হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল গোবিন্দের। অন্ধকারে তাকিয়ে কিছু ঠাওর করতে পারল না। পাশে হাত দিয়ে দেখল, কালো নেই।
ডাকল, কালো।
জবাব নেই। আবার ডাকল, কালো।
এবার জবাব এল, কী বলছ?
কোথায় যাচ্ছ এত রাতে?
কালো বলল, রাত কোথা। চারটে বাজল যে! যাই, নেয়ে টেয়ে আসি, আজ থেকে আবার কাজে যেতে হবে। বলে দরজাটা খুলে আবার সে বলল, তুমি ঘুমোও, উঠো না এখন, বুঝলে?
হুঁ। বলে গোবিন্দ চেয়েই রইল। হয়তো ঘুমিয়েই পড়ত, কিন্তু কালোকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে, অন্ধকারে অবাক হয়ে সে ঘুমের ভান করে পড়ে রইল।
কিন্তু কী একটা মনে পড়তেই সে আবার উঠে পড়ল। ডাকল, কালো।
চমকে উঠল কালো। বলল, ঘুমোওনি?
না, একটা কথা মনে পড়ে গেল। গোবিন্দ উঠে ঘরের এক কোণ থেকে কী নিয়ে কালোর সামনে বাড়িয়ে দিল।
কালো বলল, কী?
গোবিন্দ বলল, ভাত।
উভয়েই তাকাল উভয়ের মুখের দিকে। কিন্তু কেউ কারও মুখ দেখতে পেল না অন্ধকারে। নিচ্ছুপ, স্তব্ধ। শুধু পাশের বাড়িটার খোলা কল থেকে সমানে জল পড়ার একটা ছড়ছড় শব্দ শোনা যাচ্ছে। আর তার সঙ্গে তাল রেখে রাত্রির নৈঃশব্দে ঝিঝির ডাকের মতো শোনা যাচ্ছে বুড়োটে গলায় একটানা কথাহীন সুর।
কেন, কীসের ভাত, বলাটা দুজনের কাছেই এত অবান্তর মনে হল যে, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করতে পারল না। কেবল কালো ফিসফিস করে বলল, তুই কি শালা সত্যি ফোরটুয়েন্টি?
আমি ভগবান। বলে গোবিন্দ ধপাস করে আবার শুয়ে পড়ল।
নগেনের রাত্রের কথাগুলোই তার বার বার মনে পড়ছে। কেউ চেয়ে দুটো পায় না, কাউকে সেধেও খাওয়ানো যায় না। নগেনের কথার সেই স্থূল হুলের খোঁচা এখন তার বুকে বাজল যেন হাজার অপমানের ছুরি হয়ে। রাতভর ফুলকির ভাত নিজের এনতেজারিতে রেখে এখন কালোর হাত দিয়ে পাঠানোর কথাটা যেন দুই থাপ্পড়ে তার মুখটা অন্ধকারে ঠেলে দিল। নগেনের বিদ্রূপ তবে মিথ্যে নয়। কিন্তু কালোর মহব্বত!
অমনি কে যেন ধমকের সুরে আরও তীব্র বিদ্রূপ করে উঠল গোবিন্দের বুকের মধ্যে। ভাল রে তোর বিবাগী মন। কালোর পিরিতে উত্থলে ওঠে তোর যে সোহাগ, সে তো বাউণ্ডুলের ভাঙ মনের রঙ। কিন্তু এখানে সে রঙ-এর দাম কী। গোবিন্দের মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে উঠল তার সেই দশ বছর আগের মানুষটা। যে কথাটা নিজের কাছেও তার স্বীকার করতে মন চায় না, সেইটাই বার বার মনে আসে। দশ বছর আগে একদিন তাকে এখান থেকে পুলিশ বার করে দিয়েছিল, বার করে দিয়েছিল এই চব্বিশ পরগনা জেলা থেকে। জেলা খারিজ করে দিয়েছিল। একলা নয়, আরও দুজনের সঙ্গে।
সেদিন সে ছিল একটা আগুনের মতো মিস্তিরি ছোকরা। সব কিছু বোঝাবুঝির ধারটা কম ধারত, অল্প কথায় চটত। কারণ, কারখানায় সামান্য খোঁচা খেলেও সে ফোঁস করে ফণা তুলে ধরত। একটু কিছু হলেই, সোজা গোরাসাহেব ম্যানেজারের ঘরে ছুটে গিয়ে টেবিলের উপর ঘুষি মেরে কথা বলত। তখন সকলের কাছ থেকে সাড়া না পেলে সে একধার থেকে সবাইকে গালাগাল দিতে আরম্ভ করত, থুতু দিত, আর বলত, তোরা ভিতু, ভেড়ার দল। …যুক্তির প্রশ্ন তুলতে গেলে তো মারমুখীও হয়ে উঠেছে কোনও কোনও দিন। তবু এক একটা দিন গেছে, যখন তাকে সামনে রেখে খ্যাপা মানুষের দল বন্যার বেগে ছুটে গেছে ম্যানেজারের ঘরের দিকে। সবাই বলত তাকে, সেই টরন ঘরের ছোকরা মিস্তিরি।
কিন্তু তার বুদ্ধি ছিল না, ছিল হৃদয় আর সাহস। শিক্ষার চেয়ে বেশি আবেগ। তার সেই আবেগভরা বুকে সে নিজেকে বড় একলা মনে করত। কেননা, তার আশেপাশে শিক্ষা বা আবেগ কোনওটাই ছিল না। ভাল করে কান পাতলে হয়তো বুকের অনেক তলায় আবেগের রেশ সামান্য শোনা যেত। কিন্তু সে আবেগ ভীরু। সংশয় ও অবিশ্বাসের দোলায় দুলত। সে আবেগ টেনে নিয়ে যেত শুড়িখানায়, জুয়ার আড্ডায়, দেবালয়ে নয়তো বেশ্যালয়ে। কোনও কিছু বা কাউকে ক্ষতবিক্ষত করার হিংস্র বাসনায় সে আবেগ কেবলি নিজের সর্বনাশ করত। সেদিন কিছু লেখাপড়া জানা ভদ্রলোকও তার সঙ্গে কথা বলত। গোবিন্দকে তারা যেন কী একটা ঠাউরেছিল। তারা গোবিন্দকে মানত, যেন সে একজন মস্ত কেউ। তাকে নিয়ে শেষ ছিল না আলোচনার। কিন্তু শিক্ষিতদের প্রতি তার কেমন একটা সংশয় ছিল বরাবর। কেননা সে ভেবে উঠতে পারেনি, এদের বুদ্ধিমত্তা তাদের এ জীবনের কোন শুভপথের শরিক সত্যি হতে পারে। তার পর কারখানার কাজের মাঝে হঠাৎ বোমা পড়ার মতো একদিন সেপাই এসে হাজির হল জেলা খারিজের হুকুমপত্র নিয়ে। ম্যানেজার হৃষ্টচিত্তে অফিসে ডেকে তাকে পুলিশের হুকুমনামাটি দিয়ে বলল, ঘরের ডাক এসেছে, এবার সরে পড়ো।
বিস্ময়টা সকলেরই। তার ব্যাপারটাকে এতখানি বড় করে কেউ কোনওদিনই ভাবতে পারেনি। সেটা যেন আচমকা ভূমিকম্পের মতো একটা হঠাৎ নাড়া দিয়ে চলে গেল। কারও যেন ভাববার বা করবার কিছু অবসর ছিল না। গোবিন্দেরও না। চব্বিশঘণ্টার মধ্যে সে যখন ছেড়ে গিয়েছিল এ জায়গা, সেদিন একটি কথা সে কারও সঙ্গে বলেনি। অসহ্য অস্থিরতা ও অভিমান তাকে বোবা করে দিয়েছিল। কী করে জানি না, এখানকার সব কিছুকে সে বড় ভালবেসে ফেলেছিল। মনে হয়েছিল, যেন নির্বিবাদে তাকে সবাই নির্বাসনে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এমন কী তাদের সেই মূঢ় আবেগেও কোনও জোয়ার লাগল না। তারা অপরাধীর মতো কোনও পাপ করার মতো চুপ করে রইল।
নিস্তরঙ্গ ইছামতীর খেয়া পেরিয়ে যে মুহূর্তে সে গাঁয়ের পথ ধরল, সেই মুহূর্ত থেকে একেবারে ভোলবার চেষ্টা করল তার কয়েক বছরের কারখানার জীবন।
তার পরে তো একটা বিরাট পরিবর্তন। ঘর সংসার সব হারিয়ে পথকেই সম্বল করেছিল। এখন মনটা তার হয়ে গেছে অদ্ভুত শান্ত আর অমায়িক। জাত পেশার করাত বাটালি ছেড়ে বেহালার ছড়টা ধরেনি, এই যা। ভাল মন্দর প্রশ্নটা পর্যন্ত তার কাছ থেকে থেকে অবান্তর হয়ে যায়। দশবছর আগের সেই জীবনটা যেন মনে হয়, অন্য কোনও মানুষের গল্পকথা মাত্র। মনে হয় পাগলামি। এদের কাছে আত্মগোপন করে থাকাটাই তার আজকে মহানন্দ মনে হয়।
কিন্তু পথকে নিয়ে যেমন সে চিরকাল থাকতে পারল না, বুঝি নিজের মনের অজ্ঞাতসারেই চলে এল এখানে। যেমন আপনা আপনিই সে এখানকার সমস্ত কিছুর মধ্যে জড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে ঠিক তেমনি করেই তার বুকের মধ্যে জ্বালাটা আজ বড় বেড়ে উঠল।
মনের মধ্যে তার ধিক্কার দিয়ে উঠল, ফুলকির ভাত এমনি রেখে দেওয়ার জন্য। সত্যি, ফুলকির সে কতটুকু জানে। কালোর সে আদরের প্রেমযোগিনী কিন্তু নগেনের কাছে সে কুলটা। কালো যার ভাত নিয়ে পিছে পিছে ঘঘারে, তার তো তা সাজে না। সে তো কালো নয় আর তার অধিকারই বা কতটুকু! সকলে তা মানবে কেন? নিজের প্রতি ধিক্কার তার নগেনের খালি পেটের জ্বালার কথা ভেবে। তবুও নগেনের প্রতি মনটা তার বেঁকেই রইল। সে যে তাকে মেয়েমানুষের কথা বলে অপমান করেছে! আর কালোর কথা ভাবতে গিয়ে বুকটা তার টনটনিয়ে উঠল। তার বার বার ঘর ভাঙা জীবনে যে ফুলকির কাছে সে আবার মরতে চেয়েছে, না জানি সত্যি তাকে আবার মরতেই। হয়। এত সবের মধ্যে ভিড়ে পড়ার অশান্তিতে তার বিবাগী মনটা একদিনের মধ্যে তাই বারবার পালিয়ে যাবার কথা ভেবেছে।
এখনও আবার তার সেই ভাবনাটাই যেন ফিরে এল। পালাই পালাই করে উঠল মনটা।
আবার ভাবে, কোথায়, সে কোন্ ঠাঁই? পথ আর উপোস…উপোস আর পথ। যারা নেই, তাদের জন্য পথের কাছে লুকিয়ে কান্নার কি দাম আছে? সে তত বাউল নয়, জীবনের অভিশাপ তাকে ঘরছাড়া করেছে। তার ছেড়া আস্তিনের তলায় ভাঙা বুকের কোণে যে এখনও একটু রঙের দাগ লেগে আছে। কোথায় যাবে সে। জগৎ বড় মজার জায়গা। ছাড়ান পাবে না কেউ।
তার চোখের উপর হঠাৎ ভেসে উঠল দুলারীর সেই অপলক চাউনি। দুলারী। দুলারী নয়, ছুতোর বউ। মনে পড়ল গণেশের কথা। মরণের মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য সে অন্ধগর্ভের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। গণেশের মতো মানুষের জীবনেও এমনটা হয়।
সেদিনের পর সে আর গণেশের ঘরে যায়নি। যায়নি দুলারীর ওই চোখ দুটোর কথা ভেবেই। কিন্তু লক্ষ করেছে গণেশের চোখ জোড়া অষ্টপ্রহর তাকে অনুসরণ করছে। গোবিন্দের মনে হয়েছে হয়তো সে কিছু বলতে চায়। কিন্তু না, গণেশ কাছে এগোয় না। বাড়িওয়ালা গিয়ে তাকে শাসাচ্ছে, গালাগাল দিচ্ছে কাজে যাওয়ার জন্য। সবই যেন পাথরের উপর ঢিল ছোড়া।
সারা বস্তিও নির্বিকার। নির্বিকার হয়তো নয়, যে যার নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। গণেশ তাদের কাছে যেমন অসাধারণ, তেমনি অসাধারণ তার এই বউয়ের কাছে পড়ে থাকা। কিছু বলতে যাওয়াটা যেন তাদের নিজেদের কাছেই কেমন অশোভন মনে করে।
মনের সমস্ত তিক্ততাকে ফেলে সে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল।
উনুন জ্বলেছে, ধোঁয়া উঠতে আরম্ভ করেছে সারা বস্তিময়। সেই সুরহীন গলার গান আরম্ভ হয়েছে। ঘরে ঘরে কাজে যাবার তাড়া। গণেশের দরজাটা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। ভিতরে অন্ধকার। কিছু দেখা যায় না। সে ডাকল, গণেশ!
অন্ধকার কুঁড়ে গণেশ এসে দাঁড়াল তার সামনে। অদ্ভুত তার চোখের চাউনি, অপলক। যেন মৃত্যুদূতের প্রতীক্ষার অসহ্য স্তব্ধতা থেকে আচমকা উঠে এসেছে সে।
গোবিন্দ ভেবেছিল হয়তো গণেশ ঘুমিয়ে রয়েছে। কিন্তু তাকে এ ভাবে উঠে আসতে দেখে চমকে উঠল সে। ভাল করে তাকিয়ে দেখল, দুলারী ঘুমিয়ে আছে কিংবা পড়ে আছে চোখ বুজে। নিশ্বাসের ওঠা-নামায় শরীর নড়ছে তার। বলল, সব দিক তো মজিয়ে এনেছ আর কদ্দিন চালাবে? ঘরে না মরে, একটু খেটে মরো না। কাজে টাজে যাও।
গণেশ একবার মুখ তুলল যেন কিছু বলবে। কিন্তু আবার মুখ নামিয়ে চুপ করে গেল, ফিরে তাকাল দুলারীর দিকে।
গোবিন্দ আবার বলল একটা বাঁকা হেসে, বেড়ে মরণের কলটি বের করেছে। শালা মহব্বত না ফ্যাসাদ রে বাবা! পাওনাদার যে জেলে দেবে দু-দিন বাদে। তখন?
তবুও গণেশ চুপ করে রইল।
অস্বস্তিতে ভরে উঠল গোবিন্দের মন। কেমন একটা জেদের বশে হঠাৎ তীব্র গলায় সে বলে উঠল, জাহান্নামে যাবে। শালা তোর মহব্বত। বাঁচবার চেষ্টা নেই, দিন রাত্তির রোগীর কাছে পড়ে আছে। তাতে কি কেউ বাঁচে। মাইহুস জোয়ান। নিজের গলায় যে দড়ি দেয় তাকে কে বাঁচাবে? বাড়িওয়ালার বেড়ন না খেলে তোর হবে না।
মাইহুস্ জোয়ান। গণেশের ভাঙা গলায় কথাটা যেন ভেসে এল অনেক দূর থেকে। তার পর সে গিয়ে চুপচাপ বসে পড়ল বেড়ায় হেলান দিয়ে মাথা নিচু করে।
গোবিন্দ বেরিয়ে আসতে গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়ল। গণেশকে ওই রকম ভাবে সরে গিয়ে বসে থাকতে দেখে বুকটার মধ্যে তার মোচড় দিয়ে উঠল। যেন কোনও নিষ্ঠুর জাদুকরের মন্ত্ৰ-আচ্ছন্ন একটি জীব গণেশ। সে কাছে এসে আবার গণেশের পাশে বসে তার মুখটা তুলে ধরল। ডাকল, গণেশ।
গণেশ তার দিকে তাকাল। শক্ত পুরুষের রুক্ষ চোখে তার জল নেই, কিন্তু যেন কান্না ভরা। গোবিন্দের মনে হল, কালোর চেয়েও গণেশের বেদনা সীমাহীন। যেন সব মিলিয়ে মানুষটি শিশু হয়ে গেছে। সে বলল গণেশকে অনেকদিনের পুরনো বন্ধুর মতো, কারও পরে ভরসা নেই তোর কেন? তুই না উঠলে যে শালা বউটা কেটে পড়বে। আমি বলছি, ও বাঁচবে…মাইরি। তুই তোর কাজ করগে। সব ভার ছেড়ে দে আমার পরে।
গণেশ মুখ নামিয়ে বলল অত্যন্ত নিচু আর মোটা গলায়, আমি না থাকলে ও মরে যাবে।
গোবিন্দ বলল, তোর কথায়..তোরই একটা বউ আছে, আর যেন কারও নেই, ছিলও না। লোকে তো চেষ্টা চরিত্তিরও করে…বলি তোরা দুটোতে মলে এ সমসারেকার কী আসবে যাবে?
গণেশ মাথা নাড়ল। অর্থাৎ কারও কিছু আসবে যাবে না। তার পর দুলারীর দিকে একবার দেখে বলল, তুমি কেন বইবে এ ভার?
প্রশ্নটা শুনে থমকে গেল গোবিন্দ। জবাবটা দিতে গিয়ে মুহূর্তের জন্য ভারী অসহায় বোধ করল সে। বলল, কেন বইব? আমার এমন হলে তুমি দেখতে না?
গণেশ আঁতিপাঁতি করে কী খোঁজে গোবিন্দের মুখে।
গোবিন্দ এবার হেসে ফেলল। বলল, তোমাকে দেখেছি আর সেরেফ মজেছি? বলে গণেশের হাত ধরে কাছে টানল। আবার বলল, এখানে যে যার নিজেকে নিয়ে মশগুল, মন চাইলেও কেউ কাউকে দেখতে পারে না। আমি দেখব, তুমি কাজে যাও।
তারপর হঠাৎ গণেশের কাছে মুখ নিয়ে বলল, বউ না হয় তোরই, সোয়ামী না হই, তোর মতো সোহাগ তা বলে খুব করতে পারব।
বলে সে হা হা করে হেসে উঠল। যেন খানিকটা জোর করে টানা হাসি।
গণেশ খানিকটা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল গোবিন্দের দিকে। খানিকক্ষণ। তার পর হঠাৎ বলল, তোমার মতো মানুষ আর দেখিনি।
গোবিন্দ বলল, আমার মতো দেখেছ কিন্তু তোমার মতো মানুষ আমি দেখিনি।
দুজনে তারা চুপ করে তাকিয়ে রইল পরস্পরের দিকে। গণেশের জ্বালাভরা চোখ দুটো যেন গোধূলির তারার মতো করুণ হয়ে উঠল।
ফরসা হয়ে আসছে দিন। মেঘমুক্ত আকাশ। বাইরে ছোট ছেলেপিলেগুলোর সেই দৈনন্দিন প্রকৃতির পীড়ন শুরু হয়েছে। গলা শোনা যাচ্ছে বাড়িওয়ালার।
ঘরের অন্ধকার কেটে গিয়ে দুলারীর মূর্তি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে খাটিয়ার উপর। তার বড় বড় চোখের অপলক দৃষ্টি এদের দুজনের দিকে।
সেই দিকে আর একবার দেখে গণেশ আবার কথা বলল। সে যেন গণেশ নয়, আর কারও গলা ভেসে আসছে ধীর আবহ সংগীতের মতো, দোস্ত, তোমার কোনও ঠিকানা জানি না, জাপহচন্ নেই তবু আমার তলিফ নিতে এসেছে তুমি।…তামাম বস্তি বলছে আমি বেয়াকুব। বলে, গরিব কুলি কাবাড়ির আবার মহব্বত! ওসব লাখপতির ঘরে সাজে। রানীর ব্যামো হলে রাজা বসে থাকতে পারে না, তার আবার…
চুপ হয়ে যায় গণেশ। তারপর হঠাৎ চাপা উত্তেজিত গলায় বলে ওঠে, ঝুটা বাত। লাখপতির জান রূপেয়া, রাজার মহব্বত সিংহাসনে, রানী তো পুতলা। এক যাবে হাজারটা কিনবে। আমি রাজা নই, একটা ফালতু আদমি। আমার তো জানের পরোয়া নেই, পরোয়া মহব্বতের। একটা আমার লাখ লাখ, গেলে যে ফকির বনে যাব!
এমনিতেই গোবিন্দর মনটা নরম। গণেশের এ কথাগুলো শুনতে শুনতে তার বুকের কোনখানটায় যেন গোপন কান্নার হাহাকার উঠল। সে বলে উঠল, তুই যে শালা আর এক রাজা, মহারাজার ব্যাটা!
গণেশ আবার কথা বলে উঠল। তার বুকটার এতদিনের গুমোেট ঘরে যেন হঠাৎ হাওয়া লেগেছে। গোঁফদাড়ি ভরা মুখটা উত্তেজনায় কুঁচকে অদ্ভুত হয়ে উঠল। বলল, দোস্ত, ফাগু তাঁতির সুতো ভাল ছিল না, চট খারাপ দেখে সাহেব ওকে খিস্তি করে লাগালে দুই ঝাপ্পড়। ফাগু শালা চুপ। আমার জান জ্বলে গেল। মিশিন ছেড়ে ছুটে গেলাম, শালা তেরি…
বলতে বলতে তার সারা শরীর ও মুখভাবে মনে হল যেন সাহেবের গলা টিপে ধরেছে।
সবাই রুখে দিল। পালিয়ে গেল কমিনা সাহেব।…এখানে শোধ নিতে পারি। কিন্তু এই দুলারী…ও ভিজাতের ছোটঘরের মেয়ে। গাঁয়ে যখন ওকে আমার ঘরে এনে তুললাম, তখন আমাদের ঘরের মানুষেরা আর ওদের জাতের ললাকেরা আমাকে এমন পিটলে যে, জান খতম মনে করে ফেলে দিয়েছিল নদীয়া কিনারে। তখন এই দুলারী আমাকে নিয়ে বনে জঙ্গলে লুকিয়ে ফিরেছে, সারা গায়ের খুন গাইবাছুরের মতো চেটে চেটে তুলেছে, হাড়-গোড় ভাঙা টুকে কোলে করে রেখেছে। আর ও আজ মরতে বসেছে, এখানে আমি কার উপরে শোধ তুলব। কার উপর? তাই ভেবেছিলাম আমিও মরব…মরব ওর সঙ্গে।
গণেশের কথা শুনে আপনা থেকেই গোবিন্দের মুখ থেকে যেন বেরিয়ে এল, সাহেব দুশমন, ব্যামো কি তোমার মিতা? ব্যামো, দুটোই, তবে রকমফের। শোধ যদি তুলতে হয় তো দুটোর উপরেই তুলতে হবে।
গণেশের কোটরাগত চোখে তীব্র অনুসন্ধিৎসা, যেন অন্ধকারে কিছু হতে ঠেকেছে, বললে, কিন্তু এ যে সারতে চায় না।
সারবে কেন, বিগড়ে আছে যে! গোবিন্দ যেন কথার খেই পেয়ে খুশি হয়ে ওঠে। তাঁতি, তুমি, বি না চললে কী করো?
জাম ছাড়াই।
তবে জাম ছাড়াও, ও শালার চিজ গাঁটে গাঁটে দলা পাকিয়ে আছে, ওকে চেঁছে ফেলো। শরীলের জাম ব্যামো, ওটাকে ছাড়াতে হবে। এর নাম ইলাজ।
তার পর হঠাৎ গলাটা যেন অকারণে ধরে এল গোবিন্দের। আচমকা যেন টিপুনি লেগেছে অন্তরে। বলল ঢোক গিলে, আমাদের ক্ষ্যামতা কম, তবু হাল ছাড়ব না। হাল ছেড়ে তো অনেক ঠকেছি, আর নয়।
একটা কলাপাতার বাঁশির মতো সরু শব্দে উভয়ে তারা দুলারীর দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল।
দুলারীর কঙ্কাল মুখের সে এক বিচিত্র ভাব। তার নির্নিমেষ চোখের তারা কেবল গোবিন্দ-গণেশের দিকে ঘুরপাক খাচ্ছে। দ্রুত নিশ্বাসে কেঁপে কেঁপে উঠছে নাকছাবি। ঠোঁট নড়ছে, আর অবিশ্বাস্য হলেও একটা অস্পষ্ট হাসির রেখা ঠোঁটের পাশে ফুটে তার সারা মুখটাকে যেন বদলে দিয়েছে।
গণেশ অমনি ঝুঁকে পড়ল দুলারীর মুখের উপর। কান এগিয়ে দিয়ে বলল, কী বলছ, বলো।
স্বরটুকু প্রায় হারিয়ে গেছে দুলারীর। ফিসফিস করে কথা বলল সে যেন, পরপুরুষের সামনে সোয়ামীর সঙ্গে কথা বলছে নওবহুড়ি।
গোবিন্দ শুনতে পেল না সে কথা কিন্তু এই প্রথম দেখল গণেশের সারা মুখে ছড়িয়ে পড়েছে হাসি। কিম্ভুতাকৃতি মেঘের কোলে বিদ্যুতের মতো সে হাসির গভীর রেখা তার গোঁফের পাশে ও চোখের কোলে।
হাসিটা আপনা থেকেই ছড়িয়ে পড়ল গোবিন্দের মুখে। বলল, কী বলছে?
গণেশ বলল, বলছে, তোমার কথা ঠিক। ওদের ঘড়িকলটা অমনি বিগড়ে যেত মাঝে মাঝে।
এ বুঝি কাজ করত কলে?
তবে? সন্তান নোকরি ওর..আর বলছে, আমাকে কারখানায় যেতে হবে।
হাঁ?
হাঁ!
দুজনেই তারা হেসে উঠল। সে হাসি শুনে যেন আবার লজ্জা পেল দুলারী, মরা চোখ তার হাসি ও লজ্জায় মধুর হয়ে উঠেছে। তাড়াতাড়ি চোখ বুজে গেল তার। মুহূর্ত পরে সে চোখের কোল ছাপিয়ে ঝরঝর করে ঝরে পড়ল কয়েক ফোঁটা জল। অনেক দিন পর তার রোগগন্ধপূর্ণ অন্ধকার ঘরটাতে সাড়া পড়েছে হাসির। অনেক দুর্দৈবের মধ্যেও সে শুনতে পেয়েছে গণেশের হাসি, যে হাসিটুকু তার প্রাণের চেয়েও দামি। আর গোবিন্দের মুখোনি যেন এঁটে বসে গেছে তার মনের মধ্যে। ইচ্ছে করল, গণেশের মতো সেও ওকে এখুনি একবার ডেকে উঠবে, দোস্ত?…ভাবতে শরমও লাগে। ও যেন তার ফাটা সানাইয়ে ওস্তাদ বাজনদারের মতো সুরের ঢেউ তুলে দিয়েছে।
গোবিন্দের হাত ধরে গণেশ বলল, দোস্ত, আমি তবে দৌড়ই হাজিরা দিতে?
গোবিন্দ বলল, দিক ঠুকে বেরিয়ে পড়ো, সব ভার আমার। তুমি শুধু ওকে বাইরে চালার ছায়ায় শুইয়ে দিয়ে যাও।
হঠাৎ একটা খিলখিল হাসির শব্দে গোবিন্দ ফিরে দেখল, বাইরে বাড়িওয়ালা একটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে চোখ ঘোঁচ করে আর কাঁসর ফাটানো হাসিতে দুলে দুলে উঠছে ফুলকি তার পাশে।
বাইরে আসতে দেখা গেল অনেকেই নিজেদের মধ্যে নানান কথা জুড়ে দিয়েছে। কাজে বেরুবার পূর্ব মুহূর্তে মানুষগুলো যেন উপভোগ করছে একটু মজা।
ফুলকি ভ্রূ তুলে কটাক্ষ করে বলে উঠল, শুধু ফোরটুয়েন্টি লও তুমি আরও তুক ফুক জানা আছে দেখছি তোমার।
গোবিন্দ বলল, তুমি তো ফুঁক তুকের বাইরে, তোমার তবে ভাবনা কী?
বাইরে কী গো! বস্তির মধ্যে এমন সব্বনেশে মানুষ থাকলে কি আর রক্ষে আছে? বলে সে আবার হেসে উঠল।
সে হাসিকে স্তব্ধ করে দিয়ে নগেন অট্টহাসি হেসে উঠল প্রায় নাটকীয়ভাবে।
গোবিন্দ ভাবল নগেনের এ হাসির খোঁচা তারই প্রতি। এদিকে ফুলকির মুখের হাসিটুকু যেন দুরন্ত ঝড়ের বেগে ঝরে গেল শুকনো পাতার মতো।
বাড়িওয়ালা জিজ্ঞেস করল গোবিন্দকে, সাধুগিরি করতে নাকি আগে?
করতাম না, এখন থেকে করব। জবাব দিল গোবিন্দ।
লোমশ পেটটাকে ঘোঁচ করে, চোখ দুটোকে আরও খানিকটা ভূর তলায় ঢুকিয়ে বলল বাড়িওয়ালা, হুঁ। কথার রাজা আমার!…
এসো তোমার সঙ্গে আমার দুটো কথা আছে! চলো।
তারা দুজন চলে যেতেই, ফুলকি সকলের দিকে একবার দেখে তাড়াতাড়ি সরে পড়ল সেখান থেকে।
তার চলে যাওয়ার ভঙ্গি দেখে কয়েকজন আবার হেসে উঠল।
কার গলায় শোনা গেল, কিন্তু যা-ই বলল ওই ফোরটুয়েন্টিওয়ালার কোনও মতলব আছে। কেননা, ও শালা বড় ভালমানুষি দেখায়।
হাঁ, ভালমানুষ মানেই ছেলে খাবার যম। কে আর একজন বলে উঠল।
লিকলিকে লম্বা মানুষ একটা প্রায় ঘুষি বাগিয়ে উঠোনের মাঝখানে এসে সরু গলায় পেঁচিয়ে উঠল, শালা বেশি ওস্তাদি করলে হাঁকব একদিন কোঁতকা…
যাতে দুনিয়ার ভালমানুষগুলো সব শালা খতম হয়ে যায়। নগেন বলে উঠল তার স্বাভাবিক গলায়।
কথাটা তার এমন দ্ব্যর্থব্যঞ্জক যে কোঁতকা হাঁনেওয়ালা ডেলাকটা আর একবার আস্ফালন করে উঠতে গিয়ে হঠাৎ থমকে মাড়িয়ে ফেলল এক গাদা ময়লা।
অমনি সবাই হো হো করে হেসে উঠল। মাদারি খেলোয়াড় তার ড়ুগড়ুগিটা বাজিয়ে দিয়ে বলল, দ্যাটাজ কোন্ মাদারিকা-খেল।
এমনি ইংরেজি সে মাঝে মাঝে বলে থাকে।
কিন্তু ময়লা মাড়িয়ে ফেলা লোকটা তার সরু গলায় ফাটা বাঁশির মতো চিৎকার করে উঠল, কোন দীগধরের বাচ্চা এখানে এ কাজ করেছে, আমি জানতে চাই। যেন সে-ই এ বস্তির মালিক। কিন্তু তার ফল ফলল সাংঘাতিক। বাচ্চাদের মায়েরা ছিল, তারা সব একসঙ্গে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর, সে গিন্ধরের বাচ্চা তোর বাপ, তোর চোদ্দোপুরুষ রে গোছো ভূতের বাচ্চা!
লিকলিকে লম্বা লোকটা প্রায় আঁতকে উঠে, ময়লা মাড়ানো ঠ্যাংটা তুলে, এক পায়েই ছুট দিল পোঁ পোঁ করে, যেন বাচ্চাদের এক্কা-দোক্কা খেলার দৌড়।
হাসিতে চিৎকার ড়ুগড়ুগির শব্দে সে এক অদ্ভুত ব্যাপার সারা বস্তিময়। কেবল নগেন, যে কালকে রাতেও গোবিন্দকে কটুক্তি করেছে, সে আপন মনে বিড় বিড় করে উঠল, লোকটা শাল সত্যি ফোরটুয়েন্টি করে দিচ্ছে।
বাড়িওয়ালা গাঁজায় দুটো লম্বা টান দিয়ে, কলকেটা বাড়িয়ে দিল গোবিন্দের হাতে। তারপর কয়েক মুহূর্ত ভোম্ হয়ে থেকে গম্ভীর গলায় বলল, দেখ ফোরটুয়েন্টি, একটা ভারী ফ্যাসাদে পড়ে গেছি। মনে হয়, তোমার খানিক বুদ্ধিশুদ্ধি আছে, একটা মতলব দিতে পার?
গোবিন্দ প্রমাদ গণল। লোকটা এখুনি বোধ হয় পাকা বাড়ি তোলার পরামর্শ চাইবে। বলল, এখন যে আমার উনুনে আগুন দিতে হবে?
সেটা একটু বাদে দিয়ো। বলে বাড়িওয়ালা একবার ভাল করে দেখে নিল গোবিন্দের মুখটা। বলল, দেখো, আমার জমিটা আগের আইনের গুণে ঠিকা থেকে মৌস হয়ে গেছল, তখন ছিল অন্য জমিদার। এর পরে যে জমিদারটা এল সে শালা আসলে ছিচকে বেনে। গুড় বেচে বড়লোক হয়েছে। সে ব্যাটা নতুন আইনের প্যাঁচে ফের ঠিকে বানিয়ে দশ বছরের মেয়াদী করে দিয়েছে। এখন কী করা যায়?
গোবিন্দ ব্যাপারটা আগেই শুনেছিল। কিন্তু এতখানি জানত না। জিজ্ঞেস করল, এ নয়া জমিদার কি তোমার খাজনা বাড়িয়েছিল?
হাঁ।
তুমি বাড়তি খাজনা দিয়েছিলে?
হাঁ।
হাঁ? গোবিন্দ অবাক হয়ে গেল। কেন দিলে?
বাড়িওয়ালা বোকার মতো বলল, চাইলে যে!
হতাশায় মাথা নেড়ে বলল গোবিন্দ, তবে তো ল্যাঠা চুকেই গেছে। এবার পাতাড়ি গুটোও। বাড়তি খাজনা যখনি দিলে, তখনি তো তুমি ফের ঠিকে মেয়াদ মেনে নিলে, তা জানো না?
বাড়িওয়ালা হাঁ করে তাকিয়ে রইল। গোবিন্দ বিদ্রূপে হেসে বলল, শালা এমন মানুষও জগতে আছে। উলটে এট্টা নালিশও তো করতে পারতে?
তাতে কী হত?
কী না হত? আগের দলিল দেখিয়েই তো তুমি মৌরুসীপাট্টা পেতে। হাজার কেননা জমিদার বদল হোক, ওদের আইনেই পেরজার ভোগ দখল কেউ নষ্ট করতে পারে না!
কিন্তু ওদের আইনেই তো এটা হল।
সে তো তুমি বোকা পেরজা বলে। এখনকার যে রাজা, পেজা তার থেকে এক কাঠি সরেস না হয়েছে তো মরেছে। এও জানো না?
কিন্তু—
কিন্তু টিন্তু ছাড়ো। তোমার মেয়াদ আর কতদিন?
বছরখানেক মাত্র।
হতাশা ভরে মাথা বেঁকে বলল, গোবিন্দ, ও! খালি ছিলিমে দম্ দিচ্ছিলে অ্যাদ্দিন? শিগগির তোমার দলিল পত্তর নিয়ে একটা ভাল উকিল ধরো।
তা হলে আমি কী করব?
বাড়িওয়ালার এ দারুণ অসহায় গলার স্বরে অবাক হয়ে গেল গোবিন্দ। লোকটাকে দেখে মনে হল তার, এ সেই বাড়িওয়ালাই নয়। কোথায় সেই ভ্রুকুটি পাথুরে কাঠিন্য আর বিদ্রূপ ভরা ভারিক্কি চাল।
এ যেন আর কেউ, চালচুলোহীন একটা অত্যন্ত সাধারণ ভালমানুষ বলতে যা বোঝায়। দুটো শান্ত চোখে উদ্বেগ, মোটা ভ্রূ দুশ্চিন্তার রেখা।
গোঁফ জোড়া যেন ধ্বসে পড়েছে।
এরা তো আসলে আমার, মানে…পেরজাই, কি বললা? আর, সত্যি, আমি এদের রামের মতোই পালন করতে চাই। মানে ঠিক বাপের মতো।
অন্য সময় হলে গোবিন্দ হয়তো হাসি ফেটে পড়ত। কিন্তু বাড়িওয়ালার স্বপ্নাচ্ছন্ন মুখটার দিকে তাকিয়ে সহসা তার মুখে কোনও কথাই জোগাল না।
ভক্তিতে ভাগবত পাঠের মতো অপূর্ব গম্ভীর আর ব্যথিত সুরে ভরে উঠল তার গলা, ফোরটুয়েন্টি, ভাল মানুষ আমার কাছে যে আসবে, তাকে আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে রক্ষা করব, সমস্ত তকলিফ নেব। এখানে যে একবার এসেছে, সে আর কখনও আমাকে ছেড়ে যেতে পারিনি। কেন? না আমি ওদের রাজার মতো পালন করি। দেখো, ওই গণেশকে এ এলাকার কোনও বাড়িওয়ালা ঘর দেয় না। পুলিশের বড়বাবু আমাকে কতদিন শাসিয়েছে গণেশকে তাড়িয়ে দেবার জন্যে, আমি ও-সব গোড়াই কেয়ার করি। গণেশকে আমি বুঝেছি, ও যা-ই হোক, একটা খাঁটি ছো। বস্তি হোক আর ভাগাড় হোক, এটা আমার রাজ্য, এখানে আমার যাকে খুশি রাখব। কী বলে?
গোবিন্দ বলল, কিন্তু, এরা তত তোমাকে ভাড়া না দিয়ে ঠকায়?
উত্তেজনায় স্ফীত য়ে উঠল বাড়িওয়ালার মুখ, তুমি একটা সত্যি ভবঘুরে উজবুক। ওদের একটা নেড়ি বিল্লিও ঠকিয়ে মুখের রুটি খেয়ে ফেলে। ওরা ঠাকাবে আমাকে? তা যদি জানত ওরা, তা হলে বিষে বিষ মরত। এক ভাঁড় তাড়ি খেয়ে ওরা পেটটাকে চোখ ঠারে। বলতে বলতে তার গলাটা সরু হয়ে এল, চোখের দৃষ্টি হারিয়ে গেল অসীম শূন্যে। দু-হাতে মুঠো করে টেনে ধরল বুকের বড় বড় চুলের গোছা। ফোরটুয়েন্টি, তোরা সবাই অষ্টপ্রহর দুঃখের কথা প্যাঁচাল পাড়ি নিজের কথা বলতে আমার মন চায় না। তবু বলি, মানুষের পেটে জন্মে আমি ছিলাম যেন কখনও ধোবীর গাধা কখনও ছ্যাকরা গাড়িতে ঘোড়ার মতো। না মা, না বাপ। কিন্তু পুরনো কথা বলে কী লাভ! নিজের কথা ভেবেই ওদের উপর আমি জুলুম করিনে ভাড়ার জন্যে। এটা ওদেরই রাজ্যি, ওটা এটাকে নিয়ে যা খুশি তাই করতে পারে। তবে আমি কেন? না, নিমিত্ত। খাঁটি রাজার এ-ই চাল। তা বলে বেতমিজি করলে কি আর শাসন করব না? দরকার হলে ঠ্যাঙাব, ঠিক বাপের মতো। কিন্তু বস্তির মালিকদের মতো জানে মারব না। ওদের ট্যাঁকের পয়সা চুরি করব না, যে পয়সা ওদের জান।
বলে সে খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, শুনি, এ সন্সারের তিন ভাগই জলে ডোবা। সে জল আমাদের দুখ তলিফের দরিয়া, আর ডাঙাটুকু যেন সুখের কলিজা। কিন্তু, আজ কোথায় এসে ঠেকেছি… নিজেই জানি না। বলে সে তার লাল চোখ দুটো হাত চাপা দিয়ে বসে রইল।
নিবার্ক গোবিন্দ কলকে হাতে হাঁ করে তাকিয়ে রইল লোকটার দিকে। মনে হল, ডাঙা নয়, সর্বনেশে চোরাবালির কিনারে এসে ঠেকেছে লোকটা। বাড়িওয়ালা তার নিজের কথা কিছুই বলল না, কেন না ওর জীবনের দুঃখ দরিয়ার ঢেউ বুঝি কোনও মানুষ সইতে পারবে না। কিন্তু গোবিন্দের বুদ্ধির সীমা থাকলেও এটা সে বুঝেছে, ভাবনায়, চিন্তায়, জীবনের ব্যয়ে জমায় মানুষটা সব ছাড়া সব হারা একটা মস্ত মহৎ, কিন্তু একেবারে যেন ব্যর্থ। এ সংসারের আইনে ওর সবটাই পাগলামি! সদীবুড়ির কাছে ওর জীবনের অনেকখানি সে শুনেছে। জমিদরের উৎপীড়ন, সাধুদের কুৎসিত নির্যাতন। আসলে এ পাগলামিটা ওর বুকের লুকোনো মস্ত ঘা-টার উপর হয়তো নিয়ত মলমের প্রলেপের মত; কিংবা বলতে হয়, দারুণ বিদ্বেষে, সব কিছুর সঙ্গে নিজের জীবনটাকেই লোকটা বাজি রেখে বসে আছে। এত বড় শরীরটা নিয়ে লোকটা বসে আছে, সেটা কিছুই নয়। শুধু একটা পাহাড় যেন। পাথরের ভিতরে কী কথা আছে, কে জানে সে কথা!
বাড়িওয়ালা আবার তেমনি অসহায়ের মতো কথা বলে উঠল, কিন্তু যাদের জন্যে এ-সব ভাবি, তারা সব একটি মহা ছ্যাঁচড়া, বেতমিজ। ওদের মগজে কিছু নেই। ফোরটুয়েন্টি, তোমার কথামতো আমি একটা আখেরি চাননাস্ নেব, তুমি আমার সঙ্গে থাকবে। দেখি শালা একবার দেওতার মারটা।
হাসতে হাসতে কান্নার মতো একটা দোভারা যন্ত্রণায় ভরে উঠেছে গোবিন্দের বুকটা। সে কী বলবে, ভেবে পেল না। লোকটা তার নিজের কাছে এত খাঁটি যে, ওকে কিছুই বলা যায় না।
শহরের অভ্যন্তরে, বস্তি-মালিকদের মহলে সে একটা বিচিত্র মানুষ। সমস্ত শহরটাই একটা বস্তি শহর। এখানে যারা কর্তা ব্যক্তি, তারা সকলেই বস্তির মালিক। অর্থাৎ বাড়িয়ালা। একজন বাড়িওয়ালা মানে, সে দোকানদার সুদখোর আর কারখানা মালিকদের বন্ধু, সংবাদদাতা। কারখানার মালিক অসুবিধা বুঝলে, বাড়িওয়ালাদের শরণাপন্ন হয়। একমাত্র বাড়িওয়ালারাই নাকি এখানকার অবুঝ কুলিকামিন মজুরওয়ালিকে বোঝাতে শায়েস্তা করতে পারে।
সেদিক থেকে এ বাড়িওয়ালা শুধু ভিন্নরকম নয়। একেবারে উলটো মানুষ। এখানকার বাড়িওয়ালারা অবাক হয়, যখন শোনে, সে ভাড়া পর্যন্ত মকুব করে দেয় বাসিন্দাদের। তা ছাড়া কম বেশি সকলেই তার এ বিচিত্র রামরাজত্বের আদর্শের কথা শুনেছে। সেজন্য বাড়িওয়ালা মহলে তাকে নিয়ে সব অদ্ভুত আলোচনা হয়। কেউ বলে, পাগল, কেউ সাধু, কিংবা কোনও ডাকাতদলের সদার। বহু বিশেষণ তার আছে। আর সব বাড়িওয়ালাদেরই তার উপর একটা জাতক্রোধ আছে। তাদের যে-সব বাসিন্দাদের তারা ভাড়া না পেয়ে বেইজ্জত করে, তাড়িয়ে দেয় তারা সবাই এসে জোটে এ বস্তিতে। সবাই মিলে মতলব ভাঁজে, কী করে ওকে জব্দ করা যায়, বিপদে ফেলা যায়। ওত পেতে আছে সকলেই। তা ছাড়া লোকটি যত না বিচিত্র, সকলে গল্প করে করে তাকে রহস্যময় করে তুলেছে আরও বেশি। সেজন্য অনেকে তাকে ভয়ও করে। তার গোঁয়ার্তুমির খ্যাতি বেশ আছে বাইরে।
তাকে ঘাঁটাতে সাহস করে একমাত্র বিরিজামোহন। এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বস্তি-লাইন ওর, ডাকসাইটে বাড়িওয়ালা। সমস্ত বাড়িওয়ালাদের সর্দার বলা যায় তাকে। সবাই তাকে খাতির করে, সেরা আসনে বসতে দেয়। দিয়ে, তার পাশে বসে লোককে দেখিয়ে হাঁটু নেড়ে নেড়ে তৃপ্তি পায়। অর্থাৎ বিরিজামোহনের মতো সেও একজন বাড়িওয়ালা। বিরিজামোহন তার বন্ধু। বিরিজামোহন থানার বড়বাবুর বন্ধু, এখানকার বাঙালি জমিদারের বন্ধু। সাহেবদের ক্লাবের নাচঘরে যায়, গিয়ে উল্লুকের মতো নাকি বসে থাকে। মাতাল সাহেবরা তাকে পিঠ চাপড়ায়। সে মোটা চাঁদা দেয়, মেঘনাদদেবের গয়নাও গড়িয়ে দেয়। চারটে সোনার সোকান আছে তার। সমস্ত অঞ্চল জুড়ে তার পান বিড়ি থেকে সব রকমের ব্যবসা আছে। যেখানে বিরিজামোহন, সেখানেই সেলাম। কোনও বাড়িওয়ালা ভাড়াটে নিয়ে একটু মুশকিলে পড়লে পরামর্শদাতা সে-ই। তার নাকি একটা গুপ্ত দল আছে। খুনে দল তার নাম। তার বস্তির বাসিন্দারের ধন-মান ইজ্জতের সেই মালিক। ভাড়া আদায় না হলে হাজতবাস, ঠ্যাঙানি। একটু সেয়ানা ভাড়াটে হলে তার হাড়মাস কালি। শোনা গেছে, দু একজনকে নিজের হাতে খুন করেছে সে। নেশা ভাং-এ সিদ্ধ হস্ত।
নয়াসড়কের এ বস্তি-জমির যে বাঙালি জমিদার, তার সঙ্গে খুব খাতির। এ জমিটা নিজে কেনবার জন্য ফন্দি আঁটছে সে দিবানিশি। প্রয়োজন হয়তো ছিল না ততখানি, কিন্তু এখানে একমাত্র নয়াসড়কের বস্তির বাড়িওয়ালা আর তার বাসিন্দারা তাকে সেলাম করে না। তা ছাড়া জায়গাটাও খুব ভাল।
কিন্তু এদিকে বিরিজামোহন খুব ভদ্রলোক। লোকের সঙ্গে সামনা-সামনি ঝগড়া করতে কেউ দেখেনি তাকে। সামনে সে অমায়িক ও শান্ত। কাজ করে তলে তলে। সে আসে প্রায়ই নয়াসড়কের বস্তিতে, হালচালটা জেনে নিতে। বাড়িওয়ালার নাম করে সে বলে, ওকে মাঝে মাঝে খুঁচিয়ে না এলে আমার সুখ হয় না। কথাটা সে মিছে বলে না। কেননা এ বাড়িওয়ালার চরিত্রের কতগুলি দিক সে ভাল জানে। লোকটা কীসে বিরক্ত হয়, যন্ত্রণা পায়।
সেদিনও এল বিরিজামোহন। বাড়িওয়ালা গল্প করছিল গোবিন্দর সঙ্গে বসে। বিরিজামোহনকে দেখেই সটান হয়ে বসল সে। ফিসফিস্ করে বলল, ফোরটুয়েন্টি চট করে সরে বোস্। বিরিজামোহন শালা আসছে। ওর সামনে তুই আমাকে হুজুর বলে ডাকবি। মানে, ওর সামনে ডাঁট দেখাতে হবে কিনা! নইলে মুখের উপর টিটকারি দেবে খচ্চরটা।
আচমকা বিস্ময়ের ঝোঁকটা কাটিয়ে ওঠবার আগেই গোবিন্দ দেখল বিরিজামোহন আসছে এদিকেই। রোগা, বেঁটে ফরসা লোকটা কাছে আসতে দেখা গেল জরি-পাড় কাঁচির ধুতি পরেছে ফুলকোঁচা দিয়ে, হাঁটু অবধি ঝুলে পড়েছে ফিনফিনে আদ্দির কলিদার পাঞ্জাবি, মাথায় দেশি টুপি, পায়ে বুটিদার নাগরা। লোকটার মুখের চামড়া যেন অকালেই ঝুলে পড়েছে। কুকুতে দুটো চোখের তীক্ষ্ণ শিকারির দৃষ্টিতে যেন সে আগে পাছে কেবলই শিকার খুঁজছে। ঠোঁটের কোণে ও ওই চোখে তার একটা ছলনার নোংরা হাসি জ্বলজ্বল করছে। লোকটাকে গোবিন্দ আরও একদিন দেখেছে। সেদিন লোকটার একটা কথারও জবাব দেয়নি বাড়িওয়ালা। খানিকক্ষণ বকে বকে আপনিই চলে গিয়েছিল। ওর উপস্থিতির কারণই হল, বাড়িওয়ালাকে খানিকটা অপদস্থ করা।
বিরিজামোহন বাড়িওয়ালাকে বলল, জয় রামজি বাবুসাহেব, খবর সব ভাল?
বাড়িওয়ালা ইতিমধ্যেই তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একটা মুখ গাম্ভীর্যের মুখোশে ঢেকে ফেলেছে নিজেকে। পা দুটো মাটি থেকে তুলে, পা ছড়িয়ে খাটিয়ায় বসে সে আগে বলল গোবিন্দকে, এক ছিলিম বানাও। গোবিন্দ বলল, জি হুজুর।
তার পর লোকটার দিকে ফিরে বলল, জয় রামজি। আসুন, তছরি রাখুন। কিন্তু তছরি রাখবার আর খাটিয়া ছিল না। বসতে হলে মাটিতে বসতে হয়। লোকটা দাঁড়িয়ে থেকেই বাঁধানো দাঁত দেখিয়ে বলল, আপনি বসলেই আমার বসা বাবুসাহেব, তাতে আর কী হয়েছে। বলে লোকটা এক চোখ বুজে একটা ইঙ্গিত করল এদিকে চেয়ে থাকা গোবিন্দকে। তারপর পকেট থেকে একটা রাংতার মোড়ক খুলে বাড়িয়ে ধরল বাটা সিদ্ধির সুগন্ধি গুলি। আসুন বাবুসাহেব। মহাদেবের পেসাদ।
বাড়িওয়ালা বলল, ও-সব চলে না। আমি মহাদেবের অন্য পেসাদ খাই, সেটা খেলে আপনার কলিজা ফেটে যাবে।
বিরিজামোহন খুকখুক করে হেসে একটা গুলি কোঁত করে গিলে ফেলল। বলল, শত হলেও আপনি একটা মালিক আমি আপনাকে ছাড়া আর কাকে নেশার চিজ দিই। অর্থাৎ বাড়িওয়ালাকে বস্তির মালিক বলে সে উপহাস করছে। বলে আবার পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করে এগিয়ে দিল, আপনার মেহেরবানি?
গোঁফজোড়া মুচড়ে দিয়ে বলল বাড়িওয়ালা, ঠকানো পয়সায় নেশা আমি করিনে।
আপনি কীসের পয়সায় নেশা করেন?
নিজের পয়সায়।
বিরিজামোহন আবার হেসে উঠে একটা সিগারেট ধরাল। এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, সত্যি, একটা কথা শুনে আর না এসে পারলাম না। শত হলেও আপনি আমার একই পেশার লোক। বস্তিটা তো উঠে যাচ্ছে, এবার আপনি কী করবেন বাবুসাহেব?
নিষ্ঠুর হাসিতে বেঁকে উঠল তার ঠোঁট।
বাড়িওয়ালার গলায় আস্তে আস্তে তিক্ততার ঝাঁজ মিশতে আরম্ভ করেছে। সে বলল, চোরের আর আমার পেশা এক নয়। আর আমার বস্তি উঠে যাবার কোনও কথা আমি জানিনে।
বিরিজামোহন সেই একঘেয়ে বিদ্রূপের সুরেই বলল, জমিদারের কাছে শুনলাম, মেয়াদ খতম হয়ে গেছে?
আমি শুনিনি।
তবে শুনুন–
কোনও দালালির দরকার নেই। বলে বাড়িওয়ালা গোবিন্দের হাত থেকে গাঁজার কলকেটা তুলে নিল।
কিন্তু বিরিজামোহনদমবার পাত্র নয়। বলল, তা হলে আপনার পাকা মোকামের প্যালেনটা কদুর হল?
বাড়িওয়ালা এবার হঠাৎ খাটিয়া থেকে পা নামিয়ে বলল নির্মম গলায়, কোন ঠগ জুয়াচোরকে আমি তা বলতে চাইনে।
মুহূর্তের জন্য একটু থমকাল লোকটা। হঠাৎ ওই প্রসঙ্গ ছেড়ে গোবিন্দকে বলল, তোকে যেন চিনি মনে হয়।
গোবিন্দ যেন এরকম একটা জিজ্ঞাসাই প্রত্যাশা করছিল। কেননা, দশ বছর আগে লোকটা তাকে বিলক্ষণ চিনত।
কিন্তু তার আগেই বাড়িওয়ালা চাপা গলায় প্রায় গর্জে উঠল, কোনও শালার ওকে চেনার দরকার নেই।
ধ্বক্ করে জ্বলে উঠল লোকটার চোখ দুটো। একবার বাড়িওয়ালা ও গোবিন্দকে দেখে হঠাৎ পেছন ফিরে, সামনে ঝুঁকে লোকটা কুঁজোর মতো দুলে চলে গেল।
খানিকটা গিয়ে আবার ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, দাঁড়া গুণ্ডামি তোর বেরুবে। ডাকাত বস্তি তোর ভাঙল বলে।
বাড়িওয়ালাও চেঁচিয়ে উঠল, তোর বাপের বস্তিরে শালা!
কিন্তু গোবিন্দ জানত, বিরিজামোহন আবার আসবে, অমায়িক হাসবে আর থেকে থেকে এমনি বার বার হুল ফুটিয়ে নিষ্ঠুর আনন্দে চোখ কোঁচকাবে।
দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠল বাড়িওয়ালা, শুয়োরের বাচ্চা!
গোবিন্দকে বলল, দেখলে, কী রকম পেছনে লাগতে আসে শালারা। জান শালার টিকটিকির মতো, টিপুনি দিলে অক্কা পেয়ে যাবে।
বলে গাঁজার কলকেটা বাগিয়ে ধরে টানতে গিয়ে আবার থেমে বলল, ওদের কাছে ডাঁট দেখাতে হয় সব সময়। মানে, আমি তো বাড়িওয়ালা কিনা, ওদের কাছে সেটা সব সময় দেখাতে হয়। নইলে ওকে আমি কুত্তা বলেও ডাকি না।
গোবিন্দ আর কিছুতেই চোখ তুলে তাকাতে পারল না বাড়িওয়ালার দিকে। মানুষটার পাগলামির কথা সে যত ভাবল, তত যেন গুমরে উঠতে লাগল তার বুকটা। সে তাড়াতাড়ি ভেতরে যাওয়ার সেই গলিতে অদৃশ্য হয়ে গেল।
কলকেটা আর টানা হল না বাড়িওয়ালার। গোবিন্দর চলে যাওয়ার পথের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে হঠাৎ মুখটা বিকৃত হয়ে উঠল তার। দু-হাতে গলাটা চেপে ধরল এমন ভাবে, যেন ভেতর থেকে কোনও ঠেলে আসা জিনিসকে রোধ করছে। তবু এ নিষ্ঠুরদর্শন মানুষটার লাল চোখ দুটো ভিজে উঠল যেন। ফিসফিস করে বার বার বলতে লাগল, আমি ফকির…একটা ফকির।…
ওরে
সব ছেড়ে ফকির হয়ে ছুটেছি তোর পেছনে,
দেখি, আমারে না ধরা দিয়ে পালাস কেমনে।
জলদে গান ধরেছে আবেগভরে সেই বুড়োটা গম্ভীর গলা।
আকাশে মেঘ ফকির বেশে দ্রুতবেগে ছুটে চলেছে দেশান্তরে। পেছন টান নেই, বাঁকাবাঁকি নেই ডাইনে বাঁয়ে। তবু মাঝে মাঝে থমকে যেতে হয়, হাওয়া না থাকলে।
কেটে গেছে আষাঢ়ের ঘটা, ধারা বয়ে গেছে শ্রাবণের, পচানি মজেছে ভাদরের, গুমসোনি কাটছে। আশ্বিনের। হেমন্ত আসে আসে। আকাশের নীলে তার ঝকমকানি।
ভর দুপুরে, বি টি রোড থেকে নিউ কর্ড রোডের মাঝে রাবিশ ফেলা রাস্তাটা যেন ঝিম মেরে পড়ে আছে। তার ধারে বস্তিটা পড়ে আছে যেন মুখ গুজে জবুথবু হয়ে। নতুন খুটি বিবর্ণ হয়েছে, ঘুণ ধরেছে পুরনো বাঁশে। শ্যাওলা জমেছে চালায়, খানিক খানিক লালচে আভা কোথাও। খোলার আসল রং ওই লাল। এখনও একটু একটু বজায় রয়েছে যেন ভাঙা মনে রঙের ছোঁয়ার মতো। ফকিরের ঘরের চালা যে!
পাকা বাড়িটার পেছনের জানালা দিয়ে ফেলা কুটনোর অবশিষ্ট কাগজের টুকরো, ন্যাকড়ার ফালি আরও কত কী পড়ে পড়ে চালার একটা জায়গা খানিকটা ঢিবি মতো হয়ে উঠেছে।
গঙ্গার তীর থেকে ভেসে আসসা কারখানার একটানা শব্দের সঙ্গে, কর্ড রোডের ঝোপের ছায়াবাসী ঘু ঘু ঘু ঘুক তাল যেন মন্দীভূত করে দিয়েছে দিনের গতিকে।
গোবিন্দ হাসছে রান্নাঘরের রকে বসে বসে। হঠাৎ মনে হয় হাসছে না, বুঝি হাসির ছলে কাঁদছে। বন্দি হয়েছে ফকির। মুক্তি তার আসেনি, বুঝি নিজেও ভুলে গেছে মুক্তির কথা। আজ আর সে মুক্তি চায় না। মহাবন্ধন তাকে জড়িয়ে ধরেছে আষ্টেপৃষ্ঠে।
সে হাসছে ওই রুগ্ন ছেলেটার দিকে চেয়ে। মাকি সাহেবের সঙ্গে বিলেত যাত্রার আগে সে পেয়েছে ফোরটুয়েন্টি চাচাকে। গোবিন্দ আজ সব বাচ্চাদের ফোরটুয়েন্টি চাচা হয়েছে। সমস্ত বস্তিটা আজ ফোরটুয়েন্টি বলতে অজ্ঞান। মেয়েরাও ইস্তক তাকে সঙ্গী করে নিয়েছে। সকলের সব কিছুতে আছে সে। গণেশ আর দুলারীর সে দোস্ত। প্রাণের বন্ধু। দুলারীও আরোগ্যের পথে। মাদারির সে ফেরে। কেবল তার সঙ্গে কথা বলে না নগেন। দুরন্ত অভিমানে বুক পুড়ে গেছে কালোর। সে হদিস হারিয়েছে ফোরটুয়েন্টির বিচিত্র মনের। গোবিন্দ আর ফুলকির ভাত রেখে দেয়
সে আজকাল। কালো নিয়ে রেখে দেয় নিজের এতেজারিতে। কিন্তু গোবিন্দ আসলে নিজেকে বন্দি করেছে অন্যত্র। তার পরিচয় আজ মহল্লায় মহল্লায়, এলাকায় এলাকায়। বিশেষ এই বস্তির মামলাটা কেন্দ্র করেই গোবিন্দ আজ ছড়িয়ে পড়েছে। সে আজ আর সে মানুষটি নেই। সে বাইরে যেতে শুরু করেছে, আলাপ জমাতে আরম্ভ করেছে দশ বছর আগের সেই ছেড়ে যাওয়া দোস্ত ইয়ারদের সঙ্গে।
লাগে না লাগে না করেও গোবিন্দের ঝিমিয়ে পড়া পালে হাওয়া লেগে গেছে। একটা অদ্ভুত পরিবেশ গড়ে উঠেছে তার চারপাশে। এ মানুষটির মাথায় বস্তির সব ভার চাপিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছে বাড়িওয়ালা। গোবিন্দও যেন এ কাজটি পেয়ে বেঁচেছে। এ জন্য তার ছুটাছুটির শেষ নেই, অন্ত নেই ভাবনার। আর যাই হোক সে বুঝেছে শুধু মাত্র বাড়িওয়ালার স্বার্থরক্ষার জন্যই তার এত মাথা ব্যথা নয়। অনেকের অনেক দুর্দশা জমা রয়েছে এর মধ্যে।
জমিদার ও এ বস্তির বিরুদ্ধপক্ষরা যখন সবাই এটার উচ্ছন্নে যাওয়া সম্পর্কে নিশ্চিন্ত, ঠিক সে সময়েই এ মামলার খবরটা একটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। সে সঙ্গেই রটনা হয়ে গেছে, কে এক ফোরটুয়েন্টি নামধারী এসব করছে। কেননা ওই পাগলা বাড়িওয়ালার তো কোনও বুদ্ধিশুদ্ধি নেই। বিশেষ এ বস্তিরই অনেকের এ রকম একটা বিশ্বাস আছে।
কথাটা ছড়িয়েছে নানান রকম ভাবে। বিরুদ্ধপক্ষ রিরিজমোহনের দলের শেষ নেই ভাবনার আর কৌতূহলের। কেউ বলছে, ফোরটুয়েন্টি একটা বাহাদুর ছোকরা। আসলে ছোকরা বাড়িওয়ালারই ছেলে, মুলুক থেকে এসেছে। কেউ বলছে, সে একটা লেখাপড়া জানা মহা দিগজ, নইলে এরকম মামলাটা চালাচ্ছে কী করে। আবার কেউ বলছে, ও একটা জেল পালানো দাগী, ওইখানে এসে ঠাঁই নিয়েছে, কেউ বা একেবারে সাধু-সজ্জন বলেও চালিয়ে দিয়েছে।
একটা অদ্ভুত রহস্যের মতো ফোরটুয়েন্টি নামটার জন্যই আরও নানাখানা রটেছে। বিশেষ বিরুদ্ধ পক্ষের লোকেরা তাকে চিনে উঠতে পারছে না। আর এ বস্তির মানুষগুলো সুযোগ বুঝে এমন সব কথা বাইরে রটিয়ে আসে যে, তাদের ফোরটুয়েন্টি একটা না জানি কী। এ মানুষটা যেন তাদের এক মস্ত গৌরব। গৌরববোধের জন্যই হয়তো রং মেশাবার আর হিসেব নেই। এ মামলায় হার হোক আর জিত হোক, জমিদার যে কিছুটা থমকে গেছে এ নিশ্চিন্ত বিশ্বাস সবাইকে খুশি করে তুলেছে। তারা বেশ বুক ঠুকেই বাইরে বলে আসে, জমিদারের থোঁতা মুখ ভোঁতা হতে আর বেশি দেরি নেই। অন্যান্য বস্তির মালিকরা রীতিমতো প্রচার শুরু করেছে, মাঠের ধারের বস্তি একটা চোর ডাকাতদের আস্তানা হয়ে উঠেছে। এ এলাকায় সমস্ত গাঁটকাটাদের ওটাই হল আড্ডাখানা।
এরই মাঝে তবু গোবিন্দ কয়েকবার পালিয়ে যাবার কথা ভেবেছে। কিন্তু তার আর কোনও সম্ভাবনা ছিল না। সেই ওস্তাদ মিস্তিরি ছোকরা আজ অন্য পথে মেলে দিয়েছে নিজেকে। তার বেগটাও কম নয়। এই তো সেদিন এল, এরই মধ্যে সব জুটল বন্ধু, শত্রু গজাতেও রইল না বাকি। পুরনো পরিচয়ের সূত্র ধরে সে তার লেখাপড়া জানা বাবুবন্ধুদের কাছে গিয়েছে পরামর্শের জন্য, একটু সমঝে দেওয়ার জন্য। তা ছাড়া গণেশ তার পরিসর আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
দিনে দিনে, কোন্ ফাঁকে যে গোবিন্দ এ বস্তির সমস্ত কিছুর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে তা বুঝি নিজেও জানে না। এখানকার দৈনন্দিন ঝগড়া বিবাদের সালিশী বলল, বিচার বলল গোবিন্দ না হলে জমে না। বিশেষ বাড়িওয়ালা ও গণেশের মতো লোক যাকে রেয়াত করে, তাকে কি কখনও ছাড়িয়ে যাওয়া যায়।
কত সময় কত খবর আসে। এ মামলাটার জন্য প্রায়ই শাসানি আসে গোবিন্দের প্রতি। কখনও মারধোরের শাসানি, কখনও জেল অথবা খুন।
কিন্তু গোবিন্দ বুঝি এটাকে গ্রহণ করেছে প্রাণের মূল্যেই।
এখানে আর সব কিছুর মধ্যে এ ব্যাপারটা তার ফাঁকা জীবনের অনেকখানি ভরে দিয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হয়, না, ভরেনি ফাঁকের মুখটা যেন আরও বড় হয়ে গেছে। দিবানিশি এ শুন্য জীবনের জ্বালা যে কী দিয়ে ভরাট করবে, তা ভেবে পায় না।
তার চেহারাটা অনেকখানি ভেঙে গেছে, কিন্তু চোখের দৃষ্টি কেমন অসহায়, অনুসন্ধিৎসু দিশেহারা। সে যেন কী চায়! কী চায়? তা বুঝি নিজেই জানে না। শুধু একটি মুখ বারবার ভেসে ওঠে চোখের সামনে, আর ধিক্কারে ও লজ্জায় যেন মাথা নুয়ে আসে। সে মুখ মনে করে তার মতো পুরুষের বুকেও যেন নিশ্বাস আটকে আসে। জীবনের এ ফাঁকটা নিয়েই সে অষ্টপ্রহর এর ওর ঘরে ঢোকে, তার সঙ্গে গল্প জুড়ে দেয়, বাচ্চাদের কোলে করে রাখে, ফাই ফরমাশ খাটে প্রায় সকলের।
এখন যে সে হাসছে রুগ্ন ছেলেটার দিকে তাকিয়ে, তা যেন নির্ধন দরিদ্রের ধন পাওয়ার হাসি।
ওই যে নমর্দার ধারে কুন্দ ফুলের অপূর্ব সতেজ দুটি গুচ্ছ ফুটে রয়েছে, ওই গাছটি এনে পুঁতে দিয়েছিল গোবিন্দ। ছেলেটি ফুল বড় ভালবাসে। কিন্তু ফুল ফোটার কোনও আশা ছিল না। কেননা, গাছটার উপর দৌরাত্ম্য তো কম হয়নি। ঘরে উঠতে গিয়ে অনেক সময় পায়ের তলায় চেপটে গেছে, ঘরের আর দুটো বাচ্চা তো একটি সবুজ পাতা গজাতে দেখলেই টুক করে ছিঁড়ে ফেলে।
এখন ছেলেটি সদা সতর্ক প্রহরীর মতো সারাদিন বসে থাকে রকের ধারে ফুল গাছটার কাছে। একটা সুতো দিয়ে বেঁধে দিয়েছে গাছটার গোড়ায় তার ফোরটুয়েন্টি চাচা। ছেলেটা হাতে ধরে রাখে সুতো। চলৎশক্তিহীন বলে সে নামতে পারে না, অথচ নাগালও পায় না। তা ছাড়া কেউ ছুঁলেই টের পায়, যেন বৈদ্যুতিক শক লাগার মতো। এই এবড়ো-খেবড়ো উঠোনে, মেয়েদের কুড়িয়ে আনা গোবর, ছাই ঝাড়া কয়লা, ঘেঁস এখানে সেখানে তূপীকৃত। মাটি চটা ছিটে বেড়া, বড় বড় ইঁদুরের গর্ত, জটিবুড়ির জলের মতো খানে খানে ঝুল বেয়ে পড়েছে খোলার চালার গা থেকে।
তার মাঝে এ ফুলের গুচ্ছ দুটো যেন উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো একেবারে বেমানান।
ছেলেটার আহার নিদ্রা ভুলিয়েছে ওই ফুল দুটো, আজ কদিন ধরে। এ ফুলের সঙ্গে কোথায় যেন মাকি সাহেবের সঙ্গে বিলেত যাওয়ার সুখী ভবিষ্যতের যোগসূত্র আছে। শরীরটা তার আরও ভেঙে গেছে, গায়ের রংটা হলদে সবুজে মিলে নীল হয়ে উঠেছে। সমস্ত আয়ুটুকু এসে ঠেকেছে যেন চোখ দুটোতে। সেই চোখে অনুক্ষণ বিস্মিত মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে সে তাকিয়ে আছে ফুল দুটোর দিকে। কারাপ্রাচীরের মতো এর ঘরের বেষ্টনী পেরিয়ে দৈবাৎ যখন একটু হাওয়া নেমে আসে উঠোনে তখন একটু গন্ধ পাওয়ার জন্য নাকের পাটা ফুলিয়ে বুকের হাড় কাঁপিয়ে নিশ্বাস টানে।
মধুলোভী ভোমরা আসে গুনগুন করে তার সাত জন্মেও না আসা এ হতকুচ্ছিত জায়গায়।
বস্তির এ দুপুরের নৈঃশব্দ্যের সেই বুড়োটা গম্ভীর গলা নিজের সুরে বিভোর হয়ে গেছে। সে গানের পর গান গেয়ে চলেছে এক নাগাড়ে।
সম্সারেতে বাঁধা মন তোর, খুঁটোয় বাধা বলদ রে।
চোখে ঠুলি, গলায় দড়ি মনিষ্যি কাল কাটালি রে॥
এ একঘেয়ে গলার গান ছেলেটাকে আজ যেন আর ছুঁতে পারছে না। সে তার আপনমনে সুতো ধরে টানে। নড়েচড়ে ওঠে গাছটা। সেও আপন মনে দুলে দুলে হাসে আর কী যেন বলে ফিসফিস করে। গাছটা যেন তার সঙ্গী হয়ে গেছে।
মুহূর্তের জন্য সব ভুলে গোবিন্দও দুলতে আরম্ভ করে তার সঙ্গে। তার রোগা মুখে অদ্ভুত হাসি।
তার মধ্যবয়সী মা কাঁচা রকে শুয়ে আছে একেবারে খালি গায়ে। পাশে ঘুমন্ত পড়ে আছে আর দুটো বাচ্চা বেজির মতো গায়ের রঙ নিয়ে। হঠাৎ যেন কিছু মনে পড়েছে এমনি ভাবে ছেলেটা ডাকল, মা রে, মা! মায়ের কোনও সাড়া নেই।
ছেলেটা আপনমনেই কতগুলো অদ্ভুত দুর্বোধ্য ভাষা বলে উঠল। গাছটার দিকে তাকিয়ে একটু সলজ্জ হেসে বলল, ইজিরি কথা বললাম।
সুতোতে একটা টান দিয়ে বলে, বিলেত যাবার সময় তোকেও নিয়ে যাব। ভোঁস…ভোঁস…কলকল…জাহাজটা এমনি করে যাবে। সুমুরের ঢেউ কী, আর বাপরে! ডাকে কী রকম, ওই…আ…ওই…আ…। রহমত চাচা বলেছে। ..আর সেখানে গঙ্গার ধারে মাকি সায়েবের বাগানে তোর মতো অনেক আছে, তাদের সঙ্গে তোকে রেখে দেব। ওই গাছগুলো তো সব মেমগাছ, তোর সঙ্গে বেশ বে হবে। বলে সে হেসে উঠল যেন ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছে। তারপর মায়ের পাশে কাত হয়ে একটা ভোলা স্তন মুঠো করে ধরে ঠোঁটে নাকে ঘষতে লাগল আর ওক ওঠার মতো করে যেন গলার শির টেনে চাপতে লাগল একটা বমির বেগ। এক একটা বেগ চাপতে গিয়ে পেটটা ঘোঁচ হয়ে পাঁজরের হাড়গুলো বনমানুষের হঠাৎ দাঁত খিচোনোর মততা বেরিয়ে পড়ছে। থেকে থেকে তার এমনি হয়। তারপর আপনিই ঘুমে ঢলে পড়ে।
তাতে তার মায়ের কোনও ব্যাঘাত হল না ঘুমের। দাঁত বের করে সে তেমনি ঘুমিয়ে রইল। বোধ হয় তার ছেলের বিলেতে গিয়ে মিস্তিরি হওয়ার স্বপ্ন দেখছিল।
হঠাৎ হাওয়ায় শিউরে উঠল কিশোরী কুন্দ গাছটা। এক ঝলক হালকা মিঠে গন্ধ কোথায় উধাও হয়ে গেল হাওয়ার সঙ্গে।
দুলারী হাসছে আড়ে আড়ে, টিপে টিপে। বস্তির বাইরের রকে বসে হাসছে। ওই কুল ফুলের মতোই তাজা হয়ে উঠছে সে। রং লাগছে আবার তার শরীরের রেখায়, কঙ্কালের গায়ে লেগেছে মাংস। সেরে উঠেছে দুলারী।
কাছে বসে তার দিকে চেয়ে হাসছে গোবিন্দ। খানিকটা বোকাটে বিমুগ্ধতার আচ্ছন্ন তার মুখ। বিগলিত চোখে জিজ্ঞাসা…কিন্তু শরীরটা তার ভেঙে পড়েছে অনেকখানি।
দুপুর গড়ায়। রাবিশ ফেলা রাস্তাটায় কতগুলো ছোট ছোট ছেলে মেয়ে কী সব কুড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সামনের ফালি মাঠটাতে ঝগড়া লেগে গেছে শালিকদের।
দুলারী আজ নতুন হয়েছে। সদী বুড়ি আজ নিজের হাতে তাকে নাইয়ে দিয়েছে গঙ্গার মাটি ঘষে, সারা গা সরষের তেল দিয়ে লেপে মুছে দিয়েছে, চুবচুবে মাথা আঁচড়ে দিয়েছে পাট করে। কপালে দিয়েছে মেটে সিঁদুরের তেল গোলা টিপ, কাজলের রেখা টেনে দিয়েছে চোখে। কানে বিলিতি রূপোর মাকড়ি, কঙ্কন, পায়ের বাঁকমল ছাই দিয়ে মেজে দিয়েছে ঝকঝকে করে। অনেক দিন বাদে নিজের হাতে হল রঙের শাড়ি পরেছে নাভির তলা দিয়ে আঁট করে বেঁধে, বিনা কোঁচে, দোভাঁজে নিভাঁজ করে করে, যেমন করে সে কারখানায় যেত। কঙ্কালের সে মস্ত বড় বড় অসহ্য তীব্র চোখে আজ সলাজ হাসি, চোখের তলায় তারায় নতুন আলো।
গোবিন্দ বলল, কি, মিছে বললুম বুঝি?
দুলারী বলল, হট! তোমার খালি দিল্লাগি।
বাঃ রঙ্গ করলে তোমরা, দিল্লাগি হল আমার?
দুলারী এবার খিখিল করে হেসে উঠল। যেন রননিয়ে উঠল থম ধরা বস্তি। চমকে উঠল ঝগড়া ব্যস্ত শালিকের দল। বলল, আমি তো পড়েছিলাম বেমারিতে, রঙ্গ তো করেছে তোমার দোস্ত।
গোবিন্দ গালে হাত দিয়ে বলল, বোঝে তালে, অমন একটা মানুষকে কী মজানটাই তুমি মজিয়েছ। তবে ব্যাপারটা আমি বুঝেছি।
কী বুঝেছ? ঠোঁট টিপে তাকায় দুলারী গোবিন্দের দিকে।
সে আর তোমাকে কী বলব দোস্তানি। গোবিন্দও এবার আড় চোখে তাকায়। বলে, আমি ছুতোর শালাই মজে গেছি।
হায় রাম…হায় রাম! বলে হাসিতে ঢলে পড়ে দুলারী। বলে, কেন, কেন?
গোবিন্দ বলে অপাঙ্গে তাকিয়ে, অমন যার রূপের বাহার!…
হাসতে হাসতে বার বার আঁচলের ঝাপটা মারে দুলারী গোবিন্দের গায়ে মাথায়, তুমি কী বেহায়া! কিন্তু বেশিক্ষণ হাসতে পারে না দুলারী। অল্পেতেই হাঁপিয়ে ওঠে, কাশি পায়। চোখ বুজে খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, আচ্ছা, কেন এমন হয়? তোমার দোস্ত কি পাগল?
গোবিন্দ বলল, তা সে একরকমের পাগলই। ওরা যেটাকে ধরে, তার একটা গতি না করে সোয়াস্তি পায় না। খেপা কি না! দেখলে না, আমাকে যেদিন ওর প্রাণের কথা বললে, সেদিনে কী জো। আসলে ওকে যারা ভালবাসে, তাদের সকলের জন্যই ও জান দিতে পারে। তাই তো বলছি, তোমরা দুজনেই আমাকে মজিয়েছ। কিন্তু দোস্তানি, এ খ্যাপামি নিয়ে সংসার চলে না।
দুলারী ত্রাসভরে বলে, তাই তো বলি দোস্ত, কী তু তোমার জানা আছে বলো। এ সারা বস্তির তামাম মেয়ে পুরুষ ওকে ঘরের বার করতে পারেনি। ও বলত, শালা পয়সাতেও কুলিয়ে উঠতে পারিনে, ব্যামোও ছাড়ে না, কোনদিন এসে দেখব, মরে পড়ে আছে। আর বেরুব না। আমার তো কোনও তাগদ নেই। বাড়িওয়ালাকে ঘোড়া বহুত মানত, সেও হার মেনে গেল। আমি মরতে পারি, মগর ওর জান যাবে, তাই ভেবে আমার মরণেও সুখ ছিল না। দোস্ত..তুমি সেদিনে না এলে..
গোবিন্দ লাফ দিয়ে উঠে পড়ল।
দুলারী ছোটমেয়ের মতো প্রায় আব্দার করে উঠল, যেয়ো না।
গোবিন্দ কোমরে হাত দিয়ে বলল, বলবে তো যে, আমি একটা দেওতা?
না, তুমি সব। বলতে গিয়ে গলায় স্বর গভীর হয়ে আসে, চোখে ঘনায় ছায়া। বলে, আদমির। কাছে শরম করি, তুমি সেটুকুও যে লুটে নিয়েছে।
হাসতে গিয়ে কেমন বেকুব বনে যায় গোবিন্দ। খানিকক্ষণ থম ধরে থেকে তারপর হঠাৎ হেসে ওঠে হো-হো করে। বলে, তোমার খালি এক কথা।
এক কথা কেন? বেমারিতে তুমি যা করেছ, তা বুঝি মা বাপও পারে না।
শুনেও গোবিন্দ কথা বলতে পারে না। তার বুকের মধ্যে যেন শিশুর দুর্বোধ্য কলকলানি, তাও শব্দহীন কথাহারা।
দুজনেই তারা খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর আচমকা একটা নিশ্বাস ফেলে দুলারী বলে ওঠে, খেপা!
কে?
তোমার দোস্ত্।–বলতে বলতে তার মুখ থমথমিয়ে ওঠে, হাসি চোখে ফোটে দুশ্চিন্তা। বলে, ছাঁটাই আসছে আবার, দোস্ত তোমার ফের খেপে যাবে।
খেপবে কেন? খিলাফ লড়বে।
তা লড়ক। মগর, আমি কারখানায় থাকলে ওকে নজরে রাখতে পারি।
চিরকাল তোমার নজরে তো থাকবে না।
না থাকুক। যদ্দিন জিন্দা আছি, তদ্দিনই রাখব। দালালরা ওকে কত দফে মারার চেষ্টা করেছে, পারেনি আমার জন্যে।
সাথীরা তো আছে।
সাথীরা কতক্ষণ। যার হুঁশ নেই, সাথীরাই বা তার কী করবে বলে? সত্যি, ছাঁটাই যেন চটকলে শরৎকালের মেঘের মতো। কখন আসবে কখন যাবে আর কী তার কারণ বুঝতে না পেরে যেমন হঠাৎ ফ্যাসাদে বিব্রত মানুষে জানোয়রে ছুটোছুটি আরও করে, ছাঁটাইয়ের আচমকা মারটাও আসে তেমনি।
গোবিন্দ বলে, তাই তো বলছি দোস্তানি, এ প্রাণ সুখ চায়, শান্তি চায়, দিলঠাসা মহব্বত, কিন্তু জীবনের এক ধান্দাই যে সব শেষ করে দিয়েছে। সাঁতরে যদি না ডাঙায় উঠতে পারি, হাঁটব কোথা?
দুলারী বলে, সচ…মগর দিল যে মানে না দোস্ত!
দিল মানে না। গোবিন্দের মুখটা হঠাৎ কী রকম হয়ে যায়, একটা রুদ্ধ যন্ত্রণায় যেন তার মুখ স্ফীত হয়ে ওঠে। ওই একটি কথা জীবনের আর সব কিছুকে যেন মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ করে দিতে পারে। দিল মানে না।
চকিতে যেন আকাশের বুকে মেশা দিগন্তবিসারী পথ তাকে আবার বিবাগীর বেশে ডাক দেয়। জীবনের এত ধান্দার পোড় খেয়ে আজ আবার হঠাৎ সব দিকে হৃৎপিণ্ড ক্ষইতে শুরু করেছে। বেপরোয়া প্রাণের আবার এত জড়াজড়ি, না মানামানি কেন? আবার যেন মনটা পালাই পালাই করে।
পরমুহূর্তেই মনে হয়, পথেও যদি আবার প্রাণ না মানে। না মেনে তো চলে এল একবার। বেশরম প্রাণ!
বেশরম বই কী। নইলে আজ আবার কেন ছুতোর বউ ঘোমটা তুলে ইশারা করে, চোখে ভেসে ওঠে দরজা উঠোনে মাটি মেখে খেলা করে নাদুস নুদুস ছেলেমেয়ে, দু-হাত যেন তাদের সাপটে ধরতে চায় খালি বুকে।
দুলারীকে অবাক করে দিয়ে সে ভিতরে গিয়ে যে মুহূর্তে জল আনার টিনের বাঁকটা কাঁধে তোলে সেই মুহূর্তে গ্লানি ও বিরক্তিতে মনে হয় বাঁকটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যায় কোথাও।
আজকাল তার এ কাজকে মনে হয় যেন একটা বিরাট অকাজের বোঝা। কাজের পটু হাতে যেন পুতুল খেলা। আবার কারখানার কাজ ধরবার জন্য হাঁসফাঁস করে তার মন। শুধু তাই নয়। কারখানার কাজের শেষে ফিরে আসবে সে তার ঘরে। ঘরে থাকবে…
গণেশ-দুলারীর যুগল মূর্তি ভেসে তার চোখে। অমনি অপরিসীম লজ্জায় ভরে ওঠে তার বুক।
গোবিন্দ অবাক করেছে নিজেকে। অথচ তার এ মনই একদিন চেয়েছে, হেলাফেলায় কাটুক এ জীবন, মানুষের সঙ্গে থেকে, দশজনের মাঝে তাদের ফাইফরমাস খেটে, তাদের সুখ দুঃখের ওঠা নামায় দিন যাক কেটে।
কিন্তু সেদিন আজ বিস্বাদ হয়ে গেছে। এ-জীবন যেন কোনও টান নেই, রং নেই, একেবারে পাসে।
যে সুখ-দুঃখকে সে জীবনের পেছনে ফেলে রাখতে চেয়েছিল, বুঝি সেই সুখ-দুঃখ আজ আবার নতুন চেহারায় এসে দাড়িয়েছে।
মানুষ তার নিজের মনটাকে চিনতে পারে কতখানি। নিজের সঙ্গে যার বোঝাপড়া শেষ হয়নি, জগতের সঙ্গে তার বোঝাপড়া শেষ হবে কেমন করে। জগত বিচিত্র, কিন্তু মানুষের মন আরও বিচিত্র। বাঁকটা কাঁধে নিয়ে বেরুতে যাবে গোবিন্দ, এমন সময় আবার এসে দাঁড়াল দুলারী। মুখ তার গম্ভীর, থমথম করছে। সে এসে দাঁড়াল একেবারে গোবিন্দের কাছে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল তার মুখের দিকে। গোবিন্দ অপ্রতিভের মতো হেসে বলল, কী হল?
পরিষ্কার গলায় বলল দুলারী, বহুত কুছ। তোমার দিল ঠাসা আছে কীসে, কভি তা বলতে চাও। ভাবো আমি কিছু সমঝি না। বলল, কেন তুমি এমনি চলে এলে।
গোবিন্দ কাষ্ঠ হাসিতে খানিকক্ষণ হা হা করে তার স্বাভাবিক ঠাট্টার সুরে গেয়ে উঠল :
রঙ্গ
করা স্বভাব যে মোর,
স্বভাব
যায় না মেলে,
যতই কেন বৃল না গো,
ইল্লত যায় না ধুলে।
তোমার সঙ্গে রঙ্গ করেছি।
এ কী রঙ্গ। তোমার মুখ হর বখত্ দুখ-আন্ধার।
দুলারীর নিশ্বাস লাগে গোবিন্দের গায়ে। গোবিন্দের চোখ বুজে আসে। আজ আর তাকানো যায় দুলারীর দিকে। তার ভরা শরীর, নতুন পোশাক, উষ্ণ নিশ্বাস।
কান্নারুদ্ধ গলায় বলে দুলারী, বলতে, আমার ব্যানো সেরে গেলেই তুমি খুশি। সেরেছি। আজ কী দুখ তোমার, বলো আমাকে।
কী দুঃখ, সত্যি, কী দুঃখ গোবিন্দের? রোগা মুখে তেমনি হাসির ঝলক ফুটিয়ে সে জবাব দিল, দোস্তানি দুঃখের কি শেষ আছে? শেষ নেই। পথ ছাড়ো, কলে ভাঁজা লাগাতে হবে। অনেক কাজ রয়েছে।
আর একবারও দুলারীর দিকে তাকিয়ে হনহন করে চলে গেল। কিন্তু বেরোবার গলির অন্ধকারে সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল দেওয়াল সেঁটে, যেন লুকিয়ে পড়েছে সে প্রাণঘাতী আততায়ীর ভয়ে। দু-হাতে মুখটা চেপে যেন অসহ্য ক্রোধে হিসিয়ে উঠল, এ শালা কীসে ফেঁসেছি আমি কীসে?
কেবল দুলারীর কাজল টানা চোখে ভিড় করে আসে মেঘ।
আজকাল সে সবাইকে খেতে দিতে গিয়ে মাঝে মাঝে খেকিয়ে খিঁচিয়ে খিঁচিয়ে ওঠে, বিরক্তিতে হঠাৎ গালাগাল দিয়েও ওঠে। সেদিন হঠাৎ ঝগড়া লেগে গেল কী কারণে গোবিন্দের সঙ্গে সবাইকে খেতে দিতে গিয়ে।
যার সঙ্গে ঝগড়া লেগেছে, যত না চেঁচায় সে, তত চেঁচিয়ে খিস্তি করে গোবিন্দ। সবাই অবাক হয়ে দেখে গোবিন্দকে। তার এমন ঝগড়াটে মুর্তি আর কোনওদিন কেউ দেখেনি।
বাড়িওয়ালা হাঁকল, ফোরটুয়েন্টি!
কে কার কথা শোনে। তেমনি চেঁচাচ্ছে, শালা চোখ দিয়ে দেখে খা, কী দিয়েছি। বেশি বলবি তো ঝাড়ব রদ্দা।
কিন্তু রদ্দা ঝাড়াঝাড়ির আগেই বাড়িওয়ালা এসে গোবিন্দকে ধরে টেনে নিয়ে গেল রান্নাঘরের মধ্যে। বলল, জায়গায় ব্যায়ো ধরেছে দেখছি।
গোবিন্দ ফুঁসে উঠল, তা মানুষের মেজাজ সব সময় ঠিক থাকে না, যা-ই বলো।
কিন্তু আগে তা তুই এমন ছিলি না। স্নেহভরে বলল, শালা কী হয়েছে তোর?
কোনও জবাব দেয় না গোবিন্দ। ঠাণ্ডা হয়ে আসে।
একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ বাড়িওয়ালা বলে, মামলাটা বুঝি ফেঁসে যাচ্ছে? তাই তোর মেজাজ—
এবার গোবিন্দ হেসে উঠল তার স্বাভাবিক গলায়। এই সেরেছে। শালা দুনিয়ায় যে যার ভাবনা নিয়ে আছে। কে বললে তোমাকে এ কথা!
বাড়িওয়ালা তাড়াতাড়ি বলে, না, কেউ না। তোর গোমড়া মুখ দেখে তাই ভাবি। তোর কী হয়েছে ব তো?
তোমার মাথা। বিরিজুমোহন শালা এসে খচিয়ে গেছে বুঝি?
অমনি বাড়িওয়ালাও খেপাটে গলায় বলে ওঠে, হাঁ খচ্চরটা এসে আজ আমাকে বলে কী, তোমার ফোরটুয়েন্টিকে একবার দেখাও। হাঁকতুম শালাকে এক কোঁকা,
তারপর শালা আর এট্টা মামলায় ফেঁসে জেলে যেতে, বলে, হা হা করে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল গোবিন্দ।
কোনও কোনওদিন দেখা যায় গণেশ অসম্ভব চেঁচামেচি শুরু করেছে কিংবা হঠাৎ দুলারীর এই আধা রুগ্ন শরীরের উপরেই কষিয়েছে কয়েক ঘা। সেই তারই দুলারী বউ। সব সময় গণেশ তার পরিবেশের উর্ধ্বে নয়। কোনও কোনও দিন বেধড়ক নেশা করে আসে। তা ছাড়া দুলারীরও এ বস্তিবন্দি মনটা আজকাল একটু খিটখিটে থাকে। বিশেষ করে দুরন্ত গণেশের বাইরের গতিবিধি তার ধরাছোঁয়ার বাইরে বলেই আরও দুশ্চিন্তায় মেজাজ তার বিগড়ে থাকে!
এ খিটিমিটির সময় গণেশ চেঁচিয়ে গোবিন্দকে ডাকে, দোস্ত..ইধার আও।
গোবিন্দ গিয়ে দাঁড়ায় হেসে, কী হয়েছে?
গণেশ সোজা বলে দুলারীকে দেখিয়ে, একে বাঁচিয়ে তুমি ভারী ফ্যাসাদ করেছ।
গোবিন্দ বলে, হ্যাঁ, তাই তো। কী বলেছে?
গণেশের গোঁফ জোড়া যেন শজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে ওঠে, এ উল্লুক অওরত আমাকে বলে কি না, হরতাল কমিটির কাজে তুমি এখন-আনা কম কর, আমি আগে কলে যাই, তারপর ও-সব হবে। সমঝো! ওর জন্যে আমি বসে থাকব?
গোবিন্দ কিছু বলার আগেই দুলারী সাপিনীর মতো হিসিয়ে ওঠে। তার জলভরা চোখে ক্রোধ আর মুখের উপর এলিয়ে পড়া চুলে সে এক অপূর্ব রূপ। বলে, বলব, আমি লাখো বার বলব, তাতে ও মারার কে? আমার বেমারির টাইমে ও কেন ওর ওই ঘেঁচো মুখ নিয়ে ঘরে পড়েছিল বলে? কোন্ অওরত আছে যার ভাবনা না হয়। একবার তেরো দিন হাজত হল, আমার নাওয়া খাওয়া নেই, সারা দিন হাজতের কাছে পড়ে থেকেছি। এসব পরেশানি কার?
গণেশও চেঁচায়, কারও ভাবতে হবে না। ফের বললে, মারব রদ্দা—
মার না, মার। দুলারী পেছোয় না। বলে, গায়ে তাগদ থাকলে একবার দেখতাম।
তা ঠিক। দুলারী যখন সুস্থ ছিল, তখন গণেশের এরকম হঠাৎ খেপামির দিনে যখন দুলারীকে মারতে যেত, তখন সে এমন ছুটোছুটি করত যে, সারা বন্তিময় একটা হোড় পড়ে যেত তারপর আচমকা দুলারী উধাও হত। তখন গণেশ ঘরে ঘরে জিজ্ঞেস করত, দুলারী আছে এখানে?
সবাই বলত, না। আর ব্যাপারটাকে বেশ উপভোগ করত। কিন্তু এখন দুলারী সেটা পারে না।
তা ছাড়া এখন গোবিন্দকে পেয়ে ব্যাপারটার রং বদলেছে আজকাল। গোবিন্দ বলে গম্ভীর হয়ে, দেখ দু-পক্ষেই জবাব আছে। তবে দোস্তানির এ আব্দারটা খুবই অন্যায্য।
দোস্তানির মুখ অমনি দুর্জয় অভিমানে থমথমিয়ে ওঠে।
পরমুহূর্তেই গোবিন্দ কঠিন গলায় বলে, গণেশ, তুই শালা আমাকে দো, বলিনে। বলি তোর দারু খাওয়া আর বউ ঠ্যাঙানোর কথাটা কি জানে হরতাল কমিটি?
জবাব দিতে গিয়ে গণেশ হাঁ হয়ে যায়। চুপসে যায় একেবারে গোঁফ জোড়া। চুপ করে থাকে সে।
গোবিন্দ বলে, জানে না তালে। আচ্ছা, ঠিক আছে।
গণেশ চোখ পিটপিট করে ডাকে, দোস্ত।
ফের ওই নাম? ধমকে ওঠে গোবিন্দ।
গণেশ গোবিন্দের হাতটা ধরে বলে, ক-জন সাথী মিলে পিলিয়ে দিয়েছে।
দুলারী গালে জলের দাগ নিয়ে বিদ্রূপে ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে, ওকে খালি পিলিয়ে দেয়। পয়সা সবার শস্তা।
গণেশ তবুবলে, সচ বছি দোস্ত, দলে পড়ে ঝট্সে পিয়ে নিয়েছি। …আর নয়, কোনওদিন আর যাব না।
গোবিন্দ জানত, এ ব্যাপারটাতে গণেশকে জোর দেওয়া মানে অন্য রকম করা। এটা দুলারীর কাজ আসলে। সে আরও তীব্র গলায় বলে, দোস্তানির গায়ে তোর হাতটা তো আর কেউ তুলে দেয়নিরে শালা! বলেছি না, অওরতের গায়ে যে হাত তোলে সে নীচের সঙ্গে আমি মিশিনে।
গণেশ চুপ করে থেকে খানিকক্ষণ ছটফট করে। হাত কচলায়, পা কচলায়, গোঁফ ঘষে, তারপর হঠাৎ বলে, দোস্থ সচ্ বলছি মেজাজটা শালা বিলকুল কী রকম হয়ে যায়। কত ভাবি, তবু রুখতে পারি না। ও কেন আমার কাছ থেকে চলে যায় না?
তবু তুই নিজেকে রুখতে পারবি না? জ্বলে ওঠে গোবিন্দ।
আর একটু চুপ করে থেকে বলে গণেশ, পারব। আর যদি হাত তুলি তো এ শালার হাত আমি নিজেই কেটে ফেলব। ঠিক বলছি।
চট করে মুখ ফিরিয়ে বলে গোবিন্দ, তা আমাকে কেন বলছিস? যাকে পিটেছিস তাকে বল।
সে এক অদ্ভুত মুহূর্ত। গণেশ প্রায় মিনিটে এক পা করে এগোয় দুলারীর দিকে। কাছে গিয়ে ডাকে, এই…এই শোন…।
দুলারীর শরীর ফুলে ওঠে কান্নায়। সে ঘোমটার আড়াল দিয়ে আড় হয়ে থাকে। গণেশ গায়ে হাত দিতেই ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দেয়।
আর পিটব না, গোস্তাকি হয়েছে। সচ..মাফ করে দে এবার। ভরাট হয়ে আসে গণেশের গলা।
দুলারী বলে অরুদ্ধ গলায়, খালি বাতকে বাত।
না। সচ্..মরদ কি বাত…
দুলারী বলে, ঝুট।
গণেশ বলে, না, সচ্…
দুলারী লুকিয়ে তাকায় গোবিন্দের দিকে। তার জলভরা চোখে হঠাৎ ঝিলিক দিয়েছে হাসি। গোবিন্দও টিপে টিপে হাসতে আরম্ভ করে।
গণেশ তাদের দুজনের দিকে তাকিয়েই দুলারীর ঘোমটা টেনে খুলে ফেলে, আর তারা তিনজনেই হেসে ওঠে।
কেবল গোবিন্দের মুখটা কেমন বোকাটে হয়ে ওঠে আর তার হাসিটা যেন অতিরিক্ত চড়া গলায় বেসুরো হো হো শব্দে ঘরটাকে কাঁপিয়ে দেয়।
কদিন ধরে বস্তিতে একমাত্র আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে ছাঁটাই। গান হাসি হল্লা সবই আছে, তবু এর মধ্যে ছাঁটাইয়ের কথাটা হয়ে উঠেছে মুখ্য।
কেউ বলছে, চারশো ছাঁটাই হবে। কেউ বলছে, চার হাজার। কারও ধারণা, একেবারেই হবে না, ওটা গুজব! আবার কেউ বলছে, তবে এখন নয়, দেরি আছে।
একই সঙ্গে আর একটা সর্বনাশও ঘনিয়ে আসছিল, সেটা এ বস্তির মেয়াদ। মামলা চললেও মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে জায়গা ছেড়ে দিতেই হবে। সেদিনের আর বেশি বাকি নেই।
সকলেই কিছু না কিছু বলছে এ সম্পর্কে কেবল পাশের সুদৃশ্য দোতলা বাড়িটা এ বস্তির গায়ে লেগে থেকেও যেমন এখানকার সব কিছু থেকেই আলাদা, ফুলকিও ঠিক তেমনি। ওই বাড়িটার রেডিয়ো সংগীতের হঠাৎ রেশ ভেসে আসার মতোই ফুলকির খিলখিল হাসি সবাই কান পেতে, শোনে। সম্প্রতি তার প্রায়ই বাইরে রাত কাটে। আধিক্য ঘটেছে পোশাকের। সমস্ত জেনানা বহুড়ির দল হাঁ করে তাকিয়ে দেখে তার সাজগোজ। পুরুষেরা মুগ্ধ হয়ে দেখে তার হেলে দুলে চলন।
যখন সবাই কোনও কথাবার্তায় মগ্ন থাকে, তখন ফুলকি এলেই তারা এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে তার। দিকে তাকিয়ে থাকে।
ফুলকি অমূনি বাঁকা হেসে, একটা দোলন দিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে চলে যায়।
কিন্তু কেউ বিশেষ কিছু বলে না, কয়েকজন ছাড়া। সে কয়েকজন তার সঙ্গে একই কলে কাজ করে। তাদের মধ্যে নগেন একজন।
এ বস্তির সকলেই প্রায় ফুলকিকে ভালবাসে, স্নেহ করে। পাঁচ বছর আগে একদিন অচেনা ফুলকি একটা কালো কঙ্কালের মতো এখানে পুঁকতে ধুকতে এসেছিল। অনেক কথা সেদিন বলেছিল সে যে, তাকে হাসপাতাল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে বিনা ইলাজে। তার একটা বাচ্চা মারা গেছে…।
কিন্তু কেউ তাকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। কেন হাসপাতাল, কার বাচ্চা, সোয়ামী কোথায় কিছুই না। তার অবস্থা দেখে সবাই তাকে চাঁদা করে সাহায্য করেছে, ঘর দিয়েছে বাড়িওয়ালা, নগেন চাকরি যোগাড় করে। এরকম একলা মেয়ে একটা থাকলে যা হয়, সকলেরই নজরটা ঘোরে তার আশেপাশে।
এর দিলে রং লাগে, ওর চোখে লাগে নেশা।
কালো অবশ্য গোবিন্দকে এ-সব কথা বলেনি। অন্য সবার মুখে শুনেছে। কিন্তু ফুলকি নির্বিকার। সকলে ভাবে, বেওয়ারিশ হলেও একটা খাঁটি অওরত। ‘
কেবল আশা ছাড়েনি কালো। তার বার বার ঘরভাঙা প্রাণের খোলা দরজা দিয়ে অষ্টপ্রহর উঁকি। মেরে আছে একটা ভক্ত। সে আছে ছায়ার মতো ফুলকির পিছে পিছে।
নগেনের গোবিন্দের প্রতি কটুক্তির পর কালো নিজে হাতে আজ পর্যন্ত রোজ ফুলকির ভাত নিয়ে যায়। কোনও কোনওদিন সকালে ফুলকিকে ঘরে না পেলে সেই ভাতগুলো সে ধরে দেয় ওই রুগ্ন ছেলেটির মধ্যবয়সী মাকে।
আগে সে গোবিন্দকে অনেক কথা বলেছে, সম্প্রতি আর বলে না। এমন কী বাড়িওয়ালার দৈনন্দিন গাঁজার আড্ডায়ও আজকাল আর তাকে দেখা যায় না।
গোবিন্দ ভালবাসে কালোকে। দিনে দিনে কালোর এ অবস্থা দেখে ফুলকির প্রতি তার রাগটা ঘৃণায় পরিণত হচ্ছিল। সে ডেকে কালোকে একদিন জিজ্ঞেস করবে ভেবেছে, কিন্তু সে সুযোগ আসেনি। তার মাথায় অষ্টপ্রহর এক ভাবনা ও উকিলের ঘর দৌড়নোও বেড়ে গেছে। কালোকেও সময়মতো পাওয়া বড় কঠিন।
শীতের রাত।
রকের ধারে ধারে একটা করে চটের ঢাকনা দিয়েছে সকলেই শীত আটকাবার জন্য। আকাশের পাতলা কুয়াশায় আর ধোঁয়ায় সব আচ্ছন্ন। দশটা না বাজতে সবাই ঘরে ঢুকে পড়েছে।
শুধু একটানা মাতাল গলায় চিৎকার করছে সেই রুগ্ন ছেলেটার বাপ। কুন্দ ফুলের গাছটা ফুলহীন, পাতাহীন। ছেলেটা আজকাল বেশির ভাগ সময় ঘরের মধ্যেই থাকে।
গোবিন্দ তার রান্না সেরে ঘুরে এসেছে উকিলের ঘর।
এমন সময় কালো এল। গোবিন্দ একবার দেখে মুখ ফেরাতে গিয়ে হঠাৎ চমকে উঠল। দেখল কালোর চোখ সুদ্ধ কপালের একটা পাশ ফুলে উঠেছে, চোখের কোলে খানিকটা কাটা দাগ। গোবিন্দ বলল, কী হয়েছে কালো?
নিরুত্তরে কালো একটা থালা তুলে নিল। ওই থালাটায় সে রোজ ফুলকির ভাত নেয়।
কালো! গোবিন্দ কাছে এসে ডাকল।
বল!
কে মেরেছে তোকে?
কালো মুখ ফিরিয়ে অস্পষ্ট গলায় বলল, ফুলকি।
কেন? সে
কথার জবাব না দিয়ে কালো বলল, ভাত দেও।
কিন্তু গোবিন্দের সমস্ত শরীরটা যেন শক্ত হয়ে উঠল। মনে হল কালোকেই বুঝি সে দু-ঘা কষাবে।
বলল, তবু শালা তুই–
ফোরটুয়েন্টি! ডেকেই থেমে গেল কালো, একটু চুপ থেকে বলল, এইটাই শেষ,…আর একবার…আর একবার…
গোবিন্দ চাপা গলায় উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল, শালা মরে যাবি যে!
জান কি এতই শক্তা! কালোর হাসিহীন ঠোঁটের ফাঁকে অকালের ফোকলা মাড়ি বেরিয়ে পড়ল।
মুহূর্তের মধ্যে গোবিন্দের মুখটা বিকৃত হয়ে উঠল। অনেক দিন পর সে কালোর হাত ধরে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল এততেও জানটা কালোর কাছে দামি রয়ে গেছে।
সেদিন সন্ধ্যার ঝোঁকে যখন সবাই নানান জটলায় ব্যস্ত, তখন হঠাৎ নগেন এসে রান্নাঘরের কাছে বসে থাকা গোবিন্দের ঘাড়ে হাত দিয়ে ডাকল, ফোরটুয়েন্টি।
গোবিন্দ আজকাল কাজ ছাড়া বসে থাকলেই কেবল চিন্তাচ্ছন্ন থাকে। নগেনের ডাকে সে বিস্মিত হল। কারণ সেই রাত্রের পর থেকে আজ অবধি নগেনের সঙ্গে তার কথা নেই।
নগেন বলল, বাব্বা, তোমার গোঁসা যে আর কাটে না দেখছি। নগেনের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল গোবিন্দ। যত দোষ সব ফোরটুয়েন্টি শালার। তুমি বুঝি রোজই কথা বলতে আসসা?
কথা টথা বলো না, তাই বলছি। নগেন বলল।
নগেনের গলা এত মিষ্টি হতে পারে, গোবিন্দ ভাবতে পারেনি। নগেনের চোখ লাল ও আধবোজা। তার বেঁটে শক্ত শরীরে ক্লান্তির এলানো ভাব।
গোবিন্দ বলল, কি নগেন, ছাঁটাই শুরু হয়ে গেছে?
এখনও নয়। যেন খানিকটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কথাটা বলে নগেন একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ বলল, সেবারে সেই রাতে তুমি ভেবেছিলে আমি ফুলকিকে মহব্বত পেশ করতে যাচ্ছি, অ্যাঁ।
বলে সে একটানা জলের কক শব্দের মতো তাড়াতাড়ি বলে গেল ফুলকির সমস্ত কাহিনী। তার আসা থেকে শুরু করে সব। নগেন তার জন্য কত করেছে। অবশ্য একলা নয়, অনেকেই রয়েছে তবু নগেনকে ফুলকিই নিজে বলেছে, তুমি আমার যা করেছ, নিজের আদমিও তা কোনওদিন পারে না। তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। কিন্তু এ রকম কথা সে সারা বস্তির মরদদেরই বলেছে, যে জন্য সবাই তাকে নাম দিয়েছে প্রেমেযোগিনী। কিন্তু…
নগেনের মুখটা অত্যন্ত নিষ্ঠুর হয়ে উঠল। বলল, জানো ফোরটুয়েন্টি, আমাদের ছিপিয়ে ও অনেকদিন আমাদের লিবারবাবুর রেণ্ডিগিরি করে আসছে। হারামজাদী ভাবে, আমরা সে সব জানি না। কিন্তু কোনওদিন কিছু দেখিনি বলে কিছু বলিনি। রাতে আমি রোজ খোঁজ নিতুম ও ঘরে ফিরেছে কি না। আর আজকাল ও আমাদের সেল সায়েবের কোঠিতে রাত কাটায়। আমি নিজে যেতে দেখেছি…সচ,—সেল সায়েবের মেম বিলেত গেছে, এও জানি।…
বুট বাত। হঠাৎ কে বলে উঠল পাশের অন্ধকার কোণ থেকে।
চমকে নগেন ও গোবিন্দ দেখল কাছেই দাঁড়িয়ে আছে কালো।
চকিতে নগেন একটা ভাল্লুকের মতো লাফ দিয়ে উঠল, বুট বাত? কেন, সেল সায়েবের মেম বিলেত যায়নি?
কালো বলল, গেছে।
তবে? তোর সাতকালের পিরিতের ফুলকি যায় না সায়েবের কোঠিতে?
কালো বলল, যায়। ছুটির পরে ও ঝিয়ের কাজ করতে যায়।
ঝিয়ের কাজ? ক্রোধে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল নগেন। বলল, আমাকে বোঝাতে এসেছিস? বলেই জোড়া হাতের রদ্দা কষাল সে কালোকে, শালা ভেড়ো কাঁহিকা।
অপ্রস্তুত ধাক্কাটা সামলাতে না পেরে রকের কোলে নর্দমার পাঁকে একেবারে নেয়ে উঠল। তার মূর্তি ও দুর্গন্ধে সে বিশ্রী ব্যাপার। তার উপর এই অসহ্য শীতে কেমন কাঁপন ধরে গেছে তার। সমস্ত বস্তি হইহই করে ছুটে এল। শালা মহব্বত দেখাতে এসেছ? বুট বলছি আমি? বলে নগেন আবার কালোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার পূর্ব মুহূর্তে গোবিন্দ তাকে শক্ত হাতে ধরে ফেলল।
তবু নগেন তড়পাতে লাগল, পুছু শালা, কে না জানে তোর ফুলকি সেল সায়েবের কোঠিতে রাত কাটাতে গায়। পুছ, কমিনা!
অনেকে একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল,.আমি জানি।…আমি দেখেছি..।
এ রকম গণ্ডগোল হলেই মাদারি খেওয়ালা তার ড়ুগড়ুগিটা বাজাতে আরম্ভ করে। আর চিৎকার করতে থাকে, ইস্টাপ, ইস্টাপ, ডোন্ট হট, তব ফটু হো যায়েগা। মাইঅ—ডর!…
নির্বিকার শুধু সেই রুগ্ন ছেলেটি, আর তার মা। তারা আছে তাদের নিজেদের কথায় মগ্ন। আর নির্বিকার সেই দেহতত্ত্বের বুড়ো গায়ক। গণেশ তখনও আসেনি; দুলারী এসে তাড়াতাড়ি দাঁড়ায় গোবিন্দের কাছে। ঠিক সেই মুহূর্তেই ফুলকি ঢোকে বস্তির উঠোনে।
একটা নাটকীয় মুহূর্তের মতো হঠাৎ সবাই চুপ হয়ে যায়। ফুলকি এক লহমায় সব দেখে আবার ফিরে একেবারে বস্তির বাইরে চলে যায়। যেতে যেতে তার আঁট করে পরা শাড়ি উড়িয়ে, টিপ ঝিলিক দিয়ে, বাঁকা হেসে আগুন ছড়িয়ে যায়। আশ্চর্য! মানুষগুলো বোকা বনে যায় সব।
এ স্তব্ধতার মধ্যে ছেদ পড়ল মাদারি খেলোয়াড়ের চড়া গলায়, দ্যাটাজ কোল মাদারি খে। দি হুরী ইজ ফুড়ক। ফোরটুয়েন্টি, খানা লাও! আবার একটা গুস্তানি উঠল, কিন্তু জোরে নয়। ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল সব।
কেবল কালো পাঁক মাখা গায়ে ফুলকির অনুসরণ করে বেরিয়ে গেল বাইরে। সমস্ত উঠোনটা একটা নাটকীয় মুহূর্তের যবনিকা পাতের মতো থমকে রইল। গম্ভীর গোবিন্দ তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল নগেনের দিকে।
নগেন রাগতভাবেই মাথা নিচু করে বলল, কী করব। শালা শুধু শুধু বাজে কথা বলে খচিয়ে দিল। আমি মিছে কথা বলি?
গোবিন্দের মুখের কঠিন ভাবটুকু দূর হল না তাতে। নগেন সরে গেল। নোক কাঁপিয়ে হাসছে লোটন বউ। তার কাছে বসে হাসছে নন্দ আর হরিশ। অন্যান্য দিন তাদের ব্যাপার নিয়ে এ সময়ে সবাই হাসাহাসি করে। আজ তারা হাসছে।
হাসতে হাসতে বলল লোটন বউ, মাগীটা ছেনাল!
বলে কাছেই পিচ করে একগাদা থুতু ফেলে দিল। তারপরে ভাত বেড়ে খেতে দিল নন্দ-হরিশকে। লোটন বউ পোয়াতী হয়েছে। সেজন্য তোয়াজের অন্ত নেই নন্দ-হরিশের। আজ এটা আনে, কাল ওটা আনে।
চেহারা ফিরেছে লোটন বউয়েরও। মাংস লেগেছে তার লম্বা চেহারায়। হঠাৎ মনে হয় একটা রূপসী রাজপুতানী।
তার পেটে সন্তান আসার পর থেকে নন্দ-হরিশের ঝগড়ার বহরটা আগের থেকে অনেক পরিমাণে কমে এসেছে। লোকের সমস্ত ধিক্কার বিদ্রূপ সয়েও মনে হয়, তারা তিনজনে সুখেই আছে। পোয়াতী বার পর একদিন ওদের এ অঞ্চলের গ্রামবাসী ও আত্মীয় স্বজনেরা ওদের ছেকে ধরেছিল। কিন্তু একটা ভোজ দিতে তারা সবাই ব্যাপারটা মেনে নিয়েছে। ভোজটা সামাজিক অপরাধের জরিমানা হিসেবে দিতে হয়েছে।
এখানে কেউই প্রায় ওদের সঙ্গে ভাল করে কথা বলে না। কিন্তু গোবিন্দ বলে। লোটন বউ যত দূর দূর করেছে, নাছোড়বান্দা হয়ে গোবিন্দ তত কাছে কাছে গেছে।
তারপর একদিন লোটন বউ বলেছে, গোবিন্দকে নিজেদের দোস্ত ভেবেই, এখানে কেউ আমাদের দেখতে পারে না। আমাদের ঘর ভেঙে দিতে চায় সবাই।
গোবিন্দ চলেছে, এ কীরকম ধারার ঘর। তুমি কি সুখে আছ।
সে বলেছে, এ দুনিয়ার সুখ দুখ কী জানি না, খালি ওরা দুটোতে বিবাদ না করলেই আমার সুখ।
গোবিন্দ বলেছে অবাক হয়ে, কিন্তু দুজনকে নিয়ে তুমি কেমন করে আছ?
লোটন বউ বলেছে, কী করব? ওটাই আমার কিসমত!
কিসমত! হ্যাঁ, তাই তো! লোটন মরে যাবার পর সে কত কী ভেবেছিল। সে সমস্তই তার পবিত্র বৈধব্য জীবনের অঙ্গীকার। কিন্তু এই দুজন? সে যে মানুষ। হলই বা মেয়ে-মানুষ। সে এক পাখনা ঝরা শীর্ণ ময়ুরী। ওরা দুটোতে জোড়া ময়ুরের মতো পেখম মেলে কেবলি ঘুরেছে তার চারপাশে। কখনও হেসে, কখনও গেয়ে, কখনও দীন চোখে। তারপর কবে একদিন গুরু গুরু করে মেঘ ডেকে উঠেছিল তার দেহ ও মনের আকাশে। খোলা পেখমের রং আর তাকে সেদিন মুক্তি দেয়নি। কার কাছে সে প্রথম আত্মসমর্পণ করেছিল, তাও আজ আর মনে নেই, কেমন করে জড়িয়ে পড়ল দুজনের মাঝখানে। আশ্চর্য! একটুও অস্বাভাবিক বোধ হয়নি দুজনের কাছে নিজেকে
সঁপে দিতে। হৃদয়ে ফাটল ধরেনি দুই দুই করে। ওরা দুজনে মিলে একটা হয়ে গিয়েছিল।–ভাগাভাগির কথা মনে করতে সে পাপ বোধ করেছিল। বিচিত্র পাপবোধ তার! ওরা দুজনেই তার।
প্রেমিক, তার নিকটতম। তার সুখ ও দুঃখ। সে যে দুটি হৃদয়ে অধীশ্বরী, একথা ভেবে তার বাইরে লজ্জা, ভেতরে মহৎ আনন্দ, ঔদার্য ও গর্ব।
কিন্তু ওরা দুটিতে ঠোকাঠুকি শুরু করেছিল। সংসারের এ স্বাভাবিক নিয়মটাকেই অনিয়ম ভেবে সে কেঁদেছে ও রেগেছে। গোবিন্দকে বলেছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে, মগর ওরা ঝগড়া করে। খালি ঝগড়া। খালি এইজন্যেই আমাকে একদিন ভেসে যেতে হবে।
গোবিন্দ প্রথমটা একেবারে ভ্যাবাচাকা খেয়ে গিয়েছিল কিন্তু আর সকলের সঙ্গে সেও এ ব্যাপারে এখন বিস্মিত হয় না আর।
কেবল নন্দ-হরিশের মারামারির সময় বাড়িওয়ালা যখন ওদের পিটতে যায় তখন গোবিন্দ তাকে বাধা দেয়। সে দেখেছে লোটন বউ দরজা বন্ধ করলেই ওরা থেমে যায়। কিন্তু লোটন বউ পোয়াতী হওয়ার পর থেকে যেন সুখের দশা লেগেছে। নন্দ-হরিশ যেন কোন নতুন জগতে বন্ধনের সন্ধান পেয়েছে। তবু সেই জগৎও মাঝে মাঝে অন্ধকার হয়। ওরা মারামারি করে। যখন ওরা ভাবে, যে আসছে সে কার। লোটন বউ বলে, কারও নয়। আমাদের তিনজনের।