সুরপতির বৈচিত্র্যহীন কারাবাসের পঞ্চম বছরে একটা ঘটনা ঘটল।
কোনও ক্রমে চার বছর কাটিয়ে দেবার পর সে অনুভব করেছিল দশটা বছর সে কাটিয়ে দিতে পারবে ঠিকই। আবার সে মুক্তি পাবে। তারপর সুভদ্রা এবং ধ্রুবকুমার যদি বেঁচে থাকে তাহলে পৃথিবীর যে প্রান্তেই তারা থাকুক, সুরপতি ঠিক খুঁজে বার করবে তাদের।
দুর্গতির চরম সীমায় গিয়েও সুরপতি হেরে যায়নি। বেঁচে থাকার একটা অদ্ভুত জেদ আছে মানুষের। তার মাথায় ক্ষতস্থানটা সারতে দীর্ঘদিন লেগেছিল। হঠাৎ হঠাৎ যন্ত্রণা জেগে উঠত, তখন মনে হত, সে বুঝি পাগল হয়ে যাবে। সেই সময় মাঝে মাঝে সে নিজের পরিচয় ভুলে যেত। নির্জন কারাকক্ষে শুয়ে ব্যথায় ছটফট করতে করতে সে চিৎকার করে উঠত, আমি কে? আমি কোথায়? উত্তর দেবার কেউ নেই।
খানিকটা পরে যন্ত্রণা একটু কমে গেলে সে নিজেই ফিস ফিস করে নিজেকে শোনাত, আমি সুরপতি, আমাকে বাঁচতে হবে।
এই কারাগারের সঙ্গে বাইরের পৃথিবীর কোনও যোগাযোগ নেই। বাইরের কোনও সংবাদই এখানে কেউ পায় না। সুরপতি জানে না সুভদ্রা আর ধ্রুবকুমারের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তবু সে আশা করে, এক দিন না একদিন দেখা হবেই।
এই ক’বছরে সুরপতির শরীর অনেক সবল হয়েছে। কঠিন পরিশ্রমের ফলে তার প্রতিটি মাংসপেশী এখন সুদৃঢ়। তাছাড়া অসহ্য এই কারাজীবনকে কিছুটা সহনীয় করার জন্য সে কয়েকটি উপায় উদ্ভাবন করেছে।
যেমন পাথর ভাঙতে ভাঙতে সে এক দিন একটি চকমকি পাথর আবিষ্কার করে। কারুকে সেকথা না জানিয়ে সেই চকমকির দু’টি টুকরা সে নিজের কুঠুরিতে নিয়ে এসেছে। সেগুলি ঠুকলে বেশ বড় বড় ফুলকি বেরোয়, সেই আলোয় সম্পূর্ণ ঘরটা দেখা যায়। এর ফলে তার মূষিক মারার অনেক সুবিধে হয়েছে। প্রতি রাতেই দুটি তিনটি করে মূষিক সে মারতে পারে। ইদানীং মূষিকরাও তাকে ভয় পেতে শুরু করেছে, তার কুঠুরিতে আর তারা সহজে আসে না।
চকমকির আলোয় সে কুঠুরির দেয়ালে একটা খড়িপাথর দিয়ে দিনের হিসেব রাখতে শুরু কবেছে। কত দিন, কত মাস, কত বছর পার হল তার হিসাব রাখতে পারবে এখন।
নানা রকম পাথরের টুকরো দিয়ে অস্ত্র বানাতেও শুরু করেছে। পাথরগুলি ভাঙবার সময় বিভিন্ন আকৃতির হয়। রক্ষীদের চোখের আড়ালে সে বিভিন্ন টুকরো নিয়ে ঘর্ষণ করে করে পাথরের ছুরি বানায়। একটি ছুড়ি রীতিমতো ধারালো ও মজবুত। সেটা ঠিক কোন ব্যবহারে লাগবে, তা সুরপতি এখনও জানে না, তবু নিজের কাছে সযত্নে লুক্কায়িত রেখেছে।
পাথরের টুকরো দিয়ে সে কখনও-সখনও নানা রকম পুতুলও বানায়। এ ব্যাপারেও তার সহজাত দক্ষতা আছে। একটিতে সে বানিয়েছে সুভদ্রার মুখ, আর একটিতে ধ্রুবকুমারের। মূর্তি দুটি তার ঘরের কোণে বসানো আছে। রক্ষীরা কোনও দিন কয়েদিদের দুর্গন্ধ কুঠরির মধ্যে ঢোকে না, তাই ওই মূর্তি দুটির কথা কেউ জানে না। প্রতি রাত্রে সুরপতি ওই মূর্তি দুটির সঙ্গে মনে মনে কথা বলে। এখন আর সে ততটা একা নয়।
এক-এক দিন রাত্রে বড় বিভ্রম ঘটে যায়। সুভদ্রা আর ধ্রুবকুমারের পাথরের মূর্তি দু’টি শিয়রের কাছে নিয়ে শুয়ে থাকে সুরপতি। মাঝ রাত্রে হঠাৎ কোনও শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে যায় তার। ধ্রুবকুমার যেন আকুল ভাবে ডাকছে, বাবা! বাবা! একেবারে সত্যিকারের কণ্ঠস্বর। সুরপতি আমূল চমকে ওঠে। সুরপতি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ধ্রুব, ধ্রুব, বাছা, তুই কোথায়? অমনি সে একটি কচি বালকের হাতের স্পর্শ পায়। ধ্রুবকুমার বলে ওঠে, এই তো।
এ তো স্বপ্ন নয়! এ যে বাস্তবও। অন্ধকারের মধ্যে সুরপতি কিছু দেখতে না পেলেও শিশু ধ্রুবকুমারের স্পর্শ তো সে ঠিকই অনুভব করছে। তাহলে সুভদ্রা কোথায় সেকথা জিজ্ঞেস করতেই ধ্রুবকুমার বলে, মা তো আপনার পায়ের কাছেই বসে আছেন!
তাই তো। সুরপতি টের পায়, সুভদ্রা তার অভ্যস্ত ভঙ্গিতে সুরপতির পা টিপে দিচ্ছে। তার সেই নরম উত্তপ্ত হাতের স্পর্শ চিনতে ভুল হয় না।
আনন্দে, বিস্ময়ে সুরপতির আবার মাথার যন্ত্রণা হতে শুরু করে। সে চেঁচিয়ে বলে, আমি কে? আমি কোথায়? সুভদ্রা, তুমি এত দিন কোথায় ছিলে?
সুভদ্রা মৃদুকণ্ঠে উত্তর দেয়, আপনার কষ্ট হচ্ছে, আপনি আর একটু ঘুমিয়ে নিন।
সুরপতি ক্রন্দনজড়িত কণ্ঠে বলে, আমার চেয়ে বেশি কষ্ট বুঝি এ পৃথিবীতে আর কেউ পায়নি। কেন আমার এ শাস্তি।
সে আবার ঘুমিয়ে পড়ে শ্রান্তিতে। কিছুতেই চোখ খুলে রাখতে পারে না। এক প্রহর বাদে যখন আবার চোখ মেলে, তখন হাত বাড়িয়ে আরবকুমার বা সুভদ্রাকে খুঁজে পায় না। শুধু দু’টি পাথরের মূর্তি। সেই কঠিন কারাগার।
এই কারাগার থেকে ক্কচিৎ দু-একটি কয়েদি মুক্তি পায়। আবার মাঝে মাঝে নতুন কয়েদিরাও আসে। কেউ মুক্তি পাবার দিন অন্য কয়েদিরা চোখের জলে তাকে বিদায় দেয়, যেন ঘনিষ্ঠ কোনও বান্ধব চলে যাচ্ছে। নতুন কয়েদিদের প্রথম প্রথম অন্যরা পছন্দ করে না। যেন তারা অন্য জাতের লোক, তাদের গায়ে অন্য রকম গন্ধ।
সুরপতির কারাজীবনের পঞ্চম বছরে এক দিন এক সঙ্গে সাত জন নতুন কয়েদি এল। তাদের মধ্যে এক জনকে দেখে সুরপতি তীব্রভাবে চমকে উঠল। উত্তেজনায় তার শরীরে রীতিমতো কম্পন শুরু হয়ে গেল। যদিও লোকটির একটি হাত দুর্বল হয়ে শুকনো গাছের ডালের মতো ঝুলছে ও একটি চক্ষু নষ্ট, তবু তার বিশাল চেহারা ও বিরাট মুখখানা থেকে চিনতে অসুবিধা হয় না।
এ সেই দস্যু সর্দার বুধনাথ।
সুরপতির মনে হল, এই লোকটিই তার জীবনের সমস্ত দুঃখ দুর্দশার মূল। এ তার চোখের সামনে সুভদ্রার ওপর অত্যাচার করেছে, নির্দোষ ধনরাজকে হত্যা করিয়েছে। এর জন্যই সুভদ্রা মূক। সুভদ্রা যদি মূক না হত, তাহলে সুরপতি দারুকেশ্বরে থামত না, বংশীলাল বলে ভুল করে ধরাও পড়ত না।
সুরপতির সর্বাঙ্গে প্রতিশোধ প্রতিশোধ এই শব্দ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকল।
বুধনাথের সঙ্গে যে আর ছ’জন এসেছে, তারা ওরই দলের লোক। গৌড়বঙ্গে টুপিওয়ালা ইংরেজদের হাতে নাস্তানাবুদ হয়ে বুধনাথ তার দলবল নিয়ে পালিয়ে এসেছিল দারুকেশ্বরে। প্রথমে একটি সরাইখানায় আত্মগোপন করেছিল। সেখানেও একদিন এ রাজ্যের সৈন্যদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ হয়। সেই সংঘর্ষে বুধনাথের একটি হাত ও চোখ নষ্ট হয়েছে।
এই সব কথা টুকরো টুকরো ভাবে সুরপতির কানে আসে। সরাইখানার কথা শুনেই তার বুক কেঁপে ওঠে। একি সেই বলভদ্রের সরাইখানা? তাহলে সুভদ্রা আর ধ্রুবকুমারের কোনও ক্ষতি হয়নি তো? যদিও, একটিও কানাকড়ি সম্বল না করে এই চার-পাঁচ বছর সুভদ্রা তার ছেলেকে নিয়ে সেই সরাইখানাতে যে থাকবে কী করে, সেকথাও তার মাথায় আসে না।
আরও খবর সংগ্রহের জন্য সুরপতি বুধনাথের কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করে। এক-একসময় প্রচণ্ড রাগে তার ইচ্ছে হয়, তার হাতুড়ির এক ঘায়ে বুধনাথের খুলি ফাটিয়ে একেবারে ঘিলুবার করে দেয়। কিন্তু তাহলে বুধনাথের দলের লোকরা তাকে ছাড়বে না, তারাও তাকে হত্যা করবে সঙ্গে সঙ্গে। কয়েদখানার মধ্যে এ-রকম সংঘর্ষ হয় মাঝে মাঝে। অকস্মাৎ বিবাদে মত্ত হয়ে সংঘর্ষে মেতে ওঠে কয়েদিরা। তিন-চার জন খুনোখুনি করে মরে। রক্ষীরা বাধা দেবার চেষ্টাও করে না। দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসে। বন্দিদের প্রাণ সম্পর্কে যেন তাদের দায়িত্বই নেই। এরা যত কমে ততই মঙ্গল। সুরপতি এ-ভাবে মরতে চায় না।
বুধনাথ সুরপতিকে চিনতে পারেনি। চিনতে পারার কথাও নয়। সে কত জায়গায় দস্যুতা করেছে, কত মানুষের সর্বনাশ করেছে, সকলের মুখ সে মনে রাখবে কী করে? অত্যাচারিতরাই অত্যাচারীকে মনে রাখে।
কয়েক মাস কেটে যাবার পর সুরপতি বুঝতে পারল, বাকি জীবনটা কয়েদি হিসেবে কাটিয়ে দেবার মতো মানুষ বুধনাথ নয়। ইতিমধ্যেই সে পলায়নের ফন্দি আঁটছে। তখন সুরপতি সুকৌশলে বুধনাথের দলে ভিড়ে গেল। তার পাথরের তৈরি ছুরি দেখে খুশি হল বুধনাথ। এগুলি কাজে লাগবে। তাছাড়া বুধনাথের দলের প্রায় সকলেই এখন অল্প-বিস্তর অঙ্গহীন, শেষ যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। এখন সুরপতির মতো এক জন সবল স্বাস্থ্যবান লোকের সাহায্যের বিশেষ দরকার। বুধনাথ যখন শুনল যে, সুরপতির কাছে আগুন জ্বালাবার সরঞ্জাম আছে, তখন সেসব চেয়ে খুশি হয়ে উঠল। বন্ধুর মতো সেসুরপতির কাঁধে হাত রেখে বলল, তোমার ওপরেই আমাদের জীবন-মরণ নির্ভর করছে।
সুরপতির মনে হল, যেন কোনও নোংরা প্রাণী তার কাঁধের ওপর পিচ্ছিল হাত রেখেছে। তার ইচ্ছে হল, ঘৃণায় সে হাতটা ঠেলে সরিয়ে দেয়। এই হাত সুভদ্রাকে স্পর্শ করেছে, এই হাত সভুদ্রার শাড়ি খুলে নিয়েছে।
কিন্তু সুরপতি তখন বুধনাথের ওপর কোনও ক্রোধের ভাবই দেখাল না। সে বুঝে নিয়েছে, তাদের এখন পরস্পরের ওপর নির্ভর করতে হবে।
সে বিগলিত ভাবে হেসে বলল, আপনাকে যদি কোনও রকম সাহায্য করতে পারি, সে তো হবে আমার পরম সৌভাগ্য। তমলুক থেকে দারুকেশ্বর পর্যন্ত আপনার নাম জানে না কে?
বুধনাথ বলল, আবার আমার দিন আসবে। আবার আমি দল গড়ব। টুপিওয়ালা গোরাদের সঙ্গে সামনাসামনি লড়াই করে পারা যাবে না, ওদের কৌশলে শেষ করতে হবে।
একটু থেমে, হঠাৎ সুরপতির দাড়ি চেপে ধরে বলল, তোমার নাম বংশীলাল নয়?
সুরপতি বলল, না তো!
বুধনাথ হা-হা করে হেসে বলল, আমার কাছে লুকোতে পারবে না। যতই বড় বড় দাড়িগোঁফ রাখো, আমি ঠিক চিনেছি। বল্লারপুরে তুমি একবার আমার মুখোমুখি পড়েছিলে, মনে আছে? তুমি একটি গৃহস্থবাড়ির মেয়েকে নিয়ে পালাচ্ছিলে, হঠাৎ আমি দলবল নিয়ে এসে পড়ি, মনে নেই?
সুরপতি বুঝল, প্রতিবাদ করে লাভ নেই। তাই চুপ করে রইল।
বুধনাথ বলল, সেবার তুমি অতি কৌশলে আমার হাত ছাড়িয়ে পালিয়েছিলে। ছদ্মবেশ ধারণে তোমার জুড়ি নেই। তুমি প্রায় চোখের নিমেষে রূপ পালটে ফেলে এক সন্ন্যাসী সাজলে। আমারও চোখে ধন্ধ লেগে গেল। স্ত্রীলোকটিকে তুমি অজ্ঞান অবস্থায় ফেলে রেখে গিয়েছিলে এক গাছতলায়। অবশ্য যাবার আগে তুমি তার গয়নাগাঁটি সব খুলে নিয়েছিলে। ধূর্তচুড়ামণি, এবার তোমাকে হাতের কাছে পেয়েছি! তোমার এই দাড়িও কি নকল নাকি?
বুধনাথ সুরপতিরদাড়ি ধরে টান দিল জোরে। প্রচণ্ড ব্যথা লাগলেও মুখ অবিকৃত রাখল সুরপতি। গম্ভীর স্বরে বলল, বুধনাথ, এখন তুমি আর আমি একই জায়গায় এসে ঠেকেছি। এখন আর শত্রুতা করে লাভ কী? হাত সরাও।
বুধনাথ বলল, তুমি একা একা কাজ সারতে, কখনও দল গড়োনি। একা কারবার চালাবার অবশ্য কিছু সুবিধে আছে, বিশেষত যদি মেয়েদের কারবার হয়। ধরা পড়লে কী করে?
এবার কোনও কথা না বলে সুরপতি নিজের কপালটা ছুঁয়ে দেখাল।
বুধনাথ বলল, ঠিক। নিয়তিকে এড়াবার কোনও উপায় নেই। যাই হোক, পুরনো কথা মনে রেখে আর লাভ নেই। আজ থেকে আমরা দোস্ত। হাতে হাত দাও।
সুরপতি সহাস্যে বুধনাথের ডান হাতটা চেপে ধরল। মনে মনে বলল, প্রথম সুযোগেই আমি তোমাকে খুন করব বুধনাথ। তোমাকৈ আমি ছাড়ব না।
সেই দিন থেকে বুধনাথ সব সময় সুরপতির কাছাকাছি থাকে, আর জেল ভেঙে পালাবার বুদ্ধি আঁটে। এক-একটা মতলবের ঠিক হয়, আবার নানা দিক চিন্তা করে সেটা বাতিল হয়ে যায়। বুধনাথের দলের লোকেরা অন্ধের মতো এখনও তার হুকুম মেনে চলে। অন্য কয়েদিদের মধ্য থেকে খুব বেছে বেছে আরও তিন জনকে দলে আনা হল। তবে এর মধ্যে সুরপতিই সব চেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য, কারণ এখন সে যেমন সকলের চেয়ে বেশি বলশালী, তেমনি তার বুদ্ধিও তীক্ষ্ণ। সেঠাণ্ডা মাথায় সব দিক ভেবে দেখতে পারে। সে আর আগের সেই নিরীহ বিনীত সুরপতি নেই।
বুধনাথ জীবনে কখনও কারুর হুকুম মেনে চলেনি তাই কারাগারের জীবন মানিয়ে চলা তার পক্ষে খুবই শক্ত হচ্ছিল। সে নানা রকম বিকৃত ভোগবিলাসে অভ্যস্ত, এরকম প্রতি দিনের পাথর-ভাঙা শ্ৰম তার সহ্য হয় না। সব চেয়ে অসহ্য হয় রক্ষীদের হুকুম মেনে চলা। কথায় কথায় সে দপ করে জ্বলে ওঠে।
একদিন এক রক্ষী প্রায় খেলাচ্ছলেই বুধনাথের পিঠে কশাঘাত করতেই বুধনাথ খেপে গিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর রক্ষীর হাত থেকে কশা কেড়ে নিয়ে সপাটে মারল তার মুখে। আরও কয়েক জন রক্ষী তার দিকে ছুঠে আসতেই সে এলোমলো ভাবে কশা চালাতে চালাতে ছুটল প্রধান দ্বারের দিকে।
দূর থেকে দেখেই সুরপতি বুঝল, বুধনাথের মস্তিষ্ক-বিভ্রম ঘটেছে। প্রধান দ্বারের কাছে বর্শাধারী প্রহরীরা রয়েছে, তারা নিমেষে বুধনাথের দেহ ফুঁড়ে ফেলবে। সুরপতি একটা বড় পাথরের খণ্ড গড়িয়ে দিল বুধনাথের পায়ের দিকে। তাতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল বুধনাথ আর অমনি এক জন কশাধারী সৈনিকগিয়ে তার চুলের মুঠো ধরল। তারপর মারতে মারতে তাকে নিয়ে গেল কারাকক্ষের দিকে। একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল সুরপতি। প্রধান দ্বার পর্যন্ত পৌঁছলে বুধনাথ কিছুতেই প্রাণে বাঁচত না।
তারপর সুরপতি নিজেই বিস্মিত হল। সে কেন বুধনাথকে প্রাণে বাঁচাতে গেল? বুধনাথ তার চরমতম শত্রু! জেল থেকে পলায়নের সঙ্গী হিসেবে সে বুধনাথকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়? তাও নয়, কারণ পলায়নের সব ব্যবস্থা সে করে ফেলেছে, তাতে বুধনাথের সাহায্যের খুব বেশি প্রয়োজন নেই। তবে? সুরপতি বুধনাথকে সামান্য এক জন রক্ষীর হাতে নিহত হতে দিতে চায় না। তার সঙ্গে সুরপতির নিজস্ব বোঝাঁপড়া আছে।
তারপর এক দিন সন্ধের পর, কারাগারের মধ্যে মাঠের এক পাশে জেলরক্ষীদের ছাউনিতে আগুন লাগল। ছাউনির মধ্যে জেলরক্ষীদের স্ত্রী-পুত্রকন্যা থাকে, আগুন দেখে তারা দিশেহারা হয়ে গেল।
বন্দিদের তখন খাবার সময়, তাদের সারিবদ্ধ ভাবে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল খাবার ঘরে, হঠাৎ সব কিছু বিপর্যস্ত হয়ে গেল। বন্দিরাও চেঁচিয়ে উঠলো, আগুন, আগুন। জল! জল।
যেন বন্দিরাও কারারক্ষীদের ছাউনিতে আগুন নেভাতে সাহায্য করতে চায়–এইভাবে তারা ছুটে গেল সে-দিকে। কিছু কিছু চেষ্টাও করলো আগুন নেভাবার। এবং সুরপতি ও বুধনাথ এরইমধ্যে আরও বেশি করে আগুন ছড়িয়েও দিতে লাগল। এক জন কারারক্ষী বুধনাথকে সেই অবস্থায় দেখে ফেলেছিল, বুধনাথ সবলে তাকে উঁচুতে তুলে ছুঁড়ে দিল আগুনের মধ্যে। তারপর নিজেই সে চেঁচিয়ে উঠল, বাঁচাও, বাঁচাও। মানুষ পুড়ছে।
বুধনাথ এবার অন্ধকারের মধ্যে তীক্ষ্ণ শিস দিতে দিতে উলটো দিকে দৌড়াল। তার দলের লোকেরাও চলে এল তার পিছু পিছু।
দড়ির মই আগে থেকেই তৈরি করে লুকিয়ে রাখা ছিল, ঝপাঝপ সেই মই বেয়ে সকলেই উঠে গেল প্রাচীরের ওপরে, তারপর উলটো দিকে লাফ দিল। প্রাচীরের এ-পারে কী আছে কেউ জানে না, অত উঁচু থেকে লাফিয়ে পড়ায় কারুর হাত ভাঙল, কারুর পা ভাঙল, কিন্তু মুক্তির আনন্দে সবাই উল্লসিত।
সুরপতির মাথা ঠাণ্ডা, সে অমন ভাবে লাফাল না। সে প্রাচীরের ওপর উঠে সাবধানে চারপাশ চেয়ে দেখল। এখানে প্রাচীরের নিচে গড়ানে পাহাড়। সে দড়ির মইটা গুটিয়ে নিয়ে প্রাচীরের ওপর দিয়েই সাবধানে হাঁটতে লাগল।
বুধনাথ তাকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছ?
সুরপতি গম্ভীর ভাবে বলল, এসো আমার সঙ্গে।
তারপর একটা সুবিধা মতো জায়গা দেখে মই লাগিয়ে সুরপতি শেষবার কারাগারের ভেতরটা দেখে নিল। আগুনের শিখা এখন লক লক করছে সারা ছাউনি জুড়ে। এদিকে এখন কেউ আসবে না। বুধনাথ ও সুরপতি নেমে পড়ল উলটো দিকে।
সুরপতি বলল, এবার চলল, সঙ্গীদের খোঁজে যাই।
বুধনাথ তার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলল, দুর নির্বোধ। ওদের খোঁজে গিয়ে কী হবে? ওইসব কানা খোঁড়াদের নিয়ে আমার কোনও কাজ হবে না। আমি দল গড়ব নতুন লোক নিয়ে। ওরা মরুক বাঁচুক, তাতে আমাদের কী? এসো আমরা পালাই।
সুরপতি বলল, ওরা তোমার এত দিনের সঙ্গী, তুমি ওদের খবর নেবে না?
বুধনাথ বলল, গোল্লায় যাক!
দুজনে অন্ধকারের মধ্যে ছুটল।
কারাগারটি তৈরি করা হয়েছিল বেছে বেছে একটা দুর্গম জায়গাতেই। এক দিকটা শুধু উঁচু-নিচু পাথর আর জঙ্গল, পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে একটা খরস্রোতা নদী। এই রাস্তায় দৌড়ানো খুব সহজ কাজ নয়। যে-কোনও মুহূর্তে রক্ষীরা বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে। একমাত্র উপায় নদীটা পার হওয়া।
সুরপতি নদীর জলে একটুখানি পা দিয়ে দেখল, অসম্ভব তেজি স্রোত, জলও তেমনি ঠাণ্ডা। এ নদী সাঁতরে পার হওয়া যাবে না। তখন তার অনুতাপ হল, কেন দড়ির মইটা ফেলে এসেছে। সেটা থাকলে গাছের ডালে বেঁধে একটা কিছু উপা করা যেত। কিন্তু এখন আর ফিরে গিয়ে নিয়ে আসার সময় নেই।
নদীর ধার ঘেঁষেই হাঁটতে লাগল ওরা। কিন্তু এভাবে বেশি দূর যাওয়া যাবে না। সামনেই খাড়া পাহাড়, এ পাহাড়ে উঠতে বহু সময় লেগে যাবে। তাছাড়া রক্ষীরা যদি ঘোড়া ছুটিয়ে আসে, তাহলে ধরে ফেলবে অনায়াসেই। সুরপতির মধ্যে বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছটফট করছে, সে আর কিছুতেই ধরা দেবে না। এক জায়গায় দেখল, নদীর ওপর একটা তালগাছ অনেকখানি হেলে আছে। সেটা প্রায় নদীর তিন-চতুর্থাংশ পেরিয়ে এসেছে, কিন্তু বাকিটা পেরুবার উপায় কী?
সুরপতি তবু বলল, বুধনাথ তুমি দাঁড়াও, দেখি আমি কোনও উপায় করতে পারি কি না।
সুরপতি তালগাছটার ওপরে উঠে গেল। একেবারে ডগার কাছে এসে দেখল, এখনও বেশ খানিকটা দূরে তীর। এখান থেকে লাফাবার কথা ভাবলেই গা ছম ছম করে।
বুধনাথ চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী, পার হওয়া যাবে?
সুরপতি বলল, না।
তবু সে তালগাছের ডালটা ধরে ঝুলে পড়ল। নিচে জলের স্রোত, ওর মধ্যে পড়ল আর বাঁচার আশা নেই। তা-ও সে অনেক কষ্টে নিজের শরীরটাকে দুলিয়ে তারপর হাত ছেড়ে দিল।
সুরপতি জলের মধ্যেই পড়ল, তবে তীরের অনেকটা কাছে। স্রোতে ভেসে যাবার আগেই সে হ্যাঁচোড় প্যাঁচোড় করে একটা গাছের শক্ত শিকড় ধরে ফেলল। তারপর ওপরে উঠে আসতে আর বিশেষ বেগ পেতে হল না।
ওপরে উঠে সে হাঁপাতে লাগল। সে নিশ্চিত মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে এসেছে। নদীটা যেন জীবন্ত, প্রবল শক্তিতে তাকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছিল। একবার এই স্রোতের টানে পড়লে আর নিস্তার নেই।
বুধনাথ ও-পার থেকে সুরপতিকে লক্ষ্য করছিল। সুরপতি নির্বিঘ্নে পারে উঠে যাবার পর সে দুঃখিত ভাবে বলল, বংশীলাল, তুমি আমাকে ফেলে চলে গেলে?
সুরপতি বলল, তুমিও এসো।
বুধনাথ বলল, আমি ওভাবে পারব না। তুমি বেঁচে গেছ দৈবাৎ। দৈবতা আমার ওপর সদয় নাও হতে পারে!
সুরপতি বলল, তাহলে আর আমি কী করতে পারি বলো? আত্মরক্ষা মানুষের ধর্ম, আমিও আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছি মাত্র।
এই সময় দূরে কিছু কোলাহল শোনা গেল। তবে কি রক্ষীদল এই দিকেই আসছে? সুরপতি দেখল আর অপেক্ষা করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। সে প্রস্থানের উদ্যোগ করে বুধনাথের উদ্দেশে বলল, বিদায়।
বুধনাথ কাতর ভাবে বলল, যেও না! যেও না! আমি আসছি, তুমি আমাকে একটু সাহায্য করে। বুধনাথ তালগাছের ওপর উঠে এল। তার এক হাতে জোর নেই, তাই তাকে অতি সাবধানে আসতে হয়। ডগার কাছে এসে সে খুব ভয় পেয়ে গেল। এখান থেকে লাফিয়ে পড়া খুবই বিপজ্জনক। কিন্তু দূরের কোলাহলটা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। আর দেরি করার উপায় নেই।
সে-ও সুরপতির মতো ঝুলে পড়ল। কিন্তু এক হাতে সে শরীর দোলাতে পারছে না। তার বিশাল শরীরের ভার ওই এক হাতে ধরে রাখাও যাচ্ছে না। সে চিৎকার করে বলল, বংশীলাল আমাকে ধরো, আমি পারছি না।
সুরপতি জলের মধ্যে খানিকটা নেমে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়েও হাতটা গুটিয়ে নিল।
তারপর সে দৃঢ়স্বরে বলল, না। বুধনাথ, তুমি কোনও দিন কারুর সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়েছ? তবে আজ কেন নিজে সাহায্য চাইছ? এইমাত্র তুমি তোমার পুরনো সঙ্গীদের ফেলে এলে।
বুধনাথ আর্তনাদ করে বলল, বাঁচাও। আমি আর পারছি না। তুমি যা চাও, তাই দেব। আমার এখন অনেক ধনরত্ন লুকোনো আছে, তোমাকে সব দেব, বাঁচাও বংশীলাল।
সুরপতি বলল, আমার নাম বংশীলাল নয়। আমি সুরপতি। বল্লারপুরের কাছে জঙ্গলের মধ্যে তুমি আমার স্ত্রীকে ধর্ষণ করেছিলে, আমারই চোখের সামনে।
বুধনাথ বলল, তুমি আমাকে একশো ঘা চাবুক মেরো, আমি তোমার ক্রীতদাস হয়ে থাকব, বাঁচাও, আমার হাত ছিঁড়ে যাচ্ছে।
সুরপতি বলল, কুকুর, তুই যার জীবন নষ্ট করে দিয়েছিস, তার কাছেই আজ আবার নিজের প্রাণভিক্ষা করছিস?
বুধনাথ বলল, তুমি আমার নাকটা কেটে দাও, কান দুটো কেটে নিও, তবু আমাকে বাঁচতে দাও, আমাকে শুধু প্রাণে বাঁচিয়ে রাখো।
আমার স্ত্রী বিষ খেয়ে মরতে চেয়েছিল, তুই তবু তাকে —
তুমি আমার চোখ দুটো অন্ধ করে দিও। আমার পুরুষত্ব নষ্ট করে দিও, তবু তুমি আমার প্রাণটা শুধু ভিক্ষে দাও, আমি আর পারছি না। আমার হাত ছিঁড়ে যাচ্ছে, পারছি না, বাঁচাও।
নিচের দিকে চেয়ে দেখ কুকুর! এই নদীর জল তোকে কামড়ে খেয়ে ফেলবার জন্য হাঁ করে আছে।
আমাকে বাঁচাও, আমার যা ধনরত্ন আছে, তাতে তোমার সাত পুরুষ সুখে থাকবে, সব তোমাকে দেব, আমি পথের ভিখির হয়ে থাকব।
ভিখারিরও হৃদয় আছে, তোর তা-ও নেই, তুই বেঁচে থাকার যোগ্য নোস।
অসম্ভব মনের জোর বুধনাথের, সে এখনও এক হাতে ধরে আছে গাছটা। যদি একবার শরীরটা দোলাতে পারে, তাহলেই এ-পারের দিকে এসে লাফিয়ে পড়বে। সেইটুকুই সে পারছে না। তার ভারি শরীর, তার একটা হাত অকেজো।
বুধনাথকে মারার জন্য সুরপতি নদীর কিনারা থেকে একটা বড় প্রস্তরখণ্ড তুলল, কিন্তু সেটা ছুঁড়ে মারার আগেই বুধনাথের হাত ছেড়ে গেল, সে ঝুপ করে গিয়ে পড়ল জলের মধ্যে।
বুধনাথ পায়ের তলায় মাটি পেল না। বিকট আঁ-আঁ শব্দ করে সে স্রোতে ভেসে যেতে লাগল। নদীর মধ্যে মাঝে মাঝে মাথা জাগিয়ে আছে বড় বড় পাথব। তারই কোনও একটাতেই মাথায় ধাক্কা লাগায় একটু বাদেই বুধনাথেব কণ্ঠস্বর থেমে গেল।
সুরপতি জল থেকে উঠে মাটির ওপর বসে পড়ল। উত্তেজনায় তার নাক দিয়ে বিরাট বিরাট দীর্ঘশ্বাস পড়ছে। চোখ দুটি যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তার শরীরে অসম্ভব ক্রোধ এসে গিয়েছিল। বুধনাথকে সে নিজের হাতে খুন করতে চেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত যে বুধনাথের রক্তে তারহাত রঞ্জিত হলনা। সেটা এক হিসেবে ভালই। তার প্রতিশোধ নেওয়া হয়েছে, কিন্তু বীভৎস কিছু করতে হয়নি। সে বুধনাথকে বাঁচার সুযোগ দেয়নি মাত্র, কিন্তু হত্যা তো করেনি!
সুরপতি খুবই ক্লান্ত বোধ করছিল। কিন্তু আর দেরি করার উপায় নেই। ও-পারে খানিকটা দূরে এখনও মশালের আলো দেখা যাচ্ছে। আবার সে উঠে দৌড়াতে দৌড়াতে বনের মধ্যে মিলিয়ে গেল।