হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালা
এই কাহিনির তিনটি পর্ব, যা আমাদের নিকট অতীতের বাঁকবদলের আখ্যান। ১৯৬০-এর দশক ছিল আমাদের উত্থানপর্ব, যখন বাঙালি একটি ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র তৈরির স্বপ্ন দেখেছে। এই দশকে এ দেশের মানুষের মনোজগতে ঘটেছে বড় রকমের পরিবর্তন। এর চূড়ান্ত ফয়সালা দেখা যায় উনসত্তরের গণ-আন্দোলন এবং সত্তরের নির্বাচনে। এরপর আর পেছনে ফিরে যাওয়ার উপায় ছিল না। ষাটের দশকের শেষ দিকে শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশের প্রধান রাজনৈতিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। তিনি হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। সত্তরের নির্বাচনের একতরফা ফলাফলেই সংকটের ইঙ্গিত ছিল। নিয়মতান্ত্রিক পথে এর মীমাংসা হয়নি। যুদ্ধ ছিল অনিবার্য। ভূরাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক বাস্তবতায় শুরুতেই এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ভারত। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে দেখতে হবে এই প্রেক্ষাপটে।
যুদ্ধ শেষ হয়েও শেষ হলো না। স্বাধীনতার পক্ষে সাধারণ ঐকমত্য ছিল। প্রতিপক্ষ পাকিস্তান ছিল আক্রমণকারী, জনগণের চোখে বিদেশি। বাহাত্তরে প্রেক্ষাপট গেল পাল্টে। চোখের সামনে পাকিস্তান আর নেই। দেশ কীভাবে চলবে, তা নিয়ে মতভিন্নতা তৈরি হলো। এ নিয়ে বেধে গেল লড়াই। একদিকে মতাদর্শের দ্বন্দ্ব, অন্যদিকে রাষ্ট্রক্ষমতায় অংশীদারত্বের দাবি।
এই সময়ের আখ্যানে জড়িয়ে আছেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তাঁদের একজন হলেন সিরাজুল আলম খান। তাঁকে নিয়ে আছে অনেক আলোচনা সমালোচনা, আছে কৌতূহল, আছে বিতর্ক ও বিভ্রান্তি। একসময় তাঁর পরিচয় হয়ে গেল রাজনীতির রহস্যমানব।
রাজনীতির চরিত্রগুলো মঞ্চের উজ্জ্বল আলোয় দেখতে আমরা অভ্যস্ত। সেখানে দাঁড়িয়ে তারা ভালো ভালো কথা বলেন, আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনি। মঞ্চের পেছনে থাকে সাজঘর বা গ্রিনরুম। সেখানে গেলে তাদের আসল চেহারা দেখা যায়। সুন্দর পোশাক আর প্রসাধনচর্চিত মুখ দেখে আমরা ব্যক্তিত্ব বিচার করি। হাসপাতালের অপারেশন টেবিলে সার্জন যখন কারও শরীর কাটাকুটি করেন, তখন রক্ত-মাংস-অস্থি বেরিয়ে আসে। তাকে আর সুন্দর দেখায় না। কিন্তু ওটাই তো সত্যিকার মানবদেহ। বাইরে থেকে আমরা শুধু আবরণটাই দেখি।
সময় ও সময়ের চরিত্রগুলোর ব্যবচ্ছেদ করতে বসলে আমরা নির্মম ও স্কুল বাস্তবতার মুখোমুখি হই। সময় ও ব্যক্তিকে রঙিন মোড়কে উপস্থাপন করার। যে রেওয়াজ চালু আছে, তার মধ্য থেকে সত্য ঘেঁকে তোলা বেশ কঠিন। সত্য বেরিয়ে এলে আমরা অবাক হই।
আত্মস্মৃতি যারা লেখেন, তারা অনেক কিছুই উল্লেখ করেন না। একজন ব্যক্তি বা একটি সময়কে নানাভাবে দেখা বা বিচার করা যায়। জীবন তো বহুমাত্রিক। এর বিশেষ একটি দিককে গুরুত্ব দিয়ে এবং অন্য দিকগুলো পাশ কাটিয়ে গেলে ইতিহাসের ওপর সুবিচার হয় না। একপেশে বয়ান থেকে একজন ব্যক্তি সম্পর্কে সরল উপসংহার টানা যায়–তিনি নায়ক অথবা খলনায়ক, বিপ্লবী অথবা প্রতিবিপ্লবী, যুগস্রষ্টা অথবা ষড়যন্ত্রকারী। ব্যক্তি কিন্তু একজনই। তার শুক্লপক্ষ-কৃষ্ণপক্ষ দুই-ই আছে। অথচ আমরা কত অনায়াসে বলে দিই, তিনি দেবতা, নয়তো দানব।
রামায়ণের উদাহরণ দেওয়া যাক। রাক্ষসরাজ রাবণ একজন খলনায়ক। অথচ কী অপরূপ ছন্দে পরম মমতায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত সৃষ্টি করলেন। মেঘনাদবধ কাব্য, যেখানে রাবণ আর মেঘনাদ হলেন বীর, রাম-লক্ষ্মণ হলেন। হানাদার তস্কর।
সিরাজুল আলম খান এবং তাঁর নিউক্লিয়াস’ নিয়ে একাডেমিক আলোচনা বেশি হয়নি। তাকে নিয়ে যেমন অতিরঞ্জন আছে, তেমনি আছে অস্বীকৃতি। আমিই সব করেছি’–এ রকম বাগাড়ম্বর কিংবা আস্ফালন যেমন আছে, আবার ‘আমি এত গুরুত্বপূর্ণ অথচ কিছুই জানলাম না’–এ। রকম আক্ষেপও আছে।
ষাটের দশকে সিরাজুল আলম খানের উত্থান ছাত্রনেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের হাত ধরে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছায়াতলে। এ সময় আরও কয়েকজন তরুণ ছাত্রনেতা মাঠ কাঁপিয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের ফারাক এক জায়গায়–তিনি ধারাবাহিকভাবে লেগে ছিলেন। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হয়ে যাওয়ার পর মাথার ওপর ছায়াটি আর ছিল না। তখন তাকে পথ চলতে হয়েছে নিজ শক্তিতে ও বুদ্ধিতে। সঙ্গে পেয়েছেন অনেক উদ্যমী তরুণকে। সবাইকে ছাঁচে ঢেলে তিনিই তৈরি করেছেন, এমন নয়। সবার মনেই স্বপ্ন ছিল। সিরাজুল আলম খান হয়ে উঠলেন তরুণ মনের স্বপ্নের সওদাগর। তিনি নিজেই বলেছেন, শেখ মুজিবের ছয় দফা তার বুকের মধ্যে আগুন জ্বেলে দিয়েছিল। উনসত্তরে মুজিব যখন জেল থেকে ছাড়া পান, দেখলেন তার জন্য জমি তৈরি হয়ে আছে, যার ওপর ভরসা করে বীজ বোনা যায়। জমি তৈরির এ কাজটি করেছেন সিরাজুল আলম খান। শেখ মুজিবকে নেতা মেনেই তিনি এটি করেছেন। এখানে তিনি মুজিবের প্রতিদ্বন্দ্বী নন। বরং বলা যায় প্রডিজে’। এর যথার্থ বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজে পাওয়া ভার। কাছাকাছি শব্দ হলো ‘আস্থাভাজন শিষ্য। এ ধরনের একটি সম্পর্ক ও অবস্থান দাঁড় করালে শেখ মুজিব ছোট হয়ে যান না, সিরাজুল আলম খানকেও অপাঙক্তেয় ঘোষণা করতে হয় না।
বাংলাদেশের উত্থান হলো একটি জনগোষ্ঠীর জেগে ওঠার মহাকাব্য। এর পরতে পরতে আছে যুগ যুগ ধরে মানুষের যূথবদ্ধ প্রয়াস। এখানে অনেক কারিগর, অনেক বীর। সিরাজুল আলম খান তেমনই একজন, একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, যিনি শ্রম-ঘাম-মেধা দিয়ে বাংলাদেশের উত্থানপর্বে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধপর্বটি এখনো রয়ে গেছে অনেকটাই অজানা। এই সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান হলো মুজিববাহিনী। এ নিয়ে আছে অনেক ধোঁয়াশা। যুদ্ধ জয়ের প্রথম শর্ত হলো একতা। দরকার স্বাধীনতার পক্ষের সব শক্তির এককাট্টা হওয়া। সেটি কেন হলো না? রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের সঙ্গে থিয়েটার রোডের যোদ্ধাদের সমন্বয়ে ঘাটতি কেন ছিল? মুজিববাহিনীর আলাদা কমান্ড কাঠোমো কেন গড়ে উঠল? কেন সরকারের বিভিন্ন অংশের মধ্যে দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাস ও টানাপোড়েন তৈরি হলো? আজ হোক কিংবা কাল, এর একটা ব্যাখ্যা তো পেতে হবে।
একাত্তর-পরবর্তী পর্বটি জটিল ও স্পর্শকাতর। প্রশ্ন উঠেছিল, দেশ কি প্রস্তুত হওয়ার আগেই স্বাধীন হয়ে গেছে? একটি স্বাধীন দেশ কীভাবে চলবে, তার জন্য কি কোনো রূপকল্প ছিল? এ তো মধ্যরাতে ক্ষমতার হাতবদল ছিল না। এত রক্ত, এত মৃত্যু, একটি জনযুদ্ধ–এসবের মধ্য দিয়ে যে রাষ্ট্রটির জন্ম হলো, তাকে গড়েপিটে তোলার কোনো ছক-নকশা তো ছিল না? অথচ আমাদের অগ্রাধিকারের তালিকার চূড়ায় জায়গা পেল তড়িঘড়ি করে প্রচলিত নিয়মকানুন আর রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ঝাড়পোঁছ দিয়ে রেখে দেওয়া। ইংরেজ আর পাকিস্তানি যুগের রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক কাঠামো রয়ে গেল অবিচ্ছিন্ন, অবিকল।
জন্মক্ষণেই দেশ দুই পরাশক্তির শীতল লড়াইয়ের মধ্যে পড়ে যায়। দেশের ভেতরে রাজনৈতিক মতপার্থক্য ছিল চোখে পড়ার মতো। মুসলিম লীগের পুরোনো সংস্কৃতির পুনর্জন্ম হলো। আমরা দেশ স্বাধীন করেছি, আমরাই দেশপ্রেমিক, আমরাই দেশ চালাব, অন্যরা সব ষড়যন্ত্রকারী, দেশদ্রোহী, দুষ্কৃতী–এ রকম ভাবনা জেকে বসল। একে অন্যকে বিদেশের দালাল বলার মাতম শুরু হলো। ষড়যন্ত্রতত্ত্বের ঘেরাটোপে বন্দী হলেন সবাই। ঠিক এ সময় মঞ্চে হাজির হলো জাসদ। দলটি তরুণদের একটি বড় অংশকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। যাদের বয়স পঁচিশের নিচে, তাদের কাছে জাসদ হয়ে উঠল একটা স্বপ্ন, রোমাঞ্চ, ক্রেজ। মধুসূদন দত্তের শব্দাবলি কী দারুণভাবে সত্য হয়ে উঠল :
আসিতেছে দ্রুতগতি চারিদিক হতে
ঝাঁকে ঝাকে আসে যথা পতঙ্গের দল
দেখি অগ্নিশিখা–হ্যায়, পুড়িয়া মরিতে।
(মাইকেল মধুসূদন দত্ত : তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য)
তারুণ্যের এ জোয়ার শুধু ষড়যন্ত্রতত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না। এ এক অভিনব উদ্ভাসন। এ ছিল যুদ্ধোত্তর প্রবণতা, যা ছিল অনিবার্য।
একটি প্রক্রিয়া বা দল যারা পরিচালনা করেন, তারা সবাই সক্রেটিস বা আলেকজান্ডার হন না। অথবা হন না একজন স্থপতি, যিনি মাপজোক করে নকশা এঁকে তারপর দালান তৈরির সিদ্ধান্ত দেবেন। সবকিছু সাজিয়ে-গুছিয়ে ব্লু-প্রিন্ট বানিয়ে সমাজে ঝড় তোলা যায় না। করতে করতে শেখা–এ রকম একটি কথা চালু আছে। যখন আমরা শিখি না, শিখতে চাই না, তখনই তৈরি হয় সংকট। বাহাত্তরেই দেশ পড়ে গেল সংকটে।
রাজনীতিতে আদর্শ, তিতিক্ষা, আত্মত্যাগ–এসব আছে। এর পাশাপাশি আছে উগ্রতা, একগুঁয়েমি, শঠতা ও প্রতিহিংসা। যারা নির্দিষ্ট একটি মত ও পথের যাত্রী, তারা তাদের ওপর অন্যের চাপিয়ে দেওয়া নানান বিশ্লেষণের সঙ্গে একমত হবেন না। চে গুয়েভারা স্বজনদের কাছে বিপ্লবী, প্রতিপক্ষের চোখে সন্ত্রাসী। এ দেশে অনেকেই চে হতে চেয়েছেন। তাঁরা নিজেদের বীর, বিপ্লবী মনে করেন। প্রতিদ্বন্দ্বী-প্রতিপক্ষের চোখে তাঁরা পথভ্রষ্ট, হঠকারী, দুষ্কৃতী। অথবা জুতসই কোনো শব্দ হাতের কাছে খুঁজে না পেলে অপছন্দের লোককে ট্রটস্কিবাদী বলে নাকচ করে দেওয়ার লোকের অভাব নেই।
সিরাজুল আলম খানের বিরুদ্ধে একটি বড় অভিযোগ–তিনি তরুণ প্রজন্মকে ভুল পথে নিয়ে গেছেন। তিনি কি জেনেবুঝে এ কাজ করেছেন? তিনি কি উন্মাদ? নিজ হাতে একটি দল তৈরি করে সেটিই আবার ছিন্নভিন্ন করে দিলেন? এ রকম অভিযোগ উঠেছে দলের ভেতর থেকেই। সবচেয়ে বড় জিজ্ঞাসা, হাজার হাজার তরুণ কিসের আশায় তাঁর সহযাত্রী হলেন? তিনি কি হ্যাঁমিলিনের বাঁশিওয়ালা? একসময় যাঁরা তাঁকে ব্যবহার করেছিলেন, তারা তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন কেন? অসহিষ্ণু উঠতি মধ্যবিত্ত, যারা একদিন তারুণ্যের এই উদ্ভাসনকে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে লড়তে দেখে পেছন থেকে হাততালি দিয়েছেন, তাঁরাই পরে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন নতুন কুশীলবের দেখা পেয়ে। একসময় তারা বলতে শুরু করলেন–এরা বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি করছে, নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে, নষ্ট হয়ে গেছে। শুধু আন্দোলন, হরতাল, বোমাবাজি! আল মাহমুদ লিখলেন ‘আমিও রাস্তায়’ :
দিল বাইন্ধা পথঘাট, বাস গাড়ি মোটর দোকান
গোলমালের কারিগর ইটা মারে মুরব্বির গায়।
সাহস দেখো না মিয়া, বে-তমিজ বান্দীর পুতেরা
মাইনষের লওয়ের মতো হাঙ্গামার নিশান উড়ায়।
(আল মাহমুদ : সোনালি কাবিন)
রাজনীতি যেহেতু মানুষকে নিয়ে, রাজনীতিবিদেরা সব সময় জন আলোচনায় থাকেন। তারাও ভুল করেন। তখন সমালোচনা বা গালাগালের শিকার হন। এ থেকে কারও রেহাই নেই। এ জন্য তারা নিজেরাও দায়ী। নিজের অবস্থানটি ঠিকমতো ব্যাখ্যা করতে না পারার কারণে তারা প্রায়ই প্রশ্নবিদ্ধ হন। কেউ কেউ ভুল স্বীকার করেন না। বরং ভুলের পক্ষে সাফাই। গান। নিজেকে সবজান্তা মনে করেন, মনে করেন অভ্রান্ত। এই মানসিকতা। একধরনের অহংকার বা ইগো থেকে আসে। সোজা কথায় এ হলো নিছক গোঁয়ার্তুমি। সিরাজুল আলম খানও এর ব্যতিক্রম নন।
সিরাজুল আলম খান ও জাসদের কথা মানুষ ভুলতে বসেছিল। দলটি এখন খণ্ড-বিখণ্ড, আগের তেজ নেই। আমি বলি, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাসদ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়, ৭ নভেম্বর এর মৃত্যু হয়। এরপর থেকে এর কঙ্কালটাই টেনে বেড়ানো হচ্ছে। একই সঙ্গে সিরাজুল আলম খানও গেছেন অস্তাচলে।
২০০০ সালে আমি একটি উদ্যোগ নিয়েছিলাম। একটি প্রীতিসম্মিলনীর আয়োজন করেছিলাম নীলক্ষেতে আনোয়ারা রেস্টুরেন্টে। নাম দিয়েছিলাম আনোয়ারা রেস্টুরেন্ট ককাস। ষাটের দশকের শেষ দিকে, বিশেষ করে ১৯৭০-৭১ সালের উত্তাল দিনগুলোতে আমরা অনেকেই সেখানে রাতে খেতে এবং আড্ডা দিতে যেতাম-রাজনৈতিক আচ্ছা। আমাদের মধ্যমণি ছিলেন সিরাজুল আলম খান। এ নিয়ে আমাদের মধ্যে একধরনের নস্টালজিয়া কাজ করে। এ অনুষ্ঠান আয়োজনে আমাকে সাহায্য করেছিল প্রয়াত বন্ধু একরামুল হক। আমন্ত্রিতদের তালিকা মূলত তাঁরই তৈরি। সেখানে যাদের আসতে বলেছিলাম, তাঁরা কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছিলেন :
হু ইজ সিরাজুল আলম খান?
এ মিটিং ডাকার উদ্দেশ্য কী?
এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো পলিটিকস আছে?
ও কার হয়ে কাজ করছে?
তারপরও ৫০ জনের মতো হাজির হয়েছিলেন। সিরাজুল আলম খানও এসেছিলেন। সেদিন বিজয় দিবস, রোজার দিন ছিল। আমরা একসঙ্গে ইফতার করলাম। সিরাজুল আলম খান বললেন, বুলবুল একটা ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। এটা চালু থাকুক। ও হবে এর কো-অর্ডিনেটর। পরদিন দৈনিক জনকণ্ঠএ বিশাল নিউজ ছাপা হয়েছিল। সম্ভবত তিনিই এটা করিয়েছিলেন।
তাঁকে নিয়ে একটি স্মারকগ্রন্থ বের করার উদ্যোগ নিলাম। আমার সহযোগী হলেন রেজাউল হক মুশতাক ও আবু করিম। আবু করিম আমাদের তিনজনের নামে যৌথ ব্যাংক অ্যাকাউন্টও খুললেন। লেখা চাইলাম অনেকের কাছে। প্রথম লেখাটি পাঠালেন আ স ম আবদুর রব। আমি বার দুয়েক শিবনারায়ণের বাসায় গিয়ে তাঁর কাছ থেকে একটা লেখা নিয়ে এলাম। আর কেউ সাড়া দেননি। আর কারও আগ্রহ দেখলাম না। বিষয়টা ওখানেই চাপা পড়ে গেল।
সিরাজুল আলম খানের নায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। মুজিবে মোহমুগ্ধ ছিলেন তিনি। একসময় তিনি বিদ্রোহ করলেন। সঙ্গীদের চোখে তিনি হলেন প্রতিনায়ক। তৈরি হলো তাঁর কাল্ট। অর্থশাস্ত্রে মার্জিনাল ভ্যালু বা প্রান্তিক উপযোগিতার তত্ত্ব আছে। সঙ্গীরা একে একে তাঁকে ত্যাগ করায় তার প্রান্তিক মূল্যমান ঠেকে শূন্যের কোঠায়। তিনি এখন ‘রেচিড অব পলিটিকস’–রিক্ত, পরিত্যক্ত। তাকে ঘিরে যারা বিপ্লবের মন্ত্র জপেছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগ এখন দলীয় রাজনীতি থেকে অবসরে। বাকিরা নানান শিবিরে বিভক্ত। একদা স্বপ্নবাজ অ্যাংগ্রি ইয়াংম্যানরা এখন ইতিহাসের জাবর কাটেন।
সিরাজুল আলম খান লেখালেখি করে সময় কাটান। তাঁর লেখা বিদ্বজ্জনের টেবিলে ঠাই পায় না। এ নিয়ে তার ভ্রূক্ষেপ নেই। তাঁর গুরু ও ঘনিষ্ঠজনেরা অনেকেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। একদিন তিনিও চলে যাবেন। প্রকৃতির এটাই নিয়ম।
বেশ কিছুদিন আগে আমি তার কাছে গিয়েছিলাম। সঙ্গে ছিলেন সুমন মাহমুদ। তিনি কিছু কথা বলার আগ্রহ দেখালেন। সুমনকে বললেন রেকর্ড করতে। যথারীতি এর ভিডিও হলো। তিনি তাঁর শেষ ইচ্ছার কথা বললেন। ‘আমার মৃত্যুর পর কোনো শোকসভা হবে না। শহীদ মিনারে ডিসপ্লে হবে না লাশ। যত দ্রুত সম্ভব নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে আমার গ্রামের বাড়িতে পাঠাতে হবে মরদেহ, যা ঢাকা থাকবে একটা কাঠের কফিনে। মায়ের একটা শাড়ি রেখে দিয়েছি। কফিনটা শাড়িতে মুড়ে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে, মায়ের কবরে।’
মানুষ যেখান থেকে আসে, সেখানেই ফিরে যায়। কেউ কেউ জায়গা করে নেন ইতিহাসের পাতায়। কেউ নায়ক হন, কেউ হন প্রতিনায়ক। তাঁরা ইতিহাস তৈরি করেন।