হঠাৎ জনতার ভিড় ঠেলে তিন ব্যক্তি এগিয়ে এল এবং ঐ দুব্যক্তিকে পিছনে সরিয়ে দিল। রোজী চিৎকার করছিল। তাদের একজন রোজীকে উঠতে বলল। সে লোকটিকে দেখেই রোজী নিরব হয়ে গেল। তার চেহারার রং একেবারে পাল্টে গেল। তার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। সে লোকটি এবার যে লোক দুটি রোজীকে তুলতে চাচ্ছিল তাদের দূরে সরিয়ে দিল। তারপর রোজীর নিকট এগিয়ে এল।
রোজীর কণ্ঠে এক আকাশ বিস্ময়! মৃদু কণ্ঠে বলল, তুমি! তুমি কি রবিন!
লোকটি কানে কানে কথা বলার সুরে বলল, হ্যাঁ, আমি রবিন। তবে আমাকে সবাই ওয়াইস নামে চিনে।
রোজী বলল, প্রতিশোধ নেয়ার উত্তম সময় তুমি পেয়ে গেছো।
তিনজনের একজন বলল, এখন বাজে কথা রাখ। যদি বেঁচে থাকতে চাও নিরবে নির্বিঘ্নে আমাদের অনুসরণ কর।
ওয়াইস বলল, আমার হৃদয়ে কোন দুমশনী নেই। এখনো আমি আমার হৃদয়ের মণি কোঠায় তোমার ভালবাসা সযত্নে লালন করে আছি।
তৃতীয় জন বলল, ওয়াইস! এখন এতো কথা বলার সময় নেই, আগে ওকে এদের কব্জা থেকে যুক্ত কর।
প্রায় কানে কানেই তারা এ কথাগুলো বলল। কেউ তা বুঝল না। আঁচও করতে পারল না।
অনুসন্ধিৎসু সমবেত লোকদের দিকে ফিরে ওয়াইস বলল, ভাইয়েরা আমার! এই যে এই মেয়েটিকে আপনারা দেখছেন, সে কিন্তু স্বেচ্ছায় সানন্দে নীল নদের শীতল বক্ষে নিজেকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। তবে আপনাদের সাথে নয়, সে আমাদের সাথে যেতে চায়।
বাবাজ্বী লাঠি হাতে এগিয়ে এল, বলল, দাঁড়াও। আমি তোমাদের চিনি না। তবে আমি বিমুগ্ধ যে, তোমরা এ পুণ্যের কাজটি নিজেদের জিম্মায় তুলে নিয়েছে। তবে আমি হৃদয়ের প্রশান্তির জন্য তোমাদের সাথে আমার দুব্যক্তিকে পাঠাতে চাই।
ওয়াইস ও তার সাথীরা দৃষ্টি বিনিময়ে কি যেন বলল। ওয়াইস একটু কেসে বলল, বাবাজ্বী! দুজন কেন, ছজন পাঠান। আমরা মিসরী খ্রিস্টান। আমাদের পক্ষে একে অপরকে ধোকা দেয়া কি সম্ভব!
যে দুই ব্যক্তি রোজীকে নেয়ার জন্য টানাটানি করছিল বাবাজ্বীর নির্দেশে তারা ওয়াইস ও তার সাথীদের সাথে রওয়ানা হয়ে গেল। রোজী যেন ওয়াইসের দর্শনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেছে। এতক্ষণ তাকে নিয়ে যে অস্বস্থিকর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল এখন তা আর নেই। শান্ত সুবোধ বালিকার ন্যায় সে এখন ওয়াইসের সাথে যাচ্ছে। সমবেত লোকেরা ছুটে গিয়ে তার গায়ে ফুল ছুঁড়ে দিয়ে তার সুনজর অর্জনের চেষ্টা করছে।
নীল নদের তীরে একটি মাঝারি গড়রেন নৌকা ভিড়ানো ছিল। নৌকায় দুজন মাঝিও ছিল। পাল তোলা নৌকা। তীরে পৌঁছে কবিলার মাঝি দুজনকে বাবাজ্বীর প্রেরিত লোকেরা বলল, আপনাদের যেতে হবে না। আমরাই নৌকা চালাতে পারি। মাঝিরা নেমে গেল।
রোজী, ওয়াইস ও তার দুই সাথী নৌকায় আরোহণ করল। পাল তুলে দেয়া হল। স্রোতের বিপরীত দিকে তাদের নৌকা চলছে। বায়ু প্রবাহের প্রচণ্ডতা কম। ধীরে ধীরে নৌকা চলছে। তখন রাতের অন্ধকার চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। দূরে দূরে আলোর মৃদু ঝলকানী দেখা যাচ্ছে। ছল ছল্ চলাৎ, ছল্ চল্ চলাৎ আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না।
বেশ কিছুক্ষণ চলার পর নৌকাটি যখন নীল নদের মাঝ দিয়ে চলছিল, তখন বাবাজ্বীর প্রেরীত লোক দুজন নৌকার মাঝে এসে বসল। ওয়াইস, তার দুই সাথী ও রোজী পিছনে বসে আছে। ওয়াইস তার সাথী দুজনকে ইঙ্গিত করল। তিনজনই কাপড়ের নিচ থেকে ধারালো খঞ্জর বের করল। অন্ধকারেও খঞ্জর তিনটি যেন ঝলমল করে উঠল। তাদের দুহাত সামনেই বসে আছে তাদের শিকার। সুতরাং দেরি হল না। লোক দুটি কিছু বুঝে উঠার আগেই তাদের বক্ষদেশ ভেদ করে দুটি খঞ্জর চলে গেল। আর্তচিৎকার করে একটু বাঁকা হতেই তাদের ধাক্কা দিয়ে নদীবক্ষে ফেলে দিল।
ওয়াইসের কণ্ঠ আবেগে আপ্লুত। বলল, রোজী! এবার বলতো আমাকে বিশ্বাস করতে পারছো কিনা? না এখনো আমার ব্যাপারে তোমার সন্দেহ আছে?
রোজীর কণ্ঠ কিছুটা শান্ত, বলল হা ওয়াইস। আমার মনে এখন আর কোন সন্দেহ নেই। তবে তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে?
ওয়াইস বলল, শামে…… আলেপ্পায়। তোমার পিতামাতার নিকট। রোজী। আমরা মুসলমান। আমরা মানুষের কল্যাণ কামনা করি। কখনো মানুষের অকল্যাণ কিছু করি না।
রোজী জিজ্ঞেস করল, এখানে তোমরা কিসের জন্য এসেছিলে!
ওয়াইস বলল, ব্যবসা করতে। ইস্কান্দারিয়াতে আমাদের পণ্যদ্রব্য পড়ে আছে। একজন ব্যবসায়ীর সাথে সাক্ষাৎ করতে আমরা এখানে এসেছিলাম।
ওয়াইস সত্য বলল না। ব্যবসার সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। তারা মুসলিম বাহিনীর মুজাহিদ। মুজাহিদ বাহিনীর গুপ্তচর বিভাগে তারা কাজ করে। ওয়াইস ছিল খ্রিস্টান। প্রচণ্ড শক্তি ছিল তার দেহে। সুশ্রী সুন্দর ছিল তার অবয়ব। দুই আড়াই বৎসর পূর্বে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধে সে অংশগ্রহণ করেছিল। ভীষণ যুদ্ধ হচ্ছিল। যুদ্ধে এক পর্যায়ে সে জখমী হয়ে রণাঙ্গনে পড়ে রইল। প্রচুর রক্ষক্ষণের কারণে সে মৃত্যুর দুয়ারে গিয়ে পৌঁছল। তার সঙ্গী খ্রিস্টান সাথীরা তাকে রেখে পালিয়ে গেল।
যুদ্ধের পর মুজাহিদরা যখন জখমী মুজাহিদদের তুলে নিয়ে যাচ্ছিল, ওয়াইস তখন এক মুজাহিদের হাতে ধরে বাঁচার নিবেদন করল। মুজাহিদ তাকে পানি পান করাল। তারপর তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার হুকুম দিয়ে চলে গেল। দুজন মুসলমান মহিলা এসে দেখল, এক খ্রিস্টান যোদ্ধা আহত। মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে। তারা খ্রিস্টান বা দুশমন মনে না করে একজন আহতমানুষ বিবেচনা করে তাকে তুলে নিয়ে গেল। জখমী মুজাহিদদের পাশে রেখেই তার সেবা শুশ্রূষা করা হল।
দুতিন দিন পরই ওয়াইস দুপায়ে দাঁড়ানোর শক্তি ফিরে পেল। আরো কয়েকদিন পর সে হাঁটা চলা করতে শুরু করল। মুসলমানদের আচার-ব্যবহার ও কথাবার্তায় সে বিমুগ্ধ হল। সে প্রায়ই ভাবত, তাকে তার সাথীরা মৃত্যুর গহ্বরে ফেলে চলে গেছে। অথচ দুশমনদের দুজন নারী সেবা যত্ন করে তাকে সুস্থ করে তুলেছে। এরা কত মহান। জখমী যে-ই হোক তাকে তারা সেবা করবে। চিকিৎসা করবে। জখমী মানুষ, আদম সন্তান। বন্ধু না শত্রু এ পার্থক্য তারা করে না। কতো উদার তাদের ধর্মচিন্তা। চিন্তার পরতে পরতে তার গোমরাহীর স্থান হেদায়েত দখল করে নিচ্ছে। মন তার ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে গেছে।
একেবারে সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর তার সাথে যুদ্ধ বন্ধীর ন্যায় আচরণ করা দরকার ছিল। কিন্তু সালারের নির্দেশে তাকে মুক্তি দেয়া হল। সালারের এই অচিন্তনীয় আচরণে সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। সাথে সাথে সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। সালারের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে সে মুসলমান হয়ে গেল। তার নাম রাখা হল ওয়াইস।
এই ওয়াইস ছিল আলেপ্পার অধিবাসী। একই কবিলায় ওয়াইস আর রোজী বেড়ে উঠেছিল। ওয়াইসকে দেখলে রোজীর বেশ ভাল লাগত। রোজীকে দেখলে ওয়াইসের অন্তরে ঝড় উঠত। একে অপরের প্রতি আকর্ষণ বোধ করত। কথাবার্তা হত। নির্মল হাসি বিনিময় হত। ধীরে ধীরে তা প্রণয়ের দিকে গড়ায়। হৃদয় দেয়া নেয়ার পালা শুরু হল। ঠিক তখন রোজীর জীবনাকাশে ধূমকেতুর ন্যায় ইউকেলিস এসে উপস্থিত হল। রোজী আর ওয়াইসের প্রণয় বন্ধন ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়।
মুসলমান হওয়ার পর ওয়াইস মুজাহিদদের সাথে যোগ দিল। তার প্রতিভা দেখে সবাই বিমুগ্ধ হল। সবার চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। শুধু দুর্বার দুঃসাহসীই নয়। অসি চালনা, বর্শা নিক্ষেপ, তীর নিক্ষেপ, অশ্বারোহণসহ যুদ্ধের যাবতীয় কলাকৌশলে সে অত্যন্ত পারদর্শী। এরপর সবাই অনুধাবন করল, তার বুদ্ধিমত্তা, দূরদর্শীতা, স্বচ্ছ সঠিক চিন্তা এত তীক্ষ্ণ ও বিস্ময়কর যে গুপ্তচর বিভাগে তার মত মানুষ খুবই জরুরী।
***
সিপাহ সালার আমর ইবনে আস (রা.) আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা.)-কে নানাভাবে মিসর আক্রমণে অনুপ্রাণিত করতে চেয়েছেন। নানা যুক্তিও উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে, তাৎক্ষণিকভাবে আক্রমণের অনুমতি তিনি দেননি। বরং বলেছেন, শাম মাত্র বিজিত হয়েছে এখানে শাসন ব্যবস্থা সুদৃঢ় ও মজবুত করার পর অন্য চিন্তা করা যাবে। এখন আরেকটি নতুন রণাঙ্গন তৈরীতে তার মন সায় দেয়নি। তবে মিসর আক্রমণ করা দরকার ও করতে হবে তা তিনি অস্বীকার করেননি। সময় সুযোগে তা করা হবে এ আশ্বাস তিনি আমর ইবনে আস (রা.)-কে দিয়েছিলেন।
এদিকে মিসর আক্রমণের আগ্রহ আমর ইবনে আস (রা.)-কে চরমভাবে পেয়ে বসেছে। বার বার কেবল মিসর আক্রমণের চিন্তাই তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তিনি প্রায়ই চিন্তা করেন, রোমান সৈন্যরা যারা শাম থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেছে তারা মিসরে গিয়ে আবার একত্রিত হবে। হিরাক্লিয়াস তাদের পুনরায় সজ্জিত করে এক দুর্ধর্ষ বাহিনীতে রূপায়িত করবে। তারপর আবার শাম আক্রমণ করবে।
তাই একটি কাজ করতে হবে, আরব খ্রিস্টান কবিলারা যেমন বিজয়ী মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল ঠিক তেমনিভাবে মিসরের নির্যাতিত খ্রিস্টানদেরও হিরাক্লিয়াসের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে হবে। যেন তারা রোমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। একদিন তিনি তার অধিনস্ত সালারদের নিয়ে এ ব্যাপারে আলোচনায় বসলেন। কিভাবে মিসরীয়দের সম্রাট হিরাক্লিয়াসের বিরুদ্ধে উসকে দেয়া যায় তার পথ ও পন্থা কি হতে পারে।
আমর ইবনে আস (রা.) বললেন, মিসরের খ্রিস্টানরা সেখানে অত্যন্ত নির্যাতিত অবস্থায় আছে। তাদের বিদ্রোহী করে তুলতে হবে।
এক সালার বলল, তাদেরকে আমাদের অনুগত বানাতে হবে। আমাদের সাহায্যের ব্যাপারে তাদের উৎসাহী করে তুলতে হবে। যেন তারা এ ব্যাপারে এক মত পোষণ করে যে, আমরা মিসরে আক্রমণ করলে তারা আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। যে সব মিসরী রোমানদের সৈন্য বাহিনীতে আছে তারা যেন যুদ্ধের সময় উদাস থাকে, কৌশলে আমাদের মোকাবেলা এড়িয়ে চলে।
খুঁটি নাটি আরো অনেক বিষয় সম্পর্কে আলোচনা হল। সবশেষে আমর ইবনে আস (রা.) বললেন, আমার তিন চারজন মুজাহিদের প্রয়োজন যারা মিসরে গিয়ে মিসরীয়দের সাথে মিশে তাদেরকে হিরাক্লিয়াসের বিরুদ্ধে উসকে দেবে। তাদের বিদ্রোহী করে তুলবে।
গুপ্তচর হিসেবে কাজ করাতে অনেক মুজাহিদ প্রস্তুত। কিন্তু মিসরের ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যাকে তাকে দিয়ে এ কাজ হবে না। তাই সালার সর্বসম্মতিক্রমে দুজন মুজাহিদকে এ কাজের জন্য নির্বাচিত করলেন। তারপর তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে সবাই ওয়াইসকে নির্বাচন করল। আমর ইবনে আস (রা.) এ তিনজনকে নিজের নিকট রেখে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দিলেন।
প্রশিক্ষণ শেষ হলে তারা মিসরে রওয়ানা হয়ে গেলেন। তারা ব্যবসায়ীর রূপ ধারণ করে মিসরে যাচ্ছে। মাত্র এক মাস মিসরে থেকে তারা দুতিনজন নেতৃস্থানীয় মিসরীর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ভাব সৃষ্টি করেছে। মিসরী খ্রিস্টানরা তাদেরকে তাদের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থাও করে দিয়েছে।
***
গুপ্তচর বৃত্তির কাজে এদিক দিয়ে কোথাও যাচ্ছিল। হঠাৎ ওয়াইসের দৃষ্টি রোজীর উপর নিপতিত হল। রোজীর জায়গায় অন্য কোন মেয়ে হলে ওয়াইস কিছুতেই সে দিকে ফিরেও তাকাতো না। রোজীকে দেখেই সে তার সঙ্গী সাথীদেরকে দূরে নিয়ে তার সাথে রোজীর সম্পর্কে কথা বলল। কিভাবে সুদূর এ মিসরে এসে এ বিপদে সে আটকে গেছে সে কথা ভেবে তারা কোন কূল কিনারা পেলো না।
ওয়াইস সমবেত লোকদের একজনকে একটু দূরে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ভাই! এ মেয়েটির কি হয়েছে? লোকটি বলল, এ মেয়েটিকে নীল নদীতে উৎসর্গ করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু সে তাতে রাজী নয়। ওয়াইস ও তার সাথীরা এসব কিছু জেনে পরামর্শ করল। কিভাবে রোজীকে উদ্ধার করা যায়। তার পন্থাও বের করল। তারপর ওয়াইস ও তার সাথীরা মিসরী খ্রিস্টানের রূপধরে সমবেত লোকদের ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গেল এবং যারা রোজীকে নিয়ে যাওয়ার জন্য জোর প্রয়োগ করছিল তাদের নিকট থেকে রোজীকে নিজেদের হাতে তুলে নিল।
তারা কৌশলে কামিয়াব হল। তারা মিসরী দুজনকে হত্যা করে নদীবক্ষে নিক্ষেপ করল। সেখানে নদী খুব প্রশস্ত। নদীর মাঝ দিয়ে নৌকাটি তর তর করে এগিয়ে চলছে। এখন তাদের সবচেয়ে জরুরী কাজ হল তীরে নৌকা ভিড়িয়ে দ্রুত অন্যত্র চলে যাওয়া। কিন্তু আরবরা তখনো নৌকা চালনায় পারদর্শী হয়ে উঠেনি। দজলা ও ফুরাত নদীতে আরবরা ছোট ছোট নৌকা চালাতে পারত। নৌকা নিয়ে এদিক সেদিক যাতায়াতও করত। কিন্তু পালের নৌকা চালাতে তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠেনি।
ওয়াইস ও তার সাথীরা জানে যে, নৌকার গতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পিছনে বৈঠা ব্যবহার করতে হয়। বৈঠা ঘুরালেই নৌকার মুখ ঘুরে যাবে। তাদের একজন নৌকার বৈঠা ঘুরিয়ে দিল। নৌকার মুখ তীরের দিকে ফিরে গেলেও পালের নৌকা ভারসাম্য হারিয়ে এক দিকে হেলে গেল। পালের নৌকা কিভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয় তা তাদের জানা ছিল না। প্রচণ্ড বাতাসের ঝাঁপটা ও ঢেউয়ের কারণে নৌকায় পানি উঠতে লাগল।
এক মুজাহিদ ভীত সন্ত্রস্ত কণ্ঠে বলল, মেয়েটির দিকে খেয়াল রাখ।
রোজী দৃঢ়তার সাথে বলল, আমার চিন্তা করতে হবে না। আমি সাঁতার কাটতে পারি। সাঁতরেই আমি তীরে উঠেছি এবং এখনো বেঁচে আছি।
তারা আর বেশী কথা বলতে পারল না। বাতাসের একটি প্রবল ঝাঁপটা এসে পালে লাগতেই নৌকাটি এক দিকে কাত হয়ে উল্টে গেল। সবাই সাঁতার জানে। তারা তীরের দিকে সাঁতার কাটতে লাগল। ওয়াইস উল্কণ্ঠিত হয়ে রোজীকে ডাকতে লাগল। তারা সকলে সাঁতার কেটে তীরে গিয়ে পৌঁছল।
***
এখন একটি চিন্তা তাদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। রোজীকে তারা কেথায় লুকিয়ে রাখবে। কিভাবে তারা তাকে শামে পৌঁছে দেবে। এটা তাদের দায়িত্ব নয়। কিন্তু ওয়াইস স্বেচ্ছায় যেন এ দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। তারা মিসরী খ্রিস্টানদের সর্বশ্রেষ্ঠ গুরু ও পাদ্রী বিনইয়ামীনের নিকট যাচ্ছিল।
বিন ইয়ামীন কোন জনবসতিতে বসবাস করে না। কাউস নামক স্থান অতিক্রম করে এক বিস্তৃত বালুকাময় অঞ্চল। তারপর চড়াই উত্রাই ও দুর্গম পথ পেরিয়ে বিন ইয়ামীনের নিকট পৌঁছতে হয়। হিরাক্লিয়াসের রাজকীয় খ্রিস্টধর্মকে যারা মানে না তারা বিন ইয়ামীনকেই তাদের আধ্যাত্মিক নেতা মনে করে। তার আদেশ নিষেধ অম্লান বদনে মেনে নেয়। সম্রাট হিরাক্লিয়াস বিন ইয়ামীনকে হত্যার জন্য পাদ্রী কীরসকে অনুমতি প্রদান করেছিল। গোপন সূত্রে বিন ইয়ামীন সংবাদ জানতে পেরে শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছে এবং দুর্গম মরু অঞ্চলে আত্মগোপন করেছে। সে বিশ্বস্ত অনুসারীদের মাধ্যমে এখনো তার ধর্মীয় নেতৃত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।
আমর ইবনে আস (রা.) এর প্রেরিত গুপ্তচরদের সফলতা যে, তারা বিন ইয়ামীনের ঠিকানা সংগ্রহ করতে পেরেছে। তারা নিজেদেরকে মিসরী প্রকাশ করত এবং মিসরীয়দের গির্জায় গিয়ে খ্রিস্টানদের মত ইবাদত করত। এভাবে মিসরীয়দের প্রবঞ্চনায় ফেলে তাদের থেকে বিন ইয়ামীনের ঠিকানা সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে।
কিন্তু রোজীকে নিয়ে তারা দারুণ সমস্যায় পড়ল। ওয়াইসের ব্যাপারে তো এ কথা চিন্তাও করা যায় না যে, সে তার দায়িত্ব ফেলে রোজীকে তার মাতাপিতার নিকট পৌঁছাতে শামে চলে আসবে। আবার রোজীকে সাথেও রাখা বিপদ। আবার তাকে একা ফেলেও যাওয়া সম্ভব নয়। তিনজনে এ বিষয়টি নিয়ে ভাবল। পরামর্শ করল।
তাদের তিনজনের যে আমীর সে বলল, আচ্ছা এমন করলে কি হয় না যে, আমরা রোজীকে আমাদের সাথেই নিয়ে যাই। এবং বিন ইয়ামীনের নিকট রোজীকে সমর্পণ করে বলি, আপনি তাকে আলেপ্পায় প্রেরণের ব্যবস্থা করে দিন।
একজন বলল, যদি সে জানতে পারে যে, তাকে নীল নদীতে বিসর্জন দেয়ার জন্য নেয়া হচ্ছিল, আমরা তাকে নিয়ে পালিয়ে এসেছি। তাহলে কি হবে?
আমীর বলল, এ ধরনের চিন্তা মনে জায়গা না দেয়াই ভালো। কারণ আমি শুনেছি, বিন ইয়ামীনও নীল নদে যুবতী বিসর্জনের পক্ষপাতী নয়। সে একে পাপ মনে করে। তবে সে এখন মিসরীয় খ্রিস্টানদের সমর্থন ধরে রাখার জন্য এ বিষয়টি নিয়ে কোন কথা বলছে না।
নীল নদের তীরে আর বেশীক্ষণ থাকা ঠিক হবে না ভেবে তারা সেখান থেকে বিন ইয়ামীনের নিকট পৌঁছার পথ ধরে চলতে লাগল।
***
মুসলমান গুপ্তচর তিনজন অনেক চিন্তাভাবনা করে দেখেছে যে, মিসরে রোমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সৃষ্টি করতে হলে বিন ইয়ামীনকে ছাড়া সম্ভব নয়। তার সেই শক্তি আছে। সেই জনপ্রিয়তা তার আছে। আর তার দ্বারাই তা করানো যেতে পারে। এর পিছনে আছে এক রক্তাক্ত ইতিহাস। এক মর্মন্তুদ বেদনাময় কাহিনী।
দীর্ঘদিন যাবৎ খ্রিস্টানরা বিভিন্ন দল উপদলে বিভক্ত হয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে বিষ উদগিরণ করে আসছিল। তারা কেউ কাউকে সহ্য করতে পারত না। পরস্পরে প্রায়ই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।
সম্রাট হিরাক্লিয়াস দেখল, ধর্মের নামে এ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বন্ধ করা দরকার। সে সকল দল উপদলকে ভেঙে চুড়ে খ্রিস্টানদের এক পতাকা তলে সমবেত করার ফর্মুলা খ্রিস্টান জাতির নিকট পেশ করল। তোষামুদে পাদ্রীরা সম্রাট হিরাক্লিয়াসের প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে তা গ্রহণ করে নিল। কিন্তু মিসরের খ্রিস্টানরা তা মেনে নিল না। তারা তাদের পূর্ব ধর্মমত ছাড়া নতুন কিছু গ্রহণ করবে না। তারা সম্রাটের সমালোচনা শুরু করল ও রাজকীয় খ্রিস্টধর্ম বর্জন করল। সম্রাট হিরাক্লিয়াস এক শীর্ষস্থানীয় পাদ্রী কীরসকে পর্যাপ্ত ক্ষমতা দিয়ে সকল খ্রিস্টানকে রাজকীয় খ্রিস্টধর্ম মেনে নিতে বাধ্য করতে নির্দেশ দিল।
কীরস ইস্কান্দারিয়াতে এক সম্মেলনের আয়োজন করল। রাজকীয় খ্রিস্টধর্ম প্রচারের আয়োজন করল। তার এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল। আল্লাহর কিতাব ইঞ্জিল বাদ দিয়ে সম্রাটের দেয়া খ্রিস্ট ধর্মকে মিসরের কেউ মেনে নিল না। পাদ্রী ও ধর্মজাযকরা এর প্রবল প্রতিবাদ জানাল। আমজনতা তা প্রত্যাখ্যান করল। সবার শীর্ষে রইল পাদ্রী বিন ইয়ামীন। সে কড়া ভাষায় তার প্রতিবাদ করল। সমালোচনা করল।
সম্রাটের কোপানলে পড়ে গেল বিন ইয়ামীন। সম্রাট তাকে বন্দী করে হত্যার নির্দেশ দিল। বিন ইয়ামীনের নিকট কোন সামরিক শক্তি ছিল না। সম্রাটের বিরুদ্ধে কোন কিছু করার ক্ষমতাও ছিল না। তারপরও সে খ্রিস্টধর্মকে রক্ষার জন্য সাময়িকভাবে আত্মগোপন করে থাকার কথা ভাবল। এ ছাড়া তার কোন উপায়ও ছিল না। সে কাউস নামক স্থানে দুর্গম এলাকায় তার আস্তানা। বানাল। সেখান থেকেই মিসরীয়দের বিভিন্ন ধর্মীয় নির্দেশ দিতে লাগল। মিসরের লোকেরাও সকল বিপদ মসীবতকে উপেক্ষা করে তার নির্দেশ মতে ধর্মাচার পালন করতে লাগল।
বিন ইয়ামীনের কোন সন্ধান না পেয়ে কী আরো ক্ষীপ্ত হয়ে উঠল। বিন ইয়ামীনের বড় ভাইকে গ্রেফতার করে নিয়ে এল। কীরস জানে যে, বিন ইয়ামীনের মিসন তার অবর্তমানে তার ভাই পরিচালনা করছে। তাই কীরস তাকে রাজকীয় খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার নির্দেশ দিল।
বিন ইয়ামীনের ভাই তা অস্বীকার করল। অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলল, আমি আল্লাহর দেয়া বিধান মানতে বাধ্য। মানুষের দেয়া কোন বিধান মানা সম্ভব নয়। আরো বললো, রোমের সম্রাট হিরাক্লিয়াস একজন পাপী বাদশাহ। আসল বাদশাহ আল্লাহ। তিনি এ দুনিয়ার এবং পরকাল উভয় জাহানের বাদশাহ। আমি শুধু তারই হুকুম মানব, অন্য কারো নয়।
এরপর আর দেরি হয়নি। লোমহর্ষক শাস্তি তার উপর নেমে আসে। তাকে বিবস্ত্র করে তার শরীর মশালের আগুনে পুড়িয়েছে আর বলেছে–বল, রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের ধর্মমত সত্য। আর বাকী সব ধর্মমত মিথ্যা।
বিন ইয়ামীনের ভাই আগুনে পুড়তে পুড়তে চিৎকার করে বলেছে, লানত ঐ ব্যক্তির উপর সে বিশ্বাস করে হিরাক্লিয়াসের ধর্মমত সত্য। বরং ইঞ্জিলের ধর্মমত চিরসত্য।
আগুনে জ্বলে জ্বলে তার শরীর দিয়ে চর্বি গলে গলে পড়েছে তবুও সে হিরাক্লিয়াসের ধর্মমতকে সত্য বলেনি। তারপর আগুন সরিয়ে নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করেছে, তুমি যদি বল, বিন ইয়ামীন কোথায় আছে, তাহলে তোমাকে ছেড়ে দেব।
সে তখন অত্যন্ত ঘৃণাভরে তার দিকে তাকিয়ে বলেছে, যদি আমি জেনেও থাকি তবুও তোমাকে তা কেন বলব?
তখন তার একটি দাঁত তুলে ফেলে পুনরায় জিজ্ঞেস করেছে। সে ঐ একই উত্তর দিয়েছে। তারপর তার আরেকটি দাঁত তুলে ফেলে জিজ্ঞেস করেছে। সে ঐ একই উত্তর দিয়েছে। এভাবে নির্মমভাবে কষ্ট দিয়ে নির্যাতন করে তার সবগুলো দাঁত তুলে ফেলেছে। তার মুখ দিয়ে তখন অবিরাম রক্ত ঝরে পড়ছিল।
এরপর তাকে তিনবার জিজ্ঞেস করা হয়েছির, বল সম্রাট হিরাক্লিয়াসের ধর্মমত সত্য। কিন্তু প্রত্যেক বার সে উত্তরে বলেছে, সম্রাটের ধর্মমত মিথ্যা, অবাস্তব। ইঞ্জিলের ধর্মমত সত্য। তারপর পাদ্রী কীরাসের নির্দেশে হাত পা বেঁধে তাকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হয়। এভাবে পানিতে ডুবিয়ে তাকে দুনিয়া থেকে বিদায় করা হয়।
ধর্মের লেবাসে কীরাস অনেক মানুষের উপর নির্যাতন করেছে। অনেককে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। অনেককে চিরদিনের জন্য পঙ্গু করে দিয়েছে। ধার্মিক মানুষেরা তার হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে ধুকে ধূকে নিঃশেষ হয়ে গেছে। ইতিহাসের পাতায় এ ধরনের নির্যাতনের বহু ঘটনা আজো পাঠকের চোখ থেকে অশ্রু ঝরাচ্ছে।
পাদ্রী সামবীলকে নিয়ে যা ঘটেছিল আজো তা কেউ ভুলেনি। সামবীল ছিল বিন ইয়ামীনের অনুসারী। বিন ইয়ামীনের কথাবার্তা, আচার আচরণ তার ভাল লাগত। তাই সব বিষয়ে তার অনুসরণ করত। তার পরামর্শ নিয়ে চলত।
মিসরী পাদ্রী সামবীল সম্রাট হিরাক্লিয়াসের রাজকীয় খ্রিস্টধর্ম মেনে নিতে পারেনি। পাদ্রী কীরাস এ সংবাদ পেল। রেগে মেগে আগুন হয়ে কীরাস সামবীলের নামে এক ছোট্ট পত্র লিখে পাঠাল। তাকে রাজকীয় খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে নেয়ার উদাত্ত আহ্বান জানাল। পত্রটি এক সালালের হাতে দিয়ে একশত সৈন্যসহ সালারকে সামবীলের নিকট পাঠাল। সাথে সাথে প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলীও দিল। সালার গিয়ে চিঠিটি পাদ্রী সামবীলের হাতে দিলে সে তা খুলে পাঠ করল। চিঠি পড়ে তার মাথায় খুন চড়ে গেল। ধর্ম নিয়ে এ কী খেলা শুরু হল! বিন ইয়ামীন ছাড়া আমাদের ইমাম আর কেউ নয়। এ কথা বলেই চিঠিটি ছিঁড়ে ফেলল। তারপর বলল, যে এ পত্র লিখেছে তার উপর আল্লাহর লানত। আর ঐ রোম সম্রাটের উপরও লানত যে আমাদের উপর এক মনগড়া ধর্ম চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে।
সামবীলের এ ধৃষ্টতা দেখে ও উত্তেজক কথাবার্তা শুনে সালার আর দেরি করল না। সাথে সাথে তাকে গ্রেফতার করল। তার হাত পিছমোড়া করে বাধল। সালার ঘোড়ায় চড়ে সামবীলকে তার সাথে বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে চলল। লোকেরা এ অবস্থা দেখে হতবাক হয়ে বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে রইল। হৃদয়ে তাদের বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠল। কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারল না।
লোকদের দেখে সামবীল বেদনা বিধূর কণ্ঠে চিৎকার করে বলল, ভাইয়েরা আমার! আজ আমি আনন্দিত। ঈসা (আ.)-এর অনুসারী হওয়ার কারণে আজ আমার শরীর থেকে রক্ত ঝরবে। ভাইয়েরা আমার! তোমরা সঠিক ধর্ম আঁকড়ে ধরে থাকবে। কোন রাজা বাদশাহকে ভয় করবে না। তারপর সে কীরাসকে গালি দিতে লাগল।
সৈন্যরা তাকে মারতে মারতে কীরাসের নিকট যখন নিয়ে গেল তখন তার শরীরে জায়গায় জায়গায় জখম হয়ে রক্ত ঝরছে। রক্তে রক্তে তার দেহ লাল হয়ে গেছে।
কীরাস সামবীলকে লক্ষ্য করে বলল, ওহে পাপীষ্ঠ! তোকে কে পাদ্রী বানিয়েছে? আর তোকে কে এই অধিকার দিল যে, আমার অধীনস্থ হয়ে আমার বিরুদ্ধাচরণ করছিস। বল হে নরাধম! এমন করছিস কেন?
সামবীল বজ্র নির্ঘোষ কণ্ঠে বলল, ওহে দাজ্জাল! আল্লাহর ইবাদত আর বিন ইয়ামীনের আনুগত্যে রয়েছে নেকী। তুই তো ইবলিসের চেলা। তোর কথা মানা আর তোর ধর্মমতের অনুসরণ করা পাপ। মহাপাপ।
কীরাসের চোখ আগুনের গোলক হয়ে গেল। হুকুম দিল, তার মুখে ঘুষি মারতে মারতে ফুলিয়ে ফেল। ব্যস্ তাই হল। ঘুষি মারতে মারতে তার চেহারা ফুলিয়ে দিল।
তারপর কীরাস জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা বলতো, তুমি কেন মিসরের শাসক ও ধর্মীয় গুরুর কথা মানছো না? তুমি কি জান না, তোমার জীবন ও মরণ আমার হাতে?
সামবীল ক্রোধে গর্জন করে উঠল। বলল, হে কীরাস! তুমি কি ইবলিসের কথা জান না? ইবলিস ফেরেস্তাদের সর্দার ছিল। কিন্তু অহংকার তাকে আল্লাহর হুকুম মানতে অবাধ্য করল। সে আজ অভিশপ্ত। হে কীরাস! তুমি আজ ইবলিসের চেয়ে অধিক অভিশপ্ত।
কীরাস অহংকারে আগুনের মত জ্বলে উঠল। বলল, যাও এ নরাধমকে নিয়ে তার শির ধর থেকে ছিন্ন করো। তাহলে সব তেজ শেষ হয়ে যাবে।
***
জেলে আর মাঝি মাল্লাদের নিয়ে পল্লীর খ্রিস্টান সর্দার বাবাজ্বী সে রাতেই নীল নদের যে স্থানে রোজীকে উৎসর্গ করা হবে নৌকা দিয়ে সেদিকে যাচ্ছিল। নদী পথ অল্প। বাবাজ্বী যেদিকে যাচ্ছিল সে দিকে ছিল পানি প্রবাহ। তর তর্ করে তার নৌকা গন্তব্যের দিকে ছুটে যায়। কিছুদূর যেতেই দেখতে পায়, নদীবক্ষে একটা নৌকা উল্টে আছে। একটু দূরেই বৈঠা ভাসছে। কিন্তু কার নৌকা তা সে বুঝতে পারল না। এ কথা বুঝতে পারল না যে, এটা তাদের লোকদের নৌকা। বুঝতে পারল না, যাকে নদীবক্ষে উৎসর্গ করার জন্য নেয়া হচ্ছিল সে আরেকবার পালিয়ে গেছে।
নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেখল, তার আগে অন্যরা সেখানে উপস্থিত হয়ে কি যেন খুঁজছে। কয়েকজন সর্দার, তাদের সাথে একজন নেতৃস্থানীয় পাদ্রীও রয়েছে। বাবাজ্বী পৌঁছতেই পাদ্রী মহাশয় তার দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার? যে কুমারীকে উৎসর্গ করা হবে সে কোথায়?
বাবাজ্বীর কণ্ঠে এক আকাশ বিস্ময় ঝরে পড়ল। বলল, আপনি এ কেমন কথা বলছেন। পাঁচজন লোকসহ তো তাকে অনেক আগেই পাঠিয়ে দিয়েছি!
এ কথা শোনার পর সেখানে হায় হায় রব উঠল। বাবাজ্বী বলল, আমি আসার সময় দেখলাম নদী বক্ষে একটি নৌকা উল্টে আছে। কিন্তু মাঝি দুজনতো বেশ পারদর্শী। কোন কারণে যদি নৌকা উল্টে গিয়ে থাকে তাহলে মাঝি দুজন তো সাঁতরে চলে আসবে। আর কুমারী মেয়েটিও তো সাঁতার জানে।
তারপরই বাবাজ্বী বলল, নৌকায় তিনজন অপরিচিত লোক ছিল। তারা না হলে মেয়েটিকে উৎসর্গের জন্য তৈরী করাই মুশকিল ছিল।
পাদ্রী বলল, নীল নদী এ মেয়ের উৎসর্গকে কবুল করেনি। নীল নদের ক্রোধ থেকে বাঁচতে হলে ঐ মেয়েকেই উৎসর্গ করতে হবে যাকে আগে নির্বাচন করা হয়েছিল। হোরসীসের ঐ মেয়েকে নিয়ে আস। তাকে এনে নীলের বক্ষে নিক্ষেপ কর। তাহলেই নীল শান্ত থাকবে।
পাদ্রীর নির্দেশে সাথে সাথে কয়েকজন লোক হোরসীসের বাড়িতে ছুটে গেল। তাকে ঘুম থেকে জাগ্রত করে বলল, আপনার মেয়েকে নিয়ে এক্ষণই যেতে হবে। এটা পাদ্রীর নির্দেশ। হোরসীস এ সংবাদে একেবারে হতবাক হয়ে গেল। পাদ্রীর নির্দেশ অমান্য করাও সম্ভব নয়। তাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে মেয়েকে নিয়ে পাদ্রীর নিকট পৌঁছল। বিগলিত কণ্ঠে বলল, গুরুজ্বী পাদ্রী মহোদয়! আমার এ মেয়ের সমস্ত অলঙ্কার ঐ মেয়েকে পরিয়ে দিয়েছি যে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। এখন তাকে পরানোর মত কোন অলঙ্কার নেই। তার আশা ছিল, হয়তো একথা বললে তার উৎসর্গ মুলতবী করে দিতে পারে।
কিন্তু পাদ্রী তার সমস্ত আশা ভরসা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে বলল, অলঙ্কার আর সাজগোছ তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। একজন কুমারী মেয়েকে উৎসর্গ দেয়াই হল আসল কথা।
পাদ্রীর নির্দেশ উপেক্ষা করা গেল না। সে রাতেই হোরসীসের মেয়েকে নদীবক্ষে উৎসর্গ করা হল।
ইতিমধ্যে রোজী নীল নদ থেকে উঠে অনেক দূর চলে গেছে। ওয়াইস ও তার সাথীরা ভাড়া করে উট নিয়েছে। তাতে চড়ে তারা কাউস নামক স্থানে গিয়ে পৌঁছল। কাউস শহর থেকে দূরে হলেও অত্যন্ত সমৃদ্ধ এলাকা। হিরাক্লিয়াস ও কীরাসের বিপক্ষের খ্রিস্টানদের একটি শক্তিশালী কেন্দ্র। এখানে বীন ইয়ামীনের প্রভাব খুব বেশী। সবাই বিন ইয়ামীনের ভক্ত। তারা এখানে পৌঁছে নিজেদের খ্রিস্টান বলে পরিচয় দিল। বিন ইয়ামীনের অনুসারী হিসাবে ব্যক্ত করল।
ইতিমধ্যে দিনমনি পশ্চিমাকাশে কাত হয়ে যাই যাই করছে। রাত কাটানোর জন্য তারা একটি সরাইখানায় গিয়ে উঠল। ছিমছাম ছোট অথচ ভাল লাগার মত একটি সরাইখানা। রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে তারা কথাবার্তা বলছিল।
এক মুসলমান গুপ্তচর বলল, আচ্ছা রোজী বলতো, আমাদের ব্যাপারে তো তোমার এখন আর কোন সন্দেহ নেই।
রোজী বলল, না, কোন সন্দেহ নেই।
কোন প্রকার শোবা সন্দেহ না থাকারই কথা। গত রাত থেকে সে তাদের সাথে আছে। যদি তাদের কোন বদ নিয়ত থাকত তাহলে নিশ্চয় এর মধ্যেই তা প্রকাশ পেয়ে যেত। রোজী মনে মনে ওয়াইসকেই বেশী ভয় পাচ্ছিল। ইউকেলিসকে পাওয়ার পর সে তাকে অবজ্ঞাভরে উপেক্ষা করেছে। তার সাথে অনেক দুর্ব্যবহার করেছে। তার মনে অনেক কষ্ট দিয়েছে। এখন যদি সে ওসবের প্রতিশোধ নেয় তবে বলতে হবে তার সে অধিকার আছে। কিন্তু ওয়াইস তার সাথে কোন দুর্ব্যবহার করেনি। কোন কটু কথাও বলেনি। বরং তার সাথে এমন ভদ্র আচরণ করছে যা দ্বারা বুঝা যায় যেন রোজী কোন সুন্দরী রূপসী যুবতী নয়। বরং তাদের সঙ্গী কোন মুজাহিদ।
রোজী বলল, ওয়াইস! তুমি বলেছিলে, মুসলমানরা তোমাকে নতুন জিন্দেগী দিয়েছে। তুমি দেখেছিলে, মুসলমানরা শুধু তেমার প্রতি অনুগ্রহই করেনি, বরং শত্রুর সাথে এমন ব্যবহার করা তাদের ধর্মীয় বিধান। তাই তুমি মুগ্ধ হয়ে তাদের ধর্ম গ্রহণ করে নিয়েছ। এখন তুমি আর তোমার সাথীরা আমাকে নতুন জিন্দেগী দিলে। আমার বিশ্বাস হয়ে গিয়েছিল, আমার স্বধর্মীয়রা আমার হাত বেঁধে আমাকে নীল নদে নিক্ষেপ করবে। তোমরা না এলে এখন আমার লাশ নদীর প্রাণীরা টেনে টেনে খেয়ে ফেলত।
ওয়াইস বলল, আল্লাহর হুকুম ছিল তুমি জীবিত থাকবে। তাই আল্লাহ্ তোমাকে মুক্ত করার জন্য আমাদের সেখানে পাঠিয়েছিলেন। যেখানে তোমার জীবন মরণের ফয়সালা হচ্ছিল। তোমাকে আমরা নয় বরং ইসলামী আদর্শ নতুন জিন্দেগী দান করেছে।
রোজীর দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ছে। সে বলল, ওয়াইস! তাহলে আমাকেও তোমাদের ধর্মে শামিল করে নাও। আমাকে মুসলমান করে নাও। আমার একটুও বিশ্বাস হচ্ছিল না যে, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিবে। এখন আমি তোমার ও তোমার সাথীদের আচরণে এতো প্রভাবিত হয়েছি যে, আমি আমার জীবন তোমাদের আদর্শের জন্য ওয়াকফ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
ওয়াইসের দলপতি বলল, রোজী! এখন নয়। হয়তো পিতামাতার নিকট পৌঁছলে তোমার মনের খেয়াল পরিবর্তন হতে পারে। এখন তোমার মনে বিভিন্ন ভীতি শংকা ভর করে আছে। তাছাড়া তোমার বয়সও কম। কম বয়সীরা সাধারণত আবেগ প্রবণ হয়ে থাকে। আগে তুমি তোমার পিতামাতার নিকট যাও। তারপর তুমি স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিও।
রোজী মনে মনে স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে ইসলাম গ্রহণ করবে। তাই এদের কথা শুনে সে কেঁদে ফেলল। রোরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, আমি আমার পিতামাতার নিকট একা ফিরে যাব না। তোমাদেরকে সাথে নিয়ে যাব। ওয়াইস তাকে বলেছিল, ব্যবসার জন্য তারা মিসরে এসেছে। তাই রোজীর দাবী সে তাদের সাথেই ফিরে যাবে। অন্য কারো সাথে নয়।
কিন্তু তাকে তো আর একথা বলা যায় না যে, তারা ব্যবসার জন্য নয়, অন্য মিশন নিয়ে তারা এখন মিসরে আছে। তাই তাদের সাথে তার না থাকাই ভাল। কিন্তু রোজীর একগুঁয়েমী ও আহাজারী বেড়েই চলল। এক পর্যায়ে সে বলেই ফেলল, আমি আর খ্রিস্টান নই, আমি এখন মুসলমান।
রোজী অত্যন্ত সাহসী মেয়ে। কোন প্রকার ভয় ভীতি তার অন্তরে নেই। কঠিন মুহূর্তেও তাকে নিয়ে কোন সমস্যা হবে না ভেবে দলপতি তার সঙ্গীদের সাথে পরামর্শ করল। তাকে ইসলামে দীক্ষা দেয়া হলো। নাম রাখা হলো রাবেয়া। রোজী এখন রাবেয়া। একজন মুসলমান। এখন তার জীবন রক্ষা করা অপর মুসলমানের দায়িত্ব। তাকে এখন আর বিপদের মুখে ফেলে যাওয়া যাবে না। সবদিক বিবেচনা করে তারা রাবেয়াকেও তাদের মিশনের সদস্য হিসেবে গ্রহণ করে নিল।
তারা রাবেয়ার নিকট তাদের মিসরে আগমনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য খুলে বলল। বলল, তারা এখন মিসরীয় খ্রিস্টানদের অবিসংবাদিত নেতা ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় পাদ্রী বিন ইয়ামীনের সাথে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছে। তারা তার নিকট একথা কিছুতেই প্রকাশ করবে না যে, তারা মুসলমান। তারা বলবে, আমরা খ্রিস্টান। শামের খ্রিস্টান সর্দারের পত্র নিয়ে আমরা এসেছি।
রাবেয়ার কণ্ঠ অত্যন্ত উফুল্ল শোনা গেল। বলল, আমি সুখে-দুখে সর্বদা তোমাদের সাথে থাকব। প্রয়োজনে প্রাণ দিব। তবে এমন নয় তো যে, আমাকে নীল নদে ডুবিয়ে মারা হবে!
***
বিন ইয়ামীন আত্মগোপন করে আছে। অত্যন্ত সর্তক অবস্থায় আছে। তাই তার ঠিকানা নেয়া, আর আস্তানা খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন ওদুঃসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু তারা গুপ্তচর। বার বাজারের তের গলিতে তাদের যাতায়াত। সকল রহস্যের গ্রন্থি উন্মোচন করাই তাদের কাজ। তাই বিন ইয়ামীন কোথায় আছে তা বের করতে তাদের বেগ পেতে হল না। বিন ইয়ামীনের আস্তানা খুব বেশী দূরে নয়। তবে অত্যন্ত দুর্গম। চড়াই উত্রাই আর ঘন বনজঙ্গল পেরিয়ে তবে আস্তানায় পৌঁছতে হয়।
দ্বিপ্রহরের পর তারা সেখানে গিয়ে পৌঁছল। ছোট্ট একটি খেজুরের বাগান। চারদিকে রালিয়াড়ির মাঝে বাগানটিকে মরুদ্যান মনে হয়। একটি ছোট গির্জা। তার চার পাশে কয়েকটি তাঁবু। পাথরের তৈরী গির্জার এক কোণে একটি কামরায় বিন ইয়ামীন থাকে। তাকে সংবাদ জানান হল, তিনজন পুরুষ ও একজন মহিলা আপনার সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছে। বিন ইয়ামীন তাদের ডেকে পাঠালেন।
মুজাহিদদের দলপতি তাদের পরিচয় দিয়ে বলল, আমরা আলোর অধিবাসী। খ্রিস্টান। আর এ মেয়েটি আমাদের এই বন্ধুর স্ত্রী। কিছুদিন পূর্বে তাদের বিয়ে হয়েছে। তার স্ত্রী মিসর দেখার জন্য ও আপনার সাথে সাক্ষাৎ করে আশির্বাদ নেয়ার জন্য একেবারে কাতর হয়ে গিয়েছিল, তাই তাকেও সাথে করে এনেছি। সবার গলায় তখন ক্রুশ শোভা পাচ্ছিল। খ্রিস্টানদের নামের মতই তারা তাদের নাম বলল।
বিন ইয়ামীন বলল, তোমরা কি শুধু আমার সাথে সাক্ষাৎ করতেই এসেছ না বলার কোন কথা আছে? শামে খ্রিস্টানরা কি অবস্থায় আছে?
দলপতি বলল, আমরা শুধু আপনার সাক্ষাতের জন্যই এসেছি। তবে আমাদের একটি কথা আছে। শামে রোমানরা খ্রিস্টানদের সাথে গাদ্দারী করেছে। প্রতারণা করেছে। আমরা ত্রিশ হাজার সৈন্য সশস্ত্র অবস্থায় সম্রাট হিরাক্লিয়াসের নিকট গেলাম। বললাম, আমরা রোমান সৈন্যদের সাথে মিশে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। কিন্তু সম্রাট হিরাক্লিয়াস ও তার ছেলে কুস্তুনতীন আমাদের সাথে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করল। সর্বশেষে যুদ্ধের ময়দানে আমাদেরকে মুসলমানদের তরবারীর নিচে ফেলে পালিয়ে গেল।
এতটুকুতেই তাদের মনের আশা মিটল না। তারা আমাদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে উত্সকে দিল। আমরা বিদ্রোহ করলাম। কিন্তু তারা আমাদের সহায়তায় এগিয়ে এল না। আমরা মুসলমানদের মুকাবিলা করতে পারলাম না। অস্ত্র সমর্পণ করলাম। মুসলমানরা আমাদের নির্বিচারে হত্যা করতে পারত। তারা ইচ্ছে করলে আমাদের মেয়েদের ও স্ত্রীদের বাদী বানাতে পারত। আমাদের সন্তানদের গোলাম বানাতে পারত। কেউ তাদের বাধা দেয়ার ছিল না। কিন্তু তারা তা করল না, এমন কি তারা নির্যাতনমূলক কোন কাজও করল না। তারা বিজয়ী আর আমরা পরাজিত। তারা শাসক আর আমরা শাসিত–এমন আচরণ ও তাদের থেকে প্রকাশ পেল না। এমন কি তারা আমাদের ধর্মের ব্যাপারেও কিছু বলল না। কোন হস্তক্ষেপও করল না।
বিন ইয়ামীন বলল, আমি রোমানদের কার্যাবলী সম্পর্কে সজাগ। সবকিছুই জানি। শামে তারা তাদের কৃতকর্মের ফল পেয়েছে। কিন্তু তাদের শিক্ষা হয়নি। মিসরেও তারা তাই শুরু করেছে। রাজকীয় খ্রিস্ট ধর্মের নামে বর্বর ও নির্মম অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। তোমরা তো শুনেছো যে, আমি আত্মগোপন করে আছি। এমন অবস্থায় আমি শামের খ্রিস্টানদের জন্য কি করতে পারি?
দলপতি বলল, আমরা আপনার থেকে সাহায্য নেয়ার জন্য আসিনি। আমরা মিসরের খ্রিস্টানদের সহায়তা করতে এসেছি।
বিন ইয়ামীনের কণ্ঠে বিস্ময়ভাব ফুটে উঠল। বলল, তোমরা আমাদের কি সাহায্য করতে পারবে?
দলপতি বলল, আমাদের সর্দাররা আর পাদ্রীরা মিসরের সব খবর জানে। মিসর থেকে কিছু খ্রিস্টান পালিয়ে শামে গিয়েছিল। তারা সেখানে গিয়ে মিসরে খ্রিস্টানদের উপর কি জুলুম-অত্যাচার চলছে তার বিবরণ দিয়েছে। আমাদের সর্দারদের এ সামর্থ নেই যে তারা বাহিনী তৈরী করে মিসর আক্রমণ করবে। তাই তারা এক মুসলমান সিপাহসালার আমর ইবনে আসের নিকট প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেছিল। তাদের মাঝে দুজন পাদ্রীও ছিল।
তারা সিপাহসালারের সাথে সাক্ষাৎ করে মিসরের খ্রিস্টানদের দুর্দশা ও নির্যাতন নিপীড়নের অবস্থা তুলে ধরল। তারপর বলল, যদি মুসলমানরা মিসর আক্রমণ করে তবে তারা শাম থেকে ত্রিশ চল্লিশ হাজার যোদ্ধা দিতে পারবে।
দলপতি একের পর এক অনেক কথা বলতে লাগল। আর বিন ইয়ামীন মনোযোগ সহকারে শুনতে লাগল। দলপতির মূল কথা ছিল, যদি মিসরের খ্রিস্টানরা সম্রাট হিরাক্লিয়াসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাহলে মুসলমানরা মিসরে আক্রমণ করবে। আর যদি তারা বিদ্রোহ করতে সাহস না পায় তাহলে আক্রমণের সময় মুসলমানদের সাহায্য করলেও চলবে। আমর ইবনে আস (রা.) তাদের যে দায়িত্ব দিয়ে, যে উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছিলেন, ঠিক সে উদ্দেশ্যের কথাই ধীরে ধীরে দলপতি ব্যক্ত করল।
তারপর দলপতি বলল, আমি আপনাকে আরেকটি কথা বলল। এ বিষয়টি দেখে আমাদের খুব কষ্ট হয় যে, খ্রিস্টানরা আজ বিভিন্ন দল উপদলে বিভক্ত হয়ে গেছে। বর্তমান অবস্থায় এটা আমাদের জন্য দারুণ ক্ষতিকর। আর এ প্রথাও খ্রিস্টানদের খুব ক্ষতি করছে যে তারা ধর্মীয় আমেজে অন্যায়ভাবে প্রত্যেক বৎসর একজন কুমারী যুবতাঁকে নীল নদে নিক্ষেপ করে হত্যা করে। মিসরের খ্রিস্টানরাই এ গর্হিত কাজটি করে। আপনি কি তা বন্ধ করতে পারেন না?
গম্ভীর কণ্ঠে বিন ইয়ামীন বলল, আমি এ প্রথাকে ভাল মনে করি না। এটা একটা মনগড়া প্রথা। আমাদের লোকেরা এটাকে পাপ কাজ মনে করে। কিন্তু এখন এটা নিয়ে ফাসাদ করার সময় নয়। যারা যুবতীদের বিসর্জন দেয় তারা আমাকে আধ্যাত্মিক নেতা হিসাবে মানে। সম্রাট হিরাক্লিয়াসের বিরুদ্ধে আমরা যে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি তার পক্ষে তারা অম্লান বদনে সব কষ্ট সহ্য করে যাচ্ছে। যদি আমি তাদের ঐ প্রথার বিরুদ্ধে কিছু বলি তাহলে কট্টরপন্থী লোকেরা আর মূর্খ লোকেরা আমাকে ত্যাগ করবে। ফলে আমাদের শক্তি খর্ব হয়ে যাবে। আমরা রাজকীয় খ্রিস্ট ধর্মের কাছে পরাজিত হয়ে যাব। আচ্ছা যাক সে কথা, এখন তোমরা যে জন্য এসেছো সে কথা বল।
দলপতি বলল, আমরা তো আমাদের কথা শেষ করে ফেলেছি। আমরা এখন আপনার উত্তরের আশায় আছি। আমরা তা পেলেই আমাদের সর্দারদের নিকট তা পৌঁছাব।
বিন ইয়ামীন হাসতে হাসতে বলল, তোমাদের সর্দারদের নিকট নয়, বরং তোমাদের সালার আমর ইবনে আসের নিকট পৌঁছাবে। তোমরা এতো বেশী কথা বলেছো যে তোমরা নিজেদের উপর যে আবরণ দিয়েছিলে আমি তা উঘাটন করতে পেরেছি এবং তোমাদের আসল রূপ আমার নিকট পরিষ্কার হয়ে গেছে। এই মেয়েটিকে দেখে আমি বুঝে উঠতে পারছি না, তোমরা তাকে কেন লড়াইয়ের ময়দানে নিয়ে এসেছো। মুসলমানরা তো যুদ্ধ ময়দানে নারীদের আনে না। এবং গুপ্তচর বৃত্তিতেও নারীদের নিয়োগ করে না। কিন্তু তোমরা এটা করলে কী!
রাবেয়া বলল, আমি নও মুসলিম। গতকাল মুসলমান হয়েছি। আমি শামের আলেপ্পা শহরের অধিবাসী। রাবেয়া তার মনের কথা বলে দিল। কিছু কমালোও না, কিছু বাড়ালও না। তারপর বলল, এ মুসলমানরা তাদের দায়িত্ব থেকে কিছুটা সরে এসে আমাকে নতুন জিন্দেগী দান করেছে। আমি তাদের কাজকর্মে এতো প্রভাবিত হয়েছি যে, সাগ্রহে মুসলমান হয়ে গেছি। তারা আমাকে বিশ্বস্ত মনে করে তাদের সাথী করে নিয়েছে।
ওয়াইস বলল, আর আমিও নও মুসলিম। আমি আমার জীবনকে ইসলামের সেবার জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছি। তারপর ওয়াইস তার ইসলাম গ্রহণের কাহিনী বর্ণনা করল।
বিন ইয়ামীন অত্যন্ত দূরদর্শী, বিচক্ষণ ও চৌকস। ভবিষ্যতে কি ঘটতে পারে লক্ষণ দেখে তা সে অনুমান করতে পারে। মনে হয় আকাশ বাতাস, চাঁদের কিরণ আর সূর্যের আলো তাকে কানে কানে সবকিছু বলে দেয়। সে বেশ কিছুক্ষণ নিরব রইল। কোন কথা বলল না। তারপর ধীরে ধীরে তার মাথা দুলে উঠল। ভেবে চিন্তে যেন কোন কঠিন বিষয়ের সমাধানে পৌঁছতে পারল। বলল, আমি দিব্য দৃষ্টিতে ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি। মুসলমানরা যদি তাদের বর্তমান আদর্শ ধরে রাখতে পারেন তাহলে খ্রিস্টানরা ধীরে ধীরে ইসলাম ধর্শ গ্রহণ করতে থাকবে। এক সময় মিসর হবে ইসলামী দেশ। রোমানরা মিসরে থাকতে পারবে না। মিসর ছেড়ে তাদের যেতেই হবে। মুসলমানরা যদি মিসর আক্রমণ করে তাহলে মিসরের খ্রিস্টানরা নিরব দর্শকের ন্যায় তামাশা দেখতে থাকবে। আর এটা কোন আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, রোমানরা খ্রিস্টান হওয়া সত্ত্বেও মিসরের খ্রিস্টানরা তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে না। বরং মুসলমানদেরকেই তারা স্বাগতম জানাবে।
তোমরা ফিরে যাও। রোমানদের বিরুদ্ধে মিসরের খ্রিস্টানদের উসকে দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই। আমরা রোমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে চাই না। আমাদের সে অস্ত্র ও জনবল নেই। আমরা রোমানদের এই ধোকায় ফেলে রাখব যে, আমরা তাদের ওফাদারও হিতাকাঙ্ক্ষী প্রজা। আমরা তাদের বিশ্বস্ত শুভানুধ্যায়ী গোলাম।
***
মুসলিম গুপ্তচরদের মিশন সফল হল। মিসরের অন্য কোন অঞ্চলে গিয়ে খ্রিস্টানদেরকে রোমানদের বিরুদ্ধে উসকে দেয়ার বা বিদ্রোহ করানোর প্রয়োজন অনুভব করল না। খ্রিস্টানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় নেতা তাদের সে প্রয়োজন পূরণ করে দিয়েছে। ওয়াইস একটু বেশী সফল হল। তারা বিন ইয়ামীন থেকে বিদায় নিয়ে কাউস এলাকায় এসে পৌঁছল এবং সেখানেই রাত কাটাল।
খুব ভোরে যখন দুএকটি কাক কা কা করে উঠেছে তখন তারা ভাড়া করা উটে করে ইস্কান্দারিয়ায় রওয়ানা হয়ে গেল। তারা আশঙ্কা করছিল, যদি কেউ রাবেয়াকে চিনতে পারে তাহলে মহাবিপদ হবে। তাকে ছিনিয়ে নিয়ে আবার নীল নদে নিক্ষেপ করবে। ভাগ্য প্রসন্নই বলতে হয়। বন্দরে পৌঁছার সাথে সাথেই তারা একটি জাহাজ পেয়ে গেল।
তারা মিসর থেকে ফিরে এসে শুনল, সিপাহ সালার আমর ইবনে আস (রা.) বাইতুল মুকাদ্দাসে আছেন। তারা বন্দর থেকে বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে রওয়ানা হয়ে গেল। আমর ইবনে আস (রা.) যখন শুনতে পেলেন যে, মিসরে প্রেরিত গুপ্তচর তিনজন ফিরে এসেছে, তারা আপনার সাক্ষাৎ প্রার্থী। সাথে সাথে তিনি তাদের ডেকে পাঠালেন।
সিপাহসালার তাদের জিজ্ঞেস করলেন, কি করে এলে?
দলপতি তখন মিসরের কার্যাবলী একে একে উপস্থাপন করল এবং পাদ্রী নেতা বিন ইয়ামীনের কথা হুবহু শোনাল।
তারপর দলপতি বলল, এটা তো পাদ্রী বিন ইয়ামীনের কথা। তাছাড়া আমরাও মিসরের সব শ্রেণীর মানুষের সাথে কথাবার্তা বলেছি। গির্জায়, সরাইখানায়, হাটে-বাজারে, শহরে-বন্দরে, সবার সাথে রোমানদের ব্যাপারে আলোচনা করেছি। দেখেছি, তারা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ, অতিষ্ঠ।
আমর ইবনে আস (রা.) বললেন, বিন ইয়ামীন যা বলে দিয়েছে তাই শেষ কথা। এরপর আর কিছু বলার থাকে না।
একজন বলল, সিপাহ সালার মহোদয়! আমার একটি পরামর্শ, যদি মিসরে আক্রমণ করতে হয় তাহলে আর দেরি নয়। এখনই আক্রমণ করতে হবে। রোমান সৈন্য শারীরিক ও মানসিক ভাবে একেবারে ভেঙে পড়েছে। তাছাড়া মিসরের খ্রিস্টান জনতা এখন তাদের দুশমন। এ অবস্থায় আক্রমণ করলে আমরা। প্রায় বিনা যুদ্ধেই মিসর পদানত করতে পারব।
গুপ্তচরদের রিপোর্টে আমর ইবনে আস (রা.) দারুণ বিমুদ্ধ হলেন। বললেন, আমি এখন সবার আগে মদীনায় যাব। এবং আমীলুল মুমিনীন হযরত উমর (রা.) থেকে মিসর আক্রমণের অনুমতি নিয়ে তবে ফিরে আসব।
মূল আলোচনা শেষ হলে তারা রাবেয়ার প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করল। রাবেয়া তখন বাইরে বসে ছিল। ওয়াইস বলল, সিপাহসালার যেন রাবেয়ার সাথে তার বিয়ের ব্যবস্থা করেন।
আমর ইবনে আস (রা.) রাবেয়াকে ভিতরে ডেকে নিলেন। তারপর তাকে জিজ্ঞেস করলেন, সে কিভাবে ওয়াইসের নিকট এল। রাবেয়া ঐ কাহিনীই শোনাল যা গুপ্তচর সিপাহ সালারকে শুনিয়েছে। আসলে এ প্রশ্ন করে তিনি ঘটনার সত্যতা যাচাই করলেন। আর একথাও বুঝতে চেষ্টা করলেন যে, এ অল্প বয়সী কুমারীর উপর কোন প্রকার চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে না তো!
রাবেয়ার কথা শুনে আমর ইবনে আস (রা.) নিশ্চিত হলেন। তারপর রাবেয়াও নিজের বিয়ের আগ্রহ প্রকাশ করলে সিপাহ সালার আমর ইবনে আস (রা.) ওয়াইস ও রাবেয়ার বিয়ে সম্পন্ন করে দিলেন।
***
আমর ইবনে আস (রা.) মদীনায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাঁর বিশ্বাস, এবার তিনি মিসর আক্রমণের অনুমতি পাবেন। তিন চারদিন পর মদীনা থেকে আমীরুল মুমিনীনের এক দূত এক চিঠি নিয়ে এল। চিঠি পড়ে তার শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে গেল। আমর ইবনে আস (রা.) এর মত সাহসী লোকের হাতও কাঁপতে লাগল। চিঠির মর্ম ভাষা
আমর ইবনে আস (রা.)! আসোলামু আলাইকুম, তুমি কি আমাকে আমার সাথীদেরকে যারা আমার জিম্মায় রয়েছে তাদের ধ্বংস হওয়া দেখবে? আর তুমি তোমার সাথীদের নিয়ে জীবিত থাকবে? সাহায্য পাঠাও, সাহায্য, সাহায্য!
আমর ইবনে আস (রা.) দুতকে জিজ্ঞেস করলেন, কি বিপদ এসেছে?
বার্তাবাহক উত্তরে বলল, দুর্ভিক্ষ। আরবের দক্ষিণ সীমান্ত থেকে উত্তর সীমান্ত পর্যন্ত সর্বত্র মহা দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। মানুষ আর পশু না খেয়ে না খেয়ে ক্ষুধার তাড়নায় ছটফট করতে করতে মৃত্যুবরণ করছে। আমি বলতে পারব না, ফিরে যাওয়ার পূর্বে আর কতজন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। খাবারের জন্য কোথাও শস্য পাওয়া যাচ্ছে না। পানির অভাবে মানুষ ছটফট করছে। দুধের পশুগুলো হাড়ের খাঁচা হয়ে একের পর এক মরছে। এটা হিজরী ১৮ সাল মুতাবেক ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দের কথা।
এরপর আমর ইবনে আস (রা.) আমীরুল মুমিনীনের পত্রের উত্তরে লিখলেন।
আমীরুল মুমিনীনের নামে, আসোলামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওবারাকাতুহু,
আপনি কোন দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি খাদ্য সামগ্রী সহ এক কাফেলা পাঠাচ্ছি যার শুরু অংশ আপনার নিকট গিয়ে পৌঁছবে আর শেষ অংশ আমার নিকট থাকবে।
আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) এ ধরনে পত্র শামে হযরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর নিকট এবং আবু উবায়দা (রা.)-এর নিকটও প্রেরণ করেছিলেন। তারা শামের আঞ্চলিক শাসক ও সিপাহসালার ছিলেন। এ ধরনের পত্র ইরাকের গভর্নর ও সিপাহ সালার সাআদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (র.)-এ নিকটও প্রেরণ করেছিলেন। আমর ইবনে আস (রা.)-এর মত তাঁরাও উত্তর পাঠালেন।
তারপরই মদীনায় একের পর এক খাদ্য বোঝাই বিশাল বিশাল কাফেলা আসতে শুরু করল। আমর ইবনে আস (রা.) ফিলিস্তিন থেকে আটা ও ঘিয়ে বোঝাই করা এক হাজার উটের কাফেলা স্থল পথে পাঠালেন এবং আকাবা বন্দর থেকে বহু জাহাজ বোঝাই করে জল পথে খাবার-খাদ্য সামগ্রী পাঠালেন। এ ছাড়া পাঁচ হাজার কম্বলও পাঠালেন।
শাম থেকে হযরত মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান (রা.) আটা ও ঘিয়ে বোঝাই করা তিন হাজার উটের কাফেলা পাঠালেন তা ছাড়া তিন হাজার জামাও প্রেরণ করলেন।
সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রা.) ইরাক থেকে খাদ্য শস্যে বোঝাই করা এক হাজার উট প্রেরণ করলেন।
শামের এক অঞ্চলের আমীর ও সিপাহ সালার হযরত আবু উবায়দা ইবনে জাররাহ (রা.) চার হাজার উটের পিঠে খাদ্য শস্য বোঝাই করা কাফেলা নিয়ে মদীনায় উপস্থিত হলেন।
হযরত উমর (রা.) এতে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন এবং তাকেই এ খাদ্য বন্টনের দায়িত্ব দিলেন। তিনি নির্দেশ দিলেন, আবু উবায়দাকে এই পরিশ্রমের জন্য চার হাজার দেরহমা দিয়ে দাও।
আবু উবায়দা (রা.) এ কথা শুনে বিস্মিত হলেন। বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আমার এ বিনিময়ের প্রয়োজন নেই। আমি তো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এ কাজটুকু করেছি। আমার এ কাজকে আপনি দুনিয়ার দিকে ঠেলে দিবেন না।
আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর (রা.) বললেন, তুমি তো এর বিনিময় চাও নি। তাই তা নেয়াতে কোন অসুবিধা নেই। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লমের সাথে আমার এমনই একটি ঘটনা ঘটেছিল। তুমি এখন আমাকে যা বলেছে আমিও তাই রাসূলের নিকট বলেছিলাম। রাসূল আমার কথা কবুল করে নিয়ে আমাকে মূল্য নিতে বাধ্য করেছিলেন।
অবশেষে আবু উবায়দা (রা.) চার হাজার দেরহাম নিয়ে নিলেন এবং আবার শামের সে অঞ্চলে ফিরে গেলেন।
***
আকাশ পরিষ্কার। মেঘের কোন চিহ্ন নেই। ক্ষীপ্ত সূর্য পৃথিবীতে শুধু আগুন আর আগুন ঝরাচ্ছে। জমি-জমার মাটি শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে। আবহাওয়া প্রতিকূল দেখে কৃষকরা জমিনে চাষ করা বন্ধ করে দিয়েছে। চারদিকে যেন আগুন আর আগুন। জমিনের সকল ঘাস পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। শাক-সবজি যা কিছু মাটির উপর ছিল তা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
খেজুর বাগানের অবস্থা আরো করুণ। খেজুর গাছে কাঁদির কোন নাম। নিশানা নেই। স্তবকের কোন চিহ্ন নেই। বাগানে সবুজের কোন আলামত নেই। পাতাগুলো শুকিয়ে শুকিয়ে মরে গেছে। কচি কোন পাতা দেখা যায় না। শুকনো কাঠির মত গাছগুলো দাঁড়িয়ে যেন বাঁচার জন্য নিরবে আর্তনাদ করছে। গরু, বকরী, মহিষ আর মেষগুলো দিনে দিনে মরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। অনাহারে মানুষও মরতে শুরু করেছে। যারা ধন-সম্পদশালী তারাও ভীষণ কষ্টে আছে। কারণ বাজারে খাদ্যই নেই; কিনবে কোথা থেকে। সম্পদের জায়গায় সম্পদ পড়ে রইল। আর অনাহারে সম্পদশালীরা মরতে লাগল।
ইরাক, শাম আর ফিলিস্তিন থেকে যে খাদ্যের কাফেলা এসেছে হযরত ওমর (রা.) সেইসব কাফেলার লোকদের নির্দেশ দিলেন, তারা যেন দুর্দশাগ্রস্থ, ক্ষুধা-আক্রান্ত এলাকায় গিয়ে তা বণ্টন করে দেয়। তিনি নির্দেশ দিলেন, কাফেলার উটগুলোকে যবাই করে তার গোশত বিতরণ করে দিবে। কারণ দুর্ভিক্ষ কবলিত অঞ্চলে একটি উটও জীবিত নেই। সব মরে গেছে। যদিও দুএকটি বেঁচে থাকে তাহলে তা হাড়ের খাঁচা। গোশতের তাতে কোন নাম নিশানা নেই। কাফেলাগুলোর সাথে প্রায় দশ হাজার উট এসেছিল। সবগুলো উট যবাই করে ক্ষুধাপীড়িত মানুষের মাঝে বিতরণ করা হল।
ইসলামী খেলাফতের প্রাণকেন্দ্র মদীনা নগরী। এ নগরীতে খলীফা বসবাস করেন। খলীফার সহকর্মী পরামর্শদাতা সাহাবায়ে কেরাম বসবাস করেন। এ শহরে রয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের সমাধী। তাই এ নগরী গোটা আরবের প্রাণকেন্দ্র। গোটা ইসলামী জাহানের হৃদপিণ্ড।
দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষেরা অনন্যোপায় হয়ে দলে দলে মদীনায় এসে আশ্রয় নিতে লাগল। তাদের চোখে মুখে একটু আশা একটু ভরসা, হয়তো মদীনায় গেলে একমুঠো খাবার মিলবে। ছেলেপুলে নিয়ে জীবনটা ধরে রাখা সম্ভব হবে।
হযরত উমর (রা.) মদীনাবাসীদের নির্দেশ দিলেন, তারা যেন প্রতিদিন দ্বিগুণ খাবার তৈরী করে। এবং আশ্রিত ব্যক্তিদের খাবার দান করে। মদীনার লোকেরা অম্লান বদনে তা মেনে নিল। এভাবে কয়েকদিন চলল। কিন্তু শরণার্থীদের সংখ্যা প্রত্যেক বেলায়ই বেড়ে চলছে। হযরত উমর (রা.) অস্থির বেকারার। সারাক্ষণ ঘুরে ঘুরে মানুষের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। মানুষের খোঁজ খবর নেন। মদীনার লোকদের যথাসাধ্য চেষ্টা সত্ত্বেও শরণার্থীদের বেশ কিছু লোক ক্ষুধার্ত থেকে যেতে লাগল।
আবার চিন্তিত হয়ে পড়লেন হযরত উমর (রা.)। কী করবেন। কী ব্যবস্থা নিবেন। অস্থির ভাবে পায়চারী করতে করতে হঠাৎ তার মাথায় এক নতুন চিন্তা এল। ব্যস্ আর দেরি করলেন না। মদীনার লোকদের জানিয়ে দিলেন, এখন থেকে আর কেউ নিজ নিজ ঘরে আলাদাভাবে খাবার তৈরী করবে না। সবার খাদ্য এক স্থানে জমা করে সম্মিলিতভাবে তৈরী করা হবে। সবাই একই দস্তরখানে বসে খাবার খাবে। আমীরুল মুমিনীন নিজ ঘর থেকে তা শুরু করলেন। মদীনা নগরীর খাবার এক জায়গায় তৈরী হতে লাগল। সবাই একই দস্তরখানায় বসে খেতে আরম্ভ করল। আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর (রা.)-এর ঘরেও পাক বন্ধ হয়ে গেল। তিনি তার পরিজনদের নিয়ে সবার সাথে সম্মিলিত দস্তরখানায় খাওয়া দাওয়া শুরু করলেন।
প্রত্যেক দিন দুবেলা সম্মিলিত খাবারের আয়োজন হয়। প্রত্যেক বেলা দশ হাজরের চেয়ে বেশী লোক এ সম্মিলিত দস্তরখানায় বসে আহার গ্রহণ করে। যারা অসুস্থ, বৃদ্ধ, যাতায়াতে অক্ষম, তাদের খাবার পৌঁছে দেয়া হয়। নারী ও শিশুদের খাবারও পৌঁছে দেয়া হয়। এদের সংখ্যাও পঞ্চাশ হাজারের কম হবে না।
আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর (রা.) সবার সাথে বসে সম্মিলিত দস্তরখানায় খাবার খান। একদিন হযরত ওমর (রা.) খেতে বসলেন। ঘটনাক্রমে তার সাথে এক বেদুইন একই পাত্রে খেতে বসেছে। সেদিন রুটি আর ঘি পরিবেশন করা হয়েছিল। বেদুইন হযরত ওমর (রা.)-এর সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ শুরু করল। লোকটি বেশী বেশী ঘি নিয়ে বড় বড় লোকমরা দিয়ে খাওয়া শুরু করল। হযরত ওমর (রা.) বেদুইনের এ কাণ্ড দেখে বিস্মিত হলেন। বললেন, ভাই! তুমি কি ঘি দিয়ে রুটি খাওনি?
বেদুইন বিষয়টি বুঝতে না পেরে হেড়ে গলায় বলল, হে আমীরুল মুমিনীন! দুর্ভিক্ষ আসার পর থেকে ঘি দেখিনি, রুটিও দেখিনি। তাই ঘি আর রুটি ইচ্ছামত খেয়ে নিচ্ছি।
একথা শুনে আমীরুল মুমিনীনের চোখ অশ্রুসজল হয়ে গেল। তিনি কসম করে বললেন, যতদিন পর্যন্ত দুর্ভিক্ষ শেষ না হবে ততদিন আমি আর ঘি ও রুটি দ্বারা খাবার গ্রহণ করব না। এরপর তার মনে আরো ভাঙন সৃষ্টি হল। সবাই দেখতে লাগল, হযরত ওমর (রা.) গোশত খাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছেন। তার অবস্থা এমন হল যে, সারাক্ষণ শরণার্থীদের অবস্থা দেখছেন। যারা মদীনার বাইরে দূরে দূরে আছে তাদের খোঁজ খবর নিচ্ছেন। প্রয়োজনে গিয়ে তাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে আসছেন। জিজ্ঞেস করছেন, তাদের নিকট নিয়মিত খাবার পৌঁছছে কি না?
পেরেশানীর পর পেরেশানী, কষ্টের পর কষ্টের প্রভাব তার শরীরে দেখা দিল। তাছাড়া দৈনন্দিনের খাবারও তিনি কমিয়ে দিয়েছেন। ফলে তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়তে লাগল। রক্তশূন্য হয়ে শরীর ফ্যাকাসে হয়ে গেল। ক্রমেই শরীর শুকিয়ে যেতে লাগল। মাঝে মাঝে পেটে ব্যথা অনুভব করতে লাগলেন। তার সঙ্গীরা ও ঘনিষ্ট লোকেরা তাকে নিয়ে দারুণ পেরেশানীতে পড়ে গেল। যদি তিনি রীতিমত প্রয়োজনীয় খাবার গ্রহণ না করেন তাহলে তো তিনি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবেন।
বর্ষীয়ান গণ্যমান্য সাহাবীদের কয়েকজন তাঁকে বললেন, আপনি বিশ্রাম করেন না বা না করেন সে ব্যাপারে আমরা আপনাকে কিছু বলব না, কিন্তু প্রত্যেক দিনের পরিমাণ মত খাবারটুকু তো আপনি গ্রহণ করবেন।
আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর (রা.) তাদের কথা সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করতে পারলেন না। বললেন, মানুষের কষ্টের অনুভূতি আমি এভাবেই অনুভব করি। সুতরাং আমার অবস্থা নিয়ে আপনারা চিন্তা করবেন না।
এদিকে হযরত ওমর (রা.) সময় পেলেই ছুটে গিয়ে জায়নামাজে দাঁড়ান। আল্লাহর দরবারে লুটিয়ে পড়েন। নামায আদায় করেন। তারপর এক সকরুণ দৃশ্যের অবতারণা হয়। দুহাত প্রসারিত করে কাঁদতে থাকেন। অবিরাম অশ্রু ঝরতে থাকে তার চোখ থেকে। কেঁদে কেঁদে বলেন, হে আল্লাহ্! যদি এ মহা দুর্ভিক্ষ আমার পাপের কারণে হয়ে থাকে তাহলে তার শাস্তি আমাকে দিন। আমার জাতিকে দিবেন না।
এতো কাঁদছেন, এতো দুআ করছেন, কিন্তু দুআ কবুল হচ্ছে না। আকাশে কোন মেঘের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। সূর্য আগুনের হলকা বর্ষণ করে চলছে। পৃথিবী জ্বলে পুড়ে তামা হয়ে যাচ্ছে।
***
আকাশ যেন আরবদের বৈরী হয়ে গেছে। আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর (রা.)-এর সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা, তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টা ও দেখা শোনাতে মানুষ অনাহার আর ক্ষুধার জ্বালা থেকে রক্ষা পেলেও দুর্ভিক্ষের হাত থেকে রক্ষা পেল না। পরিবেশের উত্তাপ ক্রমেই বেড় চলল। সূর্যও নির্মমভাবে অগ্নি বর্ষণ করতে থাকল। বাতাসের গায়ে শুধু আগুনের হলকা।
এদিকে হযরত ওমর (রা.)-এর শরীর ক্রমেই ভেঙে পড়ছে। এতে সাহাবায়ে কেরাম দারুণ চিন্তিত, অত্যন্ত পেরেশান। কারণ তিনি পুষ্টিকর খাবার একেবারেই ছেড়ে দিয়েছেন। ঘি, গোশত এ ধরনের খাবারে হাত পর্যন্ত দেন না। তিনি বলেন, আরবের প্রতিটি লোক যখন এ ধরনের খাবার খেতে পারবে তখনই আমি এ ধরনের খাবার খাব।
একদিন এক ঘটনা ঘটল। হযরত ওমর (রা.) এর কিছু অন্তরঙ্গ লোক প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন যে, তাঁকে আজ কিছু ভাল খাবার অবশ্যই খাওয়াবেন। তারা তাকে সাধারণ দস্তরখানা থেকে সরিয়ে একটু দূরে বসালেন। গোশতের সাথে ঘিয়ে ভাজা রুটি তাকে দেয়া হল। তারা বিভিন্ন কথায় মশগুল হয়ে পড়ল। তাদের ধারণা, হয়তো কথার তালে তালে হযরত ওমর (রা.) কি খাচ্ছেন সেদিকে কোন খেয়াল করবেন না। বেখেয়ালে গোশত দিয়ে ঘিয়ে ভাজা রুটি খেয়ে ফেলবেন। কিন্তু হযরত ওমর (রা.) দারুণ সচেতন। তিনি কাউকে কিছু বললেন না। হাত দিয়ে খাবারগুলো সরিয়ে রাখলেন। তারপর শান্ত কণ্ঠে বললেন, ভাইয়েরা! যাও, দস্তরখানায় ঘুরে ঘুরে দেখ। যে ব্যক্তি অনাহারে অর্ধাহারে একেবার শীর্ণকায় হয়ে গেছে তাকে এ খাবার দিয়ে দাও। আমার তো সাধারণ রুটি আর সামান্য তরকারীই যথেষ্ট।
সেদিন সন্ধ্যায় হযরত ওমর (রা.) নির্দেশ দিলেন, যারা সাধারণ দস্তরখানায় খাবার খায় তাদের সংখ্যা গণনা করা হোক। গণনা করে দেখা গেল, সাত হাজারের চেয়ে কিছু বেশী লোক সাধারণ দস্তরখানায় বসে আহার খায়। আর বৃদ্ধ, অসুস্থ, নারী ও শিশুরা যারা দস্তরখানায় উপস্থিত হয় না এবং তাদের খাবার তাদের নিকট পৌঁছে দেয়া হয় তাদের সংখ্যা চল্লিশ হাজারেরও বেশী।
সে রাতেও আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর (রা.) সাধারণ মানুষের সাথে বসে সাধারণ খাবার খেলেন। তিনি পানি চাইলে মধু মিশ্রিত পানি তাকে দেয়া হল। এক ঢোক পানি পান করেই তা ফিরিয়ে দিলেন। বললেন, আল্লাহর কসম করে বলছি, আমি এমন কাজ করব না কিয়ামত দিবসে যার জওয়াব দিতে হবে।
আরেক দিনের ঘটনা। হযরত ওমর (রা.) দেখলেন, তার এক ছোট্ট ছেলে একটুকরো তরমুজ খাচ্ছে। সাথে সাথে তার চেহারার রং পাল্টে গেল। কণ্ঠস্বর কঠোর হয়ে গেল। বললেন, বাহবা, দেখ দেখ আমীরুল মুমিনীনের ছেলে ফল খাচ্ছে আর রাসূলের উম্মতরা অনাহারে মরছে!
পুত্র তার পিতার কঠোর স্বভাব জানত। ভয়ে সে কেঁদে ফেলল। এতেই হযরত উমরের ক্রোধ শান্ত হল না। তখন জনৈক ব্যক্তি এগিয়ে এসে বলল, ছেলেটি কয়েকটি খেজুর দিয়ে তার বিনিয়ে তরমুজের এই টুকরাটি নিয়েছে। এবার হযরত ওমর (রা.)-এর ক্রোধ শান্ত হতে শুরু করল। ধীরে ধীরে তিনি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলেন।
***
দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা, উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা বেড়েই চলল। প্রকৃতির রুক্ষ্মতা যেন আর শেষ হয় না। ইরাক আর শাম থেকে কাফেলার পর কাফেলা আসছে। খাদ্যে বোঝাই উট আসছে। সুশৃঙ্খলতার সাথে খাদ্য বণ্টন হচ্ছে। মদীনা, তার পার্শ্ববর্তী এলাকা ও দূর দূরান্তে তা বিতরণ করা হচ্ছে। আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর (রা.) নিজে তার তদারকী করছেন। দেখাশোনা করছেন। দেখতে দেখতে ছয় সাত মাস কেটে গেল।
একদিন হযরত ওমর (রা.) মদীনা থেকে একটু দূরে এক পল্লী দিয়ে আসছিলেন। হঠাৎ তার কানে স্বজন হারানোর কান্নার আওয়াজ এল। এক মহিলার যুবক পুত্র এবং আরেক মহিলার স্বামী মারা গেছে। হযরত ওমর (রা.) গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এরা তো অনাহারে মারা যায়নি? উত্তর পেলেন যে, না তারা অনাহারে মারা যায়নি। হযরত ওমর (রা.)-এর হৃদয় কিছুটা শান্ত্বনা খুঁজে পেল। শুনলেন, এক অজ্ঞাত রোগের কারণে তারা মারা গেছে যা তারা বুঝতেও পারেনি।
সাথে সাথে হযরত ওমর (রা.) বাইতুল মাল থেকে তাদের কাফনের ব্যবস্থা করলেন। নিজেই তাদের জানাযার নামায পড়ালেন ও দাফনের ব্যবস্থা করলেন।
দেখতে দেখতে এ অজানা রোগ চারদিকে ছড়িয়ে গেল। রোগাক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসারও কোন সময় পাওয়া যায় না। এ রোগ মহামারী আকার ধারণ করল। আমীরুল মুমিনীনের শান্তি দূর হয়ে গেল। একটু আধটু যাও বিশ্রাম নিতেন তাও এখন শেষ হয়ে গেল। গ্রামের পর গ্রাম, পল্লীর পর পল্লীতে তিনি ছুটতে লাগলেন। চিৎিসকদের চিন্তার শেষ নেই। তাদের ঔষধ কোন কাজে আসছে না। ঔষধ প্রয়োগে রোগী সাথে সাথে মারা না গেলেও কয়েকদিন মাত্র বেঁচে থাকে।
চিকিৎসকদের ধারণা, দীর্ঘ খরা, প্রচণ্ড তাপদগ্ধতা আর উত্তপ্ত বায়ু প্রবাহের কারণে এ মহামারী দেখা দিয়েছে। হযরত ওমর (রা.) হুকুম দিলেন, এ রোগে। আক্রান্ত হয়ে যারা ইন্তেকাল করবে তাদের কাফন দাফনের ব্যবস্থা বাইতুল। মালের পক্ষ থেকে করা হবে। সম্ভাব্য সকল জায়গায় গিয়ে হযরত ওমর (রা.) মৃতদের জানাযার নামায পড়াতেন ও দাফনে শরীক হতেন।
হযরত ওমর (রা.) জানাযার নামাযে গেলে এখন কারো কারো কাছ থেকে শুনতে লাগলেন, হে আমীরুল মুমিনীন! ক্ষুধার হাত থেকে তো আমরা বাঁচলাম। কিন্তু এখন এ মহামারী থেকে বাঁচার উপায় কি? অথবা কেউ হয়তো বলল, হে আমীরুল মুমিনীন! রুটির ব্যবস্থা তো আপনি করেছেন, কিন্তু এখন বাঁচবো কোন উপায়ে?
অজ্ঞাত এ রোগের কারণে গোটা আরবে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। এর আগে হযরত ওমর (রা.) প্রত্যেক নামাযের পর দুর্ভিক্ষ থেকে বাঁচার দুআ করতেন। এ অজ্ঞাত রোগ আক্রমণ করার পর থেকে তিনি রাতের ঘুম ছেড়ে দিলেন। সারারাত নামায পড়েন আর বিনয় বিগলিত নেত্রে আল্লাহর নিকট দুআ করেন। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে শিশুর ন্যায় কাঁদেন আর বলেন, হে আল্লাহ! হে দয়াময় খোদা! হে গাফুরুর রাহীম! আমার পাপের শাস্তি আপনি আপনার রাসূলের উম্মতেদের দিয়েন না। হে আল্লাহ! আমাদের ক্ষমা করে দিন। আমাদের এই বিপদ থেকে মুক্তি দিন। কিন্তু আকাশ যেন বন্ধ হয়ে গেছে। দুআ যেন আল্লাহর দরবারে পৌঁছছে না।
***
অবশেষে আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর (রা.) একেবারে নিরূপায় হয়ে গেলেন। সকল প্রচেষ্টা তার ব্যর্থ হয়ে গেল। মৃত্যুর হাত থেকে তিনি আর কাউকে বাঁচাতে পারছেন না। এ মহামারী যেন আরবকে মানবমুক্ত করে ছাড়বে।
তিনি চারদিকে এ পয়গাম দিয়ে পাঠালেন, যেন সকল অঞ্চলের লোক নিজ নিজ অঞ্চলে একত্রিত হয়ে ইসতেসকার নামায পড়ে কেঁদে কেঁদে আল্লাহর নিকট দুআ করে যেন আল্লাহ্ আমাদের এ মহা আযাব থেকে মুক্তি দান করেন। আর যারা রাতেই মদীনায় এসে পৌঁছতে পারে তারা যেন মদীনায় চলে আসে।
দূতরা সাথে সাথে রওয়ানা হয়ে গেল। দূর দূরান্তের দূতরা রাতেও বিরামহীন গতিতে চলতে লাগল। পরদিন দুপুরে মদীনায় ইসতেস্কার নামাযের সময় নির্ধারণ করা হল। প্রত্যেক অঞ্চলের লোক সময় নির্ধারণ করে ইতেকার নামাযের আয়োজন করল।
পরদিন দুপুরে মদীনার লোকেরা, শরণার্থীরা ও নবাগত লোকেরা মদীনার বাইরে এক বিশাল চত্বরে সমবেত হল। প্রায় পঞ্চাশ ষাট হাজার মানুষ দুপুরের অগ্নিঝরা রোদে সারিবদ্ধভাবে নামাযের জন্য দাঁড়িয়ে গেল। মাটি যেন জ্বলন্ত কয়লা। তাতে খালি পা রাখার কথা চিন্তা করাই যায় না। কিন্তু আমীরুল মুমিনীনের নির্দেশে সবাই এসে সমবেত হল। হযরত ওমর (রা.) নামায পড়ানোর জন্য সামনে অগ্রসর হলেন। তার শরীরে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইতি ওয়াসাল্লামের ব্যবহৃত চাদর। নামায শুরু হতে না হতেই চারদিকে কান্নার আওয়াজ উত্থিত হল। সবাই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। হাজার হাজার নিরূপায় অক্ষম মানুষ আল্লাহর সামনে তাদের নিবেদন পেশ করছে, ক্ষমা ভিক্ষা চাচ্ছে। আযাব থেকে মুক্তি চাচ্ছে। হযরত ওমর (রা.)ও নিজেকে সংবরণ করতে পারলেন না। নামাযের শেষ পর্যন্ত তিনি কাঁদতেই থাকলেন।
নামাযের পর হযরত ওমর (রা.) দুআ শুরু করলেন। কিন্তু কান্নার কারণে তার কোন কথাই বুঝা গেল না। অবুঝ শিশুর মত তিনি দীর্ঘক্ষণ কাদলেন। তার। দাড়ি মোবারক বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরল। হযরত আব্বাস (রা.) হযরত ওমর (রা.)-এর সামনে বসা ছিলেন। দুআ চলাকালীন অবস্থায়ই তিনি আব্বাস (রা.)-এর বাহু ধরে কাছে টেনে আনলেন এবং তার দুহাত দুআ করার ন্যায় তুলে ধরলেন ও বললেন, হে আল্লাহ! আমরা আপনার রাসূলের চাচাকে আপনার নিকট সুপারিশ হিসাবে উপস্থিত করছি। হে আল্লাহ্! আপনি তার দুআ কবুল করে আমাদের এ বিপদ থেকে উদ্ধার করুন। আমাদের বাঁচান।
হযরত আব্বাস (রা.) হযরত ওমর (রা.)-এর চেয়ে উচ্চ কণ্ঠে বললেন, হে পরওয়ার দেগার! আপনার রাসূলের উছিলায় আমাদের উপর রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ করুন। প্রবল আবেগ ও কান্নার মাঝে হযরত আব্বাস (রা.)-এর কণ্ঠ হারিয়ে গেল।
মদীনা থেকে দূর দূরান্ত এলাকায় যেখানেই হযরত ওমর (রা.)-এর পয়গাম পৌঁছেছে সেখানেই মানুষ ইসতেসকার নামাযের আয়োজন করে নামায আদায় করেছে। সবাই রোরুদ্ধ কণ্ঠে কেঁদেছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে। আল্লাহর নিকট পানাহ চেয়ে প্রার্থনা করেছে।
সেদিনের সূর্যও প্রচণ্ড প্রতাপের সাথে অগ্নিবর্ষণ করতে করতে অস্তমিত হয়ে গেল। চারদিকে অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু প্রকৃতিতে কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল না। কিন্তু রাতের পর যে সকাল এল তা দেখে সবাই যেন তাদের চক্ষুকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সূর্য যেন আজ আর উদিত হচ্ছে না। মেঘে মেঘে আকাশ ছেয়ে আছে। কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে মেঘ ধেয়ে আসছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, বাজ পড়ছে। সে এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য। মানুষ এ দৃশ্য দেখে ঘরে মসজিদে সর্বত্র আল্লাহর দরবারে সেজদায় লুটিয়ে পড়া। হু হু করে কান্না এল হৃদয় চিরে। এ কান্না বিষাদের নয়, হর্ষের। এ কান্না দুঃখের নয়, আনন্দের।
এরপর নেমে এল বৃষ্টি। মুষলধারায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে তো হয়েছে। থামতে যেন আর চায় না। দীর্ঘ নয় মাসের পিপাসার্ত জমিন আল্লাহর রহমতের বৃষ্টিতে পরিতৃপ্ত হয়ে গেল। মৃত গাছপালার জীবন সংগ্রাম শেষ হল। মরতে মরতে তারা বেঁচে গেল। উপত্যকা আর নিচু অঞ্চল পানিতে ভরে গেল। প্রকৃতি আবার শান্ত হয়ে গেল।
দুই তিন দিন লাগাতার বৃষ্টিপাতের পর এখন থেমে থেমে বৃষ্টি হতে লাগল। মদীনায় যে পঞ্চাশ ষাট হাজার শরণার্থী এসেছিল, প্রায় নয়মাস থেকে যারা উক্ত দস্তরখানার খাবার খেয়ে আসছে তাদের মাঝে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। হযরত ওমর (রা.) এসে তাদের যার যার বাড়িতে ফিরে যাওয়ার তাকীদ দিলেন। একে একে সবাই আবার মদীনা ছেড়ে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে গেল। নিজ নিজ কাজে আত্মনিয়োগ করল।
***