সেরাতে ঘুমাতে গিয়ে দীপুর হঠাৎ ওর আব্বার কথা মনে পড়ল। ওর আব্বা বলেছিলেন, যদি ওর কখনও তারিককে ভাল লেগে যায়, তা হলে তারিকেরও ওকে ভাল লাগবে, প্রাণের বন্ধু হয়ে যাবে দু’জনে! এখন তো ওর তারিককে খুব ভাল লাগছে, যত রাগ ছিল সব চলে গিয়েছে। তারিকের কি ওকে এখন ভাল লাগবে? না লাগলেও সে আর কিছু মনে করবে না কাল ভোরেই তারিকের সাথে বন্ধুত্ব করে ফেলবে।
দুদিন হল দীপু লক্ষ্য করছে, তার আব্বা কী নিয়ে যেন খুব চিন্তিত। যতক্ষণ বাসায় থাকেন সবসময় এঘর থেকে ওঘরে হাঁটতে থাকেন। অনেক সময় হাতে সিগারেট নিয়ে বসে থাকেন, টানতে পর্যন্ত মনে থাকে না, সিগারেট লম্বা ছাই জমে টুপ করে মেঝের ওপর পড়ে। দীপুর অস্বস্তি লাগে, যখন হঠাৎ করে বুঝতে পারে তার আব্বা কেমন করে জানি তার দিকে তাকিয়ে আছেন। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করে দেখেছে, আব্বা বলার চেষ্টা করে বলেছেন, না, কিছু হয়নি।
রাতে হঠাৎ দীপুর ঘুম ভেঙে যায়, বুঝতে পারে আব্বা তার মাথার কাছে চুপচাপ বসে আছেন। খুব আস্তে আস্তে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। দীপু ঘুমিয়ে থাকার ভান করে শুয়ে রইল, যদিও ওর খুব ইচ্ছে হচ্ছিল আব্বার হাত ধরে জিজ্ঞেস করে কী হয়েছে।
আগেও অনেকবার এরকম হয়েছে। ওর মনে আছে, একবার প্রচণ্ড ঝড়ের রাতে ওর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। কাঁচের জানালা দিয়ে বিদ্যুঝলকের সাথে দেখতে পাচ্ছিল প্রচণ্ড ঝড়ে গাছগুলো মাতামাতি করছে, দেখে মনে হয় গাছগুলো যেন মানুষ—যন্ত্রণায় ছটফট করছে। ঝড়কে ও ভয় পায় না, কিন্তু সে-রাতে কেন জানি ওর ভয় ভয় লাগছিল। শুধু ভয় নয়, তার কেন জানি মন-খারাপ লাগছিল, বুকের ভেতর ফঁকা ফাঁকা লাগছিল ওর। কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছিল। ঠিক সেসময় আব্বা পাশের ঘর থেকে উঠে এসে ডাকলেন। বাবা দীপু, ঘুমিয়ে আছিস?
ও বলল, না আব্বা, আমার ভয় লাগছে।
ভয় কী বাবা, বলে আব্বা বিছানায় ওর পাশে এসে বসলেন আর ও বাচ্চা ছেলের মতো ওর আব্বার বুকের মাঝে গুটিসুটি মেরে পড়ে রইল। আব্বার শরীরের ঘ্রাণ ওর কত চেনা, ওর তখন যে কী ভাল লাগছিল! শক্ত করে আব্বাকে ধরে ও শুয়ে রইল, সব ভয় যে ওর কোথায় চলে গেল।
আজ রাতেও দীপুর ইচ্ছে ওর আব্বাকে ধরে শুয়ে থাকতে। কিন্তু কেন জানি ও তবু চুপ করে শুয়ে রইল। শুনতে পেল, আব্বা খুব ধীরে ধীরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন! কেন জানি দীপুর ভারি মন-খারাপ হয়ে গেল।
.
সকালে স্কুলে যাবার আগে আব্বা ওকে বললেন, দীপু, তোর আজ স্কুলে যেতে হবে না।
দীপু একটু ভয় পেয়ে বলল, কেন আব্বা?
কাজ আছে একটু।
আগেও অনেকবার এরকম হয়েছে। স্কুল খোলা, অথচ আব্বা তাকে নিয়ে কোথায় কোথায় ঘুরতে চলে গেলেন। একবার কী একটা পরীক্ষা পর্যন্ত দেয়া হল। না, রেজাল্ট খারাপ হয়ে গেল শেষে। আব্বা হেসে বললেন, রেজাল্ট খারাপ হলে কী হয়? বেশি ভাল রেজাল্ট হলে অহঙ্কারী হয়ে যাবি, ভাববি আমি কী হনু রে।
অথচ আজ সে আব্বাকে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করতে পারল না কী কাজ। একটা চাপা ভয় নিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল।
একটু পরেই আব্বা তাকে তার ঘরে ডাকলেন। বিছানায় হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে সিগারেট খাচ্ছিলেন চুপচাপ। দীপুকে একেবারে কাছে ডেকে নিয়ে বসালেন। সচরাচর ওরকম করেন না। দীপু একটু অবাক হল। আব্বা আস্তে আস্তে বললেন, দীপু, আজ তোকে একটা জিনিস বলব।
দীপু কেন জানি খুব ভয় পেয়ে গেল। শুকনো গলায় বলল, কী?
আব্বা তবু খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই জানিস যে তার আম্মা মারা গেছেন, না?
দীপু ফ্যাকাসে মুখে মাথা নাড়ল।
আসলে—
দীপু ভয়ানক চমকে উঠে বলল, আসলে কী?
আসলে তোর আম্মা এখনও বেঁচে আছে।
কয়েক সেকেন্ড দীপু কিছু বুঝতে পারল না, শূন্য দৃষ্টিতে আব্বার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে ও বুঝতে পারল আব্বা কী বলছেন। চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল, ভাঙা গলায় বল, কী বললে?
আব্বা ওকে শক্ত করে বুকে ধরে রাখলেন, আস্তে আস্তে বললেন, আমি তোকে এতদিন মিছে কথা বলে এসেছি দীপু। আসলে তোর আম্মা এখনও বেঁচে আছে।
দীপু কোনোমতে বলল, কোথায়?
আমেরিকা। তোর জন্মের পর তোর আম্মা আর আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল। তোর মা তোকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, আমি দেইনি। তোকে আমার কাছে রেখেছি।
আব্বা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বললেন, তার কয়দিন পর তোর মা আমার এক বন্ধুকে বিয়ে করে আমেরিকা চলে গেছে। তার আরও দুটি ছেলেমেয়ে হয়েছে বলে শুনেছি। এতদিন তোকে আমি কিছু বলিনি। ভাবতাম, যদি তোকে জানতে দিই যে তোর মা বেঁচে আছে, তা হলে হয়তো শুধু শুধু কষ্ট পাবি।
দীপু চুপ করে রইল। কেন জানি তার চোখে পানি এসে গেল, তার মা বেঁচে আছেন অথচ একটিবার তার কথা মনে করলেন না? একটিবার তাকে দেখতে চাইলেন না?
আব্বা ওকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, তোকে আমি খুব শক্ত করে মানুষ করছি দীপু, যখন বড় হবি তখন দেখবি ছোটখাটো দুঃখকষ্টকে ভয় পাবি না। তোকে এতদিন তোর মায়ের কথা বলিনি, ভেবেছিলাম বড় হলে বলব। কিন্তু–
কিন্তু কী–
সেদিন তোর মায়ের একটা চিঠি পেলাম, ও ঢাকা এসেছে কয়েকদিনের জন্যে।
দীপু ভয়ানক চমকে উঠে ওর আব্বার দিকে তাকাল, ওর আম্মা তা হলে ঢাকাতে আছেন? আব্বা আস্তে আস্তে বললেন, তোকে একবার দেখতে চায়।
দীপুর দু’চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসে। আব্বা আস্তে আস্তে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, আমি না করে দিয়েছিলাম, বলেছিলাম যে, তোকে তোর মায়ের কথা জানতে দিইনি, চাই না জানুক। মা ছাড়াই ও মানুষ হোক। কিন্তু কদিন থেকেই আমার মনে হচ্ছে, কাজটা কি ভাল করলাম? আমার নিজের মা আমাকে যা আদর করত! তোর মাও নিশ্চয়ই তোর জন্যে খুব ফীল করে, আদর করার সুযোগটা আর পায় না।
আব্বা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তোর মা আবার আগামীকাল রাতে আমেরিকা চলে যাচ্ছে, আর হয়তো আসবে না। তাই আমি ভাবছিলাম, যদি তোকে এবারে তার সাথে দেখা করতে না দিই, হয়তো আর কোনোদিন তোদের দেখা হবে না। যাবি তোর মাকে দেখতে?
দীপু আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না, আব্বাকে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠল। আব্বা খুব আস্তে আস্তে দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। মৃদু গলায় বললেন, যাবি তোর মায়ের সাথে দেখা করতে? তা হলে আর দেরি করিস না বাবা। বারোটার সময় ট্রেন ছাড়বে, কাল খুব ভোরে পৌঁছে যাবি ঢাকা।
তুমি যাবে না?
আব্বা একটু হেসে বললেন, কেন, তুই একা যেতে পারবি না?
দীপু ঘাড় নাড়ল, পারব।
.
দীপু ঢাকা স্টেশনে ট্রেন থেকে নামল খুব ভোরে! ঢাকায় ও আগে যখন এসেছে তখন সাথে ছিলেন আব্বা, এবারে ও একা একা। ঘুরে বেড়াতে তার কখনও কোনো ভয় নেই, বরং ভালই লাগে। এবারে ব্যাপারটি অবশ্যি অন্যরকম। ট্রেনে ঘুমানোর জায়গা পেয়েছিল তবু সারা রাত একটুও ঘুমাতে পারেনি। ও যতবার চোখ বন্ধ করেছে ততবার আম্মার ছবি দেখতে পেয়েছে। ও জানত না ওর আব্বার কাছে ওর আম্মার ছবি ছিল। আগে অনেক জিজ্ঞেস করেছিল, আব্বা বলেছিলেন, নেই। এবারে জিজ্ঞেস করার পর ট্রাঙ্ক খুলে একটি ছবি বের করে আনলেন। ছবিতে ওর আব্বাকে দেখাচ্ছে খুব কম বয়স, পাশে ওর আম্মা। আর ওর আম্মার কোলে সে নিজে একেবারে ন্যাদা ন্যাদা বাচ্চা। ওর আম্মা কী হাসছেন, মনে হচ্ছে বুঝি হাসির শব্দ শুনতে পাওয়া যাবে! আর ওর আব্বা বাচ্চা ছেলের মতো জোর করে হাসি চেপে আছেন, যেন ভারি একটা মজার ব্যাপার আছে, কাউকে বলা যাবে না। ছবিটি দেখে ওর অভিমানে গলা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কোনোমতে আব্বাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আব্বা তোমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল কেন?
আব্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ছাড়াছাড়ি যে কেন হল তোকে বোঝানো মুশকিল!
ঝগড়া হয়েছিল?
হুঁ, অনেকটা ঝগড়ার মতোই।
কেন ঝগড়া করলে তোমরা? প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করতে পারেনি। ওর আম্মার সাথে দেখা হলে সে জিজ্ঞেস করে দেখবে। দীপুর আবার চোখে পানি এসে যায়।
স্টেশনের বাথরুমে দীপু দাঁত ব্রাশ করে পরিষ্কার হয়ে নিল। আয়নায় ও দেখতে পেল ওর চোখ লাল আর চুল উষ্কখুষ্ক। মিছেই হাত দিয়ে কয়েকবার চুল ঠিক করার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল।
আব্বা ঠিকানা লিখে দিয়েছেন, সেটা বুক-পকেটে আছে। কিন্তু এতবার ও ঠিকানাটা পড়েছে যে, মুখস্থ আছে ওর। ও বাইরে এসে একটা রিকশা ঠিক করল। অনেক দূর এখান থেকে। অন্য সময় হলে সে ঠিক খুঁজে খুঁজে বাসা বের করে ফেলত। এবারে ওর বাসে যেতে ইচ্ছে করছিল না—একা একা রিকশা করে যেতে ইচ্ছে করছিল।
ঢাকায় যতবার এসেছে ততবারই ওর খুব ভাল লেগেছে। যখনই নতুন কোনো জায়গায় যায়, ওর চোখ ঘুরিয়ে দু পাশে দেখতে খুব ভাল লাগে। কত মজার মজার দোকানপাট, বাড়িঘর, কত মজার লোকজন! এবারে ও কিছুতেই মন দিতে পারছিল না। ওর কেমন জানি ভয় ভয় লাগছিল, আর অদ্ভুত একটা অভিমান হচ্ছিল। কার ওপর কে জানে!
ওর আম্মা কেমন, দেখা হলে ও প্রথম কী বলবে, ও ঠিক করতে পারছিল না। যদি ওর নাম শুনে চিনতে না পারেন, তা হলে সে কী বলবে?
বাসা খুঁজে পেতে একটু দেরি হল বলে ও রিকশাওয়ালাকে একটু বেশি পয়সা দিল। বুড়ো রিকশাওয়ালা একগাল হেসে চলে যাবার পর ও একা একা খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল! বাসাটি ভারি চমৎকার মস্ত বড় লোহার গেট হা করে খুলে রেখেছে, ভেতরে ফুলের বাগান, দুটি চকচকে গাড়ি। একটা বিরাট বড়, আরেকটা ছোট্ট, লাল টুকটুকে। উপরের বারান্দায় ছোট ছোট সুন্দর ছেলেমেয়ে লাফঝাঁপ করছে। কে জানে হয়তো কোনো একজন তার ভাই কিংবা বোন।
এত সুন্দর ঝকমকে বাসায় ওর নিজেকে ভারি বেমানান লাগছিল, কিন্তু বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা আরও বাজে ব্যাপার। সে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই একটা কলিংবেল দেখতে পেল। একটু দ্বিধা করে ও বোতাম টিপে ধরল। ভাবছিল কড়কড় করে বুঝি বেজে উঠবে কিন্তু শুনতে পেল ভেতরে মিষ্টি বাজনার মতো একটু শব্দ হল।
একটি ছেলে দরজা খুলে দিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী খোকা, কাকে চাই?
দীপু ঢোক গিলে বলল, মিসেস রওশান বাসায় আছেন?
আছেন। ভেতরে এসো।
দীপু ছেলেটার পিছে পিছে এসে বলল, আমি তার সাথে একটু দেখা করতে চাই।
ও! ভাবী তো খুব ব্যস্ত, আজ চলে যাবেন কিনা! কী দরকার বলতে পারবে?
দীপু আস্তে আস্তে বলল, আমার ঠিক কোনো দরকার নেই, শুধু একটু দেখা। করতে এসেছি। একটু ডেকে দেবেন?
বেশ। ছেলেটা ভেতরে চলে গেল।
তার বয়েসী বেশ ক’জন ছেলেমেয়ে কার্পেটে বসে কী একটা যেন খেলছিল। বড় লোকের ছেলেমেয়েরা এগুলো দিয়ে খেলে। অনেকেই কথা বলছিল ইংরেজিতে। দীপুকে একনজর দেখে সবাই আবার খেলায় মন দিল।
দীপু কী করবে বুঝতে না পেরে একপাশে দাঁড়িয়ে চারদিকে দেখতে লাগল। কী সুন্দর করে সবকিছু সাজানো! লাল ভারী পর্দা, দেয়ালে বড় বড় চমৎকার সব ছবি, শোকেসে সুন্দর সুন্দর সব পুতুল আর হাজার হাজার বই। একপাশে ছোট খেলনার মতো একটা টেলিফোন। একটা মস্ত টেলিভিশন, তার পাশে আরও কত কী, ও সবকিছুর নামও জানে না।
ঠিক তখনি পর্দা সরিয়ে সেই ছেলেটি আর তার পেছনে পেছনে একজন খুব সুন্দরী ভদ্রমহিলা এসে ঢুকলেন। হাতে টুকটুকে একটা লাল ফ্রক, হয়তো কিছু ঠিক করছিলেন। দীপুকে দেখে বললেন, খোকা, তুমি আমার খোঁজ করছ?
দীপু মাথা নাড়ল, বলল হ্যাঁ। তারপর ভদ্রমহিলার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি দীপু।
দীপু দেখল, মুহূর্তে ওর আম্মার সারা মুখ ফ্যাকাসে বিবর্ণ হয়ে গেল। থরথর করে কেঁপে উঠলেন, হাত থেকে লাল ফ্রকটি পড়ে গেল মেঝেতে। আস্তে আস্তে এগিয়ে এলেন দুই পা, তারপর বাচ্চা মেয়ের মতো হাঁটু ভেঙে বসে পড়েলেন। আম্মা কাঁপা-কাঁপা হাতে ওকে কাছে টেনে আনলেন, বিস্ফারিত চোখে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর কিছু বোঝার আগে ওকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে উঠলেন। দীপু কাদবে না কাঁদবে না করেও কিছুতেই চোখের পানি আটকাতে পারল না।
ওর আম্মা যখন ওকে ছাড়লেন, তখন ওর শার্টের কলার, বুক ভিজে গেছে। ওর আম্মার চোখের পানিতে। কেঁদে ফেলেছে বলে ওর একা লজ্জা লাগছিল, ঘরে তাকিয়ে দেখল বাচ্চারা কেউ নেই, সারা ঘরে শুধু সে আর তার আম্মা। কেউ কেউ উঁকি মেরে দেখছে পর্দার ফাঁক দিয়ে।
আম্মা খানিকক্ষণ ওকে তাকিয়ে দেখেন, চুলে হাত বুলিয়ে দেন, তারপর কাছে। টেনে এনে মুখে চুমু দিয়ে বাচ্চার মতো আদর করেন। তারপর আবার খানিকক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন চিবুক, গাল, চোখে হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেন। তারপর আবার হু হু করে কেঁদে ওঠেন। অনেকক্ষণ পরে বললেন, বাপ আমার, এতদিন পরে আমাকে দেখতে এলে?
দীপু কী বলবে বুঝতে না পেরে মাথা নিচু করে বসে রইল। আম্মা হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে বললেন, কখন এসেছ?
একটু আগে।
তোমার আব্বা কোথায়?
বাসায়।
তুমি কার সাথে এসেছ?
একা।
একা? আম্মা একটু অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালেন, কিন্তু কিছু বললেন না। খানিকক্ষণ ওর চুলের ভেতর হাত বুলিয়ে আবার হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে বললেন, খাওয়া হয়নি তোমার, না?
উঁহু। খেয়েছি আমি স্টেশনে।
কী খেয়েছ?
পরোটা আর মিষ্টি। বলতে গিয়ে কেন জানি ওর লজ্জা লাগল।
আম্মা বললেন, ঠিক আছে, তবু এসো হাত মুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে কিছু খাবে।
দীপুর কেন জানি ভেতরে যেতে ইচ্ছে করছিল না। অপরিচিত লোকজন ওর ভাল লাগে না, না। ও আস্তে আস্তে বলল, আমি হাত মুখ ধুয়ে এসেছি, আর আমার একটুও খিদে পায়নি।
আম্মা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার ভেতরে যেতে ইচ্ছে করছে, না?
দীপু মাথা নাড়ল। আম্মা বললেন, ঠিক আছে, তা হলে বসো এখানে, আমি আসছি।
আম্মা ভেতরে গেলেন, তারপর সাথে সাথেই ফিরে এলেন দুটি ফুটফুটে বাচ্চা নিয়ে—একজন ছেলে একজন মেয়ে। আম্মা ছেলেমেয়ে দুটিকে বললেন, রুমী, লিরা, এ হচ্ছে দীপু, তোমাদের বড় ভাই।
ছেলেটি আর মেয়েটি মেশিনের মতো বলল, হ্যালো!
দীপু কী করবে বুঝতে না পেরে একটু হাসল। আম্মা বললেন, তোমরা কথা বলো, আমি আসছি।
দীপু এদের মাঝে বড়, কাজেই ওরই কথা শুরু করা দরকার, অথচ কী বলবে বুঝতে পারছিল না। ও কিছু বলার আগেই ছেলেটা খুব গম্ভীর হয়ে সোফায় বসে জিজ্ঞেস করল, তুমি আমাদের ভাই?
দীপু মাথা নেড়ে হাসল।
ভেরি স্ট্রেঞ্জ!
কী?
হ্যাভিং এ স্টেপ ব্রাদার ইজ রাদার স্ট্রেঞ্জ।
মেয়েটি একটু হেসে উঠে ওর ভাইকে বলল, হি ইজ কিউট। ইজট হি?
ভাইটি চোখ পাকিয়ে বোনের দিকে তাকাল, তারপর দীপুকে বলল, শী ইজ ইমম্যাচিওরড। ডাজনট নো হাউ টু টক!
এত ছোট বাচ্চা এমন সুন্দর টক টক ইংরেজি বলছে যে, ওর খুব অবাক লাগে। দেখতে এত সুন্দর দু’জনেই যে দীপুর আদর করতে ইচ্ছে হচ্ছিল। সত্যি সত্যি যদি ওর দু’জন ভাই-বোন থাকত—ওদের যে সে কী আদরই না করত!
এমন সময় ওর আম্মা বেরিয়ে এলেন, হাতে একটা বড়সড় ব্যাগ। ছেলেমেয়ে দু’জনকে বললেন, তোমরা নিজেদের জিনিসপত্র ঠিক করে নাও, আমার আসতে দেরি হবে, ড্যাড-এর কথা শুনো।
ছেলেটি বলল, ওকে মম। ওর আম্মা মাথা নিচু করলেন আর ছেলেমেয়ে দু’জন চুক চুক করে দু’গালে চুমু খেয়ে ভেতরে চলে গেল।
আম্মা দীপুকে বললেন, চলো।
কোথায়?
বাইরে কোথায়।
আম্মা ওর হাত ধরে বাইরে নিয়ে এলেন। ছোট লাল টুকটুকে গাড়িটার দরজা খুলে দিলেন আম্মা, ও ভেতরে গিয়ে বসল। ড্রাইভার নেই দেখে দীপু অবাক হচ্ছিল। যখন দেখল ওর আম্মাই ড্রাইভারের সীটে বসেছেন, তখন সে আরও অবাক হয়ে গেল। ওর আম্মা গাড়ি চালাতে পারেন!
দীপু গাড়ি চড়তে খুব ভালবাসে। খোলা একটা জীপে বসে শাঁ-শাঁ করে পাহাড়ের মাঝে একটা রাস্তা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে এরকম একা ছবি প্রায়ই সে কল্পনা করে কিন্তু ও গাড়ি চড়েছে খুব কম, এভাবে তো কখনওই চড়েনি। শুধু তার জন্যে তার আম্মা গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। ও চোখের কোন দিকে তার আম্মাকে দেখার চেষ্টা করল। কী আশ্চর্য! তার নিজের আম্মা!
দীপু!
উঁ।
একটা কিছু বলল।
কী বলব?
আম্মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি আমার উপর রাগ করে আছ, না?
দীপু আস্তে আস্তে বলল, কেন?
তোমাকে ছেড়ে চলে গেছি, তাই।
আমি তো জানতান না। আব্বা কখনও বলেননি।
যখন বলেছে তখন?
তখন একটু দুঃখ হয়েছে, রাগ হবে কেন?
আম্মা একহাতে ওকে ধরে টেনে নিলেন। দীপুর একটু ভয় হচ্ছিল, এক হাতে গাড়ি চালাতে গিয়ে যদি অ্যাক্সিডেন্ট হয়? ওর আম্মার শরীরে কেমন মিষ্টি একটা গন্ধ। মায়েদের শরীরে বুঝি এরকম গন্ধ হয়?
শাঁ করে একটা ট্রাক পাশ দিয়ে চলে গেল। আম্মা ওকে ছেড়ে দিয়ে আবার দু হাতে স্টিয়ারিং ধরলেন।
গাড়ি চালাতে কেমন জানি লাগে। ওখানে রাস্তার ডান দিকে দিয়ে চালাই তো!
ওখানে সবাই ডান দিক দিয়ে যায়?
হ্যাঁ।
ওখানে গাড়ি খুব বেশি?
বেশি—মানে এত গাড়ি, চিন্তা করা যায় না, দম বন্ধ হয়ে আসে আমার। তাই একবার ঢাকা এলে আর ফিরে যেতে মন চায় না। নিজের দেশের থেকে ভাল দেশ আছে কোথাও?
আম্মা একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, দীপু!
কী?
যাবে আমার সাথে?
দীপু চুপ করে রইল।
যাবে আমেরিকায়? ওখানে পড়বে?
দীপু আস্তে আস্তে বলল, এখন যাব না, বড় হয়ে যাব।
এখন যাবে না কেন?
না, এখন যাব না।
কেন?
দীপু উত্তর দিতে পারল না, যদিও ও কারণটা জানে। ও ওর আব্বাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না। আম্মা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
বায়তুল মোকাররমের পাশে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে আম্মা দীপুকে বললেন, এসো দীপু।
দীপু নামতে নামতে বলল, কোথায়?
এসো তো, একটু ঘুরে বেড়াই।
আম্মা ওকে নিয়ে সুন্দর সুন্দর দোকানের পাশ দিয়ে হাঁটতে লাগলেন। একটা খুব বড় দোকান দেখে ওর পিঠে হাত দিয়ে ভেতরে নিয়ে গেলেন। সুন্দর সুন্দর খেলনা, কাপড়, জামা সাজিয়ে রাখা হয়েছে শো-কেসের ভেতর। বড় বড় এরকম খেলনার দোকানে ঘুরে বেড়াতে ওর খুব লাল লাগে। চট্টগ্রাম থাকার সময় একটা দোকানে একটা হাতি দেখেছিল, চাবি দেয়া, থপ থপ করে হেঁটে যেত। সে ভারি মজার ব্যাপার।
আম্মা একটা শার্ট দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, দীপু, তোমার এই শার্টটা ভাল লাগে?
খুব সুন্দর শার্ট, ভাল না লাগার কোনো কারণ নেই।
দীপু মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করল, কেন?
তোমাকে কেমন সুন্দর মানাবে, বলো দেখি।
না–
কী?
আমি এত সুন্দর আর এত দামি শার্ট পরতে পারব না।
আম্মা মুহূর্তে ফ্যাকাসে হয়ে গেলেন। আস্তে আস্তে বললেন, তুমি আমাকে ঘেন্না কর দীপু? তাই আমার থেকে কিছু নিতে চাইছ না?
দীপু ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে ওর আম্মার হাত ধরে ফেলল। ব্যস্ত হয়ে বলল, না, না না ছি! আমি ঘেন্না করব কেন? তারপর বলতে গিয়েও বলতে পারল না, মানুষ কি তার মাকে ঘেন্না করতে পারে কখনও?
তা হলে আমার থেকে কিছু নিতে চাইছ না কেন?
কে বলল নিতে চাই না? আমি শুধু জামাকাপড়ের কথা বলছি, এত সুন্দর আর দামি কাপড় কখনও পরতে পারব না। আমার লজ্জা লাগে পরতে।
লজ্জা লাগে!
দীপু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, আমার স্কুলের সব ছেলে, পাড়ার সব ছেলে আমার মত, আমি তার মাঝে এরকম ফুলওয়ালা সুন্দর শার্ট পরতে পারব না। বোকা বোকা লাগবে।
আম্মা খানিকক্ষণ অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, আর দীপু আরও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। থতমত খেয়ে বলল, আমি যদি আমেরিকা থাকতাম রুমীদের মতো, তা হলে এরকম সুন্দর কাপড় পরতে হতো, এ ছাড়া আমাকে তো প্লেনেই উঠতে দেবে না। কিন্তু এখন সত্যি আমার দরকার নেই–
আম্মা আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে ওর পিঠে হাত দিয়ে ওকে বের করে আনলেন।
ওরা দু’জন স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে হাঁটতে লাগল, আর আম্মা ওকে হাজার রকম প্রশ্ন করতে লাগলেন। কোন স্কুলে পড়ে, পরীক্ষায় কী হয়, সবচেয়ে ভাল পারে কোনটা, সবচেয়ে খারাপ লাগে কী পড়তে, কতজন বন্ধু আছে তার, তারা কী করে, ছুটির দিনে কী করে সময় কাটায়, এইসব।
কথা বলতে বলতে আর হাঁটতে হাঁটতে আম্মা ওকে নিয়ে এলেন একটা ভারি সুন্দর হোটেলে। ভেতরে ঢুকেই বুঝতে পারল চাইনীজ হোটেল, ও খালি নাম শুনেছে, কখনও যায়নি ভেতরে, অন্ধকার অন্ধকার, আর চোখে সয়ে গেলে দেখা যায় কী সুন্দর চারদিকে! তার মাঝে খুব হালকা বাজনা শোনা যাচ্ছে, কী ভাল লাগে শুনতে! চারিদেকে টেবিলে লোকজন বসে আছে খুব সুন্দর জামাকাপড় পরে আর কথা বলছে খুব আস্তে আস্তে। দীপুর এত ভাল লাগল যে বলার নয়। আম্মা ওকে নিয়ে বসলেন একটা টেবিলে। খানিকক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, দীপু, বাবা, তুমি সত্যি আমার উপর রাগ করনি?
না।
তা হলে একবারও আমাকে আম্মা বলে ডাকনি কেন?
দীপু ঠিক এই জিনিসটাই ভাবছিল, একটু লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে বলল, আমার লজ্জা লাগছে। আগে কখনও তো দেখা হয়নি, তাই–
আম্মা ওকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, মায়ের কাছে লজ্জা কী? বলো একবার, বলো
দীপু বলল, তুমি আমাকে তুমি তুমি করে বলছ কেন? আব্বার মত তুই তুই করে বললেই পার।
বেশ, বলব বাবা, বলব।
দীপু আস্তে আস্তে ডাকল, আম্মা।
আম্মা বললেন, কী?
আর দীপু হু হু করে কেঁদে উঠে আম্মাকে জড়িয়ে ধরে ভাঙা গলায় বলল, তুমি আর আব্বা ঝগড়া করলে কেন?
আম্মা কী বলবেন? শুকনো ক্লান্ত মুখে বসে রইলেন দীপুকে ধরে।
.
দীপুকে আম্মা এতসব জিনিস খাওয়ালেন যে খাওয়ার পর দীপু উঠতেই পারছিল না। আর কী মজার মজার সব খাবার, এত ভাল আইসক্রীম আগে কখনও খায়নি। শুনে আম্মার খুব দুঃখ হল। এটা এমন-কিছু ভাল আইসক্রীম নয়। এই ঢাকা শহরেই নিজে অনেক ভাল আইসক্রীম খেয়েছেন।
বের হবার সময় আম্মা ম্যানেজারের ওখান থেকে বেশ কয় জায়গায় টেলিফোন করলেন। মেম সাহেবের মতো কি টকটক করে ইংরেজি বলেন আম্মা, হাসিটা পর্যন্ত যেন ইংরেজিতে।
হোটেল থেকে বাইরে বের হতেই দীপুর চোখ ধাঁধিয়ে গেল। বাইরে কী রোদ। আম্মা খুব সুন্দর একটা কালো চশমা পরলেন, আর তাতে তাকে আরও সুন্দর দেখাতে লাগল। দীপু ছেলেমানুষের মতো ওর আম্মার হাত ধরে রাখল, যেন ছেড়ে দিলেই হাতছাড়া হয়ে যাবেন।
হঠাৎ আম্মার যেন কী মনে পড়ে গেল, অমনি ব্যস্ত হয়ে গাড়ির কাছে চলে এলেন। দীপু জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে, আম্মা?
তোর ছবি তুলব। আয়–
ছবি তোলার কথা শুনেই ওর মুখে হাসি ফুটে ওঠে, ওর বরাবরই ছবি তুলতে খুব ভাল লাগে। আম্মা জিজ্ঞেস করলেন, তোর ছবি তুলতে ভাল লাগে?
হ্যাঁ, খুব! কিন্তু একটা জিনিস—
কী?
ছবি প্রিন্ট করে আসতে এত দেরি হয় যে বিরক্তি লেগে যায়।
দীপুর কথা শুনে আম্মা মুখ টিপে হাসলেন। বললেন, সত্যি খুব বিরক্ত লেগে যায়?
হ্যাঁ। আমার দেরি সহ্য হয় না।
আম্মা একটা ক্যামেরা বের করলেন। কী অদ্ভুত ক্যামেরা, দেখে দীপু অবাক হয়ে যায়! ওরকম কেন দেখতে ক্যামেরাটা?
আম্মা উত্তর না দিয়ে বললেন, তুই ওখানে দঁাড়া গাড়িটার পাশে। দীপু দাঁড়াল। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে ওর লজ্জা লাগছিল, কিন্তু উপায় কী? আম্মা ক্যামেরায় চোখ দিয়ে বললেন, ও কী? মুখ অমন করে রেখেছিস কেন? পেট কামড়াচ্ছে নাকি?
শুনে দীপু ফাঁক করে হেসে ফেলল, সাথে সাথে আম্মা ছবি তুলে নিলেন। ক্যামেরাটা তুলে ধরে আম্মা বলেলেন, এখন একটা মজা দেখবি?
কী মজা?
আম্মা ওকে হাতের ঘড়িটা দেখিয়ে বললেন, এই সেকেন্ডের কাঁটাটা যখন এখানে আসবে, তখন দেখিস।
দীপু বোকা বনে দাঁড়িয়ে রইল। আর কী আশ্চর্য, যখন ঘড়ির কাঁটাটা ওখানে এসে গেল, তক্ষুণি ঘটাং করে ক্যামেরার ভেতর থেকে কী একটা বেরিয়ে পড়ল। আম্মা উপর থেকে একটা পাতলা কাগজ সরিয়ে নিতেই ও অবাক হয়ে দেখে, ওর রঙিন একটা ছবি। সব কয়টা দাঁত বের করে কী হাসিটাই না হাসছে! দীপু আরেকটু হলেই চিৎকার করে উঠত। কোনোমতে বলল, কীভাবে হল? কীভাবে হল এটা?
এটাকে বলে পোলারয়েড ক্যামেরা, ফটো তোলার দশ সেকেন্ডের ভেতর ছবি বেরিয়ে আসে।
সত্যি?
দেখলিই তো নিজে।
কী কান্ড!
নিবি এই ক্যামেরাটা?
দীপুর দম বন্ধ হয়ে আসতে চায় উত্তেজনায়। এইরকম একটা জিনিস আম্মা তাকে দিয়ে দিতে চাইছেন!
ছবি তুলে তোর বন্ধুদের অবাক করে দিবি। নিবি?
দীপু মাথা নেড়ে বলল, নেব।
দীপু ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে দেখে। কী হালকা! দেখতে মোটেই ক্যামেরার মতো না, অথচ এক মিনিটে রঙিন ছবি বেরিয়ে আসে।
আম্মা বললেন, এই ক্যামেরার অসুবিধে কী জানিস?
কী?
ঢাকায় এর ফিল্ম পাওয়া যায় না। আমার কাছে আর অল্প কয়টা আছে, আয় তোকে শিখিয়ে দিই কীভাবে ফিল্মে ঢোকাতে হয়। আম্মা ওকে দেখানোর জন্যে আরেকটা ফিল্ম ঢোকালেন। দীপু বলল, এবার আমি তোমার একটা ছবি তুলে দিই?
আম্মা হেসে বললেন, আমার ছবি তুলবি? তোল। দীপু ক্যামেরায় চোখ লাগাতেই আম্মা বললেন, দাঁড়া। আয়, আমি আর তুই দুজনের ছবি তুলি। কাউকে বলি তুলে দিতে।
একটা ছেলে হেঁটে যাচ্ছিল পাশ দিয়ে, দেখে মনে হয় কলেজে পড়ে। আম্মা ওকে বললেন, তুমি আমাদের দুজনের একটা ছবি তুলে দেবে?
ছেলেটা কৌতূহলী হয়ে বলল, পোলারয়েড ক্যামেরা?
আম্মা বললেন, হ্যাঁ।
আগে দেখিনি কখনও আমি, খালি নাম শুনেছি। এক্ষুণি ছবি বেরিয়ে আসবে না? কী মজা।
ছেলেটা ছবি তুলে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ছবিটি দেখার জন্যে। যখন ছবিটি বেরিয়ে এল একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেল। কী সুন্দর রঙিন ছবি! বাসায় গিয়ে নিশ্চয়ই কত গল্প করবে—দীপু বুঝতে পারে।
আম্মা ওকে গাড়িতে চড়িয়ে সারা ঢাকা ঘুরিয়ে বেড়ালেন। একটু পরে পরে এক জায়গায় থেমে আরেকটি ক্যামেরা দিয়ে ওর ছবি নিলেন। এগুলো প্রিন্ট করতে হয়। তাই আমেরিকা পৌঁছে ওকে প্রিন্ট করে পাঠাবেন। আজ একদিনে ওর যত ছবি তুললেন, দীপু সারাজীবনেও এত ছবি তোলেনি।
আম্মা ওকে নিয়ে গেলেন চিড়িয়াখানায়। হেঁটে হেঁটে বাঘ-ভালুক দেখে দেখে ও ক্লান্ত হয়ে পড়ল। আম্মা তখন ওকে নিয়ে ঘাসের উপর বসে গেলেন। একটা বাচ্চা ছেলের কাছ থেকে চিনেবাদাম কিনে নিলেন। তারপর বসে বসে দীপুকে খোসা ছাড়িয়ে দিতে লাগলেন। দীপু যেন নিজে খোসা ছাড়াতে পারে না।
দীপুর হঠাৎ মনে পড়ল ওর আম্মার আজ চলে যাবার কথা। জিজ্ঞেস করল, আম্মা তোমার প্লেন ছাড়বে কখন?
রাত আটটায়। তোমার দেরি হয়ে যাবে না?
না। তোর সাথে আবার কবে দেখা হবে–খানিকক্ষণ থেকে যাই তোর সাথে! তুই যাবি কেমন করে?
ট্রেনে করে। টিকেট কিনে এনেছি।
কখন ট্রেন?
সাড়ে পাঁচটার সময়।
এখন কয়টা বাজে?
সাড়ে তিনটা। ইশ। আর মাত্র দুই ঘন্টা। আম্মা ওর দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলেন দেখে দীপুর একেবারে কান্না পেয়ে গেল।
রাতে ঘুমাবি কেমন করে?
ট্রেনে আমি ঘুমাতে পারি। আর একরাত না ঘুমালে আমার কিছু হয় না।
আম্মা মাথা নেড়ে বললেন, জানতাম তুই এরকম হবি।
কী রকম?
শক্ত সমর্থ রেসপন্সিবল। তোর আব্বা তোর জন্মের পর সবসময় বলত, ছেলেকে এমন করে বানাব যেন সবকিছু করতে পারে। আম্মা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, রুমি আর লীরা হয়ে যাচ্ছে অন্যরকম। এখানে এসে থাকতে পারে না, শুধু বলে কবে ফিরে যাবে। আমার আর ভাল লাগে না বাইরে থাকতে
দীপুর ভারি মায়া হল ওর আম্মার জন্যে।
.
ট্রেন ছাড়ার আর মাত্র দশ মিনিট বাকি। আম্মা ওর টিকেট বদলে ওকে ফাস্ট ক্লাসের টিকেট কিনে দিয়েছেন। একটা আস্ত বাংক ওর নিজের, ওর ঘুমুতে আর অসুবিধে হবে না। আম্মা বললেন, তোর আব্বা শুনে আমার উপর রাগ করবে না। যে ফার্স্ট ক্লাসের টিকেট কিনে তোকে বাবু বানিয়ে দিচ্ছি?
না! এক দুদিন চড়লে কিছু হয় না।
হ্যাঁ। তুইই বল ট্রেনে কষ্ট করে যাবি আর তা হলে আমি শান্তি পাব? বল।
দীপু মাথা নেড়ে মেনে নিল।
বল, তুই আমাকে চিঠি লিখবি?
লিখব।
বড় বড় চিঠি লিখবি?
বড় বড় চিঠি লিখব।
আর বল তুই শরীরের যত্ন করবি?
করব।
বেশি করে দুধ খাবি?
খাব।
আর বেশি করে ফলমূল খাবি?
খাব।
আর বেশি করে পড়াশোনা করবি?
করব।
আর তুই যখন খুব বড় হবি আমি তখন সবাইকে বলব, এই যে বিখ্যাত মুহম্মদ আমিনুল আলম, এটা আমার ছেলে। ঠিক?
দীপু লজ্জা পেল।
আম্মা ওকে এত এত খাবার কিনে প্যাকেট করে দিয়েছেন। ট্রেনে পড়ার জন্যে চমৎকার সব কমিক কিনে দিয়েছেন। কমিক পড়তে ওর খুব ভাল লাগে আম্মা কেমন করে বুঝতে পারলেন?
রাতে ঘুমুতে যেন অসুবিধে না হয় সেজন্যে একটা বালিশ কিনে দিয়েছেন ফু দিয়ে ভেতরে বাতাস ভরিয়ে নেয়া যায় এরকম। একটা কম্বল কিনে দিতে চাইছিলেন, দীপু কিছুতেই কিনতে দেয়নি, এত গরম যে কম্বল মোটেই দরকার পড়বে না।
দীপু খেলতে খুব ভালবাসে শুনে ওকে একটা ফুটবল কিনে দিয়েছেন। এত দামি ফুটবল সে জীবনে দেখেনি আজ পর্যন্ত। বড় বড় লীগের খেলাতেও বোধ হয় এগুলো ব্যবহার করা হয় না।
আম্মা অনেকক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আমার ইচ্ছে করছে তোকে জোর করে ধরে নিয়ে যাই।
দীপু উত্তর না দিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করল।
বল, তোকে আমেরিকা থেকে কী পাঠাব?
কিছু পাঠাতে হবে না, শুধু তুমি মাঝে মাঝে চিঠি দিও।
কিছু পাঠাব না?
না, আমার কিছু লাগবে না।
আম্মা একটু হেসে বললেন, বুঝেছি, তোর আব্বা তোকে বুঝিয়েছে এমনি এমনি কিছু নিতে হয় না, কষ্ট করে পেতে হয়, ঠিক না?
দীপু মাথা নাড়ল।
কিন্তু আমি তো তোর আম্মা। আম্মা ছেলেদের কিছু কিনে দেবে না?
দীপু চুপ করে রইল।
ঠিক আছে, শুধু তোর জন্মদিনে তোকে উপহার পাঠাব। কী লাগবে লিখিস। আর যদি না-ও লিখিস আমি ভেবে ভেবে একটা পাঠাব। আচ্ছা?
তুমি আমার জন্ম তারিখ জান?
আম্মা শব্দ করে হেসে উঠলেন, আমি তোর মা, আর জন্মতারিখ জানব না!
দীপু লজ্জা পেয়ে গেল, সত্যিই তো!
ঠিক এ-সময় ট্রেন ছাড়ার হুইসল পড়ল। আম্মা উঠে দাঁড়ালেন, ওকে ধরে একটু আদর করলেন। ট্রেন নড়ে উঠল। আম্মা তখন ওকে ছেড়ে ট্রেন থেকে নেমে গেলেন। দীপু জানালার পাশে এসে দাঁড়াল। আম্মা বাইরে থেকে ওকে ধরে জানালার পাশে পাশে হাঁটতে লাগলেন আর বাচ্চা মেয়ের মতো কাঁদতে লাগলেন। দীপুর ইচ্ছে করছিল ওর আম্মার চোখ মুছিয়ে দেয়, কিন্তু ট্রেনের বেগ বেড়ে যাচ্ছে, আম্মা আর সাথে সাথে হাঁটতে পারছিলেন না—ওকে একবার মুখের সাথে চেপে ধরে ছেড়ে দিলেন। আম্মা দাঁড়িয়ে রইলেন আর ট্রেন ঝিকঝিক ঝিকঝিক করে ওকে দূরে সরিয়ে নিতে লাগল। ও ঝাঁপসা চোখে দেখতে পেল ওর আম্মা দাঁড়িয়ে আছেন মূর্তির মতো আর আস্তে আস্তে ছোট হয়ে যাচ্ছেন, আরও ছোট, আরও ছোট…
ভেতরে ঢুকে দীপু হু হু করে কেঁদে উঠল। সামনে এক ভদ্রমহিলা বসেছিলেন, উঠে এসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন, ছিঃ খোকা কাঁদছ কেন? আবার তোমার স্কুল যখন ছুটি হবে তোমার আম্মার সাথে দেখা হবে। এই তো সামনেই ছুটি!
দীপু ভাবল, যদি জানত, আর কোনোদিনই দীপুর সাথে ওর আম্মার দেখা হবে না!
.
প্রায় তিন মাস পার হয়ে গেছে। দীপুর তার আম্মার সাথে যখন দেখা করতে গিয়েছিল তখন জুন মাস—গরমের সময়। এখন অক্টোবর মাস, আকাশে সাদা সাদা মেঘ ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ হঠাৎ ঠাণ্ডা বাতাসে বোঝা যায় শীত আসছে।
দীপুর মা যে এখনও বেঁচে আছেন সেটি দীপু এখনও কাউকে বলেনি। অনেক চিন্তা করে দেখেছে, না বলাই ভাল। সবাইকে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে বলতে ও বিরক্ত হয়ে উঠত। শুধু তাই নয়, বুঝিয়ে দেবার সময় সবাই এমন করে ওর দিকে তাকাত যে সেটা ওর মোটেই ভাল লাগত না। দীপু আব্বার সাথে আলাপ করে দেখেছে আব্বাও বলেছেন তিনি যদি দীপুর জায়গায় হতেন তা হলে তিনিও হয়তো কাউকে বলতেন না।
দীপু কাউকেই বলেনি, কথাটি অবশ্যি পুরোপুরি সত্যি নয়। সে একজনকে বলেছে, তারিককে। তারিককে না বলে সে পারেনি, তার কারণও ছিল।
একদিন ওর তারিকের বাসায় যাবার দরকার হল। পরদিন ক্লাস নাইনের সাথে ফুটবল খেলা, তারিককে আগে থেকে বলে না দিলে ও হয়তো আসবেই না। আর তারিক যেরকম স্কুল ফাঁকি দেয়, এমনও হতে পারে যে স্কুলেই আসবে না সামনের তিন চার দিন। কিন্তু মুশকিল হল যে, দীপু তারিকের বাসা চেনে না। বেশ ক’জনকে জিজ্ঞেস করে দেখল যে কেউই চেনে না। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, কেউ বলতে পর্যন্ত পারল না ও কোন এলাকায় থাকে। সতু শুধু বলল, হতে পারে ও খালের ওপারে থাকে, কাঠের পুলের ওপর দিয়ে ও কয়দিন তারিককে বইখাতা নিয়ে আসতে দেখেছে।
বাসা খুঁজে বের করতে দীপুর কেমন জানি একটু মজা লাগে। এবারে কোনোকিছু না জেনেও সে আগে বাসা খুঁজে বের করেছে। খুঁজে বের করা যত কঠিন হয়ে ওঠে, তত মজা লাগতে থাকে। অবশ্যি একা একা একটু বিরক্তিকর হয়ে ওঠে, সাথে কেউ থাকলে খুব ভাল।
আজ ওর একাই বের হতে হল। সবই কোনে-না-কোনো কাজে ব্যস্ত। এত যে নিমর্মা বাবু, তারও নাকি আজ খালার বাসায় বাগানের সবজি নিয়ে যেতে হবে!
ধোপীর খাল অনেক দূর, তিন মাইলের কম কিছুতেই না। খালের উপরে কাঠের পুল, তার সামনে একটা ছোট দোকান। দীপু সেখানে খোঁজ নিল, ছেলেটি তারিকের নাম জানে না, কিন্তু চিনতে পারল। বলল, এদিকেই কোথায় যেন থাকে। পুলটা পার হয়ে ও আরও কয়েকটা পানের দোকানে খোঁজ নিল, তাদের মাঝে একজন তারিককে চিনতে পারল, এমনকি তারিকের আব্বার নাম পর্যন্ত বলে দিল। ওরা সুতারপাড়ায় থাকে, ওর আব্বা একজন কাঠমিস্ত্রি।
এরপরে দীপুর কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবার কথা, পাড়াটার নাম জানে, তারিকের নাম পর্যন্ত জানে। কিন্তু মজার ব্যাপার, ও কিছুতেই তবু বাসাটা খুঁজে পেল না। ছোট ছোট গলি দিয়ে ও ঘুরে বেড়াতে লাগল। ঘিঞ্জি ঘিঞ্জি পাশাপাশি বাড়ি, নোংরা নর্দমা, ছোট ছোট ছেলেমেয়ে খালি গায়ে ছোটাছুটি করছে। এর মাঝে কোনটা তারিকের বাসা কে জানে!
দীপু তখন ছোট ছোট ছেলেদের জিজ্ঞেস করতে লাগল, ওরা অনেক সময়। বেশি খবর রাখে। প্রায় দশজনকে জিজ্ঞেস করে ও প্রায় হাল ছেড়ে দিচ্ছিল, তখন একজন তারিককে চিনতে পারল। বলল, ও, কাচু ভাই? ফাগলি বাড়ির।
কাচু ভাই মানে?
তারিক তো হের স্কুলের নাম। বড়িতে হেরে কাচু ভাহে। আহ আমার লগে, ফাগলি বাড়িত থাকে।
দীপু ওর কথা ভাল বুঝতে পারছিল না, পিছে পিছে গেল তবু। ছেলেটি বাঁশের দরমার নড়বড়ে একটা বাসায় সামনে দাঁড়িয়ে বলল, এই বাড়ি। ফাগলি থাহে এই বাড়িত। ছেলেটা একগাল হেসে চলে গেল।
দীপু ডাকল, তারিক, এই তারিক।
অমনি এক ভীষণ ব্যাপার ঘটে গেল। ভেতর থেকে মেয়েলি গলার একটা ভীষণ চিৎকার শোনা গেল। তারপর হঠাৎ দরজা খুলে গেল আর ময়লা ছেঁড়া কাপড় পরা একজন পাগলি বেরিয়ে এল। লাল লম্বা চুল এলোমেলো, হাত পিছনে শক্ত করে বাঁধা, কপালে কাটা, রক্ত পড়ছে দরদর করে।
দীপু ভয় পেয়ে পিছিয়ে এল। দৌড় দেবে কি না বুঝতে পারছিল না, ঠিক এই সময়ে তারিক বেরিয়ে এল। সামনে দীপুকে দেখে মুহূর্তে ফ্যাকাশে বিবর্ণ হয়ে গেল। দুই হাতে পাগলিকে ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে গেল। ভেতরে চেঁচামেচি গালিগালাজ শোনা গেল কিছুক্ষণ, একটু পরে সব থেমে গেল, আর দরজা খুলে তারিক বের হয়ে এল। সারা মুখ থমথম করছে রাগে। দীপুর কাছে এসে রুক্ষ স্বরে জিজ্ঞেস করল, এখানে এসেছিস কেন?
দীপু উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ও কে?
তোর বাপের কি তাতে?
বল না, কে?
কেউ না।
বল না!
বললাম তো, কেউ না, পাগলি।
তোর মা?
তারিক এক মুহূর্ত ওর দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, হ্যাঁ। কেন জানি হঠাৎ তারিকের মুখ কান্না-কান্না হয়ে গেল, আস্তে আস্তে বলল, তুই এখন স্কুলে গিয়ে সবাইকে বলে দিবি আমার মা পাগলি?
শুনে দীপুর এত মন-খারাপ হল যে বলার নয়। তারিকের হাত ধরে বলল, তুই আমাকে তাই ভাবিস?
তারিক মাথা নেড়ে বলল, না।
হ্যাঁ, তুই যদি না চাস আমি তা হলে কাউকে বলব না, কোনোদিন বলব না।
খোদার কসম?
খোদার কসম।
ওরা দু’জন হেঁটে হেঁটে খালের ধারে একটা হিজল গাছের ডালে গিয়ে বসল। তারিক তখন দীপুকে ওর মায়ের কথা খুলে বলল। বছর চারেক আগে টাইফয়েড হয়ে ওর মায়ের মাথায় গোলমাল হয়েছে। দিনে দিনে অবস্থা আরও বেশি খারাপ হচ্ছে। এখন প্রায় সবসময়েই বেঁধে রাখতে হয়। ওদের পয়সা নেই বলে চিকিৎসা পর্যন্ত করাতে পারছে না, ঝাড়ফুক আর তাবিজের উপর চলছে। ওর বাবা বেশি খেয়ালও করেন না, মেজাজ খারাপ হলে মারধোর পর্যন্ত করেন। তারিকের যখন অনেক পয়সা হবে তখন সে তার মা’কে ভাল করিয়ে আনবে বিদেশ থেকে। ওর মা নাকি খুব আদর করতেন তারিককে, ওর মা ভাল হয়ে থাকলে ও কখনও গুন্ডা হয়ে যেত না।
দীপুর ভারি মন-খারাপ হয়ে গেল শুনে। সেও তখন তারিককে খুলে বলল তার নিজের মায়ের কথা, ওর যে মা থেকেও নেই। শুনে তারিকের চোখে পানি এসে গেল।
তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আবছা অন্ধকারে ওরা তখন হাত ধরে ঠিক করল দু’জন দুজনের বন্ধু হয়ে থাকবে সারাজীবন। তারিকের সাথে এর আগে কেউ এত ঘনিষ্ঠ হয়ে এত কথা বলেনি, ওর নিজের দুঃখকষ্টগুলো ভাগ করে নেয়নি। তার দীপুকে এত ভাল লেগে গেল যে বলার নয়। কৃতজ্ঞতায় ওর জন্যে একটা কিছু করতে ইচ্ছে হচ্ছিল ওর! সে আবার দীপুকে নিয়ে বাসায় ফিরে গেল। দীপুকে বাইরে দাঁড় করিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। একটু পরে কাগজে জড়ানো কী একটা নিয়ে বের হয়ে এল। দীপুর হাতে দিয়ে বলল, তুই এটা নে।
কী এটা?
খুলে দ্যাখ।
দীপু খুলে হতবাক হয়ে গেল। ছোট একটা চিতাবাঘের মূর্তি। কুচকুচে কালো পাথরের তৈরি, কী তেজি চিতা, সারা শরীর টান-টান হয়ে আছে বাঘের, মনে হচ্ছে এক্ষুনি লাফিয়ে পড়বে কারও উপর।
দীপু চিৎকার করে উঠল, ইশ, কী সুন্দর! কোথায় পেয়েছিস ওটা?
ভাল লেগেছে তোর?
লাগেনি মানে! ইশ! কী সুন্দর! আমাকে দিয়ে দিবি?
হুঁ। তুই নে এটা।
কোথায় পেয়েছিস বলবি না?
পরে বলব তোকে, আরেকদিন। তারিক রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসল।
সেদিন তিন মাইল রাস্তা হেঁটে তারিক দীপুকে বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল।