সৎকার
বাড়ির আঙিনায়, ব্রহ্মুপুত্রর পাড়ে, যমুনাকে শুইয়ে রেখেছে নূপুর। শিয়রে শিউলি গাছ। বাঁধানো কবরটির গায়ে শ্বেতপাথরে লেখা একটা এপিটাফও রেখেছে। এপিটাফটি লেখার সময় নানা কিছু ভেবেছে কী লিখবে। লিখে রেখেছে কিছু এই জন্য যে অন্তত মানুষ জানুক কেউ একজন এখানে শুয়ে আছে। নূপুর তো আর সারা জীবন থাকবে না। নিজের কবর তার বাঁধানোর কোনও ইচ্ছে নেই। নিজের উত্তরসুরী বলতে তার কেউ নেই। বাড়িটা তপুকেই সে দিয়ে যাবে। তপু কি আর এ দেশে এসে এ বাড়িতে থাকবে, যদি থাকেই বা বাড়িটা রাখে, বিক্রি না করে, তবে হয়তো যমুনার পাথরে বাঁধাই করা কবরটা তপু আর তার উত্তর সুরীরা রাখবে। না হলে কেউ হয়তো ভাঙবেই, এই কবরের ওপর বাড়ি ঘর বা রাস্তা গড়ে উঠবে, কল কারখানা গড়ে উঠবে। পৃথিবীতে কতকিছুই হবে, কত ভাঙা গড়া। কোটি কোটি বছরে মানুষ কত পাল্টে যাবে, কে যমুনা কোথাকার যমুনা তার হিসেব কে রাখবে! তবে নূপুর যতদিন আছে, ততদিন যমুনার কোনও অনিষ্ট হতে দেবে না। নূপুর জানে, যমুনা এসব দেখলে বলতো, ‘নূপুর, শরীরটা খুব বড় ব্যাপার নয়, তুই ভালোবাসিস, সেটাই বড়। তোর মনটা। আমাকে তোর মনে পড়বে, আমি যে কথাগুলো বলতাম, সে কথা আদৌ যদি ঠিক মনে হয় তোর, বলবি, বুবু ঠিক বলেছিল বা বুবু এরকম করতো, ঠিক আছে আমিও করবো তো! এতেই আমার জন্মের সার্থকতা। আমি তো আর পাবলিক ফিগার নই, নিতান্তই প্রাইভেট মানুষ। কিছু মানুষ ভালোবাসে। এতেই সুখ আমার। লাশ নিয়ে যারা লাফায়, তারা আত্মায় বিশ্বাস করে। আত্মা বলে কিছু নেই। আমি বিশ্বাস করি না। তোরও নিশ্চয়ই এইসব ফালতু সুপারন্যাচারাল জিনিসে বিশ্বাস নেই!’
ভাগ্যিস যমুনা নেই, তাই নূপুরের বিশ্বাস, যা তার ভালো লাগছে তা করতে পারছে। যমুনা মানুষের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতো, কিন্তু নূপুরের অনেক স্বাধীনতায় যমুনা হস্তক্ষেপ করেছে, করেছে তো বটেই। আজ যমুনা থাকলে যমুনার লাশকে কলকাতার মেডিকেলে দিয়েই তবে নূপুরকে বাড়ি ফিরতে হত, যমুনাকে কফিনে করে নিয়ে দেশে ফিরতে হত না। তপু শেষ পর্যন্ত আপত্তি করেনি। প্রথমে অবশ্য বলেছিল, ‘মা যা চেয়েছিল, যেভাবে চেয়েছিল, সেভাবেই সবকিছু হওয়া উচিত। আফটার অল, তার বডি। আজ সে নেই। কিন্তু তার ইচ্ছে ছিল, মেডিক্যাল কলেজে বডি দেওয়া। আমরা তার ইচ্ছের মর্যাদা দেব। ব্যস’।
নূপুর খুশি ছিল না তপুর ওভাবে নাকচ করে দেওয়া নূপুরের প্রস্তাব। জানে সে, নূপুরের চেয়ে যমুনার শবদেহ নিয়ে কী হবে না হবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তপুর বেশি। নূপুর বোন, কিন্তু বোন হলেও দীর্ঘ বছর দু’বোনের সম্পর্ক শীতল ছিল। টাকাটা যমুনার কাছ থেকে ধার নেওয়ার পরও সম্পর্ক আগের মতো উষ্ণ হয়নি। একটা আড়ষ্টতা ছিলই নূপুরের। জয়কে রিহ্যাবে নিয়ে যাওয়ার জন্য যমুনা যেভাবে চেষ্টা করেছিল, আর সে কারণে নূপুর যেভাবে যমুনাকে অপমান করেছিল, সেইসব গেঁথে গিয়েছিল সম্পর্কে। একের পর এক বছর পেরিয়েছে, নূপুর কবর দিতে পারেনি তার অপরাধবোধ। নূপুরের হেরে যাওয়াটা নূপুরকে কুণ্ঠিত করে রাখতো।
আজ সে এসেছে এখানে যমুনার ইচ্ছের বাইরে একটা সিদ্ধান্ত নিতে যেখানে উপস্থিত যমুনার নিজের মেয়ে। যে মেয়েটাকে মানুষের মতো মানুষ বানিয়ে তবে তার মা দুনিয়া ছেড়েছে। ব্যর্থতা শুধু নূপুরেরই। আবারও সেই জয়ের না থাকা, বেঁচে থাকলে কী কী হতে পারতো ও, সেগুলোরই হিসেব করছিল শুয়ে শুয়ে। রাত এগারোটায় ‘নূপু খালা, জেগে আছো?’ বলে ঘরে ঢোকে তপু।
নূপুরের দুটো হাত নিজের হাতে নিয়ে চুপু খেয়ে বলে, ‘তোমার সিদ্ধান্তই ফাইনাল সিদ্ধান্ত, নূপু খালা। আমি জানি মা তোমাকে কী ভীষণ ভালোবাসতো। তুমি কতটা বাসতে দেখিনি। কিন্তু মা’র ফ্যামিলিতে তুমিই একমাত্র যে মা’র দুঃসময়ে পাশে ছিলে। যে লোকটা, মানে আমার সো কল্ড ফাদার, আমাকে মেরে ফেলতে যাচ্ছিল, মা তাকে না সরালে আমিও বাঁচতাম না, মাও হয়তো বাঁচতো না আলটিমেটলি। আই ডোন্ট লাইক কিলিং। মা অন্যায় করেছে। বাট মা’র ওই সময় আর কোনও উপায় ছিল না, সে আমি বুঝি। ওই অবস্থায় পড়লে তুমি বা আমি হয়তো একই কাজ করতাম, যা মা করেছিল। তুমি ওইসময় মা’র পাশে বোনের মতো, মায়ের মতো, বন্ধুর মতো ছিলে। মা কখনও তোমার ওই উপকারের কথা ভোলেনি। তোমার ডিসিশান নূপুখালা, যদি দেশে নিয়ে যেতে চাও মা’কে, নিয়ে যাও, আমি আপত্তি করছি না। মা হয়তো তোমার সিদ্ধান্তই মেনে নিতো। হ্যাঁ ঠিক যে মা তার মরণোত্তর দেহ মেডিক্যালে দিয়ে গেছে, কিন্তু সে তো পাঁচ বছর আগে, পাঁচ বছরেরর মধ্যে মানুষের সিদ্ধান্ত তো পাল্টায়! পাল্টায় না? তুমি নিয়ে যাও। আর তাছাড়া বডি মেডিক্যালে দেওয়ার ডিসিশান নেওয়ার সময় মা যদি জানতো তার ময়মনসিংহের বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ আছে, তবে হয়তো তাই চাইতো মা, তার বাড়িতেই কবর হোক চাইতো। মা’র বডি ছাড়াও মেডিক্যাল সায়েন্সের চলবে’।
নূপুরের চোখে তখন জল, সে তপুর হাতদুটো নিজের দিকে টেনে তপুকে জড়িয়ে দু’গালে, কপালে চুমু খায়। ঠিক এভাবে যমুনাও খেত তপুকে চুমু। তপু টের পায় স্পর্শের মিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অনেক কেঁদেছে সে যমুনার জন্য, একা একা হারভার্ডের ঘরে বসে চোখের জলে ভেসে গেছে। চোখে বোধহয় আর জল নেই তপুর। সে আর কাঁদবে না। অন্তত নির্মলা আর নূপুরের সামনে নয়। যমুনার ঋজুতা আর দৃঢতা তপু উত্তরাধিকার সুত্রে পেয়েছে। যমুনার সংবেদনশীল মনও পেয়েছে। আজকাল সময় পেলেই যমুনাকে সে চিঠি লেখে। এই একটি কাজই সে যুক্তিহীনের মতো করে। তার মা মৃত, এই চিঠি কোনওদিন পড়তে পারবে না, জেনেও সে লেখে। লিখতে লিখতে একটা ব্যাপার লক্ষ করে তপু, তার যে যমুনার মারা যাওয়ার খবর শুনে শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল, সেটা কমেছে অনেক। চিঠিতে তার সব অনুভূতির কথা সারাদিন কী কী হল, কার সঙ্গে দেখা হল, কী কথা হল, ফিজিসিস্টরা নতুন নতুন কী সব বলছেন, সব লেখে। এতে করে অন্তত একটা জিনিস হয়, যাকে তার মনের সব কথা খুলে বলতো, এখনও তাকেই খুলে বলতে পারছে সব, মুখে বলছে না, লিখে বলছে, কিন্তু বলছে তো! তার একা লাগে না। মনে হয় না, যমুনা, যে তার মা ছিল, একই সঙ্গে বন্ধু ছিল সবচেয়ে বড়, নেই।
নূপুর কফিন নিয়ে ঢাকার বিমানে ওঠে। নূপুরকে বিদেয় দিয়ে বাকিটা সময় বিমান বন্দরেই কাটায় তপু। ঘণ্টা দুই পর তপু আমেরিকার উদ্দেশে রওনা হয়। একা বাড়ি ফেরে নির্মলা। ঘর দোর সেই রকমই রেখে গেছে। নির্মলাই থাকবে বাড়িতে। তপু মাঝে মাঝে আসবে। নূপুরও হয়তো কখনও আসবে। তপু বেড়াতে এলে বা ছুটি কাটাতে এলে হয়তো নূপুর আসবে তপুকে দেখতে। তপু কি যাবে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে কোনোদিন? এই প্রশ্ন নূপুর করেনি। নূপুরের মনে হয়েছে যে নানা নানি বেঁচে থাকতে একবার দেখতে চায়নি তপুকে, আমন্ত্রণ জানায়নি তপুকে, সেই তপু কেন আসবে ওই বাড়িতে? আর নূপুরই বা খালা হয়ে কী করেছে তপুর জন্য? কিছুই না। বিদেয় নেওয়ার সময় নূপুর মাথা নিচু করে ছিল লজ্জায়। একবার বলতে চেয়েছিল, ‘আর কারও জন্য আসিস না, কাউকে ক্ষমা করিস না, তোর মা’র জন্য আসিস, তোর মা’র শরীরটা তো রইল’। বলতে গিয়েও বলেনা নূপুর, কারণ ওইসব শরীর টরীরে তপু বিশ্বাস করে না, তা সে আগেই জানিয়ে দিয়েছে।
কত মানুষ বলে, প্রাণ ছিল, উড়ে গেছে, আত্মা আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। না, নূপুরও এসব বিশ্বাস করে না। কিন্তু যমুনার ওই মৃত শরীরটাকে, তার, সে জানে না কেন, মনে হয় যমুনা। হ্যাঁ প্রাণ নেই, অনুভূতি নেই, সেগুলো নেই, কিন্তু কফিনে শুয়ে থাকা মানুষটা তো সেই মানুষটাই। সেই মুখ, সেই নাক, সেই হাত, সেই পা, সেই বুক, সেই চিবুক।
মাঠে গন্ধরাজ গাছের তলায় যখন মাটি খোঁড়ার লোক ডেকেছিল, সবাই বলেছিল, মুসলমানদের মধ্যে কফিনে শোয়াবার নিয়ম নেই, বাঁশের ওপর কাফনের সাদা কাপড়ে আর ধাঁড়িতে মুড়িয়ে শুইয়ে দিতে হয় আর শরীরের ওপর গাদা গাদা মাটি ফেলে দিতে হয়। নূপুর শুনেছে কী করে লোকের কবর হয়। শোনাটুকুই। বাবা মা মারা গেলে কবরখানায় আর যে লোকই যাক, নূপুরের যায়নি। কারণ মেয়েদের নাকি কবরখানায় ঢুকতে নেই। কিন্তু যমুনার কবর হওয়ার সময় নিজে দাঁড়িয়ে থেকেছে। এপিটাফ লিখতে কাউকে পাঠায় নি, নিজে গেছে, নিজে বসে থেকে লিখিয়ে এনেছে। ছোট বাজারের এক দোকানী শ্বেত পাথরের ওপর লিখলো। লেখার সময় লোকটা বার বার অবশ্য বলছিল, ‘আপনি বাড়ি চলে যান, লেখা হয়ে গেলে আপনার বাড়িতে দিয়ে আসা হবে পাথর’। নূপুর বলেছে, ‘আমি বসে থাকি, আমার কোনো অসুবিধে নেই। আর বাড়ি তো খালি, বাড়িতে যাওয়ার অত তাড়াও আমার নেই’।
নূপুর নিজে হাতে শ্বেত পাথরটা নিয়ে বাড়ি ফেরে। শ্বেত পাথরের গায়ে খোদাই করা কালো অক্ষরে লেখা, ‘আমি আমার মতো বেঁচেছি, তুমিও তোমার মতো বেঁচে থেকো’। এটুকুই। শিউলি গাছের তলায় এই এপিটাফ কে দেখবে ভবিষ্যতে, তপুই হয়তো অথবা তার ছেলে মেয়ে অথবা ছেলে মেয়ের ছেলে মেয়ে। তার ছেলে মেয়েরা যদি বাংলা না বুঝতে পারে, বুঝবেও না হয়তো কী লিখেছে, না বুঝলে হয়তো অনুবাদ করিয়ে নেবে। অথবা কে জানে, কেউ একজন হয়তো বাংলা ভাষা শিখে এই ভাষায় বই লিখবে।
ক’জন মামা আর কাকা দেখে গেছে যমুনার কবর। ছোটবেলার খেলার সাথীরা এসেছে। সবাই খুব অবাক, শহরে এত কবরখানা থাকতে বাড়িতে কেন! নূপুর ম্লান হেসেছে। নাইম একদিন কোথায় যেন যাচ্ছিল ময়মনসিংহের ওপর দিয়ে, থেমেছে। তার নাকি পনেরো মিনিটের বেশি সময় নেই।
—’বুবুকে তো বাড়িতেই রাখলাম’। নূপুর বলে।
—’মানে?’
—’মানে তোমরা যা বল আর কী, কবর দেওয়া। সেটা বাড়িতেই হল’।
নূপুর নাইমকে মাঠের বাঁধানো কবরটা দেখায়।
-‘তোর মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেছে নূপুর’।
নাইম ধমকে বলে। অনেকক্ষণ ধরে বলে, মাথা খারাপ না হলে কোনও মানুষ যে এই উদ্ভট কাজটি করবে না। নাইম এই ধারণাটা গেঁথে দিতে চেষ্টা করে নূপুরের মস্তিষ্কে। নূপুর চুপ করে থাকে। তার মনে হয় নাইম বেশিক্ষণের জন্য না এসে পনোরো মিনিটের জন্য এসে ভালোই করেছে। অধীর আগ্রহে সে অপেক্ষা করেছে নাইমের প্রস্থানের। এ বাড়ি নাইমের নয়। এ বাড়ি নূপুরের, নূপুরই সিদ্ধান্ত নেবে এ বাড়ির মাটিতে সে কী পুঁতবে কী পুঁতবে না। যমুনার শরীর কী হবে না হবে সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারও আজ নেই নাইমের। তবে কীসের জোর তার গলায়? সে বেশি বোঝে! নূপুরের ঠোঁটের কোণে হাসি। এইসব মানুষের ভয়ে নূপুর চিরকাল গুটিয়ে থেকেছে। আজ তার রাগ হয় সেই সব ভয়ের দিনগুলোর কথা ভেবে। নাইম বা তার বউ কী বলবে, এই ভয়ে সে শওকতকে ডিভোর্স করেনি। তার কাকা মামা, তার পুরোনো প্রতিবেশীরা শুনে কী ভাববে তাই সে শওকতের মার সহ্য করেছে, অকথ্য অত্যাচার দিনের পর দিন সহ্য করে গেছে। শেষ পর্যন্ত সে ত্যাগই করেছে শওকতকে। কই তাকে কেউ কিছু বলার সুযোগ কি পাচ্ছে এখন? পেতো, যদি দেখতো নূপুর একটা অসহায় অবলা নারী। নূপুর এখন জীবনের শেষ কটা বছর নিজের মতো করে বাঁচতে চায়। সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যখন যমুনা বারবার নূপুরকে বলতো আলাদা অ্যাকাউন্ট খুলতে। আমেরিকায় পা দেওয়ার কদিন পরই নূপুর চাকরি করতে শুরু করেছে। বেতন গিয়ে জমা হত জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে। নূপুর যমুনাকে বলতো, জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে অসুবিধে হচ্ছে না। আলাদা অ্যাকাউন্ট করবো কেন, আমাদের কী ডিভোর্স হচ্ছে নাকি, নাকি শওকত টেইক কেয়ার করছে না!
—টেইক কেয়ার করছে শওকত। কিন্তু তারপরও নিজের নামে অ্যাকাউন্ট কর।
—শওকত ভাববে আমি তাকে বিশ্বাস করছি না।
—যে যাই ভাবুক, তুই আলাদা অ্যাকাউন্ট কর। আলাদা অ্যাকাউন্ট থাকলে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায় না। সারাজীবন সুখে শান্তিতে বাস কর। কিন্তু অ্যাকাউন্টটা তোর হোক।
নূপুর তখনও যমুনার উপদেশকে ফালতু বলে উড়িয়ে দিয়েছে। উড়িয়ে দিয়েছে কারণ শওকত উড়িয়ে দিতে বলেছিল। বলেছিল, ‘নিজের তো হাজবেণ্ড নেই, সংসার নেই, সমাজ নেই। হাজবেণ্ড থাকলে যে জয়েন্ট অ্যাকাউণ্ট থাকতে হয়, এটাই তোমার বোন জানে না। জানবে কী করে! তোমাকে কুবুদ্ধি দিয়ে তোমার মাথাটা নষ্ট করছে।’
একসময় আলাদা অ্যাকাউন্ট খুলেছে নূপুর। টাকা যত শক্তি দিয়েছে নূপুরকে, তত আর কিছুই দেয়নি। যমুনাও সম্ভবত দেয়নি।
জয়ের জন্য গাড়ি কিনেছিল নূপুর। যমুনা শুনে বলেছিল, —কাজটা ভালো করিস নি নূপুর। ও গাড়ি না চাইতেই গাড়ি কিনে দিয়েছিস, পনোরো বছর বয়সী ছেলে গাড়ি চালাবে কেন।
—ষোলো বছর তো এইতো হচ্ছে। ষোলোতেই আমেরিকায় গাড়ি চালাতে পারে।
—জয়ের গাড়ির দরকারটা কেন শুনি। ও ইস্কুলে যাবে, অন্য কোথাও যাবে, ভালো পাবলিক ট্রান্সপোর্ট আছে। মেট্রো আছে, বাস আছে।
—তুমি জানো না বুবু। গাড়ির একটা দরকার হয়। ওর অনেক বন্ধু লং আইল্যাণ্ডে থাকে। ওখানে যেতে চাইলে আমরা গাড়ি ভাড়া করে ওকে ওর বন্ধুদের বাড়ি পৌঁছে দিই। আবার ওকে নিয়ে আসার জন্যও যেতে হয়। ও বলেছে, ওর একটা গাড়ি হলে ভালো হত।
—ভালো হত। অবশ্যই। কিন্তু বয়সটা হতে দে।
—এই দেশে সব ছেলেই ষোলো বছর হলেই গাড়ি চালায়।
—সব ছেলেই চালায়। এটা আমি বিশ্বাস করিনা।
—তুমি এ দেশে থাকো না। তুমি জানো না। আমি এ দেশে থাকি।
শওকত বারবার নূপুরকে বলেছে, সব ছেলেরই গাড়ি আছে, অথচ জয়ের গাড়ি নেই, ভাবলে তার মরে যেতে ইচ্ছে করে লজ্জায়। শওকতের কাছে অত টাকা নেই গাড়ি কেনার। খুব দামি একটা গাড়ি শেষে নূপুর নিজেই কিনে দেয় জয়কে। যমুনার কোনও উপদেশই বলতে গেলে নূপুর মানে না।
জয় যখন এই গাড়ি নিয়ে বন্ধুদের বাড়িতে বসে ড্রাগ সেবন করার পর লং আইল্যাণ্ড থেকে ফিরছিল, গাড়ি ধাক্কা খেলো একটা থামের সঙ্গে, তখন জয়ের আর বাঁচার জন্য কোনও যুদ্ধ করতে হয়নি, মাথায় আঘাত লেগে ওখানেই রক্তক্ষরণ, ওখানেই মৃত্যু। অন্য দিনের মতো সেদিনও নূপুর ফোনে জয়কে বলছিল, বাবা রাত হয়ে গেছে তুমি থেকে যেও বন্ধুর বাড়িতে। সকালে ফিরে এসো। অথবা আমি গিয়ে নিয়ে আসবো। না, রাতেই সে ড্রাইভ করবে। রাতেই সে যেখানে খুশি সেখানে যাবে। ‘লাইফ ইজ ফান’, নূপুরকে বুঝিয়েছে, ‘ইউ গাইজ ডোন্ট হ্যাভ এ লাইফ, হোয়াই ডোন্ট ইউ গেট এ লাইফ’। জয় প্রায়ই বলেছে এমন কথা। যে রাতেই জয় লং আইল্যাণ্ড যায় আর রাত করে বাড়ি ফেরে, নূপুর দরজা খুলে বসে থাকে আর ঘড়ি দেখতে থাকে। জয় আসবে, জয়কে খাওয়াবে, শোওয়াবে, তারপর নিজে শুতে যাবে। জয় গাড়ি চালাতে থাকলে নূপুর ফোন করে না। গাড়ি চালানোর সময় ফোন বাজালে আবার ক্ষতি হয় যদি। ফোন এল সেদিন, নূপুর দ্রুত ধরলো সে ফোন, তবে সে ফোন জয়ের ফোন নয়, পুলিশের ফোন।
শওকত দেখতে গেছে জয়ের থেতলে যাওয়া শরীর। নূপুর যায়নি। নূপুর ওভাবেই দরজার কাছে ঠাঁয় বসে ছিল। সকালে তিনটে সুটকেসে কাপড় চোপড় আর নিজের জরুরি জিনিসপত্র নিয়ে নূপুর বেরিয়ে যায়। শওকতের ঘর থেকে সেই তার শেষ বেরোনো। আর পেছন ফিরে তাকায়নি। চেনা পরিচিত অনেকে ছিল। কোথাও না উঠে কাছের একটা হোটেলে ওঠে। সেই ভালো, ভেবেছে নূপুর। কারও বাড়িতে আশ্রয় না-চাওয়ার মতো সুখ আর কী আছে! হোটেলের রুম ভাড়া নিতে কিছু টাকা খরচ হবে, কিন্তু দিনভর তো কারও একশ প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে না। ওখান থেকেই একটা ভাড়া বাড়ির খোঁজ করে নূপুর। ভাড়া বাড়ি বলতে কারও বাড়ির বেইসমেন্টে একটা রুম। মাটির তলায় থাকা। নূপুরের অসুবিধে হয়নি। চেনা পরিচিতদের সাহায্য পেয়েছে। এত দীর্ঘ বছর আমেরিকায় থেকে কাজ করে আজ কেন বেইসমেন্টের একটা রুম জোটে কপালে! কারণ যা সে কামিয়েছিল, তা জমিয়েছে জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে আর অন্ধের মতো জয়-এর পেছনে খরচ করেছে। জয়কে বুঝতে দিতে চায়নি জয় কোনো কোটিপতির ছেলে নয়। গরিব দেশ থেকে ধনী দেশে পাড়ি দেবো, ধনী দেশে যে সন্তান জন্মাবে, তারা ধনী দেশের ধনীদের মতো জীবন যাপন করতে চাইবে। এ ভালো জানে নূপুর। নিজের ইমিগ্রেন্ট পরিচয়, নিজের বাদামী রং, নিজের কালো চুল, নিজের ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন ভাষা ঢাকা দিতে একটা কালো পর্দা কিনেছিল, সেই পর্দার মূল্যই কোটি টাকা। ছেলে জয় যেন কালো পর্দার আড়ালের জিনিসগুলো কিছুই না দেখে। দামি সেলফোন, দামি ল্যাপটপ, দামি টিভি, দামি কাপড়চোপড়, দামি আসবাব জয়কে উজাড় করে দিয়েছিল। ধনকুবেরের ছেলে যেভাবে জীবন যাপন করে, জয়কে সেভাবেই দিয়েছে জীবন যাপন করতে, যেন মনে তার কোনও কখনও কোনও কষ্ট না হয় তার বাবা মা আত্মীয় স্বজন গরিব দেশের লোক বলে, তারা কেউ সাদা আমেরিকান নয় বলে, আমেরিকার উচ্চারণে ইংরেজি বলতে জানে না বলে, ছোট চাকরি করে বলে।
প্রায় পাঁচবছর হল শওকতের সঙ্গে সম্পর্ক নেই নূপুরের। নূপুর একটা চিঠি লিখে বেরিয়ে এসেছিল। চিঠিটা এরকম, ‘আমি যাচ্ছি, আমার ছেলের মৃত্যুর জন্য আমি তোমাকে দায়ী করছি, তোমার পরামর্শ মতো বা আদেশ মতো আমি জয়কে বড় করেছিলাম, আমার মতো করে কিছু করতে, সেই বিয়ের পর থেকেই, তুমি কোনোদিন আমাকে দাওনি। জয় নেই। এই সংসারের কোনও আকর্ষণ আর নেই আমার কাছে। তোমার সেবা আমি অনেক বছর করেছি। এবার নিজের সেবা করতে যাচ্ছি। কারণ এ বাড়িতে থাকলে নিজের অস্তিত্ব, নিজের সত্তা, নিজের বোধবুদ্ধি সব বিসর্জন দিয়ে থাকতে হয় তো।
আমার খোঁজ করো না। আমি যেখানেই থাকবো, ভালো থাকবো, অন্তত তোমার সঙ্গে সংসার করতে গিয়ে যে যন্ত্রণা আমি সয়েছি, এই যন্ত্রণা তো আমার সইতে হবে না। একটু অর্থনৈতিক অবস্থা হয়তো খারাপ হবে, তাতে কী! শান্তি তো থাকবে। কারও দাসি হয়ে তো থাকতে হবে না।
জয় নেই। আমার আর কোনও পিছুটান নেই। এখন আর দিনের পর দিন তোমার সঙ্গে অসহ্য দিন কাটানোর কোনও ইচ্ছে আমার নেই। এবার নিজের ইচ্ছেকে মর্যাদা দেবো আমি। সারাজীবন তো দিইনি। বাকিটা জীবন নিজের মতো করে বাঁচবো।
জয়-এর ডেডবডি নিয়ে কী করবে, সে নিয়ে আমার কোনও উৎসাহ নেই। ওর মৃত মুখ আমি দেখতে চাই না। ওকে দেশে কবর দেবে নাকি এখানে, সে সম্পূর্ণ তোমার সিদ্ধান্ত। তোমার সিদ্ধান্তেই এ যাবৎ সংসার সন্তান চলেছে। জয়-এর জীবন কী রকম হবে তা নিয়ে যেমন জয়-এর জন্মের পর আমার কোনও সিদ্ধান্তের গুরুত্ব ছিল না, জয়-এর মৃত্যুর পরও যে আমার সিদ্ধান্তের কোনও গুরুত্ব থাকবে না, সে আমি জানি বলেই আমি বাড়ি ছাড়লাম। আমার অভাব তোমার অনুভব করার কথা নয়। অভাব যদি একান্তই অনুভব করো, সে তোমার জন্য বাজার করা, রান্না করা, মুখরোচক খাবার পরিবেশন করা, তোমার ঘর পয়-পরিষ্কার রাখা, তোমার বিছানাপত্র গুছিয়ে রাখা, তোমার কাপড় চোপড় কেচে ইস্ত্রি করে রাখা, তোমার যখন প্রয়োজন তোমাকে সঙ্গ দেওয়া, এসবের অভাবই অনুভব করবে। এর জন্য যে কোনও কোনও চাকর রেখে নিলে পারো, অবশ্য এতে তোমার টাকা খরচ হবে অনেক। কিন্তু বিয়ে করে নিলে আর কোনও সমস্যা নেই। বউ-এর উপার্জিত টাকাও তুমি ভোগ করতে পারবে, ওকে চাকরবাকরের মতো ব্যবহারও করতে পারবে। আমার ভাবতে লজ্জা হয়, যে মানুষটা কোনও অন্যায়ের সামনে মাথা নত করেনি, পুরুষের কোনও বুলিকে পাত্তা দেয়নি, সারা জীবন সংগ্রাম করে গেছে নিজের মতো করে বাঁচার জন্য, তার বোন আমি! সত্যি বলছি আমি আমার যমুনা বুবুর বোন, ভাবতে আমার লজ্জা হয়। আমি আমার বুবুকে কত ঘৃণা করেছি, কত তার সঙ্গে জঘন্য ব্যবহার করেছি, এমনকি নিজের বোনকে এই বিদেশ বিভুঁই-এ বাড়ি থেকে বেরও করে দিয়েছি। তোমার কারণেই দিয়েছি। তুমি আমার মাথাকে দিনের পর দিন আমার বোনের বিরুদ্ধে বলতে বলতে বলতে বলতে একরকম বিগড়ে দিয়েছিলে। আমি তো এমন ছিলাম না আগে। তুমিই আমাকে আমার প্রিয় বোনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বারণ করেছিলে বলে আমি যোগাযোগ করিনি। যে বুবু আমার মা, আমার বন্ধু, আমার বোন, আত্মীয় বলতে একজনই আছে, তার সঙ্গে আজ আমার কোনও যোগাযোগ নেই। আমিই রাখিনি। বুবুর কথা যদি শুনতাম, তাহলে জয়কে মরতে হয় না। বুবুর কথা শুনলে আমি রিহ্যাব-এ টেনে হিঁচড়ে দিয়ে আসতাম। বুবু কত অপমান সয়েও জয়কে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল। দোষ শুধু তোমার নয়, দোষ আমারও। তুমি আমার বোধবুদ্ধি নষ্ট করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু বুবু তো আমার বোধ জাগানোর কম চেষ্টা করেনি। তোমার কথা শুনেছি, বুবুর কথা কেন শুনিনি! দোষ আমারও অনেক।
মানুষের বোধোদয় ঘটে, কারও আগে, কারও পরে। আমার না হয় পরেই ঘটলো, কিন্তু আমি শান্তি পাচ্ছি এই ভেবে যে, ঘটেছে। দেরিতে হলেও ঘটেছে। বাকিটা জীবন, সে যতদিনই বাঁচি, আর যাকেই প্রয়োজন হোক, তোমাকে প্রয়োজন হবে না।
আমার খোঁজ করো না’।
নূপুরের এখনও সেই দিনগুলো চোখের সামনে ভাসে। জয়কে নূপুর দোষ দেয় না, জয়ের পরিণতির জন্য দোষ দেয় শওকতকে, আর নিজেকে। যমুনা যখন রিহ্যাব-এর কথা বলেছিল, নূপুর এ নিয়ে শওকতের সঙ্গে কথা বলেছিল, —মনে হয় রিহ্যাবে দেওয়া দরকার জয়কে।
শওকত চোখ কুঁচকে বলেছিল, কেন?
বুবু বলছিল জয় নাকি ড্রাগ নেয়।
শওকত দাঁত খিঁচিয়ে বলেছিল—তোমার বোন ড্রাগ নেয়। আমার ছেলে নেয় না। তোমার বোনের চরিত্র কী তা সবাই জানে। কত লোকের সঙ্গে শুয়েছে? সে কি না, কত বড় সাহস আমার ছেলের নিন্দা করে! আসলে তোমার বোন বলে আমি তাকে অ্যালাও করেছি আমার বাড়িতে ঢুকতে, না হলে কোনও ক্ষমতা ছিল আমার বাড়িতে ঢোকার?
—আমার জন্য এসেছে। আমি না থাকলে কি আসতো!
—আমি চাইনা সে আমার বাড়িতে আসুক বা থাকুক। এক দিনও, এক ঘণ্টাও থাকুক চাই না। তুমি না থাকলে আমি আজ ঘাড় ধরে দুশ্চরিত্র মহিলাকে বের করে দিতে পারতাম! একটা জারজ বাচ্চা নিয়েছে। আবার একটা লোককে, যার সঙ্গে শুয়েছে, তাকেই খুন করেছে। এর তো ফাঁসি হয়ে যেত দেশে, নয়তো সারাজীবন জেলের ভাত খেতে হত। আজ কি না তিনি আমেরিকায় বেড়াতে আসেন। এর মুখ কী করে দেখ তুমি! দেখ খোঁজ নিয়ে আমেরিকায় কার পয়সায় এসেছে। কারা আনে তাকে, কী জন্য আনে, খোঁজ নাও। আমার ছেলের ধারে কাছে যেন ওই মহিলা না যায়। নিজের ছেলে নেই তো, তাই হিংসে করছে তোমাকে। শুধু তোমার বোন বলে, নাহলে…’
শওকত দাঁতে দাঁত চেপে হাতগুলো নাড়তে থাকে এদিক ওদিক। তার আসলেই ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে যমুনাকে।
—যে এমন দুশ্চরিত্র বোনকে সাপোর্ট করে, তার চরিত্রও খারাপ।
শওকত জোরে বলে। যেন যমুনা অন্য ঘর থেকে শুনতে পায়। নূপুরের হাত পা কাঁপে। এত বছর ধরে শুনছে একই কথা, তারপরও তার কাঁপন যায় না। নূপুর আরও কুণ্ঠিত, আরও সংকুচিত হতে থাকে। এই কথাগুলো কেঁচোর ওপর নুন যেমন কাজ করে, নূপুরের ওপর ঠিক তেমন কাজ করে। আর সেটা শওকত সবচেয়ে ভালো জানে। নূপুরের ধীরে ধীরে রাগ জন্মায় যমুনার ওপর, আবার শওকতের অমন গালিগালাজ যেন যমুনার কানে না যায়, তাও সে চায়।
জয়ের ড্রাগ সেবন নিয়ে নূপুর হয়তো অজ্ঞ ছিল, তার মনে হয় শওকত ছিল না। শওকত জানতো কোথাও ভুল হচ্ছে, কিন্তু তারপরও সে ভুলটাকেই ঠিক ভেবেছিল। ধনীর ছেলেরা যদি ড্রাগ খেতে পারে, জয় খাবে না কেন? জয় তো আর রাস্তার ফকিরদের সঙ্গে বা গরিব ইমিগ্রেন্টদের সঙ্গে বসে খাচ্ছে না। জয় রীতিমত লং আইল্যাল্ডের সাদা আর ধনী বন্ধুদের সঙ্গে চলছে। এ না খেলে হয়তো স্ট্যাটাস টাই রাখা যেত না।
নূপুরের জানতে ইচ্ছে করে না শওকত কতটা অনুতপ্ত। জয়ের মৃত্যু নূপুরকে সজাগ করেছে। যমুনার আর নূপুরের মধ্যে পার্থক্য হল, যমুনা তার সন্তানের মৃত্যুর আগে সচেতন হয়েছে, আর নূপুর হয়েছে পরে। নাহ, আর দুঃখ করে লাভ নেই। জয় তার একার সন্তান ছিল না। দুজনেরই রক্ত ছিল জয়ের শরীরে। জয় সেই বাচ্চা বয়স থেকে হিংসুক, এটা চাই ওটা চাইএর বায়না, কাউকে নিজের বিছানায় বসতে দেবে না, কাউকে ঘরে ঢুকতে দেবে না, কারও সঙ্গে হেসে কথা বলবে না। এসব শওকতের রক্ত। নূপুরের যদি সামান্য রক্ত পায় ও, তাহলে নূপুরের মতো হাসিখুশি কেন হল না জয়! নূপুর এই প্রশ্নের উত্তর পায় না। তাহলে জিন টিনের ব্যাপার নেই। বাচ্চাকে কী পরিবেশে বড় করো, সেটার ওপরই নির্ভর করে অনেককিছু! রাজপুত্রর মতো জয়ের আচরণ। রাশি রাশি খাবারের অর্ডার দেবে, তার সব চাই। দৌড়ে গিয়ে কিনে এনেছে শওকত আর নূপুর সেইসব খাবার। প্রচুর টাকা গেছে, সেদিকে কোনওদিন ফিরে তাকায়নি জয়। জয় দু’বছর বয়স থেকে কোনোদিন ঘরে তৈরি খাবার খায়নি। ঘরের খাবারকে বলতো ডিসগাস্টিং। গরিব দেশের খাবার। ভাত মাছ! ওয়াক! কোথায় এসব কথা বা আচরণ শিখত জয়, নূপুর জানে না।
নূপুর বলতো, বাড়ির খাবার ভালো, ভালো খাবার খাও।
শওকত নূপুরকে ধমক দিয়ে বলতো, যে খাবার আমার ছেলে খেতে চাইবে, সে খাবার যেখান থেকে পারি, যত টাকা দাম হোক, দেব ছেলেকে কিনে।
এরপর থেকে জয়-এর অভ্যেস হয়েই গিয়েছিল ফ্রেঞ্চ, ইটালিয়ান, মেক্সিকান, চায়নিজ, জাপানিজ খাবার আনানো। নূপুর খুশি হতো যদি খেতো। কিন্তু জয় বেশিরভাগই ফেলত। জয়-এর দরজার সামনে হুকুমের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতো শওকত। দিনের পর দিন দেখতে দেখতে নূপুরও অংশগ্রহণ করতে শুরু করেছে। তার ভয় হত, জয় নুপুরকে কাছে ডাকছে না, শওকতকে ডাকছে, শওকতকে পছন্দ করছে। তখন নূপুরও শুরু করলো জয়-এর অর্ডার পালন করতে। অল্প বয়স থেকে জয় সিদ্ধান্ত নেয় সে কী খাবে, কী পরবে, কী পড়বে, কখন ঘুমোবে, কখন জাগবে, তার কী কী চাই, কী কী না চাই সব। নূপুরও ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতো জয়-এর মনোযোগ আকর্ষণ করতে। জয় যেন নূপুরকেও খানিকটা ভালোবাসে। যেন অবহেলা না করে। যেন ধমকে কথা না বলে, যেন ঘৃণা না করে। এরপর শওকতের আর নূপুরের মধ্যে রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল, কে জয়ের স্বীকৃতি পাবে, শওকত নাকি নূপুর। সে কী ভয়ংকর প্রতিযোগিতা। জয় তার ঘর থেকে আওয়াজ দিলে শওকত আর নূপুর দুজনই হুড়মুড়িয়ে ছুটে যায়। কী চাই বাবা, কী খাবে বাবা, কিছু লাগবে বাবা?
ফ্ল্যাটের দুটো বড় ঘর ছিল জয়ের, একটা জয়ের শোবার ঘর, শোবার ঘরে পালঙ্ক, প্লাজমা টিভি, হোম থিয়েটার, প্রজেক্টর, নানা কিছু। আরেকটা ঘর লেখাপড়া আর খেলাধুলা করার। ড্রইংরুমের এক কোণে শওকত আর নূপুর ঘুমোতো। ক’দিনই আর ঘুমিয়েছে নূপুর। কান পেতে থাকতো সারারাত, যদি জয়ের কিছু দরকার হয়। শওকত আর নূপুর নিজেদের ছেলেকে মানুষ করার সুযোগ পায়নি। বরং তাদের ছেলে নিজের বাবা মাকে অমানুষ করার সুযোগটা হাতছাড়া করেনি। তাছাড়া আর কী!
নূপুর ভাবতো, জয় সম্পূর্ণই শওকতের রক্ত পেয়েছে, সে কারণেই এই বিদঘুটে মানসিকতার হয়েছে, নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছু বুঝতে চায় না, কোনো সহমর্মিতা নেই, মানবিকতার লেশমাত্র কিছু নেই। যমুনাকে জানিয়েছিল নূপুর, যমুনা বলেছিল, ‘জিন বা রক্তই সব কথা হলে পাশার মতো পাষণ্ড হত তপু, কী পরিবেশে বড় হচ্ছে, কী শিখছে, কী দেখছে, সেটা দেখতে হবে। বাচ্চাদের ওপর পরিবেশের প্রভাব অনেক বেশি। তোদের কোথাও ভুল হচ্ছে। বাচ্চা জন্ম দেওয়া সোজা। বাচ্চা মানুষ করা কঠিন। ওকে রিয়ালিটি থেকে দূরে সরিয়ে রাখছিস, মনে হচ্ছে। একটা আনরিয়েল ওয়ার্ল্ড দিয়েছিস ওকে তোরা, একটা ইলিউশান, যেটা ঠিক হচ্ছে না’। সমস্যা নিয়ে কথা বললেই যমুনা বলতো ‘তোর ভুল হচ্ছে, তোর ঠিক হচ্ছে না’। যমুনার সমালোচনা তীরের মতো লাগতো নূপুরের গায়ে। যমুনার উপদেশ মানা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না, যমুনা বলতো, বাইরের খাবার চাইলে বলবি ওটি হচ্ছে না বাপু, ঘরের খাবার খেতে হবে। তোরা যখন খেতে বসবি, ওকে ডাকবি। তোদের সঙ্গে বসে কখনও ও কিছু খায় না, কারণ অভ্যেস করাসনি। সময় তো চলে যায় নি। এখনও সময় আছে অভ্যেস করানোর। যদি বলে খাবো না, বলবি ঠিক আছে, শুতে চলে যাও।
—শুতে চলে যাবে না খেয়ে?
—হ্যাঁ না খেয়ে। এক রাত না খেয়ে থাকলে কেউ মরে যায় না। ক্ষিদে পেলেই খাবে। যা পায় হাতের সামনে তাই খাবে। তখন আর বলবে না, আমি ফ্রেঞ্চ খাবার খাবো, ইটালিয়ান খাবো, আমার জন্য পিৎজা নিয়ে এসো, আইসক্রিম নিয়ে এসো, চকলেট নিয়ে এসো। বাইরের খাবার খেয়ে হেলথ টাও তো নষ্ট হচ্ছে। ঘরের স্বাস্থকর খাবার খাওয়া ভালো, এ তো তোরাও জানিস।
নূপুর হয়তো যমুনার এই পরামর্শ মেনে চলতো, কিন্তু শওকত মানেনি। আমার ছেলে যা খেতে চায়, তাই আমি খাওয়াবো। নিজে না খেয়ে থাকতে হয় যদি তার জন্য, থাকবো। শওকত জয়কে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে। যেন জয় তাকে একবার বাবা বলে ডাকে। যেন জয় তাকে বাবার স্বীকৃতিটা দেয়। জয় তার বাবা মাকে ‘হেই, ইও, রিটার্ড’ এসব বলে ডাকে। নূপুরেরও বড় ইচ্ছে, জয় তাকে মা বলে ডাকুক। বুদ্ধি হওয়ার পর আর ডাকেনি। যমুনা শুনে বলেছে, বুদ্ধি হওয়ার পর বলিস না, বল নির্বোধ হওয়ার পর।
নূপুর যমুনার কবরটার সামনে গার্ডেন চেয়ার পেতেছে চারটে। একটা টেবিল। দুলি চা টা দিয়ে যায় বাগানে। এক চেয়ারে পা তুলে দিয়ে আরেক চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকে নূপুর, ফ্লাস্কে চা থাকে। চা শেষ হয়ে গেলে দুলি আবার ফ্লাস্ক ভরে চা দিয়ে যায়। নূপুর পেছনের কথাই ভাবে আর কলকাতার বাড়ির খাটের পাশে যে বইগুলো ছিল, নিয়ে এসেছে, সেই বইগুলো পড়ে। যমুনার পড়া বা এখনও না-পড়া বইগুলো। হয়তো পড়তো বেঁচে থাকলে। নূপুর যেন যমুনাকে পড়ে দিচ্ছে। কিছু বই আর ছবি ছাড়া কলকাতার বাড়ি থেকে আর কিছু আনেনি নূপুর। ঠিক যেভাবে ছিল বাড়ি, সেভাবেই আছে। বসে থাকা আর বই পড়া। এ ছাড়া তার আর কাজ কী! বয়স পঞ্চাশ হল। যমুনার পঞ্চান্ন হয়েছিল। এপিটাফে জন্ম মৃত্যুর তারিখ সাল কিছুই লেখেনি নূপুর। ইচ্ছে করেই লেখেনি।
নূপুরের গায়ে ব্রহ্মপুত্রের হাওয়া, যে গাছগুলো যমুনার বাঁধানো কবরের চারপাশে বড় হচ্ছে, সে গাছগুলোর পাতা হাওয়ায় নাচে। সবগুলো গাছই যমুনার প্রিয়। শিউলি, গন্ধরাজ, কাঁঠালিচাপা, জুঁই, কামিনী, হাসনুহানা। দেখতে দেখতেই বড় হয়ে যাবে। ফুল ফুটে চারদিক আশ্চর্য সুন্দর হয়ে থাকবে, টুপটাপ করে ঝরবে ফুল পাতা, পাথরে, ঘাসে। সুগন্ধ ছড়াবে চারদিকে। ব্রহ্মপুত্রর হাওয়াও এই সুগন্ধ গায়ে মেখে উড়ে বেড়াবে।
যারাই নূপুরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে, আত্মীয় স্বজন, চেনা পরিচিত, সবাই নূপুরের কাজকে বাড়াবাড়ি বলেছে। নূপুর সেই একইরকম ম্লান হাসি হেসেছে। কফিনে শুয়ে আছে যমুনা শুনে কেউ কেউ বলেছে, ক্রিশ্চান হয়ে গিয়েছিল যমুনা! নূপুরের সত্যি বলতে কী, কারও কথায় কিছু যায় আসে না। জব্বার কাকা এসে বলেছে, যমুনা তো আমেরকায় থাকতো। তাই না? এত দূরে ডেডবডি আনার দরকার কী ছিল, ওখানেই কবর দিয়ে দিলে পারতি! আমেরিকায় তো মুসলমানদের কবরখানা আছে, তাই না? নাকি ওরা খ্রিস্টানদের সঙ্গেই কবর দেয়!
নূপুর হ্যাঁ না দুরকমই মাথা নাড়ে। তার ইচ্ছে হয় না জব্বার কাকার সঙ্গে বসে অনেকক্ষণ গল্প করে। সুলেখা এসেছিল, ওই একই কথা, ‘যমুনাবু মরেছে বলে এত চোখের জল ফেলছো কেন, এরপর তো তুমিও যাবে, আমিও যাবো। আমাদের তো নিজেদের কথা ভাবারই সময় হয় না। কেবল পরকে ভেবেই জীবন পার করি!’
—ক্ষতিটা কী এতে?
সুলেখা চোখ কুঁচকে চারদিক দেখে নিয়ে নূপুরের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে, —’ তুমি নাকি মুসলমান মতে কবর দাওনি! কবরখানায় কবর দিলে ফেরেসতা আসতো, এখানে তো ফেরেসতা আসবে না!’
এই ব্রহ্মপুত্রর পাড়ে ফেরেসতা আসবে না। ফেরেসতা আসে কবরখানায়। এ কথা নূপুর প্রথম নয়, প্রায় প্রতিদিনই শোনে। যার বাবা নেই, মা নেই, ভালোবাসতো যে বোনটা নেই, অত সাধের নিজের ছেলেটা নেই, সংসারটাও যে স্বেচ্ছায় লোকে কী বলবে না বলবে তার দিকে না তাকিয়েই ছেড়েছে, তার কাছে আজ পুরোনো এক ছোট শহরের ছোট মনের ছোট ছোট মানুষের কথা গায়ে লাগে না। এই শহরে আর যা কিছুর জন্যই সে এসেছে, এই মানুষগুলোর সঙ্গে তথাকথিত সামাজিক জীবন কাটাতে আসেনি।
নূপুর বরং দুলিকে কাছে বসিয়ে গল্প করতে আনন্দ পায়।
নূপুরের বসে থাকা প্রতিদিন যমুনার শুয়ে থাকার পাশে, দৃষ্টি তার প্রতিদিন ব্রহ্মপুত্রে। ওই নদীতে যমুনা আর নূপুরের শৈশব কৈশোর কেটেছ, ওই জলে আর হাওয়ায়, ওই পাড়ে আর দ্বীপে। ইস্কুল ফেরা প্রতিটা বিকেলই ছিল খেলার বিকেল। ব্রহ্মপুত্রের সেই পাড়, সেই হাওয়া, সেই কাশফুল, সেই দ্বীপ, সেই খেয়া নৌকো, সেই ঝাঁক ঝাঁক স্মৃতি আর যমুনাকে পাশে নিয়ে বসে থাকে নূপুর। সন্ধে নামলে তবে ঘরে যায়।
দুলির সঙ্গে গল্প করে দিনের অনেকটা সময় কাটে নূপুরের। নূপুর ফুলির কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চায়। ফুলপুরের কোনও এক গ্রামে নাতি নাতনি নিয়ে ফুলি থাকে। স্বামী মারা গেছে। যমুনার ঢাকার ফ্ল্যাট থেকে পালিয়ে ফুলি কোথায় গিয়েছিল? এই প্রশ্নটি অনেকবার করেও উত্তর মেলেনি। দুলির সেসব কিছু মনে নেই। দুলি ছোট ছিল। দুলির মা এ বাড়িতে কাজ করতো, দুলি ফুটফরমাশ খাটতো। সেই ছোট দুলি এখন বড় হতে হতে অনেক বড় হয়েছে। বিয়ে হয়েছিল। তালাকও হয়ে গেছে। স্বামী আবার বিয়ে করেছে, দুলি আর তার মেয়েকে খেতে পরতে দেয় না। নূপুর এসে দুলি আর ফুলির খোঁজ করে দুলিকে পেয়েছে। নদীর ওপারের শহর শম্ভূগঞ্জ থেকে ওদের এনেছে, অভাবে ভুগছিল এক দূরাত্মীয়র বাড়িতে। এখন নিজের মেয়েটাকে নিয়ে এ বাড়িতেই থাকে, বাড়িটাকে গুছিয়ে রাখে, রেঁধে বেড়ে নূপুরকে খাওয়ায়। বাড়িটায় অনেকগুলো ঘর, ঘরগুলোয় ঝাঁক ঝাঁক স্মৃতি। মাঝে মাঝে নূপুরের মনে হয় পাশের ঘরে বোধহয় তার মা শুয়ে আছে, ওই বুঝি বাবা এলো, যমুনা বুঝি দৌড়ে এসে বলবে চল নদীর পাড়ে চল, প্রচুর কাশ ফুল ফুটেছে। ওই বুঝি খালি পায়ে চলে গেল ওরা। নদীর চরে বাদাম গাছের মাঝখান দিয়ে মাইল মাইল চরের পথ হাঁটলো বাদাম খেতে খেতে, বালি দিয়ে বাড়িঘর বানিয়ে সন্ধে হওয়ার আগে আগে দৌড়ে এসে পড়তে বসলো ইস্কুলের বই। নূপুর পড়ছে ইতিহাসের বই, যমুনা পড়ছে বিজ্ঞানের বই।
যমুনার মৃতদেহ বাড়িতে কবর দেওয়ার পেছনে কোনও যুক্তি নেই নূপুর জানে, কিন্তু ভালোবাসা আছে। সবসময় যুক্তি, বুদ্ধি ভালো লাগে না নূপুরের। মাঝে মাঝে অযৌক্তিক, অর্থহীন অনেক কিছু করতে ইচ্ছে করে। এতকাল নিজের ইচ্ছেকে মূল্য দেয়নি। আর যখন মূল্য দেবে বলে ভেবেছে, সুস্থ সুন্দর ইচ্ছে ভদ্রলোকের মতো এসে দাঁড়াবে তা নয়, ইচ্ছেগুলো এলো যাযাবারের মতো, ইচ্ছেগুলোর মাথায় উস্কোখুস্কো চুল। এ তো নতুন ইচ্ছে নূপুরের। ইচ্ছের চর্চা তো হয়নি, যে, ইচ্ছেকে ভদ্রঘরের কারও মতো দেখাবে! জীবনে যে ইচ্ছেগুলো সে পুরন করতে পারেনি, সেই ইচ্ছেগুলো এখন আর হাতের কাছে নেই পুরন করার। জয়কে মানুষ করার ইচ্ছেগুলো তীব্র ছিল একসময়, সেই ইচ্ছেগুলো এখন মরে গেছে। এখন আর সে জয় যখন নষ্ট হচ্ছিল দিন দিন, সেখান থেকে জয়কে মানুষ করার জন্য ওঠাতে পারবে না। এখন আর সে জয়কে রিহ্যাবে পাঠাতে পারবে না। যা হওয়ার হয়ে গেছে। যে সময় যাওয়ার সে সময় চলে গেছে। এখনকার ইচ্ছেগুলো অন্যরকম।
নূপুর বাইরে যায়, হেঁটে বেড়ায় ব্রহ্মপুত্রর পাড়ে। অনেক পুরোনো মানুষ মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়ায়, তুমি নূপুর না? তুমি ব্যারিস্টার সাহেবের ছোট মেয়ে তো?
নূপুর হেসে মাথা নাড়ে। তুমি আমেরিকায় থাকতে না? কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে। নূপুর মাথা নাড়ে, হ্যাঁ— থাকতাম। এখন দেশেই ফিরেছি। অনেক তো হয়েছে বিদেশ, আর কত?
—তোমার ছেলেমেয়ে?
—ছিল একটা ছেলে ছিল, নেই।
—নেই?
—না নেই। নূপুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে না, বরং বলে, বুবুর, মানে আমার বড় বোনের মেয়ে তো হারভার্ড ইউনিভারসিটিতে পড়ছে। খুব বড় ইউনিভারসিটি। নাম শুনেছেন তো! আসবে, এ বছরই আসবে, আমার সঙ্গে ক’টা দিন কাটাতে আসবে। নূপুর বলে আর চোখে চিকচিক করে জল। তপুর গল্প সে সবাইকে করে। তপু খুব নামকরা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে বলে? নূপুর নিজেকে জিজ্ঞেস করে। তপু যদি ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজেও পড়তো, তপুকে নিয়ে একইরকম গর্ব হত নূপুরের। মেয়েটা, নূপুর অন্তত এইটুকু বোঝে, মানুষ হয়েছে। তপু মানুষের কথা ভাবে। মানুষ হওয়া তো একেই বলে। মানুষ হয়েছে বলেই তো সে নির্মলার কথা ভেবেছে, যেন বাড়িটায় থাকে, মানুষ হয়েছে বলেই তো নূপুরকে দেখতে ছুটে এলো কলকাতায় নিজের টাকায় টিকিট করে! মানুষ হয়েছে বলেই তো নূপুরের ইচ্ছের সে মর্যাদা দিল। নূপুরের আত্মায় বিশ্বাস নেই। স্মৃতিকাতরতাই তাকে দিয়ে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে বয়ে নিয়ে এসেছে যমুনাকে ! বাঁচার জন্য হাতে তো কিছু থাকতে হয়। হ্যাঁ বই পড়বে, গান শুনবে, ভালো দু’একজন পাড়া পড়শির সঙ্গে কখনও ইচ্ছে হলে গল্প গুজব করবে, কিন্তু এতেও তো দিন ফুরোবে না। যমুনা রইলো।
বাড়িতে সে ইন্টারনেট নিয়েছে, নিজের ল্যাপটপ চালু করেছে। তপুর সঙ্গে প্রায়ই নেটে কথা হয়। আজকাল ফোন আর হয়না। স্কাইপেতে বা মেসেঞ্জারে বা হোয়াটসাপে যা কথা হওয়ার হয়। ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফেরে তপু। ঘুমোনার আগে অন্তত কিছুক্ষণ বলে যায়, কী কী হল আজ ইউনিভার্সিটিতে। আজ রিচার্ড ডকিন্স বক্তৃতা দিলেন, অসম্ভব ভালো বললেন। সে যে কী ভিড় তাঁর স্পিচ শুনতে। মা’র খুব ভালো লাগতো শুনলে। তপুকে পলকহীন চোখে দেখে নূপুর। দেখতে দেখতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তোর মা থাকলে ঠিকঠিক তোকে দেখতে হারভার্ডে ছুটে যেত।
না গো আসেনি। গত তিন চার বছর কোথাও বেশি বেরোতো না। ‘সিস্টারহুড’ নিয়েই ব্যস্ত ছিল। আসেনি। তাতে কী, আই অ্যাম সো প্রাউড অফ মাই মাদার।
বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরোয় নূপুরের। দুনিয়া একদিকে ছিল, আরেকদিকে ছিল জয়। নূপুর জয় নিয়ে দিন রাত ব্যস্ত ছিল। জয় কী খাবে, জয় কী পড়বে, জয় কী পরবে, কী হলে জয়ের ভালো লাগবে, কী পেলে জয় খুশি হবে। কোনোদিন জয় তাকে ভালো করে মা বলেও ডাকেনি, কোনওদিন বলেনি ‘আই অ্যাম সো প্রাউড অফ মাই মাদার’। সবার সবকিছু পাওয়া হয় না। নূপুরের হয়নি। যমুনা তপুকে বিপদ থেকে রক্ষা করেছিল বটে, দিন রাত তপুর খাওয়া পরা নিয়ে ব্যস্ত হয়নি। বরং শিখিয়েছে অনেক কিছু। মানুষ করতে গেলে শুধু ভালো ভালো খাওয়ানো আর ভালো ভালো কাপড় চোপড় পরানো আর দামি দামি জিনিস কিনে দিলে হয় না, শেখাতে হয় সততা, আর আদর্শ, দেখাতে হয় জগত, বোঝাতে হয় মানবতা।
তপুর জন্য প্রতিদিন অপেক্ষা করে নূপুর। হয় তপুর সঙ্গে সকালে কথা নয়, নয় রাতে। ওদিকে দিন তো এদিকে রাত, এদিকে রাত তো ওদিকে দিন। দিন রাত নূপুরের একাকার হয়ে যায়। দু’মিনিট কথা হলেই নূপুরের প্রাণ জুড়োয়। যমুনার মৃত্যুই যেন দুজনকে আরো কাছে এনে দিয়েছে। তপুর সঙ্গে নূপুরের নতুন করে দেখা হওয়া। স্বামী সন্তানহীন স্বাধীন জীবনে তপুকে আলিঙ্গণ করা। তপুময় জীবন নিভৃতে যাপন করা।
ওদিকে তপু নূপুরকে বলে সব, ঠিক যমুনাকে যেমন প্রতিদিন কী কী হচ্ছে তা বলতো, তেমন করে। যমুনা মারা যাওয়ার পর ডায়রিতে লিখে রাখতো যা যা যমুনাকে বলতে চাইতো সব। এখন আর লেখে না। এখন নূপুরকে যেহেতু বলতে হয়, নূপুরকেই বলে। ডায়রিতে আগের মতো ঘটনাগুলো লেখা হয় না। যমুনার জায়গাটা অজান্তেই দখল করে নিয়েছে নূপুর। তপু টের পায়। ধীরে ধীরে টের পায়। ক তোমার আত্মীয়, সুতরাং ক’ কে ভালোবাসতে হবে, এভাবে ভালোবাসা হয় না। ভালোবাসা ভেতরে অনুভব করতে হয়।
নির্মলার হাতে লেখা একটা চিঠি আসে এরমধ্যে একদিন।
প্রিয় নূপুর,
প্রিয় তপু,
তোমাদের দুজনকে একসঙ্গেই চিঠিটা লিখছি। দুজনই এ বাড়িতে থেকে গেছো ক’টা দিন, কিন্তু তোমাদের বলিনি। অনেকবার ভেবেছি বলবো, কিন্তু আবার দ্বিধায় ভুগেছি। যমুনা বলেছিল, তোমাদের যেন না জানাই। যমুনা তো তার মরণোত্তর দেহখানা দিয়েছিল মেডিক্যালে, তার ওই ইচ্ছে যখন পালন হয়নি, তখন কাউকে না জানানোর এই ইচ্ছেটা কেন পালন করতে হবে? আমাকে বলেছিল তোমাদের না জানাতে, অনেকদিন জানাইনি, এখন না জানানোর কোনও কারণ দেখি না। কারণ তার ইচ্ছেকে যে কারণেই হোক আমরা মূল্য দিচ্ছি না। তার মানে এই নয় যে তাকে আমরা ভালোবাসি না। ভালোবাসি বলেই হয়তো মূল্য দিচ্ছি না। কেন গোপন রাখবো সত্য! এখন আমার এটা মনে হচ্ছে, তোমাদের অধিকার আছে সত্য কথাটা জানার। তোমরা জানো যে যমুনার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। যমুনার হাতে গোনা ক’জন বন্ধু ছাড়া আর সবাই তা জানে। কিন্তু যমুনার হার্ট অ্যাটাক হয়নি। ওর কিডনি ফেলিওর হয়েছিল অনেকদিন যমুনা ডায়বেটিসে ভুগছিল। ডাক্তার ইনসুলিন নিতে বলেছিল। কিন্তু ইনসুলিন নেয়নি যমুনা। ধীরে ধীরে একসময় কিডনি নষ্ট হতে শুরু করে। ধীরে ধীরে বলাটা ঠিক হবে না, দ্রুতই দুটো কিডনি নষ্ট হয়ে যায়। ডাক্তার ফের বলে যায়, শীঘ্র ডায়ালায়সিস করানোর জন্য। দিন তারিখ সব নিয়ে আসি আমি ডায়ালাইসিসের। কিন্তু যমুনা যাবে না। ডাক্তার বারবার বলেছে, ডায়ালাইসিস না করলে যমুনা বাঁচবে না। শুনেছে যমুনা, বুঝেছে, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডায়ালাইসিস না করার। কিছুতেই ওকে রাজি করাতে পারিনি। তোমরা বলতে পারো, যমুনা আত্মহত্যা করেছে। হ্যাঁ করেছে, ঠাণ্ডা মাথায় করেছে। কেন করেছে, তা আমি জানি না।
যদি জিজ্ঞেস করো, যমুনা কি ডিপ্রেশনে ভুগতো? আমি অনেক বছর যমুনাকে কাছ থেকে দেখছি। কোনোদিন কোনও ডিপ্রেশন দেখিনি। কোনোদিন কিছু নিয়ে হতাশ ছিল ও? আমি দেখিনি। আমি জোর গলায় বলতে পারি, ছিল না। খুব প্রাণবন্ত, উচ্ছ্বল, উজ্জ্বল জীবন্ত মানুষ ছিল। মন খারাপ করে কোথাও বসে থাকা, কিছু নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করা, এই চরিত্র যমুনার নয়।
কেরালা থেকে এসে সোলার পাওয়ারের ওই চাকরির পাশাপাশি ‘সিস্টারহুড’ অরগানাইজেশন নিয়ে কলকাতায় ব্যস্ত ছিল। সিস্টারহুডকে তো দাঁড় করিয়ে গেল। আজ এই সংগঠনের পাঁচ হাজার সদস্য। রাজ্যের কটা নারী সংগঠন এত অল্প সময় এভাবে দাঁড়াতে পারে! আমার হাতে এখন দায়িত্ব, জানিনা কতটা পারবো একে টিকিয়ে রাখতে। তবে আপ্রাণ চেষ্টা করবো। ফাণ্ড আছে। অসুবিধে নেই। যমুনা দেশ বিদেশ থেকে সিস্টারহুডের জন্য যে ফাণ্ড জোগাড় করেছে, তা দিয়ে সংগঠন কয়েক বছর চমৎকার চলবে। শুধু আমিই নই, সিস্টারহুডের দু’তিন জন মেয়ে, ডাক্তাররা, আমি তো আছিই, দিনরাত বুঝিয়ে ডায়ালাইসিসের জন্য রাজি করাতে চেয়েছি, রাজি হয়নি যমুনা। বলেছে, ‘ধ্যাৎ একদিন অন্তর অন্তর রক্ত পাল্টে বেঁচে থাকতে হবে, এ আমার সইবে না। অনেক বেঁচেছি। আর কত! মাঝে মাঝে মনে হয় কয়েক হাজার বছর বুঝি বাঁচা হয়ে গেছে। নিজের মতো করে বেঁচেছি, নিজের মতো করে মরতে চাই’।
তোমরা যদি অনুরোধ করতে যমুনাকে ডায়ালাইসিস করার জন্য, কাজ হতো কি না জানি না। আমাদের কথায় কাজ হয়নি। সত্যি বলতে কী, যমুনার এই সিদ্ধান্ত আমি মানিনি। এত সংগ্রামী একজন মানুষ এমন ভেঙে পড়া মানুষের মতো সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছিল কে জানে।
তোমরা ভগবানে বিশ্বাস করো না। আমি করি। ভগবান যখন ডাকবেন, তখন চলে যাবো। কিন্তু না ডাকার আগেই নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে চলে যাবো কেন, এ জীবনটাকে ভাল না বাসার লক্ষণ, ভগবানকেও অবজ্ঞা করার লক্ষণ। হাসিখুশি মানুষটা জীবনে সংগ্রাম করেছে অনেক। কোনও বাধাকে ভয় পায়নি। কোনো শত্রুকে পরোয়া করেনি। কোনো রোগ শোকে কাবু হয়নি। কিন্তু চিকিৎসা যেখানে আছে, সেখানে চিকিৎসা না নিয়ে তার মরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত আজও আমাকে খুব বিভ্রান্ত করে। নিজেকে দোষী মনে হয়। আমি কি যথেষ্ট ভালোবাসিনি? এত ভালো আমি কাউকে বাসিনি। এ কথা জেনে রেখো। তোমরা বাড়িটা আমার দায়িত্বে দিয়ে গেলে। এত স্মৃতি নিয়ে কেবল ঘোরের মধ্যে থাকা হয়। দম বন্ধ হয়ে আসে। তপু আসবে বলে যমুনার মতো অপেক্ষা করবো, বাড়িঘর গুছিয়ে রাখবো। আমার পক্ষে তো আমেরিকায় যাওয়া সম্ভব হবে না। নূপুর রাজি হলে আমি বরং বাংলাদেশে ঘুরে আসতে পারি। যমুনাকেও দেখে আসবো, যমুনা কোথায় জন্মেছে, কোথায় বড় হয়েছে, আর তাছাড়া ব্রহ্মপুত্রও আমার দেখা হয়নি কখনও। দেখবো ব্রহ্মপুত্রর পাড়ে কী রকম জীবন কাটাতো যমুনা।
আমি ইমেইলে অভ্যস্ত নেই বলে চিঠি লিখলাম। তোমরা বোধহয় চিঠি টিঠি আর লেখো না। তপু তো হাতে কিছু লেখেই না। যমুনার একটা ইমেইল ছিল। [email protected] এই ঠিকানায় পাঠালে আমি ইমেইল পাবো। সিস্টারহুডের অফিসে যে কমপিউটার আছে, ওতেই দেখবো। যমুনার ল্যাপটপটা আমি তুলে রেখেছি যত্ন করে। ওটা ধরবো না। ওটা তপু এলে ব্যবহার করবে।
তোমরা ভালো থেকো। যমুনার আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত শুনে তোমাদের মন খারাপ হবে জানি। কিন্তু পারো তো ওকে ক্ষমা করে দিও। ওর হয়ে ক্ষমা চাইছি।
তোমাদের নির্মলা
চিঠিটা দুপুরে পড়েছে নূপুর। বিকেলে যমুনার কবরের পাশে বসে জোরে জোরে আবার পড়ে চিঠিটা। জোরে কেন পড়ে, যমুনা শুনবে বলে! নূপুর জানে কাঠের কফিননটার মধ্যে যমুনার শরীরের মাংস শুকিয়ে ঝরে পড়েছে, কংকাল বেরিয়ে এসেছে, তারপরও তার বিশ্বাস করতে ভালো লাগে, ওখানে যমুনা আছে, তাকে শুনছে, নূপুর কী বলছে শুনছে, কী করছে দেখছে। চিঠি কি নিজেকেই আবার শোনায় নূপুর!
দুলি চা দিয়ে যায়। নদীর ওপর সূর্য ডুবছে। লাল সূর্য। ‘যত রঙিন সূর্য, তত ধুলো বালি শহরে’, যমুনা বলেছিল একবার। যে যমুনা বাঁচার কথা বলতো সে কিনা ইচ্ছে করে মৃত্যুকে বেছে নিয়েছে, নূপুরের বিশ্বাস হতে চায় না। নির্মলার চিঠির ওই জায়গাগুলো আবার পড়ে সে। লাল কালিতে দাগ দিয়ে দিয়ে পড়ে, ডায়ালাইসিসে সে যে ইচ্ছে করেই যায়নি সে অংশটা। পড়লে গা কাঁপে।
নূপুর সন্ধে হয়ে যাওয়ার পরও উদাস বসে থাকে। দুলি এসে বলে, ঘরে চলো খালা। ঘরে যেতে যেতে নূপুর বিড়বিড় করে বলে, বুবু মনে হয় তপুকে আমার কাছে দিয়ে গেল। আমি সন্তান হারিয়েছি, এই দুঃখ যেন আমাকে বইতে না হয়।
নূপুরকে দূর্বল করে দিয়েছে নির্মলার চিঠি। ফোন করে তপুকে সে। তপুর এখনও চিঠি পাওয়ার কথা নয়। চিঠি ভারত থেকে বাংলাদেশেই আগে এসেছে। আমেরিকায় পৌঁছোতে দুটো দিন দেরি হবে।
নূপুর বলে, কী রে উঠেছিস ঘুম থেকে?
তপু ওদিক থেকে হেসে বলে, হ্যাঁ এই মাত্র। চা খাচ্ছি।
—নিজেকেই বানাতে হয় চা টা?
—নিজেই তো বানাবো নিজের চা।
—আজ লেকচার আছে?
—এই তো যাচ্ছি।
—নির্মলা একটা চিঠি পাঠিয়েছে ক্যুরিয়ারে তোকে আর আমাকে। আমার চিঠিটা আমি আজই পেয়েছি। তোরটা বোধহয় আজ কালের মধ্যে পেয়ে যাবি।
—তাই বুঝি, নির্মলা মাসি কখনও আগে কুরিয়ার করেনি।
—দুপুরে কী খাবি?
—কেনেডি ইস্কুলের ক্যাফেটোরায়ায় ভালো খাবার পাওয়া যায়। ওখানেই খেয়ে নেব। তুমি চিন্তা করো না নূপুখালা।
নূপুর হেসে বলে, —তোকে ইচ্ছে করছে কপালে একটা চুমু খেয়ে বলি, সারাদিন ভালো থাকিস। মন ভালো রাখিস।
—তুমি খুব লাভিং অ্যাণ্ড কেয়ারিং নূপুখালা। মাও ছিল। কিন্তু এক্সপ্রেস করতো না। আই লাভ ইউ।
—আই লাভ ইউ টু।
ফোন রেখে নূপুর লক্ষ্য করে চোখে জল তার। ভেজা চোখদুটো অঁচলে মুছে নেয়।
দুলি আর দুলির মেয়ে পাশের ঘরে ঘুমোয়। ওরা ঘুমোচ্ছে। ঘরগুলোয় হাঁটে নূপুর। যে ঘরটা নূপুরের ঘর ছিল, যে ঘরটা যমুনার ছিল, যে ঘরটা দুজনের পড়ার ঘর ছিল, বাবা মার ঘর, নাইমের ঘর, খাবার ঘর। হাঁটে আর ভাবে, তপু এলে ঠিক বাড়ি ঘর সাজাবে সে, ঠিক আগের মতো, আগে যেমন ছিল, তেমন করে। যমুনা যে ক’টা ছবি বাধিঁয়েছে তপুর আর নূপুরের, সব গুলো ছবি সে দেয়ালে টাঙিয়ে দেবে। ব্রহ্মপুত্রর পাড়ে যমুনাকে নিয়ে যেমন হাঁটতো নূপুর কিশোর বয়সে, তেমন হাঁটবে তপুকে নিয়ে। না, নূপুর ভাবে, জয়কে নিয়ে যে স্বপ্ন সে দেখেছিল, সেই স্বপ্ন নূপুরের মধ্যে তপুর জন্য একটু একটু করে জমছে, জয়কে ভেবেছিল দেখাবে তার শৈশব কৈশোর, যৌবনের সব অলি গলি, সব গাছ পাথর, সব নদী নালা, সব জল। দেখানো হয়নি। জয় দেখতে চায়নি। নূপুর এখন তপুকেই দেখাবে সব। তপুর জন্য এই বাড়িটা রেখে একদিন যমুনার মতো সেও চোখ বুজবে। হয়তো তপুকে অনুরোধ করবে আমি যেদিন মারা যাবো, আমাকে তোর মা’র পাশে শুইয়ে দিস। এপিটাফে লিখিস, ‘একজন, যে খুব মা হতে চেয়েছিল’। এটুকুই। নূপুর মনে মনে আরও একটু জুড়ে দেয়, ‘জগত তাকে যতই বলুক মা হতে সে পারেনি। সে কিন্তু পেরেছিল মা হতে। নিজের সন্তানের না হলেও, অন্য কারও সন্তানের’।
দুলির মেয়ের শরীর ঘামছে। নূপুর পাখাটা চালিয়ে দেয়। দুলির মাও দুলিকে নিয়ে ঠিক এভাবে এ ঘরেই ঘুমোতো। দুলির শরীরও ঘামতো এভাবে। আর এভাবেই নূপুর তখনও পাখাটা নিঃশব্দে চালিয়ে দিত।