১৬.
তুমি যে-সব ইংরেজদের চিনেছ তাদের ভিতর সত্যকার শিক্ষিত লোক কম। এবং যে দু-একটি লোক সাহিত্য বা অন্য কোনো রসের সন্ধান কোনো কালে বা হয়তো রাখত তারাও আণ্ডাঘরের আবহাওয়ায় পড়ে এবং রসকষহীন সরকারী-বেসরকারী কাজ করে স্কুল এবং অনুভূতিহীন হয়ে পড়ে। শেলী, কীট পড়ে যে আনন্দ পাওয়া যায় তার জন্য বহু বৎসর ধরে মনে মনে হৃদয়ের অন্তস্থলে এক বিশেষ ধর্মসাধনা করতে হয়। অল্প ইংরেজই সেটা করে থাকে, এবং করলেও সে আর পাঁচজনকে সে সম্বন্ধে কোনো খবর দেয় না। তাই ইচ্ছে করেই ধর্মসাধনা’ সমাসটা ব্যাবহার করলুম, কারণ তোমারা ঐ জিনিসকে করে থাক গোপনে গোপনে। আমার মনে হয় দুটো একই জিনিস, ধর্মসাধনা এবং কাব্যসাধনার শেষ রস একই।
ফরাসীরা তোমাদের মতো শক্ত সোমখ জোয়ান যদি গালগপের মাঝখানে হঠাৎ কবিতা আবৃত্তি আরম্ভ করে তবে আর পাঁচটা ফরাসী হকচকিয়ে ওঠে না, কিংবা বিষম খায় না। ফ্রান্সে তাই কাব্যজীবন এবং ব্যবহারিক জীবনের ভিতর কোনো দ্বন্দ্ব নেই। তাদের প্রেম যে রকম অনেকখানি খোলাখুলি, সে প্রেমকে, তারা তেমনি কবিতা আবৃত্তি করে গান গেয়ে আর পাঁচ জনের সামনে রূপ দিতে, প্রকাশ করতে লজ্জিত হয় না। তাই ইংরেজ হনিমুন করতে যায় ফ্রান্দেজীবনের অন্তত ঐ কটা দিনের জন্য সে খোলাখুলি প্রেম করতে চায়। তার জীবনের এ কটাদিন তোমাদের হোলির মতো! মাতব্বর কাশীশ্বর চক্রবর্তীকেও সেদিন আমি রং মেখে সং সেজে ঢং করতে দেখেছি। মুরব্বী রায় বাহাদুর যদি প্যারিসে হনিমুনম করতে যেতেন (ভাবতেই কি রকম হাসি পায়–প্যারিসে রাস্তায় চোগা চাপকান পরা রায়বাহাদুরের সঙ্গে নোলক-পরা চেলিতে জড়ানো আট বছরের বউ!) তবে তিনি অতি অবশ্য রাস্তার পাশের গাছতলায় পঁড়িয়ে খনে গলায় ঝুলানো হারমোনিয়াম প্যা প্যার সঙ্গে ভাটিয়ালী ধরতেন,খনে বউয়ের কোমর জড়িয়ে ধরে ধেই ধেই করে খেমটা কি পাকা নাচ জুড়তেন। ফ্রান্স দেশের বোতলেই শ্যাম্পেন নয়, তার আকাশে বাতাসে শ্যাম্পেন ছড়ানো।
মার্সেলেস থেকে দশ মাইল দূরে ছোট্ট শহর অ্যাকস-আঁ-প্রভাসে আমরা বিয়ে করব বলে স্থির করলুম। বিয়ের ব্যবস্থা করতে করতে যে তিনদিন লাগল সে সময়টা আমরা মার্সেলেসের সেরা হোটেলে কাটালুম আলাদা কামরায় তখনো বিয়ে হয়নি, এক ঘর করি কী করে?
ফরাসীরা তাই দেখে কত না চোখ টিপে মুচকি হাসি হাসলে। একেই বলে ইংরেজের ‘লেফাপা-দুরস্তমি’, ব্রিটিশ ডারি, তোমাদেরে ভাষায় এদিকে ঘোমটা,ওদিকে খেমটা।
সবাই ঘুমিয়ে পড়লে তার ঘরে যে যেতে পারতাম না তা নয়। এমন কি হোটেলওয়ালা বুদ্ধি করে আমাদের যে দুখানা ঘর দিয়েছিল তার মাঝখানে একটি দরজা ছিল। সে দরজাটি ওয়ালপেপারের সঙ্গে এমন নিখুঁত কারিগরিতে মেশানো যে, আমাদের কারো নজরেই পড়েনি। যে লিফট-বয় আমাদের সুটকেশ ঘরে নিয়ে এসেছিল তার বুঝতে বাকি রইল না যে, প্রেমের মন্দিরে আমরা একদম গাইয়া ভক্ত,আর ফরাসীরা সেখানে আমাদেরে তুলনায় বিদগ্ধ নাগরিক পাণ্ডা। অর্থাৎ ফরাসী লিফটবয় পর্যন্ত বিলেতের ডন জুয়ানকে প্রেমের মুশায়েরায় দু-চারখানি মোলায়েম বয়েত শুনিয়ে দিতে পারে। একবাক্য ইংরিজি না বলে ছোকরা; অতিশয় সংস্কৃত কায়দায় শুধু মুদ্রা দিয়ে বুঝিয়ে দিলে দূরজাটা, কোন জায়গায় এবং সেইটেই যেন আসল কথা নয়, যেন আসল দুদিক থেকেই বন্ধ করা যায়, মেলের মুখ একটুখানি রাঙা হয়ে গিয়েছিল।
.
যে দরজা বন্ধ করা যায়, সেটা খোলা যায়। বাঙলা কথা।
জানিনে, মেব্ল্ তার দিকটে খোলা রেখেছিল কি না।
তোমাদের রাধাকেষ্টর দেখা হত কুঞ্জবনে, সেখানে দরজা-দেউড়ির বায়নাক্কা নেই। আমাদের দেশে দরজা নিয়ে বিস্তর কবিত্ব করা হয়ে গিয়েছে। অবশ্য তোমাকে সে বোঝানোর চেষ্টা পণ্ডশ্রম।
আমি কিন্তু যাইনি অন্য কারণে। যাকে দুদিন বাদে সব দিক দিয়ে আমি পাবই পাব, যে খনির সব মণি একদিন আমারই হবে, যে সমুদ্রের সব মুক্তা আমারই একমাত্র আমারই গলায় একদিন দুলবে, সে খনিতে আমি ঢুকতে যাব কেন চোরের মতো, সে সমুদ্রে আমি কেন হতে যাব বোম্বেটে? মেবল্কে আমি বরণ করতে যাব বিশ্বসংসারের প্রসন্ন আর্শীবাদ নিয়ে।
এবং সবচেয়ে বড় কথা, যৌন সম্পর্কে যদিও আমার দেশ তোমাদের তুলনায় অনেকখানি চিলে তবুও জিনিসটে আমার কাছে কখনো সরল বলে মনে হয়নি। আমার মনে কেমন জানি একটা ভয়, কী যেন একটা সন্দেহ সব সময়েই জেগে থাকত। আশ্চর্য, নয় কি? যে সরল রহস্যের ফলে বিশ্বসংসারে প্রতি মুহূর্তে নবজীবন লাভ করেছে পশুপক্ষী, ফুলে রেণুতে যার সহজ প্রকাশ, তার প্রতি ভয়, তার প্রতি সন্দেহ! ভয়, এ সন্দেহ আমার এখনো যায়নি। তুমি হয়তো এ, চিঠি শেষ করার পর তার কারণ আমার চেয়েও ভালো করে বুঝতে পারবে।
.
১৫ই আগষ্ট
আমি ভেবেছিলুম, এ চিঠি আমি একদিনেই শেষ করতে পারব। এখন দেখছি, ভুল করেছি। এত কথা যে আমার বুকের ভিতর জমা হয়ে আছে সে-কথা আমি জানতুম না। আমার অজানাতে যে আমি এতখানি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি এবং তারও এতখানি এখনো আমার স্মরণে রয়েছে সে-তত্ত্বই বা জানাব কী করে?
ওদিকে তুমি হয়তো অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছ সব কিছু এক ঝটকায় জেনে নেবার জন্য। কিন্তু সোম, জীবন তো আর রহস্য উপন্যাস নয় যে, কৌতূহল দমন না করতে পারলে শেষ ক-খানাপাতা পড়েই সবকিছু জেনে নেওয়া যায়। জীবন বরঞ্চ গানের মতো। তার গতি বিচিত্র, তার বিস্তার বহু। আমার সে গান তোমাদের ভাটিয়ালীর মত মধুর হয়নি এবং সরলও হয়নি তা না হলে আজ আমার এ অবস্থা কেন-এ গানে অনেক কমসুরা, অনেক বেসুরা। সে গানের রেকর্ড তুমি এক মিনিটে বাজাতে গেলে আরো বেসুরা ঠেকবে, আমার প্রতি অবিচার করা হবে।
অ্যাকস-আঁ-প্রভাসের একটি ছোট্ট গির্জেয় যেদিন আমাদের বিয়ে হয়, সেদিন বিধাতা ছিলেন আমাদের উপর অপ্রসন্ন। পুরোত যখন ভগবানের নামে একে অন্যকে স্বামী স্ত্রীর কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন করে দিচ্ছেন, তখন বাইরে ভগবান ছাড়ছিলেন তার হুঙ্কার বৃষ্টিঝড় আর বজ্রপাতের ভিতর দিয়ে। অ্যাকস্ সেদিন সে প্রথম আষাঢ়ে মধুগঞ্জ যে রুদ্ররূপ নেয় তাই নিয়েছিল। আমি যখন মেবকে বিয়ের আঙটি পরাচ্ছিলুম ঠিক সেই মুহূর্তে বিদ্যুৎ চমকে ওঠে শির্জের সমস্ত রঙীন শার্সিগুলোতে যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। মেব্ল্ তখন শিউরে উঠেছিল। আমি তার হাতে একটু চাপ দিয়ে তাকে আশ্বস্ত করেছিলুম। পুরোত যখন গভীর কন্ঠে গির্জাতে সেই গতানুগতিক প্রশ্ন শুধালেন, এই যুবক-যুবতীর মিলনে কারো কোনো আপত্তি আছে কি না, তখন কড়কড় করে বাজ পড়েছিল–আরেকটু হলে গিঞ্জের গাম্ভীর্য ভুলে মেব্ল্ আমাকে জড়িয়ে ধরত। মে বড় ধর্মভীরু, আকাশে বাতাসে, ঘাসে ঘাসে সে ভগবানের অদৃশ্য অঙ্গুলি দেখতে পায়। আমি তার হাতে আরো একটু চাপ দিয়ে তাকে আশ্বস্ত করেছিলুম।
সেদিন কিন্তু এসব দুর্যোগ আমার মনে কোনো দাগ কটেনি। সেদিনের সে দুর্যোগে আমি ভগবানের করাঙ্গুলি-সঙ্কেত দেখিনি, আজও দেখছিনে কিন্তু কেন জানিনে আজ যেন সমস্ত জিনিসটা এক ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে আমার কাছে ধরা পড়েছে। দিনের আলোতে যে মাঠে ফুল কুড়িয়েছি, যে ঝরণায় পা ডুবিয়ে বসে ক্লান্তি জুড়িয়েছি, সন্ধ্যের অন্ধকারে সেখানে যেন প্রতি গর্তে কেউটের ফশা দেখাতে পাচ্ছি। কী জানি, সব যেন ঘুলিয়ে গিয়েছে। কতবার ভেবেছি এ-সব কথা। কখনো এসব এলোমেলো চিন্তা পাট করে ভাজে ফেলে গুছিয়ে তুলতে পারিনি। সে রাত্রে আবেগে, উত্তেজনায় মেব্ল্ আমার বুকে তার মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল। কান্নার সঙ্গে সঙ্গে তার ঢেউ-খেলানো শরীরে যেন আরেক ধরনের ঢেউ জেগে উঠছিল। আমার হাত ছিল তার কোমরের উপর। আমি আমার হাত দিয়ে তার বিক্ষোভ শান্ত করার চেষ্টা করেছিলুম। চোখ দিয়ে, কান দিয়ে শুনি, এ দু ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আন সঞ্চয় হয় বেশী, রস গ্রহণ করা যায় কম। স্পর্শের মাধ্যমে পাওয়া যায় রস-অনুভূতি জ্ঞান যেটুকু সঞ্চয় হয় তা নগণ্য। স্পর্শের নিবিড়তা রসলোকে গভীরতম। সে মানুষকে একে অন্যের যত কাছে টেনে আনতে পারে অন্য কোনো ইন্দ্রিয় তা পারে না। চোখ দিয়ে যখন প্রিয়াকে দেখি কান দিয়ে যখন শুনি তার প্রেম নিবেদন তখন সর্বচৈতন্য ভরে ওঠে এক বিপুল মাধুরীতে কিন্তু চুম্বনের যখন তার স্পর্শলাভ করি তখন পাই গভীরতম একাত্মবোধ। বরঞ্চ চুম্বনেরও সীমা আছে, সেখানেও ক্লান্তি আছে; কিন্তু গায়ে হাত বুলানোর কোনো সীমাবন্ধন নেই। তাই মায়ের গভীরতম ভালোবাসার প্রকাশ পুত্রের গাত্ৰস্পর্শে। আরেকটু সাদামাঠা ভাষায় বলি, তোমাদেরই ভাষায়, মিঠে কথায় চিড়ে ভেজে না তাতে দিতে হয় জল আর গুড়ের স্পর্শসুখ।
***
একটু চেষ্টা করলে হয়তো স্মরণ করতে পারবে ঠিক ঐ সময় মধুগঞ্জ অঞ্চলে হঠাৎ স্বদেশী আন্দোলন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। কর্তারা বিচলিত হয়ে আমাকে তার করেন, তদণ্ডেই ছুটি বাতিল করে কর্মস্থলে ফিরে আসতে। সে তার লণ্ডন, প্যারিস বহু জায়গায় বিস্তর গুত্তা খেয়ে শেষটায় এসে পোছায় আকস-আঁ-প্রভাসে আমাদের বিয়ের পরদিন ভোরবেলায়! তৎক্ষণাৎ ছুট দিতে হ’ল মার্সেলেস বন্দরের দিকে।
মার্সেলেস বন্দরে জাহাজ ধরা আমাদের মধুগঞ্জের বাজার ঘাটে নৌকো ধরার মতো। সেখানে দুনিয়ার জাত-বেজাতের জাহাজ–এমন কী গ্রীক, মিশরী, তুর্কী পর্যন্ত-খেয়া নৌকোর মতো বসে থাকে এবং সেখানে দিব্যি দরদস্তুর করা যায়, কত দামে তোমাকে ভূমধ্যসাগরের খেয়া পার করে পোর্ট সঈদে নিয়ে যাবে–মধুগঞ্জের ঘাটে যেরকম দর কষাকষি করি। মার্সেলেসে ভারতবগামী বড় জাহাজ না পেলে পোর্ট সঈদে গিয়ে সেখানে থেকে আনায়াসে অন্য জাহাজ ধরা যায়–ঐ খাড়ি দিয়েই তো সব জাহাজকে বোম্বাই, কলম্ব যেতে হয়।
আমাদের কপাল ভালো না মন্দ বলতে পারব না; কোনো ভালো ব্যবস্থাই করতে পারলুম না। শেষটায় একটা মাল-জাহাজ জুটে গেল, সেটাই দেখলুম হিন্দুস্থান পৌঁছবে সক্কলের আগে, কারণ ছাড়বে ঘণ্টা তিনেক পরেই। তবে অসুবিধে এই যে, আমাদের নিজেদের জন্য কোনো কেবিন আর তাতে খালি নেই। আমাকে ঢুকতে হবে একটা পুরুষদের কেবিনে, আর মেবল্কে একটা মেয়েদের। একেবারে ভারতীয় ব্যবস্থা মানা জানান।
মেব্ল্ খুঁতখুঁত করেছিল।
আমি হেসে বলেছিলাম, যে দেশে যাচ্ছ সেখানে ঠিক এই ব্যবস্থা। বিলেতে স্মোকিং, নন-স্মোকিং। ওদেশে লেডিজ এবং জেন্টলমেন।
আমার মনে হয়েছিল, ভালোই হ’লতাড়াতাড়ির কী।
ছোট জাহাজের এক কোণে, নিভৃতে, গুটানো দড়াদড়ির মাঝখানে আমরা দুজনায় পাশাপাশি বসতুম। সমুদ্রের উদ্দাম হাওয়া মেবলের চুলনিয়ে হুলস্থূল বাধাত, কখনো খানিকটে, নোনা জলের সূক্ষ্ম কণা তার গালে চুমু খেয়ে যেত, কখনো বা সমুদ্রের চাঁদের জোরালো আলো এসে তার মুখ অদ্ভুত দীপ্তিতে উজ্জ্বল করে তুলত। রাত একটা, দুটো, তিনটে বেজে যেত। একে অন্যের অবিচ্ছিন্ন সঙ্গসুখ বর্জন করে কেউই আপন কেবিনে যেতে রাজি হতুম না। কী হবে কেবিনে গিয়ে। সেখানে তো শুধু ঘুমের অন্ধকারে ডুবে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো অনুভূতি নেই। এখানে সমুদ্র আকাশ, আলো-অন্ধকার, চন্দ্র তারা তাদের কত অফুরন্ত সৌন্দর্য রাত্রির পর রাত্রি উছলে ঢেলে দিচ্ছে। কেউ দেখবার নেই। এই বিরাট সমুদ্রের ক ইঞ্চি জায়গা জুড়ে আছে কখানা জাহাজ? এবং সেই কটি জাহাজে সুষুপ্তিতে নিমগ্ন না হয়ে এ সৌন্দর্য পান করছে কটি নর-নারী? আমিও এ সৌন্দর্য এ রকমভাবে তার পরিপূর্ণরূপে, ক্রমবর্ধমান গতিতে আগে কখনো দেখিনি। এর পূর্বে যে একবার এসেছি গিয়েছি। তখন বেশির ভাগ সময় কেটেছে লাউঞ্জে তাস খেলে, বারে হুইস্কি খেয়ে কিম্বা কেবিনে নাক ডাকিয়ে। বার থেকে শেষ গ্লাস খেয়ে কেবিনে যাবার সময় ডেকে দাঁড়িয়ে হয়তো দু-পাঁচ মিনিটের জন্য টুরিস্টদের মতো ও, হই গ্রাও বলেছি। পাকা ইংরেজ পাঁচজনের সামনে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনেকক্ষণ দরে দেখবার সাহস ধরে না-পাছে লোকে ভাবে লোকটা হয়তো কবি। ওয়াট? দ্যাট চ্যাপি পোয়েমস? গশ। ওয়া (ট) ফ (র)! মাই গিনেস্ (গুডনেস)! তার উপর আমি অব অল পার্স পুলিশের লোক?
আমরা জাহাজে উঠেছিলুম কৃষ্ণা এয়োদশীতে আর বোম্বাইয়ে নামি পূর্ণিমাতে।
এখানে হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল, সোম, কিছু মনে কোরো না, সেটা যদি উল্লেখ করি। এর সঙ্গে আমার মূল বক্তব্যের কোনো যোগ নেই। তোমার মনে আছে। কিনা জানিনে, মধুগঞ্জে তোমার সঙ্গে পরিচয়ের দুদিন পরেই তুমি কথায় কথায় বলেছিলে, পরশু তো পূর্ণিমা সমস্ত রাত নৌকো বাওয়া যাবে। আমি তখন কিছু বলিনি। পরে দেখলুম, শুধু তুমি না, তোমাদের দেশের আর সবাইও চাঁদের বাড়া-কমা সম্বন্ধে সব সময়ই সচেতন। আমরা কেন অচেতন থাকি তার কারণ আমাদের দেশে বারো মাস যে কোনো রাত্রে বৃষ্টি, ঝড় হতে পারে, শীতকালে বরফ, আর কুয়াশা তো লেগেই আছে। চার শ পঁয়ষটি দিন ইচ্ছে করেই চার শ বললুম। ওখানে কে হিসেব রাখে চাঁদ রাতের বেলায় কখন যায়, কখন আসে, মাজাঘষা কাসার থালার মতো ঝকঝক করে, না নকনে কাটা নখের মতো আকাশ থেকে কেটে পড়ে গাছের ডগায় আটকে থাকে।
ভারতবর্ষে চাঁদকে না চিনে মফস্বলে কোন পুলিশ ঠিকঠিক কাজ করতে পারে? পূর্ণিমাতে চুরির এলাকায় মোতায়েন করলে আধা ডজন পুলিশ, অমাবস্যায় তিনটে! একমাত্র বর্ষাকালেই আগেভাগেই কিছু ঠিক করা যায় না। বিলেতে বারোমাস তাই।
কিন্তু আমি চাঁদকে সত্যি চিনতে শিখলুম জাহাজে, মেলের সঙ্গে। কৃষ্ণা এয়োদশীতে চাঁদ কখন ওঠেন, কতখানি কাত হয়ে ওঠেন আর শুকা সপ্তমতে চাঁদ কখন অস্ত যান, এদিকে কাত হয়ে না ওদিকে কাত হয়ে সে আমি ভালো করে জানলুম জাহাজে, ডেক চেয়ারে, মেবলের গাঁ ঘেঁষে। ক্লান্তিতে সে বেচারী ঘুমিয়ে পড়ত, তবু কেবিনে ঘুমতে যাবে না। আমি ডেক চেয়ারে ঘুমুতে পারিনি। তাতে কিন্তু আমার কোনো ক্ষোভ ছিল না।
.
১৭ই আগস্ট
ইয়োরোপীয়দের সঙ্গে প্রাচ্যের প্রথম পরিচয় হয় পোর্ট সঈদে।
পোর্ট সঈদের সঙ্গে গোটা মিশরের অতি অল্পই যোগসুত্র। তাই পোর্ট সঈদ দেখে মিশর সম্বন্ধে রায় প্রকাশ ভুল। ও-শহরটা জন্মেছে এবং বেঁচে আছে জাহাজ-যাত্রীদের কল্যাণে। এবং জাহাজে যে রকম বহু যাত্রী কাণ্ডজ্ঞানবর্জিত হয়ে নব নব উল্লাস উত্তেজনার সন্ধান করে, এখানেও ঠিক তাই। বরঞ্চ বলব বেশী। বরঞ্চ বলব, জাহাজে তুমি কী করলে না করলে তার সন্ধান তবু কেউ কেউ পেয়ে যেতে পারে, এখানে সে বালাই-ই নেই। এখানে তুমি ঘণ্টা পাঁচেক কী করে কাটালে, তার খবর জানবে কে? দেশৰমণ বড় ভাল জিনিস–তার একসসট পাইপ দিয়ে মেলা পাপ বেরিয়ে যায়।
পোর্ট সঈদের পাপ লুকিয়ে রাখা যায় না। মেলের চোখে পর্যন্ত তার অভদ্র ইঙ্গিত খোঁচা মেরেছিল–যদিও আমি চেষ্টার ত্রুটি করিনি ও যেন সামান্য দু-একটা কেনাকাটা করে, আর গোটা দুই মসজিদ দেখেই জাহাজে ফেরে।
শেষটায় মেবল্কে বললুম, ও যে-দেশে যাচ্ছে, সেখানকার লোক লাঞ্চ ডিনার আরম্ভ করে তোতো জিনিস দিয়ে। প্রাচ্যের সঙ্গে মোলাকাত দাওয়াতের আরম্ভেই পোর্ট সঈদের উচ্ছেভাজ-যদিও অনেক বুড়বকদের কাছে সেই বস্তুই ক্রিসমাসকে লেডি ক্যানিং বলে মনে হয়।
শোর্ট সঈদ মিশরের প্রতীক নয়, বোম্বাইকে বরঞ্চ ভারতবর্ষের শহর বলা চলে। তাই যখন বোম্বাই দেখে মেব্ল্ খুশি হলো, তখন আমার ভয়-ভাবনা অনেকখানি কেটে গেল। যদিও সে বেচারী বোম্বাইয়ের রাস্তায় হাতি সাপ আর গৌরীশঙ্করের জন্য এদিক ওদিক তাকিয়ে, দেখতে না পেয়ে একটু মনমরা হয়েছিল বৈকি?
বোম্বাইয়ে নেমেই ধরতে হ’ল কলকাতা মেবল্। সেখানে নেমে তড়িঘড়ি ফের। শেয়ালদা-গোয়ালন্দ–চাঁদপুর হয়ে মধুগঞ্জে। মে অভিভূতের মতো গাড়িতে জানালার কাছে বসে, গোয়ালন্দী জাহাজে ডেক-চেয়ারে খাড়া হয়ে দুচোখ দিয়ে বাইরের দৃশ্য যেন গিলছিল। তার কাছে সবই নুতন, সবই বিচিত্র। তার আনন্দে কিন্তু কাটা ফোঁটাতে তোমাদের দেশের দারিদ্র। স্টেশনে ভিখিরি দেখে দেখে শেষটায় বেচারী অন্য দিকে মুখ ফেরাত। বরঞ্চ আমি আয়ারল্যাণ্ডের ছেলে ইংরেজ রাজত্বের ফলে আমার দেশে কী হয়েছে, সে সম্বন্ধে আমি কিছুটা সচেতন, কিন্তু লণ্ডনের মেয়ে মেব্ল্ এ-সব জানবে কী করে? আবার সব দারিদ্রের জন্য কেবল ইংরেজই দায়ী, এই সহজ সমাধানই বা তাকে বলি কী প্রকারে? ভাবলুম, মে বোকা মেয়ে নয়, নিজের থেকেই আস্তে আস্তে সবকিছু বুঝে নেবে।
মধুগঞ্জ আর আমাদের বাঙলোটি দেখে মেবল্ মুগ্ধ ঠিক একদিন আমি যে রকম মুগ্ধ হয়েছিলুম। আম, জাম, নিম, লিচু গাছের কোনটাই সে কখনো দেখেনি। খানার টেবিলে যে-সব ফল রাখা হল, তারও সব কটাই তার অজানা। কারি যে এক নয়, দশ–বিশ রকমের হয়, সে কথা মধুগঞ্জে এসে প্রথমে শুনল। এসব দেখে শুনে মেলের বিশ্বাস হ’ল, অ্যালিস ইন ওয়াণ্ডারলাণ্ডে ওয়াপ্তার করবার মতো কিছুই নেই।
এসব জিনিস তোমাকে এত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলছি কেন সোম? একটু পরেই বুঝতে পারবে।
অ্যাকস্-আঁ-প্রভাস ছাড়ার পর মধুগঞ্জে এসেই আমাদের সত্যকার হনিমুন আরম্ভ হ’ল। হনিমুন! হায় ভগবান, না। শয়তান–কাকে ডাকব?
এক মাস ধরে প্রতি রাত্রে যে মর্মান্তিক সত্য আমার সর্বাঙ্গে চাবুক মেরে গেল, তার মূল ট্রাজেড়ি–আমি নিবীর্য–ইম্পোটেন্ট। মেব্ল্কে যৌনতৃপ্তি দেবার ক্ষমতা আমার নেই।
কথাটা কত সহজে বলা হয়ে গেল। এ রকম সহজ কথা শোনা তোমার আমার দুজনেরই অভ্যাস–পুলিশের লোক হিসেবে। জজ কত সহজ সরল ভাষায় আসামীকে বলেন, তাই তোমার ফাঁসি। কিন্তু সে কি তখন তার পূর্ণ অর্থ বুঝতে পারে? পরেও কি পারে? এর অর্থ বুঝতে হয় প্রাণ দিয়ে এবং প্রাণ দেবার পর বোঝাবুঝির রইল বা কী?
আমি ইম্পোটেন্ট। রায়টা কত সহজ। কিন্তু এর সম্পূর্ণ অর্থ আমি এখনো বুঝিনি। দিনে দিনে পলে পলে পদাঘাত খেয়ে খেয়ে যেটুকু বুঝতে পেরেছি সে জিনিস আমি তোমাকে কিংবা এ সংসারের অন্য কাউকে বোঝাব কি করে? আমার যেদিন ফাঁসি হবে সে দিন আমি বোঝাবুঝির বাইরে চলে যাব বটে, কিন্তু তোমারা হয়তো সেই দিনই খানিকটে বুঝতে পারবে।
পনেরো দিন পরে তাই আমি কলকাতা গিয়েছিলুম, ডাক্তারদের কাছে। তারা অনেক পরীক্ষা করে যা বললেন সেটাও অতি সহজ। নিজের থেকে যদি না সারে তবে ওষধ পত্রে কিছু হবে না। কলকাতার ডাক্তারদের হাইকোর্টে আমার মৃত্যুদণ্ড বহাল রইল।
ফিরে এসে যখন শুনলুম তুমি রটিয়েছ আমি কলকাতা গিয়েছি সরকারী কাজে তখনই বুঝতে পারলুম, তোমার আনকানি ষষ্ঠবুদ্ধি দিয়ে তুমি বুঝতে পেরেছ কিছু একটা হয়েছে এবং আর পাঁচজন যেন তার কোনো ইঙ্গিত না পায় তাই ও গুজবটা রটিয়েছ। থ্যাক।
এর সরল জিনিস, কিন্তু আমার কাছে এখনো এটা রহস্য।
আমি দেখতে ভালো, সৌন্দর্যবোধ আমার আছে, আমি প্রাণবান পুরুষ, আমর স্বাস্থ্য ভালো, আবার জোর দিয়ে বলছি, সোম, আমার মতো স্বাস্থ্য পৃথিবীর কম লোকই পেয়েছে, আমার অর্থের অভাব নেই। বিলাসেও আমার ঝোঁক নেই, পাঁচজনের তুলনায় আমাকে বোকা বলা যেতে পারে না, এবং সবচেয়ে বড় কথা মেবলের মতো সুন্দরী, প্রেমময়ী রমণী আমি পেয়েছি প্রিয়ারূপে, পত্মীরূপে, সে আমাকে তার সমস্ত সত্তা দিয়ে ভালোবাসে, আমাকে সে হৃদয় দিয়ে বরণ করে নিয়েছে
এই পরিপাটি প্যাটার্নটি বোনার পর ভগবানের এ কি নিষ্ঠুর ঠাট্টা না শয়তানের অট্টহাসি! এই পার্ফেক্ট প্যাটার্নটির উপর কে যেন ছড়িয়ে দিলে নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করে তার তাজা রক্ত। তোমাদের ভাষায় বলতে হলে, সুন্দর দুর্গাপ্রতিমা বহু যত্নে তৈরি করার পর তার উপর কে যেন ছিটিয়ে দিলে গোরক্ত। মর্মর মসজিদের মেহরাবে না পাক শুয়রের খুন!
কেন, কেন, কেন?
আমি কোনো উত্তর পাইনি।
অনেক ভেবেছি। অনেক ভেবেছি বললে অল্পই বলা হ’ল। আট বছর ধরে ঐ একটি কথাই ভেবেছি বললে ভুল বলা হবে না। কাজকর্মে লিপ্ত থাকার সময় আমার-চেতন মন এ সমস্যা ভুলে যেত সত্য কিন্তু হাতের কাজ শেষ হওয়া মাত্রই মন সেই প্রশ্নে ভুব মারত।
এখনো মারে। আমার এ জীবন-চৈতন্যের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমার মন ঐ কথাই ভাববে। আমি শেষ দিন পর্যন্ত ইডিয়ট ইম্বেসাইলের মতো খাদ্য শুধু চিবিয়েই যাব, কখনো গিলতে পারব না। এই যে পাঁচ লক্ষ ক্যাঞ্চল্লাইটের জোর সার্চলাইট আমার চোখের উপর জ্বলছে সেটাকে কখনো সুইচ-অফ করতে পারব না।
নিরাশ হয়ে আমি এক বৎসর ধরে বহু ধর্মগ্রন্থ পড়েছি। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারিনি। সব ধর্মই দেখি সন্ধ্যান করে একই বস্তু–তার নাম স্যালভেশন, মোক্ষ, নির্বাণ, নজাত। কিন্তু আমি তো স্যালভেশন চাইছিনে? আট বছরের বাচ্চা কি সুন্দরী কামনা করে?
তোমরা অর্থাৎ প্রাচ্যের লোকই তাবৎ ধর্ম বানিয়েছ। আমরা পশ্চিমের লোক কী এক অদ্ভুত যোগাযোগের ফলে তারই একটা খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করেছি। কিন্তু আমার মনে হয়, স্যালভেশন জিনিসটের প্রতি আমাদের ক্ষুধা নেই বলে আমরা ধর্মটা নিয়েও নিইনি। তা না হলে এদিকে বলছি, কেউ ডান গালে চড় মারলে বা গাল এগিয়ে দেবে,’ ওদিকে দেখো জনদের মারার জন্য আমরা শত শত কৌশল বের করছি, লক্ষ লক্ষ লোক মারছি। শুধু কি তাই? ডান গালে চড় মারলে বাঁ গাল এগিয়ে দেবে, এ ধর্মে যে লোক বিশ্বাস করে না তাকে এটা গেলাবার জন্য কত শার্লমেন কত পোপ কত লোককে মেরেছে! পাদ্রীটলার বুড়ো জোনকে বাদ দাও। বাদবাকি মিশনারিরা কী করছে? অসহায় নিরুপায় নিগ্রোদের জীবন অতিষ্ঠ করে তাদের ক্রীশ্চান বানাচ্ছে।
শুধু একটা ধর্মে আমি কিছুটা হদিস পেয়েছি। এবং আশ্চর্য সে ধর্মে আজ পৃথিবীতে বিশ্বাস করে বড় জোর দশ লক্ষ লোক। পার্সীদের ধর্ম, জরথুস্ত্রী ধর্ম।
জরথুস্ত্রী বলেন, সৃষ্টির প্রথম থেকেই আলো-আঁধারের দ্বন্দ্ব। আলোর প্রতীক আহুর মজদা আমাদের ভাষায় ভগবান আর অন্ধকারের প্রতীক আহির মন আমাদের ভাষায় শয়তান। জরথুস্ত্রীদের মতে যারা আহুর মজদার পক্ষে তাদের বিশ্বাস, শেষ পর্যন্ত এ যুদ্ধে জয়ী হবেন তিনিই। আহির মন আহুর মজদার সঙ্গে পেরে উঠবে না।
সংসারে যা কিছু সত্য শিব সুন্দর তা আহুর মজদার সৃষ্টি আর যত কিছু মিথ্যা, অমঙ্গল, কদর্য তা আহির মনের।
তবে কোন সুস্থ মানুষ এই শয়তানের পক্ষ নেবে?
সেই তো মজা, সোম, সেই তো মজা।
দেখোনি, এ সংসারে উন্নতির জন্য, স্বার্থের খাতিরে মানুষ কতখানি মিথ্যাচারী, ক্রর, মিত্রঘ্ন হয়। আমরা পুলিশের লোক, আমাদের বিশ্বাস এই ধরনের লোকই পৃথিবীতে বেশী। এরা মুখে ভগবান আহুর মজদাকে মানে, পুজো চড়ায়, শিরনি বিলোয়, গির্জাতে মা-মেরির সামনে মোমবাতি জ্বলে, কিন্তু আসলে কি এরা আহির মনকেই জীবনদেবতারূপে বরণ করে নেয়নি? আপন জানা-অজানায় এরা কি মেনে নেয়নি যে সুদূর ভবিষ্যতে যা হবার হবে, মজদা জিতুন আর মনই জিতুন, আমার এ জীবনকালে যখন দেখতে পাচ্ছি জ্বর কঠিন মিথ্যাচারী হয়ে আমি সাংসারিক উন্নতি করতে পারব না তখন আর গত্যন্তর কী?
এদের সবাইকে আমি দোষ দিইনে, সোম। কাচ্চা বাচ্চা রয়েছে, তাদের খাওয়াতে পরাতে হবে, আত্মীস্বজন বন্ধু বান্ধবের কাছে বিশেষ করে স্ত্রীর কাছে যে তোমাতে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে বসে আছে প্রতিদিন মাথা হেঁট করে স্বীকার করা যে আমি জীবনযুদ্ধে হেরে, চলেছি কে শুনতে চায় সত্যাবলম্বন করে কিংবা না করে–এ কর্ম কি সহজ?
তবেই দেখো সোম, পৃথিবীতে অধিকাংশ লোকই এ যাবৎ কার্যত স্বীকার করে নিয়েছে যে, উপস্থিত আহির মনই শক্তিশালী, তাকে না মেনে উপায় নেই। এমন কি তাদের একটা বনাফাইডি ডিপেস পর্যন্ত রয়েছে। শেষ বিচারের দিন যখন আহুর মজদা এদের শুধাবেন, তোমরা আহির মনের পক্ষ নিয়েছিলে কেন? উত্তরে তারা ক্ষীণকঠে বলবে–স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে তখন তিনিই শক্তিমান–তখন, হুজুর, তিনিই ছিলেন শক্তিশালী, তাঁকে না মেনে উপায় ছিল কি? এটা কি খবু সদুত্তর? কেন, ভেবে দেখো, গ্রামের জুলুমবাজ জমিদারের ভয়ে যখন প্রজারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় তখন তুমি কি সব সময় ধর্মের শোলোক কপচাও?
কিন্তু আমার জীবনে এ দর্শনের প্রয়োগ কোথায়?
পৃথিবীর সর্বত্র প্রাচীন শাস্ত্রেই আছে, অতি পূর্বযুগে নাকি একবার এক বিরাট বন্যা হয়েছিল; প্রাচীন আসিরীয় বাবিলনীয় প্রস্তরগাত্রে সে ঘটনার কথা খোদাই করা আছে, বাইবেলে তার বর্ণনা আছে, তোমাদের শও আছে কেশব তখন মীন-শরীর ধরে বেদ বাঁচিয়েছিলেন, অর্থাৎ সে বন্যায় তোমাদের সভ্যতা সংস্কৃতি ভেসে যায়নি, কোনো এক মহাপুরুষ তার শ্রেষ্ঠতম জিনিস বাঁচাতে পেরেছিলেন।
এই বন্যা নিয়ে একটি আধা খ্রীশ্চানী আধা-মুসলমানী গল্প আছে।
সেই বন্যা আসার পূর্বে জেহোভা তখনকার দিনের পয়গম্বর নূহকে ডেকে বললেন, বন্যায় সব ভেসে যাবে, তুমি একটা নৌকো বানিয়ে তাতে পৃথিবীর সব গাছ, ফুলের বীজ এবং যত প্রকারের প্রাণী এক এক জোড়া করে রেখো। বন্যার পর তাই দিয়ে পৃথিবী আবার আবাদ করবে। সাবধান কিছু যেন খোয়া না যায়।
নূহ তাই করলেন, কিন্তু বন্যার পর দেখেন কী, ইঁদুরে তাঁর আঙুরের বীজ খেয়ে ফেলেছে। আঙুর ফলের রাজা। গোজামিল দিয়ে সে ফলটা হারিয়ে যাওয়ার কেচ্ছা তিনি চাপা দিতে পারবেন না। ভারি বিপদে পড়লেন।
ওদিকে কিন্তু হুঁশিয়ার শয়তানও সব মাল এক-এক প্রস্ত করে রেখেছিল। সে তখন নুহকে তার বাঁচানো আঙুরের বীজ দেবার প্রস্তাব করলে–তার বীজ তো আর ইঁদুর শয়তানি করে খেতে পারে না অবশ্য কুমতলব নিয়ে। নূহের মনেও ধোকা ছিল, কিন্তু তিনি তখন নিরুপায়–বে-আঙুর দুনিয়া নিয়ে তিনি আল্লাকে মুখ দেখাবেন কী করে?
পৃথিবীর জমিতে শয়তানের স্বত্ব নেই। তাই শর্ত হল, নুহ দেবেন জমি, শয়তান দেবে আঙুরের বীজ। গাছের তদারকিও ৫০-৫০।
নূহ তো যত্ন করে সকাল-সন্ধ্যা চারার গোড়ায় ঢালেন সুমিষ্ট, সুগন্ধি বসরাই গোলপজল আর শয়তান ঢালে গোপনে গোপনে নাপাক শুয়রের রক্ত।
নুহের পাক পানির ফলে, ফলে উঠল মিষ্টি আঙুর ফল। আঙুরের মতো ফল পৃথিবীতে আর নেই। কিন্তু শয়তানে যে দিয়েছিল না-পাক চীজ; তারই ফলে আঙুর পচিয়ে তৈরী হয় মদ। সেই মদ খেয়ে মানুষ করে মাতলামো, যত রকমের জঘন্য পাপ।
আহুর মজদা আমার জীবনের প্যাটার্ন গড়েছিলেন অতি যত্নে, ভালো কোনো রঙই তিনি সে প্যাটার্নে বাদ দেননি, সেকথা তোমাকে পূর্বেই বলেছি।
আহির মন আড়ালে দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছিল। সে তার শক্তি সম্বন্ধে সচেতন। প্যাটার্ন যখন শেষ হবার উপক্রম তখন সে তার ভিতর ছেড়ে দিল মাত্র একটি পোকা এক রাত্রেই প্যাটার্ন কুটিকুটি হয়ে গেল।
বিশ্বকর্মা তিন ভুবনের সুন্দর সুন্দর জিনিস নিয়ে তিলে তিলে গড়লেন অনবদ্যা তিলোত্তমা। আহির মন তার রক্তে ঢেলে দিল গলিত কুষ্ঠের ব্যাধি।
এ প্যাটার্ন রিপু-করা, এ গলিত কুষ্ঠকে নিরাময় করা আহুর মজদার মরদের
.
১৮ই আগষ্ট
যৌবনে বেঁচে থাকার আনন্দেই (জোয়া দ্য ভি) মানুষ এত মত্ত থাকে যে, মোক্ষের সন্ধান সে করে না। শেলি না কে যেন বলেছেন,
I have drunk deep of joy
And I will taste no other wine to-night.
যখন মানুষ সে আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়, অথবা যখন বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যুর সম্মুখীন হয়ে ভয় পায় তখনই সে ওসব জিনিস খোঁজে। এ কথা শুধু ব্যক্তির পক্ষে সত্য নয়, গোটা জাতির পক্ষেও খাটে। তোমাদের জাতি যে কত পুরনো সেটা শুধু এই তত্ত্ব থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায় তোমরা মোক্ষের অনুসন্ধান আরম্ভ করেছ খ্রীষ্ট-জন্মের প্রায় দু শ বছর পরে। তাই দেখো, এই মধুগঞ্জের মুসলমানরাই তোমাদের তুলনায় ফুর্তিফার্তি করে বেশী; কামায় টাকাটা, খর্চা করে পাঁচ দিকে।
আইরিশমেনদের কাছেও মোক্ষ-সন্ধান এসেছে সম্প্রতি–তাও পাঁচ হাত হয়ে, ঘষা মাজা খেয়ে। তাই আমার না ছিল মোক্ষ-সন্ধানের জাতীয় ঐতিহ্য, না ছিল কণামাত্র ব্যক্তিগত প্রয়োজন। যে সব ধর্মের কথা এসে যাচ্ছে সেগুলোর অনুসন্ধান আমি করেছি আহির মনের মার খেয়ে। এবং যে সব মীমাংসায় পৌচেছি (তার কটা সম্বন্ধেই বা আমি সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ?–সম্পূর্ণ সত্য তো ভগবানের হাতে, মানুষের চেষ্টা তো ক্রমাগত যতদূর সম্ভব কাছে আসবার।) সেগুলো মাত্র কিছুদিন হল।
তাই আমার এ জবানবন্দিতে আহুর মজাদা আহির মনের কথা আসা ছিল উচিত হয়ত সর্বশেষে। কিন্তু তা-ই বা বলি কী করে? আমরা ইতিহাস লিখি ক্রনোলজিকালি– কোন ঘটনা আগে ঘটেছিল, কোনটা পরে সেই অনুযায়ী। কিন্তু অভিধান লেখায় সময় অ্যালফাবেটিকালি; যে শব্দ পৃথিবীতে প্রথম জন্ম নিয়েছিল সেইটে দিয়েই আমরা অভিধান লেখা আরম্ভ করিনে। আমার জীবন অভিধান তো নয়ই, ইতিহাসও নয়। আমি মরে যাওয়ার পর আমার জীবন তোমার কাছে ইতিহাসের রূপ নেবে। ইতিহাসের বর্তমান থাকে না, ভবিষ্যৎ নেই, তার আছে শুধু ভূত। আমি বেঁচে আছি, কাজেই আমার ভবিষ্যৎ আছে, কিন্তু সে থেকেও নেই ভূত আর বর্তমান এমনভাবে জড়িয়ে গিয়েছে যে, তার জট ছাড়িয়ে পাকাপাকি কালানুক্রমিকভাবে সব কিছু বলতে পারব না।
আহির মনকে স্বীকার করে আমি অধর্ম করেছি? অধর্ম অন্যায় যাই করে থাকিনে কেন, আমি কিন্তু ভণ্ডামি করিনি। সেই আমার সবচেয়ে বড় সান্তনা। কিন্তু আবার দেখো, আরেক নূতন ডিলেমায় পড়ে গেলুম। আমি যদি ভণ্ডামি ঘৃণা করি তবে আমি আবার আহুর মজদাপন্থী হয়ে গেলুম! ভণ্ডামি তো আহির মনের, সত্যনিষ্ঠা মজদার। এ দ্বন্দ্বের কি অবসান নেই?
হয়ত আছে, হয়তো নেই। তাই হয়তো তখন অন্তরের দ্বন্দ্ব মূলতবী রেখে দেখতে হয় কর্মক্ষেত্রে মানুষ কী করে। সেখানে তো মানুষকে অহরহ ডিসিশন-মীমাংসা, নিষ্পত্তি করতে হয়। এ সংসারে সকলের ভিতরেই কিছু না কিছু হ্যামলেট লুকিয়ে আছে যে সর্বক্ষণ টু বি অর নট টু বির সন্দেহ-সমুদ্রে দোদুল দোলায় দোলে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ডন কিকস্টও রয়েছে যে ক্ষণমাত্র চিন্তা না করে নাঙ-তলোয়ার হাতে নিয়ে যাকে তাকে তাড়া লাগায় আমরা যাকে বলি বার্কস আপ দি রঙ ষ্ট্রি–যে গাছে বেড়াল ওঠেনি তারই তলায় দাঁড়িয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে করতে থাকে ঘেউ ঘেউ।
বেচারী মেব্ল্। সে আমার ডন কিকসট রূপটাই চিনত। লণ্ডনে আস-আঁ–প্রভাসে কিছুটা ঘটলেই আমি তড়িঘড়ি অ্যাকশন নিয়ে তার একটা সমাধান করে দিতুম। ভুল যে করিনি তা নয়। একটা ঘটনার কথা বলি। আকসের বনে গিয়েছি মেব্ল্কে নিয়ে বেড়াতে। হঠাৎ শুনি নারীকণ্ঠে পরিত্রাহি চিৎকার। ছুটে গিয়ে দেখি এক ছোকরা একটা মেয়েকে জাবড়ে ধরে চুমো খাবার চেষ্টা করছে আর মেয়েটা বাপরে বাপ সে কী তীক্ষ্ণকষ্টে–চেঁচাচ্ছে। আমি ডন কিকসটের মতো ছোঁড়াটার কলারে ধরে দিলুম হ্যাঁচকা টান, তার গালে গোটা দুই চড়! মেয়েটা আমার দিকে তাকালে। আমি ভাবলুম, সে বুঝি আমার শিভালরির কদর জানাতে গিয়ে আমাকেই না চুমো খেয়ে বসে! কী হল জান, সোম? মেয়েটা দৃঢ়পদে এগিয়ে এল আমার কাছে। তারপর বলা নেই কওয়া নেই, দুহাত দিয়ে ঠাস ঠাস করে মারলে আমার গালে ছোঁড়াটার গালে নয় আমার গালে গণ্ডা পাঁচেক চড়! মোজাবুনুনির স্পীডে। আমি তো বিলকুল বেকুব। তারপর মেয়েটা ছোঁড়াটার হাত ধরে হনহন করে চলে গেল বনের ভিতর।
মেব্ল্ শেষ অঙ্কটা দেখতে পেয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে হাসছিল।
কী করে জানব, বলো, কোনটা প্রেমের ন্যাকরামোর চিৎকার আর কোনটা ধষর্ণভীতির সকরুণ আতাঁরব! একেই বলে বাকিঙ আপ দি রঙ ট্রী।
সেই আমি কলকাতার ডাক্তারদের শেষ রায় শুনে ফিরে এলুম মধুগঞ্জে। মেকে আদর না করে ঝুপ করে বসে পড়লুম ডেকচেয়ারে ঘণ্টা তিনেকের তরে। ডন তখন হ্যামলেটের রূপ নিতে আরম্ভ করছে। মেব্ল্ তখন আমার কপালে হাত বুলিয়ে আদর করেছিল–আমি সাড়া দিইনি।
সব কথা মেকে খুলে বলার প্রয়োজন হয়নি। কলকাতা থেকে ফিরে আসার পর আমি তার গাত্র স্পর্শ করছিনে দেখেই সে সমস্ত ব্যাপার নিশ্চয়ই বুঝে নিয়েছিল। পরের দিন ভোর বেলা দেখি, মেবল্ ঘরে নেই। বারান্দায় পেলুম তাকে, একটা মোড়ার উপর দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে বসে আছে। আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেবার সাহস পর্যন্ত করতে পারলুম না।
তোমাদের দেশে নাকি নিষ্কাম প্রেমের আদর্শ আছে। যৌনক্ষুধাকে অবহেলা করে তোমাদের বহুলোক জীবনধারণ করে। আমাদের দেশে যে একদম নেই সে কথা আমি বলছিনে। ক্যাথলিক পাদ্রী আর মিষ্টিকরা রমণী-সঙ্গ কামনা করে না, তোমাদের বিধবারা যে রকম যৌনক্ষুধার নিবৃত্ত করে থাকেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এঁরা সর্বপ্রকার প্রেমকেও কাটার মতো দেহ-মন থেকে তুলে দুরে ফেলে দেন। তাদের শুধু লড়তে হয় শারীরিক প্রলোভনের সঙ্গে। আমার বেলা তো তা নয়। আমি ভালোবাসতে পারি, বাসিও, কিন্তু শরীর দিয়ে বাসতে পারব না। সেও হয়তো অসম্ভব কঠিন মনে হত না যদি মেব্ল্ আর আমি একসঙ্গে প্রতিজ্ঞা করে নিতুম, আমরা আমাদের প্রেম দেহের স্তরে নিয়ে যাব না।
তোমার মনে আছে, সোম, তোমার আমার সামনে আমাদের জেলের একটা ঘটনা? স্বদেশী কয়েদীকে শেষ বিদায় দিতে এসেছে তার স্ত্রী, বাচ্চাকে কোলে করে। বাপ চেয়েছিল ছেলেকে কোলে নিতে, বাচ্চাটাও মায়ের কোল থেকে ঝাঁপ দিচ্ছিল বাপের দিকে। মাঝখানে লোহার জাল।
আমরা দুজনাই সে জায়গা ছেড়ে চলে এসেছিলুম। অবান্তর তবু যখন সুবাদটা এল তাই বলি, পরে আমার কাছে খবর এল, তুমি নাকি গোপনে তাদের মিলনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলে। খবরটা আমাদের দিয়েছিল জেলার আরো গোপনে তোমার বিরুদ্ধে আমাকে তাতানোর জন্য। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল ব্যাটাকে ধরে হান্টার নিয়ে তার ন্যাংটো পাছায় আচ্ছা করে চাবকাই। ভাষাটা একটু অস্র হল, না সোম? কিন্তু আমি তখন খুনিয়া রাগের মাথায় যে অভদ্র ভাষা মনে মনে ব্যবহার করেছিলুম, তারই স্বহু প্রকাশ দিলুম মাত্র। আহির মনকে মেনে নিয়েও ভণ্ডামি মেনে নিতে পারিনি সে কথা আমি পূর্বেই বলেছি। সে কথা থাক।
আমার অবস্থা তখন আরো কঠোর। আমার আর মেলের মাঝখানে যে জাল রয়েছে সেটা একদিন ছিন্ন হয়ে গেলে যেতেও পারে কলকাতার ডাক্তাররা সেই অতি ক্ষীণ আশাই দিয়েছিল এবং প্রতিদিন প্রতি রাত্রি সেই আশাই আমাকে মুখ ভেঙচিয়েছে।
নিষ্কাম প্রেমের কথায় ফিরে যাই। কাব্য যদি মানব-জীবনের দর্পণ হয় তবে শুধাই তোমাদের সে দর্পণে নিষ্কাম প্রেমের কতটুকু আভাস মেলে? রায়বাহাদুর কাশীশ্বর আমাকে দিয়েছিলেন দুখানি সংস্কৃত কাব্যের ইংরেজি অনুবাদ। মেঘদূত, আর গীতগোবিন্দ। (পর্নোগ্রাফি আর রিয়েল আর্টের মধ্যে তফাত কী তাই নিয়ে তখন একটা মোকদ্দমা চলছিল; রায়বাহাদুরের মতে মেঘদূত-গীতগোবিন্দ আর্ট আর মিসটিজ অব দি কোর্ট অব লণ্ডন অশ্লীল, যদিও তাতে শরীরের খুঁটিনাটি বর্ণনা অনেক, অনেক কম)। এই বই দুখানিতে কী নিষ্কাম প্রেমের ছড়াছড়ি? অন্য বইয়ে থাকতে পারে এই ভেবে আমি রায়বাহাদুরের দ্বারস্থ হই। তিনি কবুল জবাব দিয়ে বললেন, সংস্কৃতে নিষ্কাম প্রেমের বালাই নেই, সে বস্তু এসেছে মুসলমান আগমনের পর বাঙলা-হিন্দীতে। খবু সম্ভব সুফীদের নিষ্কাম প্রেম থেকে এ বস্তু এ-দেশে পাচার হয়েছে। আমি তা হলে বলব, তোমরা যতদিন ভিরাইল, বীৰ্বান ছিলে ততদিন নিষ্কাম প্রেম সম্বন্ধে ছিলে সম্পূর্ণ অচেতন। নিষ্কাম প্রেম অনৈসর্গিক। কিন্তু থাক তোমাদের দিসাস্য। আমি ক্রীস্টানের ছেলে। আমি বরঞ্চ বাইবেলে যাই।
আমি বিলক্ষণ জানি বুড়ো পাদ্রী তোমাকে অনেক বাইবেল উপহার দিয়েছেন, বদ্বার তোমাকে বইখানা পড়বার জন্য অনুরোধ করেছেন, কিন্তু তুমি পড়নি। কাজেই যে কটি লাইন তোমাকে শোনাব সেগুলো তুমি আগে কখনো শোননি।
How beautiful are thy feet with shoes. O prince’s daughter!! the joints of thy things are like jewels, the work of the hands of cunning workman.
Thy navel is like a round goblet, which wanteth not liquor: thy belly is like and heap of wheat set about with lilies.
Thy two breasts are like two young roes that are twins.
Thy neck is a tower of ivory : thine eyes like the fishpools in Heshbon, by the gate of Bathrabbim: thy nose is as the tower of Lebanon which looketh toward Demascus.
Thine head upon thee is like Carmel, and the hair of thine head like purple: the king is held in the galleries.
How fair and how pleasant are thou. O love for delights.
This thy stature is like to a palm tree, and thy breasts to clusters of grapes.
I said, I will go up to the palm tree, I will take hold of the boughs thereof: now also thy breasts shall be as clusters of the vine, and the smell of thy nose like apples;
And the roof of thy moutp like the best wine for my beloved, that goeth down sweetly, causing the lips of those that are asleep to speak.
I am beloved’s, and his desire is toward me.
কী গম্ভীর হাউ সাবলাইম! পাশবিক যৌনক্ষুধাকে সৃষ্টির কী মহিমময় অনিন্দ্যসুর নন্দনকাননে তুলে নিয়ে গেল তার স্বর্ণপক্ষ দিয়ে এ কবিতা!! এ যৌনক্ষুধা নন্দনের সুধায় সিঞ্চিত না থাকলে এর বর্ষণে ইন্দ্রপুরীর হাসি মুখে মেখে নিয়ে দেবশিশুরা মর্তে অবতীর্ণ হত কী করে?
বিরাট বাইবেলে এই একটিমাত্র প্রেমের কবিতা ছিটকে এসে পড়েছে। কী করে পড়ল তার সদুত্তর কোনো পণ্ডিত এখনো দিতে পারেননি। তাই বোধ করি তারা ধমক দিয়ে বলেন, এ প্রেম রূপক-রূপে নিতে হবে, এ প্রেমের সঙ্গে মানব-মানবীর প্রেমের কোনো সম্পর্ক নেই–এ প্রেম নাকি দি মিউচেল লাভ অব ক্রাইসট আণ্ড হিজ চার্চ বর্ণনা করেছে। চার্চের বড় কর্তা স্বয়ং পোপ। এখানে আমি পোপের স্বার্থান্বেষী করাঙ্গুলি-সঙ্কেত দেখতে পাই।
তোমাদের আদিরসাত্মক কামরসে-ঠাসা বৈষ্ণব কবিতাও নাকি শুধু বৈকুষ্ঠের দেবদেবীর জন্য। সেগুলোকেও নাকি প্রতীক হিসেবে নিতে হয়। এখানে কার স্বার্থ লুকানো আছে জানিনে।
আমি মানিনে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এ-সব কবিতা শব্দার্থে নিতে হবে। যৌন সম্পর্ক জীবনের অন্যতম গভীর সত্য। তাকে স্বীকার করে আমাদের কবিরা সত্যকে স্বীকার করেছেন মাত্র। এতে কোনো দুঃসাহস বা মৃঢ়তার প্রশ্ন ওঠে না। তোমাদের কোনো কোনো মন্দিরে যৌন সম্পর্কের নগ্ন প্রস্তরমূর্তি দেখে কেউ কেউ আশ্চর্য হয়। আমি হইনে। কাব্যে যে সত্য কবিরা অকুণ্ঠ ভাষায় বর্ণনা করে স্বীকৃতি দিয়েছেন, শিল্পী প্রস্তর-গাত্রে সেটা খোদাই করবে না কেন?
তুমি বলবে, এ-সব গুরুগম্ভীর তত্ত্বের টীকা-টিপ্পনি কাটার কী অধিকার আমার? অধিকার তবে কার? পুরু-পাণ্ডদের, পাত্রী-গোসাইদের? কিন্তু ভগবান তো তাদের পকেটের ভিতর। এসব তত্ত্বে তাদের কী প্রয়োজন? গীতগোবিন্দ বাইবেল এগুলো তো আমার মতো পাপীতাপীদের জন্য সৃষ্ট হয়েছে। যে ভক্ত ভগবানকে পেয়ে গিয়েছেন তিনি মন্দিরে যাবেন কী করতে? মন্দিরে তো যাব আমি। এ-সবের মূল্য যাচাই করব আমি, অর্থ বের করব আমি।
জীবনের এই গভীরতম রহস্যাবৃত সত্যের অত্যন্ত কাছে এসে পড়েছি বলেই কি আহির মন আমাকে এর অনুভূতি থেকে বঞ্চিত করল?
.
২০শে আগস্ট
পলে পলে তিলে তিলে কত যুগ ধরে আমি কি দহনে দগ্ধ হয়েছি, সে শুধু আমিই জানি। এ দহন কিন্তু সময়ের মাপকাঠি দিয়ে মাপা যায় না। বেদনা থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য তোমাদের সাধকেরা বলেন, বেদনা আসে মনের বটলনেকের ভিতর দিয়ে, সেই মনকে তুমি যদি আয়ত্তে আনতে পার তবে আর কোনো বেদনাবোধ থাকবে না। এ তত্ত্বটা আমি যাচাই করে দেখিনি, কারণ আমার মনে হয়েছে মনের বটলনেক যদি আমি বন্ধ করে দিয়ে বেদনা-বোধকে থামিয়ে দি, তবে সঙ্গে সঙ্গে আনন্দবোধের অনুভূতি আমার চৈতন্যে প্রবেশ করতে পারবে না। তার অর্থ সর্বপ্রকার অনুভূতি বিবর্জিত হয়ে জড়জগতে ইট পাথরের মতো শুদ্ধমাত্র খানিকটে স্পেস নিয়ে এগসিস্ট করা। তাহলে আত্মহত্যা করলেই হয়। পঞ্চভূতে পঞ্চভূত মিলে গিয়ে যে যার পরিমিত জায়গা দখল করে অস্তিত্ব বজায় রাখবে। তফাত কোথায়?
আমাদের গুণীরা বলেন, হৃদয়-বেদনা ভুলতে হলে কাজের মধ্যে ঝাঁপ দাও। মন তখন কাজে এমনি নিমগ্ন হয়ে যাবে যে, অন্য কিছু ভাবতে পারবে না। আমি তাই সেই সময়ে কাজে দিলুম ঝাঁপ। তোমার মনে আছে নিশ্চয়ই, আমি হঠাৎ কী রকম আমার এলাকার খুন-খারাবির আদমশুমারি নিয়ে উঠে পরে লেগেছিলুম, এলাকার বিরাট ম্যাপ তৈরি করে বদমায়েশির জায়গাগুলোতে চর কেটে কেটে তার কেন্দ্রস্থলের বদমায়েশকে ধরবার চেষ্টা করেছিলুম; দাগী আসামী জেল থেকে খালাস পেলেই তার গ্রামকে কেন্দ্র করে চতুর্দিকের গ্রামের চুরি-চামারির সংখ্যা বেড়ে যাওয়া থেকে তোমাদের কাছে প্রমাণ। করলুম, ঘড়েল বদমাইশ আপন গায়ে বদ কাজ করে না।
তাতে করে শুধু তোমাদের অতিষ্ঠ করে তোলা হয়েছিল। আমার কোনো লাভ হয়নি।
কাজের ভিতর সমস্ত দিন তুমি যে বেদনবোধকে বাধ দিয়ে আটকে রেখে ভাবলে বেঁচে গেছ, সে তখন কাজের অবসানে তোমার সকল বাধ ভেঙে লণ্ডভণ্ড করে দেয় তোমার সর্ব অস্তিত্বকে। পলে পলে তিলে তিলে দিনভর তুমি যদি তোমার বেদনা বোধকে নিয়ে পড়ে থাক, তাকে যদি কাজ কিংবা অন্য কোনো কৃত্রিম উপায়ে ঠেলিয়ে রাখার চেষ্টা না কর, তবে তার ইনটেনসিটি অনেকখানি কমে যায়। কিন্তু সলমনের বোতলে ভরা জিন যখন সন্ধ্যায় নিষ্কৃতি পায়, তখন তার বেধড় মার থেকে আর কোনো নিষ্কৃতি নেই।
সেই মার খেয়ে খেয়ে এপাশ ওপাশ করে করে যেন এগালে চড় খেয়ে ওপাশ হয়ে শুই–যেন ও গালে চড় খেয়ে এপাশ হয়ে শুই রাত বারোটায় এল ঘুম। কিন্তু শয়তান তোমায় নিষ্কৃতি দেবে কেন? ঘুম ভেঙে যাবে রাত দুটোয়।
পাশের খাটে মেব্ল্ শুয়ে। তার সোনালী ঢেউ-খেলানো এলো চুল চাঁদের আলোর সঙ্গে মিশে গিয়ে বালিশের উপর এঁকেছে বিচিত্র নক্সা। তার কপালে গামের একটু একটু ভেজার আভাস, চাঁদের আলো তারই উপর সামান্য চিকচিক করছে, বিলের ভেট’ ফুলের পাপড়ির উপর এই আলোই আমি অনেকবার দেখেছি ভাওয়ালির জানালা দিয়ে। মেবলের হাত দুখানি তার শরীরের দুদিকে আলসে লম্বমান হয়ে অর্ধমুষ্টিবদ্ধ যেন দুটি ভেট-ফুলের কুঁড়ি। আর তার সমস্ত কিশোর তনু যেন গাদা করে রাখা শিউলি ফুলের পাপড়ি-হ্যাঁ, মনে পড়ে গেল শিউলি ছিল মেবলের সবচেয়ে প্রিয় ফুল।
এই গরমের দেশে শীতের দেশের মেয়েকে চাঁদের আলোতে কী রকম অদ্ভুত, রহস্যময় দেখাত। আজ যদি হঠাৎ দেখি, আমার লিচুবনের ঘন সবুজের উপর গাদা গাদা সাদা বরফ জমেছে, তাহলে যে রকম সমস্ত বাগানখানা এক অবিশ্বাস্য সৌন্দর্যে ভরে উঠবে।
মেবলের এই নিশিকান্ত সৌন্দর্য আমার আত্মার ক্ষুধাকে অনির্বচনীয় তৃপ্তিতে কত শতবার ভরে দিয়েছে। আস্বচ্ছ ফিকে বেগুনি রঙের মসলিন নাইট-ড্রেসে জড়ানো মেলের শরীর আমার কবি-মানসের শুষ্ক মৎপাত্রকে অমৃতরসে বার বার ভরে দিয়েছে।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে জ্বালিয়ে দিত আমার সর্ব-ধমনীতে এক অদম্য যৌনক্ষুধা।
মনে আছে, সোম, তুমি আর আমি একদিন মফস্বলের এক গ্রামে নিষ্ক্রিয় ক্রোধে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলুম, সমস্ত গ্রামখানা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল–জল ছিল না। বলে আমরা নিষ্ফল আক্রোশে শুধু ছটফট করেছিলুম।
সে আগুন তবু ভালো। নিরন্ন বিধবার শেষ কথাখানি পুড়িয়ে দিয়ে সে আগুন তবু তো তৃপ্ত হল।
আমার এ বহ্নিজ্বালার শেষ নেই। পিরামিডের উপরে দাঁড়িয়ে আমি একদিন গ্রীষ্মের মধ্যাহ্নে সাহারার মরুভূমির দুরদিগন্তের শুষ্ক তৃষ্ণার দিকে তাকিয়েছিলুম, আর তার রুদ্রমূর্তি দেখে ভয়ে ভগবানের নাম পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিলুম। আহির মন আমার সর্বশরীরে সেই সাহারার জ্বালা জ্বালিয়ে দিল।
শরীরে এ জ্বালা নিয়ে মানুষ সমাজে মিশতে পারে না। আমি ক্লাবে যাওয়া বন্ধ করে দিলুম, লোকজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ কমিয়ে কমিয়ে শেষটায় একেবারে আলেকজাণ্ডার সালকাক হয়ে গেলুম। বিষ্ণুছড়া আর মাদামপুরের মেয়েদের ফোঁসফেঁসানি আর ছোবলাছুবলি থেকে বঞ্চিত হয়ে আমার কোনো কষ্ট হয়নি; কিন্তু পাত্রী টিলার মেয়েদের কলকল উহাস্য, তাদের লাজুক নয়নে আধা-প্রেমের ক্ষীণ আভাস আমার জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে তাকে করে দিল আরো ফাঁকা। কে যেন বলেছে, দি মোর লাইফ বিকামস এপটি দি হেভিয়ার ইট বিকামস টু ক্যারি ইট’। জীবন যতই ফাঁকা হয়ে যায়, তাকে বহন করা হয়ে যায় ততই শক্ত। বড় খাঁটি কথা বলেছে। তবু আমি জীবনের সেই শূন্য ধামা বইতে পারতুম, কিন্তু সে ধামার সর্বাঙ্গে ছিল বিছুটি।
খুব সম্ভব আমারই দেখাদেখি মেবুও বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিল। কী ভেবে বন্ধ করল জানিনে। তার মনের কথা কিন্তু আমি তোমাকে বোঝাতে যাব না। তার প্রতি আমি অবিচার করেছি কি না, তার বিচার একদিন হয়তো হবে, কিন্তু তার মনের কথা বলতে গিয়ে আমি যদি উনিশ-বিশ-করে ফেলি তবে সে অবিচার আমাকে কেউ ক্ষমা করবে না।
আমার ভিতরকার ডন কিকসট ক্রমে ক্রমে কাতর হতে হতে রোগশয্যায় পড়ল। আর আমি, ও-রেলি, আস্তে আস্তে হ্যামলেটের রূপ নিতে আরম্ভ করলুম। বরঞ্চ হ্যামলেট বক্তৃতা ঝাড়তে প্রচুর সামান্যতম প্রভোকেশনে সে বরবর করে নানা প্রকারের দার্শনিক রায় জাহির করত এন্তার তোমাদের যাত্রাগানে যে রকম ক্ষীণতম প্রভোকেশনে। নায়ক-নায়িকা দুরে থাক, পাইক-বরকন্দাজ পর্যন্ত লম্বা লম্বা গান গাইতে আরম্ভ করে। আমার মুখের কথাও শুকিয়ে গেল।
বেচারী মেবল্। গোড়ার দিকে সে আস-কথা পাশ কথা বলে বলে আমাকে আমার কচ্ছপের খোলের ভিতর থেকে বের করবার চেষ্টা করেছিল; শেষটায় সে চেষ্টাও ছেড়ে দিলে।
তখন আমি খেতে আরম্ভ করলুম মদ। মাস তিনেক দিনরাত্তির আমি ভাম হয়ে পড়ে থাকতুম। বাটলার জয়সূর্য, যে কি না বানেশ্বরী মালের পাট জলের মতো ঢকঢক করে গিলতে পারে, সে পর্যন্ত আমার পানের বহর দেখে রীতিমত ঘাবড়ে গেল। কখনো বলে হুইস্কি ফুরিয়ে গেয়েছে, কখনো বলে সোডা নেই। তারপর একদিন মাতাল হয়ে তার গালে মারলুম ঠাশ ঠাশ করে চড়। সম্বিত ফিরে বড় লজ্জা পেয়েছিলাম, সোম। আমি কি অশিক্ষিত বকস্ওয়ালা যে আমি এ রকম অন্যায় আচরণ করব?
মদ খেয়ে লাভ হয়নি। মদ খেলে মানুষের যৌনক্ষুধা উগ্রতর হয়, তৃপ্তির ক্ষমতা কমে যায়। আমার অতৃপ্তির আক্ষোভ তাই মদ খেয়ে কখনো কখনো বিকট রূপ ধরেছিল। তার কথা বলতে আমার ঘেন্না ধরে।
কিন্তু আসল কথাটা আমি শুধু এড়িয়েই যাচ্ছি। আমি শুধু বোঝাতে চাই, অমি কী কঠোর যন্ত্রণার ভিতর আমার জীবনটা কাটালুম, আর সেইটে কিছুতেই প্রকাশ করতে পারছিনে। কিন্তু এ দুর্দৈবে আমি একা নই। তোমার মনে আছে চৌধুরীর কেসটা? ভদ্রলোক কী শান্ত, দয়ালু প্রকৃতির, গরীব-দুঃখীদের ভিতর তার দান-খয়রাতের কথা কে না জানে? আর কী অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন তার স্ত্রী। দেখে মনে হত অনন্তযৌবনা–তাঁর ছেলেমেয়ে হয়নি। তার ঘাড়টির কথা তোমার মনে পড়ে কি? রাজধানীর গর্বনিয়ে যেন সে ঘাড় তার মাথাটি তুলে ধরত। একদিন তার সে খাড় নিচু হয়েছিল–আমি অবশ্য স্বচক্ষে দেখিনি। তার স্বামী যেদিন হোমোসেকসুয়েল কেসে ধরা পড়লেন।
আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারিনি এ রকম সাধুলোক কী করে এ রকম নোংরামি করতে পারে। তিনি নিজে আমার খাশ-কামরায় স্বীকার করেছিলেন বলেই শেষটায় আমার প্রত্যয় হল।
কী বিড়ম্বিত জীবন! ভগবান ভদ্রলোককে স্বাভাবিক যৌনক্ষুধা দেননি। তার অনৈসর্গিক যৌনক্ষুধাকে তিনি অদ্ভুত বিক্রমে কত বৎসর চেপে রেখে রেখে হঠাৎ একদিন কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে কুকর্মটা করে ফেললেন শুনেছি তোমাদের সাধু-সন্ন্যাসীদের মধ্যেও দৈবাৎ কখনো এরকম ধারা হয়েছে। সে ঘটনা বলতে গিয়ে ভদ্রলোকের মুখে যে আত্মবমাননার প্রকাশ দেখেছিলুম, তার দাগ আমার মন থেকে কখনো উঠবে না। ভদ্রলোক শেষটায় বলেছিলেন,’আমাকে এখন সমাজঘেন্না করবে,কুষ্ঠরোগীকে মানুষ যেরকম বর্জন করে চলে। আমি সমাজের জন্য কী করেছি, সেকথা স্মরণ করবে না– আমি তাকে দোষও দিইনে কিন্তু আমার সতী-সাধ্বী স্ত্রী, যিনি ভাবতেন আমি ধ্যান ধারণায় আত্মসমর্পণ করেছি বলে তাকে অবহেলা করি, যার পুত্রোৎপাদন-ঈপ্সাকে পর্যন্ত আমি সম্মান দিইনি, তিনি কী ভাববেন?
.
ওঃ? এ কেসটা ধামাচাপা দিতে তোমাকে কী বেগই না পেতে হয়েছিল। রায়বাহাদুর কাশীর যদি অযাচিতভাবে গুহ্য সন্ধিসুড়ক আমাদের বাতলে দিতেন, তবে আমরা চৌধুরীকে বাঁচাতে পারতাম না। কিন্তু আমার বিস্ময়ের অবধি নেই, হিন্দু সমাজের বিরাট পাণ্ডা রায়বাহাদুর কী করে এতখানি দরাজ-দিল হলেন। তবে হ্যাঁ শুনেছি, তোমাদের সাধু-সন্ন্যাসীর ভিতরও এরকম কিছু একটা হলে অন্য সন্ন্যাসীরা তাকে খুন করে না। হিমালয়ের উত্তর প্রদেশে তাকে পাঠিয়ে দেয়। তোমাদের ধর্ম সত্যই বড় অদ্ভুত। কত শতাব্দীর অভিজ্ঞতার ফলে তোমাদের সাধুরা কত সত্য আবিষ্কার করেছে, আর তার থেকে পেয়েছে অন্তহীন সহিষ্ণুতা।
তুমি হয়তো জান না, চৌধুরী আমাকে এখনো দক্ষিণের এক আশ্রম থেকে মাঝে মাঝে চিঠি লেখে। শুনে খুশী হবে তার স্ত্রী তার সঙ্গে আছেন।
দু বৎসর কঠোর সংযমে নিজেকে মেলের কাছ থেকে দূরে রেখে এক গভীর রাত্রে নিজেকে সামলাতে না পেরে আমি তার কাছে যাই। কী হয়েছিল, তোমাকে বোঝাবার চেষ্টা করবনা।
সেই রাত্রে ভোরের দিকে মেবল্ জয়সূর্যের ঘরে যায়। সেই ভোরেই সে আমার পায়ের উপর তার মাথা রেখে অনেকক্ষণ ধরে কেঁদেছিল। তার চুল ভিজে গিয়েছিল, আর পা ভিজে গিয়েছিল। আমাদের দুজনের মুখ দিয়ে কোনো কথাই বেরয়নি।
থাক।
.
২২ শে আগস্ট
মে যদি মরে যেত, তবে কি আমার এর চেয়ে বেশী কষ্ট হত? বলতে পারব না। হঠাৎ যদি আমি অন্ধ হয়ে যেতুম, তাহলে কি বেশী কষ্ট পেতুম? বলতে পারব না। তখনো বলতে পারিনি, আজও পারব না।
আমি বিমুটের মতো বসে কয়েক দিন কাটাই।
আমার মনে হয় বড় শোক যখন আসে, তখন অনেক ক্ষেত্রেও মানুষ প্রথম ধাক্কাতেই তার বেদনা পূর্ণরূপে উপলদ্ধি করতে পারে না। আস্তে আস্তে যেমন যেমন দিন যায়,সঙ্গে সঙ্গে অসহায় হরিণ শিশুর শরীরকে ঘিরে যেন পাইথনের পাশ একটার পর একটা করে বাড়তে থাকে শুনেছি, সে নাকি তখন আর আর্তস্বরে চিৎকার পর্যন্ত করে না। শেষ পাশদেওয়ার পরে পাইথন লাগায় আস্তে আস্তে চাপ। আমি কখনো দেখিনি। আমার মনে প্রশ্ন জাগে, হরিণ কি আমার চেয়ে বেশী কষ্ট পায়?
ফাঁসির আসামীও ঘুমোয়। ঘুম থেকে ওঠা মাত্রই নাকি তার মনে পড়ে অমুক দিন তার ফাঁসি। নিদ্রার কোল থেকে প্রাণ-রস যুগিয়ে নিয়ে মানব-শিশু যখন জাগলে, তখনই তার স্মরণ এল, সেই প্রাণটি তার অমুক দিন যাবে। পড়েছি, কোমর অবধি পুঁতে মানুষকে যখন পাথর ছুঁড়ে খুঁড়ে বধ করা হয়, তখন প্রথম কয়েকটা পাথরের ঘা খেয়েই সে নাকি অজ্ঞান হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। চতুর্দিকের নরদানবরা তখন নাকি তাড়িতাড়ি ছুটে এসে জল দিয়ে তাকেচৈতন্যে নিয়ে আসে। সম্বিতে ফিরে এসে সে নাকি প্রথমটায় বুঝতে পারেনা, সে কোথায় ট্রেনে ঘুম ভাঙলে আমরা যে রকম প্রথমটায় বুঝতে পারিনে আমরা কোথায়। তারপর আবার দুসরা কিস্তির প্রথম পাথরের ঘা খেয়েই নাকি সে সেই নির্মম সত্য বুঝতে পারে, তাকে পাথর ছুঁড়ে দুরে মারা হচ্ছে। বর্ণনায় পড়েছি, তাকে নাকি অন্তত বারপাঁচেক এক রকম সম্বিতে ফিরেয়ে এনে মারা হয়।
শুনেছি, যে লোক যতটা খুন করে, চীন দেশে নাকি তার ততবার ফাঁসি হয়। কিন্তু ফাঁসি একবারের বেশী হতে পারে কী করে? তোমরা এই নিয়ে একটা ঠাট্টা করো না, অমুক লোকটার তিন মাসের ফাঁসি? কিন্তু তাও হয়। বিদগ্ধ চীনেরা তারও একটা সূক্ষ্ম প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেছে। আসামীর গলায় ফাঁস দিয়ে আস্তে আস্তে তার দম বন্ধ করে আনতে আনতে তাকে অজ্ঞান করে ফেলা হয়। অজ্ঞান হওয়া মাত্রই ফাঁস ঢিলে করে দিয়ে জল ঢেলে, হওয়া করে তাকে ফের সম্বিতে আনা হয়। যে যতবার খুন করেছে, তার উপর এই প্রক্রিয়া তবার চলে। প্রতিবার সম্বিতে আসামাত্র তার কী মনে হয় ভেবে দেখো।
ধন্য সে-সব লেখক, যারা এসব মর্মাস্তিক ব্যপারে রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা করেছেন। আমার মনে হয়, হয় তারা স্যাডিস্ট, নয় তারা আপন জীবনে, আমারই মতো কোনো । এক কিংবা একাধিক নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে গিয়েছেন।
এখনো বলছি, শারীরিক ফাঁসির সংখ্যার একটা সীমানা আছে। পাঁচ-সাত বার করার পর আসামী নিশ্চিয়ই আর সম্বিতে ফিরে আসে না অচৈতন্য অবস্থা থেকে মৃত্যুর অতল গহ্বরে ডুবে যায়। কিন্তু মনের ফাঁসি, আত্মার ফাঁসির সীমাসংখ্যা নেই। বাইরে প্রকৃতিতে যে রকম রেণুতে রেণুতে প্রতিক্ষণ কোটি কোটি নবজন্মের সৃষ্টি একই মানুষ সেই রকম ভিতরে ভিতরে মরে কোটি কোটি বার। এবং প্রতি দুই মৃত্যুর ভিতর যে সম্বিত, তখন সে সম্বিত শুধু তাকে জানিয়ে দেবার জন্য, এই শেষ নয়, এই মৃত্যুযন্ত্রণাই শেষ মৃত্যুযন্ত্রণা নয়, আরো অনেকগুলো সম্মুখে রয়েছে।
এসব অভিজ্ঞতার সত্যতা সম্বন্ধে তোমার মনে যদি কোনো সন্দেহ থাকে তবে তারই একটা ক্ষুদ্রতর দৃষ্টান্ত আমিতোমাকে দিতে পারি যেখানে তুমি এ-সব অভিজ্ঞতার ক্ষীণতর রূপ খানিকটে যাচাই করে নিতে পারবে।
কোনো কোনো রুগীকে সারাবার জন্য তিন তিন বার অজ্ঞান করে অপারেশন করতে হয়। প্রথমবারে সে অতটা ডরায় না, কিন্তু প্রথম এবং দ্বিতীয় বারের মধ্যে কয়েকখানি, এবং দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বারের মধ্যে কয়েক সপ্তাহ তার কী করে কেটেছিল, সে কথা তুমি তাদের কাউকে জিজ্ঞেস করলে অনায়সেই জেনে যাবে। তিন বারের পরও যদি সে না পারে, তখন, জান সোম, সে আর দ্বিতীয় কিস্তিতে চতুর্থ বারের মতো অপারেশন করাতে সম্মত হয় না। অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করে, এদিক ওদিক লুটতে লুটতে খাট থেকে পড়ে গিয়ে যন্ত্রণা এড়াবার জন্য আত্মহত্যা করবে বলে আকুতি মিনতি করে বিষের জন্য, কিন্তু তবু আবার অপারেশন করাতে রাজী হয় না। তার সর্বক্ষণ মনে পড়ে, প্রথম অপারেশনের ক্লোরোফর্মের জড় নেশা কেটে যাওয়ার পর সে কী অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করেছিল, চিৎকার করার শক্তি পর্যন্ত ছিল না, গোঙরাতে গোঙরাতে মুখ দিয়ে শুধু ফেনা বের করেছিল।
সোম,আমার কিন্তু নিষ্কৃতি ছিল না। চিন্ময় বেদনার জগতে কোনো সরকারী আইন নেই,ডাক্তারী কোড নেই যে রোগীর বিনা অনুমতিতে তার অপারেশন করতে পারবে না। আমার মুখের প্রথম অপারেশনের ফেনা শুঁকতে না শুঁকতেই আমাকে সেই দুশমনের মতো যমদূতদর্শন ডোমেরা টেনে নিয়ে যেত অপারেশন ঘরের দিকে। সেখানে আমাকে অপারেশন করা হত অষ্টাদশ শতাব্দরি পদ্ধতিতে–যখন ক্লোরোফর্ম আবিষ্কৃত হয়নি। তারা আমাকে দুপায়ে তুলে ধরে মাথার উপর ঘোরতে ঘোরাতে ভিরমি খাইয়ে কিংবা তাতেও না হলে মাথায় ডাঙশ মেরে অজ্ঞান করে অপারেশনের জন্য তৈরি করত। ছুরির ঘা ক্লোরোফর্মের নেশাকে কাটতে পারে না বলে আজকের দিনে অপারেশন চলে রোগীকে যন্ত্রণা না দিয়ে। আমার বেলা কিন্তু ছুরির ঘা আমাকে সম্বিত ফিরে নিয়ে আসত আর আমি সজ্ঞানে দেখলুম, আমার উপর ছুরি চলছে। পাছে আমার বিকৃত চিৎকারে সার্জেন্টদের অপারেশন করাতে বাধা জন্মায় তাই ডোমরা আমার মুখ চেপে ধরে রাখত। গুঙরে গুঙরে শরীর যে তার টরচার থেকে খানিকটে–সে কত অল্প-নিষ্কৃতি পাবে তার সর্ব পন্থা বন্ধ।
চোখের সামনে মেব্ল্কে দেখতে হত প্রতিদিন।
কেন আমি তাকে খুন করলুম না প্রথম দিনই?
কিন্তু তার দোষ কী? সে তো আর আমাকে ত্যাগ করে ঐ বাটলারটাকে গ্রহণ করেনি। বদ্ধ পাগলও আমাদের দুজনকে একাসনে বসিয়ে বিচার করবে না। আমার মনে হয় বহু বাজারের মেয়েও তাকে ঘরে ঢুকতে দেবে না। কোথায় সে আর কোথায় আমি।
ঐখানেই তো ভুল। জয়সুর্যের থাকবার মতো কিছুই নেই, সত্য, কিন্তু তার একটা সম্পদ আছে যেটা আমার নেই। সে সম্পদ কুকুরবেড়ালেরও থাকে, সে কথা বলে লাভ কী? যে মানুষ দু মিনিট বাদে মরবে তাকে কি এই বলে সান্ত্বনা দেওয়া যায়, তুমি মরে যাবার পরও অনেক কুকুরবেড়ালও বেঁচে থাকবে, তাই বলে কি তাদের বাঁচাটা তোমার মরার চেয়ে বড়? মেবল্ তো নিয়েছিলো মাত্র এইটুকুই। তাকে ও জিনিস যে কোনো পুরুষই দিতে পারত। ক্ষুধার তাড়নায় মানুষ যে রকম নর্দমা থেকে বুটে তুলে তুলে ভাত খায়। তাকে কি আমরা দোষ দিই?
গোড়ার দিকে আচ্ছন্নের মতো বসে বসে এই সব চিন্তা করেছিলাম কিন্তু তখন সব ছিল ভেঁড়াছোঁড়া! কোনো বিশেষ চিত্তা বা যুক্তি নিয়ে সেটাকেযে তার চরম ফৈসালায় ফেলে গ্রহণ বা বর্জন করব সে শক্তি আমার ছিল না। ফড়িঙের মতো আমার মন এ-ঘাস থেকে ও-ঘাসে ক্ষণে ক্ষণে লাফ দিত, কোনো জায়গায় স্থির হয়ে বসে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারত না। আজও যে পারি তা নয়। তবে কয়েকমাসের জন্য একবার পেয়েছিলুম, এমন কি সেই অনুযায়ী কাজও করেছিলু, এবং সেইটে বলবার জন্যই তো এই চিঠি লেখা। সে কথা পরে হবে।
সব জেনে বুঝেও আমার মন অহরহ এক অন্ধ আক্রোশে ভরে থাকত।
তুমি তো জানো আমাদের সিভিল সার্জন আর্মস্ট্রঙের মেম তার ছোঁকড়া আরদালিটাকে মোটর-সাইক্ল কিনে দিয়েছিল। এ শহরে কে জানতনা তার রসময় কারণ। ওদিকে আর্মস্ট্রঙ তো আমার মতো মন্দভাগ্য ছিল না? মেম যখন ভারতীয় তাগড়া ছোকরার বাদামী রঙ, কালো চুল আর প্রাচ্যদেশীয় বর্বর চোখের (মাফ করো সোম, আমি তোমাকে অপমান করছিনে,কিন্তু আমার বিশ্বাস, তোমার দেশে খানদানীরা যে রকম আমাদের তুলনায় ঢের বেশী মার্জিত, ঠিক তেমনি তোমাদের চাষা-ভূষোরা আমাদের মজুরদের চেয়ে অনেক বেশী প্রিমিটিভ অনেক বেশী সেকসি) প্রাণ-মাতানো নেশায় মজে গেল, তখন গোরার দিক আমস্ট্রং বেশ কিছুটা চোটপাট করেছিল। এমন কি, আমার মনে হয়ে সে ইচ্ছে করলে আরদালিটাকে তাড়িয়ে দিতে পারত-মেম আর কী করতে পারত। কিন্তু সে করেনি। আমার মনে হয়, প্রাণবন্ত স্বাভাবিক যৌনশক্তিশালী পুরুষ এসব ব্যাপারে অনকেখানি ক্ষমাশীল হয় টু হেল চুলোয় যাকগে, বলে সে শাস্তুমনে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় ফিরে যায়। ঠিক কথা, কারণ আর্মস্ট্রঙ গিয়েছিল তেরিয়া হয়ে, উইথ ভেজেস। ঐ যে, কী সে বকওয়ালাটার নাম যে তার টিলায় কুলী মেয়েদের হারেম পুষত? আমস্ট্র তো প্রায়ই ওদিক পানে না-পাত্তা হয়ে যেত।
আবার দেখো, কিছুদিন পরে সায়েব মেম দুজনাতে ফের বেশ ভাব হয়ে গেল। আরদালি যে বরখাস্ত হল তা নয়, আর্মস্ট্রঙের হারেমগনও বন্ধ হল না। ক্লাবে যেন তখন এক সুরসিক বলেছিল, সিভিল সার্জন পরিবার দিশী-বিদেশী দুই খানাই পছন্দ করেন।
এ হল প্রাণবন্ত নরনারীর স্বাভাবিক সৌভাগ্য–তারা একটা মডুস ডিভেণ্ডি, বেঁচে থাকার পন্থা খুঁজে নিতে পারে। পুরুষ কিংবা স্ত্রী সেখানে কেউই পদদলিত কিংবা অপমানিত হয় নি। অপামান, আমার মনে হয়, আত্মার মৃত্যু। আর আত্মা যখন মরে যায় তখন মানুষ হয়ে যায় পশু নির্মম জিঘাংসু এবং মারাত্মক পশু, কারণ আত্ম মরে গেলেও তার থেকে যায় বুদ্ধিবৃত্তি, যে বুদ্ধিবৃদ্ধি পশুর নেই। সে তখন হয়ে যায় হাইড। যত রকম পাশবিক, নারকীয় জঘন্য পাপ তখন সে করতে পারে তার আহির-মনীয় বুদ্ধি, ছলচাতুরী দিয়ে।
আমারও তাই হয়েছিল। কিন্তু তার সব কথা বলার সময় এখনো আসেনি।
ঐ সময়ের অনেক কিছুই আমার মনে পড়ছে। তার একটা তোমাকে বলি।
জানো তো, পাদ্রী জোনস গুঁড়ি-গুডি লোক তোমরা যাকে বলো, ভালোমানুষ’। ধার্মিক লোক আকসারই তাই হয়। যদিও তার অজানা ছিল না যে আমি তাকে পন্তি বর্জন করেছি, তবু ভদ্রলোক রাস্তায় একদিন বেমক্কা দেখা হয়ে যাওয়াতে আমার সঙ্গ নিল আমি তো তাকে গুড ইভনিং বলে কেটে পড়ার চেষ্টাই করেছিলুম। আমি যে আশাস্তিতে আছি সে তো তার অজানা ছিল না, কিন্তু সে অবস্থাতে যে পাদ্রীর উপদেশে কোনো ফললাভ হয় না, সে তত্ত্বও তিনি জানতেন না।
ইতি-উতি ডোন্ট পোর্ক ইয়োর নোজ ইন মাই অ্যাফেয়ার্স, (আপন চরকায় তেল দাওগে-এর তুলনায় অনেক মোলায়েম) এটা শোনার জন্য বেশ তৈরী হয়েই ভদ্রালোক আমাকে বললে, যার মর্মার্থ, ইতি-উতিটা বাদ দিয়ে বলছি সাদামাটা ভাষায়ই তোমার কী বেদনা তা আমি জানি না। কিন্তু জানি, তুমি সুশীল ছেলে,তুমি ধর্মভীরু। তাই বলছি, ভগবান যদি তোমাকে অসুখী করে থাকেন তবে নিশ্চয়ই তার কোনো কারণ আছে। যখন সে যুক্তি আমরা খুঁজে পাচ্ছিনে তখন তুমি এই ভেবে মনকে সান্ত্বনা দাও না কেন যে,আমার তোমার চেয়েও অসুখী লোক এ সংসারে আছে।
সারমন্টার মধ্যে খানিকটে সত্য আছে নিশ্চয়ই। ঐ যে আমাদের বাদরটা হার্ভে,কী কুচ্ছিত তার চেহারা, আর তার বিদঘুঁটে জামাকাপড় আর চলন বলন। ক্লাবে কোনো মেয়ে তার সঙ্গে কথা কইতে চায় না, তার গা থেকে যা দুর্গন্ধ বেরোয় তাতে আমারই নাক চেপে বাপ বাপ করে পালাই। খাস খানদানী ইংরেজদের বাচ্চা,পাদ্রী টিলার যে কোন মেয়ে তাকে বিয়ে করে যাতে উঠতে পারে কিন্তু বেচারীর কী দুরবস্থা! সেখানেও ত্রিসমারের বাত্তিরে গিয়ে পাত্তা পায়নি-কোন মেয়ে তার সঙ্গে নাচেনি। নেচেছিলেন একমাত্র বুড়ী পাদ্রী-মেম। তার কথা আলাদা, তিনি অসাধারণ নারী।
আমি সে রাত্রে ক্লাব এড়াবার জন্যে পাত্রী টিলায় গিয়েছিলুম। মেয়েরা যা খুশি হয়েছিল তার স্মৃতি চিরকাল আমার মনের মধ্যে রইল। সেই আনন্দ সর্বাঙ্গে তরের মতো মেখে নিয়ে যখন বাড়ি ফিরছি, তখন দেখি হার্ভে তার মুখে দে আর গ্লানি থ গতিতে বাড়ি ফিরছে।
আমি বড় কষ্ট পেয়েছিলুম, কিন্তু, জান সান্ত্বনাও পেয়েছিলুম পাদ্রীর সামনের কথা ভেবে যে, আমার চেয়েও দুঃখ এ সংসারে আছে। বাড়িতে, আমার বুকের ভিতর যে জ্বালা জ্বলে জ্বলুক; কিন্তু সমাজ তো আমাকে ঘেন্না করে না।
এই সান্ত্বনা নিয়ে যখন বাড়ি ফিরলুম তখন দেখি, টেবিলের উপর একটা ক্রিসমাস প্যাকেট খুলে দেখি হাউসম্যানের কবিতার বই। আমার বন্ধু আর্নল্ড পাঠিয়েছে। ও বই আমি সে রাত্তিরে পেতুম না, কারণ সেদিন মধুগঞ্জে ডাক বিলি হয় না। কিন্তু পোস্টমাস্টার লাহিড়ী গভীর রাত্রেও ইংরেজদের ক্রিসমাস ডাক বিতরণ করাত।
কবিতার বই যেখানে খুশি পড়া যায়। খুলতেই চোখে পড়ল,
Little is the luck I’ve had
and oh, tis comfort smmall
To think that many another lad
Has had no luck at all.
যে সান্ত্বনাটুকু নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলুম, সেই মুহূর্তেই সেটি অন্তর্ধান করল। আর্নল্ড নয়, পাঠিয়েছিল আহির মন।
.
২৫শে আগস্ট
সব খবরই ক্রমে ক্রমে ক্লাব-বাড়িতে পৌঁছেছিল সে কথা আমি জানি, কি চেহারা নিয়ে পৌঁছেছিল সে কথা বলতে পারব না। একই ঘটনা স্বচক্ষে দেখে দুই সত্যবাদী লোক যে কি রকম ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা দিতে পারে সে সত্য, পুলিশের লোক হিসেবে, আমরা বেশ ভালো করেই জানি এবং সেই অমিলের ফাঁক দিয়েই যে আসামী নিষ্কৃতি পায় সে তত্ত্বও আমাদের অজানা নয়।
আণ্ডাঘর আমাকে বেকসুর খালাস হয়তো দেয়নি, কিন্তু একটা বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ হলুম যে, এ ব্যাপার নিয়ে ক্লাবের মুরুব্বিরা বেশী নাড়াচাড়া করতে তো চানইনি, যতদূর সম্ভব ধামাচাপা দেবার চেষ্টাও করেছিলেন। এ স্থলে যে তারা ঘুমন্ত কুকুরটাকে শুধুমাত্র জাগাতে চাননি তাই নয়। বার্কিং ডগটাকে পর্যন্ত স্ট্রাল করতে চেষ্টা করেছিলেন এবং অনেকখানি সক্ষমও হয়েছিলেন।
বক্সওয়ালাদের নিয়ে আমিও বেখেয়ালে আর পাঁচজনের মতো ছোট খাটো ঠাট্টা রসিকতা করেছি, কি যখনই তলিয়ে দেখেছি, তখনি মনের ভিতর লজ্জা পেয়েছি। বক্সওলাদের তুলনায় আমি ভদ্র সমাজের উচ্চশ্রেণীর লোক, আর এ সংসারের রীতি, দৈবদুর্বিপাকে বড়র যখন মাথা নিচু হয় তখন ছোট তাই দেখে হাসে। সার্ভ হিম রাইট, বেশ হয়েছে, খুব হয়েছে, তার মুখে তখন ঐ এক কথা। এই নিয়ে বাংলায়ও একটা জোরদার প্রবাদ আছে, সেটা নিশ্চয়ই তোমার জানা, কারণ বাংলা শেখার সময় তুমিই আমাকে এই প্রবাদের বইখানা দিয়েছিলে। বাঙলাটা আমার আর মনে নাই, তাই ইংরিজীটাই দিচ্ছি। হুয়েন দি এলিফেন্ট সিকস ইন টু দি মায়ার, ইভন দি ফ্রগ গিভ হিম এ কি। আমাদের দেশের তুলনায় তোমাদের দেশে বড়-ছোটর পার্থক্য অনেক বেশী তাই বোধ করি তোমাদের তুলনাটায় প্রতিহিংসা-প্রবৃত্তিটা ফুটে উঠেছে বেশী।
ক্লাব বাড়ির কোনো কোনো ব্যাঙ নিশ্চয়ই আমাকে লাথি মেরেছে, কিন্তু সেখানকার গণ্ডার, হিপো, অর্থাৎ মাদামপুর বিষ্ণুছড়া তাদের জিভের লকলকানি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এর জন্য ওঁদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত নয় কি?
তবে দেখো, আহুর মজদাও হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি। আহির মনের কুর সর্পদংশনে আমার অন্তরাত্না যাতে করে জর্জরিত না হয়ে যায় তাই তিনি আমার ধনীতে ঢেলে দেবার চেষ্টা করলেন ক্লাব বাড়ির অযাচিত হৃদয়তার সঞ্জীবনী সুধারস।
কিন্তু জান, সোম, শক্ত ব্যামোতে ওষুধ যদি ঠিক মাত্রায় না দেওয়া হয় তবে ফল হয় উলটো। বিষ তখন সেই ওষুধ থেকে নূতন শক্তি সঞ্চয় করে নেয়। বীজাণুকে সিদ্ধ করে মারতে গিয়ে তুমি যদি জল যথেষ্ট না ফোঁটাও তবে জল আরো বেশী বিষিয়ে ওঠে। আমার বেলা হল তাই, এবং সেই জিনিসটাই আমার জীবনের মোড় ফিরিয়ে দিল। আহির মন আমাকে তার দাসানুদাস করে ফেলল।
আমি ক্লাব বাড়ির সদাশয়তা না দেখে, উপলদ্ধি করলুম, সংসারে যত বড় অন্যায় অবিচার হোক না কেন, ধর্মের অনাচার অধর্মের যতই প্রসার হোক না কেন, একদল লোক সেটাকে চাপা দেবার জন্যে উঠে পড়ে লেগে যায়। এবং আশ্চর্য, তারা যে অসাধু তাও নয়। মাদামপুর বিষ্ণুছড়া এরা দুজনাই অতিশয় সহৃদয় ভদ্রলোক। এ পাপ ছড়িয়ে পড়লে অর্থাৎ আমাদের কেলেঙ্কারির কথা রাষ্ট্র হলে, উইরোপীয় সমাজের অকল্যাণ হবে এই আশঙ্কায় তারা সেটা চেপে রেখেছিলেন।
অর্থাৎ পাপ করলেই পুণ্যাত্মা তোমাকে ধরিয়ে দেবে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যেমন আমার বেলায়–সজ্জনরা সে পাপ লুকিয়ে রাখবার চেষ্টা করলেন।
এ-সম্বন্ধে বাকি কথা পরে হবে।
তুমি তখন ছুটি নিয়ে কাশী না গয়ায় কোথায় গিয়েছ।
এদিকে মধুগঞ্জে এল বন্যা।
দিন সাতেক ঝমাঝম বৃষ্টি। তারপর দিন তিনেক পিটির-পিটির। তাই নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই, কারণ আমাদের বছরের বরাদ্দ একশ বিশ ইঞ্চির তখনো একশ ইঞ্চি হয়নি। এমন সময় কোনো রকমের পূর্বাভাস না দিয়ে পাহাড় থেকে হুড়হুড় করে নেমে এল সাত-হাত-উঁচু জলের এক ধাক্কা। সঙ্গে নিয় এল বিরাট গাছের গুঁড়ি আর কুড়েঘরের আস্ত চাল। তার উপর আকড়ে ধরে আছে মৃত্যুভয়ে কম্পমান শত শত নরনারী, পশুপাখী, এমন কি, সাপ-বিচ্ছুও সকলের সম্মুখেই মৃত্যু যখন সশরীর বর্তমান মানুষ। তখন সাপকে মারে না, সাপ মানুষকে কামড়ায় না। ক্ষুধার উদ্রেকও নিশ্চয় তখন হয় না–একই বাঁশের উপর আমি তখন সাপের কাছে ইঁদুরকে বসে থাকতে দেখেছি। আর জলের তাড়া খেয়ে সাপ তো আমার ডিঙিতে আশ্রয় নিতে এসেছে কত গণ্ডা–ওদিকে মাঝিরা লগি দিয়ে জলে ঝপাঝপ মার লাগাচ্ছে তারা যেন না আসে তবু আসবেই।
মৃত্যভয়ে শঙ্কিত নরনারী উদ্ধারের জন্য চিৎকার পর্যন্ত করছে না। গোড়ার দিকে নিশ্চয়ই করেছিল। এখন বোধ হয় গলা ভেঙ্গে গিয়েছে। আর বাঁচাবে কে? যে কখানা নৌকো ভেসে যাচ্ছে, সেগুলো মানুষের ভারে এই ডোবে কি ঐ ডোবে। যে লোকগুলো নৌকোয় আশ্রয় পেয়েছে তারা আসন্ন মৃত্যু থেকে রক্ষা পেয়ে গিয়েছে বলা কঠিন। আর একটি মাত্র শিশুকেই তারা নৌকোয় স্থান দিতে নারাজ।
জলের উপর দিবারাত্র ভেসে চলেছে অগুনতি মড়া। গোরু, বাছুর, শেয়াল, কুকুর, মোষ-হাতি পর্যন্ত। ভেবে আমি কুলকিনারাই পেলাম না, পাহাড়ের উপর কতখানি তোড়ে জলের স্রোত নেমে আসলে একটা হাতি পর্যন্ত বেকাবু হয়ে নদীর জলে ভেসে এসেছে। একটা হাতি কোনো গতিকে সাঁতার কেটে পাড়ে এসে উঠলে। আমারই টিলার নীচে। দেখেই বুঝলুম। বুনো তখন সে নির্জীব, কিন্তু পারে না আশপাশে আতঙ্কের সৃষ্টি করে, সেই আশঙ্কায় ওটাকে গুলি করে মারব কি না যখন ভাবছি, তখন মধুমাধ। জমিদারির মাহুত উঁচু জায়গার সন্ধানে সে তার হাতি নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল আমার পিছনের টিলায়–তাকে দিব্য পোষ মানিয়ে নিয়ে গেল আপন হাতির সঙ্গে। বনের ভিতর যাবার সময় আমাকে সেলাম করে বলল, এ হাতি আশ্রয় পেয়ে বেঁচে গেছে হুজুর। এ হাতি আর কখনো বনে ফিরে যাবে না, কারো অনিষ্টও করবে না। হাতি তো নেমকহারাম জানোয়ার নয়।
শুধু জল আর জল। বর্ষার প্রথম ধাক্কাতেই কাজলধারার কালো জল ঘোলা হয়ে গিয়েছিল। এখন সে হয়ে গেল সাদা। কিন্তু ধবলকুষ্ঠের মতো কী রকম যেন বীভৎস সাদা নিয়ে। কোন কোনো সাপের গায়ে আমি এ রঙ দেখে শিউরে উঠেছি এবং বিষাক্ত কি না সে খবর না নিয়েই মাথা ফাটিয়ে দিয়েছি। এ জলের মাথায় যদি লাঠি মেরে কেউ তাকে মেরে ফেলতে পারত।
প্রথম ধাক্কাতেই বান ভেঙে দিল আমাদের নদীর পাড়। ডুবিয়ে দিল শহরের নীচ জায়গায় বাড়িঘর। ভাগ্যিস প্রথম জোরে মারটা এসেছিল দিনের বেলা, না হলে কতো লোক এবং আমাদেরই চেনা লোক যে এক ঘুম থেকে আরেক ঘুমে চলে যেত তার সন্ধান পর্যন্ত আমরা পেলুম না। তারা আশ্রয় নিল জাত-বেজাতের নৌকোয়, বাকিরা এসে উঠল টিলা-টালার উপরে। আমাদের মধুগঞ্জে আছে কটাই বা তাবু! তারই সব কটা পড়ল এখানে-ওখানে। বাকিরা টিলা থেকে ডাল-পাতা কুড়িয়ে নিয়ে তুললে চালাঘর। মুদীরাও আশ্রয় নিয়েছে সেইখানেই–আর যাবেই বা কোথায়? তোমার পরিবারের আশ্রয়ের জন্যে আমি আমার ভাওয়ালি পাঠিয়ে দিয়েছিল। সে নৌকা এনে বাধা হল আমার টিলার নীচে বটগাছের সঙ্গে।
আশ্চর্য, শহরে কোনো কুকীর্তি হলে আমরা যে কটা ভ্যাগাবণ্ড বকাটে ছোঁড়াকে সন্দেহ করে ধরে এনে তাদের ধরে চোটপাট লাগাতুম, তারাই দেখি সকলের পয়লা কোমর বেঁধে লেগে গেল উদ্ধারের কাজে। এক মুহূর্তেই কোথায় গেল তাদের তাস-পাশা, ইয়ার্কি খিস্তি । আর সবচেয়ে তাদোড় ঐ পরেশটা যে আমার বাগানের লিচু পর্যন্ত চুরি করেছে। রায়বাহাদুর কাশীবরকে পর্যন্ত যে আড়াল থেকে মুখ ভ্যাঙচায়–সে দেখি তার ইয়ারদের নিয়ে কলাগাছের ভেলা বানিয়ে ভাসিয়ে দিয়েছে নদীর ওপরে। সেই বানের ভরা গাঙে। কত লোক বাচল তারা দিনের শেষে, সন্ধ্যার অন্ধকারে দেখি আর সবাই চলে গিয়েছে, সে একা ভেলার উপরে বসে নদীর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। গায়ে ধুতির ভিজে খুঁট। আমার বয়সাতিটা অমি তার দিকে ছেড়ে দিতে সে সেটা লুফে নিয়ে আমার দিকে ফের ছুঁড়ে ফেরত দিলে। বত্রিশখানা দাঁত বের করে এ-কান ও-কান জুড়ো হা করলে এই হল আমাদের ‘থ্যাঙ্কস, নো’র বাঙলা অনুবাদ।
তুমি জান, সোম, বন্যার পর শহরে কোনো কুকর্মের জন্য ওদের সন্দেহ করলে, ডেকে শুধু বাপু, বাছা, করতুম দু-একবার জেনে শুনে ছেড়ে দিয়েছি। কড়া কথা বলতে প্রবৃত্তি হয়নি।
আহুর মজদা আর আমির মনে নিরন্তর এ কী দ্বন্দ্ব! আহির মনের যে চেলার জ্বালায় উদাস্ত সমস্ত পাড়া অতিষ্ঠ,সঙ্কটের সময় সে দেখি হঠাৎ আহুর মজদার ডাকে হা-জি-র বলে তৈরী, প্রাণটা খোলামকুচির মতো বন্যার জলে ডুবিয়ে দেবার জন্য প্রস্তুত।
তোমার বিশ্বাস, কোনো কোনো মানুষ পাপাত্ম-ক্রিমিনাল মাইণ্ড নিয়ে জন্মায়। শেষবারের মতো বলেছি, তা নয় সোম, এরা সব মিসূফিট। এরা শুধু সঙ্কটের মাঝখানে জীবসত্তার চৈতন্যবোধে বেঁচে থাকার আনন্দ (জোয়া দ্য ভিভর পায় বলে দৈনন্দিন জীবন এদের কাছে অসহ্য একঘেয়ে বলে মনে হয়। আমার দেশে এ রকম ছোঁড়ারা পল্টনে ঢুকে গিয়ে আপন জীবনের সার্থকতা পায়। তাই বাঙালী পল্টন খোলা মাত্রই আমি সর্বপ্রথম এদেরই ডেকে পাঠিয়েছিলুম। এরা যে সেখানে সুনাম করেছে। সে কথা তোমার অজানা নয়।
কোথা থেকে কোথা এসে পড়লুম। সেই সর্বব্যাপী হাহাকারের ভিতর আমি কিন্তু একটি বড় মধুর দৃশ্য দেখেছি। আমার টিলা, পাদ্রী টিলার চতুর্দিকে যখন আশ্রয়য়ার্থীরা চালা, মাচাঙ বানাতে ব্যস্ত, ভিজে কঞ্চি বাঁশ দিয়ে আগুন জ্বালাতে গিয়ে মেয়েরা চোখের জলে নাকের-জলে, তখন দেখি বাচ্চারা মহোল্লাসে শেকসপিয়ারের প্রিমরোজ পথটু ইটানেল বনফায়ারের পিকনিক চড়ই-ভাত বনের ভিতর সফল করে তুলেছে। এদের একের অন্যে সঙ্গে দেখা হয় ইস্কুল ঘরে, কিংবা খেলার মাঠে তা-ও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। আজ যেন তারা সবাই এক বিরাট বাড়ির প্রকাণ্ড পরিবার। সে বাড়ির ছাদ আকাশ, দেয়াল টিলাগুলো, খেলনার জন্য দুনিয়ার গাছপালা টিপটিপা আর নাশতার জন্য পিষ্টি-বৈচিমন, আনারালি, কালোজাম, বুনো কাঁঠাল। আর সবচেয়ে বড় আনন্দ, বাপ-মা শাসন করে না, তারা আশ্রয় নির্মাণে মত্ত। এরা যত বাইরে বাইরে কাটায়, ততই মঙ্গল। এই হনুমানদের জ্বালায় টিলার হনুমানগুলো তখন বাপ-বাপ করে এ তল্লাট ছেরে পালিয়েছিল।
শেষটায় জল এসে ঢুকল আমার লিচুবাগানে।
আগে ছিল আমার বাড়ির সামনের গাছলাপালার সবুজ, তারপর কাজলধারার কালো জল,তারপর ফের ধানখেতের কাঁচা সুজ এবং সর্বশেষে কালাই পাহাড়ের নীল রঙ। এখন আমার আর পাহাড়ের মাঝখানে শুধু নোরা ঘোলা জলের একরঙা উদরী রোগীর ফুলে উঠা পেটের মতো এক ভয়াবহ সত্তা। তারই মাঝে হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে আছে কোনো ঘর, আর কোনো ঘর মাথা অবধি ডুবিয়ে-জলের উপর শুধু টিনের চারখানা চাল বসে আছে, মোষ যে রকম সর্বাঙ্গ জলে ডুবিয়ে দিয়ে শুধু মাথাটা উপরে ভাসিয়ে রাখে। সবকিছু জলে একাকার বলে আসল নদীটি কোথায়, সে শুধু বোঝা যাচ্ছে, তার উপর দিয়ে ভেসে যাওয়া কালো ঢিপি থেকে–মড়া মোষ শুয়োর, গোরু আরো কত কী! আর আমার বারান্দায় লক্ষ লক্ষ কেঁচো সাপ পর্যন্ত ঠিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না।
সত্যি বলতে কী, তখন এসব দেখেও দিখিনি। আজ দেখছি, আমার অজানাতে মন অনেক কিছু স্মরণ রেখেছে। আমি তখন পাঁচশটা কাজ নিয়ে ব্যস্ত, যে-সব কাজ সম্বন্ধে আমার কণামাত্র অভিজ্ঞতা নেই।
তোমাদের জাতটা এমনিতে বড় ইনডিসিপ্লিণ্ড কিন্তু বিপদের সময় আমাদের তুলনায় তোমরা অনেক বেশী কমনসেনস ধর। আপনা থেকে কেমন যেন একটা ডিসিপ্লিন তোমাদের ভিতর এসে যায়। তা না হলে আমার সেই পাগলের মতো ছুটোছুটির ফলে ইষ্ট না হয়ে কী যে অনিষ্ট হত বলতে পারিনে।
সাত দিন ধরে আমি কলের মতো কাজ করে গিয়েছি আমি সম্বিতে ছিলম না। এমন কি, আমার জীবনের আপন ট্রাজেডি সম্বন্ধেও আমি অচেতন হয়ে গিয়েছিলাম।
অষ্টম দিনে বাড়ি ফেরার সঙ্গে সঙ্গে সম্বিতে ফিরলুম। ডাঙশ মেরে মানুষ একে অন্যকে অজ্ঞান করে। আমাকে ডাঙশ মেরে আনা হলো সম্বিতে।
বাঙালোয় এসে শুনলুম, মেবলের বাচ্চা হয়েছে।
.
১২ই সেপ্টেম্বর
তোমাদের সকলের মুখে শুনি, কর্ম করে যাবে, ফলোভের আশা ত্যাগ করে। ফল দেওয়া-নাদেওয়া ভগবানের হাতে। এই নাকি তোমাদের সর্ব অভিজ্ঞতা, সর্বশাস্ত্রের মূল কথা।
মা মেরী সাক্ষী, আমি বন্যার সাত দিন কোনো ফলোভের আশা করে কাজ করিনি। আমি আমার আপন প্রাণ বিপন্ন করে যাদের বাঁচিয়েছিল, তাদের কেউ কেউ বন্যার পর কলেরায় মারা যায়। তাই নিয়ে আমি শোক করিনি। অন্য ফলের কোন প্রশ্নই তো আমার মনে ওঠেনি।
কিন্তু কর্মফলের লোভ ত্যাগ করে যে মানুষ কাজ করে গেল, তাকে অর্থাৎ তার প্রিয়পাত্রকে বুঝি তোমাদের ভগবান বকশিশ দেন জারজ সন্তান।
.
১লা ডিসেম্বর
যতই ভাবি মনকে এদিক-ওদিক বিক্ষিপ্ত হতে দেব না, মূল কথা সংক্ষেপে বলে ফেলব, ততই দেখি আস-কথা, পাশ-কথা সব কথাই মনের ভিতর থেকে বাইরের প্রকাশে এসে নিষ্কৃতি পেতে চায়। অথচ মনের গভীর গুহাতে যে সব ভূতের নৃত্য অহরহ চলেছে তাদের একটাকেও তো আমি ভালো করে ধরতে পারছিনে। অনে, সজ্ঞানে, সুষুপ্তিতে, স্বপ্নে এরাই গড়ে তুলছে আমার জীবন দর্শন-ভোট-আনসাউ উ তারই বুদ্বদ শুধু চেতন মনে ভিড় করে, আত্মপ্রকাশের জন্য।
সে মনের গুহায় আছে, কত প্রাণী,–হ্যামলেট, ডন কিকসট ডক্টর জীল, মিস্টার হাইড এবং তাদের পিছনে দাঁড়িয়ে এদের নাচাচ্ছেন আহুর মজদা, আহির মন, হয়তো ছেলেবেলাকার আমার আরধ্য দেবী মা-মেরি তখনো আমাকে সম্পূর্ণ বিসর্জন করে ফেলেননি–এখনো আমি মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখি আমার ছেলেবেলাকার শহরের গির্জায় আমি হাঁটু গেড়ে উপাসনা করছি আর তিনি করুণ বয়ানে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন; এ স্বপ্ন আমি বড় ডরাই।
কখনো দিনের পর দিন বারাণ্ডায় জড়ের মতো বসে রইতুম হ্যামলেট হয়ে, আর তাকে ডক্টর জীল কানে কানে বলত, এই ভালো, চুপ করে বসে থাকো। সংসারের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে কী করতে পার তুমি? কোন কর্মের কী ফল, তা আগে ভাগে জানবে কী করে।’ ভুলে গেছ, অস্কার ওয়াইলডের সেই গল্পটা? প্রভু যীশু এক অন্ধের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন । তার পর পথে যেতে একদিন দেখেন, এই লোকটা এক বারবনিতার দিকে লোলুপ নয়নে তাকিয়ে আছে। প্রভু বিরক্ত হয়ে তাকে শাসন করলেন। উত্তরে সে কাতরকণ্ঠে বললে, আমার দৃষ্টিশক্তি ছিল না, আপনি আমাকে দয়া করে সে শক্তি দিলেন। এখন আমি তা দিয়ে অন্য কী করতুম, বলুন। তাই দেখো কর্মের কী ফল তা স্বয়ং প্রভু যীশুই যখন জানেন না, তখন তুমি, কীটস্য কীট, তুমি জানবে কী করে? কিংবা স্মরণ করো সেই চীনের গল্পটা। এক জমিদারের ছেলে বনে শিকার করিতে গিয়ে পথ হারিয়ে গুম হয়ে গেল। পাড়া প্রতিবেশী তার বাড়িতে এসে শোক প্রকাশ করে তাকে সান্তনা জানালে। জমিদার ছিলেন জ্ঞানী লোক, শুধু বললেন, এই যে খারাপ হল, জানলে কী করে? তার দিন দশেক পরে ছেলেটা বন থেকে ফিরে এল একটা চমৎকার বুনো ঘোড়া সঙ্গে করে। সবাই এসে সানন্দে অভিনন্দন জানালে। জমিদার বললেন, এ যে ভালো হল, জানলে কী করে? তার কিছুদিন পর ছেলেটা ঐ বুনো ঘোড়া থেকে পড়ে পা খানা ভেঙে ফেললাম। সবাই এসে শোক প্রকাশ করলে। জমিদার বললেন, এ যে খারাপ; হল, জানলে কী করে? তার কিছুদিন পর লাগল লড়াই, সম্রাটের লোক এসে ধরে নিয়ে গেল সব জোয়ানদের; ছেলেটার পা ভাঙা বলে তাকে যেতে হল না। সবাই এসে আনন্দ জানালে। জমিদার বললেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
তবেই দেখো, কিসে কী হয়, বলবে কে?
আর কখনো বা সেই মারমুখো ডন কিকসটকে আরো ওশকাতে লাগত তার পিছনে দাঁড়িয়ে মিস্টার হাইড। কী দেখছ, বসে বসে? তোমার লজ্জা-শরম নেই, অপমানবোধ নেই? তুমি কি একটা পাপোশ না আস্ত একটা ভেড়? আপ্তা-ঘর তোমাকে নিয়ে কী ঠাণ্ডাব্যঙ্গ করে তার খবর রাখ? ইস্তেক নেটিভ, কালা-আদমী খানসামা-গুলো? এদিকে চোরচোট্টার উপর কী রোয়াব! ওঃ যেন কলকাত্তার হাইকোর্টের বড় জজ সাহেব নেমে এসেছেন মধুগঞ্জের গুনাহ-হারামি খতম করবার জন্য আর ওদিকে নিজের ঘরের বউ যে চুরি হয়ে গেল তার জন্য কোনো গরমি নেই। সায়েবের গায়ে বুঝি মাছের রক্ত–তাও শিঙি মাছের না, একদম পুঁটি।’ বুঝলে হে, মহামান্যবরেষু, সিন্নোর ডন কিখোঠে, ব্যাটারা এই কথা কয় কত রঙে কত ঢঙে! আর তোমার বাটলারটা। তওবা, তওবা–তা তোমাকে বলে আর কী হবে? এইবার লেগে যাও, তোমার হোঃ, হোঃ, হোঃ, তোমার
ছেলের ব্যাপটিজমের ব্যবস্থা করাতে।
এই রকমই একদিন ডন কিকসট, বা আমি হঠাৎ কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে করলুম বাচ্চার বাপ্তিস্মের প্রস্তাব, জয়সুয়কে গডফাদার বানিয়ে।
তোমার মনে থাকার কথা, কারণ সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলে তুমি।
কাকে অপমান করার জন্য এ প্রস্তাব আমি করেছিলুম? মেকে? নিজেকে? কী বলব? ডন কিকসট কি কোনো কিছু ভেবে-চিন্তে করে? তবু লেখক সেরভান্তেসের মানসপুত্র ডন কিকসট কখনো কারো কিছু অনিষ্ট করেনি। আমি ডন কিকসটের পিছনে ছিল যে মিস্টার হাইড।
গির্জেঘরের সে দৃশ্য তোমার মনে আছে। মাঝে মাঝে; আমার পর্যন্ত মনে হয়েছিল, কাজটা বোধ হয় ঠিক হলনা।
তখন মিস্টার হাইড ধমক দিয়ে বলেছে, ফের!
আর আহির মন বলেছে, জীতে রহো বেটা!
আমি যা-কিছু করেছি তার জন্য তোমার কাছ থেকে আমি কোনো করুণা ভিক্ষা করছিনে, কোনো সহানুভূতি চাইছি না, কিন্তু সোম, আমার ভিতর এই যে গোটা ছয় ভিন্ন প্রকারের প্রবৃত্তি অষ্টপ্রহর অনবরত লড়াই চালাত, আমাকে নির্মমভাবে এদিক-ওদিক টান-হ্যাঁচড়া করত–একটা মড়াকে যে রকম দশটা শকুন ভেঁড়াছেড়ি করে আমার জাগরণ বিষাক্ত করে রাখত, আমি ঘুমুতে গেলেই খার্টটা নাড়াতে থাকত, ঘুমিয়ে পড়লে দুঃস্বপ্নের মতো বুক চেপে বসত, জেগে উঠেই দেখতুম তারা সব লোলুপ নয়নে পহর গুনছে, কখন আমি জাগব, কেউ দেবে চোখ ঠোকরে, কেউ ফুটো করে দেবে তালুটা এরা আমাকে নিয়ে কী করেছিল সেইটে তুমি কিছুটা বুঝতে পারলেই আমি আমার জীবনের একদিকটার কথা আর তুলব না।
আপিসে কাগজপত্র সই করার সময় তারিখ দিতে হয়, বরের কাগজও মাঝে মাঝে পড়েছি, কাজেই দিন, মাস, বৎসর সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অচেতন কখনো হতে পারিনি। তাই জানি এই করে করে বছর পাঁচেক কেটে গেল।
সত্যি বলছি, সোম বাইরের দিক দিয়ে দেখতে গেলে আমার জীবনে এ পাঁচ বছরে কিছুই ঘটেনি। লড়াই লেগেছিল বলে প্রচুর খেটেছি, হাট লুট বন্ধ করে রেখেছি, স্বদেশী আন্দোলনকে ছড়াতে দিইনি। সাধারণ মানুষের চরিত্র গড়ে ওঠে, তার জীবন বিকাশ লাভ করে এই সব ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতের ভিতর দিয়ে, বাইরের ঘটনা তার মনকে গড়ে তোলে; অবার সেইমন তার ভবিষ্যৎ কর্মধারাকে নূতনভাবে নিয়ন্ত্রিত করে। আমার জীবনের উপর বাইরের কোনো ঘটনা এ পাঁচ বছর কোনো দাগ কাটতে পারেনি।
আর ভিতরের জীবনের কিছুটা ইঙ্গিত তোমাকে দিয়েছি। আর ভিতরকার জট যদি আমি নিজেই ভালো করে ছড়াতে পারতাম তা হবে তোমাকে বলতুম–আমি পারিনি।
শুধু মেব্ল্ দূর হতে আরো দুরে চলে গেল। যে মেব্ল্ একদিন মার্সেলেসে দাঁড়িয়ে শভ রঙের রুমাল নেড়ে নেড়ে জাহাজে আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল, পাড়ে নেমে আমি রেখেছিলুম তার কাঁধে আমার হাত দুখানি, সে চেপে ধরেছিল আমার বাহু দুখানি সেই মেব্ল্ই হঠাৎ যেন আমাকে পাড়ে ফেলে উঠে পড়ল জাহাজে আর ধীরে ধীরে সে জাহাজে অদৃশ্য হলো অসীম নীলিমার অন্তহীন শূন্যতায়। কাতর আর্তনাদে, করুণ নিবেদনে আমি তাকে ডাকতে পর্যন্ত পারলুম না।
আর নেই মেবল্-ই এই বারাণ্ডাতেই বসে, আমার থেকে তিন হাত দূরে।
শুধু বুঝলাম, আমার জীবন থেকে এ দ্বন্দ্ব কখনো যাবে না। শান্তি আমি কখনো পাব না।
.
৫ই ডিসেম্বর
পেট্রিকের জ্বর হয়েছে। সিভিল সার্জন দেখে গিয়েছে। বলেছে ভয় নেই। মেব্ল্ পাংশু মুখে বারাণ্ডায় পাইচারি করছে। একবার হ্যাটটা মাথায় দিয়ে পাদ্রীটিলার দিকে রওয়ানা হল। বহুকাল হল সে বাড়ি থেকে আদপেই বেরোয়নি। কিন্তু গেল না। ফিরে এল। তারপর বারাণ্ডার রেলিঙয়ে দুই কনুইয়ে ভর দিয়ে মাথা নিচু করে অনেকক্ষণ ধরে ভাবল।
আমি তো অন্ধ নই। দেখলুম, মাতৃত্বের রসে মেবলের দেহখানির প্রতি অঙ্গটি কী অনুরূপ পরিপূর্ণতার সৌন্দর্য পেয়েছে। যেন এদেশের বর্ষার ভরা পুকুর।
অনেকক্ষণ পরে মে আমার সামনে এসে মাথা নিচু করে বললে, এদেশের আবহাওয়া পেট্রিকের সইছে না। তার পড়াশুনার ব্যবস্থাও এখানে ঠিকমত হবে না। আমরা বিলেত যাই। তুমিও সঙ্গে চলো না? তোমার তো অনেক ছুটি পাওনা আছে।
বহুকাল পরে মেব কথা বলল। . আমি বললুম, সেই ভালো। তবে আমি সঙ্গে আসতে পারব না। তোমরা ইংলণ্ডের কোথাও বাড়ি করে থাকো। আমি পরে সুযোগ পেলে যাব।
মেব্ল্ মাথা নেড়ে সায় দিলে। সে কখনো আমার কোনো ইচ্ছায় আপন অনিচ্ছা জানায়নি, নিজের ইচ্ছা তো প্রকাশ করতই না!
এ রকম ধারা কোনো একটা পরিবর্তন আমার জীবন প্যাটার্নে আসতে পারে সে কথা আমি কখনো ভেবে দেখিনি।
অথচ এতো কিছু খুদার-খামাখা আজগুবী সমাধান নয়। চার-পাঁচ বছরের লেখাপড়ার সুবিধের জন্যে আমার মতো দু-পয়সাওয়ালা লোকের পরিবার আকছারই তো বিলেত যাচ্ছে।
তবু আমি সমস্ত রাত বিছানায় পড়ে রইলুম অসাড়ের মতো।
শেষ রাত্রে একটু তন্দ্রা এসেছিল। আচমকা ঘুম ভাঙল ভোরের দিকে।
দেখি সমস্যা সমাধান করে ফেলেছি। সব সমস্যার সমাধানই হয় ঘুমে, স্বপ্নে কিংবা অবচেতন মনে।
মাত্র যে তিনটি প্রাণীর সঙ্গে আমার জীবনের যোগসুত্র, বরঞ্চ বলি, যে তিনটি প্রাণী আর আমাকে নিয়ে আমার জীবন, তারাই আমার জীবনকে অসহ্য করে তুলেছে পলে পলে, প্রতি ক্ষণে তারা আমার আয়ু ক্ষীণ করে নিয়ে আসছে, তিন দিক থেকে তিন রাহু আমার জীবনকে ক্রমে ক্রমে গ্রাস করে। একদিন বিলুপ্ত করে দেবে। এই নিয়ে আমার সিদ্ধান্তের আরম্ভ। পরের সিদ্ধান্তগুলো এক এক করে এই :
দুরে চলে গিয়ে আমার উপর এদের শক্তি আরো বেড়ে যাবে। এ সংসারে এরা বেঁচে থাকবে, না আমি বেঁচে রইব?
আমি।
এরা পাপী, মরা উচিত এদেরই। মেব্ল্ পাপী, জয়সূর্য পাপী আর পেট্রিক ওদের পাপ-জাত সন্তান। আমি নির্দোষ, আমি কোন পাপ করিনি। আমি কস্মিনকালওে কারো হকের ধন থেকে একটি কানাকড়িও কেরে নিইনি। এরাই দিয়েছে আমাকে ফাঁকি, এরা যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন আমাকে দেবে শুধু ফাঁকি।
এরা মরে গেলে আমি শান্তি পাব। আমার দ্বন্দ্বের সমাধান হবে।
খুন কী করে করা হয়, তার সব কটা পদ্ধতিই জানি আমরা। তুমি আমি অর্থাৎ পুলিশ। খুনীরা আপন আপন সঙ্কীর্ণ বুদ্ধি অনুযায়ী পন্থা বেছে নিয়ে করে খুন। সব খুনের ইতিহাস, বিশ্লেষণ জড়ো হয় থানায়। কোন পন্থার কী গলদ, সামান্য কী একটা ত্রুটি কিংবা বিচ্যুতি এড়ালে খুনী ধরা পড়ত না, এসব তত্ব আমাদের ভালো করে জানা। আমরা যদি নিখুঁত খুন না করতে পারি, তবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যেন কোনো ঢ্যাঙা লোকওঁ সে চাঁদ ধরবার আশা না করে।
এ তো চ্যালেঞ্জ নয়। এ তো অতি সোজা কাজ। কিন্তু অতি সরল কমও অবহেলার সঙ্গে করতে নেই।
আমার মনে কোন দ্বিধা নেই। আমার মনের গুহার হ্যামলেট, কিকসট, জীকল হাইড, মজদা, মনু বাই মরে গিয়েছে। এখন যা-সব আমি করতে যাচ্ছি, সেসব ডেভিড ও-রেলির সম্পূর্ণ নিজস্ব।
নির্দ্বন্দ্ব চিত্তে যে রকম বন্যার কাজে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছিলুম, পেট্রিকের ব্যপ্তিস্ম পরব করার সময় আমি যে রকম স্থির নিশ্চয় হয়ে এগিয়েছিলাম, এবারে ঠিকই তাই।
সকাল বেলা জয়সুর্যকে ডেকে বললাম, তুমি মেদের জাহাজ ধরিয়ে দেবে। বোম্বাই, মাদ্রাজ কিংবা অন্য কোনো বন্দরে। সেটা পরে স্থির হবে। তারপর তুমি কিছুদিনের জন্য সেখান থেকে সোজা দেশে যেয়ো। আগে যখন ছুটি চেয়েছিলে, তখন সুবিধে হয়নি, এখন আমার একলার কাজ আরদালিই করতে পারবে।
জয়সুর্য খুশী না বেজার হল তার মুখ থেকে বোঝা গেল না।
আমি সেদিনই কুকটুক সব ট্রাভেল এজেন্সিকে চিঠি লিখে দিলুম, কবে কোন বন্দর থেকে কোন্ জাহাজ ছাড়বে, জায়গা পাওয়া যাবে কিনা, ভাড়া কত ইত্যাদি জানতে। ফলে যে সাত উই মালমশলা উপস্থিত হল, সে তো ঐ সময় তুমি একদিন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসে দেখেছ। আমার কেমন যেন আবছা আবছা মনে পড়ছে, সেদিন তোমার সঙ্গে একটু খিটখিটে ব্যবহার করেছিলুম। তার কারণ যদিও তখন আমি ঐসব কাগজপত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলাম, কিন্তু তারই আড়ালে আমার অন্য প্ল্যানটাকে আমি ফিটফাট ওয়াটার-টাইট করে নিচ্ছিলুম।
বাইরের শোটাকে তার ফিনিশিং টাচ দেওয়ার জন্য আমার দরকার ছিল শুদ্ধ কয়েকখানা লাগেজ লেবেলের। কোনো কোনো ট্রাভেল এজেন্সি খদ্দেরকে আপন চালাকি দেখাবার জন্য কেবিন বুক হাওয়ার পূর্বেই কিছু লাগেজ টিকেট পাঠিয়ে দেয়। যেমন যেমন মেলের এক একটা সুটকেস, ও ট্রাঙ্ক তৈরী হতে লাগলো সঙ্গে সঙ্গে আমি তাদের উপর সেই লেবেলগুলো সেঁটে দিতে লাগলুম।
ওদের দিকটা তৈরী, এখন আমার দিকটা ঠিক করতে হবে।
মানুষ মারা তো অতি সহজ, বিশেষ করে যে মানুষ যখন তোমার অভিসন্ধি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অচেতন। আসল সমস্যা মড়া নিয়ে। বেশীর ভাগ খুন ধরা পড়ে মড়া থেকে এবং খুনী ধরা পড়ে তার থেকে।
ক্রমে ক্রমে সব ব্যবস্থা হয়ে গেল। বাক্স-প্যাটরা তৈরী, রাস্তার জন্য অস্পস্বল্প খাবার দাবারও প্যাক করা হয়েছে। পরদিন ভোরবেলা আমি মেদের মোটরে প্রায় কুড়ি মাইল দূরের রেল স্টেশনে পৌঁছে দেব।
সন্ধ্যের সময় চাকরবাকরদের ছুটি দিলুম। তারা যেন ভোরবেলা এসে মালপত্র মোটরে তুলে দেওয়াতে সাহায্য করে।
ডিনারের খবর নিয়ে যখন জয়সূর্য এল, তখন আমি হঠাৎ মেকে বললুম, আজ এ ডিনারে জয়সূর্য আমাদের সঙ্গে বসে খানা খাক।
মেবল্ অবাক হয়ে আমার দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছিল। তার চোখে আপত্তির চিহ্ন ছিল।
আমি বললুম, আফটার অল, ও তোমাদেরই একজন। অন্তত একদিনের জন্য তাকে তার ন্যায্য সম্মান দেখানো উচিত।
মেব্ল্ চুপ করে রইল।
খানা টেবিলে জয়সূর্যকে বসতে দেখে পেট্রিক খুশি।
আমি বললুম, বাটলার, তুমি সূপটা নিয়ে এসো; মে তুমি নিয়ে আসবে মাংস; আর আমি নিয়ে আসব পুডিং।
ব্যবস্থাটা সকলের মনঃপূত হল কি না তা ভাববার ফুরসত নেই। আমাকে আমার প্ল্যান-মাফিক কাজ করে যেতে হবে।
সে এক অদ্ভুদ ডিনার। সবাই চুপ করে খেয়ে যাচ্ছে।
পুডিং আনার জন্য আমি গেলুম রান্নাঘরে।
পকেটে আর্সেনিক ছিল। ডাক্তারি শাস্ত্রে যে পরিমাণের প্রায়োজনের কথা বলে তার চেয়ে একটু বেশি করেই জয়সুর্য মেবল্ আর পেট্রিকের পুডিঙে মিশিয়ে দিলুম।
ওদের ছটফটানি, মৃত্যু-যন্ত্রণা আমি দেখিনি। আমি ততক্ষণে বড় লিচুগাছটার কাছে গোর খুঁড়তে লেগে গিয়েছি। কাজ সহজ করার জন্য দুদিন আগে মালিকে দিয়ে সেখানে মৌসমী ফুল ফোঁটাবার ফ্লাওয়ার বেড খুঁড়িয়ে রেখেছিলুম। এক বস্তা চুনও আনিয়ে রেখেছিলুম।
রাত প্রায় চারটের সময় গোর শেষ হল।
তারপর লাগেজগুলো নিজে মোটরে তুললুম চাকরদের আসবার আগেই বেরিয়ে যাব বলে, তাদের বলেছিলুম ছটায় আসতে। স্টেশনে পথে দশ মাইল দূরে বড়শীছড়া নদীর উপর যেখানে পোল, তারই ডান দিক দিয়ে যে ছোট্ট রাস্তা তারই উপর দিয়ে মোটর চালিয়ে নিয়ে গিয়ে সেখানে লাগেজগুলোর সঙ্গে ইট বেঁধে ডুবিয়ে দিলুম নদীর গভীরে।
তারপর বাড়ি ফিরে এসে শুয়ে পড়লুম।
আমাদের মহাকবি বলেছেন, ঘুম সঞ্জীবনী রসে প্রাণকে নবজীবন দান করে সে কথা আমি মানি। কিন্তু তার উল্টোটাও হয়, তুমি লক্ষ্য করেছ কি? নিশ্চিন্ত মনে ঘুমুতে গেলে ভাবলে অন্তত ঘণ্টা দশেক গভীর নিদ্রায় মগ্ন থাকবে। আধঘণ্টা যেতে না যেতেই হঠাৎ পা দুটো হ্যাঁচকা টানে সটান খাড়া হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙ্গে গেল।
শুনি আহির মনের অট্টহাসি। যে আত্মবিশ্বাস আর দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এতদিন প্যানের প্রতিটি খুঁটিনাটি ঠিক ঠিক নিখুঁত পরিপূর্ণ করে সমস্ত কর্ম সমাধান করলুম, ঘুম ভাঙ্গতেই দেখি পায়ের তলার সে দৃঢ় ভূমি হঠাৎ ভলভলে কাদা হয়ে গিয়েছে আর আমি ক্রমাগত তলার দিকে ডুবে যাচ্ছি। ঘামে আমার সর্ব শরীর ভিজে গিয়েছে, আমি কলাপাতার মতো থরথর করে কাঁপছি। আমার শরীর, আমার মন আমার বাজার বাইরে চলে গিয়েছে। হঠাৎ হয়তো বা চিৎকার করে ফেলি, আমি খুন করেছি। লিচুগাছটার তলা খোড়ো, সবকটা মড়া সেখানে পাবে!
নিজের গলা সবলে হাতে চেপে ধরে কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করি। দেখি, হাত ওঠে না।
এই হল আহির মনের সবচেয়ে বড় শয়তানি। তোমাকে আত্মপ্রত্যয় দেবে, সাহস দেবে, সব বাধাবিঘ্ন উত্তীর্ণ হবার হাজারো সন্ধি-সুড়তে দেবে, তারপর যে মুহূর্তে তার ইচ্ছামত কর্মটি সমাধান হয়ে গেল, অমনি তোমাকে তোমার বিভীষিকার হাতে সমর্পণ করে চলে যাবে।
আমি মর্মে মর্মে অনুভব করলুম, বিশ্বাসঘাতকতাকে সৰ্বদেশ সর্বশাস্ত্র কেন সবচেয়ে বড় পাপ বলে নিন্দে করেছে।
তাই তখনো আমার যেটু্কু শক্তি বাকি ছিল, তাই দিয়ে আমি আমার শেষ আশ্রয় আঁকড়ে ধরে রইলুম। সেটা কী?
আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল এবং এখনো আছে, মেবল্দের খোঁজ কেউ করবে না। আমার কিংবা মেরে ত্রিসংসারে কেউ নেই যে, আমরা কোথায় তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে। বিলেতে যে দু-একজনের সঙ্গে আমাদের সামান্য পরিচয়, তারা ভাববে, আমরা এদেশে; এদেশের লোক ভাববে মেবল্রা বিলেতে। যদি বা কারো মনে কোনো সন্দেহ হয়, তবে সে বিষ্ণুছড়া মাদামপুরের মুরুব্বিদের মতো ভাববে, কাজ কি এ পাপ ঘেটিয়ে। খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে হয়তো বেরিয়ে পড়বে, মে ঐ নেটিভ বাটলারটার মিস্ট্রেস হয়ে গোপনে দিন কাটাচ্ছে। হয়তো বিলেতে কিংবা মসুরিতে। মসুরির কথা ওঠাতে মনে পড়ল, একবার আণ্ডা ঘরে গুজোব রটে, মেলা মসুরিতে। তার কারণ, মেবল্দের বিলেত যাওয়ার পর আমি একবার মসুরিতে বেড়াতে গিয়ে হোটেলে উঠি; সেখানে একটি মেম ও তার বাচ্ছার সঙ্গে আলাপ হয়। ওদের নিয়ে প্রায়ই বেড়াতে যেতুম বলে কেউ হয়তো আমাদের দেখে মেম এবং বাচ্চাকে ভালো করে সনাক্ত না করতে পেরে খবরটা রটিয়েছিল।
তা সে বিলেতেই হোক আর মসুরিতেই হোক, সে কেলেঙ্কারির হাঁড়ি কাল আদমিদের হাটের মাঝখানে ভেঙ্গে ইয়োরোপীয় সমাজের ক্ষতি বৈ লাভের সম্ভাবনা কী?
এটা আমি জানলুম সেইদিন, যেদিন আমাদের পারিবারিক কেলেঙ্কারি নিয়ে ক্লাব আলোচনা করে স্থির করল, এ নিয়ে আলোচনা না করাই ভালো, লেট দি স্লিপিং ডগ লাই।
তাই তোমাকে এই চিঠিতেই জোর দিয়ে লিখেছি, পাপ করলেই পুণ্যাত্মা তোমাকে ধরিয়ে দেবে না। তার ব্যক্তিগত স্বার্থ না থাকতে পারে, কিন্তু সামাজিক স্বার্থ হয়তো আছে, সে পাপ গোপন করার।
কাজেই আমাকে কেউ ধরিয়ে দেবে না।
.
১লা জুন
প্রিয় সোম,
প্রায় ছ’মাস হল তোমাকে আমার চিঠি লেখা শেষ হয়। এরপর যে আবার কিছু লিখতে হবে সে আমি ভাবিনি।
আজ কিন্তু নূতন করে লিখতে হচ্ছে। তার কারণ আমার হিসেবে একটু গোলমাল হয়ে গিয়েছে।
ত্রিসংসারে আমার বন্ধ নেই। যারা আছে তারা আমার, না শত্রু না-মিত্র। এরা যাতে আমার খুন না ধরতে পারে, তার ব্যবস্থা আমি করেছিলুম। এবং ধরার কাছাকাছি এলেও কেন যে আমাকে ধরিয়ে দেবে না তার কারণও আমি তোমাকে বলেছি।
কিন্তু অযাচিতভাবে এ সংসারে হঠাৎ যে আমার এক মিত্র দেখা দেবেন এবং আমার মঙ্গল’ এবং উপকার করতে গিয়ে আমার খুন ধরে ফেলবেন এ কথা আমি কল্পনা করতে পারিনি। তাই হয়েছে।
আমি যুদ্ধের জন্য অনেক কিছু করেছিলুম বলে আই জি, মুগ্ধ হয়ে আমার সম্বন্ধে যে-সব গুজোব রটেছে সেগুলো খণ্ডন করতে চান। করতে গিয়ে তিনি এবং ডীন সত্যের প্রায় কাছাকাছি এসে গিয়েছেন এ খবর আমি পেয়েছি।
এর জন্য আমি কোনো ব্যবস্থা করে রাখিনি। এখন আর করবারও উপায় নেই।
তাই যদি ধরা পড়ি তবে আমাকে হয়তো ঝুলতে হবে।
আমার জন্য শেষকৃত্য হয়তো তোমাকেই করতে হবে।
তাই আমার গোরের উপর নিচের দুটোর যে-কোনো একটা খোদাই করে দিতে পার :
(For a Godly Man’s Tomb)
Here lies a piece of Christ; a star in dust
A vein of gold; a china dish that must
Be used in Heaven, when God shall feast the just.
কিংবা
(For a Wicked Man’s Tomb)
Here lies the carcasse of a cursed sinner,
Doomed to be roasted for the Devil’s dinner
ডেভিড ও-রেলি।
.
সমাপ্ত