৪. স্থানীয় গোষ্ঠী

৪. স্থানীয় গোষ্ঠী

আমাদের দেশান্তর

কোনো ধরনের অর্থনৈতিক ঝামেলা ছাড়া দেশান্তরের পরিকল্পনাটি কীভাবে চালানো যেতে পারে আগের অধ্যায়গুলোতে সে বিষয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কিন্তু স্থানান্তরের এই বিশাল প্রক্রিয়া অনেক গভীর ও শক্তিশালী অনুভূতি না জাগিয়ে পারে না। পুরোনো প্রথা এবং পুরোনো স্মৃতি আছে, যেগুলো আমাদের দেশের বাড়ির (জন্ম ও শৈশব কেটেছে যেখানে) সাথে সংযুক্ত করে রাখে। আমাদের দোলনা আছে, আছে আমাদের কবরগুলো। ইহুদিদের হৃদয় কবরের সাথে কীভাবে লেগে থাকে, তা আমরাই শুধু জানি। দেশান্তরে দোলনাগুলো আমরা সাথে নিয়ে যাব। দোলনাগুলো আমাদের ভবিষ্যতকে ধরে রাখে। গোলাপি ও হাসিখুশি ভবিষ্যৎ আমাদের। প্রিয় কবরগুলো অবশ্যই আমাদের ছেড়ে যেতে হবে। আমি মনে করি, এই বিসর্জন আমাদের অন্য যেকোনো ত্যাগের চেয়ে অনেক বেশি মূল্য দেওয়া; কিন্তু তা যে অনিবার্য।

অর্থনৈতিক দুরবস্থা, রাজনৈতিক চাপ এবং সামাজিক অবমাননা ইতিমধ্যেই বাড়িঘর ও কবরগুলো থেকে আমাদের তাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা ইহুদিরা এখনো ক্রমাগতভাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তরিত হচ্ছি। একটি শক্তিশালী স্রোত আসলে আমাদের পশ্চিম দিকে সমুদ্রের ওপর দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাচ্ছে, সেখানেও আমাদের উপস্থিতি কাম্য নয়। যতদিন আমরা গৃহহীন একটা জাতি ততদিন আমাদের উপস্থিতি কোথায় আর কাম্য হবে?

আমরা আমাদের লোকদের একটি বাড়ি দেব। তাদের টিকে থাকার মাটি থেকে নির্মমভাবে টেনে উপড়ে নিয়ে যাব না, বরং একটি ভালো মাটিতে খুব যত্নের সাথে তাদের প্রতিস্থাপন করব। আমরা যেমন নতুন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করতে চাই, তেমনি আমাদের জনগণের হৃদয়ে প্রিয় হয়ে থাকা অতীতের সবটুকু পবিত্রতাও রক্ষা করব।

আমার পরিকল্পনার এই অংশটি খুব সম্ভবত বাস্তবজ্ঞানবর্জিত এক ভাববিলাসী কল্পনা হিসেবে নিন্দিত হতে পারে। তাই এখানে কয়েকটি প্রস্তাব রাখার প্রয়োজন আছে। যদিও এটা সম্ভব ও বাস্তব, তারপরও এটা এখন অস্পষ্ট ও লক্ষ্যহীন কিছু বলে মনে হচ্ছে। এক্ষেত্রে সংগঠন এটিকে যুক্তিযুক্ত কিছু হিসেবে গড়ে তুলবে।

দলবদ্ধ দেশান্তর

আমাদের লোকদের উচিত হবে পরিবার ও বন্ধুদের নিয়ে দল বেধে দেশত্যাগ করা। তবে কোনো লোককে তার পূর্বের আবাসস্থলের অন্তর্গত নির্দিষ্ট গোষ্ঠীতে যোগদান করতে বাধ্য করা হবে না। নানা বিষয়-আশয়ের নিষ্পত্তির পরপরই প্রত্যেকে তার পছন্দমতো যাত্রা করতে সক্ষম হবে। রেল ও নৌকায় করে নিজস্ব খরচে অন্যদের যেতে দেখে স্বাভাবিকভাবেই কোনো ব্যক্তি নিজের উপযুক্ত ব্যবস্থা বেছে নিয়ে যাত্রা করবে। রেল ও নৌকার যাত্রীদের ক্ষেত্রে শ্রেণীগত কোনো ভেদ না রাখাই সম্ভবত ভালো হবে, যাতে দরিদ্ররা এই দীর্ঘ যাত্রায় তাদের অবস্থানকে খুব গভীরভাবে অনুভব না করে। এটা ঠিক যে, আমরা কোনো আনন্দ ভ্রমণের আয়োজন করছি না, তারপরও যাত্রাপথে তাদের হাস্যরসের মধ্যে রাখতে হবে।

অসহায়ের মতো কেউ ভ্রমণ করবে না। আবার যারা বিলাসবহুল ভ্রমণ করতে চায় তারা তাদের প্রবণতা অনুযায়ী তা করতে পারবে। এমনকি পুরোপুরি অনুকূল পরিস্থিতি থাকলেও কয়েক বছরেও এই যাত্রায় ইহুদিদের নির্দিষ্ট একটা শ্রেণি আগ্রহী হবে না। এই সময়ের মধ্যে তাই যাত্রার জন্য সর্বোত্তম পদ্ধতি নির্বাচন করা যেতে পারে। যারা ধনাঢ্য তারা চাইলে বন্ধু- বান্ধব নিয়ে পার্টিতেও ভ্রমণ করতে পারবেন। সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের কথা বাদ দিলে মোটের ওপর বলা যায়, খ্রিস্টানদের সাথে ইহুদিদের খুব একটা ওঠাবসা নেই। কিছু দেশে তাদের পরিচিতি কেবল কিছু স্পঞ্জার[১৯], ঋণগ্রহীতা এবং নির্ভরশীলদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তারা অপেক্ষাকৃত উত্তম শ্রেণির খ্রিস্টানদের সম্পর্কে কিছুই জানে না। দেয়ালগুলো ভেঙে গেলেও ঘেটো কিন্তু ঠিকই রয়ে গেছে।

[১৯ স্পঞ্জার: যে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে জীবিকা নির্বাহ করে।]

মধ্যবিত্তরা এই কারণে দেশান্তরের জন্য বিস্তৃত ও সতর্ক প্রস্তুতি নেবে। প্রতিটি এলাকায় ভ্রমণকারীদের একটি দল গঠন করা হবে। বড় শহরগুলোকে জেলায় জেলায় বিভক্ত করা হবে। একটি দল নিয়ে একটি জেলা। যারা এই উদ্দেশ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে যোগাযোগ করবে। জেলাগুলোর এই বিভাজন কঠোরভাবে মেনে চলার দরকার নেই। এটা নিছক বহির্দেশে যাত্রার সময় দরিদ্রদের অস্বস্তি না হয় এবং ছেড়ে যাওয়া দেশের জন্য মন যাতে না পোড়ায় সেজন্য করা। কেউ চাইলে একা ভ্রমণ করতে পারবে কিংবা তার পছন্দের যেকোনো স্থানীয় গ্রুপে যুক্ত হতে পারবে। ভ্রমণের শর্তাবলি ভ্রমণকারীদের সামর্থ্য বিবেচনায় সবার জন্য একই রকম হবে। পর্যাপ্তসংখ্যক ভ্রমণকারী মিলে দলগতভাবে কোম্পানির কাছ থেকে একটি বিশেষ রেল বা বিশেষ নৌকা ভাড়া করতে পারবে।

দরিদ্রতমরা গন্তব্যে পৌঁছার পর কোম্পানির হাউজিং এজেন্সি তাদের কোয়ার্টার প্রদান করবে। পরবর্তীতে, যখন আরও সমৃদ্ধশালী অভিবাসীরা আসবে, তখন প্রথম অবতরণের পরই তাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে নির্মিত হোটেলগুলোতে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। এদের মধ্যে অধিকতর সমৃদ্ধশালীরা নিজেরা স্থায়ী বসতিতে পৌঁছার আগেই সেখানে নিজেদের জন্য বাড়ি তৈরি করবে। এক্ষেত্রে তাদের এই দেশান্তর কেবল একটি পুরোনো বাড়ি থেকে নতুন বাড়িতে চলে যাওয়ার মতো।

কী করতে হবে সে ব্যাপারে আগে থেকে ঠিক করে রেখে নির্দেশনা দেওয়া আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গগুলোর জন্য অপমানজনক হবে। জাতীয় আদর্শের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্তকারী প্রতিটি মানুষ জানবে যে কীভাবে সেই আদর্শ ছড়িয়ে দিতে হয় এবং কীভাবে সেটিকে তার প্রভাববলয়ে বাস্তব করতে হয়। সবার আগে আমরা আমাদের রাব্বিদের সহযোগিতা চাইব।

আমাদের রাব্বিরা

প্রত্যেক দলের রাব্বি থাকবেন। রাব্বিরা তাদের জামাত (মণ্ডলী) নিয়ে ভ্রমণ করবেন। স্থানীয় গোষ্ঠীগুলো পরে স্বেচ্ছায় তাদের রাব্বি নির্বাচন করবে। প্রতিটি এলাকার আধ্যাত্মিক নেতা থাকবে। আমাদের রাব্বি, যাদের আমরা বিশেষভাবে ডাকি, তারা আমাদের আদর্শের সেবায় তাদের সক্ষমতা নিবেদন করবেন এবং পুলপিটে (মিম্বর) দাঁড়িয়ে তা প্রচার করে তাদের মণ্ডলীকে অনুপ্রাণিত করবেন। এ জন্য তাদের আলাদা করে বিশেষ সভা ডাকতে হবে না। সিনেগগ থেকে এ ধরনের আহ্বান উচ্চারণ করা যেতে পারে এবং এভাবেই এটি করতে হবে। অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন জাতির ভাষা আমাদের মধ্যে এমনভাবে শেকড় গেড়েছে যে তা উপড়ে ফেলা সম্ভব নয়। যে কারণে ভাষাগত নয়, বরং আমরা কেবল আমাদের পূর্বপুরুষদের বিশ্বাসের সূত্রে পরস্পরের প্রতি ঐতিহাসিক সখ্য অনুভব করি।

সোসাইটি ও কোম্পানির কাছ থেকে রাব্বিরা নিয়মিত বার্তা পাবেন। তারা এগুলো তাদের মণ্ডলীর কাছে ঘোষণা ও ব্যাখ্যা করবেন। ইসরায়েল আমাদের জন্য এবং তার নিজের জন্য প্রার্থনা করবেন।

স্থানীয় গোষ্ঠীগুলোর প্রতিনিধি

স্থানীয় গোষ্ঠীগুলো তাদের প্রতিনিধিদের নিয়ে ছোট ছোট কমিটি গঠন করবে। রাব্বি থাকবেন এই কমিটির সভাপতি। এই কমিটিগুলো স্থানীয় বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা ও নিষ্পত্তি করবে।

জনহিতকর প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের স্থানীয় গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে স্থানান্তর করা হবে। ‘সেখানেও প্রতিটি প্রতিষ্ঠান সেই একই লোকদের নেতৃত্বে থাকবে যে বা যারা এটি প্রতিষ্ঠা করেছিল। আমি মনে করি, পুরোনো ভবনগুলো বিক্রি করা উচিত হবে না, বরং আমাদের ছেড়ে আসা শহরগুলোর অসহায় খ্রিস্টানদের সহায়তার জন্য সেগুলো উৎসর্গ করা উচিত। স্থানীয় গোষ্ঠীগুলো বিনামূল্যে ভবন, জমি এবং অন্যান্য সুবিধা পেলে নতুন দেশ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে তা ক্ষতিপূরণের মতো হবে।

জনহিতকর প্রতিষ্ঠানগুলোর এই স্থানান্তর আমাদের সেই সুযোগগুলোর আরও একটি দেবে, যেটি মানবতার সেবায় একটি নিরীক্ষার জন্য আমার পরিকল্পনার ভিন্ন অংশে এসেছে। আমাদের বর্তমান অগোছালো ব্যক্তিগত জনহিতকর কাজ এক্ষেত্রে ব্যয়ের যে বিশাল অনুপাত আছে, সে তুলনায় সামান্যই কাজে আসে; কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানগুলো অবশ্যই একটি প্রক্রিয়ার অংশ হতে পারে। যে প্রক্রিয়ায় শেষ পর্যন্ত সেগুলো হবে একে অপরের পরিপূরক। আমাদের আধুনিক সচেতনতা থেকে নতুন সমাজে এ প্রতিষ্ঠানগুলো বিকশিত হতে পারে এবং আমাদের পূর্ববর্তী সব সামাজিক নিরীক্ষা হতে পারে এগুলোর ভিত্তি। বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষের কারণে এই বিষয়টি আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের মধ্যকার দুর্বল চরিত্রগুলো, বাইরের চাপে নিরুৎসাহিত, আমাদের ধনী ব্যক্তিদের কোমল হৃদয়ের দাতব্যের মাধ্যমে বিনষ্ট, ভিক্ষা না করলে তারা যেন সহজেই ডুবে যায়।

স্থানীয় গোষ্ঠীগুলোর দ্বারা সমর্থিত সোসাইটি এই বিশেষ বিষয়ে জনপ্রিয় শিক্ষার প্রতি সর্বাধিক মনোযোগ দেবে। এটি অনেক শক্তির জন্য একটি ফলদায়ক মাটি তৈরি করবে, যা এখন ব্যবহার না করায় বিনষ্ট হচ্ছে। যে ব্যক্তি কাজ করার প্রকৃত ইচ্ছা দেখাবে তাকে উপযুক্ত কাজে নিয়োগ করা হবে। ভিক্ষুক সহ্য করা হবে না। যে ব্যক্তি মুক্ত মানুষ হিসেবে কিছু করতে অস্বীকার করবে তাকে জোর করে কাজে লাগানোর জন্য ওয়ার্কহাউসে[২০] পাঠানো হবে।

[২০ ওয়ার্কহাউস: ছোটখাটো অপরাধীদের যে কারাগারে রেখে কাজ করানো হয় তাকে ওয়ার্কহাউস বলে।]

অন্যদিকে, আমরা বৃদ্ধদের আল্মসহাউসে[২১] ছেড়ে দেব না। আল্মসহাউস হচ্ছে নিষ্ঠুরতম এক দাতব্য প্রতিষ্ঠান, যেটি আমাদের নির্বোধ ভালো মানুষদের উদ্ভাবন, যেখানে বৃদ্ধরা নিরেট লজ্জায় ও নিগ্রহে মারা যায়। সেখানে ইতিমধ্যেই তাদের সমাধিস্থ করা হয়েছে। কিন্তু আমরা তাদের পরিত্যাগ করব, যারা বুদ্ধিমত্তার সর্বনিম্ন স্তরে থেকে বিশ্বে তাদের উপযোগিতার সান্ত্বনাদায়ক বিভ্রমের মধ্যে আছে। শারীরিক শ্রমে অক্ষমদের আমরা সহজ কাজ দেব। দারিদ্র্যের কারণে জীবনীশক্তি কমে যাওয়া দুর্বল প্রজন্মকে আমাদের অবশ্যই জায়গা দিতে হবে; কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তা অন্যরকম হবে। তারা স্বাধীন একটি জীবনের জন্য স্বাধীনতার মধ্যে বেড়ে উঠবে।

[২১ আল্মসহাউস: দরিদ্রদের জন্য আশ্রয়। মধ্যযুগে বিশেষ করে খ্রিস্টান চার্চেও পক্ষ থেকে দরিদ্র, বয়স্ক ও বিধবাদের জন্য এ ধরনের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হতো।]

আমরা চাইব প্রতিটি বয়স ও শ্রেণির মানুষ যাতে কাজের মাধ্যমে নৈতিক পরিত্রাণ লাভ করে এবং এভাবেই আমাদের মানুষগুলো দিনে সাত ঘণ্টা কাজের দেশে তাদের শক্তি আবার ফিরে পাবে।

নগর পরিকল্পনা

নগর গড়ে তোলার জন্য স্থান নির্বাচন করতে স্থানীয় গোষ্ঠীগুলো তাদের অনুমোদিত প্রতিনিধিদের দায়িত্ব দেবে। জমি বণ্টনের ক্ষেত্রে অর্জিত অধিকার যাতে যথাযথভাবে বজায় থাকে, সে জন্য হস্তান্তর প্রক্রিয়া কার্যকরে সতর্কতা অবলম্বন করা হবে।

আমাদের লোকেরা যাতে আগে থেকে জানতে পারে তারা কোথায় যাবে, কোন শহরে এবং কোন বাড়িতে থাকবে; সেজন্য স্থানীয় গোষ্ঠীগুলো নগর পরিকল্পনার কাজ করবে। নির্মাণাধীন ভবনগুলোর নকশার বিস্তারিত খসড়া আগে থেকেই স্থানীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিতরণ করা হবে।

আমাদের প্রশাসনের নীতি হবে আমাদের স্থানীয় গোষ্ঠীর স্বায়ত্তশাসনের কঠোর কেন্দ্রীকরণ। এভাবে খুব কম ঝামেলায় স্থানান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যাবে।

আমি মনে করি না যে বাস্তবে যেমন আছে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এ কাজ তার চেয়ে সহজ হবে; তবে অন্যদিকে, মানুষকে এ কাজ বাস্তবের চেয়ে বেশি কঠিন বলে মনে করতে দেওয়া যাবে না।

মধ্যবিত্তদের প্রস্থান

মধ্যবিত্তরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও অভিবাসনের এই বহির্মুখী স্রোতে আকৃষ্ট হবে। তাদের ছেলেরা হবে ‘সেখানে’ সোসাইটির কর্মকর্তা বা কোম্পানির কর্মচারী। আইনজীবী, ডাক্তার, নানা ধরনের কারিগরিবিদ ও প্রযুক্তিবিদ, তরুণ ব্যবসায়ী— প্রকৃতপক্ষে, ইহুদিদের মধ্যে যারা সুযোগের সন্ধানে ছিল কিংবা যারা জন্মভূমির নিপীড়ন থেকে রক্ষা পেতে পালিয়ে অন্য দেশে গিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে— তারা সবাই গিয়ে ন্যায্য প্রতিশ্রুতিপূর্ণ একটি ভূমিতে একত্রিত হবে। মধ্যবিত্তের মেয়েরা এই উচ্চাভিলাষী পুরুষদের বিয়ে করবে। তাদের কেউ কেউ এই নতুন আবাসে তার স্ত্রী বা বাগদত্তাকে নিয়ে আসবে, কেউ হয়তো তার পিতা-মাতা, ভাই-বোনদের ডেকে পাঠাবে। নতুন সভ্যতার সদস্যরা অল্পবয়সী বিয়ে করে; কিন্তু নতুন দেশে এক্ষেত্রে সাধারণ নৈতিকতাকে সমর্থন করা হবে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে দৃঢ়তা নিশ্চিত করা হবে। আর এভাবে আমাদের যে পিতারা জীবনসংগ্রামে শক্তি ব্যয় করেছে, তাদের দেরিতে বিয়ের ফুটফুটে কোনো সন্তান থাকবে না।

মধ্যবিত্ত অভিবাসীদের প্রত্যেকে পরে তার ধরনের আরও বেশিটায় আকৃষ্ট হবে।

সাহসী ব্যক্তিরা স্বাভাবিকভাবেই নতুন বিশ্ব থেকে সেরাটা পাবে। তবে ‘সেখানে’ নিঃসন্দেহে আমার পরিকল্পনার সংকটপূর্ণ সমস্যাগুলোকে স্পর্শ করেছি বলে মনে হচ্ছে।

এমনকি যদি আমরা ইহুদি সমস্যার বিশ্ব আলোচনা খুব গুরুত্বের সাথে শুরু করার ক্ষেত্রে সফলও হয়ে থাকি—

এমনকি যদি এই বিতর্ক আমাদের একটি ইতিবাচক উপসংহারে নিয়ে গিয়েও থাকে যে, ইহুদি রাষ্ট্র বিশ্বের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল—

এমনকি যদি শক্তিগুলো আমাদের এক টুকরো ভূখণ্ডের ওপর সার্বভৌমত্ব অর্জনে সহায়তা করেও থাকে—

আমরা কীভাবে ইহুদি জনসাধারণকে তাদের বর্তমান বাড়ি থেকে এই নতুন দেশে অসঙ্গত বলপ্রয়োগ ছাড়াই নিয়ে আসব?

এক্ষেত্রে তাদের এই অভিবাসন বা দেশত্যাগের লক্ষ্য অবশ্যই হবে স্বেচ্ছাকৃত।

বহুত্বের ফেনোমেনা

লোকজনের গমনাগমনকে উৎসাহিত করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে না। ইহুদিবিদ্বেষই প্রয়োজনীয় সে কাজ করে রেখেছে। এই বিদ্বেষ আগে যা করেছে কেবল তাই করতে থাকবে। ফলে যেখানে দেশত্যাগের আকাঙ্ক্ষা আগে ছিল না, সেখানে তারা তা তৈরি করবে আর যেখানে তা আগে থেকেই ছিল, সেখানে সেটিকে কেবল শক্তিশালী করবে। ইহুদিবিদ্বেষী দেশগুলোতে এখন যে ইহুদিরা আছে, তাদের মধ্যে যারা ইতিহাস সম্পর্কে সবচেয়ে অজ্ঞ তারাও জানে যে বিগত শতাব্দীগুলোতে বাসস্থানের অসংখ্যবার পরিবর্তন তাদের জন্য স্থায়ী কোনো সুফল বয়ে আনেনি। যে ভূমি আজ ইহুদিদের স্বাগত জানিয়েছে- তা সে যে ভূমিই হোক— এবং ইহুদি রাষ্ট্র তাদের যে নিশ্চয়তা দেবে সে তুলনায় তারা কম সুবিধা দিলেও, তা অবিলম্বে আমাদের জনগণের একটি বিশাল প্ৰবাহকে আকর্ষণ করবে। সবচেয়ে দরিদ্র, যাদের হারানোর কিছু নেই, তারা নিজেদের সেখানে টেনে নিয়ে যাবে। অনেকেই হয়তো নিজেকে প্রশ্ন করবে যে আমি হয়তো সঠিক নই; কিন্তু আমি আমার অবস্থান বজায় রেখেই বলব যে, আমাদের ওপর যে চাপ তৈরি হয়, তা সমাজের সমৃদ্ধ স্তরের মধ্যেও দেশত্যাগ করার ইচ্ছা জাগিয়ে তোলে। এখন আমাদের দরিদ্রতম স্তরই একটি রাষ্ট্র খুঁজে পাওয়ার জন্য যথেষ্ট হবে; একটি জমি অধিগ্রহণের জন্য এ ধরনের সবচেয়ে শক্তিশালী মানব উপাদান, কারণ একটি মহান উদ্যোগ সংঘটিত হওয়ার জন্য সামান্য হতাশা জরুরি।

কিন্তু যখন আমাদের এই ‘বেপরোয়ারা’ তাদের উপস্থিতি ও শ্রমের মাধ্যমে জমির মূল্য বাড়িয়ে দেয়, তখন তারা একই সাথে এটিকে বসতি স্থাপনের জায়গা হিসেবে তাদের উন্নতদের কাছে ক্রমবর্ধমানভাবে আকর্ষণীয় করে তোলে।

উচ্চতর এবং এখনো উচ্চতর স্তরের মানুষ সেখানে যেতে প্রলুব্ধ হবে। প্রথম এবং দরিদ্রতম বসতি স্থাপনকারীদের অভিযাত্রাটি কোম্পানি এবং সোসাইটি যৌথভাবে পরিচালনা করবে। এই অভিযাত্রায় সম্ভবত বিদ্যমান দেশত্যাগীরা এবং জায়নবাদী সমাজ বেশি সমর্থন দেবে।

কোনো ধরনের আদেশ জারি না করে কত লোককে নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে যাওয়া যাবে! বৃহৎ পরিসরে নির্দিষ্ট ইহুদি হিতৈষী আছে যারা জায়নবাদী পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ইহুদিদের যন্ত্রণা লাঘব করার চেষ্টা করে। তাদের কাছেও এই সমস্যাটি নিজে থেকেই উপস্থিত হয়েছিল এবং তারা অভিবাসীদের অর্থ বা কর্মসংস্থানের মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধানের চিন্তা করেছিল। সমাজসেবীরা তাই বলেছিলেন, ‘আমরা এই লোকদের সেখানে যাওয়ার জন্য অর্থ প্রদান করি।’

এ ধরনের প্রক্রিয়া একেবারেই ভুল। বিশ্বের সব অর্থ দিয়েও এই উদ্দেশ্য সফল করা যাবে না।

অন্যদিকে, কোম্পানি বলবে, ‘আমরা তাদের অর্থ দেব না, আমরা তাদের আমাদের অর্থ প্রদান করতে দেব। সেখানে যাওয়ার জন্য আমরা কেবল তাদের কিছু প্রণোদনার প্রস্তাব দেব।’

এখানে একটি কাল্পনিক দৃষ্টান্ত দিলে আমার কথার অর্থ আরও স্পষ্ট হবে। সেই জনহিতৈষীদের একজন (যাকে আমরা ‘ব্যারন’ বলব) এবং আমি দুজনেই প্যারিসের কাছে লংচ্যাম্পের সমভূমিতে, রোববারের এক গরম বিকেল, মানুষের একটা ভিড় জমাতে চাইলাম। ব্যারন, তাদের প্রতিজনকে ১০ ফ্রাঁ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দুই লাখ ফ্রাঁ খরচ করে ২০ হাজার ঘর্মাক্ত ও দুর্ভোগের শিকার লোককে বের করে আনবেন এবং তারা এই ধরনের চরম বিরক্তি দেওয়ার জন্য ব্যারনকে অভিশাপ দেবে। আমি একটি ঘোরদৌড়ের আয়োজন করে এই দুই লাখ ফ্রাঁ পুরস্কার ঘোষণা করব। তারপর লংচ্যাম্পের সমভূমি থেকে লোকদের দূরে রাখতে ব্যারিয়ার (সাময়িকভাবে বেড়া দেওয়া) দেব। তারা তখন এই ব্যারিয়ারের ভেতরে যাওয়ার জন্য অর্থ প্রদান করবে। এক ফ্রাঁ, পাঁচ ফ্রাঁ, বিশ ফ্রাঁ।

ফলে আমি তাদের অর্ধ-কোটি লোককে পাব; প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি ‘আ লা দুমু’ (অভিজাত ঘোড়ার গাড়ি) চালাবেন; এবং জনতা নিজেদের উপভোগ করবে এবং মজা করবে। তাদের অধিকাংশই মনে করবে তাপ ও ধুলাবালি সত্ত্বেও খোলা বাতাসে হাঁটা আনন্দদায়ক। আমি আমার দুই লাখ ফ্রাঁ দিয়ে প্রবেশমূল্য এবং গেমিং ট্যাক্সের মাধ্যমে ১০ লাখ বানিয়ে নেব। আমি যখনই চাইব সেখান থেকে এই লোকদের বের করে আনব; কিন্তু ব্যারন তা কোনোভাবেই পারবেন না।

যেখানে তারা জীবিকা উপার্জন করছে সেখানকার বহুজনের ঘটনার জন্য আমি আরও গুরুতর দৃষ্টান্ত দেব। শহরের রাস্তায় কোনো লোককে চিৎকার করতে দিন: ‘কেউ যদি শীতের ভয়ানক ঠান্ডার মধ্যে, গ্রীষ্মের যন্ত্রণাদায়ক উত্তাপের মধ্যে, চারপাশ খোলা কোনো লোহার হলঘরে সারাদিন দাঁড়িয়ে থেকে সেখানকার প্রতিটি পথচারীকে সম্বোধন করতে পারে এবং বলতে পারে যে তাকে অভিনব জিনিসপত্র বা মাছ কিংবা ফল দেওয়া হবে তাহলে তাকে দুই ফ্লোরিন, বা চার ফ্রাঁ বা সমমূল্যের কিছু দেওয়া হবে।’

কত লোক তাহলে ওই হলে যাবে? ক্ষুধাতাড়িত অবস্থায় কতদিন তারা নিজেদের সেখানে ধরে রাখতে পারবে? তারা যদি সেখানে নিজেদের ধরে রাখতে পারে, তবে পথচারীদের মাছ, ফল বা সৌখিন জিনিসপত্র কেনার জন্য প্ররোচিত করতে গিয়ে তারা কী ধরনের শক্তি দেখাবে?

এক্ষেত্রে আমরা ভিন্ন উপায় অবলম্বন করব। যেসব জায়গায় বাণিজ্য চলমান আছে, সেগুলোকে আমরা আরও সহজেই আবিষ্কার করব, যেহেতু আমরা নিজেরাই আমাদের যেখানে ইচ্ছা সরাসরি বাণিজ্য করি, এই জায়গাগুলোতে আমরা বড় হল তৈরি করব এবং সেগুলোকে আমরা বাজার বলব। হলগুলোর নির্মাণ হয়তো তত ভালো হবে না, স্বাস্থ্যকরও হবে না হয়তো, তারপরও লোকজন সেগুলোর দিকে ধাবিত হবে। তবে আমরা আমাদের সবটুকু প্রচেষ্টা চালাব সেগুলোকে আরও ভালো করে গড়ে তোলার এবং আগেরটির চেয়ে আরও সুন্দর করার। এই লোকগুলোকে আমরা কোনো প্রতিশ্রুতি দিইনি, কারণ প্রতারণা ছাড়া প্রতিশ্রুতি হয় না, এই চমৎকার ও সুদক্ষ ব্যবসায়ীরা অত্যন্ত আনন্দের সাথে সবচেয়ে সক্রিয় বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলবে। তারা ক্রেতাদের পটানোর জন্য অক্লান্তভাবে কথা বলবে; তারা তাদের দুই পায়ের ওপর সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে এবং ক্লান্তির কথা তাদের মাথায়ই আসবে না। তারা ভোরবেলা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়বে, যাতে জায়গামতো সবার আগে পৌঁছতে পারে। জীবিকা অর্জনের কাজ নির্বিঘ্নে চালানোর জন্য তারা ইউনিয়ন, কাৰ্টেল, বা তেমন যেকোনো কিছু গঠন করবে। যদি তারা দিনের শেষে দেখতে পায় যে, তাদের সমস্ত কঠোর পরিশ্রমে মাত্র ১ ফ্লোরিন, ৫০ ক্রয়েৎজার বা ৩ ফ্রাঁ কিংবা অনুরূপ সামান্যই আসছে, তাতেও তারা হতাশ হবে না। পরের দিনের জন্য অপেক্ষা করবে, যে দিনটি হয়তো তাদের জন্য সৌভাগ্যের হতে পারে।

আমরা তাদের আশা দিয়েছি।

কেউ কি জানতে চাইবে যে চাহিদা কোথা থেকে আসে, যা বাজার তৈরি করে? তাদের কি তা আবারও বলা সত্যিই দরকার?

আমি উল্লেখ করেছি যে ‘অ্যাসিসটেন্স পার লে ট্রাভেইলের’ (কাজের বিনিময়ে সহায়তা) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রিটার্ন ১৫ গুণ বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এক মিলিয়ন হবে ১৫ মিলিয়ন এবং এক হাজার মিলিয়ন হবে ১৫ হাজার মিলিয়ন।

ছোট পরিসরে এমনটা হতে পারে; বৃহত্তর ক্ষেত্রেও কি তা হবে? পুঁজি অবশ্যই তার নিজস্ব বৃদ্ধির বিপরীত অনুপাতে হ্রাসকৃত হারে একটি রিটার্ন প্রদান করে। নিষ্ক্রিয় এবং অলস পুঁজি এই হ্রাসকৃত রিটার্ন প্রদান করে; কিন্তু সক্রিয় পুঁজি একটি বিস্ময়করভাবে বর্ধিত রিটার্ন নিয়ে আসে। সামাজিক প্রশ্নটি আসলে এখানেই নিহিত।

আমি যা বলছি তা বাস্তব কি না? আমি যে ঠিক বলছি, তা প্রমাণের জন্য সাক্ষী হিসাবে সবচেয়ে ধনী ইহুদিদের আহ্বান জানাই। কেন তারা এত এত নানা ধরনের শিল্প-কারখানা চালিয়ে যাচ্ছে! কেন তারা লোকজনকে স্বল্প বেতনের জন্য ভয়ংকর বিপদের মধ্যে মাটির নিচে কাজ করতে এবং কয়লা সংগ্রহ করতে পাঠায়? এমনকি আমি কল্পনাও করতে পারি না যে এই ব্যাপারটি খনি মালিকদের কাছেও খুব ভালো লাগার। আমি বিশ্বাস করি না যে পুঁজিবাদীরা হৃদয়হীন। এমনকি আমি তা বিশ্বাস করার ভানও করি না। আমার উদ্দেশ্য আসলে এই বিষয়টি নিয়ে গলাবাজি করা নয়, আমার উদ্দেশ্য এই পার্থক্যগুলোর মধ্যে একটা ভারসাম্য আনা।

বহুত্বের ফেনোমেনাকে[২২] চিত্রিত করা এবং ধার্মিক তীর্থযাত্রীদের কথা উল্লেখ করে একটি নির্দিষ্ট জায়গার ওপর মনোযোগ দেওয়া কি প্ৰয়োজন?

[২২ বহুত্বের ফেনোমেনাকে: প্রপঞ্চ, ঘটমান বিষয়, ব্যাপার, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু, বিস্ময়। ইহুদিদের অন্য জাতির সঙ্গে একত্রে বসবাসের বিষয়ে তৎকালীন যে আলোচনা ও পরিস্থিতি তা বোঝানো হয়েছে।]

আমি এমন কোনো কথা বলতে চাই না, যার মাধ্যমে কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে, যে কথাটির আবার ভুল ব্যাখ্যা হতে পারে।

আমি কেবল সংক্ষিপ্তভাবে মক্কায় মুসলমানদের তীর্থযাত্রা, লর্ডেসে ক্যাথলিকদের তীর্থযাত্রা[২৩], আরো অনেক স্থান আছে যেখান থেকে লোকেরা তাদের বিশ্বাসের স্বস্তি নিয়ে ফিরে আসে, মুসেলের ট্রিয়েরের কথা উল্লেখ করব। একইভাবে আমরা আমাদের লোকদের গভীর ধর্মীয় প্রয়োজনের জন্যও একটি কেন্দ্রও নির্মাণ করব। আমাদের মন্ত্রীরা প্রথমে আমাদের বুঝবেন এবং এ কাজে আমাদের সাথে থাকবেন।

[২৩ ফ্রান্সের পিরেনিসের একটি ছোট শহর লর্ডেস। ১৮৫৮ সালে ম্যারির আবির্ভাবের খবর বা গুজব ছড়িয়ে পড়ার পর লর্ডেসে দলে দলে ক্যাথলিক তীর্থযাত্রী যেতে থাকে বিভিন্ন দেশ থেকে।]

আমরা প্রত্যেককে তার নিজস্ব উপায়ে ‘সেখানে’ পরিত্রাণ খুঁজে পেতে দেব। সর্বোপরি এবং সর্বাগ্রে আমরা আমাদের মুক্তচিন্তকদের অমর দলটির জন্য পরিসর তৈরি করব, যারা ক্রমাগত মানবতার জন্য নতুন বিজয় অর্জন করে চলেছে।

রাষ্ট্র ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যতটুকু প্রয়োজন তারচেয়ে বেশি বল কারো ওপর প্রয়োগ করা হবে না; এবং অপরিহার্য বল প্রয়োগের ব্যাপারটি পরিবর্তনশীল এক বা একাধিক কর্তৃপক্ষ দ্বারা যথেচ্ছভাবে সংজ্ঞায়িত করা হবে না; এটি লৌহ আইন (অলঙ্ঘনীয় কঠোর আইন) দ্বারা নির্ধারিত থাকবে।

এখন, যে দৃষ্টান্তগুলো দিয়েছি তা যদি লোকদের অনুমান করতে বাধ্য করে যে একটি জনতা কেবল সাময়িকভাবে বিশ্বাস, ব্যবসা বা বিনোদনের কেন্দ্রগুলোতে আকৃষ্ট হতে পারে, তাহলে তাদের আপত্তির উত্তরটাও সহজ। আকর্ষণের এই কেন্দ্রগুলো যেহেতু আলাদাভাবে নিজে থেকেই নিশ্চিতভাবে নির্দিষ্ট জনতাকে আকৃষ্ট করবে, সেহেতু আকর্ষণের এসব কেন্দ্রগুলো একত্রে জনতাকে স্থায়ীভাবে ধরে রাখবে ও সন্তুষ্ট করবে বলে গণ্য করা হবে। এসব কেন্দ্র একত্রিত হয়ে একটি একক, মহান, বহুকাঙ্ক্ষিত একটি লক্ষ্য তৈরি করে, যে লক্ষ্য আমাদের জনগণ সবসময় অর্জন করতে চেয়েছে। যে কারণে তা নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যে কারণে বাইরের চাপে এটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে— একটি মুক্ত বাড়ি! আন্দোলন শুরু হলে আমরা কিছু লোককে আমাদের পেছনে টেনে নিয়ে যাব এবং অন্যদের অনুসরণ করতে দেব; অন্যরা আবার স্রোতে ভেসে যাবে এবং শেষটায় আবার তারা পেছন থেকে আমাদের ধাক্কা দেবে।

শেষের এই দ্বিধাগ্রস্ত বসতি স্থাপনকারীরা এখানে ও সেখানে, দুই জায়গায়ই, তারা হবে সবচেয়ে খারাপ।

কিন্তু প্রথমের যারা- যারা বিশ্বাস, উদ্যম ও সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যাবে- তারা সেরা অবস্থান পাবে।

আমাদের মানবিক উপাদান

ইহুদিদের সম্পর্কে চারদিকে অন্য যেকোনো লোকদের চেয়ে বেশি ভুল ধারণা রয়েছে। আমরা আমাদের ঐতিহাসিক যন্ত্রণার মাধ্যমে এতটাই হতাশ ও নিরুৎসাহিত হয়েছি যে, আমরা নিজেরাই এই ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি করি এবং এগুলো বিশ্বাসও করি। এর মধ্যে একটি হলো, ব্যবসার প্রতি আমাদের অসংযত নজর। এখন এটা সুপরিচিত যে যেখানেই আমাদের শ্রেণিগুলোকে উত্থানে অংশ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়, আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের ব্যবসা ছেড়ে দিই। বেশিরভাগ ইহুদি ব্যবসায়ী তাদের ছেলেদের উচ্চতর শিক্ষা দেয়। তাই, সব ধরনের বুদ্ধিজীবী পেশায় তথাকথিত ‘জুদাইজিং’২৪ রয়েছে; কিন্তু আমাদের সমাজের অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল পর্যায়ে বাণিজ্যের প্রতি ভালোবাসা এতটা প্রাধান্য পায় না, যেমনটি সাধারণত অনুমান করা হয়। ইউরোপের পুবের দেশগুলোতে বিপুলসংখ্যক ইহুদি রয়েছে, যারা ব্যবসায়ী নয় এবং কঠোর পরিশ্রমকেও যারা ভয় পায় না। ইহুদি সোসাইটি আমাদের মানববাহিনীর বৈজ্ঞানিকভাবে সঠিক পরিসংখ্যান প্রস্তুত করার অবস্থানে থাকবে। নতুন দেশে আমাদের জনগণের জন্য যে নতুন কাজ এবং সম্ভাবনা অপেক্ষা করছে, তা আমাদের বর্তমান হস্তশিল্প কারিগরদের সন্তুষ্ট করবে এবং এখনকার অনেক ছোট ব্যবসায়ীকে কায়িক শ্রমের কর্মীতে রূপান্তরিত করবে।

[২৪ জুদাইজিং: ইহুদিকরণ, ইহুদিদের রীতিনীতি, বিশ্বাস ও চরিত্র গ্রহণ করা বোঝায়। শব্দটি ইহুদি ধর্মগ্রহণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এখানে সাধারণ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।]

আমাদের যে ব্যবসায়ী পিঠে ভারী পোঁটলা নিয়ে সারা দেশে ঘুরে বেড়ায় সে ততটা সন্তুষ্ট নয়, যতটা তার নির্যাতকরা মনে করে। সাত ঘণ্টা কাজের দিন এই ব্যবসায়ীর মতো লোকদের শ্রমিকে রূপান্তরিত করবে। তারা ভালো, তবে তাদের ভুল বোঝা হয়, তারা এখন অন্যদের তুলনায় সম্ভবত বেশি কষ্টে আছে। ইহুদি সোসাইটি, তদুপরি, কারিগর হিসেবে শুরু থেকেই তাদের প্রশিক্ষণ দিতে ব্যস্ত থাকবে। সাফল্যের প্রতি তাদের প্রেমকে স্বাস্থ্যকরভাবে উৎসাহিত করা হবে। ইহুদিরা মিতব্যয়ী ও অভিযোজিত স্বভাবের। তারা জীবিকা অর্জনের যেকোনো উপায়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার যোগ্য। তাই তাদের ছোট ব্যবসাকে অপ্রয়োজনীয় করে তোলার জন্য এটি যথেষ্ট হবে, এমনকি বর্তমান ব্যবসায়ীরাও এটি সম্পূর্ণভাবে ছেড়ে দেবে। উদাহরণ টেনে বলা যায়, দৈনন্দিন জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সব জিনিস সরবরাহ করে এমন সব বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোকে উৎসাহিত করে তা করা সম্ভব হবে। এই স্টোরগুলো এরই মধ্যে বড় শহরগুলোর ছোট ব্যবসাকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। নতুন সভ্যতার দেশে তারা এর অস্তিত্বকে পুরোপুরি প্রতিহত করবে। এই স্টোরগুলোর প্রতিষ্ঠা আরও সুবিধাজনক, কারণ এটি দেশটিকে অবিলম্বে এমন লোকদের জন্য বাসযোগ্য করে তোলে, যাদের জীবনের জন্য আরও পরিমার্জিত জিনিসপত্র ও বিষয়-আশয়ের প্রয়োজন হয়।

অভ্যাস

এই পুস্তিকার আলোচনার গুরুতর প্রকৃতির সঙ্গে মিল রেখে সাধারণ মানুষের তুচ্ছ অভ্যাস ও স্বাচ্ছন্দ্যের উল্লেখ কেন?

আমি মনে করি, এই ভারসাম্য রাখা, এবং অধিকন্তু, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ছোট ছোট এই অভ্যাসগুলো হচ্ছে এক হাজার একটা সূক্ষ্ম সুতা, যেগুলো মিলে একটা অটুট দড়ি তৈরি করে।

এসবের মধ্যে এমন কিছু নির্দিষ্ট ধারণা আছে যেগুলোকে এখানে রাখতে হবে। দুনিয়া সম্পর্কে যার ধারণা আছে সে জানে যে, দিনানুদিনের এই সামান্য রীতিগুলো সবখানে সহজেই প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে আমাদের প্রতিদিনের প্রযুক্তিগত কৌশলগুলোকে, যেগুলো এর আগে প্ৰধানত আমাদের অভ্যাসের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে, এই পরিকল্পনা মানবতার সেবায় সেগুলোকে কাজে লাগাতে চায়। মিসরে কিংবা সুইজারল্যান্ডের পর্বত-চূড়ায় ইংলিশ হোটেল আছে, দক্ষিণ আফ্রিকায় আছে ভিয়েনা ক্যাফে, রাশিয়ায় রয়েছে ফ্রেঞ্চ থিয়েটার, আমেরিকায় আছে জার্মান অপেরা, প্যারিসে রয়েছে সেরা ব্যাভারিয়ান বিয়ার।

আমরা যখন আবার মিসরে ভ্রমণ করব তখন আমরা বিলাসিতাগুলো পেছনে ফেলে যাব না।

অভিবাসীদের প্রত্যেকেই স্থানীয় দলগুলোর মধ্যে আবার তাদের রীতি- রেওয়াজগুলো খুঁজে পাবে; কিন্তু সেগুলো হবে আগের চেয়ে ভালো, আগের চেয়ে সুন্দর এবং আরো মনোরম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *