হাইপারস্পেস
৩১.
তুমি তৈরি, জেনভ? ট্র্যাভিজ জিজ্ঞেস করল।
বই থেকে মুখ তুলল পেলোরেট। জাম্প-এর কথা বলছ, ওল্ড ফেলো?
হাইপার স্পেসাল জাম্প হ্যাঁ।
পেলোরেট ঢোক গিলল। তুমি শিওর, কোনো অসুবিধা হবে না। আমি জানি ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু যা কেউ কখনো দেখেনি সেই নিরাকার টেকিওনস-এ নিজেকে রিডিউস করার চিন্তাটা
দেখ জেনভ, ব্যাপারটা পুরোপুরি নিখুঁত। তুমিই বলেছ বাইশ হাজার বছর ধরে জাম্প ব্যবহার করা হচ্ছে এবং আমি একটাও দুর্ঘটনার কথা শুনিনি। আমরা হাইপারস্পেসের কোনো অস্বস্তিকর স্থানে বেড়িয়ে আসতে পারি, কিন্তু দুর্ঘটনা –অন্তত, যতক্ষণ টেকিওনস-এ কম্পোজড থাকব ততক্ষণ না।
সান্ত্বনা দিচ্ছ, মনে হয়।
আমরা ভুল জায়গাতেও বেড়িয়ে আসবনা। সত্যি কথা বলতে কি, আমি তোমাকে না জানিয়েই জাম্প করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরে মনে হলো সচেতনভাবে ব্যাপারটা তোমার দেখা উচিত, যেন বুঝতে পারো এতে বিপদ নেই এবং তার পরে ভুলে যেতে পারো।
বেশ, পেলোরেট সন্দেহের গলায় বলল। মনে হয় তুমিই ঠিক, কিন্তু অনেস্টলি, আমার কোনো ব্যস্ততা নেই।
আমি আশ্বাস দিচ্ছি
না, না, ওল্ড ফেলো। তোমাকে বিশ্বাস করেছি, আসলে ব্যাপারটা তুমি কখনো সান্তারস্টেইল ম্যাট পড়েছ?
নিশ্চয়ই। আমি মূর্খ না।
অবশ্যই। জিজ্ঞেস করা উচিত হয়নি আমার। তোমার মনে আছে?
আমার স্মৃতিশক্তিও লোপ পায় নি।
অফেন্ড করার ব্যাপারে তুমি ওস্তাদ। আসলে বলতে চাইছি সেই দৃশ্যগুলো আমার প্রায়ই মনে পড়ে যেখানে সান্তারস্টেইন এবং তার বন্ধু বেন প্লেনেট ১৭ থেকে সরে এসে মহাকাশে হারিয়ে যায়। সেই মনোমুগ্ধকর দৃশ্যগুলো, নক্ষত্র সীমাহীন নিঃশব্দতায় ঘুরছে অলসভাবে, পরিবর্তনহীন–আমার খুব ভালো লাগে, কিন্তু কখনো বিশ্বাস করিনি। মহাকাশে এসে ব্যাপারটা আমি উপভোগ করছি–ছেলেমানুষি জানি কিন্তু এই ছেলেমানুষিটা আমি বাদ দিতে চাই না। মনে হচ্ছে যেন আমি সান্তারস্টেইন-
আর আমি বেন, ট্র্যাভিজ কিছুটা অধৈর্য হয়ে বলল।
প্রায়। বাইরের অনুজ্জ্বল নক্ষত্রগুলো গতিহীন, আমাদের সূর্য ছাড়া, কিন্তু আমরা দেখছিনা। গ্যালাক্সি মহারাজার মতো গম্ভীর, পরিবর্তনহীন। মহাকাশ নীরব এবং আমাকে বিরক্ত করার মতো কিছু নেই।
আমি ছাড়া।
তুমি ছাড়া।–গোলান, ডিয়ার চ্যাপ, তোমার সাথে পৃথিবী নিয়ে কথা বলা এবং তোমাকে আদি ইতিহাস শেখানোতে আমি আনন্দ পাচ্ছি। চাইনা এই ব্যাপারটাও এখনি শেষ হয়ে যাক।
হবে না। অন্তত এখনি না। তুমি নিশ্চয়ই ভাবছনা যে জাম্প শেষ করেই আমরা কোনো গ্রহের সারফেসে পৌঁছে যাবো, তাই না? আমরা তখনো মহাকাশে থাকব এবং জাম্প এর জন্য খুব বেশি সময় লাগবে না। কোনো সারফেসে পৌঁছতে কম করেও এক সপ্তাহ সময় লাগবে, কাজেই আরাম কর।
সারফেস বলতে নিশ্চয়ই গায়ার কথা বলছনা। জাম্পের পরে আমরা হয়তো গায়ার কাছাকাছিও পৌঁছব না।
জানি জেনভ। কিন্তু আমরা আসল সেক্টরে পৌঁছব, যদি তোমার ইনফরমেশন ঠিক হয়। যদি না হয়–তো
পেলোরেট মনমরা ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। গায়ার কো-অর্ডিনেটসই যদি না জানি আসল সেক্টর আমাদের কিভাবে সাহায্য করবে?
জেনভ, মনে করো তুমি টার্মিনাসে রয়েছ, অর্জিয়োপল শহরে যাচ্ছ, কিন্তু জানো সেটা কোথায়। শুধু জান যে ইসথমাসের আশেপাশে কোথাও। ইসথমাসে পৌঁছে তুমি কি করবে?
পেলোরেট অনেকক্ষণ চিন্তা করল, যেন সূক্ষ্ম কোনো উত্তর দেবে। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, হয়তো কাউকে জিজ্ঞেস করব।
ঠিক! আর কি করার আছে?–এখন তুমি প্রস্তুত?
তুমি বলতে চাও, এখনই? ঝট করে দাঁড়িয়ে গেল পেলোরেট। ভাবলেশহীন ফর্সা মুখে উদ্বেগের চিহ্ন। আমাকে কি করতে হবে? বসে থাকব? দাঁড়িয়ে থাকব? কি করব?
স্পেস, তোমাকে কিছু করতে হবে না, পেলোরেট। আমার ঘরে চল যেন কম্পিউটারটা ব্যবহার করতে পারি, তারপর বস, দাঁড়াও, দৌড়াও–যা তোমার ভালো লাগে কর। আমার পরামর্শ হচ্ছে ভিউস্ক্রিনের সামনে বসে দেখ। ব্যাপারটা বেশ মজার। এসো!
ছোট করিডর পার হয়ে ট্র্যাভিজের রুমে ঢুকল দুজন। ট্র্যাভিজ বসল কম্পিউটারের সামনে।
তুমি চেষ্টা করবে, জোভ? সে হঠাৎ করে জিজ্ঞেস কবুল। ফিগারগুলো বলে দিচ্ছি, তোমাকে শুধু সেগুলো চিন্তা করতে হবে। বাকী কাজ কম্পিউটার করে দেবে।
না, ধন্যবাদ, পেলোরেট বলল। কম্পিউটার আমার সাথে ভালোভাবে কাজ করবে না। জানি তুমি বলবে যে প্র্যাকটিস প্রয়োজন। কিন্তু আমি সেটা বিশ্বাস করিনা। তোমার ভেতর এমন কিছু আছে, গোলান
বোকার মতো কথা বলোনা।
না, না। কম্পিউটারটা বোধহয় তোমার জন্যই তৈরি করা হয়েছে। যখন তুমি কন্ট্যাক্ট স্পর্শ করো মনে হয় যেন কম্পিউটার আর তুমি এক হয়ে মিশে গেছ। কিন্তু যখন আমি কন্ট্যাক্ট স্পর্শ করব তখন দুটো বিষয় জড়িত–জেনত পেলোরেট এবং কম্পিউটার। ব্যাপরটা একরকম না।
বাজে কথা, ট্র্যাভিজ বলল, কিন্তু মনে মনে খুশি হয়েছে। হ্যান্ড রেস্টের উপর মৃদু আঙ্গুল বোলাচ্ছে।
কাজেই আমি শুধু দেখব, পেলোরেট বলল। উদ্বেগ নিয়ে একবার ভিউস্ক্রীন একবার কুশারাম গ্যালাক্সির অনুজ্জ্বল নক্ষত্রগুলো দেখছে। ব্যাপারটা কখন ঘটবে। দেয়ালে হেলান দিয়ে বলল।
ট্র্যাভিজ হাসল। ব্রেষ্ট-এর উপর হাত রাখতেই মানসিক একাত্মতা অনুভব করছে। ব্যাপারটা অনেক সহজ হয়ে উঠছে দিনে দিনে, ঘনিষ্ঠতাও বাড়ছে। আর পেলোরেটের কথা, হেসে উড়িয়ে দিলেও ব্যাপারটা সে আসলেই অনুভব করতে পারে। মনে হচ্ছে কো-অর্ডিনেটস সচেতনভাবে চিন্তা করার দরকার নেই। সে কি চায়, কম্পিউটার সেটা জানে, সচেতনভাবে বলার প্রয়োজন নেই। কম্পিউটার সরাসরি তার ব্রেইন থেকে ইনফরমেশন নিয়ে নিচ্ছে।
কিন্তু সে মুখে বলল এবং জাম্প এর আগে দুই মিনিটের বিরতির আদেশ দিল।
ঠিক আছে, জেনভ। আমাদের হাতে দুই মিনিট সময় আছে: ১২০-১১৫-১১০–ভিউস্ক্রীনে তাকিয়ে থাকো।
পেলোরেট নাকমুখ শক্ত করে নিঃশ্বাস বন্ধ করে ঠিক সেই কাজটাই করছে।
ট্র্যাভিজ গুনে যাচ্ছে নরম সুরে, ১৫-১০-৫-৪-৩-২-১-০।
কোনো গতি নেই, ঝাঁকুনি নেই, কিন্তু স্ক্রীনের দৃশ্য পাল্টে গেল। স্টার ফিল্ডগুলো হালকা হচ্ছে সূক্ষ্মভাবে এবং অদৃশ্য হয়ে গেল গ্যালাক্সি।
হয়ে গেল? পেলোরেট জিজ্ঞেস করল।
কি হয়ে গেল? তুমি পিছিয়ে পড়েছ। সেটা তোমার দোষ স্বীকার কর কিছুই বুঝতে পারনি।
স্বীকার করছি।
তাহলে হয়ে গেছে। যখন হাইপারস্পেসাল ট্রাভেল ছিল একেবারে নতুন পুস্তক অনুযায়ী তখন কেউ জড়তা বা অস্বস্তি বোধ করত। কিন্তু অভিজ্ঞতা এবং উন্নত যন্ত্রপাতির কল্যাণে সেগুলো অনেক কমে এসেছে। এরকম একটা কম্পিউটার থাকলেতো কোনো অসুবিধাই অনুভব করা যাবে না, আমি তাই মনে করি।
আমাকেও মানতেই হচ্ছে। আমরা কোথায় রয়েছি, গোলান?
মাত্র এক ধাপ সামনে। কালগানিয়ান রিজিওনে। আরো অনেক দূর যেতে হবে কিন্তু তার আগে জাম্পের একুরেসী পরীক্ষা করে নিতে হবে।
আমাকে যা ভাবাচ্ছে গ্যালাক্সিটা কোথায়?
আমাদের চারপাশে, জেনভ। আমরা এখন এর ভেতরে সুরক্ষিত। সঠিকভাবে ভিউস্ক্রীন ফোকাস করলে, দূর দূর অংশগুলো দেখতে পারব, মনে হবে যেন উজ্জ্বল ফিতা দিয়ে আকাশ ঘিরে রাখা হয়েছে।
মিল্কিওয়ে! পেলোরেট খুশীতে চিৎকার করে উঠল। প্রায় প্রতিটা গ্রহই তাদের আকাশে এটা দেখতে পারে, কিন্তু আমরা টার্মিনাস থেকে দেখতে পারি না। আমাকে দেখাও, ওল্ড ফেলো!
ভিউস্ক্রিন সামান্য উঁচু হলো, মনে হচ্ছে যেন স্টারফিল্ড সাঁতার কাটছে, তারপর মুক্তার মতো উজ্জ্বল একটা পাতলা আভা ফিল্ডটাকে প্রায় ঢেকে ফেলল। স্ক্রীন সেটাকে অনুসরণ করছে চারপাশ থেকে, সেটা একবার পাতলা হচ্ছে আবার স্কুলে ফেপে উঠছে।
গ্যালাক্সির কেন্দ্রের কাছে জিনিসটা সবচেয়ে পাতলা, ট্র্যাভিজ বলল। তবে যতটুকু পাতলা এবং উজ্জ্বল হওয়ার কথা ততটুকু না, কারণ স্পাইরাল বাহুর কাছের ঘনমেঘ বেশিরভাগ বাসযোগ্য গ্রহ থেকে তুমি এই দৃশ্য দেখতে পারবে।
এবং পৃথিবী থেকেও।
এটা কোনো পার্থক্য হলোনা। কোনো সনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।
অবশ্যই না। কিন্তু তুমি জানো তুমি নিশ্চয়ই হিষ্ট্ৰী অফ সায়েন্স পড়নি, তাই না?
ভালোভাবে পড়িনি, তবে কিছু কিছু বিষয় জানা আছে। অবশ্য প্রশ্ন করলে কোনো উত্তর দিতে পারব না।
আসলে একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমার প্রায়ই ধাঁধা লাগত। এমন একটা মহাবিশ্বের বর্ণনা দেয়া সম্ভব যেখানে হাইপার স্পেসিয়াল ট্রাভেল অসম্ভব এবং যেখানে গতির ব্যাপারটা জড়িত সেখানে শূন্যের ভেতর দিয়ে আলোর গতিতে ভ্রমণ এবসলিউট ম্যাক্সিমাম।
অবশ্যই।
এক্ষেত্রে মহাবিশ্বের জ্যামিতিক কারণে-আলোকরশ্মি যে সময়ে স্থান পরিবর্তন করে তার চেয়ে কম সময়ে যে জাম্পটা এইমাত্র শেষ করলাম সেটা সম্ভব হতো না। এবং যদি আলোর গতিতে কাজটা করি তাহলে আমাদের সময় অতিবাহিত হওয়ার অভিজ্ঞতা মহাবিশ্বের সাধারণ অভিজ্ঞতার সাথে মিলবে না। ধরো এই বিন্দুটা টার্মিনাস থেকে চল্লিশ পারসেক দূরে, যদি আমরা সেখানে আলোর গতিতে পৌঁছাই তাহলে মনেই হবে না যে কোনো সময় অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু টার্মিনাস এবং পুরো গ্যালাক্সিতে একশ ত্রিশ বছর পার হয়ে যাবে। এই ট্রিপটা আমরা দিয়েছি আলোর চেয়ে হাজার গুণ বেশি গতিতে এবং কোথাও সময় একটুও আগে বাড়েনি। অন্তত আমি তাই আশা করি।
তুমি আশা করোনা যে, ট্র্যাভিজ বলল, ওলানজান হাইপারস্পেসিয়াল থিওরীর পুরো গণিত আমি তোমাকে বলতে পারব। শুধু বলতে পারি যে যদি তুমি নরমাল স্পেসে আলোর গতিতে ছোট তাহলে সময় প্রতি পারসেক-এ ৩.২৬ বছর করে এগোবে। তথাকথিত রিলেটিভিস্টিক মহাবিশ্ব, সেই আদি যুগ থেকে মানুষ সেটাকে বোঝে–যাই হোক এটা তোমার ডিপার্টম্যান্ট, আমার মতে সেটার নিয়মগুলো পাল্টাবে না। হাইপারস্পেসিয়াল জাম্পে আমরা যে শর্তগুলো মেনে চলি সেখানে রিলেটিভিটি কাজ করে কিন্তু নিয়মগুলো পাল্টে যায়। হাইপারস্পেসালি গ্যালাক্সি ক্ষুদ্র একটা বস্তু প্রকৃতপক্ষে নন-ডাইমেনশনাল ডট–এবং কোনো ধরনের রিলেটিভিষ্টিক ইফেক্ট থাকে না।
কসমোলজীর গাণিতিক সূত্রে গ্যালাক্সির জন্য দুটো প্রতীক ব্যবহার করা হয়: G অর্থাৎ রিলেটিভিষ্টিক গ্যালাক্সি, যেখানে আলোর গতি সর্বোচ্চ এবং Gh অর্থাৎ হাইপার স্পেসাল গ্যালাক্সি, যেখানে আলোর গতি কোনো অর্থবহন করেনা। হাইপারস্পেসালি গতির মান শূন্য এবং আমরা আসলে স্থান পরিবর্তন করি না; স্পেস-এর ভিত্তিতে গতি অসীম। আমি এর চেয়ে বেশি ব্যাখ্যা করতে পারব না।
পেলোরেট গম্ভীরভাবে কিছুক্ষণ চিন্তা করল তারপর দ্বিধাগ্রস্ত গলায় প্রশ্ন করল, কিন্তু কোনটা আসল গ্যালাক্সি?
নির্ভর করছে তুমি কি করবে তার উপর। টার্মিনাসে মাটির উপর দূরত্ব পার হওয়ার জন্য তুমি গাড়ি ব্যবহার করবে, সাগর পথে দূরত্ব পার হওয়ার জন্য জাহাজ ব্যবহার করবে। দুই পথের শর্তগুলো কিন্তু আলাদা, কাজেই কোনটাকে তুমি আসল টার্মিনাস বলবে, মাটি না সাগর।
পেলোরেট মাথা নাড়ল। যুক্তিতর্ক সবসময়ই খারাপ, সে বলল কিন্তু হাইপারস্পেস নিয়ে আরো বেশি ভাবনা চিন্তা করার চেয়ে একটা যুক্তি আমি মেনে নেব। এখন নিজের কাজে মনযোগ দেয়া যাক।
ট্র্যাভিজ বলল, এটাই পৃথিবীর পথে প্রথম পদক্ষেপ।
তারপর নিজের চিন্তায় ডুবে গেল, কি চিন্তা সেই জানে।
.
৩২.
বেশ, ট্র্যাভিজ বলল। একটা দিন নষ্ট করলাম।
ওহ? ইনডেক্স থেকে চোখ তুলল পেলোরেট। কিভাবে?
ট্র্যাভিজ দুহাত ছড়িয়ে দিল। কম্পিউটারকে আমি বিশ্বাস করিনি। সাহস হয়নি, তাই এখনকার অবস্থান আর জাম্পের সময় যে অবস্থান নির্ধারণ করেছিলাম সেটা মিলিয়ে দেখি। কোনো পার্থক্য নেই। কোনো ভুল নেই।
বেশ ভালো, তাই না?
ভালোর চেয়েও ভালো। একেবারে অবিশ্বাস্য। এত নিখুঁত কখনো দেখিনি। এর আগেও জাম্প করেছি, সেগুলো পরিচালনা করেছি, সবদিকে এবং সবধরনের যন্ত্রপাতি দিয়ে। স্কুলে একবার হ্যান্ড কম্পিউটার দিয়ে কাজ করেছিলাম তারপর হাইপার রিলে পাঠিয়ে ফলাফল জানতে পেরেছিলাম। আসল জাহাজ ব্যবহার করতে পারিনি কারণ খরচ বাদ দিলেও–আমি হয়তো সেটা কোনো নক্ষত্রের মাঝখানে নিয়ে ফেলতাম।
এরপর অবশ্য আর কখনো এত খারাপভাবে করিনি, ট্র্যাভিজ বলে যাচ্ছে, কিন্তু নির্দিষ্ট পরিমাণ কিছু ভুল হবেই। এমনকি বিশেষজ্ঞ হলেও কিছু ভুল থাকবেই। থাকতেই হবে, যেহেতু ভেরিয়েবলের পরিমাণ খুব বেশি। মহাশূন্যের জ্যামিতি অনেক বেশি জটিল, আর হাইপারস্পেসে এই জটিলতা পুরোটাই রয়েছে, সেইসাথে রয়েছে তার নিজস্ব জটিলতা যেগুলো আমরা সহজে ধরতেও পারিনা বুঝতেও পারি না। সেকারণেই এখান থেকে সেশেল পর্যন্ত বড় একটা জাম্প না দিয়ে ধাপে ধাপে এগোচ্ছি। দূরত্ব বেশি হলে ভুলের পরিমাণও বেশি হবে।
কিন্তু তুমি বলছ কম্পিউটার কোনো ভুল করেনি।
কম্পিউটার বলছে যে সে কোনো ভুল করেনি। আমি তাকে আসল অবস্থান এবং পূর্বের হিসাব করা অবস্থান চেক করতে বলি –কি চেয়েছি এবং কি পেয়েছি সেটাই আর কি। তো কম্পিউটার বলছে যে কোনো ভুল হয়নি এবং আমি ভাবছি; যদি সে মিথ্যা বলে তখন কি হবে?
কথাটা বলার আগ পর্যন্ত পেলোরেট তার প্রিন্টার হাতে ধরে রেখেছিল। এখন নামিয়ে রাখল, ভীতু দেখাচ্ছে। ঠাট্টা করছ? কম্পিউটার মিথ্যা বলতে পারে না। যদি না কোনো গোলমাল দেখা দেয়।
না, সেটা ভাবছি না। স্পেস! আমি ভেবেছিলাম এটা মিথ্যা বলছে। এই কম্পিউটার এত বেশি উন্নত যে আমি এটাকে হিউম্যান ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না–হয়তো সুপার হিউম্যান। অহংকার করার মতো এবং মিথ্যা বলার মতো যথেষ্ট হিউম্যান। আমি নির্দেশ দিয়েছিলাম হাইপারস্পেসের মাধ্যমে সেশেল ইউনিয়নের রাজধানী সেশেল গ্রহের কাছাকাছি কোথাও পৌঁছানোর কোর্স তৈরি করতে। তৈরি করেছে, ঊনত্রিশ ধাপের একটা কোর্স, তৈরি করেছে, যা আমার কাছে মনে হয়েছে খুব ঔদ্ধত্যপূর্ণ।
ঔদ্ধত্যপূর্ণ কেন?
প্রথম জাম্পের ভুল দ্বিতীয় জাম্পকে করে তুলবে অনিশ্চিত, তারপর ধারাবাহিক ভুলগুলো তৃতীয় জাম্প আরো বেশি অনিশ্চিত এবং অবিশ্বাস্য করে তুলবে, এভাবে চলতেই থাকবে। উনত্রিশটা ধাপ তুমি একবারে হিসাব করবে কি করে? উনত্রিশতমটা গ্যালাক্সির যে কোনো জায়গাতে গিয়ে শেষ হতে পারে, যে কোনো জায়গায়। তাই আমি শুধু প্রথম ধাপ সম্পন্ন করার নির্দেশ দেই। যেন অগ্রসর হওয়ার আগে সেটা চেক করে নিতে পারি।
যথেষ্ট সতর্কতা, পেলোরেট আন্তরিক গলায় বলল, আমি সমর্থন করছি।
হ্যাঁ, কিন্তু প্রথম ধাপ শেষ করার পর, আমার অবিশ্বাসের কারণে কম্পিউটার হয়তো দুঃখ পেয়েছে? তাই যখন জিজ্ঞেস করলাম, তখন নিজের অহংকার বজায় রাখার জন্য সে কি বলতে পারেনা কোনো ভুল হয়নি? সে কি ভুল স্বীকার করাকে অসম্ভব মনে করে? যদি তাই হয়, আমাদের কোনো কম্পিউটার দরকার নেই।
পেলোরেটের ভালমানুষের মতো মুখ বিষণ্ণ হয়ে গেল। তাহলে আমরা কি করতে পারি, গোলান?
আমি যা করছি তাই করতে পারি–একটা দিন ব্যয় করতে পারি। আমি আশেপাশের অনেকগুলো নক্ষত্রের অবস্থান প্রাচীনকালের সম্ভাব্য সবরকম পদ্ধতিতে চেক করেছিঃ টেলিস্কোপিক অবজার্ভেশন, ফটোগ্রাফি, ম্যানুয়াল হিসাব। প্রতিটি প্রকৃত অবস্থান, ভুল না হলে প্রত্যাশিত যে অবস্থান হতো তার সাথে তুলনা করে। দেখেছি। কাজটা করতে সারাদিন লেগেছে কিন্তু কোনো ফল হয়নি।
হ্যাঁ, কিন্তু ঘটেছে কি?
দুটো বড় রকমের ভুল পাই এবং সেগুলো পাই আমার হিসাবের মধ্যে। ভুলগুলো শুদ্ধ করে নিয়ে কম্পিউটারে ঢুকাই শুধু দেখার জন্য যে আলাদাভাবেও একই ফলাফল আসে কিনা। আমার হিসাবে কোনো ভুল হয়নি এবং কম্পিউটারও কোনো ভুল করেনি।
পেলোরেট লম্বা শ্বাস নিল। বেশ, সেটাতো ভালো।
হ্যাঁ, অবশ্যই! কাজেই এখন বাকী আঠাশটা ধাপও শেষ করব।
সবগুলো একসাথে? কিন্তু
একসাথে না। চিন্তার কিছু নেই। পাগল হয়ে যাইনি। একটার পর একটা করব–কিন্তু প্রতিটা ধাপের পর ভালো মতো পরীক্ষা করে নেব এবং পার্থক্য যদি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকে তাহলে পরবর্তী ধাপে এগোব। যে কোনো সময় বড় রকমের ভুল হয়ে যেতে পারে–তখন বন্ধ করে দিয়ে বাকী ধাপগুলো আবার হিসাব করে নেব।
কখন শুরু করবে?
কখন? এখনই।–তুমি তো তোমার লাইব্রেরি ইনডেক্সিং করছ-
ওহ, এখনই সুযোগ, গোলান। অনেকদিন থেকেই করব করব ভাবছি, কিন্তু একটা না একটা বাধা এসে দাঁড়িয়েছে।
কোনো অসুবিধা নেই। তুমি ইনডেক্সিং-এ মন দাও। বাকীগুলো আমি সামলাচ্ছি।
পেলোরেট মাথা ঝাঁকালো। বোকার মতো কথা বলোনা, পুরো ব্যাপারটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি স্বস্তি পাবো না।
তোমাকে বলা উচিত হয়নি, তাহলে কিন্তু কাউকে না কাউকে তো বলতেই হবে আর এখানে তুমি ছাড়া অন্য কেউ নেই। খোলাখুলিই বলি বরং। সবসময়ই সম্ভাবনা আছে যে আমরা মহাকাশের কোনো নিরাপদ স্থানে গিয়ে পৌঁছব বা এমন স্থানে গিয়ে পৌঁছব যেখানে একটা দ্রুতগতির মেটিওরয়েড এগিয়ে আসছে বা কোনো ছোট ব্ল্যাকহোলে গিয়ে পড়ব। তাত্ত্বিকভাবে এমন ঘটনা ঘটতে পারে।
কিন্তু সম্ভাবনা খুব ছোট। তুমি হয়তো নিজের বাড়িতে রয়েছ, জেনভ–পড়ালেখা করছ, কাজ করছ, ঘুমাচ্ছ–এমন সময় একটা মেটিওরয়েড টার্মিনাসের বায়ুমণ্ডল ভেদ করে তোমার মাথায় আঘাত করল, তুমি মারা গেলে। কিন্তু এরকম ঘটার সম্ভাবনা খুব কম।
হাইপারস্পেসাল জাম্পে প্রাণনাশক কোনো বস্তুর গতিপথ ছেদ করে যাওয়ার সম্ভাবনা নিজের বাড়িতে বসে মেটিওর-এর আঘাতে মারা যাওয়ার সম্ভাবনার চেয়ে কম। হাইপারস্পেসাল ট্রাভেলে এভাবে কোনো জাহাজ ধ্বংস হয়েছে বলে কখনো শুনিনি। অন্য ধরনের বিপদ–যেমন কোনো নক্ষত্রের মাঝখানে গিয়ে পড়ার সম্ভাবনা আরো কম।
তাহলে আমাকে এগুলো কেন শোনাচ্ছ গোলান?
ট্র্যাভিজ থামল, চিন্তায় মাথা নুয়ে আছে, শেষে বলল, আমি জানিনা।–হ্যাঁ, জানি। আমার যা মনে হয়, যদি যথেষ্ট লোক যথেষ্ট সুযোগ নেয়, তাহলে বিপর্যয় ঘটবেই। যতই নিশ্চিত হই যে কোনো বিপদ ঘটবে না, আমার ভেতরে কে যেন চিকন সুরে। বলছে হয়তো এখনই ঘটবে, সেই কারণে নিজেকে মনে হচ্ছে অপরাধী। আমার মতে কারণ এই একটাই। জেনভ, যদি কোনো বিপদ হয় আমাকে ক্ষমা করো!
কিন্তু গোলান, মাই ডিয়ার চ্যাপ, কোনো বিপদ হলে দুজনেই সাথে সাথে মারা যাব। তোমাকে ক্ষমা করার জন্য আমি থাকবনা, তুমিও সেটা গ্রহণ করার জন্য থাকবে না?
পেলোরেট হাসল। জানিনা কেন, কিন্তু ব্যাপারটা আমাকে আনন্দিত করেছে। এর ভেতর মজার একটা কিছু আছে। গোলান, আমি তোমাকে মাফ করব। বিভিন্ন গ্রহের সাহিত্যে মৃত্যুর পরের জীবন নিয়ে হাজারো রকম কাহিনী রয়েছে। যদি সত্যিই সেরকম কোনো জায়গা থাকে এবং তুমি আমি একই জায়গায় পৌঁছতে পারে, তাহলে আমি সাক্ষ্য দেব যে তুমি তোমার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছ এবং আমার মৃত্যুর জন্য তুমি দায়ী নও।
ধন্যবাদ। এখন আমি ভারমুক্ত। আমি ঝুঁকি নিতে চাই, কিন্তু সেই ঝুঁকিটা তোমাকেও নিতে হবে ভেবে আমার ভালো লাগছেনা।
ট্র্যাভিজের হাত জড়িয়ে ধরল পেলোরেট। তুমি জানো, গোলান, তোমাকে আমি চিনি এক সপ্তাহেরও কম সময়, জানি এত অল্প সময়ে কারো ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক না, কিন্তু আমার মতে তুমি চমৎকার একজন মানুষ।–এখন কাজটা শুরু কর এবং তাড়াতাড়ি শেষ কর।
নিশ্চয়ই! আমাকে শুধু ওই ছোট কন্ট্যাক্ট স্পর্শ করতে হবে। কম্পিউটারকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে আগেই, এখন শুধু আমার স্টার্ট বলার অপেক্ষায় আছে–তুমি বলবে
কখনোই না! এটা তোমার কম্পিউটার।
খুব ভালো কথা। এবং এটা আমার দায়িত্ব। দেখছই তো আমি এখনো হালকা ভাবে কাজটা করছি, স্ক্রীনে নজর রাখো!
অত্যন্ত দৃঢ়তা এবং মুখে অকৃত্রিম হাসি নিয়ে ট্র্যাভিজ কন্ট্যাক্ট স্পর্শ করল।
সবকিছু থেমে রইল এক মুহূর্ত তারপর স্টারফিল্ড পরিবর্তন হতে লাগল–বারবার-বারবার। নক্ষত্রগুলো দৃঢ়ভাবে ছড়িয়ে পড়ে পাতলা হচ্ছে আবার উজ্জ্বল হচ্ছে।
নিঃশ্বাস বন্ধ করে গুনছে পেলোরেট। ১৫ তে এসে একবার থেমে গেল, যেন কোনো যন্ত্র হঠাৎ জ্যাম হয়ে গেছে। ফিসফিস করে বলল, যেন ভয় পাচ্ছে জোরে কথা বললে সবগুলো কলকজা একসাথে বিকল হয়ে যাবে, কি ব্যাপার? কি ঘটেছে?
ট্র্যাভিজ কাঁধ ঝাঁকালো। আমার মনে হয় রিক্যালকুলেশন। মহাকাশের কোনো বস্তু হয়তো সামগ্রিক গ্র্যাভিটেশন্যাল ফিল্ডের সাধারণ কাঠামোতে একটা ধাক্কা দিয়েছে কোনো বস্তু হয়তো হিসাবে ধরা হয়নি–অজানা কোনো বামন নক্ষত্র বা কোনো উন্মত্ত গ্রহ-
বিপজ্জনক?
এখনো যখন বেঁচে আছি, তখন নিশ্চয়ই বিপজ্জনক না। একটা গ্রহ হয়তো একশ মিলিয়ন কিলোমিটার দূর থেকে এত ব্যাপক গ্র্যাভিটেশনাল মডিফিকেশন তৈরি করছে, ফলে রিক্যালকুলেশন প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। একটা বামন নক্ষত্র হতে পারে দশ বিলিয়ন কিলোমিটার দূরে এবং
থেমে গেল ট্র্যাভিজ, কারণ স্ক্রীনের দৃশ্য আবার বদলাচ্ছে। ক্রমাগত বদলাতে লাগল। শেষ পর্যন্ত যখন পেলোরেট বলল, ২৮, তারপর আর কোনো নড়াচড়া নেই। কম্পিউটার পরীক্ষা করে বলল, আমরা পৌঁছে গেছি।
প্রথম জাম্পটাকে আমি শুনেছি ১ এবং তারপরে যখন ধারাবাহিকভাবে শুরু হলো আমি ২ থেকে গোনা শুরু করেছি। সব মিলিয়ে আঠাশটা জাম্প। তুমি বলেছিলে ঊনত্রিশটা।
পনেরতম জাম্পের রিক্যালকুলেশন হয়তো একটা জাম্প কমিয়ে দিয়েছে। তুমি চাইলে কম্পিউটার থেকে পুরো হিসাব বের করে দিতে পারি কিন্তু তার আসলে প্রয়োজন নেই। আমরা সেশেল গ্রহের সীমানায় পৌঁছে গেছি। কম্পিউটার তাই বলছে এবং কোনো সন্দেহ নেই আমার। যথাযথ স্ক্রীন করলে বাইরে আমরা চমৎকার উজ্জ্বল একটা সূর্য দেখতে পারব, কিন্তু বিনাপ্রয়োজনে সেটা করারও কোনো প্রয়োজন নেই। সেশেল হচ্ছে চতুর্থ গ্রহ এবং আমাদের বর্তমান অবস্থান। থেকে ৩.২ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে। আমরা সেখানে পৌঁছব তিনদিনে, খুব বেশি তাড়াহুড়ো করলে দুই দিনে।
লম্বা শ্বাস নিয়ে ট্র্যাভিজ টেনসন কমানোর চেষ্টা করল।
এর অর্থ কি তুমি বুঝতে পারছ, জেনভ? সে জিজ্ঞেস করল, এর আগে আমি যতগুলো মহাকাশযানে ছিলাম বা চালিয়েছি সেগুলোতে কম্পিউটার থাকলেও এরকম একটা জাম্প শেষ করতে লাগত প্রায় একমাস। অথবা সম্ভবত দুই বা তিন সপ্তাহ; যদি তারা বিশ্রাম না নিয়ে কাজ করত। আমরা করেছি মাত্র আধঘণ্টায়। যখন প্রত্যেকটা মহাকাশযানে এমন একটা কম্পিউটার থাকবে।
আমি অবাক হচ্ছি মেয়র কেন এত আধুনিক মহাকাশযান আমাদের হাতে তুলে দিলেন। এটা নিশ্চয়ই খুব দামী।
এটা পরীক্ষামূলক, ট্র্যাভিজ শুকনো গলায় বলল। হয়তো ভদ্রমহিলা চান আমরা এটাকে চালিয়ে সমস্যাগুলো বের করি।
তুমি সিরিয়াস?
ভয়ের কিছু নেই। আমরা কোনো সমস্যা পাইনি। এটা মেয়রকে আমি ফিরিয়ে দেবনা। তাছাড়া আমাদেরকে তিনি নিরাপত্তার জন্য অস্ত্র দিয়ে বিশ্বাস করেননি, ফলে খরচ অনেক কমে গেছে।
পেলোরেট চিন্তামগ্ন স্বরে বলল, আমি ভাবছি কম্পিউটারের কথা। তোমার সাথে খুব ভালোভাবে খাপ খেয়েছে এবং সবার সাথে একইরকম খাপ খাওয়ানোর। জন্য তৈরি হয়নি। এটা হয়তো আমার সাথে কাজ করবে না।
আমাদের জন্য ভালো যে এটা শুধু একজনের সাথে কাজ করে।
হা, কিন্তু এটা কি শুধু একটা দৈব ঘটনা?
তাছাড়া আর কি, জেনভ?
মেয়র তোমাকে খুব ভালভাবে চেনেন।
আমারও তাই মনে হয়।
তিনি হয়তো কম্পিউটারটা শুধু তোমার জন্য তৈরি করেছেন?
কেন?
আমি অবাক হব যদি কম্পিউটার যেখানে চায় সেখানে আমরা না পৌঁছাই।
ট্র্যাভিজ তাকিয়ে রইল। তুমি বলতে চাও আমি যখন কম্পিউটারের সাথে যুক্ত, তখন আমি নই–আসল চার্জে থাকে কম্পিউটার।
আমি অবাক হব না।
সেটা অসম্ভব, জেনভ।
ট্র্যাভিজ কম্পিউটারের দিকে ঘুরে সেশেল গ্রহে পৌঁছানোর একটা নরমাল-স্পেস কোর্স তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
কিন্তু পেলোরেট কেন তার মাথায় এই চিন্তাটা ঢোকাল?
.
টেবিল
৩৩.
দুইদিন পার হয়ে গেছে এবং জেনডিবল যতটা না বিমর্ষ তার চেয়ে বেশি রাগান্বিত। কোনো কারণ নেই দ্রুত হিয়ারিং-এর ব্যবস্থা না করার। তার সময় বা প্রস্তুতি কোনোটাই দরকার নেই। নিশ্চিত ছিল ওরা দ্রুত একটা হিয়ারিং-এর ব্যবস্থা করবে।
অথচ যেখানে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন মিউলের চেয়েও ভয়ংকর বিপদের মুখোমুখি সেখানে তারা অযথা সময় নষ্ট করছে–কারণ শুধু তাকে উত্যক্ত করা।
ওরা অবশ্যই তাকে উত্যক্ত করেছে এবং এর ফলটা ভালো হবে না, সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল।
নিজের চারপাশে তাকালো জেনডিবল, এন্টিরুমটা খালি। দুদিন থেকেই খালি পড়ে আছে। এখন সে মার্কামারা লোক, একজন স্পিকার যার ব্যাপারে সবাই জানে–দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের পাঁচ শতাব্দীর ইতিহাসে প্রথমবার দায়িত্বহীন আচরণের কারণে শীঘ্রই পদচ্যুত হতে যাচ্ছে। তার র্যাঙ্ক কেড়ে নেয়া হবে, দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনার থেকে সাধারণ লোকে পরিণত হবে, সহজ সরল ব্যাপার।
দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনারদের র্যাঙ্ক একটা সম্মানজনক ব্যাপার, বিশেষ করে যারা দায়িত্বপূর্ণ পদবী পায়। আবার স্পিকার থেকে পদাবনতি ঘটাও একটা ব্যাপার।
ব্যাপারটা ঘটবেনা, জেনডিবল মনে মনে ভাবল, যদিও দুদিন থেকে সবাই তাকে এড়িয়ে চলছে, একমাত্র সুরা নোভী তার সাথে আগের মতো আচরণ করছে, যদিও পরিস্থিতি বোঝার মতো বুদ্ধি তার নেই। তার কাছে জেনডিবল এখনো মাস্টার।
নোভীর এধরনের আচরণে জেনডিবল আনন্দ পায়। সে খেয়াল করেছে নোভী যখন তার দিকে শ্রদ্ধা নিয়ে তাকিয়ে থাকে তখন তার উদ্যম আর কর্মস্পৃহা বহুগুণ বেড়ে যায়। ব্যাপারটা তাকে লজ্জায় ফেলে দিচ্ছে।
একজন ক্লার্ক চেম্বার থেকে বেরিয়ে এসে তাকে জানালো যে টেবিল তার কথা শোনার জন্য তৈরি। ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকল জেনডিবল। সবাই টেবিলের চারপাশে গম্ভীর মুখে বসে আছে, পরনে বিচারকের কালো পোশাক। ফার্স্ট স্পিকার স্যান্ডেস কিছুটা অস্বস্তিতে ভুগছেন, কিন্তু মুখে বন্ধুত্বের কোনো আভাস নেই। ডেলারমি–বাকী তিন স্পিকারের মধ্যে একমাত্র মহিলা তারদিকে তাকালো না পর্যন্ত।
ফার্স্ট স্পিকার বললেন, স্পিকার জেনডিবল, তোমাকে অস্পিকারসুলভ আচরণের কারণে ইমপিচ করা হয়েছে। তুমি সকলের উপস্থিতিতে টেবিলকে–কোনো প্রমাণ ছাড়াই বিশ্বাসঘাতকতা এবং হত্যা চেষ্টার দায়ে অভিযুক্ত করেছ। তুমি বলেছ দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের সবার স্পিকার এবং ফার্স্ট স্পিকারসহ সবারই–পূর্ণ মেন্টাল এনালাইসিস করা প্রয়োজন যেন বের করা যায় আমাদের মধ্যে কাকে আর বিশ্বাস করা যাবে না। তোমার এই মন্তব্যে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের একাত্মতায় ফাটল ধরেছে যা ছাড়া আমরা কোনোদিনই জটিল এবং সম্ভাব্য বিরূপ গ্যালাক্সি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবনা এবং যা ছাড়া হয়তো কোনোদিনই আরেকটা শক্তিশালী সাম্রাজ্য গড়ে তোলা যাবে না।
যেহেতু আমরা সবাই অভিযোগগুলোর প্রত্যক্ষদর্শী, আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করছি। এখন সরাসরি পরবর্তী কাজে হাত দেব। স্পিকার স্টর জেনডিবল, আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য তোমার কিছু বলার আছে?
জেনডিবল বলল, যদি সত্য কথাটাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের যোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে বলতে পারি। নিরাপত্তা ভঙ্গ হয়েছে এটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এর কারণ সম্ভবত দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনারদের-এখানে যারা রয়েছে তাদের বাদ দিয়ে মেন্টালি কন্ট্রোল করা হচ্ছে এবং এর ফলে ভয়ানক বিপদ এগিয়ে আসছে। যদি আপনি বিচারের কাজটা সংক্ষিপ্ত করেন তাহলে। হালকাভাবে বিপদের মাত্রা আন্দাজ করতে পারবেন। কিন্তু তারপরেও বলতে বাধ্য হচ্ছি অনুরোধ করার পরেও কেন আপনারা দুইটা দিন নষ্ট করলেন। আমিতো স্বীকার করেছি যা বলেছি তা এই ভয়ানক বিপদের কারণেই বলতে বাধ্য হয়েছি। অস্পিকারসুলভ আচরণ করতে বাধ্য হয়েছি।
একই কথা আবারো বলছে, ফার্স্ট স্পিকার। ডেলারমি নরম সুরে বলল।
জেনডিবলের চেয়ার রাখা হয়েছে সবার কাছ থেকে দূরে–পরিষ্কার পদাবনতি। সে চেয়ারটা আরো দূরে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আপনারা কি কিছু না শুনেই আমাকে দোষী সাব্যস্ত করে আইনের হাতে তুলে দেবেন না বিস্তারিত বলব?
ফার্স্ট স্পিকার বললেন, এটা কোনো বেআইনী অধিবেশন না, স্পিকার। আমাদের অতিমানবিক ক্ষমতা যেন কোনো অবিচার না করে সে ব্যাপারে আমরা সচেষ্ট। একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে দোষী না বানিয়ে বরং একজন অপরাধীকে স্বাধীনভাবে চলে যেতে দেব। তবে বর্তমান বিষয়টা এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে দোষী ব্যক্তিকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়া যায় না। তোমাকে ইচ্ছা মতো কথা বলার সুযোগ দিচ্ছি। যত সময় লাগে নাও, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা সবাই একমত হচ্ছি যে তোমার কাছ থেকে যথেষ্ট শোনা হয়েছে।
তাহলে বিস্তারিত বলছি, জেনডিবল বলল, গোলান ট্র্যাভিজ–যে প্রথম ফাউণ্ডেশনারকে টার্মিনাস থেকে বের করে দেয়া হয়েছে এবং যার ব্যাপারে আমি আর ফার্স্ট স্পিকার একমত হয়েছিলাম যে সেই হচ্ছে আসন্ন বিপদের ধারালো প্রান্ত–হঠাৎ করেই অপ্রত্যাশিত দিকে যাত্রা করেছে।
পয়েন্ট অফ ইনফরমেশন, ডেলারমি আবারো নরম সুরে বলল, স্পিকার কিভাবে জানল?
আমাকে জানিয়েছেন ফার্স্ট স্পিকার। কিন্তু আমি নিজের উৎস থেকেও নিশ্চিত হয়েছি। তবে চেম্বারের নিরাপত্তার অবস্থা চিন্তা করে আমার তথ্যের উৎস আমি বাধ্য হচ্ছি গোপন রাখতে।
ফার্স্ট স্পিকার বললেন, এ ব্যাপারে আলোচনা আমি থামাতে বলছি, বরং এই তথ্যটা ছাড়াই এগোই। কিন্তু যদি টেবিল মনে করে তথ্যটা জানা প্রয়োজন তখন স্পিকার জেনডিবল সেটা জানাতে বাধ্য থাকবেন।
ডেলারমি বলল, আমার মতে একজন এজেন্ট স্পিকারের পক্ষে কাজ করছে–যে এজেন্ট তার ব্যক্তিগত নিয়োেগ এবং যে এই টেবিলের কাছে দায়বদ্ধ না। আমরা নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবনা যে এই এজেন্ট দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের নিয়ম মেনে চলছে।
ফার্স্ট স্পিকার বিরক্ত হয়ে বললেন, আমি জানি, স্পিকার ডেলারমি সব কিছু আমাকে বলে দিতে হবে না।
আমি শুধু রেকর্ড রাখার জন্য বলেছি, ফার্স্ট স্পিকার, যেহেতু বিষয়টা ইমপিচম্যান্ট বিলে অন্তর্ভুক্ত নেই। আমি চাই অন্তর্ভুক্ত করা হোক।
সে ব্যাপারে যথাযথ নির্দেশ দেয়া হয়েছে।–স্পিকার জেনডিবল, তোমার বক্তব্য থেকে দূরে সরে এসেছি। শুরু করো।
জেনডিবল শুরু করল, ট্র্যাভিজ শুধু অপ্রত্যাশিত দিকেই চলে যায়নি, তার গতিও ছিল অস্বাভাবিক দ্রুত। আমার তথ্য অনুযায়ী ফার্স্ট স্পিকার যা এখনো জানেন না, একঘণ্টায় সে প্রায় দশহাজার পারসেক দূরত্ব অতিক্রম করেছে।
এক জাম্পে? একজন বয়স্ক স্পিকার অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।
দুই ডজনেরও বেশি জাম্প দিয়ে। একটার পর একটা, মাঝখানে বিরতি প্রায় ছিলইনা। একক জাম্প থেকেও ব্যাপারটা বেশি জটিল। এখন যদি তাকে খুঁজে পাওয়াও যায়, অনুসরণ করে যেতে সময় লাগবে। সে যদি আমাদের খুঁজে পায় এবং সত্যি সত্যিই ধ্বংস করতে চায়, আমরা তাকে বাধা দিতে পারব না। আর আপনি এখানে ইমপিচম্যান্টের খেলা খেলে দুদিন সময় নষ্ট করেছেন।
ফার্স্ট স্পিকার নিজের রাগ সামলালেন। দয়া করে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বল, স্পিকার জেনডিবল।
ব্যাপারটা ফার্স্ট স্পিকার, প্রথম ফাউন্ডেশনের কারিগরি অগ্রগতির ইঙ্গিত। তারা এখন প্রীম পালভারের সময়ের চেয়েও বেশি শক্তিশালী। ওদের বিরুদ্ধে আমরা দাঁড়াতে পারব না।
স্পিকার ডেলারমি উঠে দাঁড়ালো। ফার্স্ট স্পিকার, আমরা অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে সময় নষ্ট করছি। আমরাতো কচি খোকা না যে ঠাকুমার গল্প বলে ভয় দেখানো যাবে। প্রথম ফাউণ্ডেশন যত খুশি কারিগরি উন্নতি করুক, কোনো ব্যাপার না, যদি যে কোনো বিপদের সময় তাদের মাইন্ড আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে।
তোমার কি বলার আছে, স্পিকার জেনডিবল? ফার্স্ট স্পিকার জিজ্ঞেস করলেন।
শুধু এইটুকু যে, মাইন্ড-এর ব্যাপারে আমি পরে আসব। এই মুহূর্তে আমি শুধু প্রথম ফাউণ্ডেশনের কারিগরি দক্ষতার উপর জোর দিচ্ছি।
পরের পয়েন্টে আসা যাক, স্পিকার জেনডিবল। ফার্স্ট স্পিকার বললেন। তোমার প্রথম পয়েন্ট, আমার মতে, ইমপিচম্যান্ট বিলের সাথে জড়িত না।
সবাই একমত হলো।
জেনডিবল বলল, ঠিক আছে। এই যাত্রায় ট্র্যাভিজের একজন সঙ্গী আছে। জেনভ পেলোরেট, সাধারণ একজন স্কলার, যে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে পৃথিবী সম্পর্কে যাবতীয় উপকথা এবং কিংবদন্তী সংগ্রহের কাজে।
তুমি তার ব্যাপারে সব জানো? তোমার গোপন উৎস, আমার ধারণা। ডেলারমি বলল। স্বচ্ছন্দে প্রসিকিউটরের ভূমিকা পালন করছে।
হ্যাঁ, তার ব্যাপারে আমি সব জানি, জেনডিবল ঠাণ্ডা গলায় বলল। টার্মিনাসের মেয়র যথেষ্ট বুদ্ধিমতি এবং দক্ষ। কয়েকমাস আগে পরিষ্কার কোনো কারণ ছাড়াই তিনি এই স্কলারের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন, তাই আমিও আগ্রহী হয়ে উঠি। ব্যাপারটা আমি চেপে রাখিনি। যত তথ্য পেয়েছি সব ফাস্ট স্পিকারকে জানিয়েছি।
আমি তার সাক্ষী, ফার্স্ট স্পিকার নিচু স্বরে বললেন।
একজন বয়স্ক স্পিকার বললেন, এই পৃথিবীটা কি? গল্পে শোনা সেই মূল গ্রহ? প্রাচীন ইমপেরিয়াল যুগে যার ব্যাপারে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল?
জেনডিবল মাথা নাড়ল। স্পিকার ডেলারমি যে ঠাকুমার গল্পের কথা বলেছেন সেগুলোতে।–আমার ধারণা পেলোরেটের ইচ্ছা ট্র্যানটরে এসে গ্যালাকটিক লাইব্রেরি থেকে তথ্য সংগ্রহ করা, যে তথ্যগুলো টার্মিনাসের ইন্টারগ্যালাকটিক লাইব্রেরি সার্ভিস থেকে সে পাবেনা।
যখন সে ট্র্যাভিজের সাথে টার্মিনাস ত্যাগ করে হয়তো তখন আশা করেছিল তার স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। আমরাও নিশ্চিত ছিলাম যে দুজনকে হাতে পাবো। ব্যাপারটা উল্টে গেছে–এখন আপনারা জানেন তারা আসছে না। চলে গেছে। অজানা গন্তব্যে এবং কেন গেছে কোনো কারণে সেটা এখনো জানা যায় নি।
কথা বলার সময় ডেলারমির গোলাকার মুখ আরো সুন্দর হয়ে গেল, এতে চিন্তিত হওয়ার কি আছে? ওরা না আসলে আমরা নিশ্চয়ই আরো বিপদে পড়বনা। ওরা যেহেতু এত সহজে আমাদের কথা ভুলে গেছে, তাতে ধরে নেয়া যায় যে প্রথম ফাউণ্ডেশন ট্র্যানটরের আসল ব্যাপারটা ধরতে ব্যর্থ হয়েছে, সেজন্য প্রীম পালভারকে ধন্যবাদ জানাতে হয়।
বেশি চিন্তাভাবনা না করলে, এমন একটা সহজ সমাধানে পৌঁছানো যায়। জেনডিবল বলল, এটাও তো হতে পারে যে ট্রানটরের আসল গুরুতু ধরতে না পারার কারণেই তারা অন্যদিকে চলে যায়নি? হতে পারে দুজনকে পরীক্ষা করে পৃথিবীর ব্যাপারে আমরা জেনে যাবো বলেই অন্যদিকে চলে গেছে?
টেবিলের চারদিকে নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেছে।
যে কেউ, ডেলারমি ঠাণ্ডা গলায় বলল, তার ভীতিকর স্বপ্নগুলো সুন্দর বাক্যে গুছিয়ে নিতে পারে। কিন্তু তোমার কথার কোনো অর্থ আছে? দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন পৃথিবী সম্পর্কে কি ভাবছে সেটা নিয়ে কে মাথা ঘামাবে? হতেপারে এটা মূল গ্রহ, ট্র প্ল্যানেট অফ অরিজিন অথবা শুধুই একটা গল্প অথবা এমন কোনো একক স্থান নেই যেখান থেকে সবকিছু শুরু হয়েছিল। অবশ্যই বিষয়টা শুধু হিস্টোরিয়ান, এনথ্রপলজিষ্ট এবং লোক গল্প সংগ্রাহকদের আকর্ষণ করবে, যেমন পেলোরেট কে করেছে। আমরা আগ্রহী হব কেন?
কেন হবনা? জেনডিবল বলল, যদি নাই হই, তাহলে লাইব্রেরিতে পৃথিবী সম্বন্ধে কোনো তথ্য নেই কেন?
এই প্রথমবারের মতো টেবিলের চারপাশের আবহাওয়া থেকে বিরূপ ভাব দূর হয়ে গেল।
ডেলারমি জিজ্ঞেস করল, নেই?
জেনডিবল শান্ত গলায় বলল, যখন প্রথম শুনলাম যে ট্র্যাভিজ এবং পেলোরেট পৃথিবীর ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করতে এখানে আসছে, তখন আমি লাইব্রেরির কম্পিউটারকে এই বিষয়ে যত ডকুমেন্টস আছে তার তালিকা তৈরি করতে বলি। আমার আগ্রহ কমে যায় যখন কম্পিউটার জানায় যে কিছু নেই–একেবারেই কিছু ছিল না।
তারপর আপনারা দুদিন সময় নষ্ট করলেন, একই সময়ে আমার কৌতূহল বেড়ে গেল যখন শুনলাম প্রথম ফাউণ্ডেশনাররা এখানে আসছে না। আপনারা যখন বসে বসে ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন, সেই সময় আমি আমার নিজের সংগ্রহের কিছু ইতিহাসের বই পড়ি। সেখানে বেশ কয়েক জায়গায় ইমপেরিয়াল যুগের শেষ পর্যায়ে মূল প্রশ্ন নিয়ে অনুসন্ধানের ব্যাপারটা চোখে পড়ে। এই বিষয়ে ছাপানো এবং ফিল্ম –দুধরনের নির্দিষ্ট কিছু ডকুমেন্টের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। লাইব্রেরিতে গিয়ে এবার আমি নিজে সেগুলো খুঁজে দেখি। কিছু পাইনি।
ডেলারমি বলল, না পেলে অবাক হওয়ার কি আছে। যদি পৃথিবী আসলেই একটা লোককাহিনী হয়
তাহলে মিথজিক্যাল রেফারেন্সে পাওয়া যেত। যদি ঠাকুৰ্মার গল্প হয় তাহলে রূপকথার বইয়ে এর নাম থাকত। যদি কোনো অসুস্থ মনের কল্পনা হয় তাহলে সাইকোপ্যাথলজীর কোনো না কোনো জায়গায় এই বিষয়ের উল্লেখ থাকত। আসলে পৃথিবীর ব্যাপারে কোনো না কোনো বর্ণনা অবশ্যই আছে। নইলে আপনারা সবাই এই নামটা জানতেন না বা অন্তত মানব প্রজাতির বিকাশের মূল গ্রহ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারতেন না। তাহলে কেন লাইব্রেরি বা অন্য কোথাও এই বিষয়ে কোনো রেফারেন্স নেই?
ডেলারমি চুপ করে গেল এই ফাঁকে কথা বলল আরেকজন স্পিকার। তার নাম লিওনিস চ্যাং, ছোটখাটো মানুষ, সেলডন প্ল্যানের খুটিনাটি বিষয়ে অসম্ভব জ্ঞান রাখেন এবং আসল গ্যালাক্সির ব্যাপারে উদাসীন। যখন কথা বলে চোখ দুটো ঘনঘন পিট পিট করতে থাকে। সবাই জানে যে সাম্রাজ্যের শেষ সময়ে সবার মনযোগ প্রি ইম্পেরিয়াল যুগের প্রতি আকৃষ্ট করে একটা রহস্য তৈরি করার চেষ্টা করেছিল।
জেনডিবল মাথা নাড়ল। সংক্ষেপে বলা যায় মনযোগ সরানো হয়েছিল, স্পিকার চ্যাং। কিন্তু তার মানে এই না যে সমস্ত প্রমাণ নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। আপনি অন্যদের চেয়ে ভাল জানেন যে সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে হঠাৎ করে প্রাথমিক যুগের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠা। আমি এইমাত্র হ্যারি সেলডনের সময়ে মূল প্রশ্নের প্রতি আগ্রহের কথা বলেছি।
চ্যাং গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল, আমি ভাল করেই জানি, ইয়ংম্যান, এবং তুমি যা ধারণা করেছ, সাম্রাজ্যের পতনের এই সামাজিক সমস্যাগুলোর ব্যাপারে তার চেয়েও বেশি জানি। ইমপেরিয়ালাইজেশন প্রক্রিয়া পৃথিবী সম্পর্কিত যাবতীয় গবেষণার গুরুত্ব কমিয়ে দেয়। দ্বিতীয় ক্লিয়ন-এর অধীনে সাম্রাজ্যের সর্বশেষ পুনরুত্থানের সময়, সেলডনের মৃত্যুর দুই শতাব্দী পরে ইমপেরিয়ালাইজেশন-এর চূড়ান্ত পর্যায়ের কারণে পৃথিবী নিয়ে সকল চিন্তা ভাবনা একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। দ্বিতীয় ক্লিয়নের সময়ে এক নির্দেশে এই বিষয়ে বলা হয়েছিল, নীরস এবং নিষ্ফল গবেষণা যা রাজশক্তির উপর থেকে মানুষের ভালবাসা কমিয়ে দিচ্ছে।
জেনডিবল হাসল। তাহলে স্পিকার চ্যাং, আপনি বলছেন দ্বিতীয় ক্লিয়নের সময়ে পৃথিবীর সকল রেফারেন্স ধ্বংস করা হয়েছে?
আমি কোনো উপসংহার টানছিনা। শুধু যা ঘটেছিল তার বর্ণনা দিচ্ছি।
আপনি বেশ হুঁশিয়ার। যাই হোক, ক্লিয়নের সময়ে হয়তো সাম্রাজ্যের পুনরুত্থান হয়েছিল, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় এবং লাইব্রেরি অন্তত আমাদের বা আমাদের পূর্বসূরীদের হাতে ছিল। দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের স্পিকারদের অজ্ঞাতে কোনো জিনিস সরিয়ে ফেলা ছিল অসম্ভব। আসলে কাজটার জন্য স্পিকারদের দায়ী করা যায়।
জেনডিবল থামল, চ্যাং কিছু বলল না, জেনডিবলের মাথার উপর দিয়ে তাকিয়ে আছে।
আবার শুরু করল জেনডিবল, সেলডনের সময়ে লাইব্রেরি থেকে পৃথিবী সম্পর্কিত দলিল প্রমাণ সরানো সম্ভব ছিলনা, যেহেতু মূলপ্রশ্ন ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা। পরবর্তী সময়েও সরানো সম্ভব ছিলনা, কারণ দায়িত্ব ছিল দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের হাতে। অথচ লাইব্রেরি থেকে প্রমাণগুলো সরানো হয়েছে। কিভাবে?
ডেলারমি অধৈর্য স্বরে বলল, জেনডিবল উভয় সংকট তৈরি না করে বরং এই। ধাঁধার সমাধান কি বল। তুমি নিজেই ডকুমেন্টসগুলো সরিয়েছ?
স্বাভাবিকভাবেই ডেলারমি, আপনি একেবারে আসল জায়গায় হাত দিয়েছেন? তারপর জেনডিবল বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে মাথা নিচু করল। একটা সমাধান হচ্ছে ডকুমেন্টসগুলো সরিয়েছে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের কোনো স্পিকার যে জানে কিভাবে কিউরেটরকে ব্যবহার করলে তার স্মৃতিতে কিছু থাকবে না এবং কম্পিউটারে কোনো রেকর্ড থাকবে না।
ফার্স্ট স্পিকার স্যান্ডেস রেগে গেলেন। উদ্ভট কথা, স্পিকার জেনডিবল। আমি কল্পনাও করতে পারি না কোন স্পিকার কাজটা করেছে। কেন করবে? এমনকি যদি কোনো কারণে পৃথিবী সম্পর্কিত প্রমাণগুলো কেউ সরিয়ে ফেলে, টেবিলের কাছ থেকে সেটা গোপন রাখবে কেন? যেখানে ধরা পড়ে যাওয়ার পুরোপুরি সম্ভাবনা রয়েছে সেখানে কেন একজন তার ক্যারিয়ার নষ্ট করার ঝুঁকি নেবে? তাছাড়া আমার মতে সবচেয়ে দক্ষ স্পিকারের পক্ষেও প্রমাণ না রেখে কাজটা করা সম্ভব না।
তাহলে, ফার্স্ট স্পিকার, আপনি নিশ্চয় স্পিকার ডেলারমির সাথে একমত নন। যে কাজটা আমি করেছি।
অবশ্যই, ফার্স্ট স্পিকার বললেন। তোমার বিচার বুদ্ধির উপর মাঝে মাঝে সন্দেহ হলেও আমি তোমাকে পুরোপুরি পাগল মনে করিনা।
তাহলে এটা কখনোই ঘটত না, ফার্স্ট স্পিকার। পৃথিবীর তথ্য প্রমাণগুলো এখনো লাইব্রেরিতে থাকা উচিত, যেহেতু সেগুলো সরানোর সম্ভাব্য সবগুলো উপায় আমরা বাতিল করে দিয়েছি–অথচ সেগুলো নেই।
ডেলারমি ক্লান্ত স্বরে বলল, বেশ, শেষ করা যাক। আবারো জিজ্ঞেস করছি, সমাধান কি হবে? আমি নিশ্চিত যে তোমার কাছে একটা সমাধান আছে।
আপনি নিশ্চিত হলে, স্পিকার, আমরা সবাই নিশ্চিত হতে পারি। আমার মতে লাইব্রেরি থেকে তথ্য প্রমাণগুলো সরিয়েছে আমাদেরই কেউ যে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের বাইরের কোনো সূক্ষ্ম শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ব্যাপারটা কারো চোখে পড়েনি কারণ সেই একই শক্তি চেয়েছে যেন এটা গোপন থাকে।
ডেলারমি হাসল। যতক্ষণ না তোমার চোখে পড়ে। যদি এই রহস্যময়শক্তি থাকেই তাহলে তুমি কিভাবে ধরতে পারলে যে লাইব্রেরিতে তথ্য প্রমাণগুলোনেই? কেন তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়নি?
জেনডিবল গম্ভীর গলায় বলল, হাসির কোনো ব্যাপার না, স্পিকার। আমাদের মতো হয়তো তারাও মনে করে যে নিয়ন্ত্রণ যত কম হবে ততই ভালো। কিছুদিন আগে যখন বিপদে পড়েছিলাম তখনো নিজেকে রক্ষা করার চেয়ে গুরুত্ব দিয়েছিলাম কোনো হ্যামিশ মাইন্ড নিয়ন্ত্রণ করা থেকে বিরত থাকার প্রতি। হয়তো প্রতিপক্ষ মনে করেছে নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে নেয়াই হবে নিরাপদ। এখানেই সবচেয়ে বড় বিপদ। আসলে ব্যাপারটা আমার চোখে ধরা পড়েছে, অর্থাৎ প্রতিপক্ষ ধরে নিয়েছে যে তারা জিতে গেছে। আর আমরা এখনো আমাদের খেলা চালিয়ে যাচ্ছি।
কিন্তু কেন তারা এগুলো করছে? কি উদ্দেশ্যে? ডেলারমি মেঝেতে পা ঠুকে জিজ্ঞেস করল। সে বুঝতে পারছে টেবিলের সবাই আগ্রহী হয়ে উঠছে এবং তার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে।
প্রথম ফাউণ্ডেশন তার ব্যাপক শক্তি নিয়ে পৃথিবী অনুসন্ধান করছে। ভান করছে। যে তারা দুজন বেপরোয়া লোককে মহাকাশে পাঠিয়েছে এবং আশা করছে আমরাও ঠিক তাই মনে করব। অথচ তাদেরকে এমন একটা মহাকাশযান দিয়েছে যেটা ঘণ্টায় দশহাজার পারসেক যেতে পারে।
আর আমরা পৃথিবী খুঁজতে যাইনি এবং আমাদের অজান্তেই এই গ্রহের সমস্ত তথ্য সরিয়ে ফেলা হয়েছে। প্রথম ফাউণ্ডেশন অনেকদূর এগিয়ে গেছে কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারিনি, সেটা
জেনডিবল থামল এবং ডেলারমি বলল, সেটা কি? তোমার ছেলেভুলানো গল্পটা শেষ কর। তুমি কিছু জানো নাকি জানো না?
আমি সবকিছু জানি না, স্পিকার। চারপাশে ছড়ানো জাল আমি ভেদ করতে পারিনি, কিন্তু জানি একটা জাল ছড়ানো রয়েছে। পৃথিবীর গুরুত্ব কি হতে পারে আমি জানি না, কিন্তু নিশ্চিত যে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন ভয়ংকর বিপদের মুখে পড়েছে সেই সাথে সেলডন প্ল্যান এবং মানবজাতির ভবিষ্যত।
ডেলারমি উঠে দাঁড়ালো। মুখ গম্ভীর। কঠিন কিন্তু নিয়ন্ত্রিত গলায় বলল, আবর্জনা। ফার্স্ট স্পিকার ব্যাপারটা শেষ করা উচিত। সে যা বলছে সেগুলো শুধু ছেলে ভুলানো নয় অপ্রাসঙ্গিকও। তত্ত্বের জাল তৈরি করে সে তার অপরাধের মাত্রা কমাতে পারবে না। ব্যাপারটা নিষ্পত্তির জন্য আমি ভোটের মাধ্যমে সবাইকে একমত হওয়ার দাবী করছি।
দাঁড়ান, জেনডিবল ধারালো গলায় বলল। আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ দিয়েছেন, এবং আরেকটা ব্যাপার বাদ রয়েছে শুধু একটা। সেটা বলতে দিন তারপর ভোটাভুটির ব্যাপারে আমি আর কোনো আপত্তি করব না।
ফার্স্ট স্পিকার তার ক্লান্ত চোখ দুটো ডলে নিলেন। তুমি বলে যাও স্পিকার জেনডিবল। টেবিলের কাছে পরিষ্কার করে দেয়া উচিত যে একজন স্পিকারকে অভিযুক্ত করে অপসারণ করার ঘটনা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের পূর্ণ সুযোগ দেয়া উচিত। আরো মনে রাখবেন আজকে আমরা সন্তুষ্ট হলেও আমাদের পরে যারা আসবে তারা সন্তুষ্ট নাও হতে পারে এবং আমি বিশ্বাস করি না যে স্পিকাররা ছাড়াও যে কোনো স্তরের দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনারদের ঐতিহাসিক ঘটনার ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা নেই। কাজেই অনাগত শতাব্দীর স্পিকারদের সমর্থন যেন পাই সেই লক্ষ্যে আমাদের কাজ করতে হবে।
ডেলারমি হিংস্র গলায় বলল, ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে নিজেদের হাস্যস্পদ করে তোলার ঝুঁকি আমরা নেব, ফার্স্ট স্পিকার। অভিযুক্তকে কথা চালিয়ে যেতে দেয়ার সিদ্ধান্ত আপনার।
জেনডিবল লম্বা দম নিল, আপনার অনুমতি নিয়ে, ফার্স্ট স্পিকার, আমি একজন সাক্ষীকে ডাকতে চাই–একজন তরুণী, তিনদিন আগে তার সাথে আমার পরিচয় এবং তার সাহায্য ছাড়া আমি সেদিন মিটিং-এ পৌঁছতে পারতাম না।
মেয়েটি কি টেবিলের কাছে পরিচিত? ফার্স্ট স্পিকার জিজ্ঞেস করলেন।
না, ফার্স্ট স্পিকার। সে এই গ্রহের স্থানীয় বাসিন্দা।
ডেলারমি চোখ বড় করে বলল। হ্যামিশ মেয়ে?
হ্যাঁ তাই।
তাদের একজনকে নিয়ে আমরা কি করব? ওরা যা বলবে তার কোনো গুরুত্ব নেই। ওদের কোনো অস্তিত্ব নেই।
দাঁত বেড়িয়ে পড়ল জেনডিবলের, কিন্তু সেটাকে কোনোক্রমেই হাসি বলা যাবে না। ধারালো গলায় বলল, প্রত্যেক হ্যাঁমিশের বাস্তব অস্তিত্ব রয়েছে। তারা মানুষ এবং সেলডন প্ল্যানে যথাযথ ভূমিকা পালন করছে। দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের পরোক্ষ নিরাপত্তায় তাদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। স্পিকার ডেলারমির অমানবিক আচরণের প্রতি আমার সমর্থন নেই এবং আশা করছি তার মন্তব্য রেকর্ডে রাখা হবে যেন পরবর্তীকালে স্পিকার পদের জন্য তার অযোগ্যতার প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বাকী সবাই কি স্পিকারের মন্তব্যের সাথে একমত এবং আমার সাক্ষীকে বাধা দেবেন?
ফার্স্ট স্পিকার বললেন, তোমার সাক্ষীকে ডাকো, স্পিকার?
জেনডিবল স্বস্তি বোধ করল। তার মাইন্ড সে গার্ড দিয়ে রেখেছে, কিন্তু নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভেতরে থেকেও সে বুঝতে পারল আসল বিপদ কেটে গেছে এবং সে জিতেছে।
.
৩৪.
ভয় পেয়েছে সুরা নোভী। চোখ দুটো বড় হয়ে গেছে, নিচের ঠোঁট কাঁপছে। হাত একবার মুঠ করছে আবার খুলছে। চুলগুলো ফিতা দিয়ে বাঁধা। থেকে থেকে কাঁপছে সূর্যতাপে দগ্ধ হওয়া মুখ। স্কার্টের ভাজ ঠিক করছে কিছুক্ষণ পরপর। দ্বিধাগ্রস্তভাবে টেবিলের চারপাশে স্পিকারদের দিকে তাকাচ্ছে–বড় বড় চোখে শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভয়।
সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে ঘৃণা ও অবজ্ঞা নিয়ে। ডেলারমি নোভীর মাথার উপর দিয়ে তাকিয়ে আছে। যেন তার উপস্থিতির ব্যাপারে সে সচেতন নয়।
সতর্কতার সাথে জেনডিবল নোভীর মাইন্ড-এর ত্বক স্পর্শ করে তাকে শান্ত ও শিথিল করে তুলল। একই কাজ সে হাত ধরে বা চিবুকে হাত বুলিয়ে করতে পারত, কিন্তু এখানে এই পরিস্থিতিতে সেটা অসম্ভব।
ফার্স্ট স্পিকার, আমি এই মহিলার সচেতন অনুভূতি অসাড় করে দিচ্ছি, যেন ভয় পেয়ে তার সাক্ষ্য বিকৃত না হয়। দয়া করে লক্ষ্য করুন–ইচ্ছা হলে আপনারাও দেখতে পারেন যে আমি কোনোভাবেই তার মাইন্ড মডিফাই করিনি।
জেনডিবলের গলা শুনে নোভী আতঙ্কে ফিরে তাকালো। অবাক হলো না জেনডিবল। জানে নোভী কখনো উচ্চপদস্থ দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনারদের নিজেদের ভেতর কথা বলতে দেখেনি বা শুনেনি। শব্দ, কণ্ঠস্বর, অনুভূতি এবং চিন্তার দ্রুত অদ্ভুত সংমিশ্রণের কোনো অভিজ্ঞতা তার নেই। তবে আতঙ্কটা যত দ্রুত এসেছিল, তত দ্রুত সরে গেল, তার মাইন্ড শান্ত করে দেয়ার কারণে।
শান্ত ভাব দেখা দিল নোভীর চেহারায়।
তোমার পেছনে একটা চেয়ার আছে, নোভী, জেনডিবল বলল, দয়া করে বস।
জড়োসড়োভাবে এগিয়ে গিয়ে সে চেয়ারে বসল।
কথা বলল পরিষ্কারভাবে, কিন্তু হ্যামিশ উচ্চারণের কারণে জেনডিবল মাঝে মাঝে তাকে পুনরাবৃত্তি করতে বাধ্য করল এবং প্রয়োজনে তার প্রশ্নগুলোও পুনরাবৃত্তি করল।
রাফির্যান্ট এবং তার মাঝে লড়াইয়ের বর্ণনা খুব ভালোভাবে দিল।
জেনডিবল জিজ্ঞেস করল, তুমি পুরো ঘটনা নিজের চোখে দেখেছ, নোভী?
না, মাস্টার। দেখলে আগেই থামাতে পারতাম। রাফির্যান্ট খুব ভালো মানুষ, তবে বুদ্ধিশুদ্ধি নেই।
কিন্তু তুমি পুরোটাই বর্ণনা করেছ। না দেখলে সেটা কি করে সম্ভব হলো?
রাফির্যান্টকে প্রশ্ন করে জেনেছি। সে লজ্জিত।
লজ্জিত? তুমি বলতে পারবে এর আগে সে এমন আচরণ করেছে কিনা?
রাফির্যান্ট? না, মাস্টার। শরীরটা বিশাল হলেও মানুষ হিসেবে মহান এবং ক্ষমতাবান।
আমার সাথে যখন দেখা হলো তখন এভাবে চিন্তা করে নি কেন?
অদ্ভুতই বলতে হবে। কারণটা বুঝতে পারিনি। সে নিজের মধ্যে ছিলনা। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ব্যাটা ফাঁকা-মাথা। স্কোওলারকে অপমান করেছিস কেন? সে বলেছিল, জানিনা এটা কিভাবে ঘটল। মনে হচ্ছিল যেন আমি একপাশে দাঁড়িয়ে আরেক আমাকে দেখছিলাম।
স্পিকার চ্যাং বাধা দিল। ফার্স্ট স্পিকার, একজন লোক এই মহিলাকে কি বলেছে সেটা জানার কোনো দরকার আছে? প্রশ্ন করার জন্য সেই লোকটাকে হাজির করা হয়নি?
হয়েছে। যদি এই মহিলার সাক্ষ্য গ্রহণের পর টেবিল আরো তথ্যপ্রমাণ চায়, আমি ক্যারল রাফির্যান্টকে ডাকতে পারি। যদি না চায়, এরপর টেবিল সরাসরি বিচারের কাজ শুরু করতে পারে।
খুব ভালো, ফার্স্ট স্পিকার বললেন, তোমার কাজ চালিয়ে যাও।
জেনডিবল বলল, আর তুমি, নোভী? দুজন পুরুষের ঝগড়ার মাঝে নাক গলানো কি তোমার জন্য স্বাভাবিক?
একমুহূর্ত চুপ করে থাকল নোভী, ভুরু সামান্য বাঁকা হয়ে আবার সোজা হয়ে গেলো। জানি না। আমি চাই না স্কোওলারদের কোনো ক্ষতি হোক। কোনো চিন্তা না করেই আমি মাঝখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। প্রয়োজন হলে আবারো করব।
নোভী, তুমি এখন ঘুমাবে। কিছু চিন্তা করবেনা। কোনো স্বপ্নও দেখবে না।
নোভী কিছুক্ষণ ফিসফিস করল। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেছে। চেয়ারের হেডরেস্টে মাথা এলিয়ে পড়ল।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে জেনডিবল বলল, ফার্স্ট স্পিকার, আমার সাথে এই মহিলার মাইন্ডে প্রবেশ করুন। আপনার কাছে খুব সরল এবং প্রতিসম মনে হবে, কিন্তু যা দেখবেন সেজন্য নিজেকে আপনার ভাগ্যবান মনে হবে।–এখানে-এখানে! দেখেছেন।
-যদি বাকী আপনারাও প্রবেশ করেন ভালো হবে একজন করে দেখলে।
টেবিলের চারপাশে গুঞ্জন শুরু হলো।
কারো মনে কোনো সন্দেহ আছে? জেনডিবল জিজ্ঞেস করল।
ডেলারমি বলল, আমার আছে, কারণ- কথা শেষ না করেই থেমে গেল। তার হয়ে জেনডিবলই বলল, আপনার ধারণা মিথ্যে প্রমাণ হাজির করার জন্য আমি ইচ্ছা করেই এই মহিলার মাইন্ড সমন্বয় করেছি? আপনি বলতে চান আমি এত সূক্ষ্ম এডজাস্টমেন্ট করার মতো দক্ষ–একটা মেন্টাল ফাইবার এমনভাবে সরিয়ে দিয়েছি যেন বাকীগুলোর কোনো সমস্যা না হয়। যদি করতে পারতাম তাহলে কি আপনাদের সাথে তর্ক করার কোনো প্রয়োজন ছিল? কেন নিজেকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাব? আপনাদের রাজী করানোর চেষ্টা করব? এই মহিলার মাইন্ড এ যা দেখা যাচ্ছে সেটা যদি আমি করতে পারতাম, তাহলে আপনারা প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ছাড়া আমার সামনে অসহায় হয়ে পড়তেন–সত্যি কথাটা হচ্ছে আপনারা কেউই এই মহিলার মতো কোনো মাইন্ড ম্যানিপুলেট করতে পারেন না। আমিও পারিনা। অথচ করা হয়েছে।
থেমে প্রত্যেক স্পিকারের দিকে একবার তাকালো। তারপর ডেলারমির দিকে দৃষ্টি স্থির করে ধীর গলায় বলল, যদি আরো কিছু জানার থাকে, আমি হ্যামিশ কৃষক ক্যারল রাফির্যান্টকে ডেকে আনতে পারি। তাকেও আমি পরীক্ষা করেছি এবং তার মাইন্ডও একইভাবে সমন্বয় করা হয়েছে।
তার কোনো দরকার নেই, ফার্স্ট স্পিকার বললেন, মুখে দুঃশ্চিন্তার ছাপ। যা দেখেছি, সেটা যথেষ্ট ভয়ংকর।
সে ক্ষেত্রে এই হ্যামিশ মহিলাকে বিদায় করে দেয়া যায়? ওর শুশ্রূষার জন্য বাইরে কয়েকজনকে দাঁড় করিয়ে রেখেছি।
আলতোভাবে নোভীর কনুই ধরে জেনডিবল তাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল, তারপর ফিরে এসে বলল, দ্রুত সংক্ষেপে বলছি। আমাদের ক্ষমতার চেয়েও সূক্ষ্মভাবে মাইন্ড পরিবর্তন করা সম্ভব এবং হচ্ছেও। ঠিক এভাবেই কিউরেটররা লাইব্রেরি থেকে পৃথিবীর যাবতীয় তথ্য সরিয়ে ফেলার জন্য প্রভাবিত হয়েছে। আমরা দেখেছি আমাকে দেরি করিয়ে দেয়ার জন্য কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। আমাকে হুমকি দেয়া হয়েছিল; তারপর উদ্ধার করা হয়েছিল। ফলাফল হচ্ছে আমার অপসারণ। হয়তো আমি তাদের জন্য বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, তাই আমাকে সরানো প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।
ডেলারমি সামনে ঝুঁকল। প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছে। এই গোপন সংগঠন যদি এতই চালাক হয়, তুমি এত কিছু জানলে কি করে?
জেনডিবল এখন মন খুলে হাসতে পারছে। আমার কোনো কৃতিত্ব নেই। অন্য স্পিকারদের চেয়ে আমি বেশি জানি তাও বলছিনা। যাই হোক, এন্টি মিউলরা নামটা দিয়েছেন ফার্স্ট স্পিকার অসম্ভব জ্ঞানী বা পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে পুরোপুরি মুক্ত না। সম্ভবত এই হ্যামিশ মহিলাকে তারা হাতিয়ার হিসাবে নির্বাচন করেছিল কারণ তার অত্যন্ত ক্ষুদ্র এডজাষ্টমেন্টের প্রয়োজন ছিল। তার নিজের বৈশিষ্ট্য বজায় ছিল, স্কলারদের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং অনুগত।
কিন্তু তারপর, সব শেষ হওয়ার পর, আমার স্বল্প সময়ের সংস্পর্শ তার স্কলার হওয়ার স্বপ্নকে আরো বাড়িয়ে দেয়। এই উদ্দেশ্য নিয়ে পরেরদিন সে আমার কাছে আসে। তার এই ব্যতিক্রমী উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে আমি কৌতূহলী হয়ে তার মাইন্ড পরীক্ষা করি–অন্য অবস্থায় সেটা অবশ্যই করতামনা এবং প্রায় দুর্ঘটনাবশত এই এডজাষ্টমেন্ট-এর উপর হোঁচট খাই এবং এর গুরুত্বটা চোখে পড়ে। স্কলার হওয়ার আগ্রহ নেই এমন কাউকে নির্বাচন করলে হয়তো এডজাস্টমেন্টের জন্য এন্টি মিউলদের আরো বেশি পরিশ্রম করতে হতো, কিন্তু আমি ধরতে পারতাম না। ধরা পড়ে যাবে এই ব্যাপারটা এন্টি-মিউলরা হিসাব করে নি।
ডেলারমি বলল, ফার্স্ট স্পিকার এবং তুমি এই সংগঠনের নাম দিয়েছ–এন্টি মিউল, কারণ বোধহয় তারা মিউলের মতো ধ্বংস না করে, সেলডন প্ল্যানকে সঠিক পথে রাখতে চাচ্ছে। তাহলে আর এন্টি মিউলদের ভয় কি?
তারা কষ্ট করছে কেন যদি কোনো উদ্দেশ্য না থাকে? কি উদ্দেশ্য, সেটা জানি না। একজন হতাশাবাদী বলতে পারে তারা হয়তো ভবিষ্যতের কোনো সময়ে ইতিহাসের ধারা পরিবর্তন করে দেবে। হতাশাবাদীরা সন্তুষ্ট হলেও আমরা হতে পারি না। স্পিকার ডেলারমি কি মনে করেন এগুলো মহাজাগতিক পরার্থবাদ, কেউ একজন আমাদের কাজগুলো করে দিচ্ছে, প্রতিদানের আশা না করেই।
এই কথায় সবাই হেসে ফেলল এবং জেনডিবল জানে যে সে জিতেছে। এবং ডেলারমি জানে যে সে হেরে গেছে, কারণ তার ধারালো মেন্টালিক কন্ট্রোলের ভিতর দিয়েও রাগের প্রবাহ ধরা পড়ল, অনেকটা যেন গাছের পাতার আচ্ছাদনের। ভেতর দিয়ে সূর্যের হঠাৎ এক ঝলক আলো।
জেনডিবল বলল, হ্যামিশ কৃষকের মুখোমুখি হয়ে ভেবেছিলাম এর পেছনে কোনো স্পিকারের হাত রয়েছে। হ্যামিশ মহিলার মাইন্ডে এডজাস্টমেন্ট যখন ধরা পড়ল, তখন বুঝতে পারলাম যে পরিকল্পনাটা আমি ঠিকই ধরেছি কিন্তু পরিকল্পনাকারীর ব্যপারে ভুল করেছি। সে জন্য আমি দুঃখিত এবং সবাইকে ব্যাপারটা ভুলে যেতে অনুরোধ করছি।
ফার্স্ট স্পিকার বললেন। আমার মতে তার বক্তব্য ক্ষমাপ্রার্থনার
ডেলারমি বাধা দিল। অনেক শান্ত হয়ে গেছে–চেহারায় বন্ধুত্বের আভাস, কণ্ঠস্বর নরম। ফার্স্ট স্পিকার, ইমপিচমেন্টের ব্যাপারটা আমরা বাদ দিতে পারি। এই মুহূর্তে আমি দোষী সাব্যস্ত করার পক্ষে ভোট দেবনা এবং আমার মনে হয় কেউই দেবে না। আমি বরং পরামর্শ দেব যে স্পিকারের রেকর্ড থেকে ইমপিচমেন্টের কথাটা মুছে ফেলা হোক। স্পিকার জেনডিবল নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন। সে কারণে তাকে আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি এবং আসল বিপদ দেখিয়ে দেয়ার জন্য। আমার প্রথম দিককার আচরণের জন্য আমি স্পিকারের কাছে। আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাইছি।
ডেলারমি তাকিয়ে আছে জেনডিবলের দিকে। নিজের পরাজয় ঢাকার জন্য যেভাবে দ্রুত আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে দিল, সেটা দেখে জেনডিবল অনিচ্ছায় হলেও প্রশংসা না করে পারল না। এটাও জানে যে এই সবকিছু হচ্ছে নতুন দিক থেকে আক্রমণ করার পায়তারা।
সে নিশ্চিত, যা আসছে সেটা আনন্দদায়ক কিছু হবে না।
.
৩৫.
নিজের আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব দিয়ে স্পিকার ডেলোরা ডেলারমি স্পিকার টেবিল প্রভাবিত করতে পারে। মৃদু কণ্ঠস্বর, মনভোলানো হাসি, চকচকে চোখ, সবকিছু মিলে চমৎকার। এই মুহূর্তে তাকে বাধা দেয়ার সাহস কারো নেই।
স্পিকার জেনডিবলকে ধন্যবাদ, আমার বিশ্বাস, এখন আমরা জানি আমাদেরকে কি করতে হবে। এন্টি-মিউলদের আমরা দেখিনি; তাদের ব্যাপারে কিছুই জানি না, শুধু এখানে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের নিজস্ব গন্ডীর ভেতর বসবাসকারী সাধারণ মানুষের মাইন্ডে তাদের অনুপ্রবেশ ছাড়া। আমরা জানিনা প্রথম ফাউণ্ডেশন কি পরিকল্পনা করেছে। হয়তো আমাদের এন্টি-মিউল এবং প্রথম ফাউণ্ডেশনের মুখোমুখি হতে হবে। আমরা জানি না।
আমরা জানি যে গোলান ট্র্যাভিজ এবং তার সঙ্গী নামটা এই মুহূর্তে আমার মনে নেই, অজানা কোনো গন্তব্যে রওয়ানা হয়েছে এবং ফার্স্ট স্পিকার আর জেনডিবল মনে করছে আসন্ন সমস্যার সমাধান রয়েছে ট্র্যাভিজের হাতে। তাহলে এখন আমরা কি করতে পারি? অবশ্যই ট্র্যাভিজের ব্যাপারে আমাদেরকে সবকিছু জানতে হবে; সে কোথায় যাচ্ছে; কি ভাবছে; কি উদ্দেশ্য; অন্তত তার কোনো গন্তব্য বা উদ্দেশ্য রয়েছে কি না; আসলে সে কোনো বিশাল শক্তির একটা হাতিয়ার মাত্র।
তাকে নজরে রাখা হয়েছে। জেনডিবল বলল।
ডেলারমি প্রশ্রয়ের হাসি হাসল। কে নজরে রেখেছে? বহির্বিশ্বের আমাদের কোনো এজেন্ট? সেই এজেন্ট এখানে শক্তির যে নমুনা দেখেছি তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে? অবশ্যই না। মিউলের সময়ে এবং তার পরবর্তী সময়েও, যখন কোনো উপায় ছিল না তখন দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন তার শ্রেষ্ঠ লোকদের উৎসর্গ করে দিতে দ্বিধা করে নি। সেলডন প্ল্যান পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য প্রিম পালভার নিজে ট্রানটরিয়ান বণিকের ছদ্মবেশে গ্যালাক্সিতে ঘুরে বেড়িয়েছেন, আর্কেডিকে ফিরিয়ে আনার জন্য। যেখানে বিপদ আগেরগুলোর চেয়ে অনেক বেশি ভয়ানক, আমরা চুপ করে বসে থাকতে পারি না। ওয়াচার এবং মেসেঞ্জারদের উপর নির্ভর করতে পারি না।
আপনি এই মুহূর্তে ফার্স্ট স্পিকারকে ট্র্যানটর ত্যাগ করার পরামর্শ দিচ্ছেন না। নিশ্চয়?
অবশ্যই না। এখানে তাকে আমাদের প্রয়োজন। অন্যদিকে রয়েছ তুমি, স্পিকার জেনডিবল। তুমিই বিপদের গুরুত্ব ধরতে পেরেছ। লাইব্রেরি এবং হ্যামিশ মাইন্ডে বাইরের সূক্ষ্ম হস্তক্ষেপ তুমি ধরতে পেরেছ। টেবিলের সম্মিলিত বিরোধিতা সত্ত্বেও তুমি জয়ী হয়েছ। এখানে কেউ নেই যে আসল ব্যাপার তোমার মতো পরিষ্কার বুঝতে পারবে। আমার মতে তোমারই গিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করা উচিত। আমি কি সবার অনুভূতি জানতে পারি?
সবার অনুভূতি প্রকাশ করার জন্য কোনো আনুষ্ঠানিক ভোটের প্রয়োজন ছিল না। প্রত্যেক স্পিকার প্রত্যেকের মাইন্ড বুঝতে পারেন এবং জেনডিবল হঠাৎ আতঙ্কের সাথে বুঝতে পারল ঠিক তার বিজয় এবং ডেলারমির পরাজয়ের মুহূর্তে, এই মহিলা তাকে এমন একটা কাজে জড়িয়ে ফেলছে যেটা তাকে অনির্ধারিত সময় পর্যন্ত ব্যস্ত রাখবে, যখন ডেলারমি থেকে যাবে পিছনে স্পিকারদের টেবিল নিয়ন্ত্রণ করবে–তারপর দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন–তারপর গ্যালাক্সি। আর যদি জেনডিবল বর্তমান সমস্যা থেকে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের মুক্তি পাবার তথ্য সংগ্রহ করতে পারে কৃতিত্বটা পাবে ডেলারমি, তার সফলতা শুধু ডেলারমির ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলবে। সে। যত দ্রুত সফল হবে, তত দ্রুত তার ক্ষমতা বাড়বে।
চমৎকার চাল, অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তন।
টেবিলকে প্রভাবিত করে এখন সেই ফার্স্ট স্পিকারের ভূমিকা পালন করছে। জেনডিবলের ভাবনা ঢাকা পড়ে গেল ফার্স্ট স্পিকারের প্রচণ্ড রাগের প্রবাহ অনুভব করতে পেরে।
ঘুরল সে। ফার্স্ট স্পিকার তার ক্রোধ গোপন করার কোনো চেষ্টাই করছেন না–এবং ব্যাপারটা দ্রুত পরিষ্কার হয়ে গেল যে একটা সমস্যার সমাধান হতে না হতেই আরেকটা অভ্যন্তরীণ সমস্যা তৈরি হয়েছে।
.
৩৬.
কুইন্ডর স্যান্ডেস, পঁচিশতম ফার্স্ট স্পিকার, নিজেকে তিনি অসাধারণ কিছু মনে করেন না।
ভালো করেই জানেন তিনি সেই কয়েকজন শক্তিশালী ফার্স্ট স্পিকারের মতো নন, যারা দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনের পাঁচ শতাব্দীর ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছেন হওয়ার প্রয়োজনও নেই। গ্যালাক্সির দীর্ঘস্থায়ী শান্তির যুগে তিনি টেবিল নিয়ন্ত্রণ করেছেন। আর সময়টাও শক্তি প্রদর্শনের সময় না।
তুমি কোনো অ্যাডভেঞ্চারার না, একজন স্কলার, চব্বিশতম ফার্স্ট স্পিকার তাকে বলেছিলেন। তুমি প্ল্যানটাকে রক্ষা করবে, যেখানে একজন অ্যাডভেঞ্চারার সেটা ধ্বংস করে ফেলবে। রক্ষা! তোমার টেবিলের জন্য এটাই যেন হয় মূলমন্ত্র।
তিনি চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তার অর্থ একটা অসাড় ফার্স্ট স্পিকারশীপ এবং মাঝে মাঝে সেটাকে দুর্বলতা হিসাবে ধরা হয়েছে। বর্তমানে গুজব শোনা যাচ্ছে যে তিনি নাকি অবসর নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং তার উত্তরাধিকারী নিয়ে খোলাখুলিই আলোচনা চলে।
স্যান্ডেস-এর মনে কোনো সন্দেহ নেই যে ডেলারমিই বিরোধী পক্ষের নেতা। সে-ই টেবিলে সবচেয়ে শক্ত প্রতিপক্ষ, জেনডিবলের চেয়েও। তারুণ্যের দীপ্তি এবং সাহস থাকা সত্ত্বেও জেনডিবল তার সামনে নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছে।
কিন্তু সেলডনের কসম, হয়তো তিনি দুর্বল, কিন্তু এমন কোনো ফার্স্ট স্পিকার নেই যে কখনো হাল ছেড়ে দিয়েছে বা দেবে।
তিনি উঠে দাঁড়াতেই টেবিলের সবাই থেমে গেল। যখন ফার্স্ট স্পিকার কথা বলার জন্য উঠে দাঁড়াবেন, তখন কোনো রকম বাধা দেয়া যাবে না। এমনকি ডেলারমি বা জেনডিবলও বাধা দিতে সাহস পেল না।
তিনি বললেন, স্পিকারস। আমি একমত যে আমরা একটা ভয়ানক বিপদের মুখোমুখি হয়েছি এবং সেটা মোকাবেলার জন্য জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। আমারই বাইরে গিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করা উচিত। কিন্তু এখানে আমার প্রয়োজন আছে এই কথা বলে স্পিকার ডেলারমি আমাকে সেই দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছেন। সত্যি কথা হচ্ছে আমাকে এখানে বা ওখানে কোনোখানেই প্রয়োজন নেই। আমি বৃদ্ধ হয়েছি; দুর্বল হয়ে পড়েছি। দীর্ঘদিন থেকে সবাই আশা করছে আমি অবসর নেব, এবং নেয়া উচিত। সফলভাবে বর্তমান সমস্যা মোকাবেলা করার পর আমি অবসর নেব।
কিন্তু নিজের উত্তরাধিকার নির্বাচনের অধিকার অধিকাংশ ফার্স্ট স্পিকারের রয়েছে। এখন সেই কাজটাই করতে যাচ্ছি। আমাদের মাঝে এমন একজন স্পিকার আছে যে দীর্ঘদিন থেকে টেবিলের কার্যপ্রণালী প্রভাবিত করছে; একজন স্পিকার যার প্রখর ব্যক্তিত্ব দ্বারা দৃঢ় নেতৃত্ব দিতে পারছে। বুঝতেই পারছ আমি স্পিকার ডেলারমির কথা বলছি।
থেমে একটু দম নিলেন, তারপর বললেন, শুধু তুমি একা, স্পিকার জেনডিবল, বিরোধিতা করে যাচ্ছ। জিজ্ঞেস করতে পারি কেন? তিনি বলেন, যেন জেনডিবল উত্তর দিতে পারে।
আমি বিরোধিতা করিনি, ফার্স্ট স্পিকার, জেনডিবল নিচু গলায় বলল। উত্তরাধিকার নির্বাচন করা আপনার বিশেষ অধিকার।
সেটাই করছি আমি। যখন তুমি ফিরে আসবে–এই সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়া সফলভাবে শুরু করার পর আমার অবসর নেয়ার সময় হবে। তখন আমার উত্তরাধিকারী সরাসরি সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার প্রয়োজনীয় নীতি নির্ধারণের দায়িত্ব নেবে।–তোমার কিছু বলার আছে, স্পিকার জেনডিবল?।
জেনডিবল শান্তস্বরে বলল, আপনি যখন স্পিকার ডেলারমিকে নির্বাচন করেছেন, ফার্স্ট স্পিকার, আশা করি আপনি তাকে উপদেশ দিয়ে
জোর গলায় বাধা দিলেন ফার্স্ট স্পিকার। আমি স্পিকার ডেলারমির কথা বলেছি, কিন্তু আমার উত্তরাধিকার হিসেবে তার নাম বলিনি। এখন তোমার কি বলার আছে?
ক্ষমা চাইছি, ফার্স্ট স্পিকার। বলা উচিত, এই মিশন থেকে ফেরার পর স্পিকার ডেলারমিকে দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন
ভবিষ্যতে কোনো অবস্থাতেই আমি তাকে উত্তরাধিকার নির্বাচিত করবনা। এখন তুমি কি বলবে? ডেলারমির দিকে ঘুষির মতো ঘোষণাটা ছুঁড়ে দেয়ার আগে ফাস্ট স্পিকার তার সন্তুষ্টি গোপন রাখতে পারলেন না। এর চেয়ে অপমানজনকভাবে কাজটা তিনি করতে পারতেন না।
বেশ, স্পিকার জেনডিবল, তিনি বললেন, তুমি কি বলবে?
শুধু বলব যে, আমি দ্বিধাগ্রস্ত।
ফার্স্ট স্পিকার আবার উঠে দাঁড়ালেন। সবাইকে প্রভাবিত করার মতো এবং নেতৃত্ব দেয়ার মতো গুণাবলী স্পিকার ডেলারমির রয়েছে, কিন্তু ফার্স্ট স্পিকার পদের জন্য সেগুলোই যথেষ্ট নয়। আমরা যা দেখতে পারিনি স্পিকার জেনডিবল সেটা দেখতে পেরেছে। সবার সম্মিলিত বিরোধিতার মুখে দাঁড়িয়ে সে তাদেরকে বিষয়টা পুনর্বিবেচনা এবং তার সাথে একটা চুক্তি করতে বাধ্য করেছে। জানিনা কেন স্পিকার ডেলারমি গোলান ট্র্যাভিজকে অনুসরণ করার দায়িত্ব স্পিকার জেনডিবলের উপর চাপিয়েছে, কিন্তু দায়িত্বটা তাকেই দেয়া উচিত। আমি জানি সে সফল হবে, যখন সে ফিরে আসবে, স্পিকার জেনডিবল হবে ছাব্বিশতম ফার্স্ট স্পিকার।
ফার্স্ট স্পিকার বসলেন, আর প্রত্যেক স্পিকার শব্দ, কণ্ঠস্বর, চিন্তা, ইঙ্গিত ইত্যাদির হট্টগোল দ্বারা সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা করতে লাগল। ফার্স্ট স্পিকার সেদিকে মনযোগ না দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কাজ শেষ হয়েছে, তিনি বুঝতে পারলেন–অবাক হয়ে ভাবলেন–দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার ভেতরও আনন্দ আছে। কাজটা আরো আগে করা উচিত হলেও তিনি করতে পারেন নি।
ঠিক এই মুহূর্তের আগে তিনি জানতেন না কার হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন।
তখনই তার মাইন্ড ডেলারমির মাইন্ড ধরতে পারল এবং তিনি চোখ তুললেন।
সেলডন! শান্ত এবং হাসছে সে। তার বেপরোয়া ক্রোধ প্রকাশ পায়নি–হাল ছাড়েনি। সে আর কি করতে পারে?
.
৩৭.
প্রয়োজন হলে ডেলোরা ডেলারমি তার বেপরোয়া ক্রোধ আর বিরক্তি খোলাখুলি প্রকাশ করতে পারে।
যে বুড়োটা টেবিলকে চালাচ্ছে বা কম বয়সের ইডিয়ট যার কারণে তার ভবিষ্যত নষ্ট হয়ে গেছে, তাদেরকে একটা ধাক্কা দিতে পারলে সে সন্তুষ্টি পাবে। কিন্তু সে শুধু সন্তুষ্টি পেতে চায় না। তার আরো কিছু প্রয়োজন।
সে চায় ফার্স্ট স্পিকার হতে।
আর এখন একটা হাত তুলে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল সে। বাকী সদস্যরা পুরোপুরি স্বাভাবিক এবং শান্ত না হওয়া পর্যন্ত হাতটা তুলে রাখল।
ফার্স্ট স্পিকার, স্পিকার জেনডিবলের মতো আমিও আপনার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছি না। উত্তরাধিকার নির্বাচন করা আপনার বিশেষ অধিকার। আমার কথাগুলো হয়তো স্পিকার জেনডিবলের মিশনের সাফল্যের ব্যাপারে অবদান রাখবে। ব্যাখ্যা করে বলব, ফার্স্ট স্পিকার?
বল, ফার্স্ট স্পিকার কাটা কাটা গলায় বললেন। স্পিকারকে তার অনেক বেশি স্বাভাবিক মনে হচ্ছে।
ডেলারমি গম্ভীর ভাবে মাথা নিচু করল। এখন আর হাসছে না। আমাদের মহাকাশযান আছে, যদিও প্রথম ফাউন্ডেশনের মতো এত উন্নত না। স্পিকার জেনডিবল জানে সেগুলো কিভাবে চালাতে হয়। গ্যালাক্সির প্রধান প্রধান গ্রহগুলোতে আমাদের প্রতিনিধি রয়েছে, সবজায়গাতেই সে সুবিধা পাবে। তাছাড়া যেহেতু সে বিপদের ব্যাপারে সচেতন, এন্টি-মিউলদের কাছ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে। পুরোপুরি না জানলেও, আমার ধারণা তারা নিচু শ্রেণী এমনকি হ্যামিশ কৃষকদের নিয়ে কাজ করে। অবশ্যই স্পিকারসহ সকল দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনারদের মাইন্ড পরীক্ষা করে দেখা হবে, তবে আমি নিশ্চিত যে তারা নিরাপদ। এন্টি মিউলরা আমাদের ঘাটাতে সাহস পাবে না।
যাই হোক, স্পিকার জেনডিবলের অতিরিক্ত ঝুঁকি নেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। বিপজ্জনক কাজ করার অভ্যাস তার নেই। ভাল হবে সে যদি ছদ্মবেশ ধারণ করে, হ্যামিশ বণিকের ছদ্মবেশ নিয়ে যায়। আমরা জানি প্রিম পালভার, বণিকের ছদ্মবেশ নিয়ে গ্যালাক্সিতে বেরিয়েছিলেন।
ফার্স্ট স্পিকার বললেন, প্রিম পালভারের একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছিল, কিন্তু স্পিকার জেনডিবলের তা নেই। আর যদি কোনো ধরনের ছদ্মবেশ নিতে হয়, আমি নিশ্চিত কিছু একটা করার মতো বুদ্ধি তার আছে।
উইথ রেসপেক্ট, ফার্স্ট স্পিকার, আমি নির্দিষ্ট একটা ছদ্মবেশের কথা বলছি। আপনার নিশ্চয় মনে আছে, প্রিম পালভার তার দীর্ঘদিনের সঙ্গী, তার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। আর কোনো ছদ্মবেশ তার চরিত্রের সাধাসিধা বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলতে পারতনা। ফলে সব সন্দেহ দূর হয়ে যায়।
জেনডিবল বলল, আমার স্ত্রী নেই। কয়েকজন সঙ্গী ছিল, কিন্তু তারা কেউ স্বেচ্ছায় স্ত্রীর ভূমিকা পালন করবে না।
সেটা সবাই জানে, স্পিকার জেনডিবল, ডেলারমি বলল। স্বেচ্ছাসেবক একজন নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র তোমাকে সংগ্রহ করে দেয়া হবে। আমার মতে অন্তত একজন মহিলা তোমার সাথে আসবেই।
একমুহূর্তের জন্য জেনডিবলের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। সে নিশ্চয়ই
তার সাফল্যের অংশীদার হওয়ার জন্য কোনো কূটচাল? সে কি যুক্তভাবে ফাস্ট স্পিকারশীপের জন্য চেষ্টা করছে?
জেনডিবল হাসিমুখে বলল, স্পিকার ডেলারমির বোঝা উচিত যে তিনি
ডেলারমি হেসে ফেলল এবং জেনডিবলের দিকে সত্যিকার স্নেহের দৃষ্টিতে তাকালো। ফাঁদে পা দিয়ে বোকার মতো তাকিয়ে আছে জেনডিবল। টেবিল সেটা ভুলবে না।
স্পিকার জেনডিবল, এই কাজে অংশ নেয়ার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। আমার ধারণা ছিলনা যে তুমি আমাকে চাও। সত্যি, স্পিকার, এই বয়সে, নিজেকে আর আকর্ষণীয় মনে হয় না।
সবাই হাসছে এমনকি ফার্স্ট স্পিকারও চেষ্টা করছেন হাসি লুকানোর।
জেনডিবল চেষ্টা করল ব্যাপারটাকে হালকা করার। যতদূর সম্ভব হালকা গলায় বলল, তাহলে আপনার পরামর্শ কি? আমার সাথে আপনি যাবেন সেটা আমি চিন্তাও করিনি, এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন। টেবিলে আপনি সেরা, কিন্তু গ্যালাক্সির ব্যাপারে কিছু জানেন না।
মেনে নিচ্ছি, স্পিকার জেনডিবল, মেনে নিচ্ছি, ডেলারমি বলল। আমার পরামর্শ হচ্ছে তোমার হ্যামিশ বণিকের ভূমিকা বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে, সঙ্গী হিসেবে একজন হ্যামিশ মহিলার চেয়ে আর কে ভাল হবে?
হ্যামিশ মহিলা? দ্বিতীয়বারের মতো জেনডিবল আবাক হলো। বাকী সবাই ব্যাপারটা উপভোগ করছে।
হ্যামিশ মহিলা, ডেলারমি বলে যাচ্ছে। যে তোমাকে পিটুনির হাত থেকে বাঁচিয়েছে। তোমার দিকে দেবতার মতো ভক্তি নিয়ে তাকায়। যার মাইন্ড তুমি পরীক্ষা করেছ এবং যে তোমাকে দ্বিতীয়বারের মতো আরো বড় অপমানের হাত থেকে বাঁচিয়েছে। আমার পরামর্শ তাকে সাথে নিয়ে যাও।
জেনডিবল প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান করবে, কিন্তু জানে ডেলারমি সেটাই চায়। ফলে টেবিলের কাছে ব্যাপারটা আরো উপভোগ্য হয়ে উঠবে। এখন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে ফার্স্ট স্পিকার ডেলারমিকে থামানোর জন্য উত্তরাধিকার হিসেবে জেনডিবলের নাম বলে ভুল করেছেন
জেনডিবল সবচেয়ে কম বয়সের স্পিকার। টেবিলের সবাইকে সে খেপিয়েছে এবং তারপর নিজেকে সে নির্দোষ প্রমাণ করতে পেরেছে। ফার্স্ট স্পিকার হিসেবে কেউ তাকে সহজে মেনে নেবে না।
এখন আর সামলানোর কোনো উপায় নেই, কিন্তু তারা মনে রাখবে ডেলারমি কত সহজে তাকে হাস্যকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল। পরে সবাইকে সে বুঝাতে পারবে যে ফার্স্ট স্পিকার হওয়ার জন্য জেনডিবলের বয়স এবং অভিজ্ঞতার অভাব আছে। তাদের সম্মিলিত চাপের মুখে–যখন সে মিশন নিয়ে বাইরে থাকবে–ফার্স্ট স্পিকার হয়তো তার সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হবেন। আর যদি নাও বদলান জেনডিবল স্বভাবতই সম্মিলিত বিরোধিতার মুখে অসহায় হয়ে পড়বে।
সবগুলো বিষয় জেনডিবলের কাছে একবারে ধরা পড়ল এবং সে দ্বিধা না করে দ্রুত উত্তর দিল। স্পিকার ডেলারমি, আপনার বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারছি না। ভেবেছিলাম সবাইকে অবাক করে দেব। আপনি বলার আগেই আমি ঠিক করে রেখেছিলাম হ্যামিশ মহিলাকে সাথে নেব। তার মাইন্ড-এর কারণেই আমি তাকে নিতে চাই। আপনারাতো তার মাইন্ড পরীক্ষা করে দেখেছেন; বুদ্ধিমতি, তারচেয়েও বড় কথা, পরিষ্কার, সহজ সরল এবং নির্দোষ।
তবে কেউ খেয়াল করেছেন কি না জানি না, এই হ্যামিশ মহিলা চমৎকার ওয়ার্নিং সিস্টেম হিসেবে কাজ করবে। তার মাইন্ডের সাহায্যে আমি মেন্টালিজম এর উপস্থিতি সহজেই ধরতে পারব।
অবাক হয়ে গেছে সবাই। জেনডিবল বলল, ও কেউ খেয়াল করেন নি। ঠিক আছে, তেমন একটা গুরুত্ব নেই। এখন আমি যাবো। নষ্ট করার মতো সময় হাতে নেই।
দাঁড়াও, ডেলারমি বলল, তৃতীয়বারের মতো তার পরিকল্পনা ভেস্তে যাচ্ছে। তুমি কি করতে চাও?
জেনডিবল ছোট করে কাঁধ ঝাঁকালো। বিস্তারিত জানার দরকার কি? টেবিল যত কম জানবে এন্টি মিউলরা ততই তাদেরকে কম বিরক্ত করবে।
এমনভাবে বলল যেন টেবিলের নিরাপত্তাই তার কাছে প্রধান বিষয়। এই অনুভূতি দিয়ে সে তার মাইন্ড ভরিয়ে তুলল এবং সবাইকে সেটা দেখতে দিল।
.
৩৮.
সেদিন সন্ধ্যায় ফার্স্ট স্পিকার জেনডিবলের সাথে একা কথা বললেন।
তোমার কথাই ঠিক, তিনি বললেন। তোমার মাইন্ড সারফেস এ দেখেছি যে আমার ঘোষণাটাকে তুমি মনে করছ ভুল পদক্ষেপ। আসলেই তাই। আমি ডেলারুমির মুখের হাসি মুছে দিতে চেয়েছিলাম।
জেনডিবল নরম সুরে বলল, ভালো হতো শুধু আমাকে জানাতেন তারপর আমার ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন।
তাহলে তো প্রতিশোধ নেয়া হতো না। কাজটা ফার্স্ট স্পিকারের পক্ষে শোভা পায় না, আমি জানি।
এভাবে তাকে থামাতে পারবেন না, ফার্স্ট স্পিকার। সে এখনো এই পদে বসার আশা ছাড়েনি। আমি নিশ্চিত যে অনেকেই বলবে আমার উচিত আপনার মনোনয়ন প্রত্যাখ্যান করা। ডেলারমি টেবিলের সেরা মাইন্ড এবং সেরা ফার্স্ট স্পিকার হতে পারবে।
সেরা মাইন্ড, স্বীকার করছি, স্যান্ডেস গজগজ করে বললেন। স্পিকারদের ছাড়া সে অন্য কাউকে শত্রু মনে করেনা। তাকে স্পিকার বানানোই উচিত হয়নি।–দেখ, হ্যামিশ মহিলাকে সাথে নেয়ার ব্যাপারটা কি আমার বাধা দেয়া উচিত? আমি জানি তুমি বাধ্য হয়েছ।
না, না, তাকে সাথে নেয়ার যে কারণটা বলেছি সেটা সত্যি। আসলেই সে ওয়ার্নিং সিস্টেম হিসেবে কাজ করবে এবং বাধ্য করার জন্য আমি স্পিকার ডেলারমির প্রতি কৃতজ্ঞ। হ্যামিশ মহিলাকে দিয়ে অনেক কাজ হবে।
ঠিক আছে। ভাল কথা, আমিও মিথ্যে কথা বলছি না। আমি সত্যিই বিশ্বাস করি, এই বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য যা করা প্রয়োজন সব তুমি করবে–যদি আমার অন্তর্জানের উপর ভরসা করতে পারো।
বোধহয় পারি, সে কারণেই তো আপনার সাথে একমত হয়েছি। কথা দিচ্ছি, যাই ঘটুক না কেন আমি ফিরে আসব। আমি ফিরে আসব ফার্স্ট স্পিকার হওয়ার জন্য, এন্টি-মিউলরা বা স্পিকার ডেলারমি. যা ইচ্ছা করতে পারে।
কথা বলতে বলতেই জেনডিবল নিজেকে পরীক্ষা করল। সে এত আনন্দিত কেন, কেন মহাকাশে যেতে এত আগ্রহী। উচ্চাকাঙ্ক্ষা, অবশ্যই। প্রিম পালভার ঠিক এই কাজটাই করেছিলেন এবং সে প্রমাণ করে দেবে স্টর জেনডিবলও করতে পারে। তারপর ফার্স্ট স্পিকারের পদ কেউ তার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। এছাড়াও আরেকটা ব্যাপার রয়েছে। লড়াইয়ের আগ্রহ। যে ব্যক্তি প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের পুরোটাই কাটিয়েছে অনুন্নত গ্রহের অন্ধকার কুঠুরিতে তার জন্য উত্তেজনা খোঁজা স্বাভাবিক।–পরিষ্কার সব বলতে পারবে না, তবে এটুকু বলতে পারবে যে মহাকাশে যেতে সে ভীষণরকম আগ্রহী।
.
সেশেল
৩৯.
জেনভ পেলোরেট জীবনে প্রথমবারের মতো দৃশ্যগুলো দেখছে। ট্র্যাভিজের ভাষ্যমতে একটা মাইক্রোজাম্পের পর নক্ষত্র পরিণত হয়েছে উজ্জ্বল গোলকে। চতুর্থ গ্রহ–যেটাতে মানুষ বাস করে, তাদের পরবর্তী গন্তব্য–ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে এবং স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
গ্রহের একটা মানচিত্র তৈরি করে পোর্টেবল স্ক্রিনিং ডিভাইসে প্রদর্শন করছে কম্পিউটার। জিনিসটা রয়েছে পেলোরেটের কোলের উপর।
এর আগে বেশ কয়েকটি গ্রহে নেমেছে ট্র্যাভিজ। আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল, এখনই এত ভালভাবে দেখতে শুরু করোনা, জেনভ। প্রথমে আমাদেরকে এন্ট্রি স্টেশনে যেতে হবে। বেশ বিরক্তিকর একটা ব্যাপার।
পেলোরেট চোখ তুলল। নিশ্চয়ই শুধু আনুষ্ঠানিকতা।
হ্যাঁ। কিন্তু বিরক্তিকর।
কিন্তু এখন তো শান্তির সময়।
অবশ্যই। তার মানে আমরা এন্ট্রি স্টেশন পার হতে পারব। প্রথমে যদিও ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্সের ব্যাপারটা রয়েছে। প্রত্যেক গ্রহেরই নিজস্ব ইকোলজী রয়েছে। সেটা তারা নষ্ট করতে চায়না। তাই আমাদের মহাকাশযান পরীক্ষা করে দেখবে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত অর্গানিজম বা ইনফেকশন আছে কিনা।
আমার মনে হয় সেরকম কিছু নেই।
নেই, পরীক্ষা করলেই ওরা বুঝতে পারবে। আরেকটা কথা মনে রাখবে, সেশেল ফাউণ্ডেশন ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত না। তাদের স্বাধীনতার প্রতি আমাদের সম্মান জানাতে হবে।
ইন্সপেকশনের জন্য একটা ছোট যান এগিয়ে এল। সেখান থেকে একজন কাষ্টমস অফিসিয়াল উঠল তাদের যানে। নিজের সৈনিক জীবনের কথা মনে পড়ায় ট্র্যাভিজ চঞ্চল হয়ে পড়েছে।
ফার স্টার, টার্মিনাস থেকে এসেছে, সে বলল। জাহাজের কাগজপত্র। কোনো অস্ত্র নেই। ব্যক্তিগত ভেসেল। আমার পাসপোর্ট। একজন যাত্রী আছে। তার পাসপোর্ট। আমরা ট্যুরিস্ট।
কাস্টমস অফিসিয়ালের পরনে উজ্জ্বল ইউনিফর্ম, সেটাতে গাঢ় লাল রং-এর আধিক্য বেশি। গাল এবং উপরের ঠোঁট মসৃণভাবে কামানো কিন্তু চিবুকের দুইপাশে ছোট ছোট দাড়ি আছে। ফাউণ্ডেশন শিপ? সে জিজ্ঞেস করল।
উচ্চারণ করল ফাউণ্ডেইসানসিপ, কিন্তু ট্র্যাভিজ হাসলনা বা উচ্চারণ ঠিক করে দিলনা। যতগুলো গ্রহ রয়েছে ঠিক ততগুলো বাচনভঙ্গি রয়েছে। সবাই যার যার ভঙ্গিতে কথা বলে। যতক্ষণ বোঝা যাবে ততক্ষণ কেউ এগুলো নিয়ে মাথা ঘামায় না।
হ্যাঁ, ট্র্যাভিজ বলল। ফাউণ্ডেশন শিপ। ব্যক্তিগত।
খুব সুন্দর। আপনার লেডিং।
আমার কি?
আপনার লেডিং। কি বহন করছেন?
ওহ, আমার কার্গো। এই যে আইটেম অনুযায়ী তালিকা। সবই ব্যক্তিগত মালপত্র। বাণিজ্য করতে আসিনি। আগেই বলেছি, আমরা সাধারণ টুরিস্ট।
কাস্টমস অফিসিয়াল কৌতূহলী হয়ে চারপাশে তাকালো। ট্যুরিস্টদের জন্য অনেক বড় ভেসেল।
ফাউণ্ডেশন স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী না, ট্র্যাভিজ কৌতুক করে বলল। আর আমার যথেষ্ট সামর্থ্য রয়েছে।
অর্থাৎ আপনি বলছেন যে আমি ধনী হতে পারি? অফিসার তার দিকে চোখ ছোট করে তাকালো, তারপর দৃষ্টি সরিয়ে নিল।
শব্দটার অর্থ নিয়ে এক মুহূর্ত দ্বিধা করল ট্র্যাভিজ, তারপর আরো কয়েক মুহূর্ত গেল পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করার জন্য। না, আপনাকে ঘুষ দেয়ার কোনো ইচ্ছা আমার নেই, সে বলল ঘুষ দেয়ার কোনো কারণ নেই–তাছাড়া ইচ্ছা থাকলেও দেখে মনে হয়না যে আপনি ঘুষ খান। প্রয়োজন মনে করলে মহাকাশযান পুরোটা দেখতে পারেন।
প্রয়োজন নেই, অফিসার তার পকেট রেকর্ডার একপাশে সরিয়ে বলল। এরই মধ্যে পরীক্ষা করে দেখা হয়ে গেছে কোনো বেআইনী ইনফেকশন আছে কিনা। নেই। একটা রেডিও ওয়েভলেংথ দিচ্ছি। এপ্রোচ বীমের কাজ করবে।
লোকটা চলে গেল। আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতে মাত্র পনের মিনিট লেগেছে।
পেলোরেট নিচু গলায় বলল, লোকটা ঝামেলা করতে পারত, তাই না? আসলেই ঘুষ আশা করছিল?
কাঁধ ঝাঁকালো ট্র্যাভিজ। কাস্টমসের লোকদের ঘুষ দেয়া গ্যালাক্সির মতো পুরনো ব্যাপার। দেয়ার জন্য আমি তৈরিই ছিলাম। যাই হোক সে হয়তো ফাউণ্ডেশন শিপ থেকে সুযোগ না নেয়াটাই উচিত মনে করেছে। মেয়র বুড়ি বলেছিলেন, যেখানেই যাই ফাউণ্ডেশনের নাম আমাদের রক্ষা করবে। ভুল বলেননি–ব্যাপারটা শেষ হতে অনেক সময় লাগতে পারত।
কেন? যা জানা দরকার সেটাতো সে পেয়েছে।
হ্যাঁ, কিন্তু ভদ্রতা করে কাজ সেরেছে রিমোট রেডিও স্ক্যানিং-এর মাধ্যমে। ইচ্ছা করলেই সে হ্যান্ড মেশিন দিয়ে মহাকাশযান পরীক্ষা করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাগিয়ে দিতে পারত। আমাদেরকে কোনো ফিল্ড হসপিটালে নিয়ে সারা দিন আটকে রাখতে পারত।
কি? মাই ডিয়ার ফেলো!
বেশি উত্তেজিত হয়োনা। আমি বলেছি করতে পারত, কিন্তু করেনি। তার মানে আমরা এখন ল্যান্ড করতে পারি। আমি চাই গ্র্যাভিটিক্যালি নিচে নামতে মাত্র পনের মিনিট লাগবে। কিন্তু ল্যান্ডিং সাইটটা কোথায় জানি না। চাই না কোনো ঝামেলা হোক। অর্থাৎ রেডিও বীম অনুসরণ করেই নামতে হবে অনেক সময় লাগবে–কারণ এটমোস্ফিয়ার পেরিয়ে নিচে নামতে হবে।
পেলোরেটকে উফুল্ল মনে হলো। সেটাইতো ভালো, গোলান। আমরা কি ভূখণ্ড দেখতে পাবার মতো যথেষ্ট ধীরে নিচে নামব? পোর্টেবল ভিউস্ক্রিনসহ দুহাত উপরে তুলে সে জিজ্ঞেস করল।
কিছুটা মেঘের স্তর পেরিয়ে আমাদেরকে প্রতি সেকেন্ডে কয়েক কিলোমিটার করে নামতে হবে। বেলুনে ওড়ার মতো না হলেও, প্ল্যানেটোগ্রাফি স্পট করতে পারবে।
চমৎকার! চমৎকার!
ট্র্যাভিজ চিন্তিত স্বরে বলল, যদি সেশেল গ্রহে অনেকদিন থাকতে হয় তাহলে স্থানীয় সময়ের সাথে জাহাজের ঘড়ি মিলিয়ে নেয়া উচিত।
ব্যাপারটা নির্ভর করছে আমাদের পরিকল্পনার উপর। আমরা কি করব, গোলান?
আমাদের কাজ হচ্ছে গায়া খুঁজে বের করা, তার জন্য কতদিন লাগবে আমি। জানিনা।
হাত ঘড়ির সময় মিলিয়ে নেই, জাহাজের ঘড়ি যেমন আছে থাক।
ভাল বুদ্ধি, ট্র্যাভিজ বলল। চোখ নামিয়ে তাকালো গ্রহের দিকে, তাদের নিচে দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে। এখানে অপেক্ষা করার কোনো মানে হয় না। তো!–চল নিচে নামা যাক, জেনভ, দেখি ওখানে কি পাই।
চিন্তিতভাবে ট্র্যাভিজ গ্রহের দিকে তাকিয়ে আছে। এর আগে সে কখনো সেশেল ইউনিয়নে আসেনি, কিন্তু জানে গত এক শতাব্দী ধরে এটা ফাউণ্ডেশনের সাথে দূরত্ব বজায় রেখেছে। অবাক হলো কিছুটা ভয়ও পেল–কারণ তারা খুব তাড়াতাড়ি কাস্টমস পেরিয়েছে।
ব্যাপারটা ঠিক মিলছে না।
.
৪০.
কাস্টমস অফিসারের নাম জগ্রথ শোধ্যর্থ। জীবনের অর্ধেকটা কাটিয়েছে সে এই স্টেশনে।
এই জীবনে সে খুশী, কারণ প্রতি তিন মাস অন্তর একমাসের জন্য সে নিজের বইগুলো পড়ার পছন্দের গান শোনার এবং স্ত্রী ও ছেলের কাছ থেকে দূরে থাকার সুযোগ পায়।
অবশ্য, গত দুই বছরের সবচেয়ে বিরক্তিকর ব্যাপার হচ্ছে বর্তমান কাস্টমস হেড একজন স্বপ্নচারী। নিজের অদ্ভুত কাজের কৈফিয়ত হিসেবে যে লোক বলে যে সে স্বপ্নে নির্দেশ পেয়েছে তার চেয়ে বিরক্তিকর আর কিছু হতে পারে না।
ব্যক্তিগতভাবে শোভাধ্যৰ্থ এগুলো কোনোটাই বিশ্বাস করে না, যদিও ব্যাপারটা সে প্রচার করেনি। অধিকাংশ সেশেলিয়ান এন্টিসাইকিক সন্দেহ পছন্দ করে না। কিন্তু মেটেরিয়ালিস্টিক হিসেবে নিজেকে প্রচার করলে পেনশন পেতে সমস্যা হবে।
দুহাত দিয়ে চিবুকের দুপাশের দাড়ি ঘষল সে, কাশল, তারপর অস্বাভাবিক ভদ্র গলায় জিজ্ঞেস করল, এটাই সেই মহাকাশযান, হেড?
কাস্টমস হেডেরও একটা কঠিন সেশেলিয়ান নাম রয়েছে–নামারাথ গডিসাভট্ট। কম্পিউটারের তৈরি কিছু ডাটা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করল, কিসের মহাকাশযান?
ফার স্টার। ফাউণ্ডেশন শিপ। এইমাত্র নিচে পাঠালাম। বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে যে যানের হলোগ্রাফ আমাদের দেখানো হয়েছে। আপনি কি এটারই স্বপ্ন দেখেছিলেন?
গডিসাভট্ট এবার তাকালো। ছোটখাটো মানুষ, কালো চোখ, চোখের চারপাশে সূক্ষ্ম বলিরেখা। তুমি জিজ্ঞেস করছ কেন?
বুক টান করে দাঁড়ালো শোভাধ্যর্থ, ভুরু কুচকে গেছে। আরোহীরা বলছে যে ওরা ট্যুরিস্ট, কিন্তু আমি আগে এরকম মহাকাশযান দেখিনি। আমার মতে ওরা ফাউণ্ডেশনের এজেন্ট।
গডিসাভট্ট চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল। শোন, আমি তোমার মতামত জানতে চাইনি।
কিন্তু হেড, দেশের প্রতি দায়িত্ববোধের কারণে
বুকের উপর দুহাত ভাজ করে গডিসাভট্ট কড়া চোখে অধীনের দিকে তাকালো। শোভাধর্থ (যদিও আকৃতিতে অনেক বড়) উপরওয়ালার কড়া দৃষ্টির সামনে হার মানল।
মাই ম্যান, তোমার জন্য কোনটা ভালো হবে সেটা তোমার জানা উচিত, গডিসাভট্ট বলল। কোনো প্রশ্ন না করে নিজের কাজ করবে–নইলে আমি দেখব অবসরের পর তুমি যেন পেনশন না পাও, বেশি ছোঁক-ছোঁক করলে অবসরও নিতে হবে তাড়াতাড়ি।
নিচু স্বরে, শোভাধ্যর্থ বলল, ইয়েস স্যার। তারপর অনুগত গলায় বলল, আমাদের আওতায় আরেকটা মহাকাশযান দেখা যাচ্ছে, সেটা রিপোর্ট করা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে?
ধরে নাও রিপোর্ট করা হয়েছে, গডিসাভট্ট বিরক্ত স্বরে বলল, আবার ব্যস্ত হয়ে পড়েছ নিজের কাজ নিয়ে।
যেটা, শোভাধ্যর্থ আরো আন্তরিক গলায় বলল, ঠিক আগেরটার মতো।
ডেস্কে ভর দিয়ে গডিসাভট্ট উঠে দাঁড়ালো। দ্বিতীয় আরেকটা?
শোভাধ্যর্থ মনে মনে হাসল। আশাবাদী লোকটা দুইটা যান স্বপ্নে দেখেনি।
পুরোপুরি স্যার! সে বলল। আমি এখন পোস্টে ফিরে গিয়ে নির্দেশের অপেক্ষায় থাকি। আর আশা করি, স্যার।
হ্যাঁ? পেনশনের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও নিজেকে সে ঠেকাতে পারলনা, আশা করি, স্যার, আমরা ভুল মহাকাশযানটাকে ছাড়িনি।