৪. সকালে ডিউটিটা ভাল লাগে না

অধ্যায়: ৪

সকালে ডিউটিটা ভাল লাগে না বুলটনের। বরং নাইট ডিউটি করলে সারা দিনটা সময় পাওয়া যায়, দিনে অনেক কিছু করার থাকে মানুষের। কাজ অবশ্য কিছুই না, ফালতু বসে থাকা আর মাছি তাড়ানো। আনপ্রোডাকটিভ লেবার। গালভরা নাম সিকিওরিটি গার্ড, আসলে পাতি বাংলায় চৌকিদার। চাকরির কোনও ওজন নেই, অ্যাডভেঞ্চার নেই, আর এ দেশে মানুষ সস্তা বলে যে যা খুশি বেতন ধরিয়ে দেয়। তাই হাত পেতে নিতে হয় বটে, কিন্তু মনটা গজরাতে থাকে। তার বাবা একটা তেলকলে চাকরি করে। নামকাওয়াস্তে তেলকল, আসলে সেটা মুরগি বরুণের ঘানি। ঘানির একটা পুরনো মেশিন আছে বটে, কিন্তু তা থেকে কেউ কখনও তেল বেরোতে দেখেনি। তবে মেশিনটায় পাছে মরচে ধরে যায়, সেই জন্য মাঝে-মাঝে চালানো হয়। আসলে বিক্রি হয় চালানি তেল। বোকা লোকেরা ভাবে ঘানির তেল কিনছে। কত রকমের যে দু’নম্বরি আছে চারদিকে! একটা চটি জার্মান টেক্সট বই পড়ার চেষ্টা করছিল সে প্লাস্টিকের চেয়ারটায় বসে।

“এই, শোনো!”

বুলটন বইটা সরিয়ে দেখে সামনে বুলা। সে টপ করে দাঁড়িয়ে বলল, “কিছু বলছেন?”

বুলা বিপন্ন গলায় বলে, “এই, দ্যাখো না, আমাদের তিনতলার বাথরুমে জল আটকে যাচ্ছে। পাইপে জ্যাম হয়েছে বলে মনে হয়। এ বাড়ির প্লাম্বারকে ডাকতে হবে। আমি তো নতুন এসেছি, কিছু জানি না।”

বুলটন বলে, “প্লাম্বার সঞ্জয় জেনা। আমি ফোন করে দিচ্ছি, এসে যাবে।”

“আচ্ছা, তুমিই কি বুলটন? বাবাকে মাঝে-মাঝে ওপরে তুলে দাও?”

“হ্যাঁ ম্যাডাম, আর আমিও আপনাকে চিনি।”

“আমাকে আপনি করে বলছ কেন?”

“এমনি, আপনি এসে গেল।”

বুলা একটু হাসল। বলল, “আমাকে এখন কেউ চেনে না।”

“আমি চিনি ম্যাডাম।”

“শোনো, আমাকে ম্যাডাম ডাকতে হবে না। বুলা বলে ডেকো। আর আপনি আজ্ঞেও করবে না, বুঝলে? এখন ফোনটা তো করো।”

বুলটন সঞ্জয়কে ফোন করে বলল, “তাড়াতাড়ি আয়, ইমার্জেন্সি।”

সঞ্জয় বিরক্ত হয়ে বলে, “কী করে যাব, একটা কাজে আটকে আছি তো।”

“তাহলে তোর বাবা বা ভাইকে পাঠা। বললাম না ইমার্জেন্সি!”

“দেখছি দাঁড়া। ঘণ্টাখানেক দেরি হবে।”

“আধ ঘণ্টায় ম্যানেজ কর।”

“বললাম তো দেখছি, যত কথা বলবি তত দেরি হবে। বুঝলি?”

“ঠিক আছে।” বলে ফোন কাটল বুলটন। বুলার দিকে চেয়ে বলল, “আধ ঘণ্টা লাগবে আসতে।”

“বাঁচা গেল। আমি তো ভেবেছিলাম আজ আর হবেই না।”

আজ লক্ষ করল বুলটন, বুলাকে কিন্তু বেশ দেখতে। না, সুন্দরী বলা যায় না, কিন্তু শ্যামলা রঙের মধ্যে মুখের ডৌলখানা বেশ মিষ্টি। পরনে সাদা সালোয়ার আর হালকা মেজেন্টা রঙের কামিজ, সাদা ওড়না। চুলে চিরুনি নেই, রূপটান নেই, মুখটা তেলতেল করছে। শরীরটা মেদহীন, লকলকে। চলেই যাচ্ছিল, লবির দিকে পা বাড়িয়েও ফিরে তাকিয়ে বলল, “তোমার কখন ডিউটি থাকে বলো তো!”

“তার কিছু ঠিক আছে? কখনও সকালে, কখনও রাতে।”

“একদিন তোমার সঙ্গে গল্প করব। বাবা তোমার কথা খুব বলে। তুমি নাকি ভীষণ ভাল ছেলে, তুমি বি কম পাশ, জার্মান শিখছ, আর বাউন্সার হতে চাও।”

বুলটন লজ্জা পেয়ে বলে, “স্যার দিলদরিয়া মানুষ তো তাই ওসব বলেন। আচ্ছা আপনি তো ঘর থেকে একদম বেরোন না, তাই না?”

“না, বেরোতে ইচ্ছে করে না।”

“সারাদিন ঘরে সময় কাটে?”

“কেটে যায়। টিভি চালিয়ে স্পোর্টস চ্যানেল দেখি, নইলে ইউ টিউবে গান শুনি। তবে খুব ভোরে আমি ছাদে যাই। এ বাড়ির ছাদটা তো খুব বড়। সারা ছাদ চক্কর মারি। তুমি কিন্তু এখনও আপনি আজ্ঞে করে যাচ্ছ, বয়সেও তো আমি তোমার ছোটই হব, তাই না?”

বুলটন ফের লজ্জা পেয়ে বলে, “চেষ্টা করেও হচ্ছে না যে।”

“তা বললে শুনব না, এখনই বলতে হবে। বলো, তুমি। বলো না।”

“বুলা, তুমি খুব ভাল।”

বুলা হেসে ফেলে বলল, “আমি মোটেই ভাল নই, তবু তো তুমি বলেছ, তাইতেই আমি খুশি।”

বুলা চলে গেলে ল্যান্ডিংটা বড্ড ফাঁকা লাগতে লাগল বুলটনের। মেয়েটার বয়স মাত্র উনিশ, কিন্তু এই বয়সের মেয়েদের যে ছলবলানি থাকে তা নেই। যেন একজন বয়স্কা মহিলা, টিনএজারের উচ্ছলতাটা কোথায় হারিয়ে গেল! বসে-বসে আজ বুলার কথাই ভাবতে লাগল সে।

তিন দিন বাদে দুপুরে টিফিনের কৌটো খুলে ঠান্ডা রুটি আর ঢেঁড়সের তরকারি খাচ্ছিল বুলটন, হঠাৎ দেখল সামনে বুলা দাঁড়িয়ে আছে। পরনে সবুজ রঙের কামিজ আর সাদা সালোয়ার, সাদা ওড়না।

“কী খাচ্ছ তুমি দেখি!”

বুলটন ফের লজ্জা পেয়ে বলে, “এই তো রুটি-তরকারি।”

“মাছ খাবে? আমাদের ফ্রিজে আছে কিন্তু।”

বুলটন প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, “না, না। আমার ওসব লাগে না। আমি এটা দিয়েই বেশ খেয়ে নেব।”

বুলা ফাঁকা একটা চেয়ারে বসে বলল, “বসছি। কেউ কিছু আবার বলবে না তো!”

“কে কী বলবে! তুমি বোসো তো।”

টেবিলের ওপর তার জলের বোতলটা রাখা, সেটা তুলে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে বুলা বলে, “প্লাস্টিক পুরনো হলে ইউজ় করতে নেই। বোতলটা আজই বদলে নিয়ো। এটা কিন্তু খুব ময়লা।”

“হ্যাঁ, আজই মাকে বলতে হবে।”

“খেতে-খেতে কথা বোলো না, বিষম খাবে।”

খাওয়া শেষ করে বুলটন উঠে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে এসে বসল। বলল, “আজ আমার ডে ডিউটি শেষ, কাল থেকে নাইট।”

“জানি। সেই জন্যই তো আজ গল্প করতে এলাম।”

“আমাদের ক্লাবে একজন এক্স-ফুটবলার আছে, জানো! তোমার সংবর্ধনার দিন তিনি আমাকে বলেছিলেন, দেখিস, এই মেয়েটা একদিন অলিম্পিকে যাবে।”

“পাগল! অত সস্তা নয়। আর গেলেই তো হবে না। আমরা কি সেখানে দাঁড়াতে পারব! ওদের টাইমিংয়ের ধারেকাছেও আমার টাইমিং নয়। আমাদের জন্মগত স্কিলটুকুই সম্বল। ভাল ট্র্যাক নেই, কোচ নেই, জুতো নেই, জিম নেই, সফিস্টিকেটেড ট্রেনিং নেই। বড় অ্যাথলিটদের নিজস্ব সাইকায়াট্রিস্টও থাকে তাকে মোটিভেট করার জন্য। আমরা ভেঙে পড়লে হয়তো কোচ এসে পিঠ চাপড়ে বলে, বেটার লাক নেক্সট টাইম। তার বেশি কিছু না। এখানে কোনও অ্যাথলিটের সাপোর্ট স্টাফ আছে শুনেছ? তার চেয়ে বড় কথা, ফ্যামিলিই আমাদের শেষ করে দেয়, তুমি দৌড়োবে কী করে যদি উপোসি ভাইবোনের মুখ মনে পড়ে, যদি রুগ্ণ বাবার কাতরানির শব্দ কানে আসে, যদি মায়ের ছেঁড়া শাড়ি চোখের সামনে ভাসে?”

“তা তো ঠিকই। তবে কী জানো, তোমার তো তবু জন্মগত একটা ট্যালেন্ট আছে, আমাদের তো তা-ও নেই। বুলা মণ্ডল তো আর ডজন ডজন জন্মায় না।”

“এদেশে না জন্মানোই ভাল, ট্যালেন্ট থেকেও যদি কিছু না হয় তার যন্ত্রণা বেশি।”

“আচ্ছা, তুমি তো একদিন ভালবেসেই দৌড়োতে, অলিম্পিকে মেডেল পাবে বলে তো নয়!”

বুলা উদাস মুখে বলল, “হ্যাঁ তো, স্কুলের স্পোর্টসে দৌড়োতাম পাঁইপাঁই করে। যেখানেই ওপেন টু অল স্পোর্টস হত, সেখানেই নাম দিতাম প্রাইজ়ের লোভে। ছুটতে খুব ভালবাসতাম, তবে প্রাইজ় বা ফেমের লোভ না থাকলে কিন্তু মোটিভেশন তৈরি হয় না। আর মোটিভেশন না থাকলে স্পিডও বাড়ানো যায় না। শুধু আনন্দের জন্য যদি দৌড়োও, তা হলে তুমি এক জায়গায় পড়ে থাকবে।”

“বেশ, এখন তো তোমার আর অ্যাম্বিশন নেই। স্পিডও বাড়ানোর কোনও দায় নেই। এখন তো আনন্দের জন্যই দৌড়োতে পারো, তাই না!”

বুলা তার দিকে বড়-বড় চোখ করে চেয়ে হঠাৎ হেসে ফেলল, “তোমার মতলবটা কী বলো তো!”

বুলার দাঁত এত ঝকঝকে সাদা আর হাসিটা এত ভাল যে, বুলটন চোখ ফেরাতে পারল না। চেয়ে রইল।

বুলা মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে বলে, “আবার আমাকে ট্র্যাকে ফেরাতে চাও নাকি! সেটা আর সম্ভব নয়। দৌড় আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। বুলা মণ্ডল আর দৌড়োবে না।”

কথাটা এমনভাবে বলল, বুকটা ধক করে উঠল বুলটনের। সে একটু অপেক্ষা করল। বুলা আনমনে চেয়ে আছে সামনের দিকে। ভাবছে।

খানিকটা সময় ছাড় দিয়ে বুলটন খুব নরম গলায় বলে, “আমিও একসময়ে দৌড়োতাম, স্প্রিন্টার হব বলে নয়, ফিটনেসের জন্য।”

বুলা তার দিকে হাসিমুখটা ফেরাল। বলল, “দৌড় নিয়ে আর কথা নয়, কেমন? ওটা শুনতে আমার আর ভাল লাগে না, বুঝলে?”

বুলটন মাথা হেলিয়ে বলল, “বুঝেছি। রাগ করোনি তো?”

বুলা মাথা নেড়ে বলে, না, “রাগ করব কেন? তুমি একটা বেশ ভাল ছেলে। এখন আমার আর বেশি বন্ধু নেই। বড্ড ফাঁকা হয়ে গেছি। ফেসবুক অ্যাকাউন্টও বন্ধ করে দিয়েছি।”

বুলটন খুব সন্তর্পণে জিজ্ঞেস করল, “তোমার বয়ফ্রেন্ড নেই?”

বুলা হেসে ফেলে বলে, “দূর, ওসবের সময় পেতাম নাকি! আর যা সব ছেলেছোকরা আশপাশে এসে জুটত, সেগুলো হেভি চালাক। আমি বাপু একটু নাকউঁচু আছি।”

“আমারও গার্লফ্রেন্ড নেই।”

বুলা ফের উদাস হয়ে গেছে, কথাটা শুনতে পেল বলে মনে হল না। মুডি মেয়ে, যখন-তখন মুড পালটে যায়। এ মেয়ের সঙ্গে সাবধানে মিশতে হবে।

অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল বুলা। তারপর মুখ ফিরিয়ে বলল, “আমি একবার দোকান থেকে গয়না চুরি করে ধরা পড়েছিলাম, জানো? হাজতবাসও করতে হয়েছে।”

“জানি। শুনেছি।”

বুলা একটা বড় শ্বাস ফেলে বলল, “খুব বোকার মতো কাজ হয়েছিল। প্রতিভা না থাকলে কি চুরি করে বড়লোক হওয়া যায়, বলো! হ্যাকিং করতে, সাইবার ক্রাইম করতে কত বুদ্ধি লাগে, কত কী শিখতে হয়! এটা বোকা চোরদের যুগ নয়।”

“ঠিক কথা।”

বুলা হঠাৎ বলল, “এই শোনো, বিকেল হয়ে আসছে লোকজন আসতে শুরু করেছে। এবার আমি যাই। নইলে কে কী ভাববে!”

“আর-একটু বোসো না।”

বুলা একটু হেসে বলে, “আবার আসব তো। কতদিন কারও সঙ্গে আড্ডা মারিনি বলো তো!”

“তোমার ফোন নম্বরটা চাইলে কি তুমি রাগ করবে?”

“না, রাগ করব কেন, তবে আমি আজকাল বেশির ভাগ সময়েই ফোনটা সুইচ অফ করে রাখি। আমি ওপরে গিয়ে তোমাকে মিসড কল দিচ্ছি। আমার ফোনটা চার্জে বসানো আছে। তোমার নম্বরটা বলো।”

অবাক কাণ্ড হল, বুলা চলে যাওয়ার পর গোটা ল্যান্ডিংটায় হু-হু করে একটা স্পেস ঢুকে পড়ল যেন! এত ফাঁকা তো কোনওদিন মনে হয় না জায়গাটাকে! এই রে! সে কি প্রেমে পড়ে গেল নাকি মেয়েটার! সর্বনাশ!

এবারের নাইট ডিউটিটা ভারী একঘেয়ে শুরু হল। রোজকার মতোই। তবে আর-একটু বোরিং। এমনকী, সোমবার রাতে রাঘববাবু পর্যন্ত রাত এগারোটায় ফিরে এলেন। ট্যাক্সি থেকে নামাতে এগিয়ে গিয়েছিল বুলটন, কিন্তু স্যার নিজেই দিব্যি নেমে এলেন, ডান হাতটা উঁচু করে বললেন, “ধরতে হবে না, আজ ঠিক আছি।”

লবির দিকে না গিয়ে হঠাৎ আজ ল্যান্ডিংয়ে বুলটনের পাশের চেয়ারটায় বসে পড়ে বললেন, “তোমার তো খুব বাউন্সারের চাকরি পছন্দ, তাই না?”

বুলটন রাঘববাবুর সম্মানে চেয়ারে বসেনি, দাঁড়িয়ে ছিল, বলল, “হ্যাঁ স্যার।”

“একজনের সঙ্গে কথা হয়েছে, মধু খাবড়া। তার একটা বার আছে তপসিয়ায়। তাকে বলেছি। তোমাকে পছন্দ হলে নিয়ে নেবে। কাল গিয়ে একবার দেখা কোরো। এই নাও ওর বিজ়নেস কার্ড।”

কার্ডটা হাতে নিয়ে বুলটন রাঘববাবুকে একটা প্রণাম করে ফেলল। তার বহুকালের একটা স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে! অবিশ্বাস্য।

রাঘববাবু হেসে বললেন, “আগে চাকরিটা তো হোক, তারপরে তো প্রণাম!”

দুপুর বারোটায় সুইনহো স্ট্রিটের অফিসে যেতে বললেন মধু খাবড়া। গলাটা বেশ রাশভারী, অথরিটেটিভ।

ঠিক দুপুর বারোটাতেই ভিতরে যাওয়ার ডাক এল। ছোট, সাজানো চেম্বারটায় ঢুকে যে লোকটার মুখোমুখি হল বুলটন, তার চেহারাও জবরদস্ত। লম্বা-চওড়া, মজবুত শরীর, তবে একটু চর্বি আছে পেটে। পঞ্চাশের আশপাশে বয়স। তার দিকে চেয়ে গম্ভীর গলায় বলল, “তুমি তো সিকিওরিটি গার্ড! বাউন্সারের কাজ কিন্তু অন্যরকম। পারবে?”

“হ্যাঁ স্যার, পারব।”

“তোমাকে রাঘববাবু রেকমেন্ড করেছেন, কাজেই ইউ মাস্ট বি ওকে। ঠিক আছে। আজ একুশ তারিখ, তুমি এক তারিখে জয়েন করো। কিছুদিন তোমার কাজ দেখা যাক, তারপর স্যালারি নিয়ে কথা হবে। তবে ইট উইল বি অ্যারাউন্ড টেন থাউজ্যান্ড।”

বেতন কোনও ব্যাপার নয় তার কাছে, যা হোক একটা হলেই হবে। বাউন্সার হওয়াটাই আসল কথা।

সোমবার ডে ডিউটি করতে এসে মনটা একটু খারাপ লাগছিল বুলটনের। জীবনের চেনা ছকটা পালটে যাবে তার। সম্পূর্ণ অজানা একটা জগতে ঢুকে যাবে সে। বার ড্যান্সার, নিবু নিবু আলো, অ্যালকোহলের মাদক গন্ধ, চড়া মিউজ়িক, উচ্চকিত ড্রামের রিদ্‌ম, মাতালদের অসংলগ্ন প্রলাপ, চোরা চাউনি, সন্দেহজনক মানুষ, মস্তান এবং তরল মহিলারা। হ্যাঁ, থ্রিল আছে, অ্যাডভেঞ্চারের আভাস আছে, রিস্কও কি নেই? ঠিক বুঝতে পারছে না বুলটন। একটু অস্বস্তিও হচ্ছে তার।

খুব আনমনে এসব ভাবছিল বুলটন। গত এক সপ্তাহ রাঘববাবু নামমাত্র নেশা করে ফিরছেন। নিজেই উঠে যাচ্ছেন ফ্ল্যাটে, তার সাহায্যের দরকার হচ্ছে না। বুলার সঙ্গে তাই দেখাও হয়নি তার। মুডি মেয়ে, এ সপ্তাহেও দেখা হবে কি না কে জানে! সামনের সপ্তাহে নতুন কাজে চলে যাবে সে। আর হয়তো দেখাই হবে না। সেটা অবশ্য ভালই হবে হয়তো। সে বোধ হয় একটু দুর্বল হয়ে পড়ছিল মেয়েটার প্রতি। সে কোনও সম্পর্কে জড়াতেই চায় না। অফার থাকা সত্ত্বেও সে কখনও জড়ায়নি।

বাজারে যখন যেটা সস্তা সেটাই তার টিফিন বক্সে চলে আসে। আজ দুপুরে টিফিনের বাক্স খুলে দেখল, রুটির সঙ্গে কুদরির তরকারি। খিদের মুখে কিছুই খারাপ লাগে না তার। একটু কটকটে ঝাল হলেই হল।

“কী খাচ্ছ শুনি!”

বুলটনের বুকটা একটা বলটান খেল। আজ পরনে একটা বুটিকের কাজ করা সাদা জমিনের শাড়ি। একই কাজ করা ব্লাউজ়, মাথায় মস্ত খোঁপা। মুখটা তেমনই রূপটানহীন, তেলতেলে। হাসিটা সম্মোহন জানে। চোখ ফেরানো যায় না। অপ্রস্তুত বুলটন তটস্থ হয়ে বলে, “এই তো দ্যাখো না, মা আজ কুদরির তরকারি দিয়েছে।”

পাশের চেয়ারটায় আস্তে করে বসে বলল, “ঠিক তোমার টিফিনের সময়েই এসেছি ভাগ্যিস। কুদরি আমার বেশ লাগে।” বলেই মুখ টিপে একটু হেসে হঠাৎ আঁচলের আড়াল থেকে একটা স্টিলের ঝকঝকে বাটি বের করে এনে বলল, “তোমার জন্য এনেছি।”

বুলটন ভয় খেয়ে বলে, “কী এনেছ?”

কৌটোর ঢাকনাটা খুলল বুলা, মাংসের মোগলাই গন্ধটা যেন জড়িয়ে ধরল বুলটনকে। সে চোখ কপালে তুলে বলে, “তুমি আমার চাকরিটাই খাবে। সেক্রেটারি টের পেলে তাড়িয়ে দেবে আমাকে।”

“আর ন্যাকামি করতে হবে না। চাকরি তো নিজেই ছেড়ে দিচ্ছ শুনলাম। কাল রাতে আমি নিজে রেঁধেছি। খেতে হবে। তোমার ফেয়ারওয়েল ট্রিট।”

বুলটন হাসল না, বুলার দিকে চেয়ে করুণ গলায় বলল, “মনটা বেশ খারাপ লাগছে, জানো!”

“কেন, এটাই তো তোমার অ্যাম্বিশন ছিল বলে জানতাম।”

“হুঁ। তবু কেমন একটা লাগছে। এ তো অনেকটা এনেছ!”

“খাও।”

মুরগিটা এত ভাল রান্না হয়েছে যে, বুলটন অবাক হয়ে বলে, “এ তো শেফদের মতো রান্না! দারুণ!”

বুলা উদাস হয়ে বলে, “গরিবদের রান্না ভালই হয়। না হলে চলবে কেন?”

“বোধ হয় ঠিকই বলেছ। আমার মা তো কচু ঘেঁচু এমন রাঁধে যে, চেটেপুটে খেতে হয়।”

“মায়ের রান্না সব ছেলেরই ভাল লাগে, ওটা মা বলেই।”

“তা অবশ্য ঠিক।”

“মাংস জুটে গেছে বলে আবার কুদরিটাকে ফেলে দিয়ো না। ওটাও খেয়ো।”

“মাংস আজ কুদরির উইকেট ফেলে দিয়েছে, বুঝলে। তবে খেয়ে নেব।”

বুলটন খেয়ে নিল। হাতমুখ ধুয়ে এসে বলল, “দাঁড়াও, তোমার বাটিটা ধুয়ে দিই।”

বুলা ভারী বিরক্ত হয়ে বলে, “রাখো তো, তোমাকে গিন্নিপনা করতে হবে না, ওপরে বাসন মাজার লোক আছে।”

বুলটন আর কিছু বলতে সাহস পেল না। বসে পড়ল। বুলা ফের উদাস মুখ করে অন্য দিকে চেয়ে বসে আছে। যেন পাশে বুলটন নেই, কেউ নেই। বুলটনও সাবধান হল, মুডি মেয়ে, অল্পেই বিগড়ে যায়। তাই কথা না বলে অপেক্ষা করতে লাগল।

অনেক অনেকক্ষণ বাদে বুলা যেন স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে চারদিকে তাকাল। তারপর হঠাৎ যেন বুলটনকে দেখে চিনতে পারছিল না এমনভাবে চেয়ে রইল। তারপর মৃদু হেসে বলল, “চাকরিটা তা হলে নিচ্ছ!”

বুলটন কাঁচুমাচু হয়ে বলে, “কী আর করব বলো তো!”

“কিছু যদি মনে না করো, তা হলে একটা কথা বলবে?”

“কেন বলব না? পুছো তো সহি।”

বুলা হেসে ফেলল। তারপর বলল, “এখানে তুমি কত পাও?”

“সাড়ে সাত হাজার, নাইট অ্যালাউন্স ধরলে হাজার দশেকের মতো। আর চারটে গাড়ি ধুয়ে আরও চার হাজার।”

“আর ওরা কত দেবে?”

“বলছে তো অ্যারাউন্ড টেন থাউজ্যান্ড।”

বুলা যেন কী একটু ভাবল। তারপর বলল, “তুমি বাউন্সার হওয়ার স্বপ্ন দ্যাখো, তাই তোমাকে বলে কোনও লাভ নেই। কিন্তু এই চাকরি কি তোমাকে মানায়? মাতাল বদমায়েশদের সামলানো, গুন্ডা মস্তানদের পাঙ্গা নেওয়া, এটা কি কোনও ভাল কাজ? বাবা বলেন, বাউন্সারদের মধ্যে অনেকে আছে যারা নাকি মাতালদের পকেট থেকে টাকা তুলে নেয়। তোমার ধারণা হয়তো বাউন্সারের চাকরিটা খুব থ্রিলিং, অ্যাডভেঞ্চারাস, কিন্তু আসলে কি তাই? তারা শুঁড়ির মাইনে করা গুন্ডা কাম দরোয়ান। আর বেশিদিন ওই পরিবেশে থাকলে ওই অন্ধকার একটু একটু করে তোমার ভিতরেও ঢুকে যাবে। আমি মাতালদের ভীষণ ভয় পাই, রিপালসিভ বলে মনে হয়। অতক্ষণ মাতালদের পরিবেশে থাকতে গেলে আমি তো পাগল হয়ে যেতাম। বাবা বলছিল, বুলটনটার খুব ইচ্ছে দেখে আমি একটা ব্যবস্থা করেছি বটে, কিন্তু ভাল ছেলেটা নষ্ট হয়ে যাবে।”

বুলটন চুপ করে রইল। অনেকক্ষণ পরে খুব মৃদুস্বরে বলল, “এই চাকরিটাও তো খুব সম্মানজনক নয় বুলা! এখানে পড়ে থেকেই বা কী হবে বলো! এর তো কোনও ভবিষ্যৎও নেই!”

“হুঁ, তা ঠিক। আমিও একসময়ে রেলের চাকরির জন্য পাগল হয়েছিলাম, রেল আমাকে কথা দিয়েও নেয়নি। খুব ভেঙে পড়েছিলাম। কিন্তু আবার তো উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। এই যে শাড়িটা পরে আছি দেখছ? কেমন বলো তো!”

“শাড়ি-টাড়ি তো আমি ভাল বুঝি না, তবে তোমাকে খুব মানিয়েছে। শাড়িটা তো ভাল বলেই মনে হচ্ছে।”

বুলা হেসে ফেলে বলল, “থাক বাবা, তোমাকে আর মতামত দিতে হবে না। তবে এ শাড়িটা আমার নিজের ডিজ়াইন করা, নিজেরই কাজ করা। বাজারে এটা সাত হাজারে বিক্রি হবে। আমাকে মা আজ সকালে জোর করে পরিয়েছে। নইলে আমি শাড়ি পরি নাকি! মা বলল, শাড়ি না পরলে ফিলিংসটা আসবে না, মাঝে-মাঝে পরতে হয়। তাই পরে আছি। এটা হল কনজ়িউমারস মার্কেট, লোকের হাতে পয়সা আছে, তারা কিনতেও চায়। ঠিকমতো জিনিস বানাও, মার্কেটিং করো, সব বিক্রি হবে। যদি ঠিকমতো চানাচুরও বানাতে পারো, তা হলেও শিল্পপতি হয়ে যাবে। তুমি সারা জীবন মাতাল সামলে সেই স্যাটিসফ্যাকশন পাবে কি?”

বুলটন অবাক হয়ে বলে, “ওরে বাবা, সেসব তো অনেক বড় কথা!”

“বড় কথা মনে করে ভয় পেলে কিছু করা যায় না। তুমি যে বাউন্সারের চাকরি করবে সেটা মা-বাবাকে জানিয়েছ?”

“হুঁ। তবে তারা ব্যাপারটা ঠিক বোঝে না। তারা শুধু জানে ছেলে একটা ভাল কাজ পেয়েছে।”

“বুঝলে মত দিত না।”

“তা ঠিক। আচ্ছা স্যার আজকাল তেমন ড্রিংক করেন না তো!”

“তোমাকে তো বললাম, আমি মাতাল দু’চোখে দেখতে পারি না। বাবাকে সোজা বলে দিয়েছি, তুমি যদি মাতাল হও তা হলে আমি তোমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। তাই ভয় পেয়েছে। আমার হাতে-পায়ে ধরে বলেছে, একবারে ছাড়লে অসুখ করবে, আস্তে-আস্তে ছাড়ব। তাই কম খাচ্ছে। তবে একদম ছেড়ে দেবে, আমি জানি।”

“তোমাকে খুব ভালবাসেন তো!”

“ওদের তো ছেলেপুলে নেই। যখন ছোট ছিলাম তখনই আমার মা একবার কাজ করার জন্য আমাকে ওদের কাছে এনেছিল। তখন বাবা আর মা থাকত যাদবপুরে। মা আমাকে দেখেই আমার মাকে বলে, ও মা, এ কাজ করবে কেন, আমাকে দাও, আমি ওকে পুষ্যি নেব। মা রাজি হয়নি। আমরা ঢাকা জেলার মানুষ, তখন যাদবপুরে বিধানপল্লির রেফিউজি কলোনিতে থাকতাম। সেই থেকে শুরু সম্পর্ক। এখন আর ছাড়তে চায় না। জেল থেকে বাবাই ছাড়িয়ে এনেছে। আমিই-বা আর কোথায় যাব বলো? এখানে আছি বলে রোজগার হচ্ছে, মা-বাবাকে টাকা পাঠাতে পারছি।”

“বাঃ, বেশ মজা তো! এখন তোমার দুটো বাবা আর দুটো মা।”

বুলা হেসে বলে, “শুধু মজা নয়, ঝামেলাও আছে, দু’জোড়া বাবা-মায়েরই বেজায় ঝগড়া। সামাল দেওয়াই মুশকিল। তবে হ্যাঁ, এরা আমাকে ভালওবাসে খুব। মা নিজের হাতে আমাকে বুটিকের কাজ শেখায়।”

“এই ব্যবসায়ে কি অনেক লাভ?”

“খারাপ কী বলো! খাটতে হয় বটে, কিন্তু মাসে ত্রিশ-চল্লিশ হাজার টাকা হয়েই যায়। মার্কেটিংটা ঠিকঠাক হলে আরও বাড়বে। একটাই মুশকিল, লার্জ স্কেলে বুটিক করার জন্য অনেক এক্সপার্ট হ্যান্ডস দরকার। তুমি তা হলে এক তারিখে নতুন কাজে জয়েন করছ!”

“সে রকমই কথা হয়ে আছে।”

“আর হয়তো দেখা হবে না। ভাল থেকো।”

চেয়ারটায় আস্তে করে বসেছিল বুলা, তেমনই আস্তে উঠে দাঁড়াল।

“এখনই চলে যাবে? আর-একটু বোসো না।”

“কাজ করতে করতে উঠে এসেছিলাম, ঘরময় জিনিস ছড়িয়ে আছে। হাতে অর্ডার রয়েছে, সময়মতো দিতে হবে তো।”

বুলা চলে যাওয়ার পরই এক শূন্যতার অনুপ্রবেশ। হু হু করে একটা স্পেস যেন কোথা থেকে উড়ে এসে ডানার বিষণ্ণ ছায়ায় চারদিকের সব ঔজ্জ্বল্য ঢেকে দিল। কী যে হচ্ছে এসব!

পরপর তিনদিন আর বুলার দেখা নেই। ফোন করতে ঠিক সাহসে কুলোয় না, ইচ্ছে করে কিন্তু।

ডে ডিউটির একেবারে শেষের দিন সকাল থেকেই খুব ঝড় আর বৃষ্টি। আলো নেই। ল্যান্ডিং ফাঁকা। খুব একা বসে ছিল বুলটন। আর দুটো দিন, তারপর সে একটা অচেনা জগতে ঢুকে পড়বে। কেমন হবে কে জানে। তবে সে বরাবর দেখে এসেছে, যা কল্পনা করা যায় বা যা ধরে নেওয়া হয় বাস্তবের সঙ্গে তা মেলে না। চাকরিটা যতটা থ্রিলিং হবে বলে সে ভেবেছিল ততটা বোধ হয় হবে না। তাই একটু ভয়-ভয় করছে তার। তার জিগরি দোস্ত হল রাজু, সে শুনে বলেছে, তুই খরচা হয়ে যাবি। রাজু বেশি কথা কয় না, একটু কীরকম আছে যেন। নরমাল অ্যাবনরমাল।

টিফিনের কৌটোটা খুলে আজ বুলটন অবাক। রুটির সঙ্গে আলুপোস্ত! মা পোস্ত পেল কোথায়! পোস্ত খাওয়ার ধক তো তাদের নেই! দু’-একবার রুটির সঙ্গে মাখিয়ে খেয়ে দেখল পোস্ত নয়, সাদা সরষে। দেখতে হুবহু পোস্ত। বিভ্রম! তা বিভ্রম জিনিসটাও খারাপ নয়, বিভ্রমে বিভ্রমেই জীবনটা বেশ কাটিয়ে দেওয়া যায়। খেয়ে একটু ঘুম-ঘুম পাচ্ছিল তার। প্লাস্টিকের টেবিলটায় মাথা রেখে একটু ঘুমিয়ে নিল। বৃষ্টি ছাড়া কোনও ঘটনা নেই আজ। কোনও সংবাদ নেই। ক্রমে বিকেল হয়ে গেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধে। রবিঠাকুরের একটা লাইন মনে পড়ছিল তার। মেঘের অন্তরপথে অন্ধকার হতে অন্ধকারে চলে গেল দিন। মনে-মনে চুপিচুপি একটা আশা ছিল আজ শেষ দিনটায় বুলা একবার আসবে। এল না। রাত-ডিউটির সুকুমার এলে নিজের ছাতাটা খুলে বেরিয়ে পড়ল সে। একা এবং বড্ড সঙ্গীহীন।

ফোনটা করল সকালে এবং হঠাৎ, কিছু ভেবেচিন্তেও নয়।

মধু খাবড়ার গমগমে গলাটা যেন ধমকে উঠল তার কানে, “হ্যাল্লো!”

“স্যার, আমি ভোলানাথ সর্দার।”

“কে ভোলানাথ?”

“আমি স্যার, বুলটন। রাঘববাবুর রেফারেন্সে বাউন্সারের চাকরির জন্য গিয়েছিলাম।”

“ও হ্যাঁ, বলো।”

“স্যার, আমি চাকরিটা করব না। সরি।”

“ইটস ইয়োর চয়েস জেন্টলম্যান। ওকে। ইউ আর ওয়েলকাম।”

বলেই ফোনটা কেটে দিল খাবড়া। বুলটন হাঁফ ছাড়ল। কাল থেকে নাইট ডিউটি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *