৪. স্ফীতি ও সমান্তরাল মহাবিশ্ব

৪. স্ফীতি ও প্যারালাল ইউনিভার্স

শূন্য থেকে কিছুই আসতে পারে না।

— লুক্রেসিয়াস

আমার ধারণা, আমাদের মহাবিশ্ব আসলে ১০^১০ বছর আগে একেবারে শূন্য থেকে উদয় হয়েছে… আমার প্রস্তাব, মহাবিশ্ব ওই সবের মতো, যারা কালে কালে ঘটে।

—এডওয়ার্ড ট্রাইসন

মহাবিশ্ব হলো চূড়ান্তভাবে একটা ফ্রি লাঞ্চ।

-অ্যালান গুথ

.

পল অ্যান্ডারসনের লেখা চিরায়ত কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস টাও জিরোতে প্রতিবেশী নক্ষত্রে এক অভিযানে এক স্টারশিপ পাঠানো হয়েছিল। স্টারশিপের নাম লিওনোরা ক্রিস্টিন। নতুন নক্ষত্র ব্যবস্থার দিকে ওই যাত্রায় অংশ নেয় ৫০ জন মানুষ। তাদের বহনকারী স্টারশিপটি একসময় অর্জন করে আলোর বেগে কাছাকাছি গতি। আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, স্টারশিপটি বিশেষ আপেক্ষিকতার একটি নীতি ব্যবহার করেছিল। এ নীতি অনুযায়ী, স্টারশিপ যত দ্রুতবেগে চলে, তার ভেতরে সময় তত ধীরে বয়ে যায়। কাজেই প্রতিবেশী নক্ষত্রের ওই ভ্রমণে পৃথিবীর হিসাবে কয়েক দশক পেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নভোচারীদের জন্য তা ছিল মাত্র কয়েক বছর। পৃথিবীর কোনো দর্শক টেলিস্কোপে ওই নভোচারীদের দেখলে, তার কাছে মনে হবে, নভোচারীরা যেন সময়ের মধ্যে জমে গেছে। আসলে একধরনের সাসপেন্ড অ্যানিমেশনের মধ্যে ছিল তারা। কিন্তু নভোযানের ভেতরের যাত্রীদের কাছে সময় স্বাভাবিকভাবে অতিবাহিত হতে থাকে। স্টারশিপটি একসময় গতি কমাতে শুরু করে। এক নতুন বিশ্বে অবতরণ করার সময় যাত্রীরা দেখতে পায়, মাত্র কয়েক বছরে তারা পাড়ি দিয়েছে ৩০ আলোকবর্ষ পথ।

প্রকৌশলগত দিক দিয়ে স্টারশিপটি ছিল বিস্ময়কর। এতে শক্তি জোগাত রামজেট ফিউশন ইঞ্জিন। গভীর মহাকাশের হাইড্রোজেন সংগ্রহ করে পুড়িয়ে সীমাহীন শক্তি পেত এ ইঞ্জিন। এটা এত দ্রুতগতিতে চলতে পারত যে শিপের ক্রুরা নক্ষত্রের আলোর ডপলার বিচ্যুতিও দেখতে পেত স্বচক্ষে। তাদের সামনের নক্ষত্রগুলো নীলচে দেখা যেত আর পেছনের নক্ষত্রগুলোকে দেখা যেত লালচে।

এর পরপরই হঠাৎ তাদের ওপর এক বিপর্যয় নেমে আসে। পৃথিবী থেকে প্রায় ১০ আলোকবর্ষ দূরে এসে, এক আন্তনাক্ষত্রিক ধূলিমেঘের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে স্টারশিপটি। এর গতি কমানোর মেকানিজম স্থায়ীভাবে অকেজো হয়ে যায়। এক গোলমেলে স্টারশিপে নিজেদের আবিষ্কার করে আতঙ্কিত ক্রুরা। স্টারশিপটি তখন ক্রমেই গতি বাড়িয়ে আলোর গতির কাছাকাছি চলে যাচ্ছিল। নিয়ন্ত্রণহীন স্টারশিপের ভেতর তারা প্রচণ্ড অসহায় বোধ করতে থাকে। কারণ, পুরো নক্ষত্র ব্যবস্থাটি মাত্র এক মিনিটেই পেরিয়ে যাচ্ছিল নভোচারীরা। এক বছরের মধ্যে স্টারশিপটি মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিরও অর্ধেকটা পথ পেরিয়ে চলে যায়। এর ত্বরণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকার কারণে মাত্র কয়েক মাসেই (যদিও পৃথিবীতে তখন কয়েক লাখ বছর পেরিয়ে গেছে) তা গ্যালাক্সি ছাড়িয়ে বাইরে চলে যাবে—এমন একটা অবস্থা। শিগগিরই যাত্রীরা আলোর গতিতে ভ্রমণ করতে শুরু করে। তাতে সাক্ষী হয়ে ওঠে মহাজাগতিক ঘটনাগুলোর। তাদের চোখের সামনে মহাবিশ্ব তার জন্ম থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিকশিত হতে থাকে।

ক্রমেই তারা দেখতে পায়, মহাবিশ্বের প্রকৃত প্রসারণ উল্টো পথে যেতে শুরু করেছে। অর্থাৎ সংকুচিত হতে শুরু করে মহাবিশ্ব। এ সময় তাপমাত্রা নাটকীয়ভাবে বাড়তে থাকে। বিগ ক্রাঞ্চের দিকে এগিয়ে যাওয়ার কারণে তাপমাত্রার ঊর্ধ্বগতি বুঝতে পারে তারা। চোখের সামনে তাপমাত্রা রকেটের গতিতে বাড়তে শুরু করে। গ্যালাক্সিগুলো সব একত্র হয়ে গঠিত হতে শুরু করে একটা মহাজাগতিক আদিম পরমাণুতে। তা দেখে ক্রু সদস্যরা নীরবে প্রার্থনা করতে শুরু করে। অনিবার্যভাবে প্রচণ্ড অগ্নিময় মৃত্যু আলিঙ্গনের আর যেন বেশি সময় বাকি নেই।

তাদের একমাত্র ভরসা, পদার্থ সংকুচিত হচ্ছে এক সসীম এলাকায় সসীম ঘনত্বে। তাই আলোর মতো চরম গতিতে চললে এই সংকোচন এড়ানো হয়তো সম্ভব। অলৌকিকভাবে, আদিম পরমাণুর ভেতর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় তাদের রক্ষাকবচ রক্ষা করে নভোচারীদের। এরপর নতুন এক মহাবিশ্ব জন্ম হতে দেখে চোখের সামনে। নতুন মহাবিশ্বটি প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নক্ষত্র ও ছায়াপথ তৈরি হতেও দেখে। এরই মধ্যে নিজেদের স্টারশিপের ত্রুটি ঠিকঠাক করে সাবধানে যাত্রাপথ ঠিক করা হয়। গন্তব্য হিসেবে একটা যথেষ্ট পুরোনো ছায়াপখে গন্তব্য ঠিক করে স্টারশিপের যাত্রীরা। সেখানে তখন গঠিত হয়েছে প্রাণধারণের জন্য উচ্চতর মৌলগুলো। একসময় একটা গ্রহও খুঁজে পাওয়া যায়। নভোচারীরা সেখানেই বসতি স্থাপনের মাধ্যমে নতুন করে পথচলা শুরু হয় মানবজাতির

গল্পটা লেখা হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। সে সময় মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি নিয়ে জ্যোতির্বিদের মধ্যে তুমুল তর্কবিতর্ক চলেছে। মহাবিশ্ব বিগ ক্রাঞ্চে, নাকি বিগ ফ্রিজের মধ্য দিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবে, অথবা অনির্দিষ্টকালের জন্য দুলতে থাকে, নাকি স্থিতিশীল অবস্থায় চিরকাল রয়ে যাবে—সেটাই ছিল বিতর্কের বিষয়বস্তু। এরপর ইনফ্লেশন বা স্ফীতি নামের নতুন এক তত্ত্বের আগমনের পর বিতর্কটা কমে গেছে বলে মনে হয়।

ইনফ্লেশনের জন্ম

‘বিস্ময়কর উপলব্ধি’ অ্যালান গুথ তাঁর ডায়েরিতে এ কথা লেখেন ১৯৭৯ সালে। তখন বেশ উৎফুল্ল বোধ করছিলেন তিনি। কারণ, তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন যে কসমোলজির অন্যতম বড় একটি আইডিয়া দৈবাৎ পেয়ে গেছেন। মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের ৫০ বছরের ইতিহাসে প্রথম বড় কোনো সংশোধন করেন গুথ। আর সেটি করেন গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। তিনি যদি ধরে নেন, মহাবিশ্বের জন্মের পরপরই সেটা হুট করে এক শক্তিশালী অতিস্ফীতির মধ্যে গিয়েছিল, তাহলে কসমোলজির কিছু জটিল ধাঁধার সমাধান করা যায়। অবশ্য এই অতিস্ফীতি অধিকাংশ পদার্থবিদের কাছে অবিশ্বাস্য রকম দ্রুতগতির। গুথ দেখতে পান, এই অতিপ্রসারণের মাধ্যমে অনায়াসে প্রসারণ অস্বীকার করা কসমোলজির গভীর কিছু প্রশ্নের সমাধানও দেওয়া যাচ্ছে। এই আইডিয়া কসমোলজিতে এক বিপ্লব বয়ে আনে। (ডব্লিউএমএপি স্যাটেলাইটসহ সাম্প্রতিক কসমোলজিক্যাল উপাত্তের সঙ্গে এর ভবিষ্যদ্বাণী মিলে গেছে।) এটা এখন শুধু একটা কসমোলজিক্যাল থিওরিই নয়, বরং সহজতম ও সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য তত্ত্ব।

তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হলো, এই সরল আইডিয়া বিশ্বজগতের অনেকগুলো যন্ত্রণাদায়ক প্রশ্নের সমাধান দেয়। অন্যান্য সমস্যার মধ্যে ফ্ল্যাটনেস প্রবলেম বা মসৃণতার সমস্যাও দক্ষতার সঙ্গে সমাধান দেয় স্ফীতিতত্ত্ব। মহাবিশ্ব থেকে পাওয়া উপাত্ত থেকে দেখা যায়, মহাবিশ্বের বক্রতা লক্ষণীয়ভাবে শূন্যের কাছাকাছি। আসলে আগের জ্যোতির্বিদদের বিশ্বাসের চেয়েও তা শূন্যের আরও বেশি কাছাকাছি। এটা ব্যাখ্যা করা সম্ভব, মহাবিশ্ব যদি একটা বেলুনের মতো দ্রুতবেগে স্ফীত হয়ে থাকে। তাহলে স্ফীতি পর্যায়কালে মসৃণ হয়ে যাবে। আমরা যদি পিঁপড়ার মতো একটা বেলুনের পৃষ্ঠতলে হাঁটতে থাকি, তাহলে বেলুনটির বক্রতা বোঝার জন্য আমাদের আকৃতি আসলে অতি ক্ষুদ্র। একইভাবে স্ফীতির কারণে স্থান-কাল এতই প্রসারিত হয়েছে যে তাকে এখন মসৃণ বলে মনে হয়।

গুথের আবিষ্কারের আরেকটা ঐতিহাসিক ব্যাপার হলো, এটা মৌলিক কণা পদার্থবিজ্ঞান (প্রকৃতিতে দেখতে পাওয়া অতিক্ষুদ্র কণার বিশ্লেষণের সঙ্গে সম্পর্কিত) কসমোলজিতে (মহাবিশ্বের উৎপত্তিসহ একে সামগ্রিকভাবে গবেষণা) ব্যবহারের প্রতিনিধিত্ব করে। আমরা এখন বুঝতে পারি, অতিক্ষুদ্র পরিসরের পদার্থবিজ্ঞান ছাড়া, অর্থাৎ কোয়ান্টাম তত্ত্ব ও মৌলিক কণার পদার্থবিজ্ঞান ছাড়া মহাবিশ্বের গভীরতম রহস্য সমাধান সম্ভব নয়।

একত্রীকরণের অনুসন্ধানে

গুথের জন্ম ১৯৪৭ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির নিউ ব্রুনউইকে। তাঁর পদার্থবিজ্ঞানের জগতে আসার পেছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে আইনস্টাইন, গ্যামো কিংবা হয়েলের মতো কোনো যন্ত্রপাতি বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো ঘটনাও ছিল না। তাঁর বাবা-মা কেউ কলেজে গ্র্যাজুয়েশন পর্যন্ত করেননি। এমনকি বিজ্ঞানের প্রতিও খুব একটা আগ্রহও ছিল না তাঁর বাবা-মায়ের। কিন্তু নিজের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, তিনি গণিত ও প্রকৃতির সূত্রগুলোর মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে সব সময় কৌতূহলী ছিলেন।

১৯৬০-এর দশকে এমআইটিতে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে মৌলিক কণা পদার্থবিজ্ঞানে ক্যারিয়ার গড়ার কথা ভাবেন গুথ। বিশেষ করে, সব মৌলিক বলগুলোর একত্রীকরণের প্রচেষ্টার ফলে তখন পদার্থবিজ্ঞানে শুরু হয়েছিল নতুন এক বিপ্লব। তাতে যুক্ত হতে চাইলেন গুথ। এ বিপ্লবের ফলে যে উত্তেজনার জন্ম হয়, তা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। অনেক দিন ধরে পদার্থবিজ্ঞানের কাঙ্ক্ষিত বিষয়টি ছিল এসব বলকে একত্র করা। এই একত্রীকরণ মহাবিশ্বের জটিলতাকে সরলতম উপায়ে ও সংগতিপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবে। গ্রিকদের সময় থেকে বিজ্ঞানীরা ভেবে আসছেন, বর্তমানে যে মহাবিশ্ব দেখা যায়, তা অতি সরলতম কোনো কিছুর চূর্ণবিচূর্ণ হওয়া ভগ্নাবশেষ। আমাদের লক্ষ্য, এই একত্রীকরণটা উদ্ঘাটন করা।

পদার্থ ও শক্তির প্রকৃতি নিয়ে প্রায় দুই হাজার বছর ধরে তদন্তের পর, পদার্থবিদেরা উদ্ঘাটন করেছেন যে মাত্র চারটি মৌলিক বল শাসন করছে এই মহাবিশ্বকে। (বিজ্ঞানীরা সম্ভাব্য পঞ্চম আরেকটি বল খোঁজারও চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এই দিক থেকে পাওয়া সব ফল ঋণাত্মক, নয়তো অনির্ণায়ক রয়ে গেছে।)

প্রথম বলটি হলো মহাকর্ষ। এই বলটি সূর্যকে একত্রে ধরে রেখেছে। পাশাপাশি গ্রহগুলোকে সৌরজগতে তাদের নিজ নিজ কক্ষপথে নিয়ন্ত্রণ করছে এ বল। মহাকর্ষ যদি হুট করে অদৃশ্য হয়ে যায়, তাহলে মহাকাশের নক্ষত্রগুলো বিস্ফোরিত হবে। খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যাবে আমাদের প্রিয় পৃথিবীও। আবার আমরা বাইরের মহাকাশে ঘণ্টায় প্রায় এক হাজার মাইল বেগে ছিটকে পড়বে।

দ্বিতীয় বড় ধরনের বলটি হলো ইলেকট্রোম্যাগনেটিক বা বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল। এ বলটির কারণে বিভিন্ন শহর আলোকিত হয়। আবার পুরো বিশ্বে এখন টিভি, সেলফোন, রেডিও, লেজার রশ্মি ও ইন্টারনেটে ভরে গেছে এ বলের কারণেই। বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বলটি যদি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যেত, তাহলে সভ্যতা তাৎক্ষণিকভাবে এক শতক বা দুই শতক পেছনের অন্ধকার আর নীরবতার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হবে। তার জলজ্যান্ত প্রমাণ দেখা গিয়েছিল ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বড় ধরনের ব্ল্যাকআউটের সময়। এতে দেশটির গোটা উত্তর- পূর্বাঞ্চল অকেজো পড়ে পড়ে। আমরা যদি বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল আণুবীক্ষণিকভাবে পরীক্ষা করি, তাহলে দেখা যাবে, এটা আসলে একধরনের অতিক্ষুদ্র কণা বা কোয়ান্টা দিয়ে গঠিত। এ কণাকেই বলা হয় ফোটন।

তৃতীয় বলটির নাম উইক নিউক্লিয়ার ফোর্স বা দুর্বল পারমাণবিক বল। তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের জন্য দায়ী এই বলটি। পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে ধরে রাখার মতো দুর্বল বল যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। তাই পরমাণুর নিউক্লিয়াস ভেঙে যায় বা ক্ষয় হয়। হাসপাতালে নিউক্লিয়ার মেডিসিন ভীষণভাবে এই নিউক্লিয়ার বলের ওপর নির্ভর করে। তেজস্ক্রিয় পদার্থের মাধ্যমে পৃথিবীর কেন্দ্রকে উষ্ণ রাখতেও সহায়তা করে দুর্বল বল। ফলে অতি শক্তিশালী আগ্নেয়গিরি নিয়ন্ত্রিত হয়। দুর্বল বলের ভিত্তি ইলেকট্রন ও নিউট্রিনোর মধ্যকার মিথস্ক্রিয়া (নিউট্রিনো একধরনের ভুতুড়ে কণা, যারা প্রায় ভরহীন। এই কণা কোনো কিছুর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া না করেই ট্রিলিয়ন মাইল পুরু কঠিন সিসার দেয়াল ভেদ করে চলে যেতে পারে।) ইলেকট্রন ও নিউট্রিনো মিথস্ক্রিয়া করে ডব্লিউ ও জেড বোসন কণার বিনিময়ের মাধ্যমে।

পরমাণুর নিউক্লিওগুলোকে একত্রে ধরে রাখে স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্স বা শক্তিশালী পারমাণবিক বল। তাই পারমাণবিক বল ছাড়া চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যেত পরমাণুর নিউক্লিও। ফলে স্বভাবতই পরমাণু ভেঙে যেত এবং আমাদের চেনা- জানা বাস্তবতা স্রেফ অদৃশ্য হয়ে যেত। মহাবিশ্বে পরিপূর্ণ প্রায় এক শ মৌল গঠনের পেছনে দায়ী শক্তিশালী পারমাণবিক বল। দুর্বল ও শক্তিশালী পারমাণবিক বল একত্রে আইনস্টাইনের সমীকরণ E=mc^2 অনুযায়ী নক্ষত্র থেকে আলো নিঃসরণের জন্য দায়ী। পারমাণবিক বল ছাড়া গোটা মহাবিশ্ব ডুবে যেত গাঢ় অন্ধকারে। আবার পৃথিবীর তাপমাত্রা কমে যেত এবং জমাট বেঁধে কঠিন হয়ে যেত সাগর-মহাসাগর।

এই চারটি বলের সবচেয়ে বিস্ময়কর ধর্ম হলো, সেগুলো প্রত্যেকে একে অপরের চেয়ে একেবারে আলাদা। এমনকি তাদের শক্তি ও ধর্ম ও আলাদা। যেমন মহাকর্ষের কথাই ধরা যাক। চারটি বলের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল হলো মহাকর্ষ। এটি বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বলের চেয়ে ১০^৩৬ গুণ দুর্বল। পৃথিবীর ওজন ৬ ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কিলোগ্রাম। তারপরও পৃথিবীর ওজন ও তার মহাকর্ষকে খুব সহজে হারিয়ে দিতে পারে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল। যেমন স্থির বিদ্যুতের মাধ্যমে আপনার চিরুনি কাগজের ছোট টুকরো টেনে তুলতে পারে। আসলে এর ফলে গোটা পৃথিবীর মহাকর্ষের বিরুদ্ধে কাজ করে চিরুনির স্থির বিদ্যুৎ। তবে মহাকর্ষ চরমভাবে আকর্ষীধর্মী। অন্যদিকে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল কণার চার্জের ওপর নির্ভর করে আকর্ষী ও বিকর্ষীধর্মী দুই রকমের হতে পারে।

মহাবিস্ফোরণের একত্রীকরণ

আজকের পদার্থবিজ্ঞান বেশ কিছু মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি। প্রধান একটি মহাবিশ্ব কেন শুধু এই চারটি আলাদা বল দিয়ে শাসিত? আবার এই চারটি বলের শক্তি, মিথস্ক্রিয়া ও পদার্থবিজ্ঞানের দিক দিয়ে দেখতেও আলাদা কেন?

আইনস্টাইন প্রথমবার এ বলগুলোকে একটি একক ও সমন্বিত তত্ত্ব হিসেবে একীভূত করার চেষ্টা চালান। সেটি করতে মহাকর্ষকে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বলের সঙ্গে একত্র করার চেষ্টাও করেন। তবে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হন আইনস্টাইন। কারণ, তাঁর সময়ের তুলনায় তিনি অনেক এগিয়ে ছিলেন। সে সময় একটা বাস্তবসম্মত একীভূত ক্ষেত্রতত্ত্ব প্রণয়নের জন্য শক্তিশালী পারমাণবিক বল সম্পর্কে খুব কমই জানা গিয়েছিল। কিন্তু আইনস্টাইন ব্যর্থ হলেও তাঁর এই কাজটি পথ দেখিয়েছিল অন্য পদার্থবিদদের। তাই একটা ‘থিওরি অব এভরিথিং’-এর সম্ভাবনার ব্যাপারে পদার্থবিজ্ঞানজগতের চোখ খুলে যায়।

১৯৫০ সালের দিকে একটা একীভূত ক্ষেত্ৰতত্ত্বের লক্ষ্য চরম হতাশাজনক বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক। বিশেষ করে তখন পুরো বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে ছিল মৌলিক কণা পদার্থবিজ্ঞান। সেই সঙ্গে ছিল পদার্থের মৌলিক গাঠনিক উপাদান খুঁজতে অ্যাটম স্ম্যাশার দিয়ে নিউক্লিওকে ছিন্নভিন্ন করার ঘটনা। শুধু পরীক্ষা থেকে আরও শতাধিক কণা খুঁজে বের করতে ওই কাজটি করতেন সেকালের বিজ্ঞানীরা। এসব কারণে মৌলিক কণা পদার্থবিজ্ঞান হয়ে ওঠে পরিভাষাগতভাবে পরস্পরবিরোধী। যেন একটা কসমিক জোক বা মহাজাগতিক কৌতুক। গ্রিকরা ধারণা করেছিল, কোনো বস্তুকে যতই তার মৌলিক এককে ভাঙা হবে, ততই সরলতর হবে সেটা। কিন্তু বাস্তবে ঘটতে লাগল তার উল্টোটা। আবিষ্কৃত কণার জন্য গ্রিক বর্ণমালা থেকে অক্ষর খুঁজতে হয়রান হতে হচ্ছিল পদার্থবিদদের। তাই তো জে রবার্ট ওপেন হাইমার একবার রসিকতা করে বলেছিলেন, এ বছর যে পদার্থবিদ নতুন কোনো কণা আবিষ্কার করবেন না, তাকেই নোবেল পুরস্কার দেওয়া উচিত। নোবেল বিজয়ী স্টিভেন ওয়াইবার্গ বিস্মিত হয়েছিলেন এ কথা ভেবে যে মানুষের মন কি সত্যিই পারমাণবিক বলের গুপ্ত রহস্য উন্মোচনের জন্য সমর্থ কি না।

এই বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খলায় ১৯৬০-এর দশকের প্রথম দিকে কিছুটা লাগাম পরানো সম্ভব হয় ক্যালটেকে মারি গেল-মান এবং জর্জ জুইগের কোয়ার্কের ধারণা প্রস্তাবের পর। তাঁদের মতে, প্রোটন আর নিউট্রনের মৌলিক গাঠনিক একক হলো কোয়ার্ক। কোয়ার্ক থিওরি অনুযায়ী, তিনটি কোয়ার্ক মিলে একটা প্রোটন বা একটা নিউট্রন গঠিত হয়। আর একটা কোয়ার্ক আর একটা অ্যান্টিকোয়ার্ক মিলে গঠিত হয় একটা মেসন (যে কণাটি নিউক্লিয়াসকে একত্রে ধরে রাখে)। অবশ্য এটা ছিল স্রেফ আংশিক একটা সমাধান (এখন পর্যন্ত আমরা বিভিন্ন ধরনের কোয়ার্কের বন্যায় ভাসছি।) কিন্তু একদা ঘুমন্ত একটা ক্ষেত্রে এটা নতুন শক্তির সঞ্চার করেছিল এ ধারণাটি।

১৯৬৭ সালে বড় ধরনের একটা সফলতা পান পদার্থবিদ স্টিভেন ওয়াইবার্গ এবং আবদুল সালাম। তাঁরা দেখান, দুর্বল ও বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল দুটোকে একত্র করা সম্ভব। নতুন একটা তত্ত্ব প্রণয়ন করেন এই দুই বিজ্ঞানী। সেখানে ইলেকট্রন ও নিউট্রিনো (যাকে বলা হয় লেপটন) পরস্পরের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে ডব্লিউ (W−), জেড (Z) বোসন ও ফোটন নামের কণার বিনিময়ের মাধ্যমে। ডব্লিউ ও জেড বোসন এবং ফোটনকে প্রায় একই অবস্থায় এনে তাঁরা তত্ত্বটি প্রণয়ন করছেন। দুটি বলকে একত্র করে এ তত্ত্ব। চারটি বলের মধ্যে দুটি বলকে (বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল আর দুর্বল পারমাণবিক বল) একত্র করতে যৌথ গবেষণার জন্য এবং শক্তিশালী পারমাণবিক বল সম্পর্কে নতুন জ্ঞানের সন্ধান দেন স্টিভেন ওয়াইনবার্গ, শেলডন গ্ল্যাশো এবং আবদুল সালাম। সে জন্য ১৯৭৯ সালে নোবেল পুরস্কার পান এই তিন বিজ্ঞানী।

১৯৭০-এর দশকে স্ট্যানফোর্ড লিনিয়ার অ্যাকসিলারেটর সেন্টার (SLAC) পার্টিকেল অ্যাকসিলারেটর থেকে পাওয়া উপাত্ত বিশ্লেষণ করেন পদার্থবিদেরা। প্রোটনের ভেতরে গভীরভাবে অনুসন্ধান চালানোর লক্ষ্য নিয়ে তার মধ্যে তীব্রভাবে ইলেকট্রন বিম ছোড়া হয়। এভাবে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, প্রোটনের ভেতরে কোয়ার্ককে একত্রে বেঁধে রাখা শক্তিশালী পারমাণবিক বলকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব, যদি গ্লুয়ন নামের নতুন একটা কণার প্রবর্তন করা হয়। এ গ্লুয়ন কণাই শক্তিশালী পারমাণবিক বলের কোয়ান্টা। প্রোটনকে একত্রে ধরে রাখা বন্ধন বলকে তার ভেতরের কোয়ার্কদের মধ্যে গ্লুয়নের বিনিময় হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। ফলে শক্তিশালী পারমাণবিক বলের নতুন একটা তত্ত্ব পাওয়া গেল। একে বলা হয় কোয়ান্টাম ক্রোমোডাইনামিকস।

কাজেই চারটি প্রাকৃতিক বলের মধ্যে তিনটিকে (মহাকর্ষ বাদে) গাঁটছড়া বাঁধা সম্ভব হয় সেই ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে। এর ফলে যা পাওয়া গেল, তাকেই এখন বলা হয় স্ট্যান্ডার্ড মডেল বা প্রমিত মডেল। এটি কোয়ার্ক, ইলেকট্রন ও নিউট্রিনোর একটা তত্ত্ব। এই কণাগুলো মিথস্ক্রিয়া করে গ্লুয়ন, ডব্লিউ ও জেড বোসন আর ফোটন বিনিময়ের মাধ্যমে। কণা পদার্থবিজ্ঞানে কয়েক দশকের কষ্টকর ধীরগতির গবেষণার অর্জন ছিল এটাই। এই স্ট্যান্ডার্ড মডেল বর্তমানে কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই কণা পদার্থবিজ্ঞানের সব কটি পরীক্ষামূলক উপাত্তের সঙ্গে খাপ খায়।

পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্বগুলোর মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড মডেল অন্যতম সফল হলেও এটা বেশ বিদ্ঘুটে। বিশ্বাস করাও কঠিন যে মৌলিক পর্যায়ে প্রকৃতি এমন এক তত্ত্ব পরিচালনা করতে পারে, যাকে জোড়াতালি মারা বলে মনে হয়। যেমন এ তত্ত্বে ১৯টি অযৌক্তিক প্যারামিটার আছে। সেগুলো কোনো ছন্দ বা কারণ ছাড়াই প্রয়োগ করা হয়েছে বলে মনে হয় (অর্থাৎ একটা সত্যিকার একীভূত তত্ত্বে বিভিন্ন ভর ও মিথস্ক্রিয়ার শক্তিতত্ত্ব দিয়ে নির্ধারিত হয়নি, বরং পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছে। নৈতিকভাবে এসব ধ্রুবক বাইরের পরীক্ষা বাদ দিয়ে খোদ তত্ত্ব দিয়ে নির্ধারিত হওয়া উচিত হলো)।

আবার মৌলিক কণার তিনটি হুবহু কপি আছে, যাদের বলা হয় জেনারেশন বা প্রজন্ম। বিশ্বাস করাও কঠিন যে প্রকৃতি তার মৌলিক পর্যায়ে অতিপারমাণবিক কণার এ রকম হুবহু কপি রাখতে পারে। এই তিন প্রজন্মের এসব কণা পরস্পরের সঙ্গে সব দিক দিয়ে মিল আছে, তবে শুধু ভরের দিকে দিয়ে সেগুলো ভিন্ন। (যেমন কার্বনের ইলেকট্রন কপিতে মিওয়ন থাকে। এর ভর ইলেকট্রনের ২০০ গুণ বেশি। আবার থাকে টাও কণা, যার ভর ৩,৫০০ গুণ বেশি)। সবশেষে মহাকর্ষ মহাবিশ্বের সবচেয়ে বিস্তৃত বল হলেও স্ট্যান্ডার্ড মডেলে এর কোনো কথা বলা হয়নি।

মৌলিক কণার সবচেয়ে সফল তত্ত্ব স্ট্যান্ডার্ড মডেলে কোয়ার্ক ও গ্লুয়নের বিভিন্ন প্রজন্ম।
মৌলিক কণার সবচেয়ে সফল তত্ত্ব স্ট্যান্ডার্ড মডেলে কোয়ার্ক ও গ্লুয়নের বিভিন্ন প্রজন্ম।

স্ট্যান্ডার্ড মডেলের চমকপ্রদ পরীক্ষামূলক সফলতা থাকা সত্ত্বেও একে ফন্দি করে বা কৃত্রিমভাবে বানানো বলে মনে হয়। তাই আরেকটি তত্ত্ব প্রণয়নের চেষ্টা করেছেন পদার্থবিদেরা। একে বলা হচ্ছে গ্র্যান্ড ইউনিফায়েড থিওরি (GUT)। এতে কোয়ার্ক ও লেপটনকে একই অবস্থানে রাখা হয়েছে। আবার এ তত্ত্বে একই পর্যায়ে রাখা হয়েছে গ্লুয়ন, ডব্লিউ ও জেড বোসন এবং ফোটনকেও। (তবে এটাও চূড়ান্ত কোনো তত্ত্ব হতে পারে না। কারণ, মহাকর্ষকেও এখানেও কার্যত বাদ দেওয়া হয়েছে। আসলে আমরা শিগগিরই দেখতে পাব, অন্যান্য বলের সঙ্গে মহাকর্ষকে অন্তর্ভুক্ত করা খুব কঠিন। )

মৌলিক কণার সবচেয়ে সফল তত্ত্ব স্ট্যান্ডার্ড মডেলের মধ্যকার অতিপারমাণবিক কণা এগুলো। এর মধ্যে রয়েছে প্রোটন ও নিউট্রন গঠনকারী কোয়ার্ক, ইলেকট্রন ও নিউট্রিনোর মতো লেপটন ও অন্যান্য আরও কণা। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এই মডেলে অতিপারমাণবিক কণার তিনটি হুবহু কপি রয়েছে। স্ট্যান্ডার্ড মডেলে মহাকর্ষকে অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে (যা বেশ বিব্রতকর)। তাই তাত্ত্বিক পদার্থবিদদের ধারণা, এটা কোনোভাবেই চূড়ান্ত তত্ত্ব হতে পারে না।

একীভূত করার এই কর্মসূচির কারণে কসমোলজিতে নতুন এক উদাহরণের সূচনা হয়েছে। ধারণাটি সরল ও অভিজাত : মহাবিস্ফোরণে তাৎক্ষণিক মুহূর্তে সব কটি মৌলিক বল একটামাত্র একীভূত ও সমন্বিত বল হিসেবে বিরাজ করছিল। একে বলা যায় রহস্যময় কোন সুপারফোর্স। সব কটি বলের শক্তিমত্তা ছিল একই। সমন্বিত একটিমাত্র বলের অংশ ছিল সেগুলো। মহাবিশ্ব শুরু হয়েছিল একটা চূড়ান্ত বিন্দু অবস্থার মধ্যে দিয়ে। কিন্তু মহাবিশ্ব প্রসারণ শুরু করার পর তা দ্রুত শীতল হতে থাকে। তাতে আদি সুপারফোর্সে একসময় ফাটল দেখা দেয়। এরপর এই সুপারফোর্স একের পর এক বিভিন্ন বল হিসেবে ভেঙে পড়তে শুরু করে।

এই তত্ত্ব অনুসারে, মহাবিস্ফোরণের পর ঠান্ডা হতে থাকা মহাবিশ্বের সঙ্গে জমাটবাঁধা পানির বেশ মিল আছে। তরল অবস্থায় পানি বেশ সুষম ও মসৃণ। কিন্তু পানি জমাট বেঁধে গেলে তার ভেতরে লাখ লাখ অতিক্ষুদ্র বরফের স্ফটিক গঠিত হয়। তাই তরল পানি পুরোপুরি জমাট বেঁধে গেলে তার আদি সুষমতাও ভেঙে পড়ে। তখন বরফের মধ্যে থাকে ফাটল, বুদ্বুদ আর স্ফটিক।

অন্য কথায়, আমরা আজকে যে মহাবিশ্ব দেখি, তা ভয়ংকর রকম ভাঙা। এটা সুষম বা প্রতিসাম্য নয় মোটেও, বরং এতে রয়েছে এবড়োখেবড়ো বিস্তৃত পাহাড়-পর্বত আগ্নেয়গিরি, ঘূর্ণিঝড়, পাথুরে গ্রহাণু ও বিস্ফোরণোম্মুখ নক্ষত্ৰ। তাদের কোনো সমন্বিত একতা নেই। আবার এতে আমরা চারটি মৌলিক বল ও দেখতে পাই, কিন্তু তাদের পরস্পরের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। মহাবিশ্ব এতটা ভাঙাচোড়া হওয়ার কারণ হলো এটা অনেক পুরোনো ও শীতল।

একটা চরম ঘন অবস্থার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল আমাদের মহাবিশ্ব। কিন্তু আজকের পর্যায়ে আসতে একে অনেকগুলো ক্রান্তিকালের পর্যায় পেরিয়ে বা অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আসতে হয়েছে। তাই মহাবিশ্ব যতই শীতল হয়েছে এর বলগুলো পরস্পর থেকে ভেঙে একটার পর একটা আলাদা হয়ে গেছে। পদার্থবিদদের কাজ এখন পেছন দিকে ফিরে গিয়ে মহাবিশ্ব যেভাবে শুরু হয়েছে (একটা চরম বিন্দু অবস্থা) সেই ধাপগুলো পুনর্নির্মাণ করা। এর মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে আমাদের চারপাশে দৃশ্যমান ভগ্ন মহাবিশ্বে আসা যাবে।

মহাবিশ্বের শুরুতে এই ক্রান্তিকাল পর্যায়গুলো কীভাবে ঘটল, তা সঠিকভাবে বোঝার মূল চাবিকাঠিকে পদার্থবিদেরা বলেন স্পন্টেনিয়াস ব্ৰেকিং বা স্বতঃস্ফূর্ত ভাঙন। এটা বরফের গলে যাওয়া, পানির বাষ্পীভবন, বৃষ্টি মেঘের সৃষ্টি, মহাবিশ্বের শীতল হওয়া, পর্যায়ের ক্রান্তিকালকে বস্তুর পুরো আলাদা পর্যায়কে সংযুক্ত করতে পারবে। (এই পর্যায় ক্রান্তিকাল কতটা শক্তিশালী হতে পারে, তা বোঝাতে শিল্পী বব মিলার একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করেছেন : ‘৫০০,০০০ পাউন্ড পানিকে ধারণ করার মতো কোনো দৃশ্যমান ভিত্তি ছাড়াই আপনি কীভাবে বাতাসে ভাসিয়ে রাখতে পারবেন? উত্তর হলো : একটা মেঘ তৈরি করা।’)

মেকি শূন্যতা

একটা বল যখন অন্য বলগুলো থেকে ভেঙে আলাদা হয়ে যায়, তখন এই প্রক্রিয়াকে একটা বাঁধ ভেঙে যাওয়ার সঙ্গে তুলনা করা যায়। নদী নিচের দিকে প্রবাহিত হয়। কারণ, পানির প্রবাহ সর্বনিম্ন শক্তির দিকে বয়ে যায়। এখানে সর্বনিম্ন শক্তি হলো সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা (sea level)। সর্বনিম্ন শক্তি স্তরকে বলা হয় ভ্যাকুয়াম বা শূন্যতা। তবে এখানে একটা অস্বাভাবিক অবস্থাও থাকে, যাকে বলা হয় ফলস ভ্যাকুয়াম বা মেকি শূন্যতা। যেমন কোনো নদীতে বাঁধ দিলে বাঁধটিকে স্থিতিশীল বলে মনে হয়। কিন্তু এটি আসলে চরম চাপের মুখে থাকে। বাঁধে ক্ষুদ্র ফাটল দেখা দিলে এই চাপটা হঠাৎ করে বাঁধটিকে ফাটিয়ে দিতে পারে। এতে মেকি শূন্যতা (বাঁধ দেওয়া নদী) থেকে প্রবল জলরাশির শক্তি বেরিয়ে আসবে। ফলে সত্যিকার শূন্যতায় (সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা) দিকে দুর্ভাগ্যজনক বন্যার কারণ হবে। বাঁধটা হঠাৎ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভেঙে গেলে পুরো গ্রাম বন্যায় তলিয়ে যেতে পারে এবং সত্যিকার শূন্যতায় একটা হঠাৎ ক্রান্তিকাল দেখা দেবে।

একইভাবে, GUT তত্ত্বে মহাবিশ্ব আসলে একটা মেকি শূন্যতা অবস্থা হিসেবে শুরু হয়। সেখানে এই তিনটি বল একটা একক বল হিসেবে একীভূত ছিল। তবে তত্ত্বটি অস্থিতিশীল। পাশাপাশি তত্ত্বটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেকি শূন্যতা থেকে ক্রান্তিকাল ভেঙে ও গড়ে (যেখানে বলগুলো একীভূত ছিল) সত্যিকার শূন্যতার দিকে যেতে থাকে। সেখানে বলগুলো ভেঙে পড়ে বা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

অ্যালান গুথ GUT থিওরি বিশ্লেষণ শুরুর আগেই এগুলো জানা গিয়েছিল। তবে গুথ এমন কিছু খেয়াল করেন, যা অন্যদের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। মেকি শূন্যতা অবস্থায় মহাবিশ্ব প্রসারিত হয়েছিল গুণনীয়ক হারে। ১৯১৭ সালে ডি সিটার ঠিক এমনই অনুমান করেছিলেন। মহাজাগতিক ধ্রুবক এখানে মেকি শূন্যতার শক্তি, যা মহাবিশ্বকে এ রকম বিপুল হারে প্রসারণের দিকে নিয়ে গেছে। গুথ নিজেকেই একটা ভাগ্যনির্ধারণী প্রশ্ন করেছেন : এই গুণনীয়ক ডি সিটার প্রসারণ কি কসমোলজির কিছু সমস্যার সমাধান করতে পারবে?

মনোপল সমস্যা

GUT থিওরি বা গাট তত্ত্বের অনেকগুলো অনুমানের মধ্যে একটা হলো, সময়ের সূচনালগ্নে প্রচুরসংখ্যক মনোপোল তৈরি হওয়া উচিত। মনোপোল বা এক মেরু হলো একটা একক চুম্বক, যার শুধু উত্তর বা দক্ষিণ মেরু থাকে। প্রকৃতিতে পাওয়া চুম্বকে এই দুই মেরু সব সময় জোড়ায় জোড়ায় পাওয়া যায়। একটা চুম্বক হাতে নিলে আপনি একই সঙ্গে উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরু দুটোকেই একত্রে বাঁধা থাকতে দেখতে পাবেন। একটা হাতুড়ি দিয়ে চুম্বকটিকে দুই ভাগ করা হলে দুটো আলাদা মনোপোল বা মেরু নয়, পাওয়া যাবে দুটি আলাদা চুম্বক। আর এই চুম্বকের প্রতিটিতে জোড়ায় জোড়ায় থাকবে উত্তর ও দক্ষিণ মেরু।

সমস্যাটি হলো, কয়েক শতাব্দী পরীক্ষার পরও বিজ্ঞানীরা মনোপোল বা এক মেরুর কোনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর মতো প্রমাণ খুঁজে পাননি। কেউই মনোপোল না দেখার কারণে গুথ ধাঁধায় পড়লেন, তত্ত্ব কেন এদের এত বেশি থাকার কথা অনুমান করেছে। ‘ইউনিকর্নের মতো, মনোপোলের কোনো নিশ্চিত অনুপস্থিতি সত্ত্বেও তা মানুষের মনকে মুগ্ধ করেছে।’ মন্তব্য করেছেন গুথ।

এরপর হঠাৎ একটা কথা তাঁর মাথায় আসে। হঠাৎ আলোর ঝলকের মতো একত্রে খাপে খাপে মিলে গেল সব কটি টুকরো। তিনি বুঝতে পারলেন, মহাবিশ্ব একটা মেকি শূন্যতা অবস্থার মধ্য দিয়ে শুরু হলে এটি গুণনীয়ক হারে প্রসারিত হতে পারবে। মহাবিশ্বের প্রসারণ নিয়ে কয়েক দশক আগে যে রকম প্রস্তাব করেছিলেন, এ ক্ষেত্রে ঘটতে পারবে ঠিক সেভাবেই। এই মেকি শূন্যতা অবস্থায় মহাবিশ্ব হঠাৎ করে ব্যাপক পরিমাণ প্রসারিত হতে পারবে, তাতে মনোপোলের ঘনত্ব পাতলা বা দুর্বল হয়ে যাবে। বিজ্ঞানীরা যদি আগে কখনো মনোপোল না দেখে থাকেন, তাহলে তার একমাত্র কারণ, মনোপোল এমন এক মহাবিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে, যা আগের ভাবনার চেয়েও আকৃতিতে অনেক অনেক প্রকাণ্ড।

গুথের জন্য এই গুপ্ত তথ্যের উন্মোচন ছিল আনন্দ আর বিস্ময়ের। এ রকম একটা সরল পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মনোপোল সমস্যার সমাধান হতে পারে। কিন্তু গুথ বুঝতে পারলেন, এই অনুমান তাঁর মৌলিক আইডিয়া ছাড়িয়ে মহাজাগতিক নিহিতার্থও থাকতে পারে।

মসৃণতার সমস্যা

গুথ বুঝতে পারেন, তাঁর তত্ত্বটি আরেকটি সমস্যারও সমাধান করে। সেটা আগের আলোচিত ফ্ল্যাটনেস প্রবলেম বা মসৃণতার সমস্যা। মহাবিশ্ব এত মসৃণ কেন, তা মহাবিস্ফোরণের আদর্শ চিত্রটি ব্যাখ্যা করতে পারে না। ১৯৭০-এর দশকে অনেকের বিশ্বাস ছিল, মহাবিশ্বে পদার্থের ঘনত্ব (যাকে ওমেগা বলা হয়) প্রায় ০.১। এটা ক্রান্তি ঘনত্ব ১.০-এর বেশ কাছাকাছি। মহাবিস্ফোরণের অনেক বিলিয়ন বছর পর তা ব্যাপক বিশৃঙ্খলার মধ্যে ছিল। মহাবিশ্ব প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওমেগার মান সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে বদলে যাওয়া উচিত ছিল। এই সংখ্যাটি ১.০ মানের অনেক কাছে, যা নিখুঁতভাবে একটা মসৃণ স্থানের বিবরণ দেয়।

সময়ের সূচনায় ওমেগার যেকোনো যৌক্তিক মানের জন্য সময়ের সূচনায় আইনস্টাইনের সমীকরণ দেখায়, বর্তমানে এর মান প্রায় শূন্য হওয়া উচিত। মহাবিস্ফোরণের কয়েক কোটি বছর পর ওমেগার মান ১- এর কাছাকাছি থাকার জন্য কোনো অলৌকিক কিছু ঘটা প্ৰয়োজন। কসমোলজিতে একে বলা হয় ফাইন টিউনিং প্রবলেম বা সূক্ষ্ম- সংগতিজনিত সমস্যা। ঈশ্বর অথবা সৃষ্টিকর্তাকে ওমেগার মান এ রকম বেছে নিয়ে বর্তমানের জন্য অসাধারণ নিখুঁতভাবে প্রায় ০.১ নির্ধারণ করতে হয়েছিল। বর্তমানে ওমেগার মান ০.১ থেকে ১০-এর মধ্যে হওয়ার মানে হলো, মহাবিস্ফোরণের এক সেকেন্ড পর ওমেগার মান অবশ্যই ১,০০০০০০০০০০০০০০ হতে হবে। অন্য কথায়, সময়ের সূচনালগ্নে ওমেগার মান অবশ্যই ১ থেকে এক শ ট্রিলিয়নের এক ভাগের সমান বেছে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এটা উপলদ্ধি করা খুব কঠিন।

একটা পেনসিলকে তার সুচালো সিসের ওপর খাড়াভাবে ভারসাম্য অবস্থায় দাঁড় করিয়ে রাখার কথা ভাবুন। আমরা যেভাবেই পেনসিলটিকে ভারসাম্যে রাখার চেষ্টা করি না কেন, স্বাভাবিক নিয়মে সেটা পড়ে যাবে। আসলে পেনসিলটি যাতে পড়ে না যায়, তার জন্য খুবই নির্ভুলভাবে সূক্ষ্ম-সংগতিতে ভারসাম্যে রাখার চেষ্টা করতে হবে পেনসিলটি। এখন পেনসিলটিকে তার সুচালো সিসের ওপর এমনভাবে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করুন, যাতে তা খাড়াভাবে মাত্র ১ সেকেন্ড নয়, কয়েক বছর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। দেখা যাবে, বর্তমানে ওমেগার মান ১.০ পাওয়ার জন্য বিপুল ফাইন টিউনিং দরকার। ওমেগার ফাইন টিউনিংয়ে অতিসামান্য ত্রুটিও ওমেগা ১-এর চেয়ে একেবারেই ভিন্ন কিছু পাওয়া যাবে। কাজেই ওমেগা যখন যথার্থভাবে অন্য কিছু হওয়া উচিত, সেখানে এর মান কেন ১-এর কাছাকাছি?

এ উত্তরটির ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন গুথ। মহাবিশ্ব সরলভাবে একটা লক্ষণীয় হারে প্রসারিত হয়েছে। ফলে তা মসৃণ বা সমতল করে দিয়েছে মহাবিশ্বকে। দিগন্ত দেখতে না পারার কারণে কেউ যখন সিদ্ধান্তে আসে যে পৃথিবী সমতল—অনেকটা সে রকম। একইভাবে জ্যোতির্বিদেরা সিদ্ধান্তে এসেছেন, স্ফীতির মসৃণতার কারণে মহাবিশ্বে ওমেগার মান ১-এর কাছাকাছি।

দিগন্ত সমস্যা

স্ফীতি শুধু মহাবিশ্বের মসৃণতার খাপ খাওয়া উপাত্তই সমর্থন করে না, সেই সঙ্গে হরাইজন প্রবলেম বা দিগন্ত সমস্যারও সমাধান করে। রাতের আকাশের যে প্রান্তেই তাকান না কেন, তা আপেক্ষিকভাবে সুষম দেখায়—এই সরল উপলব্ধিই এ সমস্যার ভিত্তি। আপনার মাথাটা ১৮০ ডিগ্রিতে ঘোরালেও দেখতে পাবেন, মহাবিশ্ব সুষম। এমনকি ১০ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে মহাবিশ্বের অংশবিশেষ দেখলেও একই মনে হবে। শক্তিশালী টেলিস্কোপ ব্যবহার করে মহাকাশ স্ক্যানিং করেও এ সুষমতার কোনো পরিমাপযোগ্য বিচ্যুতি পাওয়া যায়নি। আমাদের স্পেস স্যাটেলাইট থেকে দেখা গেছে, কসমিক মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশনও চরমভাবে সুষম। মহাকাশের যেকোনো জায়গায় তাকান না কেন, ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশনের তাপমাত্রা ১ ডিগ্রির ১ হাজার ভাগের ১ ভাগের বেশি বিচ্যুত হয় না।

কিন্তু এটা একটা সমস্যা। কারণ, আলোর গতি মহাবিশ্বের চূড়ান্ত গতিসীমা। রাতের আকাশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে আলো বা তথ্য যাওয়ার কোনো উপায় নেই। অন্তত মহাবিশ্বের জীবনকালে সেটা অসম্ভব। যেমন আমরা যদি মহাকাশের এক প্রান্তের মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশনের দিকে তাকাই, তা মহাবিস্ফোরণের পর থেকে ১৩ বিলিয়ন বছরের বেশি সময় ধরে ভ্রমণ করেছে। আমাদের মাথা ঘুরিয়ে যদি উল্টো দিকে তাকাই, তাহলেও দেখা যাবে মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশন হুবহু একই। সেটাও ১৩ বিলিয়ন বছরের বেশি ভ্রমণ করেছে। সেগুলোর তাপমাত্রা একই হওয়ার কারণে সময়ের সূচনালগ্নে তাদের মধ্যে অবশ্যই একটা তাপীয় সংযোগ ছিল। কিন্তু মহাবিস্ফোরণের পর থেকে রাতের আকাশের বিপরীত প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে (যা মধ্যবর্তী দূরত্ব ২৬ বিলিয়ন আলোকবর্ষ) কোনো তথ্য ভ্রমণ করার উপায় নেই।

পরিস্থিতিটা আরও ঘোলাটে হয়ে ওঠে যখন মহাবিস্ফোরণের ৩ লাখ ৮০ হাজার বছর পরের আকাশের দিকে তাকাই। তখন ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন মাত্র গঠিত হয়েছে। আকাশের বিপরীত প্রান্তে তাকালে দেখব, ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন প্রায় সুষম। কিন্তু মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব থেকে পাওয়া গণনা অনুযায়ী, বিপরীত প্রান্তগুলো ৯০ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে আলাদা (বিস্ফোরণের পর থেকে স্থানের প্রসারণের কারণে)। কিন্তু আলো ৯০ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরত্ব মাত্র ৩,৮০,০০০ বছরে পাড়ি দেবে, এমনটা হওয়ার কোনো উপায় নেই। তাহলে তথ্যকে আলোর চেয়েও বেশি গতিতে পাড়ি দিতে হবে, যা এককথায় অসম্ভব।

সত্যিকার অর্থে, মহাবিশ্ব কিছুটা পিণ্ডাকৃতির হওয়া উচিত ছিল, যেখানে এক প্রান্ত আরেকটি দূরবর্তী প্রান্তের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য খুব দূরের হতো। কিন্তু মহাবিশ্ব এত সুষম হলো কেন, যখন খোদ আলোই মিশে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় পায়নি? আবার মহাবিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে তথ্যও ছড়িয়ে পড়তে পারেনি? (প্রিন্সটনের পদার্থবিদ রবার্ট ডিক একেই বলেছেন হরাইজন প্রবলেম বা দিগন্ত সমস্যা। কারণ, দিগন্তই হলো আমাদের দেখা সবচেয়ে দূরবর্তী বিন্দু। আবার আলোর ভ্রমণের জন্যও তা সবচেয়ে দূরবর্তী বিন্দু।)

কিন্তু গুথ বুঝতে পারেন, স্ফীতিই হলো এই সমস্যা ব্যাখ্যার একমাত্র চাবিকাঠি। তিনি কারণ দেখালেন, আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্ব হয়তো কোনো আদি অগ্নিগোলকের অতিসামান্য অংশমাত্র। এই অংশটি নিজেই ঘনত্ব ও তাপমাত্রার দিক থেকে সুষম ছিল। কিন্তু স্ফীতি হঠাৎ করে সুষম পদার্থের এই ক্ষুদ্র অংশটিকে প্রসারিত করে ফেলে ১০ গুণ। প্রসারণের এ হার আলোর বেগের চেয়ে অনেক গুণ বেশি ছিল। কাজেই আজকের দৃশ্যমান মহাবিশ্ব লক্ষণীয় রকম সুষম। তাই রাতের আকাশে এবং মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশনে দৃশ্যমান মহাবিশ্বে এত সুষম। অথচ এককালে এটা ছিল এক আদি অগ্নিগোলকের সুষম অংশমাত্র, যা হঠাৎ করে প্রসারিত হয়ে আজকের এই মহাবিশ্বে পরিণত হয়েছে।

স্ফীতি নিয়ে প্রতিক্রিয়া

স্ফীতির ধারণাটি যে সঠিক, সে ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন অ্যালান গুথ। তবু বিষয়টি নিয়ে সবার সামনে প্রথমবার খোলাখুলি কথা বলতে শুরু করতে গিয়ে কিছুটা নার্ভাস হয়ে পড়েন। ১৯৮০ সালে তত্ত্বটি উপস্থাপন করেন তিনি। ‘তত্ত্বটির কিছু পরিণতি হয়তো ব্যাপকভাবে ভুল হতে পারে ভেবে বেশ দুচিন্তা হচ্ছিল। আরেকটা ভয়ও ছিল, হয়তো আমার স্ট্যাটাস নবিশ কসমোলজিস্ট হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় কি না।’ স্বীকার করেছেন তিনি। কিন্তু তাঁর তত্ত্ব এতই দক্ষ আর শক্তিশালী ছিল যে বিশ্বের পদার্থবিদেরা বেশ দ্রুত তার গুরুত্ব বুঝতে পারেন। নোবেলজয়ী মারি গেল-মান উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘আপনি কসমোলজির অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান করে ফেলেছেন!’ গুথকে নোবেল বিজয়ী শেলডন গ্ল্যাশো গোপনে বলেছিলেন, স্ফীতির কথা শুনে উন্মত্ত হয়ে ওঠেন স্টিভেন ওয়াইনবার্গ। চিন্তিত হয়ে গুথ জিজ্ঞেস করেন, “স্টিভ কি এ ব্যাপারে কোনো অভিযোগ করেছেন?’ জবাবে গ্ল্যাশো জানান, ‘আরে না, তার চিন্তা ছিল, তার নিজের মাথায় আইডিয়াটা আসেনি কেন।’ বিজ্ঞানীরা নিজেদের জিজ্ঞেস করতে শুরু করেন, এই সরল সমাধান তাদের মাথায় কেন আসেনি। গুথের তত্ত্বের ব্যাপ্তি দেখে বিস্মিত তাত্ত্বিক পদার্থবিদেরা প্রবল উৎসাহে তা স্বাগত জানান।

গুথের চাকরির ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলে তত্ত্বটি। চাকরির বাজারে মন্দা থাকার কারণে একদিন বেকার হয়ে পড়েন তিনি। ‘চাকরির বাজারে আমি ছিলাম প্রান্তিক পর্যায়ে।’ স্বীকার করেছেন গুথ। হঠাৎ শীর্ষ সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর কাছে চাকরির প্রস্তাব আসতে থাকে। কিন্তু তাঁর প্রথম পছন্দ এমআইটি থেকে কোনো অফার আসে না। কিন্তু এরপর তিনি রাশিচক্র পড়ে দেখেন, সেখানে লেখা আছে, ‘আপনি যদি মুখচোরা না হন, তাহলে আপনার ঠিক সামনেই একটা আকর্ষণীয় সুযোগ অপেক্ষা করছে।’ এটাই তাঁকে এমআইটিতে ফোন করে চাকরির ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়ার ব্যাপারে সাহস জোগাল। এমআইটি কদিন পরেই তাঁকে ফোন করে অধ্যাপনার প্রস্তাব দিলে হতভম্ব হন তিনি। এরপরের রাশিচক্রে তিনি লেখা দেখতে পান, ‘এ মুহূর্তে আবেগের বশবর্তী হয়ে কিছু করা ঠিক হবে না।’ তবে রাশিচক্রের পরামর্শ পাত্তা না দিয়ে তিনি এমআইটির প্রস্তাবটা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। ‘চীনের একটা রাশিচক্র এত কিছু জানবে কোত্থেকে?’ নিজেকে প্রশ্ন করেছিলেন তিনি।

এরপরও বেশ কিছু গুরুতর সমস্যা রয়ে গেল। গুথের তত্ত্বে খুব বেশি মুগ্ধ হতে পারেননি জ্যোতির্বিদেরা। কারণ, স্পষ্টত একটা জায়গায় দুর্বলতা ছিল, এটা ওমেগা সম্পর্কে ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করে। ওমেগা মোটামুটি ১-এর কাছাকাছি, যা স্ফীতিকে ব্যাখ্যা করতে পারে। তবে স্ফীতি আরও অগ্রসর হতে পারে এবং ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে যে মসৃণ মহাবিশ্ব বিবেচনা করলে ওমেগার মান (বা ওমেগা যোগ ল্যাম্বডা) নিখুঁতভাবে ১.০ হওয়া উচিত। পরের কয়েক বছর, মহাবিশ্বের বিপুল পরিমাণ গুপ্তবস্তুর অবস্থান শনাক্ত করে আরও অনেক পরীক্ষামূলক উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। এতে ওমেগার মান কিছুটা পাল্টে যায়, তা বেড়ে দাঁড়ায় ০.৩-এ। কিন্তু তারপরও এটা স্ফীতির জন্য মারাত্মক সম্ভাবনাময় ছিল। স্ফীতি নিয়ে এরপরের দশকে পদার্থবিদেরা তিন হাজারের বেশি গবেষণাপত্র লিখবেন। তবু জ্যোতির্বিদদের জন্য তখনো সেটা হয়ে থাকবে স্রেফ একটা কৌতূহলের বিষয়বস্তু। তাদের কাছে উপাত্তগুলো মনে হবে, স্ফীতির সঙ্গে সঠিকভাবে খাপ খায় না।

কয়েকজন জ্যোতির্বিদ ব্যক্তিগতভাবেও অভিযোগ করেছেন, কণা পদার্থবিজ্ঞান স্ফীতির সৌন্দর্য নিয়ে এত বেশি আচ্ছন্ন যে তাঁরা পরীক্ষামূলক সত্যকেও অস্বীকার করতে চাইছেন। [হার্ভার্ডের জ্যোতির্বিদ রবার্ট ক্রিশনার লিখেছেন, ‘এই স্ফীতির ধারণা উদ্ভট বলে মনে হয়। একে গুরুত্বের সঙ্গে কেবল তাঁরাই নিয়েছেন, যাঁরা উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া চেয়ার দখল করে শক্তভাবে বসে আছেন, স্বয়ংক্রিয়ভাবে এটা সঠিকে পরিণত হতে পারে না।’ অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানী রজার পেনরোজ ইনফ্লেশন বা স্ফীতিকে বলেছেন, ‘এমন একটা ভঙ্গি, যেন উচ্চশক্তির পদার্থবিদেরা কসমোলজিস্টদের দেখতে গিয়েছেন…এমনকি আর্ডভার্কও (আফ্রিকার এক প্রাণী) তাদের বাচ্চাদের সুন্দর বলে মনে করে।’]

গুথ বিশ্বাস করতেন, আগে হোক পরে হোক, উপাত্ত থেকে দেখা যাবে, মহাবিশ্ব সমতল বা সুষম। কিন্তু তাঁকে একটা বিষয় বেশ বিব্রত করেছিল। তাঁর এই মৌলিক চিত্রে একটা ছোট, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি ছিল। অবশ্য ত্রুটিটি এখনো ঠিকভাবে পুরোপুরি বোঝা যায়নি। নৈতিকভাবে স্ফীতি এক গুচ্ছ মহাজাগতিক সমস্যার সমাধান করতে পারে। কিন্তু সমস্যাটি হলো, স্ফীতি কীভাবে বন্ধ করতে হবে, তা তিনি জানতেন না।

একটা পাত্রে পানিকে তাপ দিতে দিতে স্ফুটনাঙ্কে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবুন। একে ফোটানোর একটু আগে, এটা ক্ষণিকের জন্য উচ্চশক্তি অবস্থায় থাকে। এটা ফুটতে চায়, কিন্তু তা হতে পারে না। কারণ বুদ শুরু করার জন্য এর কিছু অপদ্রব্য প্রয়োজন হয়। কিন্তু একবার বুদ্বুদ শুরু হলে, তা দ্রুত সত্যিকার শূন্যতার একটা নিম্নশক্তি অবস্থায় চলে যায় এবং পাত্রটি বুদে ভরে ওঠে। ক্রমে বুদগুলো এত বড় হয়ে ওঠে যে একত্র হতে থাকে। পাত্রটি সুষমভাবে বাষ্পে ভরে যাওয়া না পর্যন্ত চলতে থাকে এ অবস্থা। সব বুদ একত্র হয়ে গেলে, পানি থেকে বাষ্পীভবনের ক্রান্তিকাল সম্পূৰ্ণ হয়।

গুথের আদি চিত্রে, প্রতিটি বুদ্বুদ আমাদের মহাবিশ্বের একটা অংশের প্রতিনিধিত্ব করে, যা শূন্য থেকে প্রসারিত হয়েছে। কিন্তু গুথ এ-সংক্রান্ত গণনা করে দেখলেন, বুদ্বুদগুলো সঠিকভাবে একত্র হয়নি। কারণ, সেটি হলে মহাবিশ্ব অবিশ্বাস্য রকম পিণ্ড আকৃতির হয়ে পড়ে। অন্য কথায়, তার তত্ত্বটি পাত্রের মধ্যে বাষ্পীয় বুদ্বুদ রেখে যায়, যারা কখনোই একত্র হয়ে একটা সুষম বাষ্পের পাত্র হতে পারেনি। গুথের ফোটানো পানির পাত্র কখনোই বর্তমানের মহাবিশ্বে এসে পৌঁছাতে পারে না বলে মনে হয়।

১৯৮১ সালে রাশিয়ার পিএন লেবেদেব ইনস্টিটিউটের আন্দ্রেই লিন্দে এবং পেনসিলভানিয়ার পল জে স্টেইনহার্ট ও আন্দ্রিয়াস আলব্রেচ এই ধাঁধা সমাধানের একটা উপায় পান। তাঁরা বুঝতে পারেন, মেকি শূন্যতার একটা একক বুদ্বুদ যদি যথেষ্ট প্রসারিত হয়, তাহলে সেটা ক্রমান্বয়ে পুরো পাত্রটি ভরে ফেলবে এবং একটা সুষম মহাবিশ্ব গড়ে তুলবে। অন্য কথায়, আমাদের গোটা বিশ্বজগৎ একক একটা বুদ্বুদের উপজাত হতে পারবে, যা প্রসারিত হয়ে মহাবিশ্ব পরিপূর্ণ করবে। বাষ্পের একটা সুষম পাত্র বানাতে বিপুলসংখ্যক বুদ্বুদ একত্র হওয়ার কোনো দরকার নেই। স্ফীতির পরিমাণ যথেষ্ট বেশি হলেই কেবল একটা বুদ্বুদই সেটা করতে পারবে।

সেই বাঁধ আর মেকি শূন্যতার তুলনার কথা আরেকবার ভাবা যাক। বাঁধটি যত ঘন হবে, বাঁধের মধ্য দিয়ে পানির টানেল তৈরি করতে তত বেশি সময় লাগবে। বাঁধের দেয়াল পর্যাপ্ত ঘন হলে, টানেলিং হতেও দেরি হবে অনেক বেশি। মহাবিশ্ব যদি ১০^৫০ গুণ স্ফীত হয়, তাহলে একটা বুদ্বুদ দিগন্ত, সুষমতা ও এক মেরু সমস্যার সমাধানে পর্যাপ্ত সময় পাবে। অন্য কথায়, টানেলিংয়ে যদি যথেষ্ট দেরি হয়, তাহলে মহাবিশ্ব যথেষ্ট স্ফীত হয়ে সুষম হবে এবং মনোপোল বা এক মেরুত্বকে হালকা করে দেবে। কিন্তু এখানেও একটা প্রশ্ন রয়ে যায় : কোন কৌশলের কারণে স্ফীতি প্রক্রিয়া এত বিপুল পরিমাণে দীর্ঘায়িত করতে পারবে?

এই নাছোড়বান্দা সমস্যাটি ক্রমে পরিচিত হয় ‘গ্রেসফুল এক্সিট প্রবলেম’ বা মার্জিত প্রস্থান সমস্যা নামে। এর মানে, মহাবিশ্ব কীভাবে পর্যাপ্ত সময় ধরে স্ফীত হয়েছিল যে একটা একক বুদ্বুদ গোটা মহাবিশ্ব তৈরি করতে পারল। গ্রেসফুল এক্সিট প্রবলেম সমস্যার সমাধানে বেশ কয়েক বছর ধরে অন্তত ৫০টি ভিন্ন ভিন্ন কৌশলের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। (এটা একটা বিভ্রান্তিকর কঠিন সমস্যা। আমিও অনেকভাবে এটা সমাধানের চেষ্টা করেছি। আদিম মহাবিশ্বের একটা মার্জিত পরিমাণ স্ফীতি তৈরি করা তুলনামূলকভাবে সহজ। কিন্তু একে ১০^৫০ গুণ স্ফীত করে এই মহাবিশ্ব পাওয়া চরমভাবে কঠিন সহজভাবে ১০^৫০ গুণ দেওয়া অবশ্যই সহজ, কিন্তু তা হবে কৃত্রিম ও অস্বতঃস্ফূর্ত।) অন্য কথায়, স্ফীতির প্রক্রিয়া এক মেরুত্ব, দিগন্ত ও সুষমতা সমস্যার সমাধান করে বলে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয়। কিন্তু এখনো কেউই সঠিকভাবে জানে না, স্ফীতি কেন শুরু হলো এবং কেনই-বা হুট করে বন্ধ হয়ে গেল।

বিশৃঙ্খল স্ফীতি ও সমান্তরাল মহাবিশ্ব

পদার্থবিদ আন্দ্রেই লিন্দে একটা কারণে নিশ্চিন্তে ছিলেন, কেউই মার্জিত এক্সিট প্রবলেমের কোনো সমাধানের সঙ্গে একমত নয়। লিন্দে পরে স্বীকার করেছেন, ‘আমার শুধু এমন অনুভূতি হয়েছিল যে নিজের কাজটি সহজ করার জন্য এ ধরনের ভালো সম্ভাবনা ব্যবহার না করা স্বয়ং ঈশ্বরের পক্ষে ও অসম্ভব হতো।’

একসময় স্ফীতির নতুন এক সংস্করণের প্রস্তাব করেন লিন্দে। সেটা আগের সংস্করণের কিছু ত্রুটি দূর করেছিল বলে মনে করা হয়। তিনি এমন একটা মহাবিশ্বের কল্পনা করলেন, যার মধ্যে স্থান ও কালের ভেতর এলোমেলো বিন্দুগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত বিরতি ঘটে। বিরতি সংঘটিত হওয়া প্রতিটি বিন্দুতে একটি মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়, যেটি অল্প পরিমাণ স্ফীত হয়। বেশির ভাগ সময় এই স্ফীতির পরিমাণ তুচ্ছ। কিন্তু এ প্রক্রিয়াটি এলোমেলো হওয়ার কারণে ক্রমেই সেখানে একটা বুদের আবির্ভাব হবে, যেখানে আমাদের মহাবিশ্ব সৃষ্টি করার মতো স্ফীতি পর্যাপ্ত সময় পাবে। পাশাপাশি একে নিয়ে যাবে একটা যৌক্তিক উপসংহারে। এর মানে, স্ফীতি হলো চলমান এবং চিরন্তন। সহজ কথায়, মহাবিস্ফোরণ সব সময়ই ঘটছে। আর অন্যান্য মহাবিশ্ব থেকে আরও অনেক মহাবিশ্ব অঙ্কুরিত হচ্ছে। এই মত অনুযায়ী, বিভিন্ন মহাবিশ্ব অন্য আরও সব মহাবিশ্বের কুঁড়ি হিসেবে কাজ করতে পারে এবং মাল্টিভার্স বা বহুবিশ্ব তৈরি করতে পারে।

এই তত্ত্বে, স্বতঃস্ফূর্ত বিরতি হয়তো আমাদের মহাবিশ্বের ভেতরে যেকোনো জায়গায় সংঘটিত হয়। তাতে এর মাধ্যমে গোটা একটা মহাবিশ্ব থেকে অঙ্কুরিত হতে পারে আমাদের মহাবিশ্ব থেকে। এর থেকে আরও বোঝা যায়, আমাদের মহাবিশ্ব হয়তো আগের কোনো মহাবিশ্বের কুঁড়ি থেকে অঙ্কুরিত হয়ে থাকতে পারে। এই কোয়েটিক ইনফ্লেশনারি বা বিশৃঙ্খল স্ফীতিশীল মডেল, মাল্টিভার্স হলো চিরন্তন ঘটনা। এমনকি আলাদা মহাবিশ্ব যদি না-ও হয়, তারপরও তা হয়তো সত্যি হতে পারে। কিছু মহাবিশ্বের ওমেগার মান হয়তো অনেক বড়। সেসব ক্ষেত্রে তারা মহাবিস্ফোরণের পরপরই অবিলম্বে একটা বিগ ক্রাঞ্চে বিলীন হয়ে যাবে। কিছু মহাবিশ্বের ওমেগার মান অতিক্ষুদ্রও হতে পারে এবং সেগুলো চিরকাল প্রসারিত হতে থাকবে। যেসব মহাবিশ্ব ব্যাপক পরিমাণে স্ফীত হবে, সেগুলো একসময় মাল্টিভার্সগুলোতে আধিপত্য বিস্তার করবে।

পূর্বাপর ঘটনাগুলোর দিকে তাকালে, সেটা আমাদের ওপর প্যারালাল ইউনিভার্স বা সমান্তরাল মহাবিশ্বের ধারণা চাপিয়ে দেয়। গতানুগতিক বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্ব এবং কণা পদার্থবিদ্যার অগ্রগতির সঙ্গে একত্রীকরণের প্রতিনিধিত্ব করে এই স্ফীতি। কণা পদার্থবিজ্ঞান একটা কোয়ান্টাম তত্ত্ব। তাই কণা পদার্থবিজ্ঞানের মতে, এখানে সমান্তরাল মহাবিশ্ব সৃষ্টির মতো কোনো অসম্ভব ধরনের ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা সসীম। কাজেই আমরা যখন একটা মহাবিশ্ব সৃষ্টির সম্ভাবনার কথা স্বীকার করি, তখন আসলে অসংখ্য সমান্তরাল মহাবিশ্ব সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে দিই। যেমন কোয়ান্টাম তত্ত্বে ইলেকট্রনকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, সে কথা একবার ভেবে দেখুন। অনিশ্চয়তার কারণে ইলেকট্রন কোনো নির্দিষ্ট বিন্দুতে থাকে না, বরং নিউক্লিয়াসের চারদিকের সব কটি সম্ভাব্য বিন্দুতে তার অস্তিত্ব থাকে। নিউক্লিয়াসের চারদিকে ইলেকট্রন মেঘ থাকার মানে হলো, একই সময়ে অনেকগুলো জায়গায় থাকতে পারে এই ইলেকট্রন। এটাই সব রসায়নের মৌলিক ভিত্তি, যার মাধ্যমে আসলে ইলেকট্রনগুলো বিভিন্ন অণুকে একত্রে সংযুক্ত করতে পারে। আমাদের অণুগুলো বিলীন হয়ে যায় না। কারণ, সমান্তরাল ইলেকট্রন তাদের চারপাশে নৃত্যরত থাকে এবং সেগুলোকে একত্রে বেঁধে রাখে। ঠিক একইভাবে খোদ মহাবিশ্বও একসময় একটা ইলেকট্রনের চেয়েও ছোট ছিল। মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে আমরা যখন কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রয়োগ করি, তখন আমরা স্বীকার করতে বাধ্য হই যে মহাবিশ্ব একই সঙ্গে অনেকগুলো অবস্থা বা দশায় থাকতে পারে। অন্য কথায়, মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে যখন কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন প্রয়োগ করা হয়, তখন আমরা স্বীকার করতে প্রায় বাধ্য হই যে সমান্তরাল মহাবিশ্বের অস্তিত্বও আছে। এটি দেখে মনে হয়, এ ক্ষেত্রে আমাদের বেছে নেওয়ার খুব বেশি সুযোগ নেই।

শূন্য থেকে মহাবিশ্ব

প্রথমে হয়তো মাল্টিভার্স বা বহুবিশ্বের ধারণায় আপত্তি জানাতে পারে অনেকেই। কারণ, বস্তু ও শক্তির সংরক্ষণশীলতার মতো আমাদের জানা সূত্রগুলো প্রথম দর্শনে এটা লঙ্ঘন করে বলে মনে হয়। তবে একটা মহাবিশ্বের সর্বমোট বস্তু বা শক্তি আসলে হয়তো একেবারেই কমও হতে পারে। নক্ষত্র, গ্রহ আর ছায়াপথসহ মহাবিশ্বের সব বস্তু বা পদার্থের পরিমাণ বিপুল ও তা ধনাত্মক। তবে মহাকর্ষের ভেতর যে শক্তি জমা হয়ে আছে, তা ঋণাত্মকও হতে পারে। পদার্থের ধনাত্মক শক্তির সঙ্গে যদি মহাকর্ষের ঋণাত্মক শক্তি যোগ করা হলে তার যোগফল হতে পারে শূন্যের কাছাকাছি। অন্য অর্থে, এ ধরনের কোনো মহাবিশ্ব আসলে সৃষ্টিতে বাড়তি কোনো খরচ নেই। তারা আসলে শূন্য থেকে বিনা আয়াসে ছিটকে বেরিয়ে আসতে পারে। (মহাবিশ্ব যদি বদ্ধ হয়, তাহলে এর মোট শক্তির পরিমাণ অবশ্যই নিখুঁতভাবে শূন্য হতে হবে।)

(এটা বুঝতে চাইলে, ভূমির মধ্যে এক বিশাল গর্তে পড়ে যাওয়া একটা গাধার কথা কল্পনা করুন। গাধাটাকে বাইরে বের করে আনতে আমাদের শক্তি দিতে হবে। তাকে বাইরে একবার বের করে আনলে, সে মাটির ওপর দাঁড়ালে, সে শূন্য শক্তিতে আছে বলে মনে করবে। কাজেই গাধাটাকে শূন্য শক্তি অবস্থায় আনতে আমাদের শক্তি যোগ করতে হয়েছিল। তাই সে যখন গর্তের ভেতরে ছিল, তখন তার মধ্যে অবশ্যই ঋণাত্মক শক্তি ছিল একইভাবে, একটা সৌরজগতে থেকে কোনো গ্রহকে বাইরে টেনে নিয়ে যেতে শক্তির দরকার হয়। গ্রহটা কখনো উন্মুক্ত স্থানে বেরিয়ে গেলে তার শক্তি হবে শূন্য। আমরা যেহেতু গ্রহটাকে বাইরে টেনে বের করে তাকে শূন্য শক্তিতে আনতে শক্তি খরচ করেছি, তাই গ্রহটি যখন ওই সৌরজগতের ভেতরে ছিল তখন তার ঋণাত্মক মহাকর্ষ শক্তি ছিল। )

আসলে আমাদের মতো একটা মহাবিশ্ব সৃষ্টি করতে অবিশ্বাস্য রকম কম পরিমাণ পদার্থের প্রয়োজন পড়বে। হয়তো ১ আউন্সের মতো। গুথ বলতে পছন্দ করেন, ‘এই মহাবিশ্ব হয়তো একটা ফ্রি লাঞ্চ।’ শূন্য থেকে একটা মহাবিশ্ব সৃষ্টির ধারণাটি প্রথম দেন নিউইয়র্কের সিটি ইউনিভার্সিটির হান্টার কলেজের পদার্থবিদ এডওয়ার্ড ট্রায়ন। নেচার ম্যাগাজিনে ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত এক পেপারে এ বিষয়ে লিখেছিলেন তিনি। তিনি অনুমান করেন, মহাবিশ্ব এমন কিছু, যা শূন্যস্থানে কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের কারণে সময়ে সময়ে ঘটে। (অবশ্য তারপরও একটা মহাবিশ্ব সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় পদার্থের মোট পরিমাণ শূন্যের কাছাকাছি হতে পারে। এই পদার্থকে অবশ্যই অবিশ্বাস্য রকম ঘনত্বের হতে হবে। এ বিষয়ে ১২ অধ্যায়ে আলোচনা করা হবে।)

প্যান কু পৌরাণিক কাহিনির মতো, এটাও ক্রিয়েটিও এক্স নিহিলো (শূন্য থেকে সৃষ্টি) কসমোলজির একটা উদাহরণ। অবশ্য শূন্য থেকে মহাবিশ্ব সৃষ্টির তত্ত্ব প্রচলিত অর্থে প্রমাণের কোনো উপায় নেই। তবে এটা মহাবিশ্ব সম্পর্কে খুবই প্রায়োগিক কিছু প্রশ্নের জবাব দিতে পারে। যেমন মহাবিশ্ব ঘূর্ণনশীল নয় কেন? আমাদের চারপাশে আমরা যা-ই দেখি, সবই ঘুরছে। লাটিম থেকে শুরু করে ঘূর্ণিঝড়, গ্রহ, ছায়াপথ, কোয়াসার পর্যন্ত সবই ঘুরছে। এটাই মনে হয় মহাবিশ্বে পদার্থ বা বস্তুর সর্বজনীন ধর্ম। কিন্তু মহাবিশ্ব নিজে ঘুরছে না। আমরা যখন মহাকাশের ছায়াপথের দিকে তাকাই, তখন দেখা যায়, তাদের মোট ঘূর্ণন পরস্পরকে বাতিল করে শূন্য হয়ে যায়। (এটা বেশ সৌভাগ্যের ব্যাপার। কারণ, পঞ্চম অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাব, মহাবিশ্ব যদি ঘুরত তাহলে টাইম ট্রাভেল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়াত। আর সে ক্ষেত্রে ইতিহাস লেখা এক প্রকার অসম্ভব ব্যাপার হতো।) মহাবিশ্ব না ঘোরার কারণ হয়তো, আমাদের মহাবিশ্ব শূন্য থেকে এসেছে। কারণ, শূন্যস্থান কখনো ঘোরে না। আমরা কখনো আমাদের মহাবিশ্ব কোনো নেট বা বেঁচে যাওয়া অবশিষ্ট ঘূর্ণনের আবির্ভাব হচ্ছে—এমন ঘটনা দেখতে পাব না। আসলে মাল্টিভার্সের ভেতরের সবগুলো বুদ-মহাবিশ্বের ঘূর্ণন হয়তো শূন্যও হতে পারে।

ধনাত্মক আর ঋণাত্মক বৈদ্যুতিক চার্জ পরস্পরকে নিখুঁতভাবে বাতিল করে ভারসাম্যে আসে কেন? মহাজাগতিক বলগুলোর কথা ভাবতে গেলে স্বাভাবিকভাবে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বলের চেয়ে মহাকর্ষ বলের কথা বেশি চিন্তা করা হয়। কারণ, ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জের মধ্যে সুষম ভারসাম্য। ফলে মহাবিশ্বের মোট চার্জ শূন্য হতে দেখা যায়। তাই মহাবিশ্বে মহাকর্ষের আধিপত্য, বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বলের নয়।

আমরা বিষয়টি গ্রাহ্য না করলেও ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জের বাতিল হওয়ার ব্যাপারটিতে বেশ তাৎপর্য আছে। একে পরীক্ষামূলকভাবে ১০২১-এর মধ্যে ১ অংশ পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। (অবশ্য এই চার্জের মধ্যে স্থানীয়ভাবে কিছু ভারসাম্যহীনতাও থাকে। আর সে কারণেই বিদ্যুৎ চমকায়। কিন্তু চার্জের সর্বমোট পরিমাণ বজ্রপাতের ক্ষেত্রে যোগ হয়ে শূন্যতে পরিণত হয়।) আপনার দেহের ভেতরের ধনাত্মক ও ঋণাত্মক বৈদ্যুতিক চার্জের মধ্যে যদি মাত্র ০.০০০০১ শতাংশও পার্থক্য হয়, তাহলে আপনি তাৎক্ষণিকভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবেন। আর বৈদ্যুতিক চার্জের কারণে আপনার দেহের অংশগুলো নিক্ষিপ্ত হবে মহাকাশে।

এই দীর্ঘমেয়াদি ধাঁধার উত্তর হলো, মহাবিশ্ব শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়েছে। শূন্যস্থানের মোট স্পিন বা ঘূর্ণন ও চার্জ শূন্য হওয়ার কারণে শূন্য থেকে ছিটকে উদয় হওয়া যেকোনো শিশু মহাবিশ্বের মোট ঘূর্ণন ও চার্জও অবশ্যই শূন্য হবে।

তবে আপাতদৃষ্টে এই নিয়মের একটা ব্যতিক্রমও আছে। ব্যতিক্রমটা হলো, মহাবিশ্ব পদার্থ দিয়ে তৈরি, প্রতিপদার্থ দিয়ে নয়। পদার্থ ও প্রতিপদার্থ পরস্পরের বিপরীত (প্রতিপদার্থের চার্জ পদার্থের ঠিক বিপরীত)। তাই আমরা হয়তো অনুমান করতে পারি, মহাবিস্ফোরণে পদার্থ ও প্রতিপদার্থ তৈরি হয়েছিল ঠিক সমান পরিমাণে। সমস্যাটি হলো, পদার্থ এবং প্রতিপদার্থ পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়ে একটা গামা রশ্মি বিস্ফোরণের মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কথা। তাই যদি হতো, তাহলে আজ আমাদের কোনো অস্তিত্ব থাকার কথা নয়। সে ক্ষেত্রে আজকের পরিচিত সাধারণ পদার্থে পরিপূর্ণ থাকার বদলে মহাবিশ্বের হওয়া উচিত ছিল গামা রশ্মির এলোমেলো সম্ভার। মহাবিস্ফোরণ যদি নিখুঁতভাবে প্রতিসাম্য হতো (কিংবা এটা যদি শূন্য থেকে এসে থাকে), তাহলে আমাদের সমপরিমাণ পদার্থ ও প্রতিপদার্থ গঠিত হওয়ার প্রত্যাশা করা উচিত। কিন্তু আমাদের অস্তিত্ব আছে কেন? এই সমস্যা সমাধানের প্রস্তাব দেন রুশ পদার্থবিজ্ঞানী আন্দ্রেই শাখারভ। তাঁর প্রস্তাবিত সমাধানটি হলো, আদি মহাবিস্ফোরণে মোটেও নিখুঁত প্রতিসাম্য ছিল না। সৃষ্টির পরপরই সেখানে পদার্থ ও প্রতিপদার্থের মধ্যে অতি ক্ষুদ্র পরিমাণ প্রতিসাম্য ভেঙে গিয়েছিল। ফলে প্রতিপদার্থের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে সাধারণ পদার্থ। তাই আমাদের চারপাশে আজ এই পরিচিত মহাবিশ্ব অস্তিত্ব সম্ভব হয়েছে। (মহাবিস্ফোরণের সময়ে যে প্রতিসাম্য ভেঙে গিয়েছিল, তাকে বলা হয় সিপি সিমেট্রি বা সিপি প্রতিসাম্য। অর্থাৎ এটা এমন প্রতিসাম্য, যা চার্জগুলো বাতিল করে দেয় এবং পদার্থ ও প্রতিপদার্থ কণার মধ্যে সমতা আনে।) মহাবিশ্ব যদি স্রেফ শূন্য থেকে এসে থাকে, তাহলে তা নিখুঁতভাবে শূন্য হবে না, বরং কিছু পরিমাণ প্রতিসাম্য ভাঙা থাকবে। এ কারণে বর্তমানের প্রতিপদার্থের ওপর থাকবে পদার্থের আধিপত্য। তবে প্রতিসাম্য ভেঙে যাওয়ার ঘটনা কেন ঘটল, তা-ও এখনো সঠিকভাবে বোঝা যায়নি।

অন্য সব মহাবিশ্বের চেহারা কেমন হতে পারে

মাল্টিভার্স বা বহুবিশ্বের ধারণাটা বেশ আকর্ষণীয়। কারণ, শুধু এখানে এলোমেলোভাবে সংঘটিত স্বতঃস্ফূর্ত সিমেট্রি ব্রেকিং অনুমান করতে হয়। অন্য আর কোনো অনুমানের প্রয়োজন নেই। আরেকটি মহাবিশ্ব থেকে কোনো একটা মহাবিশ্ব অঙ্কুরিত হলে, ভৌত ধ্রুবকগুলো মূল থেকে পৃথক হয়ে যায় এবং নতুন ভৌত সূত্র বা আইন গঠন করে। এ কথা সত্যি হলে, প্রতিটি মহাবিশ্বের ভেতরে সম্পূর্ণ নতুন বাস্তবতা আবির্ভূত হতে পারে। কিন্তু এর ফলে একটা জটিল প্রশ্নও ওঠে। প্রশ্নটি হলো : তাহলে অন্য মহাবিশ্বগুলো দেখতে কেমন? প্যারালাল ইউনিভার্সের পদার্থবিজ্ঞান বোঝার মূল চাবিকাঠি হলো, স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিসাম্য ভাঙন ঘটার প্রক্রিয়া সঠিকভাবে বোঝা।

কোনো মহাবিশ্বের যখন জন্ম হয় এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভাঙন ঘটতে থাকে, তখন এই প্রতিসাম্যের আদি তত্ত্বও ভেঙে যায়। একজন পদার্থবিদের কাছে সৌন্দর্যের মানে হলো প্রতিসাম্যতা ও সরলতা। কোনো তত্ত্ব সুন্দর হওয়ার মানে, এর একটা শক্তিশালী প্রতিসাম্যতা আছে। এই প্রতিসাম্যতা বিপুল সংখ্যা উপাত্তকে সংক্ষিপ্ত, কিন্তু গভীর অর্থবোধক ও যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। আরও স্পষ্টভাবে বললে, একটা সমীকরণকে সুন্দর বলে বিবেচনা করা হয়, যদি তার ভেতরের উপাদানগুলো পারস্পরিক বিনিময় করার পরও তা আগের মতো একই থাকে। প্রকৃতির গুপ্ত প্রতিসাম্যতা খুঁজে বের করার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, আমরা দেখাতে পারি, যেসব পরিঘটনা দৃশ্যত আলাদা বলে মনে হয়, সেগুলো আসলে একই জিনিস। সেগুলো পরস্পরের সঙ্গে একটা প্রতিসাম্যের মাধ্যমে সংযুক্ত। যেমন দেখানো যায়, বিদ্যুৎ ও চুম্বকত্ব আসলে একই বিষয়ের দুটি ভিন্ন ভিন্ন দিক। কারণ, তাদের মধ্যে একটা প্রতিসাম্যতা আছে, যা ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণের মাধ্যমে তাদের মধ্যে পারস্পরিক বিনিময় করা যায়। একইভাবে আইনস্টাইন প্রমাণ করেছেন, আপেক্ষিকতা স্থানকে সময়ে বদলে দিতে পারে। আবার একই সঙ্গে উল্টোটাও সত্য। কারণ, তারা আসলে একই বিষয়ের অংশ, অর্থাৎ তারা স্থান-কালের বুনন।

একটা তুষারকণার কথা ভাবুন, যার ছয় পরতের সুন্দর একটা প্রতিসাম্যতা আছে, যা অন্তহীন এক মুগ্ধতার উৎস। এর সৌন্দর্যের সারমর্ম হলো তুষারকণাটিকে ৬০ ডিগ্রি ঘোরালেও তা একই রকম দেখায়। এর আরেকটি অর্থ হলো, তুষারকণাকে বর্ণনার জন্য আমরা যেকোনো সমীকরণ লিখি না কেন, তাকে সত্যের প্রতিচ্ছবি হতে হবে। অর্থাৎ ৬০ ডিগ্রি গুণিতকে ঘূর্ণনে অপরিবর্তনীয় থাকবে সেটা। গাণিতিকভাবে আমরা বলতে পারি, তুষারকণাটির প্রতিসাম্যতা Co।

প্রতিসাম্যের মধ্যে তখন প্রকৃতির গুপ্ত সৌন্দর্য লিপিবদ্ধ হবে। কিন্তু বাস্তবে এসব প্রতিসাম্যতা এখন ভয়াবহভাবে ভেঙে গেছে। মহাবিশ্বের চারটি বলের মধ্যে এখন আর কোনো মিল নেই। আসলে মহাবিশ্ব অনিয়ম আর ত্রুটিতে ভরে গেছে। আমাদের চারপাশে মহাবিস্ফোরণের আদিম প্রতিসাম্যের ভগ্ন টুকরো। কাজেই সম্ভাব্য সমান্তরাল মহাবিশ্বকে বুঝতে চাইলে, প্রতিসাম্যের ভাঙনও বুঝতে হবে। অর্থাৎ মহাবিস্ফোরণের পর এই প্রতিসাম্যতা কেন ভেঙে গেল, তা বুঝতে হবে আমাদের। এ সম্পর্কে পদার্থবিদ ডেভিড গ্রস বলেন, ‘প্রতিসাম্যতা প্রকৃতির গুপ্ত ব্যাপার। কিন্তু বিশ্বের অধিকাংশ বুননের পেছনের কারণ এই প্রতিসাম্যতার ভাঙন।

সহস্র টুকরো হয়ে যাওয়া একটা সুন্দর আয়নার কথা একবার কল্পনা করুন। মূল আয়নায় চমৎকার এক প্রতিসাম্যতা ছিল। আয়নাটাকে যেকোনো কোণে ঘোরালেও তা থেকেই আলো প্রতিফলিত হতো একইভাবে। কিন্তু টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যাওয়ার পর এর আদি প্রতিসাম্যতাও ভেঙে যায়। এই প্রতিসাম্যতা কীভাবে ভাঙল, তা নিখুঁতভাবে নির্ধারণ করা গেলে আয়নাটা কীভাবে টুকরো টুকরো হয়ে গেল, তা-ও নির্ধারণ করা যাবে।

সিমেট্রি ব্রেকিং

সেটা দেখতে গেলে, একটা ভ্রূণের বিকাশের কথা ভাবা যাক। গর্ভধারণের কদিন পর বা প্রথম অবস্থায় একটা ভ্রূণ নিখুঁত গোলকীয় কোষ দিয়ে গঠিত হয়। একটা কোষ থেকে আরেকটায় কোনো পার্থক্য থাকে না এ সময়। একে যেদিকেই ঘোরানো হোক না কেন, তা দেখতে একই রকম লাগে। পদার্থবিদেরা বলেন, ভ্রূণের এই অবস্থার সিমেট্রি বা প্রতিসাম্যতা O(3)। অর্থাৎ একে যেকোনো দিকেই ঘোরালেও তার চেহারা একই থেকে যায়।

ভ্রূণটা সুন্দর আর চমৎকার হলেও এটা একই সঙ্গে অকেজো। কারণ, এটা নিখুঁত গোলকীয় হলেও পার্শ্ববর্তী পরিবেশের সঙ্গে কোনো মিথস্ক্রিয়া বা কোনো কাজ করতে পারে না। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভ্রূণের প্রতিসাম্যতা ভেঙে একটা অতিক্ষুদ্র মাথা ও দেহ বিকশিত হয়। একে অনেকটা বোলিং পিনের মতো বলে মনে হয়। ভ্রূণের আদি প্রতিসাম্যতা তখন ভেঙে গেলেও প্রতিসাম্যতার একটা ভগ্নাংশ বিরাজ করে তাতে। এর অক্ষ বরাবর একে ঘোরানো হলেও তা দেখতে একই থাকে। কাজেই তখন এর প্রতিসাম্যতা সিলিন্ডারাকৃতির। গাণিতিকভাবে বলা যায়, আদি O(3) গোলকের প্রতিসাম্যতা ভেঙে এখন সিলিন্ডারের O(2) প্রতিসাম্য অবস্থায় এসেছে।

O(3) প্রতিসাম্যতা ভাঙন এগিয়ে যেতে পারে আরও ভিন্ন প্রক্রিয়ায়ও। যেমন স্টারফিশের সিলিন্ডার আকৃতির বা দ্বিপার্শ্বীয় প্রতিসাম্যতা নেই, তার বদলে গোলকীয় প্রতিসাম্যতা ভেঙে গেলে তাদের Cg প্রতিসাম্যতা থাকে (যা ৭২ ডিগ্রি ঘূর্ণনে একই থাকে)। এ কারণে পাঁচটি বিন্দুসম্পন্ন নক্ষত্রের আকার পায় তারা মাছ। কাজেই কোনো জীব জন্মের সময় কোনোভাবে প্রতিসাম্যতা ভাঙার ওপর তার আকৃতি নির্ধারিত হয়।

একইভাবে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, মহাবিশ্বের শুরুও হয়েছিল একটা নিখুঁত প্রতিসাম্য অবস্থায়। সে সময় মহাবিশ্বের সব কটি বল একটা একক বলে একীভূত হয়েছিল। ওই মহাবিশ্ব সুন্দর ও প্রতিসাম্য ছিল, কিন্তু তা একই সঙ্গে ছিল অকেজোও। আমাদের চেনাজানা জীবন রূপের অস্তিত্ব ওই সুষম অবস্থায় টিকে থাকতে পারত না। তাই জীবনের অস্তিত্ব সম্ভব করে তুলতে মহাবিশ্বের শীতল হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিসাম্যতা অনিবার্যভাবে ভাঙতে হয়েছিল।

প্রতিসম ও স্ট্যান্ডার্ড মডেল

একইভাবে, সমান্তরাল মহাবিশ্ব কেমন হতে পারে, তা বুঝতে হলে, আমাদের অবশ্যই প্রথমে শক্তিশালী, দুর্বল ও বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বলের মিথস্ক্রিয়ার প্রতিসাম্যতা বুঝতে হবে। যেমন শক্তিশালী বলের ভিত্তি তিনটা কোয়ার্ক বিজ্ঞানীরা কোয়ার্কগুলোকে কল্পিত রঙে (কালার) চিহ্নিত করেছেন (যেমন লাল, সাদা ও নীল)। আমরা চাই এই তিনটা কালারের কোয়ার্ক পারস্পরিক বিনিময়ের পরও সমীকরণগুলো যেন একই থাকে। তাহলে আমরা বলতে পারব, সমীকরণগুলোর SU(3) প্রতিসাম্যতা রয়েছে। অর্থাৎ কোয়ার্ক তিনটিকে আমরা যখন রদবদল করব, তখনো সমীকরণগুলো একই থাকবে। বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, SU(3) প্রতিসাম্যতাসম্পন্ন কোনো তত্ত্ব শক্তিশালী বলের মিথস্ক্রিয়ার সবচেয়ে সঠিক বিবরণ দেয় (যাকে বলা হয় ক্রোমোডাইনামিকস)। ধরা যাক, আমাদের কাছে একটা প্রকাণ্ড সুপারকম্পিউটার আছে। তাহলে তা দিয়ে কোয়ার্কগুলোর ভর এবং তাদের মিথস্ক্রিয়ার শক্তি গণনা শুরু করলে, তাত্ত্বিকভাবে প্রোটন ও নিউট্রনের ধর্ম এবং পারমাণবিক পদার্থবিদ্যার সব ধর্ম গণনা করা যেত।

একইভাবে, ধরা যাক আমাদের কাছে দুটি লেপটন বা ইলেকট্রন ও নিউট্রিনো আছে। কোনো সমীকরণে তাদের মধ্যে পারস্পরিক বিনিময় করা হলে আমাদের কাছে থাকবে SU(2) প্রতিসাম্যতা। আমরা আলো ছুড়েও কাজটি করতে পারি। আলোর প্রতিসাম্য গ্রুপ U(1)। (এই প্রতিসাম্য গ্রুপ পরস্পরের মধ্যে বিভিন্ন আলোর উপাদান বা পোলারাইজেশন অদলবদল করে।) কাজেই দুর্বল আর বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বলের মিথস্ক্রিয়ার প্রতিসাম্য গ্রুপ হলো SU(2) × U ( 1 )।

এই তিনটি তত্ত্বকে সরলভাবে একসঙ্গে সংযুক্ত করা হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই—আমরা SU (3) × SU (2) × U(1) পাব। অন্য কথায়, এই প্রতিসাম্যতায় তিনটা কোয়ার্ক ও দুটি লেপটনকে আলাদাভাবে নিজেদের মধ্যে মিশে গেছে (তবে এখানে কোয়ার্কের সঙ্গে লেপটন মেশেনি)। পরিণতিতে পাওয়া যায় স্ট্যান্ডার্ড মডেল বা প্রমিত মডেল। আগেই দেখেছি, এই মডেল সম্ভবত সর্বকালের সবচেয়ে সফল তত্ত্বগুলোর মধ্যে অন্যতম। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ডন কেন এ সম্পর্কে বলেন, ‘আমাদের বিশ্বে যা কিছু ঘটে (একমাত্র মহাকর্ষের প্রভাব বাদে) তা স্ট্যান্ডার্ড মডেলের কণাদের মিথস্ক্রিয়ার ফলাফল।’ এর কিছু ভবিষ্যদ্বাণী গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। সত্যি বলতে কি, ২০ জন পদার্থবিদকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, কারণ স্ট্যান্ডার্ড মডেলের টুকরো টুকরো অংশগুলো একত্র করেছেন তাঁরা।)

শেষ পর্যন্ত কেউ একজন হয়তো এমন একটা তত্ত্ব গড়ে তুলতে পারবে, যা শক্তিশালী, দুর্বল ও বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় মিথস্ক্রিয়াকে একটা একক প্রতিসাম্যতায় বাঁধতে পারবে। সরলতম GUT তত্ত্ব পাঁচটি কণার সব কটির (তিনটি কোয়ার্ক ও দুটি লেপটন) মধ্যে তাৎক্ষণিকভাবে পারস্পরিক বিনিময় ঘটাতে পারে। স্ট্যান্ডার্ড মডেলের প্রতিসাম্যতার তুলনায় GUT প্রতিসাম্যতা একটু আলাদা। GUT প্রতিসাম্যতা কোয়ার্ক আর লেপটনকে একসঙ্গে মেশাতে পারে (মানে, প্রোটন ক্ষয় হয়ে ইলেকট্রনে পরিণত হতে পারে)। অন্য কথায়, GUT তত্ত্বের প্রতিসাম্যতা SU(5) (তিনটি কোয়ার্ক ও দুটি লেপটন বা পাঁচটি কণার সব কটিকে পরস্পরের মধ্যে অদলবদল করতে পারে)। অনেক বছর ধরে, অন্যান্য প্রতিসাম্য গ্রুপ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কিন্তু SU(5) প্রতিসাম্যতা সম্ভবত সূক্ষ্মতম গ্রুপ, যা উপাত্তের সঙ্গে মেলে।

স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভাঙন ঘটলে মূল GUT প্রতিসাম্য ভেঙে যেতে পারে বিভিন্নভাবে। একটা উপায় হলো, GUT প্রতিসাম্যতা SU(3) × SU(2) × U(1)-তে ভেঙে যেতে পারে। এখানে সুনির্দিষ্টভাবে ১৯টি মুক্ত প্যারামিটার থাকে, যেগুলো আমাদের মহাবিশ্বের বিবরণের জন্য দরকার। এটা আমাদের পরিচিত মহাবিশ্ব দিতে পারে। তবে GUT প্রতিসাম্যতা ভাঙার আরও অনেক উপায় আছে। সেগুলোর কারণে অন্যান্য মহাবিশ্বে হয়তো অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরোপুরি ভিন্ন প্রতিসাম্যের ভগ্নাংশ থাকবে। এই ন্যূনতম অবস্থায় এসব সমান্তরাল মহাবিশ্বে হয়তো এই ১৯টি প্যারামিটারের মান হতে পারে বিভিন্ন রকমের। অন্য কথায়, ভিন্ন ভিন্ন মহাবিশ্বে বিভিন্ন বলের শক্তি হয়তো ভিন্ন ভিন্ন রকম। ফলে ওই সব মহাবিশ্বের কাঠামোতেও আসতে পারে ব্যাপক পরিবর্তন। যেমন পারমাণবিক বলের শক্তিমত্তা কমে গেলে, নক্ষত্র গঠিত হতে পারবে না। তাতে মহাবিশ্ব চিরস্থায়ীভাবে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে থাকবে এবং সেখানে জীবনের উন্মেষও হয়ে উঠবে অসম্ভব। আবার পারমাণবিক বলের শক্তিমত্তা অনেক বেশি বাড়ানো হলে, নক্ষত্ররা নিজেদের নিউক্লিয়ার জ্বালানি এত দ্রুত পুড়িয়ে ফেলবে যে জীবন গঠিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট সময়ও পাবে না।

আবার প্রতিসাম্য গ্রুপও বদলে যেতে পারে। ফলে গড়ে উঠতে পারে পুরোপুরি ভিন্ন কণা দিয়ে গঠিত মহাবিশ্ব। এসব মহাবিশ্বের কোনো কোনোটিতে প্রোটনও স্থিতিশীল না-ও হতে পারে এবং প্রোটন দ্রুত ক্ষয় হয়ে অ্যান্টি- ইলেকট্রনে রূপান্তরিত হতেও পারে। এ রকম মহাবিশ্বে আমরা যেমন জীবন বা প্রাণের সঙ্গে পরিচিত তেমন জীবের উদ্ভব হওয়া সম্ভব নয়। তবে সে মহাবিশ্বটি দ্রুত ইলেকট্রন ও নিউট্রিনোর প্রাণহীন কুয়াশায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। অন্যান্য মহাবিশ্বে GUT প্রতিসাম্যতা হয়তো ভেঙে যেতে পারে আরও ভিন্ন কোনো উপায়ে। তাতে সেখানে প্রোটনের মতো আরও স্থিতিশীল কণা থাকতেও পারে। এ ধরনের মহাবিশ্বে গড়ে উঠতে পারে বিপুল বৈচিত্র্যময় অদ্ভুত নতুন রাসায়নিক মৌলের সম্ভার। আবার এসব মহাবিশ্বের প্রাণের অস্তিত্ব হয়ে উঠতে পারে আমাদের চেয়েও জটিল। এর মধ্যে হয়তো আরও অন্য ধরনের রাসায়নিক মৌল থাকবে, যা থেকে ডিএনএর মতো রাসায়নিক তৈরি হতে পারবে।

আমরা মূল GUT প্রতিসাম্যতাও ভাঙতে পারি। তাতে আমাদের কাছে একের বেশি U(1) প্রতিসাম্যতা থাকবে। ফলে এখানে একাধিক আলোর রূপ থাকতে পারে। সেটা হতে পারে অতি অদ্ভুত একটা মহাবিশ্ব। কে জানে সেখানকার জীবগুলো হয়তো শুধু এক ধরনের বল ব্যবহার করে নয়, বরং একাধিক বল ব্যবহার করে ‘দেখতে’ পারে। এমন কোনো মহাবিশ্বে যেকোনো জীবের চোখ জোড়ায় বিপুলসংখ্যক রিসেপ্টর থাকতে পারে, যা দিয়ে হয়তো আলোর মতো অন্যান্য বিকিরণও শনাক্ত করতে পারে তারা।

অবাক হওয়ার কিছু নেই, এই প্রতিসাম্যতা শত শতভাবে, হয়তো অসীমসংখ্যকভাবে ভেঙে যেতে পারে। এদের প্রতিটি সমাধানে হয়তো পুরোপুরি ভিন্ন মহাবিশ্ব গঠিত হবে।

পরীক্ষণযোগ্য ভবিষ্যদ্বাণী

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বিভিন্ন ভৌত সূত্রধারী বিভিন্ন মহাবিশ্বে মাল্টিভার্স থিওরি পরীক্ষা করার সম্ভাবনা বর্তমানে একেবারে অসম্ভব। অন্য কোনো মহাবিশ্বে যেতে চাইলে আলোর চেয়েও বেশি বেগে ভ্রমণ করতে হবে। কিন্তু স্ফীতি তত্ত্বের একটা সুবিধা হলো, তত্ত্বটা আমাদের মহাবিশ্বের প্রকৃতি সম্পর্কে এমন কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করে, যেগুলো পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব।

স্ফীতি তত্ত্ব একটা কোয়ান্টাম তত্ত্ব, যার ভিত্তি হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার নীতি (যা কোয়ান্টাম তত্ত্বের ভিত্তি)। (অনিশ্চয়তার নীতিমতে, কোনো কিছুই অসীম নির্ভুলভাবে মাপা যাবে না। যেমন কোনো একটা ইলেকট্রনের ভরবেগ ও অবস্থান। আপনার যন্ত্রপাতি যতই সংবেদশীল বা সূক্ষ্ম হোক না কেন, পরিমাপে সব সময়ই অনিশ্চয়তা থাকবে। ইলেকট্রনটার ভরবেগ জানা গেলে তার অবস্থান সঠিকভাবে জানা যাবে না। আবার যদি তার অবস্থাটা সঠিকভাবে জানা যায়, তাহলে তার ভরবেগ জানা যাবে না।) মহাবিস্ফোরণ সৃষ্টি করা সেই আদিম অগ্নিগোলকে স্ফীতি তত্ত্ব প্রয়োগ করলে দেখা যায়, মূল মহাজাগতিক বিস্ফোরণ কখনোই অসীমভাবে মসৃণ হতে পারে না। (এটা নিখুঁত রকম সুষম হলে মহাবিস্ফোরণ থেকে উদ্ভূত অতিপারমাণবিক কণাদের গতিপথ নিখুঁতভাবে জানা যেত। কিন্তু সেটা অনিশ্চয়তায় নীতির লঙ্ঘন করত।) কোয়ান্টাম তত্ত্ব আমাদের এই মূল অগ্নিগোলকে এসব ঢেউ বা ফ্ল্যাকচুয়েশনের আকার নির্ণয়ের সুযোগ দেয়। আমরা যদি এসব অতিক্ষুদ্র কোয়ান্টাম ঢেউগুলো স্ফীত করি, তাহলে সর্বনিম্নসংখ্যক ঢেউ গণনা করতে পারব। মহাবিস্ফোরণের ৩৮০,০০০ বছর পরের মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশনে সেগুলো আমাদের দেখতে পাওয়া উচিত। (এসব ঢেউকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রসারিত করা হলে, গ্যালাকটিক ক্লাস্টারের বর্তমান বণ্টনে খুঁজে পাওয়ার কথা। আমাদের গ্যালাক্সি এ রকম কোনো অতিক্ষুদ্র ফ্ল্যাকচুয়েশন থেকে শুরু হয়েছিল।)

প্রাথমিকভাবে কোব স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া উপাত্তগুলো সূক্ষ্মভাবে দেখলে, মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডে বিচ্যুতি বা ফ্ল্যাকচুয়েশন পাওয়া যায়নি। এ ঘটনা পদার্থবিদদের উদ্বেগের মধ্যে ফেলেছিল। কারণ, একটা নিখুঁতভাবে মসৃণ মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড শুধু স্ফীতিকেই লঙ্ঘন করে না, সেই সঙ্গে পুরো কোয়ান্টাম তত্ত্ব, তথা অনিশ্চয়তার নীতিকেও লঙ্ঘন করে। এ ঘটনাটা বেশ নাড়া দিয়েছিল পদার্থবিজ্ঞানকে। বিশ শতকের কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের পুরো ভিত্তিটাকে এটা হয়তো নড়বড়ে করে দেয় এমন একটা অবস্থা।

অবশেষে কোব স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া উপাত্তে কম্পিউটারে বর্ধিত করে একটা অস্পষ্ট ঢেউয়ের মতো গুচ্ছ দেখতে পেয়ে একটু স্বস্তি পান বিজ্ঞানীরা। এর তাপমাত্রার পার্থক্য ছিল ১০০,০০০ ভাগের ১ ভাগ। অর্থাৎ কোয়ান্টাম তত্ত্ব যে সর্বনিম্ন বিচ্যুতি সহ্য করতে পারে সে পরিমাণ। এই অণুমাত্র ঢেউ স্ফীতি তত্ত্বের সঙ্গে বেশ খাপখায়। গুথ স্বীকার করেছেন, ‘মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণের কারণে আমি পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছিলাম। এই সংকেত এতই দুর্বল যে ১৯৬৫ সালের আগপর্যন্ত তা শনাক্ত করাও সম্ভব হয়নি। এখন এতে ১০০,০০০ ভাগের মধ্যে এক ভাগ ফ্ল্যাকচুয়েশন মাপা গেছে।’

পরীক্ষামূলক প্রমাণাদি ধীরে ধীরে স্ফীতির পক্ষে জড়ো হতে থাকলেও, বিজ্ঞানীরাও এখন ওমেগার মানের সেই বিরক্তিকর সমস্যাটা (ওমেগা ১.০ না হয়ে ০.৩ ছিল কেন) সমাধানের চেষ্টা করছেন।

সুপারনোভা-ল্যাম্বডার প্রত্যাবর্তন

কোব স্যাটেলাইট থেকে বিজ্ঞানীদের সংগৃহীত উপাত্তের সঙ্গে স্ফীতি বেশ খাপ খায় বলে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকেও জ্যোতির্বিদেরা ঘোঁত ঘোঁত করে অভিযোগ করতে শুরু করেন যে স্ফীতি ওমেগাবিষয়ক পরীক্ষামূলক উপাত্তকে নিদারুণভাবে লঙ্ঘন করে। এই জোয়ার প্রথম শুরু হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত একটা দিক থেকে উপাত্ত পাওয়ার কারণে এটা শুরু হয়েছিল। সুদূর অতীতে মহাবিশ্বের প্রসারণের হার নতুনভাবে গণনার চেষ্টা করেন জ্যোতির্বিদেরা। ১৯২০-এর দশকে সেফিড ভেরিয়েবল বিশ্লেষণ করেছিলেন হাবল। কিন্তু তা না করে অতীতের কয়েক কোটি আলোকবর্ষ দূরের সুদূর গ্যালাক্সিগুলোতে সুপারনোভা পরীক্ষা করতে শুরু করেন এই জ্যোতির্বিদেরা। বিশেষ করে Ia টাইপের সুপারনোভা পরীক্ষা করে দেখা হলো। এরা সাধারণত স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডেল হিসেবে ব্যবহারের উপযোগী।

জ্যোতির্বিদেরা জানেন, এ রকম সুপারনোভার উজ্জ্বলতা প্রায় একই রকম। (Ia টাইপের সুপারনোভার উজ্জ্বলতা জানা ছিল বেশ ভালোমতো। তাই এর মাধ্যমে সামান্য বিচ্যুতিও মাপা গেল। সুপারনোভা যত উজ্জ্বল তার উজ্জ্বলতা তত ধীরে ধীরে কমে।) কোনো বাইনারি সিস্টেমে শ্বেতবামন নক্ষত্ৰ যখন ধীরে ধীরে তার সঙ্গী নক্ষত্রের উপাদানগুলো শুষে নিতে থাকে, তখন এ ধরনের সুপারনোভা দেখা যায়। শ্বেতবামনটির ভর বেড়ে যায় সঙ্গী নক্ষত্রটিকে ভক্ষণের মাধ্যমে। তার ভর ১.৪ সৌর ভরের সমান হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে এ ভোজনপ্রক্রিয়া। এটাই শ্বেতবামন নক্ষত্রের সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ভর। এই সীমা ছাড়িয়ে গেলে সেগুলো চুপসে গিয়ে বিস্ফোরিত হয় একটি Ia টাইপের সুপারনোভা হিসেবে। Ia টাইপের সুপারনোভার উজ্জ্বলতা এত সুষম বা অভিন্ন কেন, তার মূল কারণ হলো, শ্বেতবামন নক্ষত্র সহজাত কারণে নির্দিষ্ট ভরে যাওয়ার পর তার নিজের মহাকর্ষের অধীনে চুপসে যেতে থাকে। (সুব্রক্ষানিয়ন চন্দ্রশেখর ১৯৩৫ সালে দেখান, শ্বেতবামন নক্ষত্রে মহাকর্ষ বল নক্ষত্রটিকে পিষ্ট করার সময় ইলেকট্রনের মধ্যে বিকর্ষীধর্মী বল তাকে ভারসাম্যে আনে। একে বলে, ইলেকট্রন ডিজেনারেসি প্রেশার বা ইলেকট্রন ক্ষয় চাপ। কোনো শ্বেতবামন নক্ষত্রের ভর ১.৪ সৌরভরের চেয়ে বেশি হলে তার মহাকর্ষ এই বলের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে এবং নক্ষত্রটি পিষ্ট হতে থাকে। ফলে সুপারনোভা তৈরি হয়।) আদিম মহাবিশ্বে সুদূরে সুপারনোভা থাকার কারণে সেগুলো বিশ্লেষণ করে কোটি কোটি বছর আগে মহাবিশ্বের প্রসারণের হার গণনা করা যায়।

জ্যোতির্বিদদের দুটি আলাদা দল আশা করছিলেন, তাঁরা এমন কিছু খুঁজে পাবেন, যার মাধ্যমে প্রমাণিত হবে, মহাবিশ্ব এখন প্রসারিত হয়ে চললেও তা ক্রমে ধীরগতির হয়ে পড়েছে (দুটি দলের একটির নেতৃত্বে ছিলেন সুপারনোভা কসমোলজি প্রজেক্টের সল পার্লমুটার এবং আরেকটির হাইজেড সুপারনোভা সার্চ টিমের নেতৃত্বে ছিলেন ব্রায়ান পি স্মিট)। জ্যোতির্বিদদের মধ্যে কয়েক প্রজন্ম অন্ধভাবে বিশ্বাস করত, মহাবিশ্বের আদি প্রসারণ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। প্রতিটি কসমোলজি ক্লাসেও এটাই শেখানো হতো।

প্রতিটি দল ডজনখানেক সুপারনোভা বিশ্লেষণের পর দেখতে পান, আদিম মহাবিশ্বকে আগে যেমন ভাবা হতো, তা আসলে তেমন দ্রুত হারে প্রসারিত হয়নি। (অর্থাৎ সুপারনোভার লোহিত বিচ্যুতি এবং তাদের বেগ পাওয়া গেল ধারণার চেয়ে কম)। বর্তমানের প্রসারণের হারের সঙ্গে আদিম প্রসারণের হার তুলনা করে এই দুই দল সিদ্ধান্তে এলেন, প্রসারণের হার এখন তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। বেশ শোকের সঙ্গে দল দুটি একসময় বিস্ময়কর এক সিদ্ধান্ত টানলেন, মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে।

হতাশ হয়ে তাঁরা আবিষ্কার করলেন, ওমেগার যেকোনো মানের সঙ্গে উপাত্ত খাপ খাওয়ানো অসম্ভব। উপাত্তের সঙ্গে তত্ত্বটিকে খাপ খাওয়ানোর একমাত্র উপায় পাওয়া গেল ল্যাম্বডাকে নতুন করে ব্যবহার করা। শূন্যস্থানের শক্তি বোঝাতে প্রথম ল্যাম্বডা ব্যবহার করেছিলেন আইনস্টাইন। শুধু তা-ই নয়, এই জ্যোতির্বিদেরা দেখতে পান, ওমেগাকে ছাড়িয়ে যায় অস্বাভাবিক বড় ল্যাম্বডা, যার কারণে মহাবিশ্বে ডি সিটার ধরনের প্রসারণ হয়। দুটি দলই আলাদাভাবে বিস্ময়কর এই উপলব্ধিতে পৌছালেও নিজেদের ফলাফল প্রকাশ করতে কিছুটা ইতস্তত করেছিলেন। কারণ, ঐতিহাসিকভাবে একটা জোরালো কুসংস্কার চালু ছিল যে ল্যাম্বডার মান শূন্য হতে হবে। যেমন কিটি পিক অবজারভেটরির জর্জ জ্যাকব একবার বলেছিলেন, ‘ল্যাম্বডা জিনিসটা সব সময় একটা হতাশাজনক ধারণা। কেউ যদি বেশ মূর্খের মতো বলতে চায়, এর মান শূন্য নয়, তাহলে তাকে পাগল হিসেবে বিবেচনা করতে হবে

স্মিট স্মৃতি হাতড়ে বলেছেন, ‘আমি তখনো মাথা নেড়েছিলাম, কিন্তু আমরা সবকিছু যাচাই করে দেখেছি…লোকজনকে ব্যাপারটা বলতে অনিচ্ছুক ছিলাম। কারণ মনে হচ্ছিল, আমরা যেন একটা গণহত্যা চালাতে যাচ্ছি।’ তবে দুটি দল তাদের ফলাফল অবশেষে প্রকাশ করে ১৯৯৮ সালে। বিশাল স্তূপের মতো যে বিপুল উপাত্ত তাঁরা সংগ্রহ করেছিলেন, তা খারিজ করা অত সহজ ব্যাপার ছিল না। ল্যাম্বডা হলো আইনস্টাইনের সেই ‘বড় ধরনের ভুল’। আধুনিক কসমোলজি একে প্রায় ভুলতে বসেছিল। প্রায় ৯০ বছর বিস্মৃতির অতলে চাপা থাকার পর অসাধারণভাবে আবার ফিরে এল ল্যাম্বডা।

এ ঘটনায় অনেক পদার্থবিদ বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেলেন। প্রিন্সটনের ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডির এডওয়ার্ড উইটেন বলেন, ‘পদার্থবিদ্যায় আমি আসার পর এটাই সবচেয়ে অদ্ভুত পরীক্ষামূলক অনুসন্ধান।’ ওমেগার মান ০.৩-এর সঙ্গে যখন ল্যাম্বডার মান ০.৭ যোগ করা হলো, তখন তার যোগফল পাওয়া গেল ১.০। এটাই ছিল স্ফীতি তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণী। ঘটনাটা যেন আমাদের চোখের সামনে একটা জিগস পাজল সাজানো হয়ে গেল। কসমোলজিস্টরা স্ফীতির হারিয়ে যাওয়া খণ্ডটা খুঁজে পেলেন ঠিক এভাবেই। আর এটা পাওয়া গিয়েছিল খোদ শূন্যস্থান থেকে।

এই ফলাফলটিকে চমকপ্রদভাবে আবারও নিশ্চিত করেছিল ডব্লিউএমএপি স্যাটেলাইট। সেখানে দেখা গেল, মহাবিশ্বের সব পদার্থ আর শক্তির ৭৩ শতাংশ গঠন করেছে ল্যাম্বডার সঙ্গে সম্পর্কিত শক্তি বা ডার্ক এনার্জি (গুপ্তশক্তি)। এভাবে এখন জিগস পাজলের সবচেয়ে প্রভাবশালী খণ্ডে পরিণত হয়েছে এটা।

মহাবিশ্বের বিভিন্ন পর্যায়

সম্ভবত ডব্লিউএমএপি স্যাটেলাইটের সবচেয়ে বড় অবদানটি হলো, এটা বিজ্ঞানীদের এই আত্মবিশ্বাস এনে দিয়েছে যে তারা কসমোলজির ‘স্ট্যান্ডার্ড মডেলে’র দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। অবশ্য এতে এখনো অনেক শূন্যস্থান বা ফাঁক থেকে গেলেও উপাত্ত থেকে আসতে থাকা একটা স্ট্যান্ডার্ড থিওরির রূপরেখা দেখতে পাচ্ছেন জ্যোতিঃপদার্থবিদেরা। আমাদের একত্র করা চিত্র অনুসারে, মহাবিশ্বের বিবর্তন তার শীতল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আলাদা আলাদা পর্যায়ে ক্রমেই এগিয়ে গেছে। প্রতিসাম্যতার ভাঙন ও প্রকৃতির বল ভেঙে যাওয়ার প্রতিনিধিত্ব করে এই পর্যায়গুলোর ক্রান্তিকাল। বর্তমানে আমরা যেসব পর্যায় বা মাইলফলক জানতে পেরেছি সেগুলো হলো-

১. ১০^-৪৩ সেকেন্ডের আগে—প্ল্যাঙ্ক যুগ

প্ল্যাঙ্ক যুগ সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। প্ল্যাঙ্ক শক্তিতে (১০^১৯ বিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্ট), অন্যান্য কোয়ান্টাম বলগুলোর মতো শক্তিশালী ছিল মহাকর্ষ বল। ফলে মহাবিশ্বের চারটি বল সম্ভবত একীভূত হয়ে একটা একক সুপারফোর্স বা অতিবল হিসেবে বিরাজ করছিল। সম্ভবত মহাবিশ্ব অস্তিত্বশীল হয়েছিল শূন্যের একটা নিখুঁত পর্যায় বা শূন্য উচ্চতর মাত্রিক স্থান হিসেবে। সব সমীকরণ অকার্যকর করে রহস্যময় প্রতিসাম্যতায় সব কটি বল মিশে ছিল। সেটা ছিল সম্ভবত অনেকটা সুপারসিমেট্রি বা অতিপ্রতিসাম্যতার মতো। (৭ম অধ্যায়ে সুপারসিমেট্রি নিয়ে আলোচনা করা হবে)। অজানা কোনো কারণে সব কটি বলকে একত্র করা এই রহস্যময় প্রতিসাম্যতা একসময় ভেঙে যায় এবং একটি অতিক্ষুদ্র বুদ্বুদ গঠিত হয়। অর্থাৎ গঠিত হয় আমাদের ভ্রূণ মহাবিশ্ব। এর কারণ সম্ভবত এলোমেলো কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন। বুদটির আকার ছিল প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্যের সমান, যার আকার ১০^-৩৩ সেন্টিমিটার।

২. ১০^-৪৩ সেকেন্ড—GUT যুগ

প্রতিসাম্যতার ভাঙন ঘটতে থাকে। এতে দ্রুত হারে প্রসারণশীল একটা বুদ গঠিত হয়। বুদ্‌দটি স্ফীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চারটি মৌলিক বল দ্রুত পরস্পরের কাছ থেকে আলাদা হতে থাকে। অন্য তিনটি বল থেকে যে বলটি প্রথম আলাদা হয়ে যায়, সেটি ছিল মহাকর্ষ। ফলে মহাবিশ্বজুড়ে এক শক ওয়েভ বয়ে যায়। সুপারফোর্সের মূল প্রতিসাম্যতা ভেঙে গঠিত হয় টুকরো টুকরো প্রতিসাম্যতা। সম্ভবত এর মধ্যে GUT প্রতিসাম্যতা SU(5) ছিল। বাকি শক্তিশালী, দুর্বল ও বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বলের মিথস্ক্রিয়া এখনো GUT প্রতিসাম্যতা দিয়ে একীভূত করা যায়। মহাবিশ্ব বিপুল বেগে স্ফীত হতে থাকে। সম্ভবত এর পরিমাণ ছিল ১০^৫০ গুণ। এই পর্যায়ে স্থান আলোর চেয়েও বেশি বেগে প্রসারিত হতে থাকে। কিন্তু এর কারণ এখনো বোঝা সম্ভব হয়নি। তখন মহাবিশ্বের তাপমাত্রা ছিল ১০^৩২ ডিগ্রি।

৩. ১০^-৩৪ সেকেন্ড—স্ফীতির সমাপ্তি

শক্তিশালী বল অন্য দুটি বল থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা কমে নেমে আসে ১০^২৭ ডিগ্রিতে। (GUT প্রতিসাম্যতা গ্রুপ ভেঙে পরিণত হয় SU(3) × SU(2) × U(1)।) স্ফীতির পর্যায় শেষ হয়ে যায়। এরপর মহাবিশ্বে শুরু হয় আদর্শ ফ্রিডম্যান প্রসারণ। মহাবিশ্বে তখন ছিল মুক্ত কোয়ার্ক, গ্লুয়ন আর লেপটনের উত্তপ্ত প্লাজমা ঝোল বা স্যুপে পরিপূর্ণ। মুক্ত কোয়ার্ক ঘনীভূত হয়ে আজকের প্রোটন ও নিউট্রন গঠন করতে থাকে। আমাদের মহাবিশ্বকে তখনো আকারে বেশ ছোটই বলতে হবে। তখন তার আকার ছিল বর্তমানে আমাদের সৌরজগতের সমান। পদার্থ ও প্রতিপদার্থ পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়ে একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছিল। কিন্তু প্রতিপদার্থের চেয়ে পদার্থ সামান্য পরিমাণে বেশি ছিল (১ বিলিয়ন ভাগের ১ ভাগ)। এই বেঁচে যাওয়া পদার্থই এখন আমাদের চারপাশে দেখা যায়। (এটাই সেই শক্তির পরিসর, যা পরবর্তী কয়েক বছরে লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার পার্টিকেল অ্যাকসিলারেটরে আমরা প্রতিলিপি তৈরির প্রত্যাশা করি।)

[২০১২ সালে লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার বা এলএইচসিতে হিগস বোসন কণা আবিষ্কৃত হয়েছে। এই কণাটি অন্য কণাগুলোতে ভরের জোগান দিয়েছিল বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।—অনুবাদক]

৪. ৩ মিনিট—নিউক্লিও গঠন

তাপমাত্রা যথেষ্ট কমে যায়। তাতে নিউক্লিও গঠিত হতে থাকে। তখন আর অতিরিক্ত তাপে এসব নিউক্লিও আলাদা হলো না। হাইড্রোজেন পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে হিলিয়াম তৈরি হতে থাকে (এভাবে বর্তমানে ৭৫ শতাংশ হাইড্রোজেন/২৫ শতাংশ হিলিয়ামের অনুপাত খুঁজে পাওয়া যায়)। এরপর অতি সামান্য লিথিয়ামও গঠিত হয়, কিন্তু বন্ধ হয়ে যায় উচ্চতর অন্যান্য মৌলের ফিউশন বিক্রিয়া। কারণ, ৫টি কণার নিউক্লিও খুব অস্থিতিশীল। এ সময় মহাবিশ্ব ছিল অস্বচ্ছ। মুক্ত ইলেকট্রনের কারণে আলো বিক্ষিপ্ত ছিল। একে চিহ্নিত করা হয় আদিম অগ্নিগোলকের সমাপ্তি হিসেবে।

৫. ৩৮০,০০০ বছর—পরমাণুর জন্ম

এ সময় তাপমাত্রা কমে নেমে আসে ৩০০০ ডিগ্রি কেলভিনে। নিউক্লিওর চারপাশে ইলেকট্রন স্থায়ী হয়ে বসায় পরমাণু গঠিত হতে থাকে। তাপের কারণে সেগুলো আর আগের মতো ভেঙে গেল না। ফোটনও এখন আর শোষিত না হয়ে মুক্তভাবে চলতে শুরু করে। কোব আর ডব্লিউএমএপি স্যাটেলাইটে এই বিকিরণই পরিমাপ করা হয়েছে। মহাবিশ্ব একসময় অস্বচ্ছ আর প্লাজমায় পরিপূর্ণ ছিল, কিন্তু তা এই এ সময় স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। তখন সাদার পরিবর্তে কালো হয়ে ওঠে মহাকাশ।

৬. ১ বিলিয়ন বছর—নক্ষত্রে ঘনীভূত

তাপমাত্রা কমে ১৮ ডিগ্রিতে নেমে আসে। ঘনীভূত হতে শুরু করে কোয়াসার, ছায়াপথ ও গ্যালাকটিক ক্লাস্টার। আদি অগ্নিগোলকে অতিক্ষুদ্র কোয়ান্টাম ঢেউয়ের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে বিশেষ করে এটা ঘটতে থাকে। নক্ষত্র কার্বন, অক্সিজেন ও নাইট্রোজেনের মতো হালকা মৌল রান্না হতে শুরু করে। লোহার পরের ভারী মৌলগুলো মহাকাশে উগরে দিয়েছিল বিস্ফোরিত নক্ষত্র। এটিই সবচেয়ে দূরবর্তী যুগ, যে পর্যায়ে হাবল স্পেস টেলিস্কোপের মাধ্যমে অনুসন্ধান চালানো গেছে।

৭. ৬.৫ বিলিয়ন বছর—ডি সিটার প্রসারণ

ফ্রিডম্যান প্রসারণ ক্রমেই শেষ হয়ে যেতে থাকে। মহাবিশ্ব ত্বরিত হতে থাকে এবং তা ত্বরিত বেগের পর্যায়ে প্রবেশ করে। একে বলা হয় ডি সিটার প্রসারণ। এ প্রসারণের পেছনে একটা রহস্যময় অ্যান্টিগ্রাভিটি বল কাজ করছে, যার কারণ এখনো বোঝা সম্ভব হয়নি।

৮. ১৩.৭ বিলিয়ন বছর–বর্তমান

বর্তমান যুগ। তাপমাত্রা কমে ২.৭ ডিগ্রিতে নেমে আসে। আমরা বর্তমান মহাবিশ্বে ছায়াপথ, নক্ষত্র ও গ্রহ দেখছি। মহাবিশ্ব একটা পলায়নপর গতিতে প্রসারিত হচ্ছে।

ভবিষ্যৎ

অবশ্য স্ফীতি বর্তমান এমন একটা তত্ত্ব, যার মহাবিশ্বের রহস্যময় বিভিন্ন বিষয় ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা আছে। কিন্তু এতে প্রমানিত হয় না যে তত্ত্বটা সঠিক (আবার প্রতিদ্বন্দ্বী বেশ কয়েকটি তত্ত্বও প্রস্তাবিত হয়েছে। এ ব্যাপারে আমরা সপ্তম অধ্যায়ে আলোচনা করব।) সুপারনোভার ফলাফল বারবার যাচাই করতে হবে, যাতে সুপারনোভা থেকে তৈরি ধূলিকণা আর বিশৃঙ্খলার মতো ফ্যাক্টরগুলো বিবেচনায় আনা যায়। আর যার মাধ্যমে স্ফীতির চিত্র যাচাই করা কিংবা বাতিল করা সম্ভব হবে, সেটাই হলো এ ব্যাপারে চূড়ান্ত প্রমাণ। সেটা হলো মহাকর্ষ তরঙ্গ। মহাবিস্ফোরণের পর তাৎক্ষণিকভাবে তৈরি হয়েছিল এ তরঙ্গ। মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশনের মতো এই মহাকর্ষ তরঙ্গ ও মহাবিশ্বজুড়ে প্রতিধ্বনিত হওয়ার কথা। একে মহাকর্ষ তরঙ্গ ডিটেক্টর দিয়ে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হতে পারে (এ ব্যাপারে নবম অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে)। [২০১৫ সালে প্রথমবার মহাকর্ষ তরঙ্গ সনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। বিস্তারিত টীকা অংশে দেখুন।—অনুবাদক] মহাকর্ষ তরঙ্গের প্রকৃতির ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী করে স্ফীতি তত্ত্ব। কিন্তু স্ফীতি তত্ত্বের অন্যতম জটিল ভবিষ্যদ্বাণী সরাসরি পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব নয়। সেটি হলো শিশু মহাবিশ্বের অস্তিত্ব, যা অনেকগুলো মহাবিশ্বের মাল্টিভার্সে বিদ্যমান। এসব মহাবিশ্বের প্রতিটি অন্যটা থেকে আলাদা ভৌত আইন মেনে চলে। মাল্টিভার্সের পুরো নিহিতার্থ বুঝতে হলে, স্ফীতি তত্ত্ব যে আইনস্টাইনের সমীকরণ এবং কোয়ান্টাম তত্ত্ব উভয়ের উদ্ভট পরিণতিগুলোর সব সুবিধা নেয়, তা বুঝে নেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। আইনস্টাইনের তত্ত্বে, মাল্টিপল ইউনিভার্সের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব। আর কোয়ান্টাম তত্ত্বে ওই সব মহাবিশ্বের ভেতর টানেলিং করা সম্ভব। এম- থিওরি (সম্ভবত আমাদের চূড়ান্ত তত্ত্ব) নামের নতুন পরিকাঠামোতে সমান্তরাল মহাবিশ্ব ও টাইম ট্রাভেল-সংক্রান্ত এসব প্রশ্নের সমাধান পাওয়া যাবে।

তথ্যনির্দেশ

ফ্ল্যাটনেস প্রবলেম : স্থান এত সরল কেন—তা অনেক দিন ধরেই রহস্য হয়ে ছিল। মহাবিস্ফোরণের পর এত দীর্ঘ সময় পরও স্থানের কাঠামো তুলনামূলক কম জটিল বা মসৃণ বলে মনে হয়। কিন্তু কিছু কসমোলজিক্যাল তত্ত্বমতে, এটা আসলে আরও জটিল হওয়ার কথা। এটাই ফ্ল্যাটনেস প্রবলেম বা মসৃণতার সমস্যা নামে পরিচিত ক্রিয়েটিও এক্স নিহিলো : ল্যাটিন এই শব্দগুচ্ছের অর্থ শূন্য থেকে আসা বা শূন্য থেকে সৃষ্টি হওয়া।

কোয়ার্ক : চার্জিত মৌলিক কণা, যা শক্তিশালী বল দ্বারা প্রভাবিত হয়। প্রোটন ও নিউট্রনের প্রত্যেকে তিনটি কোয়ার্ক কণা দিয়ে গঠিত। এ পর্যন্ত ছয় ধরনের বা ফ্লেভারের কোয়ার্ক পাওয়া গেছে। যথা: আপ, ডাউন, স্ট্রেঞ্জ, চার্মড, বটম ও টপ। প্রতিটি ফ্লেভারের তিনটি কালার বা রং : লাল, সবুজ ও নীল।

প্রোটন: নিউট্রনের মতো একটি কণা। তবে এই কণাটি ধনাত্মক চার্জযুক্ত। বেশির ভাগ পরমাণুর কেন্দ্রে এ কণাটি প্রায় অর্ধেক থাকে। এই কণা তিনটি কোয়ার্ক (দুটি আপ ও একটি ডাউন কোয়ার্ক) দিয়ে গঠিত।

নিউট্রন : প্রায় প্রোটনের মতো একটি কণা। তবে এর কোনো চার্জ নেই। বেশির ভাগ পরমাণুর কেন্দ্রে প্রায় অর্ধেক এই কণা থাকে। তিনটি কোয়ার্ক (দুটি ডাউন আর একটি আপ কোয়ার্ক) দিয়ে একটি নিউট্রন গঠিত।

ইলেকট্রন : ঋণাত্মক চার্জযুক্ত একটি কণা, যা একটি পরমাণুর কেন্দ্ৰ বা নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘোরে।

নিউট্রিনো : চার্জহীন কণা। খুবই হালকা কণা, যা শুধু দুর্বল বল দিয়ে প্রভাবিত হয়।

স্ট্যান্ডার্ড মডেল : কণা পদার্থবিজ্ঞানের একটি তত্ত্ব। মহাকর্ষ বাদে প্রকৃতির মৌলিক বলগুলোকে ব্যাখ্যা করে। একই সঙ্গে আমাদের জানা থাকা, সব মৌলিক কণাগুলোকে শ্রেণিবদ্ধ করা হয় এই তত্ত্বের মাধ্যমে। এ মডেলে বলা হয়েছে, সব বস্তুই ১২টি ফার্মিয়ন কণা (৬টি কোয়ার্ক ও ৬টি লেপটন) এবং তাদের বিপরীত বা প্রতিকণা দিয়ে গঠিত। আর তাদের পারস্পরিক ক্রিয়া সংঘটিত হয় চারটি গেজ বা দূত বোসন কণার মাধ্যমে। এখন পর্যন্ত এই তত্ত্বের সব কটি ভবিষ্যদ্বাণীই পরীক্ষার সঙ্গে মিলে গেছে। সম্প্রতি এই তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণী করা নতুন এক কণা (যা হিগস বোসন নামে পরিচিত) শনাক্ত করেছেন সার্নের বিজ্ঞানীরা।

ক্রোমোডাইনামিকস : পদার্থবিজ্ঞানের এই তত্ত্বে অতিপারমাণবিক কণা কোয়ার্ক ও গ্লুয়নের মধ্যে শক্তিশালী পারমাণবিক বলের মিথস্ক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করা হয়। এর সংক্ষিপ্ত নাম কিউসিডি।

স্পিন বা ঘূর্ণন : মৌলিক কণার একটি ধর্ম। দৈনন্দিন ঘূর্ণন ধারণার সঙ্গে এটি সম্পর্কিত হলেও তা পুরোপুরি এক রকম নয়।

মহাকর্ষ বল : গ্র্যাভিটি বা মহাকর্ষ একধরনের নীরব বল, যা আমাদের পাকে মাটির সঙ্গে আটকে রেখেছে। আবার পৃথিবী ও নক্ষত্রগুলোকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া প্রতিরোধ করছে এবং সৌরজগৎ ও গ্যালাক্সিকে একসঙ্গে বেঁধে রেখেছে এই বল। মহাকর্ষ না থাকলে গ্রহের ঘূর্ণনের কারণে আমরা পৃথিবী থেকে সেকেন্ডে ১০০০ মাইল বেগে মহাশূন্যে ছিটকে যেতাম। আকর্ষণধর্মী মহাকর্ষকে অন্য বলগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে এটি খুবই দুর্বল। কিন্তু তারপরও তা বিপুল দূরত্ব থেকেও ক্রিয়া করতে পারে।

বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল : ইলেকট্রোম্যাগনেটিজম (ইএম) বা বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল আমাদের শহরগুলোকে আলোকিত করে। লেজার, রেডিও, টিভি, আধুনিক ইলেকট্রনিকস, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, বিদ্যুৎ, চুম্বকত্ব—সবই বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বলের ফল। মানবজাতির পোষ মানানো সবচেয়ে উপকারী বল সম্ভবত এটিই। এটি আকর্ষণ ও বিকর্ষণ—দুটোই করতে পারে। জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলো বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বলের সূত্রগুলো বর্ণনা করে।

দুর্বল নিউক্লিয়ার বল : দুর্বল নিউক্লিয়ার বা পারমাণবিক বল হলো তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের বল। এই বলটিই পৃথিবীর কেন্দ্রকে উষ্ণ রাখছে, যা রেডিওঅ্যাকটিভ বা তেজস্ক্রিয়। আগ্নেয়গিরি, ভূমিকম্প ও মহাদেশীয় চলনের পেছনে বলটি কাজ করে।

শক্তিশালী পারমাণবিক বল : এ বল পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে একসঙ্গে আটকে রাখে। সূর্য ও নক্ষত্রদের শক্তি উৎপন্ন হয় এই নিউক্লিয়ার বল থেকে, যা মহাবিশ্বকে আলোকিত করার জন্য দায়ী। সমস্যাটি হলো, নিউক্লিয়ার বল স্বল্পপাল্লার বল, যা মূলত নিউক্লিয়াসের দূরত্বে কার্যকর। এই বল নিউক্লিয়াসের ধর্মের সঙ্গে আবদ্ধ হওয়ার কারণে একে কাজে লাগানো খুব কঠিন। বর্তমানে এ বলকে কাজে লাগানোর একমাত্র উপায় হলো, অ্যাটম স্ম্যাশারে অতিপারমাণবিক কণায় বিভক্ত করা কিংবা পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো।

বৈদ্যুতিক আধান বা চার্জ : কণার একটি ধর্ম, যার কারণে কণাটি একই ধর্মের (বা বিপরীত ধর্মের) অন্য কণাকে বিকর্ষণ (বা আকর্ষণ) করে।

গামা রশ্মি : খুবই ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় রশ্মি। তেজস্ক্রিয় পদার্থের ক্ষয় বা মৌলিক কণাদের সংঘর্ষে এই রশ্মির সৃষ্টি।

কোয়ান্টাম তত্ত্ব: পদার্থবিজ্ঞানের যে শাখায় বল প্রয়োগে শক্তিকণার গতিবেগ, ধর্ম, আচরণ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হয়, সেটিই কোয়ান্টাম মেকানিকস বা কণাবাদী বলবিদ্যা। চিরায়িত বলবিদ্যায় দৃশ্যমান বস্তুর ওপর বল প্রয়োগে বস্তুর ধর্ম বা আচরণ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ক্ষেত্র অতি ক্ষুদ্র শক্তিকণা (যেমন ইলেকট্রন)। চিরায়ত বলবিদ্যায় যেসব বস্তুর ভর আছে কিন্তু তরঙ্গ প্রকৃতি নেই, তাদের নিয়ে আলোচনা করা হয়। কিন্তু কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় এমন সব বস্তু সম্পর্কে আলোচনা করা হয়, যাদের কণা (বা ভর) প্রকৃতি এবং তরঙ্গ প্রকৃতি উভয়ই আছে। যেমন আলো একই সঙ্গে কণা ও তরঙ্গ।

মহাকর্ষ তরঙ্গ : আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব থেকে পাওয়া একটি তরঙ্গ, যা আলোর গতিতে চলে। একটি বিপুল ভরের বস্তু আরেকটি বিপুল ভরের বস্তুর চারপাশে ঘুরলে বস্তু দুটি এই তরঙ্গ বিকিরণ করে। ১৯১৬ সালে আইনস্টাইন এ ধরনের তরঙ্গের ভবিষ্যদ্বাণী করেন। এর প্রায় ১০০ বছর পর, ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের লাইগোর ডিটেক্টরে প্রথমবার ধরা পড়ে এই তরঙ্গ। এই তরঙ্গের উৎস ছিল ১৩০ কোটি বছর আগে সূর্যের চেয়ে ৩৬ গুণ এবং সূর্যের চেয়ে ২৯ গুণ ভারী দুটি কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে সংঘর্ষে। ওই বছরের ২৬ ডিসেম্বর দ্বিতীয়বার শনাক্ত করা হয় মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। এরপর ২০১৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি এ-সংক্রান্ত ঘোষণা দেওয়া হয়।

কণা ত্বরক যন্ত্র : কণা ত্বরক যন্ত্র বা পার্টিকেল অ্যাকসিলারেটর যন্ত্রের সাহায্যে বিদ্যুৎ-চুম্বক ব্যবহার করে চার্জিত কণাগুলোকে অনেক বেশি শক্তি দান করে গতিশীল করতে পারে।

এলএইচসি : বতর্মান বিশ্বে সবচেয়ে বড় আর শক্তিশালী কণা ত্বরক যন্ত্র এলএইচসি বা লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার। ইউরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ বা সার্নের তৈরি এই যন্ত্রটি ফ্রান্স-সুইজারল্যান্ড সীমান্তে জেনেভার কাছে মাটির নিচে ২৭ কিলোমিটার বৃত্তাকার এক সুড়ঙ্গে বানানো হয়েছে। ২০১২ সালে এখানেই হিগস-বোসন কণা আবিষ্কৃত হয়।

হিগস-বোসন : হিগস-বোসন কণাটি একসময় গড পার্টিকেল বা ঈশ্বর কণা নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। ২০০৮ সালে সুইজারল্যান্ডের মাটির নিচে প্রায় ২৭ কিলোমিটার পরিধির সুড়ঙ্গ খুঁড়ে তাতে বসানো লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার বা এলএইচসি। সেখানে প্রায় আলোর গতিতে ধাবমান দুটি বিপরীতমুখী প্রোটনের মধ্যে সংঘর্ষে সৃষ্টি হয় বিপুল পরিমাণ শক্তি আর অসংখ্য অতিপারমাণবিক কণা। সেখান থেকেই বিজ্ঞানীরা খোঁজ পান বহুকাঙ্ক্ষিত হিগস-বোসন কণা। ২০১২ সালের ৪ জুলাইয়ে এ কণার অস্তিত্ব আবিষ্কারের ঘোষণা দেয় সার্ন।

সুপারসিমেট্রি : এ তত্ত্বটি ১৯৭১ সালে প্রস্তাব করেন রুশ বিজ্ঞানী ইউজেনি লিখটম্যান এবং উইরি গলফ্যান্ড। এ ধারণায় তাঁরা কণাগুলো আর মিথস্ক্রিয়ার মধ্যে নতুন প্রতিসাম্যতার কথা বলেছিলেন। এ তত্ত্বমতে, প্রকৃতিতে প্রতিটি মৌলিক কণার অতিপ্রতিসাম্য সঙ্গী বা সুপার পার্টনার আছে। তবে এদের দেখতে পাওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে ফোটনের সুপার পার্টনারের নাম দেওয়া হয়েছে ফোটিনো।

চন্দ্রশেখর : সুব্রামানিয়ান চন্দ্রশেখর ব্রিটিশ ভারতে জন্মগ্রহণকারী মার্কিন জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী। ১৯৩০ সালের দিকে চন্দ্রশেখর গবেষণা করে দেখালেন, কোনো নক্ষত্র সূর্যের চেয়ে সামান্য ভারী হলে (সূর্যভরের তুলনায় ১৪ গুণের বেশি) এবং তার জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে যদি সংকুচিত হতে শুরু করে, তবে তা ততক্ষণ পর্যন্ত সংকুচিত হবে যতক্ষণ না তার ব্যাসার্ধ শূন্য হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ এই ভরের কোনো নক্ষত্র শ্বেতবামনে পরিণত হবে না। প্রতি একক আয়তনে ভরের এই পরিমাণকে বলা হয় চন্দ্রশেখর সীমা। চন্দ্রশেখর সীমা হলো স্থিতিশীল শীতল শ্বেতবামন তারকার সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ভর। এর চেয়ে ভর বেশি হলে নক্ষত্রটি চুপসে একটা কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হবে।

পূর্ণাঙ্গ একীভূত তত্ত্ব (Grand unified theory—GUT) : যে তত্ত্ব বিদ্যুৎ- চুম্বকীয়, শক্তিশালী এবং দুর্বল বলগুলোকে একীভূত করে।

শ্বেতবামন : যেসব তারার ভর নিউট্রন তারা হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়, তাদের সবাই বিবর্তনের শেষ পর্যায়ে শ্বেতবামনে পরিণত হয়। সে হিসাবে আমাদের ছায়াপথের শতকরা ৯৭ ভাগ তারার শেষ গন্তব্য শ্বেতবামন। এদের ভর সূর্যের সঙ্গে তুলনীয় হলেও আকার তুলনীয় পৃথিবীর সঙ্গে, অর্থাৎ এদের ঘনত্ব অনেক বেশি। উজ্জ্বলতা খুব কম যা তাদের জমিয়ে রাখা তাপ শক্তি থেকে উৎপন্ন হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *