৪. সুন্দর সুন্দর কাণ্ড-কারখানা, বৃহস্পতিবার
অজস্র কাকের ডাকে ঘুম ভাঙল । বেশি রাত হওয়ায় স্লিপিং পিল খেয়েছিলুম কাল । ভালো ঘুম হয়েছে । মশারির ভেতরে বসেই দেখলুম অঞ্জলিদির বাড়ি, কাস্টমসের চ্যাটার্জির বাড়ি, কাকে চেয়ে আছে । কাকেদের র্যালি । সলিলা নিজের যোগব্যায়াম আরম্ভ করে দিয়েছিল । বলল, পাঁচ-ছ’টা হনুমান এসেছে, আমার ফুলগাছগুলোর দফারফা করে দিয়েছে নিশ্চই এতক্ষণে । পুকুর পাযের দিকের জানলা দিয়ে দেখলুম, অঞ্জলিদির আমগাছে ফিকে-সবুজ বহুলের গন্ধে মৌতাত মৌমাছিরা দোল খেত, তার আর বিশেষ-কিছু অবশিষ্ট নেই । ওপরতলা থেকে স্বর্গীয় সাধনবাবুর নাবালক নাতি দিগন্তর চেঁচামেচি শুনতে পেলুম, স্কুলের গাড়ির অপেক্ষা করার জন্য হনুমানের ভয়ে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে চাইছে না । রাস্তার দিকে এসে দেখলুম, দোতলায় দীপ্তিদির বারান্দায় একটা কেঁদো হনুমান শিবুর চায়ের দোকানের দিকে তাকিয়ে বসে আছে । চায়ের ঠেকের বেঞ্চ ফাঁকা । দীপ্তিদি আর ওনার স্বামীর একই সঙ্গে মৃত্যু হওয়ায় দোতলাটা বন্ধ পড়ে আছে ক’বছর । রাত্তিরে ইঁদুর রাজত্বের আওয়াজ পাই।
ফিজিওথেরাপি করতে ইচ্ছে করছিল না । করলুম । কতকাল হনুমান দেখিনি । দেখে মামার বাড়ির কথা মনে পড়ল । ছোটোবেলাকার । পাটনাতে ছোটোবেলায় বাঁদর আসত । ছোটোবেলাকার স্মৃতি আপসেট করে দিলে ।
দুধ গরম করতে আর চায়ের জল বসিয়ে দাঁত মেজে নিলুম । ফ্রিজে দেখে নিয়েছি, বাজার যাবার দরকার নেই, অনেককিছু মজুত ।
চা খেতে-খেতে কালকে যে চিঠিগুলো এসেছে, সেগুলো রেসপণ্ড করলুম ।
আশুরালি গ্রামোন্নয়ন পরিষদের সম্পাদক অমৃতলাল পাড়ুই, পরিষদের পত্রিকার জন্য ‘বর্তমান গ্রামজীবনে হাংরি আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা’ বিষয়ে একটা প্রবন্ধ চেয়েছেন । ভালো লাগল । এভাবেও তাহলে চিন্তা করা হচ্ছে । লখনউ থেকে মে মাসে ফিরে ভাবব কী করা যায় । গ্রামোন্নয়নের বিষয়ে পরামর্শদাতা হবার অনুরোধ করেছেন। অবসর নেবার পর গ্রামোন্নয়ন আর তার রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগ কমে এসেছে । উত্তর লিখে দিলুম ।
কমল চক্রবর্তী ‘কৌরব’-এর জন্যে সপ্তার সাত দিন কী ভাবে কাটাই লিখে পাঠাতে বলেছে । এক সপ্তাহের রোজনামচা । সব্যসাচী দেব ‘দেশ’ পত্রিকায় পঞ্চাশজনের তালিকায় কমলের পাঠকৃতি উল্লেখ করেননি । প্রাক্তন নকশালরা পশ্চিমবঙ্গের লায়াবিলিটি । বিভিন্ন রাজ্যের দুর্গম অঞ্চলে এঁদের পুনর্বাসন দেয়া যায় না কি ? অভিজ্ঞতার জন্য ? কমল বড় দয়ালু, কাউকে আঘাত দিতে চায় না । যদিও সবাইকে তোয়াজ তদবির করে । ‘আজকাল’ পত্রিকা পুজো সংখ্যার জন্যে কমলের উপন্যাস চেয়েছিল । সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ল্যাং মেরে দিয়েছেন ; অথচ কমল কত-কত চিঠি দিয়েছে সন্দীপনকে আনুগত্য জানিয়ে । কমলকে পরে চিঠি লিখব ।
‘অজন্তা’ পত্রিকার সম্পাদক রজতশুভ্র গুপ্ত অনুমতি চেয়েছেন আমার পাঠানো কবিতা ‘পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে বাঁচাতে হলে লিরিক লেখকদের হত্যা করতে হবে’ শিরোনামটা ছোটো করে ‘লিরিক লেখকদের হত্যা করতে হবে’ অংশটা বাদ দেবার জন্য । এমব্যারাসমেন্টের কারণটা বুঝতে পারলুম না । আমি কি বার্ধক্যে আক্রান্ত ? রজতশুভ্র তো আমারই বয়সী !
সকালে চিঠিপত্র নিয়ে বসলে পড়াশুনা ব্যহত হয় । একটু পরে সম্ভবত সুকান্ত ঘোষাল আসবে ‘চারুলতা’ পত্রিকার জন্য কবিতা নিতে । কপি করলুম কবিতাটা । ‘চারুলতা’ বইমেলা সংখ্যাটা পড়িনি এখনও । অনেক পত্রিকা জমে গেছে । সবকটা পুরো পড়া হয়ে উঠবে না । সুকান্ত কাজ করে কলকাতা পুরসভায় । অমন একটা পাঁকে চাকরি করে মিষ্টি-মিষ্টি কবিতা লেখা চাড্ডিখানি কথা নয় ।
বিশ্বাসকারীরা অবিশ্বাসীদের মগজে ঈর্ষার উদ্রেক করে কেন ?
তাবৎ শ্রোতাকে ‘বন্ধুগণ’ সম্বোধন কবে থেকে শুরু হল ? বন্ধুগণ, পোঁদে লাথি নিন ।
সলিলা বলল, ‘আজ বোধহয় সরস্বতী আসবে না ।’ কালের বউ । দু’জন মাত্র । তাই অসুবিধে নেই । সরস্বতী হিন্দু না মুসলমান, সলিলার সন্দেহ আছে, কেননা বাংলাদেশি মুসলমান ছাড়া সস্তার ঝি পাওয়া যায় না । হিন্দু ঝিদের রেট আর ন্যাকরা বেশি ।
ব্রেকফাস্ট সলিলাই রেডি করল, আমি কাগজপত্র ছড়িয়ে বসে আছি দেখে । শশা, পাঁউরুটি । ব্লাডপ্রেশার আর হার্টবিটের অ্যাংমলোপিন, লোপ্রিন, ডিলকনটিন, অ্যানজিনেক্স, লিসটিরিল, ফ্ল্যাভিনডন ।
টেলিফোন বাজল । প্রতিবেশী চৌধুরীর স্ত্রী । কাজের বউ এসেছে কি না জানতে চাইলেন । বললেন, ‘আজকে আবার চাদর-মশারি ডুবিয়েছি।’ এ-পাড়ার যাংবতীয় গাছগাছালি কাটিয়ে সাফ করে দিচ্ছেন চৌধুরীবাবু । কলকাতার ওপর অধিকার ব্যক্ত করার অবচেতন ডায়াসপোরিক বহিঃপ্রকাংশ ।
কলিংবেল । ‘কাভিতা’ পত্রিকার ষাটোর্ধ সম্পাদক সুপ্রিয় বাগচি । ওর দাদা নারায়ণ বাগচি মারা যাওয়ায় বেশ বিপর্যস্ত । দশ-পনেরোটা বেড়ালের মধ্যে একটা কাল মরেছে, আর একটা পালিয়েছে, তাই মন খারাপ । দাদা মারা যেতে নিচেতলার জবরদখলকারী পরিবারগুলো ওকে উৎখাত করে ওপরতলাটা দখল করতে চাইছে । রাতদুপুরে টালি খুলে নিয়ে চলে যায় । কাঠের সিঁড়িটার কয়েকটা ধাপ ভেঙে দিয়েছে তারা । নে, এবার ওঠ ওপরে । গেটে তালা মেরে দ্যায় যাতে ও বেরোতে না পারে । অভিযোগ নিয়ে এক কমরেডের কাছে গিয়েছিল । তা তিনি নাকি বলেছেন, ‘দ্যাখেন আমি তো উদ্বাস্তুদের নেতা আর আপনে এ-দ্যাশের লুক…।’ বেচারা সুপ্রিয় । নিজের কথা বলে চলল । প্রতিবার একই কথা । যেতে-যেতে বলল, একা থাকতে-থাকতে পাগল হয়ে যাচ্ছে ও । তারপর হঠাৎ, ‘বিয়ে করছি ।’
সুপ্রিয় বাগচি যে বাড়িটার ওপরতলায় থাকে তার নাম ডালগিশ হাউস । ডালগিশ নামে এক ব্রিটিশ সায়েব থাকতেন বাড়িটায় । সুপ্রিয়র ঠাকুর্দা তাঁর সচিব ছিলেন । দাদু মারা যাবার পর সুপ্রিয়র মা-বাবা থাকতেন ওদের নিয়ে । তারপর তো দেশভাগ হল ; অত বড় বাড়ির নিচেতলাটা দখল করে নিলে উদ্বাস্তু পরিবাররা । সেসব পরিবারকে খাবার-পরার খরচ যোগাতেন তাঁরা । তাঁরা মারা যেতে সুপ্রিয় আর ওর দাদা পড়েছিল বেকায়দায় । দাদা তো দিব্বি কেটে পড়ল । এখন অনাথ সুপ্রিয় বিয়ে করে সনাথ হতে চাইছে ।
মুর্শিদকে টেলিফোন করলুম । ‘নামগন্ধ’ উপন্যাসটা ঢাকা থেকে এসে গেছে জানাল । ‘ক্যাম্প’-এ পাওয়া যাচ্ছে । শনিবার এনে দেবে । ‘দিশা’ পত্রিকার দামটা দেয়া হয়নি ওকে । জহর সেনমজুমদার আর শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিল ‘দিশা’ পত্রিকা নিয়ে আসবে আড্ডা দিতে । ওদের বলা হয়নি মাসখানেকের জন্যে বাইরে যাচ্ছি । ‘রক্তকরবী’ পত্রিকার প্রদীপ ভট্টাচার্য ‘নামগন্ধ’ উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি পড়ে বলেছিলেন, ‘ও তো সেই একঘেয়ে অরিন্দম আর অতনু।’
পুরো সকালটা নষ্ট হল । লেখা, পড়া, কিছুই হল না । সওয়া বারোটা বাজে । ঝুল হয়েছে বেশ, দেখে, ঝেড়ে ফেললুম । সিঁড়ির মুখটাও ।
রান্না সেরে সলিলা বাথরুমে । বলল, ভাত চাপিয়ে দাও, আর জামাকাপড় কি আছে কাচাকাচির দিয়ে দাও । শর্টস আর গেঞ্জি খুলে দিয়ে দিলুম । উলঙ্গ । ভাতের জল চাপালুম । এই ফ্ল্যাটটার চারিদিক খোলা হওয়া সত্ত্বেও উলঙ্গ থাকা যায় । এই সময়টা উলঙ্গ থাকার অভ্যাস হয়ে গেছে । আঠারো মিনিটে হয়ে গেল ভাত । ফ্যান গেলে উপুড় করে রাখলুম ডেকচি । ফ্রিজের জল বাইরে বের করে রাখলুম যাতে খাবার সময়ে নাতিশীত লাগে ।
তোয়ালে পরতে হল । কাচা কাপড়গুলো শুকোতে দিলুম বারান্দায় । সামনের বাড়ি থেকে মনুর বিধবা ননদ, একা থাকেন, রোজই দেখেন কাপড় সোকাচ্ছি, আজও দেখলেন । আমার হার্টঅ্যাটাক হতে সলিলাকে বলেছিলেন, ‘একা কী করে কাটাবে?’ মনু সলিলার জামাইবাবুর বোন । উনিই এই ফ্ল্যাটটা কিনিয়েছিলেন । স্বামী, যিনি অতীব সুপুরুষ এবং বেকার ছিলেন, মারা গেছেন । মনু অফিসে চলে গেলে ওর বড় ছেলে নিজের বাজনাদলের মহড়া জমায় । ‘ম্যায় তো রাস্তে পে যা রহি থি’ চলছে পুরো দমে ।
তোয়ালে কাঁধে ফেলে ডাইনিং টেবিল সাজালুম । চান করলেই খিদে পায় । কালকের চচ্চড়িটা ফ্যানের ডেকচির ওপর রেখে দিলুম । সামান্য আচারের তেলে সাঁতলে নিলে চচ্চড়ির স্বাদ-সুগন্ধ হত । কিন্তু বারণ । ইলিশ, চিংড়ি, রেডমিট, কাঁকড়া, আচার, তেলেভাজা, বিয়ার, ভেরমথ, ওয়াইন, মাখন, ডিম ।
চান করে খেয়ে নিলুম । অনেক আইটেম । নিমবেগুন, পালংশাক ভাজা, চচ্চড়ি, বেগুন আলু সজনেডাঁটা, কাতলা মাছ, টমাটোর চাটনি, দই । শেষের দুটো যদিও বারণ ।
নিচে থেকে ডাকবাক্স খুলে ‘সাহিত্য সেতু’ আর ‘অনুত্তর’ পত্রিকা নিয়ে এলো সলিলা । আর অড্রীশ বি৯শ্বাস, কাজল সেন, নাগপুর থেকে বড়দির চিঠি । মনু এই বড়দিরই ননদ ।
কার্তিক ঠাকুর সম্পর্কে অসাধারণ প্রবন্ধ ছেপেছেন জগবন্ধু কুণ্ডু ; জানতুম না কলকাতার উকন্ঠে কার্তিকের এমন রমরমা । সমুদ্রগুপ্তের ষণ্ডামার্কা কালোপাথরের কার্তিককে নিজের ছোটোছেলে মহাদেবের আদলে ফর্সা আর সৌম্যকান্তি জমিদারি রূপ দিয়েছিলেন লক্ষ্মীকান্ত । ‘নামগন্ধ’ উপন্যাসের ব্যাকড্রপ রাঢ় রেখেছিলুম । এই এলাকায় সবচেয়ে বেশি ঘোরাঘুরি করেছি । আমাদের পূর্বপুরুষ রত্নেশ্বর রায়চৌধুরী শ্যাওড়াফুলির রাজা মনোহর রায়চৌধুরীর কাছ থেকে চকবালির অংশ পেয়ে উত্তরপাড়া শহরের পত্তন করেছিলেন । তাও একটা কারণ । তাছাড়া ঠাকুর্দার বাবা বিধবা বিয়ে করেছিলেন । লক্ষ্মীকান্ত রায়চৌধুরী, যিনি সাবর্ণ চৌধুরীদের আদিপুরুষ, তাঁর ঠাকুর্দা পঞ্চানন গঙ্গোপাধ্যায় হুগলির গোহাট্য-গোপালপুরে থাকাকালে যোগ দিয়েছিলেন হুমায়ুনের সৈন্যবাহিনীতে ।
এখন তো প্রেমে না পড়লে ছেলেরা বিধবা বিয়ে করবে না । আর তখনকার দিনে নিগোশিয়েট করে বিধবা বিয়ে । সামাজিক সাহস এখন মস্তানিতে এসে ঠেকেছে । অধঃপতনের নাম প্রগতি । অনুশ্রী পাঞ্জাবি ছেলে প্রশান্তকে বিয়ে করে উচিত কথাই বলেছিল, ‘দ্য ব্লাড স্পিকস ফর ইটসেল্ফ’ ঠাকুর্দার বাবার দ্রৌঐর সঙ্গে সম্পর্ক জুড়ে ।
যৌধেয়, কুষাণ, গুপ্ত সম্রাটদের কালো রণদেবতা কলকাতার উপকন্ঠে এসে ফর্সা লালটুশ চেহারায়, কোঁচানো জরিপাড় ধাক্কা-দেওয়া ধুতি আর কল্কাদার পাঞ্জাবি গায়ে মোমমাজা গোঁফে কার্তিক ঠাকুরে রূপান্তরিত । দেবতার নামও বাবু কার্তিক, হুগলির বাজার ঘাতে আড়াইশ বছর পুজো হচ্ছে । মহাকালীতলা, রথতলা, সুরকিমিল, খামারপাড়ায় পূজিত দেবতার নাম জামাই কার্তিক । রাজা কার্তিক, অর্জুন কার্তিকও রয়েছেন । মাল্টিভোকাল কার্তিক ঠাকুরের অঞ্চলে সাহিত্যভাষার উদ্ভব স্বাভাবিক । জামাই কার্তিক আসলে লক্ষ্মীকান্তর বড় জামাইয়ের আদল । দেবী-দেবতারা যখন প্রকৃতির অংশ ছিলেন, তখন তাঁদের মুখাবয়ব-আকার ছিল অস্বাভাবিক, অলৌকিক । ইংরেজরা এনলাইটেনমেন্ট এনে পুরো ব্যাপারটা মানবিকে পালটে ফেলেছে । বাঙালির ডায়াসপোরিক সমাজে পচন যত বাড়ছে, হুজুগের দেবী-দেবতারা তত চিত্রতারকা-সুলভ হয়ে উঠছেন । প্রতিটি অঞ্চল তার নিজের ঠাকুর স্পনসর করছে । এর ব্যাখ্যা কী ?
ভাত খাবার ঝিমুনি আসায় মিনিট চল্লিশেক ন্যাপ নিই । স্বপ্নে পাটনার ছোটোবেলাকার ইমলিতলায় পৌঁছে গিয়েছিলুম । ভাই-বোনরা সবাই শোর তুলেছি, ‘কার্তিক ঠাকুর হ্যাংলাআআআআ, একবার আসে মার সঙ্গে, একবার আসে একলাআআআআ ।’
উঠে, পেয়ারা কেটে, নিয়ে গিয়ে দেখলুম, টিভি দেখতে-দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছে সলিলা । টিভি চলছে । বাংলা সিরিয়াল কোনো ।
সিএনএন-এ খবর দেখলুম । যুগোস্লাভিয়া টুকরো হয়ে খ্রিস্টান আর মুসলমানের খুনোখুনি চলছে তো চলছেই । আয়ারল্যাণ্ডে প্রটেস্ট্যান্টরা ক্যাথলিক নেতাকে বোমা দিয়ে উড়িয়েছে । ইজ্রায়েলে ইহুদি ধার্মিক নেতা কোটি-কোটি টাকা মেরে জেলে যাচ্ছে । আমেরিকায় একই ব্যাপার করেছে খ্রিস্টান কৃষ্ণাঙ্গ নেতা । হোলিফিল্ডের বক্সিং-এ জোচ্চুরি হয়েছে । ইউরোপীয় কমিশনে সবাই স্বজনপোষণ করেছে, টাকা উড়িয়েছে । সিডনি অলিম্পিকের জন্যে আই ও সি সদস্যরা টাকা খেয়েছে, মাগিবাজি করেছে । অর্থাৎ পৃথিবী ঠিকঠাক চলছে ।
চ্যানেল সারফিং করলুম । অস্ট্রেলিয়ায় টু-পিস পরে ব্যায়াম । ন্যাশানাল জিওগ্রাফিতে ‘গোরিলাজ ইন দি মিস্ট’ । এ এক্স এন-এ চুম্মাচাটি । জি-তে গোবিন্দা-রাবিনা । এ-তে দলিপকুমার-নার্গিস । ডিসকভারিতে ইলেকট্রনিক্স । বিবিসিতে হলিডে । ভি-তে বয় জোনস, ব্যাকস্ট্রিট বয়েজ, চের, সিলিন ডিয়ন । এটিএন-এ বেঁটেমোটা-মুটকি বাংলাদেশী নাচ । ষাঁড়ের ডালনা খেলে কি এরকম বেঁটেমোটা হয়ে যান তরুনীরা ? মরেলিন মনরো হননি, তার কারণ উনি বিফস্টিক খেতেন, মশলাহীন মাংস ।এমটিভিতে থামলুম , শেনাজের মোস্ট ওয়ান্টেড, বরজাতিয়ার আব্বাস আর প্রীতি । প্রীতি ঝংগিয়ানি । অসাধারণ ইনোসেন্স, এরকম বাঙালি যুবতী দেখিনি এখনও ।
চা আনল সলিলা ।
বেড়াতে বেরোলুম । সান্ধ্য ভ্রমণ । ছবি বিশ্বাসের বাড়ি, অর্থাৎ বাঁশদ্রোণী বাজার, নাকতলা হয়ে ফেরত । দামোদরের দোকান থেকে সিঙাড়া ভাজার গন্ধ আসতে , চারটে কিনলুম । যদিও বারণ । অফিস থেকে ঘর্মাক্ত গৃহবধুরা ফিরছেন । শেতলা মন্দিরের পাশে ডাবের খোলার ঢিপি । পযঅর অমলদা হাতজোড় করে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে । অদৃশ্য দরখাস্ত করছেন ।
চান করে পড়ার টেবিলে বসলুম । বাকার্ডি ছিল সামান্য । তার সঙ্গে রয়াল স্ট্যাগ মিশিয়ে নিলুম । সলিলাকে দিলুম একটু লেমন স্কোয়াশ মিশিয়ে । শ্রীধর আগামী ‘অনার্য সাহিত্যের’ জন্য গল্প চেয়ে রেখেছে । তার খসড়া করে ফেললুম একটা । নাম দেবো ‘জিরো নম্বর মানুষ’ । সুরজিৎ সেনের সঙ্গে আড্ডার সময়ে ছকটা এসে গিয়েছিল মগজে ।
আমার কবিতা-পাঠক, গল্প-পাঠক, প্রবন্ধ পাঠক, উপন্যাস-পাঠক, নাটক-পাঠক, সব আলাদা আলাদা । শুধু বিশ্বজিত সেন, অজিত রায়, শঙ্করনাথ চক্রবর্তী আর প্রবীর চক্রবর্তীই বোধহয় টোটাল পাঠক । অদ্রীশকে লিখলুম কোন-কোন পত্রিকায় প্রবন্ধ বেরিয়েছে । কাজল সেনকে কবিতা পাঠাবার জন্য কপি করলুম । অজিত রায় ‘যৌনতা’ নিয়ে লেখা চেয়েছিল । ওকে লিখলুম অতনু দাসের ‘ছন্নচাড়া’ পত্রিকায় লিখে ফেলেছি ইতিমধ্যে । ‘ছন্নছাড়ার’ সংখ্যাটা বারাসতের এসডিও ব্যান করে দিয়েছিল স্হানীয় কমরেডদের চাপে, তারপর ওরা মহাকরণে গিয়ে চেঁচামেচি করতে ব্যান তুলে নেয়া হয় । অথচ বামপন্হীদের বিরুদ্ধে বা সরকারের বিরুদ্ধে কিছুই নেই সংখ্যাটায় । স্তালিনের হস্তমৈথুন থেকে কত যে কীট নর্দমা বয়ে পশ্চিমবাংলায় এয়েচে, কেউই জানে না ।
লিরিক সম্বন্ধে ফার্নান্দো পেসোয়ার লেখাটা পড়লুম । বাঙালিরা ন্যাকামিকে মনে করে লিরিক । ঘুমটা আসছে । উঠে পড়লুম । মশারি টাঙালুম ।
তিনটে রুটি । আলুপটল । এঁছোড়ের শুকনো তরকারি । দাঁত মেজে বিছানায় ।
‘জিরো নম্বর মানুষ’ গল্পটা এরকম :
জিরো নম্বর মানুষ
ইংরেজগুলো আসার আগে চট আর পাট তো একই জিনিস ছিল না । শনের সুতোর মোটা কাপড় ছিল চট, এখন যা দিয়ে গানিব্যাগ তৈরি হয় মিলগুলোয় । বিদ্যাপতি লিখেচিলেন, ‘চটের চান্দয়া খসায় চটের মসারি।’ চট কথাটার মধ্যেই কেমন একটা ছ্যাঁচড়ামি লুকিয়ে । চটকলের সাইনবোর্ড-সর্বস্ব ট্রেড ইউনিয়ানগুলো কথাটায় নিজেদের পাঁয়তাড়া ঢুকিয়ে আরও নোংরা করে দিয়েছে, একেবারে ভ্রষ্ট, পতিত, উদ্ধারের অযোগ্য । সাইনবোর্ড হল ক্ষমতার উৎস । তাতে থাকে মসনদের ছাপ্পা, তাই । বোর্ড ঝুলিয়ে, চেয়ার-টেবিল পেতে ফ্যালো, মসনদি রঙের ঝাণ্ডা ওড়াও, ব্যাস, যত ইচ্ছে অন্যদের বুকনি ঝাড়ো, মাইকচোঙে বকমবকম বকে যাও ।
পাটের জন্নত থেকে চটের জাহান্নমে পৌঁছে দেবার জন্যে কাকে যে দায়ি করবেন, জানেননি খালেদালি মণ্ডল । বিলেতের মেম-সায়েবগুলোকে ? যাঁরা লাটবাহাদুরের পেছন-পেছন স্কটল্যাণ্ডের ড্যাণ্ডি থেকে এসেছিলেন চটের ব্যবসা করতে ? জর্জ অকল্যাণ্ড নামে লোকটাকে, যেনি ১৮৫৫ সালে হুগলি জেলার রিষড়েতে প্রথম চটকলটা পত্তন করেছিলেন ? খালেদালির দাদুর আব্বা ঢুকেছিলেন মিলটায় কুলি হয়ে । হেল্পার হয়েছিলেন । দাদু তো হয়েছিলেন সরদার । সরদার ওঁদের পদবি নয়, তবু দাদুর নাম হয়ে গিয়েছিল হেদায়েত সরদার ।
হেদায়েত সরদারের বাপ পাটতাঁতি ছিলেন । পাটের তাঁত । বিশ্বাসই করতে চান না খালেদালির ছেলে-মেয়েরা যে, পাটের তাঁত ছিল এককালে । সে তাঁতে চটকাপড় বোনা হত না । বোনা হতো পাটের শাড়ি । যিনি পরতেন তিনিই তো ছিলেন রাজার পাটরানি । বিলেতি সায়েবরা আসার আগে আমাদের তো আর চেয়ার ছিল না ; ছিল গদি, চটের গদি, রাজার জন্য পাটের রেশমের ওপর সিংহের চামড়া, সিংহাসন । শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল পালায় আছে তো, ‘পাটে কংস নরবর’। সে কবেকার লেখা গান । আরেকটা পালাগান আছে দুর্গাপঞ্চরাত্রির, ‘রামচন্দ্র পাটে রাজা হইলা।’ কিংবা শূন্যপুরাণ পালায়, সুনার পাটেত বেসাতির বৈসয়ে হাট।’
এখন আর গাও না ক্যানে ?
গলায় চটের ফেঁসো ঢুকে জাম হয়ে গেচে । ও সব গান আর গলা দে বেরুবেনি । খালেদালির বউ আফরোজা জানান, তবলিগ পার্টি বলে গেচে, হিঁদুর গান গাইবিনি । বাপ আর মেয়ের কথাবার্তার মাঝে মাথা গলান তিনি, ছেলেমেয়ের নিকাশাদি আছে, সমাজে থাকতি হয় । আরে, ওদের কথা ছাড়ো, তবলিগ করছেন আবার সিপিএম করছেন । না, এখন তো তৃণমূল । এখানেও সেই সাইনবোর্ড । চটকলের সাইনবোর্ড-নেতাদের দায়ে তো মিলগুলো ডুবল । ডুববেনি ? প্রথম পোয়াতির বুক আর পাটের পোয়াতির মুখ ।
বলেচো ভালো । পাটের পোয়াতি, মানে যার ছেলেপুলে অনেক । আমাদের মিলে তো আঠারোটা ইউনিয়ান । আরও বিয়োবে শুনচি, ব্যালটের বিল পাস হবার আগে । সংস্হান নেই সংস্হা আছে ।
তোমাদের তো সিটু, ইনটাক, আইটাক, এলএস, এইচ এম এস, বি এম এস, এন এফ আই টি উ, এম এল ও সি আরও কী কী যেন ?
মিল গেচে বি আই এফ আর-এ, কিন্তু সাইনবোর্ড ব্যবসা চলচে পুরোদমে ।
ওঁরাই আবার চুক্তি তদারকির মনিটারিং কমিটিতে । আমেদালিটা মাধ্যমিক পাস করলে ছেড়ে দেব এই জিরো নম্বর ওয়ার্কার কুলিগিরি ।
চটকলের রেকর্ডে যে শ্রমিকের অস্তিত্ব নেই, তাঁরা জিরো নম্বর ওয়ার্কার । যতবার ধর্মঘত, লকআউট, সাসপেনশান অব ওয়র্ক হয়ে কারখানা বন্ধ হয়েছে, ততবার মিল খুলেছে মালিক বদল হবার পর । আর প্রতিবার স্হায়ী মজুর ছাঁটাই হয়েছেন । বেড়েছেন জিরো নম্বর ওয়ার্কার । জিরো ন্ম্বর ওয়ার্কারকে পুরো মজুরি দিতে হয় না । তাঁর জন্য পি এফ, গ্র্যাচুইটি, ই এস আই, ঝক্কি-ঝামেলা পোয়াতে হয় না । একটা পোস্টের জন্য দুটো করে শূন্য নম্বর কর্মী । কাংগাল চামার নামে মজুরটা পুলিশি হামলার পরে নিখোঁজ হয়ে গেলে, মিল যখন আবার খুলেছিল, তখন বদলি মজুরের কাজ থেকে ছাঁটাই হবে, ওই কাংগাল চামারের জায়গা ভরাট করতে ঢুকেছিলেন খালেদালি আর বৈকুন্ঠ নস্কর ।
এক জনের জায়গায় দুজনের কাজ । ‘দুই জনারে কাম পাইয়া দিসি কমরেড’ , বলেছিলেন এক ট্রেড ইউনিয়ানের নেতা । কী বারফট্টাই ভাটিয়া বাবুলোগদের । অন্য শ্রমিকরা তবু স্হায়ী, বদলি, স্পেশাল বদলি, ক্যাজুয়াল, কনট্র্যাক্ট হন । খালেদালি-বৈকুন্ঠরা কিছুই হন না । ওঁরা আছেন, কিন্তু নেই । খালেদালিও স্হায়ী ছিলেন । তারপর বদলি, স্পেশাল বদলি, ক্যাজুয়াল হয়ে জিরো নম্বরে নেবেছেন ।
১৯৭০ সালে কুড়ি দিনের ধর্মঘট হয়েছিল, সাত থেকে ছাব্বিশ ডিসেম্বর । ১৯৭৪ সালে ১৫ই জানুয়ারি থেকে ১৫ই ফেব্রূয়ারি, ৩১ দিন । ১৯৭৯ন সালে টানা পঞ্চাশ দিন, পাঁচ জানুয়ারি থেকে তেইশ ফেব্রূয়ারি । ১৯৮৪ সালে ষোলো জানুয়ারি থেকে সাত এপ্রিল, চুরাশি দিন । ১৯৯২ সালে জানুয়ারি মাসে । ১৯৯৫ সালে নভেম্বরে । প্রায় একই সময়ে দু-হাজার সালে । বাজারে কাঁচা পাট আসে জুন-জুলাইতে । প্রতি মাসে দাম বাড়ে । ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে দ্বিগুণ হয়ে যায় । ওই সময়ে ধর্মঘট হলে মালিকের সুবিধে । যাঁরা কাঁচা পাট খরচ করে ফেলেছেন, তাঁদের আর কিনতে হবেনি । দাম আক্রা । যাঁদের বেনামি গুদামে মাল আছে তাঁরা বিদেশে বেচে ডলার কামাবেন । কাঁচা পাটের গুদামগুলো মিল কমপাউণ্ডে নয়, তাই টের পাবার উপায় নেই । মালিকরা মিল চালান এক নামে, কাঁচা পাট কিনে গুদামে ঢোকান আরেক নামে । একই লোক, অথচ গুদাম থেকে মিলকে বেশিদামে কাঁচা পাট বিক্রি করেন যাতে মিলটা লোকসানে চলছে দেখান যায় ।
বৈকুন্ঠ নস্কর বলেছিলেন, খালেদ, তুই এত জানিস, সব ফাঁস করে দিস না কেন ?
ফাঁস ? কার কাছে ফাঁস ? সরকার জানেন, বিধায়ক জানেন, শ্রমমন্ত্রী জানেন, লোকাল ইউনিয়ান নেতা, কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ান নেতা, পার্টিগুলো, কাগজের লোকেরা জানেন । সব্বাই সবকিছু জানেন ।
ভগবান শুধু জানতে পারেন না ।
না, আল্লা জানবেননি, তা কখুনো হয় !
জানেন বলে খালেদালি আজ জিরো নম্বর। চটকলে আট ঘণ্টার কাজ শ্রমিকরা করেন দুটো শিফটে । চটের উড়ন্ত ফেঁসো আর ধুলোয় টানা আট ঘণ্টা কাজ করা অসম্ভব । প্রথম খেপে পাঁচ ঘণ্টা, তারপর কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে দ্বিতিয় খেপে তিন ঘণ্টা । কাংগাল চামার, থাকতেন কুলি ব্যারাকে, মিলের লাগোয়া, দুটো খেপ নিজেই করতেন । এখন পাঁচ ঘণ্টার খেপটা করেন খালেদালি আর তিন ঘণ্টার খেপটা বৈকুন্ঠ । ভাউচারে টিপছাপ দিয়ে মজুরির টুকরো-টাকরা পান । একজন টুকরো, অন্যজন টাকরা ।
হেদায়েত সরদার, খালেদালির দাদু, কুলি ব্যারাকে ঘর পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু খালেদের বাপ সেটা ভাড়া দিয়ে দ্যান এক প্রাইমারি স্কুল শিক্ষককে । শিক্ষকের বড় ছেলে ছাত্র ইউনিয়ানের নেতা, তাই ভাড়া পাওয়া যায় না । তাছাড়া, তিনটে জিনিস খুবই দিষ্প্রাপ্য, হাওয়া, জল আর আলো । আর নোংরা কুলি ব্যারাক, তাই থাকা যায় না অমন বাসায় । খালেদের বাপ নেয়ামতালি সাত কাঠা জমি কিনে দু-মাইল দূরে কোতলবেড়িয়ায় থাকতেন দুই বউ আর সাত ছেলে-মেয়ে নিয়ে । খালেদের ভাগে দেড় কাঠার ওপর কুঁড়েঘর । বিজলিবাতি হুকিং করে পাওয়া । কেরোসিন এত আক্রা যে হুকিং ছাড়া উপায় নেই ।
পাঁচ ঘণ্টার মজুরিতে চারজনের ছিয়ানব্বই ঘণ্টার পেট । বাকি সময়টা গান গেয়ে রোজগারের চেষ্টা । বলতে গেলে ভিকখে । কেউ যদি দ্যান তো দিলেন । বৈকুন্ঠ অন্তত ছুতোরের কাজটা ছাড়েনি । কাজের ফাঁকে, যদি পান ছুতোর মিস্ত্রির করার মতন কিছু, তিন ঘণ্টার খেপটা মেরে চলে যান । তাঁতির কাজটা খালেদালির শেখা থাকলে বাড়িতে সবাই মিলে গামছা-মোটাকাপড় তো বোনা যেত । যাঁরা স্হায়ী শ্রমিক তাঁদেরই, ১৮২৯ টাকা ন্যূনতম মজুরিতে, কাটৌতি বাদ দিলে, তো কথাই নেই, চলে না । একই কাজের জন্য, একই মজুরি পান না সবাই । শ্রমিক মানে তো শ্রমের দাস । অসুখ-বিসুখে পড়লে পাঁচ ঘণ্টার কাজটাই চলে যাবে । আঠারোজন ইউনিয়ান কত্তা তক্কে-তক্কে থাকেন সবসময় । কাউকে কাজ পাইয়ে দিলেই ভাগা দিতে হয় কত্তাদের ।
তিমি মাছ মারা বেশি করে আরম্ভ হল বলে পাট তাঁতিদের মরণ হয়েছিল দেড়শ বছর আগে । তিমির তেল দিয়ে চটের কাপড় ব্লিচ করা আবিষ্কার হতেই তো সুতির কাপড় বোনার কলে একটু অদল-বদল করে সায়েবরা তড়িঘড়ি চটকল বসাতে লাগলেন । ১৮৭০ সালে ওব্দি পাঁচটা চটকল বসে গিয়েছিল এ-তল্লাটে । একশ একটা চটকল ছিল দেশভাগের সময় ।
দেশভাগ ! কোনো মানে হয় ! কার কেমন নুনু সেই অনুযায়ী দেশভাগ । যাঁদের নুনুর খোসা ছাড়ানো, তাঁদের জন্য একটা দেশ । যাঁদের আস্ত তাঁদের জন্য আরেকটা দেশ । বাপ নেয়ামতের কাছে সেসব গল্পগাছা শুনেছেন খালেদ । উনি নিজে তো জন্মেছেন দেশভাগের দশ বছর পর । নেয়ামত ভিটেমাটি ছেড়ে যেতে চাননি । পাগল নাকি । জানি না, চিনি না, দেখিনি, সেখানকার জনমনিষির কথা বুঝিনে, কেন ছুটব সেখানে ? নুনুর খোসা ছাড়ানো বলে ? সে তো সারা দুনিয়া জুড়ে দেশে-দেশে অমন । সবাই উদিকে ছুটচে নাকি ? মারামারি কাটাকাটি অমন হয়ই । নিজেরাই সামাল দাও । বর্গিরা যখন আসত ত্যাখন তো নিজেরাই সামলিচি । তবে ?
সদামাল দিতে নেয়ামতের অসুবিধা ছিল না । গর্দা সাফাই কুলি ছিলেন নেয়ামতের দুই বউ । চটকলের গর্দায় যক্ষ্মা হয়ে মরেছিলেন বড়টি । ছোটটির চাকরি গেল ১৯৭৪ সালের ধর্মঘটের পর । সারা পশ্চিমবাংলায় চল্লিশ হাজার জেনানা শ্রমিককে খেপে-খেপে ১৯৭০ সালের ধর্মঘটের পর ছাঁটাই করে দিয়েছেন চটকল মালিকরা । বাঙালিরা যত আধুনিক হয়েছেন ততই কমেছেন নারী শ্রমিক । এখন উনষাটটা রুগ্ন মিলে হাতে গোনা কজন । ফুলটাইম চটকল শ্রমিক মা-বাপের ছেলে কিনা জিরো নম্বর কর্মী ।
চাকরি গিয়ে বেঁচে গিসলেন আম্মি । যেখানটায় সাফাই করার কাজ বরাদ্দ ছিল, সেখানেই ১৯৯৩ সালের ফেবরারিতে কারখানার ভেতর পায়খানার চেম্বার ফেটে মারা গিসলেন তিনজন কুলি । ইংরেজরা যাবার পর আর পোষ্কার হয়নি । মালিকের লোক বলেছিলেন, মিল তো চলে লোকসানে, পোষ্কার করবার ট্যাকা কোথায় । ইউনিয়ানের লোক বলেছিল, ‘আমরা কী করুম কন কমরেড, সটকলের হাল ভালো না, দ্যাখতাসেন তো থুঁকতাসে।’
ধুঁকতাসেন তো সবাই । কুলি লাইনে বর্ষাকালে যে পাঁক জমে, তাতে ফি-বছর আন্ত্রিকে মরে বাচ্চারা । দিনের বেলায় ডাঁশ ওড়ে । গতবছর ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ায় মরেছেন তিনজন উড়িয়া মজুর । জিরো নম্বর নয়, স্হায়ী ছিলেন তাঁরা । যাঁরা টিকে আছেন তাঁরাও ধুঁকতাসেন । রোজই ভয়ে-ভয়ে কাজে যান । গিয়ে হয়ত দেখবেন, গেটে কারখানা বন্ধের নোটিশ ঝোলানো । ইউনিয়ান নেতারা অফিস বন্ধ করে হাওয়া । খালেদালি অনেকবার দেখেছেন অমন কাণ্ড । মিল বন্ধ হলে যাদব, কুর্মি আর বিহারি মুসলমানরা লালু যাদবের রাজ্যে আলু চাষের কাজে চলে যান কিংবা কোনো ধান্দাবাজির ফিকিরে । খালেদালি আর কোথায় যাবেন । ব্যাণ্ডেল বর্ধমান শ্রীরামপুর হাওড়া কলকাতায় গান গেয়ে ভিককে করতে বেরোন । শহরের তুলনায় শহরতলীতে রোজগার বেশি । কুলিগিরি ছেড়ে ভিকিরি হবার লোভ পেয়ে বসে অনেক সময়ে ।
মিল বন্ধ হয়, আবার খোলে । আবার খুলবে, এই উদ্বেগে, আর হয়ত খুলবে না, এই আতঙ্কের মাঝে, দোল খান ওঁরা । সিধো কানহো ডহরে মজুরের কাঁচাপাকা চুল আর শিড়িঙ্গে মুখ আবিরে লাল-সবুজ হয় । নানা কিসিমের নেতা ভাষণ দেন সংগ্রামী সাফল্যের । তারপর আবার যে-কে সেই । বছর ঘুরতেই চুক্তি আঁস্তাকুড়ে । সব কর্মীকে জিরো নম্বর না করলে মিলের হাল ফিরবেনি । যে মিলে যত জিরো নম্বর সে চটকল তত ভালো চলে । তাঁরা ডিভিডেণ্ড বিলি করেন, মিল বন্ধ করতে চান না । ওই তো চাঁপদানি, ডেল্টা, একতা, বিড়লা, ল্যাডলো, কত ভালো চলছে, বিদেশে মাল যাচ্ছে, বাজারে শেয়ার ছেড়েচে ।
বৈকুন্ঠ নস্কর বলেছিলেন, আর কোনো কাজে জিরো নম্বর কর্মী নেই কেন বলো দিকিন ।
সত্যি তো, জিরো নম্বর প্রথানমন্ত্রী হন না কেন ? জিরো নম্বর সাংসদ ? বিধায়ক জিরো নম্বর ? জেলাধিপতি ? পঞ্চায়েত প্রধান ? মিলমালিক ?
আরে মিলমালিক তো জিরোর চেয়ে অধম, বলেছিলেন বৈকুন্ঠ ।
তা একখানা জবর বলেচ বটে । মিলটা তো বসিয়েছিল টমাস ডাফ । তারপর কিনলে হেনরি ব্রাউন । তারপর ব্রেইলি । সেই থেকে ভাড়ায় খাটছে মিলটা । মালিক বলে কিছু নেই ।
কখনো মেহতা, কখনো দুগার, বাজোরিয়া, সারদা, পাসারি । আসল বাচ্চা যে কার, কেউ জানে না । রাঁঢ়ের বাচ্চা ।
ফলে আবার ক্লোজার । খালেদালি মণ্ডল বেরিয়ে পড়েছিলেন ভিককের পর্যটনে । অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন টালা পার্কের কাছে, কলকাতায় । পেটে দানা পড়েনি কদিন । পাবলিক চ্যাংদোলা করে আর জি কর হাসপাতালে সোপর্দ করেছিলেন । কুড়ি দিন পর মারা যেতে তদন্তের জন্য গিয়েছিলেন পুলিশ মর্গে । ময়না তদন্তের কাটাছেঁড়ার পর কালো পলিথিন প্লাসটিকে মোড়া অন্ধকারে আবদ্ধ ছিলেন । খালেদের ছেলে আর কোতলবেড়িয়ার গ্রামবাসীরা সেই প্লাসটিক পুঁটলি নিয়ে ফিরেছিলেন গাঁয়ে । একটাই বডি ছিল, তাও ওনারা দ্যাখেননি প্লাসটিক খুলে । খুলতে সাহসও হয়নে । কেমনধারা কাটাছেঁড়া কে জানে । প্লাসটিকের গায়ে লেবেলে খালেদালি মণ্ডল নাম লেখা ছিল ।
কোতলবেড়িয়া পৌঁছে, শবকে পবিত্রকরণের জন্য বের করতে গিয়ে সবাই থ । কান্নাকাটি স্তব্ধ । এ তো খালেদালি মণ্ডল নয় । এর পায়ে তো দিবাকর যুগির লেবেল সাঁটা । ম্যাটাডর ভ্যানে শব চাপিয়ে আবার ফেরত পুলিশ মর্গে, কলকাতায় ।
নিয়ে যাবার সময় দ্যাখেন নাই কেন ?
স্যার, একটাই বডি ছেল । পলিথিনের ঢাকনায় আব্বার নামের লেবেল ছেল ।
ময়না তদন্তের পর থানা থেকে ডিসপোজাল অর্ডার বা দেহ নিয়ে যাবার আদেশের কাগজ দেখে তবেই মর্গ থেকে মৃতদেহ নিয়ে যেতে দ্যান ওয়ার্ডমাস্টার । ডিসপোজাল অর্ডার দেয়ার পরে তা নিয়ে ওয়ার্ডমাস্টার কিংবা ডোমেরা কী করছেন তা দেখার কাজ আমাদের নয়, বললেন পুলিশ ইন্সপেক্টর কালীশঙ্কর জানা । যান, ডাক্তারবাবুকে জিগেস করুন গিয়ে ।
ডাক্তার পার্থসারথি গুপ্ত, যিনি ময়নাতদন্ত করেছেন, জানালেন, আপনারা শোকে মূহ্যমান বলে হদিশ করতে পাংরছেন না । দেহটা আপনার বাবা খালেদালি মণ্ডলেরই । দিবাকর যুগির হলে তো সে দেহ ফেরত চলে আসত আগেই ।
স্যার এটা মুসলমান পুরুষের দেহ নয় ।
ডেড বডির আবার ধর্ম হয় নাকি ? আমাকে জ্ঞান দেবেন না । মৃতদেহ শনাক্ত করার পরেই তো মর্গের রেজিস্টারে সই করে নিয়ে গেছেন ।
কিন্তু এই দেহ তো আমাদের পক্ষে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় ডাক্তারবাবু । মুসলিম সম্প্রদায়ে মৃতকে বাড়িতে নিয়ে যাবার পর স্হানীয় মানুষ তাঁর মুখ দ্যাখেন । দেহকে চান করানো হয় । তারপর জানাজা বেরোয় ।
আমি আর কি করতে পারি !
কোতলবেড়িয়ার লোকজন পুলিশের বড়কর্তার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন । আহা, উনি তো আর ফিরবেন না, বিষয়টা মিটিয়ে ফেলুন না ।
মিটমাট ? কী বলছেন স্যার !
আচ্ছা আমরা দেখছি । দিবাকর যুগির ভেরিফিকেশানের জন্য ওয়ারলেস করা হয়েছে । কাল আসবেন । বডি মর্গে ফেরত দিয়েছেন ?
হ্যাঁ স্যার ।
অসুস্হ লোককে বাড়ি থেকে বেরোতে দেন কেন ? ওনার পকেটে এলিজাবেথ জুট মিলের কাগজ না থাকলে তো লাশ বেওয়ারিশ হয়ে যেত । তার ওপর আবার আমাদের কাছে জুট মিলের যে লিস্ট আছে তাতে তো দেখছি এলিজাবেথ মিলের কোনো উল্লেখ নেই । ডিসি সদর কথাগুলো বলার সময়ে সৎ ভাবেই বিরক্তি জানালেন ।
খালেদালির ছেলে আর ওনার কাকারা একযোগে আঁৎকে ওঠেন, কী বলছেন কী সায়েব, ওই চটকলেই তো কাংগাল চামারের নিখোঁজ হবার কেস হয়েছিল । সিবিআই এনকোয়ারি হয়েছিল । আদালতে মামলা চলছে আজ ক’বছর ।
টেবিলের ওপর থেকে পুস্তিকাটা তুলে পাতা ওলটান আমিনুল । উনিই একমাত্র ইংরিজি জানেন, শার্ট ফুলপ্যান্ট পরেন । বাকি সবাই লুঙ্গি-গেঞ্জি বা কুর্তা । আমিনুল, খালেদালির ছেলে ঘিরে, রুদ্ধশ্বাস ।
তালিকাটায়, পশ্চিমবঙ্গে চালু চটকলগুলোর লিস্টটায়, বারবার চোখ বোলান খালেদালির ছেলে, ওপর থেকে নিচে আর নিচে থেকে ওপরে । সত্যি এলিজাবেথ চটকলের নাম নেই । কাংগাল চামারের লাশের সঙ্গে মিলটাকেও হাপিশ করে দিয়েছে ।
সাদা ধুতি-পাঞ্জাবিতে এক চশমাচোখ টেকো কালো হোঁৎকা বসেছিলেন চুপচাপ । পুস্তিকাটা মৃতের ছেলের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে মন্তব্য করলেন, ‘ইংরেজগুনো বিদেয় হতেই চটকলগুনো বন্ধ করে দেয়া উচিত ছিল । যত্তোসব ক্রিমিনালের ডেন । কী উবগার হয়েছে শুনি বাঙালিদের ? মজুরগুনো তো সব উড়ে-খোট্টা-তেলেঙ্গি, আর মালিকগুনো মেড়ো কিংবা গুজু ।’
সিঁড়ি দিয়ে নাবতে-নাবতে মৃতের সৎভাই বললে, শালা বোধহয় নবোজাগড়নঅলা ।
মৃতের আত্মীয় জ্ঞাতি-প্রতিবেশিদের মগজ থেকে সে মুহূর্তে মৃতের উবে যাবার বদলে এলিজাবেথ জুটমিলের উবে যাওয়াটাই দুশ্চিন্তা হয়ে ঘিরে ধরেছে ।
মৃতের চাচা : মিলটাই কি না জিরো নম্বর করে দিয়েচে ।
মৃতের বড়ভাই : প্রথমে কাংগাল চামারের কোর্ট কেসকে জিরো নম্বর করেছেল ।
মৃতের ছোটোভাই : আলামোহন দাসের পর চটকলে তো বাঙালিরাই জিরো নম্বর ।
মৃতের সৎভাই : এবার পাট হতে চলল জিরো নম্বর ।
মৃতের ছেলে : লিজ কাকে বলে ?
মৃতের সহকর্মী : মাসে মাসে ভাড়া না দিয়ে একলপ্তে কিছুকালের জন্যে ।
মৃতের ছেলে : আর টেকওভার ?
মৃতের আরেক সহকর্মী : কাঁচা পাটের দাম অনেক বকেয়া পড়লে মহাজনের হাতবদল ।
মৃতের ছেলে : মালিকানা তো দেখলুম সিনেমা প্রযোজক আরন বিল্ডিং প্রোমোটারের ।
মৃতের চাচা : সব কাঁচা পাটের দালাল, শেয়ার মার্কেটে চটকলের টাকা খাটায় ।
মৃতের ছেলে : এরাই কি ক্রিকেট বুকি ? ইস্টবেঙ্গল – মোহনবাগান গড়াপেটায় খরচ যোগায় ?
মৃতের বড়ভাই : সল্টলেক আলিপুরের বাড়িগুনোও তো টেকওভার করেচে ।
মৃতের চাচা : কী টেকওভার করতে বাকি রেকেচে ?
মৃতের বড়ভাই : আমাদের কথাবার্তাও তো টেকওভার করে নিচ্চে ওরা ।
মৃতের সহকর্মী : ট্রেড ইউনিয়ানগুলোকে নিয়েচে ।
মৃতের ছেলে : পার্টিগুলোকে নিয়েচে ।
মৃতের সহকর্মী : পুরো দেশটাকেই জিরো নম্বর করে দিল ।
দিবাকর যুগি ছিলেন খেতমজুর । বৈদ্যনাথ পাল যে জমিটা পার্টিকে বলে-কয়ে বর্গা পেয়েছিলেন, তার নাবাল অংশটা ফি-বছর পাঁচ মাসের জন্যে পেতেন । বৈদ্যনাথবাবুর অন্য অংশে সারা বছর মাঙনায় কাজ করার মজুরি হিসেবে । মে মাসেও জল জমে থাকত বলে, শুকনো পাটকাঠি চুবিয়ে রাখার আর ফেঁসো বের করার সুবিধে । ফেবরারি থেকে মে কিংবা জুন । ধারকর্জ পালবাবুই দিতেন । উনি আরও অনেক চাষির পাট কিনে ব্যাপারিকে বেচেন । ব্যাপারি বেচেন আড়তদারকে । আড়তদারের মাল তোলেন পাটের দালালের লোক । তাঁরা চটকলের পাটমজুতদারকে বেচেন । মিল কেনে মজুতদারের কাছ থেকে । এত উঁচু সিঁড়ি থেকে পাটের দাম নাবতে-নাবতে দিবাকরের জন্যে বাঁচত না লাভ করার মতন কিছু । তারপর চটকলে ধর্মঘট ক্লোজার লকআউট সাসপেনশান অব ওয়র্ক তো আর দিবাকরকে আগাম জানিয়ে হয় না । তখন কাঁচা পাট যে দামে পারা যায় বেচে দিতে হয় দিবাকরকে । অথচ তখনই আড়তদারের কেনার ধুম । ঘন ঘন ট্রাক বোঝাই হয় । ধর্মকাঁটায় ওজন হয়ে চলে যায় ।
বদ্যিনাথবাবু জেনে নিতে পারেন ব্যাপারির কাছে, তোষা-তেইশি নাকি সাদা পাটের বীজ বুনলে লাভ । তোষা-তেইশির টিভি-তিন বীজ আর সাদার ডাবলু-তিন বীজের পাট বেশি দামে বিকোয় । আষাড় থেকে আশ্বিন ওব্দি হপ্তায়-হপ্তায় দাম বাড়ে । ব্যাপারি পরশুরাম সাহার গুদাম আছে তুফান গঞ্জে আর মাথাভাঙায় । আড়তদার চাপ না দিলে মাল ধরে রাখেন । বড় একটা পারেন না ধরে রাখতে । ফরোড ব্লক ছেড়ে সিপিয়েম করতে গিয়ে হ্যাঙ্গামে ফেঁসেছেন কমরেড বদ্যিনাথ । যে তল্লাটে যারা বেশি তাদের সঙ্গেই থাগগি যা না বাপু । তবে টিভি-তিন আর ডাবলু-তিনের একর প্রতি ফলনটা কম, বড্ড খেয়াল রাখতে হয় । তার চেয়ে টিভি-পাঁচ কিংবা ডাবলু-ছয়ের ফলন বেশি, আর প্যাঁকাটি পচতে ঝক্কি-ঝামেলা কম । কোমরজল ডোবাগুলোয় থাকতে-থাকতে পচা প্যাঁকাটি থেকে বাড়িসুদ্দু সবাই হপ্তা দুয়েকে পাট বের করে নাও । ভাদ্দর মাসের রোদে শুকুতে পারলে ডাবলু-তিন কি চারের পাট তো ঐ্যাকেবারে সোনার জল-চড়ানো রুপো, চোখ জুড়িয়ে যায় দেখে।
পাটের ভালোমন্দ ছাঁটাই করে বেল বানিয়ে ব্যাপারিই পাঠায় আড়তদারকে । সে ব্যাটা মারোয়াড়ি ব্যাবসাদার, প্রতিটি বেল ওজন করে দেখে নেয় পাক্কা আশি কিলো আছে কি না । বছর বিশেক আগে তো এক হেক্টরে পাঁচ-ছ বেল তৈরি মাল বেরোত । এখন সার আর কীটনাশক দিয়ে দশ-এগারো বেল মাল ওঠে । অথচ চাষির অবস্হা বছর-বছর খারাপ হয়ে চলেছে ।
জুট কর্পোরেশান এ-বছর থেকে পাট কেনা বন্ধ করে দিলে । বদ্যিনাথবাবু এর আগে বার দুয়েক জুট কর্পোরেশানকে মাল বেচার চেষ্টাচরিত্তির করেছিলেন । ব্যাপারি আরআর আড়তদার এমন ধাতানি দিয়েছেন যে বাপের জমমে ওমুখো হবেন না । দিবাকর তো বর্গাদারের খেতমজুর, ওসব উঁচু মনিষ্যিদের কাজে নাক গলাবেন কেন । কলকাতার পার্টির র্যালিতে যাবার জন্যে বাড়ির সবাইকে মাথাপিছু একশ টাকা দেন বদ্যিনাথবাবু, তা কি চাড্ডিখানি কথা ! তাছাড়া জুট কর্পোরেশান তো নিজেই অসুখে ভুগছে ।
–বুঝলে দিবাকর, কেন্দ্রীয় সরকার কাঁচা পাটের সহায়ক মূল্য কুইন্টাল প্রতি ন’শো টাকা বেঁধেছে এ-বছর ।
–আজ্ঞা হ্যাঁ ।
–পশ্চিমবঙ্গের দুশো আটটা জুট কর্পোরেশান আপিসের বেশিই তো আগে থাকতে বন্ধ । ওদের পাট দিয়েই এন জে এম সির পাঁচটা মিল চলত ধিকিয়ে-ধিকিয়ে ।
–আজ্ঞা হ্যাঁ ।
–ওই পাঁচটা চতখলও তার মানে বছর কয়েকে বন্ধ হয়ে যাবে । আকাশে শকুন উড়তে লেগেছে । কাঁচা পাটের ফাটকাবাজার জমবে । বাবুরা তিরিশ বছরেই ঝাঁঝরা করে দিলে জেসিকে ।
–আজ্ঞা হ্যাঁ । কই শকুন দেখতাছি না ।
–মাস দুয়েক পাটটা ধরে রাখতে হবে আমাদের । পঁচানব্বুই সনে টিভি-পাঁচের দাম দেড় হাজার টাকা কুইন্টাল উঠেছিল । মনে আছে ? মাসে দুই-এক বেলা মুড়ি খেয়ে থেকো ।
–আজ্ঞা হ্যাঁ ।
–তাছাড়া কলকাতায় ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে র্যালি আছে একটা, আসছে সোমবার । যাবার সময় টাকা আর ঝাণ্ডা নিয়ে যেও ।
–আজ্ঞা হ্যাঁ । কুন ঝাণ্ডা এবার ?
–এখনও খবর আসেনি । সে তোমায় ভাবতে হবে না । ন’টন করা পাট নিয়ে আড়তদারের লরি যাচ্ছে ফাটকার জন্যে । ওতে চেপেই দশজন করে লোক চলে যাও । গুদোমগুলো দেখে রেখো ।
কলকাতায় র্যালি-সমাবেশে গেলে অনেক খবর পান দিবাকর । গতবার বজবজ জুট মিলের দিনমজুর মদনবাবুর সঙ্গে আলাপ হয়েছেল, এখন চাগরি গিয়ে আইসক্রিম বেচেন, হানিফভাই রিকশা চালান, গৌরবাবু রাস্তায় গামছা বেচেন । ওই মিলের বারোজন মজুর আত্মহত্যা করেছেন । ওখানকার কয়াল সড়ক আর চড়িয়াল বাজারে গিয়েছিলেন দিবাকর । আত্মহত্যা করা কেন ! কোনো উপায়ই কি নেই ?
–উপায় আর কই দাদা ? ছমাস র্যাশান তুলতে পারিনি বলে কার্ড বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে । আগে জানলে কার্ডটা কিছু দিনের জন্যে বেচে দিতুম বা বন্ধক দিতুম কাউকে ।
–ধার দিয়ে-দিয়ে তো আমার কাপড়ের দোকান উটে গেল । কেউ শোধ দিতে পারেনি ।
লাউডস্পিকারে কে একজন, অত দূরে ডেঁওপিঁপড়ের মতন দেখাচ্ছিল, বললেন, বেশ মনে ধরেছিল দিবাকরের, ‘শ্রমিক সাথিগণ ! এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যে ১৮৮৪ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত শ্রমিক শ্রেণির দুরবস্হা হ্রাস পায়নি।’
–১৮৪৮ কেন গা ?
–বুড়ো, তোমার দাদুন জন্মেছিল সে বছর, হ্যাঃ হ্যাঃ ।
শুনে, দিবাকরের প্রথমবার খেয়াল হল, সত্যইই বুড়ো হয়ে গেছেন, ষাট-পঁয়ষট্টি হবে । এসব সমাবেশে হাজিরা দেয়াটা স্বাস্হ্যে কুলোয় না ।
সঠিকই ভেবেছিলেন দিবাকর । সভা ভাঙলে ভিড়ের চাপে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন ছেলে আর ছেলের বোউ থেকে । অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন গরমে । হাসপাতালে জনগণ চ্যাংদোলা করে বাসে চাপিয়ে নিয়ে গেলে ডাক্তার বললে, রেনাল ফেলিয়র হয়ে মারা গেছেন । বদ্যিনাথবাবুর দৌড়ঝাঁপে দিবাকর যুগির মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া গেল পুলিশ মর্গে ।
ভাগ্যিস বদ্যিনাথবাবু ছিলেন । নইলে লাশ খালাসের পাঁচশো টাকা মর্গের ডোমকে দেবার মতন রেস্ত দিবাকরের সঙ্গে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের কারোরই ছিল না । মৃতদেহ ছিলেন কালো পলিথিনে মোড়া । ডোম বললেন, এইটে আবনাদের, ওইটে একটা নেড়ের, খালেদালি মণ্ডলের ।
–ভালো যে তুমি বলে দিলে । শেষে মুসুলমানের মড়া ছুঁয়ে জাতধম্ম যেত ।
–হুজুর আমরা হলুম ডোম । আমাদের কাজই সেবা করা । লোকে মরে গেলেও আমরা তার সেবা করি ।
আড়তদারের যে-লরি মজুতদারের গুদামে কাঁচা পাট নাবিয়ে ফিরে যাচ্ছিল, তাতেই তোলা হল দিবাকরকে । কলকাতায় মকড়া পোড়াতে অনেক খরচ আর হাজার হ্যাঙ্গাম । পলিথিনটা বর্ষাকালে কাজে দেবে ।
মৃতদেহ নিয়ে মাথাভাঙায় পৌঁছোবার পরেই বরং আরম্ভ হল হ্যাঙ্গাম । লোকাল থানায় আগেই কলকাতা থেকে ওয়ারলেস এসে গিয়েছিল যে, ওই সব আসলে খালেদালি মণ্ডল নামে এক চটকল মজুরের । পৌঁছোনো মাত্র যেন কলকাতায় ফেরত পাঠানো হয় । ডেড বডি বদলা-বদলি হয়ে গেছে । পুলিশমন্ত্রী ও স্বাস্হ্যমন্ত্রী অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ।
ওসি ভক্তিভূষণ কুণ্ডু ওয়ারলেসের কপি হাতে পাবার আগেই দুপুরে টিভিতে খাসখবর প্রোগ্রামে স্বস্হ্যমন্ত্রীকে বলতে শুনেছেন, ‘হাসপাতালে কোনো রোগী যতক্ষণ বেঁচে থাকেন, ততক্ষণই দায়িত্বটা বর্তায় স্বস্হ্য দফতরের উপরে । রোগীর মৃত্যুর পরে মৃতদেহ পুলিশ মর্গে চলে গেলে পুরো দায়িত্ব গিয়ে পড়ে পুলিশের উপরে ।’ আবার লালবাজারে গোয়েন্দা প্রধানকে ওসি বলতে শুনেছেন, ‘হাসপাতালের মর্গ থেকে মৃতদেহ উধাওয়ের যে-ঘটনা ঘটেছে, তার দায়িত্ব কোনোমতেই পুলিশের নয় । হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই পুরো বিষয়টি দেখেন ।’
অবস্হা বেগতিক বুঝে ওয়ারলেস বার্তা পাওয়া মাত্র দিবাকর যুগির চালাঘরে পৌঁছেছিলেন ওসি ভক্তিভূষণ কুণ্ডু । সঙ্গে এ এস আই নারায়ন সান্যাল । জিপ থেকে নেবে তাঁরা দেখলেন শবকে পলিথিন মোড়ক থেকে খুলে কাঁচা বাঁশের খাটে শোয়ানো হয়েছে ।
–এই যে বদ্যিনাথবাবু রয়েছেন দেখছি । কলকাতা থেকে অর্ডার এসেছে এই ডেড বডি ইমিডিয়েটলি ফেরত পাঠাবার । বডিটা খালেদালি মণ্ডলের ।
–কী বলছেন কী ! কুড়ি বছর আমার খেতের কাজ দেখছে দিবাকর আর আমি চিনব না ? ওর বাড়ির লোকেদেরই জিগ্যেস করুন ।
–হ্যাঁ, ইনি আমার বাবা দিবাকর যুগি ।
–প্রমাণ কী ?
–প্রমাণ আবার কিসের ? বাবাকে আমি চিনব না ? বললেই হল খালেদালি মণ্ডল !
–কী বিপত্তি বলো দিকিন ! কলকাতা থেকে জেলা সদরে হুকুম এসেছে যে ডেডবডিটা সিজ করে ফেরত পাঠাতে হবে । জেলা শাসকের আদেশে একটা ম্যাটাডর ভ্যান সিজ করা হয়েছে, বরফের ফ্যাকট্রিকে ছ’স্ল্যাব আইস দেবার আদেশ হয়ে গেছে, অথচ আপনারা বলছেন ইনি হলেন দিবাকর যুগি । কাকে ঠিক বলে মানব ? আমার ওপরঅলাদের না আপনাদের ?
আচ্ছা, আপনারা একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়ান, আমরা একটু চেক করেনিই, বললেন ওসি ।
বদ্যিনাথ পাল, এই তল্লাটের ডাকসাইটে রাজনৈতিক ফোড়ন, কলকাতার হুকুমের চেয়ে স্হানীয় হুকুমের আধিপত্য যে বেশি, তা দেখাবার চেষ্টায় বললেন, মরা লোকের আবার চেক করাকরির কী আছে ? বডি তো কাটাছেড়াঁ করায় আগেই দোরমা হয়ে গেছে । তাড়াতাড়ি দাহসংস্কসর করে ফেলা দরকার । তা আপনি যখন জোরাজুরি করতে চাইছেন, তখন দেখে নিন কী-কী চেক করার আছে, আমরা বাইরে গিয়ে অপিক্ষে কচ্চি । ভোটাত আইডেনটিটি কার্ডটা করিয়ে দিলুম, সেটাও হারিয়ে ফেলেচে দিবাকর ।
–তা হলেও হয় । বডির বদলে বডির কাগজ সিজ করলেই চলে যাবে ।
–অ্যাই দ্যাখো না, আইডেনটিটি কার্ডটা খুঁজে ।
আত্মীয়স্বজনের কান্নাকাটি, ওসি ভক্তিভূষণ কুণ্ডু আর তাঁর বাপের বয়সী এ এস আই নারায়ণ সান্যালকে দেখে থেমে গিয়েছিল আগেই । ওনাদের গাঁয়ে ঢুকতে দেখে দিবাকরের আঙনায় ইতিমধ্যে প্রায় তাবৎ ভোটার আর হবু ভোটার জড়ো হয়েগিয়েছিলেন নতুন আহ্লাদের খোঁজে । গাঁয়ে রাজনীতিহীন আহ্লাদ এখন খাওয়া-পরার চেয়েও বেশ গুরুত্বপূর্ণ ।
ঘর থেকে সবাই বেরিয়ে যেতেই, বার-ভেতরের আড়কপাট বন্ধ করে ওসি গলা নাবিয়ে ্ধে এস আইকে বললেন, শশ শশ চেক করে নিন, চেক করে নিন ।
–কী ভেরিফাই করব, আমি তখন থেকে সেটাই ভাবছি স্যার । গাঁয়ের এত লোকজন, বাড়ির লোকেরা, সবাই মেনে নিয়েছে যে এই লোকটাই খেতমজুর দিবাকর যুগি । দেখুন না, পায়ে সাঁটা স্টিকিং প্লাস্টারেও লেখা রয়েচে দিবাকর যুগি । সরকারি কাজে বাংলা আরম্ভ হয়েচে বলে এই দেখুন না, দেখুন, বাংলায় লেখা দিবাকর যুগি । বাংলায় লেখা আমাদের জেলার প্রথম ডেড বডি । বডি বদলা-বদলি কি আর আজকে হবেছে স্যার, সেসব দেড়শো বছর আগেই হয়ে গেছে । জাতে পাটতাঁতি দিবাকর হয়ে গেছে চাষা, আর জাতে চাচা খালেদালি মণ্ডল হয়ে গেল চটকলের তাঁতি ।
আরে টাইম ওয়েস্ট করবেন না, তাড়াতাড়ি চেক করে নিন ।
–কী স্যার ? চেক তো হয়েই গেল । আমরা যা দেখলুম, আর একটা পাঁচনামা দিয়ে রিপোর্ট পাঠিয়ে দেব ।
–শশ, তা বলছি না । শিওর হয়ে নিন । ওইটে চেক করুন, ওইটে ।
–ওইটে ?
–হ্যাঁ হ্যাঁ, নুনুটা চেক করুন, রিপোর্ট লিখতে হবে তো ?
–নুনু ? কী বলছেন স্যার ?
–কেন ? বামুন বলে তাঁতির নুনুতে হাত দিতে অসুবিধে ?
–না স্যার, যদি সত্যই অন্য হয় ? মুসুলমান বেরোয় ? তবে ? নিজেই তো নিশ্চিত নন, আর আমায় বলছেন !
দিবাকরকে ঢাকা দেয়া ওঁরই মেটে ধুতিটা ওপর থেকে সরান দুই সরকারি প্রতিনিধি । কোমরে লুঙ্গির মতন পরানো ছেঁড়া ধুতিটা তোলেন এবং একযোগে আশ্বস্ত হন দুজনেই । নাঃ, এ সত্যই দিবাকর যুগি, এর খোসা ছাড়ানো নয় । বদলা-বদলি হয়নি ।
খালেদালি মণ্ডলের দেহ গেল কোথায় স্যার ? এই দিবাকর যুগি লোকটার দেহ আর আইডেনটিটি দুই আছে । কলকাতার মর্গে যে-লোকটার দেহ আছে তার কিন্তু আইডেনটিটি নেই । আর খালেদালি মণ্ডলের দেহও নেই, আইডেনটিটিও নেই । জিরো ? অ্যাঁ !