৪. সবকিছু কী দিয়ে তৈরি?

চতুর্থ অধ্যায় – সবকিছু কী দিয়ে তৈরি 

ভিক্টোরীয় সময়ে, শিশুদের জন্য একটি জনপ্রিয় বই ছিল এডওয়ার্ড লিয়ারের ‘বুক অব ননসেন্স’। এছাড়াও পেঁচা এবং বিড়াল নিয়ে লেখা তাঁর কিছু কবিতা [যা হয়তো আপনি জানেন, কারণ সেগুলো এখনো বিখ্যাত], ‘দ্য জাম্বলিস অ্যান্ড দ্য পোবল হু হ্যাস নো টোস’, এই বইটির শেষে দেয়া রেসিপিগুলো আমার খুব পছন্দ। ‘ক্রাম বলিয়াস কাটলেট’ বানানোর রেসিপিটি বর্ণিত হয়েছিল এভাবে, ‘গরুর মাংসের কিছু টুকরো যোগাড় করুন, সম্ভাব্য সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম টুকরোয় তাদের কাটার পর সেই টুকরোগুলোকে আরো ক্ষুদ্রতর করে কাটার জন্য চেষ্টা করতে থাকুন, আট কিংবা নয়বার।’ 

যদি কোনোকিছুকে ক্ষুদ্র থেকে আরো ক্ষুদ্রতর টুকরোয় কাটতে থাকেন, আপনি পরিশেষে কী পেতে পারেন? ধরুন, আপনি যে-কোনো কিছুর একটি টুকরো নিলেন, সবচেয়ে সরু এবং আপনার পক্ষে খুঁজে পাওয়া সম্ভব সবচেয়ে পাতলা এবং ধারালো রেজর ব্লেড ব্যবহার করে এরপর এটিকে অর্ধেক করুন, এরপর আপনি সেটিকে আবার দুই ভাগে ভাগ করে কাটুন, এরপর সেই অর্ধেককে আবার অর্ধেক করুন, এভাবে বার বার কাজটি করা অব্যাহত রাখুন। সেই টুকরোগুলো কি একসময় এতটাই ক্ষুদ্র হবে যে আপনি আর তার চেয়ে বেশি ক্ষুদ্রতম টুকরো করে সেটি কাটতে পারবেন না? রেজার ব্লেডের ধারটি কত সরু? একটি সুইয়ের ধারালো শেষ প্রান্ত কতটা ক্ষুদ্র? কোনোকিছুর সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম অংশ আসলে কী দিয়ে তৈরি? 

গ্রিস, চীন এবং ভারতের প্রাচীন সভ্যতাগুলো স্পষ্টতই একই ধারণায় উপনীত হয়েছিল : সবকিছুই তৈরি হয়েছে চারটি ‘এলিমেন্ট’বা মৌলিক উপাদান দিয়ে : বাতাস, পানি, আগুন এবং মাটি। কিন্ত প্রাচীন একজন গ্রিক দার্শনিক, ডেমোক্রিটাস, সত্যের খানিকটা নিকটে অগ্রসর হতে পেরেছিলেন। ডেমোক্রিটাস ভেবেছিলেন যে যদি আপনি কোনোকিছুকে যথেষ্ট ক্ষুদ্রাকার অংশে কাটতে থাকেন, আপনি একসময় এমন একটি টুকরোয় পৌঁছাবেন, যা এতই ক্ষুদ্র হবে যে আপনি এর চেয়ে বেশি আর সেটিকে কাটতে পারবেন না। কাটার গ্রিক শব্দ হচ্ছে ‘টোমোস’ আর আপনি যদি কোন গ্রিক শব্দের শুরুতে একটি ‘এ’ যুক্ত করেন এর অর্থ হবে, ‘না’ বা আপনি পারবেন না, সুতরাং ‘এ-টমিক’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে, কোনোকিছু এত ক্ষুদ্র যে আপনি এর চেয়ে ক্ষুদ্রতর অংশে এটি কাটতে পারবেন না। আর এখান থেকেই আমাদের পরিচিত ‘অ্যাটম’ শব্দটি এসেছে। সোনার অ্যাটম বা পরমাণু হচ্ছে সোনার সম্ভাব্য সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম অংশ। এমনকি এই পরমাণুটিকে আরো ক্ষুদ্র করে কাটা যদি সম্ভবও হয়, এটি আর ‘সোনা’ থাকবে না। একটি লোহার অ্যাটম হচ্ছে লোহার সম্ভাব্য সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম অংশ এবং ইত্যাদি। 

আমরা এখন জানি যে প্রায় ১০০ ধরনের পৃথক অ্যাটম বা পরমাণু আছে, শুধুমাত্র যার প্রায় ৯০টিকে প্রকৃতিতে পাওয়া যায়। অন্য কয়েকটিকে সৃষ্টি করা হয়েছে পরীক্ষাগারে কৃত্রিমভাবে, কিন্তু শুধুমাত্র খুব সামান্য পরিমাণে। 

বিশুদ্ধ কোনোকিছু যেখানে শুধু এক ধরনের অ্যাটম বা পরমাণু থাকে তাকে বলা হয় ‘এলিমেন্টস’ বা মৌল [এলিমেন্টও সেই একই শব্দ, যা একসময় ব্যবহার করা হত মাটি, বাতাস, আগুন ও পানিকে বোঝানোর জন্য, কিন্তু খুবই ভিন্ন একটি অর্থে]। মৌলের উদাহরণ, যেমন- হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, লোহা, ক্লোরিন, তামা, স্বর্ণ, পারদ এবং নাইট্রোজেন ইত্যাদি। কিছু মৌল, যেমন মলিবডেনাম পৃথিবীতে দুষ্প্রাপ্য [সে-কারণে হয়তো আপনি কখনো মলিবডেনামের নাম শোনেননি], কিন্তু মহাবিশ্বের অন্য জায়গায় এটি সহজপ্রাপ্য [আপনি যদি ভাবেন এটা আমরা কেমন করে জানলাম, তাহলে অধ্যায় ৮ পর্যন্ত অপেক্ষা করুন]। 

ধাতু, যেমন—লোহা, সিসা, তামা, দস্তা, টিন ও পারদ সবই মৌল। যেমন—অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন এবং নিওন গ্যাসগুলো, কিন্তু চারপাশে অধিকাংশ যা-কিছু আমরা দেখি সেগুলো মৌল নয়, বরং কমপাউন্ড বা যৌগ। একটি যৌগ হচ্ছে সেটি, যা আপনি পাবেন যখন দুই বা ততোধিক পরমাণু একসাথে যুক্ত হয় একটি বিশেষ উপায়ে। আপনি হয়তো শুনেছেন, পানিকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয় হাইড্রোজেন ডাই অক্সাইড বা সংকেতে ‘H2O’ হিসেবে। এটি একটি রাসায়নিক সংকেত এবং এর মানে এটি এমন একটি যৌগ, একটি অক্সিজেন পরমাণু দুটি হাইড্রোজেন পরমাণুর সাথে যুক্ত হবার মাধ্যমে এটিকে গঠন করেছে। যখন একগুচ্ছ পরমাণু একসাথে যুক্ত হয়ে একটি যৌগ তৈরি করে তাদের বলা হয় একটি অণু। অন্য অণুগুলো, বিশেষ করে যেগুলো জীবন্ত শরীরে আমরা দেখি, তাদের শত শত পরমাণু আছে, প্রত্যেকটিই একটি বিশেষ সজ্জায় পরস্পরের সাথে যুক্ত। আসলেই তাদের যুক্ত হবার উপায়গুলো এবং পরমাণুদের প্রকৃতি ও সংখ্যা, যা কোনো অণুকে একটি অনন্য যৌগে পরিণত করে। 

এছাড়াও আপনি ‘অণু’ শব্দটিকে ব্যবহার করতে পারেন যখন দুই বা ততোধিক একই ধরনের পরমাণু একসাথে যুক্ত হয়ে যা তৈরি করে সেটি ব্যাখ্যা করার জন্য। কখনো তিনটি অক্সিজেন পরমাণু একই সাথে যুক্ত হয়ে একটি ভিন্ন ধরনের অণু সৃষ্টি করে, যাকে আমরা বলি ‘ওজোন’। কোনো একটি অণুতে পরমাণুর সংখ্যা আসলেই অনেক ভিন্নতার কারণ হয়, এমনকি যখন সেই পরমাণুরা সব একই। 

ওজোন শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য ক্ষতিকর, কিন্তু আমরা উপকৃত হই একটি ওজোন স্তরের কল্যাণে, যেটি পৃথিবীর উচ্চ বায়ুমণ্ডলে থাকে, সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মিগুলো থেকে যে স্তরটি আমাদের রক্ষা করে। কিছু কারণের একটি যার জন্যে অস্ট্রেলিয়াবাসীদের বিশেষভাবে সতর্ক হতে হয়ে যখন তাঁরা সূর্যস্নান করেন, কারণ দক্ষিণে পৃথিবীর ওজোন স্তরে একটি বড় ছিদ্র আছে। 

স্ফটিক, যখন পরমাণুরা সুসজ্জিত প্যারেডে 

হীরার একটি স্ফটিক হচ্ছে বিশাল আকারের অণু, যার কোনো নির্দিষ্ট আকার নেই, বহু মিলিয়ন কার্বন মৌলের পরমাণু একসাথে যুক্ত হয়ে এটি সৃষ্টি করে, প্রত্যেকটি সজ্জিত একটি বিশেষ সুনির্দিষ্ট উপায়ে। স্ফটিকের মধ্যে তারা এত বেশি নিয়মিতভাবে সজ্জিত, আপনি তাদের ভাবতে পারেন কোনো প্যারেড মাঠে সারিবাঁধা সৈন্যদের মতো। শুধুমাত্র এটি প্যারেড করছে একটি ত্রিমাত্রিক জগতে, মাছের কোনো বড় ঝাঁকের মতো। এই ঝাঁকের মধ্যে ‘মাছ’-এর সংখ্যা—এমনকি সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম হীরার স্ফটিকে কার্বন পরমাণুর সংখ্যা সুবিশাল, সারা পৃথিবীর যত মাছ আছে [এবং সব মানুষসহ] তার চেয়েও অনেক বেশি এবং তারা ‘একসাথে যুক্ত’ হয়ে আছে এমন কোনো শব্দ খানিকটা ভ্রান্ত ধারণা দিতে পারে তাদের বিবরণে, যদি এটি আপনাকে এমনকিছু ভাবতে প্ররোচিত করে যে, কার্বণ পরমাণুগুলো এমন ঘনভাবে সাজানো থাকে যে তাদের মধ্যে কোনো শূন্যস্থান থাকে না, যেন কার্বন পরমাণুর একটি দলা। বাস্তবিকভাবেই, যেমন আমরা পরে দেখব, বেশিরভাগ ঘন পদার্থ আসলে মূলত শূন্যস্থান দিয়ে তৈরি। এই বাক্যটির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে হবে। আমি সেটা নিয়ে পরে আলোচনায় ফিরে আসব। 

সব স্ফটিকই নির্মিত হয়েছে একই ‘প্যারেডের সজ্জায় সৈন্যদের’ মতো পরমাণুদের দিয়ে, যেখানে পরমাণুরা নিয়মিত ব্যবধানে সাজানো থাকে একটি সুনির্দিষ্ট সজ্জায় এবং পুরো স্ফটিকটাকে এটি একটি রূপ দেয়। আসলেই কোনো স্ফটিক বলতে আমরা সেটাই বোঝাই। কিছু সৈন্য সেখানে কুচকাওয়াজ করতে পারে একাধিক উপায়ে এবং তারা খুবই ভিন্ন ধরনের স্ফটিক তৈরি করে। কার্বন পরমাণু, তারা যদি একভাবে সজ্জিত হয়, তারা সেই কিংবদন্তির সুকঠিন হীরার স্ফটিক তৈরি করে, কিন্তু তারা যদি কোনো ভিন্ন সজ্জা গ্রহণ করে তারা গ্রাফাইটের স্ফটিক তৈরি করে, এতই নরম যে তারা লুব্রিকান্ট বা পিচ্ছিল করতে পারে এমনকিছু হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। 

আমরা স্ফটিকগুলোকে সাধারণত স্বচ্ছ কিছু বলে ভাবি এবং আমরা পানিকে বলি ‘স্ফটিক স্বচ্ছ’ কিন্তু আসলেই, অধিকাংশ ঘন বস্তু স্ফটিক দিয়ে তৈরি এবং অধিকাংশ ঘন বস্তু আবার স্বচ্ছ নয়। একটুকরো লোহা পূর্ণ খুব ঘনভাবে সাজানো অসংখ্য ক্ষুদ্র স্ফটিক দিয়ে, তারা নির্দিষ্ট দূরত্বে অবস্থান করে, কুচকাওয়াজের সৈন্যদের মতো, ঠিক যেমন করে হীরার স্ফটিকে কার্বন পরমাণুগুলো থাকে। সিসা, অ্যালুমিনিয়াম, লোহা, তামা— সবকিছু তৈরি তাদের ভিন্ন ভিন্ন পরমাণু দিয়ে গড়া স্ফটিকে। তেমনি ঘটে পাথরে, যেমন—গ্রানাইট অথবা বেলে পাথর, কিন্তু তারা প্রায়শই নানা ধরনের বহু ক্ষুদ্র স্ফটিক দ্বারা পূর্ণ যারা আবার খুব আঁটোসাটোভাবে পরস্পরের সাথে সজ্জিত থাকে। 

বালিও স্ফটিকের মতো, আসলেই বহু বালির কণা আসলে পাথরের ক্ষুদ্র কণা, পানি আর বাতাসে ঘর্ষণে যা ক্ষয়ীভূত। কাদার ক্ষেত্রে বিষয়টি একইভাবে সত্য, শুধুমাত্র সেখানে যোগ হয় পানি অথবা অন্য কোনো তরল। প্রায়শই বালির কণা আর কাদার কণা একসাথে খুবই আঁটোসাটো হয়ে তৈরি করে নতুন ধরনের পাথর, ‘সেডিমেনট্রি’ বা পাললিক শিলা, কারণ তারা শক্ত আর কঠিন হয়ে যাওয়া বালি ও কাদার পলি [কোনো সেডিমেন্ট বা পলি হচ্ছে কোনো তরলের নিচে তলানি হিসেবে জমা হওয়া ক্ষুদ্র কণা, যেমন কোনো নদী বা হ্রদের তলদেশে]। কোনো স্যান্ডস্টোনে থাকা বালি মূলত কোয়ার্টজ আর ফেল্ডস্পার দিয়ে তৈরি, পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠে সবচেয়ে বেশি যে দুই ধরনের স্ফটিকের সন্ধান পাওয়া যায়। লাইমস্টোন ভিন্ন, চকের মতো এটাও ক্যালসিয়াম কার্বনেট, এটি তৈরি হয় ঘর্ষণের মাধ্যমে প্রবালের কঙ্কাল আর সামুদ্রিক খোলসের—যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত খুব ক্ষুদ্র এককোষী প্রাণী, যাদের নাম ফোরাম–ক্ষয়ীভূত অংশ থেকে। আপনি যদি খুব সাদা একটি বেলাভূমি দেখেন, বালিটি খুব সম্ভবত ক্যালসিয়াম কার্বনেট, যাদের উৎপত্তি একই সামুদ্রিক খোলস থেকে। 

কখনো স্ফটিকগুলো তৈরি হয় সম্পূর্ণভাবে একই ধরনের পরমাণুদের সজ্জার মাধ্যমে—পুরোটাই একটাই এলিমেন্ট বা মৌল। হীরা, স্বর্ণ, তামা, লোহা হচ্ছে এর উদাহরণ, কিন্তু অন্য স্ফটিকও আছে যাদের তৈরি করেছে দুটি ভিন্ন ধরনের পরমাণু, আবারো সুনির্দিষ্ট সজ্জায়—একান্তরভাবে সজ্জিত। যেমন—লবণ [সাধারণ লবণ, টেবিল সল্ট] কোনো একক মৌল না বরং দুটি মৌলের একটি যৌগ, সোডিয়াম এবং ক্লোরিন। লবণের স্ফটিকে নির্দিষ্ট সজ্জায় সোডিয়াম এবং ক্লোরিন পরমাণুগুলো একান্তরভাবে সাজানো থাকে। আসলেই এই ক্ষেত্রে তাদের পরমাণু না বলে বলা হয় ‘আয়ন’, কিন্তু আমি বিস্তারিত বিবরণে যাব কেন তাদের এটা বলা হয়। প্রতিটি সোডিয়াম আয়নের কাছে থাকে ছয়টি ক্লোরিন আয়ন, পরস্পরের সাথে সমকোণে : সামনে, পেছনে, ডানে, বামে, উপরে ও নিচে এবং প্রতিটি ক্লোরিন আয়নকে ঘিরে থাকে সোডিয়াম আয়ন, একইভাবে। পুরো সজ্জাটি গড়ে উঠে সোডিয়াম আর ক্লোরিন আয়ন দিয়ে তৈরি বর্গক্ষেত্রগুলো দিয়ে, আর সে-কারণে লবণের স্ফটিককে যদি আপনি সতর্কভাবে শক্তিশালী লেন্স দিয়ে দেখেন সেগুলো কিউবিক বা ঘন আকৃতির—এক বর্গক্ষেত্রের ত্রিমাত্রিক রূপ–অথবা অন্ততপক্ষে এর ধারগুলো সব বর্গাকৃতির। বহু স্ফটিক আছে যার একাধিক ভিন্ন পরমাণু সজ্জায় সৃষ্ট হতে পারে এবং সে-রকম অনেকগুলোই আমরা দেখতে পাই পাথরে, বালিতে আর মাটিতে। 

