৪ সেপ্টেম্বর, শনিবার ১৯৭১
আজ দশটার সময় আকবরের মায়ের সঙ্গে পাগলাপীরের বাসায় যাব। আকবরের মা বলেছেন ওঁর কাছে যেতে হলে কিছু একটা হাতে নিয়ে যেতে হয়। কেউ খালি হাতে গেলে খুব রাগ করেন। তাই আমিরুদ্দিকে পাঠিয়েছি মিষ্টি কিনে আনতে। এই অবসরে গত কয়েকদিনের খবর কাগজে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছি। গতকাল তো জামীর ডাকে খবর কাগজ দেখতে গিয়ে রাগে-দুঃখে কেঁদেকেটে একটা কেলেঙ্কারিই বাধিয়ে ফেলেছিলাম।
প্রদেশে এতদিনে বেসামরিক গভর্নর দিয়েছে। নতুন গভর্নর ডাঃ মালিকের হাসিমুখের ছবি ছাপা হয়েছে। নতুন সামরিক আইন প্রশাসকও দেওয়া হয়েছে লেঃ জেনারেল এ. এ. কে. নিয়াজী।
একই সঙ্গে গভর্নর আর সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করে অবশেষে টিক্কা খান বিদায় নিয়েছে। গভর্নর হয়েই ডাঃ মালিক ঘোষণা করেছেন শিগগিরই মন্ত্রিসভার সদস্যদের নাম ঘোষণা করা হবে।
সামরিক বাহিনী আরো একটা জায়গায় হানা দিয়ে অনেক অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করেছে। নয়জনকে মেরেছে, একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। ঢাকা থেকে তিন মাইল দূরে নাসিরাবাদ বস্তির একটা বাড়ি থেকে ১ সেপ্টেম্বর পাক আর্মি এই অস্ত্রশস্ত্র ধরেছে।
এখানেও দেশপ্রেমিক নাগরিকদের কাছ থেকে খবর পেয়ে ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সেস-সংক্ষেপে ইপকাফের একটা দল এই অস্ত্র উদ্ধার করে এবং যাদের মারে তারা হল ভারতীয় এজেন্ট। ভাবছি কোন নয়জন মুক্তিযোদ্ধাকে ওরা মেরেছে? তাদের কেউ কি আমাদের চেনা? যাকে গ্রেপ্তার করেছে, সেও কি সেক্টর টুয়েরই কোন মুক্তিযোদ্ধা? কে জানে? জানবার কোন উপায়ই নেই।
৩১ আগস্টের দৈনিক পাকিস্তানের একটা খবরে চোখ আটকে গেল।
মরতে যখন হবেই, তখন দেশের জন্যই মরি। বিশ বছর বয়স্ক পাইলট রশীদ মিনহাজ গত ২০ আগস্ট পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একটি বিমানকে জোর করে ভারতে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াস ব্যর্থ করতে গিয়ে নিজের জীবন দিয়েছেন।
এটা আবার কি ধরনের খবর? জোর করে ভারতে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াস যিনি করেছেন তার নাম কই? কে তিনি? কি তার পরিচয়?
পরবর্তী দিনগুলোর কাগজ ঘাটতে লাগলাম। তিন সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কেবল রশীদ মিনহাজের বীরত্বগাথার কাহিনী। বীরত্বের জন্য তাকে সর্বোচ্চ সম্মানসূচক খেতাব নিশানে হায়দার দেওয়া হয়েছে, তাকে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য নির্ধারিত গোরস্থানে দাফন করা হয়েছে, তার বাপের ইন্টারভিউ নেয়া হয়েছে, তার চোদ্দগুষ্ঠির কুষ্টি-কুলুজী বর্ণনা করা হয়েছে, অথচ কে বিমান হাইজ্যাক করলেন তাঁর নাম নেই!
চার সেপ্টেম্বরে এসে নাম পেলাম। রশীদ মিনহাজের অমর বীরত্বগাথা নাম দিয়ে চার কলামজুড়ে এক নিবন্ধে রশীদের বীরত্ব, মহত্ত্ব, ত্যাগের অনেক ধানাই-পানাই করে বলা হয়েছে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এ. কে. এম. মতিয়ুর রহমান বলে আট বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এক পাইলট বিমানটা হাইজ্যাক করার চেষ্টা করেন। পরিণামে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে দুজনেই মৃত্যুবরণ করেন।
কে এই মতিয়ুর রহমান? কোন দেশী লোক? কিছুই বলে নি। বোঝাই যাচ্ছে কোন দেশপ্রেমিক বাঙালি পাইলট একটি বিমান হাইজ্যাক করে ভারতে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল। ভারতের আকাশে পৌঁছেছিল ঠিকই কিন্তু শেষ রক্ষা হয় নি। বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে এবং দুজনেই মৃত্যুবরণ করেছে। একজন সর্বোচ্চ বীরের খেতাব পেয়েছে, অন্যজনকে বলা হয়েছে বিশ্বাসঘাতক। এই খবর দৈনিক পূর্বদেশ-এ বিশ্বাসঘাতকের নাম মতিয়ুর রহমান–এই শিরোনামে ছাপা হয়েছে।
মুক্তিকামী বীর বাঙালি মতিয়ুর রহমান বিশ্বাসঘাতক? যদি কোনদিন পূর্ব বাংলার এই ভূখণ্ড স্বাধীন হয়, তবে মতিয়ুর রহমান সেই স্বাধীন দেশ নিশ্চয় তোমাকে সর্বোচ্চ বীরত্বসূচক খেতাবে ভূষিত করবে।
এলিফ্যান্ট রোডের যে অংশটা রমনা থানার সামনে দিয়ে ঘুরে আউটার সার্কুলার রোড ক্রস করে ওয়ারলেস কলোনির দিকে চলে গেছে, সেই রাস্তায় ঢুকে রেললাইন ক্রস করে একটু এগোলোই বাঁয়ে পাগলাপীর বাবার বাড়ি। আগে বোধ হয় টিন ও বেড়া ছিল, এখন সামনের দিকের দুতিনটে ঘর পাকা। সদ্য সমাপ্ত, দেখেই বোঝা যায়। চারদিকে ইট, বালি, লোহা এলোমেলো পড়ে রয়েছে। একটা ঘরে সিমেন্টের বস্তার টাল, পেছন দিকে কাজ চলছে। বাবার কাছে দোয়াপ্রার্থী নারী-পুরুষের ভিড়ে চারদিক থৈথৈ করছে।
আকবরের মা বলেছেন, বাবার খুব ক্ষমতা। দোয়া পড়ে ফুঁক দিয়ে শক্ত শক্ত অসুখ চোখের নিমেষে ভালো করে দেন। ওনার কাছে যে যা আর্জি নিয়ে আসে, তাই কবুল হয়। ক্যান্টনমেন্ট থেকে বড়ো বড়ো মেজর, কর্নেল, জেনারেল সবাই ওনার কাছে আসেন দোয়া নিতে। দেখবেন, উনি ঠিক আপনার রুমীর খবর বের করে দেবেন।
সেই আশাতেই তো এসেছি। এই একই আশা নিয়ে পাগলাপীরের কাছে এসেছেন রাজশাহীর ডি.আই.জি, মামুন মাহমুদের স্ত্রী মোশফেকা মাহমুদ, এসেছেন রাজশাহীর এস.পি. শাহ আবদুল মজিদের স্ত্রী নাজমা মজিদ, এসেছেন চট্টগ্রামের এস.পি. শামসুল হকের স্ত্রী মাহমুদা হক, এসেছেন আলতাফ মাহমুদের স্ত্রী ঝিনু মাহমুদ।
ঝিনু মাহমুদকে দেখে আমি চমকে গেছি। ছোট্টখাট্টো চেহারার সোনারবরণী এক মেয়ে, পুতুলের মতো সুন্দর –কাঁদতে কাঁদতে চোখের কোণে কালি পড়ে গেছে। এইটুকু মেয়ে, কততই বা বয়স, দেখে মনে হয় আঠারো-উনিশ। কোলে আড়াই বছরের মেয়ে শাওন। এই নবীন বয়সে ওর জীবনে এতবড় দুর্দৈব? ঝিনুর সঙ্গে পাগলা বাবার কাছে এসেছেন ঝিনুর মা, তার ছোট বোন শিমুল বিল্লাহ আর চার ভাই নুহেল, খনু, দীনু ও লীনু বিল্লাহ। শরীফ, জামী, মাসুমের কাছে এই চার ভাইয়ের কথা আগেই শুনেছি।
মোশফেকা মাহমুদকে আগে অল্পস্বল্প চিনতাম, তার মুখে শুনলাম, ২৬ মার্চ বাসায়। মিলিটারি এসে মামুন মাহমুদকে ডেকে নিয়ে যায়। সেই যে গেল মামুন, আর ফিরে আসে নি। একই কাহিনী নাজমা মজিদের, মাহমুদা হকের।
এরা কেউ এদের স্বামীর খোঁজ জানে না। আমি জানি না আমার ছেলের খোঁজ। পাগলাপীর বাবা সবাইকে আশ্বাস দিয়েছেন–এরা সবাই বেঁচেবর্তে আছে। উনি ঠিকই সকলের খোঁজ বের করে আনবেন।