শাহরাজাদ বলে, এবার যদি জাঁহাপনা অনুমতি করেন তবে কামর আর হালিমাহর কাহিনী শোনাতে পারি।
-বেশ তো, শোনাও।
শাহরাজাদ হাসে, তার আগে ছোট্ট একটা হিতোপদেশের গল্প শোনাই আগে। আমাদের পূর্বপুরুষরা এই ধরনের শিক্ষামূলক অনেক কাহিনী রেখে গেছেন। আমাদের জন্য। আজ তারই একটা শোনাচ্ছি আপনাকে।
সুলতান শারিয়ার বলে, আচ্ছা তাই শোনাও দেখি কেমন উপদেশের কথা। শাহরাজাদ, আমি ভেবে পাই না, তুমি একনাগাড়ে এতদিন ধরে একটার পর একটা এইরকম মজাদার কিসসা কি করে বলে যেতে পারছো!
শাহরাজাদ বলে, মহানুভব শাহেনশাহর অপার করুণা। ওয়াদা মতো প্রতিটি রাতে তো আমি আপনাকে কাহিনী শোনাতে পারিনি। কখনও মন মেজাজ ভালো লাগেনি বলে বাদ দিয়েছি, আবার কখনও অসুখ-বিসুখ হওয়াতেও ছেদ পড়েছে। একবার তো একটানা বিশদিন বিমারে পড়েছিলাম। আপনাকে কিসসা শোনাতে পারিনি। কিন্তু আমার ওপর আপনার অশেষ দয়া,—আপনি আমাকে ক্ষমার চোখে দেখেছেন।
শারিয়ার হাসে, তুমি কী আমাকে শুধুমাত্র হৃদয়হীন পাষণ্ড বলেইমনে কর শাহরাজাদ। রক্ত মাংসে গড়া মানুষের শরীর। অসুখ-বিসুখ হবেই। তাছাড়া তুমি তো একটা কলের পুতুল নও, দম দিলেই চলতে থাকবে। আর সকলের মতো তোমারও ইচ্ছে অনিচ্ছে ভালো লাগা না-লাগা বলে একটা ব্যাপার থাকতেই পারে। আমি কী এতোই অমানুষ, সেটুকুও বুঝতে পারবো না?
কৃতজ্ঞতায় মাথা নত হয়ে যায় শাহরাজাদের। একটুক্ষণ পরে সে গল্প শুরু করে :
কোন এক সময় এক সুন্দর সুপুরষ বিদ্যোৎসাহী তরুণ নানা শাস্ত্র অধ্যয়ন করে অতি অল্প বয়সেই পরম জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলো। যেখানে যা ভালো বইপত্তর পেত সংগ্রহ করে পড়তো সে। জ্ঞানী গুণী ব্যক্তির সন্ধান পেলেই সে ছুটে যেত তাদের কাছে। যদি কিছু জ্ঞান আহরণ করা যায়। এইভাবে দুনিয়ার তাবৎ জ্ঞানভাণ্ডার উজার করে নিতে থাকলো সে। তবুতার তৃষ্ণা মেটে না। দেশ হতে দেশান্তরে ছুটে চলে—নতুন কোনও বিদ্যা যদি সে শিখতে পারে এই আশায়!
একদা চলতে চলতে এক ফকির দরবেশের সাহচর্য পায় সে। যুবক তাকে আঁকড়ে ধরে, আপনি আমাকে কিছু জ্ঞান দান করে যান পীরসাহেব।
দরবেশ ওর মাথায় হাত রেখে বললেন, বেটা, তোমার সঙ্গে আলোচনা করে বুঝলাম, এই বয়সে তুমি যে জ্ঞানের অধিকারী হয়েছ আমি সারাজীবন ঘুরে ঘুরে এই বৃদ্ধবয়সে তার ধারে কাছেও পৌঁছতে পারিনি। তোমাকে জ্ঞান দান আমার বিদ্যায় কুলাবে না। বরং আমি তোমাকে এক দিব্যজ্ঞানীর কাছে পাঠাচ্ছি সেখানে যাও, তিনি তোমাকে দিব্যজ্ঞান দিতে পারবেন।
যুবক কৃতজ্ঞচিত্তে সেই জ্ঞানী মহাজনের ঠিকানা নিয়ে রওনা হলো। কুড়ি দিন একটানা পথ চলার পথ এক গণ্ডগ্রামে এসে পৌঁছলো। সেই গ্রামে বাস করেন সেই দিব্যজ্ঞানী, এক কর্মকার।
যুবক দেখলো, একটা ছোটোখাটো কামারশালা। এক পলিতকশে বৃদ্ধ নিজের হাতে হাপর টেনে লৌহশলাকা গরম করছে। যুবককে দেখে বৃদ্ধ কর্মকার মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলেন, কী বাবা, কী দরকারে এসেছ।
যুবক তার পদধূলি মাথায় নিয়ে বললো, আমি আপনার কাছে এসেছি জ্ঞানলাভের জন্য। অনেক পথ হেঁটে বহু দূরদেশ থেকে আসছি। শুনেছি সারা দুনিয়ার মধ্যে এখন আপনিই একমাত্র প্রাজ্ঞব্যক্তি।
বৃদ্ধ হাসলেন। মাথা নেড়ে বললেন, জ্ঞান-সমুদ্রের এক আজলা পানিও কী আমরা গ্রহণ করতে পারি বাবা। যাই হোক কাছে এসো। এখানে বস। আমার যা জানা আছে অবশ্যই তোমাকে
তা শেখাবো, কিন্তু তার জন্য ধৈর্য ধরতে হবে, হাঁক-পাক করলে হবে না।
যুবক বলে, আপনার আজ্ঞা শিরোধার্য।
বৃদ্ধ বললেন, তা হলে আজ থেকে পাঠ শুরু হয়ে যাক। এই নাও ধরো এই হাপরের দড়িখানা। বুড়ো হয়েছি, একনাগাড়ে কতকাল ধরে দড়ি টেনে হাওয়া করে লোহা গরম করে আসছি। এবার তুমি এসে গেছে, ভালোই হোল। আমি হাতুড়ি পিটে যন্ত্রপাতি বানাবো, আর তুমি হাপর টেনে আমার কাজের একটু সাহায্য করবে!
যুবক বলে, এভাবে আপনার কোনও কাজে লাগতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি আমি। প্রতিদিন কামারশালা খোলে বৃদ্ধ। হাপর জ্বালানো হয়। যুবক সারাদিন ধরে হাপর টানে আর বৃদ্ধ নানারকম যন্ত্রপাতি তৈরি করতে থাকেন! কত রকম খদ্দের আসে। কত লোকের কত রকম ফরমাশ। বৃদ্ধ যত্ন সহকারে সব শোনে। বায়না নেয়। এবং সেই মত কাজ সমাধা করে যথাসময়ে খদ্দের বিদায় করেন।
একদিন দুদিন করে একটা সপ্তাহ কেটে গেলো। বৃদ্ধ কোনও জ্ঞানের কথা বলে না। যুবক ভাবে, সময় হলে তিনি নিজে থেকেই বলবেন। সুতরাং পুনরায় তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া সঙ্গত হবে না।
কিন্তু দিনে দিনে মাস অতিক্রান্ত হতে চললো, বৃদ্ধ তার নিজের কামারশালার কাজকর্মে ডুবে থাকেন। সারাদিন অন্য কোনও কথাবার্তা বলার ফুরসতই নাই! যুবক লক্ষ্য করে, এই বয়সেও বৃদ্ধ কী অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। এক মুহূর্ত কাজে গাফিলতি নাই। সারাদিন ধরে হাতে কাজ করে চলেছেন এবং সেই সঙ্গে মুখে কথা বলে যাচ্ছেন খদ্দেরদের সঙ্গে। কোনও বিরাম নাই।
এইভাবে মাসে মাসে বছর পার হয়ে গেলো। যুবক বুঝতে পারলো, বৃদ্ধ ইচ্ছে করেই তার সঙ্গে জ্ঞানের আলোচনায় প্রবৃত্ত হচ্ছেন না। কিন্তু কেন? অনেক ভেবেও কোনও কারণ অনুসন্ধান করতে পারে না সে। যাই হোক, যুবক নিজে থেকে তার শিক্ষালাভের কোনও প্রস্তাব উত্থাপন করতে সাহস করে না। বৃদ্ধ যদি অপ্রসন্ন হন, যদি তিনি বিমুখ হয়ে বলেন, না বাপু আমার দ্বারা হবে না, তুমি অন্য পথ দেখ।
এক এক করে পুরো পাঁচটা বছর কেটে গেলো। তবু বৃদ্ধ মুখ খোলেন না। তার জ্ঞানের ভাণ্ডার উন্মুক্ত করে দেন না ওর কাছে। এবার কিন্তু যুবক ঈষৎ অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। কিন্তু মুখে কিছু প্রকাশ করে না। অসীম ধৈর্য নিয়ে সেই পরমক্ষণটির প্রতীক্ষা করতে থাকে।
এইভাবে আরও পাঁচটা বছর চলে গেলো। যুবক তখন সব কিছু ভুলে বৃদ্ধের চরণে নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছে। সে জানে সময় হলে আপনা থেকেই তিনি তাকে দিব্যজ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত করবেন।
বৃদ্ধ একদিন বললেন, আচ্ছা বাবা একটানা দশটা বছর তুমি একই ভাবে হাপর টেনে যাচ্ছো, তোমার বিরক্তি লাগে না?
যুবক বললো, এখন আমি সে সবের অনেক ওপরে চলে গেছি, বাবা। প্রথম প্রথম যে একেবারে সে-রকম হয়নি তা নয়, কিন্তু এখন আর হয় না?
বৃদ্ধ বলেন, আমার কাছে কিছু শিখবে বলে এসেছিলে! এতকাল ধরে তোমাকে বসিয়ে বসিয়ে শুধু হাপরের দড়ি টানালাম। দিব্যজ্ঞান তো কিছু দিতে পারলাম না, বেটা।
যুবক বলে, প্রথমে বুঝতে পারিনি, কিন্তু পরে আমার সম্যক জ্ঞানলাভ হয়েছে বাবা, দিব্যজ্ঞান লাভ করতে গেলে, অসীম ধৈর্যের অধিকারী হতে হবে। জগতে ধৈর্যশীল ব্যক্তিরাই প্রকৃত জ্ঞানী হতে পারে। এতকাল পরে এই পরম সত্যটি আমি আপনার সাহচর্য থেকে লাভ করতে পেরে ধন্য হয়েছি।
বৃদ্ধ আশীর্বাদ করে বললেন, যাও বাবা গৃহে ফিরে যাও। যে ধৈর্য তিতিক্ষার পরিচয় তুমি রেখে গেলে আমার কাছে, সারা দুনিয়ায় তার নজির মেলা ভার। আমি বিশ্বাস করি, তুমি দিব্যজ্ঞান লাভ করেছ।
যুবক বৃদ্ধের পদধূলি মাথায় নিয়ে দেশে ফিরে গেলো।
শাহরাজাদ থামলো। সুলতান শাহরিয়ার বলে, অপূর্ব! খুব ভালো লাগলো শাহরাজাদ। এবার তাহলে তোমার সেই কমার আর হালিমাহর কিত্সা শুরু কর, শোনা যাক।
শাহরাজাদ বললো, জাঁহাপনা ভাবছি, তার আগে অন্য আর একটা কাহিনী আপনাকে শোনাবো।
শারিয়ার বলে, কী কাহিনী?
গুলাব সুন্দরী ফারিজাদ-এর কিসসা বলছি শুনুন জাঁহাপনা। খুব সুন্দর নির্মল মনোগ্রাহী এক কাহিনী।
সুলতান বলে, বেশ তাই বলল, শাহরাজাদ। শাহরাজাদ বলতে শুরু করে।