ঘন, তরল, গ্যাস–কিভাবে অণুরা নাড়াচাড়া করে 

স্ফটিক ঘন, তবে সবকিছুই ঘন নয়, যেমন—তরল কিংবা গ্যাস। কোনো গ্যাসে অণুরা পরস্পরের সাথে সংযুক্ত থাকে না, যেমন করে তারা স্ফটিকে থাকে, তারা স্বাধীনভাবেই যে পরিমাণ জায়গা আছে সেখানে ছুটে বেড়াতে পারে, বিলিয়ার্ড বলের মতো সরলরেখায় [কিন্তু ত্রিমাত্রিক কোনো ক্ষেত্রে, কোনো সমতল টেবিলের উপর থাকা দুটি বলের মতো নয়]। তারা ছুটে বেড়ায় যতক্ষণ-না কোনোকিছুর সাথে আঘাতপ্রাপ্ত হয়, সেক্ষেত্রে তারা আবার বিলিয়ার্ড বলের মতোই ধাক্কা খেয়ে ভিন্ন দিকে চলে যায়। গ্যাসকে খুব চাপ দিয়ে সংকুচিত করে রাখা যেতে পারে, যা প্রদর্শন করে পরমাণু আর অণুদের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে শূন্যস্থান আছে। যখন আপনি কোনো গ্যাসের ওপর চাপ প্রয়োগ করবেন, স্প্রিং-এর মতো একটি অনুভূতির অভিজ্ঞতা হবে। বাইসাইকেল পাম্প দেয়ার মেশিনের এক প্রান্তে হাত দিন, স্পিং-এর মতো অনুভূতিটি বোঝার চেষ্টা করুন যখন আপনি প্লানজারটি বা হাতলের উপর চাপ দেবেন। যদি আপনি সেখানে আপনার হাত রাখেন এবং প্লানজারটি ছেড়ে দেলে এটিও ধাক্কা দিয়ে বাইরে বের হয়ে আসে। এই যে স্প্রিং-এর মতো অনুভূতি যা আপনি অনুভব করছেন সেটি হচ্ছে প্রেসার বা চাপ। পাম্পের মধ্যে বাতাসের [নাইট্রোজেন, অক্সিজেন আর বেশকিছু গ্যাসের মিশ্রণ] বহু মিলিয়ন অণুর ক্রমাগত অবিরাম বোমাবর্ষণের প্রভাব, যা প্লানজারটির উপর চাপ ফেলে [সবকিছুর উপরেই ফেলে, কিন্তু প্লানজারটি একমাত্র পারে এর প্রত্যুত্তরে নড়তে]। উচ্চ চাপে অণুদের এই বোমাবর্ষণ ঘটে অনেক দ্রুত হারে। এটি ঘটে যদি আরো ছোট আয়তনে গ্যাসের একই সংখ্যক অণু থাকে [যেমন—যখন আপনি বাইসাইকেল পাম্পের হাতলটায় চাপ দেবেন], অথবা এটা হতে পারে যদি আপনি তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেন, যখন গ্যাস অণুগুলোকে আরো দ্রুত ছোটাছুটি করতে শুরু করে। 

কোনো তরল হচ্ছে গ্যাসের মতোই যেখানে এর অণুগুলো এদিকে সেদিকে ঘুরে বেড়ায় অথবা ফ্লো বা প্রবাহিত হয় [সে কারণে উভয়কে বলে ফ্লুইড, আর ঘন কঠিন কোনো পদার্থকে সেটা বলা হয় না], কিন্তু কোনো তরলে অণুগুলো গ্যাসের অণুগুলোর চেয়ে অপেক্ষাকৃত কাছাকাছি থাকে। গ্যাসের আয়তন খুব দ্রুত সম্প্রসারিত হয়ে পুরো ট্যাঙ্ক পূর্ণ করে। কোনো তরলও ট্যাঙ্কের সব কোণ আর ঘুপচি পূর্ণ করে, কিন্তু একটি নির্দিষ্ট স্তর অবধি। কোনো একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ তরল, একই পরিমাণ গ্যাসের ব্যতিক্রম, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ আয়তন ধারণ করে এবং মাধ্যাকর্ষণ এটিকে নিচের দিকে টেনে ধরে, সুতরাং এটি ট্যাঙ্কের আয়তনের জন্য যতটুকু দরকার ঠিক ততটুকু পূর্ণ করে, নিচ থেকে উপরে। এর কারণ হচ্ছে তরলে অনুগুলো পরস্পরের কাছাকাছি অবস্থান করে, কিন্তু, কঠিন কোনো পদার্থে ব্যতিক্রম, তারা পরস্পরের উপর দিয়ে পিছলে চলে যেতে পারে, সে-কারণেই তরল পদার্থ তরলের মতোই আচরণ করে। 

কঠিন পদার্থ কোনো চেষ্টাই করবে না ট্যাঙ্ক বা পাত্র পূর্ণ করার—এটি এর মূল আকারটি ধরে রাখবে, এর কারণ কঠিন পদার্থে অনুগুলো একটার উপর একটি পিছলে যেতে পারে না যেমনটি তরল পদার্থের অণুরা করতে পারে, বরং তারা [মোটামুটিভাবে] তাদের প্রতিবেশী অণুদের সাপেক্ষে একই অবস্থান ধরে রাখে। মোটামুটিভাবে, কারণ কঠিন পদার্থে ও অণুগুলো এক ধরনের নাড়াচাড়া করতে পারে [তাপমাত্রা বেশি হলে আরো দ্রুততার সাথে] শুধুমাত্র স্ফটিক ‘কুচকাওয়াজে’ এটি অবস্থান পরিবর্তন করে এর আকৃতিকে প্রভাবিত করার মতো যথেষ্ট পরিমাণ দূরে সরে যেতে পারে না। 

মাঝে মাঝে কোনো তরল পদার্থ আঠালো হতে পারে এর সান্দ্রতার জন্য, আঠালো গুড়ের মতো। আঠালো তরল প্রবাহিত হতে পারে, তবে খুবই ধীরে, যদিও কোনো খুব আঠালো তরল ট্যাঙ্কের নিচের অংশ পূর্ণ করে, অনেক সময় লাগে সেটি করার জন্য। কিছু তরলের সান্দ্রতা খুবই বেশি—খুব ধীরে এটি প্রবাহিত হয়—তাদের মনে হতে পারে কঠিন কোনো পদার্থ, যদিও তারা স্ফটিক দিয়ে তৈরি নয়। 

পদার্থের তিনটি সাধারণ অবস্থাকে চিহ্নিত করতে, কঠিন, তরল বা গ্যাস, এই নামগুলো আমরা দেই। পৃথিবীতে, মিথেন হচ্ছে গ্যাস [প্রায়ই যাকে বলা হয় মার্শ গ্যাস, কারণ মার্শ বা জলাভূমি থেকে গ্যাসটি বুদ্বুদ হয়ে বের হয়, কখনো সেই গ্যাসে আগুন ধরে গেলে আমরা ভুতুড়ে আলেয়া দেখতে পাই], কিন্তু শনি গ্রহের একটি বড়, খুব শীতল উপগ্রহ টাইটানে, আমরা তরল মিথেনের হ্রদ খুঁজে পেয়েছি। যদি কোনো গ্ৰহ আরো শীতল হয় তাহলে ঠাণ্ডায় জমাট বাঁধা মিথেনের পাথর আমরা পাব। আমরা পারদকে তরল হিসেবে ভাবি, কিন্তু তার মানে শুধু পৃথিবীর সাধারণ তাপমাত্রায় এটি তরল অবস্থায় থাকে। পারদ কঠিন ধাতুর মতো হবে যদি মেরু অঞ্চলের শীতের সময় এটি বাইরে থাকে। লোহা তরল, যদি আপনি যথেষ্ট পরিমাণ তাপমাত্রায় এটিকে উত্তপ্ত করতে পারেন। আসলেই, পৃথিবীর গভীর অভ্যন্তরে তরল লোহার একটি সমুদ্র আছে, যেখানে লোহার সাথে মিশে আছে তরল নিকেল। সম্ভবত খুবই উত্তপ্ত অনেক গ্ৰহ আছে যেখানে তরল লোহার সাগর আছে পৃষ্ঠদেশে এবং হয়তো অদ্ভুত কোনো প্রাণী সেখানে সাঁতার কাটছে, যদিও আমার সন্দেহ আছে সে বিষয়ে। আমাদের মানদণ্ডে লোহার ঘনীভবন বিন্দু বরং বেশ উষ্ণ, সুতরাং পৃথিবীপৃষ্ঠে আমরা এটিকে ‘লোহা—শীতল লোহা’ হিসেবে পাই [গুগল করে দেখতে পারেন, শব্দটি এসেছে কবি রুডইয়ার্ড কিপলিং থেকে] এবং পারদের ঘনীভবন বিন্দু বেশ শীতল নিম্ন তাপমাত্রায়, সুতরাং আমরা সাধারণত এটি তরল বা ‘কুইক সিলভার’ হিসেবে পাই। তাপমাত্রার স্কেলে অন্য প্রান্তে, পারদ আর লোহা দুটোই গ্যাস হতে পারে যদি আপনি তাদের যথেষ্ট পরিমাণ উত্তপ্ত করতে পারেন। 

পরমাণুর ভিতরে 

আমরা যখন কোনো পদার্থকে এর সম্ভাব্য সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম অংশে কাটার কল্পনা করেছিলাম এই অধ্যায়ের শুরুতে, আমরা পরমাণুতে এসে থেমে গিয়েছিলাম। কোনো সিসার পরমাণু হচ্ছে সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম পদার্থ যা সিসা হিসেবে চিহ্নিত হবার অধিকার রাখে, কিন্তু আমরা কি পরমাণুকে আরো ক্ষুদ্রতর অংশে কাটতে পারি? আর সিসার কোনো পরমাণু কি সিসার ক্ষুদ্রতম কোনো টুকরোর মতো দেখতে হবে? না, এটি সিসার কোনো টুকরোর মতো দেখতে হবে না। এটি কোনোকিছুর মতো দেখতে হবে না। তার কারণ হচ্ছে দেখার জন্যে পরমাণু অনেক ক্ষুদ্র, এমনকি শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্র দ্বারাও সম্ভব নয়। আর হ্যাঁ, আপনি একটি পরমাণুকেও বিভাজিত করতে পারবেন আরো ক্ষুদ্রতর অংশে, কিন্তু এরপরে আপনি যা পাবেন সেটি আর সেই একই মৌল থাকবে না, আর কারণগুলো আমরা কিছুক্ষণ পরেই জানতে পারব। এছাড়া কাজটি করা বেশ কঠিন এবং এটি প্রচুর পরিমাণে শক্তি অবমুক্ত করে। সে-কারণে, কিছু মানুষের কাছে, ‘পরমাণুকে বিভাজিত করা’ বাক্যটি ভীতিকর। ১৯১৯ সালে এই কাজটি প্রথম করেছিলেন নিউজিল্যান্ডের বিজ্ঞানী আর্নস্ট রাদারফোর্ড। 

যদিও আমরা একটি পরমাণু দেখতে পারি না এবং যদিও আমরা এটিকে অন্য কিছুতে রূপান্তর না করে বিভাজিত করতে পারি না, তার মানে এই নয় যে এর ভিতরে কী আছে সেটি আমরা আবিষ্কার করতে পারব না। প্রথম অধ্যায়ে আমি ব্যাখ্যা করেছিলাম, যখন বিজ্ঞানীরা কোনোকিছু সরাসরি দেখতে পারেন না, এটি কেমন হতে পারে তাঁরা সেটির একটি ‘মডেল’ প্রস্তাব করেন। তারপর তাঁরা সেই মডেলটি টেস্ট করেন। একটি বৈজ্ঞানিক মডেল হচ্ছে পরিস্থিতি কেমন হতে পারে সেটি ভাবার একটি উপায়। সুতরাং কোনো একটি পরমাণুর মডেল হচ্ছে পরমাণুর ভিতরটা কেমন দেখতে হতে পারে তার একটি মানসিক চিত্র। বৈজ্ঞানিক কোনো মডেলকে মনে হতে পারে একটি কল্পনা মাত্র, কিন্তু এটি শুধুমাত্র কল্পনা নয়, বিজ্ঞানীরা কোনো মডেল প্রস্তাব করেই বসে থাকেন না। এরপর তাঁরা সেটি পরীক্ষা করে দেখার চেষ্টা করেন। তাঁরা বলেন- যদি এই মডেল, যা আমি কল্পনা করছি তা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে আমরা এই বিষয়গুলো বাস্তব পৃথিবীতে দেখতে পাব। তাঁরা প্রাকধারণা করেন, আপনি কী খুঁজে পেতে পারেন যদি আপনি নির্দিষ্ট কোনো পরীক্ষা করেন এবং কিছু নির্দিষ্ট পরিমাপ করেন। একটি সফল মডেল হচ্ছে সেটি, যার সম্বন্ধে করা ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক প্রমাণিত হয়, বিশেষ করে যদি তারা ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় টিকতে পারে। আর যদি ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক প্রমাণিত হয়, আমরা আশা করি যে এর মানে মডেল সম্ভবত সত্যের অথবা নিদেনপক্ষে সত্যের একটি অংশের প্রতিনিধিত্ব করছে। 

কখনো কখনো ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক হয় না এবং বিজ্ঞানীরা আবার আগের অবস্থানে ফিরে যান এবং তাঁদের মডেলে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করেন অথবা নতুন কোনো মডেল কল্পনা করেন, তারপর আবার সেটি পরীক্ষা করে দেখেন। মডেল প্রস্তাব ও সেটি পরীক্ষা করে দেখার এই পদ্ধতিটিকে আমরা বলি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বা সায়েন্টিফিক মেথড। কোনোকিছুর প্রকৃত অবস্থা কী সেটি আবিষ্কারের করার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিটি যে-কোনোভাবেই সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা ধারণ করে। আর এই পদ্ধতিটি আসলেই সবচেয়ে সুন্দর আর কল্পনাপ্রবণ পুরাণ অপেক্ষা অনেক উত্তম, এগুলো ব্যাখ্যা করার জন্যে যা আবিষ্কার করা হয়েছিল—যা মানুষ সেই সময় জানত না এবং প্রায়শই, সেইসময়, বুঝতেও পারত না। 

পরমাণুর একটি আদি মডেল হচ্ছে তথাকথিত ‘কারেন্ট বান’ মডেল, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে যা প্রস্তাব করেছিলেন বিখ্যাত পদার্থবিদ জে. জে. থমসন। আমি এটিকে ব্যাখ্যা করব না কারণ এটিকে প্ৰতিস্থাপিত করেছে আরো সফল রাদারফোর্ড মডেল, যা প্রথম প্রস্তাব করেছিলেন সেই একই আর্নস্ট রাদারফোর্ড, যিনি পরমাণুকে বিভাজন করেছিলেন। থমসনের ছাত্র হিসেবে তিনি নিউজিল্যান্ড থেকে ইংল্যান্ডে এসেছিলেন, পরে ক্যামব্রিজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে থমসনের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। রাদারফোর্ড মডেলটিকে আরো পরিমার্জিত করেছিলেন তাঁরই ছাত্র ডেনিস পদার্থবিদ নিল বোর, মডেলটি প্রস্তাব করেছিল পরমাণুর গঠন খুব ক্ষুদ্রাকৃতির সৌরজগতের মতো। পরমাণুর ঠিক কেন্দ্রে আছে নিউক্লিয়াস, এটি পরমাণু কাঠামোর একটি বড় অংশ গঠন করে এবং ক্ষুদ্র কণা ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের চারপাশে কক্ষপথে খুবই দ্রুত ঘুরছে [‘অরবিট’ বা কক্ষপথের ধারণাটি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে যদি আপনি ইলেকট্রনকে সূর্যের চারপাশে কক্ষপথে আবর্তিত গ্রহদের মতো ভাবেন, কারণ ইলেকট্রন নির্দিষ্ট কোনো একটি জায়গায় অবস্থান করা ছোট গোলাকার বস্তু নয়]। 

রাদারফোর্ড/বোর মডেলের একটি বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, যা সম্ভবত একটি সত্যের প্রতিফলন, প্রতিটি নিউক্লিয়াসের সাথে এর নিকটবর্তী আরেকটি নিউক্লিয়াসের দূরত্ব অনেক বিশাল, যদি আমরা নিউক্লিয়াসের আকারের সাথে সেটি তুলনা করে দেখি, এমনকি হীরার মতো কঠিন কোনো পদার্থের টুকরোতেও নিউক্লিয়াসগুলোর মধ্যে সুবিশাল শূন্যস্থানের অস্তিত্ব আছে। প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি বিষয়টি নিয়ে আমি পরে আবার আলোচনায় ফিরে আসব। 

মনে করে দেখুন, আমি বলেছিলাম, হীরার স্ফটিক হচ্ছে একটি দানবীয় অণু, যা তৈরি করেছে কার্বন পরমাণু, কুচকাওয়াজে সাজানো সৈন্যদের মতো একটি সুনির্দিষ্ট সজ্জায় সজ্জিত হয়ে, কিন্তু সেই সজ্জা ত্রিমাত্রিক জগতে। বেশ, এখন হীরা স্ফটিকের আমাদের এই মডেলটিকে আরো উন্নত করতে পারি এটিকে একটা মাত্রা দিয়ে। তার মানে, পরস্পরের সাথে এর আপেক্ষিক দূরত্ব আর আকারের একটি ধারণা দিয়ে। মনে করুন স্ফটিকের মধ্যে থাকা প্রতিটি কার্বন পরমাণুর আবর্তনরত ইলেকট্রনসহ নিউক্লিয়াসকে কুচকাওয়াজের সজ্জায় সৈন্য নয় বরং একটি ‘ফুটবল’ দিয়ে প্রতিনিধিত্ব করছি। এই আকারের মাত্রায়, হীরার মধ্যে প্রতিবেশী ফুটবলগুলো পরস্পর থেকে ১৫ কিলোমিটারেরও বেশি দূরত্বে অবস্থান করবে। 

‘ফুটবলগুলোর’ মধ্যে ১৫ কিলোমিটার এই দূরত্বের মধ্যেই থাকবে ইলেকট্রনগুলো যা নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘুরছে, কিন্তু প্রতিটি ইলেকট্রন, আমাদের সেই ‘ফুটবলের’ মাত্রায় ছোট একটি মাছির চেয়েও অনেক ক্ষুদ্র হবে, এইসব ক্ষুদ্রাকৃতির মাছিগুলো নিজেরাই যে ফুটবলের চারপাশে ঘুরছে তার থেকে বেশ কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে। সুতরাং আপনি দেখতে পারছেন—বিস্ময়করভাবেই—এমনকি কিংবদন্তিসম কঠিন হীরাও প্রায় পুরোপুরিভাবে একটি শূন্যস্থান বা খালি জায়গা! 

একইভাবে এটি সত্য সব পাথরের ক্ষেত্রেও, সেই পাথর যতই শক্ত আর কঠিন হোক-না কেন। এটি লোহা আর সিসার ক্ষেত্রেও সত্য। এটি সত্য সবচেয়ে কঠিনতম কাঠের ক্ষেত্রেও এবং এটি সত্য আমার ও আপনার ক্ষেত্রেও। আমি বলেছি যে কঠিন পদার্থ ‘আঁটোসাটোভাবে’ সজ্জিত পরমাণু দিয়ে তৈরি, কিন্তু ‘আঁটোসাটোভাবে’ সজ্জিত থাকার মানে এখানে খানিকটা অদ্ভুত, কারণ পরমাণুরা নিজেই মূলত শূন্যস্থান। পরমাণুদের নিউক্লিয়াসগুলো পরস্পর থেকে এত দূরে সজ্জিত থাকে যে তাদের যদি ফুটবলের মাত্রায় ভাবা হয়, যে-কোনো জোড়া নিউক্লিয়াসের মধ্যবর্তী দূরত্ব হবে ১৫ কিলোমিটার, মাঝখানে অল্প কিছু ছোট মাছিসহ [যারা ইলেকট্রন]। 

কিভাবে এটি হতে পারে? যদি কোনো পাথর প্রায় পুরোটাই শূন্যস্থান হয়, যেখানে আসল পদার্থগুলো সজ্জিত ‘ফুটবলের’ মতো, পরস্পর থেকে যারা বহু কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত, তাহলে কিভাবে তারা এত কঠিন আর ঘন হতে পারে? কেন এটি তাসের ঘরের মতো ধসে পড়ে না আপনি এর উপরে যখন বসেন? কেন আমরা এদের ভিতর দিয়ে দেখতে পারি না? যদি কোনো দেয়াল আর আমি মূলত শূন্যস্থান হই, কেন তাহলে আমি দেয়ালের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে পারি না? কেন পাথর আর দেয়ালকে এত শক্ত অনুভব হয়, কেন আমরা আমাদের শূন্যস্থানের সাথে তাদের শূন্যস্থানকে একীভূত করতে পারি না? আসলেই একটি বেশ কৌতুককর গল্প আছে যুক্তরাষ্ট্রের একজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাকে নিয়ে, জেনারেল স্টাবলবাইন ঠিক সেই কাজটাই করার চেষ্টা করেছিলেন। গল্পটি এ রকম, আমি এটি আমার আগের একটি বইতেও উল্লেখ করেছিলাম। 

[এটি একটি সত্য ঘটনা]… ১৯৮৩ সালের গ্রীষ্মকাল। মেজর জেনারেল আলবার্ট স্টাবলবাইন [তৃতীয়] আর্লিংটন, ভার্জিনিয়ায় তাঁর অফিসের ডেস্কের পেছনে বসে দেয়ালের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন, যার উপর সাজানো আছে তাঁর অসংখ্য সামরিক পুরস্কারের স্মারক। সেগুলো একটি দীর্ঘ আর মর্যাদাপূর্ণ পেশাগত জীবনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা শাখার প্রধান, যার অধীনে কাজ করছে প্রায় ষোলো হাজার সৈন্য। তিনি তাঁর পুরস্কারগুলো ছাড়িয়ে দেয়ালের উপর দৃষ্টি রাখেন। তিনি একটি কাজ করার তাড়না অনুভব করছিলেন, যদিও সেটি করার ভাবনা তাঁকে শঙ্কিত করেছিল। তিনি ভাবছিলেন তাঁকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তিনি এই অফিসে বসে থাকতে পারেন অথবা পার্শ্ববর্তী অফিসে যেতে পারেন। সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত তাঁকেই নিতে হবে এবং অবশেষে তিনি তাঁর সেই সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন। তিনি পাশের অফিসটিতে যাবেন। তিনি উঠে দাঁড়ালেন, হেঁটে ডেস্কের পেছন থেকে বের হয়ে আসলেন এবং হাঁটতে শুরু করলেন। তিনি ভাবছিলেন, পরমাণু মূলত কী দিয়ে তৈরি? শূন্যস্থান! তিনি খুব দ্রুত হাঁটতে শুরু করেন। আমি মূলত কী দিয়ে তৈরি, তিনি ভাবলেন, পরমাণু! আমাকে শুধু এই শূন্যস্থান দুটি একীভূত করতে হবে… তারপর তাঁর অফিসের দেয়ালের সাথে সজোরে জেনারেলের নাকটি ধাক্কা খায়। নিকুচি করি, জেনারেল ভাবলেন। দেয়ালের মধ্যে দিয়ে হাঁটার এই প্রচেষ্টার অবিরাম ব্যর্থতার কারণে জেনারেল স্টাবলবাইন সংশয়গ্রস্ত হয়ে পড়েন। 

জেনারেল স্টাবলবাইনের জন্য দুঃখ অনুভব করতেই হবে। তিনি জানতেন যে দেয়াল, তাঁর নিজের শরীরের মতোই পরমাণু দিয়ে তৈরি এবং সেই পরমাণুগুলো পরস্পর থেকে এত দূরে ছড়িয়ে আছে যে তারা সেই পনেরো কিলোমিটার দূরে ছড়িয়ে থাকা ‘ফুটবলের’ মতো। নিশ্চয়ই যদি দেয়াল আর তাঁর নিজের শরীর দুটোই মূলত শূন্যস্থান দিয়ে গঠিত হয়ে থাকে, দেয়ালের মধ্যে দিয়ে তাঁর হাঁটতে পারা উচিত, দেয়ালের পরমাণুগুলোর ফাঁকা জায়গাগুলোর মধ্যে তাঁর নিজের পরমাণুগুলো প্রবেশ করানোর মাধ্যমে? কেন তিনি সেটি করতে পারলেন না? কেন পাথর আর দেয়ালগুলোকে কঠিন মনে হয়, কেন আমরা পারি না তাদের শূন্যস্থানগুলো একীভূত করতে? 

আমাদের অনুধাবন করতে হবে যে কঠিন পদার্থ হিসেবে আমরা যা অনুভব করি ও দেখি সেগুলো নিউক্লিয়াস আর ইলেকট্রন—সেই ফুটবল আর ছোট মাছি–ছাড়াও আরো বেশি কিছু। বিজ্ঞানীরা ‘ফোর্স’ [বল], কিংবা, ‘বন্ড’ [সংযুক্তি] আর ‘ফিল্ড’ [ক্ষেত্র] নিয়ে কথা বলেছেন, যেগুলো তাদের ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে একই সাথে ফুটবলগুলোকে যেমন পরস্পর থেকে দূরে রাখে, তেমনই প্রতিটি ফুটবলের উপাদানগুলোকে একসাথে ধরে রাখে। আর এইসব শক্তি [বল] আর ক্ষেত্রগুলোই কোনোকিছু যে কঠিন সেই অনুভূতিটি আমাদের দেয়। 

যখন আপনি পরমাণুর আর নিউক্লিয়াসের মতো সত্যিকারের ক্ষুদ্রতর স্তরে নেমে আসেন, ‘পদার্থ’ আর ‘শূন্যস্থানের’ মধ্যে পার্থক্য এর অর্থ হারাতে শুরু করে। আসলেই এমনকিছু বলা ঠিক নয় যে নিউক্লিয়াস ফুটবলের মতো কোনো ‘পদার্থ’ এবং পরবর্তী নিউক্লিয়াস অবধি শূন্যস্থান থাকে। 

আমরা কঠিন পদার্থকে সংজ্ঞায়িত করি এমনকিছু ‘যার মধ্য দিয়ে আপনি হাঁটতে পারবেন না’। আপনি কোনো দেয়ালের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে পারবেন না কারণ এই রহস্যময় শক্তিগুলো যার কোনো একটি নিউক্লিয়াসগুলোকে সংযুক্ত করে রাখে এর প্রতিবেশীদের সাথে কোনো একটি নির্দিষ্ট অবস্থানে। কঠিন বস্তু বলতে আমরা এটাই বুঝি। 

তরল মানেও খানিকটা একই জিনিসকে বোঝায়, শুধুমাত্র সেই রহস্যময় ক্ষেত্র আর শক্তিগুলো পরমাণুগুলো ধরে রাখে অপেক্ষাকৃত শিথিলভাবে। সুতরাং তারা একটি উপর আরেকটি পিছলে গড়িয়ে যেতে পারে, তার মানে আপনি পানির মধ্যে দিয়ে হাঁটতে পারেন, যদিও ততটা দ্রুত নয় যতটা দ্রুত আপনি বাতাসে হাঁটতে পারেন। বাতাস, গ্যাস হবার [গ্যাসের মিশ্রণ আসলে] কারণে, এর মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়া খুব সহজ, কারণ পরস্পরের সাথে শক্তভাবে যুক্ত হয়ে থাকার বদলে এখানে পরমাণুরা স্বাধীনভাবে এদিক-সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছে, কিন্তু গ্যাসের মধ্যে দিয়ে হাঁটা বেশ কঠিন হবে যদি বেশিরভাগ পরমাণু একটি দিকে ছুটতে থাকে, আর আপনি যেদিকে হাঁটার চেষ্টা করছেন এটি তার বিপরীত দিকে। এটাই ঘটে আপনি যখন বাতাসের বিপরীতে হাঁটার চেষ্টা করেন [‘বাতাস’ বলতে এটাকেই বোঝায়]। খুব শক্তিশালী ঝড়োবাতাসের বিরুদ্ধে হাঁটা বেশ কঠিন হতে পারে, কিন্তু হারিকেন মাত্রার কোনো ঝড়ের বিপরীতে হাঁটা অথবা জেট ইঞ্জিনের পেছন থেকে বের হওয়া কৃত্রিম ঝড়োবাতাসের বিপরীতে হাঁটা অসম্ভব। 

আমরা কঠিন কোনো পদার্থের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে পারি না, কিন্তু কিছু খুব ছোট কণা, যেমন—একটি হচ্ছে, ফোটন, সেটি পারে। আলোকরশ্মি হচ্ছে ফোটনের প্রবাহ, তারা কিছু কঠিন পদার্থের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করতে পারে, সেই ধরনের পদার্থকে বলা হয় ‘স্বচ্ছ’। কাচ অথবা পানি, কিছু নির্দিষ্ট রত্নপাথরের সেই ‘ফুটবলগুলো’ এমনভাবে সজ্জিত থাকে যে, ফোটন কণাগুলো অনায়াসে তাদের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করতে পারে। যদিও তাদের গতি খানিকটা মন্থর হয়, ঠিক যেমন করে আপনিও ধীরে চলেন যখন আপনি পানির মধ্যে দিয়ে হাঁটতে চেষ্টা করেন। 

কোয়ার্টজ স্ফটিকের মতো কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, পাথর স্বচ্ছ নয় এবং ফোটনরা তাদের মধ্য দিয়ে যেতে পারে না। বরং, পাথরের রঙ অনুযায়ী তারা পাথর দ্বারা শোষিত হয় অথবা এর পৃষ্ঠদেশ থেকে প্রতিফলিত হয় এবং প্রায় সব কঠিন পদার্থের ক্ষেত্রে বিষয়টি সত্য। অল্প কিছু কঠিন পদার্থ ফোটন কণাদের প্রতিফলিত করে খুব বিশেষ ধরনের সরলরেখা অনুযায়ী এবং তাদের আমরা বলি আয়না, কিন্তু বেশিরভাগ কঠিন বস্তু বেশকিছু পরিমাণ ফোটন কণা শোষণ করে নেয় [তারা স্বচ্ছ নয়] এবং তারা যা প্রতিফলিত করে সেটিও ছড়িয়ে দেয় [তারা আয়নার মতো আচরণ করে না] : আমরা তাদের দেখি শুধুমাত্র অস্বচ্ছ হিসেবে এবং আমরা তাদের আরো দেখি রঙিন হিসেবে, সেটি নির্ভর করে, কোন ধরনের ফোটন কণা তারা শোষণ করে আর কোন ধরনের ফোটন তারা প্রতিফলিত করে। রঙের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে আবার আমরা আলোচনায় আসব অধ্যায় সাতে, ‘রংধনু কী?’ সেই বিষয়ে আলোচনায়। ইতোমধ্যে, আমাদের দৃষ্টিকে খানিকটা সংকোচন করা প্রয়োজন খুবই ক্ষুদ্র জিনিস দেখার জন্য, যেন আমরা সরাসরি নিউক্লিয়াসের—সেই রূপক ফুটবলের- ভিতরে দেখতে পারি। 

সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম জিনিস 

নিউক্লিয়াস কিন্তু আসলে ফুটবলের মতো নয়। এটি একটি স্থূল মডেল হিসেবে আমরা কল্পনা করেছিলাম মাত্র। এটি অবশ্যই ফুটবলের মতো গোলাকারও নয়। এমনকি এটিও স্পষ্ট নয় যে এর বিবরণ দেয়ার সময় এর আকার আছে এমনকিছু আমাদের বলা উচিত হবে কি না। 

হয়তো ‘আকার’ শব্দটিও ‘ঘন’ শব্দটির মতোই তাদের অর্থ হারিয়ে ফেলে এই ক্ষুদ্রতম জগতে। আমরা খুবই ক্ষুদ্র জিনিস নিয়ে কথা বলছি, এই বাক্যের শেষের বিন্দুতেই ছাপার কালির প্রায় এক মিলিয়ন মিলিয়ন পরমাণু আছে। 

প্রতিটি নিউক্লিয়াস আরো ক্ষুদ্রতর কণা ধারণ করে যাদের বলে প্রোটন ও নিউট্রন। তাদের আপনি গোলাকার বলের মতো ভাবতে পারেন। যদি আপনি চান, কিন্তু নিউক্লিয়াসের মতো তারা আসলে বল নয়। প্রোটন আর নিউট্রন মোটামুটি একই আকারের এবং আসলেই তারা খুবই ক্ষুদ্র, কিন্তু তারপরও তারা ইলেকট্রনের চেয়ে ১০০০ গুণ বড় [সেই উদাহরণের ছোট মাছি। যা নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘুরছে। একটি প্রোটন আর একটি নিউট্রনের মধ্যে মূল পার্থক্য হচ্ছে যে প্রোটনের একটি ইলেকট্রিক চার্জ আছে। ইলেকট্রনদেরও ইলেকট্রিক চার্জ থাকে, প্রোটনের ঠিক বিপরীত। আমাদের মাথা না ঘামালেও চলবে ইলেকট্রিক চার্জ বলতে এখানে কী বোঝাচ্ছে। নিউট্রনদের কোনো চার্জ নেই। 

যেহেতু ইলেকট্রনগুলো খুবই খুবই খুবই ক্ষুদ্র [অন্যদিকে প্রোটন আর নিউট্রনরা শুধু খুবই খুবই ক্ষুদ্র] কোনো পরমাণুর ভর কার্যত এর প্রোটন আর নিউট্রনগুলোর ভর, কিন্তু মাস বা ভর বলতে কী বোঝায়? বেশ, আপনি ভাবতে পারেন মাস বা ভর হচ্ছে বরং ওজনের মতো এবং আপনি তা পরিমাপ করতে পারেন ওজনের মতো একই একক ব্যবহার করে [গ্রাম অথবা পাউন্ড]। যদিও ওজন আর ভর কিন্তু একই নয় এবং আমার এই পার্থক্যটা ব্যাখ্যার করার দরকার হবে, কিন্তু আমি সেটি স্থগিত করছি পরের অধ্যায় অবধি। আপাতত ভরকে মনে করুন ওজনের মতো কোনোকিছু। 

কোনো একটি বস্তুর ভর নির্ভর করে প্রায় পুরোপুরিভাবে এর সব কয়টি পরমাণুতে থাকা প্রোটন আর নিউট্রন কত আছে তার মোট যোগফলের ওপরে। কোনো একটি নির্দিষ্ট মৌলের যে-কোনো একটি পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রোটনদের সংখ্যা সবসময়ই একই এবং এটি নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘুরতে থাকা ইলেকট্রনের সংখ্যার সমান। যদিও ইলেকট্রন লক্ষ করার মতো কোনো ভর যুক্ত করে না, কারণ তারা খুবই ক্ষুদ্র। একটি হাউড্রোজেন পরমাণুর একটিমাত্র প্রোটন থাকে [এবং একটি ইলেকট্রন]। একটি ইউরেনিয়াম পরমাণুর আছে ৯২টি প্রোটন, সিসার আছে ৮২টি, কার্বনের আছে ৬টি। ১ থেকে ১০০ অবধি প্রতি সম্ভাব্য সংখ্যার, মাত্র একটি এবং একমাত্র মৌল আছে যার সেই সংখ্যক প্রোটন আছে [এবং একই সংখ্যক ইলেকট্রন]। আমি তাদের তালিকা এখানে দেব না, কিন্তু অনায়াসে একটি তালিকা করা যেতে পারে। 

প্রোটন [অথবা ইলেকট্রন] সংখ্যা যা কোনো মৌল ধারণ করে তাকে বলা হয় এর অ্যাটমিক বা পারমাণবিক সংখ্যা। সুতরাং আপনি কোনো মৌলকে শুধুমাত্র তার নাম নয় এর নিজস্ব অনন্য একটি পারমাণবিক সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করতে পারেন। যেমন – মৌল নং ৬ হচ্ছে কার্বন, মৌল নং ৮২ হচ্ছে সিসা। মৌলগুলো সুবিধামতো একটি টেবিলে সাজানো থাকে, যাকে বলে পিরিওডিক টেবল বা পর্যায় সারণি। কেন এটিকে এই নামে ডাকা হয় সেটি বর্ণনা করার জন্য আমি বিস্তারিত বিবরণে যাব না, কিন্তু সেই কথায় ফিরে আসার সময় হয়েছে এখন, যা আমি করব বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম; সেই কেন প্রশ্নটিতে ফিরে আসা, যখন আপনি কোনোকিছুকে ক্ষুদ্র করে কাটবেন, যেমন ধরুন ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর টুকরোয় সিসাকে, আপনি একসময় এমন একটি বিন্দুতে পৌঁছাবেন যদি আপনি আবারো এটিকে বিভাজিত করেন, এটি আর সিসা থাকবে না। একটি সিসার পরমাণুতে ৮২টি প্রোটন আছে। আপনি যদি পরমাণুকে এমনভাবে বিভাজিত করেন যদি তার ৮২টি প্রোটন না থাকে এটি আর সিসা থাকে না। 

প্রোটনের সংখ্যার চেয়ে পরমাণুর নিউট্রনের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম স্থির। বহু মৌলের ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণ আছে, যাদের আইসোটোপ বলা হয়, এদের ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যক নিউট্রন থাকে। যেমন—কার্বনের তিনটি আইসোটোপ আছে, যাদের বলে কাবন-১২, কার্বন-১৩ ও কার্বন-১৪। এই সংখ্যাটি পরমাণুর পারমাণবিক ভর ইঙ্গিত করছে, যা প্রোটন ও নিউট্রনের যোগফল। এই তিনটি আইসোটোপের প্রতিটির ছয়টি প্রোটন আছে। কার্বন-১২-এর আছে ৬টি নিউট্রন, কার্বন-১৩-এর আছে সাতটি নিউট্রন, কার্বন-১৪-এর আছে আটটি নিউট্রন। কিছু আইসোটোপ, যেমন—কার্বন-১৪ তেজষ্ক্রিয়, এর মানে তারা একটি নির্দিষ্ট হারে ক্ষয় হয়ে ভিন্ন মৌলে রূপান্তরিত হয়, যদিও অনির্দিষ্ট কোনো মুহূর্তে। বিজ্ঞানীরা এই বৈশিষ্ট্যটি ব্যবহার করেন জীবাশ্মদের বয়স পরিমাপ করার জন্য। কার্বন-১৪ যেমন ব্যবহার করা হয় জীবাশ্মের চেয়ে কম প্রাচীন অধিকাংশ জিনিসের সময় নিরূপণে, যেমন—প্রাচীন কোনো কাঠের জাহাজ। 

বেশ তাহলে, তাহলে কি আমাদের কোনোকিছু ক্ষুদ্র থেকে আরো ক্ষুদ্রতর অংশে বিভাজন করার প্রচেষ্টা শেষ হয় এই তিনটি পার্টিকল বা কণায়—ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রনে? না–প্রোটন ও নিউট্রনের একটি অভ্যন্তর আছে। এমনকি তারাও আরো ক্ষুদ্রতর কোনোকিছু ধারণ করে, যাদের বলে ‘কোয়ার্ক’। তবে আমি এই বিষয়টি নিয়ে এই বইয়ে কোনো কথা বলব না।। এর মানে এই নয় যে আপনারা বুঝতে পারবেন না বিষয়টি। এর কারণ আমি জানি, আমি নিজেই সেটি বুঝি না। কারণ এখানে আমরা এমন একটি জগতে প্রবেশ করি যেটি বিস্ময়কর আর রহস্যময়, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, আমরা যা বুঝি তার সীমানায় যখন পৌঁছে যাই সেটি শনাক্ত করা। এর মানে কিন্তু এই নয় যে আমরা কোনোদিনও আর সেটি বুঝতে পারব না। সম্ভবত আমরা পারব এবং বিজ্ঞানীরা সেই বিষয় নিয়ে কাজ করছেন সফল হবার সম্ভাব্য সব আশাবাদ নিয়েই, কিন্তু কোনো বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করার আগেই আমাদের জানতে হবে আমরা কী বুঝতে পারি না এবং আমাদের নিজেদের কাছে সেটি স্বীকার করতে হবে। ক্ষুদ্র কণাদের এই অদ্ভুত বিস্ময়কর জগৎ সম্বন্ধে অন্ততপক্ষে কিছু জানেন এমন বিজ্ঞানীদের সংখ্যাও কম নয়, কিন্তু আমি তাদের একজন নই। আমি আমার সীমাবদ্ধতা জানি। 

কার্বন-জীবনের কাঠামো 

তাদের পৃথক পৃথক উপায়ে সব মৌলেরই বিশেষত্ব আছে, কিন্তু একটি মৌল, কার্বন, এত বেশি বিশেষ ধরনের যে আমরা এই অধ্যায়টি শেষ করব সেই বিষয়ে সংক্ষিপ্ত একটি আলোচনা করে। কার্বন রসায়নের নিজস্ব একটি নাম আছে বাকি সব রসায়ন থেকে : অর্গানিক বা জৈব রসায়ন। রসায়নের বাকি অংশটি হচ্ছে ইনঅর্গানিক বা অজৈব রসায়ন। তাহলে কার্বনের এত বিশেষত্ব কেন? 

উত্তর হচ্ছে, একটি কার্বন পরমাণু অন্য কার্বন পরমাণুগুলোর সাথে যুক্ত হয়ে চেইন বা শিকল তৈরি করে। রাসায়নিক যৌগ, যেমন—অকটেন, আপনি হয়তো জানেন যে এটি পেট্রলের একটি উপকরণ [গ্যাসোলিন] সেটি বরং আটটি কার্বনের ছোট একটি শৃঙ্খল যার পাশ থেকে হাইড্রোজেন পরমাণুগুলো বের হয়ে থাকে। কার্বনের সবচেয়ে চমৎকার বিষয় হল এটি যে-কোনো দৈর্ঘ্যের চেইন তৈরি করতে পারে, কোনো কোনোটি আসলেই আক্ষরিকার্থে শত শত কার্বন অ্যাটম দিয়ে তৈরি। কখনো কখনো চেইনগুলো আবার ফিরে এসে লুপ তৈরি করে। যেমন— ন্যাপথলিনের অনুগুলো [যে রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে মথবল তৈরি করা হয় কার্বন দিয়ে তৈরি যাদের সাথে হাইড্রোজেন অণু যুক্ত থাকে, এখানে তারা দুটি লুপ তৈরি করে। 

কার্বনের রসায়ন অনেকটাই খেলনা বানানোর কিট ‘টিংকারটয়ের’ মতো। ল্যাবরেটরিতে, রসায়নবিদরা কার্বনের পরমাণুগুলো পরস্পরের সাথে যুক্ত করে শুধুমাত্র লুপ বানাতেই সফল হননি বরং চমৎকার আকারের টিংকারটয় সদৃশ অণুও তৈরি করতে পেরেছেন যাদের নাম দেয়া হয়েছে ‘বাকিবল’ আর ‘বাকিটিউব’। ‘বাকি’ ছিল বিখ্যাত বাকমিনিস্টার ফুলারের ডাক নাম, আমেরিকার সেই বিখ্যাত স্থপতি যিনি ‘জিওডেসিক ডোম’ উদ্ভাবন করেছিলেন। বাকিবল আর বাকিটিউবগুলো যা বিজ্ঞানীরা বানিয়েছেন, সেগুলো কৃত্রিম অণু, কিন্তু সেগুলো প্রদর্শন করে টিংকারটয় সদৃশ উপায়ে কার্বন পরমাণুগুলো একটি কাঠামোর উপর ভিত্তি করে একসাথে যুক্ত হতে পারে, যা অনির্দিষ্টভাবে বিশাল হতে পারে [খুব সম্প্রতি একটি উত্তেজনাপূর্ণ খবর ঘোষিত হয়েছে যে বাকিবলদের শনাক্ত করা গেছে মহাশূন্যে, বহু দূরের একটি নক্ষত্রের চারপাশে ভেসে থাকা নক্ষত্রধুলায়]। কার্বন রসায়ন প্রায় অসীম সংখ্যক সম্ভাব্য অণুদের ব্যাপারে আভাস দেয়, যারা সবাই ভিন্ন ভিন্ন রূপ ও আকারের, জীবিত কোনো শরীরে এইসব বহু সহস্র ভিন্ন ভিন্ন অণু দেখতে পাওয়া যায়। 

একটি খুব বিশাল অণু, যেমন—বহু মিলিয়ন সংখ্যক অণু দিয়ে গঠিত মায়োগ্লোবিন, আমাদের মাংসপেশির সব কোষে যে অণুটি আমরা দেখি। মায়োগ্লোবিনের সব পরমাণুই কার্বন পরমাণু নয়, কিন্তু এখানেও কার্বন পরমাণুরা একসাথে যুক্ত হয়ে বিস্ময়কর টিংকারটয় সদৃশ্য কাঠামো তৈরি করে এবং এটাই আসলে সেই জিনিসটি যা সম্ভব করে জীবনের অস্তিত্ব। যখন আপনি ভাববেন যে, মায়োগ্লোবিন, জীবিত কোষে একই রকম আরো হাজার সংখ্যক জটিল অণুর শুধুমাত্র একটি উদাহরণ, আপনি হয়তো কল্পনা করতে পারবেন যে, আপনি মোটামুটিভাবে যে-কোনো কিছু বানাতে পারবেন যদি আপনার কাছে যথেষ্ট পরিমাণ বড় টিংকারটয় সেট থাকে, সুতরাং কার্বনের রসায়ন সুবিশাল ব্যাপ্তির সম্ভাব্য রূপের সুযোগ করে দেয়, জীবিত জীবের মতো কোনো জটিল কিছু নির্মাণে যার প্রয়োজন আছে। 

কি, কোনো পুরাণ-কাহিনি নেই? 

এই অধ্যায়টি ভিন্ন ছিল এই অর্থে যে, এটি পুরাণ-কাহিনির কোনো তালিকা দিয়ে শুরু হয়নি। এর কারণ এই বিষয়ে পুরাণ-কাহিনি খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন। যেমন ধরুন, সূর্য অথবা রংধনু অথবা ভূমিকম্প ইত্যাদির ব্যতিক্রম এই অতি ক্ষুদ্র জিনিসগুলো পৃথিবীর আদিম মানুষের কখনোই নজরে পড়েনি। আপনি যদি বিষয়টি নিয়ে একটু ভাবেন, বিষয়টি খুব বিস্ময়কর কিছু নয়। তাদের কোনো উপায় ছিল না জানার যে এদের অস্তিত্ব আছে। আর সে-কারণে সেগুলো ব্যাখ্যা করতে তারা পুরাণ- কাহিনি আবিষ্কার করেনি। ষোড়শ শতাব্দীতে অণুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার হবার পরই মানুষ আবিষ্কার করেছে পুকুর আর হ্রদে, মাটি ও ধুলোয়, এমনকি আমাদের নিজেদের শরীরও অতি ক্ষুদ্র জীবিত প্রাণী দিয়ে পূৰ্ণ, সাহায্য ছাড়া চোখ দিয়ে দেখার জন্য তাদের আকার খুবই ক্ষুদ্র। তারপরও তারা জটিল এবং তাদের নিজস্ব উপায়ে সুন্দর অথবা হয়তো ভীতিকর, নির্ভর করছে কিভাবে আপনি তাদের সম্বন্ধে ভাবছেন। 

ডাস্ট মাইটরা মাকড়শাদের দূরের আত্মীয় কিন্তু খালি চোখে দেখার জন্যে তারা খুবই ক্ষুদ্রাকৃতির, হয়তো ধুলোর কণার মতো মনে হতে পারে। প্রতিটি বাসায় হাজারে হাজারে তাদের বাস, প্রতিটি কার্পেটে, প্রতিটি বিছানায় তারা হেঁটে বেড়াচ্ছে, খুব সম্ভাবনা আছে আপনার বিছানাতেও। যদি আদিম মানুষ তাদের সম্বন্ধে জানত, আপনি কল্পনা করতে পারবেন যে, তাদের উপস্থিতি ব্যাখ্যা করার জন্য কত পুরাণ আর কিংবদন্তির কাহিনি তারা হয়তো আবিষ্কার করত, কিন্তু অণুবীক্ষণ যন্ত্ৰ আবিষ্কারের আগে, তাদের অস্তিত্ব স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি, সুতরাং তাদের সম্বন্ধে কোনো পুরাণ-কাহিনিও তৈরি করেনি। আর যতই ছোট হোক-না কেন ডাস্ট মাইট, তারও এক শত ট্রিলিয়নের চেয়েও বেশি পরমাণু থাকে। 

আমাদের চোখে দেখার জন্য ডাস্ট মাইট খুবই ছোট, কিন্তু তারা যে কোষগুলো দিয়ে তৈরি তারা আরো ছোট, তাদের ভিতর যে ব্যাকটেরিয়া বাস করে বা আমাদের ভিতরে, তারা আরো ছোট তার চেয়ে। 

একটি ব্যাকটেরিয়ামের তুলনায় পরমাণু আকারে অনেক অনেক ক্ষুদ্ৰ। পুরো পৃথিবী তৈরি অবিশ্বাস্য নানা ক্ষুদ্র জিনিস দিয়ে, খালি চোখে দেখার জন্য যেগুলো খুবই ছোট এবং তারপরও কোনো পুরাণ অথবা তথাকথিত পবিত্র গ্রন্থগুলো, যা-কিছু মানুষ এখনো ভাবেন, সর্বশক্তিমান ঈশ্বর আমাদের দান করেছেন—তাদের কথা আদৌ উল্লেখ করেননি। বাস্তবিকভাবে যখন আপনি সেই পুরাণ আর গল্পগুলোর দিকে নজর দেবেন, আপনি দেখতে পারবেন সেখানে সেইসব জ্ঞানের ছিটেফোঁটাও নেই বিজ্ঞান বিশেষ ধৈর্যের সাথে যা সমাধান করেছে। তারা আমাদের বলে না যে কত বড় বা কত পুরাতন এই মহাবিশ্ব, তারা আমাদের বলেনি কিভাবে ক্যান্সারের চিকিৎসা করতে হয়, তারা মাধ্যাকর্ষণ-শক্তি অথবা কমবাস্টন বা অন্তর্দাহ ইঞ্জিন কিভাবে কাজ করে সেটি ব্যাখ্যা করেনি। তারা আমাদের রোগজীবাণু নিয়ে কিছু বলেনি, অথবা নিউক্লিয়ার ফিউশন অথবা বিদ্যুৎ অথবা চেতনানাশক ওষুধ ইত্যাদি নিয়ে কিছুই বলেনি। বাস্তবিকভাবেই, বিস্ময়ের কোনো কারণ নেই, পবিত্র বইয়ের কাহিনিগুলো পৃথিবী সম্বন্ধে আদিম মানুষদের যতটুকু জানা ছিল ও যারা সেগুলো প্রথম বলতে শুরু করেছিল তার চেয়ে বেশি কোনো তথ্য ধারণ করে না। যদি আসলেই সর্বজ্ঞ দেবতারা এই ‘পবিত্রতম’ বইগুলো লেখা বা শ্রুতলিপির জন্য নির্দেশনা প্রদান অথবা অনুপ্রাণিত করে থাকেন, আপনার কি একটি বিষয় খুব অদ্ভুত মনে হয় না, এই গুরুত্বপূর্ণ আর উপযোগী বিষয়গুলো সম্বন্ধে ওই দেবতারা কিছুই বলেননি? 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *