৪. সিন্ধু সভ্যতা

সিন্ধু সভ্যতা

১ নাম

সিন্ধু সভ্যতা প্রথম আবিষ্কারের সময় এই সভ্যতার দুটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র— মোহেঞ্জোদারো এবং হরপ্পা—সিন্ধু উপত্যকাতেই আবিষ্কৃত হয়; হরপ্পা ১৯২১-এ, মোহেঞ্জোদারো ১৯২২-এ। ‘সিন্ধু সভ্যতা’ নাম হওয়ার এইটি মূল কারণ। বর্তমান কালে সিন্ধু উপত্যকার বাইরেও সভ্যতার বহু কেন্দ্র আবিষ্কার হওয়ার জন্য—যথা, রাজস্থানে, গুজরাটে, হরিয়ানায়, এমনকী, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে—শুধু সিন্ধু নদের উপত্যকার সঙ্গেই এই সভ্যতার নাম জড়ানো ভৌগোলিক দিক দিয়ে স্পষ্টতই যুক্তিযুক্ত নয়। তবে, বহুদিন ধরে এই নাম চলে আসছে—এই নামেই এই সভ্যতাকে বেশি মানুষ চেনেন। কাজেই এই নাম পালটে দেওয়াও খুব সমীচীন নয়। অন্যদিকে, যে জায়গায় কোনও সংস্কৃতি প্রথম আবিষ্কৃত হয়, সংস্কৃতির নাম সেই জায়গার নামানুসারে হয়—প্রত্নতত্ত্বের এটি একটি প্রথা। সেদিক থেকে এই সভ্যতাকে অনেকে ‘হরপ্পা সংস্কৃতি’, ‘হরপ্পা সভ্যতা’ বলে থাকেন। তবে ‘হরপ্পা সংস্কৃতি’ নামটি নিয়ে একটি কথা আছে। প্রত্নতত্ত্বে ‘সংস্কৃতি’ এবং ‘সভ্যতা’তে তফাত করা হয়; সভ্যতাতে লিপিমালার প্রচলন আছে, সুসংবদ্ধ নগরজীবন আছে, পরিষ্কার ভাবে শাসকশ্রেণী আছে, শিল্প আছে, বড় স্থাপত্য আছে, ইত্যাদি। এর কিছু কিছু উপাদান ‘সংস্কৃতি’ পর্যায়েও থাকতে পারে—প্রত্নতত্ত্বে এর আলোচনার ইতিহাস দীর্ঘ তবে মতানৈক্য থাকলেও বলতে হয় যে, লিপিমালার প্রচলন সভ্যতার সব চাইতে বড় মাপকাঠি। লিপিমালা শুধু লিপিই বোঝায় না—লিপির পিছনের ঐতিহাসিক এবং অপেক্ষাকৃত জটিল সমাজকেও বোঝায়। হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতা কোনও সাধারণ ‘সংস্কৃতি’ নয়; মিশর, ক্রিট এবং গ্রিসের, ইরাকের, চীনের প্রাচীন এবং মৌলিক সভ্যতাগুলির ভেতর একটা। ভৌগোলিক দিক থেকে এর বিস্তৃতি সমসাময়িক অন্য ‘সভ্যতা’র তুলনায় বেশি। একে সংস্কৃতি বলে মানবেতিহাসে এর গুরুত্ব কম করার চেষ্টা শোভন নয়।

অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক কালে এই সভ্যতাকে ‘সিন্ধু-সরস্বতী’ সভ্যতা বলেও উল্লেখ করা হচ্ছে। আগের অধ্যায়টিতে আমরা দেখেছি, সিন্ধু সভ্যতার তো বটেই— এক সঙ্গে ১৭৪টি কেন্দ্র—এর পূর্বে আরও দুটি স্তরের মূল বিস্তৃতি হাক্‌রা প্রবাহ বা প্রাচীন সরস্বতীর প্রবাহ ধরে পাওয়া গেছে। যাকে আমরা সিন্ধু সভ্যতা বলি তার মূল কেন্দ্র বা উৎপত্তিস্থল যে সিন্ধু উপত্যকায় না হয়ে প্রাচীন সরস্বতী উপত্যকার একটি বিশেষ অঞ্চলে—বর্তমান চোলিস্তান মরু অঞ্চলে—এই সম্পর্কে কোনও সন্দেহ নেই। আমরা ‘সিন্ধু সভ্যতা’ বা ‘হরপ্পা সভ্যতা’ দুটি নামই এই পুস্তকে ব্যবহার করব। ‘সিন্ধু-সরস্বতী’ এমনকী শুধু ‘সরস্বতী সভ্যতা’ নামের যৌক্তিকতাও আমরা স্বীকার করি। তবে, এটাও মানি যে, ‘হরপ্পা সভ্যতা’ নামটিই নৈর্ব্যক্তিক প্রত্নতাত্ত্বিক প্রথা-সিদ্ধ নাম। অন্যদিকে, ‘সিন্ধু সভ্যতা’ নামটি অনেক স্বীকৃত এবং প্রচলিত। যা বহুস্বীকৃত ও পরিচিত নাম সে নাম ব্যবহার করতে থাকাই যুক্তিসঙ্গত। আমরা তাই এই অধ্যায়ের শীর্ষক হিসাবে ‘সিন্ধু সভ্যতা’ নামটিই রেখেছি।

২ বিস্তৃতি

এক একটি অঞ্চল ধরে আলোচনা করলেই এই সভ্যতার বিস্তৃতি ভাল বোঝা যাবে। একেবারে পশ্চিমের কেন্দ্রটির নাম সুত্‌কাগেনদর। দাশ্‌ত নদীর মোহনা থেকে ৩৬ মাইল ভেতরে। এক সময় মনে করা হয়েছিল যে, সেই সময়ে সমুদ্র আরও ভেতরে ছিল এবং এই কেন্দ্রটি ছিল একটি বন্দর। এটা মেনে নেওয়ার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ নেই। আরও পূর্বে শাদি-কাউর বলে আর একটি ছোট নদীর মোহনা থেকে ভেতরে সোত্‌কা কোহ্‌ বলে একটি কেন্দ্র আছে। সিন্ধু প্রদেশের দিকে আসতে সোনমিয়ানী বলে একটি উপসাগরের কুলে লাসবেলার সমতল প্রদেশে বালাকোটে উপরের স্তরে এই সভ্যতার নিদর্শন আছে। লাসবেলা অবশ্য বালুচিস্তানের উপকুলপ্রদেশ মাকরানের আওতায় পড়ে না। এখানে বলা ভাল যে, এই তিনটি কেন্দ্রের একটিতেও সামুদ্রিক বাণিজ্যের কোনও প্রত্যক্ষ প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে বাণিজ্য একেবারে হত না এটাও জোর দিয়ে বলা যায় না। একদিকে ‘গাল্‌ফ’ অঞ্চল এবং অন্যদিকে সিন্ধু উপত্যকা দুয়ের সঙ্গেই সামুদ্রিক যোগাযোগ থাকাটা অসম্ভব নয়। মাকরান উপকুলের উত্তরে পাহাড় পেরিয়ে কেজ উপত্যকায় তারবুত মরুদ্যানে মিরি কালাতের উপরের স্তরে সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন আছে। এ ছাড়া তারবুতের খেজুর ওই অঞ্চলে বিখ্যাত; তার কিছু সিন্ধু উপত্যকাতেও আসতে পারত। দক্ষিণ বালুচিস্তানের অন্যত্র, সারাওয়ান, ঝালাওয়ান ইত্যাদি অঞ্চলে ঠিক আলাদা করে সিন্ধু সভ্যতার কেন্দ্র পাওয়া যায়নি, তবে এই সভ্যতার সঙ্গে যোগাযোগ চিহ্ন অনেক জায়গাতেই পাওয়া গেছে। বালুচিস্তানে এই সভ্যতার অনেক আগে থেকেই গ্রাম বসতি আছে; যখন সভ্যতাটি ছিল তখনও এসব বসতি ছিল; এবং ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে এদের সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে এটা স্বাভাবিক। তা ছাড়া সিন্ধু সভ্যতার বাণিজ্যিক যোগ ছিল আফগানিস্তান, পারস্য, মধ্য এশিয়া, গাল্‌ফ, মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের সঙ্গে। স্থলপথের যোগাযোগ রক্ষিত হয়েছে অনেকটাই বালুচিস্তানের ভেতর দিয়ে। তাই, বালুচিস্তানের সমসাময়িক বসতিগুলিতে সিন্ধু সভ্যতার জিনিস পেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবে, এই অঞ্চলটি যে এই সভ্যতার পুরো আওতায় ছিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। শ্ৰাম্পাকোট (প্রায় ৭ একর) এবং মিরি কালাতের ওপরের স্তর নিঃসন্দেহে প্রত্যক্ষ ভাবে সিন্ধু সভ্যতার কেন্দ্র এবং সুত্‌কাগেনদরও (৪ একরের কম আয়তন) তাই। এই অঞ্চলের ভেতর দিয়ে পশ্চিমের বাণিজ্যপথ গেছে বলেই হয়তো এখানে প্রত্যক্ষ কেন্দ্র ছিল। অন্যদিকে, উত্তর বালুচিস্তানে অন্তত দুটি প্রত্যক্ষ কেন্দ্র মূলত বাণিজ্যিক রাস্তার ওপর। প্রথমটি দাবারকোট (প্রায় ৪৫ একর), গোমাল ধরে আফগানিস্তানের রাস্তায়, আর দ্বিতীয়টি মুলা গিরিবর্থের পাশে, বালুচিস্তানেরই ভেতর। এটির নাম পাঠানিদাম্‌ব। যিনি এটি বের করেছিলেন তাঁর মতে এটি মোহেঞ্জোদারোর মতো বড়। বালুচিস্তানের ভেতর জিভের মতো যে সিন্ধুর সমতলভূমি ঢুকেছে, কাচ্চির সমতল যেখানে মেহেরগড় অবস্থিত, সেই অঞ্চলেও দুটি বড় কেন্দ্র আছে— নৌশারো আর জুদিরজোদারো। দুটিই সিন্ধু উপত্যকা থেকে আফগানিস্তানের কান্দাহারের রাস্তায়, তবে এদের স্থানীয় গুরুত্বও থাকতে পারে। বৃষ্টিপাত কম এবং গরম বেশি হলেও নদীতে মাঝ বরাবর বাঁধ দিয়ে জল ওপরে তুলে দিয়ে চাষের কল্যাণে কাচ্চিতে এই শতাব্দীর প্রথম পর্যন্ত বছরে তিন বার চাষ হত, আর সিন্ধুপ্রদেশে কাচ্চির বলদ বিখ্যাত ছিল।

সিন্ধুপ্রদেশে কেন্দ্র হিসেবে মোহেঞ্জোদারো সবচেয়ে বিখ্যাত লারকানা অঞ্চলে এবং লারকানা অঞ্চল সিন্ধুপ্রদেশে সব চাইতে উর্বর অঞ্চল বলে খ্যাত ছিল। আধুনিক সেচ ব্যবস্থার আগেও এই অঞ্চলে বছরে তিন বার চাষ হত। এ ছাড়াও আর একটি দিক দিয়ে মোহেঞ্জোদারোর ভৌগোলিক অবস্থিতি লক্ষণীয়। শিকারপুর শহর এরই কাছাকাছি। পুরো বোলান গিরিবর্ত্ম ধরে যে পণ্য নামত ঊনবিংশ শতকে, শিকারপুর বাজারে তা প্রথম আসত। পুরো পারস্য এবং মধ্য এশিয়ার বাণিজ্যে শিকারপুরের ব্যবসায়ীদের মূল ভূমিকা ছিল পুঁজি জোগানোর। শিকারপুরের মতো কোনও ভূমিকা মোহেঞ্জোদারোও পালন করতে পারে। এ ছাড়া স্থানীয় সিন্ধুপ্রদেশের নদী পথের বাণিজ্যেও এই প্রাচীন শহরের ভূমিকা থাকা সম্ভব। মোহেঞ্জোদারোর আয়তন ২৫০ একরের কাছাকাছি—এটা পুরনো হিসেব। সম্প্রতি কিছু আবিষ্কারের ফলে মনে হয় এর আয়তন এই হিসেবের দ্বিগুণ হতে পারে। মোহেঞ্জোদারো বাদ দিয়ে অন্য কেন্দ্রগুলি অপেক্ষাকৃত অনেক ছোট—নারুওয়ারা ধারো প্রায় ৮৬ একর, আর চানহুদারো প্রায় ১৬ একর। সিন্ধু সমতলে যে খুব বেশি সিন্ধু সভ্যতার কেন্দ্র পাওয়া গেছে তা নয়—২০টির হিসেব পাওয়া যাচ্ছে। এবং এরা যে অঞ্চলটির সবচেয়ে উর্বর জায়গাগুলিতে অবস্থিত এটা স্পষ্ট। এই প্রদেশে বাৎসরিক বৃষ্টিপাত গড় ৮ ইঞ্চি। সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকে আবহাওয়া পালটানোর কোনও প্রমাণ নেই কোথাও। তাই ওই সময়েও সিন্ধুপ্রদেশে মোটামুটি একই রকম বৃষ্টিপাত হত ধরে নিতে হবে। সেচ ব্যবস্থা বাদ দিয়ে এখানে ব্যাপক চাষবাস হত এটা মনে করা অসমীচীন।

চোলিস্তানে হাক্‌রা প্রবাহ ধরে ১৭৪টি সিন্ধু সভ্যতার কেন্দ্রের ভেতর ৭৪টির আয়তনের হিসেবে পাওয়া গেছে—৫ হেক্টর পর্যন্ত ৪৪টি কেন্দ্র, ৫ থেকে ১০ হেক্টর ২০টি কেন্দ্র, ১০ থেকে ২০ হেক্টর ৮টি কেন্দ্র, ৮০ হেক্টর ১টি কেন্দ্র। ৮০ হেক্টর একর হিসাবে প্রায় ২০০ একর। এটি যে আঞ্চলিক অন্য কেন্দ্রগুলির চাইতে অনেক বড় ছিল এতে সন্দেহ নেই। অন্য দিক থেকে, এই অঞ্চলের ৭৯টি কেন্দ্রে দেখা যাচ্ছে যে কুমোরের ভাটা এবং বিবিধ জিনিস তৈরি করার জন্য বসতির ভেতর আলাদা জায়গা রাখা হচ্ছে। এই ধরনের কিছু কেন্দ্রে তামা গলানোর চিহ্ন যথেষ্ট। সঙ্গতভাবেই অনুমান করা যায় যে রাজস্থানের তামা এই অঞ্চলে যাচ্ছে।

সিন্ধু ধরে ওপরে পঞ্জাবে গেলে দোয়াব অঞ্চল, অর্থাৎ দুটি নদীর মাঝখানের জায়গা, প্রথমে সিন্ধু ও ঝিলামের ভেতর ‘সিন্‌দসাগর’; ঝিলাম ও চেনাবের ভেতর ‘জেচ’, চেনাব আর রাভির ভেতর ‘রেচ্‌না’, রাভি আর সাতলেজ এর ভেতর ‘বারি’ এবং সাতলেজ ও বিয়াসের ভেতর ‘বিশ্‌ত’। রাভির পশ্চিমে আবহাওয়া ও জমি কোনওটাই আধুনিক সেচ ব্যবস্থার আগে বসবাসের পক্ষে বিশেষ উপযোগী ছিল না; সিন্‌দসাগরের মাঝামাঝি অঞ্চলটি ‘থল’ মরুভূমি। হরপ্পা কেন্দ্রটি (প্রায় ৩৭০ একর বলে আজকাল অনুমিত হচ্ছে), রাভি নদীর একটি পুরনো খাতের ধারে। এর আরও পশ্চিমে সিন্ধু সভ্যতার কোনও কেন্দ্র নেই; বস্তুত পঞ্জাবের যে অংশ পাকিস্তানে পড়েছে সেখানে হরপ্পা বাদ দিয়ে ২টি ছোট কেন্দ্রের বেশি সন্ধান পাওয়া যায়নি। সংখ্যায় পঞ্জাবের কেন্দ্রগুলি পূর্ব পঞ্জাব অর্থাৎ ভারতীয় পঞ্জাবে অনেক বেশি। বস্তুত রাজস্থান, হরিয়ানা, ভারতীয় পঞ্জাব ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে সিন্ধু সভ্যতার কেন্দ্রগুলির বিস্তৃতি আমাদের এক সঙ্গে ভাবতে হবে। ১৯৮৪-তে প্রকাশিত হিসেব অনুযায়ী রাজস্থানে ঘগ্‌গর প্রবাহ ধরে হনুমানগড় অঞ্চলে ২৮টি কেন্দ্র। এদের ভেতর কালিবাঙ্গান বিখ্যাত। হরিয়ানায় আম্বালা, কুরুক্ষেত্র, কার্নাল, জিন্‌ড, সোনিপত, রোটক, ভিওয়ানি ও হিসার অঞ্চলে একই নদী অববাহিকায় ৪৪টি। ভারতীয় পঞ্জাবে অমৃতসর, কপুরতলা, জলন্ধর, রোপার, পাতিয়ালা, সাংরুর, লুধিয়ানা, ফরিদকোট, ফিরোজপুর ও ভাতিণ্ডা অঞ্চলে ৩৫টি। উত্তরপ্রদেশে সাহারানপুর ও মিরাট জেলায় ৩১টি। এখানে উল্লেখযোগ্য যে এই গুনতিতে সব কটি কেন্দ্রই পরিণত সিন্ধু সভ্যতার; এই অঞ্চলে আদি বা প্রথম পর্যায়ের কেন্দ্রও সমপরিমাণ আছে তবে এই বৃহৎ অঞ্চলটিতে সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ের সাক্ষ্য অনেক বেশি ও ব্যাপক। উত্তরপ্রদেশে সাহারানপুর (৯৯টি), মুজফ্‌ফরনগর (১৩), মিরাট (৮), বুলান্দশহর (৭), এটা (১), এটোয়া (১) এবং বিজনোর (১) অঞ্চলে সর্বমোট ১৩০টি সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ের কেন্দ্র। হরিয়ানাতে পূর্বোক্ত অঞ্চলগুলিতে ২৯৭টি কেন্দ্র, আর ভারতীয় পঞ্জাবে ১২৮; চণ্ডীগড়ে ৪ এবং হিমাচল প্রদেশে সোলান জেলায় ৪। দিল্লিতেও অন্তত ৩টি এই সময়ের কেন্দ্র আছে। রাজস্থান থেকে এই পর্যায়ের হিসেব পাওয়া যাচ্ছে না। উত্তরপ্রদেশের সংখ্যা নিয়ে একটু বিতর্ক উঠতে পারে কিন্তু যে হিসেব আমরা পেশ করলাম তাতে রাজস্থান-হরিয়ানা-পঞ্জাব-হিমাচল প্রদেশ-চণ্ডীগড়-ইউনিয়ন টেরিটরি-দিল্লি রাজ্য এবং পশ্চিম-উত্তরপ্রদেশ জুড়ে সিন্ধু সভ্যতার আদি, পরিণত ও শেষ পর্যায়ের ব্যাপ্তি ও গুরুত্ব বুঝতে অসুবিধে হবে না। এ ছাড়া পঞ্জাবের প্রান্ত ঘেঁষে জম্মুতে মান্‌ডা নামে ১টি কেন্দ্র আছে। এই প্রসঙ্গে পঞ্জাবের ভাতিণ্ডা জেলায় মাত্র ৫০×২৫ কি.মি.-র ভেতর ২১টি আদি ও পরিণত পর্যায়ের কেন্দ্রের উপস্থিতি লক্ষণীয়। এর ভেতর ৫টি কেন্দ্রের আয়তনের হিসেব ১৫০ হেক্টর, ১৪৩ হেক্টর, ১০০ হেক্টর, ২২৫ হেক্টর, ১০০ হেক্টর। এর রহস্য এখনও বোঝা যায়নি।

এবার, একটু লক্ষ করলে দেখব, সিন্ধুপ্রদেশে সিন্ধু নদী ধরে আমরা মাত্র ২০টি কেন্দ্রের উল্লেখ করতে পেরেছি; পাকিস্তানি পঞ্জাবে হরপ্পা নিয়ে মাত্র ৩টি; অন্যদিকে চোলিস্তানে পরিণত পর্যায়ের কেন্দ্রই ১৭৪টি। একটি হিসেবে ১৬৬ দেখা যাচ্ছে আর, ভারতীয় পঞ্জাব (৩৫), রাজস্থান (২৮), হরিয়ানা (৪৪), উত্তরপ্রদেশ (৩১) নিয়ে পরিণত পর্যায়ের কেন্দ্র ১৩৮টি। এর সঙ্গে চোলিস্তানের কেন্দ্রগুলি যোগ করলেই বোঝা যায় সিন্ধু সভ্যতার বিস্তৃতি সিন্ধু নদী ধরে না সরস্বতী-দৃষদ্বতী উপত্যকা জুড়ে।

এবার আসতে হয় গুজরাট অঞ্চলে—দুটি অন্তরীপ, কচ্ছ এবং সৌরাষ্ট্র বা কাথিয়াওয়াড়, আর গুজরাটের মূল ভূভাগ—সরস্বতী- মাহি- নর্মদা- তাপ্তি উপত্যকা। কচ্ছ ও সৌরাষ্ট্রে মধ্যস্থলের পার্বত্য ভূভাগ থেকে নীচের চারদিকে নদী নেমে গেছে; মধ্যস্থলের বাইরে, বিশেষ করে উপকূল অঞ্চলে জমি সমতল। কচ্ছের ব্যাপারে মনে রাখতে হবে যে, সিন্ধু সভ্যতার সময় সিন্ধু এবং সরস্বতীর মিলিত প্রবাহ কচ্ছের রান্‌ অঞ্চলে সমুদ্রে যেত এবং সেই কারণে কচ্ছের দ্বীপ অবস্থা থাকা স্বাভাবিক। গুজরাটের সব অঞ্চলেই কেন্দ্র আছে। ১৯৮৪র হিসেবেই দেখছি, পরিণত পর্যায়ের কেন্দ্র ১০১টি আর শেষ পর্যায়ের সাক্ষ্য ১৩০টিতে। আগের অধ্যায়ে দেখেছি যে, আদি পর্যায়ের সাক্ষ্যও মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে।

আমাদের দেওয়া সংখ্যাতে একটি জিনিস মনে রাখতে হবে। বিভিন্ন পর্যায়ের কেন্দ্রগুলি সব সময় যে পরস্পর বিচ্ছিন্ন তা নয়। একই কেন্দ্রে আদি, পরিণত, শেষ তিনটি পর্যায়ের সাক্ষ্য থাকতে পারে। যেমন, গুজরাটের ১৩১টি পরিণত পর্যায়ের কেন্দ্র আর ১৩০টি শেষ পর্যায়ের কেন্দ্র—এর অর্থ এই নয় যে গুজরাটে পরিণত ও শেষ পর্যায়ের কেন্দ্রের মোট সংখ্যা ২৬১টি। অনেক জায়গায় দুটি পর্যায়ের সাক্ষ্যই থাকতে পারে। ১৯৮৪র পর গুজরাট অঞ্চলে এবং অন্যত্রও বেশ কিছু কেন্দ্র বেরিয়েছে। এখানে আর একটি কথা মনে রাখা দরকার। ব্যাপক অনুসন্ধানে (প্রতিটি গ্রামাঞ্চলে সন্ধান এখনও করা হয়নি) আরও অনেক বেশি কেন্দ্র হয়তো পাওয়া যাবে। তবে আনুপাতিক হিসেবটা পালটানোর সম্ভাবনা খুব কম।

দেখা যাচ্ছে যে, ‘সিন্ধু সভ্যতা’ নাম হলেও, নামটি মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মোহেঞ্জোদারো এবং হরপ্পার নাম মনে পড়া সত্ত্বেও, সভ্যতাটির বিস্তৃতি সিন্ধু উপত্যকার তুলনায় অনেক ব্যাপকভাবে সরস্বতী-দৃষদ্বতী অববাহিকায়, কিছুটা যমুনা-গঙ্গা দোয়াবের পশ্চিমাংশে, এবং পুরো গুজরাট অঞ্চলে। তা ছাড়া, বালুচিস্তান, গোমাল উপত্যকা সব ধরে সভ্যতার ব্যাপ্তি, বিভিন্ন অঞ্চলের ভৌগোলিক বৈচিত্র্য নিয়ে, এটা কম কথা নয়।

ভারতবর্ষের এই সব অঞ্চলের বাইরেও উত্তর আফগানিস্তানে আমুদরিয়ার উপনদী কোক্‌চা উপত্যকায় শোরতুঘাই নামক জায়গায় সিন্ধু সভ্যতার পরিণত পর্যায়ের বিশদ নিদর্শন পাওয়া গেছে। হয়তো এটি একটি বাণিজ্যিক উপনিবেশ ছিল।

৩ উৎপত্তি

প্রত্যক্ষভাবে উৎপত্তির প্রসঙ্গে আসার আগে এই সভ্যতার পর্যায়ক্রম অর্থাৎ আদি/ প্রথম, পরিণত এবং শেয—এই তিনটি পর্যায়ের ভিত্তি বোঝা দরকার। প্রথমত, এই পর্যায়ক্রম প্রত্নতাত্ত্বিক স্তরের পরম্পরার ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং এই পরম্পরাতে কোনও অকস্মাৎ বিভাজনরেখা নেই। একটি স্তর এবং পর্যায় থেকে আর একটি স্তর এবং পর্যায়ের বিবর্তন বোঝা যায়। দ্বিতীয়ত, এই পর্যায়ক্রম সম্পর্কে ধারণা অল্প কিছু কেন্দ্রে খননকার্য থেকে হয়নি; এর পেছনে বহু কেন্দ্রের প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য আছে।

আমরা তৃতীয় অধ্যায়ে দেখেছি যে যাকে আমরা কোট ডিজি সংস্কৃতি বলি এবং যার সাক্ষ্য কোট ডিজি ছাড়াও বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পাওয়া গেছে, তাই সভ্যতার আদি পর্যায়। পরিণত সিন্ধু সভ্যতার মূল গ্রামীণ যে ভিত্তি সেটা এই পর্যায়ে: বিস্তীর্ণ চাষবাস এবং পশুপালন, বিস্তীর্ণ অন্তর্দেশীয় বাণিজ্য এবং অন্তত মধ্য এশিয়া, পারস্য ও আফগানিস্তানের সঙ্গে আদানপ্রদান, ব্যাপক কারিগরি জীবন (যথা মৃৎশিল্প, ধাতুশিল্প, প্রস্তরশিল্প, যানবাহনের পরিচয়), প্রাকারবেষ্টিত বসতি, সুপরিকল্পিত বাড়িঘর ইত্যাদি। ছোটখাটো কিছু জিনিস যেমন দু-এক ধরনের মৃৎপাত্র, মৃৎপাত্রের ওপর নকশা, পোড়ামাটির চ্যাপটা ঢেলা, যেগুলিকে পরিণত সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক পরিচায়কের ভেতর ফেলা যায়, এমন সব কিছু জিনিসের সূত্রপাত এই পর্যায়েই দেখা যায়। তা ছাড়া এই পর্যায়ের বিস্তৃতিও বিপুল—নিম্ন সিন্ধু উপত্যকা, পাকিস্তানি পঞ্জাব, ভারতীয় পঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, চোলিস্তান এবং গুজরাট। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ এবং বালুচিস্তান-এর গোমাল উপত্যকা এর সঙ্গে যোগ করলেই এটা পরিণত সিন্ধু সভ্যতার বিস্তৃতির অঞ্চল। এই বিস্তৃতি অবশ্যই একদিনে হয়নি। খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি যদি এর সূত্রপাত ধরি আর খ্রি. পূ. তৃতীয় সহস্রাব্দের প্রথমার্ধের দ্বিতীয় পাদে যদি পরিণত সিন্ধু সভ্যতার সূত্রপাত হয় তবে এর সময়কাল এক হাজার বছরের বেশি—১২০০/১৩০০ বছর বলেই মানা যায়। এই দীর্ঘ সময় ধরে এটি গড়ে উঠেছে এবং এক সময় পরিণত সিন্ধু সভ্যতায় রূপান্তরিত হয়েছে। এর মূল কেন্দ্র চোলিস্তানে। চোলিস্তানেই এবং মধ্য সিন্ধু উপত্যকাতে (যথা মুলতানের কাছে জলিলপুর) এর পূর্বস্তর দৃঢ়। কুনালে পাওয়া নিদর্শন থেকে প্রমাণ হয় যে, হরিয়ানাতে এই পূর্বস্তর পৌঁছেছিল। আরও একটি জিনিস খেয়াল রাখা প্রয়োজন। এমন হওয়ার কারণ নেই যে পরিণত সিন্ধু সভ্যতা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই পর্যায়ের সংস্কৃতি অর্থাৎ আদি সিন্ধু সভ্যতার স্তর মুছে গেল। বস্তুত তখন এই পর্যায় সিন্ধু সভ্যতার সমসাময়িক গ্রামজীবনের চিহ্ন হিসেবেও থাকতে পারে। কলকারখানা, বিদ্যুৎ ইত্যাদি নিয়ে আধুনিক ভারতীয় যে সংস্কৃতি আমরা শহরগুলিতে দেখি তা এখনও শহরের বাইরে সব বসতিতে নেই। কাজেই পরিণত সিন্ধু সভ্যতার চিহ্ন বা পরিচায়কগুলি কিছু অঞ্চলে শুরু হওয়ার পর সব অঞ্চলেই বা সব কেন্দ্রেই তা পৌঁছবে মনে করার কোনও কারণ নেই।

