৪. হাত-মুখ ধুয়ে কিকিরা

০৪.

হাত-মুখ ধুয়ে কিকিরা আর তারাপদ চা খেতে বসেছে, লোচন এসে বলল, কতাবাবু আসছেন।

তারাপদর মনটাই বিগড়ে গিয়েছিল। সপ্তমী পুজোর সকালটা শুরু হয়েছিল ভাল, চমৎকার লাগছিল তারাপদর, চোখ জুড়িয়ে আসছিল, ঝরঝরে লাগছিল শরীর-মন, হঠাৎ কোত্থেকে একটা বন্দুক ছোঁড়ার আওয়াজে সব নষ্ট হয়ে গেল। কে বন্দুক ছুড়ল, কেনই বা ছুড়ল, তাও বোঝা গেল না।

কিকিরা বললেন, “দেখো তারাপদ, বন্দুক যেই ছুড়ক, আমাদের লক্ষ করে ছোড়েনি। তা যদি ছুড়ত তবে আগেই ছুড়ত। জিপে করে যখন আসছিলাম। বাড়িতে পৌঁছানোর পর কেন আমাদের দিকে নজর দেবে? ওটা অন্য কিছু। ফকির আসুক, জানা যাবে।”

যুক্তিটা তারাপদও স্বীকার করল। মন কিন্তু বিগড়েই থাকল।

“ফকিরবাবুর খুড়তুতো ভাইরা কোথায় থাকেন?” তারাপদ জিজ্ঞেস করল।

“ভাইরা মানে অমূল্যদের বাড়ি। সেবাড়ি এখান থেকে সিকি মাইলটাক হবে। এই যে বাড়ি দেখছ ফকিরদের, এই রকমই দেখতে, তবে বাহার একটু বেশি, আকার কিছু ছোট।”

“আপনি তো ওদের চেনেন?”

“মুখে চিনি একজনকে, ফকিরের খুড়তুতো ভাই অমূল্যকে। অমূল্যর ছেলেমেয়েদের চিনি না।”

“মানুষ কেমন?”

“সুবিধের নয় শুনেছি। বুদ্ধি খুব প্যাঁচালো, বুকের পাটা রয়েছে অমূল্যর, শুনেছি খুনটুন করিয়েছে, বেআইনি কাজকর্ম করে।”

তারাপদ এক কাপ চা শেষ করে আরও এক কাপ ঢালতে লাগল। এখানে সবই বোধ হয় এলাহি কাণ্ড। সাত-আট কাপ চা তৈরি করে একটা কাচের পটে করে দিয়ে গিয়েছে লোচন, বড় একটা কাচের প্লেটে একরাশ মিষ্টি।

চটির শব্দ পাওয়া গেল বাইরে। ফকির রায় ঘরে ঢুকলের। তারাপদ তাকাল।

কোনো সন্দেহ নেই, ফকির রায় সুপুরুষ। মাথায় বেশ লম্বা, ছ’ফুট তো হবেই’। গায়ের রঙ নিশ্চয় টকটকে লালই ছিল কোনো সময়ে, বয়েসে এবং এই কয়লার দেশে সে রঙ জ্বলে এখন তামাটে দেখায়। কাটা কাটা চোখমুখ, নাক লম্বা, গড়ন শক্ত। মাথার চুল কোঁকড়ানো। অবশ্য, চুল বেশি নেই মাথায়। অল্পস্বল্প পেকেছে।

ফকির একেবারে সাদামাটা পোশাকেই এসেছেন। পরনে দামি সাদা লুঙ্গি, গায়ে গেঞ্জি, হাতে সিগারেটের প্যাকেটে আর লাইটার। গলা আর গেঞ্জির ফাঁকে পইতে দেখা যাচ্ছিল।

“এই যে কিঙ্কর, তুমি তা হলে ঠিক সময়মতনই এসে পড়েছ?” ফকির বললেন।

কিকিরা বললেন, “আমি ভাবছিলাম, তোমারই না ভুল হয়ে যায়।..আলাপ করিয়ে দিই। এই হল সেই তারাপদ। এর কথা তোমায় বলেছি। আমার সাকরেদ। আর এক সাকরেদ–চাঁদু-ডাক্তার, সে পুজোর পর আসবে।” বলে কিকিরা তারাপদর দিকে তাকালেন, “তারাপদ, ফকিরের পরিচয় তো তুমি শুনেছ। এখন চোখে দেখো।”

তারাপদ হাত তুলে নমস্কার জানাল।

ফকিরও নমস্কার জানিয়ে কাছে এসে চেয়ার টেনে বসলেন।

কিকিরা বললেন, “নাও, চা খাও। আজ তোমার সকাল-সকাল ঘুম ভাঙল নাকি?”

বাড়তি কাপ ছিল। কিকিরা চা ঢেলে দিলেন।

ফকির বললেন, “ঘুমোলাম কোথায় যে ভাঙবে! সারা রাত জেগে। সকালে চোখ লেগেছিল, তা তুমি আসবে তো, একবার লোচনকে দেখতে বেরুলাম। ফিরে আর ঘুম এল না। নানান চিন্তা।” ফকির চায়ের কাপ তুলে নিলেন।

তারাপদ ফকিরের মুখ দেখছিল। মণির রঙ বেশ কটা, চোখের পাতা মোটা। সারা মুখে ক্লান্তি ও অশান্তির ছাপ। অনিদ্রার জন্যে ফকিরের চোখমুখ শুকনো দেখাচ্ছিল।

কিকিরা বললেন, “খানিকটা আগে বন্দুক ছোঁড়ার শব্দ হল? ব্যাপারটা কী?”

ফকির একটু চুপ করে থেকে বললেন, “বিশু ছুঁড়েছে।”

 কিকিরা যেন চমকে উঠলেন, “সে কী! বিশু? বিশু বন্দুক পেল কোথায়? তার কিছু হয়নি তো?”

“না, কিছু হয়নি।…বন্দুকটা আমার। কদিন ধরে ঘরে রাখছি, কেমন একটা ভয় এসে গিয়েছে কিঙ্কর। কিসের ভয় তোমায় ঠিক বোঝাতে পারব না। আমার শোবার ঘরে হাতের নাগালের মধ্যে রাখি বন্দুকটা।”

“তা না হয় রাখো; কিন্তু বিশুর হাতে গুলিভরা বন্দুক গেল কেমন করে? তা ছাড়া তুমি নিজেই জানো, বন্দুক তো বড় কথা, একটা সামান্য ছুরি ওর হাতে পড়াও সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার।

ফকির অপরাধীর মতন মুখ করলেন।”সবই জানি ভাই। তবু কেমন করে যে হল…।”

“কেমন করে?”

“আমার মনে হয়, আমি যখন নিচে লোচনকে ডেকে দিতে এসেছিলাম। তখন বোধহয় বিশু আমার ঘরে ঢুকছিল।”

“ও ঘুমোয়নি?”

“হয়ত রাত্তিরে ঘুমিয়েছিল। ঘুম ভেঙে গিয়েছিল শেষ রাত্রে।”

“ওকে তো ঘুমোবার ওষুধ খাওয়ানো হয়?”

“খায়। তবে সব সময় যে সমান কাজ করবে ওষুধে–তা তো নয়।”

কিকিরা আর কোনো কথা বললেন না। বোধ হয় ফকিরকে চা খাবার সময় দিলেন।

ফকির চা খেতে-খেতে একটা সিগারেট ধরালেন। অন্যমনস্ক চিন্তিত। তারাপদর দিকে তাকালেন ফকির। ম্লান হাসলেন, “আমি বেশ খানিকটা পারিবারিক গণ্ডগোলের মধ্যে আছি। কিঙ্করের কাছে শুনেছেন?”

মাথা হেলাল তারাপদ।”শুনেছি।…গুলির শব্দে বেশ ঘাবড়েই গিয়েছিলাম।”

ফকির সিগারেটের প্যাকেটটা তারাপদ দিকে ঠেলে দিলেন।”ঘাবড়ে যাবার মতনই ব্যাপার। বন্দুকে টোটা ভরা ছিল। বিশু একটা অঘটন ঘটাতে পারত। ঘটায়নি এই আমার সৌভাগ্য। মা বাঁচিয়েছেন।” ফকির হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বোধ হয় দেবী দুর্গাকেই স্মরণ করলেন।

তারাপদ বেশ খুঁটিয়ে লক্ষ করছিল ফকিরকে। শক্ত মানুষ নিশ্চয়, সংসারের আপদ-বিপদে পোড় খাওয়া, তবু ফকিরকে কেমন ভীত চিন্তিত দেখাচ্ছে।

কিকিরা হঠাৎ বললেন, “বিশু এমনিতে কেমন আছে?”

“সেই রকমই। উনিশ-বিশ। ভালমন্দ বোঝা যায় না। তবে আগের চেয়ে খারাপ নয়।”

“ডাক্তার আসছে?”

“কাল আসেনি। পরশু এসে দেখে গিয়েছে।”

“কে থাকছে ওর কাছাকাছি?”

“ওর মত থাকত। গত পরশু দিন ভবানী এসেছে। ভবানীই থাকে এখন।”

“ভবানী কে?”

“আমার ভাগ্নে। বড়দির ছেলে। বিশুর চেয়ে বছর দুয়েকেরে বড়, দুজনের মেলামেশা বরাবরই।“

কিকিরা চুপ করে গেলেন। কিছু ভাবছিলেন।

তারাপদ অনেকক্ষণ কথাবাতা কিছু বলেনি। তার মনে হল দু-একটা কথা বলা দরকার ফকিরবাবুর সঙ্গে, নয়ত বড় খারাপ দেখাচ্ছে। তারাপদ বলল, “বিশু বন্দুক ছুঁড়তে পারে? না এমনি অন্ধাড়াক্কা ছুঁড়ে ফেলেছে?”

ফকির তাকালেন তারাপদর দিকে, “পারে। আমার ছোট ছেলেও বন্দুক ছুঁড়তে জানে।”

কথাটা এমনভাবে বললেন ফকির যে, তারাপদর মনে হল, এ বাড়ির ছেলেদের ওটা শিখে রাখতেই হয়।

“ও বাড়ির খবর কী?” কিকিরা জিজ্ঞেস করলেন।

“অমূল্যদের কথা বলছ? কাল একবার এসেছিল। ওরাও আজকাল দুগা পুজো করে, বলতে এসেছিল। বিশুকে দেখতে চাইছিল। এড়িয়ে গিয়েছি।

কিকিরা কপাল কুঁচকে চোখ ছোট করে ফকিরকে দেখছিলেন। দেখতে-দেখতে বললেন, “কিছু বলল?”

“না, সরাসরি কিছু বলল না। তবে হাবেভাবে বুঝিয়ে গেল, বিশুকে কোথাও পাঠিয়ে দেওয়াই ভাল।”

“তুমি কিছু বললে না?”

“বলেছি। ঘুরিয়ে বলেছি। বিশুর যদি কেউ ক্ষতি করার চেষ্টা করে আমি তাকে ছেড়ে দেব না। আমার হাতে সে মরবে।” ফকিরের কটা চোখ ঝকঝক করে উঠল প্রতিহিংসায়।

কিকিরা তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে নিলেন।”না, না, এখন মাথা গরম করে কাজ করার সময় নয়, ফকির। মাথা গরম করলে কিচ্ছু হবে না। ঠাণ্ডা মাথায় যা করার করতে হবে। তা ছাড়া তুমি ভাবছ কেন? অমূল্যদের হাতে যদি তেমন কোনো প্রমাণ থাকত, তবে তারা থানা-পুলিশ না করে বসে থাকত নাকি এতদিন?”

“সবই জানি, ভাই। আমার বরাতের দোষ, নয়ত আর কী বলব, বলো? আমি নিজেই বুঝতে পারি না, বিশু কেন, কার পাল্লায় পড়ে ঘোড়াসাহেবের কুঠিতে গেল? কী দরকার ছিল তার ওখানে যাবার?”

কিকিরা বললেন, “ছেলেমানষ, এত কি বুঝতে পেরেছিল!..যাক, সে পরে ভাবা যাবে। এখন অন্য ক’টা কাজের কথা বলি, শোনো।”

“বলো?”

“তোমার কাছে তোমাদের সাত-পুরুষের একটা বংশলতিকা গোছের কি আছে না?”

“আছে একটা। সাতও হতে পারে, দশও হতে পারে।”

“সেটা একবার পাঠিয়ে দিতে পারো না?”

“অনায়াসেই পারি।”

“তা হলে পাঠিয়ে দিও, এ-বেলাতে।…এবার আর একটা কথা বলল, তোমার বাবা কাকারা তিন ভাই ছিলেন তো?”

“হ্যাঁ। তিন ভাই দুই বোন।”

“অমূল্যের বাবা তোমার মেজো কাকা? ছোট কাকা মারা গেছেন। কবে তুমি জানো?”

“জানি বই কি। বছর বারো–হাঁ, মোটামুটি তাই হবে।”

“তুমি বলেছিলে, এখানে মারা যাননি।

“না। ছোটকাকার শেষের দিকে সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসী ভাব হয়েছিল। বাড়ি ছেড়ে চলে যেত। কোথায় ঘুরে বেড়াত কে জানে! কেউ বলত শ্মশানে বসে সাধনা করে, কেউ বলত পঞ্চকোট পাহাড়ের তলায় ধুনি জ্বেলে বসে থাকে। আমরা সঠিক কিছু জানি না।”

“ছোটকাকা মারা গিয়েছেন, এটা কেমন করে জানলে?”

“একদিন এক গেরুয়া-পরা সন্ন্যাসী এসে খবর দিয়েছিল।”

“কী ভাবে মারা গিয়েছিলেন ছোটকাকা?”

“সাপের কামড়ে।”

“মৃতদেহ তোমরা কেউ দেখোনি তো?”

 “না। বরাকর নদীতে মৃতদেহ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল।”

“সেই কাকার কে কে আছে?”

“কাকিমা বেঁচে আছেন। কাকার ছেলেমেয়ে নেই। কাকিমা এখানে। কেন না। বহুকাল। বাপের বাড়ি কাশীতে সেখানেই থাকেন। আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক একেবারেই নেই। তা তুমি এ-সব জিজ্ঞেস করছ কেন? সবই তো আগে শুনেছ।” কিকিরা তারাপদর দিকে আঙুল তুলে দেখালেন, “তারাপদ শুনে রাখল।…যাক, তুমি একবার তোমাদের ওই বংশের লিস্টিটা পাঠিয়ে দাও। ভাল করে একবার দেখব। আর শোনো, আজ বিকেলে আমি আর তারাপদ একবার ঘোড়া-সাহেবের কুঠিতে যাব। তারাপদকে দেখিয়ে আনব কুঠিটা। তুমি কিছু ভেব না। আমরা সাবধানে যাব-আসব।”