকে থেকে আরও একটু খোঁজখবর করে ফিরব। সেই সিদ্ধান্তই গৃহীত হল।
ফিরে চলল জনদেব নৌকা। আর যথাসময়ে শ্রীরামপুরের ঘাটে এসে পৌঁছল।
জন বলল, আমি কলকাতায় ফিরে যাই। অন্য সবাই বলল, অবশ্যই কলকাতায় যেতে হবে কিন্তু তার আগে একবার এখানে নেমে পরামর্শ করা আবশ্যক।
জন নামল শ্রীরামপুরে। ফেলিক্সের বাহু অবলম্বন করে কোনরকমে ঘরে পৌঁছে সে শুয়ে পড়ল। কেন জানি না হঠাৎ লিজার কথা মনে পড়ে দুই-চোখ জলে ভরে উঠল তার।
.
৪.০৩ ভ্রাতা-ভগ্নী
সেকালের কলকাতা শহর কতটুকু? অবিলম্বে মুখে মুখে সর্বত্র রেশমী-হরণের সংবাদ প্রচারিত হয়ে গেল। কিন্তু যত যা ঘটেছিল, প্রচার হল তা থেকে ভিন্ন রকম। গুজব শরতের মেঘ দেখতে দেখতে তার আকৃতি প্রকৃতি যায় বদলে। কেউ শুনল রেশমী নামে মেয়েটা গঙ্গাস্নানে এসেছিল, এমন সময়ে একদল বোম্বেটে (মতান্তরে সাহেব, মতান্তরে পাত্রী সাহেব) তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছে। গঙ্গার ঘাটে কথাটা প্রচারিত হওয়াতে ঘুনাথীর সংখ্যা বাড়ল সরেজমিনে শোনবার আগ্রহে। কেউ শুনল মেয়েটাকে বাড়ি থেকে ছিনিয়ে নিয়ে খ্রীষ্টান-ধর্মে দীক্ষিত করা হয়েছে, এখন মেয়েটাকে লুকিয়ে রেখেছে গড়ের মধ্যে, খোলা তলোয়ার গোরা সেপাই পাহারা দিচ্ছে। কেউ শুনল মেয়েটাকে জাহাজে করে তুলে নিয়ে বিলেত রওনা করে দেওয়া হয়েছে, সেখানে নাকি রাজবাড়ির দাসী হবে। আবার কেউ কেউ বলল, ওসব কথা শোন কেন, মেয়েটা বড় সহজ পাত্রী নয়, স্বেচ্ছায় গিয়ে সাহেবের নৌকোয় উঠেছে। সকলের কথাই সমান সত্য, কারণ এ সামান্য চোখের দেখা নয়, কানের শোনা—বত্তা সত্যবাদিতায় যুধিষ্ঠির। দু’একজন অসমসাহসিক সব অস্বীকার করল। বলল, যত সব বাজে কথা; বলল, মেয়েটাকে তারা নিজ চক্ষে দেখেছে, সেটা তিনকালণত বুড়ি, নাতির শোকে গঙ্গায় ডুবে মরেছে। গঙ্গায় ডুবে মরা নৈসর্গিক নিয়ম, উত্তেজনার তাপ নেই তাতে, কাজেই অন্য সকলে অস্বীকার করল; বলল, আরে যে বুড়িটার কথা বলছিলে, তার নাতিকে তো আমরাই দাহ করে এলাম, আহা রাজপুত্রের মত চেহারা। তারা হলফ করে বলল, এ যার কথা হচ্ছে সে ছুঁড়ি, আমাদের পাড়ার মেয়ে যে। আহা, তার মা কেঁদে কেঁদে চোখ অন্ধ করে ফেলল।
কেউ আর উত্তেজনার আগুন নিভতে দিতে রাজী নয়। একটুখানি নিস্তেজ হয়ে আসবামাত্র সাক্ষ্য-প্রমাণের নূতন ইন্ধন যোগায়, আগুন আবার দপ করে জ্বলে ওঠে। সবাই হাত-পা তাতিয়ে আরাম অনুভব করে।
সংবাদটা লোকের মুখে ঘুরতে ঘুরতে ক্রমে সাহেবপাড়ায় এসে পৌঁছল। সেখানকার চাপরাসী আরদালির দল তাকে নূতন আকার দিল। তাদের মধ্যে ইতিমধ্যেই জানাজানি হয়ে গিয়েছিল যে, স্মিথ সাহেব একটা বাঙালী মেয়েকে নিয়ে কোথায় চলে গিয়েছে। এখন লুটপাটের কথা শুনে তারা অনুমান করল চোরের উপর বাটপাড়ি হয়েছে, স্মিথ সাহেবের ভোগের নৈবিদ্যি চিল-শকুনে ছোঁ মেরে নিয়ে গিয়েছে। কথাটা এই আকারেই লিজার কানে পৌঁছল। সে ভাবল, রেশমীকে আর-একটা সাহেবেই কেড়ে নিক বা কতগুলো নেটিভ লোকে মিলেই ছিনিয়ে নিক, মোট কথা সে জনের হাতছাড়া হয়েছে। ভগবানের সুবিচারে মনে মনে লিজা ভগবানের পিঠ চাপড়িয়ে সুসংবাদ দানের উদ্দেশে তখনই মেরিডিথের বাড়ির দিকে রওনা হল। গত রবিবারে ভগবানের সঙ্গে অসহযগিত। করে সে গির্জায় যায় নি।
মেরিডিথ, সুসংবাদ শুনেছ?
কৃত্রিম উল্লাসে মেরিডিথ বলল, কি, মিস্টাব আর মিসেস স্মিথ বুঝি এসে পৌঁছেছে?
আঃ, ঠাট্টা রাখ। মিস্টার স্মিথ শীঘ্রই ফিরে আসবে আশা করছি, কিন্তু নিশ্চয় জেনে রেখ যে, মিসেস স্মিথ আর আসবে না।
এবারে অকৃত্রিম জিজ্ঞাসায় মেরিডিথ শুধাল, ব্যাপার কি?
তার ‘বাণ্ডল অব সিল্ক’ হাতছাড়া হয়েছে!
ইন্ডিয়ান সিল্ক খুব দামী জিনিস, এমন হওয়াই সম্ভব, কিন্তু কি ঘটেছে খুলে বল তো।
লিজা যেমন শুনেছিল বলল। মন্তব্য করল, আমি গোড়া থেকেই জানতাম ভগবান এমন অনাচার ঘটতে দেবেন না।
মেরিডিথ বলল, ভগবানের উপর এতই যদি বিশ্বস তবে এমন মুষড়ে পড়েছিলে কেন?
লিজা বলল, ভগবান ও মানুষের মাঝখানে যে মাঝে মাঝে শয়তানটা এসে পড়ে।
সেই শয়তানটাই বুঝি জনকে স্বর্ণ-আপেল দেখিয়ে লুব্ধ করেছিল?
জনকে নয়, hussy-টাকে।
যাক, এবার তো তোমার ভগবানের জয় হল।
তার পরে একটু থেমে বলল, সত্যি করে বল তো লিজা আনন্দটা কেন, ভগবানের জয়ে না তোমার জয়ে!
মেরিডিথ, তোমার ঐ বড় দোষ, ভগবানের কথা উঠলেই তুমি পরিহাস শুরু কর।
আচ্ছা, তবে এবার সত্যি কথা বলি। তোমার ভগবান একটি মনোরম ধাপ্পা।
ছি ছি মেরিডিথ, অমন কথা বলতে নেই। আচ্ছা, তুমি বসে বসে ভাব-আমি চললাম, তুমি সন্ধ্যায় আমার বাড়িতে যেতে যেন ভুলো না।
অবশ্যই যাব, যদি ইতিমধ্যে মাঝখানে শয়তানটা এসে উপস্থিত না হয়।
লিজা হেসে বলল, না, সে আসবে না। আমি চললাম।
জনের অকস্মাৎ পলায়নের পর থেকে লিজা মুহ্যমান অবস্থায় ছিল। এতদিন পরে তার মুখে হাসি ফুটল।
সেদিন রাত্রে সে জনের অপেক্ষা করছিল। স্থির করে রেখেছিল পাঁচ কাহনকে সাত কাহন করে রেশমীর কথাগুলো বর্ণনা করবে। বলবে যে রেশমী বাড়ি বয়ে এসে তাকে ন ভুতো ন ভবিষ্যতি করে গালাগালি করে গিয়েছে। পিতামাতা ও জনকেও কটুকাটব্য করতে বাদ দেয় নি। লিজার বিশ্বাস ছিল কথাগুলো যথোচিত অশ্রুসিক্ত করে বলতে পারলে জনের মন ঘুরে যাবে রেশমীর নেশা কেটে যাবে তার। সঙ্গে সঙ্গে বিয়ের কথাটাও পাড়তে হবে। কয়েকটি সুন্দরী (নিজের চেয়ে নিকৃষ্ট) মেয়ের নামও স্থির করে রেখেছিল। জন যেমন নিষ্ক্রিয়—একেবারে থালায় সাজিয়ে এনে ওর মুখের কাছে না ধরলে ওর পক্ষে খাওয়া অসম্ভব। “ভ্রাতা-ভগ্নী-পুনর্মিলন” অথবা “রেশমী-পরাজয়” নাটকের মহড়া সম্পূর্ণ করে যখন প্রতি মুহূর্তে সে জনের প্রতীক্ষা করছে তখন জনের বদলে এল চাপরাসী। জন লিখছে বন্ধুদের অপ্রত্যাশিত তাগিদে এখনই তাকে সুন্দরবনে রওনা হতে হচ্ছে। শিকার সেরে ফিরতে দু-চার দিন দেরি হবে।
চিঠি পড়ে লিজা হতাশ হলেও দুঃখিত হল না; ভাবল, ভালই হল, অন্তত ঐ দু-চার দিন রেশমীর প্রভাব থেকে দূরে থাকবে।
কিন্তু দিন-দুয়ের মধ্যেই আসল কথা প্রকাশিত হয়ে পড়ল। অফিসের মুণী আরদালির ভাবগতিক দেখে তার কেমন যেন সন্দেহ উপস্থিত হল। তখন সে একজন পুরনো কর্মচারীকে জেরা করে করে সত্য আবিষ্কার করে ফেলল। জন আর রেশমী দুই রাত অফিসে কাটিয়েছে—তৃতীয় দিন ভোরবেলা নৌকাযোগে দুজনে কোন দিকে চলে গিয়েছে। কোন দিকে কেউ জানে না-লিজাও জানতে পারল না।
তখনই সে ছুটে গিয়ে সংবাদটা দিল মেরিডিথকে।
মেরিডিথ বলল, এ মন্দর ভাল।
কেমন?
বিয়ে করলে মেয়েটাকে স্বীকার করতেই হত।
আর এখন?
যতদিন খুশি ভোগ করুক, আমরা স্বীকার করতে বাধ্য নই।
তুমি জান না ঐ দে শয়তানীকে, বিয়ে না হলে ও কখনও জনের অঙ্কগত হবে না।
লিজার কথায় মেরিডিথ হাসল।
হাসলে যে?
মেয়েদের প্রতিজ্ঞা বালির বাঁধ। ওরা মুখে যখন ‘না’ বলছে মনে তখন ওদের ‘হাঁ’।
আমাকেও কি তুমি সেই দলের মনে কর নাকি!
তোমার কথা আলাদা, ডিয়ারি—এই বলে সে মুখ বাড়িয়ে দিল লিজার দিকে, লিজা সরিয়ে নিল মুখ।
মেরিডিথ হাসল।
হাসলে যে বড়?
আমার উক্তিটা স্মরণ করে মেয়েরা মুখে যখন বলছে ‘না’ মনে তখন ওদের ‘হাঁ।
লিজা বলল, তুমি ভারি বেয়াদপ।
রাগ কর না, শোন। মেয়েটাকে নিয়ে দু-চার দিন থাক জন, তার পরে আশ মিটে গেলেই ফিরে আসবে।
লিজা হেসে বলল, তোমার অভিজ্ঞতা মানতে হয়।
হয় বই কি। তোমার ভগবানকে ধন্যবাদ দাও যে, বিপদ অঙ্গের উপর দিয়েই কেটে গেল।
মেরিডিথ সর্বদা ‘তোমার ভগবান’ বলে উল্লেখ করত লিজার কাছে।
লিজা হেসে বলল, আমার ভগবান কৃতার্থ হলেন তোমার মুখে তাঁর নাম শুনে।
রেশমী ও জনের পলায়নে লিজা বুঝল যে আবার পরাজয় হল লিজার। তবু মনটা খানিকটা হাল্কা হল মেরিডিথের কথা শুনে-নেশা অল্প দিনের মধ্যেই কেটে যাবে। যাক, তাই যাক, ভগবান-লিজা প্রার্থনা করে।
তখন সে ভাবতে পারে নি যে ওরা বিয়ের উদ্দেশ্যেই পলায়ন করেছে।
মেরিডিথ আরও বলে দিয়েছিল জন ফিরে এলে লিজা যেন রাগারাগি না করে, মাঝখানের এ কটা দিনে কিছুই যেন ঘটে নি এমন ভাবে যেন তাকে গ্রহণ করে। আর যাই হক, রেশমীর প্রসঙ্গ আদৌ যেন না তোলা হয়। লিজা তার যুক্তি স্বীকার করেছিল, বলেছিল, হাঁ, আমার মনে থাকবে, জনকে অকারণে কষ্ট দেব না।
সেইভাবেই মনটাকে প্রস্তুত করে সে ফিরে এল।
লিজা বাড়ি এসে দেখল যে সন্ধ্যার স্তিমিতপ্রদীপ ড্রয়িংরুমে জন বসে আছে।
জন এত শীঘ্র ফিরবে সে আশা করে নি। জনকে দেখে সে সত্যই খুশি হল।
জন, কখন ফিরলে?
এইমাত্র এসে পৌঁছেছি।
সব ভাল তো? তার পর, শিকার কেমন হল?
শিকার! জন চমকে ওঠে। সে যে শিকার করতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছিল, এ কদিনের অভাবিত ঘটনায় সে প্রসঙ্গ ভুলেই গিয়েছিল। সে ভাবল রেশমীর পলায়নের কাহিনীটা নিশ্চয় লিজার কানে পৌঁছেছে—তাই সে ব্যঙ্গ করছে।
রুই জন কিছু উগ্রকণ্ঠে বলে উঠল, শিকার? এর মধ্যে শিকার এল কোত্থেকে?
তখনও তার মনে পড়ল না পূর্ব প্রসঙ্গ।
লিজা অবাক। রেশমীর কথা তুলবে না বলেই শিকারের কথা তুলেছিল, তাতে উল্টো ফল হল। তবু সে শান্তভাবে বলল, কেন তুমি শিকার করতে যাও নি?
পূর্ব-প্রসঙ্গ-বিস্মৃত জন বলল, নিতান্ত কদর্য তোমার পরিহাস।
কদর্য পরিহাস! এবারে লিজা সত্য সত্যই চটে গেল, ব্যঙ্গবাণ নিক্ষেপ করে বলল, কেন, শিকার ফস্কে গেল বুঝি?
লিজা, তোমার যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা!
আর শিকারটা তার চেয়েও বড়।
লিজা, অযথা অপমান কর না!
অপমান আমি করছি না তুমি করছ?
কাকে?
শুধু আমাকে নয়, বাপ-মাকে, শ্বেতাঙ্গ সমাজকে।
বিস্মিত জন শুধায়, কেমন করে?
তা-ই যদি বুঝবে, তবে এমন আচরণ করতে যাবে কেন?
কথার ধর্ম এই যে, নিজের তাপে উত্তাপিত হয়ে উঠে সীমানা ছাড়িয়ে যায়।
লিজা বলে চলল, তোমার মান-অপমান জ্ঞান থাকলে একটা বেহায়া নেটিভ খুঁড়িকে নিয়ে পালাতে না!
সাবধান লিজা, আমার বাগদত্তা বধূ সে, অপমান কর না।
একশ বার করব-hussy! বেশ্যা!
জন চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, আমার বাড়িতে যদি আমাকে এই অপমান সহ্য করতে হয়, তবে এমন বাড়ি ছেড়ে আমি চললাম।
যাও, গিয়ে দেখ, এতক্ষণ তোমার বাগদত্তা বধূ বড় শিকারীর অঙ্কগত হয়েছে।
নিঃশব্দে জন সশব্দে দরজা খুলে ফেলে প্রস্থান করল।
রাগের বেগ শান্ত না হওয়ায় প্রতি জনকে লক্ষ্য করে রেশমীর পিতামাতা ও সমাজের উদ্দেশে যেসব কথা লিজা বলতে লাগল তার অনেকগুলোই স্বয়ং শেপীয়রেরও ভাষা-জ্ঞানের অতীত।
রাত্রে একাকী শুয়ে লিজা ভাবতে লাগল-কোন সূচনার অকস্মাৎ এ কেমন উপসংহার হয়ে গেল।
এই অবোধ ভাইটিকে নিয়ে লিজার দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। দুজনের বয়সে খুব বেশি প্রভেদ ছিল না, পিঠোপিঠি ওদের জন্ম। বাল্যকালে ওরা রাগারাগি মারামারি করেছে, যেমন পিঠোপিঠি ভাই-বোন করে, কিন্তু কৈশোরের প্রারম্ভে মায়ের মৃত্যু হতেই লিজা রাতারাতি হয়ে উঠল জনের অভিভাবক। সেই থেকে ওর দুশ্চিনার সূত্রপাত। তার পর বাপের মৃত্যুর পরে দায়িত্ব যখন আরও বেড়ে গেল—তখন এল এই অভাবিত ঘটনা। জনকে সয়েহে গ্রহণ করবে বলেই ও এসেছিল, কিন্তু হঠাৎ মূহুর্তে ঘটে গেল বিপরীত কাও। লিজা শুয়ে শুয়ে ভাবে, কেন এমন হয়, মনে মুখে আচরণের এমন হেরফের ঘটে কেন? সে স করল, কাল সকালে গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে জনকে ফিরিয়ে আনবে। ও জানত, জন অফিসবাড়ি ছাড়া আর কোথাও যাবে না।
জন বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা অফিসে গিয়ে উঠল। বাপের আমলের বুড়ো মুলী কাদির আলী অফিসবাড়িতেই থাকত। সে সয়েহে জন ‘বাবা’কে অভ্যর্থনা করে নিল। এতক্ষণ পরে একজনের মেহম্পৰ্শ পাওয়ায় অভিমানের বাম্প অণুতে নির্গত হওয়ার উপক্রম হল জনের চোখে। এই স্নেহস্পর্শটুকু পাবে আশা করেই সে এসেছিল লিজার কাছে।
কাদির আলী লোকমুখে সব ঘটনা শুনেছিল। সে জনকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘ডয়ো মৎ বাবা’—বলল যে, যেমন করেই হক, সে রেশমীবিবিকে খুঁজে বের করবে, এমন কি ‘জিনে’ হরণ করে নিলেও তাকে নিয়ে এসে হাজির করে দেবে জনের কাছে।
কাদির আলী বৃথা সান্ত্বনা দেয় নি, পরদিনই বিশ্বাসী লোক লাগিয়ে দিল রেশমী বিবির সন্ধানকার্যে।
.
৪.০৪ বিশ্ববতী
সৌরভী, সৌরভী ওঠ, বেলা হয়েছে। রেশমী ডাক শুনে জেগে ওঠে। নূতন স্থান, নৃতন মুখ এক লহমার জন্যে তার মনে বিভ্রান্তি ঘটায়, বুঝতে পারে না কোথায় এসেছে, সম্মুখে এ কে! পরক্ষণেই গত রাত্রির স্মৃতি মনে পড়ে যায়। বিভ্রান্তির ভাব অপরেও লক্ষ্য করছে ভেবে একবার অপ্রস্তুতের হাসি হাসে। তার পরেই বলে, এত বেলা হয়ে গিয়েছে, ডাক নি কেন দিদি?
টুশকি বলে, শেষ রাতে ঘুমিয়েছ। একবার ডাকতে এসে দেখলাম, অঘোরে ঘুমোচ্ছ; ভাবলাম, থাক, আর একটু ঘুমোক।
তার পরে বলে, নাও ওঠ, মুখ ধুয়ে খেয়ে নাও, নিশ্চয় খুব খিদে পেয়েছে।
রেশমী সংক্ষেপে বলে, খুব।
তার পর হাত মুখ ধুয়ে পাশের ঘরে এসে খেতে বসে। দুধ চিঁড়ে কলার বাটিটা সম্মুখে এগিয়ে দিয়ে টুশকি বলে, নাও খেয়ে নাও।
রেশমী বলে, তুমি?
টুশকি বলে, আমি সকালে কিছু খাই নে।
সত্যি রেশমীর খুব খিদে পেয়েছিল, কাল দুপুরের পরে তার কিছু খাওয়া হয় নি। খেতে খেতে তার দুই চোখ জলে ভরে ওঠে, প্রবল আত্মসংযম সত্বেও জল গড়িয়ে নামে গালে।
কাঁদছ কেন বোন? শুধায় টুশকি।
রেশমী কিছু লুকোনোর চেষ্টা করে না, সরলভাবে বলে, অনেকদিন এমন ভাবে কেউ খেতে দেয় নি, খেতে বলে নি।
এ কথার আর কি উত্তর সম্ভব? তাছাড়া টুশকি বুঝেছিল মেয়েটি অ-বয়সে অনেক দুঃখ পেয়েছে। সে চুপ করে থাকে। কিন্তু কিছু বলাও আবশ্যক। বলে, এখন খেয়ে নাও ভাই, পরে এক সময়ে তোমার সব কথা শুনব।
আরও একটা রাত কেটে গেছে রেশমীর এই নূতন আশ্রয়ে। সে আর টুশকি এক শয্যায় পাশাপাশি শোয়। সে বুঝতে পারে না এ কেমন গেরালি! বাড়িতে কোন পুরুষ নেই, অন্য কোন লোক নেই, মাঝখানে একটা ঠিকে ঝি এসে বাসনকোসন মেজে দিয়ে যায়। ঝি ও টুশকির কথোপকথনের টুকরো তার কানে গিয়েছিল বিকেল বেলায়।
এ মেয়েটি কে মা?
আমার দুরসম্পর্কের বোন।
চেহারা দেখে আমারও তাই মনে হয়েছিল, কিন্তু আগে তো দেখি নি।
হ্যাঁ, এই প্রথম এল।
কিছুদিন থাকবে বুঝি?
থাকবে না! কলকাতা শহরে এসে দু-চার দিনে কে ফিরে যায় বল। এখানে কত দেখবার আছে।
তা থাকুক। বয়স হয়েছে দেখছি, বিয়ে হয় নি কেন?
আমাদের কুলীনের ঘরে ঐ ধরন—বর জুটতে জুটতে বয়স বেড়ে যায়।
আর বিয়ে হলেই বা কি। বিয়ে করে স্বামীর ঘর করতে না পারলে বিয়ে করা করা সমান। তোমার অবস্থা দেখে চোখের জল রাখতে পারি না মা।
প্রসঙ্গান্তর সূচনা করে টুশকি বলে, নে এখন হাতের কাজ কর।
টুশকির কথায় রেশমী একসঙ্গে কৃতজ্ঞতা ও করুণা অনুভব করে। রেশমীর নিজের অবস্থার সহজবোধ্য ব্যাখ্যা কৃতজ্ঞতার হেতু, আর করুণা অনুভব করে টুশকির জন্যে আহা বেচারা, বিয়ের পরেও বাপের ঘর করছে-কুলীন বর কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে–হয়তো আরও দশ গড়া বিয়ে করেছে। হয়তো কালেভদ্রে একবার আসে-হয়তো তা ও আসে না।
তার মনে পড়ে যায় গায়ের মুক্তাদিদিকে। বিয়ের রাতের পরে আর বরের দেখা পায় নি সে। সারাটা জীবন কেটে গেল তার বাপের বাড়িতে। দাঁত পড়ে গেল, চুল পেকে গেল—এদিকে সিঁথির সিঁদুর সবচেয়ে চওড়া, সবচেয়ে লাল।
ছোট ছেলেমেয়েরা পরিহাস করলে বলত, আমার যে ঐ সিঁদুর ছাড়া কিছু নেই, তাই ওটাকে খুব করে চোখের সামনে চওড়া করে আঁকতে হয়।
মৃত্যুর কিছুকাল আগে সিথির সিঁদুর আরও চওড়া হয়ে উঠল–ছোট ছেলেমেয়েরা বলল, দিদিমা, সিঁদুর যে ক্রমেই চওড়া হয়ে উঠল।
মুক্তাদিদি বলত, প্রদীপের তেল ফুরিয়ে আসছে কিনা তাই উস্কিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু এখানেই শেষ মনে করিস না, সিঁদুর একেবারে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে চিতার আগুনে।
রেশমী ভাবে, কিন্তু এ কেমন হল, টুশকিদিদির সিঁথিতে সিঁদুর নেই কেন, কপালে সিঁদুর নেই কেন, হাতে এয়োতির চিহ্ন নেই কেন?
ভাবে, হয়তো বরের মারা যাওয়ার সংবাদ পেয়েছে। কিন্তু তখনই মনে পড়ে, তাই বা কেমন করে সম্ভব? পরনে তার পাড় দেওয়া শাড়ি, মাছ খায় পান খায়। সে ভেবে পায় না টুশকি সধবা না বিধবা না কুমারী? তখনই মনে পড়ে, আমিই বা কি? আমার অত বিচার করার দরকারটাই বা কি? ভাবে, ও আমাকে আশ্রয় না দিলে আমার এতক্ষণ কি দশা হত!
আসল কথা, দীর্ঘকাল পাদ্রীদের সঙ্গে থাকায় অনেকগুলো সংস্কারের সুতো তার মন থেকে ছিঁড়ে গিয়েছিল। নতুবা টুশকির অভিনব গেরস্থালি যে কিভাবে গ্রহণ করত বলা যায় না। কিন্তু আবার স্পষ্ট করে কিছু জিজ্ঞাসা করতেও সাহস হয় না তার। পরিচয় জিজ্ঞাসা করতে গেলেই পরিচয় দেওয়ার দায়িত্ব এসে পড়ে, তাই চুপ করে থাকে।
রাতের বেলা এক পাশে শুয়ে রেশমী যখন এইরকম চিন্তা করে আর এক পাশে শুয়ে টুশকির জিজ্ঞাসার ধারা হোটে সমান্তরাল খাতে।
সে ভাবে, কে এই মেয়েটি? গাঁয়ের নামধাম, ডাকাতে চুরি করে আনা সবই সম্ভব, কিন্তু তবু কেমন পুরোপুরি বিশ্বাস হতে চায় না। কেবলই মনে হতে থাকে কোথায় কি
একটা যেন অনুক্ত রয়ে গিয়েছে। অথচ খোলাখুলি জিজ্ঞাসা করবারও সাহস নেই—নিজের সত্যকার পরিচয়টাও তো দেয় নি।
দিন দুই পরে রেশমী বলে, টুশকিদি, এখানে আর কতদিন থাকব?
যাবেই বা কোথায় ভাই?
গাঁয়ে ফিরে যাই।
একবার গা থেকে যারা চুরি করে আনতে পারে দ্বিতীয়বারও সে কাজটা তাদের পক্ষে সম্ভব। তাছাড়া, তোমাদের গাঁ তো কাছে নয়।
তবে কি এখানেই থেকে যাব?
ক্ষতি কি?
চিরদিন আমাকে খাওয়াবে পরাবে?
চিরদিন কে কাকে খাওয়ায় পরায়? একটা বর খুঁজে বিয়ে দিয়ে দেব।
হাসতে হাসতে রেশমী বলে, তার মানে ডাকাতের হাতে তুলে দিতে চাও?
টুশকি হেসে ওঠে, বলে, আচ্ছা, না হয় নাই দিলাম ডাকাতের হাতে। এখন থাক তো কিছুদিন, তার পরে সেখো পেলে পাঠিয়ে দেব গাঁয়ে।
টুশকি সত্যই সমস্যায় পড়েছে মেয়েটিকে নিয়ে। সে ভাবে, এই সময়ে কায়েৎ দা থাকলে একটা ব্যবস্থা হতে পারত। কিন্তু সে যে সেই শ্রীরামপুরে গিয়েছে আসবার নাম করে না। একদিন খোঁজ করল ন্যাড়ার, শুনল, কায়েদার ছেলেটিকে নিয়ে সে চলে গিয়েছে শ্রীরামপুরে। তখন ভাবল, এখন থাক এখানে, পরে যা হয় করা যাবে।
ওদিকে রেশমী মনে মনে ভেবে স্থির করল যে, জনের নামে একখানা চিঠি লিখে। পাঠিয়ে দেবে অফিসের ঠিকানায়। সে নিশ্চয় জানত, জন কলকাতায় চলে এসেছে; আরও জানত, জন নিশ্চয় সন্ধান করছে তার। কিন্তু পত্র লেখার অনেক বাধা। কাগজ কলম কোথায়? যদি বা কোথাও থাকে হঠাৎ চিঠি লিখতে বসলে টুশকির সন্দেহ জাগবে। তার পরে পাঠাবেই বা কাকে দিয়ে? একবার ভাবল, নিজেই গিয়ে উপস্থিত হবে জনের অফিসে। কিন্তু টুশকিকে কি বলবে? আর ভাবতেই শরীর শিউরে ওঠে, কাছাকাছি কোথাও যদি চণ্ডী বীর দল থাকে? সে ভাবত, আহা এই সময়ে একবার কায়েৎ দার দেখা পেলে সব দুশ্চিন্তার ভায় তার হাতে সঁপে দিয়ে সে নিশ্চিন্ত হতে পারত। কিন্তু কোথায় কায়েৎ দা? আর যদি বা কলকাতায় ফিরে আসে তবু তার দেখা পাওয়ার উপায় কি? তখন ভাবে, যেমন চলেছে চলুক, দেখা যাক কি হয়।
তিন-চার বার সদ্য মৃত্যুর কবল থেকে বেঁচে গিয়ে ঘটনাচক্রে অভাবিত গতিবিধির উপরে তার বিশ্বাস বেড়ে গিয়েছিল।
এখানকার জীবন রেশমীর মন্দ লাগে না। এত অনিশ্চয়তার মধ্যে কেমন একটা আরাম ও স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে সে। মনে পড়ে তার মাটির জীবন, মনে পড়ে কলকাতার সাহেবপাড়ার জীবন। সে-সব জায়গায় ছিল নিত্য নৃতন অভিজ্ঞতার প্রেরণা, মনটাকে রেখেছিল চঞ্চল করে, কখনো থিতোতে দেয় নি। সে-সব জায়গায় ছিল সে ঝরনা, এখানে হয়েছে নিভৃত একটি পল। এতদিন ছিল সে গুণ-পরানো ধনুক, আঘাতেই শিরা-উপশিরায় টঙ্কার উঠত; আজ ঘটনার হস্ত খুলে দিয়েহে গুণ, নীরবে, নিস্তেজ, আরামে পড়ে রয়েছে সে।
সকালবেলা উঠে টুশকির সঙ্গে গিয়ে সে গঙ্গায় স্নান করে আসে, তার পরে সারাদিন তার সঙ্গে মিলে বাড়ির কাজকর্ম করে।
টুশকি বলে, আবার তুমি এলে কেন সৌরভী?
রেশমী বলে, চুপ করে কি বসে থাকা যায়, হাতে পায়ে যে মরচে ধরে যাবে।
না ভাই, তুমি কষ্ট কর না, কতটুকুই বা কাজ!
এতটুকু কাজে আর কষ্ট কোথায়, উত্তর দেয় রেশমী।
না না, তুমি দুদিনের জন্য এসেছ। এর পরে বলবে, দুদিনের জন্য গিয়েছিলাম দিদির বাড়িতে, একদণ্ড বসবার সময় পাই নি।
তখন কি বলব তা তো শুনতে যাবে না, তবে ভয় কি! তাছাড়া দুদিনের জন্য এসেছি তাই বা কে বলল!
মুখে কথা চলে, সঙ্গে সঙ্গে হাত চলে। টুশকি কিছুতেই কাজ করতে দেবে না। রেশমী কাজ করবেই।
গৃহকার্যে মেয়েরা ব্যক্তিত্ব-বিকাশের সুযোগ পায়, তাই নিতান্ত শ্রমসাধ্য হলেও তারা নিরস্ত হতে চায় না।
দুপুরে খাওয়ার পরে দুজনে সেলাই করতে বসে। টুশকি বলে, তুমি এমন সুন্দর সেলাই করতে শিখলে কোথায়? এসব তো দেশী নক্সা নয়?
টুশকি ধরেছে ঠিক-রেশমী বিদেশী ফুল বিদেশী নকশা তোলা শিখেছিল মদনাবাটি থাকতে মিসেস কেরীর কাছে।
সে কথা তো বলা যায় না, বলে, দেশী কি বিদেশী কে জানে! যা মনে আসে তুলে যাই।
অপরাহ্নে একবার দুজনে যায় গঙ্গার ঘাটে। কত লোকের ভিড়। কেউ মান করছে, কেউ কাপড় কাচছে, কেউ সন্ধ্যাক্কি করছে, আর কেউ বা শুধু শুধুই ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘাটে কত রকমের নৌকা, কোনটা বোঝাই, কোনটা বোঝাই হচ্ছে, কোনটা খালাস হচ্ছে, কোনটা খালি। উজান-ভাটিতে নৌকার যাতায়াতের আর অন্ত নেই। তীরে আর জলে, লোকে আর নৌকায় এ এক চিরন্তন মেলা। কিছুক্ষণ পরে ওপার যখন ঝাপসা হয়ে আসে, আকাশের আলো যখন ঝিমিয়ে আসে, দুজনে চলে যায় মদনমোহনের মন্দিরে আরতি দেখতে।
যেদিন কোন কারণে টুশকি সঙ্গে আসতে পারে না, ও একাই আসে গঙ্গার ধাবে।
একা যাব তো দিদি?
যাও না ভাই, ভয় নেই।
ভয় নেই জানি, তবু একবার জিজ্ঞাসা করতে হয়।
টুশকি বলে, তাড়াতাড়ি ফিরে এস, তার পরে দুজনে মদনমোহনের বাড়িতে যাব, ততক্ষণে আমার কাজটুকু হয়ে যাবে।
রাতের বেলা দুজনে পাশাপাশি শুয়ে গা বাঁচিয়ে জীবনকথা বলে যায়। দুজনেই বোকে, অপর পক্ষ কিছু চাপছে, কিন্তু খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করতে সাহস হয় না, নিজেও তো কিছু চেপে যাচ্ছে।
তার পরে কখন একই ঘুমের প্রলেপে দুজনের চৈতন্য যায় তলিয়ে। এমনিভাবে চলে ওদের জীবন।
একদিন হঠাৎ দুজনে চমকে ওঠে একসঙ্গে।
বিকেলে গঙ্গায় যাওয়ার আগে আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে রেশমী চুল বাঁধছিল। টুশকির ঘরে বড় মাপের একখানি আয়না ছিল। এমন সময় তার মধ্যে ভেসে উঠল আর একখানি মুখ, দুখানি মুখ অবিকল এক ছাঁচে ঢালা। দুজনে একসঙ্গে চমকে ওঠে, চমকটুকু ধরা পড়ে স্বচ্ছ কাঁচে-সেইটুকুর ভঙ্গী অবধি এক ছাঁচের। এক মুহূর্ত কেউ কথা বলতে পারে না। অবশেষে রেশমী বলে, চমকে উঠলে কেন টুশকিদিদি?
তুমিও তো চমকালে সৌরভী!
তার পরে টুশকি বলে, আমার ঝি রাধারাণী তোমাকে দেখে এমনি চমকে উঠেছিল; শুধিয়েছিল, মেয়েটি তোমার কে হয় দিদি? আমি বললাম বোন। সে হেসে বলল, আমি দেখেই বুঝেছি, মুখ ঠিক একরকম।
রেশমী বলে, কথাটা আমাকেও সে বলেছে, কিন্তু আজকের আগে বুঝতে পারি নি, তোমার মুখের সঙ্গে আমার কত মিল।
তার পরে বলে, ছায়া দেখে হঠাৎ মনে হল, আমার দিদি যেন পাশে এসে দাঁড়াল।
তোমার কি দিদি ছিল?
শুনেছি ছিল, মনে পড়ে না, আমার জ্ঞান হওয়ার আগে মারা গিয়েছিল। দিদিমাকে বলতে শুনেছি, দুজনের চেহারায় নাকি খুব মিল ছিল। হঠাৎ মনে হল, সেই অশরীরী এসে ছায়া নিক্ষেপ করেছে আয়নায়।
টুশকি যেন কি বলতে চায়, কি বলবে ভেবে পায় না। রেশমী যেন কি মনে করতে চায়, কিছু মনে আসে না তার। দুজনেরই মনের তলায় স্মৃতির অগোচরে কি যেন একটা রহস্য চাপা আছে; আছে সুনিশ্চিত, তবু মনে পড়তে চায় না। জলের নীচে পড়ে আছে বিচিত্র উপলখঙ, হাত যতই বাড়িয়ে দেওয়া যাক, নাগালের বাইরে থেকেই যায়। ঐ, আর একটুখানি বাড়ালেই পাওয়া যাবে। নাঃ, তবু ধরা দেয় না হাতে, অথচ ঐ যে ঝলমল করছে।
সেদিন দুজনে পাশাপাশি শুয়ে স্মৃতির সুড়ঙ্গ-পথে ঢুকে পড়ল—দুজনেই বিম্ববতীর রহস্য সন্ধানের নীরব অভিযাত্রী। দুজনেই নীরবে ভাবে, আহা, ও যদি আমার বোন
.
৪.০৫ পুলিসের পরওয়ানা
মোতি রায় যেমন ধনবান, তেমনি বুদ্ধিমান। কখনও কখনও ও দুই গুণ একসঙ্গে দেখা যায়। রেশমী-হরণের ব্যাপারটাকে সে গড়ে-পিটে নিজের সুবিধামত তৈরী করে নিল। তার পক্ষে নারী দুর্লভ নয়, রেশমীর মত সামান্য একটা নারীর অভাব অনায়াসে পূরণ করে নিতে পারত। কিন্তু সেজন্য নয়, অন্য কারণে রেশমীর উজার আবশ্যক। তার অভীষ্ট শিকার পালিয়েছে বা অন্য কেউ ছিনিয়ে নিয়েছে—এ তার সামাজিক মর্যাদার পক্ষে হানিকর। ইতিমধ্যেই তার জ্ঞাতিভ্রাতা শরিক মাধব রায় ঘটনাকে ফলাও করে প্রচার করতে লেগে গিয়েছে। তাদের লোকে বলে বেড়াচ্ছে, আমাদের আয়ান ঘোষের এবারে বড় বিপদ, সাধের রাধিকাকে কলির কেষ্ট হরণ করে নিয়ে গিয়েছে। আয়ান ঘোষ এখন গলায় দেবার মত দড়ি কলসী খুঁজে মরছে।
মাধব রায়ের লোকে শুধু তিলকে তাল করে রটিয়েই ক্ষান্ত হল না, ঘটনার তাল রক্ষাতেও মনোযোগ দিল। একদিন সকালবেলায় মোতি রায়ের বৈঠকখানার সম্মুখে দড়ি ও কলসী আবিষ্কৃত হল। কলসীর গায়ে আলকাতরায় লেখা-”এই যে আমরা এসেছি, এবারে চল তোমাকে নিয়ে গঙ্গায় যাই।”
মোতি রায় শ্রীরামপুরে লোক পাঠিয়ে খবর নিল। হাঁ, সেখানে কেরী, টমাস, ওয়ার্ড, মার্শম্যান, ফেলিক্স নামে একদল পাদ্রী আছে, আর আছে জন, সঙ্গে রামরাম বসু।
এবারে মোতি রায় মামলা সাজাতে লেগে গেল। সে বুঝল, কেরী ও টমাসকে আসামী করা চলবে না, তারা অনেকদিন এদেশে আছে, কলকাতার শেতাঙ্গ সমাজে তারা পরিচিত, তাদের আসামী করতে সমর্থন পাওয়া যাবে না, তাই তাদের নাম বাদ দেওয়া হল, জনের নামও ঐ কারণে বাদ পড়ল। রাম বসু বাঙালী, সামান্য লোক, সে যে মোতি রায়ের বিরুদ্ধতা করেছে, একথা স্বীকার করায় লজ্জা আছে-তাই রাম বসুও আসামী শ্রেণীভুক্ত হল না। আসামী দাঁড় করানো হল ওয়ার্ড ও মার্শম্যানকে, আর তাদের কলিত পাইকদের।
আসামীর নাম স্থির হলে ঘটনা স্থির হতে বিলম্ব হল না। চণ্ডী বলী রেশমী আর দিদিমাকে নিয়ে গঙ্গাস্নানে এসেছিল। এমন সময়ে গঙ্গার ঘাট থেকে পাইক বরকন্দাজের সহায়তায় মার্শম্যান আর ওয়ার্ড সাহেব মেয়েটিকে নিয়ে নৌকাযোগে পালিয়ে যায়। ঘটনার সাক্ষীর অভাব নেই—এক ঘাট লোক ব্যাপারটা দেখেছে। বলা বাহুল্য সক্ষী বলে যাদের উল্লেখ করা হল, তারা সবাই মাতি রায়ের নিজ লোক।
ঘটনা এইভাবে সাজিয়ে নিয়ে মোতি রায়ের দেওয়ান রতন সরকার অভিযোগকারী চণ্ডী বক্সীকে নিয়ে কলকাতায় পুলিস সুপারিন্টেন্টে পোকার সাহেবের কুঠিতে গিয়ে উপস্থিত হল।
রতন সরকার সাহেবকে বুঝিয়ে দিল যে, চণ্ডী বক্সীকেই অভিযোগকারী বলে ধরতে হবে, কারণ অপহৃত বালিকার দিদিমা পর্দানশীন জেনানা। সমস্ত অবস্থা নিবেদন করে সে প্রার্থনা করল যে, সাহেবদের গ্রেপ্তারের জন্য এবং মেয়েটির উদ্ধারের জন্য পরোয়ানা বের করতে এখনই আজ্ঞা হক।
তার পর সে আরও বলল যে, হুজুর, আমার মনিব মোতি রায় বাবুজী হিন্দু সমাজের প্রধান—তাঁর কর্তব্য হিন্দুদের ধর্মরক্ষা ও প্রাণরক্ষা করা। তাই তিনি অভিযোগকারীকে নিয়ে আপনার কাছে আসতে বললেন।
এখন, অভিযোগকারীর পিছনে মোতি রায় থাকাতে অভিযোগের গুরুত্ব শতগুণ বেড়ে গেল। অভিযোগকারী সামান্য লোক হলে আর আসামী শ্বেতাঙ্গ হলে কি ফল হত কে জানে, হয়ত উল্টো ফল হত।
স্পোকার বলল, মার্শম্যান আর ওয়ার্ডকে তো কোম্পানির মুল্লুকে আসতে নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে। সুযোগ বুঝে রতন সরকার বলল, তবেই দেখুন হুজুর, পাদ্রীদের সাহস কত বেড়ে উঠেছে।
সাহেব অধ্যক্ত গর্জন করল, হম।
তাও আবার দিনের বেলায়।
সাহেব পুনরায় গর্জন করল, হম্।
রতন সরকার আশ্বাস পেয়ে বলল, তাও কিনা আবার হোলি মাদার গ্যাঞ্জেসে রিলিজিয়াস বেদিং-এর সময়ে–
সাহেব মুখের চুরুট রেখে দিয়ে বলল, মোতি বাবুজীকে আমার সম্ভাষণ জানিয়ে ব’ল যে, আমি যত শীঘ্র সম্ভব ব্যবস্থা অবলম্বন করছি।
রতন সরকার সেলাম করে বিদায় নিল। এতক্ষণ চণ্ডী বক্সী নীরবে দাঁড়িয়ে মোতি রায়ের প্রভাব প্রত্যক্ষ করে ক্রমেই অধিকতর বিস্মিত হচ্ছিল, সে বুঝে নিল যে সাহেব সত্য ও ঘটনাক্রম মোতি রায়ের হাতধরা।
রতন সরকার আগের দিনে এসে স্পোকারকে অনেক টাকা খাইয়ে গিয়েছিল।
মোতি রায় চারদিক রক্ষা করে অগ্রসর হতে জানে। সে জানত যে, অভিযোগকারীদের নিজের হাতের মধ্যে রাখা দরকার, নতুবা তারা বিগড়ে বসলে সব মাটি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা।
বাসস্থানে সুবিধা করে দিচ্ছি অজুহাতে মোতি রায় চণ্ডী বঙ্গী ও মোক্ষদাকে নিজের একটা বাড়িতে এনে তুলল। কার্যত তারা নজরবন্দী হয়ে পড়ল। গতিক মন্দ দেখে মৃত্যুঞ্জয় আগেই সরে পড়েছিল।
.
সেদিন বিকালবেলায় গঙ্গার ধারে রেশমী একা গিয়েছিল, ‘হাতের কাজটুকু সেরে নিই’ অজুহাতে টুশকি বাড়িতে ছিল।
সে বলল, সৌরভী, তুমি ঘুরে এস, এই তো এখানে, ভয় কি।
রেশমী বলল, ভয় আবার কি।
তাহলে যাও, শীগগির করে ফিরে এসো।
রেশমী বসে বসে গঙ্গায় নৌকা যাতায়াত দেখছিল, যেমন নিত্য দেখে থাকে। এমন সময়ে রাস্তার উপরে ঢোলের শব্দ শুনে ফিরে তাকাল। দেখল সে, জনকয়েক কোম্পানির পুলিস, সঙ্গে একটা ঢুলী—আর পিছনে জুটে গিয়েছে একদল লোক। ঢুলীটা মাঝে মাঝে ঢোলে বাড়ি দিচ্ছে আর তার পরে কি যেন আউড়ে যাচ্ছে।
রেশমী আবার গঙ্গার দিকে মন দিল। কিন্তু কানের খানিকটা মনোযোগ পড়ে রইল পিছনের দিকে। হঠাৎ কানে এত ৩ার নামটা। সে কান খাড়া করে উঠল। এবারে সবটা শুনতে পেল। ঢুলীর আবৃত্তি শুনে তার মুখ শুকিয়ে গেল, হাত-পা কাঁপতে লাগল, মনে হল কাছাকাছি সমস্ত লোক সন্দেহের সঙ্গে তার দিকেই তাকাচ্ছে। কি করা উচিত, সে স্থির করতে পারল না। ঢুলীরা একটু দূরে যেতেই সে উঠে পড়ল, প্রথমে কিছুটা ধীরপদে চলে অবশেষে প্রায় ছুটতে ছুটতে বাড়িতে এসে পৌঁছল। তখনও সে হাঁপাচ্ছিল।
টুশকি শুধাল, হাঁপাচ্ছ কেন ভাই?
একটা ষাঁড়ে তাড়া করেছিল।
যা বলেছ ভাই, মহারাজ নবকৃষ্টের বৃষোৎসর্গের ষাঁড়গুলোর জ্বালায় কলকাতার পথেঘাটে চলা কঠিন হয়ে পড়েছে।
তার পরে বলল, মদনমোহনতলায় যাবে না? আরতির সময় হল যে?
রেশমী বলল, আমার শরীরটা ভাল নেই, তুমিই যাও।
রাতে সে ভাল করে খেল না। তার মধ্যে কেবলই ঢোলের শব্দের সঙ্গে শুনতে পায়, ‘রেশমী নামে একটি মেয়েকে উদ্ধার করে দিতে পারলে পাঁচ শ সিক্কা টাকা বকশিশ। স্বপ্নের মধ্যে দেখে—তাকে যেন বেঁধে নিয়ে চলেছে, আগে আগে মোতি রায়, পিছে পিছে চণ্ডী বক্সী, দূরে জ্বলছে চিতার আগুন। আর জেগে উঠলে রাস্তার প্রত্যেক পদধনিকে নিদারুণ অর্থপূর্ণ বলে মনে হয়। এইভাবে স্বপ্ন, তন্দ্রা ও জাগরণের টানা-হাচড়ায় তার রাত্রির প্রহরগুলো কাটে। সে এক সময়ে নিজের অগোচরে বলে ওঠে-মদনমোহন, রক্ষা কর আমাকে!
অনেককাল পরে দেবতার নাম উচ্চারণ করবার সঙ্গে সঙ্গে তার দুই চোখে নামল অতর্কিত জলের ধারা। রাতটা কেটে যায়।