১৩.
শ্রাবণ মাসের প্রথমে আমার পাঠশালা গেল উঠে। আর আমার এখানে শুধু-হাতে থাকা অসম্ভব। মালতীকে একদিন বললাম—শোনো, আমি চলে যাচ্ছি মালতী–
সে অবাক হয়ে বললে–কেন চলে যাবেন?
—কতদিন এসেছি ভাবো তো এখানে? প্রায় দশ মাস হ’ল—
মালতী চুপ করে থেকে বললে ঘুরে আবার আসবেন কবে?
—ভগবান জানেন। না-ও আসতে পারি।
মালতীর মুখের স্বাভাবিক হাসি হাসি ভাবটা যেন হঠাৎ নিবে গেল। বললে–কেন আসবেন না? আখড়ার কত কাজ বাকি আছে মনে নেই?
ওর মুখ দেখে আমার আবার মনে হ’ল,–ওর কেউ নেই, এখানে ও একেবারে একা। ওকে বুঝবার মানুষ এই গ্রাম্য অশিক্ষিত বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীদের মধ্যে কে আছে? আমার কাছেই ওর যা-কিছু অভিমান আবদার খাটে–এর মধ্যে যে লীলাময়ী কিশোরী আছে, সে তার নারীত্বের দর্প, গর্ব ও অভিমান প্রকাশ করে সুখ পায় একমাত্র আমার কাছে–আমি তা জানি। তা ছাড়া, ও এখনও বালিকা, ওর ওপর আমার মনে কি যে একটা অনুকম্পা জাগে…ওকে সকল দুঃখ, বিপদ থেকে আড়াল করে রাখি ইচ্ছা হয়। শ্রাবণ মাসে নীল মেঘের রাশি দ্বারবাসিনীর চারিধারের দিগন্তবিস্তৃত তালীবন-শোভা মাঠের ওপর দিয়ে উঠে যায় রোজ…আমি দীঘির ধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি, দেখে দেখে মনে কত কি অনির্দিষ্ট অস্পষ্ট আকাঙ্ক্ষা জাগে। মনে হয় ছোট্ট কোন কলস্বনা গ্রাম্য নদীতীরে খড়ের ঘরে মালতীকে নিয়ে ছোট্ট সংসার পাতবো…আমরা দুজনে এমনি সব বর্ষা-মেদুর শ্রাবণ-দিনে ব’সে ব’সে কত কথা বলব, কত আলোচনা করব। ওকে রাঁধতে দেব না, কাজ করতে দেব না, আমার কাছ থেকে উঠতে দেব না–কত বিশ্বাসের কথা, ভক্তির কথা, জ্ঞানের কথা, সাধু-মোহন্তের কথা, আকাশের তারাদের কথা–ও আমায় বোঝাবে, আমি ওকে বোঝাবো।…কিন্তু তা হবার নয়। মালতী ওর বাপের আখড়া ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না–আমি অনেকবার ঘুরিয়ে প্রশ্ন করে ওর মনের এ ইচ্ছা বুঝেছি। আমি ওকে চাই একান্ত আমার নিজস্ব-ভাবে–এখানে থাকলে ও দিনে রাতে কাজে এত ব্যস্ত থাকে যে ওকে সেভাবে পাওয়া অসম্ভব। এই আখড়াই হয়েছে ওর আর আমার মধ্যে ব্যবধান। আমি এখান থেকে ওকে নিয়ে যেতে চাই। আমিও এখানে থাকতে পারব না চিরকাল। মালতীকে ভালবাসি, কিন্তু ওকে বিবাহ করে এই রাঢ়-অঞ্চলের এক গ্রাম্য আখড়ায় চিরকাল কি করে কাটাবো বৈষ্ণব-বৈষ্ণবী সেজে? আমি ওকে নিয়ে যাব এখান থেকে।
এক দিনের ব্যাপারে মালতীকে আরও ভাল করে চিনলুম। দ্বারবাসিনী গ্রামের বৃদ্ধ শম্ভু বাঁড়ুয্যে চার-পাঁচ দিনের জ্বরে মারা গেল। তিনি এখানকার সমাজের কাছে একঘরে ছিলেন–এটা আমি আগেই জানতাম। তাঁর একমাত্র বিধবা কন্যাকে নিয়ে কি-সব কথা নাকি উঠেছিল–তাই থেকে গ্রামে শম্ভু বাঁড়ুয্যে একঘরে হন। শম্ভু বাঁড়ুয্যে কোথাও যেতেন না, কারও সঙ্গে মিশতেন না, তাঁর হাতেও দু-পয়সা ছিল–সবাই বলত টাকার গুমর।
বেলা পাঁচটার সময় মালতী এসে বললে–শুনেছেন ব্যাপার? শম্ভু বাঁড়ুয্যেকে এখনও বের করা হয় নি–আমি এতক্ষণ ছিলাম সেখানে। সেই দুপুর থেকে একজন লোকও ওদের বাড়ির উঠোন মাড়ায় নি। মড়াকোলে মেয়েটা দুপুর থেকে বসে আছে–ওর মা তো বাতে পঙ্গু, উঠতে পারে না। আপনি আসুন, দু-জনে মড়া তো দোতলা থেকে নামাই–তার পর উদ্ধব-জ্যাঠাকে বলেছি আখড়ার লোকজন নিয়ে আমাদের সঙ্গে যাবে– ব্রাহ্মণের মড়া অপর জাতে ছুঁলে ওদের কষ্ট হবে–তাই চলুন আপনি আর আমি আগে নামাই–তার পর আমাদেরই নিয়ে যেতে হবে অজয়ের ধারে–পারবেন তো?
তিনজনে ধরাধরি করে সেই ঘোরানো ও সঙ্কীর্ণ সিঁড়ি দিয়ে মড়া নামানো–ওঃ সে এক কাণ্ড আর কি! মালতী আর শম্ভু বাঁড়ুয্যের মেয়ে নীরদা এক দিকে–আমি অন্য দিকে। নীরদা দেখলুম খুব শক্ত মেয়ে–বয়সে মালতীর চেয়ে বড়–বছর বাইশ হবে ওর বয়েস, মালতীর মত মেয়েলী গড়নের মেয়ে নয়, শক্ত, জোরালো হাত-পা, একটু পুরুষ ধরনের মালতী খুব ছুটোছুটি করতে পারে বটে, কিন্তু ওর গায়ে তেমনি শক্তি নেই। নীরদার সাহায্য না পেলে সেদিন শুধু মালতীকে দিয়ে মড়া নামানো সম্ভব হত বলে মনে হয় না। শেষ পর্যন্ত গাঁয়ের লোক এল এবং তারাই মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে গেল। আমিও সঙ্গে গেলুম, মেয়েদের যেতে হ’ল না, মালতী রইল নীরদার কাছে। নীরদা আমায় বললে–দাদা, শ্রাদ্ধের সময় কিন্তু আপনাকে সব ভার নিতে হবে। আর কারও হাতে দিয়ে আমার বিশ্বাস হবে না। রুণি তো আছেই, আপনাকে অন্য কিছু খাটাবো না, ভাঁড়ারের ভার আপনাকে হাতে নিতে হবে, নইলে এ-সব পাড়াগাঁয়ের ব্যাপার আপনি জানেন না।
বেশ ঘটা করেই শ্রাদ্ধ হ’ল। মালতী বুক দিয়ে পড়ে কি খাটুনিটাই খাটলে! মালতী, তুমি আমার চোখ খুলে দিলে। ঘুম নেই, নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, বসা নেই–কিসে কাজ সর্বাঙ্গসুন্দর হবে, কেউ নিন্দে করবে না ওদের, কোন জিনিস অপচয় না হয় ওদের, সে-ই একমাত্র লক্ষ্য। পরের কাজে এমনি করে নিজেকে ঢেলে দিতে তুমি পার তোমার বাবার রক্ত তোমার গায়ে বইছে বলে।
নীরদাকেও চিনলুম সেদিন।
রাত দশটা। রান্নাঘরের দরদার কাছে শূন্য ডালের গামলা, লুচির ধামা, ডালনার বালতির মধ্যে নীরদা দাঁড়িয়ে আছে। সারাদিন কি খাটুনিই খেটেছে সে! চরকির পাক ঘুরেছে মালতীর সঙ্গে সমানে সেই সকাল থেকে–এর মধ্যে আবার পীড়িতা মায়ের দেখাশুনা করেছে ওপরে গিয়ে। ঘামে ও শ্রমে মুখ রাঙা নীরদার রং বেশ ফর্সা, চুল আলুথালু হয়ে মুখের পাশে কপালে পড়েছে।
আমি বাইরের ক-জন লোককে খাওয়াব ব’লে কি আছে না-আছে দেখতে রান্নাঘরে ঢুকেছি। নীরদা বললে–দাদা, কিছু নেই আর ক-জন লোক? আচ্ছা দাঁড়ান, ময়দা মাখছি, দিচ্ছি ভেজে।
আমি বললুম–আর তুমি আগুনের তাতে যেও না নীরদা। তোমার চেহারা যা হয়েছে! আচ্ছা দাঁড়াও–মালতীকে বলি একটু মিছরির শরবৎ তোমায় বরং দিতে–
নীরদা বললে–দাঁড়ান, দাঁড়ান দাদা। রুণি কতবার খাওয়াতে এসেছিল–সে কি চুপ করে থাকবার মেয়ে?
তারপর হেসে বললে–আজ যে একাদশী, দাদা।
আমার চোখে জল এল। আর কিছু বললাম না। মেয়েমানুষের মত সহ্য করতে পারে কোন জাত? অনেক শিখলাম এদের কাছে এই ক-মাসে।
মাকে দেখেছি, বৌদিদিকে দেখেছি, সীতাকে দেখেছি, শৈলদিকে দেখেছি, এদেরও দেখলাম। অথচ এই নীরদাকে ভেবেছিলুম অশিক্ষিতা গ্রাম্য মেয়ে, ওর কথাবার্তায় রাঢ় দেশের টান বড় বেশী ব’লে।
মালতী আখড়ায় ফিরে এসে আমায় বললে–অনেকগুলো সন্দেশ এনেছি, খান– নীরদাদিদি জোর করে দিলে। ভাল সন্দেশ, দ্বারবাসিনীতে এ-রকম করতে পারে না, সিউড়ি থেকে আনানো।
তার পর কেমন এক ধরনের ভঙ্গি করে হাসতে হাসতে বললে–বসুন, ঠাঁই করে দিই আপনাকে। ও-বেলার লুচি আছে, দই আছে,–নীরদাদিদি একরাশ খাবার দিয়েছে বেঁধে–
ওকে এত ছেলেমানুষ মনে হয় এই-সব সময়ে!
ঘরে কেউ নেই, নিঃসঙ্কোচে আমার কাছে বসে ও আমায় খাওয়ালে–খেতে খেতে একবার ওর মুখের দিকে চাইলাম। কি অপূর্ব স্নেহ-মমতামাখা দৃষ্টি ওর চোখে! মালতীর কাছে এত ঘনিষ্ঠ যত্ন এই কিন্তু প্রথম। বললে–আমি কি আর দেখি নি যে আজ সারাদিন আপনি শুধু খেটেছেন আর পরিবেশন করেছেন, খাওয়া যা হয়েছিল ও-বেলায় আপনার, তার আমি সন্ধান রাখি নি ভেবেছেন? খান,–না–ও লুচি ক-খানা খেতেই হবে।
খাবো কি, লুচি গলায় আটকে যেতে লাগল–সে কি অপূর্ব উল্লাস, আমার সারাদেহে কিসের যেন শিহরণ। আজ সারদিনের ভূতগত খাটুনির মধ্যেও মালতী দৃষ্টি রেখেছিল আমি কি খেয়েছি না-খেয়েছি তার ওপর।
ঘন বর্ষা নামল। সারা মাঠ আঁধার ক’রে মেঘ ঝুপসি হয়ে উপুড় হয়ে আছে। এই সব দিনে মালতীকে সর্বদা কাছে পেতে ইচ্ছে করে–ইচ্ছে করে ঘরের কোণে বসে ওর সঙ্গে সারা দিনমান বাজে বকি। কিন্তু ও আসে না, এমনই সব বর্ষার দিনে আখড়ার যত সব খুচরো কাজে ও ব্যস্ত থাকে।
দু-একবার যখন দেখা হয় তখন বলি–মালতী, আস না কেন?
মালতী বলে সে আসবে। তার পর এক ঘণ্টা, দু ঘণ্টা কেটে যায়, ও আসে না। আমার রাগ হয়, অভিমান হয়। ও যদি আমার জন্যে একটুও ভাবত, তাহলে কি আর না এসে পারত? ওর কাছে কাজই বড়, আমি কেউ নই। কিন্তু হয়ত অপ্রত্যাশিত ভাবে হঠাৎ মালতী এসে পড়ে। প্রায়ই বিকেলের দিকে, এমন কি সন্ধ্যার সময়। চুলটি টান-টান করে বেঁধে পান খেয়ে ফুল্ল ওষ্ঠাধর রাঙা ক’রে হাসিমুখে আমার দাওয়ার সামনে এসে বলে–কি করছেন?
–এস মালতী, সারাদিন দেখি নি যে?
–আপনার কেবল–সারাদিন দেখি নি, আর, এই তখন ডাকলুম এলে না কেন, আর, কেন আস না–এই-সব বাজে কথা। আসি কখন? দেখছেন তো। খেয়ে উঠেছি এই তো ঘণ্টাখানেক আগে। কাজ ছিল।
–কি কাজ ছিল আমি আর জানিনে মালতী? উদ্ধব-বাবাজীর কোণের ঘরে মেঝের চাটাই পেতে বসে তোমার সেই কবিতার বই লিখছিলে–আমি দেখি নি বুঝি?
–বেশ, দেখেছেন তো দেখেছেন। আসুন বিষ্ণুমন্দিরে সন্ধে দেখিয়ে আসি–একা ভয় করে।
বাস্তবিকই আমি ওকে একমনে বই লিখতে দেখেছিলাম। প্রায়ই দেখি। মালতী ঠিক পাগল, আচ্ছা, পাষণ্ডদলনের অনুকরণে লেখা ওর বই কে পড়বে যে রাত নেই দিন নেই বই লিখছে! ওর মুখ দেখলে আমার কষ্ট হয়। ওই এক খেয়াল ওর। মালতীর সঙ্গে বিষ্ণুমন্দিরে গেলাম। মালতীর এই এক গুণ, ও যখন মেশে তখন মেশে নিঃসঙ্কোচে, উদার ভাবে। সে-সম্বন্ধে কোনো বাধা বা সংস্কার ও মানে না। কেন এই সন্ধ্যাতে আমার সঙ্গে একা যাবে পুকুরপাড়ের বিষ্ণুমন্দিরে–এ-সব নিয়ে সঙ্কোচ নেই ওর। মন্দিরের পথে যেতে যেতে মনে হ’ল মালতীকে পেয়ে আমার এই বর্ষাসন্ধ্যাটি সার্থক হ’ল। ওকে ছেড়ে আর কিছু চাই নে। কাঞ্চনফুলতলায় গিয়ে বললাম–সেই গানটা গাও না, সেদিন গাইছিলে গুনগুন করে!
মালতী ছেলেমানুষের মত ভঙ্গিতে বললে–উদ্ধব-জ্যাঠা যে শুনতে পাবেন?
—তা পাবেন, পাবেন।
—তা পাবেন, পাবেন।
—তবে আসুন পুকুরের ঘাটে গিয়ে বসি।
মালতীর মুখে গানটা বেশ লাগে–দু-তিনবার শুনলাম।
আমার নয়নে কৃষ্ণ নয়নতারা হৃদয়ে মোর রাধা-প্যারী
আমার বুকের কোমল ছায়ায় লুকিয়ে খেলে বনবিহারী।
গান শেষ হ’লে বললাম–শোন কথাটা কথা বলি মালতী, তুমি আস না কেন? তোমাকে না দেখলে আমার বড় কষ্ট হয়। আজ সারাদিন বসেছিলুম ঘরের দাওয়াতে, এমন বর্ষা গেল–তুমি চৌষট্টিবার আমার ঘরের সামনে দিয়ে যাও, একবার তো এলে পারতে? তোমার সে-সব নেই। শুধু কাজ আর কাজ। এই যে তোমাকে পেয়েছি, আর আমার যেন সব ভুল হয়ে গিয়েছে–সত্যি বলছি মালতী।
মালতী মুখ নীচু করে হাসি-হাসি মুখে চুপ করে রইল।
আমি বললাম–হাসলে চলবে না মালতী। কথার উত্তর দাও। তুমি কি ভাবো আমি তোমাদের এখানে পড়ে আছি খেতে পাইনে বলে তাই? তা নয়।
–কে বলেছে আপনাকে যে না খেতে পেয়ে এখানে আছেন? আমি আপনাকে বলেছি নাকি?
–যাক ওসব বাজে কথা। আমার কথার উত্তর দাও।
মালতী আবার ছেলেমানুষি আরম্ভ করলে। মুখ নীচু করে হাঁটুর কাছে ঠেকিয়ে মৃদু মৃদু হাসিমুখে হাত দিয়ে শানের ওপর কি আঁকজোক কাটতে লাগল, কখনই ওর কাছে আমার কথার সোজা জবাব পেলাম না।
এক দিন বেড়াতে গিয়ে বাঁধের ওপর বসে আমার অবস্থাটা ভেবে দেখলুম। আমি এমন জড়িয়ে পড়েছি যে নড়বার সাধ্য নেই এতটুকু। ও আমার সব কিছু ভুলিয়ে দিয়েছে–যে উদ্দেশ্যে এই দু-বছর পথে পথে ঘুরেছি সে উদ্দেশ্য এখন হয়ে পড়েছে গৌণ। এখন মালতীই সব, মালতীই আমার বিশ্বের কেন্দ্র, ও যখন আসে তখন জীবনে আর কিছু চাইবার থাকে না, ও যেদিন আসে, যেদিন হেসে কথা বলে–আমার মত সুখী লোক সেদিন জগতে আর কেউ থাকে না,– মাঠের ওপর সূর্যাস্ত সেদিন নতুন রঙে রঙীন হয়, বিচালি-বোঝাই গাড়িগুলোর দ্বারবাসিনীর হাটের দিকে যায়, তাদের চাকার শব্দও ভাল লাগে, আখড়ার বাবাজীরা নিমগাছে উঠে নিমপাতা পাড়ে–সে-ই যেন এক নতুন দৃশ্য। মালতী যেদিন আসে না, কি ভাল করে কথা বলে না, সারাদিন আমার মনে শান্তি থাকে না, ওরই কথা ভাবি সারাক্ষণ–কতক্ষণে দেখা হবে, কতক্ষণে কথা বলবো। মালতী আমায় এমন জালেও জড়িয়ে ফেলেছে!
হয়ত আমি এখান থেকে যেতাম না–হয়ত শেষ পর্যন্ত থেকেই যেতে হত–কিন্তু যেদিন মালতী আমার কাছে বসে পুকুরঘাটে গান গাইলে তার পরদিনই দুপুরের পরে উদ্ধব-বাবাজী আমায় ডেকে বললে–একটা কথা বলি আপনাকে–কিছু মনে করবেন না। আপনার এখানে অনেক দিন হয়ে গেল, আমাদের আখড়ার নিয়ম অনুসারে তিন দিন মাত্র এখানে অতিথ-বোষ্টমের থাকবার কথা। আপনার প্রায় এগারো মাস হল–
আমি চুপ করে রইলাম, কারণ ওর মুখ দেখেই আমার মনে হ’ল এটা কথার ভূমিকা–আসল কথাটা এখনও বলে নি। ঘটলও তাই। একটু ইতস্তত করে উদ্ধব বললে–তাতেও কিছু না–কি জানেন, আপনার রুণির সঙ্গে এই মেলামেশাটা ভাল দেখাচ্ছে না। আপনার কাছে বসে পুকুরঘাটে বিকেলে ও গান গেয়েছিল–একথা নিয়ে সবাই–বুঝলেন না, মেয়েমানুষের নামে দুর্নাম রটতে দেরি লাগে না। আমি ওর অভিভাবক–এসব যাতে না হয় আমার দেখা উচিত বলেই আপনাকে জানাচ্ছি এ-কথা। রুণি-মা সেরকম মেয়ে নয়। আমি সেটা খুবই জানি, কিন্তু লোকে তো–রাগ করবেন না, ভেবে দেখুন। লোকে যদি ওর নাম পাঁচটা কথা ওঠায় বা বলে–সেটা আমার উচিত হতে না দেওয়া–নয় কি?
আমি বললাম–সেটা আমার অন্যায় হয়েছে স্বীকার করি। কিন্তু আমি ওকে বিয়ে করতে চাই। আপনি তো বলেছিলেন, মালতীর যদি ইচ্ছে হয়–ওর বাবার ওর ওপর আদেশ আছে।–
–কিন্তু ওর বাবা কণ্ঠীধারী বৈষ্ণব ছিলেন–আপনি ব্রাহ্মণ বটে, বৈষ্ণব নন, তার ওপর আপনি খৃস্টানী মতের লোক, আপনার সঙ্গে কি ক’রে ওর বিয়ে হতে পারে?..ও বৈষ্ণবের মেয়ে, বৈষ্ণবের সঙ্গেই ওর বিয়ে হবে। তবে মালতীর এতে কি ইচ্ছে জানুন, সে যদি বলে, আমার আপত্তি নেই–ওর বাবা ওরই ওপর সে ভার দিয়েছিলেন।
সেদিনই সন্ধ্যার সময় ওকে নির্জনে পেলাম। ওকে বললাম–একটা কথা বলব মালতী? তুমি অভয় দেবে?
মালতী কৌতুকের সুরে বললে–উঃ মাগো–যাত্রার দলের মত কথা শুনে আর বাঁচিনে। কি বলবেন বলুন না?
তুমি কি চিরকাল এই ভাবে জীবন কাটাবে? না, হাসিখুশী না—দরকারী কথা। সবতাতেই হাস কেন–ভেবে দেখ আমি কি বলছি–
–কেন এ জায়গা কি খারাপ? এমন চমৎকার মাঠ, দীঘি–আপনি সেদিন কি কবিতাটা বলছিলেন।
মালতী কথা শেষ না করেই ছেলেমানুষি হাসি শুরু করলে। আমি বললাম–না মালতী, লক্ষ্মীটি ওভাবে কথা উড়িয়ে দিও না। আমি তোমায় চাই। তোমায় বিয়ে করে এখান থেকে নিয়ে যেতে চাই। কি বল তুমি?
মালতীর মুখের হাসি হঠাৎ বন্ধ হয়ে এল–সে কেমন বিস্ময়বিহ্বল-দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইলে–তার পরেই তার মুখেচোখে ঘনিয়ে এল লজ্জা। ওর এ ধরনের লজ্জা আমি কখনও দেখি নি।
বেশ খানিকক্ষণ কেটে গেল। মালতীর মুখে উত্তর নেই। বললাম–ভেবে উত্তর দিও। এখুনি চাইনে তোমার উত্তর। তাড়াতাড়ি কিছু না বলাই ভাল।
মালতী এতক্ষণ মুখ নীচু ক’রে ছিল–এইবার মুখ তুলে কিন্তু অন্যদিকে চেয়ে বললে–কিন্তু এ জায়গা ছেড়ে যেতে হবে কেন?
–ছেড়ে যেতে হবে এই জন্য মালতী যে, আমি তো তোমাকে এখানে আখড়ায় থাকতে দিতে পারব না। আমিও এখানে চিরদিন কাটাতে পারি নে।
মালতীর মুখের ভাবে আমার মনে হল আমার মুখে এ-কথা যেন ওর পক্ষে অপ্রত্যাশিত। ও কি ভেবেছে আমিও চিরকাল এই আখড়াতেই থেকে যাব? ওর মুখ দেখে মনে হল আমার এ কথায় ও মনে বেদনা পেয়েছে। আমি কথাটা যতদূর সম্ভব নরম করতে পারা যায় করে বললাম–তুমি এখনও ছেলেমানুষ! নিজের সম্বন্ধে বিচার করে দেখতে পাবার ক্ষমতা এখনও হয় নি। তুমি একা এখানে কি করবে বল? উদ্ধব বাবাজীও চিরকাল থাকবেন না। এই মাঠের মধ্যে আখড়ায় চিরজীবন কাটাবে একা একা?
মালতী মুখ নীচু করেই আস্তে আস্তে নরম সুরে বললে–বাবা মরণকালে এর ভার সঁপে দিয়েছিলেন উদ্ধব-জ্যাঠার ওপর নয়, আমারই ওপর। বাবার বিষ্ণুমন্দির আমায় শেষ করে তুলতে হবে। উদ্ধব-বাবাজী চিরদিন থাকবেন না বলেই তো আমার এখানে আরও থাকা দরকার। বাবার ধানের জমি পাঁচজনে লুটেপুটে খাবে অথচ আখড়ার দোর থেকে অতিথ-বোষ্টম গরীব লোকে ফিরে যাবে খেতে না পেয়ে, এ আমি বেঁচে থেকে দেখতে পারব না। তাতে কোথায় গিয়ে আমার শান্তি হবে?
মালতীর মুখে এ ধরনের গম্ভীর কথা–বিশেষ করে ওর নিজের জীবন নিয়ে–এই প্রথম শুনলাম। সব জিনিস নিয়ে ও হালকা হাসি-ঠাট্টা করে উড়িয়ে দেয়, এই ওর স্বভাব। ও এ ধরনের কথা বলতে পারে তা আমি ভাবি নি। বললাম–মালতী, এটা কি তোমার মনের কথা? জীবনটা এই করে কাটাবে? এতেই শান্তি পাবে? আমি যে প্রস্তাব করেছি, তাতে তুমি রাজী নও? কারণ আমি এখানে থাকতে পারব না চিরকাল এটা নিশ্চয়।
শেষ কথাটা বলতে আমার বুক বেদনায় টনটন করে উঠল, তবুও বলতে হল।
মালতী অনেকক্ষণ বিমুখী হয়ে বসে রইল। কাপড়ের একটা আঁচল পাকিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে ছেলেমানুষের মত সেটা নিয়ে নাড়াচাড়া করলে অনেকক্ষণ। আমার মনে হল ও হয়ত কাঁদছে, নয়ত কান্না চেপে রাখবার চেষ্টা করছে।
তার পরে আমার দিকে একবার চেয়েই আবার মুখ ফিরিয়ে বললে–কি করব বলুন, আমার অদৃষ্টে ভগবান এই লিখেছেন, এই আমায় করতে হবে।
আমার কেমন একটা অভিমান হ’ল, বললাম–এই তাহলে তোমার শেষ কথা? বেশ মালতী।
মালতী সে কথার উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল মাথা নীচু করে। আবার আমার মনে হ’ল ও কাঁদছে, কিম্বা কান্না চেপে রাখবার চেষ্টা করছে–একবার মনে হ’ল ওর ডাগর চোখ দুটি জলে ভ’রে এসেছে–কিন্তু অভিমানের আবেগে আমি সেদিকে ফিরেও চাইলাম না।
রাত্রে বাইরে বসে ভাবলুম। সারারাত্রিই ভাবলুম।
মালতীকে ছেড়েই যেতে হ’ল শেষ পর্যন্ত?
ও না এক দিন আমায় বলেছিল..আখড়ার কত কাজ বাকী আছে মনে নেই?
আমার ওপর কিসের দাবিতে এ কথা বলেছিল ও?
সে দাবি অগ্রাহ্য করে নিষ্ঠুর ভাবে যাব চলে?
যদি না যাই–তবে এখানে আখড়ার মোহন্ত সেজে চিরকাল থাকতে হবে। এই গ্রাম্য বৈষ্ণবদের সঙ্কীর্ণ গণ্ডী ও আচার-সংস্কারের মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে হবে।
নিস্তব্ধ তারাভরা রাত্রি। দীঘির পার থেকে হু-হু হাওয়া বইছে।
নীল আকাশের দেবতা, যাঁর ছবি এই বিশাল মাঠের মধ্যে সন্ধ্যার মেঘে, কালবৈশাখীর ঝোড়ো হাওয়ায়, এই রকম তারাভরা অন্ধকার আকাশের তলে কতবার আমার মনে এসেছে, তাঁকে পাওয়া আমার হঠাৎ ফুরিয়ে না যায়…যে দেবতা সকল ধর্মের অতীত, দেশকালের অতীত..যার বেদী যেমন এই পৃথিবীতে মানুষের বুকে, তেমনি ওই শাশ্বত নীলাকাশে অনন্ত নক্ষত্রদলের মধ্যে…মর্ত্যে ও অমর্তে তাঁর বীণার দুই তার…আমার মনে হোমের আগুন তিনি প্রজ্জ্বলিত রাখুন সুদীর্ঘ যুগসমূহের মধ্যে…শাশ্বত সময় ব্যেপে। আমার যা-কিছু মনের শক্তি, যা-কিছু বড়, তাই দিয়ে তাঁকে বুঝতে চাই। গণ্ডীর মধ্যে তিনি থাকেন না।
পরদিন খুব ভোরে–আখড়ার কেউ তখনও বিছানা থেকে ওঠে নি–কাউকে কিছু না জানিয়ে আমি দ্বারবাসিনীর আখড়া থেকে বেরিয়ে পড়লুম। কিসের সন্ধানে বেরিয়েছি তা আমি জানি নে–আমার সে সন্ধানের আশা আলেয়ার মত হয়ত আমাকে পথভ্রান্ত করে। পথ থেকে বিপথে নিয়ে গিয়ে ফেলবে–শুধু আমি এইটুকু বুঝি যে, যে কোন গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ হয়ে থাকলে আমার চোখের অস্বচ্ছ দৃষ্টির সামনে তার প্রবুদ্ধমান রূপ ক্ষীণ হয়ে আসবে–আমার কাছে সেই সন্ধানই সত্য—-আর সব মিথ্যে, সব ছায়া।
লোচনদাসের আখড়া ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। কোন দিকে যাব তার কিছুই ঠিক নেই। বর্ষাকাল কেটে গিয়েছে, আকাশ নির্মল, শরতের সাদা লঘু মেঘখণ্ড নীল আকাশ বেয়ে উড়ে চলেছে, মণিহারী ঘাটের কাছে গঙ্গা পার হবার সময় দেখলুম গঙ্গার চরের কাশ-বনে কি অজস্র কাশফুলের মেলা! খানিকটা রেলে খানিকটা পায়ে হেঁটে এলাম কহলগাঁয়ে। গঙ্গার ধারে নির্জর স্থানটি বড় ভাল লাগল। স্টেশনের কাছেই পাহাড়, সামনে যে পাহাড়টা, তার ওপরে ডাকবাংলো–এখানে একটা রাত কাটালাম। ডাক-বাংলোর কাছে কি চমৎকার এক প্রকার বন্যফুল ফুটেছে, জ্যোৎস্নারাত্রে তার সুগন্ধে ডাক-বাংলোর বারান্দা আমোদ করে রেখেছে।
এক দিন কহলগাঁয়ের খেয়াঘাটে শুনলাম ক্রোশখানেক দূরে গঙ্গার ধারে বটেশ্বরনাথ পাহাড়ে একজন সাধু থাকেন। একখানা নৌকা ভাড়া করে বেরিয়ে পড়লাম। বটেশ্বরনাথ পাহাড় দূর থেকে দেখেই আমার মনে হ’ল এমন সুন্দর জায়গা আমি কমই দেখেছি, এখানে শান্তি ও আনন্দ পাব। গঙ্গার ধারে অনুচ্চ ছোট পাহাড়, পাহাড়ের মাথায় জঙ্গল, নানা ধরনের বুনো গাছ, এক ধরনের হলদে-পাপড়ি বড় বড় ফুল ফুটেছে পেয়ারাগাছের মত গাছে, নাম জানিনে। একটা বড় গুহা আছে পাহাড়ের দক্ষিণ দিকের ঢালুতে জঙ্গলের মধ্যে। গুহার মুখের কাছে প্রাচীন একটা বটগাছ, বড় বড় ঝুরি নেমেছে, ঘন ছায়া, পাকা বটফল তলায় পড়ে আছে রাশি রাশি। সাধুটির সঙ্গে আলাপ হ’ল, বাড়ি ছিল তাঁর মাদ্রাজে, কিছু কথাবার্তায় চেহারায় হিন্দুস্থানী। সাধুটি খুব ভাল লোক, লম্বাচওড়া কথা নেই মুখে, বাঙালি বাবু দেখে খুব খাতির করলেন। নিজে কাঠ কুড়িয়ে এনে চা করে খাওয়ালেন, আমার সম্বন্ধে দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করলেন। বললেন– আপনি এখানে যতদিন ইচ্ছে থাকুন, এখানে খরচ খুব কম। আমি এর আগে মুঙ্গেরে কষ্টহারিণীর ঘাটে ছিলাম, শহর বাজার জায়গা, এত খরচ পড়ত যে টিকতে পারলাম না। তাও বটে, আর দেখুন বাবুজী, সাধুরা চিড়িয়ার জাত, আজ এখানে, কাল ওখানে–এক জায়গায় কি ভাল লাগে বেশী দিন?
লোকজন বিশেষ নেই, স্থানটি অতিশয় নির্জন, কথা বলবার লোক নেই, তার প্রয়োজনও বোধ করি নেই বর্তমানে–সারাদিনের মধ্যে সন্ধ্যার সময় সাধুজীর সঙ্গে বসে একটু আলাপ করি। এতদিন কোথাও যে-শান্তি পাই নি, এখানে তার দেখা মিলেছে। একদিন পাহাড়ের ওপরে বেড়াতে বেড়াতে জঙ্গলের মধ্যে একটা সুঁড়ি-পথ পেলাম। পাহাড়ের গা কেটে পথটা বার করা হয়েছে, ডাইনে উঁচু পাহাড়ের দেওয়ালটা, বাঁয়ে অনেক নীচে গঙ্গা, ঢালটাতে চামেলির বন, একটা প্রাচীন পুষ্পিত বকাইন গাছ পথের ধারে। কিছু দূর গিয়ে দেখি, পাহাড়ের গায়ে খোদাই-করা কতকগুলো বৌদ্ধ দেবদেবীর মূর্তি–গভর্নমেন্টের নোটিশ টাঙানো আছে এই মূর্তিগুলো কেউ নষ্ট করতে পারবে না ইত্যাদি। আমি জানতাম না এদের অস্তিত্ব। জায়গাটা অতি চমৎকার, সূর্যাস্তের সময় সেদিন পীরপৈঁতির অনুচ্চ শৈলমালার ওপরের আকাশটা লাল হয়ে উঠল, গঙ্গার বুকে আকাশজোড়া রঙীন মেঘমালার ছায়া, খোদাই-করা দেবদেবীর মূর্তি গোধূলির চাপা। আলোয় কেমন একটা অনির্দেশ্য শ্রী ধারণ করেছে–সে শ্রী বড় অদ্ভুত, কোন মূর্তির নাক ভাঙা, কোনটার নাক নেই, বেশীর ভাগ মূর্তিরই মুখ খসে গিয়েছে–কিন্তু গোধূলির রক্ত পিঙ্গল আকাশের ছায়ায় যক্ষিণী যেন জীবন্ত হয়ে উঠল পাথরে কাটা পীন স্তনযুগল যেন রক্তমাংসের বলে মনে হ’ল, লুম্বিনী উদ্যানের ছায়াতরুমূলে শায়িতা আসন্নপ্রসবা মায়াদেবীর চোখের পলক যেন পড়ে পড়ে, তারপর চামলীর বন কালো হয়ে গেল, গঙ্গার বুকে নোঙর-করা বড় বড় কিস্তির মাঝিরা হনুমানজীর ভজন গাইতে শুরু করে দিলে, পাহাড়ের পূর্ব দিকে ছোট কেওলিন খনিটাতে মজুরদের ছুটির ঘণ্টা পড়ল–আমি তখনও অবাক হয়ে দাঁড়িয়েই আছি।…রাঢ় দেশের মাঠে সেই খালের ধারের তালবনে সেদিন যে অদ্ভুত ধরনের শান্তি ও আনন্দ পেয়েছিলুম, সেটা আবার পাবার আশায় কতক্ষণ অপেক্ষা করলুম–কিন্তু পেলাম কই? তার বদলে একটা ছবি মনে এল।
আমি জানি এ-সব কথা বলে কি কিছু বোঝানো যায়? যার না হয়েছে, সে কি পরের লেখা পড়ে কিছু বুঝতে পারবে, আমিই বোঝাতে পারব? মনে হ’ল কোথায় যেন একজন পথিক আছেন, ঐ নীল আকাশ, ঐ রঙিন মেঘমালা, এই কলরবপূর্ণ জীবনধারার পেছনে তিনি চলেছেন… চলেছেন… কোথায় চলেছেন নিজেই হয়ত জানেন না। তাঁর কোন সঙ্গী নেই, তাঁকে কেউ বোঝে না, তাঁকে কেউ ভালবাসে না। অনাদি অনন্তকাল ধরে তিনি একা একা পথ চলেছেন। এই দৃশ্যমান বিশ্ব, এদের সমস্ত সৌন্দর্য–তিনি আছেন বলেই আছে।
আমি তাঁকে ছোট করে দেখতে চাইনে। তাঁকে নিয়ে পুতুলখেলার বিরুদ্ধে ছোটবেলা থেকে আমি বিদ্রোহ করে আসছি। তিনি বিরাট, মানুষে দশ হাজার বছরে তাঁকে যত বুঝে এসেছে আগামী দশ হাজার বছরে তাঁকে আরও ভাল করে বুঝবে। এক-আধ জন মানুষে কি করবে? সমগ্র মানব জাতি যুগে যুগে তাঁকে উপলব্ধির পথে চলেছে। আমি তাঁকে হঠাৎ বুঝে শেষ করতে চাইনে–কোটী যোজন দূরের তারার আলো যেমন লক্ষ বৎসর পৃথিবীতে আসছে… আসছে… তেমনি তাঁর আলোও আমার প্রাণে আসছে…হয়ত সিকি পথও এখনও এসে পৌঁছয় নি–কত যুগ, কত শতাব্দী, এখনও দেরি আছে পৌঁছবার। এই তো আমার মনের আসল য়্যাডভেনচার (adventure), এ যেন আমার হঠাৎ ফুরিয়ে না যায়। আমি খুঁজে বেড়াবো…এই খোঁজাই আমার প্রাণ, বুদ্ধি, হৃদয়কে সঞ্জীবিত রাখবে, আমার দৃষ্টিকে চিরনবীন রাখবে।
আমি হয়ত এজন্মে তাঁকে বুঝবো না, হয়ত বহু জন্মেও বুঝবো না–এতেই আনন্দ পাব আমি, যদি তিনি আমার মনের বেদীতে হোমের আগুন কখনও নিবে যেতে না দেন, শাশ্বত যুগসমূহের মধ্যে, সুদীর্ঘ অনাগত কাল ব্যেপে। আমি চাই ও নীল আকাশ, ওই সবুজ চর, কলনাদিনী গঙ্গা, দূরের নীহারিকাপুঞ্জ, মানুষের মনোরাজ্য, ওই হলদে-ডানা প্রজাপতি, এই শোভা, এই আনন্দের মধ্যে দিয়ে তাঁকে পেতে।
লোচনদাসের আখড়াতেই সবাই বললে, আমি নাস্তিক, কারণ আমি বলতাম নাম-জপ করা কেন? ঈশ্বরের নাম দিতে পেরেছে কে? শেষ পর্যন্ত উদ্ধব-বাবাজী আমাকে আখড়া ছাড়িয়ে দিল এই জন্যে বোধ হয়।
একদিন বৈকালে গঙ্গায় নাইতে নেমেছি–কাটারিয়ার ওপারের বহুদূর দিকচক্রবালের প্রান্ত থেকে কালো মেঘ ক’রে ঝড় এল, গঙ্গার বুকে বড় বড় ঢেউ উঠল, আমার মুখে কপালে মাথায় বুকে ঢেউ ভেঙে পড়ছে, ওপারের চরের উপর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, জলের সুঘ্রাণ পাচ্ছি–এরকম কত ঝটিকাময় অপরা ও কত নীরন্ধ্র অন্ধকারময়ী রাত্রির কথা মনে এল–আমারই জীবনের কত সুখদুঃখময় মুহূর্তের কথা মনে এল–
মনে কেমন একটা অপূর্ব ভাবের উদয় হ’ল, তাকে আনন্দও বলতে পারি, প্রেমও বলতে পারি, ভক্তিও বলতে পারি। তার মধ্যে ও তিনটেই আছে। বটেশ্বরনাথের পাহাড়টার ঠিক ধূসর স্তূপের দিকে চেয়ে, দূর, বহুদূর দিগন্তের দিকে চেয়ে যেখানে বাংলা দেশ, যেখানে মালতী আছে, যেখানে এমন কত সুন্দর বর্ষার সন্ধ্যা মধুর আনন্দে কাটিয়েছি, কত জ্যোৎস্নারাত্রে শুকনো মকাইঝোলানো চালাঘরের দাওয়ার তলায় বসে দুজনে কত গল্প করেছি, তার মুখে জ্যোৎস্নার আলো এসে পড়েছে..কতবার অপ্রত্যাশিত মুহূর্তে সে এসেছে–আবার কতবার ডাকলেও আসেনি, কতবার চোখাচোখি হলেই হেসে ফেলেছে–এ কথা মনে হয়ে আমার মনে কেমন একটা উন্মাদনা, আনন্দ, প্রেম, ভক্তি আরও কত কি ভাবের উদয় হ’ল একটা বড় ভাবের মধ্যে দিয়ে। ওই একটার মধ্যেই সবটা ছিল। তাদের আলাদা আলাদা করা যায় না–কিন্তু তারই প্রেরণায় আমার আঙুল আপনা-আপনি বেঁকে গেল, গঙ্গার জলে মা, বাবা, হীরু-জ্যাঠার নামে তর্পণ করলুম, ভগবানের নামে সমস্ত দেহ-মন নুয়ে এল, জলের ওপরই মাথা নত করে তাঁর উদ্দেশে প্রণাম করলুম। সীতার জন্যে করুণ সহানুভূতিতে চোখে জল এল। হঠাৎ ঘোর বৈষয়িকতার জন্যে জ্যাঠামশায়ের প্রতি অনুকম্পা হ’ল–আবার সেই সৃষ্টিছাড়া অপরূপ মুহূর্তেই দেখলুম মালতীকে কি ভালই বাসি, মালতীর সহায়হীন, সম্পদহীন, ছন্নছাড়া মূর্তি মনে করে একটা মধুর স্নেহে তাকে সংসারের দুঃখকষ্ট থেকে বাঁচানোর আগ্রহে, তাকে রক্ষা করবার, আশ্রয় দেবার, ভালবাসার, ভাল করবার, তার মনে আনন্দ দেবার, তার সঙ্গে কথা বলবার আকুল আগ্রহে সমস্ত মন ভরে উঠল–কি জানি সে মুহূর্ত কি করে এল, সেই মেঘান্ধকার বর্ষণমুখর সন্ধ্যাটিতে সমস্ত বিশ্বপ্রকৃতি যেন সেই মহামুহূর্তে আমার মধ্যে দিয়ে তার সমস্ত পুলকের, গৌরবের, অনুভূতির সঞ্চয়হীন বিপুল আত্মপ্রকাশ করলে। সেদিন দেখলুম ঈশ্বরের প্রতি সত্যিকার ভক্তির প্রকৃতি মালতীর প্রতি আমার ভালবাসার চেয়ে পৃথক নয়। ও একই ধরনের, একই জাতীয়। যেখানে হৃদয়ের সহানুভূতি নেই, ভালবাসা নেই, সেখানে ঈশ্বরও নেই। ভগবানের প্রতি সেদিন যে-ভক্তি আমার এল–তা এল একটা অপূর্ব আনন্দের রূপে–সত্যিকার ভক্তি একটা joy of mind..আত্মা, দেহ, মন সেখানে আনন্দে মাধুর্যে আপ্লুত হয়ে যায়।
ঠিক মালতী আমাকে ভালবেসেছে বা আমি মালতীকে ভালবেসেছি। এই ভেবে যেমন হয় তেমনি। কোন পার্থক্য নেই। একই অনুভূতি–দুটো আলাদা আলাদা নামমাত্র। এতেও মন অবশ হয়ে যায় আনন্দে–ওতেও।
উপলব্ধি ক’রে বুঝলুম যদি কেউ আমাকে আগে এ-সব কথা বলত, আমার কখনই বিশ্বাস হত না। হওয়া সম্ভবও নয়।
সাধুজী সন্ধ্যাবেলা রোজ ধর্মকথা পড়েন। আমি মনে মনে বলি–সাধুজী আপনি জীবন দেখেন নি। ভালবেসেছেন কখনও জীবনে? প্রাণ ঢেলে ভালবেসেছেন? যে কখনও নরুন হাতে নিতে সাহস করে নি, সে যাবে তলোয়ার খেলতে। শুকনো বেদান্তের কথার মধ্যে ঈশ্বর নেই–যেখানে ভাব নেই, ভালবাসা নেই, হৃদয়ের দেওয়া-নেওয়া নেই, আপনাকে হারিয়ে ফেলা, বিলিয়ে দেওয়া নেই–সেখানে ভগবান নেই, নেই, নেই। হৃদয়ের খেলা যে আস্বাদ করেছে, ও-রস কি জিনিস যে বোঝে–ভগবানকে ভালবাসার প্রথম সোপানে সে উঠেছে।
আমি মালতীর কথা এত ভাবি কেন? সে আমাকে এত অভিভূত করে রেখেছে কেন দিন, রাত, সকাল, সন্ধ্যা?…এই বিক্রমশিলা বিহারের পাহাড়মালা, বন-শ্ৰেণী পাদমূলে প্রবাহিতা পুণ্যস্রোতা নদী, সন্ধ্যার পটে রাঙা সূর্যাস্ত, বনচামেলীর উগ্র উদাস গন্ধ–এ সবের মধ্যে সে আছে, তার হাসি নিয়ে, তার মুখভঙ্গি নিয়ে, তার গলার সুর নিয়ে, তার শতসহস্র টুকরো কথা নিয়ে, তার ছেলেমানুষি ভঙ্গি নিয়ে। কেন তাকে ভুলি নি, কেন। তার জন্য আমার মন সর্বদাই উদাস, উন্মুখ, ব্যাকুল, বেদনায় ভরা, স্মৃতির মাধুর্যে আপ্লুত, নিরাশায় যন্ত্রণাময়-হঠাৎ তাকে এত ভালবাসলুম কেন? তার কথা মনে যখন আসে, তখন কেওলিন খনির উপরকার পাহাড়চূড়াটায় একটা বকাইন গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে সারাদিন তার কথা ভাবি–খাওয়া-দাওয়ার কথা মনে থাকে না, ভালও লাগে না–তার মুখের হাসির স্মৃতিতেই যেন আমার শান্তিময় নিভৃত গৃহকোণ, তার কথার সুর দূরের ব্যবধান ঘুচিয়ে, মাঠ নদী বন পাহাড় পার হয়ে ভেসে এসে আমার প্রদীপ-জ্বালানো শান্ত আঙিনার ছোট্ট খড়ের রান্নাঘরের একপাশে উপবিষ্ট নিরীহ গৃহস্থ সাজায়–জীবনে তাই যেন চেয়ে এসেছি, সব দুরাশা, সব-কিছু ভুলিয়ে দেয়, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ একাকার হয়ে যায়..এদিকে রোদ চড়ে ওঠে কিংবা সূর্য ঢলে পড়ে, বটেশ্বরনাথের পাহাড় রঙে রঙে রাঙা হয়, পাখীর গান হঠাৎ যায় থেমে–সাধুজীর চেলা বর্মানারায়ণ আমাকে খুঁজতে আসে চা খাবার জন্যে…তখন অনিচ্ছা সত্বেও উঠতে হয়…গাঁজার ধোঁয়ায় অন্ধকার সাধু-বাবাজীর গুহার সামনে বসে দুধবিহীন কড়া চা খেতে খেতে হনুমানচরিত শুনতে হয়।
সাধুজী আমাকে ভালবাসেন। এই জন্যেই ওঁর এখানে আছি। এখানে পয়সার খরচ নেই বললেই হয়। বারোটা টাকা এনেছিলুম, সাধুজীর হাতে তুলে দিয়েছি–নিতে চান নি–আমি পীড়াপীড়ি করে দিয়েছি। একবেলা খাই মকাইয়ের ছাতু, একবেলা রুটি আর ঢেড়সের তরকারি। অন্য কিছু এখানে মেলে না। কেওলিন খনির ম্যানেজার মাঝে মাঝে কলগাঁও থেকে মাছ আনায়, সেদিন ওর বাংলোতে আমায় খেতে বলে–কারণ সাধুর এখানে ওসব কারবার হবার জো নেই।
মালতীর সঙ্গে আবার দেখা হবে না? কিন্তু কী করে হবে তা তো বুঝি নে। আমি আবার সেখানে কোন ছুতোয় যাবো? উদ্ধবদাস-বাবাজী আমায় ভাল চোখে দেখতো না। দু-একবার অসন্তোষ প্রকাশও করেছিল, মালতীর সঙ্গে যখন বড় মিশছি–তখন দু একবার আমায় এমন আভাসও দিয়েছিল যে এখানে বেশী দিন আর থাকলে ভাল হবে না। ও-সবে আমি ভয় করি নে। সপ্তসিন্ধু পাড়ের দেশ থেকে মালতীকে আমি ছিনিয়ে আনতে পারি, যদি আমি জানতাম যে মালতীও আমায় চায়। কিন্তু তাতে আমার সন্দেহ আছে। সেই সন্দেহের জন্যেই যত বেদনা, যা-কিছু যন্ত্রণা! কি জানি, বুঝতে পারি নে সবখানি। রহস্যময়ী মালতীর মনের খবর পুরো এক বছরেও পাই নি।
এক-একবার কিন্তু আমার মনের গভীর গোপন তল থেকে কে বলে, অত সন্দেহ কেন তোমার মনে? তোমার চোখ ছিল কোথায়? মালতীকে বোঝ নি এক বছরেও?
মালতী–কি মাধুর্যের রূপ ধরেই সে মনে আসে! তার কথা যখনই ভাবি, অস্ত আকাশের অপরূপ শোভায় পাহাড়ের ধূসর ছায়ায় গঙ্গার কলতানের মধ্যে ওপারের খাসমহলের চরে কলাইওয়ালী মাথায় কলায়ের বোঝা নিয়ে ঘরে যখন ফেরে, যখন সাদা পাল তুলে বড় বড় কিস্তি কহলগাঁয়ের ঘাট থেকে বাংলা দেশের দিকে যায়…কিংবা যখন গঙ্গার জলে রঙীন মেঘের ছায়া পড়ে, খেয়ার মাঝিরা নিজেদের নৌকোতে বসে বিকট চিৎকার করে ঠেট হিন্দীতে ভজন গায়–সমস্ত পৃথিবী, আকাশ, পাহাড় একটা নতুন রঙে রঙীন হয়ে ওঠে আমার মনে–ওই দূর বাংলা দেশের এক নিভৃত গ্রামের কোণে মালতী আছে, যখন আবার বর্ষা নামে, খুব ঝড় ওঠে, কিংবা পুকুরের ঘাটে একা গা ধুতে যায়, কি বিষ্ণুমন্দিরে প্রদীপ দেখায় সন্ধ্যায়–আমার কথা তার মনে পড়ে না? আমার তো পড়ে–সব সময়ই পড়ে, তার কি মনে পড়ে না?
মালতীকে নিয়ে মনে কত ভাঙা-গড়া করি, কত অবস্থায় দুজনকে ফেলি মনে মনে, কত বিপদ থেকে তাকে উদ্ধার করি, আমার অসুখ হয়, সে আমার পাশে বসে না ঘুমিয়ে সারারাত কাটায়–কত অর্থকষ্টের মধ্যে দিয়ে দু-জনে সংসার করি–সে বলে–ভেবোনা না লক্ষ্মীটি, মদনমোহন আবার সব ঠিক করে দেবেন! তার ছোটখাটো সুখদুঃখ, আখড়ার বিগ্রহের ওপর গভীর ভক্তি ও বিশ্বাস, তার সেবা–আমার ভাল লাগে। মনে হয় কত মেয়ে দেখেছি, সবারই খুঁত আছে, মালতীর খুঁত নেই। আবার মেয়েরা যেখানে বেশী রূপসী, সেখানে মনে হয়েছে এত রূপ কি ভাল? মালতীর স্নিগ্ধ শ্যামল সুকুমার মুখের তুলনায় এদের এত নিখুঁত রূপ কি উগ্র ঠেকে! মোটের ওপর যেদিক দিয়েই যাই–সেই মালতী।
এক-একবার মনকে বোঝাই মালতীর জন্যে অত ব্যস্ত হওয়া দুঃখ বাড়ানো ছাড়া আর কি? তাকে আর দেখতেই পাব না। তাদের আখড়াতে আর যাওয়া ঘটবে না। স্বপ্নকে আঁকড়ে থাকি কেন? কিন্তু মন যদি অত সহজে বুঝতো!
মালতী একটা মধুর স্বপ্নের মত, বেদনার মত, কত দিন কানে-শোনা গানের সুরের মত মনে উদয় হয়। তখন সবই সুন্দর হয়ে যায়, সবাইকে ভালবাসতে ইচ্ছে করে, সাধুর বকুনি, পাণ্ডা-ঠাকুরের জ্ঞাতি-বিরোধের কাহিনী–অর্থাৎ কি ক’রে ওর জ্যাঠতুতো ভাই ওকে ঠকিয়ে এতদিন বটেশ্বর শিবের পাণ্ডাগিরি থেকে ওকে বঞ্চিত রেখেছিল তার সুদীর্ঘ ইতিহাস–সব ভাল লাগে। কিন্তু কোন কথা বলতে ইচ্ছে করে না তখন, ইচ্ছে হয় শুধু বসে ভাবি, ভাবি–সারা দীর্ঘ দিনমান ওরই কথা ভাবি।
বটেশ্বরনাথ পাহাড়ের দিনগুলো মনে আমার অক্ষয় হয়ে থাকবে। রূপে, বেদনায়, স্মৃতিতে, অনুভূতিতে কানায় কানায় ভরা কি সে-সব অপূর্ব দিন! অনেক দিন হয়ে গিয়েছে। কিন্তু প্রেমের অমর মধু-মুহূর্তগুলির ছায়াপাতে তাদের স্মৃতি আমার কাছে চিরশ্যামল। শরতের দুপুরে নিভৃত বননিবিড় অধিত্যকায় চুপ করে ঝরা-পাহাড়ী-কুরুচি-ফুলের শয্যায় ব’সে চারিদিকে রৌদ্রদীপ্ত পাহাড়শ্রেণীর রূপ ও শরতের আকাশের সাদা সাদা মেঘখণ্ডের দিকে চেয়ে চেয়ে মালতীর ভাবনাতে সারাদিন কাটিয়ে দিতাম। তিনটাঙার মাঠে বটগাছের সবুজ মগডালে সাদা সাদা বকের সারি বসে আছে, যেন সাদা সাদা অজস্র ফুল ফুটে আছে–কত কি রং, প্রথমে মাটির ধূসর রং, তার পর কালো সবুজ গাছপালা, তার ওপরের পর্দায় নীলকৃষ্ণ পাহাড়, তার ওপরে সুনীল ও সাদা মেঘস্তূপ, সকলের নীচে কূলে কূলে ভরা গৈরিক জলরাশি। কিসে যেন পড়েছিলুম ছেলেবেলায় মনে পড়ে–
অলসে বহে তটিনী নীর,
বুঝি দূরে–অতি দূরে সাগর,
তাই গতি মন্থর,
শ্রান্ত, শান্ত পদসঞ্চার ধীর!
আগে প্রেম কাকে বলে তা জানতাম না, জীবনে তা কি দিতে পারে, তা ভাবিও নি কোন দিন। এখন মনে হয় প্রেমই জীবনের সবটুকু। স্বর্গ কবির কল্পনা নয়–স্বর্গ এই পিয়ালতলায়, স্বর্গ তার স্মৃতিতে। নয়তো কি এত রূপ হয় এই শিলাস্তৃত অধিত্যকার, ওই উচ্চ মেঘপদবীর, ওই পুণ্যসলিলা নদীর, ওই বননীল দিগন্তরেখার!
দিনে রাতে মালতী আমায় ছাড়ে কখন? সব সময় সে আমার মনে আছে। এই দুপুর, এখন সে আখড়ার দাওয়ায় পরিবেশন করছে। এই বিকেল, এখন সে কাপড় সেলাই করছে, নয় তো মুগকলাই ঝাড়ছে। এই সন্ধ্যা, এখন সে টান-টান করে তার অভ্যস্ত ধরনে চুলটি বেঁধে, ফুল্লাধরে মৃদু হেসে বিষ্ণুমন্দিরে প্রদীপ দেখাতে চলেছে। আজ মঙ্গলবার, সারাদিন সে উপবাস করে আছে, আরতির পরে দুধ ও ফল খাবে। সেই নিঃসঙ্কোচে পুকুরের ঘাটে বসে বসে আমাকে গান-শোনানো, আমার সঙ্গে শিবের মন্দিরে যাওয়া–খাতা পড়ে শোনানো–সকলের ওপরে তার হাসি, তার মুখের সে অপূর্ব হাসি! কত কথাই মনে এসে নির্জনে যাপিত প্রতি প্রহরটি আনন্দবেদনায় অলস করে দিত।
দূরের গিরি-সানুর গায়ে ক্রীড়ারত শুভ্র মেঘরাজির মধ্যে এমন কি কোন দয়ালু মেঘ নেই যে এই কূটজ-কুসুমাস্তীর্ণ নিভৃত অধিত্যকার ওপর দিয়ে যেতে যেতে পিয়ালতলার এই নির্বাসিত যক্ষের বিরহবার্তাটি শুনে জেনে নিয়ে বাংলা দেশের প্রান্তরমধ্যবর্তী অলকাপুরীতে পৌঁছে দেয় তার কানে?
কতবার মনে অনুশোচনা হয়েছে এই ভেবে যে কেন চলে আসতে গিয়েছিলুম অমন চুপি চুপি? তখন কি বুঝেছিলুম মালতী আমায় এত ভাবাবে! কি বুঝে আখড়া ছেড়ে চলে এলাম পাগলের মত! এমনধারা খামখেয়ালী স্বভাব আমার কেন যে চিরকাল, তাই ভাবি। আমার মাথার ঠিক নেই সবাই বলে, সত্যিই বলে। এখন বুঝেছি কি ভুলই করেছি মালতীকে ছেড়ে এসে। ওকে বাদ দিয়ে জীবন কল্পনা করতে পারছি নে–এও যেমন ঠিক, আবার এও তেমনি ঠিক যে আর সেখানে আমার ফেরা হবে না।
না–মালতী, আর ফিরে যাব না। কাছে পেয়ে তুমি যদি অনাদর কর সইতে পারব না। তোমার খামখেয়ালী স্বভাবকে আমার ভয় হয়। তার চেয়ে এই-ই ভাল। আমার জীবনে তুমি পুকুরের ঘাটের কত জ্যোৎস্নারাত্রি অক্ষয় করে দিয়েছ, সেই সব জ্যোৎস্নারাত্রির স্মৃতি, তোমার বাবার বিষ্ণুমন্দিরের কত সন্ধ্যায় প্রদীপ দেওয়ার স্মৃতি–তোমার সে সব আদরের স্মৃতি মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে থাক।
.
১৪.
এক বছর কেটে গেল, আবার শ্রাবণ মাস।
হঠাৎ দাদার শালার একখানা চিঠি পেলাম কলকাতা থেকে। দাদার বড় অসুখ, চিকিৎসার জন্যে তাকে আনা হয়েছে ক্যাম্বেল হাসপাতালে।
পত্র পেয়ে প্রাণ উড়ে গেল। সাধুজীর কাছে বিদায় নিয়ে কলকাতায় এলাম। হাসপাতালে দাদার সঙ্গে দেখা করলাম। সামান্য ব্রণ থেকে দাদার মুখে হয়েছে ইরিসিপ্লাস, আজ সকালে অস্ত্রও করা হয়ে গিয়েছে। দাদা আমায় দেখে শরীরে যেন নতুন বল পেল। সন্ধ্যা পর্যন্ত হাসপাতালে বসে রইলাম দাদার কাছে। দাদা বললে–এখানে বেশ খেতে দেয় নিতু। রোজ প্রতিবেলায় একখানা বড় পাঁউরুটি আর আধ সের ক’রে দুধ দিয়ে যায়। দেখিস এখন, এখুনি আনবে। খাবি রুটি একখানা?
