৪. সেই মানুষটির উত্তাপ

সেই মানুষটির উত্তাপ

এইখানে এসে প্রথম বসেছিল মনোরঞ্জন এই জলচৌকিতে, মেঝেতে ছিল আলপনা আঁকা। জামাই আসবে বলে এই ঘরখানাই বানানো হয়েছিল নতুন, সব কিছুতেই নতুন নতুন গন্ধ।

জলচৌকিটা নেই, ঠিক সেই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছে বাসনা। ঘোর দুপুর। থান কাপড় পরা বাসনার মুখখানিতে স্বপ্ন মাখা। ঘরে এখন আর কেউ নেই, বাসনা অনেকক্ষণ ধরে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে সম্পূর্ণ চুপচাপ। কিন্তু তাকে দেবী-প্রতিমার মতো দেখাচ্ছে একথা বলা যাবে না। কারণ বাসনা সে-রকম একটা কিছু দেখতে ভাল নয়। নাকটা বোঁচার দিকেই, মুখখানা গোলগাল, আর এক ইঞ্চি লম্বা হলেই ওকে বেঁটে বলা যেত না। তবু এই বাইশ বছর বয়েসে বাসনা কোনও দিন এমন স্তব্ধ, স্থির ভাবে এতক্ষণ কোথাও দাঁড়িয়ে থাকেনি, সেই জন্য তাকে একটু অন্য রকম দেখাচ্ছে ঠিকই।

তোমার ডাকনাম বাসি, তাইনা?

মোটেইনা।

 কেন লুকোচ্ছ? বাসনার ডাকনাম বাসি হবে না তো কী? ঠিক বাসি-বাসি চেহারা।

আমার কোনও ডাক নামই নেই!

বুঝেছি। কলাগাছের বাসনা হয় জানো তো? তোমাকে নিশ্চয় বাপের বাড়ির সবাই বাস্না বলে ডাকে। নামখানা কী মানিয়েছে, একেবারে সাক্ষাৎ কলাগাছ।

আর তোমার নামখানাই কী?

আমার মতো এমন ভাল নাম হোল টুয়েন্টি ফোর পরগনাজ-এ আর কারুর আছে? খুঁজে বার করো তো আর একটা মনোরঞ্জন?

আর খাঁড়া? শুনলেই ভয় করে।

ভয় তো করবেই। আমাদের কী যে-সে বংশ?

 তোমাদের বংশের আগেকার লোকেরা ডাকাত ছিল, তাই না?

ডাকাত? আমার ঠাকুরদার বাবা ছিল কর্ণগডেব রাজার সেনাপতি। মিদনাপুরে এখনও আছে কর্ণগড। বীরের যা যোগ্য কাজ, লহ খড়গ, বধো এই বিশ্বাসঘাতকে’ পতিঘাতিনী সতী পালা দেখোনি? সেই খড়গ থেকে খাঁড়া।

হি-হি হি-হি, সেনাপতি? ঢাল-তরোয়াল কোথায়?

আমার ঠাকুরদা মিদনাপুর থেকে চলে এসেছিল এই বাদায়। অনেক জমি-জায়গা ছিল আমাদের। নদীতে সব খেয়ে গেছে।

আমরাও মেদিনীপুর থেকে এসছি।

 জানি! চুরি করে পালিয়ে এসছিলে। তাই তোমাদের পদবি সাধু।

এই, এই ভাল হবে না বলছি।

তোমার কাকাটাকে তো একদম চোরের মতো দেখতে।

এই হচ্ছে মনোরঞ্জন-বাসনার মধুযামিনীর নিভৃত সংলাপের অংশ। প্রতিটি শব্দ মনে আছে বাসনার। লোকটা খুব রাগাতে ভালবাসত। আর যাত্রাপালার কত কথা যে মুখস্থ বলতে পারত পটাপট।

বিয়ের পর মাত্র একবারই সস্ত্রীক শ্বশুর বাড়িতে এসেছিল মনোরঞ্জন। তিনটি রাত কাটিয়ে গেছে এই ঘরে। শ্বশুর-জামাই সম্পর্ক প্রথম থেকেই একটু চিড়ধরা ছিল। মনোরঞ্জনের ধারণা তাকে যথেষ্ট খাতির করা হয় না। সে বেলে মাছ খায় না জেনেও তাকে বেলে মাছের ঝোল খেতে দেওয়া হয়েছিল। বেলে, গুলে, ন্যাদোস –এই সব কাদা খাওয়া মাছ মনোরঞ্জন পছন্দ করে না। বাসনা তো জানত, সে কেন তার বাপ-মাকে বলে দেয়নি? এরা সবাই মাছের দেশের লোক, নতুন জামাইকে খাসির মাংস খাওয়াতে পারেনি এক দিন?

ব্যাপারটা হচ্ছে এই মনোরঞ্জনদের তুলনায় বাসনার বাবা-কাকার অবস্থা কিছুটা ভাল। শ্রীনাথের বারো বিঘে খাস জমি। তাছাড়া কিছু খুচরো ব্যবসাপত্তর আছে। নাজনেখালির তুলনায় মামুদপুর অনেকবর্ধিষ্ণু জায়গা। কিছু দোকানপাট আছে, দিনে দু’বার লঞ্চ আসে, তাছাড়া আসে ব্যাঙ্কের লঞ্চ। সুতরাং মনোরঞ্জনের মতো গোঁয়ারগোবিন্দ এবং গরিব পাত্রের তুলনায় আরও কিছুটা অবস্থাপন্ন ঘরের ভাল ছেলের সঙ্গে বাসনার বিয়ে হতে পারত। কিন্তু ওই যে বলে না, কপালের লেখা।

বাসনার বিয়ে দিতে হল তো খুব তাড়াহুড়ো করে। শ্রীনাথ সাধুর বরাবরের গোঁ, মেদিনীপুরের লোক ছাড়া অন্য কোনও ঘরে মেয়ে দেবে না। এদিকে ফটিক নামে এক বাঙাল ছোঁড়া বাসনার পেছনে লাগল। সে-ছোঁড়াটা একেবারে হাড় হারামজাদা। এমন ভাল মেয়ে বাসনা, তার কানে ওই ফটিক এমনই ফুসমন্তর দিয়েছিল যে তাতেই বাসনার মাথা খারাপ হয়ে গেল। ওই ফটকের সঙ্গে বাসনা রওনা দিয়েছিল হাসনাবাদের দিকে, ভাগ্যিস পথেই নিতাইচাঁদের হাতে ধরা পড়ে যায়! ন্যাজাটের লঞ্চঘাটায় নিতাইচাঁদ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এক মহাজনের সঙ্গে হিসাব-পত্তর কষছিল, হঠাৎ চোখ তুলে দেখল, লঞ্চের খোলে বসে আছে বাসনা। প্রথমে নিতাইচাঁদ নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারেনি। বোকা-বোকা লাজুক মেয়ে বাসনা, কোনও দিন একলা বাড়ির বাইরে পা দেয়নি, সে কিনা লঞ্চে! সঙ্গে কে আছে? তক্তা তুলে নিয়ে লঞ্চ তখন সবেমাত্র জেটি ছেড়েছে, নিতাইচাঁদ চেঁচিয়ে উঠেছিল, ওরে থামা, থামা! ও সারেং ভাই, লঞ্চ ভিড়োন আবার!

বাড়িতে এনে বাসনাকে আগা-পাশ-তলা পেটানো হয়েছিল, তার মুখ থেকে জানাও গিয়েছিল ফুসলাইকারির নাম। কিন্তু ফটিককে তো কিছু বলা যায় না, তা হলেই সব জানাজানি হয়ে যাবে যে! তখন সাত-তাড়াতাড়ি করে মেয়ের বিয়ে না দিলে চলে না! মেদিনীপুরের ভাল ছেলে ঠিক তক্ষুনি আর পাওয়া গেল না। শ্রীনাথের শালা ওই নাজনেখালির মনোরঞ্জনের সন্ধান আনল, আর হুট করে বিয়ে হয়ে গেল।

বাসনার মা সুপ্রভা বলেছিল, তা যাই বলল, জামাই আমার খারাপ হয়নি। চেহারা-গতর ভাল, বুদ্ধি আছে, গায়ে খেটে এক দিন উন্নতি করবে ঠিকই। শ্রীনাথ বিয়ের দিনই জামাইকে আভাস দিয়েছিল, সে যদি নাজনেখালি ছেড়ে মামুদপুরে এসে থাকতে চায়, তাহলে এখানে তার জন্য বিঘে পাঁচেক জমির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাইতেই মনোরঞ্জন চটে আগুন! সে বছরের অর্ধেক সময় অপরের জমিতে জন খাটে বটে, কিন্তু সে কিছুটা লেখাপড়া শিখেছে, যাত্রা নাটকে সে কত বীরপুরুষ আর আদর্শবান ব্যক্তির কাহিনি জানে, সে হবে ঘরজামাই?

সেই জন্যই তো মনোরঞ্জন বাসনার কাছে প্রতি কথায় একবার করে শ্বশুর বাড়িকে ঠোকে।

তুমি কলকাতা দেখেছ?

না।

 গোসাবা?

ও মা, গোসাবা দেখব না কেন? একবার ক্যানিং পর্যন্ত গেসলাম, কলকাতা যাব বলে, ও হরি, সেখানে দেখি রেলগাড়ি চলছে না, রেলগাড়ির হরতাল! ব্যাস, আর যাওয়া হল না।

সে তো অনেক দিন আগে ট্রেনের হরতাল হয়েছিল। তারপর আর যেতে পারোনি?

না যাইনি। কে নিয়ে যাবে?

 তোমার বাপ-মা একেবারে চাষাভুষো ক্লাস। মেয়েকে একবারও কলকাতা দেখিয়ে আনতে পারেনি পর্যন্ত। তোমাদের বাড়ির কেউই নিশ্চয়ই কখনও কলকাতা যায়নি?

আমার কাকা প্রত্যেক মাসে একবার কলকাতায় যায়।

চোরাই মাল বেচতে, তা জানি!

এই, আবার সেই এক কথা?

তোমার কাকার চেহারা অবিকল চোরের মতো নয়!

মোটেই নয়।

তোমার বড়দিদির যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে, সে খেয়ার নৌকো চালায় না?

বড় জামাইবাবু? উনি তো ইস্কুলের মাস্টার।

হেঃ! খলসেখালিতে ইস্কুলই নেই, তার আবার মাস্টার! আমি খলসেখালিতে যাইনি ভেবেছ?

ইস্কুল তো পাশের গ্রামে! জামাইবাবু রোজ হেঁটে যাওয়া-আসা করেন।

তাহলে তোমার জামাইবাবুর ছেলে ওখানে নৌকো চালায়।

তা চালাতে পারে। তাতে দোষের কী হয়েছে?

না, এক দিন দেখছিলাম কিনা, ছেলেটা মার খাচ্ছে। ইজারাদারের কাছে পয়সা জমা দেয়নি। চুরি করেছিল। চোরের বংশ। কালো হ্যাংলাপানা একটা ছেলে আছে না তোমার দিদির? খুব পিটুনি খেয়েছে।

সে মার খাচ্ছিল, তা-ও তুমি থামাতে যাওনি?

তখন কি জানি ওই ছেলের মাসির সঙ্গে আমার বিয়ে হবে? শুধু শুধু একটা চোরকে আমি বাঁচাতে যাব কেন?

এ কী অদ্ভুত মানুষ রে বাবা!

হ্যাঁ, আমি দস্তুর মতো অদ্ভুত। সমুখেতে দেখিতেছি অদ্ভুত এক। নিরাকার নহে, উজ্জ্বল বসনে…

এই, একটা কথা বলব?

কী?

 আমাকে একবার কলকাতায় নিয়ে যাবে?

খুব শখ না?

বলো না, নিয়ে যাবে কি না?

আচ্ছা নিয়ে যাব। তোমার বাপ তোমাকে কলকাতা দেখায়নি, আমি দেখাব। শেয়ালদায় আমার এক বন্ধু থাকে, কলকাতা আমার সব চেনা।

জামাই বলে তো আর কোঁচা দুলিয়ে, চুলে টেরি কেটে ফুলবাবুটি হয়ে বসে থাকবে না। চাষির ছেলে মনোরঞ্জনের ও-সব শখও নেই। হ্যাঁ, প্রথম বউ নিয়ে আসবার সময় সে মালকোচা মারা ধুতির ওপর নীল রঙের শার্ট পরে এসেছিল বটে, পায়ে রবারের কাবলি, কিন্তু আসা ইস্তক সে জুতো ও শার্ট খুলে রেখেছিল। মামুদপুরে ভাল বীজ ধান পাওয়া যায় সে শুনেছিল, একবার হাটখোলার দোকানগুলোয় খোঁজ নিয়ে এল। ফিরে এসে দেখল ডাব পাড়ার তোড়জোড় চলছে। এটাই তার জন্য এস্পেশাল খাতির।

শ্রীনাথ আর নিতাইচাঁদ বাড়ি ভাগাভাগি করে নিয়েছে। শ্রীনাথের পাঁচ ছেলে মেয়ের মধ্যে বাড়িতে আছে দুই ছেলে। বড়টি বিবাহিত, ছোটটির বয়স বছর চোদ্দো। শ্রীনাথ একটু দুর্বল স্বভাবের বলে নিতাইচাঁদই এখনও সর্দারি করে এ সংসারে।

দু’বাড়ি মাঝখানে ডাব গাছ, কিন্তু দু’বাড়িতে এক জনও লোক নেই ডাব পাড়ার। বাসনার ভাইটা কোনও কম্মের না। এ বাড়ির বাঁধা মুনিষ কালাচাঁদকে খবর পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু সে গেছে জমিতে। লালমোহন বলে আর এক জন আছে ডাব পাড়ায় ওস্তাদ, তাকে ডাকতে গিয়েও ফিরে এল বাসনার ভাই। লালমোহনের কোমরে ব্যথা।

ওই সব দেখেশুনে আর থাকতে পারেনি মনোরঞ্জন। এই লোকগুলো কী? বাড়িতে গাছ পুঁতেছে, আর ডাব পেড়ে দেবে অন্য লোক এসে? বাসনার কাকা নিতাইচাঁদ শুধু বাজখাই গলায় চ্যাঁচাতেই পারে। কাটারিখানা বাসনার ভাইয়ের হাত থেকে নিয়ে সে বলল, দেখি, আমি উঠছি!

বাসনার ভাই বলল, দাঁড়ান, দড়ি আনি। পায়ে দড়ি বাঁধবেন না?

মনোরঞ্জন সগর্বে উত্তর দিয়েছিল, আমার দড়ি লাগে না। এই তো বেঁটে বেঁটে গাছ এ-দিককার ।

এই নতুন ঘরের দরজার সামনে বাসনাদাঁড়িয়েছিল সেদিন। খুব গর্ব হয়েছিল তার। তার স্বামীর যেমন গায়ের জোর, তেমনি সাহস, কী সুন্দর তরতরিয়ে উঠে গেল নারকোল গাছে। যেন চোখেব নিমেষে! তারপর কোমর থেকে কাটারিখানা হাতে নিয়ে ঝকঝকে হাসি মুখে সে একবার তাকিয়েছিল বাসনারদিকে।

দরজার সামনে এসে বাসনা নির্নিমেষে তাকিয়ে থাকে নারকোল গাছটার দিকে। গাছটা ঠিক একই রকম আছে। সবই ঠিকঠাক আছে আগের মতো, শুধু এক জন নেই। অথচ ছবিটা সে স্পষ্ট দেখতে পায়।

নিচ থেকে হা-হা করে উঠেছিল নিতাইচাঁদ। অতগুলোর দরকার নেই, অতগুলো লাগবে না, গোটা চারেক।

ততক্ষণে পুরো কাঁদিটাই কেটে ফেলেছিল মনোরঞ্জন। ধপ করে সেটা পড়ল নিচে। নতুন জামাই গাছ থেকে নেমে এসে ভৎর্সনার দৃষ্টিতে তাকাল খুড় শ্বশুরের দিকে। আশ্চর্য এ-দিককার লোকজন। ডাব আর নারকোলের তফাত চেনে না? এগুলো যে পেকে ঝুনো হয়ে গেছে প্রায়, আর কত দিন গাছে থাকবে?

ডাব হলে খেত, কিন্তু নারকোলের জল বা শুধু নারকোল কোনওটাই সে খাবে না বলে খুব একটা ফাঁট দেখিয়েছিল মনোরঞ্জন। এ বাড়িতে সে সব সময় মাথা উঁচু করে থেকেছে।

আর তাস খেলা? মামুদপুরের লোকেরা বিখ্যাত তাসুড়ে, এখানে টুয়েন্টি নাইন খেলার টুর্নামেন্ট হয় পর্যন্ত। বাসনার দাদা বদ্যিনাথ তার বন্ধু বঙ্কাকে পার্টনার নিয়ে সেই টুর্নামেন্ট জিতেছিল একবার। প্রত্যেক সন্ধেবেলা বদ্যিনাথের তাস খেলা চাই-ই চাই। এই উঠোনে মাদুর পেতে হ্যারিকেন নিয়ে বসেছিল তাসের আসর। মনোরঞ্জনও এক পাশে বসে গলা বাড়িয়েছে। নতুন জামাই এসেছে বাড়িতে, তাকে খেলায় না নিলে ভাল দেখায় না। কিন্তু মনে মনে একটা অবজ্ঞার ভাব ছিল বদ্যিনাথের, ওবা জঙ্গলের জায়গার লোক, ওরা তাস খেলার কী জানে!

বদ্যিনাথ ভদ্রতা করে জিজ্ঞেস করছিল, কী হে জামাই, খেলবে নাকি এক হাত!

 মনোরঞ্জনও দিয়েছিল তেমন উত্তর।

আমরা ব্রিজ খেলি। এ-সব টোয়েন্টি নাইন তো মেয়েদের খেলা। অনেক দিন অভ্যোস নেই, আচ্ছা দেখি তবু।

তারপর তো মনোরঞ্জন বসল তাস খেলতে। রান্নাঘর থেকে আসা-যাওয়ার পথে বাসনা ফিরে ফিরে তাকিয়ে যায় স্বামীর দিকে। দেখে দেখে আশ মেটে না। এই যে পাঁচ-ছ’জন পুরুষ মানুষ বসে আছে, তার মধ্যে মনোরঞ্জনের মাথাটাই যেন এক বিঘত উঁচু, চুলের ছাঁট কত সুন্দর!

বাপ রে বাপ, এ কী ডাকাতে খেলোয়াড়। পেয়ার না পেয়েও মনোরঞ্জন তেইশ পর্যন্ত ডেকে রঙ করে। প্রথম গোলামেই তুরুপ? সেভেনথ কার্ডেরঙ করেও সে খেলা জিতে যায়? ডবল দিলেইরি ডবল দেয়। একবার খেলল সিঙ্গিল হ্যান্ড। পর পর কালো সেট খাওয়াতে লাগল অপনেন্টদের।

শেষ পর্যন্ত খেলোয়াড়দের এক জন, ছোট পাঁচু স্বীকার করল, দাদা, আপনি বললেন টোয়েন্টি নাইন খেলা অব্যেস নেই, তাতেই এই খেলা? অব্যেস থাকলে না জানি কী হত!

অবশ্য সেই খেলার আসরে একটা খুব মজার ব্যাপারও হয়েছিল।

তাস খেলায় গভীর মনোযোগ মনোরঞ্জনের, মাদূরের ওপর কী যেন সর সর করে যাচ্ছে, সেদিকে না তাকিয়ে সেখানে হাত দিয়ে চলন্ত ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা কী যেন ঠেকল। সঙ্গে সঙ্গে সে, ওরে বাপরে বলেই মারল এক লাফ। সে একখানা লাফ বটে। বঙ্কার মাথা ডিঙিয়ে পড়ল অন্য দিকে। বসে বসে কোনও মানুষকে ও-রকম ভাবে লাফাতে কেউ কখনও দেখেনি।

সাপ! সাপ!

অন্য সবাই তখন হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। হ্যাঁ, সাপ বটে, কিন্তু ওটা তো সেই ঢ্যামনাটা। ওটা বাস্তু সাপ, যখন তখন আসে। বুড়ো হয়ে গেছে বেচারা, রেলগাড়ির মতো লম্বা, অত বড় শরীরটা নিয়ে নড়াচড়া করতেই পারে না, ওকে দেখেই মনোরঞ্জনের এত ভয়!

এত হাসি হাসতে লাগল সবাই যে খেলাই ভেস্তে গেল তারপর। যাক, নতুন জামাইকে একবার অন্তত জব্দ করা গেছে। মুখে কাপড় চাপা দিয়ে বাসনাও হেসেছে।

ছোট পাঁচু বলেছিল, দাদা, বসে বসে ও-রকম আর একখানা লাফ দিয়ে দেখান ত!

রাত্রে শুয়ে শুয়ে মনোরঞ্জন বলেছিল, তোমাদের এ-দিককার লোক তো ঢ্যামনা ছাড়া আর কোনও সাপ দেখেনি, ওরা সাপের মর্ম কী বুঝবে? আমাদের অশ্বিনীকে যেবার কাটল…।

বাসনা স্বামীর বুকে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিল, তুমি রাগ কোরো না, তুমি রাগ কোরো না—

এ বাড়ির মধ্যে একমাত্র তুমি ভাল। আর সব ক’জনা কেমন যেন বেয়াড়া।

তুমি রাগ কোরো না।

এই সেই খাট। এবার ফিরে এসে ওই খাটে আর শোয়নি বাসনা। পুরুষালি উত্তাপের অভাবে ওটা এখন কী দারুণ ঠাণ্ডা!

যতবার মনোরঞ্জনের মুখখানা মনে পড়ে, ততবার বাসনার শরীরটা জ্বরের মতো ঝনঝনে গরম হয়ে যায়। মানুষটা নিজেও যেমন চনমনে, তেমনি অন্য কারুকে কখনও ঝিমিয়ে পড়তে দিত না।

ভরদুপুর, বাড়িতে বিশেষ কেউ নেই, বাসনার মা ঘুমোচ্ছ উঠোনের ও-পাশে বড় ঘরটায়। নারকোল গাছের পাতায় সর সর সর সর শব্দ হতে লাগল। জোর হাওয়া উঠেছে। কালো মেঘে থম থম করে আকাশ। আজ বোধ হয় ঝড় বৃষ্টি হবেই হবে।

খাটের একটা পায়া ধরে সেখানে মাথা ঠেকিয়ে থাকে বাসনা। এত কান্না কেঁদেছে এই কদিন, তবু ফুরোয় না, আবার চোখ ফেটে জল আসে। এত জল কোথায় জমা থাকে? যাদের চোখের জল খরচ হয় না, তাদের সেই জল কোথায় যায়? আর সবই ঠিকঠাক আছে, শুধু একটা মানুষ নেই, তাতেই পৃথিবীটা শূন্য। চোখের সামনেই তাকে দেখা যায়, তার কথাও যেন সব এখনও কানে শোনা যায়, তবু সে নেই।

এই একটা কথা বলব?

কী?

আমাকে একবার কলকাতায় নিয়ে যাবে?

খুব শখ না?

বলো না নিয়ে যাবে কিনা?

আচ্ছা নিয়ে যাব। তোমার বাপ তোমাকে কলকাতা দেখায়নি, আমি দেখাব। শেয়ালদায় আমার এক বন্ধু থাকে, কলকাতা আমার সব চেনা…!

.

এ-পক্ষ আর ও-পক্ষ

মনোরঞ্জনের মা ডলির যদি চোপার জোর থাকতে পারে, তা হলে বাসনার মা সুপ্রভারই-বা থাকবে না কেন? সেই-বা কম যায় কীসে?

বাসনাকে ফিরিয়ে আনার পর থেকেই সুপ্রভা তার স্বামী ও দেওরকে একেবারে ধুইয়ে দিচ্ছে। উঃ, এত বোকাও পুরুষ মানুষ হয়? এরা বোধহয় কাছা দিয়ে ধুতি পরতেও জানে না। জানবেই-বা কী করে, সর্বক্ষণ মোল্লাদের সঙ্গে মিশে মিশে লুঙ্গিই তো পরে। বাসনার বাপ তো চিরকালই একটা জলঢোঁড়া কিন্তু নিতাইচাঁদ নিজে কী করে এমন গোখুরির কাজটা করল? এই সময় কেউ মেয়েকে ফিরিয়ে আনে?

একে তো ভাল করে না দেখে না শুনে হুট করে কোথাকার এক জংলি ছোঁড়ার হাতে তুলে দিল মেয়েকে। সম্বৎসরের খোরাকি ধান তোলার মতো জমি যাদের নেই, সে-বাড়িতে কেউ জেনেশুনে মেয়ের বিয়ে দেয়! কেন, তাদের মেয়ে কি জলে পড়েছিল? এর চেয়ে যে বাঙাল বাড়িতে বিয়ে দেওয়া ভালো ছিল! এত জায়গা থাকতে শেষ পর্যন্ত কিনা বাদাবন থেকে জামাই আনতে হল। ওই রকম গুণ্ডার মতো চেহারা, ও বাঘের পেটে না গেলেও কোনও দিন নির্ঘাত পুলিশের গুলি খেয়ে মরত! কী-রকম ছোটলোকের বাড়ি ভেবে দেখো, ছেলে মরতে না-মরতেই ছেলের বউকে তাড়িয়ে দেয়! এ-রকম কথা কেউ সাতজন্মে শুনেছে? চশমখোর, চামার কোথাকার!

সুপ্রভার ঢ্যাঙা চেহারা, মুখে সব সময় পান ঠোঁটের পাশ দিয়ে রস গড়ায়, মেটে সিঁদূরের বিষে সিঁথির দু’পাশে অনেকখানি চুল উঠে গেছে। সুপ্রভার স্তন দুটি বেশি লম্বা ও ঝোলা। পঞ্চাশ বছর বয়স পেরিয়ে যাবার পর তার আর লজ্জা-শরমের বালাই নেই।

ঝগড়া-গালাগালি দেবাব সময় সামনে পেলে প্রতিপক্ষ না থাকলেও সুপ্রভার কোনও অসুবিধে হয় না। শ্রীনাথ আর নিতাইচাঁদ কোথাও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে। তবু সুপ্রভার গালাগালির শ্রোত চলেছে তো চলেছেই। এরই মধ্যে তার স্বামীকে মাঝে মাঝে খুঁজে এনে সে গলা চড়ায়।

ছি, ছি, ছি, ছি! পুরুষ মানুষ এমন বে-আক্কেলে হয়! হু, পুরুষ মানুষ সেই যে বলে না, গোঁফ নাইকো কোনও কালে, দাড়ি রেখেছেন তোবড়া গালে। একটা উটকপালে মাগির কাছে জব্দ হয়ে এল? যেমন দাদা তেমনি ভাই! ধরলে চিঁ চিঁ ছাড়া পেলেই সিংগি। মেয়েটার হাত ধরে জেটিঘাটে নামল, আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনা! শাঁখা-সিঁদুর পরিয়ে এই ক’মাস আগে মেয়েটাকে পাঠালাম, সেই কপাল-পোড়া মেয়েকে কেউ এমন ভাবে নিয়ে আসে? কী আক্কেল!

এ-রকম চলতেই থাকে অনবরত বাক্যের স্রোত। এক-একবার গলা খাঁকারি দিয়ে শ্রীনাথ বলবার চেষ্টা করে, আহা-হা, তখন থেকে যে বকেই যাচ্ছিস, আমরা কী করতুম তাহলে? মেয়েটাকে বাড়ির বার করে দিয়েছে, জানা নেই শোনা নেই অন্যের বাড়িতে পড়ে আছে, সেখানে ফেলে রাখা কি ভাল দেখায়? কপাল যখন পুড়েছেই— আমাদের মেয়েকে দুটো ভাত-কাপড় আমরা দিতে পারব না?

সুপ্রভা চোখ কপালে তুলে বলে, হায় আমার পোড়া কপাল! কোনঠেকায় কথা কোনঠে গেল। চত্তির মাসে বান হৈল। মেয়েকে ভাত-কাপড় দিতে পারব না, সে-কথা বলিছি? ওগো বুদ্ধির ঢেঁকি, এ-কথা বুঝলে না যে মেয়েটাকে ওরা একেবারে বেড়াল পার করে দিল? এরপর ওরা বলবে, শ্রাদ্ধ চুকবার আগেই বউ চলে গেল, ওই বউয়ের সঙ্গে আর সম্পর্ক নাই। হা-ঘরের বংশের লোক ওরা, ওরা সব পারে!

শ্রীনাথ বলল, সম্পর্ক নাই তো নাই! কে আর ওদের ঘরে মেয়েকে পাঠাচ্ছে। সে তুই যাই বলিস বোকার মা, আমার মেয়েকে আমি আর কোনও দিন ওই নাজনেখালির ছোটলোকের বাড়িতে পাঠাব না। এই একখান কথা আমি কয়ে দিলাম।

এঃ! মরদ বড় তেজি, মারবেন বনের বেজি! একখান কথা আমি কয়ে দিলাম? বলি, দু’কানে দুটো ফুল, নাকছাবি আর দু’গাছা চুড়ি যে দিয়েছিলুম, সেগুলো যাবে কোথায়? সেগুলো এনেছ, আট মাসের বিয়ে, তার জন্য আমরা ঘরের সোনা গচ্চা দেব?

এবার শ্রীনাথের সম্বিৎ ফেরে। চটাস করে গালে হাত দিয়ে সে বলে, তাই তো!

নতুন ঘরে শুয়ে থেকে মায়ের বকুনি শুনতে শুনতে এত শোক-দুঃখের মধ্যেও এই কথাটি শুনে বাসনাও চমকে ওঠে। সোনার জিনিসগুলো তো আনা হয়নি! একবার মনেও পড়েনি সেকথা!

বিজয়িনীর ভঙ্গিতে এক পাক ঘুরে গিয়ে সুপ্রভা বলল, তবে? আমাদের হকের সোনা ওর ওই শাশুড়ি মাগিটা কেন ভোগ করবে? কেন, শুনি? কেন? কেন?

তাই তো!

শুধু তাই তো বললেই কাজ হবে? হাসিও পায়, কান্নাও ধরে, এ-কথা আর বলি কারে? আর আমাদের ওই জমি?

আমাদের জমি?

সে-জমিটা আমরা এমনি এমনি মিনি মাগনা ছেড়ে দেব?

কী বলছিস তুই, আমাদের জমি কে নেবে?

আমাদের নয় তো কার? বিয়ের ট্যাকায় মনোরঞ্জন এক বিঘে সাত কাঠা তিন ছটাক জমি কেনেনি?

ওঃ হো।

ফের ওঃ হো! তোমার মাথায় ঘিলু দিয়ে গণ্ডাখানেক ঘুঁটে হবে শুধু। সে-জমি কার? ওর বাপের চোদ্দো পুরুষের? আমাদের টাকায় জমি কিনেছে মনোরঞ্জন, গোঁয়ারের মতো সে জঙ্গলে মলল, এখন ও জমি আমরা ভূতের হাতে ছেড়ে দেব? অ্যাঁ? বাপের নামে কেনেনি, মনোরঞ্জন জমি কিনেছে নিজের নামে, স্বামীর অবর্তমানে স্ত্রী পাবে সেই জমি। পাবে না? বাসনা যদি ওখেনে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকত, ওর জমি কেউ নিতে পারত? এসব ব্যবস্থা না করে তুমি মেয়েটাকে খালি হাতে নিয়ে চলে এলে?

স্ত্রীর বুদ্ধির কাছে হার মেনে শ্রীনাথ গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসল। ওপাশ থেকে নিতাইচাঁদও শুনে ভাবে, এঃ হে, বড়ই কাঁচা কাজ হইয়ে গিয়েছে তো!

এবার ও-দিকের দৃশ্য দেখা যাক।

নাজনেখালিতে বিষ্টুপদ খাঁড়ার বাড়ি একেবারে শান্ত। এদিকে কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে বলে বিষ্টুপদ মাঠে গেছে বীজতলা রুইতে। রান্নাঘরের উনুন থেকে গল গল করে বেরুচ্ছে ধোঁয়া, ভিজে কাঠের আঁচ। উঠোনে বসে থুপথুপিয়ে কাপড় কাঁচছে ডলি, দাওয়ায় বসে কবিতা সেলাই করে তার ব্লাউজ। স্বয়ং বিধাতা পুরুষও এখন হঠাৎ এসে পড়লে বুঝতে পারবেন না যে, মাত্র কয়েক দিন আগে এ বাড়ির একটি সমর্থ, বলিষ্ঠ যুবা-ছেলে বাঘের মুখে মারা গেছে।

বিধাতা পুরুষের বদলে উঠোনে এসে দাঁড়ালেন পরিমল মাস্টার। সঙ্গে সাধুচরণ। ডলি ওদের দেখেও দেখল না। আড়চোখে একবার তাকিয়ে বেশি মন দিল কাপড় কাঁচায়।

সাধুচরণ বলল, ও মাসি, মাস্টারমশাই এশ্চেন!

 তা আমি কী করব? বাড়ির লোক এখন বাড়িতে নেই।

কবিতা কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে উঠেদাঁড়িয়েছে। তার দুচোখ দিয়ে ঝরে পড়ছে অভিভূত শ্রদ্ধা। পরিমল মাস্টার তার চোখে সিনেমার নায়কের সমতুল্য। কত বড় বিদ্বান, অথচ সাধারণ চাষা-ভুষোর কাঁধে হাত দিয়ে কথা বলেন, ঠিক চাষিদের মতো মাঠে উবু হয়ে বসেন।

ডলির থুপথুপানির শব্দ বেড়ে গেছে। ভদ্রলোক শ্রেণীর প্রতি তার একটা রাগ আছে, সে তার সহজাত বুদ্ধি দিয়ে বোঝে যে, তাদের সব দুঃখ কষ্টের জন্য দায়ী শহরের লোকেরা। তাছাড়া, তার প্রথম যৌবন বয়সে এক ছোকরা স্কুলমাস্টার অনেক মিষ্টি মিষ্টি মিথ্যে কথা বলে তার সারা গায়ে হাত বুলিয়েছিল। তখন ছিল সুখ, এখন সেই স্মৃতি ডলির কাছে বিষ। সেই মাস্টার তাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও পালিয়েছিল।

কবিতা চাটাই পেতে দেবার আগে পরিমল এসে বসলেন দাওয়ার এক কোণে। তারপর বললেন, মনোরঞ্জনের মা, আপনার সঙ্গে আমার কয়েকটা কথা আছে।

ডলি কোনও উত্তর দিল না, মুখও ফেরাল না।

 বাড়ি থেকে বউটাকে তাড়িয়ে দিলেন?

 বেশ করেছি।

একেবারে ফোঁস করে উঠল ডলি। দর্পিতার মতো ঘাড় বাঁকিয়ে বলল, বাড়ি থেকে অলক্ষ্মী ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছি, এখন আমার শান্তি! ছেলে তো গেছে গেছেই। ওই ভাতারখাকিকে দুধ কলা দিয়ে পুষব কেন?

সাধুচরণ অসহিষ্ণু ভাবে বলল, ও মাসি, কী হচ্ছে? একটু চুপকরো না।

পরিমল মাস্টার হাসল।

নাটক নভেলে প্রায়ই গ্রামের আদর্শবাদী স্কুল শিক্ষকের একটা চরিত্র থাকে। তাদের পোশাক হয় পাজামা ও গেরুয়া পাঞ্জাবি, কাঁধে পথিক-ঝোলা। বড় বড় চুল। রবি ঠাকুরের ভাষায় কথা। পরিমল মাস্টারও সেই টাইপের চরিত্র হলেও এই সুমহান ঐতিহ্য তিনি রক্ষা করেনি পোশাকও কথাবার্তায়।

পরনে সেই লুঙ্গি আর একটা গেঞ্জি, পায়ে রবারের চটি। মাথার চুল পাতলা হয়ে এসেছে।

ঈষৎ কৌতুকের সুরে, যেন ডলিকে আরও খেপিয়ে তোলার জন্যই সে বলল, কাজটা আপনি ভাল করেননি।

ভাল করিছি কি মন্দ করিছি, সে আমি বুঝব। অন্য কারুর ফোঁপর-দালালি করবার দরকার নেই। যার জন্য আমার ছেলেটাই চলে গেল, সেই রাক্ষুসিকে আমি বাড়িতে রাখব?

কিন্তু এ জন্য পরে যদি আপনাকে পস্তাতে হয়?

রাগের চোটে ডলি প্রায় লাফাতে শুরু করে দিল। মাস্টারবাবুটির এই ধরনের গেরেমভারি কথা সে একেবারে সহ্য করতে পারছে না।

সাধুচরণ থামাবার চেষ্টা করতে লাগল তাকে। পরিমল মাস্টার যেন ব্যাপারটা বেশ উপভোগই করছিল।

সাধুচরণের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, বিড়ি আছে?

বিড়িটি ধরিয়ে সে বলল, মনোরঞ্জনের মা, আপনার সঙ্গে আমি ঝগড়া করতে আসিৰি। রাগ মাগ না করে মন দিয়ে শুনুন। কাগজপত্রে আপনার ছেলের বউয়ের কয়েকটা সই লাগবে। মনোরঞ্জনের নামে বারো হাজার টাকা পাওয়া যাবে।

কে কীসে সই করবে, তার আমি কী জানি?

কত টাকা বললুম, শুনতে পেয়েছেন? বারো হাজার টাকা। আপনারা পাবেন।

এক জন জাদুকর এসে জাদুর মায়া ছড়িয়েছে। ডলি, সাধুচরণ আর কবিতা নিশ্বাস বন্ধ করে, স্থির চক্ষে চেয়ে আছে জাদুকরের মুখের দিকে। নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই।

পরিমল সাধুচরণকে উদ্দেশ করে বলল, তোরা যাবার আগে ফর্ম সই করে নিয়েছিলাম, মনে আছে? আমি জানি তো তোদের ধরন। তোদের নামে গ্রুপ ইনসিওরেন্স করিয়ে রাখা আছে। একজন কেউ বাঘের পেটে গেলে তার নামে বারো হাজার টাকা পাওয়া যাবে। তুই মরলে তোর পরিবারও পেত।

মাস্টারমশাই, আপনি আগে তো বলেননি?

 কেন আগে বললে তুই ইচ্ছে করে বাঘের পেটে যেতি?

বালতির জলে খলবলিয়ে হাত ধুয়ে আঁচলে মুছতে মুছতে ডলি দৌড়ে চলে এল কাছে। বারো হাজার টাকা আমরা পাব? সে কত টাকা?

পরিমল জিজ্ঞেস করল, জমির দর এখন কত যাচ্ছে রে সাধু? বারোশো টাকা নয়? তাহলে ধরুন, এক লপ্তে দশ বিঘে ধানজমি।

ডলির চোখ দিয়ে জলের রেখা নেমে এল।

সাধুচরণ বলল, এই বুঁচি, শিগগির যা, মাঠ থেকে তোর বাবাকে ডেকে নিয়ে আয়।

কবিতা দাওয়া থেকে লাফ দিয়ে উঠোনে নেমেই ছুটল।

সেই জন্যই তো বলছিলুম বউকে তাড়িয়ে দিলেন, এখন বউয়ের সই না পেলে তো কিছু হবে না। তখন আমি অসুখে পড়েছিলাম।

কেন, বউয়ের সই লাগবে কেন?

বউ নমিনি। বউয়ের নাম লেখা আছে। আইনের চোখে বউই উত্তরাধিকারী।

চোখের জলের ফোঁটা নামতে নামতে থেমে গেল ডলির চিবুকে। এক দৃষ্টে সে চেয়ে রইল পরিমল মাস্টারের দিকে। সেই দৃষ্টিতে মিশে আছে ধিক্কার, অভিশাপ, ঘৃণা আর হতাশা। এই সবই শহরের লোকের ষড়যন্ত্র! মনোরঞ্জন তার পেট থেকে বেরোয়নি? তার নাড়িকাটা ধন নয়? তার শরীরের রক্ত জমানো বুকের দুধ খায়নি ছেলেটা? তার গু-মুত কে পরিষ্কার করেছে? নিজে না খেয়ে ডলি কত দিন তার ছেলেকে খাইয়েছে। জন্মদাতা বাপ পাবেনা, গর্ভধারিণী মা পাবেনা, পাবে একটা পরের বাড়ির আবাগি মেয়ে? আট মাসের বিয়ে করা বউ!

এই অবিচারের জন্য ডলি মনে মনে একমাত্র পরিমল মাস্টারকেই দায়ী করল।

 মাস্টারবাবু, আপনি এত বড় একটা ক্ষতি করলেন আমাদের?

এবার পরিমলের অবাক হবার পালা। সে নিজের উদ্যোগে গ্রুপ ইনসিওরেন্স করিয়ে দিয়েছিল, বারো হাজার টাকার বন্দোবস্ত হয়ে আছে, তার পরও তার নামে এই অদ্ভুত অভিযোগ।

সে বলল, ও সাধু, কী বলছেন ইনি? আর একটা বিড়ি দে। কিংবা এক প্যাকেট সিগারেট কিনেই নিয়ে আয়, এ-দিকে পাওয়া যায় না? আচ্ছা থাক, একটু পরে যাস। হ্যাঁ বলুন তো, কী ক্ষতি করলুম আমি?

টাকা আমরা পাব না, সে পাবে?

আহা, হা, সে পাবে মানে কী, আপনারা সকলেই পাবেন। বউকে ফিরিয়ে নিয়ে আসুন, সে এখানেই থাকবে আপনাদের সঙ্গে। তার সই না পেলে তো কিছুই হবে না, তারপর টাকাটা পেলে যাতে পাঁচ ভূতে লুটেপুটে না খায়, জমি-জায়গা কিনে ঠিক মতো খাটানো যায়, সে-ব্যবস্থা আমি করব।

এই সময় ছুটতে ছুটতে হাজির হল বিষ্টুচরণ। উদভ্রান্তের মতো অবস্থা। সে ভেবেছে মাস্টারমশাই বুঝি পকেট বোঝাই করে হাজার হাজার টাকা এনেছেন তাদের দেবার জন্য। বাঘের পেটে মানুষ গেলে যে কেউ টাকা দেয়, সেকথাটা বিষ্টুচরণের কিছুতেই বোধগম্য হবে না। তার মাথায় কেউ হাতুড়ি মেরে বোঝালেও না।

শুধু তো বিষ্টুচরণ নয়, তার পেছনে এল আরও অনেক লোক। মৃত মনোরঞ্জনের বাড়িতে নাকি টাকার হরির লুট হচ্ছে।

সব কিছু যে নির্ভর করছে একটা একরত্তি বিধবা মেয়ের ওপর, এই কথাটা কেউ বুঝছে, কেউ বুঝছে না, এই দু’দলে লাগিয়ে দিলে তর্ক। এরই মধ্যে নিরাপদ এক জনকে ‘গাড়োলের মতো বুদ্ধি’ বলে ফেলায় সে চটে আগুন! তখন দু’জনে হাতাহাতি লেগে যাওয়ার উপক্রম। অন্যরা ছাড়িয়ে দিল আবার।

পরিমল মাস্টার সামনে যাকে পাচ্ছে, তার কাছ থেকেই বিড়ি চাইছে একটা করে। বিড়ি টানতে টানতে এক সময় সে উদাসীন হয়ে গেল। মনোরঞ্জনের চেহারাটা খুব মনে পড়ছে তার। যেন হঠাৎ সে এক্ষুনি এখানে এসে উপস্থিত হবে!

সে বারো হাজার টাকার ব্যাপারটা বলার পর সবাই এমন উত্তেজিত, যেন মনোরঞ্জন মরে গিয়ে ভাল কাজই করেছে।

গ্রুপ ইনসিওরেন্স ব্যাপারটা চালু হয়েছে ক’বছর মাত্র। এ-দিককার লোক কেউ জানতই না। মাস্টারমশাইয়ের কল্যাণে এর আগে তারা জেনেছে জেলেদের কো-অপারিটিভের কথা, এবার আরও শুনল বাঘে মানুষ মারার খেসারত-এর আজব খবর। মনোরঞ্জনকে মেরেছে বনের বাঘ, তাহলে টাকাটা কি ওই বাঘ দিচ্ছে? বাঘ নয়, গভর্নমেন্ট? মানুষ মরলে গভর্নমেন্টের কী মাথাব্যথা? বাঘের বদলে একটা মানুষ যদি আর একটা মানুষকে মারে, তাহলে সেইমরা-মানুষটার পরিবারকে গভর্নমেন্ট টাকা দেয় না কেন? এ-সব বোঝা সত্যিই খুব শক্ত নয়?

টাকা গভর্নমেন্টও দিচ্ছে না, দিচ্ছে ইনসিওরেন্স কোম্পানি? সে আবার কোন দাতা কর্ণ?

হ্যাঁ, গভর্নমেন্টও দিচ্ছে কিছু। মানুষে মানুষ মারলে গভর্নমেন্ট কিছু দেয় না বটে, কিন্তু বাঘের অভিভাবক হিসেবে গভর্নমেন্ট কিছু দেয়। পরদিন তিনটের লঞ্চে আসা খবরের কাগজে জানা গেল সেই খবর। সুলেখক অরুণাংশু সেনগুপ্তর মর্মস্পর্শী রচনার গুণের জন্যই হোক বা যে-জন্যই হোক, বিধানসভায় সরকারপক্ষ ঘোষণা করেছেন যে, এখন থেকে সুন্দরবনের ব্যাঘ্র-নিহত মানুষের পরিবারকে তিন হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হবে। সরকার শুধু সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণের ব্যাপারেই উৎসাহী, সেখানকার মানুষদের কথা চিন্তা করেন না, এটা ঠিক নয়।

তাহলে দাঁড়াল, বারো আর তিন পনেরো। জ্যান্ত মনোরঞ্জন থুত্থুরে বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকলেও জীবনে কখনও পনেরো হাজার টাকার মুখ দেখত না।

নাজনেখালির মনোরঞ্জন বাঘের পেটে গেছে বলে তার বাড়ির লোক পনেরো হাজার টাকা পাবে, এ-কথা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার একটি মানুষেরও জানতে বাকি রইল না। দিল্লিতে ষষ্ঠ যোজনায় কত কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে, তা থেকে এ সংবাদ অনেক বেশি মূল্যবান এখানে।

গোসাবার কাছে মালোপাড়ার বিধবাপল্লীতে থান কাপড় পরা মেয়েমানুষরা এ কথা শুনে তাজ্জব। ঘরের পুরুষরা তো সবাই বাঘের পেটে গেছে, কই তারা তো এক পয়সাও পায়নি সে-জন্য?

.

একটি সংক্ষিপ্ত অথচ ঘটনাবহুল অধ্যায়

এবার আর মিনমিনে শ্রীনাথকে সঙ্গে আনা হয়নি। নিতাইচাঁদের সঙ্গে এসেছে বদ্যিনাথ, আর মাঝপথে জুটে গেছে ফটিক বাঙাল। এই ফটিককে সঙ্গে আনার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না নিতাইচাঁদের, সে এরই মধ্যে বাসনার সঙ্গে গুজ গুজ ফুসফুস শুরু করেছে। তবু টাকা-পয়সার ব্যাপার, লোকবল থাকা ভাল। বাসনার গয়না উদ্ধার করতে হবে এবং সম্ভব হলে এবারই বেচে দিয়ে যেতে হবে ওই এক বিঘে সাত কাঠা তিন ছটাক জমি।

নিতাইচাঁদ ভেবেছে যে ফটিক বাঙালের সঙ্গে বুঝি হঠাৎই দেখা হয়ে গেছে লঞ্চে, কিন্তু ফটিকের জীবনে সব কিছুই হিসেব করা। তিরিশ একত্রিশ বছর বয়েস ফটিকের, এর মধ্যে সে তিনটি বিয়ে করেছে পুরুতের সামনেই। আরও বাদ বাকি তো আছেই। দুর দূর গ্রামে সে বিয়ে করে আসে নাম ভাঁড়িয়ে, তারপর এক বছর দেড়-বছর বাদে বউ ছেড়ে পালাতে তার কোনও রকম দ্বিধা থাকে না। মেয়েরা তার কাছে মিষ্টি আখের মতো, যতক্ষণ রস ততক্ষণ সোহাগ, তারপর সারা জীবন ছিবড়ে বয়ে বেড়াবার মতো আহাম্মক সে নয়।

ছিপছিপে ফর্সা মতো চেহারা, চোখ-নাক চোখা, দৃষ্টি সর্বদাই চঞ্চল। ফটিক ছেলেটি প্রতিভাবান, নইলে এত মেয়ে পটাপট পটে কেন তাকে দেখে? কথাবার্তায় অতি তুখোড়। এত দিনের মধ্যে মাত্র একবার সে হাঁসখালি গ্রামে ধরা পড়ে মার খেয়েছিল। সেকী শুয়োর-পেটা মার! তারপর তিন মাস বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়েছিল তাকে। তবু মেয়ে ধরাই এখনও ফটিকের জীবিকা।

গত কাল দুপুরে পুকুরে স্নান করতে করতে ফটিকের মাথায় একটা ঝিলিক দিয়ে উঠেছিল হঠাৎ। বাসনা বিধবা হয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছে, এ খবর ফটিক যথাসময়ে পেয়েছে। প্রথমে সেও নিয়ে মাথা ঘামায়নি। কিন্তু পুকুরের কোমরজলে দাঁড়িয়ে তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় এবং তৃতীয় নেত্র যেন

আচমকা তাকে বলে দিল, এই মেয়েটার মধ্যে মধু আছে। ওরে ফটিক লেগে যা।

কয়েক দিন ধরে আড়ালে আড়ালে তক্কে তক্কে থেকে সব খবর সংগ্রহ করেছে ফটিক। বাসনারা যে আজ এই লঞ্চে যাবে, সে আগেই জানে। কিন্তু এক সঙ্গে এলে যদি কেউ সন্দেহ করে সেই জন্যই নিজের গ্রাম থেকে না উঠে সে পাটনাখালির কলেজ ঘাট থেকে লঞ্চ ধরেছে। ছাদে, কেবিনঘরে পিছনে ঠেস দিয়ে জবুথবু হয়ে বসে আছে বাসনা, এক পাশে তার দাদা, অন্য পাশে কাকা। ওদের দেখে কত স্বাভাবিক ভাবে চমকে উঠল ফটিক।

মেয়েদের মন কী করে জয় করতে হয়, তা জানার জন্য ফটিককে ডেল কার্নেগির বই পড়তে হয়নি। সে ঠিকই জানে যে, সদ্য বিধবা মেয়ের সঙ্গে ভাব জমাবার শ্রেষ্ঠ উপায় তার মৃত স্বামীর প্রশংসা করা। সহানুভূতি বড় চমৎকার সিঁড়ি, একেবারে ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেয়।

অ-বাঙাল মেয়ের সঙ্গে কক্ষনও বাঙাল ভাষায় কথা বলে না ফটিক। এ ব্যাপারে সে খুব সতর্ক।

ভগবানের কী বিচার! আমাদের মতো হেঁজিপেঁজি অকম্মা লোকদের নেয় না, আমরা বাঁচলেই-বা কী, মলেই-বা কী, আর নাজনেখালির মনোরঞ্জন খাঁড়া, অমন সোন্দর চেহারা, আর কী দরাজ দিল, সেই মানুষটাকে অকালে নিয়ে গেল।

এইভাবে কথা শুরু করে ফটিক। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, জীবন অনিত্য, কে কবে আছি, কবে নেই। দু’জন মাছের চালানদার এই মূল্যবান দার্শনিক তত্ত্বটিতে খুব মনোযোগের সঙ্গে সায় দেয়। এক জন মন্তব্য করে, যা বলেছেন দাদা, আমাদের বাঁচা-মরা দুই-ই সমান। বোঝা যায়, বহু দিনের নিষ্ফল অভিমান থেকে এই কথাটা বেরিয়ে আসছে।

রাজযোটক যাকে বলে? এমন বিয়ে কটা হয়? পাত্রটি যেমন ভাল, তেমন আমাদের গাঁয়ের মেয়েও রূপে-গুণে কিছুকমতি নয়, এরকম মিল সহজে দেখা যায় না। তা-ও সহ্য হল না ভগবানের?

মাথায় ঘোমটা দিয়ে কলা-বউ-এর মতো নিথর হয়ে বসে আছে বাসনা। মাঝে মাঝে ফোঁস ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে শুধু। ফটিক তাকে উদ্দেশ করে একটানা ওই ধরনের কথা বলে চলল।

ফটিকের নির্লজ্জতায় নিতাইচাঁদ প্রথমটা স্তম্ভিত হয়ে যায়। এই ছোঁড়াই বাসনাকে নিয়ে পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছিল। ইচ্ছে হয় একটা লাথি মেরে ছোঁড়াটাকে নদীতে ফেলে দিতে।

নিতাইচাঁদের দিকেই তাকিয়ে ফটিক এর পরে বলল, কাকা কেমন আছেন? কইখালির নেবারণ দাস আপনার খুব সুনাম কচ্ছিল, আপনি নাকি বিনা সুদে ওকে দুশো টাকা হাওলাত দিয়ে অসময়ে বড় বাঁচা বাঁচিয়েছেন?

নিতাইচাঁদকে বাধ্য হয়েই হাসতে হয় একটু প্রশংসা শুনে খুশি হয়ে পারা যায়? নিবারণ দাসের কাছ থেকে সুদ নেওয়া হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু কোনও জামিন ধরা হয়নি, সেই জন্য সে সুনাম করেছে?

ফটিক এরপর বদ্যিনাথের দিকে ফিরে বলল, ভূতোদা, তোমার পার্টি নাকি তাসের টুর্নামেন্ট জিতেছে? খেজুরিয়াগঞ্জে খেলতে যাবে? বড় খেলা আছে।

যাদের লোক চরিয়ে খেতে হয়, তাদের সব রকম খবরও রাখতে হয়। যে-লোকের সঙ্গে একবার পরিচয় হয়েছে, তার নাড়ি-নক্ষত্রের সন্ধান জানে ফটিক। বদ্যিনাথ একবার একটু উঠে গেলে ফটিক তার জায়গাটায় বসে, বাসনার পাশে।

গাদাগাদি ভিড়ে লঞ্চে এখন কে কোথায় বসল, তা নিয়ে কোনও কথা চলে না। ইঞ্জিনের ঘ্যাস ঘ্যাস শব্দের জন্য কেউ কথা বললে একটু দূরের লোক শুনতে পায় না। ফটিক ফিস ফিস করে বাসনাকে বলল, জীবনে এ-রকম দুঃখ এলে, সে দুঃখ অন্য কারুর সঙ্গে ভাগ করে নিতে হয়। তবেই না তা সওয়া যায়?

বাসনা ডাগর চোখ মেলে তাকাল ফটিকের দিকে। এই মানুষটির জন্য তাকে এক দিন দারুণ লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে, তবুএর ওপর সে রাগ করতে পারল না। ফটিকের মুখখানাই এমন যে, তাকালে আর রাগ থাকে না। তাছাড়া এত ঝগড়াঝাটির মধ্যে এই এক জন মাত্র লোক শুধু কত নরম করে শুধুদুঃখের কথাটাই বলল।

মনোরঞ্জনের ছবি আছে তোমার কাছে?

ছবি?

ফটো তুলে রাখোনি এক সঙ্গে? গোসাবায় তো পাঁচ টাকায় ফটো তুলে দেয়। ইস, কী নিয়ে কাটাবে সারা জীবন!

কোনও রকম স্বার্থের গন্ধ নেই ফটিকের কথার মধ্যে। একটি নীতিতে ফটিক সব সময় অটল থাকে, ধীরে বন্ধু ধীরে!

এক সময় গলা খাঁকারি দিয়ে নিতাইচাঁদ জিজ্ঞেস করল, তুমি ইদিকে কোথায় যাচ্ছ ফটিক?

আজ্ঞে কাকা, আমি যাচ্ছি নাজনেখালি, সেখানে আমার এক মাসির বাড়ি–।

তাহলে চলো আমাদের সঙ্গে বাসনার শ্বশুর বাড়িতে একটু গোলমাল কচ্ছে, তুমি আমাদের গাঁয়ের ছেলে, একটু পাশে দাঁড়াবে।

নিশ্চয়ই, ফটিক তো তাই-ই চায়। লঞ্চে সেকি হাওয়া খাওয়ার জন্য উঠেছে? তার মাসির বাড়ি সারা পৃথিবীতে ছড়ান।

বাসনার যেন কোনও ইচ্ছে-অনিচ্ছে নেই। সে কোথায় থাকবে কোথায় যাবে, তা সে নিজেই ঠিক করতে পারে না। শ্বশুর বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল, চলে এল বাপের বাড়ি, আবার বাপের বাড়ির লোকই তাকে নিয়ে চলেছে শ্বশুর বাড়ি। সেখানে গেলে যে আবার কী কুরুক্ষেত্র শুরু হবে, তা ভাবলেই বাসনার রক্ত হিম হয়ে যায়। তার একটুও যেতে ইচ্ছে করছে না। ও-বাড়ির পেছনের একটুখানি জমিতে বেগুন গাছে ফুল দেখে এসেছিল বাসনা। এখন সেখানে নিশ্চয়ই কচিকচি বেগুন ফলেছে। মনোরঞ্জন নিজে হাতে ওই বেগুনের খেত করেছিল। বাসনা সে-দিকে কী করে তাকাবে? ধানের গোলা, ঝিঙের মাচা, সব কিছুতেই মনোরঞ্জনের হাতের ছাপ।

নাজনেখালি এসে গিয়েছে বলে কিছু লোক উঠে দাঁড়াতেই তার বুকের মধ্যে দুপ দুপ করে উঠল। এই জায়গাটার নাম শুনলেই তার এ-রকম হচ্ছে কদিন ধরে। বিয়ের আগে নাজনেখালির নামই শোনেনি।

জেটিঘাটায় নামতেই বোকা নগেন দাসের সঙ্গে দেখা।

প্রত্যেক দিন এই সময় নগেন দাস এখানে দাঁড়িয়ে থাকে। সে কোনও দিন লঞ্চে উঠে কোথাও যায় না, তার কাছে কেউ আসে না, তবু এই একটা নেশা। এই লঞ্চের মানুষজনের ওঠা-নামা দেখাই তার কাছে একঝলক বাইরের পৃথিবী দেখা।

নিতাইচাঁদকে সে নিজেই ডেকে বলল, ওমশাই আবার এসেছেন? ভাল করেছেন। খবর শুনেছেন তো?

আর এক জন লোক বলল, এই তো মনোরঞ্জন খাঁড়ার বউ ফিরে এসেছে।

অন্য এক জন বলল, তাহলে আর চিন্তা নাই, বিষ্টু খাঁড়ার কপালডা ফিরা গ্যাল এবার।

ভুরু দুটো নেচে উঠল নিতাইচাঁদের। কী ব্যাপার? এরা কী বলতে চায়?

দু’পা বাড়ালেই মোচা বিষ্টুর চায়ের দোকান। সেখানে এসে চায়ের অর্ডার দিল ফটিক। একদল লোক তাদের ঘিরে দাঁড়িয়েছে। বাসনাকে বানো হল বাণী কাঠের তক্তার বেঞ্চে।

আপনে শোনেন নাই, মনোরঞ্জনের বউয়ের নামে ভারত সরকার আর বাংলা সরকার পনেরো হাজার টাকা দেবে!

সাহেবরাও আরও কিছু দিতে পারে শুনছি।

 আমেরিকা দেবে।

আমেরিকা দিলে রাশিয়াও দেবে।

দিল্লিতে নিয়ে গিয়ে ইন্দিরা গান্ধী ওর হাতে প্রাইজ দেবেনা?

একটা হাসির রোল পড়ে যায়। মনোরঞ্জন খাঁড়ার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বেশ একটা রসিকতা জমে উঠেছে। বাঘে মরলে পনেরো হাজার টাকা। তুমি জলে ডুবে মরা, কেউ তোমাকে পাত্তা দেবে না। তুমি যদি ওলাউঠোয় মরলে তো মরলে, ব্যাস, ফুরিয়ে গেল! এমনকী, তোমাকে পাগলা কুকুরে কামড়াক কিংবা জাতসাপে কাটুক, কেউ তা নিয়ে মাথা ঘামাবে না। কিন্তু বাঘে তোমার ঘাড় ভেঙে দিলেই পনেরো হাজারটি টাকা পেয়ে যাবে। গভর্নমেন্ট দেবে। চমৎকার ব্যাপার না?

নিতাইচাঁদ একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। কিছুই বুঝতে পারছে না। পনেরো হাজার টাকা কাকে বলে এরা জানে? ওই মেয়ে এত টাকা পাবে কেন!

ফটিকের বুকের মধ্যে রেলগাড়ির ইঞ্জিন চলছে। তার মন বলেছিল না, এই মেয়ের মধ্যে মধু আছে? পনেরো হাজার টাকা। দেখা যাক ওই টাকা কে পায়! তার নাম ফটিক লস্কর।

নদীর ধারের বাঁধের ওপর দিয়ে দলে দলে লোক আসছে বাসনাকে দেখবার জন্য। আজ হাটবার, এমনিতেই অনেক লোক আসতে শুরু করে এখন থেকেই।

রীতিমতো ভিড় জমে গেল বাসনাকে ঘিরে। আর সেই সঙ্গে নানা রকম গুঞ্জন। মনোরঞ্জন খাঁড়ার বিধবা বউ এখন দারুণ এক দ্রষ্টব্য ব্যাপার। এক গলা ঘোমটা টেনে ওই যে পুঁটুলিটা নিয়ে বসে আছে, তার হাতের একটা সই-এর দাম এখানকার সকলের চেয়ে বেশি।

ফটিক নিতাইচাঁদের কাঁধে হাত ছুঁইয়ে বলল, কাকা একটু শোনেন!

তারপর ভিড়ের জটলা থেকে নিতাইচাঁদকে খানিকটা দূরে টেনে নিয়ে গিয়ে দারুণ উত্তেজিত ভাবে বলল, কাকা ব্যাপারটা বোঝলেননি? আপনাগো মাইয়া এখানে আনছেন, সব টাকা তো অরা লইয়া যাবে।

নিতাইচাঁদ বলল, কার টাকা? কীসের টাকা বলো তো?

ওই যে শোনলেন না? মনোরঞ্জনরে বাঘে খাইছে, সেই জন্যই সরকার ক্ষতিপূরণ দেবে। অনেক টাকা। ক্ষতি কার, আপনাগো না?

এমন যে ধুরন্দর নিতাইচাঁদ, তারও বিষয়টা মাথায় ঢুকছেনা এখনও। ফটিক অতি দ্রুত বুঝিয়ে দিল।

তাহলে এখন উপায়?

কাকা, এই ফটিক বাঙালের পরামর্শ যদি শোনেন, তাহলে আমি কই চলেন এখনি আমরা ফিরা যাই।

ফিরে যাব?

বাসনারে একবার শ্বশুর বাড়ি লইয়া গ্যালে হ্যারা আর ছাড়বে অরে? বাসনারে দিয়া সই-সাবুদ করাইয়া সব টাকা অরা হজম কইরা দেবে না?

টাকা…ওরা নেবে?

 নেবে না? একবার বাসনার সই পাইলেই হয়!

তাহলে এখন উপায়?

চলেন, এক্ষুনি ফিরা যাই। মনোরঞ্জনের বাবা আইস্যা কইলেও আপনে বাসনারে ছাড়বেন না, কিছুতেই ছাড়বেন না। আমাগো গ্রামের মেয়ে, আমাগো গ্রামেই থাকবে।

লঞ্চ ছেড়ে গেল, এখন আমরা ফিরব কী করে?

সে-ব্যবস্থা আমার, আপনে যান বাসনার হাত ধইরা থাকেন, অগো সাথে কথা কইয়া সময় কাটান গিয়া একটু।

সত্যিই করিৎকর্মা ছেলে বটে ফটিক। হাটবার বলে অনেক নৌকো এসে লেগেছে আজ। তারই মধ্যে একটি নৌকোর মাঝির সঙ্গে সে দরাদরি করে ঠিক করে ফেলল।

তারপর ছুটে এসে বলল, কাকা, চলেন।

বদ্যিনাথ কিছু বুঝতে পারেনি। সে বলতে লাগল, কোথায়? কোথায়? মনোরঞ্জনদের বাড়ি তো এ-দিকে।

আগে একবার জয়মণিপুরে যেতে হবে, শিগগির।

ওদের দলটি আবার জেটিঘাটের দিকে ফিরে যেতেই ভিড়ের লোকজন বলল, এ কী, ওরা চলে যায় যে!

বিষ্টরা কোনও খবর পেল না।

অবাক কাণ্ড, এখনও চিতের ধোঁ উডল না, আর বউ ড্যাংডেঙিয়ে চলল বাপের বাড়ি।

আবার এলই-বা কেন, ফিরে চললই-বা কেন?

মাঝপথে খেলা ভেঙে যেতে মজাটা যেন জমল না। সদ্য বিধবা বউ, বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়িতে এসে লঞ্চঘাটে পা দিয়েই ফিরে যাচ্ছে, এ কেমন ধারা ব্যাপার! দু-চার জন চলে গেল মনোরঞ্জনের বাপ-মাকে খবর দিতে।

ফটিক নিজে বাসনার হাত ধরে তুলল নৌকোয়। নিতাইচাঁদ কেমন যেন ন্যাবড়জ্যাবড়া হয়ে গেছে। নৌকোর দড়ি খুলে মাঝিকে তাড়া দিয়ে ফটিক বলল, আরে ভাই, ছাড়েন ছাড়েন।

ভাটার সময়। তবু নাজনেখালি থেকে যত তাড়াতাড়ি দূরে চলে যাওয়া যায়, ততই মঙ্গল।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই হইহই করে এসে গেল সাধুচরণের দল। ভিড় ঠেলে এসে জেটিঘাটের ওপর দাঁড়িয়ে তর্জন-গর্জন করতে লাগল।

মাধবদা, তোমার চোখের সুমুখ দিয়ে মনোরঞ্জনের বউকে নিয়ে চলে গেল, আর তুমি কিছু বললে না?

মাধব একমনে গাঢ় নীল রঙের নাইলনের জাল ধুয়ে পরিষ্কার করছিল, সম্পূর্ণ অনুত্তেজিত দুটি চোখ তুলে সে তাকাল ওদের দিকে। ওরা আরও অনেক কথা বলে যাচ্ছে, মাধব চুপ।

তারপর হঠাৎ সে ধমক দিয়ে বলে উঠল, তা আমি কী করুম? পরের বউ লইয়া টানাটানি করুম?

তা বলে আমাদের গাঁয়ের বউকে জোর করে ধরে নিয়ে যাবে?

 যার যা ইচ্ছে করুক।

প্রথমে প্রায় লাফিয়ে পড়ল নিরাপদ, তারপর সাধুচরণ, সুশীল, বিদ্যুৎ, সুভাষ সবাই নেমে এল নৌকোর ওপরে। আশপাশের কয়েকখানা নৌকো থেকে তারা চেয়ে নিল কয়েকটা দাঁড়, সবাই ঝপাঝপ হাত চালাল এক সঙ্গে।

ফটিক, নিতাইচাঁদ পেছন দিকে তাকিয়েই ছিল, ওরা এক নজর দেখেই বুঝতে পারল একখানা নৌকো তেড়ে আসছে ওদের দিকে। ফটিক চেঁচিয়ে উঠল, হাত চালাও, ও দাদা, হাত চালাও, আমাদের যেন ধরতে না পারে।

তারপর শুরু হল নৌকো বাইচ।

কিন্তু নাজনেখালির জয়হিন্দ ক্লাবের দুর্দান্ত মেম্বারদের সঙ্গে পারবে কেন মামুদপুরের লোকেরা! নিতাইচাঁদ আর বদ্যিনাথ দু’জনেই বাবু ধরনের, তারা নৌকোর দাঁড় ধরতে জানে না।

মাধবের নৌকো একেবারে ঠাস করে লাগল নিতাইচাঁদের ভাড়া নৌকোর গায়ে। সাধুচরণ আগে থেকেই ঝুঁকে ছিল, খপ করে চেপে ধরল বাসনার হাত।

নিতাই বলল, এই, এই, আমাদের মেয়ের গায়ে হাত দেবে না।

নিরাপদ বলল, শালা, চোর, আমাদের গেরামের বউকে চুরি করে পালাচ্ছ।

 দু’দলই হাতের দাঁড়গুলো উঁচু করে তুলেছে, এই বুঝি কাজিয়া বাধে।

সাধুচরণ বাসনার হাত ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিতেই উলটে গেল নিতাইচাঁদদের নৌকোটা। বেগতিক বুঝে ঠিক সেই মুহূর্তেই ফটিক জলে ঝাঁপ দিয়েছে।

অত্যন্ত কেরামতির সঙ্গে নিজের নৌকোটা সামলে আছে মাধব। এই সব ব্যাপারটিতেই সে বিরক্ত। সে সংসারী লোক, তাকে আবার জড়িয়ে পড়তে হবে ঝঞ্ঝাটে। সে চ্যাঁচাতে লাগল, আরে বইস্যে পড়, বইস্যে পড়, হারামজাদারা, এডারেও উলটাবি!

এত বড় একখানা নদীতে কেউ কোনওদিন সাধ করে একবারও ডুব দেয় না। ঘাটের কাছেও স্নানে নামে না। এমন কামটের উৎপাত। সেই নদীর জলে এতগুলো মানুষ। বাসনার হাত ছাড়েনি সাধুচরণ, তাকে ডুবতে দেয়নি। নিতাইচাঁদকেও টেনে তুলল সুভাষ আর বিদ্যুৎ। বদ্যিনাথ কিছুক্ষণ হাবুডুবু খেল। মাঝি দু’জন অনেক কষ্টে আবার ভাসিয়ে তুলল তাদের নৌকোটাকে।

শুধু তলিয়ে গেল ফটিক, তাকে আর দেখতে পাওয়া গেল না। তবে, সত্যি সত্যিই কি আর তলিয়ে যাবে? বাঙলা দেশের ছেলে, ওরা নাকি জলের পোকা, ভুস করে আবার কোথাও মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে ঠিকই।

ধুতির কাঁছা-কোঁচা খুলে গেছে, নিতাইচাঁদের মাথা থেকে জল গড়াচ্ছে, ত্রিভঙ্গ মুরারির মতো দাঁড়িয়ে তড়পাতে লাগল, আমি থানায় যাব…জুলুমবাজি…এ কি মগের মুলুক…তোদের সব কটার কোমরে দড়ি দিয়ে জেলের ঘানি ঘুরাতে না পারি…আমার নাম নিতাইচাঁদ সাধু নয়। দিনদুপুরে ডাকাতি…মেয়েছেলের গায়ে হাত…আমি ছাড়ব না। সবকটাকে আমি…।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *