চতুর্থ খণ্ড – প্রথম পরিচ্ছেদ
১.
জুলাই বিপ্লবের পর ১৮৩১ ও ১৮৩২ সাল দুটির এক বিশেষ তাৎপর্য আছে আমাদের ইতিহাসে। এই দুটি সাল যেন বিপ্লবের ফলাফলের দুটি দিককে উদঘাটিত করে লোকচক্ষে। সে ফলাফলের একদিকে আছে এক বিরাট পাহাড় আর একদিকে আছে এক গভীর খাদ। নানারকম আবেগানুভূতি আর তত্ত্বকথার মেঘঝড়ের মাঝে সমাজের যে জনগণ সব সভ্যতার ভিত্তিভূমি সে জনগণের বারবার আনাগোনা ঘটেছে আন্দোলন আর প্রতিরোধের মাধ্যমে।
বুর্বন রাজবংশের প্রতিষ্ঠায় সারা দেশের মধ্যে একটা ঝিমুনির ভাব আসে। অনেক বিপ্লব, যুদ্ধবিগ্রহ, বীরত্ব, আর জাতীয় উচ্চাভিলাষের মত্ততার পর শান্তি চায় দেশের ক্লান্ত জনগণ। এই সময় রাষ্ট্রদর্শনের প্রবক্তারা এগিয়ে আসেন তৎপর হয়ে। কিন্তু দেশের জনগণ অনাবিল শান্তি আর শৃঙ্খলা চায়। স্টুয়ার্ট যুগের ইংল্যান্ড যেমন একদিন লর্ড প্রোটেক্টরের অধীন প্রজাতন্ত্রের পর শান্তি চায় তেমনি ফরাসি জনগণ বিপ্লব ও সাম্রাজ্যশাসনের পর শান্তি চায়।
সম্রাট নেপোলিয়নের পতনের পর পুনঃপ্রতিষ্ঠিত বুর্বন রাজতন্ত্র জনগণের দাবির প্রতি ছিল উদাসীন। তারা তখন রাজ্যশাসনের ঐশ্বরিক অধিকারে প্রমত্ত হয়ে উঠেছিল। তাদের এই বিশ্বাস ছিল যে রাজা অষ্টাদশ লুই-এর সনদে প্রজাদের অধিকার দানের যে প্রতিশ্রুতি ছিল সে অধিকার ইচ্ছা করলে ফিরিয়ে নিতে পারেন রাজা। প্রজারা বুঝতে পেরেছিল তাদের ন্যায়সংগত অধিকার দানের ব্যাপারে রাজাদের বিতৃষ্ণার অন্ত নেই।
বুর্বন রাজারা ভাবত সম্রাটের পতনের পর তাদের হাত খুব শক্ত হয়েছে। কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি যে শক্তি সম্রাটকে অপসারিত করে তার পতন ঘটায় সে শক্তির হাতে তারা ক্রীড়নক মাত্র। তারা ভাবত যে অতীতে তাদের রাজশক্তির শিকড় গাড়া আছে সেই অতীত থেকেই তারা প্রাণরস আহরণ করে বেঁচে থাকবে। কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি যে অতীতের মধ্যে তাদের শিকড় গাঁথা আছে সে অতীত হল ফরাসি আর ফরাসি জাতি। তারা বুঝতে পারেনি যে গভীর আর শক্তিশালী শিকড়গুলো তাদের ধারণ করে রেখেছে সে শিকড় কোনও এক বিশেষ রাজবংশের অধিকার নয়, সে শিকড় হল সমস্ত ফরাসি জনগণের জাতীয় অধিকার।
বুর্বন রাজবংশ হল ফ্রান্সের রক্তাক্ত ইতিহাসের মূল; কিন্তু ফ্রান্সের ভাগ্য বা রাজনীতির ভিত্তি হিসেবে তার কোনও ভূমিকা ছিল না। কুড়ি বছর ধরে শাসনক্ষমতা হারিয়ে দেশ ও জাতির ভাগ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তারা। তারা এ কথাটা বুঝতে পারেনি। তারা বুঝতে পারেনি রাজা সপ্তদশ লুই-এর রাজত্বকালেই থার্মিভরের ঘটনা ঘটে এবং অষ্টাদশ লুই-এর আমলে ম্যারঙ্গোর ঘটনা ঘটে। ইতিহাসের আদিকাল থেকে আর কোনও রাজা কখনও দেশের ঘটনা সম্পর্কে এমন ঔদাসীন্য দেখায়নি। এর আগে আর কখনও রাজার অধিকার জনগণের অধিকারকে অস্বীকার করেনি। ১৮১৪ সালের সনদে জনগণকে যে অধিকার দেওয়া হয়েছে তা অধিকার নয়, জনগণের অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ, সে অধিকার গ্রাস।
রাজারা যখন দেখল রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার ফলে বোনাপার্টের ওপর রাজশক্তির জয় প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তাদের অধিকারের প্রতি সচেতন হয়ে উঠল জনগণ। জুলাই-এর কোনও এক সকালে জনগণ তাদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত অধিকার সম্বন্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে অকস্মাৎ। তাদের ধারণা ছিল, রাজা জাতি ও নাগরিকদের ন্যায়সংগত অধিকার দান করতে চাইছেন না।
সুতরাং যে উদ্দেশ্যে রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়েছিল তা কার্যত ব্যর্থ হয়ে গেল। তা সত্ত্বেও একটা কথা স্বীকার করতে হবে যে এই রাজতন্ত্র অগ্রগতির পথে কোনও প্রতিকূলতা সৃষ্টি করেনি। এই রাজতন্ত্রের আমলে অনেক ভালো কাজও হয়েছিল।
পুনঃপ্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্রের আমলে ফরাসি জাতি শান্তিপূর্ণ আলোচনায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল, যা প্রজাতন্ত্রের আমলে সম্ভব হয়নি। আবার সাম্রাজ্যবাদের যুগেও তা সম্ভব হয়নি। স্বাধীন ও শক্তিশালী ফ্রান্সের শান্তিপূর্ণ ভাবধারা ও জীবনভঙ্গিমা ইউরোপের অন্যান্য জাতিদের সামনে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। ফরাসি বিপ্লব রোবেসপিয়ারের মুখ দিয়ে অনেক বিক্ষুব্ধ কথা বলেছিল আর বোনাপার্টের অধীনে কামানগর্জনে ফ্রান্স অনেক কথা বলেছিল। কিন্তু অষ্টাদশ লুই আর দশম চার্লস-এর অধীনে দেশের বুদ্ধিজীবীরা কথা বলতে থাকে এবং সে কথা দেশের জনগণ শুনতে থাকে। ঝড় থেমে যাওয়ায় আবার সব আলো জ্বলে ওঠে। ঊর্ধ্বে আত্মার শান্ত আলোকে কাঁপতে দেখা যায়। তা দেখে আনন্দ পায় দেশের মানুষ। পনেরো বছর ধরে অনেক বড় বড় নীতি কাজ করতে থাকে, আগে রাজনীতিবিদরা যে নীতি কার্যকরী করতে পারেনি। আইনের আগে সাম্য, আত্মার স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, মত প্রচারের স্বাধীনতা, গুণী ব্যক্তিদের উপযুক্ত কাজ দান
এই সব কিছু ১৮১৫ থেকে ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে। ঈশ্বরের বিধানে বুর্বনরা সভ্যতার যন্ত্রস্বরূপ কাজ করতে থাকে।
জুলাই বিপ্লবের ফলে বুর্বন রাজবংশের পতনের মধ্যে যে একটি মহত্ত্ব ছিল সে মহত্ত্ব হল ফরাসি জাতির। বুর্বন রাজারা নীরবে সিংহাসন ত্যাগ করে চলে যায়। রাজসৈন্যের সম্মুখীন হয়ে এবং সামরিক শক্তির চাপ পেয়েও জনগণ খুব বেশি বিক্ষুব্ধ হয়নি। তারা রাজপরিবারে কোনও রক্তপাত ঘটায়নি, রাজারা সিংহাসন ছেড়ে পালিয়ে যান দেশ থেকে। এতে তারা শান্ত হয়ে ওঠে। জুলাই বিপ্লবের ফলে জনগণের যে অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় সেই অধিকারই ছিল ন্যায় আর সত্য। সে অধিকার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই বলপ্রয়োগের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়।
.
২.
রাজনীতিবিদদের মতে কোনও দেশে বিপ্লবের পর তার পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোতে যদি রাজতন্ত্র কায়েম থাকে তা হলে সে দেশে এক রাজবংশের শাসন দরকার হয়। বিপ্লবের পর শান্তি প্রতিষ্ঠার দরকার। কিন্তু রাজা খুঁজে পাওয়া আর রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করা এক নয়। কাউকে রাজা করা যত সহজ কোনও রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করা তত সহজ নয়। নেপোলিয়নকে হঠাৎ রাজা করা হয়, ১৮২১ সালে মেক্সিকোর এক সেনাপতি ইতুর্বিদেকে সম্রাট করা হয়, পরে অবশ্য ১৮২৩ সালে তিনি আবার সিংহাসনচ্যুত হন। কিন্তু নেপোলিয়ন বা ইতুর্বিদে কেউ একটি রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে যেতে পারেননি।
কিন্তু রাজবংশ প্রতিষ্ঠার জন্য কী কী দরকার? যে রাজা একই সঙ্গে বিপ্লবী, যিনি বিপ্লবে সক্রিয় অংশ গ্রহণ না করলেও বিপ্লবের ভাবাদর্শকে নীতিগতভাবে গ্রহণ করেন, আবার দেশের অতীত ইতিহাসের প্রতি সহানুভূতিশীল, যিনি দেশের ভবিষ্যতের কথাও ভাবেন সেই রাজাই এক রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে যেতে পারেন। বিপ্লবের পর ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের জনগণ একজন ক্রমওয়েল ও নেপোলিয়নের মতো একজন শক্ত লোকের খোঁজ করেছিল। কিন্তু পরে তারা ব্যর্থ হয়ে আর এক বিপ্লবের পর একটি করে রাজবংশের খোঁজ করতে থাকে। ইংল্যান্ডের জনগণ ব্রানসউইক রাজবংশ এবং ফ্রান্সের জনগণ অর্ডিয়ান্স রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে। রাজবংশগুলো হচ্ছে ভারতীয় বটগাছের মতো যার ডালগুলো মাটিতে নুইয়ে পড়ে শিকড়ের মতো মাটিতে ঢুকে গিয়ে এক একটি গাছ হয়ে ওঠে। তেমনি এক একটি রাজা এক একটি রাজবংশ হয়ে উঠতে পারের যদি সে রাজা জনগণের হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারেন।
কিন্তু রাজশক্তিকে অপসারিত করার জন্য ফ্রান্সের জুলাই বিপ্লবও সফল হয়নি একেবারে। ১৮৩০ সালের সে বিপ্লবকে উপর থেকে সফল বলে মনে হলেও তা যেন মাঝপথে বাধা পেয়ে থেমে যায়। সে বাধা কে দিল? সে বাধা দান করে বুর্জোয়ারা।
কিন্তু কেন? কারণ ক্ষুধা থেকে অভাব থেকে সহসা প্রাচুর্যের মধ্যে পড়ে যায় তারা। গতকাল যেখানে ছিল কুণ্ঠার তাড়না, আজ সেখানে দেখা দেয় প্রাচুর্য, কাল আবার সেখানে দেখা দেবে উদ্বৃত্ত। নেপোলিয়ন ক্ষমতার আসীন হবার পর ১৮১৪ সালে যা হয়েছিল দশম চার্লস-এর পর ফ্রান্সে আবার তারই পুনরাবৃত্তি ঘটে।
ভুল করে বুর্জোয়াদের তখন একট পৃথক শ্রেণি হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু আসলে তারা ছিল জনগণেরই একটি পরিতৃপ্ত অংশ। তারা তখন আরাম কেদারায় বসে বিশ্রামে ব্যস্ত ছিল। তাদের দোষ এই যে তারা দেশের সামগ্রিক অগ্রগতির দিকে না তাকিয়ে নিজেদের আরাম উপভোগে মত্ত হয়ে থাকত। তারা বুঝতে পারেনি দেশের কিছু লোক যদি ব্যস্ত ও অশান্ত হয়ে ওঠে তা হলে দেশের অগ্রগতি ব্যাহত হয়। এটাই হল বুর্জোয়াদের ব্যর্থতা। দেশের সবাই এগিয়ে যাবে আর কিছু লোক আত্মস্বার্থে মগ্ন হয়ে থাকবে, এটা কখনও চলতে পারে না।
১৮৩০ সালের মত্ততার পর ফরাসি জাতির বুর্জোয়া নামে একটি অংশ বিশ্রামের জন্য থামতে চেয়েছিল। তারা ঘুমোয়নি, বা স্বপ্ন দেখেনি অথবা আত্মবিস্মৃত হয়ে থাকেনি। তারা শুধু থামতে চেয়েছিল। কিন্তু কোনও সামরিক অভিযানের সময় সৈনিকদেরও মাঝে মাঝে বিশ্রাম করার জন্য হুকুম দেওয়া হয় যাতে তারা বিশ্রামের পর দেহে নতুন শক্তি আর মনে উদ্যম পায়। কিন্তু থামা হল গতকালকার যুদ্ধ আর আগমী কালের যুদ্ধের মাঝখানে এক সজাগ সতর্ক বিরতি এবং সে থামার হুকুম দেওয়ার জন্য থাকে এক সেনাপতি বা সেনানায়ক।
বুর্জোয়াদেরও থামার হুকুম দেওয়ার জন্য একজন নেতা বা নায়কের প্রয়োজন ছিল। অর্ডিয়ান্সের লুই ফিলিপই হল সেই লোক।
জাতীয় আইনসভার ২২১ জন ডেপুটির ভোটে লুই ফিলিপ রাজা নির্বাচিত হন। লাফায়েত্তে সে সভায় সভাপতিত্ব করার সময় প্রজাতন্ত্রের গুণগান করে। ১৮৩০-এর বিপ্লবের এটাই হল কৃতিত্ব।
কিন্তু পরে এই জোড়াতালি দেওয়া সমাধানের মধ্যে একটি বিরাট দুর্বলতা ধরা পড়ে। এত করা সত্ত্বেও জনগণের মৌল অধিকারের প্রতি কোনও সম্মান দেখানো হয়নি।
.
২.
বিপ্লবের হাত যত শক্তিশালীই হোক, তার অস্ত্র যত জোরালোই হোক, তার মধ্যে কতকগুলি ভুল-ত্রুটি থাকে। বিপ্লবের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে আমাদের বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়। বিপ্লবেরও দোষ থাকতে পারে এবং ১৮৩০ সালের বিপ্লবও সে দোষ থেকে মুক্ত নয়।
১৮৩০ সালের বিপ্লব প্রথমে ঠিক পথেই চলতে শুরু করেছিল। রাজতন্ত্রের মধ্যে দোষগুণ যা-ই থাক, রাজার একটা ব্যক্তিগত মূল্য আছে। লুই ফিলিপ সত্যিই একজন ভালো লোক ছিলেন। তাঁর পিতা যেমন নিন্দার পাত্র ছিলেন লুই ফিলিপ তেমনি ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র।
তাঁর অনেক ব্যক্তিগত গুণ ছিল। তিনি ছিলেন স্থিতধী, শান্তিপ্রিয়, ধৈর্যশীল, সকলের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন এবং স্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্ত। অথচ তাঁর বংশের পূর্বপুরুষরা অবৈধ নারীসংসর্গে অভ্যস্ত। আসলে তিনি যেন গুণানুশীলনের দিক থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির একজন ছিলেন। আবার রাজকীয় আত্মমর্যাদার দিক থেকে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের অনেক ঊর্ধ্বে ছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর বংশমর্যাদার প্রতি সচেতন থাকলেও তার সুমতি এবং যথেষ্ট বুদ্ধিবিবেচনা ছিল। তিনি ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ভাষার সঙ্গে সঙ্গে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষাও জানতেন। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে মিতবাক হয়েও প্রকাশ্য জনসভায় ভাল বক্তৃতা দিতে পারতেন। তিনি তার বংশের ও তার আমলের অন্য সব রাজাদের থেকে মানুষ হিসেবে খুব ভালো এবং বড় ছিলেন। তিনি নিজেকে বুর্বন না বলে অর্পিয়ান্স বলে অভিহিত করতেন। তিনি অনেক বই পড়তেন, কিন্তু সাহিত্যরস আস্বাদনে কোনও মতিগতি ছিল না। তিনি ছিলেন মোহমুক্ত এক রাজনীতিবিদ এবং কর্তব্যপরায়ণ। কোন কাজ আগে করতে হবে তা তিনি জানতেন। তিনি ছিলেন আত্মসম্প্রসারণশীল এবং প্রভুত্বপিয়াসী। তিনি সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে প্রতিকূল জনমতকে স্তব্ধ করতে পারতেন। তিনি দেশকে ভালোবাসতেন ঠিক, কিন্তু দেশের থেকে তাঁর বংশগৌরবকে বেশি ভালোবাসতেন। প্রভুত্বের থেকে আবার শাসনক্ষমতাকে বেশি ভালোবাসতেন। আবার আত্মমর্যাদার থেকে প্রভুত্বকে বেশি পছন্দ করতেন। তিনি আনকোনাতে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে এবং স্পেনে ইংল্যান্ডের সঙ্গে সাহসের সঙ্গে বোঝাপড়া করেন। তিনি বিশেষ আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে ‘মার্সাই’ গান গাইতেন। কোনও কিছুতেই ভয় পেতেন না। সৌন্দর্য বা কোনও আদর্শবাদের প্রতি
তার কোনও অনুরাগ ছিল না। আবার যুক্তিহীন আবেগাত্মক উদারতা বা কোনওরূপ দিবাস্বপ্ন অথবা কোনও অলীক অবাস্তব ভাবধারার প্রতি তার কোনও প্রবৃত্তি ছিল না। তার পর্যবেক্ষণশক্তি ছিল তীক্ষ্ণ, কিন্তু কোনও অন্তর্দৃষ্টি ছিল না। বোধশক্তির তীক্ষ্ণতা, বাস্তব বুদ্ধি ও বাগ্মিতার দিক থেকে তিনি ছিলেন সিজার, আলেকজান্ডার আর নেপোলিয়নের সমতুল। তিনি ছিলেন এক রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রবক্তা। সেই শতাব্দীর এক মহান লোক, এক ঐতিহাসিক শাসনকর্তা।
যৌবনে তিনি সুন্দর ছিলেন দেখতে। সমগ্র জাতি তাকে খুব একটা শ্রদ্ধা না করলেও সাধারণ মানুষ তাকে ভালোবাসত। তার মাথার চুল সব পেকে গেলেও তাকে বৃদ্ধ বলে মনে হত না। অভিজাত আর বুর্জোয়ার সংমিশ্রণ ছিল তাঁর চরিত্রে। নতুন এবং পুরনো চিন্তাধারা সমন্বিত এক যুগসন্ধিক্ষণের প্রতিমূর্তি ছিলেন লুই ফিলিপ। দশম চার্লস-এর মতো তিনি গ্রাদ ন্যাশনালের পোশাক পরতেন এবং নেপোলিয়নের মতো লিজিয়ন দ্য অনার-এর ব্যাজ ধারণ করতেন।
তিনি কখনও গির্জায় যেতেন না, শিকার করতে যেতেন না অথবা কোনও অপেরা বা নাচগানের আসরেও যেতেন না। বুর্জোয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য অন্য রাজারা তখন সাধারণত এই সব করত। কিন্তু লুই ফিলিপ ছিলেন স্বতন্ত্র। তিনি ছাতা হাতে অনেক সময় রাস্তায় বেড়াতেন।
ইতিহাসে রাজা লুই ফিলিপের বিরুদ্ধে তিন রকমের অভিযোগ পাওয়া যায়। এ অভিযোগ হল তার ব্যক্তিত্ব এবং রাজ্যশাসনের বিরুদ্ধে। বাড়ি নির্মাণ, বাগানের কাজ আর ঔষধিবিদ্যায় বিশেষ আগ্রহ ছিল তাঁর। তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো হল গণতান্ত্রিক অধিকারের কণ্ঠরোধ, দেশের জাতীয় অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি, গণবিক্ষোভ দমন এবং বিদ্রোহ দমনে সেনাবাহিনী নিয়োগ এবং দেশে পুরোপুরিভাবে আইনের অনুশাসন প্রবর্তন না করা। তাছাড়া বেলজিয়ামকে প্রত্যাখ্যান এবং ইংরেজদের ভারত জয়ের মতো বর্বরোচিত নিষ্ঠুরতার সঙ্গে আলজিরিয়া জয় তাঁর রাজত্বকালের ত্রুটি। আসলে ফ্রান্সের জাতীয় গৌরব বৃদ্ধির ব্যাপারে তিনি ছিলেন অত্যুৎসাহী। এটাই তাঁর বড় দোষ। তার সঙ্গে তাঁর রাজবংশের ভাবমূর্তিটাকেও অতিমাত্রায় উজ্জ্বল করে তুলঁতে চেয়েছিলেন তিনি।
একদিকে রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা আর অন্যদিকে বিপ্লব এই দুই-এর মধ্যে যে বৈপরীত্য ছিল সে বৈপরীত্য যেন মূর্ত হয়ে উঠেছিল তার মধ্যে। ১৮৩০ সালে এই বৈপরীত্য থেকে লাভবান হয়েছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন সে যুগের উপযুক্ত এক রাজা। গাঁয়ে রাজরক্ত থাকা সত্ত্বেও নির্বাসনে থাকাকালে বিদেশে দারুণ দুরবস্থার মধ্য দিয়ে চলতে হয় তাঁকে। এক বিরাট ধনী ও সমৃদ্ধিশালী দেশের রাজবংশের সন্তান হয়েও সুইজারল্যান্ডে নির্বাসনে থাকাকালে একদিন খাবারের টাকা জোগাড়ের জন্য একটি ঘোড়া বিক্রি করতে হয় তাকে। বিশেনতে যাবার সময় তিনি এক জায়গায় অঙ্ক শিখিয়ে কিছু রোজগার করেন এবং তাঁর বোন অ্যাদেলেজ সূচিশিল্পের কাজ করতেন। এই সব কারণে তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন দেশে ফিরে আসার পর।
রাজা হবার পর তিনি সেন্ট মাইকেলে রক্ষিত বন্দিদের রাখার জন্য লোহার খাঁচাটি নিজের হাতে ধ্বংস করেন। এই খাঁচাটি রাজা একাদশ লুই-এর আদেশে নির্মিত হয় এবং পঞ্চদশ লুই-এর আদেশে ব্যবহৃত হয়। লুই ফিলিপের ব্যক্তি হিসেবে দোষের থেকে রাজা হিসেবে কর্তব্যচ্যুতির দোষই বেশি। তার রাজকীয় কর্তব্যের থেকে তাঁর পরিবারের কর্তব্যকেই বড় বলে মনে করতেন তিনি। তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোর মধ্যে এই অভিযোগটাই সবচেয়ে বড়।
তার পুত্রকন্যাদের মনের মতো করে মানুষ করে তোলেন তিনি। তাঁর এক কন্যা মেরি দ্য অর্পিয়ান্স শিল্পী হিসেবে নাম করেন এবং চার্লস দ্য অর্পিয়ান্স নামে এক পুত্র কবি হিসেবে নাম করেন। মেরি জোয়ান অব আর্কের যে একটি প্রতিমূর্তি নির্মাণ করেন, তা তাঁর উন্নত মানের শিল্পীমানসের এক গৌরবময় কৃতিত্বের পরিচয় বহন করে। তার আরও দুটি পুত্র গুণবান হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। পরবর্তীকালে মেটারনিক তাঁদের সম্বন্ধে মন্তব্য করেন, যুবক হিসেবে তারা বিরল।
যৌবনে লুই ফিলিপ ছিলেন দুমোরিজের সহকর্মী এবং লাফায়েত্তের বন্ধু। তিনি ছিলেন জ্যাকোবিন ক্লাবের সদস্য। মিরাববা তাঁর কাঁধের উপর একটা চাপড় দেয় এবং দাঁতন তাঁকে ‘যুবক’ বলে সম্বোধন করে। ১৭৯৩ সালে কনভেনশনের পেছনের বেঞ্চে বসে ষোড়শ লুই-এর বিচার স্বচক্ষে দেখেন। এক অন্ধ অন্তদৃষ্টিসম্পন্ন যে বিপ্লব রাজা এবং রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ সাধন করে, সে বিপ্লবের উগ্র ভাবধারার চাপে কিভাবে একটি মানুষ নিষ্পেষিত হয় তা লুই ফিলিপ দেখেন। কিন্তু লুই বুঝতে পারেন জনগণের আসল ক্ষোভ হল রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং সে ক্ষোভ ন্যায়সঙ্গত, ঈশ্বরের বিধানের মতোই সে ক্ষোভের প্রতি শ্রদ্ধা অনুভব না করে পারেননি লুই ফিলিপ।
তাঁর মনের ওপর বিপ্লবের প্রভাব ছিল অপরিসীম। সেই বিপ্লবের কয়েক বছরের সব ঘটনা এক জীবন্ত ছবির মতো তাঁর মনে জাগ্রত থাকে সব সময়।
রাজা হওয়ার পর জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন তিনি। তাঁর রাজত্বকালে মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রকাশ এবং প্রচারের ব্যাপারে সংবাদপত্রগুলোর স্বাধীনতা ছিল। আইন-আদালতের কাজে কোনওরূপ হস্তক্ষেপ করতেন না রাজা। নাগরিকরা স্বাধীনভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারত। জনগণ রাজার যেকোনও কাজের সমালোচনা করতে পারত স্বাধীনভাবে।
যে ইতিহাস সব রাজা ও রাজশক্তির বিচার করে, লুই ফিলিপ সম্বন্ধে সেই ইতিহাসের বিচারে কিছু ভুলভ্রান্তি আছে। তবে প্রখ্যাত কঠোরমনা ঐতিহাসিক লুই ব্লা পরে লুই ফিলিপ সম্বন্ধে তাঁর মনোভাবের পরিবর্তন করেন।
সিংহাসন ও রাজ্যশাসনের কথা ছেড়ে দিয়ে লুই ফিলিপকে যদি আমরা মানুষ হিসেবে দেখি তা হলে কী দেখব? মানুষের প্রতি তাঁর দয়া এবং করুণা তার অন্য সব মহত্ত্বকে আচ্ছন্ন করে দিয়েছে। তাঁর শত কাজ এবং চিন্তা-ভাবনার মাঝে এবং সারাদিন যুদ্ধক্ষেত্রে কাটিয়ে ও সারা ইউরোপের বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে বাড়ি ফিরে তিনি সারারাত ধরে ফৌজদারি বিচারের সব কাগজপত্র খুঁটিয়ে দেখতেন। বিশেষ করে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামিদের প্রতি তাঁর দয়া ছিল অপরিসীম। কিভাবে তাদের বাঁচানো যায় তার জন্য বিশেষ নিষ্ঠা ও আগ্রহের সঙ্গে চেষ্টা করতেন। সরকারপক্ষের উকিল ও রাজকর্মচারীদের কাজে আস্থা রাখতে পারতেন না তিনি। গিলোটিনে ফাঁসি দেওয়া পছন্দ করতেন না তিনি। গিলোটিনের পরিবর্তে তিনি সাধারণ ফাঁসিমঞ্চের ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন করেন। একবার তিনি সাতজন আসামির মৃত্যুদণ্ড মওকুব করেন।
.
৪.
রাজসিংহাসনে বসার জন্য বলপ্রয়োগ করতে হয়নি লুই ফিলিপকে। রাজবংশের সন্তান হিসেবে সিংহাসনে অধিকার ছিল তার। তার ওপর তিনি জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারা রাজা নির্বাচিত হন। তাঁর বিশ্বাস ছিল এই নির্বাচন আইনসংগত এবং এই রাজপদ গ্রহণ করা তাঁর কর্তব্য। লুই ফিলিপ সরল বিশ্বাসে সিংহাসনে বসেন আর গণতন্ত্রও সরল বিশ্বাসে তাঁকে আক্রমণ করে। রাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব যেন প্রকৃতির দুটি প্রধান বস্তুর মধ্যে দ্বন্দ্ব। তাদের দ্বন্দ্ব দেখে মনে হয় জলের প্রতিনিধিরূপ সমুদ্র বাতাসের প্রতিনিধিরূপ ঝড়ের সঙ্গে এক দ্বন্দে মেতে উঠেছে।
১৮৩০ সালে রাজার শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার সঙ্গে সঙ্গে গোলযোগ শুরু হয়, নানারকমের আন্দোলন আর বাদ-প্রতিবাদ শুরু হয়।
ইউরোপের অন্য সব দেশ জুলাই বিপ্লবকে ভালো চোখে দেখেনি এবং ফ্রান্সের মধ্যেও এই বিপ্লব সম্বন্ধে নানারকম ব্যাখ্যা করা হয়। অনেক রাজনৈতিক মত এবং দল গড়ে ওঠে। রাজনৈতিক ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের যে বিধান মূর্ত হয়ে ওঠে সে বিধানের কথা কেউ বুঝতে পারে না। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শান্ত বিত্তের যে সব মানুষ শান্ত ও নিষ্ক্রিয়ভাবে সব কিছু প্রত্যক্ষ ও পর্যালোচনা করার পর কাজ শুরু করে তখন ঘটনার স্রোত অনেক দূর এগিয়ে যায়। অনেক কিছু ঘটে যায়। দেশের পুরনো রাজনৈতিক দলগুলো সব সময় বিপ্লবকে বাধা দেবার চেষ্টা করে। তারা যেন স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটার চেষ্টা করে। তাদের মতে রাজ্যশাসনে রাজার বংশগত অধিকার আছে, সুতরাং যে রাজদ্রোহিতা থেকে বিপ্লবের জন্ম সে বিদ্রোহ দমনের অধিকার রাজার আছে। সব বিদ্রোহের পেছনে থাকে এক অন্ধ ক্রোধ। কিন্তু সব বিপ্লবের মূলে থাকে এক আদর্শ, এক প্রয়োজনীয়তা। কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেকে সে বিপ্লবকে বাধা দেয়। বাধাদানকারীরা বলতে লাগল, এ বিপ্লব রাজাকে সিংহাসনে বসাবার বিপ্লব। এ বিপ্লবের অর্থ হয় না। ১৮৩০ সালের বিপ্লব দেউলে হয়ে পড়ে সবদিক দিয়ে। প্রজাতন্ত্রীরা ও গণতন্ত্রবাদীরা একযোগে আক্রমণ করে তাকে। একদিকে ছিল যুগ-যুগান্তকারী রাজতন্ত্র আর অন্যদিকে ছিল গণতান্ত্রিক অধিকার। একদিকে অতীত, অন্যদিকে ভবিষ্যৎ। দু দিকে চাপ পাচ্ছিল এই বিপ্লব। বৈদেশিক ব্যাপারে এ বিপ্লবের এক তাৎপর্য ছিল। কারণ এ বিপ্লবের ফলে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ইউরোপের অন্য রাষ্ট্রগুলো খুশি হয়। তারা সমর্থন করে এ বিপ্লব। অভ্যন্তরীণ দিক থেকেও এর একটি তাৎপর্য ছিল। এ বিপ্লব রাজতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করলেও সে রাজতন্ত্রকে প্রতিক্রিয়াশীল বলা যায় না কোনওক্রমে। তাছাড়া ইউরোপীয় কায়দায় অন্যান্য দেশের মতো এখানেই রাজ্যশাসনে রাজাকে পরামর্শ দেবার জন্য মন্ত্রিসভা গঠিত হয়।
ইতোমধ্যে অসংখ্য সমস্যা এসে দেখা দেয় রাজসরকারের সামনে। দারিদ্র্য, সর্বহারা, বেতনহার, শিক্ষা, শান্তি, বেশ্যাবৃত্তি, নারীসমাজের অবস্থা, উৎপাদন, বণ্টন, ভোগ, বিনিময়, মুদ্রাব্যবস্থা, মূলধন ও শ্রমের অধিকার–এই সব সমস্যা একসঙ্গে এক ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে।
জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরেও একটি আন্দোলন দানা বেঁধে উঠছিল। সে আন্দোলন হল চিন্তাশীল ব্যক্তিদের আন্দোলন। জনগণ যখন বিপ্লবের তরঙ্গের ঘাত-প্রতিঘাতে দুলছিল, চিন্তাশীল ব্যক্তিরা তখন তাদের অনেক উর্ধ্বে তত্ত্বকথা চিন্তা করছিলেন। এঁরা রাজনৈতিক অধিকারের ব্যাপারটা পুরোপুরি রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর ছেড়ে দিয়ে শুধু দেশের জনসাধারণের অর্থনৈতিক অধিকার এবং সুখশান্তির কথা চিন্তা করতে থাকেন। এঁরা ব্যক্তিগতভাবে বা সমষ্টিগতভাবে চিন্তা করলেও এঁরা সবাই নিজেদের সমাজতন্ত্রবাদী বলে অভিহিত করতেন এবং এই নামেই তারা পরিচিহ্নিত ছিলেন।
এই সব সমাজতন্ত্রবাদীরা যে দুটি সমস্যাকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতেন সেগুলো হল সংখ্যায় দুটি। প্রথম সমস্যা হল উৎপাদন এবং দ্বিতীয় সমস্যা হল বন্টন। উৎপাদন সমস্যার মধ্যেই আছে শ্রম অর্থাৎ সম্পদ সৃষ্টিতে মানবিক শক্তি প্রয়োগের প্রশ্ন। বণ্টন সমস্যার মধ্যে আছে বেতনের প্রশ্ন এবং কিভাবে দেশের শ্রমজাত সম্পদ দেশের লোকের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া যায় তার কথা।
দেশের মানবিক শক্তি ও শ্রমের যথাযথ প্রয়োগে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে তোলে। আর সুষম বণ্টন দেশের মানুষের সুখশান্তি বৃদ্ধি করে। সুষম বণ্টন মানে অবশ্য সমবণ্টন নয়, সুষম বণ্টন মানে ন্যায়সংগত বন্টন অর্থাৎ দেশের জাতীয় সম্পদ বন্টনের ব্যাপারে যেন অন্যায় অসাম্য না থাকে। দেশের সব মানুষ যেন খেতে পায়, ভালোভাবে সুখে-শান্তিতে জীবন ধারণ করতে পারে। বণ্টনের এই সমতার নীতিই হল সাম্যের মূল ভিত্তি।
এই দুটি সমস্যার সমাধান মানেই দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হওয়া এবং দেশের প্রতিটি মানুষের সুখসম্পদ বৃদ্ধি পাওয়া। তার মানেই সামাজিক সম্পদ বৃদ্ধি, তার মানেই এক স্বাধীন সুখী জাতির উদ্ভব।
ইংল্যান্ড উৎপাদন সমস্যার সমাধান করেছে। জাতীয় সম্পদের বৃদ্ধিতে দারুণ সফল হয়েছে। কিন্তু তার বণ্টন ব্যবস্থা খুবই খারাপ। তার ফলে একদিকে বিরাট সম্পদ, আর একদিকে বিরাট দারিদ্র। দেশের যত সব সম্পদ মুষ্টিমেয় সামান্য কিছুসংখ্যক লোক ভোগ করে আর বিরাট সংখ্যক জনসাধারণ ভোগ করে শুধু দুঃখ আর দারিদ্র্য। যে রাষ্ট্রের মধ্যে জাতীয় সম্পদ ব্যক্তিগত অভাব এবং দারিদ্র্যের ওপর নির্ভরশীল সে রাষ্ট্র সত্যিই বিপজ্জনক। এ নীতি যারা সমর্থন করে তারা নীতিহীন যুক্তিহীন এক জড়বাদেরই সমর্থক।
সাম্যবাদীরা ও কৃষিব্যবস্থার সংস্কারকরা বণ্টন সমস্যার সমাধান করে বলে প্রচার করে। বেড়ায়। কিন্তু এটা তাদের ভুল ধারণা। তাদের উৎপাদন পদ্ধতির ত্রুটিই উৎপাদনকে ব্যাহত করে। সমবণ্টনের ব্যবস্থা কায়েম হলে উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে প্রতিযোগিতা বন্ধ হয়ে যায় এবং তার ফলে শ্রমও উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাহত হলে জাতীয় সম্পদ নষ্ট হয় আর জাতীয় সম্পদের উৎপাদন কমে গেলে তার সমবণ্টনের কোনও অর্থ হয় না। সাম্যবাদীরা যেন একধরনের কসাই যারা কোনও জিনিস সকলের মধ্যে বণ্টন করে দিতে গিয়ে নিজেরাই গ্রাস করে ফেলে।
আসলে এ দুটি সমস্যাকে পৃথক করে দেখলে চলবে না। একই সমস্যার এ হল দুটি দিক মাত্র। এ দুটি সমস্যার সমাধান একই সঙ্গে করতে হবে। সমাজতন্ত্রের কথা হল ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপসাধন এবং সমস্ত রকম শোষণের বিলোপসাধন। সমাজবাদীদের মতে রাষ্ট্রের মানুষ শ্রেণি নির্বিশেষে দেশের সব সম্পত্তির মালিক। তারা সম্পদ উৎপাদন করবে এবং সে সম্পদ সমানভাবে ভাগ করে নেবে। এইভাবে পার্থিব উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে নৈতিক উন্নতি সাধন করবে।
সমাজতন্ত্রবাদীরা এটাই চেয়েছিল এবং এই সমস্যাটাই সবচেয়ে বিব্রত করে তোলে লুই ফিলিপকে। দার্শনিকরা তখন এক আদর্শ গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন যে আদর্শ একই সঙ্গে প্রাচীন ভাবধারা এবং বৈপ্লবিক আদর্শের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবে, যা সংসদ ব্যবস্থা এবং রাস্তার জনগণকে মিলিয়ে দেবে, সমস্ত দলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার অবসান ঘটাবে।
লুই ফিলিপ দেখলেন তাঁর পায়ের তলায় মাটি কাঁপছে। দিগন্তে মেঘ ঘনিয়ে উঠছে। জুলাই বিপ্লবের কুড়ি মাস যেতে না যেতেই চারদিক থেকে বিপদ ঘনীভূত হয়ে উঠল। ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্র ক্রুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ফ্রান্সের দিকে। ফ্রান্স তখন অস্ট্রিয়া ও আনকোনার সঙ্গে পেরে উঠছিল না। মেটারনিক তখন ইতালিতে বলগোনার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। জার নিকোলাসের ওপর রুশ জনগণের ঘৃণা বেড়ে যাচ্ছিল ক্রমশ। স্পেন আর পর্তুগাল শত্রু হয়ে উঠেছিল ফ্রান্সের। তার ওপর গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল প্যারিসে।
.
৫.
এপ্রিলের শেষের দিকে অবস্থা আরও খারাপের দিকে গেল। ১৯৩০ সাল থেকে ছোটখাটো অনেক আন্দোলন এবং গোলমাল চলছিল এবং সে গোলমাল এবং আন্দোলন দমনও করা হচ্ছিল। তখন সমগ্র ফ্রান্স প্যারিসের দিকে তাকিয়ে ছিল এবং প্যারিস তাকিয়ে ছিল ফবুর্গ সেন্ট আঁতোনের দিকে।
ফবুর্গ সেন্ট আঁতানে তখন গরম আগুনের মতো হয়ে উঠেছে। র্যু দ্য শারানের অবস্থা তখন ছিল একই সঙ্গে শান্ত এবং বিক্ষুব্ধ। বিভিন্ন হোটেলে তখন শ্রমিকরা শুধু বিপ্লবের কথা আলোচনা করত। প্রায় সব কলকারখানার শ্রমিকরা তখন আন্দোলনে নেমে পড়েছিল। একদিন একটা হোটেলে একজন শ্রমিক বলল, আমরা তিনশোজন শ্রমিক আছি। রোজ যদি দশ স্যু করে দিই তা হলে মোট দেড়শো ফ্রাঁ হবে এবং তাই নিয়ে গুলি আর বারুদ কেনা হবে। আর একজন শ্রমিক বলে, আমাদের আর এখন ছ’মাস সময় চাই না! এমনি আমরা সংখ্যায় পঁচিশ হাজার হয়ে উঠেছি এবং আমরা সরকারের শক্তির সমান হয়েছি। আর একজন শ্রমিক বলে, আমাদের অস্ত্র নেই। তখন আর একজন উত্তর করে, “কেন, সেনাবাহিনীর হাতে অস্ত্র আছে।’
এইভাবে তখন দারুণ উত্তেজনা চলছিল সাধারণ মানুষের মধ্যে। যেখানে-সেখানে শ্রমিকদের গোপন ও প্রকাশ্য সভা বসত। সেই সব সভায় তারা বিপ্লবের জন্য শপথ করত। আবার এই উত্তপ্ত উত্তেজনায় আবহাওয়ার সুযোগ নিয়ে অনেকে অন্যায় ও অনৈতিক কাজ করে বসত। এক একদিন একটি লোক একটি কাফেতে ঢুকে মদ খেয়ে তার দাম না দিয়েই বেরিয়ে যাবার সময় বলত, বিপ্লব এই মদের দাম দেবে। বিভিন্ন কাফেতে সাধারণ জনগণের ভোটের মাধ্যমে বিপ্লবের প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হত।
এই সময় মেয়েরাও বসে ছিল না চুপ করে। একদিন একট মেয়ে বলে, আমরা বেশ কিছুদিন ধরে দারুণ পরিশ্রম করে কার্তুজ বানাচ্ছি। একদিন মার্শে লেনয়ের অঞ্চলের এক মদের দোকানের বাইরে সীমানা নির্ধারণসূচক একটা পাথরের স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে কালো দাড়িওয়ালা একটা লোক গোপন জায়গা থেকে আসা একটা কাগজ পড়ে শোনাচ্ছিল একদল লোককে। একদল লোক তার সামনে জড়ো হয়ে ভিড় করে সেই পড়া শুনছিল। লোকটা কাগজের কথাগুলো পড়ে যাচ্ছিল, আমাদের নীতি চেপে দেওয়া হয় জোর করে, আমাদের প্রচারপত্র ছিঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। সম্প্রতি তুলাশিল্প বন্ধ হয়ে পড়লে অনেক নরমপন্থী চরমপন্থী হয়ে ওঠে। আমাদের গোপন আস্তানাগুলোতে জনগণের ভবিষ্যৎ গড়ে উঠছে। আজ আমাদের দুটো পথের একটাকে বেছে নিতে হবে–হয় ক্রিয়া না হয় প্রতিক্রিয়া, বিপ্লব না হয় প্রতিবিপ্লব। এখন নিরপেক্ষতা বা নিষ্ক্রিয়তার কোনও স্থান নেই। এখন হয় জনগণের জন্য লড়াই করতে হবে অথবা জনগণের বিরুদ্ধে যেতে হবে। যদি আমরা তোমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে না পারি তা হলে আমাদের ধ্বংস করে ফেল, কিন্তু আজ আমাদের সাহায্য কর সর্বপ্রকারে।
এই ধরনের অনেক ঘটনা ঘটত। আর একদিন একটি লোক এসে পথের ধারে একটি স্তম্ভের উপর উঠে দাঁড়িয়ে বলতে থাকে, বামপন্থী বিরোধীপক্ষের লোকরা বিশ্বাসঘাতক। তারা একধারে গণতন্ত্রবাদী ও রাজতন্ত্রবাদী সেজে আমাদের বোকা বানাতে চায়। তারা মার খাবার ভয়ে গণতন্ত্রবাদী সাজে। আবার লড়াই করতে হবে না বলে রাজতন্ত্রবাদী বলে নিজেদের প্রচার করে বেড়ায়। প্রজাতন্ত্রীরা হল ভেড়ার চামড়া ঢাকা নেকড়ে। হে শ্রমিকবৃন্দ, তোমরা তাদের সম্বন্ধে সতর্ক হয়ে ওঠ।’ আর একজন তখন তার পেছন থেকে বলে ওঠে, থাম শ্রমিকদের চর কোথাকার।’ সে কথায় চুপ করে যায় লোকটা। একদিন সন্ধেবেলায় একজন শ্রমিক মাঠের মাঝে একটা ক্যানেলের ধারে একজন ভালো পোশাকপরা লোককে দেখতে পায়। লোকটি তখন তাকে প্রশ্ন করে, কোথায় যাচ্ছ নাগরিক?’ শ্রমিকটি তখন উত্তর করে, আমি আপনাকে চিনি না।’ লোকটি তখন বলল, ‘কিন্তু আমি তোমাকে চিনি।’ শ্রমিকটি বলে, আমি হচ্ছি কমিটি এজেন্ট। তোমাকে বিশ্বাস করি না আমরা। আমাদের কোনও কথা যদি ফাঁস করে দাও, আমরা বাকি রেখে দেব না তোমায়। আমরা নজর রাখব তোমার ওপর।’
একদিন একজন লোক বলে, আমাদের অভিযানের পরিকল্পনা সব প্রস্তুত।
আর একদিন একজন বলে, ভদ্রলোককে প্যারিসের রাস্তায় আর বেশিদিন বেড়াতে দেবে না। তার জন্য ওরা উঠে-পড়ে লেগেছে এবং যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে।
কিন্তু ভদ্রলোকটি কে? এইটাই হচ্ছে রহস্যময় ব্যাপার।
পয়েন্ত সেন্ট ইউসত্রাশের কাছে এক কাফেতে বিপ্লবের নেতারা জড়ো হত। অগাস্তে নামে এক দর্জি শ্রমিক সংস্থার লোক ফবুর্গের শ্রমিকদের সঙ্গে নেতাদের যোগাযোগ রক্ষা করে চলত। একজনকে বিচারের সময় আদালতে জিজ্ঞাসা করা হয়, তোমার নাম কী? কে তোমার নেতা? সে তখন উত্তর করে, আমি আমার নেতাকে চিনি না।
একদিন এক কাঠের মিস্ত্রি এক নতুন বাড়ির চারদিকে কাঠের বেড়া দেবার সময় একটা কাগজের চিরকুট পায়। তাতে লেখা ছিল, ফবুর্গ অঞ্চলে র্যু দ্য পাসনিয়েরের একটি বন্দুকের দোকানে পাঁচ-ছ’ হাজার রাইফেল আছে, আমাদের অস্ত্রের বড় দরকার। মিস্ত্রি লোকটি সঙ্গে সঙ্গে তার সহকর্মীদের সেটা দেখায়।
পুলিশ আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে অনেক বাড়ির গোপন জায়গা থেকে অনেকগুলো বন্দুক উদ্ধার করে। এদিকে বিপ্লবী শ্রমিকরাও অনেকগুলো বন্দুকের দোকান থেকে অনেক অস্ত্র চুরি করে আনে। ব্যারিয়ের সাবেস্তন কাফের বাইরে গলিপথে দাঁড়িয়ে প্রায় রোজ একজন শ্রমিক দিনের কাজ থেকে এসে আর একজন শ্রমিকের হাতে একটা করে পিস্তল তুলে দিত। এমনি করে ফবুর্গ অঞ্চলের বিপ্লবী শ্রমিকদের ব্যাপকভাবে অস্ত্র সরবরাহ করা হতে থাকে। ন্যালে নামে একটি লোক বলে, তার কাছে ৭০০ কার্তুজ আছে।
একজন আসবাপত্র বিক্রেতা অন্য একজন দোকানদারকে বলে, আমরা এবার কাৰ্থ আক্রমণ করব।’ তখন অন্য দোকানদার বলে, তোমরা শীঘ্রই আক্রমণ শুরু করবে। গত মাসে তোমরা সংখ্যায় ছিলে পনেরো হাজার। এখন হয়েছ সংখ্যায় পঁচিশ হাজার।
বিপ্লবের এই উত্তাপ-উত্তেজনা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। শুধু প্যারিস নয়, ফ্রান্সের কোনও অঞ্চল বাদ পড়েনি। বিপ্লবের এই প্রস্তুতির জন্য কতকগুলি সংস্থা গড়ে উঠেছিল যেমন সোসাইটি অফ ফ্রেন্ডস অফ দি পিপল আর দি রাইট অফ ম্যান। লিগ অফ দি রাইট অফ ম্যান আবার লিগ অফ অ্যাকশন নামে আর একটি দল গড়ে তোলে।
প্যারিসের পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চলে বিপ্লবের এই উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। লেয়নস, নান্তে, লিলে, আর মার্শাই অঞ্চলে দি লিগ অফ দি রাইট অফ দি ম্যান-এর কাজকর্ম বেড়ে যায়। তবে প্যারিসের ফবুর্গ সেন্ট আলতানের থেকে ফবুর্গ সেন্ট মার্সোতে বিক্ষোভ বেড়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ স্কুল-কলেজের ছাত্রাবাসগুলোতেও শ্রমিকদের অঞ্চলের মতোই বিপ্লবের উত্তপ্ত প্রস্তুতি চলতে থাকে।
সেনাবাহিনীর লোকেরাও এই গণবিপ্লবে যোগদান করতে থাকে। বেনকেতি, লুনেভিল ও এপিনালে যে বিদ্রোহ দেখা দেয় তাতে সেনাবাহিনীর অনেক লোকও ছিল। বিপ্লবীরা সেনাবাহিনীর সমর্থনের ওপর অনেকখানি নির্ভর করত।
এই ছিল তখনকার বিপ্লবের অবস্থা। তবে এ বিপ্লবের প্রস্তুতিপর্বের কেন্দ্রস্থল ছিল ফবুর্গ সেন্ট আঁতোনে। এই অঞ্চলের পরিশ্রমী, সাহসী ও মৌমাছির মতো স্পর্শকাতর শ্রমিকরা দলে দলে প্রস্তুত হয়ে উঠছিল বিপ্লবের জন্য। কিন্তু তারা তাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম বন্ধ করেনি। বিপদের সময়ে তাদের দারিদ্র আর বুদ্ধি দুটোই বেড়ে যায়।
ফবুর্গ সেন্ট আঁতোনেতে বৈপ্লবিক কর্মতৎপরতার যে আতিশয্য আর উত্তাপের আধিক্য দেখা যায় তার কারণও ছিল যথেষ্ট। অর্থনৈতিক সংকট এই অঞ্চলেই চরমে ওঠে। অভাব, ধর্মঘট আর বেকারত্ব অশান্ত আর বিক্ষুব্ধ করে তোলে এ অঞ্চলের লোকদের। আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন, আত্মাভিমানী, পরিশ্রমী শ্রমিকরা দীর্ঘদিনের অবজ্ঞা ও অবহেলায় প্রচণ্ডভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তাদের অন্তর্নিহিত সমস্ত শক্তি সংহত ও সুসংবদ্ধ হয়ে ফেটে পড়তে থাকে। শুধু স্ফুলিঙ্গের প্রতীক্ষায় স্তব্ধ হয়ে থাকে তারা।
আমরা আগেই যে সব মদের দোকানগুলোর কথা উল্লেখ করেছি সেগুলো বৈপ্লবিক কাজকর্মের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে। এই সব দোকানগুলোতে যারা আসত তারা মদের থেকে উত্তেজনাময় কথায় মত্ত হয়ে উঠত বেশি।
বিভিন্ন জায়গায় বিপ্লবের যে দুর্ভেদ্য প্রাচীর গড়ে ওঠে তার মাঝে জনগণের সার্বভৌমত্ব উঁকি দিতে পারে। এই বিপ্লবী জনগণের আচরণ সব সময় ভালো না হতে পারে, তাদের কিছু ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে। সেই সব ভুলভ্রান্তি সত্ত্বেও তাদের মহত্ত্ব অক্ষুণ্ণ থাকে। তারা কী চেয়েছিল?
তারা চেয়েছিল সমস্ত অত্যাচার আর অবিচারের অবসান ঘটাতে। সব বেকার লোকের জন্য কাজ আর ছেলেমেয়েদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা চেয়েছিল। তাদের স্ত্রীদের জন্য চেয়েছিল নিরাপত্তা চেয়েছিল সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা এবং যথেষ্ট খাদ্য। তারা চেয়েছিল পৃথিবীকে স্বর্গ করে তুলঁতে। তারা চেয়েছিল প্রগতি, জাতীয় অগ্রগতি। তবে তাদের চাওয়ার ধরনটা ছিল ভয়ঙ্কর। তাদের মুখে ছিল উত্তপ্ত শপথ এবং হাতে ছিল অস্ত্র। তারা সভ্যতার জন্যই বর্বর হয়ে পড়েছিল।
.
৬.
এঁজোলরাস এই সময় তার শিষ্যদের সংখ্যা আর মনের অবস্থাটা একবার যাচাই করে দেখতে চাইল। সেদিন কাফে মুসেঁতে আলোচনা চলছিল ওদের নিজেদের মধ্যে। সে উপমা-অলঙ্কার সহযোগে তাদের বোঝাতে লাগল। সে বলল, এখন দেখ তো আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, আমাদের প্রকৃত অবস্থা কী। এমন সব সক্রিয় লোকদের আমাদের খুঁজে নিতে হবে যারা লড়াই করতে পারবে। এখন দেখতে হবে আমাদের দলে কত লোক আছে। এখন নষ্ট করার মতো সময় নেই। তাড়াতাড়ি সব কাজ সারতে হবে। আমরা কতখানি এগিয়েছি তা পর্যালোচনা করে দেখতে হবে। এক অপ্রতাশিত ঘটনার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। কুরফেরাক, তুমি পলিটেকনিক ছাত্রদের কাছে গিয়ে দেখ, আজ তাদের ছুটির দিন। আজ বুধবার। ফুলি, তুমি গ্রেসিয়ারের শ্রমিকদের কাছে যাও। কমবেফারে বলেছে সে পিকপাসে যাবে, সেখানে অনেক ভালো লোক আছে। প্রভেয়ার, তুমি র্যু দ্য গ্রেনেলে রাজমিস্ত্রিদের কাছে যাবে, তারা হতোদ্যম হয়ে পড়েছে। জলি দুপুত্রেন হাসপাতালে গিয়ে মেডিকেল ছাত্রদের অবস্থাটা যাচাই করে দেখবে। বোসেত প্যানে দ্য জাস্টিনে গিয়ে আইনের ছাত্রদের সঙ্গে দেখা করবে। আমি কুরবোর্গের ব্যাপারটা দেখব।
কুরফেরাক বলল, এরাই হল আমাদের সব?
না।
আর আমাদের দলের লোক কোথায় আছে?
আছে।
কমবেফারে বলল, তারা কারা?
এঁজোলরাস বলল, ব্যারিয়ের দু মেন।
কিছুক্ষণ নীরবে ভেবে নিয়ে সে আবার বলল, ব্যারিয়ের দু মেনে মর্মরপ্রস্তরের কাজ করে এমন কিছু শ্রমিক আছে। স্টুডিওতে কিছু শিল্পী ও শ্রমিকও আছে। সম্প্রতি তারা উদ্যম হারিয়ে ফেলেছে। তারা শুধু ডোমিনো খেলে সময় কাটায়। তারা কাফে রিশেফুতে বেলা বারোটা থেকে একটার মধ্যে থাকে। আমাদের কেউ গিয়ে তাদের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলবে। নিবে আসা ওই সব কাঠগুলোকে ফুঁ দিয়ে আবার জ্বালিয়ে দিতে হবে। সুতরাং সেখানে যাবার মতো একজন কাউকে চাই। সেখানে পাঠাবার মতো কোনও লোক পাচ্ছি না। ভাবুক মেরিয়াস তো এখন এখানে আসেই না।
গ্রান্তেয়ার বলল, একজন আছে। সে হচ্ছে আমি।
তুমি?
কেন নয়?
তুমি প্রজাতন্ত্রের নীতিগুলো ব্যাখ্যা করে লোকদের জাগাবে।
কিন্তু কেন আমি ওখানে যাব না?
তুমি গেলে কি ভালো হবে?
গ্রান্তেয়ার বলল, চেষ্টা করে দেখতে চাই।
তুমি তো এসব কিছু বিশ্বাসই কর না।
তোমার প্রতি আমার বিশ্বাস আছে।
গ্রান্তোয়ার, তুমি কি সত্যিই আমার কিছু উপকার করতে চাও?
তুমি যা বলবে আমি করব; তোমার জুতোতে কালি পর্যন্ত দিয়ে দেব।
তা হলে আমাদের এ সব কাজ থেকে দূরে থাক।
এটা তোমার অকৃতজ্ঞতার পরিচয় এঁজোলরাস।
তুমি কি সত্যিই সত্যিই মনে কর ব্যারিয়ের দু মেনে যাবার উপযুক্ত লোক তুমি, তুমি এ কাজ করতে পারবে?
আমি ভগিয়ার্দ, এসাস ও র্যু দ্য মঁতপার্নেসি হয়ে কাফে রিশেফুতে যাব।
কাফে রিশেফুতে ওদের চিনতে পারবে?
খুব ভালো একটা চিনি না, তবু কিছুটা বন্ধুভাব আছে।
কী বলবে তাদের?
আমি তাদের রোবোসপিয়ার আর দাঁতনের নাম উল্লেখ করে বিপ্লবের কথা বলল।
তুমি তা পারবে?
হা পারব। আমাকে কেউ বুঝতে পারে না। কোনও একটা কাজে গেলে আমি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠি। আমি প্রুধো ও লা সোশ্যাল কনস্ট্রাক্ট পড়েছি। আমি দ্বিতীয় বর্ষের সংবিধানও পড়েছি। যেখানে নাগরিকদের স্বাধীনতা শেষ হচ্ছে সেখানেই শুরু হচ্ছে নতুন নাগরিক। তুমি কি মনে কর আমি অজ্ঞ? মানুষের অধিকার, জনগণের সার্বভৌমত্ব–আমি সব জানি। আমি কিছুটা হেবার্তিস্তুও। দরকার হলে আমি ছ ঘণ্টা একটানা বসে গভীরভাবে পড়াশোনা করতে পারি।
এঁজোলরাস বলল, গুরুত্ব দিয়ে কথা বল।
হ্যাঁ, গুরুত্ব দিয়েই বলছি।
কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে এঁজোলরাস সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলল। সে গম্ভীরভাবে বলল, ঠিক আছে গ্রান্তেয়ার। আমি তোমাকে পরীক্ষা করব। তুমি ব্যারিয়ের দু মেনে যাবে।
গ্রান্তেয়ার কাফে মুসেঁর কাছাকাছি একটা ভালো ঘরে থাকত। সে তার ঘরে চলে গিয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই রোবোসপিয়ার মার্কা একটা ওয়েস্টকোট পরে ফিরে এল। সে এঁজোলরাসের দিকে অপূর্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, তাকাবার কোনও কারণ নেই।
এই বলে মাথায় টুপিটা চাপিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
পনেরো মিনিটের মধ্যে কাফে মুর্সের পেছন দিকের ঘরটা খালি হয়ে গেল। এবিসি সংস্থার সব সদস্যরা তাদের আপন আপন কাজে বেরিয়ে গেল। সবশেষে গেল এঁজোলরাস।
প্লেস দ্য ইসির একটা পরিত্যক্ত ঘরে কুগোর্দের সদস্যরা বসত। পথে সব কিছু খুঁটিয়ে ভেবে দেখতে লাগল এঁজোলরাস। সমাজে যখন গোলমাল দেখা দেয় এবং তার প্রতিকারের জন্য কিছু একটা কাজ শুরু করা হয় তখন সামান্য একটা জটিলতাকে এক বিরাট বাধা বলে মনে হয়। এখন বিস্ময়ের কাজ শুরু করা ঠিক হবে না। দিগন্তব্যাপী মেঘমালার ওপার থেকে এক নতুন উজ্জ্বল প্রভাত উঁকি মারছিল এঁজোলরাসের চোখের সামনে। সে ভাবতে লাগল, কে বলতে পারে, অচিরে এমন একদিন আসবে যখন বিপ্লবের বেগবান স্রোতোধারা সমগ্র ফ্রান্সকে পরিপ্লাবিত করে ফেলবে এবং জনগণ তাদের অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করবে। সে দেখল তার হাতে এমন একদল বন্ধু আছে যারা সারা ফ্রান্সে বক্তৃতা দিয়ে জনগণকে উত্তেজিত করে বেড়াচ্ছে। সেই সব বক্তৃতার মধ্যে আছে কমবেফারের গম্ভীর দার্শনিক বাগিতা, ফুলির বিভিন্ন ভাষার জ্ঞান, কুরফেরাকের অত্যুৎসাহিতা, বাহোরেলের হাস্যরস, জাঁ ভেয়ারের বিষণ্ণ গাম্ভীর্য, জলির পাণ্ডিত্য, বোসেতের শ্লেষাত্মক ভঙ্গি। তাদের এই সব গুণগুলো একযোগে প্রচারের সঙ্গে নিয়োজিত হচ্ছে। কাজ সব ঠিকই চলছে।
এবার হঠাৎ গ্রান্তেয়ারের কথা মনে পড়ে গেল তার। ব্যারিয়ের দু’ মেন বা কাফে রিশেফু এখান থেকে বেশি দূরে নয়। কাফেতে এখন কারা কী করছে সেটা যদি এখন নিজে গিয়ে দেখে আসে তা হলে ক্ষতি কী?
এঁজোলরাস কাফে রিশেফুতে গিয়ে বাইরে থেকে দেখল ঘরের ভেতরে ডোমিনো খেলা চলছে। সমস্ত ঘরটা ধোঁয়ায় ভর্তি। গ্রান্তেয়ার একটা লোকের সঙ্গে কথা বলছিল। তাদের মাঝখানে একটা টেবিল ছিল।
এঁজোলরাস শুনতে পেল গ্রান্তেয়ার টেবিলের উপর একটি ঘুষি মেরে বলল, ছয় ডবল।
অন্য লোকটি বলল, চার।
গ্রান্তেয়ার ডোমিনো খেলায় মত্ত হয়ে উঠেছে একেবারে।