পরিণত সিন্ধু সভ্যতা যে সংস্কৃতি স্তর এবং প্রত্নতাত্ত্বিক স্তরকে বলা হচ্ছে তার পরিচায়কগুলি স্পষ্ট—লিপি, বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মৃৎপাত্রের ধারা, ভাস্কর্য নিদর্শন, এক বা একাধিক বিশেষ ধরনের নগরবিন্যাস, চার্ট পাথরের ছোট ছোট ওজন, বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ধাতুর জিনিসের ধারা, ইট দিয়ে গেঁথে কুয়ো, এরকম বহুবিধ জিনিস। ‘সভ্যতা’ অবশ্য শুধু ফর্দ মিলিয়ে হয় না। আলাদা আলাদা করে অনেক জিনিসের উৎস পূর্বস্তরে বা পর্যায়ে পাওয়া যাবে কিন্তু সব মিলিয়ে সভ্যতাটির পরিণত রূপ সত্যকার পরিণত রূপই। মৃৎপাত্রের ধারার মতো সাধারণ জিনিস নিয়ে যদি দেখা যায় তবে বোঝা যাবে এটা শুধু আকার ও চিত্রণের ব্যাপার থাকেনি—গুণগত মানেরও পরিবর্তন এসেছিল অনেক মৃৎপাত্রের ক্ষেত্রে। অপেক্ষাকৃত মোটা, পুরু লালরঙের প্রলেপ দেওয়া, ওপরে কালো রঙে ঘন জ্যামিতিক ও প্রকৃতি-ঘেঁষা চিত্রণের শৈলী— চোখ বন্ধ করে হাত দিয়ে বোঝা যায় এটি পরিণত সিন্ধু সভ্যতার। তেমনি, যদিও চতুষ্কোণ লিপিবিহীন সিলমোহর পরিণত পর্যায়ের আগেই পাওয়া গেছে (রহমান ধেরী, কুনাল), তবু লিপিযুক্ত এবং অনেক ক্ষেত্রেই বিভিন্ন প্রতিকৃতি-সহ পরিণত পর্যায়ের সিলমোহর অবিস্মরণীয়। ধাতুর ব্যবহার বহু আগে থেকেই আছে কিন্তু পরিণত পর্যায়ের যে ধাতুর জিনিসের বিশেষ গড়ন তা আগে ছিল না। দুর্গপ্রাকার আগেও আছে কিন্তু পরিণত পর্যায়ের দুর্গপ্রাকারের শ্রেণী আলাদা। যেমন, একই শহরে দুটি আলাদা বসতি অঞ্চল; দুটোই প্রাকার ঘেরা। এইভাবে উদাহরণ বাড়ানো যেতে পারে: কিন্তু মোট কথা, পরিণত পর্যায়ের সিন্ধু সভ্যতার ধরন, ব্যাপকতা, মান, সব কিছু আদি পর্যায়ের অবস্থা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। পরিণত পর্যায়ে বিশাল গুণগত পরিবর্তন এসেছিল।

‘শেষ’ পর্যায়টিও প্রত্নতাত্ত্বিক স্তর থেকেই নিরূপিত। যে গুণগত মানের কথা আমরা আগে বললাম ‘শেষ’ পর্যায়ে তা কমে আসছে; আবার সমাজে পরিবর্তন এসেছে বোঝা যাচ্ছে। এই পরিবর্তনের কথা আমরা যথাস্থানে আলোচনা করব।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পরিণত পর্যায়ের বিশাল গুণগত পরিবর্তনের পেছনের কারণগুলি কী? হরপ্পা, ধোলাবিরা, বনোয়ালী এবং কুনালে খনন কার্যের পর এই পরিবর্তন সূচনাকারী (অর্থাৎ আদি থেকে পরিণত পর্যায়ে বিবর্তনের সূচনাকারী) স্তরও পাওয়া যাচ্ছে। পরিণত পর্যায়ের দ্বারপ্রান্ত প্রত্নতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে সূচনা করা যাচ্ছে। তবে, সভ্যতার উত্তরণ হয় শুধু অর্থনৈতিক ও কারিগরি ভিত্তি দিয়ে নয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক যে গড়ন বা বিন্যাসগুলি ছিল তাদের ভেতর দিয়েও। অনেকে এই দ্বিতীয় ক্ষেত্রে পরিবর্তনকেই লিপি-পূর্ব পর্যায় থেকে লিপিযুক্ত পর্যায়ে উত্তরণের মূল কারণ হিসেবে ধরেছেন।

এই জাতীয় পরিবর্তনের কারণ কোনও বাঁধা ছকে ফেলা যায় না, তবু সিন্ধু সভ্যতার ক্ষেত্রে বর্তমান লেখকের মতে দুটি কারণকে আলাদা করে দেখা সম্ভব। প্রথমটি খাল কেটে সেচ ব্যবস্থার আরম্ভ, আর দ্বিতীয়টি কারিগরি জীবনের ব্যাপক প্রসার।

প্রথম কারণটি বুঝতে গেলে দুটি প্রারম্ভিক কথা আছে। (১) সিন্ধু সভ্যতার সময়েও, এখন তার বিস্তৃতির বিভিন্ন অঞ্চলে যে ধরনের আবহাওয়া, তা-ই ছিল। এই নিয়ে আলোচনা এবং বিতর্কের ইতিহাস দীর্ঘ। আবহাওয়া ভিন্ন ছিল অর্থাৎ বর্তমানের চাইতে বৃষ্টিপাত বেশি হত এই মতের পক্ষে যুক্তি খুবই দুর্বল। (২) সরস্বতী প্রবাহ হয়তো সভ্যতার সূত্রপাতের আগে থেকেই শুকিয়ে যেতে আরম্ভ করেছে। ‘শেষ’ পর্যায়ে হরিয়ানা-পঞ্জাবের বসতিগুলি যে ভাবে এক একটা বিশেষ অঞ্চলে সন্নিবদ্ধ তাতে মনে হয় নদীর খাতে যে সকল অঞ্চলে ভাল জল জমা ছিল সেসব অঞ্চলেই বসতি হয়েছে। ‘শেষ’ পর্যায়ের আগেই কি নদী শুকিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা ধরে নেওয়া যায়? জোর দিয়ে বলা যায় না, কিন্তু বোধ হয় যায়। ‘শেষ’ পর্যায়ে যদি নদী শুকিয়ে যাওয়ার একটা ছবি স্পষ্ট হয়ে থাকে তবে তা একদিনে হয়নি। এটা নিশ্চয় বহুদিন ধরে জল কমে আসার ফল। সিন্ধু নদের পারে সিন্ধুপ্রদেশে সভ্যতার সময় চাষবাস খাল কেটে সেচ ভিত্তিক ছিল—এই দাবিটির কিছু পরোক্ষ প্রমাণ আছে। সিন্ধুপ্রদেশে আম্‌রি বা কোট ডিজি বা এই পর্যায়ের অন্য কোনও বসতি যদি দেখি তবে দেখব যে, বসতিটি ঠিক সিন্ধুর উপত্যকায় নয়; উপত্যকার ধার ঘেঁষে। অথচ, এর পরের পর্যায়ে, অর্থাৎ পরিণত সিন্ধু সভ্যতা পর্যায়ের বসতিগুলি নদী উপত্যকার ভেতরেই। আদি থেকে পরিণত পর্যায়ে উত্তরণের সময় কখনও সভ্যতা নদীভিত্তিক হয়েছিল অর্থাৎ তখনই নদীর জল সেচের জন্য ব্যবহার করা হত—এমন অনুমান অযৌক্তিক নয়। এ ছাড়া সিন্ধুপ্রদেশে আধুনিক সেচ ব্যবস্থা প্রচলনের আগে যে সেচ ব্যবস্থা ছিল তার আর একটি পরোক্ষ প্রমাণ: এই শতাব্দীর প্রথম দিকে প্রকাশিত গেজেটিয়ার সমূহে এই পুরনো সেচ ব্যবস্থার উল্লেখ আছে এবং তা থেকে আমরা যে ছবিটি পাই তা আকর্ষণীয়। সিন্ধু নদীর খাতের উচ্চতা দু পাশের জমির উচ্চতার চাইতে বেশি; এর অর্থ নদীর জলপ্রবাহ দু পাশের জমি থেকে অপেক্ষাকৃত উঁচুতে বইছে। এই অবস্থাতে নদীর পাড় কেটে খালের মাধ্যমে জল ভেতরে নিয়ে যাওয়াটা একটি স্বাভাবিক সম্ভাব্য ব্যাপার। খাল যে সব সময় বাঁধানো জায়গায় নদীর পাড় কেটে শুরু করতে হবে তাও নয়। সুবিধে মতো যে কোনও জায়গাতেই খাল কাটা যায়, খাল সব সময় কেটে তৈরি করতে হবে তা নয়; পুরনো দহ, নদীর প্রবাহ বা সাধারণ জল প্রবাহের রাস্তা—সব কিছুর মধ্য দিয়েই জল ভেতরে নেওয়া যায়।

এখানে উল্লেখ করা ভাল যে প্রাচীন মেসোপটেমিয়াতেও সেচ ব্যবস্থা এ-রকম ছিল। ইউফ্রাটিস আর টাইগ্রিস-এর খাত পাশের জমির চাইতে উঁচু। বছরে ৮ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত সম্বল করে সেচ ব্যবস্থা ছাড়া যে সিন্ধুপ্রদেশে চাষ হতে পারে না—অথবা বলা ভাল, সে চাষে সিন্ধু সভ্যতার মতো কোনও সভ্যতা গড়ে উঠতে পারে না— একথা আমাদের আগেই বোঝা উচিত ছিল। আমাদের মতে গ্রামীণ ‘আদি’ পর্যায় থেকে ‘পরিণত’ পর্যায়ের লিপিযুক্ত নাগরিক জীবনে উত্তরণের পেছনে, সিন্ধু সভ্যতার ক্ষেত্রেও, একটি বড় কারণ নদীতে খাল কেটে সেচ ব্যবস্থার সৃষ্টি। আমাদের আরও ধারণা—যদিও এর কোনও প্রমাণ নেই—এই সেচ ব্যবস্থার সৃষ্টি সম্ভবত হাক্‌রা বা সরস্বতীর অপেক্ষাকৃত নির্জীব জলপ্রবাহ ধরে শুরু হয়েছে; সিন্ধুর জলস্রোত প্রবলতর —সুতরাং এই নদী থেকে সেচ ব্যবস্থা প্রথম শুরু হওয়ার সম্ভাবনা কম।

আমাদের দ্বিতীয় কারণ—কারিগরি জীবনের ব্যাপক প্রসার—প্রত্যক্ষ প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ নির্ভর। ধোলাবিরা, হরপ্পা, বনোয়ালী, কুনালে খননকারীরা পরিণত পর্যায়ের ঠিক আগে, আদি স্তরের শেষ অংশটুকুকে উত্তরণের স্তর বলে উল্লেখ করেছেন। এই উত্তরণের স্তরে পাওয়া, কুনালের ‘মুকুট’ অথবা টায়রা এবং বাজুবন্ধর কথা আমরা যদি ভাবি, তবে সেই সময় রাজকীয় শ্রেণীর উদ্ভবের কথাও ভাবা যেতে পারে। অন্তত, ভাবনাটি অসঙ্গত হবে না। তবে, সেচ ব্যবস্থার সূত্রপাতের মতো আর একটি জিনিসও এখানে পণ্ডিতদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। তৃতীয় অধ্যায়ে উত্তর-পূর্ব রাজস্থানের গণেশ্বর কেন্দ্রের তাম্ৰধাতুশিল্পের গুরুত্বের কথা আমরা উল্লেখ করেছি। এও বলেছি যে, এই ব্যাপক ধাতুশিল্প আরাবল্লী জুড়ে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের শেষপাদ থেকে ছিল। অর্থাৎ পরিণত সিন্ধু সভ্যতা পর্যায়ের বেশ কিছু আগে থেকে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ব্যাপক তাম্রশিল্প কোন অঞ্চলের জন্য দরকার ছিল? উত্তর একটাই: ঘগ্‌গর-হাক্‌রা প্রবাহ ধরে আদি সিন্ধু সভ্যতা পর্যায়ের সংস্কৃতির জন্য। ঘগ্‌গর-হাক্‌রা প্রবাহ থেকে এটাই সব চাইতে কাছের এবং সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ তামার উৎস। উত্তর-পূর্ব রাজস্থানের আরাবল্লীতে তামার জিনিসপত্র তৈরির ব্যাপকতা থেকে মনে হয় যে আদি পর্যায়ের বসতিগুলির তামার জিনিসের যথেষ্ট প্রয়োজন ছিল। কোনও একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কারিগরি ক্ষেত্রে এত প্রয়োজন থাকার অর্থ যে সমাজ পালটাচ্ছিল।

আমরা দুটি কারণ, সেচ ব্যবস্থার উদ্ভব ও কারিগরি শিল্পের ব্যাপক প্রসার, উল্লেখ করলাম বলে যে অন্য কোনও কারণ থাকতে পারে না তা নয়। কুনালের ‘টায়রা’ এবং ‘বাজুবন্ধ’ সুনিশ্চিতভাবে রাজকুলের অস্তিত্ব ইঙ্গিত করে।

সভ্যতার উত্তরণের প্রসঙ্গেই আর একটি প্রশ্ন আসে। এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সিন্ধু সভ্যতার ‘পরিণত’ রূপ কি সর্বত্র এক সময় শুরু হয়েছিল? সাধারণ বুদ্ধিতেই বলে যে এরকম হওয়ার সম্ভাবনা কম। তা ছাড়া, চোলিস্তান অঞ্চলে এক সঙ্গে সবচেয়ে বেশি কেন্দ্রের অবস্থিতি এবং সেই ভিত্তিতে ওই অঞ্চলেই সিন্ধু সভ্যতার ‘পরিণত’ রূপের উৎস তাও বলেছি। চোলিস্তান যদি প্রথম কেন্দ্র হয় তবে ভৌগোলিক রেখা ধরে—অর্থাৎ প্রাচীন হাক্‌রা প্রবাহ এবং পরে সিন্ধু ও হাক্‌রার মিলিত প্রবাহ ধরে— বর্তমান কচ্ছে এবং সৌরাষ্ট্রেও, হয়তো এর কিছু পর কিন্তু মোটামুটি সমসাময়িক কেন্দ্র বিন্যাস পেতে পারি। কচ্ছ এবং সৌরাষ্ট্র অন্তরীপ অনেকাংশে পাথুরে এবং সে হিসেবে খনিজ দ্রব্যের আকর। ওই অঞ্চলে সিন্ধু সভ্যতার নিশ্চয় প্রয়োজন ছিল। চোলিস্তান থেকেই সিন্ধু উপত্যকায় সভ্যতা ছড়িয়ে যেতে কোনও বাধা নেই। কচ্ছ সৌরাষ্ট্রের সিন্ধু সভ্যতা হয়তো একটু পরে, তবে মোটামুটি সমসাময়িক। আরও পশ্চিমে অবশ্যই আরো পরে ছড়িয়েছে। আমাদের ব্যক্তিগত ধারণা চোলিস্তানের দিক থেকে হাক্‌রা-ঘগ্‌গর ধরে ওপরে, অর্থাৎ রাজস্থান, হরিয়ানা, ভারতীয় পঞ্জাব এবং উত্তরপ্রদেশে বা দোয়াবের উপরাংশে এই সভ্যতা গুজরাট আর সিন্ধু উপত্যকায় ছড়ানোর পর ছড়িয়েছে। হয়তো পাকিস্তানি পঞ্জাবে যে ৩টি কেন্দ্র আছে, যাদের ভেতর একটি হচ্ছে হরপ্পা, সে সম্পর্কেও একই কথা বলা যেতে পারে। আবার, হরপ্পাতে রাভি নদীর ধার উজিয়েও সভ্যতা পৌঁছতে পারে। জোর করে কিছু বলা মুশকিল। আমরা শুধু যুক্তিসঙ্গত কিছু অনুমান পেশ করলাম। তবে, ম্যাপের সর্বত্রই অর্থাৎ সব কেন্দ্রেই এক সময়ে সভ্যতা দাঁড়িয়ে উঠছে এটা কিছুতেই মানা যায় না। কাল পরম্পরার একটি ইতিহাস নিশ্চয় আছে। এই কাল পরম্পরার ইতিহাসটি কী হতে পারে আমরা তাই অনুমান করলাম।

৪ মূল কিছু কেন্দ্র

এর পর যে সব কেন্দ্রের প্রত্নতাত্ত্বিক রূপ সম্পর্কে আলোচনা করব, সে সব কেন্দ্রে মাটি খোঁড়া হয়েছে এবং সেই কারণে এই কেন্দ্রগুলি দেখতে কী রকম ছিল, অর্থাৎ এদের পরিকল্পনা, বাড়িঘর কী রকম ছিল, আমরা তা জানি। সব সময় যে খুব বিশদভাবে জানি তা নয়, তবু খানিকটা নিশ্চয়ই জানি। অন্তত তিনটি বৃহৎ কেন্দ্রে দীর্ঘদিন ধরে খননকার্যের বিশদ বিবরণ নেই। এটা একটা অসুবিধে। প্রথম দিকে যে খনন হয়েছে সব সময় যে সেটা আধুনিক অর্থে নির্ভরযোগ্য হয়েছে তা নয়। সেটাও একটা অসুবিধে। তবে যে সমস্ত বড় কেন্দ্রে খননকার্য হয়েছে তাদের পরিকল্পনা এবং বাড়িঘরের একটা হিসেবনিকেশ এখনই করা ভাল। কারণ, সাধারণভাবে সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে আমাদের যা পরিচয় তা মূলত পরিকল্পিত শহর এবং ভালভাবে তৈরি বাড়িঘরের ছবি দেখে। প্রথম দিকের প্রত্নতাত্ত্বিকরা যাই করুন না কেন, যে সব বড় কেন্দ্রে তাঁরা হাত দিয়েছিলেন, যেমন মোহেঞ্জোদারো এবং হরপ্পা, তাদের একটা সামগ্রিক ছবি তাঁরা দিতে পেরেছিলেন।

৪.১. মোহেঞ্জোদারো

কেউ কেউ মোয়েঞ্জোদারো লিখতে শুরু করলেও, নামটি মোহেঞ্জোদারোই। সিন্ধু নদীর প্রবাহ থেকে কিছু দূরে—উত্তর পাড়ে। নদী শহরের কাছ দিয়ে বইত কিনা প্রমাণ নেই। শহরের পশ্চিম এবং পূর্বদিকের বসতি স্তূপের মাঝখানে কিছু খালি জমি। কেউ বলছেন যে হয়তো নদী থেকে একটা খাল এই ফাঁকা জায়গা দিয়ে ঢুকত। পশ্চিমের বসতি স্থূপটি অন্যটির তুলনায় ছোট—৩৬৫.৫×১৮৩ মি. এবং নীচের জমি থেকে ১২ মি. পর্যন্ত উঁচু। উঁচু ইচ্ছে করেই করা হয়েছে। প্রথমে মাটি ফেলে একটি বিশালাকার এবং অনেক উঁচু ভিতের মতো জায়গা করে নেওয়া হয়েছে এবং তারপর তাদের নিজস্ব ভিত নিয়ে ঘরবাড়ি তৈরি হয়েছে। প্রথম যে কাদামাটির ভিত বা মঞ্চটি করা হয়েছিল তার চারদিক পাকা ইটের দেয়ালের গাঁথুনির ভেতর ছিল এবং এই দেয়ালই আরও ওপরে তুলে দিয়ে এবং সঙ্গে বন্ধনী/বেষ্টনী (bastion) এবং বুরুজ চূড়া (tower) যোগ করে পরিষ্কার একটি দুর্গপ্রাকারের সৃষ্টি করা হয়েছিল। এই পুরো জিনিসটা—অর্থাৎ মাটির ভিত, চারদিকের পাকা ইটের দেওয়াল এবং সঙ্গে গড়া দুর্গপ্রাকার—এক সঙ্গেই করা হয়েছিল মনে করা যায়। এর আগের পর্যায়ে নিশ্চয়ই একটি বসতি ছিল, যা পরিণত সিন্ধু সভ্যতারই। কিন্তু তার সম্পর্কে পরিষ্কার কিছু বলা মুশকিল। মোহেঞ্জোদারোতে খননের একটি অসুবিধা হচ্ছে যে, এখানে তাড়াতাড়ি জল বেরিয়ে যায় এবং ফলে একেবারে নীচের স্তরে পৌঁছনো প্রায় অসম্ভব। এই অঞ্চলে গভীর নলকূপ খননে দেখা গেছে যে বহু নীচ থেকেও বসতির চিহ্ন পাইপের ভেতর আটকানো মাটিতে পাওয়া যাচ্ছে। একজন বলছেন যে, এগুলি হয়তো সত্যিকার বসতি চিহ্ন নয়। যে বিশালায়তন ভিত তৈরি হয় তার জন্য মাটি খোঁড়া নিশ্চয় সঙ্গের জমিতেই হয়েছিল এবং খোঁড়া জায়গায় জল জমে তা জলের একটি গভীর পরিখার রূপ পায়। ওপরের দুর্গপ্রাকার থেকে নিশ্চয় দৈনন্দিন ব্যবহারের অনেক জিনিস এই পরিখার গভীরে পড়ে। চারপাশে পাইপ ঢুকিয়ে যে বসতি চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে তা হয়তো পরিখার গভীরে পড়ে যাওয়া জিনিস। অনুমানটি আকর্ষণীয় হলেও এটি নিছক অনুমানই।

এই পশ্চিমের বসতিটির উত্তর-পূর্বে কুষাণযুগের একটি বৌদ্ধ স্তৃপ—তার নীচে খোঁড়া যায়নি। অনেকে মনে করেছেন যে এখানে খুঁড়লে কোনও বড় মন্দির জাতীয় ধর্মস্থান বেরোত। এর উলটো দিকে, একটি চওড়া রাস্তা পেরিয়ে এমন একটি বাড়ি পাওয়া গেছে যাকে মনে করা হয়েছে ‘মন্দিরের’ পুরোহিতদের থাকার জায়গা বলে। দোতলায় এঁরা থাকতেন এবং একতলায় স্নানাদির জন্য নেমে আসতেন। এ ছাড়া আর একটি বাড়িকে মনে করা হয়েছে পুরোহিতদের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট বিদ্যায়তন বা ‘কলেজ’ বলে। এগুলি অনুমান হলেও, শহরের এই অংশেই পাওয়া ‘বৃহৎ স্নানাগার’টি কোনও অনুমানের ব্যাপার নয় এবং বিশেষ যত্ন নিয়ে তৈরি— উত্তর দক্ষিণে ১১.৮৯ মি., পূর্ব-পশ্চিমে ৭.০১ মি., গভীরতায় ২.৪৪ মি.। জিপসামের বাঁধুনি দেওয়া আড়াআড়িভাবে খাড়া ইটের তৈরি সিঁড়ি উত্তর এবং দক্ষিণ দিক থেকে জলে নেমে এসেছে। এই সিঁড়ি আবার বিটুমেনের সাহায্যে কাঠ দিয়ে ঢাকা। চারপাশের দেওয়ালেও জলনিরোধক জিপসামের গাঁথুনি। এর পর বাইরের দিকে ২ সেমি. পুরু বিটুমেনের প্রলেপ দেওয়া; তারপর একটি চারপাশ ঘেরা দেওয়াল এবং এর চারদিকে কাঁচা ইট ঠেসে দেওয়ার পর একেবারে বাইরের দিকের চারপাশ ঘেরা দেওয়াল। ছোট পুকুরটির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ দিয়ে একটি বড় প্রণালীর যোগ আছে, যে প্রণালীটি দুর্গপ্রাকারের পশ্চিম দিক দিয়ে নীচে নেমে গেছে। এই প্রণালীটিতে মানুষ-সমান একটি খিলান লক্ষ করা যায়। পুকুরটির তিনদিকে খোলা বারান্দা। তারপর ঘর। একটি ঘরে পাকা ইটের একটি কুয়ো আছে। মনে হয় এখান থেকে জল তুলেই পুকুরটি ভর্তি করা হত। পরে, প্রয়োজনমতো, বড় খিলানযুক্ত প্রণালীটি দিয়ে, জল বের করে দেওয়া যেত। সমসাময়িক পৃথিবীতে এ ধরনের স্নানাগার কোথাও পাওয়া যায়নি এবং জমি থেকে অনেক উঁচুতে একটি প্রাচীরঘেরা জায়গাতে এরকম একটি সম্পূর্ণ ইট-বাঁধানো পুকুর তৈরির পেছনে প্রযুক্তিগত দক্ষতা সহজেই অনুমেয়।

স্নানাগারটির দক্ষিণ-পশ্চিমে ৪৫.৭২×২২.৮৬ মি. জায়গা জুড়ে শস্যাগার। সবশুদ্ধ ২৭টি ভাগ অনুমান করা হয়েছে। মূলত ইটের তৈরি উঁচু মাচান বা ভিতের ওপর কাঠ দিয়ে বানানো চৌকোনা শস্য রাখার জায়গা। আলাদা আলাদা ভাগে তৈরি এবং ভাগগুলির মাঝে সরু ব্যবধান। এখানে বলে রাখা ভাল যে, এখানে শস্য রাখার কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সবটাই অনুমান। অনুমিত শস্যাগারের কাছ থেকে ৬.৭ মি. চওড়া একটি সিঁড়ি নীচের জমি পর্যন্ত নেমে গিয়েছিল—এরকম অনুমান করা হয়েছে। তবে এই অনুমান খুব স্বাভাবিক। যখন পশ্চিমদিকের বসতি অঞ্চলটি বিশাল এবং উঁচু ভিতের ওপর করা হয় তখন নীচে সমতল জমিতে নামার জন্যও নিশ্চয় সিঁড়ি ছিল। তবে সিঁড়ির প্রত্যক্ষ চিহ্ন নষ্ট হয়ে গেছে। শস্যাগারের কাছাকাছি এটি নীচে নেমে গিয়েছিল এটা অনুমান। তবে সবাই এই অনুমান মানেন না।

পশ্চিমের অঞ্চলটির আর একটি জায়গা লক্ষণীয়। ২৭.৪৪ মি. বর্গাকার জায়গা—উত্তর দিকে মূল ঢোকার জায়গা—প্রতি সারিতে পাঁচটি করে ৪ সারি ইটের মাচা এটিকে পাঁচটি করিডোরে ভাগ করেছে। কোনও মিটিং করার জায়গা বা বাজার—দুটো মতামতই রয়েছে।

পূর্বের বসতি অঞ্চলটি পশ্চিমের বসতি অঞ্চলটির চাইতে অনেক বড়। এটির কেবল একপাশে প্রাকারের চিহ্ন পাওয়া গেছে এবং অনুমান করা হয়েছে যে এটির চারপাশেই প্রাকার ছিল, যদিও পশ্চিমের অঞ্চলটির প্রাকারটির মতো এটি হয়তো দুর্গপ্রাকার ছিল না। তবে বাড়িঘর এখানেও বিভিন্ন উচ্চতার মাটির ভিতের ওপর— সব মিলিয়ে একটি হিসেবে ২.৫৯ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে। নগর পরিকল্পনা অনেকটাই দাবার বোর্ডের মতো সাজানো—উত্তর-দক্ষিণে, পূর্ব-পশ্চিমে মোটামুটি সমান্তরাল চওড়া রাস্তা। তবে এই রাস্তাগুলি থেকে যে গলিগুলি বেরিয়েছে তা মোটেই সমান্তরালভাবে নয়—অনেক ক্ষেত্রেই গলিগুলি ঘুরে ফিরে গেছে। বড় রাস্তাগুলি ৯.১৫ মি. চওড়া। সাধারণত বাড়িগুলির পরিকল্পনা এক বা একাধিক খোলা আঙিনা ঘিরে। কোথাও কোথাও ছাদ বা ওপরের তলাতে যাওয়ার সিঁড়ির চিহ্ন পাওয়া গেছে। অনেক বাড়িতেই কুয়ো ছিল—স্নান করার জায়গা এবং কোথাও শৌচাগারও। নোংরা জল বেরোবার জন্য নালি ছিল। রাস্তা বাঁধানো ছিল না; তবে ইটের তৈরি ঢাকা নালি বা ড্রেন ছিল; আবার কোথাও ইটেরই তৈরি আবর্জনা ফেলার চৌকো চৌবাচ্চা ছিল। এগুলোতে নীচে নামার সিঁড়ি দেখে অনুমান হয় যে, এগুলি পরিষ্কার করার কোনও নাগরিক বন্দোবস্ত ছিল। নালিগুলি নিয়মিত পরিষ্কারেরও কিছু চিহ্ন পাওয়া গেছে। তা ছাড়া রাস্তার নীচে ছিদ্র করা বড় মাটির জালা গেঁথে বসিয়ে রাখা থাকত, যেখানে বাড়িগুলি থেকে নোংরা জল গড়িয়ে আসত। ঘরগুলোতে জানালা বড় একটা পাওয়া যায়নি; দেওয়ালের ওপর দিকে হয়তো ছিল, যেমন পুরনো বাড়িগুলোতে এখনও দেখা যায়। একটি বাড়িতে ঢোকার পথ বাইরের বড় রাস্তা থেকেই ছিল এবং সেখানে উঠেই যে ঘরটি তাতে ইটের মেঝের ওপর পাঁচটি বড় জালা রাখার গর্ত ছিল। গ্রামাঞ্চলে পুরনো ধরনের মিষ্টির দোকানগুলিতে এরকম গর্ত বসিয়ে মাটির জালা রাখার ব্যবস্থা ক’দিন আগে পর্যন্তও দেখা যেত। তবে মোহেঞ্জোদারোর বেলায় এটি মিষ্টির দোকান না হয়ে জলসত্র হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কাদার গাঁথুনি দেওয়া পাকা ইটের দেওয়াল যথেষ্ট মোটা হয়—এখানেও এক মিটার থেকে দু মিটারের একটু বেশি চওড়া দেওয়াল দেওয়া বাড়ি পাওয়া গেছে। কোথাও কোথাও ঘরে তন্দুর জাতীয় চুলা। ছাদ নিয়ে সংশয় আছে, তবে সমতল ছাদ—কাঠের বর্গার ওপর মাটি দিয়ে তৈরি—এর সম্ভাবনাই বেশি। বাড়িগুলি কোনও দিক থেকেই অলংকৃত নয়; দেওয়ালে মাটির প্লাস্টারের ওপর চুনের প্রলেপ দেওয়া হয়তো কোথাও কোথাও। রাজপ্রাসাদ, মন্দির ইত্যাদি বের করতে পণ্ডিতেরা কল্পনার ত্রুটি করেননি, তবে সবটাই কল্পনার ওপর। বেশির ভাগ বাড়িই একরকম। তবে একটি ক্ষেত্রে মাত্র দুটি কামরাওয়ালা ১৬টি বাড়ির একটি ব্লক পাওয়া গেছে। পণ্ডিতদের জল্পনা অনুযায়ী এই বাড়িগুলি দাস অথবা সাধারণ কাজ করা মানুষদের হতে পারত।

মোহেঞ্জোদারোর শেষ পর্যায়ে বাড়িগুলি ঘিঞ্জি এবং খারাপ ভাবে তৈরি করা হয়েছিল; তবে সভ্যতার পরিণত পর্যায়ে এরকম সুসংঘবদ্ধ, সুখ-সুবিধা বিশিষ্ট নগরী সমসাময়িক পৃথিবীতে বিরল ছিল। এই নগরীতে বিভিন্ন ধরনের কারিগরদেরও আবাস ছিল এবং বিভিন্ন ধরনের কারিগরির চিহ্ন এখানে পাওয়া গেছে। মৃৎপাত্র তৈরি ছাড়াও, পাথরের পুঁতি তৈরি, উচ্চ মানের পোড়ামাটির বালা, ধাতুর কাজ ইত্যাদির চিহ্ন বিস্তর আছে।

মোহেঞ্জোদারোর বাড়িঘর ঠিকভাবে রাখার সমস্যা জটিল। নোনা লেগে খননকার্যে আবিষ্কৃত বহু ইটের চিহ্ন নষ্ট হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। তা ছাড়া, বাতাসে আসা বালির ঝাপটা লেগেও দেওয়াল খারাপ হয়। মোহেঞ্জোদারোর খোঁড়া ধ্বংসস্তূপ কতদিন টিকিয়ে রাখা যাবে কেউ জানে না। যে সমস্ত প্রতিরোধক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তার ভেতর একটি হচ্ছে এখানে যা পাওয়া গেছে (দেওয়াল, জিনিস, যাই হোক না কেন), তার পূর্ণ নথিকরণ, যাতে প্রয়োজন হলে মডেলও তৈরি করা যায়। এই নথিকরণের কাজের সময় শহরের বিস্তৃতি যে অনেক ব্যাপক ছিল (আগের অনুমানের চাইতে) তার বহু প্রমাণ পাওয়া গেছে।

৪.২ হরপ্পা

রাভি নদীর একটি পুরনো খাতের ওপর অবস্থিত হরপ্পার ধ্বংসস্তূপ লাহোর-মুলতান রেললাইন তৈরির সময় পাথরের টুকরোর বিকল্পে ইটের টুকরোর উৎস হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। অর্থাৎ, লাইন তৈরির ঠিকাদার লোক লাগিয়ে পুরনো ঢিবির ইট বের করে সেগুলি ছোট টুকরো করিয়ে লাইনে বিছানো হত। ভারতবর্ষে রেললাইন তৈরির সময় যে সব অঞ্চলে পাথর পাওয়া যেত না সে সব অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসস্তূপ ঠিকাদারদের অনেক কাজে লেগেছিল। হরপ্পার ঘটনা আশ্চর্য কিছু নয়। মোহেঞ্জোদারোর যে পূর্বদিকের বৃহৎ বসতি অঞ্চল হরপ্পাতে তা অধিকাংশ নষ্ট হয়ে যায়। পশ্চিমদিকের বসতি অঞ্চলটিতেও দুর্গকারটি ঠিক আছে কিন্তু এর ভেতরের বাড়িঘর অনেক নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। হরপ্পার মূল বাড়িঘরের সাক্ষ্য পাওয়া গেছে রাভি নদীর খাত আর দুর্গপ্রাকারের মাঝখানে, দুর্গপ্রাকারের প্রাকারটির প্রকৃতি বোঝা গেছে। প্রাকার ঘেরা জায়গার বাইরে দক্ষিণাংশে দুটো সমাধি স্থান পাওয়া গেছে। একটি পরিণত সিন্ধু সভ্যতার সময়ের, আর একটি সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ের সমসাময়িক। সাম্প্রতিককালে পূর্বদিকের বসতি অঞ্চলটিতেও খননকার্য করা হচ্ছে এবং কিছু নিদর্শন বেরিয়েছে।

হরপ্পাতেও পশ্চিমদিকের বসতি অঞ্চল স্পষ্ট—উত্তর-দক্ষিণে আনুমানিক ১৯৩ মি. (উত্তর-দক্ষিণ) এবং পূর্ব-পশ্চিমে আনুমানিক ১২ মি. উঁচু এবং মাটি ফেলে পুরো উঁচু করা জায়গাটি প্রথমে কাঁচা ইটের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা, এর ওপর পাকা ইটের দেওয়াল। উত্তরদিকের প্রবেশপথটি বড়, যদিও এটা খোঁড়া হয়নি। পশ্চিমদিকের প্রবেশপথটির সঙ্গে বাইরের দিকে কিছু সংযোজন আছে, যা দিয়ে হয়তো কোনও বিশেষ সময়ে বা দিনে শোভাযাত্রা করে লোক ঢুকতে পারত। দুর্গপ্রাকারের দেওয়ালের মাঝে মাঝে প্রতিরক্ষা প্রাকার। ভেতরে যে সমস্ত বাড়ির ধ্বংসস্তূপ আছে তারাও উঁচু ভিতের ওপর, মোহেঞ্জোদারোর পশ্চিম বসতি অঞ্চলটির সঙ্গে হরপ্পার এই পশ্চিমাঞ্চলটির পরিকল্পনাগত সাদৃশ্য খুব স্পষ্ট, যদিও হরপ্পাতে মোহেঞ্জোদারার এই অঞ্চলটির বাড়িঘর যথা স্নানাগার ইত্যাদি কিছু পাওয়া যায়নি অথবা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কিছু পাওয়া সম্ভব হয়নি। নীচে দুর্গপ্রাকারের নদীর পাড়ে প্রথমে আছে শস্যাগার। ১.২২ মি. উঁচু উত্তরদিকে ভিতের ওপর, মাঝখানে ৭.০১ মি. চওড়া একটি বারান্দা বা খালি জায়গা নিয়ে, এক এক লাইনে ছয়টি করে দুটি লাইনে সাজানো। এক একটির আয়তন ১৫.২৪×৬.১০ মি.। এদের মেঝে কাঠের বর্গার ওপর, হয়তো খুঁটির ওপর ছাদ তৈরি করা এবং মাঝখানের লম্বা খালি জায়গাটা ইট দিয়ে বাঁধানো। এই জায়গাটায় উঠে যাওয়ার জন্য ভিতের নীচ থেকে সিঁড়ি আছে। ভিতটা পেটানো মাটির ওপরে অর্থাৎ বাইরের দিকে পাকা ইট দিয়ে গড়া। কাঠের বর্গার ওপর তোলা মেঝে হওয়াতে নীচ দিয়ে বাতাস খেলত। রোমান যুগে ব্রিটেনে এরকম ভাবে তৈরি শস্যাগার পাওয়াতে হরপ্পাতে এই পুরো নিদর্শনটিকে শস্যাগার বলা সহজ হয়েছিল। ‘শসাগার’ বলার আর একটি কারণ হচ্ছে এর কিছু দক্ষিণে, পাশ দিয়ে সাজানো ইটে বাঁধানো, মাঝখানে গর্ত করা গোলাকার জায়গা। এগুলির ভেতর থেকে যব এবং গমের খড় এবং তুষ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া কিছু পোড়া গম এবং খোলা ছাড়ানো যব। দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে এই ধরনের গর্তে ঢেঁকির পাড় দেওয়া হয়। বর্তমানের সঙ্গে এর সাদৃশ্য খুব স্পষ্ট। আরও দক্ষিণে দুটি নিদর্শন লক্ষ করার মতো। প্রথমটি ১৮×৮ মি. মাপের বাসস্থানের ৭টি করে ২টি সারি। প্রত্যেকটিই দেওয়াল দিয়ে ঘেরা এবং ঢোকার জায়গা কিছুটা তেরছাভাবে। একটি ঘর এবং একটি উঠোন। ‘কুলিদের থাকার জায়গা’ বলে পণ্ডিতেরা উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া, এই অঞ্চলেই একটু উপরের স্তরে ১৬টি তামা গলানোর চুল্লি পাওয়া গেছে। চুল্লিগুলির মাপ ১.১ মি. থেকে ১.৮৮ মি.। এদের ভেতরের দিকের ইট আগুনের তাপে ঝামা হয়ে গেছে এবং তামা যাতে গলানো হয় এমন মাটির পাত্র পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে হরপ্পা দুর্গপ্রাকারের নীচে এই সমস্ত নিদর্শন খুব আকর্ষণীয়। নদীতে নৌকো দিয়ে শস্য তোলা হত; ঢেকিতে পাড় দিয়ে শস্য কোটা হত: যাঁরা কাজটি করতেন তাঁদের থাকার জায়গাও সঙ্গে। তা ছাড়া, পরের দিকে তামা গলানোর জায়গা।

হরপ্পায় পূর্বদিকের বসতি অঞ্চলটিতে খননকার্য চলছে। এ পর্যন্ত যা পাওয়া গেছে তার ভেতর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে একটি নগরদ্বার। বোঝা গেছে যে পূর্বের অঞ্চলটিও দেওয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল। পরিণত পর্যায়ের যে সমাধিস্থানটি খোঁড়া হয়েছে তার নাম আর-৩৭ (R37)। শেষ পর্যায়ের কবরটির নাম দেওয়া হয়েছে সিমেট্‌রি-এইচ (Cemetery H)। এর কথা আমরা যথাস্থানে আলোচনা করব। সাধারণভাবে পরিণত পর্যায়ের সমাধি ১০ ফুট লম্বা, ৩ থেকে ৪ ফুট চওড়া এবং ২ ফুট গভীর। মাথার দিকে সাধারণত বেশি চওড়া হত। শরীর পুরো একপাশে করে শোয়ানো থাকত; মাথা উত্তরদিকে, তবে ব্যতিক্রমও আছে। মাথার দিকে গড়পড়তা ১৫ থেকে ২০টি মৃৎপাত্র, যে ধরনের মৃৎপাত্র তখনকার লোকেরা ব্যবহার করতেন। ব্যক্তিগত অলংকারও মৃতের সঙ্গে পাওয়া গেছে; কখনও ডান হাতে অনামিকায় তামার আংটি, কোথাও গলায় স্টিয়েটাইট পাথর দিয়ে তৈরি পুঁতির মালা; কোথাও একটি কানে সরু তামার তার দিয়ে বানানো কর্ণালংকার; তা ছাড়া ঝিনুকের তৈরি হাতের বালা, তামা দিয়ে তৈরি আয়না, চোখে কাজল দেওয়ার জন্য তামা দিয়েই বানানো শলাকা ইত্যাদি। একটি সমাধিতে পায়ের কাছে একটি দীপ, আর মোরগের হাড়। সাধারণত শরীর মাটিতেই শোয়ানো হত কিন্তু অন্তত একটি ক্ষেত্রে ৭ ফুট লম্বা, ২ থেকে আড়াই ফুট চওড়া কাঠের কফিনে দেহ (সম্ভবত কোনও স্ত্রীলোকের) শোয়ানো—দেহটি বোধ হয় মাদুর জাতীয় জিনিসে জড়ানো ছিল।

৪.৩ কালিবাঙ্গান

এখানেও বসতির দুটি ভাগ—পশ্চিমে কালিবাঙ্গান-১, আর পূর্বে কিছুটা খালি জায়গার পর কালিবাঙ্গান-২। পশ্চিমের দিকটি দুর্গপ্রাকার ঘেরা, উত্তর-দক্ষিণে ২৪০ মি., পূর্ব-পশ্চিমে ১২০ মি.। উত্তর-দক্ষিণে দুটি ভাগে বিভক্ত, দুটি ভাগই মোটামুটি সমান এবং দুটিই প্রাকার ঘেরা—কিছু পর পর বেষ্টনী দিয়ে। প্রাকার কাঁচা ইট দিয়ে তৈরি (অনুপাত ১: ২ : ৪; এক্ষেত্রে ৪০×২০×১০ সে.মি. আর অন্যক্ষেত্রে ৩০×১৫×৭.৫ সে.মি.)—দুটো পর্যায়ের। প্রথম পর্যায়ে বড় মাপের ইট ব্যবহৃত হয়েছে; দ্বিতীয় পর্যায়ে ছোট মাপের। এ ছাড়া দুটি পর্যায়ে কোনও তফাত নেই। প্রাকারের ভেতর ও বাইরে দুদিকেই মাটি দিয়ে লেপা। দক্ষিণের অংশটি অপেক্ষাকৃত বেশি সুরক্ষিত ভাবে তৈরি—এখানে প্রাকারে দৃঢ় বেস্টনীর সংখ্যা বেশি। এই দক্ষিণ অংশে প্রাকারবেষ্টিত জায়গায়, ৫ থেকে ৬টি উঁচু মঞ্চ পাওয়া গেছে। এই মঞ্চগুলি আলাদা আলাদা, মাঝখান দিয়ে খোলা করিডর আছে। এগুলির সঙ্গে প্রকারের কোনও সম্পর্ক নেই। অর্থাৎ প্রাকারবেষ্টনী আর মঞ্চগুলির ভেতর খালি জায়গা আছে। মঞ্চের ওপর ওঠার সিঁড়ি নীচের করিডর থেকে। এদের ওপরে কী ধরনের বাড়িঘর ছিল জানা যায় না কারণ এখানে ইট আগেই তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে একটির ওপর ইট দিয়ে বানানো ছোট চৌবাচ্চা মতো পাওয়া গেছে যার ভেতর থেকে হরিণ আর গবাদি পশুর হাড় পাওয়া গেছে। আর একটি মঞ্চের ওপর পর পর ৭টি এরকম জায়গা; ভেতরে ছাই, কাঠকয়লা এবং পোড়ামাটির ঢেলা। কাছাকাছি একটি কুয়া। এই অঞ্চল থেকে একটি ইটের তৈরি প্রণালীও বেরিয়েছে। সব দেখে মনে হয় না এই অংশে কোনও বাসস্থান ছিল। ধর্মীয় যজ্ঞাদি কাজেই এই অংশটি ব্যবহৃত হত। এদিকে ভেতরে ঢোকার মূল দরজা দক্ষিণ দিক থেকে। উত্তরদিকের অংশ থেকেও একটি সিঁড়ি ওপরে উঠে গেছে এবং তারপর ভেতরে ঢোকার দরজা, আবার উত্তরদিকের অংশে, অনুমান করা হয়েছে যে, দক্ষিণের অংশে ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে যুক্ত শ্রেণীর লোকেরা থাকতেন। এখানে বাড়িঘর সম্পর্কে বিশেষ কিছু প্রকাশিত হয়নি, তবে এই অংশে ঢোকার তিনটি রাস্তা ছিল। দুইটি উত্তর-পূর্ব কোণ ঘেঁষে; আর একটি উত্তর-পশ্চিম কোণে। বলা ভাল যে, এই ঢোকার রাস্তাগুলি নদীর পাড় থেকে। এই রাস্তাগুলি সাধারণভাবেই প্রাচীরের মাঝখান দিয়ে ভেতরে এসেছে; প্রথমে বাইরের একটি সিঁড়ি দিয়ে প্রাচীরের ওপরে এসে তারপর ভেতরের আর একটি সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে যাওয়া নয়।

প্রায় ৪০ মি. খোলা জায়গার পর, পূর্বের বৃহত্তর এবং সাধারণ মানুষের জন্য নির্দিষ্ট বসতিস্থল। উত্তর-দক্ষিণে ৩৬০ মি., পূর্ব-পশ্চিমে ২৪০ মি.; এটিও প্রাকারঘেরা তবে এখানে চারটি কোণ বাদ দিয়ে অন্য কোথাও দৃঢ় বেষ্টনীর চিহ্ন নেই। এই প্রাকার ৩.৫০ মি থেকে ৯ মি. পর্যন্ত চওড়া; ভেতরে বাড়িঘরের ৩-৪টি পর্যায় পাওয়া গেছে। কয়েকটি প্রায় সমান্তরাল রাস্তা উত্তর-দক্ষিণে, পূর্ব-পশ্চিমে। তবে এগুলি প্রাকারের সঙ্গে সমান্তরাল নয়, আর একটি রাস্তা উত্তরের অংশে ভালভাবেই বাঁকানো। তবে, মোটামুটি একটি চৌখুপী পরিকল্পনানুযায়ী পুরো অঞ্চলটি বিন্যস্ত। গলিগুলি ১.৮ মি. চওড়া আর বড় রাস্তাগুলি ৩,৬ আর ৭.২ মি. চওড়া। বোঝা যায় যে গলি আর রাস্তাগুলির প্রস্থ ঠিক করার সময় একটা পরিকল্পনা কাজ করেছে। বাড়িগুলি আঙিনা ঘিরে; আঙিনার এক কোণে চুলার চিহ্ন, আবার পশুকে জল খাওয়ানোর জন্য কাঁচা ইট দিয়ে বানানো চৌবাচ্চা। অবশ্য এই চৌবাচ্চা জল ভরে রাখার জন্যও ব্যবহার করা যেতে পারে। রাস্তার ধারে বাড়িগুলির সামনে ‘রক’ জাতীয় জিনিস আছে; বাড়িগুলির কোণের দিক ঘেঁষে কাঠের খুঁটি পোতার চিহ্ন আছে—গরুর গাড়ি মোড় নেওয়ার সময় যেন বাড়ির দেওয়াল ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। ঘরের মেঝে সাধারণত পেটানো মাটির। তবে অন্তত একটি ক্ষেত্রে নকশা করা পোড়ামাটির টালি বিছানো আছে। পূর্বের এই বসতি অঞ্চলটির থেকে ৮০ মি. মতো পূর্বে একটি জায়গা আছে যেখানে ৪/৫টি যজ্ঞ জাতীয় কাজে লাগে এমন বেদি ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়নি।

পশ্চিমের দুর্গপ্রাকার ঘেরা অঞ্চলটির প্রায় ৩০০ মি. পশ্চিম-দক্ষিণপশ্চিমে পরিণত সিন্ধু সভ্যতার সমাধিস্থান। তিন রকম সমাধি পাওয়া গেছে। প্রথমে, চৌকো বা ডিম্বাকৃতি গর্তে শরীর পুরো শোয়ানো—কখনও কানে পুঁতির কর্ণালঙ্কার। কোথাও গলায় পুঁতির মালা। দ্বিতীয়, গোলাকৃতি গর্তে শুধু মৃৎপাত্র পোঁতা আছে; তৃতীয়, চৌকো, এবং ডিম্বাকৃতি গর্তে শুধু মৃৎপাত্র। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শ্রেণীর সমাধিতে কোনও দেহাস্থি পাওয়া যায়নি।

মোহেঞ্জোদারো হরপ্পার তুলনায় কালিবাঙ্গান সম্পর্কে দু-তিনটি সাধারণ কথা বলা যায়। প্রথমত, এখানে সাধারণ মানুষের বাড়িঘর পুরোপুরি কাঁচা ইটের। রাস্তাতেও ইটের তৈরি ড্রেন নেই। বাড়িঘরের বিস্তৃত বিবরণ প্রকাশিত হয়নি, অর্থাৎ খননকারীরা প্রকাশনা করেননি, তবে কুয়োর সংখ্যা শহরে খুব সীমিত। স্নানাগারের কথাও মনে পড়ে না। নদীতেই মেয়েরা জল আনতে যেতেন এটা সহজে অনুমান করা যায়, এবং শৌচ ব্যবস্থাও ছিল নিশ্চয় নগরের বাইরে মাঠে। আর একটি জিনিস, যদিও ৩/৪ পর্যায়ে বাড়িঘর হয়েছে অর্থাৎ এক একবার পুরো নতুন করে তৈরি হয়েছে তবু কোথাও রাস্তার জায়গা দখল হয়নি। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত নগর মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী ছিল।

৪.৪ বনোয়ালী

হরিয়ানার হিসার জেলার ফতেহাবাদ তহশিলে সরস্বতীর প্রাচীন প্রবাহের দক্ষিণ পাড়ে অবস্থিত এই কেন্দ্রের সম্পর্কে প্রকাশনা বেশি অগ্রসর হয়নি। কালিবাঙ্গানের মতোই অবস্থা। তবে কালিবাঙ্গানের সঙ্গে নগর পরিকল্পনায় এর পার্থক্য আছে। নগরটির বাইরের প্রাকার উত্তর, পূর্ব এবং পশ্চিম কয়েকটি জায়গায় খনন করে বোঝা গেছে। দক্ষিণদিকের প্রাকার এখনও বের করা হয়নি। উত্তরদিকের প্রাকার ২৭৫ মি. লম্বা। এর মাঝামাঝি বোধ হয় নগরে ঢোকার একটি ছোট দরজা ছিল এবং তা দিয়ে একটি রাস্তা বোধ হয় সোজা ভেতরে এসেছে। যেখানে এই দরজাটি অনুমান করা হয়েছে সেখানে প্রাকারের প্রস্থ ৯ মি., এই অতিরিক্ত প্রস্থ থেকে অনুমান করা হয়েছে যে এখানে বোধ হয় একটি প্রাকারবেষ্টনী (bastion) ছিল। পশ্চিমদিকের প্রাকার হয়তো, লম্বায় সর্বমোট ৩০০ মি. এর কাছাকাছি। পূর্বদিকে ২৬০ মি. পর্যন্ত দৈর্ঘ্য বের করা হয়েছে, তবে পুরোটা বের করা যায়নি। এখানে দেওয়াল ৫ থেকে ৭ মি. চওড়া—গড়পড়তা ৬ মি.। দুদিক থেকেই ঢাল নেমে গেছে দেওয়ালের ওপর থেকে। এই প্রাকার তৈরির ২টি কি ৩টি পর্যায় পাওয়া গেছে। পূর্বদিকে দেওয়ালের মধ্যবিন্দুর কিছু উত্তরে নগরে ঢোকার মূল তোরণদ্বার খুঁড়ে বার করা হয়েছে। এর সামনে একটি পরিখা, দুদিকে দুটি বেষ্টনী এবং চওড়া ভেতরে ঢোকার রাস্তা। এই রাস্তা দিয়ে একটা ড্রেন বেরিয়ে এসেছে। দক্ষিণদিকের বেষ্টনীতে ওঠার জন্য একটি সিঁড়ি দেখা যাচ্ছে এবং বোধ হয় দেয়ালের ওপরে উঠে ভেতরে নেমে যাওয়ার জন্য এখানে সিঁড়ি ছিল। এই অংশে প্রকারের সামনে বোধ হয় একটি ছোট প্রাকার আছে এবং তার পর পরিখা। প্রায় ৭৫ মি. জুড়ে পরিখাটি বের করা হয়েছে। প্রাকারবদ্ধ পুরো জায়গাটি পুরো আয়তাকার ছিল না। পূর্বদিকের দেওয়ালটি বেশ তেরছাভাবেই গড়া হয়েছিল মনে হয়। তবে ভেতরে কিছুটা জ্যা-রেখার মতো একটি প্রাকার তৈরি করে পুরো জায়গাটিকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। জ্যা-রেখার মতো দেওয়ালের ভেতরের অংশটিকে বলা হচ্ছে ‘অ্যাক্রোপলিস’ এবং বাইরের অংশটিকে ‘নীচের শহর’। ‘অ্যাক্রোপলিস’ কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে এই বোঝাতে যে, এই অংশে শাসককুল থাকতেন এবং অন্য অংশের তুলনায় এটি নাগরিক শক্তির কেন্দ্রস্থল। কয়েকটি রাস্তার চিহ্ন আছে; কোনও রাস্তাই সমান্তরাল ভাবে চলছে না। যিনি বনোয়ালী খননকার্যে ভারপ্রাপ্ত ছিলেন তিনি কী পেয়েছে গুছিয়ে না লিখতে পারার জন্য আমাদের বর্ণনাতেও সন্তর্পণে অগ্রসর হতে হয়। একটি রাস্তা ৩.৪০-৩.৫০ মি. চওড়া ছিল; একটিতে গরুর গাড়ি চলার দাগও পাওয়া গেছে। বাড়িঘর অন্য জায়গাগুলির মতোই আঙিনা ঘিরে। একটি বাড়ির নকশা পরিষ্কারভাবে বেরিয়েছে। প্রবেশপথ একটি গলি থেকে যদিও বাড়িটা একটি রাস্তার ওপর। একটি পাকা ইটের ড্রেন বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটি বসানো জালার ভেতর পড়েছে। গলি দিয়ে ঢুকেই একটি বড় আঙিনা; তার উত্তর এবং দক্ষিণে একটি করে ঘর। পশ্চিমে আর একটি ঘর; তারপর কয়েকটি ছোট ছোট ঘর—একটি ঘরে চুলা বসানো আছে। একটি ঘরে ছোট আগুন জ্বালাবার বেদি আছে—এটিকে পুজোর ঘর বলে অনুমান করা হয়েছে। শহরের ভেতর প্রণালী খুব কম ছিল—একটি দুটি ছাড়া উদাহরণ পাওয়া যাচ্ছে না। বনোয়ালী খোঁড়া হয়েছে ১৯৭৪-৭৭ (৪ বছর) আর ১৯৮৩-৮৪ (১ বছর)। কালিবাঙ্গান খোঁড়া হয়েছে ৬০-এর দশকে অন্তত ৯ বছর। দুটি ক্ষেত্রেই ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব সর্বেক্ষণ খননকার্য পরিচালনা করেছে। খননকার্যের বিশদ বিবরণ প্রকাশ না করাটা দুঃখ এবং লজ্জার ব্যাপার।

৪.৫ লোথাল

গুজরাটে সৌরাষ্ট্র অঞ্চলে সবরমতীর একটি উপনদী ভোগাবোর উপত্যকায় লোথাল কেন্দ্রটি অবস্থিত। এলাকাটিকে গুজরাটিতে ‘ভাল্‌’ এলাকা বলে—বর্ষায় প্রায় সবটাই ডুবে যায়, গ্রামগুলো ভেসে থাকে। জমি সাধারণত নোনা ধরা; তবে বর্ষায় বন্যার শেষে গম, ধান, এবং তুলোর ভাল চাষ হয়। উদ্ভিদ বলতে বেশির ভাগই বাবলা গাছ আর তেঁতুল। কাছাকাছি নাল সরোবর বলে একটি জলা জায়গা আছে। অনুমান করা হয়েছে যে, কাম্বে উপসাগরের একটি খাঁড়ি আগে আরও ভেতরে ঢুকত এবং সেখান থেকে লোথালে আসার জন্য জলপথ ছিল। মূলত কেন্দ্রটি ৪০০×৩০০ মি. এবং ১৩ মি. চওড়া কাঁচা ইটের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। এখানে কোনও প্রাকারবেষ্টনী লক্ষ করা যায়নি। এটা কতটা দুর্গপ্রাকার আর কতটা শুধু বন্যা আটকাবার জন্য দেওয়াল তাতে সন্দেহ আছে। তবে, যেহেতু প্রাকার দিয়ে বন্যা আটকানো যায় না, সেহেতু, বেষ্টনী না থাকলেও দুর্গপ্রাকার হওয়াই বেশি সঙ্গত মনে হয়। কেন্দ্রটির পশ্চিমদিকে পুরনো নদীর খাত। উত্তরদিকে নদীর সঙ্গে যুক্ত একটি নালা। এখানে বাইরের দেওয়ালের বাইরের দিকটা পাকা ইটের আবরণ দেওয়া, দক্ষিণ-পূর্ব অংশ জুড়ে যে অঞ্চলটি তাকে বলা হচ্ছে ‘অ্যাক্রোপলিস’; বাকি অংশটুক ‘নীচের শহর’। এই নীচের শহরে কয়েকটি রাস্তা পাওয়া গেছে; একটি রাস্তা ১৩ মি. চওড়া; আবার ৩-৪ মি. চওড়া কি ৪-৫ মি. চওড়া রাস্তাও আছে। এখানে পাকা ইটের তৈরি বাড়িঘর বেশ ভাল অবস্থাতেই পাওয়া গেছে; একটিকে অনুমান করা হয়েছে পাথরের পুঁতি বানাবার জায়গা বলে। আর একটিকে বলা হয়েছে কোনও বণিকের বাড়ি— সামনে খোলা বারান্দা এবং পেছনে কয়েকটি ঘর। একটি বাড়ির ভেতর একটি ঘরে একটি কাঁচা ইটে তৈরি বেষ্টনীর ভেতর একটি শঙ্খ, পোড়ামাটির কয়েকটি চ্যাপটা ঢেলা, এবং পাথরের শিল এবং একটি নোড়া পাওয়া গেছে। এটিকে অনুমান করা হয়েছে একটি পূজার ঘর বলে। আর একটি বাড়িতে একটি রান্নাঘর এবং একটি বাথরুম পাওয়া গেছে—দুটো থেকেই জল বেরিয়ে বাইরে মাটিতে বসানো জালায় পড়ছে। কোথাও দেখা যাচ্ছে ধাতু গলাবার জায়গা। একটি রাস্তার কোণের বাড়ির বাইরের দিকে ৪.৫×১.২ মি. আয়তনের বারান্দা, এর পর ৯ মি.×৪.৫ মি. আয়তনের একটি হলঘর, আর তার সঙ্গে আরও দুটি ঘর যার একটির আয়তন ৪.৫ মি.×৪ মি.। ঘরের মেঝে কাঁচা ইট বিছানো এবং দরজার চৌকাঠ ০.৯২ মি. থেকে ১.২৩ মি. চওড়া। ২২ সে.মি. চওড়া সিঁড়ির ধাপ দেখা গেছে। পাকা ইটের তৈরি ড্রেন লোথালে অনেক; কোনওটা সমতলভাবে ইট পেতে ঢাকনা দেওয়া, কোনওটা ইট গেঁথে খিলানের মতো করা। ড্রেনগুলির ঢাল ভাল এবং কোথাও মুখে কাঠের দরজা বসাবার চিহ্ন লক্ষ করা যায়।

লোথালের পূর্বদিক প্রায় সবটা জুড়ে ‘ডক’ বা নৌকো বা তদানীন্তন জাহাজ নোঙর করা এবং সারানোর জায়গা। উত্তরের নালা দিয়ে প্রথম ঢোকার রাস্তা ছিল। তারপরের ঢোকার জায়গা দক্ষিণ-পূর্ব কোণে। এ ছাড়া প্রয়োজনমতো জল বের করার জায়গা দক্ষিণদিকের দেওয়ালে, মূলত এই ডকটি উত্তর-দক্ষিণে ২১৯ মি. লম্বা, পূর্ব-পশ্চিমে ৩৮ মি. চওড়া ৪.১৫ মি. উঁচু পাকা ইটের দেওয়াল ঘেরা একটি জায়গা, যেখানে নৌকো ঢোকার রাস্তা ছিল। প্রথম পর্যায়ে এই রাস্তাটি ১২ মি. চওড়া। জোয়ারের বেশি জল বাইরে বের করে দেওয়ার জন্য রাস্তাও ছিল এবং এই জল বের করে দেওয়ার মুখটা কাঠের দরজা দিয়ে বন্ধ করে দেওয়ার বন্দোবস্তও ছিল। এর ভেতর জলের গভীরতা থাকত অন্যূন ২ মি., আর জোয়ারের সময় ৩.৫ মি.। এটি ডক না হয়ে চাষের জলের জন্য পুকুর—এ কথা কয়েকজন বলেছেন। কেউ কেউ বলেছেন যে, এখানে জোয়ারের জল আসার কোনও প্রশ্ন আসে না। তবে, সম্প্রতি এই ডকে জমা পুরনো মাটি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, জোয়ারের জল এখানে ঢুকত। ডক ছাড়া এটির অন্য কিছু হওয়ার সম্ভাবনা কম। আর একটি জিনিস লক্ষ করার আছে। এত বড় একটি জায়গা জল আটকানোর জন্য প্রাচীর দিয়ে ঘিরতে লক্ষ লক্ষ পাকা ইট দরকার হয়েছে; জলের চাপ আটকানো; লেভেল ঠিক করে অতিরিক্ত জলের বাইরে যাওয়ার পথ ঠিক করা—সব মিলিয়ে প্রযুক্তিগত কুশলতা লক্ষ করার মতো। সমসাময়িক পৃথিবীতে এরকম ডক পাওয়া যায়নি। ডকের পশ্চিমদিকে সবটা জুড়ে ইট বাঁধানো খোলা জায়গা। এটিকে নৌকো থেকে মাল নামাবার জায়গা বলা হয়েছে। এর একপাশ জুড়ে ‘অ্যাক্রোপলিস’। পরপর কিছু ঘর—প্রায় ১২টি, দুটি কামরা এবং একটি স্নানের জায়গা নিয়ে এক একটি বাড়ি। একটি জায়গাকে গুদামঘর বলে হয়েছে।

এখানে একটি মন্তব্য করা যায়। আয়তনের দিক থেকে লোথাল মোহেঞ্জোদারো, হরপ্পার চাইতে অনেক ছোট—কিন্তু পাকা ইটের ব্যবহার, নগর পরিকল্পনাতে, সাধারণ গুরুত্বে ছোট হলেও এই কেন্দ্রটি একেবারেই উপেক্ষণীয় নয়। শুধু ভাল্‌ এলাকার জমি চাষ করে এই কেন্দ্রটির স্বাচ্ছন্দ্য আসেনি। ব্যবসা বাণিজ্যের একটি হাত এখানে থাকা স্বাভাবিক। এর সমাধিস্থান প্রকারের বাইরে উত্তর-পশ্চিম কোণে। দুটি সমাধিতে নারী-পুরুষ শোয়ানো, সাধারণত উত্তরশিয়রী—অলঙ্কার, মৃৎপাত্র, কোথাও গরু-ভেড়ার হাড়। ৯-১০ বছরের একটি খুলিতে চৌকো করে ফুটো করা, অবশ্যই কোনও চিকিৎসার জন্য।

৪.৬ সুরকোটাডা

কচ্ছের ভুজ থেকে ১৬০ কি.মি. উত্তর-পূর্বে, আদেসার বলে একটা ছোট শহর থেকে ১২ কি.মি. উত্তর-পূর্বে সুরকোটাডা। কেন্দ্রটি বিশেষ বড় নয়—মাত্র ১৬০×১২৫ মি.। একটি নদী এদিক দিয়ে গিয়ে কচ্ছের ‘রান্‌’-এ মিশেছে। এখন একটি ছোট নালা হলেও নদীটি এক সময় বড় ছিল তার প্রমাণ আছে। তিনটি পর্যায়ে এখানে বসতি। সুরকোটাডাতে একটিই বসতি অঞ্চল; কিছুটা লোথালের মতো, তবে সুরকোটাডার সঙ্গে পরিকল্পনার দিক থেকে কালিবাঙ্গানের পশ্চিমের বসতি অঞ্চলটির সাদৃশ্য বেশি। কালিবাঙ্গানের পূর্বদিকের বসতি অঞ্চলটি এখানে নেই। কালিবাঙ্গানের পশ্চিম অঞ্চলটির মতো প্রাকার দিয়ে সুরক্ষিত একটি জায়গা—কোণে কোণে বেষ্টনী বা বুরুজ দিয়ে সুদৃঢ় করা। জায়গাটি প্রায় মাঝখানে আর একটি বুরুজ-যুক্ত প্রাকার দিয়ে দ্বিখণ্ডিত; পশ্চিমের অংশটা বলা হয়েছে দুর্গকেন্দ্র বা ইংরাজিতে ‘সিটাডেল’; পূর্বের অংশটি অনুমান করা হয়েছে সাধারণ থাকার জায়গা বলে। অনুমান করা হয়েছে, বসতিটি ৬০০ বছর মতো ছিল; এর ভেতর এর মূল বিন্যাস পালটায়নি। যে পরিবর্তনগুলি দেখা গেছে তা এই : দুর্গকেন্দ্রের প্রাকারের প্রস্থ প্রথম পর্যায়ের ৭ মি. থেকে তৃতীয় পর্যায়ে ৪ মি. হয়েছে; সাধারণ বাসের অঞ্চলটির প্রাকার বরাবর ৩.৪৫ মি. থেকে গেছে। তিনটি পর্যায়েই কাঁচা ইটের মাপ ১০×২০×৪০ সে.মি.। প্রথম পর্যায়ে প্রাকারে কাঁচা ইট, মাটির ঢেলা, ভেঙে পড়া টুকরো সবই ব্যবহার হয়েছে; তবে তৃতীয় পর্যায়ে পাথরের টুকরো এবং যত্ন করে কাটা পাথরের ব্যবহার বেশি। দুর্গকেন্দ্রে ঢোকার রাস্তা দক্ষিণদিকে; এখানে প্রহরীদের প্রহরাকক্ষ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে এমন কক্ষও পাওয়া গেছে। তৃতীয় পর্যায়ে এই ঢোকার রাস্তাটা প্রাকারেরও বাইরে দেওয়াল গেঁথে এমন করা হয়েছে যে, একটু ঘুরে একটি আঙিনার ভেতর দিয়ে সিঁড়িতে উঠে ভেতরে যেতে হয়। সাধারণ বাসস্থান অঞ্চলটিতেও ঢোকার জায়গা দক্ষিণদিক দিয়েই, এ ছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব কোণেও একটি ঢোকার জায়গা আছে। এই দুই দিক দিয়েই সোজাসুজি ভেতরে যাওয়া যায়।

কালিবাঙ্গানে দুর্গকেন্দ্রে কোনও সাধারণ বাড়িঘর পাওয়া যায়নি, কিন্তু সুরকোটাডাতে এই অংশে সাধারণ বাড়িঘর আছে। দুর্গকেন্দ্র থেকে সাধারণ বাসের অংশে যাওয়ার জন্য প্রথম পর্যায়ে, ৫.৩০ মি. প্রস্থ নিয়ে শুরু হয়ে ৪ মি. প্রস্থে শেষ হয়েছে এরকম রাস্তা ছিল। দুর্গকেন্দ্রের দিকটা বাসের অংশটির চাইতে উঁচু; সেজন্য দুটোর মাঝের যোগাযোগের রাস্তাটি প্রথমে মাঝের প্রাকারে উঠে তারপর আবার সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেছে। দুর্গকেন্দ্রের ভেতর সবচেয়ে বড় বাড়িটিতে নয়টি কামরা এবং এদের আয়তন ৪.৩০×৩.৬০ মি. থেকে ১.৮০×৪ মি.। বাড়িগুলির ভেতর গলি লক্ষ করা গেছে; রাস্তা যা পাওয়া গেছে তা সোজা নয়। বাসের অঞ্চলটিতে কোনও কোনও বাড়িতে ৫টি পরস্পর যুক্ত কামরা (প্রত্যেকটি ২.৯০×২.৫০ মি.) ছিল—বাড়ির পেছনের দিক ঘেঁষে। এ ছাড়া এই সব বাড়িতে পেছনের দিকেই আঙিনা পাওয়া গেছে। এই আঙিনাতে হয়তো গবাদি পশু রাখা হত।

৪.৭ ধোলাবিরা১০

যোলাবিরা কেন্দ্রটিও কচ্ছে অবস্থিত। কচ্ছের ‘রান্‌’-এর ভেতর খাদির নামক একটি দ্বীপের উত্তর-পশ্চিম কোণে। কেন্দ্রটির উত্তরদিক ঘেঁষে নগর প্রাকারের বাইরে দিয়ে মান্দসার নালা, আর দক্ষিণে প্রাকারবেষ্টনীর দক্ষিণ-পূর্ব অংশের ভেতর দিয়ে মানহার নালা। দুটোই রান্‌-এ গিয়ে পড়ে; নালা হলেও বৃষ্টিতে জোরে জল নামে, আবার তাড়াতাড়ি শুকিয়েও যায়। বস্তুত, এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম—বছরে ১০ ইঞ্চির মতো; তা ছাড়া পরপর কয়েক বছর বর্ষা না হওয়ার ঘটনাও বিরল নয়। বর্ষার জল ধরে রাখার জন্য যে পুকুর ইত্যাদি আছে তাতে বিশেষ সুরাহা হয় না। তবে এই অঞ্চলের জমির নীচে চুনাপাথরের স্তরে জলের প্রাচুর্য আছে; পুরো খাদির অঞ্চলে একমাত্র ধোলাবিরা অঞ্চলেই এটার প্রাচুর্য। তবে চাষবাসের জমি বেশি নেই এই অঞ্চলে। বর্ষাতেই যা চাষ হয়। সিন্ধু সভ্যতার লোকেরা কেন এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর গড়েছিল তা বুঝতে আমাদের অসুবিধে হয়। আমরা আগে বলেছি যে ঘগ্‌গর-হাক্‌রা এবং সিন্ধুর মিলিত প্রবাহ রান্‌-এ এসে মিশত এবং সেই কারণে ধোলাবিরাতে বৃষ্টিপাত এখনকার চাইতে বেশি না হলেও, সাধারণ শ্যামলিমা বেশি থাকা স্বাভাবিক।

ধোলাবিরা কেন্দ্রটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত, কিছু দিক থেকে ধোলাবিরা বোধ হয় এই সভ্যতার সব কটি কেন্দ্রের ভেতর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে কালিবাঙ্গান, বনোয়ালী এঁদের যেমন পূর্ণাঙ্গ বিবরণ লেখা হয়নি, তেমনি ধোলাবিরার খননকার্যের বিবরণও মূলত অপ্রকাশিত। ভারতের প্রত্নতত্ত্ব চর্চার ইতিহাসে এটি খুব দুঃখের কথা।

পুরো প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চলটি ১০০ হেক্টর আয়তনের বলে অনুমান করা হয়েছে। তবে মূল নগরের আয়তন উত্তর-দক্ষিণে ৬৫০ মি. এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৮০০ মি.। এই পুরো অঞ্চলটিই প্রাকার দিয়ে ঘেরা, তবে দক্ষিণ-পূর্ব অংশে মানহার নালার জায়গাটুকুও এই প্রাকারবেষ্টিত ছিল কি না তা জানা যায়নি। ভেতরে, প্রথম যাকে সোজা দুর্গ (castle) বলা হয়েছে, সেই অঞ্চলটি দিয়ে শুরু করতে পারি। পুরো অঞ্চলটি পূর্ব-পশ্চিমে ৩০০ মি., আর উত্তর-দক্ষিণে ১৪০ থেকে ১৬০ মি.। পূর্ব অংশে ১১৪×৯৪ মি. প্রাকারবদ্ধ একটি অঞ্চল। এর পশ্চিমদিকে, লাগালাগি, প্রাকারবদ্ধ আর একটি জায়গা; আয়তন ১২৩ মি. বর্গ। এই দ্বিতীয় জায়গাটি অপেক্ষাকৃত নিচু। দুর্গকেন্দ্রটি ১৫ থেকে ১৮মি. পর্যন্ত উঁচু, নীচের জমি থেকে; পশ্চিমের প্রাকারবদ্ধ জায়গাটি এর অর্ধেক উঁচু। যাকে দুর্গ বলা হয়েছে তার ভেতর ঢোকার রাস্তা চারদিকের প্রাকার থেকেই আছে। পূর্বের অংশটিতে পাথরের বাড়িঘর সাধারণত প্রাকার ঘেঁষে; মাঝখানের জায়গাটি নিচু।

পুরো দুর্গ-অঞ্চলটির উত্তরে, নিচুতে কিছুটা খোলা জায়গা; তারপর যাকে ‘মধ্যম শহর’ বলা হয়েছে সেই জায়গা। পূর্ব-পশ্চিমে ২৬০ মি., উত্তর-দক্ষিণে ২৫০ মি.। এটিও প্রাকারবদ্ধ এলাকা; বুরুজ বা বেষ্টনী আছে; বোধ হয় রাস্তাও। এই অংশটুকুর উত্তরে নগর প্রাকার পর্যন্ত আবার খোলা জায়গা; তবে এটার পূর্বদিকে, প্রাকারের ওপারে, বাকি অঞ্চলটুকু জুড়ে ‘নীচের শহর’—সাধারণ মানুষের বাসস্থল।

প্রাকারবদ্ধ নগরটি পূর্ব-পশ্চিমে ৭৭২ মি., উত্তর-দক্ষিণে ৬২৬ মি. (২-৩ মি. তারতম্য হতে পারে দুই ক্ষেত্রেই)। যদি দক্ষিণদিক থেকে প্রথম দেখি, তবে প্রথমে নগরপ্রাকারের পর কিছু খোলা জায়গা। তার উত্তরে দুটি লাগালাগি পূর্ব-পশ্চিমে বিন্যস্ত প্রাকারবদ্ধ অংশ। পূর্বের অংশটির উচ্চতা নীচের জমি থেকে ১৫ থেকে ১৮ মি. উঁচু; পশ্চিমের অংশটির উচ্চতা এর অর্ধেক। দুটো মিলিয়ে বলা হয়েছে দুর্গকেন্দ্র। পূর্বের অংশটির আয়তন ১১৪ মি. × ৯৪ মি.; পশ্চিমের অংশটি বর্গাকার— এক একটি দিক ১২৩ মি.। এই দুর্গকেন্দ্রের উত্তরে ৫৫ মি. প্রশস্ত একটি খোলা জায়গা; তারপর উত্তরে ৩৩৩ মি.×১৮১ মি. (পশ্চিম অংশে ২০০ মি.) প্রাকারবদ্ধ ‘মধ্যম শহর’। তারও উত্তরে, উত্তরের নগর প্রাকার পর্যন্ত খোলা জায়গা। ‘মধ্যম শহর’টির প্রাকারের বাইরে পূর্বদিকে, পূর্ব-পশ্চিমে ৩০০ মি. প্রশস্ত ‘নীচের শহর’। এর সবটার আয়তন এখনও বোঝা যায়নি। দুর্গকেন্দ্রের পূর্ব অংশে পূর্বের তোরণদ্বারটি খোঁড়া হয়েছে। প্রথমে একটি সিঁড়ি, তারপর একটি নিচু, বসানো প্রবেশ পথ, উঠে গেছে একটি কক্ষে এবং তারপর একটি প্রশস্ত এবং লম্বাটে ছাদ জাতীয় খোলা জায়গা। সবটাই ১২.৩০ মি. চওড়া প্রকারের ভেতর। যে কক্ষটির কথা বলা হয়েছে তার কাছাকাছি ভাল পালিশ করা, কিছুটা ডমরুর মতো দেখতে প্রস্তরখণ্ড এবং তেমনই পালিশ করা প্রস্তর-স্তম্ভ। এই অঞ্চলেই কোথাও ৯টি পাথর কাটা এবং হয়তো কাঠের কোনও ফলকের ওপর লাগানো লিপিচিহ্ন—প্রত্যেকটি লিপিচিহ্ন ৩৭ সে.মি. উঁচু এবং ২৫ থেকে ২৭ সে.মি. চওড়া। পুরো জিনিসটি মনে হয় একটি সাইনবোর্ডের মতো ছিল। এই অংশেরই উত্তরদিকের দেওয়াল ঘেঁষে ১২.৮০ মি. চওড়া এবং ২৪ মি. লম্বা, ৭০ মি. চওড়া প্রণালী শুদ্ধ একটি বৃষ্টির জল ধরে রাখার জায়গা পাওয়া গেছে।

ধোলাবিরার খননকার্যের ওপর যা প্রকাশিত হয়েছে, তার মধ্যে অনেক কিছুরই কোনও সুষ্ঠু নকশা বেরোয়নি; যার ফলে কোনও পরিষ্কার ছবি তুলে ধরা এখনও সম্ভব নয়। তবে কেন্দ্রটির বেশ কিছু নিজস্ব বা আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথমত ‘উচ্চ, মধ্যম এবং নীচ’—এই তিন স্তরে নগর পরিকল্পনা অন্য কোথাও পাওয়া যায়নি। নগরের ভেতর বড় বড় খোলা জায়গাও অন্যত্র ধরা পড়েনি। দ্বিতীয়ত, জল সংগ্রহ করে রাখার ব্যাপারে নগরটিতে অতিরিক্ত গুরুত্ব ছিল। দুটো নালার জল ধরার ব্যাপার তো ছিলই, তা ছাড়া ভেতরে জল রাখার যে ব্যবস্থা পাওয়া গেছে তা বিস্ময়কর। তৃতীয়ত, প্রস্তর-স্তম্ভ এবং কিছু বৃহৎ প্রস্তর খণ্ড—প্রত্যেকটিই ভাল পালিশ করা। চতুর্থত, এক ফুটের বেশি উঁচু লিপিচিহ্ন পাথরে কেটে বানিয়ে ৯টি কাঠের ফলকের ওপর সাজিয়ে সাইনবোর্ড। সত্যি বলতে ধোলাবিরার বিভিন্ন আবিষ্কারের গুরুত্ব আমরা পুরো বুঝতে পারিনি। এর জন্য প্রথম দরকার খননকার্যের পূর্ণাঙ্গ বিবরণের সুষ্ঠু প্রকাশনা।

৪.৮ কুনতাসি১১

কচ্ছে এবং সৌরাষ্ট্রে—পুরো গুজরাটেই—পরিণত সিন্ধু সভ্যতার বহু কেন্দ্র আছে। যে সব জায়গায় খনন হয়েছে তার প্রত্যেকটি বিবরণ দেওয়া এখানে সম্ভব নয় বা প্রয়োজনীয়ও নয়। তবে কুনতাসির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। কুনতাসি রাজকোট থেকে উত্তরে, সৌরাষ্ট্রের উত্তর উপকূলে। বছরে সব সময় জল থাকে এমন একটি ছোট নদী ঝিনাঝারার পাশে ২ হেক্টর আয়তনের বসতি। সোজা গেলে সমুদ্র ৪ কি.মি.। বড় বড় পাথর সাজিয়ে প্রাকার এবং তার ভেতরে ও বাইরে বসতি। একটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে যে, কেন্দ্রটি নদীর ধারে বটে কিন্তু নদীর জল নোনা— এমনকী স্থানীয় কুয়োর জলও নোনা। মিষ্টি জল পাওয়া যায় বর্তমানের কুনতাসি গ্রামে, যা প্রাচীন কেন্দ্রটি থেকে ২.৫ কি.মি. দূরে। এখানে দুটি মূল স্তর পাওয়া যায়। প্রথম স্তরটিকে বলা হয়েছে পরিণত সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ের আর দ্বিতীয় স্তরটিকে বলা হয়েছে শেষ পর্যায়ের সিন্ধু সভ্যতার স্তর। প্রথম স্তরটির বাড়িঘরের দুটি পর্যায়। প্রথম পর্যায়ের বাড়িঘরের সম্পর্কে বিশদ জানা হয়নি। এগুলি পাথরের তৈরি ছিল এবং সাধারণ বসবাসের জন্য। দ্বিতীয় পর্যায়ে বাড়িঘর পাথরের ভিতের ওপর কাদার গাঁথুনিতে পাথর বসিয়ে (স্থানীয় পাথর), কখনও কাঁচা ইটের তৈরি। এই সময় পুরো বসতিটাকে বলা হয়েছে চতুঃশালা পরিকল্পনায় তৈরি অর্থাৎ চারপাশে বাড়িঘর, আর মাঝখানে অনেকটা খোলা জায়গা। ১২৫ মি. বর্গাকার একটি জায়গা জুড়ে দুটো প্রাকার—এদের প্রস্থ ১ থেকে দেড় মি. এর ভেতর। পূর্বদিকে ৩ মি. চওড়া প্রবেশদ্বার—এই প্রবেশদ্বারের দুদিকে প্রাকার আয়তাকার বেষ্টনী দিয়ে সুরক্ষিত। এ ছাড়াও এখানে আরও কিছু সুরক্ষার বন্দোবস্ত ছিল। এই প্রবেশদ্বারের ভেতর দিয়ে একটি রাস্তা বসতির ভেতর পশ্চিমদিকে গেছে। এই রাস্তার উত্তরে বড় বড় (৮×৪.২০ মি.) কয়েকটি কামরা (সামনে বারান্দা)। এর পর রাস্তাটা উত্তরে বেঁকে গেছে। যেখানে রাস্তাটি বাঁক নিয়েছে তার সঙ্গের বাড়িটি ১৩.২০×৭.৮০ মি., মাঝখানে দেওয়াল দিয়ে দুটি কামরা। এই বাড়ির বাইরে, উত্তরমুখী রাস্তার ওপর একটি পাথরের অর্ধচন্দ্রাকার বেদি। এ ছাড়া কুনতাসির এই পর্যায়ের উল্লেখনীয় জিনিস হচ্ছে উত্তরের প্রাকারের পশ্চিম অংশ থেকে একটি ২৩×৫ মি. করিডর বা রাস্তা এসে একটি মহল্লাতে শেষ হচ্ছে। এখানে ৫টি মাটির ভেতর বসানো শস্যগোলার চিহ্ন পাওয়া গেছে। তা ছাড়া পাওয়া গেছে একটি কক্ষ থেকে বর্গাকৃতি ফেঁয়স (faience) দিয়ে বানানো সিলমোহর—ভেতরে লাইন কেটে দুটি বর্গক্ষেত্র তৈরি হয়েছে—একেবারে মাঝখানের বর্গক্ষেত্রের ভেতর জ্যামিতিক চৌকো চিহ্ন সাজানো। এই মহল্লার পশ্চিমদিকে ঘরগুলির ভেতর মৃৎপাত্র তৈরির ভাটা, পাথরের পুঁতি, তামার জিনিস ও হাতিয়ার ইত্যাদি পাওয়া গেছে। অনুমান করা হয়েছে যে, জিনিসগুলি এখানে তৈরি হত। কুনতাসিতে যে পাথরের পুঁতি পাওয়া গেছে তার ভেতর কিছু বেশ লম্বা, চমৎকার স্বচ্ছ লাল কার্নেলিয়ান পাথরের পুঁতি। এই ধরনের পুঁতি সমসাময়িক মেসোপটামিয়া ও ইরানে রপ্তানি হত, তার প্রমাণ আছে। কুনতাসিকে একটি আদি যুগের বন্দর এবং শিল্প বাণিজ্যের স্থান বলে কল্পনা করা হয়েছে। এত বিস্তৃত অঞ্চলে এত বসতি সত্যিই লক্ষ করার মত। কাজেই পরিণত সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন কেন্দ্র বিভিন্ন ধরনের এবং বিভিন্ন জাতের হবে—এটা ধরে নেওয়াই সমীচীন। কুনতাসি সম্পর্কে আর একটি লক্ষণীয় বিষয়—এর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটি পাথরের তৈরি বুরুজ।

৫ কারিগরি বিদ্যার কিছু দৃষ্টান্ত

৫.১ মৃৎপাত্র ও মৃৎশিল্প

মৃৎপাত্র এমনিতে সামান্য জিনিস হতে পারে কিন্তু এর পেছনে একটি বিরাট কারিগরি এবং অর্থনৈতিক জীবন লুকিয়ে আছে। মৃৎপাত্রের কাদা নির্বাচন, কাদা ছানা এবং তাতে প্রয়োজনমতো মিশেল দেওয়া, হাতে বা চাকে গড়া, গড়ার সময় বিভিন্ন আকৃতি সম্পর্কে ধারণা, ভাটাতে কাঁচা মৃৎপাত্র (রৌদ্রে শুকানো) পোড়ানো, তারপর সেই মুৎপাত্রের আশপাশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে কুমোরের উৎপাদন হিসাবে স্বীকৃত হওয়া, কোথাও কোথাও দূরদূরান্তে মৃৎপাত্রের রপ্তানি—সব কিছুর পেছনেই কুমোরদের বহু শতাব্দীর প্রযুক্তি বিদ্যার অভিজ্ঞতা এবং সমসাময়িক অর্থনীতির চাহিদা কাজ করে। তারপর যেখানে মৃৎপাত্রের ওপর রঙিন প্রলেপ দেওয়া হয় এবং তার ওপর বিভিন্ন চিত্রণ করা হয় সেখানে সমসাময়িক ধ্যানধারণা ও শৈল্পিক চেতনাও কাজ করে। প্রাগিতিহাসের একান্ত প্রস্তর ব্যবহারের পর্যায়গুলি বাদ দিলে, যে কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানেই রাশি রাশি মৃৎপাত্রের টুকরো পাওয়া গেছে। এগুলির মাধ্যমে আঞ্চলিক রীতিনীতির জানার জন্য প্রত্নতাত্ত্বিকদেরই বিশেষ ঝোঁক আছে বটে, কিন্তু তার বাইরে প্রযুক্তি এবং অর্থনীতি, এবং কিছুটা শৈল্পিক চেতনা নিয়ে মৃৎপাত্রের একটি নিজস্ব বৃহৎ জগৎ আছে।

সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন পর্যায়ে কী কী ধরনের মৃৎপাত্র ছিল এবং কোন কোন পর্যায়ে এবং অঞ্চলে তারা কীরকম ভাবে তৈরি হত তা আমরা জানি। তবে আঞ্চলিক রীতিনীতি বাদ দিলেও সিন্ধু সভ্যতার পরিণত পর্যায়ের মৃৎপাত্রের কিছু মৌলিক পরিচয় আছে। প্রথমত, গড়ার ধরন খুব ভাল। কিছুটা মোটা, ভালভাবে পোড়ানো, খুব দক্ষভাবে চাকে তৈরি করা। এই পর্যায়ের মৃৎপাত্রের সঙ্গে তার পূর্ব এবং পরের মৃৎপাত্রের অথবা মৃৎপাত্র শৈলীর অনেক তফাত—এমনকী, চিত্রণেও। ভাল লাল প্রলেপের ওপর ভাল তুলিতে দক্ষ হাতে বিভিন্ন জ্যামিতিক এবং কোথাও কোথাও প্রাকৃতিক নকশার ঘন বুনোট। কোথাও কোথাও গল্প বলার ছাপ। লোথাল থেকে পাওয়া একটি টুকরোতে একটি হরিণ যে ভাবে মুখ ঘুরিয়ে পেছনে মুখ বাড়ানো একটি পাখিকে দেখছে তাতে কোনও গল্পগাথার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। চিত্রিত মৃৎপাত্রের তুলনায় চিত্রবিহীন মৃৎপাত্রের সংখ্যা অনেক বেশি। এদের কিছু আকৃতি যে গ্রামেগঞ্জে খুঁজলে এখনও পাওয়া যাবে না তা নয়। চা বা জল/দুধ খাওয়ার জন্য উত্তর ভারতের অনেক বাজারে, রেল স্টেশনে ব্যবহৃত ভেতরে ঢেউখেলানো একটি দাগ দিয়ে নীচে সরু হয়ে আসা মাটির গ্লাস একটি পরিচিত উদাহরণ। পূর্ব ভারতে চ্যাপটা বা তেরছা কানাতোলা হাঁড়ি নেই, কিন্তু অন্য ধরনের হাঁড়ি, জালা, বাটি বিস্তর। গুজরাটে এই পর্যায়ের এক ধরনের বাটিতে একটি ছোট, একটু চ্যাপটা বাঁটের মতো হাতল লাগানো আছে। আর এক ধরনের ফুটো ফুটো করা পাত্র, মোটামুটি সব জায়গাতেই পাওয়া যায়। স্পষ্টতই অন্য একটা বড় জালার ফুটন্ত জলের ওপর এই ধরনের পাত্র বসিয়ে ভাপে কোনও কিছু সিদ্ধ করা হত। বদনার মতো নল লাগানো কোনও পাত্র নেই—যাতে জল গড়ানো যায়, সাধারণ ঘটিরই ব্যবহার ছিল। বিভিন্ন ধরনের লম্বা পা-ওয়ালা বাটি বা কানা তোলা থালা পাওয়া গেছে, যাকে ইংরেজিতে ‘ডিশ-অন-স্ট্যান্ড’ বলা হয়। এ রকম পা লাগানো রেকাবি এখনও তৈরি হয়, তবে পেতল কাঁসাতে। অনেক সময়, চিত্রণ ছাড়াও মৃৎপাত্রের গায়ে অলঙ্করণ আছে। কাঠি দিয়ে চাকে গড়ার সময়েই বাইরের দিকে দাগ দেওয়া যেত। লাল বা লালচে প্রলেপ দেওয়া বা প্রায় লাল রঙের কাছাকাছি এনে পোড়ানো পাত্র ছাড়াও, হলুদ-ধূসর রঙের পাত্রও যথেষ্ট আছে। তা ছাড়া, অন্যান্য শৈলীরও নিদর্শন হিসেবে দেখা যায়, কিছু ক্ষেত্রে এত তাপমাত্রায় মৃৎপাত্র পোড়ানো হয়েছে যে, তা প্রায় ‘গ্লেজ্‌ড’ জাতীয় চকচকে হালকা পাথরের মতো পাত্রে পরিণত হয়েছে। গুজরাটে অনেক কেন্দ্রেই আমরা ‘কালো এবং লাল’ (পাত্রের কানা এবং ভেতরের দিকটা কালো, বাইরেটা লাল; পাত্র উলটো করে ভাটায় বসিয়ে পোড়ালে এ রকম হয়) পাত্র পেয়েছি। আমরা কোন অঞ্চলে কী ধরনের মৃৎপাত্র পাওয়া যায় জানি কিন্তু তাদের বিশদ প্রকৃতি, আদান-প্রদান ইত্যাদি নিয়ে খুব একটা গবেষণা হয়নি।

মৃৎশিল্প অবশ্য শুধু মৃৎপাত্র তৈরিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। পোড়ামাটির খেলনা, ছোট মূর্তি এবং গয়না বিস্তর ছিল। গয়না বলতে মূলত পুঁতি, যা দিয়ে মালা হত, হাতের বালা, হয়তো কর্ণচূড়ও। এ ছাড়া বড়, গোল পুঁতিরই মতো এবং বড় ছিদ্রযুক্ত জিনিস ছিল, যা হয়তো মাছ ধরার জালে লাগানো হত। অনেক তাপে পুড়িয়ে বিশেষ শক্ত, প্রায় পাথরের মতে, মাটির বালা তৈরি হত। দৈনন্দিন পূজা বন্দনা, ব্রত ইত্যাদিতে কাজে লাগে এমন ছোট, কিছুটা জ্যামিতিক, নারী মূর্তি ও গবাদি পশুর মূর্তি বিস্তর পাওয়া যায়। সব কিছুরই যে বিশেষ গুরুতর উদ্দেশ্য থাকতে হবে এমন নয়; অনেক কিছু বাচ্চাদের খেলনা হতে পারে। পাখির আকারে বানানো মাটির ‘হুইসল’, ঝুমঝুমি., বাঁদরের মূর্তি, গরুর গাড়ির ফ্রেমের টুকরো ইত্যাদির কথা এই প্রসঙ্গে মনে আসে। পোড়ামাটির চ্যাপটা ঢেলা, যাকে প্রত্নতত্ত্বের ভাষায় ‘টেরাকোটা কেক’ বলা হয় এবং যা সিন্ধু সভ্যতার সব পর্যায়েরই একটি বিশেষ চিহ্ন, তার ব্যবহারের উদ্দেশ্য যে খুব সঠিক নিরূপিত হয়েছে তা নয়। লোথালে এটি ‘অগ্নিবেদি’ থেকে পাওয়া গেছে; সেই সুবাদে ধর্মীয় ছোঁয়া থাকতে পারে, কিন্তু নিশ্চিত কিছু নয়। সব সময় যে বস্তুটি ত্রিকোণ বা চ্যাপটা তাও নয়: গোল, মাঝখানে একটু নিচু, এ রকম দৃষ্টান্ত দেখা গেছে। পাথরের টুকরোর বিকল্প হিসাবে এ ধরনের মাটির জিনিস বহু কাজে লেগে থাকতে পারে।

৫.২ প্রস্তরের কারিগরি

সব চাইতে প্রাথমিক পর্যায়ে পাথর কাটা এবং কাটা টুকরো দিয়ে কোথাও বাড়ির ভিত করা, কোথাও প্রকার বানানো, প্রাকারের বেষ্টনী এবং বুরুজ দেওয়া ইত্যাদি কাজ হত। স্থাপত্য পরিকল্পনাতেই ধোলাবিরা থেকে প্রাপ্ত সাক্ষ্য এই প্রসঙ্গে যুগান্তকারী। বড় গোলাকৃতি এবং ছিদ্রযুক্ত মসৃণ পাথর স্তম্ভের ভিত্তি হিসেবে বেশ কয়েকটি পাওয়া গেছে। এমনও হতে পারে যে ভিত্তি হিসেবে না থেকে এ ধরনের পাথর একটির ওপর আর একটি সাজিয়ে স্তম্ভের মতো কিছু তৈরি হত। চার থেকে ছয় ফুট উঁচু, ব্যাঙের ছাতার মতো দেখতে শীর্ষদেশ—এমন পাথরের স্তম্ভও অবশ্য পাওয়া গেছে। এই নিদর্শনগুলির মসৃণতা এবং বৃহদাকার দেখলে বোঝা যায় যে, তখন শিল্পের মান সমসাময়িক পৃথিবীর তুলনায় বিশেষ উঁচু ছিল।

এ ছাড়া আলাবাস্টার জাতীয় চিকণ পাথরের পাত্র ছিল; চার্ট জাতীয় পাথরের ওজন (বাটখারার ওজন) ছিল। দুটিই উন্নত তক্ষণবিদ্যার পরিচায়ক। তা ছাড়া গয়না হিসাবে পাথরের পুঁতি তৈরি তো ছিলই। একটি বিশেষ ধরনের পুঁতি তৈরি হত— পুঁতির ওপর ক্ষার-জাতীয় রস দিয়ে নকশা করা। এটি সমসাময়িক পৃথিবীতে সিন্ধু সভ্যতা ছাড়া কোথাও ছিল না। এর কিছু বাণিজ্যে ব্যবহার হত—এদের ইংরেজিতে বলে ‘এচ্‌ড বিড’—এদের বহু নিদর্শন পশ্চিম এশিয়া থেকে পাওয়া গেছে, এই সভ্যতার বহির্বাণিজ্যের প্রমাণ হিসাবে। গুজরাটে এখনও বিভিন্ন ধরনের পাথরের পুঁতি তৈরি হয়ে থাকে—কাম্বে অঞ্চল এই ধরনের পুঁতির জন্য আজও বিখ্যাত, গুজরাটে পাথরের পুঁতি বেশি তৈরির কারণ হচ্ছে যে, এই অঞ্চলে এর জন্য সুবিধাজনক পাথর প্রচুর। রাজপিপলার পাথরের খাদ এই কারণে বিশেষ প্রসিদ্ধ। সিন্ধু সভ্যতার কাল থেকেই হয়তো রাজপিপলার খাদের ব্যবহার হয়ে আসছে।

একান্ত ব্যবহারিক শিলনোড়ার পাথরের কথা বাদ দিলেও চার্ট জাতীয় পাথরের হাতিয়ার তৈরির ব্যাপারটা বাদ দেওয়া যায় না। লম্বা, সমান্তরাল দুটি ধার সম্পন্ন চার্টের ‘ব্লেড’ সিন্ধু সভ্যতার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এরকম ‘ব্লেড’ আগে বা পরে পাওয়া যায়নি। জিনিসগুলি দেখলে কোনও সন্দেহ থাকে না যে, এই ধরনের ‘ব্লেড’ বানানো একটি বিশেষ সংঘবদ্ধ শিল্পের পর্যায়ে ছিল। সিন্ধুপ্রদেশে সুক্কুর-রোর্‌হি পাহাড়ি অঞ্চলের একটি বিশেষ ধরনের চার্ট জাতীয় পাথরের তৈরি এই জাতীয় ‘ব্লেড’ ওই অঞ্চল থেকে সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন কেন্দ্রে রপ্তানি হত। বস্তুত, এই পাহাড়ে সিন্ধু সভ্যতার সমসাময়িক বসতি পাওয়া গেছে এবং মনে করা হয়েছে যে, এই বসতি ব্লেড বানানো কারিগরদের জন্য। অনুমানটি সঙ্গত। এর অর্থ এই নয় যে, সর্বত্র সব ‘ব্লেড’ই সুক্কুর-রোর্‌হি পাহাড় থেকে আসত; স্থানীয়ভাবে লভ্য পাথর থেকেও বহু ‘ব্লেড’ তৈরি হয়েছে এবং সেগুলি সুক্কুর-রোর্‌হির পাথরের তৈরি ব্লেডের মতো এত উচ্চমানের নয়।

৫.৩ ধাতুশিল্প

প্রথমে যেটি জানা প্রয়োজন তা হচ্ছে যে, লোহা বাদ দিলে মূল ধাতুগুলির সবকটিই সিন্ধু সভ্যতার সময়ে পরিচিত ছিল। লোহার ব্যাপারটিও আজকাল খুব জোর দিয়ে বলা যায় না। লোথাল থেকে পাওয়া একটি নিদর্শন বিশ্লেষণ করে বস্তুটির ৬৬.১% লোহা বলে প্রমাণ হয়েছে এবং যিনি রাসায়নিক বিশ্লেষণটি করেছিলেন তিনি এটিকে লোহার জিনিস বলেই বলেছেন। এখানে বলা ভাল যে, এটি সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ের নিদর্শন হতে পারে, এবং আমরা পরে দেখব যে এই সময়ে গুজরাটের সংলগ্ন উদয়পুর/মেওয়ার অঞ্চলে লোহার ব্যবহার শুরু হয়ে গিয়ে থাকতে পারে। লোহার ব্যবহার জানা থাকলেই ‘লৌহযুগ’ হয় না—অল্প পরিমাণে লোহার ব্যবহার সমসাময়িক পশ্চিম এশিয়াতেও আছে।

তামা এবং আমার মিশ্রণ হিসাবে টিন, সিসা, দস্তা এবং আর্সেনিক-এর প্রয়োগ সুপ্রমাণিত। এই প্রসঙ্গে প্রথমে জরুরি হচ্ছে ব্যবহৃত ধাতুর উৎস সন্ধান; তারপর, সেই উৎসে কোনও সমসাময়িক খনি আছে কি না বোঝা; পরে তাম্রনির্মিত বস্তুর ভেতর কোনও মিশ্রণ আছে কি না এবং তা কী পরিমাণে, নির্ণয় করা। সিন্ধু সভ্যতায় ব্যবহৃত তামার এবং মিশ্রণধাতু হিসাবে সিসা, দস্তা এবং আর্সেনিক এর উৎস নিয়ে বিশেষ জটিলতা নেই। আফগানিস্তান, বালুচিস্তান, গুজরাট এবং রাজস্থানের বিভিন্ন অঞ্চলে এদের আকরিক উপাদান ছড়িয়ে আছে। তামা নিয়ে উত্তর-পূর্ব রাজস্থানের আরাবল্লী অঞ্চল একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ছিল। টিনের আকরিক উৎস নিয়ে জটিলতা আছে। কাছাকাছি টিনের বড় আকরিক উৎস একমাত্র উত্তর আফগানিস্তানে। তা ছাড়া, হরিয়ানাতে হিসার-ভিওয়ানি অঞ্চলে টিন আছে বলে সম্প্রতি বলা হয়েছে। অন্য সূত্রও থাকতে পারে, যা আমরা এখনও জানি না। আর একটি জটিলতা হচ্ছে সমসাময়িক কোনও খনির প্রত্যক্ষ চিহ্ন পাওয়া যায়নি। ভারতে খনির ইতিহাস নিয়ে গবেষণা এখনও খুব স্তিমিত, যদিও এত খনিবহুল একটি দেশে তা হওয়া উচিত নয়। কাজেই আমরা যখন বলি যে, অমুক অঞ্চল অমুক সময়ে এই বিশেষ ধাতুর উৎস ছিল তা প্রায় সব সময়েই পরোক্ষ প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে।

সিন্ধু সভ্যতায় প্রাপ্ত তাম্ৰাদি ধাতুর জিনিসগুলির একটি নিজস্ব সরল শৈলী আছে। সবগুলি জিনিসই ব্যাপকভাবে বহু জায়গায় পাওয়া গেছে। বাসনকোসনও বিস্তর পাওয়া গেছে এবং সেই নির্মাণ শৈলী এখনও দেখা যায়। বর্তমানের ঢোকরা শৈলীতেই ছোট ছোট মূর্তি বানানো সম্ভব হয়েছিল। সোনা-রূপারও ব্যবহার যথেষ্ট ছিল। সোনা-রূপার গয়না এবং ব্যবহারের চিহ্ন অল্পবিস্তর প্রায় সব বড় খননেই পাওয়া গেছে, মোহেঞ্জোদারোতে রূপার একটি এবং তামার দুটি পাত্রে রাখা কিছু গয়না তিন জায়গায় পাওয়া গেছে। কাজেই সোনার গয়নার গুরুত্ব তখনও যে যথেষ্ট ছিল তা বোঝা যাচ্ছে। সিসার আকরের ভেতর রূপার আকর মিশ্রিত থাকে এবং এই ধরনের আকর সিন্ধু সভ্যতা অঞ্চলে আছে। সোনার আকরিক উৎস ওই অঞ্চলে বিরল; দক্ষিণ ভারতের সোনার খনি অঞ্চল থেকে কিছু সোনা বাণিজ্যিক ভাবে আসতে পারে; নইলে নদীর বালি থেকে সংগ্রহ করা সোনারও ব্যবহার হতে পারে।

৫.৪ কৃষি ও পশুপালন

সমস্ত অঞ্চলে একই ভাবে কৃষিকাজ হত মনে করার কোনও কারণ নেই। এখনও বালুচিস্তানের মাকরান উপকূলে যা চাষ হয় পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে তা হয় না বা অন্তত সেভাবে হয় না। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যা, তাতে সমৃদ্ধ কৃষির জন্য সেচ ব্যবস্থা দরকার। বিশেষ করে, তুলনামূলক ভাবে সিন্ধু সভ্যতার কালে বেশি বৃষ্টি হত মনে করার যখন কারণ নেই। এর কিছু পরোক্ষ প্রমাণের কথা ‘উৎপত্তি’র অংশে বলা হয়েছে। তৃতীয়ত, লাঙলের ব্যবহার ছিল। সিন্ধু সভ্যতার পরিণত পর্যায়ের আগে থেকেই যে লাঙলের ব্যবহার ছিল তার প্রমাণ আদি পর্যায়ের চষা ক্ষেত—যা পাওয়া গেছে কালিবাঙ্গানে। এ ছাড়া বনোয়ালিতে এই পর্যায়েই খেলনার আকারে পোড়ামাটির একটি লাঙল পাওয়া গেছে। লাঙলে ধাতুর ফাল বা ফলা লাগানো হত কি না প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। তবে পাথরের কুড়ালের মতো ফাল, পুড়িয়ে শক্ত করা কাঠের ফাল, এমনকী ধাতুর ফালও থাকতে পারে। চতুর্থত, সারের ব্যবহার এমনিতেই অনুমান করা যেতে পারে; তা ছাড়া কালিবাঙ্গানে একটি পাত্রে রাখা জিপসাম থেকে কেউ অনুমান করেছেন যে, নোনা লাগা জমিকে ভাল অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে জিপসামের প্রয়োগ হতে পারে। পঞ্চমত, কোনও কোনও পণ্ডিত মনে করেন যে, যে-সকল শস্য উৎপাদন হত, তার ভেতর জোয়ার-বাজরার ব্যবহার সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ের গোড়া থেকে, অর্থাৎ পরিণত পর্যায়ের শেষ দিক থেকে হতে পারে। আমাদের মতে, এরকম মনে করার কোনও যথার্থ কারণ নেই। বর্তমান সেচ ব্যবস্থার প্রথমে সিন্ধুপ্রদেশে জোয়ার-বাজরাই মূল শস্য ছিল। তবে এতদিনের একটি কৃষি ব্যবস্থা—বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অঞ্চলে চাষবাসের তারতম্য, পরিবর্তন ইত্যাদি হতেই পারে। প্রশ্ন অবশ্য প্রমাণের। প্রমাণ যে আবার সব সময় পাওয়া যাবেই তাও নয়। আজকাল প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যে কাটা মাটিকে জলে ডুবিয়ে পরীক্ষা করে দেখা যায় যে শস্য, উদ্ভিদ ইত্যাদি অবশেষ হালকা হয়ে জলের ওপর ভেসে ওঠে। এতে নমুনা সংগ্রহ আগের তুলনায় অনেক ব্যাপকভাবে হয়। তবে আমাদের দেশের ক্ষেত্রে মুশকিল হচ্ছে যে, এগুলিকে সনাক্ত করতে পারেন এমন উদ্ভিদ/কৃষি বিজ্ঞানী সংখ্যায় খুবই অল্প। এই কারণে আমাদের দেশে সুসংবদ্ধ কৃষির ইতিহাস এখনও লেখা হয়নি, লেখার বিভিন্ন প্রচেষ্টা হয়ে থাকলেও।

পরিণত পর্যায়ের শস্যগুলির মধ্যে গম, যব দুটিই প্রচুর পাওয়া গেছে। গুজরাটে লোথাল কেন্দ্রে ধানের অস্তিত্বের কথা বলা হয়েছে। যদিও এটা জলো জায়গার পাশে জন্মানো বুনো ধান হতে পারে। গুজরাট থেকে জোয়ার-বাজরা অনেক কেন্দ্রেই আছে। জোয়ার-বাজরার বিভিন্ন শ্রেণী আছে। রাগী এবং সোরঘুম দুটি বিখ্যাত উপজাতি। বুনো ঘাসের মতো গাছগাছড়াও আছে। তিল এবং সরষে পাওয়া গেছে। ডালের ভেতর ছোলা, মুগ ও মটর আছে, অন্যরাও থাকতে পারে। এ ছাড়া তুলার চাষ হত; খেজুর ও কুল তো ছিলই।

পশুপালন যে তৎকালীন কৃষি জীবনের অঙ্গাঙ্গী অংশ ছিল এটা সহজেই মেনে নেওয়া যায়। গরু এবং ষাঁড়/বলদ খনন করা হাড়ে এবং সিলমোহরের চিত্রণে পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে। যে জাতের ষাঁড় বৃহৎ কুঁজ এবং গলকম্বল নিয়ে কিছু সিলমোহরে দেখতে পাওয়া যায়, ঠিক তাদের মতো ষাঁড় নাকি এখনও সিন্ধুপ্রদেশের কোথাও আছে। এদের কমবয়সী প্রাণীর হাড় এবং কখনও পোড়া হাড় দেখে মনে হয় যে, এদের মাংস ভক্ষণে তখন সামাজিক বাধা ছিল না। ভেড়া এবং ছাগল যথেষ্ট সংখ্যায় ছিল। এখনও গুজরাট ইত্যাদি অঞ্চলে ভেড়া, ছাগল, গবাদি পশু নিয়ে পশুপালক শ্রেণী আছে। তখনও থাকতে মানা ছিল না। কিছু পণ্ডিতের অসম্মতি সত্ত্বেও উট এবং ঘোড়া দুই-ই ছিল। এদেরও গৃহপালিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এই উট আমাদের এক-কুঁজওয়ালা উট। উত্তর-আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার দুই-কুঁজওয়ালা উট— যাকে ইংরেজিতে ‘ব্যাক্‌ট্রীয় উট’ বলা হয় তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না। গৃহপালিত মোষ নিশ্চয় ছিল। সিলমোহরে যে সমস্ত জীব চিত্রিত দেখা যায় তাদের ভেতর হাতিরও গৃহপালিত বা পোষ মানানো হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। বুনো জাতের ভেতর হরিণ, শেয়াল, বাঘ, গণ্ডার ইত্যাদি।

মাছ পশুর পর্যায়ে না পড়লেও এখানে মাছের কথা বলা যায়। নদীর মাছ তো ছিলই। কাছিমও ছিল; তা ছাড়া হরপ্পাতে সম্প্রতি সামুদ্রিক মাছের হাড় বের হওয়াতে মেনে নিতে হচ্ছে যে, শুকনো সামুদ্রিক মাছ আরবসাগর উপকূল থেকে বাণিজ্যসূত্রে পঞ্জাব পর্যন্ত যেত।

৫.৫ কারিগরি সংক্রান্ত অন্য কিছু তথ্য

নগর পরিকল্পনাতে এবং ইটের বাড়িঘর তৈরিতে যে যথেষ্ট প্রযুক্তিবিদ্যার ছাপ আছে তা বলাই বাহুল্য। কাঁচা বা পোড়ানো যাই হোক না কেন, ইট একটি বিশেষ অনুপাতের— ৪:২:১। লক্ষ লক্ষ এক অনুপাতের ইট তৈরি হয়েছে এত বিস্তৃত অঞ্চলব্যাপী বহু বহু কেন্দ্রে। আয়তাকার উচ্চ ভিত তৈরি হয়েছে বহু সহস্র। উপর থেকে নীচে দুদিকে ঢাল নেমে গেছে এরকম বহু প্রাকার। বহু প্রাকার জুড়ে আয়তাকার বা বর্গাকার বেষ্টনী এবং কখনও বুরুজ। পাথরের এবং ইটের ড্রেন বা প্রণালী তৈরিতে তাদের সুষ্ঠু ঢালের হিসেব। গোল ইট-গাঁথা কুয়োর পরিকল্পনা— কুয়ো গাঁথা দেখা গেছে বিশেষ ধরনের ইট দিয়েই। কম বা বেশি গভীর কুয়োতে চারপাশের মাটির চাপ সইতে গেলে যে গোল গর্তই ভাল—এটা প্রথমে বোঝার কৃতিত্ব বোধ হয় সিন্ধু সভ্যতার কারিগরদের। মোহেঞ্জোদারোর ক্ষেত্রে অনুমান হয়েছে যে ২৫ মি. জমির পরপর একটি কুয়ো ছিল। সর্বমোট ৭০০ কুয়ো অথবা প্রতি তৃতীয় বাড়িতে একটি করে কুয়ো ছিল। যা খোঁড়া হয়েছে তাতে যা কুয়ো পাওয়া গেছে সে অনুপাতে সমস্ত জায়গাটার হিসাব এটা। কুয়োতে দড়ি যে-পাশে টেনে তোলা হত সে-পাশে পরিষ্কার চিহ্ন আছে। গুজরাট অঞ্চলে ‘বাওলি’ অর্থাৎ ধাপে ধাপে বা চারপাশ থেকে ঢালে নেমে যাওয়া কুয়োও থাকতে পারে বা থাকার সম্ভাবনা বেশি। খিলান তৈরির কায়দাও জানা ছিল; তবে ওপর দিকটা একেবারে অর্ধবৃত্তাকারে নয়; দুদিক থেকে ইট গেঁথে গেঁথে ওপরে খাঁজ করে তৈরি করা।

ব্রোঞ্জ, ঝিনুক এবং হাতির দাঁতের তৈরি দৈর্ঘ্য পরিমাণের ‘স্কেল’ পাওয়া গেছে, ক্রমানুসারে হরপ্পা, মোহেঞ্জোদারো এবং লোথাল থেকে। মোহেঞ্জোদারোর পরিমাপটি ভাগ ভাগ কাটা আছে এবং দুটো কাটা দাগের মধ্যে তফাত ৬.৭০৫৬ মিলিমিটার। হিসেব করা হয়েছে যে, মোহেঞ্জোদারোর স্কেলটির মূল পরিমাপ ছিল বর্তমান ‘মিটার’ পরিমাণের দুই-তৃতীয়াংশ। হরপ্পা এবং লোথালের হিসেবটি কিছুটা পৃথক। তবে সর্বত্র দশমিক হিসেবে পরিমাপ ছিল এটা মনে করা হয়েছে। সিন্ধু সভ্যতার ‘ওজন’ বিখ্যাত—পাথর কেটে কেটে অনুপাত অনুযায়ী বানানো। এদের অনুপাত ১ : ২: ৫ : ১০ : ২০ : ৫০ : ১০০ ইত্যাদি। অন্তত দুরকম ওজনের ধারা আছে—প্রথমটি শুরু হচ্ছে ১.২১৮৪ গ্রাম নিয়ে, ওপরে দেখানো হয়েছে ৪০০৬৫ গ্রাম। দ্বিতীয়টি শুরু হচ্ছে ০.৮১৭ গ্রাম দিয়ে, শেষ দেখানো হচ্ছে ৬৯০৩ গ্রাম। মূল্যবান বস্তু, সোনা ইত্যাদি পরিমাপের জন্য ৫০ মিলিগ্রাম থেকে ৩২৫০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত আর একটি ওজন পরিমাপের ধারা অনুমান করা হয়েছে, বিশেষ করে লোথালে। এ ছাড়া, কম্পাসের মতো জিনিস, শাঁখ জাতীয় ঝিনুক দিয়ে তৈরি, পাওয়া গেছে। এ দিয়ে নাকি আকাশে তারার কোণ পরিমাপ করা যেত, ফলত নৌযান চালানোর ক্ষেত্রে এটা কাজে লাগত। এতবড় একটি সভ্যতার সৃষ্টি যে গণিতবিদ্যা এবং অন্যান্য সুসংহত বৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণা বাদ দিয়ে হতে পারে না এটা বলাই বাহুল্য।

এখানে আরও উল্লেখ করা যেতে পারে যে, দাবার ঘুঁটির মতো পোড়ামাটির ঘুঁটি পাওয়া গেছে এবং হাতির দাঁতের পাশাও। ঝিনুকের বা শাঁখের কারিগরি বিদ্যাও বহু বিস্তৃত ছিল।

৫.৬ বাণিজ্য

দুধরনের বাণিজ্যই অর্থাৎ বহির্দেশীয়-অন্তর্দেশীয় বাণিজ্য ছিল। অন্তর্দেশীয় বাণিজ্যের সাক্ষ্য সব কেন্দ্র থেকে নেওয়ার দরকার নেই; একটি মাত্র কেন্দ্র—হরপ্পা থেকে উদাহরণ দিয়ে আলোচনা করা যাক। এখানে মূল যা যা কাঁচামালের উদাহরণ পাওয়া গেছে তা স্টিয়েটাইট পাথর, আলাবাস্টার পাথর, ঝিনুক, প্রবাল, হাতির দাঁত, কার্নেলিয়ান পাথর, অ্যাগেট পাথর, জ্যাসপার পাথর, জেড পাথর, লাপিস লাজুলি, তামা/ব্রোঞ্জ, রূপা, সোনা, সিসা, অন্যান্য অল্প দামি পাথর, যথা স্ফটিক পাথর ইত্যাদি। যা সাক্ষ্য আছে, তাতে মনে হয় যে প্রবাল ছাড়া, যার শুধু ছোট টুকরো পাওয়া গেছে, প্রতিটি কাঁচামাল থেকেই স্থানীয়ভাবে জিনিস তৈরি হত। এখানে আরও মনে করা দরকার যে, হরপ্পা একেবারে নদীর কূলে, সমতলে। যে কাঁচামালগুলি নিয়ে এখানে কারিগরির কাজ হত তার একটিও স্থানীয়ভাবে লভ্য হতে পারে না। প্রবাল এবং জেড—আমরা পরে দেখব—বহির্বাণিজ্য থেকে এসেছে। লাপিস লাজুলির ক্ষেত্রেও সে সম্ভাবনা আছে; কিন্তু বাকিগুলি দুরের হোক, কাছের হোক, অন্তর্দেশীয় বাণিজ্যের ফল। কোরাল/প্রবাল এবং জেড দুটোই মধ্য এশিয়া থেকে আসতে পারে।

এটা শুধু হরপ্পার ব্যাপার নয়—যেখানে যেখানে বিশদভাবে খোঁড়া হয়েছে এবং বিস্তৃত বিবরণী আছে সেখানেই চিত্রটি অল্পবিস্তর এই। মোহেঞ্জোদারোর ক্ষেত্রেও কাঁচামালের তালিকা প্রায় এই: স্টিয়েটাইট পাথর, আলাবাস্টার পাথর, ঝিনুক, হাতির দাঁত, কার্নেলিয়ান পাথর, অ্যাগেট পাথর, জ্যাসপার পাথর, জেড পাথর, লাপিস লাজুলি, তামা/ব্রোঞ্জ, সোনা, রূপা, সিসা, অল্প দামি পাথর, এবং সাধারণ শ্রেণীর পাথর। কাঁচামালের তালিকার চাইতেও এদের উৎসের সম্ভাব্য তালিকা, সে সমস্ত উৎস থেকে সংগ্রহ এবং রপ্তানি হয়ে সুসংবদ্ধ বাণিজ্য পথে বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছানোর জগৎ আমাদের তদানীন্তন অন্তর্দেশীয় বাণিজ্যের ব্যাপকতা মনে করায়। নদীপথ নিশ্চয় বড় ভূমিকা পালন করত; তা ছাড়াও স্থলপথ নিশ্চয় বহু ছিল। সাধারণত, এই স্থলপথগুলি পরবর্তীকালেও ব্যবহার হয়ে এসেছে। যেমন, বলা যায়, সিন্ধুপ্রদেশ থেকে রাজস্থান-পঞ্জাব-হরিয়ানার যোগাযোগের একটি বড় এবং সোজা রাস্তা ছিল হাক্‌রা-ঘগ্‌গর প্রবাহধারা মধ্যযুগ পর্যন্ত, অনেক বিশাল বসতির চিহ্ন এই পথের দুদিকে এখনও বিদ্যমান। যে কাঁচামাল মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে তা ছাড়াও অনেক রকম কাঁচামাল নিশ্চয় আমদানি-রপ্তানি হত। নদীর জলে ভাসিয়ে পাহাড়ি কাঠ—শিশু, চির, পাইন ইত্যাদি—নিশ্চয় সমতলে নামত। শস্যের বোঝা নিয়ে নদীবক্ষে নিশ্চয় নৌকো যেত। আরবসাগর উপকূল থেকে শুকনো সামুদ্রিক মাছ নিয়ে উজিয়ে হরপ্পায় পৌঁছননার কথা আমরা আগে বলেছি।

বহির্বাণিজ্যের সাক্ষ্য আফগানিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, ইরান, গাল্‌ফ অঞ্চল এবং ইরাক জুড়ে। উত্তর আফগানিস্তানে এই সভ্যতার নিজস্ব কেন্দ্র—শোরতুঘাই-এর কথা আমরা আগে বলেছি। কোক্‌চা এবং আমুদরিয়া বা অক্‌সাসের সঙ্গমস্থলের কাছে এই কেন্দ্রটি অবস্থিত। কোক্‌চা আমুদরিয়ার বামপাড়ের উপনদী। এই উপনদী ধরে উজিয়ে গেলে উত্তর-পূর্ব আফগানিস্তানের বাদাখশান অঞ্চলের বিখ্যাত লাপিস লাজুলি পাথরের খনি পড়ে। এই কেন্দ্রের দুটি মূল পর্যায়ের ভেতর প্রথম পর্যায়টি পুরো, অবিমিশ্রিত সিন্ধু সভ্যতার—সেই মৃৎপাত্রের শৈলী, পোড়ামাটির জিনিস, লিপিচিহ্ন, ইট তৈরির অনুপাত, ঝিনুকের কাজ, ধাতুর ব্যবহার ইত্যাদি। এটিকে এই অঞ্চলে সিন্ধু সভ্যতার উপনিবেশ বলাই ভাল। প্রশ্ন হচ্ছে, এটি কি একটি মাত্র উপনিবেশ ছিল, না আরও বেশি কেন্দ্র আছে? জানা যায়নি। আর যুদ্ধবিগ্রহের ফলে আফগানিস্তানে প্রত্নতত্ত্বের কাজ অদূর ভবিষ্যতে হবে বলে মনে হয় না। অনুমান হয় যে, কিছুটা লাপিস পাথর সংগ্রহ এবং কিছুটা টিন সংগ্রহের কেন্দ্র হিসেবে জায়গাটিতে সিন্ধু সভ্যতার লোকেরা বসতি গড়ে তুলেছিল। তুর্কমেনিয়া আরও উত্তর-পশ্চিমে। কাসপিয়ান সাগরের পূর্বপাড়ে, উত্তর-পূর্ব ইরানের বা পারস্যের সীমান্তে কোপেত দাগ পর্বত পেরিয়ে। এখানে সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে যোগাযোগের নিদর্শন যেখানে বিশেষ করে পাওয়া গেছে তার নাম ‘অলতিন টেপে’। সিন্ধু সভ্যতার একটি সিলমোহর পর্যন্ত আছে। ইরানের মাঝখানে বড় মরুভূমি—এর উত্তর এবং দক্ষিণ দিয়ে বাণিজ্যপথ গেছে। উত্তরের বাণিজ্যপথ ‘এল্‌বুর্জ’ পর্বতশ্রেণীর দক্ষিণ পাদদেশ দিয়ে গেছে—এখানে হিসার, শাহ টেপে ইত্যাদি জায়গায় সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে যোগাযোগের চিহ্ন আছে। এই রাস্তা পশ্চিমে জ্যাগ্রোস শ্রেণী পেরিয়ে, উত্তর ইরাকে বাগদাদ-মোসুল অঞ্চলে ঢুকেছে। ইরানে দক্ষিণের রাস্তা বেরিয়েছে বালুচিস্তান হয়ে, কিরমান হয়ে, ফার্স সমতল পেরিয়ে, জ্যাগ্রোসের গা ঘেঁষে, প্রাচীন সুসা নগরী হয়ে দক্ষিণ ইরাকে পৌঁছচ্ছে। এখানে নিদর্শন পাওয়া গেছে সুসাতে, জ্যাগ্রোসে এবং কিরমানে ‘টেপে ইয়াহিয়া’তে। রাস্তা এখনও আছে—এখনও ধরে ধরে বিভিন্ন অঞ্চলের ভেতর দিয়ে এই প্রাচীন বাণিজ্যের সুলুক সন্ধান নিতে নিতে যাওয়া যায়। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার উত্তর এবং দক্ষিণ অঞ্চলের সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার স্থলপথে যোগাযোগ রক্ষিত হত ইরানের ভেতর দিয়ে এই দুই মূল রাস্তা দিয়ে। সমসাময়িক মেসোপটেমিয়ার উত্তর দক্ষিণে বেশ কিছু কেন্দ্রেই সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে যোগাযোগের চিহ্ন আছে। মূলত পাথরের পুঁতি (দুই ধরনের) এবং সিলমোহর। এর পর, ওই অঞ্চলেই পড়ে গালফ অঞ্চল—ওমান অন্তরীপ, বাহরাইন, ইত্যাদি। এখানেও পুঁতি, সিলমোহর ইত্যাদি পাওয়া গেছে এবং এর অবস্থান দেখে মনে হয়— মৌসুমী বায়ু তাড়িত হয়ে গুজরাট উপকূল থেকে পালতোলা জাহাজ প্রথম এই অঞ্চলে আসত। পরবর্তীকালের দৃষ্টান্ত দিয়ে তাই বলা যায়। রাস-এল-হাড-এ সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে যোগাযোগের নিদর্শন পাওয়ার পর মনে হয়েছে যে, মৌসুমী বায়ুর উপযোগিতা সিন্ধু সভ্যতার সময়েই হয়তো বোঝা গেছে।

সিন্ধু সভ্যতার ভেতরে বিদেশি নিদর্শন তুলনামূলকভাবে কম। বালুচিস্তানে— বিশেষ করে কোয়েটা ও শিবি অঞ্চলে—উত্তর আফগানিস্তানের পাথরের এবং সোনার জিনিস কিছু আছে। মোহেঞ্জোদারোতে ওমান অঞ্চলের এক ধরনের পাথরের বাটি, মেসোপটেমিয়ার সিলমোহর জাতের সিলমোহর আছে। এ ছাড়া গভীর স্তর থেকে এক ধরনের ইরানীয় পাথরের বাটির টুকরো, লোথালে, মাটির ওপর থেকে, গাল্‌ফের সিলমোহর পাওয়া গেছে। কালিবাঙ্গান থেকে মেসোপটেমিয়া জাতীয় সিলমোহর পাওয়া গেছে। যদিও তার ওপরের নকশা বিশুদ্ধ সিন্ধু সভ্যতার। জেড পাথর মধ্য এশিয়ায় বর্তমান সিনকিয়াং অঞ্চলে পাওয়া যায়। সিন্ধু সভ্যতার জেড পাথর বোধহয় এই অঞ্চলের।

সব মিলিয়ে এক বিশাল বহির্বাণিজ্যের জগৎ। যাঁরা এই বিশাল ভূভাগে পরবর্তী ইতিহাসের খবর রাখেন তাঁরা জানেন যে, এই বাণিজ্যের ধারা ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত চলেছে; এই পরবর্তী বাণিজ্যের ইতিহাসে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের (বিশেষ করে সিন্ধু প্রদেশের, পঞ্জাবের, গুজরাটের) স্থান অনেক ব্যাপক। ভাবতে অবাক লাগে যখন দেখি সিন্ধু সভ্যতার সময়ই এই বাণিজ্যের দৃঢ় ভিত গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া আমরা এও জানি যে, হিন্দুকুশের পার্বত্য পথগুলি সেই সময়ই পরিচিত হয়ে উঠেছিল।

৫.৭. লিপি

সিন্ধু সভ্যতার লিপি দেখতে কী রকম ছিল বুঝতে অসুবিধা নেই, কিন্তু তার বাইরে অনেক কিছু নিয়েই আমাদের অজ্ঞতা অপরিসীম। এখনও পর্যন্ত সিলমোহরের ওপরেই এই লিপির সবচেয়ে বেশি নমুনা পাওয়া গেছে। এ ছাড়া, অপেক্ষাকৃত অল্প পরিমাণে, মৃৎপাত্রের ওপর, এবং তামার ছোট ফলকের ওপর। তামার ফলকের ওপর এবং মৃৎপাত্রের ওপর সাধারণত লিপি উৎকীর্ণ হয়েছে, কিন্তু লোথাল থেকে পাওয়া অন্তত একটি মৃৎপাত্রের টুকরোর ওপর লিপিচিহ্ন আঁকা আছে। যদি এই ক্ষেত্রে লিপিচিহ্ন আঁকা যেতে পারে তবে ভূর্জপত্র জাতীয় জিনিসের ওপর বা কাঠের ফলকের ওপরও লিপিচিহ্ন আঁকা যেতে পারে। ভূর্জপত্র এবং কাঠের ফলক কোনওটাই সিন্ধু সভ্যতার ক্ষেত্রে পাওয়া যায়নি; এত সময়ের ব্যবধানে পাতা বা কাঠ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবে, শুধু সিলমোহর, মৃৎপাত্র এবং তাম্রফলকের ওপরই লিপি ব্যবহার সীমাবদ্ধ ছিল—এটা মনে করা বোধ হয় সমীচীন হবে না। ধোলাবিরাতে সূক্ষ্ম পাথরের টুকরো কেটে বড় বড় লিপিচিহ্ন বানিয়ে এবং খুব সম্ভব কাঠের ফলকের ওপর লাগিয়ে যে সাইনবোর্ড-এর মতো জিনিসটি তৈরি হয়েছিল, তা থেকে বোঝা যায় যে, সিন্ধু সভ্যতায় লিপির ব্যবহার, যা আমরা জানি, তার চাইতে অনেক ব্যাপক ছিল।

এই লিপির উৎপত্তির জন্য আমাদের ইতস্তত তাকিয়ে লাভ নেই। মৃৎপাত্রে উৎকীর্ণ চিহ্নের ধারা সিন্ধু সভ্যতার আদি পর্যায় থেকে যথেষ্ট ছিল এবং কোথাও কোথাও (যেমন, পাদ্‌রি, রহমান ধেরী) পরিণত সিন্ধু সভ্যতার লিপিচিহ্নের সঙ্গে তাদের যথেষ্ট মিল। নিশ্চিত ভাবে এই লিপি সম্পর্কে কিছু বলা মুশকিল। তবে, এর লেখার রীতি ডানদিক থেকে বাঁদিকে হতে পারে এবং কখনও কখনও, এই ভাবে শুরু হয়ে নীচের লাইনে আবার ঘুরে গেছে, বলদ লাঙল টানার সময় একদিক থেকে টেনে আবার যে রকম করে ঘুরে আসে। এই দ্বিতীয় রীতিটির নাম ‘বুস্ট্রফেডন’ (boustrophedon)। মূল চিহ্ন কতগুলি তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও চারশ’র আশেপাশে কোনও সংখ্যা হওয়ারই সম্ভাবনা। অক্ষরভিত্তিক লিপি হওয়ার পক্ষে অনেক বেশি (বর্তমান অক্ষরভিত্তিক ইংরেজি লিপির অক্ষর মাত্র ২৬), আবার চিনা জাপানি লিপির মতো কোনও বিশেষ বস্তুর ধারণা জন্মানো চিহ্ন হওয়ার পক্ষে ‘৪০০’ সংখ্যাটি কম। চিনা বা জাপানি লিপিতে ব্যবহৃত চিহ্ন হাজার হাজার। কাজেই অনুমান যে, অক্ষর এবং ধারণা-ব্যঞ্জক—এই দুই রীতির মাঝামাঝি কোনও রীতি ব্যবহৃত হয়ে থাকবে। অর্থাৎ কিছু চিহ্ন বোধ হয় সোজা অক্ষরের মতো ব্যবহার হয়েছে, আবার কিছু চিহ্ন হয়তো ধারণা-ব্যঞ্জক ছিল। এখানে, মূল চিহ্নের গণনা কী করে হয়েছে বলা ভাল। আমাদের যেমন ‘আ’কার, ‘উ’ কার ইত্যাদি চিহ্ন আছে, তেমনি সিন্ধু সভ্যতার বহু চিহ্নেই এরকম সংযোজন দেখতে পাওয়া যায়। এই সব সংযোজন বাদ দিয়ে গণনা করে চারশ-র আশেপাশে একটি সংখ্যাতে পৌঁছনো গেছে। তবে, যে সব অক্ষর অনেকবার ব্যবহৃত হয়েছে তার সংখ্যা অনেক কম।

কোন চিহ্নের কোথায় অবস্থান—অর্থাৎ যে সমস্ত দুই বা ততোধিক চিহ্ন উৎকীর্ণ নিদর্শন পাওয়া গেছে তাতে চিহ্নগুলির অবস্থান কী (প্রথমেই, না দ্বিতীয় ইত্যাদি)— তা পণ্ডিতেরা বিশ্লেষণ করেছেন। কোন চিহ্ন কোন চিহ্নের সঙ্গে আছে তাও। বস্তুত, বাহ্যিক ভাবে যত ধরনের বিশ্লেষণ করা সম্ভব তা হয়েছে। বর্তমানে এই ধরনের বিশ্লেষণ কমপিউটার নির্ভর। কমপিউটার অজানা ভাষা পড়ে দেয় না। যদি এমন কোনও কিছু উৎকীর্ণ পাওয়া যেত যেখানে একই ‘শিলালিপি’ দুটি লিপিতে উৎকীর্ণ—একটি সিন্ধু সভ্যতার লিপিচিহ্নের সঙ্গে আরও এমন একটি লিপিতে যা পণ্ডিতেরা পড়তে পারেন যথা, সুমেরীয়, বা প্রাচীন ইলামাইট লিপি—তা হলেও পড়ার ব্যাপারটা সুগম হত। এখন সত্যিই অন্ধকার।

উৎসাহী বিদ্বানদের অবশ্য দমানো যায়নি। এই লিপির পেছনে ব্যবহৃত ভাষা দ্রাবিড় গোষ্ঠীর ছিল বলে এক জাতীয় পণ্ডিত পড়ার চেষ্টা করেছেন। আবার, ব্যবহৃত ভাষাটি সংস্কৃত পরিবারের অনুমান করে আর এক জাতীয় পণ্ডিত পড়তে চেষ্টা করেছেন। দুপক্ষেই যুক্তি সমান, অর্থাৎ নেই। অন্যদিকে, কোনও কোনও লিপিচিহ্নের সঙ্গে আমাদের দেশে পরবর্তীকালে ব্যবহৃত অনেক চিহ্নাবলীর মিল আছে। কোনও কোনও পণ্ডিত আবার বহু পরবর্তী এই চিহ্নাবলীর আলোকে লিপিটি পড়ার চেষ্টা করেছেন। ইংরেজি ষাটের দশকের কলকাতায় সরল এবং বিদ্যানুরাগী এক দুঃস্থ স্বামীজিকে দেখা যেত যিনি এই নিয়ে বেশ কিছু বই লিখেছিলেন। উনি বলতেন যে, আমাদের তান্ত্রিক চিহ্নের সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার লিপিচিহ্নের বিশেষ মিল। তান্ত্রিক অভিধান বা ‘ডিকশনারি’ও নাকি আছে, যাতে এই চিহ্নগুলির অর্থ দেওয়া আছে। তবে, এক একটি চিহ্নের জন্য একের বেশি অর্থ দেওয়া থাকায় স্বামীজি পছন্দমতো অর্থগুলিই বেছে নিয়েছিলেন। ১৯৯৪তে ভাগলপুরে আঞ্চলিক পরিবহণের অধিকর্তার কাছ থেকে জেনেছিলাম যে সাঁওতাল পরগনার রাজমহল পাহাড়ে স্থানীয় অধিবাসীরা/উপজাতিরা তাঁদের বিভিন্ন ধর্মানুষ্ঠানে যে সমস্ত মাঙ্গলিক/ধার্মিক চিহ্ন ব্যবহার করেন তার সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার লিপিচিহ্নের যথেষ্ট সাদৃশ্য। উপজাতি পুরোহিতদের কাছ থেকে ওই সব চিহ্নের অর্থ জেনে উনি সিন্ধু সভ্যতার চিহ্নে সে সব অর্থ আরোপ করে সিন্ধু সভ্যতার লিপির পাঠোদ্ধার করেছেন বলে দাবি করেন। এ রকম চেষ্টা বেশ কিছু হয়েছে, এবং যাঁরা করেছেন তাঁরা অনেকেই পেশাদার ‘পণ্ডিত’ না হলেও (এবং তাঁদের পড়ার পেছনে গভীর কোনও যুক্তি না থাকলেও) গভীর বিদ্যানুরাগী ও সৎ মানুষ। আমরা শুধু দুজনের কথা উল্লেখ করলাম।

পরিশেষে শুধু আর একটি কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। পরবর্তীকালের ব্রাহ্মীলিপির সঙ্গে যে সিন্ধুলিপির অনস্বীকার্য মিল আছে এটা কিছু পণ্ডিত স্বীকার করেছেন। ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর একজন ভারতীয় অধ্যাপক সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, এই সাদৃশ্য আচমকা কোনও সাদৃশ্য হতে পারে না। ভারতীয় লিপির ক্রমবিবর্তনের দিক থেকে এই সিদ্ধান্তটি—যা আগেও অনেক বিশিষ্ট ভারতীয় পণ্ডিত বলেছেন—বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

৫.৮. কলাশিল্প

চিত্রিত মৃৎপাত্রে, অগুনতি পোড়ামাটির খেলনায় এবং ছোট ছোট নারী এবং গবাদিপশুর মূর্তিতে সভ্যতার সাধারণ জনস্তরের একটি শৈল্পিক চেতনা লক্ষ করা যায়। উচ্চকোটির শিল্পশৈলীর চিহ্ন এখনও খুব সীমিত। তবে যতটুকু আছে তাতেই এই শিল্পশৈলীর বিস্তৃত ধারা, বৈচিত্র্য এবং পরবর্তী ঐতিহাসিক কালের ভারতীয় শৈলীর সঙ্গে সাদৃশ্যের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

পাথরের ভাস্কর্যের যা উদাহরণ তা প্রায় সবটাই মোহেঞ্জোদারো এবং হরপ্পা থেকে পাওয়া গেছে। এর বিশেষ কোনও কারণ আছে কি না আমরা জানি না। মোহেঞ্জোদারো থেকে পাওয়া প্রথম বিখ্যাত উদাহরণ: স্টিয়েটাইট পাথরের ১৭.৮ সেমি উঁচু একটি পুরুষ মাথা—গোঁফ কামানো কিন্তু দাড়ি আছে, নাকের ডগা একটু ভেঙে গেছে, দুটি চোখ নিমীলিত; কপালের ওপর ঠিক মাঝখানে একটি ফিতের সঙ্গে লাগানো একটি গোল অলংকার—এই অলংকারটা কপালের ওপর রেখে—সঙ্গে লাগানো দুই দিকের ফিতে দিয়ে চুল টেনে বাঁধা হয়েছে; বাঁ কাঁধ ঢাকা এবং ফিতের দুটো দিক মাথার পেছনে ঝুলে আছে। কাঁধ খোলা রেখে ডান হাতের নীচ দিয়ে তিনমুখো নকশা কাটা শাল। নিমীলিত দুটি চোখই নাকের ডগার ওপর সংবদ্ধ— যোগধ্যানে বসা কোনও পুরোহিতের কথাই প্রথমে মনে হয়। মোহেঞ্জোদারো থেকে পাওয়া আলাবাস্টার পাথরের একটি মাথা ভাঙা ২৯.৫ সেমি উঁচু (উপবিষ্ট অবস্থায় দেখানো) পুরুষ মূর্তির কথা উল্লেখ করা যায়। হরপ্পা থেকে পাওয়া দুটি ভাস্কর্য নিদর্শন বিখ্যাত। একটি কালো-ধূসর পাথরের ছোট একটি পুরুষ দেহ—গলার দিকে একটি ছিদ্র—মাথাটি আলাদা লাগানো ছিল। তা ছাড়া দুটি হাতের জায়গাও তাই, স্পষ্টতই হাত দুটিও আলাদা লাগানো হয়েছিল। বাঁ পা-টি ভাঙা কিন্তু ওঠানো অবস্থায় এবং ডানদিকে বাঁকানো। ডান পা-টি মাটিতে। সব মিলিয়ে মূর্তিটির নৃত্যভঙ্গিমা এবং ভাব দেখলে নটরাজের নৃত্যভঙ্গিমার কথাই মনে আসে। হরপ্পা থেকেই ছোট একটি লালপাথরের পুরুষ দেহ পাওয়া গেছে। এখানেও গলা, হাত এবং পা ভাঙা। কিন্তু এর বলিষ্ঠ অথচ সুকুমার গড়ন পরবর্তীকালের ভারতীয় ভাস্কর্যের কথাই মনে করায়। ব্রোঞ্জ দিয়ে গড়া মোহেঞ্জোদারোর ছোট, নগ্নিকা ‘নর্তকী মূর্তি’ বিখ্যাত—খোঁপা বাঁদিক ঘেঁষে নামানো; গলায় ছোট ‘পেনডেন্ট’ দেওয়া মালা—ডান হাত কাঁধের নীচ থেকে পুরোটাই বালাতে ঢাকা—বাঁ হাতের কনুইতে এবং কবজির কাছে বালা—বাঁ হাত কোমরে, ডান হাত সামনে বাঁকানো, ডান পায়ের হাঁটু পর্যন্ত গেছে। এরকম ‘ঢোকরা’ পদ্ধতির কাজের উদাহরণ আরও কয়েকটি আছে—যেমন লোথাল থেকে পাওয়া একটি ক্ষুদ্র পাখি, কালিবাঙ্গান থেকে পাওয়া একটি ক্ষুদ্র ষাঁড় ইত্যাদি। সিলমোহরের ওপর দেখানো জন্তুজানোয়ারের প্রতিকৃতিতেও সমসাময়িক শিল্পচেতনা বোঝা যায়—বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কিছুটা পেশি টনটনে এবং সুকুমার অথবা সাবলীলভাবে বলিষ্ঠ বিভিন্ন প্রতিমূর্তি। সত্যি বলতে, যা উদাহরণ পাওয়া গেছে তার থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, সামগ্রিকভাবে এই ভাস্কর্যশৈলী এই অঞ্চলের নিজস্ব—পরবর্তীকালের ভারতীয় ভাস্কর্য শৈলীর অনুরূপ। মোহেঞ্জোদারোর নগ্নিকা নর্তকীর হাতের বালাসমষ্টিও বোধ হয় তখন হাতির দাঁত, হাড় অথবা শাঁখার মতো জিনিস দিয়ে তৈরি হত। রাজস্থান এবং গুজরাটে এ-ধরনের এবং এইভাবে বালা পরা মহিলা এখনও দেখা যায়। নাচেরও কোনও ধারা হয়তো ছিল। মোহেঞ্জোদারোতে অন্তত পোড়ামাটির মুখোশ পাওয়া গেছে। মোম গলিয়ে বানানোর পদ্ধতিতে গড়া তামার ‘ঢোকরা’র জিনিস যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। শুধু শৈল্পিক-চেতনার ইঙ্গিতবহ হিসাবে নয়, ‘ঢোকরা’ পদ্ধতিটির প্রাচীনত্বের দিক থেকেও। সমসাময়িক পৃথিবী, যথা পশ্চিম এশিয়ার, শিল্পশৈলীর ইঙ্গিত যে ভারতবর্ষীয় এই শিল্পে একেবারেই নেই, তা নয়—যেমন একটি সিলমোহরে দুটি জন্তুর মাঝখানে একটি মানুষ মূর্তি আছে—এটি একটি সুমেরীয় উপাখ্যানের (গিলগামেশ এনকিডু) স্মারক। তবে এই ধরনের ইঙ্গিতও খুব বিরল।

৬ ধর্ম

যেহেতু আমরা এই সভ্যতার লিপি পড়তে পারি না, তাই এই সভ্যতার ধর্ম নিয়ে আমাদের ধারণাতে কিছুটা অনুমান থাকবেই। তবে, যেটুকু বুঝতে পারা যায় তাতে পরবর্তীযুগের ধর্ম চেতনার সঙ্গে একটা গোত্রীয় সাদৃশ্য সহজেই ধরা পড়ে। বর্তমানের দেবদেবী মেলানোর চেষ্টাতে লাভ নেই—দেবতাদের গুরুত্ব ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তিত হয়—ঋক্‌ বেদের ইন্দ্র যে এখন খুব ভাল অবস্থায় নেই এটা আমরা জানি। তেমনি, বর্তমানের শিব, কার্তিক, গণেশ যদি অপরিবর্তিত অবস্থাতে আমরা সিন্ধু সভ্যতায় দেখতে চাই তা হলে ভুল করব। আবার, অন্য দিকে ভারতীয় ধর্মের ইতিহাসের ধারা থেকে একেবারে বাইরে এনে এই ধর্মকে দেখায়ও কোনও লাভ নেই।

প্রথমত, আমরা দেখছি যে অনেক কেন্দ্রেই ‘অগ্নিবেদি’ জাতীয় একটি জিনিস আছে। কালিবাঙ্গানে তো এই ধরনের ‘বেদি’ (ঠিক বেদি নয়, ছোট চৌকো, মাটি অথবা কাঁচা ইট দিয়ে নিচু করে ঘেরা জায়গা ভেতরে ছাই, পশুর হাড়, কাদার ঢেলা) আলাদা অংশে পাওয়া গেছে; কিন্তু এরকম আলাদা অংশ ছাড়াও অন্যত্র এদের অস্তিত্ব আছে। যে তুলনাটা প্রথমই আসে তা যজ্ঞবেদির—উত্তর ভারতে এখনও অনেক ধার্মিক মানুষ সস্ত্রীক প্রত্যুষে মাটিতে চৌকো গর্ত করে যজ্ঞ করেন। লোথালে পাওয়া ক’টি ‘বেদির’ গড়ন এবং আয়তন বলা প্রাসঙ্গিক হতে পারে—৪৫.৭২ × ৩০.৪৮ সে.মি., চারদিকে ১২.৭ সে.মি. চওড়া ২৭.৯৪ সে.মি. উঁচু কাঁচা ইটের দেওয়াল। ভেতরে ছাই। এই ধরনের জায়গা কোনও বাড়ির ভেতরে যেমন পাওয়া গেছে তেমনি বাড়ির বাইরে রাস্তার পাশেও পাওয়া গেছে।

সিন্ধু সভ্যতার ধর্ম সম্পর্কে বেশ বড় ইঙ্গিত পাওয়া যায় সিলমোহরের ওপর খোদিত প্রতিকৃতি থেকে। একটি সিলমোহরে খোদা প্রতিকৃতি এই প্রসঙ্গে বিখ্যাত। জন্তু-জানোয়ারের মাঝে যোগাসনে বসা একটি মূর্তি—খুব সম্ভবত ত্রিমুখ, ঊৰ্দ্ধলিঙ্গ, মস্তকে শিং বসানো শিরস্ত্রাণ। পশুপতি শিবের রূপ বলে অনুমান করা হয়েছে। প্রতিবাদ নিশ্চয়ই করা যায়, কিন্তু এর চাইতে ভাল ব্যাখ্যাও নেই। অন্য একটি সিলমোহরে ৭টি নারীমূর্তি—‘সপ্তমাতৃকা’র ধারণা এখানে বোধ হয় অবান্তর নয়। কোথাও দেখানো আছে গাছের ভেতর একটি নারীমূর্তি—বৃক্ষ দেবী? আর একটি ক্ষেত্রে দেখছি একটি নারীর স্ত্রীঅঙ্গ থেকে একটি গাছ বেরিয়ে আসছে—নারী এবং বৃক্ষের অথবা উদ্ভিদজগতের চেতনা আমাদের অচেনা নয়। একজন একে ‘শাকম্ভরী’ দেবীর দ্যোতক বলে ব্যাখ্যা করেছিলেন। মোহেঞ্জোদারোর ‘বৃহৎ স্নানাগার’ নিয়ে ভাবলেও মনে হয় সমস্ত ভারতবর্ষ জুড়েই মন্দিরের সঙ্গে পুকুরের একটা যোগাযোগ আছে। মোহেঞ্জোদারোতে শিবলিঙ্গের মতো এবং কখনও শালগ্রাম শিলার মতো পাথর বেশ কিছু পাওয়া গেছে। তর্ক অবশ্যই আছে, কিন্তু শিবলিঙ্গ বা নারায়ণশিলার মতো ব্যাখ্যাতেই বা অপরাধ কোথায়। অঙ্ক মিলিয়ে, বিশেষ শ্লোক মিলিয়ে আমরা কিছু দাবি করছি না; শুধু গোত্রীয় সাদৃশ্য দাবি করছি। সিলমোহরে এত ষাঁড় দেখানো কেন? অনেক ক্ষেত্রে ধ্বজাই বা কেন? এই ধারার সঙ্গে পরবর্তীকালে এবং বর্তমানে আমরা পরিচিত। বিস্ময়ের কথা শুধু এটি যে, সিন্ধু সভ্যতা পর্যন্ত এই ধারাটিকে এবং অন্য এই ধরনের ধারাগুলিকে টেনে নেওয়া যাচ্ছে।

ধর্মীয় ধারা যে বহু হাজার বছর পর্যন্ত চেনা যায় তার একটি বড় প্রমাণ উচ্চ পুরাপ্রস্তরযুগীয় ‘বাঘোর-১’ কেন্দ্র থেকে আমরা পেয়েছি। এখানে আরও ঘরের কাছের একটা উদাহরণ দিই। নামখানাতে নৌকাতে নদী পেরিয়ে ওপারে বকখালি যাওয়ার জন্য, সাধারণত মাছ নিয়ে যায়, এমন একটি ছোট খালি লরি ভাড়ায় নেওয়া হল। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে ডানদিকে একটু দূরে মাঠের ভেতর কয়েকটি শেষ বর্ষার জলে ভরা পুকুর দেখিয়ে লরিচালক বললেন যে পুকুরগুলোর পাশের গ্রামটিই ওঁর গ্রাম। পুকুরগুলোর প্রশংসা করাতে বললেন, ‘সবই ভাল, কিন্তু ‘জক্কি’গুলো বড় বিরক্ত করে।’ আরও আলোচনায় বোঝা গেল যে, পুকুরগুলোর জলের নীচে সারা গা গয়নায় ঢাকা যক্ষীরা থাকেন—গভীর রাত্রে তাঁরা উঠে আসেন। গয়নার ঝমঝম শুয়ে থাকা মানুষ শুনতে পান। তাঁদের চলার নির্দিষ্ট পথ আছে—সেই পথের ওপর কেউ বাড়ি করলে তার ভাল হয় না। আর, দিনের বেলাতেও, শিশুরা জলের ধারে গেলে, তাঁরা তাদের জলের নীচে নিয়ে যান। এখানে লক্ষ করা ভাল যে, যক্ষী/অপ্সরা একই দেবী/উপদেবী; জলের সঙ্গে যে তাঁদের সম্পর্ক নিবিড় তা অতি প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্র থেকে উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, আর, দক্ষিণ পশ্চিমবঙ্গে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত যে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বোধহয় সবচাইতে বেশি পাওয়া যায় তা হল গয়নায় গা ঢাকা পোড়ামাটির যক্ষীমূর্তি। আমাদের ধর্মীয় জীবন থেকে তাঁরা লোপ পেলেও কোথাও কোথাও গ্রামবাসীর মনোজগতে জল থেকে উঠে তাঁরা গয়না ঝমঝম করে বেড়ান! ভারতবর্ষে ধর্মের ইতিহাস প্রাচীন পুঁথির বিচিত্র তথ্যে, ‘ইশতার’, ‘নানা’ ইত্যাদি দুর্বোধ্য দেবীদের কাহিনীতে ভারাক্রান্ত; অথচ, প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে যে ভারতীয় ধর্মীয় ধারা আমাদের চারপাশে বইছে, আমাদের মনে হয় না যে সিন্ধু সভ্যতার ধর্মীয় ধারাটি তার থেকে ভিন্ন ছিল।

৭ সামাজিক, রাজনৈতিক গঠন এবং লোকজন

সামাজিক তফাত তো নিশ্চয়ই ছিল—মোহেঞ্জোদারো, হরপ্পা, কালিবাঙ্গান এবং অন্যত্র সাধারণের থাকার জন্য শহরের অংশ আর যে অংশকে বার বার ‘অ্যাক্রোপলিস’, ‘সিটাডেল’ ইত্যাদি বলে বর্ণনা করা হয়েছে, তার ভেতর পার্থক্য যথেষ্ট স্পষ্ট। তবে সব জায়গায় ‘সিটাডেল’-এর প্রকৃতি এক কিনা তা স্পষ্ট নয়। আর ‘সিটাডেল’-এ যাঁরা থাকতেন তাঁরা কতটা রাজা/রাজপুরুষ আর কতটা পুরোহিত শ্ৰেণী তা বলা মুশকিল। তবে, রাজশক্তিতে অনেক ধর্মীয় প্রভাব ছিল এটা মেনে নেওয়া যেতে পারে। তবে এদের থাকার জায়গা থেকে যে বিশেষ কোনও বিলাসিতার পরিচয় পাওয়া গেছে তা নয়। শিল্পকলাতেও কোথাও রাজা বা পুরোহিতশ্রেণীর বিশেষ চিত্রণ নেই—যা আছে যথা মোহেঞ্জোদারো থেকে পাওয়া নিদর্শন কয়েকটি, তাতে পুরোহিতের কথাই বেশি মনে হয়। একটি জিনিস খেয়াল রাখা উচিত: ভারতীয় শিল্পে রাজাকে কোথাও বিশেষভাবে দেখানো নেই। কয়েকটি ক্ষেত্রে মুদ্রাতে রাজাকে দেখানো হয়েছে, কিন্তু সাধারণ মানবিক মূর্তিতেই। শত্রুদের গলা কাটছেন, অন্য মানুষ থেকে অনেক ঊর্ধ্বে দাঁড়িয়ে আছেন—এসব ভঙ্গিতে নয়, যা সমসাময়িক পশ্চিম এশিয়ার শিল্পকলায় বহুল প্রচলিত। এত দুর্গবিন্যাস থেকে সিন্ধু সভ্যতায় রাজশক্তি ছিল না মনে হয় না; আর, তা ছাড়া কুনালে সভ্যতার আদি পর্যায়ের শেষে মুকুটে টায়রার অস্তিত্ব লক্ষণীয়। তবে, এটাও সত্যি যে রাজা সামাজিক এবং ধর্মীয় আদর্শের বন্ধনের ভেতরই ছিলেন। নইলে, কোথাও না কোথাও বাসস্থান বা অন্য কিছুতে বিশেষ ভোগবিলাসিতার চিহ্ন ধরা পড়ত। পুরোহিত শ্রেণী নিশ্চয় ছিলেন—সামাজিক রীতিনীতি, ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার আদর্শের একটি প্রধান উৎস হিসাবে। নাকের ওপর অর্ধ নিমীলিত চক্ষুদ্বয় বদ্ধ—ভাল শাল আমাদের ধরনেই গায়ে দেওয়া, মোহেঞ্জোদারোর মুখ আমাদের কাছে অপরিচিত ঠেকে না। বণিক এবং কারিগরি শ্রেণী যে ছিলেন তা নিয়ে তর্কের অবকাশ নেই। অন্তর্দেশীয় বাণিজ্যের যে ব্যাপকতা, বহির্দেশীয় বাণিজ্যের যে বিস্ততি, তাতে বণিক শ্রেণীর গুরুত্ব উপেক্ষা করার নয়। কারিগরশ্রেণীর অবস্থিতি এবং গুরুত্ব বিভিন্ন কারুশিল্পের উদাহরণ থেকেই বোঝা যায়। কিন্তু এত নগরকেন্দ্র শ্রমজীবী বাদ দিয়ে নিশ্চয় গড়ে ওঠেনি; হরপ্পার শস্যাগার, ঢেঁকি কুটে শস্য ভাঙার জায়গা, এক ঘরের সঙ্গে আঙিনা নিয়ে দেওয়াল ঘেরা বাড়ি—সব নিয়ে বোঝা যায় যে বিশাল শ্রমজীবী শ্রেণী ছিলেন।

তবে, আরও কিছু কথা থাকে। এই সভ্যতার বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে কি একই রাজ্য, অর্থাৎ সাম্রাজ্য ছিল? উত্তর অনুমানের ওপরই নির্ভরশীল, তবে আমরা যদি এই বিস্তৃত অঞ্চলের পরবর্তী ইতিহাসের কথা ভেবে দেখি তা হলে দেখব মৌর্যদের দুশ বছর বাদ দিলে প্রাচীন ইতিহাসে এই অঞ্চল কখনও একই রাজ্যের ভেতর ছিল না; সিন্ধু-সৌবীর, লাত, অনর্ত, মৎস্য, কুরু ইত্যাদি রাজ্য ছিল। সিন্ধু সভ্যতার ক্ষেত্রেও আমরা তা অনুমান করি। মনে হয় না যে, রাজনৈতিক ঐক্যের ওপর সভ্যতা নির্ভরশীল ছিল। আমাদের ঐতিহাসিক কালের সভ্যতাও তা ছিল না; অথচ আদর্শ এক ছিল, ধর্মীয় ব্যবহার, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন ইত্যাদিতেও প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে বিভেদের চাইতে সাদৃশ্য অনেক বেশি। জাতিভেদ প্রথা ছিল কি না কিছু পণ্ডিত প্রশ্ন তুলেছেন। ভারতবর্ষের জাতিভেদ প্রথার প্রাচীন ভিত্তি পেশাগত পার্থক্য; সেদিক থেকে সিন্ধু সভ্যতার ভেতর পেশাগত পার্থক্য সুপরিস্ফুট দেখে মনে হয় যে, জাতিভেদ প্রথার সূত্রপাত সে সময়েই হতে পারে।

সভ্যতার লোকজন দেখতে কী রকম ছিলেন অবশ্যই প্রশ্ন উঠতে পারে। খোঁড়া কঙ্কালগুলি যখন প্রথম বিশ্লেষণ হয় তারপর বহুদিন পর্যন্ত পণ্ডিতেরা তাদের ‘রেস’ (Race) ভিত্তিক ভাগ করেছিলেন। এই নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক, কিন্তু এটুকু বলা যেতে পারে যে, রেস-ভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ অবৈজ্ঞানিক বলে প্রমাণিত হয়েছে এবং সাধারণভাবে এখনও এই সভ্যতার বিস্তৃত অঞ্চলে যে ধরনের মানুষ এখন থাকেন মোটামুটি সেই ধরনের মানুষই তখনও থাকতেন।

খনন করে যথেষ্ট সমাধি পাওয়া গেছে। দাহ প্রথাও যে ছিল সে সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হওয়া যায়, কারণ, নগরের তুলনায় সমাধিস্থল থেকে খোঁড়া কঙ্কাল বা সমাধি কম। কিন্তু যেটা প্রাসঙ্গিক তা হচ্ছে যে সমাধি সমাধিতে মৌলিক প্রভেদ নেই; সঙ্গে দেওয়া মৃৎপাত্রের সংখ্যায়, কোথাও কোথাও গয়নায়, কোথাও কোথাও সমাধির ধরনে তফাত আছে, কিন্তু এমন তফাত নেই যা প্রাচীন মিশর বা মেসোপটেমিয়ায় বা অন্যত্র লক্ষ করা যায়। সামরিক অনুশাসন নিশ্চয় ছিল—দুর্গপ্রাকারের ঘটা, বেষ্টনী, বুরুজ সব থেকেই অনুমান হয়, তবে সমসাময়িক পৃথিবীর তুলনায়—অস্ত্রশস্ত্রের তেমন ঘটা নেই। বল্লম, ছুরি, তরোয়াল সবই তামার জিনিসের ভেতর আছে বলা হয়েছে, কিন্তু কোথাও আতিশয্য নেই। খুঁড়ে পাওয়া কঙ্কালের ভেতর হঠাৎ আঘাতে মরার নমুনা কম। আজকাল ‘ফরেনসিক’ বিজ্ঞানের সহায়তায় মাথার খুলি পেলে মুখের সাদৃশ্য গড়ে তোলা যায়। আশা করি আমাদের সিন্ধু সভ্যতার মানুষদের কঙ্কালের ব্যাপারেও তা একদিন সম্ভব হবে। মোহেঞ্জোদারোতে একটি রাস্তার ধারের কুয়োর পাশে কলসী বসানোর দাগ পাওয়া গেছে এবং পাশে একটি বেঞ্চ জাতীয় জিনিসের চিহ্ন। কুয়ো থেকে জল তোলা এবং গল্প করা দুটোই একসঙ্গে চলত। যে দিক থেকেই দেখি না কেন সিন্ধু সভ্যতার পৃথিবীটা খুব অচেনা লাগে না।

৮ পরিবর্তন: শেষ পর্যায়ের সিন্ধু সভ্যতা

পরিণত সিন্ধু সভ্যতা যে সমস্ত অঞ্চলে পাচ্ছি তার সর্বত্র আমরা পরের ধাপে আলাদা আলাদা পরিবর্তিত সংস্কৃতি দেখছি। এই সংস্কৃতিগুলি স্তর-পরম্পরায় সিন্ধু সভ্যতারই পরিবর্তিত রূপ; এগুলি যে সিন্ধু সভ্যতা থেকেই উদ্ভূত তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। সব অঞ্চলে পরিবর্তনের রূপ এক নয়। এই পরিবর্তনের প্রক্রিয়া কেন শুরু হয়েছিল আমরা পরে আলোচনা করব। এখানে আমরা শুধু এই পরিবর্তিত সংস্কৃতিগুলি বোঝার চেষ্টা করব।

বালুচিস্তানের ছবি কিছুটা অস্পষ্ট। কোয়েটা অঞ্চলে যে সংস্কৃতির ধারা শুরু হয়েছিল তা খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ পরবর্তী কাল পর্যন্ত পরিবর্তিত রূপে ছিল। এর সাক্ষ্য আসে পিরক বলে একটি কেন্দ্র থেকে। সিন্ধু সভ্যতার পরিচায়ক কিছু মৃৎপাত্রও এই স্তর থেকে পাওয়া যায়। দক্ষিণ বালুচিস্তানে পুরনো কুল্লি সংস্কৃতির ধারাই গড়িয়ে চলে। সিন্ধুপ্রদেশে এই সময়ের যে সংস্কৃতি তার নাম ঝুকর সংস্কৃতি। এর তিনটি পর্যায় দেখা গেছে। তিনটিতেই পরিণত সিন্ধু সভ্যতার মৃৎপাত্র পাওয়া যায়। যিনি এর ওপর কাজ করেছেন তাঁর মতে ঝুকর সংস্কৃতি শুধু একটি অতিরিক্ত মৃৎপাত্রের ধারা—পরিণত সিন্ধু সভ্যতার অংশ হিসেবেই এই অঞ্চলে শুরু হয়েছিল। স্তর-পরম্পরায় কোনও হঠাৎ পরিবর্তন বা থেমে যাওয়া নেই। তবে যেটা লক্ষ করার মতো তা হচ্ছে চৌকো সিলমোহরের ব্যবহার প্রায় নেই; বদলে গোলাকার এক ধরনের সিলমোহর দেখা যাচ্ছে; লিপিচিহ্নের ব্যবহার শুধু মৃৎপাত্রের ওপর উৎকীর্ণ দেখা যাচ্ছে। ‘ওজন’ এবং পোড়ামাটির নারীমূর্তি খুব কমে এসেছে। পাকিস্তানি পঞ্জাবে যে সংস্কৃতি এই পর্যায়ে আছে তার নাম হরপ্পায় প্রাপ্ত একটি সমাধিক্ষেত্র— সিমেটরি এইচ—এই নামে। এই সংস্কৃতির মৃৎপাত্র, যা প্রথম পাওয়া গিয়েছিল, সমাধিতে দেওয়া হিসাবে, সেগুলি বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ; মোটামুটি উজ্জ্বল লাল প্রলেপের ওপর কিছুটা মোটা বুরুশে সাবলীল চিত্রকর্ম—ময়ূর, লম্বা এবং ছড়ানো শিং-ওলা লম্বা শরীর ষাঁড়, ফুল ইত্যাদি। হরপ্পায় সাম্প্রতিক খননে এই সংস্কৃতির প্রকৃতি বিশদ বোঝা গেছে। পরিণত সিন্ধু সভ্যতার পর্যায় (যা হরপ্পাতে নীচ থেকে ৩ নং কাল) এবং এই সংস্কৃতির মাঝে (যা হরপ্পাতে নীচে থেকে ৫ নং কাল) একটি ক্রমিক পরিবর্তন সূচনাকারী ৪ নং কাল আছে। পাকা ইট, ড্রেন সবই আছে এই ‘সিমেটরি এইচ’ সংস্কৃতিতে, তবে ছোট হয়ে আসছে। হরপ্পার এই পর্যায়ের বিশদ বিবরণ এখনও প্রকাশিত হয়নি, তবে চোলিস্তান অঞ্চলে, ঘগ্‌গর-হাক্‌রা উপত্যকাতে, এই সংস্কৃতির অন্তত ৫০টি কেন্দ্রের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এর ভেতর ২৬টি কেন্দ্রের আয়তন সম্পর্কে ধারণা হয়েছে: ৫ হেক্টর পর্যন্ত—১২টি কেন্দ্র; ৫ থেকে ১১ হেক্টর—৭টি; ১১ থেকে ২০ হেক্টর—৬টি; ২০ হেক্টরের বেশি—১টি (৩৮.১ হেক্টর বা প্রায় ৯৫ একর)। এখানেও জোর দেওয়া হয়েছে সাংস্কৃতিক ধারার অবিচ্ছিন্নতার ওপর; কেন্দ্রগুলির আয়তন থেকে অনুমান করা যায় যে এই সংস্কৃতির বসতি বসতিতে যথেষ্ট তফাত আছে; অন্তত একটিকে তো নগরই বলা চলে।

১৯৮৪ পর্যন্ত হিসেবে (তারপর কোনও মোট হিসেব প্রকাশিত হয়নি) ভারতীয় পঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, হিমাচলপ্রদেশ, (পঞ্জাবের গা ঘেঁষা অংশটি শেষ) দিল্লি, চণ্ডীগড়—এই পুরো অঞ্চলটিতে ৫৮০টি ‘সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়’-এর কেন্দ্র। এর পর অনুসন্ধানে এই সংখ্যা আরও বেড়েছে। সাধারণভাবে বসতিগুলির আয়তন ৫ একর বা তার চাইতে ছোট। মৃৎপাত্রের ধারা এবং পরিণত সিন্ধু সভ্যতার মৃৎপাত্রের ধারার সঙ্গে এই ধারার ঘনিষ্ঠতা বোঝা গেছে। হরিয়ানার বনোয়ালী থেকে মৃৎপাত্র ছাড়াও কিছু সাক্ষ্য মেলে—কাদামাটির বাড়ি, ‘ফেঁয়স’ দিয়ে বানানো গয়না (বালা, কানের দুল, পুঁতি, আংটি ইত্যাদি), ভাল পাথরের পুঁতি, কিছু তামার জিনিস, পোড়ামাটির জিনিস ইত্যাদি। পঞ্জাবে সাংঘোল থেকে মাটির ঘরের চিহ্ন, উনুন, কাচা ইটের বাড়ি, শস্য রাখার গর্ত এবং ‘অগ্নিবেদি’ পাওয়া গেছে। দাধরীতে পুরো বসতিটাই মাটির বড় ভিত বানিয়ে তার ওপর ঘরবাড়ি বানানো। এখানে তামা, পোড়ামাটির ষাঁড়, ‘ফেয়স’-এর বালা এবং কার্নেলিয়ান ও লাপিস লাজুলি পাথরের পুঁতি পাওয়া গেছে। পঞ্জাবে মেহেরানাতে এই স্তর থেকে বিভিন্ন জাতের যব ও গম, মসুর ডাল এবং আঙুর পাওয়া গেছে। রোহিরাতে এ ছাড়া ছোলা, জোয়ার এবং খেজুর চিহ্নিত হয়েছে। উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুরের হুলাস কেন্দ্রটি থেকে এই পর্যায়ে কৃষিকার্যের নমুনা হিসাবে যব এবং গম তো বটেই, তা ছাড়াও ধান, ২/৩ রকমের বাজরা , ‘ওট্‌স’, বিভিন্নরকমের মুগ এবং মটর, তুলা এবং বড় কাঠবাদাম ও আখরোট ফল পাওয়া গেছে।

বোঝা যাচ্ছে যে ঘগ্‌গর-হাক্‌রা উপত্যকা থেকে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ পর্যন্ত এই পর্যায়ের কেন্দ্রগুলি আয়তনে ছোট হলেও কৃষির প্রাচুর্যে বলীয়ান। পুরাতাত্ত্বিক দিক দিয়ে এই কেন্দ্রগুলির বিস্তৃতির ম্যাপ আমরা যদি দেখি তবে দেখব যে ঘগ্‌গর-হাক্‌রা উপত্যকার পুরাতন অঞ্চল থেকে গাঙ্গেয় উপত্যকার দিকে, দোয়াব পর্যন্ত, একটা বসতি বিস্তারের বড় ঢেউ।

গুজরাটে প্রথম পরিবর্তন বোঝা যায় লোথালের ৫ নং পর্যায় থেকে, যাকে খননকর্তা ‘লোথাল বি’ বলেছেন: মৃৎপাত্রের ধরনে কিছু পরিবর্তন, তা ছাড়া মাটি ও বেত জাতীয় জিনিস দিয়ে সাধারণভাবে তৈরি ঘরবাড়ি, বড় চার্ট পাথরের ‘ব্লেড’-এর পরিবর্তে অন্য পাথরের ছোট ‘ব্লেড’, পাথরের পুঁতির পরিবর্তে পোড়ামাটির পুঁতি, চার্ট বা অ্যাগেট পাথরের ‘ওজনের’ পরিবর্তে নিম্নমানের পাথরের বড় ‘ওজন’ ইত্যাদি। লিপিচিহ্নসমেত স্টিয়েটাইট-এর চৌকো সিলমোহর অবশ্য এই পর্যায়েও ব্যবহৃত হয়েছিল। রোজডি নামক আর একটি কেন্দ্রে এই পর্যায়ের সাক্ষ্য আছে। রোজডির খননকারীরা মনে করেন যে, রোজডি এবং সমগোত্রীয় কেন্দ্রগুলি সিন্ধু সভ্যতার পরিণত পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু তাঁদের যুক্তি পুরোটাই রোজডি থেকে পাওয়া রেডিওকার্বন তারিখ থেকে—যে তারিখগুলি পাওয়া যাচ্ছে তা সিন্ধু সভ্যতার পরিণত পর্যায়ের ভেতর পড়ে। দুঃখের কথা এই যে, রেডিওকার্বন তারিখ আর প্রত্নতাত্ত্বিক স্তর-পরম্পরার সাক্ষ্য যখন মেলে না তখন স্তর-পরম্পরার সাক্ষ্যই মানতে হয়। স্তর-পরম্পরাতে গোলমাল হয় না, রেডিওকার্বন তারিখ অনেক সময় অনেক কারণে গোলমাল হয়। যাই হোক, ভাদর নদীর পারে অবস্থিত রোজডি, নদীর দিকটি ছাড়া, পাথরের ১.৫-২ মি. চওড়া দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। প্রথমে সমান্তরালভাবে বড় বড় ব্যাসলট পাথর (কতগুলি পাথর এর ভেতর ১ মেট্রিক টনের বেশি ওজন) অগভীর ভিতের ওপর সাজিয়ে—মাঝখানের জায়গাটা মাটি, পাথরের টুকরো ইত্যাদি দিয়ে ভর্তি করে এই দেওয়ালটা করা। পশ্চিমদিকে একটি দুর্গদ্বার— দুটি বেষ্টনী যোগ করে এই দ্বার সুরক্ষিত করা হয়েছিল। বসতিটির আয়তন প্রায় ৭ হেক্টর। এখানে কয়েকরকম জোয়ার-বাজরা ছাড়া, গম, সর্ষে কয়েকরকম ডাল, কুল, ওষধি জাতীয় উদ্ভিদ, বুনো ঘাস ইত্যাদি পাওয়া গেছে। এ ছাড়া কিছু তামার জিনিস পাওয়া গেছে। গুজরাটে এই পর্যায়, অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ের বহু কেন্দ্র পাওয়া গেছে। যেমন, দ্বারকার কাছে, বেট দ্বারকা বলে কিছুটা সমুদ্রমগ্ন জায়গায় খনন করে পাথরের দেওয়াল, মৃৎপাত্র, একটি লিপিহীন ‘সিলমোহর’ ইত্যাদি বের করা হয়েছে। তারিখ খ্রি. পূ. ১৫৭০। একটি মৃৎপাত্রে লিপি উৎকীর্ণ পাওয়া যায়। সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় কিছুটা সমুদ্রগর্ভে চলে যায়।

এই ধরনের বসতি ছাড়াও এই সময়ে গুজরাটে বহু ধরনের বসতি আছে। বেশ উজ্জ্বল চকচকে লাল রঙের চিত্রিত এক ধরনের মৃৎপাত্র গুজরাটে সিন্ধু সভ্যতার একেবারে শেষ পর্যায়ের বৈশিষ্ট্য। এই মৃৎপাত্র ছোট বড় বহু কেন্দ্র থেকে পাওয়া গেছে। উত্তর গুজরাটে রূপেন উপত্যকায় এই ধরনের যে কেন্দ্রগুলিতে আয়তন বোঝা গেছে তার ভেতরে ৮-৯ হেক্টর আয়তনের কেন্দ্র হচ্ছে মাত্র ১টি; ৮টি কেন্দ্র আছে ১ হেক্টরেরও ছোট। অনেক ক্ষেত্রে মৃৎপাত্রে সিন্ধুলিপি উৎকীর্ণ আছে। তাই এগুলি যে সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ের বুঝতে অসুবিধে হয় না। ঘেরা জেলায় কানেওয়াল বলে একটা কেন্দ্রের কথা ভাবা যেতে পারে—মাটি, কুটো ইত্যাদি দিয়ে বানানো ঘর। পেটানো শক্ত মাটির মেঝে, পোড়ামাটির ত্রিকোণাকৃতি বা আয়তাকার ঢেলা, কার্নেলিয়ান, ঝিনুক এবং পোড়ামাটির পুঁতি, জালে বাঁধার পোড়ামাটির ছিদ্রযুক্ত গুলি, তামা এবং মৃৎপাত্র। নেসডি বলে একটি জায়গায় মনে হয়েছে বছরের বিভিন্ন সময়ে এটি গোচারকদের বা গয়লাদের বসতি ছিল।

সব মিলিয়ে, বালুচিস্তান, সিন্ধুপ্রদেশ, পঞ্জাব, চোলিস্তান, দোয়াবের উত্তর প্রান্ত পর্যন্ত অঞ্চল, গুজরাট—এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যেখানে, আদি এবং পরিণত সিন্ধু সভ্যতার চিহ্ন পাওয়া গেছে (দোয়াবের উত্তর অঞ্চলে অবশ্য আদি পর্যায়ের চিহ্ন এখনও পাওয়া যায়নি), শেষ পর্যায়ের চিত্রটি কিঞ্চিৎ বিক্ষিপ্ত এবং অনেকাংশে আঞ্চলিক। তবে, কোথাও সিন্ধু সভ্যতার ধারা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে না, যদিও খুব কমে আসছে। কোথাও কোথাও, যেমন গুজরাট এবং ভারতীয় পঞ্জাব-হরিয়ানা-দোয়াবে আয়তনে কেন্দ্রগুলি ছোট হয়েছে কিন্তু সংখ্যায় অনেক বেশি। লিপির সঙ্গে, পরিণত সভ্যতার মৃৎপাত্র শৈলীর সঙ্গে, অপরাপর কিছু বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে যোগসূত্র থাকছে। গুজরাটে কিছু বড় বড় কেন্দ্রও ছিল—গুজরাটের সঙ্গে এই পর্যায়ে ‘গাল্‌ফ’ অঞ্চলের বহির্বাণিজ্যিক যোগসুত্র নিশ্চয় ছিল। সব মিলিয়ে সমস্যাটা পরিণত সিন্ধু সভ্যতার ‘পতন’-এর নয়, ‘পরিবর্তন’-এর।

এখানে একটি ভৌগোলিক ব্যাপার ভাবা যেতে পারে। পরিণত সিন্ধু সভ্যতার সময়েই দোয়াবে মিরাট জেলায় আলমগিরপুর বলে একটি কেন্দ্র ছিল। এই কেন্দ্র থেকে পাওয়া লিপিযুক্ত সিলমোহর, মৃৎপাত্র ইত্যাদি দেখে একে পরিণত সিন্ধু সভ্যতা পর্যায়েরই বলতে হয়। মিরাট অঞ্চল কিন্তু একেবারেই গাঙ্গেয় উপত্যকা। সাহারানপুরের হুলাসের প্রথম স্তরটিও বোধ হয় পরিণত সিন্ধু সভ্যতা পর্যায়েরই। এই পর্যায়ের চৌকো কাঁচা ইটের ঘর পরবর্তী পর্যায়ে গোল মাটির ঘরে পর্যবসিত হচ্ছে। মানচিত্র দেখলে বোঝা যায় যে, শেষ পর্যায়ের বসতিগুলি গাঙ্গেয় উপত্যকার ওপরের প্রান্তের দিকে সরছে। যে ভৌগোলিক ব্যাপারটা ভাবার কথা, তা হচ্ছে যে, গাঙ্গেয় উপত্যকার কোনও অংশে কোনও সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ আর সেই উপত্যকার মূল স্রোতে একাত্ম হওয়া একই কথা। গুজরাটের ব্যাপারেও যা ভাবার কথা তা হচ্ছে যে গুজরাটে কোনও সংস্কৃতি দৃঢ়মূল হলে গুজরাট থেকে ২/৩ দিকে আরও ভেতরে ঢোকার সুযোগ রয়ে যায়। উত্তর গুজরাট হয়ে রাজস্থানের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে প্রায় উন্মুক্ত রাস্তা: তাপ্তি নদীর উপত্যকা ধরে মহারাষ্ট্রে ঢোকা এবং নর্মদা-তাপ্তি ধরেই মধ্য ভারতের মালোয়া অঞ্চলে ঢোকা। বস্তুত, মহারাষ্ট্রে গোদাবরী অঞ্চলে দাইমাবাদ নামক কেন্দ্রে শেষ পর্যায়ের সিন্ধু সভ্যতার বসতি স্তর পাওয়া গেছে। মধ্যপ্রদেশেও আস্তে আস্তে এর সাক্ষ্য বেরোচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে যে, সিন্ধু সভ্যতা শুধু পরিবর্তিতই হচ্ছে না, উপমহাদেশের গাঙ্গেয় উপত্যকা এবং রাজস্থান- মধ্যপ্রদেশ- দাক্ষিণাত্যের সংস্কৃতি স্রোতে বইতে আরম্ভ করেছে। ছবিটি বিক্ষিপ্ত হলেও হঠাৎ পতনের নয়।

কিছুদিন আগে পর্যন্ত যে ছবিটি দেওয়া হত তা হঠাৎ পতনেরই। এ সিদ্ধান্তে আসার কারণ ছিল, মোহেঞ্জোদারোতে ওপরের স্তরগুলিতে প্রাপ্ত কিছু কঙ্কাল। সংখ্যায় বেশি না হলেও, সমাধি বা দাহ না করা মানুষের চিহ্ন নগরজীবনে অশান্তির ইঙ্গিত করে এবং এই ইঙ্গিতের সঙ্গে ভারতবর্ষের ‘আর্য আক্রমণ’-এর কথা ভাবলেই আকস্মিক পতনের চিত্রটি সহজেই বোধগম্য হয়। কঙ্কালগুলি সম্পর্কে একটি মাত্র জিনিস মনে রাখলেই যথেষ্ট: ওপরের দিকে হলেও এগুলি বিভিন্ন স্তরের; তাই এক সময়ের হতেই পারে না, আর এক সময়ের না হলে কোনও বিশেষ আক্রমণের দ্যোতকও এরা নয়। এ ছাড়াও লক্ষ করতে হবে যে, অন্য কোনও খনন করা কেন্দ্রে শেষ পর্যায়ে এ ধরনের ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কোনও কঙ্কাল পাওয়া যায়নি।

আক্রমণের ধারণা তখনকার পণ্ডিতদের ভেতর অবিসংবাদী সত্য হওয়ায়, তাঁরা এই আক্রমণের সাক্ষ্য হিসাবে আরও অনেক কিছু বলেছেন: বালুচিস্তানে এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত ও ভেতরে অন্যত্র এমন কিছু তাম্ৰ কুঠার ইত্যাদি পাওয়া গেছে যেগুলি সাধারণত পশ্চিম এশিয়া যথা পারস্য কি মধ্য এশিয়াতে পাওয়া যায়। ওই অঞ্চল থেকে কোনও জিনিস ভারতবর্ষে আসতে গেলে অশ্বারোহীর আক্রমণের দরকার হয় না—সব সময়ের যে লোকজন যাতায়াত (বাণিজ্যিক সূত্রে) তাতেই আসতে পারে।

আক্রমণের বা হঠাৎ পতনের ব্যাখ্যা যখন শূন্যগর্ভ বোঝা যেতে লাগল তখন থেকে পণ্ডিতেরা বলতে শুরু করলেন যে, সিন্ধু সভ্যতার লোকেরা প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সম্পদ নষ্ট করে ফেলেছিলেন তাই পতন হল। আবার কেউ কেউ বললেন, মোহেঞ্জোদারো কাদায় ডুবে গিয়েছিল। মোহেঞ্জোদারোর নীচের দিকে অর্থাৎ ভাটিতে কোনও ভূতাত্ত্বিক কারণে নদীর মাটির তলা উঁচু হয়ে একটি বাঁধ হয়ে গিয়েছিল। নদী বাধা পেলে—বিপরীত দিকে, অর্থাৎ মোহেঞ্জোদারোর দিকে প্রথমে একটি বড় হ্রদ হয়ে যায়, তারপর মাটির বাঁধ দিয়ে জল চুঁইয়ে গেলেও, কাদা তো যেতে পারে না। উজানে কাদা জমতে আরম্ভ করে। মোহেঞ্জোদারোর লোকেরা ভিত উঁচু করে কিছুদিন এই কাদার ওপর ভেসে থাকার চেষ্টা করল; তারপর, তা যখন সম্ভব হল না তখন নগর ছেড়ে গেল। এখানেও কিন্তু ব্যাখ্যা সিন্ধু সভ্যতা নিয়ে নয়; শুধু মোহেঞ্জোদারোকে নিয়ে। এই নিয়ে বিতর্কও চলেছিল বহুদিন। আবার, আর একজন পণ্ডিত বললেন যে, যমুনা নদী সিন্ধু এবং গঙ্গা অববাহিকার ভেতর পেণ্ডুলামের মতো দুলছে। যখন যমুনা সিন্ধু অববাহিকার ভেতর তখন ঘগ্‌গর-হাক্‌রাতে জল ছিল; যখন যমুনা পাকাপাকি গঙ্গা অববাহিকায় চলে এল তখন ঘগ্‌গর-হাক্‌রাতে জলও শুকিয়ে গেল, আর তাই, কালিবাঙ্গানের পতন হল। লোথালে দেখানো হল বন্যা—একবার এমন বন্যা হল যে অধিবাসীদের আর ভাল করে নগর করে বসতে ইচ্ছেই হল না। আমাদের নিজেদের ব্যাখ্যা সভ্যতার সব অঞ্চল নিয়েই। কোনও একটি বিশেষ অঞ্চলের নয়।

প্রথমত, এটা বুঝতে সময় লাগে না যে শেষ পর্যায়ে সভ্যতার সমৃদ্ধ নগরজীবন যথেষ্ট পালটেছিল। মোহেঞ্জোদারোতে এবং অন্যত্র একেবারে শেষ পর্যায়ে বাড়িঘরের খারাপ, কিছুটা দরিদ্র ও ঘিঞ্জি অবস্থার কথা অনেক খননকারীই বলেছেন। এর সঙ্গে সঙ্গে দেখছি ছোট ছোট কেন্দ্রের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাওয়া। গুজরাটে এই পর্যায়ে নগরও ছিল—বেট দ্বারকা, রোজডি ইত্যাদির পাথরের দুর্গপ্রাকার, বহির্বাণিজ্যের চিহ্ন উপেক্ষণীয় নয়। কিন্তু অন্যদিকে এই পর্যায়ের বৈশিষ্ট্য দোয়াবের দিকে ঝুঁকে পড়া, আর গুজরাট থেকে দক্ষিণ-পূর্ব রাজস্থান, মালোয়া অধিত্যকা এবং দাক্ষিণাত্যের দিকে। গুজরাটে অন্তত সিলমোহরের ব্যবহার উঠে যাচ্ছে না, যদিও সর্বত্রই লেখার ওপর জোরটা কম মনে হচ্ছে। ‘বি-নাগরিকীকরণের’ একটা কথা মনে আসে—প্রায় সব অঞ্চলেই কিছু না কিছু তা হচ্ছে। অন্তর্দেশীয় বাণিজ্যও যে কমে এসেছে তা বোঝা যায় দূরের কাঁচামালের অপেক্ষাকৃত অনেক কম ব্যবহার। অথচ, অর্থনৈতিকভাবে এটা যে অবনতির যুগ তাও বলা যায় না। কেন্দ্রের সংখ্যা বেড়েছে, যতই ছোট ছোট হোক না; কৃষিরও কিছু অসমৃদ্ধি নজরে আসছে না। নগর যাচ্ছে বুঝতে পারছি, তবে জনজীবনের ধারা মরছে না, বরং ভেতরের ভারতবর্ষের দিকে আসছে—দোয়াব, দাক্ষিণাত্য ইত্যাদি।

প্রথম যে কারণটি মনে আসে তা ঘগ্‌গর-সরস্বতী প্রবাহ অর্থাৎ প্রাচীন সরস্বতীর ব্যাপক শুকিয়ে আসা। এই প্রবাহের যৌবন বোধহয় সভ্যতার আদি পর্যায়ের সময় থেকেই অতিক্রান্ত; তবু এই সময় বোধহয় বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে প্রবাহ বিশেষ শীর্ণ হতে আরম্ভ করে। এটা শুধু অনুমান তবে, যেভাবে হরিয়ানা ও পঞ্জাবের কিছু বিশেষ অঞ্চলের ভেতর বসতি ঘন-সন্নিবদ্ধ তাতে মনে হয় যেখানে যেখানে নদীতে জল জমা ছিল সেখানেই মানুষ ভিড় করছে। এসব একদিনে হয়নি, পরবর্তী অংশে দেখব যে এই শেষ পর্যায়ও কয়েক শতাব্দীর ব্যাপার। তবু দিন যে পালটাচ্ছে তা বোঝা যায়। এটা সত্যি যে, সিন্ধু সভ্যতার দৃঢ় ভিত্তিভূমির পেছনে অনেক শতকের গ্রামজীবন আছে। যেটা নজর করার মতো তা হচ্ছে সব অঞ্চলেই এই গ্রামজীবনের ভিত্তি সুদৃঢ় নয়। যেমন, দোয়াব বা গুজরাটের কিছু জায়গায়। দোয়াবে তো কোথাও সভ্যতার আদি পর্যায়েরই খোঁজ পাওয়া যায়নি। গুজরাটে সিন্ধু সভ্যতার সময়কালেই যে আশেপাশে অনেক খাদ্যসংগ্রহকারীরা ছিল তা কয়েকটি কেন্দ্রের সাক্ষ্য থেকেই বোঝা গেছে। যখন সভ্যতা প্রাকৃতিক কারণে টাল খাচ্ছে, যখন তাকে পালটাতে হচ্ছে, তখন চারপাশের জমি থেকে খাদ্যসংগ্রহকারীরাও উঠে আসছে। হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতা একদিনে তার বিস্তৃতির সমগ্র অঞ্চলে ছড়ায়নি। চোলিস্তানে শুরু হয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের ভেতর দিয়েই বালুচিস্তান থেকে দোয়াব আর জম্মু থেকে তাপ্তিমোহনা পর্যন্ত ছড়িয়েছে। কিন্তু তা হলেও বলতে হয় যে সভ্যতার প্রভাব ক্রমে হ্রাস পেয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত প্রাকৃতিক কারণ, অর্থাৎ নদীভিত্তিক সভ্যতার উৎস যে জলপ্রবাহ তা শুকিয়ে আসায়, সভ্যতার রাষ্ট্রব্যবস্থা (যা হয়তো কয়েকটি অঞ্চলভিত্তিক ছিল) শেষ পর্যন্ত টাল সামলাতে পারেনি। এবং যখন তা পারেনি তখন তার নাগরিক জীবন থাকারও কোনও প্রশ্ন ওঠে না।

প্রমাণ-সিদ্ধ কোনও কথা বলা হল না এখানে। তবু, সর্বমোট প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকে এ ধরনের ইঙ্গিতই পাওয়া যাচ্ছে। এখানে যেটুকু লক্ষ করার মতো তা হচ্ছে এই ব্যাখ্যাতে সভ্যতার অবলুপ্তি নেই, তার পরিবর্তন আছে, বি-নাগরিকীকরণ আছে। বি-নাগরিকীকরণ হলেই কোনও জনজীবনপ্রবাহ নিঃশেষিত হয় না; প্রবাহটি শুধু মোড় পালটায়। আমাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সিন্ধু সভ্যতার ক্ষেত্রেও এই ঘটেছিল।

৯ পরিণত ও শেষ পর্যায়ের সিন্ধু সভ্যতার কালর্নিণয়

সিন্ধু সভ্যতার আদি পর্যায়ের সূত্রপাত যে খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি এটি আমরা যথাস্থানে বলেছি। এই অংশের বিচার্য, কখন আদি পর্যায় থেকে পরিণত পর্যায়ে উত্তরণ ঘটেছিল, আর পরিণত থেকে শেষ পর্যায়ই বা কখন, অথবা শেষ পর্যায়টিই কতদিন পর্যন্ত টিঁকেছিল। প্রথমেই আমাদের মনে করা উচিত যে পরিণত সিন্ধু সভ্যতার তারিখ প্রত্নতাত্ত্বিক দিক দিয়ে মেসোপটেমিয়াতে এবং অন্যত্র প্রাপ্ত এই সভ্যতার নিদর্শনের তারিখের ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ, ওইসব অঞ্চলে যে সমস্ত স্তরে সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে সেই সমস্ত স্তরের তারিখ থেকে সিন্ধু সভ্যতার সেই সমস্ত নিদর্শনগুলির তারিখ বলা যেতে পারে এবং সেই তারিখের ভিত্তিতে সভ্যতাটির একটি পূর্ণাঙ্গ কালনির্ণয়ের চেষ্টা সম্ভব। তবে এখানেও গোলমাল আছে। প্রথম গোলমাল হচ্ছে বাইরে যে সমস্ত স্তরে নিদর্শন পাওয়া গেছে সেই স্তরগুলির তারিখ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া। দুর্ভাগ্যবশত সেটা হওয়া অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয়ত, যেখানে এটা সম্ভব হয়, আমরা কী করে বুঝব, যে-নিদর্শনটির তারিখ এইভাবে হল, সেটি সভ্যতার কোন পর্যায়ের নিদর্শন? এটা বোঝার উপায় এখনও নেই।

রেডিওকার্বন সমীক্ষা পদ্ধতিতে আহৃত তারিখগুলিও গোলমালের বাইরে নয়। সমস্ত খনিত কেন্দ্রের সমস্ত পর্যায়ের তারিখ মেলা চাই। এটা হয়নি। ধোলাবিরা থেকেও এখনও নির্ভরযোগ্য রেডিওকার্বন তারিখ আসেনি। তা ছাড়া, যে অঞ্চলটিতে আমরা সিন্ধু সভ্যতার উৎপত্তিস্থল নির্ণয় করেছি সেই অঞ্চলটির কেন্দ্রগুলিতে এখনও তো খোঁড়াই হয়নি; রেডিওকার্বন তারিখ তো দূরের কথা। দ্বিতীয়ত, রেডিওকার্বন তারিখে সংশোধনের প্রয়োজন আছে—সূক্ষ্ম নিরূপণের (যাকে ইংরেজিতে ‘হাই প্রিসিশান ডেটিং’ বলা হচ্ছে) প্রয়োজন আছে। সূক্ষ্ম নিরূপণ করার গবেষণাগার এখনও আমাদের দেশে করা হয়নি। তা ছাড়া, সংশোধনের ব্যাপারেও বিশেষ নজর দেওয়া হয়নি। রেডিওকার্বন পদ্ধতির একটি মূল ভিত্তি হল যে, অন্তরীক্ষে রেডিও অ্যাকটিভ ‘কার্বন-১৪’ বরাবর সমান পরিমাণে আছে, বিভিন্ন সময়ে তার তারতম্য ঘটেনি। দেখা গেছে এই তারতম্যই ঘটেছে, এবং অন্তত খ্রি. পূ. পঞ্চম সহস্রাব্দ পর্যন্ত তারিখগুলি ‘সংশোধন’ করে নেওয়া উচিত। এই সময়কালের যে রেডিওকার্বন তারিখ তা ঐতিহাসিক তারিখ নয়। সংশোধনে ঐতিহাসিক তারিখটি পেতে হবে এবং তাতে তারিখটি বেশি হবে। কতটা বেশি হবে, কীভাবে সংশোধন হবে তারও যে বিশেষ একটা পদ্ধতি আছে তা নয়। এই সংশোধনের ব্যাপারে মৃত গাছের কাঠ/ চাকতির বাৎসরিক দাগ ভিত্তিক গণনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। ইংরেজিতে এটিকে ‘ডেন্‌ড্রোক্রোনোলজি’ বা ‘ট্রি রিং ডেটিং-মেথড’ বলা হয়। আমাদের দেশে এটা আরম্ভই হয়নি। রেডিওকার্বন তারিখে আবার ‘যোগ-বিয়োগ’ দাগের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যথা ১০০০ (১০০ খ্রি. পূ. তারিখ হলে এটার অর্থ হবে যে, সভ্যতার তারিখ ৯০০ থেকে ১১০০ খ্রি. পূ. ভেতর হওয়ার সম্ভাবনা ৬৬%। আর ৮০০ থেকে ১২০০ খ্রি. পূ. ভেতর হওয়ার সম্ভাবনা ৯৫%। বলাই বাহুল্য কে কীভাবে রেডিওকার্বন তারিখ বিশ্লেষণ বা ব্যবহার করবেন তা কিছুটা তাঁর নিজের ওপর নির্ভর করছে।

যে পদ্ধতিটি সিন্ধু সভ্যতার মৃৎপাত্রের ওপর ব্যাপক ব্যবহার করা যেত অথচ হয়নি তাকে ‘থার্মোলুমিনিসেন্স’ পদ্ধতি বলা হয়। এটি করার জন্য আমেদাবাদে ‘ফিজিকাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটে’ একটি গবেষণাগার আছে, তবে সে গবেষণাগার থেকে করা বেশি তারিখ আমরা দেখতে পাই না। রেডিওকার্বনেও মাত্র দুটি গবেষণাগার—একটি আমেদাবাদের ফিজিকাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটেই—এটির খবরও আজকাল কম পাওয়া যায়। আর একটি লক্ষ্ণৌতে ‘বীরবল সাহানি ইনস্টিটিউট অব প্যালিওবোটানি’তে। এদেরও নিয়মিত প্রকাশনা দেখা যায় না।

সীমাবদ্ধতার ভেতরও যতটুকু জানি তা হচ্ছে এই: মেসসাপটেমিয়ায় সর্বপ্রাচীন যে সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে তা হচ্ছে দুটি বিশেষ ধরনের পুঁতি এবং যেখানে এদের পাওয়া গেছে তার তারিখ নিয়ে সন্দেহ নেই: খ্রি. পূ. ২৬০০। অর্থাৎ, খ্রি. পূ. ২৬০০ অব্দে পরিণত সিন্ধু সভ্যতা ছিল। এই পুঁতিগুলির মতো পুঁতি পরিণত পর্যায়ের আগে হয়নি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে মেসোপটেমিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ যদি খ্রি. পূ. ২৬০০ অব্দ নাগাদ ঘটে গিয়ে থাকে তবে তার কতদিন আগে সভ্যতার পরিণত রূপ আরম্ভ হয়েছিল। ১০০ বছর, ২০০ বছর? ১০০ বছর বললে বোধহয় অপরাধ হয় না। কাজেই আমরা বলতে পারি যে, সভ্যতার পরিণত রূপ হয়তো খ্রি. পূ. ২৭০০ অব্দ নাগাদ আরম্ভ হয়েছিল। এর আগে হতে পারে, পরে হওয়ার সম্ভাবনা কম। শুধু পুঁতির তথ্যই নয়, আরও কিছু তথ্য আছে, তবে সেগুলি এখানে আলোচনা করার প্রয়োজন নেই।

এবার প্রশ্ন: পরিণত পর্যায় কতদিন ছিল? এখানে রেডিওকার্বন তারিখের ওপর নির্ভর করতে হয়। যদি বলি খ্রি. পূ. ২০০০ অব্দ নাগাদ ‘পরিণত’ থেকে ‘শেষ’ পর্যায়ের পালা বদল ঘটছে তা হলে অসঙ্গত অনুমান হয় না। তবে এই সময়টা কিছুটা অঞ্চলভিত্তিক হবে। সব অঞ্চলে নিশ্চয় একসময়েই পালাবদল ঘটেনি। পরিশেষে, শেষ পর্যায় কতদিন ছিল? মেসোপটেমিয়া ও ‘গাল্‌ফ’-এ ক্যাসাইট যুগের (খ্রি. পূ. চতুর্দশ শতক) স্তরে সিন্ধু সভ্যতার চৌকো সিলমোহর পাওয়া গেছে। তাই চতুর্দশ শতক পর্যন্ত টিঁকে থাকাটা সংশয়ের ব্যাপার নয়। কোথাও কোথাও, আর দু-একশ বছর টিঁকে থাকলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।

তা হলে এবার আমরা সভ্যতাটির আদি, পরিণত ও শেষ এই পুরো অঞ্চলের কালটি একসঙ্গে দেখি। খ্রি. পূ. চতুর্থ সহস্রাব্দ থেকে খ্রি. পূ. দ্বিতীয় সহস্রাব্দের দ্বিতীয় ভাগ। ২০০০ বছরের কিছু বেশি, কম তো নয়ই। জমিতে শুরু হয়ে জমিতেই পরিবর্তিত হয়েছে এই দীর্ঘকাল ধরে, এই সুবিস্তৃত অঞ্চলে। এই সভ্যতার প্রবাহ মোড় পালটালেও শুকিয়ে যায়নি; তার স্রোত পরিবর্তিতভাবে ভারতবর্ষের পরবর্তী ইতিহাসে মিশেছিল। কীভাবে মিশেছিল পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা দেখব।১২

১০ পরিশেষের মন্তব্য

সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন দিক নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই। সত্যি বলতে, এই বিতর্ক একেবারে ‘রাজনীতি’-শূন্য নয়। এখানে তার দিকে কিছু ইঙ্গিত করা বোধহয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ‘প্রথম বিতর্ক’ সভ্যতার উৎপত্তির কারণ নিয়ে—‘আদি’ থেকে ‘পরিণত’ পর্যায়ে উত্তরণ কিসের প্রভাবে ঘটেছিল। আমরা এখানে আমাদের ব্যাখ্যা দিয়েছি—খাল কেটে সেচ ব্যবস্থার প্রচলন এবং কারিগরিশিল্পের ব্যাপক বিস্তার। এখনও অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক (বিদেশি এবং ভারতীয় দুই-ই) মনে করেন যে, এর পেছনে মেসোপটেমিয়ার প্রভাব কোনও না কোনওভাবে ছিল। সাক্ষ্য নেই কোনও, তবে, সাক্ষ্যের অভাব পণ্ডিতদের মত সৃষ্টিতে কবে বাধা দিয়েছে? ‘রাজনীতি’ এ ক্ষেত্রে দুটো: মিশর, মেসোপটেমিয়া ইত্যাদির চর্চা প্রায় সম্পূর্ণভাবেই পশ্চিমি পণ্ডিতদের হাতে। এ ছাড়া মেসসাপটেমিয়া পর্যন্ত বাইবেলের যোগসূত্র আছে। তার পূর্বদিকে, তার বৃত্তের বাইরে মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয় সভ্যতার কোনও প্রভাব নেই, এরকম স্বাধীন সভ্যতা? দ্বিতীয়ত, ভারতবর্ষে একটি স্বাধীন সভ্যতার উদ্ভব? এই দুটি জিনিস মানাতেই অনেকের গোলমাল আছে। বিভিন্নভাবে এটা প্রকাশিত হয়। যেমন, উৎপত্তিকাল নিয়ে আলোচনায়। সময়কাল অন্তত খ্রি. পূ. ২৭০০ না হওয়ার কোনও কারণই নেই। তবু, বেশিরভাগ রচনাতেই ‘খ্রি. পূ. ২৫০০ অব্দ’— এই তারিখটি পাওয়া যাবে। ২৭০০ হলে এটার উৎপত্তি মেসোপটেমিয়ার সভ্যতার উৎপত্তির প্রায় সমসাময়িক হয়ে যায়; ২৫০০ হলে বলা যায় এটা মেসোপটেমিয়ার সভ্যতার উৎপত্তির পরের এবং সেই কারণে এর ওপর প্রভাবের কথাও অনুমান করা যায়।

আর একটি বিতর্ক আর্য-অনার্য’ ব্যাপারটি নিয়ে। এটা কি ঋক্‌বেদ-পূর্ব বা ঋক্‌বৈদিক? এই বিতর্কে আমরা একেবারেই যাচ্ছি না এখানে। আমাদের একমাত্র বিষয় শুধু প্রত্নতত্ত্বের দৃষ্টিতে ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাস; কোনও সাহিত্যিক উপাদান নিয়ে নয়। তবে আমাদের ইতিহাস বই ইত্যাদিতে ‘সিন্ধু সভ্যতা’র যা স্থান, তাতে এই সভ্যতা একটা অসংলগ্ন ব্যাপার। ঋক্‌বেদ ইত্যাদি এসে গেলেই বৈদিক সাহিত্য, বৌদ্ধ-জৈন সাহিত্য বেয়ে আমরা ইতিহাসের পাকা কোঠায় ঢুকে স্বস্তি বোধ করি। এটা একেবারেই ঠিক না। প্রায় দু-হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষের এত বড় একটা অঞ্চল জুড়ে যে সভ্যতাটার জের চলল তা আমাদের কাছে অসংলগ্ন হতে পারে না। এখানে যে রাজনীতিটা করা হয় তা হচ্ছে এর তারিখকে চেপে অনেক ছোট করে আনা। মোহেঞ্জোদারো ইত্যাদি কেন্দ্রগুলিকে শ-চারেক বছরের ভেতর যদি ঢুকিয়ে দেওয়া যায় তবে ব্যাপারটা ভারতবর্ষের সমস্ত ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে একটা খণ্ড অধ্যায় বলে দেখা যেতে পারে। যে কোনও জাতির ঐতিহ্য, ইতিহাস বিশ্লেষণেই রাজনীতি, ঐতিহাসিকের শ্ৰেণীচেতনা ইত্যাদি কাজ করে। এটা সর্বজনবিদিত সত্য। কাজেই সিন্ধু সভ্যতার ক্ষেত্রেও এটা কাজ করবে তাতে আশ্চর্য হওয়ার নেই। তবে, এই রাজনৈতিক পটভূমি সম্পর্কে সচেতন হওয়া দরকার। সেই কারণেই এখানে এই প্রসঙ্গের অবতারণা করা হল।১৩

.

চতুর্থ অধ্যায়

। ‘সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতা’ নামটির ব্যবহারের জন্য, এস পি গুপ্ত, ‘দ্য ইন্ডাস সরস্বতী সিভিলাইজেশন, ওরিজিনস, প্রবলেমস অ্যান্ড ইস্যুজ’, দিল্লি, ১৯৯৬।

। ভারতে অবস্থিত কেন্দ্রগুলির হিসেব যেখান থেকে নেওয়া হয়েছে তা হল, জে পি জোশি ও অন্যান্য, ‘দ্য ইন্ডাস সিভিলাইজেশন; এ রিকনসিডারেশন অন দ্য বেসিস অভ ডিসট্রিবিউশন ম্যাপস’, বি বি লাল ও এস পি গুপ্ত (স.), ফ্রন্টিয়ারস অভ দ্য ইন্ডাস সিভিলাইজেশন, দিল্লি, ১৯৮৪, পৃ. ৫১১-৩০।

। আমাদের ব্যাখ্যার প্রথম প্রকাশ, দিলীপ কে. চক্রবর্তী, দ্য আর্কিওলজি অভ এনশেন্ট ইন্ডিয়ান সিটিজ, দিল্লি, ১৯৯৫, পৃ. ৪৬-৫২।

। নাম নিয়ে, হাকিম আলি শেখ বুখারি, ‘মোয়েঞ্জোদারো অর মোহেঞ্জোদারো’, দ্য আর্কিওলজিকাল রিভিউ, করাচি, ভল্যুম ৪, ১৯৯৫, পৃ ২৩৮-৫৪। খননকার্যের মূল বিবরণ, জে এইচ মার্শাল (স.), মোহেঞ্জোদারো অ্যান্ড দ্য ইন্ডাস সিভিলাইজেশন, লন্ডন, ৩ খণ্ড; ই ম্যাকাই, ফারদার এক্সকাভেশনস অ্যাট মোহেঞ্জোদারো, দিল্লি, ১৯৩৮, ২ খণ্ড; পরবর্তী পর্যায়ের খননকার্যগুলির বিশদ বিবরণী নেই; এদের সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণার জন্য, ৬ নং টীকার চক্রবর্তী, পৃ. ৬১-৭৬।

। হরপ্পার ওপর মূল খননকার্যের বিবরণী, এম এস ভাটস, এক্সকাভেশনস অ্যাট হরপ্পা, দিল্লি, ১৯৪০, ২ খণ্ড; আর ই এম, হুইলার, ‘হরপ্পা ১৯৪৬ : দ্য ডিফেনসেজ অ্যান্ড সিমেটেরি’ আর ৩৭, এনশেন্ট ইন্ডিয়া. ৩, ১৯৪৭, পৃ. ৫৮-১৩০। বর্তমানে হরপ্পাতে আমেরিকীয় খননকার্যের গত কয়েক বছরের বিবরণ সম্প্রতি গ্রন্থাকারে বেরিয়েছে—জে এম কেনোয়ার, এনশেন্ট সিটিজ অভ দ্য ইন্ডাস সিভিলাইজেশন, করাচি, ১৯৯৮। তবে এই সম্পর্কে ধারণার জন্য, চক্রবর্তী, উপরি উল্লিখিত, পৃ. ৮২-৮।

। বি বি লাল, ‘কালিবাঙ্গান অ্যান্ড দ্য ইন্ডাস সিভিলাইজেশন’, ডি পি অগ্রবাল ও ডি. কে. চক্রবর্তী (স.), এসেজ ইন ইন্ডিয়ান প্রোটেহিসটরি, দিল্লি, ১৯৭৯, পৃ. ৬৫-৯৭।

। আর এস বিশট, ‘স্ট্রাকচারাল রিমেইনস অ্যান্ড টাউন প্ল্যানিং অভ বনোয়ালি’, গুপ্ত এবং লাল (স.), প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৯-৯৮। আর এস বিশট, ‘ফারদার এক্সকাভেশন অ্যাট বনোয়ালি’, বি ডি চট্টোপাধ্যায় এবং বি এম পাণ্ডে (স.), আর্কিওলজি অ্যান্ড হিস্টরি, খণ্ড ১, দিল্লি ১৯৮৭, পৃ. ১৩৫-৫৬।

। এস আর রাও, লোথাল, এ হরপ্পান পোর্ট টাউন, ভলিউম, দিল্লি, ১৯৭১।

। জে পি জোশি, এক্সকাভেশন অ্যাট সুরাকোটাডা অ্যান্ড এক্সপ্লোরেশন ইন কাচ্ছ, দিল্লি, ১৯৯০।

১০। আর এস বিশট, ‘ধোলাবিরা : ‘নিউ হরাইজনস অভ দ্য ইভাস সিভিলাইজেশন’, পুরাতত্ত্ব, বুলেটিন অভ দ্য ইন্ডিয়ান আর্কিওলজিকাল সোসাইটি, ২১ সংখ্যা, ১৯৯১, পৃ. ৭১-৮২।

১১। এম কে ধাবালিকর, কালচারাল ইম্পিরিয়ালিজম, ইন্ডাস সিভিলাইজেশন ইন ওয়েস্টার্ন ইন্ডিয়া, দিল্লি, ১৯৯৫, পৃ. ৭৫-৮৮।

১২। সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের আলোচনা প্রচুর। উদাহরণস্বরূপ অল্প কিছু লেখার কথাই বলা যেতে পারে। যথা, লাল ও গুপ্ত (স.), প্রাগুক্ত। জি এল পশেল (স.), হরপ্পা সিভিলাইজেশন, দিল্লি, ১৯৮২ (দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৯৩)। অগ্রবাল ও চক্রবর্তী (স.), প্রাগুক্ত। এই ধরণের গ্রন্থে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বিভিন্ন জনের লেখা আছে। মৃৎপাত্রের ওপর ধারণার জন্য, মূল খননকার্যের রিপোর্টগুলি ভাল। লিপির ওপর প্রকাশিত রচনা অজস্র, তবে—আই মহাদেবন, দ্য ইস স্ক্রিপট: টেক্সটস কনকরডেনস অ্যান্ড টেবলস, দিল্লি, ১৯৭৭ ধাতুবিদ্যার জন্য— দিলীপ কে চক্রবর্তী ও এন লাহিড়ী, কপার অ্যান্ড ইটস অ্যালয়স ইন এনশেন্ট ইন্ডিয়া, দিল্লি, ১৯৯৬, তৃতীয় অধ্যায়। বহির্বাণিজ্যের ওপর লেখাও অজস্র, তবে, দিলীপ কে চক্রবর্তী, দ্য এক্সটারনাল ট্রেড অভ দ্য ইন্ডাস সিভিলাইজেশন, দিল্লি, ১৯৯০; অন্তর্দেশীয় কাঁচামালের বিস্তৃতি ও উৎসের জন্য, নয়নজ্যোত লাহিড়ী, দ্য আর্কিওলজি অভ ইন্ডিয়ান ট্রেডরুটস, দিল্লি, ১৯৯২, তৃতীয় অধ্যায়। ধর্মের ওপর এবং কলাশিল্পের ওপর এখনও সবচাইতে ভাল আলোচনা পাওয়া যাবে, জে এইচ মার্শাল (স.), প্রাগুক্ত। খননকার্যে পাওয়া কঙ্কালের ‘রেস’ বিচার যেভাবে হয়েছে এবং তার অযৌক্তিকতার জন্য প্রথমদিকের একটি লেখা, ডি কে সেন, ‘এনশেন্ট রেসেজ অভ ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান—এ স্টাডি অভ মেথডস’, এনশেন্ট ইন্ডিয়া ২০-২১, ১৯৬৭, পৃ. ১৭৮-২০৫। কাল নিয়ে সাম্প্রতিক বিচার। চক্রবর্তী ‘সিটিজ’, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১১-১৪। পতন নিয়েও এই পুস্তক, পৃ. ১২৪-৪০।

১৩। এই প্রসঙ্গে আগ্রহী পাঠক, দিলীপ কে. চক্রবর্তী, কলোনিয়াল ইন্ডোলজি: সোসিও পলিটিকস অভ দ্য এনশেন্ট ইন্ডিয়ান পাস্ট, দিল্লি, ১৯৯৭, দেখতে পারেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *