সুশাসন
কেমন করে ফসল ফলে মরুভূমিতে
২০১৫ সালে ইজরায়েলে ‘ড্রিপ ইরিগেশন’ প্রযুক্তির পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হয়। ওই বছরই টেল আভিভে কৃষিপ্রযুক্তির একটি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী হয়েছিল।
যুদ্ধটা জিতেই গেল ইজরায়েল। যাতে মানুষ মারা পড়ে, তেমন যুদ্ধ নয়। পড়শি দেশগুলোর সঙ্গে ইহুদিদের সে-যুদ্ধ আরও একশো বছর চলতে পারে। ইজ়রায়েল জিতেছে জল বাঁচানোর যুদ্ধে। অতি সামান্য জলে প্রচুর ফলন করে দেখিয়ে দিয়েছে। বিন্দু সেচ (ড্রিপ ইরিগেশন) প্রযুক্তি, যার উদ্ভাবন ও প্রয়োগে ইজরায়েল বিশ্বে পথিকৃৎ, এ বছর পড়ল ৫০ বছরে। চিন, ভারত, রাশিয়া, যে সব দেশে বড় বড় নদীর অভাব নেই, তারাই এখন চাষ শিখতে আসে এই মরুভূমির দেশে। তিন বছর অন্তর রাজধানী টেল আভিভ-এ কৃষিপ্রযুক্তির যে প্রদর্শনী (অ্যাগ্রিটেক) হয়, এ বছর এপ্রিলের শেষে (ওখানে এখনও বসন্ত) তা জমজমাট হয়ে উঠেছিল আফ্রিকা, এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকার নানা দেশের ভিড়ে। ভারতের মহারাষ্ট্র, গুজরাত, কর্নাটক থেকে চাষিরা এসেছিলেন। কনফারেন্স সেন্টারে ঘন রঙের কোট-টাইয়ের ভিড়ে গাঁধী-টুপি, পিরান-ধুতির দল যেন ছোট ছোট চলন্ত সাদা দ্বীপ।
তা দেখে ভারী তৃপ্ত ন্যাটি বরাক। আধুনিক বিন্দু সেচ প্রযুক্তি গোটা বিশ্বে বিক্রি করে তাঁর সংস্থা, ‘নেটাফিম’। এলোমেলো সাদা চুলে হাত বুলিয়ে বরাক বললেন, ‘প্রথমটা বিন্দু সেচ কাজে লাগাতেন ধনী দেশের ধনী চাষিরা। ওয়াইনের জন্য আঙুর, পেস্তা, গ্রিন হাউসে দামি সবজি, ফলের জন্য। এখন কিন্তু তা বেশি কাজে লাগছে তৃতীয় বিশ্বে, আলু, ভুট্টা, ধান, গম, কাসাভার চাষে।’ ভারতে বিন্দু সেচ বেশি হয় তুলো আর আখ চাষের ক্ষেত্রে। মহারাষ্ট্রের একটি গবেষণা বলছে, সাবেকি সেচের চাইতে বিন্দু সেচে আখের ফলন বাড়ে ২৩ শতাংশ, জল বাঁচে ৪৪ শতাংশ, বিদ্যুৎ বাঁচে প্রতি হেক্টরে ১০৫৯ কিলোওয়াট।
খেত জুড়ে জল দিলে (ফ্লাড ইরিগেশন) যত জল লাগে, বিন্দু সেচ পদ্ধতিতে লাগে তার এক-তৃতীয়াংশ, বা তারও কম। খেতের উপর জলের পাইপের ‘জাল’ এমনভাবে বিছিয়ে দেওয়া হয়, যাতে পাইপের গায়ের ফুটোয় লাগানো মুখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ে ঠিক গাছের উপর। যতটুকু জল প্রয়োজন, ঠিক ততটুকুই পড়ে, আর তা যায় একেবারে শিকড়ে।
জলের সঙ্গে মিলিয়ে দিলে সারও সেভাবেই শিকড়ে পৌঁছে যায়। জল, সার, তেল-বিদ্যুতের খরচ, মজুরি বাঁচে, উৎপাদনও বাড়ে। যে-জমিতে জলের অভাবে সেচ হয় না, বিন্দু সেচ দিলে সেই জমিও দোফসলি, তেফসলি জমি হয়ে উঠতে পারে। এ রাজ্যে অন্তত চারটে জেলা, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর এবং বীরভূমে চাষের ছবি বদলে যেতে পারে, বলছেন ক্ষুদ্র সেচ দফতরের কর্তারা।
কিন্তু কেবল এক টুকরো প্রযুক্তিকে তুলে এনে এ দেশে বসিয়ে দিলে কাজের কাজ হবে কি? ইজরায়েলের চাষবাস দেখে সেই প্রশ্নটাই বারবার খোঁচা দেয়। এ দেশে যে আবেগে মানুষ পুজো-পরবে নির্জলা উপোস করে, তেমনই নিবেদিত হয়ে ওঁরা জল বাঁচান। পঞ্চাশের দশকে এক ইহুদি নেতা কুড়ুল দিয়ে টয়লেটের ‘ফ্লাশ’ ভেঙে দিয়েছিলেন, পশ্চিমি কেতায় বিলাসী অপব্যয় ঠেকাতে। ‘যেমন দরকার তেমন, যতটুকু দরকার, ততটুকু’, এই হল ওঁদের জীবনদর্শন। যার মূল কথা, ‘মাইক্রো-ম্যানেজমেন্ট’। ষাটের দশকে ইজরায়েলের এক বাণিজ্যমন্ত্রী নাকি এক একটি কারখানার জন্য ডলারের এক এক রকম বিনিময়মূল্য চালু করেছিলেন।
চাষের ক্ষেত্রে ‘মাইক্রো’ পদ্ধতি স্পষ্টতই এসেছে ইহুদি চাষিদের জীবনযাত্রা থেকে। সেখানে চাষ চালায় প্রধানত ‘কিবুৎজ’। এ হল রুশ কমিউনের মতো। যেখানে জমি, বাড়ি, গাড়ি কোনও কিছুর মালিকানা ব্যক্তির নয়, সব কিবুৎজের। চাষি পরিবারের কেউ অন্য সূত্রে রোজগার করলে সবটা জমা পড়ে কিবুৎজে। যেমন ন্যাটি বারাকের স্ত্রী সাইকোলজিস্ট। তাঁর প্র্যাকটিস-প্রাপ্ত টাকার সবটাই যায় কিবুৎজে। সেখান থেকে যাকে যতটুকু দরকার, ততটুকু টাকা দেওয়া হয়। যিনি কিবুৎজের মার্কেটিং ম্যানেজার, আর যিনি কিবুৎজের রাস্তা ঝাঁট দেন, সবাই নিজের প্রয়োজন অনুসারে সমান হারে টাকা পান।
যেমন মানুষ, তেমনই গাছও। জমিতে বালি বেশি না কাদা, জলে খনিজ বেশি না কম, আবহাওয়া গরম না ঠান্ডা, তা দেখে ঠিক হয় প্রতি বিন্দু সেচে ঘণ্টায় ক’ফোঁটা জল পড়বে। পাইপে কত দূরত্বে ছিদ্র, তা ঠিক হবে কোন ফসল তা দেখে। ফসল ওঠার পরেও কী ভাবে সংরক্ষণ করলে সব চাইতে কম অপচয় হয়, কোন বাজারে বিক্রি করলে সব চাইতে বেশি দাম মেলে, তার খোঁজ চলে। কত কম থেকে কত বেশি পাওয়া সম্ভব, প্রতিদিন তার সাধনা চলছে। যার সাধন প্রযুক্তি। এক ফোঁটা জলের জায়গায় দু’ফোঁটা কিছুতেই দেবে না ইজরায়েল। কিন্তু দু’ফোঁটার কাজ কী করে আধফোঁটায় করা যায়, তা বার করতে অকাতরে টাকা খরচ করবে রিসার্চে। গোটা টেল আভিভের সমস্ত ব্যবহৃত জল, মায় পয়ঃপ্রণালীর জলও পরিস্রুত করে ফের ব্যবহার করা হয়। তার ৮০ শতাংশ পান চাষিরা।
১৯৯৯ থেকে ২০০৯, এই এক দশকে ইজরায়েলে চাষিরা জলের ব্যবহার ১২ শতাংশ কমিয়েছেন, ফলন বাড়িয়েছেন ২৬ শতাংশ। সেই সঙ্গে ‘লেবার’-এর প্রয়োজনও কমেছে। চাষির সংখ্যা সাড়ে ২৩ হাজার থেকে কমে এখন ১৭ হাজার। জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশ চাষ করে, তাতেই গোটা দেশের খাবারের চাহিদার ৯৫ শতাংশ মিটে যায়, আবার ফল, সবজি, রফতানিও হয় ইউরোপের নানা দেশে।
এ যে গল্পের গোরু নয়, মালুম হল সত্যি গোরু দেখে। টেল আভিভ থেকে মিনিট চল্লিশের দূরত্বে এক ডেয়ারি ফার্মে দুগ্ধবতী গাভী, বাছুর নিয়ে দু’হাজার প্রাণী। দেখাশোনা করেন ২০ জন। দিনে এক একটা গোরু দুধ দেয় ৭২ কিলোগ্রাম অবধি, গড়ে ৪১ কিলোগ্রাম। গোরু-পিছু দুধ উৎপাদনে বিশ্বে সেরা ইজরায়েল। দুধ (মেশিনে) দোওয়ার পর তা পাইপে যাওয়ার আগে একটি যন্ত্র বিশ্লেষণ করে বলে দেয়, কতটা ল্যাকটোজ, ফ্যাট, প্রোটিন, ইউরিয়া আছে তাতে। সংক্রমণের ফলে দুধে রক্ত এলে আপনিই বন্ধ হয়ে যাবে দোওয়ার যন্ত্র। বারোশো গাভীর প্রতিটির সামনের ডান পায়ে লাগানো ‘মনিটর’ থেকে অন্তত ১০০টি ডেটা নিরন্তর বলে দিচ্ছে, কোন গোরু কেমন আছে, কার কী চিকিৎসা, পরিচর্যা দরকার। কাছে গিয়ে দাঁড়ালেই আহ্লাদি ভঙ্গিতে ভিজে নাক বাড়িয়ে দেয় সাদা-কালো ইজরায়েলি হলস্টেইন। নাকে হাত রেখে মনে হয়, কেন ভারতে এমন হয় না?
সমস্যাটা ঠিক প্রযুক্তির নয়। কৃষি গবেষণা, প্রযুক্তিতে ভারত কম যায় না, তার প্রমাণ সবুজ বিপ্লব। তফাত মনে হয় এখানেই যে, ও দেশে ল্যাবরেটরির কাজ থেকে চাষির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা না-পড়া পর্যন্ত ‘চাষ’ নামক কাজটি চলতে থাকে। আর এখানে বিজ্ঞানী চাকরি করেন, ফড়ে ব্যবসা করেন, চাষ করেন কেবল চাষি। চাষির ক্ষতি হলেও ব্যবসায়ীর লাভ, আর বিজ্ঞানীরা ফসলের বাজারদর জানেনই না। চাষ করে লাভ হল কি না, সে-প্রশ্নে ও দেশে সবাই তটস্থ। এ দেশে লাভ-ক্ষতি চাষির ভাগ্যের ব্যাপার।
চাষিও তা-ই বিশ্বাস করেন। তাই লাভ অনিশ্চিত জেনেও আড়াই-তিন বিঘে জমি চাষ করেন তিনি, তবু সমবায় তৈরি করে অনেকের জমি একসঙ্গে চাষ করে খরচ কমিয়ে লাভ বাড়ানোর চেষ্টা করেন না। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির কোনওটাই ছোট চাষির জন্য নয়, জেনেও জোট বাঁধতে পারেন না। স্বনির্ভর হওয়ার চাইতে সরকার-নির্ভর হওয়া তাঁদের নিরাপদ মনে হয়।
সরকারও তাই চায়। এ দেশে চাষি আর বাজারের মাঝখানে সরকার। কম সুদে ঋণ, ভর্তুকিতে (কিংবা বিনামূল্যে) জল, বিদ্যুৎ, সার। শেষ অবধি ন্যূনতম মূল্যে খরিদ। ও দেশে চাষির সামনে বাজার, পিছনে সরকার। ইজরায়েলের চাষি জল, বিদ্যুৎ সব কেনেন বাজারদরে। ভর্তুকির কোনও ধারণাই চালু নেই। কৃষিমন্ত্রী ইয়ায়ের শমির বললেন, ‘প্রাইভেট সেক্টর যাতে সারা বিশ্বে বাজার ধরতে পারে, তার জন্য সহায়তা করে সরকার।’ এ দেশে সরকার প্রতিযোগিতা থেকে আড়াল করে চাষিকে, ও দেশে প্রতিযোগিতায় জেতাতে চাষিকে পিছন থেকে ঠেলে সরকার। এমনকী ক্রেতার স্বার্থেও চাষিকে দাম কমাতে বলে না ইজ়রায়েল। ইজ়রায়েলে উৎপন্ন ফসলের দাম সে দেশের চাইতে জার্মানিতে বেশ খানিকটা কম কেন, ক’দিন আগে তা নিয়ে খানিক বিক্ষোভও হয়ে গিয়েছে টেল আভিভে। দাম অবশ্য কমেনি।
কৃষি না শিল্প, আমাদের এই নিয়ে বিতর্ক। ইজরায়েলে প্রশ্নটাই অর্থহীন। লাভজনক কৃষি আসলে শিল্পই। দুটোর উৎপাদন, বিপণন হতে হবে এক নীতিতে। এ কথাটা হজম না করে কেবল মেশিন, প্রযুক্তি আনলে জল হয়তো একটু বাঁচবে, চাষি বাঁচবে না।
স্বাতী ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৪ মে ২০১৫
আত্মঘাতী চাষির খোঁজে
২০১৫ সালের জুলাই-অগস্ট মাসে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ১৩ লক্ষ হেক্টর কৃষিজমি।
শেষ শ্রাবণের বর্ধমান। চাষিকে পথে বসিয়ে এখন রূপ দেখাচ্ছে বেহায়া আকাশ। ফাঁপানো মেঘ, গিল্টি-করা রোদ, ফিচেল বৃষ্টি। উপরমহলে যখন এমন নির্লজ্জ উৎসব, নীচে তখন ঢিবি-ভাঙা পিঁপড়ের মতো চাষিদের ছোটাছুটি। পুরুষ মেয়েরা মাথায় করে, ভ্যানরিকশা করে ধানের চারার বান্ডিল বয়ে এনে ফের পুঁতছেন জমিতে। পলিথিনের নীচে আবার তৈরি করছেন সবজির চারা। বাড়তি খরচ, বাড়তি পরিশ্রমেও অনেক দেরিতে, অনেক কম পরিমাণ ফসল মিলবে। তবু মাথায়-পিঠে বৃষ্টি নিয়ে চারদিকে বাঁচার মরিয়া চেষ্টা। তার মাঝে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করতে হল, চাষি মরে কেন?
উত্তরের খোঁজ শুরু করা চলে হরগোবিন্দপুরে, যেখানে সুশান্ত রুইদাসের বাড়ি। জামালপুর ব্লকের সহ-কৃষি অধিকর্তা জানালেন, সুশান্ত রুইদাস মদ খেতেন বলে ছেলেদের সঙ্গে অশান্তি লেগেই থাকত। এক দিন মা বাড়ি ছিল না, সেই সুযোগে ফুচকা-বিক্রেতা ছেলেরা বাপকে পেটায়। অভিমানে আত্মহত্যা করেন জামালপুর ব্লকের হরগোবিন্দপুরের বছর পঁয়তাল্লিশের সুশান্ত। নিজে গ্রামে গিয়ে ও স্থানীয় সূত্রে খবর পেয়ে এমনই তিনি লিখেছেন রিপোর্টে।
সুশান্তের স্ত্রী পূর্ণিমা তাঁদের ইট-গাঁথা দেওয়াল, টিনের চালের বাড়ির দাওয়ায় বসে বলছিলেন, পটল খেতে জল জমেছে দেখেই মুষড়ে পড়েছিল লোকটা। অনেক ধার হয়েছিল কিনা। কত ধার, প্রশ্ন করতেই গুটিয়ে গেলেন পূর্ণিমা। ঘিরে-থাকা প্রতিবেশীরা বলতে লাগলেন, ‘না না, ও সব ওরা কিছুই জানে না।’
যার কাছে তাঁর ধার, সেই তারক সাহানা ছিপছিপে যুবক, প্রায় ৪৭ বিঘা জমির মালিক। নিজে চাষ করেন ২০ বিঘে, বাকিটা ঠিকায় দিয়েছেন আট জন চাষিকে। তাঁদেরই এক জন সুশান্ত রুইদাস। এক মরশুম থেকে অন্য মরশুম, এক বছরের জন্য জমি নিয়েছিলেন। শীতে আলু মার খেয়েছে। বর্ষায় ১০ কাঠা জমিতে বাদাম, ১০-১৫ কাঠা জমিতে পটল বসিয়েছিলেন। বাদাম বীজ, পটলের কীটনাশক, লেবার খরচ, সবই ধারে। কেবল তারকের কাছেই ১৫ হাজার টাকার বেশি দেনা সুশান্তর, সব মিলিয়ে তার ডবল তো হবেই। টানা বৃষ্টিতে বাদামের কল বেরিয়ে গিয়েছে, অর্ধেক খেত থেকে তোলাই যায়নি। পচেছে পটল। ঠিকা চাষিদের ঢ্যাঁড়শ, লঙ্কা সব নষ্ট হয়েছে, বললেন তারক।
ভাতারের সোনা দাসও আত্মহত্যা করেছেন। তাঁর জমি ছিল বিঘে পাঁচেক, ঠিকা নিয়েছিলেন তিন বিঘে, আর ভাগে চাষ করছিলেন দু’বিঘে আট কাঠা। তাঁর পরিবারও বলছে, বোরো ধান শিলাবৃষ্টিতে নষ্ট হয়েছে, যা ধান উঠেছিল তা মাত্র ৪০০-৪৩০ টাকা বস্তা (৬০ কেজি) দরে বিক্রি করতে হয়েছিল। মহাজনের কাছে হাজার দশেক টাকা, সারের আড়তদারের কাছে সাত হাজার টাকা বাকি, জলের দাম, লেবারের টাকা বাকি, ঘরের সোনা বন্ধক দেওয়া আছে।
সরকার বলছে, সুশান্ত, সোনা, তাঁদের মতো আলু, ধান চাষিরা মারা গিয়েছেন পারিবারিক অশান্তিতে। নইলে ছ’কাঠা কি আড়াই বিঘের ফসল কতটুকু? তার উপর নির্ভর করে কে-ই বা বাঁচতে পারে, যে তার জন্য মরতে যাবে?
ভাতার, জামালপুরের গ্রামে গ্রামে কথা বলে দেখা গেল, যে-চাষির জমি নেই, বা সামান্য জমি, চাষ করতে গিয়ে তাঁর ঋণের বোঝা বড় সামান্য হয় না। ধরা যাক হরগোবিন্দপুরের কথাই। গ্রামে কেবল চার-পাঁচ ঘর আছেন, যাঁদের জমি ১০ বিঘার বেশি। শ’দুয়েক পরিবারের জমি দু’তিন বিঘে, আরও আড়াইশো পরিবার জমিহীন, খাতায়-কলমে খেতমজুর। কিন্তু সরকারি নথি, ব্যাঙ্ক-সমবায়ের খাতা, আর চাষের জমির হিসেব এক নয়। সুশান্তের মতো যাঁদের জমি নেই, বা সোনা দাসের মতো অতি সামান্য জমি, সেই খেতমজুর বা প্রান্তিক চাষি মুখের চুক্তিতে জমি ঠিকা নিয়ে চাষ করেন। মূলধন বলতে কায়িক পরিশ্রম। খরচ-মুনাফার হিসেব করতে গিয়ে যার কোনও মূল্য এঁরা ধরেন না। সরকারি খাতায় এঁরা জমির মালিকও নন, বর্গাদারও নন, ভাগচাষিও নন। ‘চাষি’ স্বীকৃতি না পাওয়ায় চাষিদের জন্য সরকারের যা কিছু সুযোগসুবিধে— সামান্য সুদে ঋণ, ভর্তুকিতে সার-বীজ, ট্র্যাক্টর বা পাওয়ার টিলারের মতো যন্ত্র কেনার অনুদান, ফসলের সরকারি সহায়ক মূল্য— কিছুই এদের জোটে না। উলটে ঋণ নিতে হয় মহাজনি সুদে, মালপত্র বাজার থেকে কিনতে হয় বেশি দামে, আর ফসল বিক্রি করতে হয় বাজারদরের কম দামে।
কত বেশিতে কেনা? কত কমে বিক্রি? ঠিকাচাষির চাষবাস নিয়ে কথা হচ্ছিল ভাতারের কালীটিকুরি গ্রামের এক চাষিবাড়ির দাওয়ায়। চাষিরা জানালেন, বোরো মরশুমে বিঘে-প্রতি ৩ হাজার টাকা, আমনে ৪ হাজার টাকা দিতে হয় জমির মালিককে। মহাজনি সুদ খাতায়-কলমে ১৬ শতাংশ, হিসেব হয় প্রধানত মালের নিরিখে। সারের আড়তদার (তথা মহাজন) ধারে সার দেয় বাজারের চাইতে বস্তায় (৫০ কেজি) ২০ টাকা বেশিতে। ধান উঠলে মাঠ থেকে কিনে নেয় বাজারদরের চাইতে বস্তায় (৬০ কেজি) ২০ টাকা কম দিয়ে। বীজের হিসেবও হয় সে ভাবেই। বাজারদরে কিনতে হয় জল, লেবার। এ ছাড়া রয়েছে বন্ধকিতে ধারের কারবার। ‘এক ভরি সোনার ২৫ হাজার টাকা বাজারদর, আপনাকে দেবে ১০ হাজার টাকা, আবার মাসে ১০ শতাংশ সুদ নেবে,’ বললেন শেখ মফিজুল হক। বন্ধকি কারবার আবার গোপনীয়। পাঁচকান হলেই আর মিলবে না ধার। অথচ ধার করে বীজ, সার, কীটনাশক, মজুরি, জল, ট্র্যাক্টর ভাড়া, সব বিনিয়োগ ঠিকাচাষির। সবই মুখচুক্তি।
কথা চলছে, আর ঘন ঘন চোখ মুছছেন বাড়ির বিধবা মালকিন। তাঁর ছেলে সবর মোল্লা মাত্র ১৮ বছর বয়সে কীটনাশক খেয়েছিল। চাষ করতে গিয়ে ৫০-৬০ হাজার টাকা ধার করে ফেলেছিল বাপ-মরা ছেলে। সুদ মেটাতে ফের ধার করে শেষে আর সামলাতে পারেনি। তখন গ্রামে অনেক রিপোর্টার এসেছিল। কে কী লিখেছে তাঁরা জানেন না, কিন্তু আজও কিষাণ ক্রেডিট কার্ড পায়নি পরিবার।
অতিরিক্ত চড়া সুদে অতিরিক্ত ধার করে ফেলে শেষে আত্মহত্যা, এই সংকটে ভুগছেন সব ধরনের চাষি। এই শ্রাবণেই আরামবাগের লক্ষ্মীকান্ত পাশাড়ি ১২ বিঘে জমির মালিক হয়েও ঋণের বোঝা (ব্যাঙ্কের কাছে ১ লক্ষ, সমবায়ের কাছে ৬০-৭০ হাজার, সার-জল-লেবারের ধার) সামলাতে না পেরে বিষ খেয়েছেন। কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রক গত জুন মাসে জানিয়েছে, গত তিন বছরে এদেশে আত্মহত্যা করেছেন ৩৩১৩ চাষি। লক্ষ করলে দেখা যাবে, বড় চাষি-ছোট চাষি, জমির মালিক-ভূমিহীন ঠিকাচাষি, তুলো-ভ্যানিলার মতো দামি ফসলের চাষি থেকে পটল-তিলের মতো সস্তার ফসলের চাষি, সব ধরনের চাষিই ঋণে সর্বস্বান্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছে। চাষি বন্যা, খরা, বাজারের ওঠা-পড়ায় মরে না। চাষি মরে ঋণে। অন্য রাজ্য অন্তত সেটা স্বীকার করে। পঞ্জাব আত্মঘাতী চাষির পরিবারকে তিন লক্ষ টাকা দেয়, অন্ধ্রপ্রদেশ দেয় দেড়-দু’লক্ষ টাকা, মহারাষ্ট্র ৫ লক্ষ টাকা বিমা পলিসি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ যে চাষির আত্মহত্যাকে পুরোপুরি অস্বীকার করে, সে কি কেবল ক্ষতিপূরণ এড়ানোর জন্য? যে-রাজ্য চোলাই মদ খেয়ে মরলেও ২ লক্ষ টাকা দেয়, ক্লাবকে দেয় ২ লক্ষ, সেখানে টাকা বাঁচানো খুব বড় কথা মনে হয় না। তবে কি ৯০ শতাংশ চাষিকে কিষাণ ক্রেডিট কার্ড পৌঁছে দেওয়ার সরকারি রূপকথা টোল খেয়ে যাওয়ার ভয়? বহু চাষিকে যে আজও মহাজনি সুদ নিতে হয়, সে-সত্য ঢাকতে চাষিমৃত্যুর ব্যাখ্যায় বাড়ির ঝগড়ার গল্প ফাঁদা?
হয়তো এই পাইকারি অস্বীকৃতি আসছে আরও গভীর কোনও ভয়, অস্বস্তি থেকে। এ রাজ্যের গ্রামে যে এক শ্রেণির চাষি তৈরি হয়েছে, যাঁরা চাষের সমস্ত ঝুঁকি বহন করেন, কিন্তু চাষিদের প্রাপ্য সরকারি নিরাপত্তার কুটোটিও পান না, সে-সত্যটা সরকারের পক্ষে অস্বস্তিকর। আজ যদি সরকার উদারতা দেখিয়ে কৃষিঋণ মকুব করে, কিংবা বিমা কোম্পানি ফসলের ক্ষতিপূরণ দিতে মাঠে নামে, তাতে ৩০-৫০ শতাংশ চাষির কানাকড়িও লাভ হবে না। চাষের শ্রমের সঙ্গে জমির স্বত্বের দূরত্ব যে বেড়ে চলেছে, এটা বাম-তৃণমূল, দু’পক্ষের কাছেই মারাত্মক। তাই শাসক বা বিরোধী, খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা ঠিকাচাষিদের কথা কেউ মুখেও আনছেন না।
এত ফাটকা কেন
চাষির দারিদ্র কী করে দূর করা যায়? বামফ্রন্ট সরকার উত্তর দিয়েছিল, চাষিকে জমির অধিকার দাও। জমির পাট্টার হাত ধরে এসেছিল আরও নানা সুযোগসুবিধে: স্বল্পহারে সুদ, ভর্তুকিতে সার-বীজ, বিনামূল্যে বা অল্পমূল্যে বিমা। কিন্তু একুশ শতকে এসে বোঝা যাচ্ছে, আবার সে এসেছে ফিরিয়া। সুদপীড়িত, হতদরিদ্র চাষির একটা শ্রেণি তৈরি হয়ে গিয়েছে, নিয়মের ফাঁদে-পড়া সরকার যাদের ছুঁতেও পারছে না।
সিপিএম-এর বর্ধমান জেলা সম্পাদক অচিন্ত্য মল্লিক মনে করেন, এই ‘ঠিকা চাষি’ (মুখের কথায় জমি ঠিকা নিয়ে, সম্পূর্ণ নিজের খরচে চাষ করেন যাঁরা) শ্রেণির উদ্ভব আট-দশ বছর আগে। ‘বামফ্রন্টের আন্দোলনের ফলে খেতমজুরদের মজুরি একটা স্থিতাবস্থায় আসে। তার পর দেখা গেল, খেতমজুররা বোরো চাষের সময় জমির একটা অংশ ঠিকা নিল।’ ক্রমশ ধান থেকে আলু, বোরো থেকে আমন, তার পর সব ধরনের চাষই করতে শুরু করল এই ঠিকাচাষিরা।
এখন এমন চাষি কত? অচিন্ত্যবাবুর মতে, বর্ধমানে জমির মালিক, যিনি নিজে বা খেতমজুর দিয়ে চাষ করান, এমন চাষি ৫০ শতাংশ। বর্গাদার ২৫ শতাংশ। ঠিকাচাষি বাকি ২৫ শতাংশ। ‘খেতমজুরদেরই এক অংশ ঠিকা নিচ্ছে,’ বললেন তিনি। তাঁর আন্দাজ মিলে গেল জেলাশাসক সৌমিত্র মোহনের সঙ্গে। জেলার কৃষি কর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জেলাশাসক বললেন, জেলায় নথিহীন বর্গাচাষি অন্তত ২৫ শতাংশ। জামালপুরের চকদিঘি সমবায় সমিতির (যার সদস্য প্রয়াত ঠিকাচাষি সুশান্ত রুইদাসের জমিমালিক তারক সাহানা) সভাপতি গৌরাঙ্গ মুখোপাধ্যায়ের আন্দাজ, ভূমিহীন খেতমজুর ঠিকাচাষি অন্তত ৩০ শতাংশ, আর প্রান্তিক চাষি যাঁরা বাড়তি জমি ঠিকা নিয়ে চাষ করছেন, এমন অন্তত ১৫-২০ শতাংশ।
হরেদরে অর্ধেক চাষি জীবিকার জন্য ঠিকার উপর নির্ভর। প্রশাসনের খাতায় যাঁরা খেতমজুর, যাঁরা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি, তাঁদের একটা বড় অংশই ঠিকাচাষি। চাষের শ্রম ও আর্থিক বিনিয়োগের অনেকটাই তাঁদের। ঠিক কতটা, সে-তথ্য কারও কাছে নেই। তবে চাষে বিনিয়োগ হয় যে-টাকা, তার অনেকটাই যে মহাজনি ঋণ, তার ইঙ্গিত মেলে। বর্ধমানের লিড ব্যাঙ্ক ইউকো ব্যাঙ্ক। কৃষিঋণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সুজিত সরকার জানালেন, খাতায় রয়েছেন পাঁচ লক্ষ চাষি। কিন্তু মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ স্রেফ ২৫ হাজার টাকা। বর্ধমান সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কেও খোঁজ নিয়ে জানা গেল, চলতি মরশুমে (এপ্রিল-জুলাই, ২০১৫) যত চাষি ঋণ নিয়েছেন, তাঁদের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ২০,৩৮৪ টাকা।
ঠিকাচাষি বর্গাদার নন। জমি চাষের আইনি অধিকার আছে বর্গাদারের, তাই বর্গা রেকর্ড দেখিয়ে তিনি ঋণ থেকে বিমা, সবই পাবেন। ঠিকাচাষির কোনও আইনি অধিকার নেই জমিতে। ভাগচাষির জমির অধিকার নেই, কিন্তু বিনিয়োগও তিনি করেন না। করেন জমির মালিক। চাষের সব কাজ দেখাশোনার জন্য ভাগচাষি নেন ফসলের অর্ধেক। ঠিকাচাষি কিন্তু চাষের জমিতে বিনিয়োগ করেন ১০০ শতাংশ। সাধারণত চড়া সুদে টাকা ধার নিয়ে। বিঘে প্রতি ৭০-৭৫ বস্তা আলু উৎপন্ন হলে, খেতমালিককে চার বস্তা দিয়ে, বাকিটা তাঁর থাকে। বাজার ভাল থাকলে সব ধার চুকিয়েও তাঁর হাতে থাকে কিছু টাকা, যেমন ছিল ২০১৪-১৫ সালের আলু মরশুমে। পরের মরশুমেই বিঘে প্রতি প্রায় ৫ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। পরপর দুটো মরশুম ক্ষতি হলেই কার্যত মারা পড়ে ঠিকাচাষি, গলায় কীটনাশক ঢালুক আর না-ই ঢালুক। তা হলে কেন চাষ করা? ‘আশায় বাঁচে চাষা’ কথাটা অনেকেই শোনালেন। যদি সারা বছরের চালটুকু মিলে যায়, যদি এবার আলুর বাজার ভাল হওয়ায় আগের ধার শোধ হয়ে যায়, হাতে কিছু টাকা আসে সেই আশায় চাষ করে চাষি।
এ এক ধরনের ফাটকা তো বটেই। প্রাণ বাজি রেখে চাষ। কিন্তু কথা হল, চাষ যাঁদের জীবিকা, তাঁদের এক-তৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেক যদি ফাটকায় নামতে বাধ্য হন, তা হলে কি চাষির চরিত্রদোষ খুঁজব? নাকি খুঁজব, কেন ফাটকা না খেললে চাষ করা যাচ্ছে না? ঠিকাচাষির জন্য তবে কী করছে রাজনীতি? কী করছে ব্যাঙ্ক, সমবায়?
করার আছে অনেক কিছুই। ভূমিহীন চাষিরা ব্যাঙ্কের অধীনে ‘জয়েন্ট লায়াবিলিটি গ্রুপ’ তৈরি করে নাবার্ডের ঋণ পেতে পারে। কিন্তু চাষের খাস জেলা বর্ধমানে তেমন গ্রুপ নেই বললেই চলে। কেন নেই? শুনে একটি সমবায় সমিতির কর্তা হাসলেন। বললেন, ‘বর্ধমান সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের কর্মীরা বসিরহাট, দমদম, বেহালার লোক। জামালপুরের ঠিকাচাষিদের গ্রুপ তৈরি করে ঋণ দেওয়া গেল কি না, তা নিয়ে কেন মাথা ঘামাবেন? তাঁরা ট্রান্সফার হওয়ার চেষ্টায় আছেন।’
বর্ধমানের সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কে গিয়ে জানা গেল, সমবায় থেকে যাঁরা কৃষিঋণ নিতে পারেন, তাঁদের মধ্যেও মৌখিক ঠিকাচাষি (‘ওরাল লেসি’) বলে একটি শ্রেণি রয়েছে। জমির মালিক শুধু যদি লিখে দেন, অমুক আমার জমি ঠিকা নিয়ে চাষ করছে, তবে ১৬ শতাংশ সুদের মহাজনি ঋণের জায়গায় ৪-৭ শতাংশ সুদে কৃষিঋণ পেতে পারে ঠিকাচাষি। কত ঠিকাচাষির কাছে তেমন নথি আছে? ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান জওহরলাল মুখোপাধ্যায় জানালেন, ২০১৪-১৫ সালে কৃষিঋণ নিয়েছেন ১ লক্ষ ৫৫ হাজার চাষি। তাঁদের মধ্যে ‘মৌখিক ঠিকাচাষি’ ১৮ হাজার ৩০৪। মানে ১২ শতাংশ।
বাস্তবে ঠিকাচাষি যখন প্রায় ৫০ শতাংশ, তখন সমবায়ের খাতায় কেন এত কম? দুটো উত্তর পাওয়া গেল। এক, পরপর তিন বছর কোনও ব্যক্তি একই জমিতে ঠিকাচাষ করছে, প্রমাণ দেখাতে পারলে সে বর্গার জন্য আবেদন করতে পারে। তাই লেখাপড়া করে ঠিকা দিতে চান না জমির মালিক। আর দুই, জমির মালিক স্বল্প সুদের লোভে নিজেই ওই জমির জন্য কিষাণ ক্রেডিট কার্ডে ঋণ নেন। স্রেফ ফিক্সড ডিপোজিট রাখলেও লাভ। শোনা গেল, ঠিকাচাষিদের মধ্যে মহাজনি কারবারও চলে ‘কেসিসি’-র টাকায়। সরকারের থেকে ৪ শতাংশ সুদে টাকা নিয়ে ঠিকাচাষিদের মধ্যে ১৬ শতাংশ হারে খাটানো হচ্ছে। চাষির জন্য ভর্তুকির এই হল গতি।
যার কেউ নেই, তার আছে রাজনীতি। সরকারি সুবিধে যাতে প্রকৃত চাষি পায়, তার জন্য নেতারা কী করছেন? সিপিএম নেতা অচিন্ত্য মল্লিক, জামালপুরের তৃণমূল নেতা তথা পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ প্রদীপ পাল, দু’জনেই বললেন, পঞ্চায়েতে বীজ, সার এলে পঞ্চায়েত সদস্য মধ্যস্থতা করে মালিকের ভাগের জিনিস কিছুটা পাইয়ে দেন ঠিকা চাষিকে। ‘একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং থাকে,’ বললেন অচিন্ত্যবাবু। সোজা কথায় যার মানে, সরকারি অনুদান আর গরিব চাষির মধ্যের জায়গাটুকু আনুগত্যের পরিসর, অধিকারের নয়।
রাজনীতি অধিকার দিতে পারলে জমির মালিক ঠিকাচাষির সঙ্গে লিখিত চুক্তি করতে বাধ্য হত। নয়তো সমবায় কর্তা, পঞ্চায়েত সদস্যরা লিখে দিতেন, সুশান্ত রুইদাস চাষি। তা দেখিয়ে ঋণ মিলত সমবায় থেকে। কিন্তু এখন সমবায়ের কর্তারাও জমির মালিক। দলের নেতারাও। তারা সুশান্তদের কেউ নয়। অচিন্ত্যবাবু বললেন, ‘ঠিকাচাষি বেশি বিপন্ন। তবে তাদের জন্য আলাদা কোনও কর্মসূচি নয়। সব চাষির জন্য এক আন্দোলন।’ সেটা কী? সরকারকে ফসলের সহায়কমূল্য বাড়াতে হবে, যাতে জমির মালিক চাষে ফের উৎসাহী হয়। তাতে ঠিকাচাষির কী সুবিধে? ‘তাকে পাট্টা পাওয়ার জন্য আন্দোলন করতে হবে।’
আরও দার্শনিক কথা বললেন ভাতারের বিধায়ক বনমালী হাজরা, ‘এই চাষিদের কী হবে, এ হল চিরন্তন প্রশ্ন। মা মাটি মানুষের সরকার এদের জন্য ভাবছে।’ কী ভাবছে? ‘কে কী চাষ করবে, সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তৈলবীজ, ভুট্টা…’ কিন্তু বিকল্প চাষ করেও বা ঠিকাচাষির সুবিধে কোথায়? গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন বনমালীবাবু। তাঁর নিজের সাতটি ধানের মরাই, তিনটি পুকুর, ৬০ বিঘে জমি, পাঁজা করে রাখা সারের বস্তা, কোথাও উত্তর মিলল না।
ঠিকাচাষিদের পাশে যে রাজনৈতিক দল নেই, তা স্পষ্ট করে দিলেন জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন। বললেন, ‘বহু দাবি নিয়ে লোকে ডেপুটেশন দিতে আসে। ‘ওরাল লেসি’-দের দাবি নিয়ে কেউ আসে না। ওঁরা সংগঠিত নন। কোনও রাজনৈতিক আন্দোলনও আছে বলে চোখে পড়ছে না।’
যে বাজার ধরতে পারে না, নেতাও ধরতে পারে না, তার মরা ছাড়া গতি কী?
স্বাতী ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১ ও ২ সেপ্টেম্বর ২০১৫
কী পাওয়ার কথা, কত দিনে, কত মঞ্জুর হল
দুর্নীতি-বিরোধী সামাজিক আন্দোলনের অন্যতম নেতা মহারাষ্ট্রের অণ্ণা হাজারে লোকপাল বিলের দাবিতে দিল্লিতে অনশনে বসেন ৫-৯ এপ্রিল, ২০১১। বহু মানুষ তাঁর আন্দোলনে সামিল হন। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে লোকপাল বিল পাশ করে সংসদ।
যে দেশে সাধারণ মানুষের ইচ্ছা নিয়ন্ত্রণ করে সরকারকে, সেই দেশ প্রজাতন্ত্র। গণতান্ত্রিক দেশে সেই ইচ্ছার প্রকাশ ও রূপায়ণ জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে দিয়ে হয়ে থাকে। ক্ষোভ দেখা দেয় যখন জনপ্রতিনিধিরা সেই ইচ্ছার মর্যাদা দেন না। যেখানে গরিব ঘুস দিতে বাধ্য হয়, নেতা-আমলারা বিপুল সম্পদ আত্মসাৎ করে, তেমন দেশকে ‘আমার দেশ’ বলে মেনে নেব কেন? সেই রাগেই লক্ষাধিক ভারতবাসী এক স্বল্প-পরিচিত, সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধের সঙ্গে অনশনে বসলেন, স্বেচ্ছায় গ্রেফতার হলেন। তাগিদ ছিল তীব্র, প্রকাশও হয়েছে জোরালো। এবার চিন্তার প্রয়োজন মানুষের মূল ইচ্ছাটি নিয়ে। দুর্নীতি দূর হোক, এই যদি হয় দেশের মানুষের চাহিদা, লোকপাল আইন পাশের দাবিই কি তা পূরণের সবচেয়ে কার্যকর উপায়?
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি উত্তরপ্রদেশের বিধায়কদের বিষয়ে নানা তথ্য সংগ্রহ করা হয়। দেখা গিয়েছিল, যাঁদের ‘রাজনীতিতে প্রবেশের পর নিজের বা পরিবারের আর্থিক অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে,’ তাঁরা প্রায় ৪০ শতাংশ। ‘রাজনীতিতে প্রবেশের পর নতুন ব্যবসা কিংবা ঠিকাদারির কাজ শুরু হয়েছে বা বেড়েছে’ ৫৪ শতাংশের ক্ষেত্রে। রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যক্তিগত লাভের জন্য ব্যবহার করেছেন অন্তত ৪২ শতাংশ। সংখ্যাগুলি খানিকটা অনুমান-ভিত্তিক, তবু এ-ও ঠিক যে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে ভারতে দুর্নীতি দ্রুত বেড়েছে। লোকপাল আইন হলে বহু সাংসদ বেকায়দায় পড়বেন। জেলের টিকিট কে-ই বা কাটতে চায়?
এই সাংসদদের খুব বেশি দোষও দেওয়া চলে না। সবাই জানে, ভোটে লড়তে যে বিপুল টাকা লাগে তার কোনও বৈধ উৎস অধিকাংশ প্রার্থীই দেখাতে পারবেন না। ভোটের আগে প্রকাশ্যে টাকা বিলি হয় বহু রাজ্যের নির্বাচনে। টাকাগুলো আসে কোথা থেকে? যে-কোনও সাংসদ ধরেই নেন, তাঁর দল আইনের বাইরে গিয়েও তাঁর জন্য টাকা তুলবে। আর নির্বাচনের জন্য যখন টাকা তুলতেই হচ্ছে, তখন যারা টাকা তুলছে তারা যে কিছু টাকা নিজের পকেটে পুরবে, তাতে কি আশ্চর্য হওয়া চলে? সাংসদ নিজে সৎ হলেও তাঁকে পার্টির তোলা টাকার উপর নির্ভর করতেই হবে। তাই কোন সাংসদ সৎ আর কে অসৎ, বিচার করে লাভ হয় না। সাংসদ নির্বাচনের যে-ব্যবস্থা বহাল, সেটাই দুর্নীতিকে অবধারিত করে তোলে।
নির্বাচনে দুর্নীতি রোধ করা যায় কী করে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বড় বড় কর্পোরেটগুলো রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনী খরচ দেয়। সেখানে সুপ্রিম কোর্ট যেমন রায় দিয়েছে, তাতে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, যে-কোনও কোম্পানি তার পছন্দের দলকে যত ইচ্ছে টাকা দিতে পারে, যদি তারা তা খোলাখুলি ঘোষণা করে দেয়। ভারতে (বা ফ্রান্স-জার্মানিতে) ব্যাপারটা গোলমেলে মনে হবে, একে পয়সা দিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো বলেই ধরে নেবেন অনেকে। কেউ হয়তো বলবেন, দল যখন টাকা নেবেই ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে, তখন লুকোছাপা না করে খোলাখুলি বলতে দোষ কী? অন্য পক্ষ আপত্তি করবেন, কে কাকে কত দিচ্ছে, সে-তথ্য এত জটিল যে তা জানিয়ে দিলেও হাসিম শেখ, রামা কৈবর্তের পক্ষে তার তাৎপর্য উদ্ধার কঠিন।
ভারতে অন্য সংস্কারের কথা ভাবা যায়। যেমন, রাষ্ট্রই নির্বাচনে প্রচারের খরচ দিক প্রতি রাজ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ চারটি (বা তিনটি বা পাঁচটি) রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের। টাকার অঙ্ক না হয় দরাজভাবেই ঠিক হোক। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো, টাকা ঢেলে টাকার অপচয় আটকাতে হবে। অবশ্যই এই প্রস্তাব নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠবে: নতুন দলগুলোর কী হবে? বিধানসভা নির্বাচনের টাকা কে দেবে? উত্তর খোঁজা দরকার। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারের খরচে স্বচ্ছতা আনতে টাকা দিতে হবে রাষ্ট্রকে, এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা জরুরি।
লোকপাল আইন নিয়ে আপত্তি একেবারে গোড়ায়। এ আইনের মূলে রয়েছে রাষ্ট্র সম্পর্কে অণ্ণা হজারের ধারণা: ‘রাষ্ট্রের প্রধান কাজ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তোলা। তাই রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের যতটা সম্ভব ভয়ে রাখা, চাপে রাখা দরকার।’ কিন্তু রাষ্ট্রকে যতই নির্মম মনে হোক, শেষ অবধি তাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোথায় সেতু তৈরি হবে, পানীয় জল পরিস্রুতির সেরা উপায় কী, শিক্ষা নীতি কী হবে। সরকারের কাজ হয়তো আরও সরল, আরও সীমিত করা যেতে পারে। কিন্তু তার পরেও বহু কাজ থেকে যাবে, যা সরকারকেই করতে হবে, এবং ভাল করে করতে হবে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়লেই যে অন্য কাজগুলো আরও ভাল ভাবে হয়ে যাবে, এমন নয়। বরং লোকপাল ভুরু কুঁচকে চেয়ে রয়েছে জানলে সরকারি কর্মীদের কম টাকায় ভাল কাজ করানোর উদ্যোগটাই চলে যাবে। সরকারি টাকা বাঁচানোর ঝুঁকি কেউ নিতে চাইবে না।
সরকারি দফতরগুলোয় বজ্র-আঁটুনি কষতে গিয়ে ফসকা-গেরো দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে তহবিলের টাকা, এমন দেখা গিয়েছে অনেক দেশে। যেমন, ইতালিতে সরকারি কর্তারা দু’ভাবে জিনিস কিনতে পারেন। এক, সরকার-নির্দিষ্ট সরবরাহ সংস্থা ‘কনসিপ’-এর থেকে। কনসিপ ঘোষিত দামে জিনিস দেবে, ঘুস দেবে না। দুই, বাজার থেকে সরাসরি দরদাম করে, সে ক্ষেত্রে ঘুস খেয়ে বরাত পাইয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ইতালি ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ বলে পরিচিত, সেখানে সরকারি কর্তারা বাজার থেকে জিনিস কিনতে আগ্রহী হবেন, এমনই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তাঁরা কনসিপ থেকেই কিনছেন, বাজারের চেয়ে দেড়গুণ বেশি দাম দিয়েও। অবশ্যই দুর্নীতির অভিযোগ থেকে গা বাঁচাতে। অকারণ ব্যয়ের ফলে ইতালি সরকারের মোট জাতীয় উৎপাদনের দুই শতাংশ নষ্ট হচ্ছে। লোকপালের কড়াকড়িতে ভারতেও এমন ঘটতে পারে।
সরকারি দফতরের উপর নজরদারি অবশ্যই দরকার। কিন্তু যে সব দেশে আমলাতন্ত্র কাজ ভাল করে, সেখানে দেখা যায় কর্মীরা নিরপেক্ষ নিয়ন্ত্রকের চেয়ে দফতরের ভিতরের নিয়ন্ত্রণের উপর নির্ভর করছেন বেশি। বাইরে থেকে কেবল দেখা যায় অমুক নিয়মটা মানা হচ্ছে না। ভিতরের লোকেরা বোঝে কে নিয়মের এদিক ওদিক করছে কাজটা আরও দ্রুত করার জন্য, আর কে তা করছে নিজের পকেট ভরার জন্য। কী করে সেচের কাজ ঠিক সময়ে হবে, পোস্ট অফিস আর একটু ভাল কাজ করবে, তার উত্তর লোকপালের কাছে নেই। বরং যে দক্ষ, সৎ লোকগুলো এ সব কাজ করতে পারতেন তাঁরা দমে যাবেন। লোকপাল কাজে লাগবে সেই রাঘববোয়ালদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে, যাঁরা আইনকে পরোয়া না করেও পার পেয়ে যান।
কেবল ঘুসখোরকে শাস্তি দিয়ে স্বচ্ছ, দক্ষ ও তৎপর প্রশাসনের দাবি পূরণ করা যাবে না। বাড়ির সামনে মরা কুকুর পচছে, পুরসভার কর্মী তুলে নিয়ে যাচ্ছেন না। শিক্ষক মাইনে পাচ্ছেন, ক্লাসে আসছেন না। এগুলোও দুর্নীতি, যা ঘুসের চেয়ে বেশি বিপন্ন করে সাধারণ মানুষকে। প্রাপ্য যথাসময়ে না পেলে যে ক্ষতি হয় তা অপূরণীয়। অথচ এ দেশে যা পাওয়ার কথা তা পাওয়া একটা বিরল ঘটনা। একটা বড় কারণ, কোন পরিষেবা কার, কোন সময়ের মধ্যে দেওয়ার কথা, স্পষ্ট করে জানানো হয় না নাগরিকদের।
২০০৭-এ পশ্চিমবঙ্গের রেশন রোষে স্পষ্ট হয়েছিল যে, গ্রাহকদের কত চাল-গম কোন দরে পাওয়ার কথা, ক’দিন খোলা থাকার কথা রেশন দোকান, তা অনেকে জানেন না। ফলে ‘সাপ্লাই আসেনি’ বলে পার পেয়ে যান ডিলাররা, গ্রামবাসী জানেন না কোথা থেকে তার সত্যতা জানা যাবে। তাই কোন ডিলারটা চোর, শুধু সেটা খুঁজে লাভ নেই। বদলাতে হবে ব্যবস্থাটাই।
একটা উপায়, নাগরিকদের কী কী প্রাপ্য, কোন শর্তে, তা স্পষ্ট জানানোর পদ্ধতি তৈরি করা। বহু রাজ্যে তৈরি হয়েছে ‘নাগরিক সনদ’ (সিটিজেন্স চার্টার), নাগরিকদের অধিকারগুলি যেখানে বিশদে বলা হচ্ছে। যেমন, জমির নথির জন্য আবেদন করলে কত দিনের মধ্যে দফতর তা দিতে বাধ্য। এর ফলে সরকারি দফতরগুলোর অদক্ষতা বোঝার একটা মাপকাঠি আসে নাগরিকদের হাতে, তাই চাপ সৃষ্টির ক্ষমতাও বাড়ে। এদেশে সেটা হতে দেন না সরকারি কর্মীরাই। বিভিন্ন প্রকল্পের বিষয়ে তথ্যগুলি তাঁরা অস্পষ্ট করে রাখেন, আর প্রায়ই বদলান, ফলে ধন্দ তৈরি হয়। মিড-ডে মিল প্রকল্পটি যে অন্য অনেক প্রকল্পের তুলনায় নিয়মিত ও কার্যকর তার একটা কারণ এটার বিষয়ে কোনও ধন্দ নেই। সকলেই জানেন, স্কুল খোলা থাকলেই মিড-ডে মিল পাওয়ার কথা প্রতিটি ছাত্রের, এবং তার দায়িত্ব মাস্টারমশাইদের।
আমজনতার কাছে তথ্য প্রকাশের নিয়মিত ব্যবস্থা থাকলে সেই চাপে দুর্নীতিও কমে আসে। উগান্ডায় কেন্দ্রীয় সরকার প্রচুর অনুদান পাঠাত স্কুলগুলির জন্য, কিন্তু বিতরণের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্থানীয় নেতা-আমলারা বেশির ভাগই আত্মসাৎ করতেন। শেষে সরকার কোন স্কুলে কত অনুদান গেছে, খবরের কাগজে ছেপে দিতে লাগল। হাতে হাতে ফল: ’৯৫ সালে স্কুলগুলোয় গড়ে বার্ষিক অনুদানের ২৪ শতাংশ টাকা পৌঁছোত, ২০০১-এ পৌঁছোল ৮০ শতাংশেরও বেশি। এ দেশে যদি নিয়মিত জানানো হত কোন ব্লকে রেশনে কত চাল এসেছে, বা সেচ বা রাস্তা তৈরির খাতে পঞ্চায়েতে কত টাকা এসেছে, তা হলে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় করার দরকার হত না। ব্যবস্থার চাপে দুর্নীতি কমত।
নেতাদের ইচ্ছা যখন মানুষের ইচ্ছার বিপরীতে যাবে না, তাঁদের স্বার্থের সঙ্গে জনস্বার্থের বিরোধ বাধবে না পদে পদে, তখন সেই ব্যবস্থা হয়ে উঠবে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যোগ্য শাসনতন্ত্র।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্বাতী ভট্টাচার্য,
আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬ জানুয়ারি ২০১২
সাবানের কাজ
সাধারণ পরিচ্ছন্নতার নিয়মগুলো ছাত্ররা কতটা জানে, কতটা পালন করে, তা বুঝতে বীরভূমের কয়েকটি স্কুলে একটা সমীক্ষা হয়েছিল ২০১১ সালের শেষে। সর্বশিক্ষা মিশনের অনুদানে ‘আশা’ সংস্থার এই সমীক্ষায় পাঁচশোর উপর ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে কথা বলা হয়েছিল, তাদের বয়স ৬ থেকে ১১ বছর। তাদের মধ্যে তফশিলি জাতি-জনজাতির ছাত্ররাও ছিল বেশ কিছু।
প্রাথমিক ফলাফল দেখে আঁতকে উঠতে হয়। দশ জনে আট জনই রাতে খাবার পরে দাঁত মাজে না, অর্ধেকেরও বেশি শৌচাগার ব্যবহারের পর সাবান দিয়ে হাত ধোয় না। বড় হতে হতে তারা যে এগুলো শিখে যাচ্ছে, এমনও নয়। দেখা যাচ্ছে, দশ-এগারো বছরের ছেলেমেয়েদের ৮৪ শতাংশ খাওয়ার আগে সাবান দিয়ে হাত ধোয় না। কোনও কোনও বিষয়ে খানিক উন্নতি হচ্ছে। প্রাথমিকের তুলনায় উচ্চ প্রাথমিকে থুতু ফেলার মতো বদ অভ্যাস কমছে, কাশির সময়ে মুখের উপর হাত চাপা দেওয়ার ভাল অভ্যাস বাড়ছে। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়, দশ জনে চার জন ছেলেমেয়ের মধ্যে খারাপ অভ্যাসগুলো থেকেই যাচ্ছে।
এ তথ্য উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না, কারণ ভারতের সামগ্রিক ছবিটাও এর কাছাকাছি। একটি বেসরকারি সংস্থার তৈরি ‘হাংগার অ্যান্ড ম্যালনিউট্রিশন রিপোর্ট’ (সংক্ষেপে ‘হাংগামা রিপোর্ট’) নয়টি রাজ্যের ১০০টি জেলায় সমীক্ষা করেছে। দেখা যাচ্ছে, প্রায় ১০০ শতাংশ ক্ষেত্রেই বাড়িতে সাবান আছে, কিন্তু শৌচাগার ব্যবহারের পর সাবান দিয়ে হাত ধুচ্ছেন মাত্র ১৯ শতাংশ পরিবার, আর খাবার আগে ১০ শতাংশ। সাবানের দরকার স্নানের জন্য, এটাই চলতি ধারণা। উদ্বেগ কিশোরী মেয়েদের নিয়েও। বীরভূমে দেখা যাচ্ছে, দশ জনে ছ’জনই ঋতুস্রাবের দিনগুলোতে ‘ন্যাপকিন’ হিসেবে যা ব্যবহার করছে, তা দোকান থেকে কেনাই হোক বা বাড়িতে তৈরিই হোক, স্বাস্থ্যসম্মত নয়। অনেকেই ব্যবহৃত জিনিসটি আবার ব্যবহার করছে, সংক্রমণের সম্ভাবনা অত্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। যথাযথ পদ্ধতি ব্যবহার না করায় অনেক ছাত্রী মাসে চার-পাঁচ দিন স্কুলে যাচ্ছে না।
এই তথ্যগুলো বীরভূমের, কিন্তু বাকি রাজ্যে ছবি খুব আলাদা নয়। তার একটা ইঙ্গিত ডায়ারিয়ার প্রকোপ। সরকারি হিসেবে, এ রাজ্যে প্রতি বছর অন্তত আড়াই লক্ষ মানুষ ডায়ারিয়ার জন্য সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার দ্বারস্থ হন, মারা যান পাঁচশোরও বেশি। শিশুদের মধ্যে ডায়ারিয়ার প্রকোপ জাতীয় হারের চাইতে বেশি। অথচ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে খেতে বসলেই ৪২ শতাংশ কমে যায় ডায়ারিয়া। স্বাস্থ্য-অস্বাস্থ্যে এত সামান্য দূরত্ব, অথচ তা ঘোচানো আর যাচ্ছে না।
কেন এই সহজ উপায়গুলো মানা হচ্ছে না? এমন তো নয় যে, স্বাস্থ্যের কোনও নিয়মই মানছে না শিশুরা। তারা রোজ সকালে দাঁত মাজে, প্রায় সকলেই নিয়মিত নখ কাটে, চোখ ধোয় পরিষ্কার জলে, পানীয় জল ঢাকা দিয়ে রাখে। এমনকী ১০-১১ বছরের ছেলেমেয়েদের অধিকাংশ (২৯৪ জনের মধ্যে ২৫২ জন) জানিয়েছে, তারা নিয়মিত মশারি ব্যবহার করে। এই বার্তাগুলো তাদের কাছে কোনও-না-কোনওভাবে পৌঁছে গিয়েছে। অথচ পৌঁছয়নি রাতে দাঁত মাজা, কিংবা শৌচের পর সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার বার্তা।
অন্য দিকে, সুস্বাস্থ্যের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য অবিশ্বাস্য পরিমাণ টাকা বরাদ্দ রয়েছে, যার অনেকটাই খরচ হয় না। কোন প্রকল্পে বরাদ্দের কী দশা, এক বার তাকিয়ে দেখা যাক।
তথ্য ও সংস্কৃতি: জনস্বার্থমূলক বার্তাগুলি প্রচারের মূল দায়িত্বে রয়েছে যে দফতর। এই দফতরের দেওয়া হোর্ডিং কিংবা কাগজ-টিভির বিজ্ঞাপনের বাইরেও, মুখোমুখি আদানপ্রদানের মাধ্যমে প্রচারের জন্য বরাদ্দ থাকে টাকা। ২০০৯-১০ সালের জন্য ছিল ৩৮ লক্ষ টাকা, ২০১০-১১ সালের জন্য ৪০ লক্ষ টাকা। স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রভৃতি নানা বিষয়ে এই টাকা খরচ হতে পারত। কিন্তু পর পর দু’বছর এই গোটা বরাদ্দই খরচ না হয়ে ফেরত চলে গিয়েছে। কী প্রকল্পে, কীসের প্রচারে খরচ হবে এই টাকা, তার পরিকল্পনা করে উঠতে পারেননি দফতরের কর্তারা।
পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন: এই দফতর পরিচালিত শিশুশিক্ষা কেন্দ্রগুলিতে শিক্ষা সহায়িকাদের প্রশিক্ষণের জন্য, সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে মা ও শিশুদের শেখানোর জন্য ‘ফ্লিপ চার্ট’-এর জন্য, টাকা দেয় স্বাস্থ্য দফতর। ২০০৮-০৯ সালের বার্ষিক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, তিন কোটি ৮০ লক্ষ টাকার মধ্যে খরচ হয়নি দেড় কোটি টাকারও বেশি।
এ ছাড়া ‘টোটাল স্যানিটেশন ক্যাম্পেন’-এর অধীনে অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস বদলের জন্য প্রচার করতে ২০০২ সাল থেকে এখনও অবধি মোট ১৮৭ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। কেবল ‘Information, Education, Communication’-এর জন্য ধার্য এই টাকার মাত্র ২০ শতাংশ খরচ হয়েছে এ রাজ্যে। প্রতিটি জেলা বছরে এই বরাদ্দ থেকে দু’কোটি থেকে পাঁচ কোটি টাকা পায়। বীরভূম খরচ করেছে বরাদ্দের মাত্র ৬-৭ শতাংশ টাকা। ইউনিসেফ-এর এক প্রতিনিধি জানালেন, এর কারণ জেলাগুলোতে IEC-র জন্য ভারপ্রাপ্ত কেউ নেই, স্থানীয় এনজিও দিয়ে কাজ চালানো হয়। তারা কখনও ছৌ নাচ, কখনও বাউল গান, কখনও পথনাটিকা করে স্বাস্থ্য বিষয়ক বার্তা প্রচার করছে। কিন্তু তাতে কাজ কতটা হচ্ছে, তার নজরদারি (মনিটরিং) হচ্ছে না। এই ছবির দিকে তাকালে স্পষ্ট হয় যে, বরাদ্দ খরচ না-হওয়ার সঙ্গে অসুস্থতার হারে বদল না-হওয়ায় একটা সম্পর্ক রয়েছে। অন্তত খরচ না-করলে যে শিশুরা সুস্থ থাকবে না, সেটা নিশ্চিত।
স্কুল শিক্ষা: সর্বশিক্ষা মিশন বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের (জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন, টোটাল স্যানিটেশন ক্যাম্পেন, রাজীব গাঁধী পানীয় জল প্রকল্প প্রভৃতি) টাকা সমন্বিত করে পরিচ্ছন্নতার প্রচার করতে পারে, তাই টাকার অঙ্কটা নির্দিষ্ট নয়।
শিক্ষা-সম্পর্কিত প্রচার মিডিয়ার মাধ্যমে করার জন্য রাজ্য স্তরে দু’কোটি টাকা, এবং জেলাগুলির প্রতিটিতে প্রায় সমান পরিমাণ টাকা বরাদ্দ করেছে সর্বশিক্ষা মিশন। এই টাকা থেকে ব্যয় হতে পারে সু-অভ্যাসের প্রচারের জন্যও।
‘লার্নিং এনহান্সমেন্ট প্রোগ্রাম’-এর অধীনে বই-বহির্ভূত শিক্ষার নানা দিক নিয়ে কাজের জন্য রাজ্যের হাতে গত বছর ছিল ১৩০ কোটি টাকা।
এ ছাড়াও জেলায় জেলায় সর্বশিক্ষা মিশনের ‘প্রজেক্ট অফিস’ থেকে প্রকল্প রূপায়ণ বাবদ বরাদ্দ টাকার অনেকটাই স্কুলগুলির জন্য সাবান কেনা, এবং তার ব্যবহারের বিষয়ে প্রচারের কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।
সমাজ কল্যাণ দফতর: Information, Education, Communication-এর জন্য প্রতিটি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র বছরে হাজার টাকা পায়।
টাকার অভাব নেই। তা হলে শিশুদের কুঅভ্যাস বদলাচ্ছে না কেন? কারণ তা নিয়ে কারও খুব মাথাব্যথা নেই। শিক্ষা দফতরের কর্তাদের সঙ্গে কথা বলে স্পষ্ট হল, তাঁদের তাগিদ দু’রকম। এক, স্কুলগুলোতে শৌচাগার তৈরি করা। ২০০৮ সাল অবধি নির্মাণের কাজই ছিল একমাত্র লক্ষ্য। দুই, কিছু কার্যসূচি পালন করে যাওয়া। যেমন ‘নির্মল বিদ্যালয় পুরস্কার’-এর জন্য প্রতিযোগিতার আয়োজন, বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে ৭-১৩ এপ্রিল স্বাস্থ্য সপ্তাহ পালন প্রভৃতি। কিন্তু শিশুদের দৈনন্দিন অভ্যাসের উপর নিয়মিত নজরদারির কোনও ব্যবস্থা নেই। বরং সর্বশিক্ষা মিশনের কর্তাদের মনোভাবটি এ রকম যে, ‘জানানো হচ্ছে যখন, শিশুরা তা করছে নিশ্চয়ই।’
কী ভাবে স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত বার্তা দিলে তাতে কাজ হবে, তা নিয়ে নানা পরীক্ষা হয়েছে। অমিতাভ বচ্চনকে কাজে লাগিয়ে পোলিয়ো টিকার জন্য ‘দো বুঁদ জিন্দেগি কা’ প্রচারটি কার্যকর হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতার ভরসায় বিদ্যা বালনকে দিয়ে ‘নির্মল ভারত অভিযান’ শুরু করছে কেন্দ্রীয় পঞ্চায়েত মন্ত্রক। আবার সাধারণ মানুষ যাঁরা অভ্যাস পরিবর্তন করে ভাল ফল পেয়েছেন (‘পজিটিভ ডিভিয়ন্স’), তাঁদের সামনে রেখে প্রচার করে ফল মিলেছে পশ্চিমবঙ্গেই, অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্প দিয়ে অপুষ্টি মোকাবিলার ক্ষেত্রে। কিছু ক্ষেত্রে ছোট ছোট দলে ভাগ করে কথাবার্তা বললে কাজ হয়, যেমন গর্ভবতীদের কাছে স্বাস্থ্যের কথা পৌঁছতে হলে। কোথাও এলাকার বাসিন্দাদের সার্বিক অংশগ্রহণ দ্রুত ফল দেয়, যেমন ম্যালেরিয়া নিবারণের জন্য জমা জল পরিষ্কার করা।
কোন কৌশল কাজ দেবে, ‘স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশন’-এর সেই উপায়টি ঠাহর করা সহজ নয়। তা পরিকল্পনা, পরিশ্রম এবং সময় দাবি করে। সেই দাবিই করছে পশ্চিমবঙ্গের শিশুরা। তাদের শিক্ষার অধিকারের মধ্যে পরিচ্ছন্ন পরিবেশের অধিকার ঢোকানো অর্থহীন হয়ে যাবে যদি কেবল টয়লেট তৈরি করে, আর স্বাস্থ্য বিষয়ে বসে আঁকো প্রতিযোগিতা করে দায় সারা হয়। যদি পরিকল্পনার অভাবে প্রচারের টাকা ফিরে যায়। স্কুলগুলোতে শৌচাগারও রয়েছে, মিড-ডে মিলের খাওয়াদাওয়াও হচ্ছে, অথচ শিশুরা হাত ধোয়ার অভ্যাস রপ্ত করতে পারছে না। অসুখ-অপুষ্টি-অশিক্ষার চক্র ভাঙছে না। এই একটি ব্যর্থতাই স্বাস্থ্য-শিক্ষা-তথ্য-পঞ্চায়েত-সমাজ কল্যাণ, সব দফতরকে ফেল করিয়ে দিচ্ছে।
ওই অ-ধোয়া হাতগুলোই এ রাজ্যে দারিদ্রের সূচক।
স্বাতী ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫ মে ২০১২
শুকনো পুকুর
এক কথায় প্রকাশ করুন: ‘মহাত্মা গাঁধী জাতীয় গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্প।’
উত্তর: ‘পণ্ডশ্রম।’
তাই পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের বুকে এত খাদ। ওগুলো হওয়ার কথা ছিল পুকুর। গ্রামের মানুষ পুকুর সংস্কার করে তাতে ধরে রাখবেন বৃষ্টির জল, মাটির তলা থেকেও জল উঠে এসে ভরে দেবে পুকুরকে, এমনই ভাবা হয়েছিল। ছয় মাসও যদি জল থাকে, সেচের জলের চাহিদা মেটে অনেকটা, শ্যালো চালিয়ে জলস্তর ক্ষয় করতে হয় না। বাসন-মাজা কাপড়-কাচার জলের চাহিদা মিটে মেয়েদের জীবনটা খানিক সহনীয় হয়। সেই উদ্দেশ্যে একশো দিনের প্রকল্পের বেশির ভাগ কাজই এ রাজ্যে হয়েছে জলাশয় সংস্কারের প্রকল্পে। খরচ হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। গত সাত-আট বছরে যত পুকুর কাটা হয়েছে, তাতে জল থাকলে বহু জমি দোফসলি হত, বৃষ্টির জন্য আকাশ-পানে তাকিয়ে বসে থাকতে হত না চাষিদের। বৃষ্টি যথেষ্ট না হলেও তা অনেক গা-সওয়া হত।
আসলে ঘটছে কী? আষাঢ়ের এক সকালে, উত্তরখরা গ্রামে তার একটা নমুনা দেখা গেল। বীরভূমের বাহিরি-পাঁচশোয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের এই গ্রামটির নামেও খরা, কাজেও খরা। পাঁচশোয়া গ্রামের পুবে, গাজিডাঙার উত্তরে আর বাহিরির দক্ষিণে বিস্তীর্ণ প্রায় হাজার বিঘে জমি, শ্যালো পাম্প বসাতে গিয়ে সেখানে জলের নাগাল মেলেনি। হারু বাউরি, চণ্ডী বাউরি, রতন বাউরিদের ভরসা আকাশ আর পুকুর। সাড়ে ন’শো ফুট লম্বা আর ১৪০ ফুট চওড়া উত্তরখরা খাল সংস্কার করতে তাঁদের মতো ২৬০ জন লেগে পড়েছিলেন একশো দিনের কাজে। খানিক বৃষ্টিতে এঁটেল মাটি একটু নরম হয়েছে, পুরুষরা কোদাল চালাচ্ছেন, মেয়েরা ঝুড়ি করে মাটি নিয়ে পাড়ে ফেলে আসছেন। মাথাপিছু গড়ে ৬২ ঘন ফুট মাটি কাটলে ওরা পাবেন ১৩৬ টাকা মজুরি। কাজ হয় গ্রাম পঞ্চায়েতের তত্ত্বাবধানে। গরিবের ন্যূনতম প্রয়োজনীয় রোজগার যাতে হয়, তাই প্রকল্পটি মূলত শ্রমনির্ভর। যে-কোনও কাজের অন্তত ৬০ শতাংশ টাকা ধরতে হবে মজুরি খাতে।
আরও কতটা কাটতে হবে? ‘এখানে জলের লেয়ার আছে বারো ফুট তলায়। দশ ফুট মতো কাটলে খালে জল থাকত অন্তত অঘ্রান অবধি, আমন ধান ঘরে তুলেও গম, সর্ষে, আলু বোনা যেত,’ বললেন হারু, চণ্ডীরা। ‘কিন্তু তার জন্য ২০ দিন কাজ করতে হত কম করে। সে কি আর হবে? সাত দিনের বেশি কাজ হবে না।’ সুপারভাইজারও জানালেন, নয় দিন কাজ হওয়ার কথা এই খালে। সব গ্রামে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কাজ করতে হবে, তাই এমন ‘রেশন’ হচ্ছে কাজ, যুক্তি দিচ্ছে পঞ্চায়েত। কিন্তু আসল কথাটা হল, জল নিয়ে মাথাব্যথা নেই কর্তাদের। বীরভূমেরই এক পঞ্চায়েত সচিব, যিনি পাঁচটি গ্রাম পঞ্চায়েতে কাজ করেছেন, স্পষ্ট বললেন, ‘এনআরইজিএ নীতিতে যদিও সেচের পুকুরকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু আসলে এটা হয়ে দাঁড়িয়েছে সংখ্যার খেলা। মজুরিতে যত খরচ হবে তত ভাল। কত দিন কাজ দেওয়া হল, তা দেখতে গিয়ে জলসম্পদের কথা সবাই ভুলে যাচ্ছে। ব্লকে নানা ওয়ার্কশপে যাই, কই সেখানেও তো জলের কথা শুনি না।’
অপর একটি পঞ্চায়েতের সচিবও বললেন, ‘পুকুরে জল উঠবে না জেনেও কাজ দিতে হয়। না হলে এত কাজ কোথায়? উপরওয়ালারা তো বলেই দিচ্ছেন, ৫০ দিন কাজ দিতে হবে, কেমন করে দেবে আমার দেখার দরকার নেই।’ বোলপুরের কাছে দু’টি গ্রাম পঞ্চায়েতে কাজ করেছেন তিনি, বললেন ‘এই দুই অঞ্চলে ৪০ শতাংশ মতো পুকুরে জল আছে। বাকিগুলো জল থাকবে না জেনেও খোঁড়া হচ্ছে।’
উত্তরখরা খাল এ বারও ফুট ছয়েক গভীরতায় থমকে যাবে। তিন বছর আগে এই খালই কাটা হয়েছিল এনআরইজিএ’র টাকায়। খানিক দূরে আড়াই-তিন বিঘে জুড়ে শালুকগড়া খালও সংস্কার হয়েছিল। তারও আজ সেই একই দশা, নীচে পাঁকটুকুও শুকিয়ে কাঠ। এর আগে যা হয়েছিল, এ বারও তাই হবে, ধান রোয়ার সময়ে জল পাওয়া যাবে ওই খালগুলো থেকে, কিন্তু কার্তিকে ধান তোলার সময়ে খালে জল থাকবে না, বিঘে প্রতি ফলন হবে বড়জোর পাঁচ-ছয় বস্তা (তিন কুইন্টাল)। খালে জল থাকলে আশেপাশের ৩০ বিঘে জমিতে দুটো ফসল হতে পারত, আফশোস করছিলেন ওঁরা। ‘হয় আমাদের এক মাস খুঁড়তে দিক, নইলে মেশিন নামিয়ে তলাটা কেটে দিক। আমরা মাটি ফেলে দেব,’ বিড়িটা ছুড়ে ফেলে বললেন সন্ন্যাসী বাউরি। কিন্তু শ্রমিকদের সুযোগ বেশি দিতে হবে বলে বুলডোজার ব্যবহারের সুযোগ নেই প্রকল্পে। তাই কোনও গ্রামেই যতটা কাটা দরকার পুকুর, ততটা কাটা হয়ে ওঠে না।
মহাত্মা গাঁধীর নামাঙ্কিত প্রকল্প বাউরি, মার্ডি, হেমব্রমদের ‘লেবার’ করে রেখে দিল। দিন আনি দিন খাই-এর বাইরে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ করে দিল না।
এই চিত্র সর্বত্র। বীরভূমের ৪৪টি গ্রামে একটি সমীক্ষা করেন অর্থনীতির গবেষক শুভাশিস দে, ২০১০ সালে। সময়টা ছিল অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর, সে-বছর বর্ষা শেষ হওয়ার পরে পরেই। একশোটিরও বেশি এনআরইজিএ-র পুকুর তিনি নিজে দেখেন। সেই গ্রাম পঞ্চায়েতগুলিতে তার আগের চার-পাঁচ বছরে পুকুরের কাজে খরচ হয়েছিল এনআরইজিএ-র জন্য বরাদ্দ টাকার ৭৪-৮৯ শতাংশ। তা সত্ত্বেও নতুন পুকুরের ৮৮ শতাংশে জল ছিল না, পুরনোগুলো তো প্রায় সবই শূন্য। সম্বৎসর জল থাকে, এমন পুকুর মেরেকেটে তিন শতাংশ। যদিও প্রায় ৩০ শতাংশ পুকুরের চারপাশে চাষের জমি ছিল, কিন্তু মাত্র ১১ শতাংশ পুকুরের জল পাচ্ছিলেন চাষিরা।
উত্তরখরার আদিবাসী পাড়ার মণি হাঁসদা, মালতী হেমব্রমদের গ্রামের ডোবা কোটালগড়ায় বছর দুই আগে সাত দিনের কাজ হয়েছিল, কিছু দিন জল ছিল। এখন একটা গামছা ধোয়ারও জল নেই। ‘আগুন লাগলে চেয়ে চেয়ে দেখতে হবে,’ বললেন ওঁরা। দেড়শো পরিবারের জন্য দুটি টিউবকল। পাশের ইটোন্ডা গ্রামের চন্দনা, তন্দ্রা রাজবংশীরা জানালেন, পাড়ায় দশ-বারোটা পুকুর, কোনওটায় জল নেই। সকাল ছ’টা থেকে ৯টা, দুপুর একটা থেকে সন্ধ্যা ছ’টা ওঁরা টিউবকলে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। ‘আর দু’তিন ফুট পুকুর কাটলে জল মিলত।’ উত্তরখরা খালের মাটি কাটতে কাটতে পঞ্চায়েত সদস্য সুন্দরী মার্ডি বললেন, ‘এখানে খানিক, ওখানে খানিক, এমনি কাজ দেয়। এক মাস কাজ না করলে জল দাঁড়াবে কী করে?’
যতটা মাটি কাটলে জল দাঁড়ায়, ততটা কাজ হয় না কেন? কী ভাবে স্থির হয় কতটা মাটি কাটা হবে? এক পঞ্চায়েত সচিব বললেন, ‘নির্মাণ সহায়ক পুকুরটা মেপে নেয়, জেনে নেয় কত টাকা চেয়েছি, তার পর ঠিক করে কতটা কাটা হবে। জলস্তর দেখে পুকুর কাটা, তেমন আমি দেখিনি।’ এনআরইজিএ কমিশনার দিব্যেন্দু সরকার অবশ্য জানালেন, আট-দশ লক্ষ টাকার প্রস্তাব ব্লক বা জেলাকে দিয়ে মঞ্জুর করিয়ে দরকার মতো পুকুর খোঁড়া যায়। কিন্তু উপরের কর্তাদের দিয়ে কাজের প্রস্তাব অনুমোদন করানোর ঝামেলায় যেতে চায় না অনেক গ্রাম পঞ্চায়েত। আড়াই লক্ষ টাকার মধ্যে কাজের প্রস্তাব মঞ্জুর করতে পারে গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্মাণ সহায়ক, তাই তার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চায় কাজ। তবে তিনি এ-ও স্বীকার করেন যে, পুকুর কাটা হয়ে যাওয়ার পর তা সত্যিই জলসম্পদ তৈরি করে গ্রামের মানুষের প্রয়োজন মেটাচ্ছে কি না, তা পরখ করার কোনও ব্যবস্থাই চালু নেই। গ্রামে নয়, রাজ্যে নয়, কেন্দ্রে নয়।
গরিবের সঙ্গে এমনই রসিকতা করেন দেশের কর্তারা। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ঘোষণা করেছেন, এনআরইজিএ প্রকল্পে দুর্নীতি আটকাতে হবে। মানে সরকার আরও কোমর বেঁধে দেখবে, কাগজের সঙ্গে কম্পিউটার, কম্পিউটারের সঙ্গে কাজ মিলল কি না। কাটা-মাটি পুকুর হয়ে উঠল কি না, তা কিন্তু দেখবে না। জুয়াচুরি ভারী খারাপ, বোকামি আরও ভয়ানক।
দুপুর গড়াতে রোদ গনগনে, গরম বাতাস উপরে উঠছে, উত্তরখরা খালের সামনে সেই কাঁপা বাষ্পের পরদা চোখে যেন ধাঁধা লাগাল। ওই যে লোকটি কোঁকড়া চুল, কথা বলতে বলতে কোদাল চালাচ্ছেন ধাঁই ধাঁই, ওই আমাদের পঞ্চায়েত মন্ত্রী নয়? ওই যে সাদা-দাড়ি বৃদ্ধ মাথায় নীল গামছার ফেট্টি বেঁধেছেন, কাদামাটি তুলে দিচ্ছেন আর এক জনের ঝুড়িতে, ওনাকেই কি দেখিনি লালকেল্লায়? সাদা শাড়ি, কষে চুল-বাঁধা মেয়েটি ঝপ করে কাদামাটি ফেলে তরতর করে নেমে গেল নীচে, ওই দ্রুত হাঁটাচলা যে রোজ দেখা যায় টিভির পরদায়। এখানে এঁরা কেন? তবে কি এঁরা বুঝেছেন, নির্জলা পুকুর তৈরির সঙ্গে তাঁদের রাজনীতির কোনও তফাত নেই? হয়তো ওঁরাও জানেন, জলহীন পুকুর কাটার মতোই লাভ নেই রেশন ব্যবস্থা চালু রেখে যদি তাতে অপুষ্টি দূর না হয়, সর্বশিক্ষা মিশন চালিয়ে যদি তা শিশুদের লিখতে-পড়তে না শেখায়, গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনে টাকা ঢেলে যদি তা আরোগ্য না আনে। প্রকল্প মানুষের জন্য কী করতে পারল, সে-কথাটা ভুলে গিয়ে প্রকল্প চালানোটাকেই ‘কাজ’ বানিয়ে ফেলেছেন দেশের কর্তারা। তাঁদের ‘কাজ’ মানুষের কতটা কাজে লাগে, তা টের পেয়েই হয়তো চড়া রোদে নির্জলা পুকুর কাটছেন একটা দিন। নেতা হলেও, মানুষ তো।
স্বাতী ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৪ জুলাই ২০১২
লোকে কেন টয়লেট চায় না
ভারতে শুদ্ধ জীবনযাত্রার অন্যতম ‘রোল মডেল’ হিন্দু ঘরের বয়স্ক বিধবারা। ‘ছোঁয়ানেপা’ এড়াতে তাঁরা সব সময়ে কেমন কাঁটা হয়ে থাকতেন, তার গল্প পাওয়া যায় কল্যাণী দত্তের ‘থোড় বড়ি খাড়া’ বইটিতে। ‘গেরস্তের শোবার ঘরে বিছানা মাদুর সতরঞ্চি পরদা, সব এঁটোকাঁটা হয়ে যায় মায় দরজার কড়াটি পর্যন্ত। তক্কে তক্কে থেকে কোন ফাঁকে এঁরা লাফিয়ে বা ডিঙিয়ে কোনও সময় ঘরে ঢুকে কাঠের পিঁড়েয় উঁচু হয়ে বসতেন।’ এমন প্রাণপণ চেষ্টায় যিনি পবিত্র থাকতেন, তাঁরই আবার ‘পায়ে লম্বা লম্বা ফাটা, জল ঘেঁটে ঘেঁটে হাত-পায়ে হাজা, অর্দ্ধেক সময় ভিজে কাপড়ে থাকার জন্য সর্দিজ্বর লেগেই থাকে।’ বহু রকম এঁটো-সগড়ি মানতেন, কিন্তু শনি-মঙ্গল-বৃহস্পতি, আর ছেলের জন্মবারে নখ কাটা বারণ, তাই হাতে-পায়ে লম্বা নখ, পরনের কাপড়খানি আধময়লা। এঁরা জমিদার ঘরের বিধবা, বলছেন কল্যাণী। তাঁরা মলিন, রুগ্ণ থাকতেন অভাবে নয়, সংস্কারবশে।
সমাজ-পরিবারের চোখে যা ‘শুচি’, তার সঙ্গে যে পরিচ্ছন্নতা, সুস্বাস্থ্যের তেমন কোনও যোগই নেই, ‘স্বচ্ছ ভারত’ তৈরির পথে এটাই এখন সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দেখা দিচ্ছে। এ দেশের এত মানুষ এখনও কেন টয়লেট ব্যবহার করছেন না, তা খুঁজতে গিয়ে এই কারণটাই ক্রমশ আর সব কারণকে ছাপিয়ে উঠছে। গুজরাত, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের গ্রামের মানুষ গবেষকদের বলেছেন, বাড়ির কাছে টয়লেট থাকাটাই তো নোংরা। অন্য দিকে, খোলা মাঠে যাওয়ার অনেকগুলো সদ্গুণ দেখতে পাচ্ছেন তাঁরা। যে খোলা মাঠে যায় সে অলস নয়, নিয়ম করে ভোরে ওঠে, বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে, উন্মুক্ত পরিবেশ, খোলা হাওয়া পছন্দ করে। সে সতেজ, স্বাস্থ্যবান, প্রাণবন্ত। অর্থাৎ বহু দিনের সংস্কার, অভ্যাস যা বলছে, সরকারি প্রকল্প বলছে তার ঠিক উলটো। তাই প্রকল্প যত টয়লেট তৈরি করছে, তত ব্যবহার হচ্ছে না।
গবেষকরা নানা রাজ্যে গ্রামের মানুষের সঙ্গে বিশদে কথাবার্তা বলে জানছেন, যে সব বাড়িতে টয়লেট আছে, তার অর্ধেকেরও বেশি (৫৬%) পরিবারের অন্তত এক জন সদস্য বাড়ির বাইরে যাচ্ছেন কাজ সারতে। বলাই হয়, ‘বড় বাইরে’ আর ‘ছোট বাইরে’।
কংগ্রেস সরকারের ‘নির্মল ভারত’ প্রকল্পের সময়ে চিন্তাটা ছিল এইরকম: আহা গরিব মানুষ, বাড়িই নেই, টয়লেট পাবে কোথায়। ওদের টয়লেট বানিয়ে দাও, নিশ্চয়ই ব্যবহার করবে। অতএব রাজ্যে রাজ্যে, জেলায় জেলায় টয়লেট নির্মাণ শুরু হল। কিন্তু ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছে, জোগান যতই বাড়ুক, চাহিদা বাড়ছে না। বরং জোগান-দেওয়া টয়লেট অব্যবহারে, অনাগ্রহে অকেজো হয়ে পড়ছে। পশ্চিমবঙ্গেই যে ১০৭৭ গ্রাম পঞ্চায়েত ‘নির্মল গ্রাম’ বলে ঘোষিত হয়েছিল, সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, তার ২৫-৩০ শতাংশ বাড়িতেই টয়লেট আর কাজ করছে না। ফের এই সব গ্রামে অন্তত ১৪ লক্ষ টয়লেট তৈরি করতে হবে। ফলে বিজেপি-র ‘স্বচ্ছ ভারত’ পরিকল্পনায় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে টয়লেট গড়া নয়, টয়লেট ব্যবহার।
টয়লেট থাকতেও কেন ব্যবহার হয় না, তা নিয়ে নানা আলগা গল্প হাওয়ায় ভাসে। যেমন, গরিব মানুষ একটা বাড়তি ঘর পেলে বরং তাতে ছাগল-মুরগি রাখবে, খড়বিচুলি রাখবে, টয়লেট হিসেবে ব্যবহার করবে কেন? কিংবা, সরকারি টয়লেটের এমন খারাপ দশা, ব্যবহারই করা যায় না। কিংবা জলই নেই, টয়লেট ব্যবহার করবে কী করে? এগুলো কিন্তু ধোপে টেকে না তেমন। ধরুন, জলের কথাই। পশ্চিম ও উত্তর ভারতে ‘মাঠে যাওয়া’ লোকেদের মধ্যে সমীক্ষায় মাত্র ৩ শতাংশ বলেছেন, জল না-থাকা টয়লেট এড়ানোর কারণ। যে সব বাড়িতে পাইপবাহিত জল আসে, সেখানেও বাড়ির টয়লেট ব্যবহারের হার অন্যদের প্রায় সমান। এ রাজ্যের বীরভূমে ৬৫ শতাংশ মানুষ বলছেন, তাঁদের বাড়ির ভিতরে অথবা কাছে জলের উৎস রয়েছে। অথচ প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগ করেন। গোটা ভারতেও এই ছবি: বাড়ির কাছে জল থাকলেও লোকে ছুটছে মাঠে। অথচ আফ্রিকায় সাহারার নীচের গরিব দেশগুলিতে দেখা যাচ্ছে, ভারতের চেয়ে ঢের কম লোক বাড়ির কাছাকাছি জল পান, কিন্তু উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগ করেন ঢের কম লোক। ভারতের গ্রামে ৬০ শতাংশ বাইরে যাচ্ছেন, সেখানে ওসব দেশে ৩৫ শতাংশ।
দারিদ্রকেও দায়ী করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ নিশ্চয় ভারতের চেয়ে ধনী নয়। সেখানে মাত্র চার শতাংশ মানুষ মাঠে যান। ভারত সরকার যে-টয়লেট গরিবদের দেন, ইট-সিমেন্টের নির্মাণ থাকায় তা নাকি বাংলাদেশে ব্যক্তিগত খরচে তৈরি অনেক টয়লেটের চেয়ে বেশি দামি। আবার ভারতেই মুসলিমরা গড়ে হিন্দুদের চেয়ে গরিব হলেও, তাঁদের টয়লেট ব্যবহারের হার বেশি। গ্রামীণ হিন্দু পরিবারের ৭৭ শতাংশ বাইরে মলত্যাগ করেন, মুসলিমদের ৫৫ শতাংশ। বাড়িতে সরকারের দেওয়া টয়লেট থাকা সত্ত্বেও বাইরে যান ৪০ শতাংশ হিন্দু, মাত্র ৭ শতাংশ মুসলিম। কেন এই তফাত?
কারণ খুঁজতে গিয়ে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডায়ান কোফি পাচ্ছেন সেই শুচিতার ধারণার গ্যাঁড়াকল। যার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে অস্পৃশ্যতার ভূত। টয়লেটের লাগোয়া নিকাশি নেই বহু বাড়িতে, ব্যবহার করতে হয় সেপটিক ট্যাঙ্ক। হিন্দুদের চোখে ট্যাঙ্ক সাফাই ‘ছোট জাত’-এর কাজ, যাঁদের তাঁরা সহজে বাড়ির কাজে ডাকতে চান না। দেখা গিয়েছে, ভারতে ব্যক্তিগত খরচে তৈরি টয়লেটের সেপটিক ট্যাঙ্ক সাধারণ ট্যাঙ্কের চেয়ে অনেক বড় হয়, যাতে দীর্ঘ দিন পরিষ্কার না করলেও চলে। বহু স্কুলে টয়লেট তৈরি হয়ে পড়ে আছে, সে-ও এই মানসিকতা থেকেই। শিক্ষকদের প্রশ্ন, পরিষ্কার করবে কে? ‘ছোট’ কাজটিতে শামিল হতে তাঁদের বড় আপত্তি। যে-স্কুলে টয়লেট ব্যবহার হচ্ছে, সেখানে ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষকরাও ঝাড়ুটি হাতে ধরছেন। ‘কে করবে’ প্রশ্নটা আর রাস্তা আটকে দাঁড়াতে পারে না।
যা ছিল ‘বড় বাইরে’, তাকে ‘বড় ভিতরে’ করাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ মানুষ মারা যদি পাপ হয়, তা হলে মাঠে যাওয়ার চেয়ে বড় পাপ বোধহয় আর কিছু নেই। এই একটা কাজ যে কত শিশুর মৃত্যু ডেকে আনছে, আরও কত শিশুকে রোগা, বেঁটে করে রাখছে, গবেষকরা তার নতুন নতুন সাক্ষ্য বার করে আনছেন। এ দেশে প্রতি বছর ৪০ লক্ষ শিশু উদরাময়ে মারা যায়। কয়েক কোটি অনবরত পেটের রোগে ভোগে। বিজ্ঞানীরা দেখছেন, যেখানে উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগের অভ্যাস যত বেশি, সেখানে শিশু-অপুষ্টির হারও বেশি। মল থেকে ছড়ানো জীবাণুতে বারবার পেট খারাপ, তা থেকে এক রকম দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টি তৈরি হচ্ছে। না হলে আফ্রিকার গরিবতর দেশের শিশুরা কী করে ভারতীয় শিশুদের চেয়ে লম্বা হয়? গবেষকরা অনেক মাপজোক, হিসেবনিকেশ করে বলছেন, ভারতে টয়লেট ব্যবহার বাড়লে শিশুরা আরও বেশ কিছুটা লম্বা হত। আর সুপুষ্ট, লম্বা শিশুরা লিখতে-পড়তে, অঙ্ক কষতে পারে আরও ভাল, সে-ও প্রমাণিত।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে টানিছে পশ্চাতে’। সে-কথা যেন অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাচ্ছে। কলুষের আশঙ্কায় ঘরে ছোট জাতকে ডেকে এনে ঘর অশুচি করার ভয়ের শেষ পরিণতি: সন্তানের রোগ, মৃত্যু। আর গোটা বিশ্বের কাছে ভারতের পিছিয়ে পড়া। কী হবে তোমার মঙ্গলে গিয়ে, ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিতে, যদি শিশুদের বাঁচাতে না পারো? কী হবে আমেরিকা-চিনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, যদি বাংলাদেশ-কিনিয়ার কাছে হেরে বসে থাকো?
এই প্রশ্নগুলো ‘স্বচ্ছ ভারত’ তুলবে কি না, সেটাই প্রশ্ন। ‘নির্মল ভারত’-এও টয়লেট ব্যবহারের প্রচারকে খাতায়-কলমে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। কাজের বেলায় তা হয়ে দাঁড়িয়েছিল টয়লেট তৈরির প্রকল্প। তাতে নেতা-অফিসার-ঠিকাদার চক্রের পোয়াবারো। এই মুহূর্তে ভারতে প্রায় ৩ কোটি ৭৫ লক্ষ ‘মিসিং টয়লেট’ রয়েছে। মানে, হিসেবের খাতায় সেগুলো আছে, বাস্তবে কেউ খুঁজে পাচ্ছে না। ‘স্বচ্ছ ভারত’-এও দেখা যাচ্ছে, মানুষের আচরণ বদলানোর কাজকে গুরুত্বের বিচারে এক নম্বরে রেখেও কাজের বেলায় বরাদ্দ কেবল ১৫ শতাংশ টাকা। তাড়া পড়ছে দিনে ৪৮ হাজার টয়লেট নির্মাণে। ক্রমাগত টয়লেট জোগান না দিয়ে, কী ভাবে টয়লেটের চাহিদা বাড়ানো যায়, সেটা চিন্তা না-করলে ফের একগাদা টাকা বাজে খরচ হবে ‘স্বচ্ছ ভারত’ প্রকল্পের নামে।