৪.১
দুরমনস্কর মতো চড়াইয়ের রাস্তা ভেঙে সেলুলার জেলের দিকে উঠতে উঠতে হঠাৎ থেমে, পেছন ফিরে তাকাল বিনয়। অনেক নিচে সেসোস্ট্রেস বে’র জেটিটায় এর মধ্যে ফিরে গেছে লা-পোয়েরা। তারা কিন্তু এবার আর জেটির লম্বা পাটাতনে বসে তখনকার মতো ঢিলেঢালা মেজাজে আড্ডা জমাতে বসল না। পাশেই বাঁধা রয়েছে তাদের ধবধবে সাদা মোটর বোটটা–’সি-বার্ড’। সবাই একে একে ‘সি-বার্ড’-এ উঠে পড়ল। তারপর বোটটা উপসাগরের ডানদিকের কিনারা ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল। বোঝাই যাচ্ছে লা-পোয়ের ডাইভাররা সমুদ্রে ‘সিপি’ অর্থাৎ নানা ধরনের ‘শেল’ যেমন শঙ্খ, টার্বো, ট্রোবাস, ফ্রগ শেল ইত্যাদি নজরে পড়লেই বোট থামিয়ে, জলে নেমে সেসব তুলতে তুলতে এগিয়ে যাবে। যতক্ষণ দিনের আলো থাকবে, আর উপসাগরের ধারের দিকের অগভীর, স্বচ্ছ জলের তলা অবধি দেখা যাবে, তাদের ‘সিপি’ তোলার কাজ চলতেই থাকবে। বিরামহীন। দিন ফুরিয়ে এলে যখন সূর্য পশ্চিম দিকে মাউন্ট হ্যারিয়েটের আড়ালে নেমে যাবে, ঝাপসা হয়ে যাবে চরাচর, তখন আজকের মতো লা পোয়েদের জলতল থেকে ‘শেল’ বা ‘সিপি’ তোলার কাজ শেষ।
মোটর বোট ‘সি-বার্ড’ জল কেটে কেটে দূরে, আরও দূরে চলে যাচ্ছে। তার ইঞ্জিনের ভটভট আওয়াজ ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে। একসময় ‘সি-বার্ডটাকে আর দেখা গেল না। অনেক দূরে ঘোড়ার খুরের আকারের উপসাগর যেখানে একটা ছোটখাটো পাহাড়ের পাশ দিয়ে ডাইনে ঘুরেছে সেখানে অদৃশ্য হয়ে গেল।
বেলা অনেকটাই বেড়ে গেছে। পোর্টব্লেয়ারের উলটোদিকে, কোনাকুনি ‘রস’ আইল্যান্ডের ওধার থেকে সূর্যটা আকাশের ঢাল বেয়ে বেশ খানিকটা ওপরে উঠে এসেছিল। রোদের তেজ দ্রুত বাড়ছে। সিসোস্ট্রেস উপসাগরের মেজাজ আছে মোটামুটি শান্ত। পাহাড়প্রমাণ ঢেউ ছুটে এসে পাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে না। এখন চারিদিকে লক্ষ কোটি ছোট ছোট ঢেউ। সেগুলোর ওপর রোদ এসে পড়ায় ঝকমক করছে। সব মিলিয়ে সমুদ্র জুড়ে পরমাশ্চর্য এক রোশনাই। কিছুক্ষণ পর কিন্তু সেদিকে তাকিয়ে থাকা যাবে না। বেলা যত আরও চড়বে, রোদ যত তীব্র হবে, নোনা জলের ঢেউ থেকে এমন ঝঝ উঠে আসবে যে চোখ ঝলসে যাবে।
যতদূর চোখ যায়, উপসাগরের দিকে ঝুঁকে অজস্র সিগাল উড়ছে। এই সাগর-পাখিদের পেটে সারাক্ষণ রাহুর খিদে। তাদের ধ্যানজ্ঞান সেসোস্ট্রেস বে’র জলের দিকে। মাছের নড়চড়া চোখে পড়লেই চকিতে তড়িৎগতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, পরক্ষণে ধারালো ঠোঁট এবং পায়ের নখ দিয়ে গেঁথে শিকার। তুলে আনছে। সারা উপসাগর জুড়ে এই একই দৃশ্য। আন্দামানে আসার পর থেকে এসব দেখে চলেছে বিনয়। সে আর দাঁড়াল না।
লা-পোয়েদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে শেখরনাথের কথা খেয়াল ছিল না। আজ মোহনর্বাশি কর্মকারকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে দেওয়া হবে, তাও ভুলে গিয়েছিল। শেখরনাথকে বিনয় বলেছিল, কয়েক মিনিটের ভেতর ফিরে আসবে কিন্তু অনেকটা সময় কেটে গেছে। প্রায় চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট। নিশ্চয়ই শেখরনাথ খুব বিরক্ত হচ্ছেন। বিনয় অস্বস্তি বোধ করল। পাহাড়ি রাস্তার চড়াই ভাঙার গতি অনেকটাই বাড়িয়ে দিল সে।
সেলুলার জেলের বিশাল গেটের পাল্লাদু’টো দিনরাত হাট করে খোলা থাকে। এখনও রয়েছে। বিনয় গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল।
সকালের দিকে হাসপাতাল আর অফিসগুলো মোটামুটি ফাঁকাই থাকে। এখন বেলা বাড়ার পর লোজনও বেড়েছে। ব্যস্ততাও। অফিসগুলো গমগম করছে। হাসপাতালেও বেশ ভিড়। এই সময়টা হাসপাতালের এবেলার ভিজিটিং আওয়ার্স। যেসব রোগী ভর্তি আছে তাদের বাড়ি থেকে আত্মীয়-পরিজনেরা এসেছে। তাছাড়া পোর্টব্লেয়ার এবং কাছাকাছি দ্বীপগুলো থেকে নতুন পেশেন্ট নিয়ে অনেক গাড়িও আসছে।
বিনয় সিঁড়ি টপকাতে টপকাতে উঠে এল। অন্যদিনের মতো লম্বা প্যাসেজের একধারে মোহনবাঁশির বউ জ্যোৎস্না এবং তাদের তিন ছেলেমেয়ে বসে আছে। ক’দিন ধরে রোজ দু’বেলা হাসপাতালে আসছে ওরা। জ্যোৎস্নার পাংশু মুখ অসীম উৎকণ্ঠায় ভরা থাকত। দেখে মনে হত তার স্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। চোখ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় অবিরাম জল ঝরে যেত। রুক্ষ চুল এলোমেলো হয়ে উড়তে থাকত, সিঁথিতে শুকনো সিঁদুর। পরনে সাতবাসি শাড়ি। ছেলেমেয়েগুলোও কেমন যেন জড়সড় হয়ে গুটিয়ে থাকত। ভয়ার্ত, বিহ্বল। কিন্তু আজ জ্যোৎস্না আর তার তিন সন্তানের সমস্ত উদ্বেগ উধাও। চারটি মুখ ঝলমল করছে খুশিতে। পোর্টব্লেয়ার থেকে চল্লিশ মাইল দূরে জেফ্রি পয়েন্টে যেখানে জঙ্গল নির্মূল করে পূর্বপাকিস্তানের রিফিউজিদের সেটলমেন্ট বসানো হচ্ছে সেখানে ক্রুদ্ধ, হিংস্র জারোয়াদের তির আমূল ঢুকে গিয়েছিল মোহনবাঁশির ফুসফুসে। শেখরনাথরা কী কষ্ট করেই না তাকে পোর্টব্লেয়ারে নিয়ে এসেছিলেন। হাসপাতাল থেকে তাকে বাঁচিয়ে নিয়ে যাবে, কদিন আগেও ভাবতে পারেনি জ্যোৎস্নারা। আজ তাদের মুখ তো আলো হয়ে উঠবেই।
বিনয় জিগ্যেস করল, ‘কাকা কোথায়?’
অন্যদিন ক্কচিৎ দু-একটা শব্দ বেরুতো জ্যোৎস্নার মুখ থেকে। ‘হ’ বা ‘না’। তবে রোজই ব্যাকুল স্বরে বলত, ‘আমার পোলা-মাইয়ার বাপেরে আপনেরা বাঁচান।‘ ব্যস, এটুকুই। আজ তার আতঙ্ক, বিহ্বলতা, কিছুই নেই। সে এখন অনেক সহজ আর স্বাভাবিক। জ্যোৎস্না বলল, ‘বাবায় অহন (এখন) ডাক্তরকত্তার ঘরে। আপনে ফিরা আইলে তেনাগো (তাদের) কাছে যাইতে কইছে।‘
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, যাচ্ছি—’ ব্যস্তভাবে দোতলার অন্য প্রান্তে ডাক্তার চট্টরাজের চেম্বারে চলে এল বিনয়।
চেম্বারে আন্দামান-নিকোবরের চিফ মেডিক্যাল অফিসার ডাক্তার চট্টরাজ, শেখরনাথ এবং একজন নার্স ছাড়া আর কেউ ছিল না। বিনয়ের অস্বাচ্ছন্দ্য বাড়ছিল, ভয়ে ভয়ে চোখের কোণ দিয়ে সে। শেখরনাথের দিকে তাকাল। দেরি করে আসার জন্য তিনি কতটা রুষ্ট হয়েছেন, আন্দাজ করতে চেষ্টা করল। কিন্তু বাইরে থেকে দেখে মনে হল না তিনি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। এক লহমা বিনয়ের দিকে তাকিয়ে বেশ সহজভাবেই বললেন, ‘এসে গেছ। বোসো—’
নিঃশব্দে একটা চেয়ারে বসে পড়ল বিনয়। তার মধ্যে যে অস্বস্তি জমা হয়েছিল ধীরে ধীরে কেটে গেল।
বিনয় চেম্বারে ঢোকার আগে থেকেই মোহনবাঁশি সম্পর্কে ডাক্তার চট্টরাজের সঙ্গে শেখরনাথের কথাবার্তা চলছিল। তার খেই ধরে ডাক্তার চট্টরাজ ফের শুরু করলেন।–’কাল বলেছিলাম, আজও মনে করিয়ে দিচ্ছি, মোহনবাঁশিকে ডিসচার্জ করে দেওয়া হচ্ছে ঠিকই কিন্তু পোর্টব্লেয়ারে তার মিনিমাম একটা উইক থাকা দরকার। রোজ তাকে একবার হাসপাতালে এসে চেপ-আপ করাতে হবে। জেফ্রি পয়েন্টে চলে গেলে অত দূর থেকে রোজ রোজ তাকে নিয়ে আসা তো সম্ভব নয়। তাই—’
শেখরনাথ হাসলেন।–-‘মনে আছে। আমার বয়েস হয়েছে ঠিকই, তবে স্মৃতিশক্তিতে এখনও মরচে পড়েনি।‘
ডাক্তার চট্টরাজও একটু হাসলেন, তবে সামান্য অপ্রতিভও দেখাল তাঁকে।–’জানি তো।’ তারপর মোহনবাঁশির প্রসঙ্গে ফিরে গেলেন।–‘প্রেসক্রিপশন লিখে দিচ্ছি। ওষুধগুলো নিয়ম করে তিন বেলা খেতে হবে। সকাল বিকেল দশ মিনিট করে ওকে ধরে ধরে হাঁটাতে হবে। পরীক্ষার পর যদি দেখা যায় সব ঠিক আছে, মাস তিনেক কোনও ভারী কাজ করা চলবে না। ওয়েট তোলা বারণ। ফুল রেস্ট। শরীর খুব উইক। ফুসফুসের উন্ড সেরেছে, তবু এতটুকু রিস্ক নেওয়া উচিত নয়। ফের যদি ব্লিডিং হয় মোহনবাঁশিকে বাঁচানো মুশকিল হবে।’
শেখরনাথ বললেন, ‘তুমি স্বয়ং ধন্বন্তরি, ওকে রক্ষা করেছ। যেমনটা বলবে সেভাবেই ও চলবে।
‘আপনাকে আর বিনয়বাবুকে রোজ কষ্ট করে মোহনবাঁশিকে হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে। । যে কেউ ওকে এনে দেখিয়ে গেলেই চলবে।’
‘আচ্ছা—’
ডাক্তার চট্টরাজ প্রেসক্রিপশন এবং ‘ডিসচার্জ’ অর্ডার লিখে পাশে দাঁড়ানো নার্সটিকে বললেন, ‘সিস্টার, তুমি তেতলা থেকে পেশেন্টকে এখানে নিয়ে এসো। ডাক্তার সুকুমার বোস আর তাপস মিত্রকেও আসতে বলবে।’
নার্স চলে গেল। মিনিট দশেক বাদে মোহনবাঁশি কর্মকারকে ধরে ধরে নামিয়ে নিয়ে এল সে। সঙ্গে দুই তরুণ ডাক্তার। আগেও এদের দেখেছে বিনয়। সুকুমাররা কার-নিকোবরে ক’জন নিমুনিয়া আর টাইফয়েডের রোগী দেখতে গিয়েছিল; তাদের ফিরতে দেরি হচ্ছিল তাই ডাক্তার চট্টরাজ মোহনবাঁশির অপারেশনটা শেষ পর্যন্ত একা নিজেই করতে চেয়েছিলেন। সাহায্যকারী ছাড়া এতবড় অপারেশন করা প্রায় অসম্ভব। সুকুমাররা আরও দেরি করলে মোহনবাঁশিকে হয়তো বাঁচানো যেত না।
ডাক্তার চট্টরাজ তার সহকারীদের বললেন, ‘মোহনবাঁশি রোজ চেক-আপের জন্যে কাল থেকে। আসবে। এই দায়িত্বটা তোমাদের। যদি কোনও সমস্যা হয় আমাকে জানাবে।’
সুকুমার এবং তাপস মাথা নাড়ল। ডাক্তার চট্টরাজের নির্দেশ তারা পালন করবে।
ডাক্তার চট্টরাজ তাঁর চেয়ার থেকে উঠে এলেন। প্রেসক্রিপশনটা শেখরনাথের হাতে দিয়ে মোহনবাঁশির কাঁধে একটা হাত রাখলেন।-এখন কেমন লাগছে?
মোহনবাঁশি ঘাড় কাত করে কৃতজ্ঞ সুরে বলল, ‘ভালা ডাক্তরকত্তা। আপনেগো দয়ায় বাইচা গেছি। কিন্তুক শরীলে বল নাই।
ডাক্তার চট্টরাজ হালকা গলায় বললেন, ‘আস্তে আস্তে বল এসে যাবে। এখন থেকে কীভাবে চলতে হবে, কাকাকে বলে দিয়েছি। তার কাছ থেকে সব শুনে নিও।
মোহনবাঁশি আবার ঘাড় হেলিয়ে দিল।–’আইচ্ছা।‘
‘হাসপাতাল থেকে তোমার ছুটি হয়ে গেছে। এবার চল—’
সবাই মিলে মোহনবাঁশিকে নিয়ে চেম্বারের বাইরে বেরিয়ে এল। ডাক্তার চট্টরাজও সঙ্গে এসেছেন। খানিক দূরে বসে ছিল জ্যোৎস্নারা। শেখরনাথ হাত নেড়ে তাদের ডাকলেন।
জ্যোৎস্না ত্বরিত পায়ে উঠে এল। তার গায়ের সঙ্গে লেপটে তাদের ছেলেমেয়েগুলোও। যে একান্ত আপন মানুষটা অবধারিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে, বিপুল আবেগে তাকে হয়তো জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা হল। মোহনবাঁশি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দিন থেকে রোজই আসছে জ্যোৎস্না। প্রথম প্রথম তাকে স্বামীকে দেখতে দেওয়া হয়নি। পরে কেবিনের বাইরে থেকে কয়েক পলক দেখেছে, কাছে ঘেঁষা ছিল বারণ। আজ মোহনবাঁশি নাগালের মধ্যেই রয়েছে। কিন্তু মনের ইচ্ছাটা মনেই থেকে গেল। শেখরনাথ, বিনয়, ডাক্তার চট্টরাজরা সঙ্গে রয়েছেন। তাদের সামনে জড়িয়ে ধরা যায় নাকি? নিজেকে সামলে নিয়ে ব্যগ্রভাবে মোহনবাঁশিকে দেখতে দেখতে সিঁড়ি ভেঙে সবার সঙ্গে নিচের চত্বরে নেমে এল সে।
বিশ্বজিৎ রাহার বড় জিপটা একধারে দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভার কালীপদ সেটার গায়ে ঠেসান দিয়ে অপেক্ষা করছে। এই গাড়িতেই রোজ শেখরনাথ, বিনয়, জ্যোৎস্নারা হাসপাতালে যাতায়াত করেছে এ ক’দিন।
কালীপদ ক্ষিপ্রহাতে সামনের এবং পেছনের দিকের দরজা খুলে দিল। শেখরনাথ বললেন, ‘মোহনবাঁশিকে নিয়ে আমি ফ্রন্টসিটে বসছি। বিনয়, তুমি জ্যোৎস্না আর বাচ্চাগুলোর সঙ্গে পেছনের সিটে বোসো।’
সবাই উঠে পড়ল। শেখরনাথ হাত নেড়ে ডাক্তার চট্টরাজদের বললেন, ‘চলি ডাক্তারবাবুরা—‘
ডাক্তার চট্টরাজরা হাসিমুখে হাত নাড়লেন। জিপ চলতে শুরু করলে তারা হাসপাতাল বিল্ডিংয়ের দিকে পা বাড়ালেন।
বিনয় বেশ অবাকই হয়েছিল। অন্যদিন তাকে নিয়ে শেখরনাথ কালীপদর পাশে বসেন। আজই তার ব্যতিক্রম হল। কারণটা অবশ্য খানিক পরেই বোঝা গেল।
শেখরনাথ কালীপদকে বলছিলেন, ‘গাড়ি আস্তে আস্তে চালাবি। পাহাড়ি রাস্তা, মোহনবাঁশির বুকে ব্যান্ডেজ বাঁধা আছে। আঁকুনি লাগলে ক্ষতি হবে।’
কথামতো স্পিড তুলল না কালীপদ। জিপ খুব ধীরগতিতে এবারডিন মার্কেটের দিকে এগিয়ে চলল।
শেখরনাথ এবার মোহনবাঁশির দিকে ফিরলেন।–’বড় ডাক্তারবাবু কী বলেছেন, মন দিয়ে শুনে নে। সেইমতো তোকে চলতে হবে।’
মোহনবাঁশি জানতে চাইল।–’কী কইছেন তেনি (তিনি)?’
ডাক্তার চট্টরাজ প্রেসক্রিপশনে যা যা লিখেছেন সমস্ত বুঝিয়ে দিলেন শেখরনাথ।
মোহনবাঁশির কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে।–’অ্যাতদিন হাসপাতলে পইড়া রইলাম। হের (তার) পর ফির হেইহানে (সেখানে) দৌড়াদৌড়ি, হের (তার) পর তিনমাস বিশ্রাম। অ্যাতখানি সোময়.. কি আমাগো পুটবিলাসে (পোর্টব্লেয়ারে) থাকতে অইব?’
‘ডাক্তারবাবু যদি বলেন, থাকতেই হবে।’
‘কিন্তুক—’
‘কিন্তু কী?’
ঢোক গিলে মোহনবাঁশি বলল, ‘সরকার আমাগো পনেরো বিঘা কইরা জমিন দিছে। হেই জমিন সাফসুফ কইরা, চৌরস করতে অইব (হবে)। যদিন পুটবিলাসেই মাসের পর মাস পইড়া থাকি আমার জমিনের কী গতিক? সরকার থিকা অহন (এখন) আমাগো খাওয়াইতে আছে। চিরকাল (চিরকাল) কি খাওয়াইব? চাষবাস না করতে পারলে খামু কী?’
এটা ঠিকই, আপাতত কিছুদিন পুনর্বাসন দপ্তর থেকে জেফ্রি পয়েন্টের উদ্বাস্তুদের চার বেলা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রান্নাবান্না থেকে সবার হাতে হাতে শালপাতার থালায় ভাতডাল, তরকারি ইত্যাদি তুলে দেওয়ার যাবতীয় দায়িত্ব দপ্তরের। কিন্তু এটা সাময়িক বন্দোবস্ত। অনন্তকাল তো চলতে। পারে না। জমি চাষের যোগ্য করে তোলার পর সরকারি কিচেন বন্ধ করে দেওয়া হবে। এখানে পুনর্বাসন দপ্তর যখন কো-অপারেটিভ স্টোর বসাবে তখন থেকে ঘর-গৃহস্থালির সমস্ত জিনিসপত্র–চাল-ডাল, আটা, নুন, চিনি, তেল, মশলা, এমনকি জামাকাপড় অবধি পাওয়া যাবে। সেই সময় মাথাপিছু সরকারি ‘ভোল’ চালু করা হবে। সেই টাকায় প্রতিটি ছিন্নমূল পরিবারকে তাদের সংসার চালাতে হবে। রান্নাবান্না সব নিজের নিজের। তবে ওষুধপত্র, গুঁড়ো দুধ এবং ড্রাই ফুডের জন্য খরচের প্রশ্নই নেই। সেসব তো আসছেই, ভবিষ্যতেও আসতেই থাকবে আমেরিকান, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান এবং ইউরোপের অন্যান্য ধনী দেশগুলোর নানা প্রতিষ্ঠান থেকে।
শেখরনাথ বললেন, ‘সরকারি তরফে খাবার দেওয়া এখনই তো বন্ধ হচ্ছে না। সেজন্যে দুর্ভাবনার কারণ নেই। তবে হ্যাঁ, অন্য উদ্বাস্তরা অল্পদিনের মধ্যেই তাদের জমি তৈরি করে ফেলবে। তোর পক্ষে তা সম্ভব নয়। জারোয়াদের তিরে তুই জখম হয়ে মরতে বসেছিলি। তাতে তোর তো কোনও দোষ নেই। ভাবিস না, তোর জমি তৈরি করে দিতে সরকার বাধ্য। তাদের আমি বুঝিয়ে বলব।’
মোহনবাঁশি এবার অনেকটা স্বাভাবিক হতে পারল। তার মনে যে উৎকণ্ঠা জমেছিল তা কেটে যাচ্ছে। বলল, ‘আপনের দয়া বড়কত্তা।’
শেখরনাথ উত্তর দিলেন না, একটু হেসে মোহনবাঁশির মাথায় আলতো করে হাত রাখলেন।
একসময় এবারডিন মার্কেট পেছনে ফেলে চড়াই-উতরাই পেরোতে পেরোতে ফুঙ্গি চাউঙের কাছে এসে ডাইনে বাঁক ঘুরে একটা ছোট পাহাড় টপকে উত্তর দিকে সেসোস্ট্রেস বের ধারে বিশ্বজিৎ রাহার বাংলোয় পৌঁছে গেল জিপটা।
.
৪.২
বাংলোটা ঘিরে সবুজ ঘাসে ভরা বিশাল কমপাউন্ড। কালীপদ জিপটা সেখানে এনে থামিয়েছিল। সবাই নেমে পড়েছে। সিঁড়ি দিয়ে অনেকটা ওপরে উঠতে হবে মোহনবাঁশিকে। ফুসফুসের ক্ষত শুকিয়ে এলেও একা-একা দোতলায় ওঠা তার পক্ষে কষ্টকর তো বটেই, বিপজ্জনকও। ওঠার সময় চাপ পড়লে ক্ষতস্থান ফেটে রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে আসার ভয় আছে। শেখরনাথ গলার স্বর উঁচুতে তুলে ডাকতে লাগলেন, ‘গোপাল, কার্তিক—’
গোপালদের জানাই ছিল আজ দুপুরের আগে আগে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবে মোহনবাঁশি। তারা কান খাড়া করেই ছিল। তরতর করে নিচে নেমে এল।
শেখরনাথ বললেন, ‘দু’জনে দু’পাশ থেকে ধরে ধরে মোহনবাঁশিকে তোল। আস্তে আস্তে। একদম তাড়াহুড়ো নয়। দেখিস ওর বুকে যেন চাপ না পড়ে।’
তার কথামতো খুব সতর্কভাবে তোলা হল মোহনবাঁশিকে। গোপালদের পেছন পেছন বাকি সবাই। উঠে এল।
শেখরনাথ বললেন, ‘মোহনবাঁশিকে এবার ওর ঘরে নিয়ে শুইয়ে দে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করুক।’
হলঘরের কোণের দিকের একটা ঘরে মোহনবাঁশিকে রেখে ফিরে এল গোপালরা। এবার ডাক পড়ল ভুবনের।
হলঘরের একধারে ড্রইংরুমের একটা সোফায় বসে পড়েছিলেন শেখরনাথ, তাঁর মুখোমুখি বিনয়ও।
ভুবন কিচেন থেকে এর মধ্যে ব্যস্ত পায়ে চলে এসেছে। শেখরনাথ জিগ্যেস করলেন, ‘রান্না কতদূর?’
ভুবন বলল, ‘হয়ে এসেচে। আধঘন্টার মদ্যে শেষ হয়ে যাবে।’
শেখরনাথ বললেন, ‘আমি যেরকম বলেছি সেইমতো বেঁধেছিস তো? বেশি তেল-মশলা না চলবে কিন্তু। ডাক্তারের বারণ।’
বিনয়ের মনে পড়ে গেল, আজ সকালে হাসপাতালে যাওয়ার সময় ভুবনকে মোহনবাঁশির জন্য পাতলা মাছের ঝোল, অর্থাৎ রোগীর পথ্য যেমন হয় তেমনটাই রাঁধতে বলে গিয়েছিলেন শেখরনাথ। ব্রিটিশ আমলের সশস্ত্র বিপ্লবী এই মানুষটিকে যত দেখছে, তার কথা যত শুনছে ততই অবাক হচ্ছে। সে, তার প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যাচ্ছে। তেরো-চোদ্দো দিন আগে জেফ্রি পয়েন্টের দুর্গম জঙ্গলে জারোয়াদের তিরে জখম মোহনবাঁশিকে ট্রাকে চাপিয়ে চল্লিশ মাইল পাহাড়ি রাস্তার চড়াই-উতরাইতে ঝাঁকুনি খেতে খেতে পোর্টব্লেয়ারে এসে সেলুলার জেলের ভেতর হাসপাতালে এনে ভর্তি করেছিলেন শেখরনাথ। তখন থেকে প্রতিটি দিন তার ছেলেমেয়েবউকে নিয়ে সকালে হাসপাতালে গেছেন। সঙ্গে বিনয়। সারাদিন সেখানে কাটিয়ে বিকেলের ভিজিটিং আওয়ার্সে পেশেন্টকে দেখে বাংলোয় ফিরতে ফিরতে সন্ধে নেমে গেছে। একদিন দু’দিন নয়, প্রায় দু’টো সপ্তাহ। ক্লান্তি নেই, বিরক্তি নেই। নেই লোশমাত্র ক্লেশবোধ। বাঁচার আশা ছিল না মোহনবাঁশির। শেষ পর্যন্ত ডাক্তার চট্টরাজ এবং তার দুই সহকারী তাকে সুস্থ করে তুলেছেন।
পূর্বপাকিস্তানে পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হয়ে আসা কে.এক তুচ্ছ মানুষ, তার জন্য কী গভীর মায়া, কী অনন্ত উৎকণ্ঠা শেখরনাথের! বিনয় তো তাঁর প্রতিদিনের সঙ্গী, লক্ষ করেছে মোহনবাঁশিকে বাঁচানোর জন্য তার অধীর ব্যাকুলতা। কত দিকে নজর এই বয়স্ক, শ্রদ্ধেয় বিপ্লবীর। আজ মোহনবাঁশিকে হাসপাতালে রিলিজ করে দেওয়া হবে; বাংলোয় ফিরলে তার পথ্য কী হবে, সে খেয়ালও তাঁর ছিল।
শেখরনাথ ভুবনকে বললেন, ‘তুই রান্নাঘরে যা।’
ভুবন কিচেনের দিকে পা বাড়াল।
একটু নীরবতা।
তারপর শেখরনাথ বললেন, ‘মোহনবাঁশি যে বেঁচে গেছে, এটা যে কত বড় স্বস্তি! ও মরে গেলে সর্বনাশ ঘটে যেত।’
এটা ঠিক, মোহনবাঁশির মৃত্যুতে জ্যোৎস্নাদের পরিবারটার বিপুল ক্ষতি হত। জ্যোৎস্না তার স্বামীকে হারাত। ওদের ছেলেমেয়েরা হারাত বাপকে।
শেখরনাথ থামেননি।–’ক্ষতিটা শুধু ওর বউছেলেমেয়েরই না, আন্দামানে রিহ্যাবিলিটেশনের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তা প্রচণ্ড ধাক্কা খেত। জারোয়াদের তিরে মোহনবাঁশি যে জখম হয়েছে, তোমাদের ‘নতুন ভারত’ কাগজে সেই রিপোর্ট তো তুমি পাঠাওনি।
আস্তে মাথা নাড়ল বিনয়। নিচু গলায় বলল, ‘না–মানে—’
‘জার্নালিস্ট হিসাবে কাজটা উচিত হয়নি। সাংবাদিকের সততা থাকা দরকার। যা সত্যি তাই পাঠককে জানানো দরকার–তাই না?’
চমকে মুখ তুলল বিনয়। রীতিমতো হতচকিত। বিশ্বজিৎ রাহা এ নিয়ে লিখতে বারণ করেছিলেন। সেটা আর জানাল, না। কোনওরকমে গলার ভেতর থেকে স্বরটা বের করে আনতে পারল।–‘আমি–আমি—’
হাত তুলে তাকে শান্ত করলেন শেখরনাথ।–’কিন্তু পুনর্বাসনের স্বার্থে সঠিক কাজই করেছ। পূর্বপাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের জন্যে সাউথ, মিডল আর নর্থ আন্দামানের তিনটি বিরাট দ্বীপে প্রায় একশো কুড়ি পঁচিশ মাইল এলাকা জুড়ে রিহ্যাবিলিটেশনের যে বিশাল পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, শেষ পর্যন্ত সেটা কতটা করা সম্ভব হত, বলা মুশকিল।–’
বিনয় উত্তর দিল না।
শেখরনাথ বলতে লাগলেন, তুমি নিজের চোখে দেখে এসেছ, কলকাতায় কমিউনিস্ট আর অন্য পার্টিগুলো উদ্বাস্তুদের নিয়ে তুমুল আন্দোলন শুরু করেছে। দিনকে দিন সেই আন্দোলন আরও তীব্র হচ্ছে। রোজ মিটিং, মিছিল, পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ। এই পলিটিক্যাল পার্টিগুলো চায় না, উদ্বাস্তুদের পশ্চিমবঙ্গের বাইরে পাঠানো হোক। স্টেটের মধ্যে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু লক্ষ লক্ষ মানুষ বর্ডারের ওপার থেকে সর্বস্ব খুইয়ে চলে এসেছে। এদের বেশিরভাগই কৃষিজীবী, নিরক্ষর। পশ্চিমবাংলা ছোট রাজ্য। আয়তনের তুলনায় মানুষ অনেক বেশি। সেখানে এত মানুষকে চাষের জমি দেওয়া অসম্ভব। আন্দামানে রিহ্যাবিলিটেশনের একটা সুবর্ণ সুযোগ এসেছে। এটা সেকেন্ড বেঙ্গল হয়ে উঠতে পারে। সুযোগটা হাতছাড়া হতে দেওয়া যায় না। কোনওভাবেই উচিত নয়।
এসব বিনয়ের অজানা নয়। এই নিয়ে কতজনের সঙ্গেই না তার কথা হয়েছে। এদের মধ্যে ‘নতুন ভারত’ কাগজের নিউজ এডিটর তারাপদ ভৌমিক, চিফ রিপোর্টার প্রসাদ লাহিড়ি তো আছেনই, রয়েছেন বিশ্বজিৎ রাহাও। তারা খুবই উত্তেজিত এবং উদ্বিগ্নও। আন্দামানে আসতে না দিলে কী হাল হবে বাঙালি উদ্বাস্তুদের? কিছু ছিন্নমূল মানুষ কলকাতার চারপাশে–গড়িয়া, যাদবপুর, নাকতলা, ওদিকে আগরপাড়া, ঘোলা, সোদপুর ইত্যাদি অঞ্চলে ফাঁকা মাঠ, জলা জায়গার খোঁজ পেয়ে জবরদখল কলোনির পত্তন করছে কিন্তু তা নিয়ে জমির মালিকদের গুণ্ডা-বাহিনীর সঙ্গে রোজ দাঙ্গাহাঙ্গামা চলছে। উদ্বাস্তুদের মধ্যে ক’জন আর এইসব কলোনিতে ঠাই পেয়েছে? বাকি লক্ষ লক্ষ মানুষ? তারা শিয়ালদা, ঢাকুরিয়া, যাদবপুর রেলস্টেশনের চত্বরে এবং সরকারি অস্থায়ী ত্রাণশিবিরগুলোতে তিলে তিলে ক্ষয়ে-ক্ষয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এমনটা ঘটতে দেওয়া কোনওভাবেই ঠিক নয়। আন্দামান প্রকল্পকে সফল করে তুলতে প্রতিটি পলিটিক্যাল পার্টির উচিত একসঙ্গে হাত মেলানো এবং তা বাঙালিরই স্বার্থে। কিন্তু পশ্চিমবাংলায় তার উলটো ছবিটাই দেখা যাচ্ছে।
শেখরনাথ বললেন, ‘মোহনবাঁশির মৃত্যু হলে যে কয়েকশো ফ্যামিলি এর মধ্যেই আন্দামানে চলে এসেছে, তাদের কি ধরে রাখা যেত? এই দ্বীপে তুমুল গোলমাল শুরু হয়ে যেত। তুমি তোমাদের কাগজে এই রিপোর্ট পাঠাও আর না পাঠাও, মৃত্যুর খবরটা একটু দেরি হলেও কলকাতায় পৌঁছে যেত। তার ফলটা কী হত, বুঝতে পারছ?’
এই বিষয়ে আগেই বিশ্বজিৎ রাহার সঙ্গে বিনয়ের কথা হয়েছে। সে উত্তর না দিয়ে শেখরনাথ কী বলেন শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে রইল।
শেখরনাথ বলতে লাগলেন, ‘মৃত্যুর খবরটা পাওয়া মাত্র লুফে নিত কমিউনিস্ট পার্টি আর অন্য বিরোধী দলগুলো। সেটাকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে কলকাতায় আন্দোলনের ইনটেনসিটি যে কতগুণ বাড়িয়ে দিত, ভাবা যায় না। আন্দামানে রিফিউজি মুভমেন্ট খুব সম্ভব বন্ধ হয়ে যেত। আসলে ব্যাপারটা কী জানো?’
বিনয় বলল, ‘কী?’
‘কমিউনিস্ট পার্টি এখন ছোট দল। অন্য বিরোধী দলগুলো আরও ছোট। আর দু-তিন বছরের ভেতর দেশের প্রথম জেনারেল ইলেকশনের কথা ভাবা হচ্ছে। তার আগে উদ্বাস্তুদের মধ্যে নিজেদের সাপোর্ট-বেস তৈরি করতে চায় এই পার্টিগুলো। চল্লিশ-বিয়াল্লিশ লাখ মানুষ একটা বেশ বড় রকমের শক্তি। এদের ভোট টানতে পারলে নিজেদের স্ট্রেংথ কতটা বেড়ে যাবে ভাবতে পারো?’
সেই কোন উনিশশো কুড়ি সালে সেলুলার জেলে যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা মাথায় নিয়ে কলকাতা থেকে আটশো-ন’শো মাইল দূরে বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে এই দ্বীপে এসেছিলেন শেখরনাথ। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরও তিনি দেশে ফিরে যাননি। স্থির করেছেন বাকি জীবন এখানেই থেকে যাবেন। কত বছর তিনি দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে দূরে রয়েছেন, অথচ সেখানকার, বিশেষ করে পশ্চিমবাংলার যাবতীয় খুঁটিনাটি খবরই রাখেন। অর্থনৈতিক দুর্গতি, রাজনৈতিক টানাপোড়েন, উদ্বাস্তু সমস্যা–সব মিলিয়ে বাংলার খণ্ডিত অংশটি যে তোলপাড়, এসব কী না জানেন তিনি?
শেখরনাথ বললেন, ‘বাঙালির মতো আত্মঘাতী জাত ভূ-ভারতে কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। ছোট ছোট স্বার্থের জন্যে পলিটিকাল পার্টিগুলো রাজ্যটাকে জাহান্নামে পাঠাতে চলেছে। এখনও যদি নিজেদের না শোধরায়, ভবিষ্যৎ অন্ধকার। নিজেরাই যদি নিজেদের সর্বনাশের রাস্তা তৈরি করি, কে আমাদের বাঁচাবে?’
সমস্ত ড্রইংরুম জুড়ে অদ্ভুত এক বিষাদ নেমে আসে।
একসময় শেখরনাথ একটু হাসলেন।-–’বুড়ো হয়েছি তো। বয়েস হলে মানুষ বেশি বকে। যাও, নিজের ঘরে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে স্নান কর। ভুবনের রান্না কিন্তু হয়ে এল।’
আজ এমন কিছু ধকল হয়নি। সকালে হাসপাতালে গিয়ে মোহনবাঁশিকে ‘রিলিজ’ করে আনা। গাড়িতে গেছে, গাড়িতেই ফিরেছে। ব্যস, এটুকুই। বিনয় জিগ্যেস করল ‘ও বেলা কি বেরুবেন?’
‘না।’ ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন শেখরনাথ।–-‘আজ তোমার আর আমার পূর্ণ বিশ্রাম।‘
‘তা হলে—’
শেখরনাথ ভুরু দুটো সামান্য ওপরে তুললেন।–-‘তা হলে কী?’
‘সেদিন সেলুলার জেলে বৈজু নামে যে লোকটির সঙ্গে দেখা হয়েছিল, আপনার কাছে শুনেছি, সে ছিল মারাত্মক খুনি। আপনাদের কিছু আগে ‘কালাপানি’-র লম্বা মেয়াদ খাটতে এসেছিল। পরে বিয়েটিয়ে করে ভদ্রসভ্য হয়ে গেছে। আপনি বলেছিলেন তাদের বাড়িতে আমাকে নিয়ে যাবেন। কবে–’ বাকিটা শেষ না করে থেমে গেল বিনয়।
শেখরনাথের মুখের হালকা হাসিটা এবার আরও ছড়িয়ে পড়ল। লঘু সুরে বললেন, ‘বাংলায় একটা কথা আছে, ‘জাতে মাতাল, তালে ঠিক’। তোমার দেখি সেই অবস্থা। পেনাল কলোনি নিয়ে লেখার জন্যে হাত নিশপিশ করছে। অবশ্য প্রেসের খাদ্য তত জোগাতে হবে। নিত্যনতুন সেনশনাল ইনফরমেশন চাই। নিশ্চয়ই নিয়ে যাব তোমাকে। আজ রেস্ট। কাল আমি চিফ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করব। পরশু যাব বৈজুদের বাড়ি।
কী কারণে শেখরনাথ চিফ কমিশনারের কাছে যেতে চান, বিনয় তা জানে। সে একটু দ্বিধার সুরে বলল, আমাকে কি আপনার সঙ্গে চিফ কমিশনারের কাছে নিয়ে যাওয়া সম্ভব?
শেখরনাথ বললেন, ‘না। বিনা অ্যাপয়েন্টমেন্টে একজন জার্নালিস্টের যাওয়া তিনি খুব সম্ভব পছন্দ করবেন না। তা ছাড়া আমার এমন কিছু চাচাছোলা প্রশ্ন থাকবে যার উত্তর খবরের কাগজের লোকের সামনে তিনি দিতে চাইবেন বলে মনে হয় না। আর দেরি নয়, এবার উঠে পড়।’
বিনয় তার ঘরে চলে গেল। শেখরনাথও উঠে পড়লেন।
.
৪.৩
দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর শুয়ে পড়েছিল বিনয়। শিয়রের দিকের দেওয়ালজোড়া জানলা দিয়ে অলস চোখে বাইরে তাকাল সে। সকালের দিকে সেসোট্রেস বে এবং আরও দূরের সমুদ্র বেশ শান্ত ছিল। লক্ষ-কোটি ছোট ছোট ঢেউ নরম রোদে ঝিলমিল করছিল। ঝিরঝির করে বাতাস বয়ে যাচ্ছিল। গায়ে লাগলে মনে হচ্ছিল পালকের ছোঁয়া।
কিন্তু বে অফ বেঙ্গল একটা আশ্চর্য খ্যাপাটে সমুদ্র। তার মেজাজ-মর্জি, মতিগতি বোঝা ভার। এই ভরদুপুরে তার চেহারাটাই পুরোপুরি বদলে গেয়েছে। এই শান্তশিষ্ট, পরক্ষণেই হয়তো উন্মত্ত হয়ে উঠল।
এখন সমুদ্রের ঢেউগুলো পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে বিপুল আক্রোশে আছড়ে পড়ছে পাথরের বোল্ডারগুলোর ওপর। কী প্রচণ্ড গজরানি সেগুলোর। রোদও আর তেমন মায়াবী নেই; যেন আগুনের হলকা হয়ে গেছে। সামনের দিকে যতদূর চোখ যায়, সমুদ্র থেকে তীব্র ভাপ উঠে আসছে। বাতাসের ওপর কোনও দানব ভর করেছে; সাঁই সাঁই করে আছড়ে পড়ছে পাড়ের সারি সারি নারকেল গাছের ওপর। সেগুলোর ঝুঁটি ধরে ঝাঁকিয়ে আঁকিয়ে নাস্তানাবুদ করে দিচ্ছে।
জানলার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল বিনয়। সারা শরীরে কয়েকদিনের ক্লান্তি জড়ো হয়েছিল। কখন যে দু’চোখ গাঢ় ঘুমে জুড়ে গেছে, খেয়াল নেই।
.
ঘুম যখন ভাঙল, সন্ধে নামে নামে। সূর্যটাকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না। পশ্চিম দিকে মাউন্ট হ্যারিয়েটের উঁচু চুড়োর আড়ালে কখন নেমে গেছে টেরও পাওয়া যায়নি। বাসি হলুদের মতো যে মলিন, ফ্যাকাশে আলোটুকু সমস্ত চরাচরে ছড়িয়ে রয়েছে, লাটাইতে সুতো গোটানোর মতো কেউ যেন অদৃশ্য হাতে সেটুকু দ্রুত টেনে নিচ্ছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যে সেই আলোও থাকবে না, ঝপ করে আঁধার নেবে যাবে।
বিছানা থেকে উঠে বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে জল দিয়ে এল বিনয়; তারপর কী ভেবে জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সমুদ্র খুব স্পষ্ট না হলেও দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ মনে পড়ল, কয়েকদিন আগে ঝিনুক এক বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধার সঙ্গে প্রাইভেট কোম্পানির জাহাজ ‘এস এস সাগর’-এ উঠে বহুদূরে সেসোস্ট্রেস বে যেখানে মাউন্ট হ্যারিয়েটকে বেড় দিয়ে গভীর সমুদ্রের দিকে গেছে সেখানে মিলিয়ে গিয়েছিল। তাদের গন্তব্য মিডল আন্দামান; সেখানে সবে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের কাজ শুরু হয়েছে। অঘ্রান মাসের কুয়াশায় ঝাপসা এক শীতের রাতে ভবানীপুরের প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের বাড়ি থেকে ঝিনুক অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। চরম অপমানে, আত্মগ্লানিতে। কলকাতার বিশাল জনারণ্যে তাকে কত খুঁজেছে বিনয়। তারপর বহু আলোকবর্ষ পেরিয়ে তার সঙ্গে আবার আন্দামানে দেখা হল। একবার নয়, দু-দু’বার। প্রথমবার ‘রস আইল্যান্ড’ থেকে সে যখন ইন্টার-আইল্যান্ড শিপ সারভিসের জাহাজ ‘চলুঙ্গা’য় মিডল আন্দামানে যাচ্ছে সেই সময়। দূর থেকে দেখা, তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগই পাওয়া যায়নি। আর দ্বিতীয়বার মাত্র কয়েকদিন আগে। মিডল আন্দামান থেকে একটি প্রাইভেট টিম্বার কোম্পানির ছোট জাহাজ ‘এস এস সাগর’-এ একজন অসুস্থ বৃদ্ধ এবং এক বৃদ্ধাকে সঙ্গে করে সেলুলার জেলের হাসপাতালে এসেছিল। ওরা যখন ফিরে যাচ্ছে সেই সময় ঝিনুকের সঙ্গে তার দেখা।
যে মেয়েটি ছেলেবেলা থেকে বিনয়ের পাশাপাশি বড় হয়ে এখন পূর্ণ যুবতী। ধর্ষিতা, প্রায় অপ্রকৃতিস্থ যে ঝিনুককে বুকের ভেতর আগলে আগলে সে মহাসংকটের ভেতর দিয়ে, জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে সীমান্তের এপারে চলে এসেছে, সেই মেয়ে তাকে দেখার পরও না চেনার ভান করেছে। কী নিদারুণ উদাসীন সে, পুরোপুরি নিরাসক্ত। একদিন ঝিনুক যে তার সঙ্গে শতপাকে জড়িয়ে গিয়েছিল, তা মনে করে রাখার আর প্রয়োজন বোধ করেনি সে। স্মৃতি থেকে পুরনো অতীতটাই
সে একেবারে মুছে দিতে চেয়েছে। এমনকি নিজের ঝিনুক নামটাও বদলে দিয়েছে। তার পরিচয়। এখন সীতা।
বিনয়ের মনে পড়ছে দু-চারটের বেশি কথা বলেনি ঝিনুক। নেহাতই দায়সারা। অতি সংক্ষেপে। কেউ প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে হয়, ব্যস এটুকুই। তাকে উপেক্ষা করে, পেছনে ফেলে তার সঙ্গী বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধাটিকে নিয়ে সেসোস্ট্রেস বের ছোট জেটির দিকে চলে গিয়েছিল।
বিশ্বজিৎ রাহার বাংলার এই ঘরের জানলা দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে সেই দৃশ্য দু’টি বারবার মনে পড়ছিল বিনয়ের। ‘রস’ আইল্যান্ড থেকে ‘চলুঙ্গা জাহাজে একবার, আর দ্বিতীয়বার ‘এস এস সাগর’-এ সেসোস্ট্রেস বে পেরিয়ে কয়েকটা দ্বীপের পাশ দিয়ে গভীর সমুদ্রে ঝিনুকের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া।
বিনয় ভেবে পায় না, তার ওপর ঝিনুকের কেন এত তীব্র অভিমান, এত প্রচণ্ড ক্রোধ। তার বাবা অবনীমোহন ঝিনুকের মতো এক ধর্ষিতা মেয়েকে মেনে নিতে পারেননি, সে অপরাধ কি বিনয়ের? কেন এত অবুঝ ঝিনুক? ন’দশ বছর বয়স থেকে সে বিনয়কে দেখে আসছে। অবনীমোহন তার আদ্যিকালের সংস্কার, সেকেলে ধ্যানধারণা নিয়ে থাকুন। কিন্তু বিনয়? সে তো ঝিনুককে জীবনের সাতপাকে জড়িয়ে নেওয়ার জন্য দু’হাত বাড়িয়েই ছিল। সেটা বুঝল না মেয়েটা? অনন্ত উদাসীনতায় নিজেকে ঢেকে রেখে ঝিনুক যতই তাকে দূরে ঠেলে দিতে চাক, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড চষে ফেলে তাকে খোঁজার পর যখন জানা গেছে সে মিডল আন্দামানে রয়েছে, বিনয় সেখানে পৌঁছে যাবেই যাবে। শেল কালেক্টর। লা-পোয়ের সঙ্গে আজই তার কথা হয়ে গেছে। দু-তিন সপ্তাহের মধ্যে সে তাদের ছোট মোটরবোট ‘সি-বার্ড’-এ করে বিনয়কে মিডল আন্দামানে নিয়ে যাবে।
সন্ধে নেমে এসেছিল। সাগরপাখিরা সারাদিন ছোঁ মেরে মেরে সমুদ্রে ছোট ছোট সার্ডিন কি পমফ্রেট শিকার করে কখন যেন তাদের আস্তানায় ফিরে গেছে। বেশ ক’টা স্টিমার ‘রস’ আইল্যান্ডের দিক থেকে এসে চ্যাথাম জেটির দিকে চলে যাচ্ছে। এই সব জলযানের আলোগুলো অন্ধকারে অলৌকিক মনে হয়। পোর্টব্লেয়ার শহরেও টিলার মাথায় মাথায় এবং ঢালগুলোতে যে সব কাঠের বাড়িটাড়ি রয়েছে সেগুলোতেও অজস্র আলো। রাস্তায় মিউনিসিপ্যালিটির বাতিগুলো তেজ কিন্তু কম। টিম টিম করে জ্বলছে।
সমুদ্রের দিকে তাকিয়েই ছিল বিনয়। দূরমনস্ক মতো। হঠাৎ কার ডাকে চমকে ফিরে দাঁড়াল। গোপাল। সে বলল, ‘কাকা আপনাকে বসার ঘরে যেতে বললেন। আসুন—’
একটু হেসে ব্যস্তভাবে ড্রইংরুমে চলে এল বিনয়। শেখরনাথ সোফায় বসে আছেন। তার সামনে সেন্টার টেবিলে দু’টো চায়ের কাপ থেকে ধোঁয়া উড়ছে। শুধু চা-ই নয়, ভুবন সিঙাড়াও ভেজেছে। এক প্লেট বোঝাই গরম সিঙাড়া চোখে পড়ছে।
শেখরনাথ বললেন, ‘বোসো। তোমার জন্যেই ওয়েট করছি। গোপালকে এর আগে দু’বার তোমার ঘরে পাঠিয়েছি। সে দু’বারই এসে বলল, ঘুমোচ্ছ। ‘নাও, শুরু কর’–বলে তিনি একটা সিঙাড়া তুলে নিয়ে কামড় দিলেন। চিবুতে চিবুতে বলতে লাগলেন, ‘ভুবনটার হাতে ম্যাজিক আছে। যা রাঁধে তাই অমৃত। যাক, ঘুমটা তা হলে বেশ জব্বরই হয়েছে, কী বল? আমিও খুব একচোট ঘুমিয়েছি। ক’টা দিন খুব ছোটাছুটি গেছে। তোমার আর আমার এই ঘুমটা ভীষণ দরকার ছিল। এখন ফ্রেশ লাগছে, তাই না?’
বিনয় হেসে মাথা কাত করল।
খেতে খেতে এলোমেলো কথা হচ্ছে। এই বাংলোর সব ঘর থেকে সেসোস্ট্রেস উপসাগরটা দেখা যায়। মাঝে মাঝে সেদিকে চোখ চলে যাচ্ছিল বিনয়ের। এটা পূর্ণিমাপক্ষ। আকাশে পূর্ণ চাঁদের মায়া। সেই চাঁদ সমুদ্রের ওপর স্নিগ্ধ রুপোলি আলো ঢেলে দিচ্ছে। বাঁ পাশের মাউন্ট হ্যারিয়েট, ডানপাশের ‘রস’ আইল্যান্ড, আরও দূরের নানা আকারের ছোট-বড় দ্বীপগুলি অপার রহস্যে মোড়া। দিনের বেলা কতবার এগুলো দেখেছে বিনয় কিন্তু এই পূর্ণিমার রাতে তাদের আগাগোড়া অচেনা মনে হচ্ছে।
ওদের খাওয়া আর গল্পের মধ্যেই কাঠের সিঁড়িতে আওয়াজ তুলে বিশ্বজিৎ রাহা ফিরে এলেন। কার্তিকরা সবাই ড্রইংরুমে দাঁড়িয়ে ছিল। গোপাল ছোঁ মেরে বিশ্বজিতের অ্যাটাচি কেসটা টেনে নিয়ে তার বেডরুমে রেখে এল।
বিশ্বজিতের চোখ সেন্টার টেবিলের দিকে। বললেন, ‘কী ব্যাপার, আমি কি দু-একটা সিঙাড়া পাব না? সব শেষ নাকি?
শশব্যস্ত ভুবন বলল, না না, অনেক আছে।
বিশ্বজিৎ জানেন, তাকে বাদ দিয়ে এই বাংলোর কেউ কিছু খাওয়ার কথা ভাবতেই পারে না। তাঁর চোখেমুখে দুষ্টুমির একটু হাসি ফুটল। এত বড় অফিসার, এত দায়িত্ব মাথায়, তবু তার মধ্যে অতি সরল, অতি চঞ্চল একটি বালক লুকনো রয়েছে। কখনও সখনও বাইরের গাম্ভীর্যের শক্ত খোলাটা ভেদ করে সে বেরিয়ে আসে। একটা সোফায় বসতে যাচ্ছিলেন, শেখরনাথ মৃদু ধমকের সুরে বললেন, ‘এ কী, বাইরে থেকে এলি, হাতমুখ ধুয়ে জামাকাপড় পালটে আয়।
বিশ্বজিৎ তার বেডরুমে চলে গেলেন। খানিক বাদে যখন ফিরে এলেন, স্নান করা হয়ে গেছে, চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। পরনে ঘরোয়া পোশাক–ধবধবে পাজামা আর পাঞ্জাবি।
এর মধ্যে আরও কিছু সিঙাড়া দিয়ে গিয়েছিল ভুবন, এবং বিশ্বজিতের জন্য চা।
সিঙাড়া তুলে নিয়ে মোহনবাঁশির কথা জিগ্যেস করলেন বিশ্বজিৎ। শেখরনাথ সব জানালেন। হাসপাতাল থেকে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তবে রোজ একবার ডাক্তার চট্টরাজের সহকারীদের কাছে নিয়ে যেতে হবে। সেটা করবে কালীপদ। যে দুর্বলতাটুকু এখনও রয়েছে তা কেটে গেলে মোহনবাঁশি এবং তার বউছেলেমেয়েদের জেফ্রি পয়েন্টের রিফিউজি সেটলমেন্টে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
শেখরনাথের দিকে তাকিয়ে বিশ্বজিৎ বললেন, ‘কটা দিন মোহনবাঁশিকে নিয়ে তোমার আর বিনয়বাবুর দৌড়োদৌড়ি তো গেছে, তার ওপর টেনশনও কম যায়নি। এখন দুর্ভাবনা কেটেছে, তিন চার দিন দু’জনে ভাল করে রেস্ট নাও।
শেখরনাথ বললেন, ‘রেস্ট নেওয়ার কি উপায় আছে? কাল আমাকে চিফ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করতে হবে।
এরআগেও জেফ্রি পয়েন্টে থাকার সময় এই নিয়ে শেখরনাথের সঙ্গে কথা হয়েছে বিশ্বজিতের। ভেবেছিলেন পোর্টব্লেয়ারে এসে মোহনবাঁশিকে নিয়ে শেখরনাথ এতই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে চিফ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করার ব্যাপারটা তার মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু কাকার স্মৃতিশক্তি এই বয়সেও যথেষ্ট সতেজ। কিছুই তিনি ভোলেন না। বিশ্বজিৎকে বেশ চিন্তিত দেখাল। তার কপালে দু-চারটে ভাঁজ পড়েছে। বললেন, আপনি কি জারোয়াদের ব্যাপারটা বলবেন?
‘শুধু জারোয়াদের কেন, জেফ্রি পয়েন্ট আর তার চারপাশের উদ্বাস্তু কলোনিগুলোর জন্যে না আছে হাসপাতাল, না একটা হেলথ সেন্টার–তা নিয়েও চাপ দেব।’
‘কিন্তু—’ বাকিটা শেষ না করে থেমে গেলেন বিশ্বজিৎ। তাঁর স্বাধীনতা-সংগ্রামী সশস্ত্র বিপ্লবী কাকাটিকে তো তিনি চেনেন, স্পষ্ট কথা মুখের ওপর বলে দিতে পারেন। যিনি যত ক্ষমতাধরই হোন, রেয়াত করেন না। যে মানুষ একদা প্রবল প্রতাপে ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে বন্দুক তুলে ধরেছিলেন, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা ভোগ করতে এসেছিলেন ভয়াবহ সেলুলার জেলে, তিনি একজন চিফ কমিশনারকে পরোয়া করবেন কেন?
শেখরনাথ তাঁর ভাইপোটির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। বিশ্বজিতের মনোভাবটা আঁচ করে নিতে পেরেছেন, ভাইপোটি রীতিমতো অস্বস্তি বোধ করছেন। চিফ কমিশনার আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের হর্তাকর্তাবিধাতা, বিশ্বজিতের ওপরওয়ালা। তাঁর কাকা যদি এখানকার প্রশাসনের এই বড়কর্তার সঙ্গে দেখা করে চোটপাট করেন, সেটা বিশ্বজিতের প্রতি আদৌ স্বস্তিকর হতে পারে না। শেখরনাথ একটু হেসে বললেন, ‘তোর ভয়ের কারণ নেই। আমি তো তোদের চিফ কমিশনারের বেয়ারা নই। স্বাধীন ভারতের একজন স্বাধীন নাগরিক। একসময় আর্মড রেভোলিউশনারি ছিলাম বলে বন্দুক উঁচিয়ে চিফ কমিশনারের কাছে যাব, এটা হয় নাকি? তুই আমাকে একজন জেন্টলম্যান ভাবতে পারিস না? ভয় নেই। চিফ কমিশনারকে জারোয়া আর রিফিউজিদের সমস্যার কথা শান্তভাবে। ভাল করে বুঝিয়ে বলব।
বিশ্বজিতের চোখমুখ দেখে বোঝা গেল, তার মাথায় যে দুর্ভাবনাটা চেপে বসেছিল তা অনেক্টাই হালকা হয়ে গেছে। বললেন, ঠিক আছে।
বিনয় চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল। এবার বলে উঠল, ‘কাকা, আমাকে আপনার সঙ্গে চিফ কমিশনারের কাছে নিয়ে চলুন না। আগেও এই অনুরোধটা করেছিল সে।
শেখরনাথের একই উত্তর।–-‘না। একজন সাংবাদিক কাছে থাকলে খুব সম্ভব তিনি মন খুলে। কথা বলতে পারবেন না। কী লিখতে কী লিখে বসবে, তার ফলে তাঁকে মুশকিলে পড়তে হবে। নিউজপেপারকে সরকারি আমলারা বেশ ভয়ই পান।’
‘কিন্তু তারা তো প্রেস মিট করেন।’
‘তা করেন। আমি তো চাঁচাছোলা প্রশ্ন করব, উনি সহজে এড়িয়ে যেতে পারবেন না। আমি এখানকার অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সম্বন্ধে এমন অনেক কিছু জানি যা তোমার মতো যারা বাইরে থেকে দু-চার দিন কি দু-চার মাসের জন্যে আসে তাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। আমি একা থাকলে সেই সব প্রশ্নের উত্তর চিফ কমিশনারের পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া সহজ হবে না। আমি চেপে ধরব। তুমি সামনে থাকলে তার মুখ থেকে বিশেষ কিছু বের করা যাবে না।’
‘ওঁর সঙ্গে কিন্তু আমার একবার দেখা করা দরকার। অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের হেড হিসাবে রিফিউজি সেটলমেন্ট সম্পর্কে তাকে অনেক প্রশ্ন করার আছে। আমাদের এডিটর চান তাঁর বক্তব্য ‘নতুন ভারত’-এ বেরোক।
‘ঠিক আছে, আমি অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করে দেব। তুমি একা গিয়ে দেখা করবে।’
একটু নিরাশ হল বিনয়। শেখরনাথের সঙ্গে যেতে পারলে তার ভাল লাগত। একটু চুপ করে থেকে জিগ্যেস করল, ‘আর বৈজুর ব্যাপারটা?’
বিশ্বজিতের কৌতূহল হচ্ছিল। জিগ্যেস করলেন, ‘বৈজু কে?’
উত্তর দিলেন শেখরনাথ।–-‘বৈজুকে তো তুই চিনিস। আমি আন্দামানে আসার কয়েক বছর আগেই কয়েকটা মার্ডারের চার্জে ওকে ‘কালাপানি’ পাঠানো হয়েছিল। সেলুলার জেলে থাকার সময় বৈজু আমাকে প্রচুর সাহায্য করেছে। ও পাশে না থাকলে নারকেল ছোবড়া পিটতে পিটতে আর ঘানি ঘুরিয়ে রোজ পনেরো সের নারকেল কি সরষের তেল বের করতে করতে কবেই শেষ হয়ে যেতাম। তোকে তো সব বলেছি।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। তা ব্রিটিশ আমলের একজন ড্রেডড ক্রিমিনালের সঙ্গে বিনয়বাবুর কী দরকার?’
‘বিনয় তো শুধু রিফিউজি সেটলমেন্ট দেখতে আসেনি। আগেকার পেনাল কলোনিগুলো সম্পর্কে ওদের পেপারে রিপোর্ট পাঠাবে। বৈজু ওকে প্রচুর মেটিরিয়াল দিতে পারবে।’
আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন বিশ্বজিৎ–‘পেনাল কলোনিগুলোর কিভাবে পত্তন হয়েছিল, তার হিস্ট্রি ভীষণ ইন্টারেস্টিং। কিভাবে সেকালের দুর্ধর্ষ ক্রিমিনালরা ধীরে ধীরে দেশের ভদ্র, সভ্য নাগরিক হয়ে উঠছে তাও কম অ্যাট্রাক্টিভ নয়। এর আগে কেউ এসব নিয়ে লিখেছেন কি না, আমার জানা নেই।–বিনয়বাবু, ডিটেলে বৈজুর কাছ থেকে সেলুলার জেলের পুরনো দিনের ক্রিমিনালদের সম্বন্ধে সব ইনফরমেশন জেনে নেবেন। রিপোর্টগুলো বেরুলে আপনাদের পেপারের সার্কুলেশন অনেক বেড়ে যাবে।’
এরপর খানিকক্ষণ এলোমেলো কিছু কথা হল। তারপর শেখরনাথের দিকে তাকিয়ে বিশ্বজিৎ জিগ্যেস করলেন, ‘কাকা, আপনি আর বিনয়বাবু কি আবার জেফ্রি পয়েন্টে ফিরে যাবেন?’
শেখরনাথ কণ্ঠস্বরে জোর দিয়ে বললেন, ‘নিশ্চয়ই। মোহনবাঁশিকে জারোয়ারা তির মেরেছে, এর ফলে জেফ্রি পয়েন্টের রিফিউজিরা খুব আতঙ্কে আছে। কোনওরকমে তাদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে চলে এসেছি। ফের যদি এমন ঘটনা ঘটে রিফিউজিদের ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। তারা মেনল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার জন্যে তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে ছাড়বে। তোদের রিহ্যাবিলেটেশন ডিপার্টমেন্টের যে এমপ্লয়িরা রয়েছে, তাদের পক্ষে উদ্বাস্তুদের সামলে রাখা প্রায় অসম্ভব। তাই আমার কিছুকাল থাকা, দরকার। ডাক্তার চট্টরাজ বলেছে দিন সাতেকের মধ্যে ফিট সার্টিফিকেট দেবে। তারপরই মোহনবাঁশি আর তার ফ্যামিলিকে নিয়ে বিনয় আর আমি জেফ্রি পয়েন্টে চলে যাব। এসব তো তোকে আগেও বলেছি। ভুলে গেছিস নাকি? তা ছাড়া—’
‘কী?’ উৎসুক হলেন বিশ্বজিৎ।
‘জেফ্রি পয়েন্টে সেটলমেন্ট সবে শুরু হয়েছে। অনেক কাজ বাকি। বিনয়ের তা দেখা দরকার।’ শেখরনাথ বললেন।
‘ঠিক বলেছেন–’ বলে বিনয়ের দিকে ফিরলেন বিশ্বজিৎ।–‘আমাদের এখানে বাঙালিদের একটা ক্লাব আছে– ‘অতুল স্মৃতি সমিতি’। তার মেম্বাররা চাইছেন আপনি সেখানে একদিন যান। আমিই নিয়ে যাব। কবে যেতে পারবেন?
বিনয় বলল, ‘কয়েকদিন তো পোর্টব্লেয়ারে আছি। আপনার সুবিধেমতো যেদিন ইচ্ছে নিয়ে যাবেন।’
হঠাৎ কিছু মনে পড়ে গেল বিশ্বজিতের। দু’জনকে লক্ষ করে বললেন, ‘ভাল কথা, বিভাস আর নিরঞ্জনকে তিন সপ্তাহ আগে নতুন রিফিউজি আনার জন্যে কলকাতায় পাঠানো হয়েছিল। আপনারা পোর্টব্লেয়ারে থাকতে থাকতেই তারা খুব সম্ভব চলে আসবে।
বিনয়ের মনে আছে, এই তো সেদিন নিরঞ্জন, বিভাস এবং বহু উদ্বাস্তু ফ্যামিলির সঙ্গে ‘এম ভি মহারাজা’ জাহাজে সে কলকাতা থেকে আন্দামানে এসেছিল। পরের বার ওরা আর রিফিউজি আনতে কলকাতায় যেতে চায়নি। রিলিফ ক্যাম্প আর শিয়ালদা স্টেশন থেকে পূর্বপাকিস্তানের ছিন্নমূল মানুষগুলোকে ঠাণ্ডা মাথায় বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কী নিদারুণ কষ্ট করে খিদিরপুরের বাইশ নম্বর ডকে এনে জাহাজে তুলতে হয়, সেই প্রক্রিয়া সম্বন্ধে বিনয়ের স্পষ্ট ধারণা আছে। সহজে কি এই উদ্বাস্তুরা কলকাতা ছেড়ে সুদূর আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে আসতে চায়!
বিভাস আর নিরঞ্জন এবার কলকাতায় আসতে চায়নি। পুনর্বাসন দপ্তরে কিন্তু অন্য কর্মীদের ওপর ভরসা রাখতে পারে না। উদ্বাস্তুদের বোঝাবার মতো ধৈর্য, কৌশল অন্যদের নেই। বিভাস আর নিরঞ্জন দিন নেই রাত নেই, খাটতে পারে প্রচণ্ড। সবচেয়ে বড় ব্যাপার কোনওরকম উসকানিতে তাদের মেজাজ তেতে ওঠে না। সারাক্ষণ হাসিখুশি। দু’জনেই সাবেক পূর্ববাংলার (এখন পূর্ব পাকিস্তান) মানুষ, সেখানকার ভাষাটা অনর্গল বলে। আন্দামানের গুণকীর্তন করতে করতে, সেখানে গেলে কতরকম সুযোগসুবিধা পাবে, তার একটা স্বপ্নের ছবি যখন তুলে ধরে, উদ্বাস্তুদের মনে হয়, ত্রাণশিবির আর শিয়ালদা স্টেশনের চত্বরে পচে গলে শেষ হয়ে যাওয়ার চেয়ে সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে সেখানে চলে যাওয়াই ভাল। রাজনৈতিক দলগুলোর অবিরাম বাধা সত্ত্বেও বিভাস আর নিরঞ্জনকে তাদের বড় আপনজন মনে হয়। এই দুজন ছাড়া আর কার ওপরেই বা পুনর্বাসন দপ্তর আস্থা রাখতে পারে?
বিনয় জিগ্যেস করল, ‘এবার কত ডিপি (ডিসপ্লেসড পার্সন অর্থাৎ উদ্বাস্তু) ফ্যামিলি কলকাতা থেকে আসছে?’
বিশ্বজিৎ বললেন, ‘একশো কুড়িটা ফ্যামিলির কোটা। রিলিফ ক্যাম্প ঘুরে ঘুরে পুরোটাই জোগাড় করতে পেরেছে বিভাসরা। ওদের জন্যে মিডল আর সাউথ আন্দামানে জঙ্গল কেটে জমি রিক্রেমও করা হচ্ছে। খিদিরপুরে আসার পর জাহাজ-টাহাজ দেখে উদ্বাস্তুদের মতিগতি বিগড়ে যাবে কি না, খবর পাওয়া যায়নি। হয়তো দেখা যাবে আট-দশটা ফ্যামিলি জাহাজে না উঠে পালিয়ে গেছে।’ তাঁকে বেশ চিন্তিত দেখাল।
বিনয়ের মনে আছে, সে যখন আন্দামানে আসে খিদিরপুর থেকে ছ’টা ফ্যামিলি জাহাজে না উঠে নিঃশব্দে সরে পড়েছিল। ‘রস’ আইল্যান্ডে ‘এস এস মহারাজা’ জাহাজটা ভেড়ার পর ছ’জোড়া অবিবাহিত যুবক-যুবতাঁকে ভরদুপুরে বিয়ে দিয়ে নতুন ফ্যামিলি বানিয়ে ‘কোটা’ পুরণ করা হয়েছিল। উদ্বাস্তু ফ্যামিলিগুলো তাদের জন্য নির্দিষ্ট জমির পুরোটাই পেয়ে গিয়েছিল।
বিনয় একটু হেসে বলল, ‘দুশ্চিন্তার কী আছে, যে ক’টা ফ্যামিলি আসবে না, আগের মতো অন্য সব ফ্যামিলি থেকে ছেলেমেয়ে বেছে নিয়ে বিয়ে দিয়ে ‘কোটা’ কমপ্লিট করে দিলেই তো প্রবলেম সলভড।’
বিশ্বজিৎ বললেন, ‘এবার খুব সম্ভব সেটা হবে না।’
বিনয় অবাক।-–’কেন?’
‘রিফিউজিরা মেনল্যান্ড থেকে এলে ‘রস’ আইল্যান্ডে পোর্টব্লেয়ারের বাঙালিরা তাদের রিসিভ করতে যায়। এতদিন এটাই চলে আসছে। শুনছি, এবার নাকি চিফ কমিশনারও বাঙালিদের সঙ্গে উদ্বাস্তুদের ওয়েলকাম জানাতে ‘রস’-এ হাজির থাকবেন।’
শেখরনাথের ভুরু কুঁচকে গেল। তিনি এতক্ষণ নীরবে শুনে যাচ্ছিলেন। জিগ্যেস করলেন, ‘কারণ? হঠাৎ উদ্বাস্তুদের ওপর তিনি এমন মহানুভব হয়ে উঠলেন যে? দেড় বছর এই আন্দামানের হর্তাকর্তা হয়ে এসেছেন। দু-এক মাস পর পর কলকাতা থেকে রিফিউজি আসছে। কোনও দিন তো ‘রস’-এ গিয়ে তাদের রিসিভ করেননি!’
বিশ্বজিৎ বললেন, ‘আমার ধারণা, লাস্ট যে রিফিউজিরা এসেছিল তাদের ভেতর থেকে ছ’ জোড়া যুবক-যুবতীর বিয়ে দিয়ে কোটা’ কমপ্লিট করা হয়েছিল, বাঙালিদের স্বার্থে এটা না করে উপায় ছিল না, খবরটা যেভাবে তোক চিফ কমিশনারের কানে উঠেছে। তাই এই ফন্দিটা বন্ধ করার জন্যে তিনি ‘রস’-এ চলে যাবেন।
কিছুক্ষণ ভেবে শেখরনাথ বললেন, ‘এই খবরটাকে তাকে কে দিতে পারে? বাঙালিরা ছাড়া রিফিউজি আসার দিন প্লোর্টব্লেয়ার থেকে অন্য কেউ তো যায় না!’
বিশ্বজিৎ কটু গলায় বললেন, ‘কে আবার দেবে? নিশ্চয়ই কোনও বাঙালিরই কাজ।’
মেজাজটা তেতো হয়ে গিয়েছিল শেখরনাথের।–-‘বাঙালিদের মধ্যে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দরা জন্মেছেন ঠিকই, তারা মহাপুরুষ। তাঁদের কথা আলাদা। কিভাবে যে এদেশে জন্মেছেন! বাকি জাতটাই বজ্জাত। উদ্বাস্তুদের জমি সামান্য কৌশল করলে যদি তাদের হাতে থাকে, তোদের ক্ষতিটা কী? বিয়ে তো এই ছেলেমেয়েগুলোর হতই। আলাদা-আলাদা ফ্যামিলিও। না হয় দু-চারদিন আগেই হয়েছে। ইস্ট পাকিস্তান থেকে সর্বস্ব খুইয়ে ওরা এপারে এসেছে। তাদের কথা ভেবে একটু না হয় মুখ বুজেই থাকতিস। ওদিকে ওয়েস্ট পাকিস্তান থেকে পাঞ্জাবে, দিল্লিতে যে– রিফিউজিরা এসেছে তাদের জন্যে সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট সিন্দুক খুলে দশ হাতে ঢেলে দিয়েছে। আর ইস্ট পাকিস্তান থেকে যারা আসছে তাদের জন্যে স্রেফ ছিটেফোঁটা। এরকম একচোখো পক্ষপাতিত্ব ভাবা যায় না। বাঙালি রিফিউজিদের তাদের প্রাপ্য আদায় করে নিতে হবে, হয় আন্দোলন করে, নইলে নানারকম ফন্দি-ফিকির করে। সব বাঙালিরই এদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। তা নয়, পেছন থেকে ছুরি মারার চেষ্টা। বলে থমথমে মুখে তিনি চুপ করে গেলেন।
শেখরনাথের সঙ্গে ক’দিনেরই বা পরিচয়। কিন্তু এর মধ্যে তাকে অনেকখানিই চিনে ফেলেছে বিনয়। মানুষটি স্বচ্ছ, সহৃদয়, উদার। বর্মা থেকে নর্থ-ওয়েস্টার্ন প্রভিন্স অবধি এই বিশাল দেশে কত যে প্রদেশ! কত ধরনের মানুষ! ওড়িয়া, অসমিয়া, বিহারি, তামিল, শিখ–এমনি অজস্র। কিন্তু শেখরনাথের কাছে সবাই সমান। এদের সবার স্বাধীনতার জন্য একদিন ইংরেজদের বিরুদ্ধে তিনি অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। কিন্তু উদ্বাস্তুদের সম্বন্ধে, বিশেষ করে যারা পূর্বপাকিস্তান থেকে উৎখাত হয়ে এপারে চলে এসেছে, তাদের প্রতি তার অপার সহানুভূতি। চোদ্দো পুরুষের ভিটেমাটি খুইয়ে যে শরণার্থীরা স্বাধীনতার দাম চুকিয়ে দিচ্ছে তাদের জন্য বহু টালবাহানার পর যে জমি বরাদ্দ করা হয়েছে, শেখরনাথ চান সেখানেই তাদের পুনর্বাসন হোক। তারা সেখানে থিতু হয়ে বসুক। পূর্বপাকিস্তানে যা তারা ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছে, এই দ্বীপপুঞ্জে নতুন করে তা গড়ে তুলুক। রাজনৈতিক নানা চতুর চালে আজ হয়তো অনেক উদ্বাস্তু এখানে আসতে চাইছে না, কেউ কেউ খিদিরপুর ডক অবধি এসে পালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এক মাস, দু’মাস কি ছ’মাস বাদে তাদের আসতেই হবে। এই ছিন্নমূলদের জন্য নির্দিষ্ট জমি থেকে যদি কারসাজি করে তাদের বঞ্চিত করার চেষ্টা হয়, শেখরনাথ কিছুতেই মেনে নেবেন না।
ড্রইংরুমের আবহাওয়াটা ভারী হয়ে উঠেছিল। একসময় শেখরনাথ ফের বলতে লাগলেন, যে বা যারা চিফ কমিশনারের কাছে গোপনে আগের বারের বিয়ের খবরটা জানিয়ে এসেছে তারা কী। মানুষ! দু-চারটে ইনক্রিমেন্ট কি একটা প্রোমোশনের জন্যে এমন অসভ্যতা কেউ করে!
নানা কথাবার্তায় রাত অনেকটা বেড়ে গেছে। পোর্টব্লেয়ার শহর এখন নিঝুম। হঠাৎ বাইরে হাওয়ার জোর বেড়েছে, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমুদ্রের খ্যাপামিও। আন্দামানের আবহাওয়ার মেজাজের তলকুল পাওয়া যায় না। এই হয়তো শান্ত, পরক্ষণেই উত্তাল। সেসোস্ট্রেস বে’র পাড় ধরে যে নারকেল গাছের সারি তার ওপর ঝড়ো হাওয়া ঝাঁপিয়ে পড়েছে, আওয়াজ উঠছে সাঁই সাঁই। পাহাড়প্রমাণ ঢেউয়ের গর্জন ভেসে আসছে।
বিশ্বজিৎ বললেন, ‘কাকা, কাল কোর্টে একটা কেসের রায় দিতে হবে। আজ রাত্তিরে সেটা টাইপ করে না রাখলে মুশকিলে পড়ব।’
দেওয়াল ঘড়ির দিকে ব্যস্তভাবে তাকালেন শেখরনাথ।– ‘আরে তাই তো, সাড়ে দশটা বাজতে চলল। কাজে বসার আগে খেয়ে নে।’ হাঁক দিয়ে ভুবনকে বললেন, ‘খাবার গরম কর।’
.
৪.৪
খাওয়া-দাওয়া চুকে গেলে যে যার বেডরুমে চলে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ কী মনে পড়ে যাওয়ায় বিশ্বজিৎ বললেন, ‘বিনয়বাবু, একটু দাঁড়ান, আমি আসছি—’ ত্বরিত পায়ে নিজের ঘরে গিয়ে একটা বড় প্যাকেট আর মাঝারি ধরনের একটা খাম এনে বললেন, ‘এই দুটো কাল এসেছে। আপনাকে দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। আই অ্যাম সরি—’ তিনি আর দাঁড়ালেন না।
খাম আর প্যাকেট নিয়ে নিজের ঘরে চলে এল বিনয়। প্রথমে ভারী প্যাকেটটা খুলল সে। ‘নতুন ভারত’-এর শেষ দশ দিনের কপি। তার রিপোর্টগুলো দেখা গেল, খুব গুরুত্ব দিয়ে প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছে। সেই সঙ্গে কলকাতার এবং দেশের নানা খবর। দ্রুত পাতার পর পাতা উলটে যেতে লাগল সে। উদ্বাস্তুরা স্রোতের মতো আসছেই, আসছেই। এর মধ্যে বরিশালে বিরাট আকারের দাঙ্গা হয়ে গেছে। দাঙ্গা বললে ঠিক হবে না, একতরফা খুন, ধর্ষণ, আগুন ইত্যাদি ইত্যাদি। কমিউনিস্ট পার্টি এবং অন্য রাজনৈতিক দলগুলির আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন উদ্বাস্তুদের সঙ্গে পুলিশের খণ্ডযুদ্ধ।
পড়তে পড়তে মন খারাপ হয়ে গেল বিনয়ের। কলকাতা যেন একটা জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির মাথায় বসে আছে। বিনয় আন্দামানে আসার পর থেকে কিছুদিন বাদে বাদে চিফ রিপোর্টার প্রসাদ লাহিড়ি একসঙ্গে আট-দশ দিনের কাগজ পাঠিয়ে দেন। জেফ্রি পয়েন্টে যে কলোনি তৈরি হওয়ার তোড়জোড় চলছে সেখানেই তো আপাতত থাকছে বিনয়। কলকাতা থেকে যে চিঠিপত্র আসে সবই পোর্টব্লেয়ারে বিশ্বজিৎ রাহার ঠিকানায়। জেফ্রি পয়েন্টে মালপত্র বোঝাই ট্রাক কখনও সখনও গেলে তিনি সেসব ড্রাইভারের হাতে পাঠিয়ে দেন। মোহনবাঁশি কর্মকারকে নিয়ে পোর্টব্লেয়ারে আসায় দেরি হয়নি, হাতে হাতেই এবার প্রসাদ লাহিড়ির প্যাকেটটা পাওয়া গেছে।
কাগজগুলো দেখা হয়ে গিয়েছিল। সেগুলোর সঙ্গে দু’টো মুখবন্ধ খামও রয়েছে। খামের ওপর তার নাম লেখা। একটা পাঠিয়েছেন প্রসাদ লাহিড়ি। হাতের লেখা দেখেই বোঝা গেল। দ্বিতীয় খামের লেখাটা দেখে রীতিমতো অবাকই হল বিনয়। ওই গোটা গোটা মুক্তোর মতো অক্ষরগুলো সুনীতির। কিন্তু সে আন্দামানে আসার পর সুনীতি আগে কখনও চিঠি লেখেনি। যা লেখার আনন্দদাই লিখেছে, আর লিখেছে সুধা। হঠাৎ কী এমন ঘটতে পারে?
ক্ষিপ্র হাতে প্রথমে প্রসাদ লাহিড়ির খামের মুখ কেটে চিঠি বের করে পড়ে ফেলল বিনয়।
‘স্নেহাস্পদেষু,
‘তোমাকে আগের পত্রে আন্দামানের পেনালগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠাতে লিখেছিলাম, যাতে পরপর কয়েক কিস্তিতে আমাদের কাগজে বেরুতে পারে। এডিটরও তাই চাইছেন। আমাকে ডেকে এর মধ্যে দু’তিনবার বলেও দিয়েছেন। আমি তোমাকে মনে করিয়ে দিলাম। যত দ্রুত সম্ভব পাঠিয়ে দেবে। ক্যামেরা পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। যতদিন না তুমি সেটা পাচ্ছ অবশ্যই পোর্টব্লেয়ারের কোনও ফোটোগ্রাফারকে তোমার সঙ্গে কলোনিগুলোতে নিয়ে যাবে। রিপোর্টর সঙ্গে ছবি থাকলে লেখার আকর্ষণ এবং গুরুত্ব বাড়ে। অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্যও হয়ে ওঠে। ফোটোগ্রাফারের জন্য ভাল পেমেন্টের বন্দোবস্ত করা হবে। কয়েকদিনের মধ্যে বেশ কিছু টাকা পাঠাচ্ছি।
‘কাগজ পড়ে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, কলকাতার অবস্থা ভয়াবহ। চারিদিকে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা। কবে যে এই অস্থিরতা আর উত্তেজনা কমবে জানি না।
‘যাই হোক, তোমার রিপোর্ট এবং চিঠির আশায় রইলাম। নিজের শরীর স্বাস্থ্যের যত্ন নিও। সাবধানে থেকো।
‘ইতি, শুভার্থী প্রসাদদা।’
চিঠিটা খামের ভেতর পুরে রাখতে রাখতে বিনয়ের মনে পড়ল, ফটোগ্রাফারের ব্যাপারটা আগের একটা চিঠিতেও জানিয়েছিলেন প্রসাদ লাহিড়ি। কিন্তু জেফ্রি পয়েন্টের রিফিউজি রিহ্যাবিলিটেশনের নানা সমস্যায় এমনভাবে সে জড়িয়ে পড়েছে যে ফোটোগ্রাফার জোগাড় করায় চিন্তাটা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। বিশ্বজিৎ রাহাই এই দ্বীপপুঞ্জে তার সবচেয়ে বড় ভরসা। কাল তাঁকে ফোটোগ্রাফারের কথাটা বলতে হবে। তিনি নিশ্চয়ই ব্যবস্থা করে দেবেন। পেনাল কলোনি নিয়ে বৈজুদের বাড়ি যাবেন, সেটা ঠিক হয়ে আছে। আশা করা যায়, সপ্তাহখানেকের মধ্যে পেনাল কলোনি নিয়ে একটা বড় লেখা পাঠানো যাবে।
এবার দ্বিতীয় ঘামটা তুলে নিজের নামটা বারকয়েক দেখে নিল বিনয়। সেটার মুখ ছিঁড়ে চিঠি বের করতে গিয়ে চমকে উঠল। খামের ভেতর একটা নয়, দু’দু’টো চিঠি। একটা সুনীতির, কিন্তু অন্য চিঠিটার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না বিনয়। হাতের লেখা দেখেই চেনা গেল–অবনীমোহন। তার বাবা।
নিস্পৃহ, উদাসীন যে মানুষটি নিজের সন্তান, আত্মীয়-পরিজন নিয়ে গড়ে তোলা ভূমণ্ডলটি পেছনে ফেলে বেনারসে গুরুর আশ্রমে চলে গিয়েছিলেন, সমস্ত অতীতকে মুছে দিয়েছিলেন নিজের জীবন থেকে, হঠাৎ তিনি যে ফের চিঠি লিখতে পারেন, ভাবা যায়নি।
অপার বিস্ময়ে কয়েক লহমা চিঠিটার দিকে তাকিয়ে রইল বিনয়। তারপর ধীরে ধীরে পড়তে শুরু করল।
‘কল্যাণীয়েষু,
‘বিনু, অনেকদিন তোমাদের খোঁজখবর লওয়া হয় নাই। যখন কলিকাতা ত্যাগ করিয়া কাশীধামে গুরুর আশ্রয়ে চলিয়া আসি সেই সময় স্থির করিয়াছিলাম অতীত সংসার জীবনের কোনও কিছুর সঙ্গে লেশমাত্র সম্পর্ক রাখিব না। আমি সম্পূর্ণ নিরুৎসুক এবং আগ্রহশূন্য হইয়া নূতন জীবনে মগ্ন হইয়া থাকিব। প্রাণপণে সেই প্রয়াসই চালাইয়া গিয়াছি।
‘কিন্তু অতীত আমার পিছু ছাড়ে নাই। বিগতস্পৃহ সন্ন্যাসী হইতে গেলে যে মনোবল এবং নিরাসক্তির প্রয়োজন, খুব সম্ভব আমার তাহা নাই। অতীত এবং বর্তমানের মাঝখানে আমি ত্রিশঙ্কুর মতো ঝুলিয়া আছি, বলিতে পার।
‘তোমার ঠিকানা জানা নাই, তাই সুধার ঠিকানায় কিছুদিন পূর্বে একটি পত্র দিয়াছিলাম, কিন্তু উত্তর পাই নাই। পত্রটি কেন সুধাদের বাড়ি পৌঁছাইল না, বুঝিতে পারিতেছি না। ডাকবিভাগের গণ্ডগোল কি না, কে জানে। অগত্যা সুনীতির নিকট আবার লিখিতে হইল। তাহাকে জানাইয়াছি, যেমন করিয়া পারে, অতি সত্বর এই পত্র যেন তোমার নিকট পাঠাইবার বন্দোবস্ত করে। কারণ আমি গুরুতর অসুস্থ, একপ্রকার শয্যাশায়ী বলিতে পার। আশ্রমের গুরুভাইরা আমাকে বাঁচাইয়া রাখার জন্য নিরন্তর চেষ্টা করিয়া যাইতেছেন। ডাক্তার-কবিরাজ তো আছেনই, গুরুভাইরা দিনের বেলা তো বটেই, রাত জাগিয়া সেবা-শুশ্রূষা করিতেছেন।
‘কিন্তু বুঝিতে পারিতেছি, আমার আয়ু ফুরাইয়া আসিতেছে। এই পৃথিবীতে আমি আর বেশিদিন নাই।
‘অন্তিম সময়ে মন ভীষণ দুর্বল হইয়া পড়িয়াছে। বারংবার যে অতীতকে জীর্ণ বস্ত্রের ন্যায় পিছনে ফেলিয়া আসিয়াছি, তাহা আমার সামনে আসিয়া উপস্থিত হইতেছে। সংসারের কত খুঁটিনাটি যে মনে পড়িতেছে ভাবিয়া কুলকিনারা পাই না। যাঁহারা সত্যকারের সাধক তাহাদের চিত্তচাঞ্চল্য ঘটে না। তাহারা স্থিতধী, অচঞ্চল, কোনও কারণেই বিচলিত হন না। তাহাদের একটাই লক্ষ্য-ঈশ্বরোপলব্ধির জন্য সাধনা। অন্য কোনও দিকে দৃষ্টি নাই। যাঁহারা একদা গৃহী ছিলেন, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-আত্মীয়-পরিজনদের দ্বারা পরিবৃত, সেই জীবনকে তাহারা চিরকালের মতো পিছনে ফেলিয়া গিয়াছেন, কোনও দিন ফিরিয়া তাকান নাই। ইহাদের কথা ভাবিলে মনে হয় আমি সাধক জীবনের যোগ্য নই।
‘এ সব প্রসঙ্গ থাক। বিশেষ করিয়া যে কারণে এই পত্র লিখিতেছি, তাহা জানাই। দাঙ্গার সময় নির্যাতিতা ঝিনুককে আমি মানিয়া লইতে পারি নাই। আজন্মলালিত সংস্কার বাধা হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। এই সংস্কারকে আমি প্রাধান্য দিয়াছি। মানবিক কর্তব্য পালন করি নাই। রোগশয্যায় শুইয়া শুইয়া যতই তাহার কথা ভাবি, তীব্র অনুশোচনায় দগ্ধ হই। সেই শীতের রাত্রে ঝিনুক কোথায় নিরুদ্দেশ হইয়াছিল, জানি না। কলিকাতা শহর তো নিরাপদ স্থান নয়, বিশেষ করিয়া একাকী একটি উদ্বাস্তু তরুণীকে পাইলে শকুনের পাল ছিঁড়িয়া খায়।
‘তুমি কি জানো, সে কি বাঁচিয়া আছে? তাহার সন্ধান কি করিয়াছ? তাহাকে কি পাওয়া গিয়াছে? পাইলে কোথায় আছে? আর যদি তাহার মৃত্যু হইয়া থাকে কিংবা পাপের পথে যাইতে বাধ্য হইয়া থাকে, তাহার জন্য আমি সম্পূর্ণ দায়ী। আত্মগ্লানিতে আমি জর্জরিত। একটি নিষ্পাপ মেয়েকে রক্ষা না করিয়া তাহার জীবন ধ্বংস করিয়া দিয়াছি ভাবিলে মনে হয়, ঈশ্বরের সাধনা আমার কাজ নয়। আমি একজন হীন মানুষ। পরকাল বলিয়া যদি কিছু থাকে সেখানেও মৃত্যুর পর নিষ্কৃতি নাই। জন্ম-জন্মান্তর ধরিয়া আমাকে দণ্ডভোগ করিতে হইবে। ঈশ্বর ইহজন্মে বা পরজন্মে এই পাপিষ্ঠকে ক্ষমা করিবেন না।
‘আমার বিশেষ অনুরোধ, আমি কলিকাতা হইতে চলিয়া আসার পর যদি ঝিনুকের সন্ধান পাইয়া থাক, পত্রপাঠ তাহাকে লইয়া একবার কাশী চলিয়া আসিবে। আমি তাহার কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাহিয়া লইব। আমার এই শেষ ইচ্ছাটুকু পূরণ করিলে হয়তো কিছুটা হইলেও শান্তি পাইব।
‘গুরুর আশ্রমে আমার অন্য একটি নামকরণ হইয়াছে। কিন্তু গৃহী জীবনের নামটি নিচে লিখিলাম।
শুভার্থী
অবনীমোহন বসু’
চিঠির এককোণে কাশীতে গুরুর আশ্রমের ঠিকানা লেখা আছে।
পড়া শেষ হলে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল বিনয়। এ কোন অবনীমোহন? সেদিন শীতের রাতে নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন, সংস্কারগ্রস্ত যে কঠোর মানুষটিকে সে দেখেছিল তাঁর সঙ্গে এই চিঠিটি যিনি লিখেছেন তাকে একেবারেই মেলানো যাচ্ছে না। কাশীতে গিয়ে অবনীমোহনের কি জন্মান্তর ঘটে গেছে?
বাইরে সমুদ্রের তুমুল আছাড়িপিছাড়ি, ঝড়ো বাতাসের খ্যাপামি। বিনয়ের হৃৎপিণ্ডে তেমন কিছুই যেন শুরু হয়েছে।
ঝিনুককে কাশীতে নিয়ে যাওয়ার কথা লিখেছেন অবনীমোহন। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে তার খোঁজ পাওয়া গেছে, মিডল আন্দামানে তার সঙ্গে দেখা করবে সে। অবনীমোহনের চিঠিগুলো তাকে দেখাবে। কিন্তু অপরাধবোধে বিপর্যস্ত, সন্তপ্ত একটি মানুষের ব্যাকুলতা ঝিনুককে কি আদৌ টলাতে পারবে?
আলো নিবিয়ে একসময় শুয়ে পড়ল বিনয়। কিন্তু চোখ বুজলেই কি ঘুম আসে? একবার অবনীমোহন, একবার ঝিনুক, এইভাবে দু’টো মানুষ বার বার বন্ধ চোখের ভেতর ফুটে উঠছে।