পরদিন সকালে আবার গেলাম হাসপাতালে। আঙুর কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম বৌবাজারের মোড় থেকে, দাদাকে ব’সে ব’সে খাওয়ালাম। দুপুরের আগে চলে আসছি, দোর পর্যন্ত এসেছি, দাদা পেছু ডাকলে–জিতু, শোন!
দাদা বিছানার ওপর উঠে বসেছে–তার চোখ দুটিতে যেন গম্ভীর হতাশা ও বিষাদ মাখানো। বললে–জিতু, তোর বৌদিদি একেবারে নিপাট ভালমানুষ, সংসারের কিছু বোঝে না। ওকে দেখিস–
আমি বিস্ময়ের সঙ্গে বললাম–ও কি কথা দাদা! তুমি সেরে ওঠ, তোমায় বাড়ি নিয়ে যাব, তোমার সংসার তুমি দেখবে।
দাদা চুপ করে রইল।
বিকেলে দাদার ওয়ার্ডে ঢুকবার আগে মনে হ’ল দাদা ত বিছানাতে বসে নেই! গিয়ে দেখি দাদা আগাগোড়া কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। মাথার কাছে চার্টে দেখি জ্বর উঠেছে ১০৪ ডিগ্রীর ঘরে। পাশের বিছানার রোগী বললে–আপনি চলে যাবার পরে খুব জ্বর এসেছে। কোন কথা বলতে পারেন নি, আপনি আসবার আগে ডেকেছিলাম, সাড়া পাই নি।
সেদিন সারাদিন তেমনি ভারে কেটে গেল। পরদিনও তাই, দাদার জ্ঞান আর ফিরে এল না–জ্বরও কমল না, পরদিন রাত্রে আমি রোগীর কাছে রইলাম।
ওঃ কি বর্ষা সে রাত্রে! ঘনকৃষ্ণ শ্রাবণের মেঘপুঞ্জে আকাশ ছেড়ে গিয়েছে, নির্নিরীক্ষা অন্ধকারে কোথাও একটা তারা চোখে পড়ে না। একখানা বই পড়ছিলাম দাদার বিছানার ধারে বসে। রাত বারোটায় একবার নার্স এল। আমি তাকে বললাম–রোগীর অবস্থা খারাপ–একবার রেসিডেন্ট মেডিকেল অফিসারকে ডাকাও। ডাক্তার এল, চলেও গেল। রাত তখন দেড়টা। বাইরে কি ভীষণ মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। আকাশ ভেঙে পড়বে বুঝি পৃথিবীর ওপরে–সৃষ্টি বুঝি ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।
একজন ছাত্র এসে রোগী দেখে বললে–ইনজেকশন দিতে হবে।
আমি বললাম–বেশ দিন—
তারপর আমি বাইরে এসে দাঁড়ালুম। ঘন মেঘে মেঘে আকাশ অন্ধকার। হাসপাতালের বারান্দাতে কুলিরা ঘুমুচ্ছে। টিটেনাস ওয়ার্ড থেকে অনেকক্ষণ ধরে আর্ত পশুর মত চীৎকার শোনা যাচ্ছে–একবার সেটা থামছে, আবার জোরে জোরে হচ্ছে। সামনের ওয়ার্ডে মেম নার্সটা ঘুরে বেড়াচ্ছে বারান্দাতে।
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হেডলাইট জ্বালিয়ে একখানা মোটর এসে ওয়ার্ডের সামনে দাঁড়াল। সুপারিন্টেনডেন্ট তদারক করতে এসেছেন। দাদাকে তিনি দেখলেন। নার্সকে কি বললেন। ছাত্রটিকে ডেকে কি জিজ্ঞেস করলেন। ছাত্রটি আর একটা ইনজেকশন দিলে।
রাত আড়াইটে। বৃষ্টি আবার শুরু হয়েছে। হাসপাতালের বারান্দার ওদিকের আলোগুলো নিবিয়ে দিয়েছে–অনেকটা অন্ধকার।
দাদার সঙ্গে অনেক কথা বলবার ইচ্ছে হচ্ছিল। ছেলেবেলাকার কথা, দার্জিলিঙের কথা। সেই আমরা কার্ট রোড ধরে উমপ্লাঙের মিশন-হাউস পর্যন্ত বেড়াতে যেতুম, মনে আছে দাদা? একদিন থাপা তোমাকে কাদার পুতুল গড়িয়ে দিয়েছিল! মুরগীর ঘরে লুকিয়ে তুমি আমি মিছরি চুরি করে শরবৎ খেতুম? তুমি দোকান করলে আটঘরাতে বাবা মারা যাওয়ার পরে পাঁচ সের নুন, আড়াই সের আটা, পাঁচ পোয়া চিনি নিয়ে–সবাই ধার নিয়ে দোকান উঠিয়ে দিলে। বৌদিদিকে কি বলব দাদা?
এবার এসে দাদার খাটের পাশে বসে রইলাম। একটানা বৃষ্টি-পতনের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। মাঝে মাঝে কেবল টিটেনাস ওয়ার্ড থেকে বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়েও সেই আর্ত চীৎকারটা শোনা যাচ্ছে। একটা ছোট ছেলের টনসিল কাটা হয়েছিল– সে একবার ঘুম ভেঙে উঠে খাবার চাইলে। কুলিটা উঠে তাকে জল দিলে।
এই কুলিগুলো, ওই বুড়ো মেথরটা, নার্সেরা-–এরা ঘুমোয় কখন? সারারাত জেগে জেগে রোগীদের ফাইফরমাশ খাটছে। দাদার অবস্থা খারাপ বলে সবাই এসে একবার করে দেখে যাচ্ছে। নার্স যে কতবার এল! সবাই তটস্থ…দাদাকে বাঁচাবার জন্যে সবারই যেন প্রাণপণ চেষ্টা। বাঁচলে সবাই খুশী হয়। নার্স একবার আমায় বললে–তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও বাবু। সারারাত জেগে বসে থাকলে অসুখ করবে তোমার।
হাসপাতালটিকে আমার মনে হল যেন স্বর্গ। আর্তের সেবা যেখানকার মানুষে মনপ্রাণ দিয়ে করে, সে স্বর্গই। ওই বুড়ো মেথরটা এখানকার দেবদূত। যেদিন কয়েক শতাব্দী আগে শ্রীচৈতন্য গৃহত্যাগ করেছিলেন, কিংবা শঙ্করাচার্য সংসারের অসারত্ব সম্বন্ধে চিন্তা করেছিলেন–তাঁদের স্বপ্নে এই স্বর্গের কল্পনা ছিল। চৈতন্যদেবের সংকীর্তনের দলে, নবদ্বীপের গঙ্গার তীরে এই বুড়ো মেথরটা যোগদান করতে পারত, তিনি ওকে কোল দিতেন, ঝাড়খণ্ডের পথে শ্রীক্ষেত্র রওনা হবার সময়ে ওকে পার্শ্বচর করে নিতেন।…রাত সাড়ে তিনটে। রাত আজ কি পোয়াবে না? বৃষ্টি একটু থেমেছে। আকাশ কিন্তু মেঘে মেঘে কালো।
এই সময়ে দাদার নাভিশ্বাস উপস্থিত হ’ল। কলের ঘোলা জল দাদার মুখে দিলাম। কানের কাছে গঙ্গানারায়ণব্রহ্ম নাম উচ্চারণ করলাম। এই বিপদের সময় কি জানি কেন মালতীর কথা মনে পড়ল। মালতী যদি এখানে থাকত! আটঘরার অশ্বত্থতলার সেই বিষ্ণুমূর্তির কথা মনে পড়ল–হে দেব, দাদার যাওয়ার পথ আপনি সুগম করে দিন। আপনার আশীর্বাদে তার জীবনের সকল ত্রুটি, সকল গ্লানি ধুয়ে মুছে পবিত্র হোক, যে সমুদ্র আপনার অনন্ত শয্যা, যে লোকালোক পর্বত আপনার মেখলা–সে-সব পার হয়েও বহুদূরের যে পথে দাদার আজ যাত্রা, আপনার কৃপায় সে পথ তার বাধাশূন্য হোক, নির্ভয় হোক, মঙ্গলয়ময় হোক।
পাশের বিছানার রোগী বললে–একবার মেডিকেল অফিসারকে ডাকান না!
আমি বললাম–আর মিথ্যে কেন?
তার পর আরও ঘণ্টাখানেক কেটে গেল। আমার ঘুম এসেছে, ভয়ানক ঘুম। কিছুতেই আর চোখ খুলে রাখতে পারি নে। মধ্যে নার্স দুবার এল, আমি তা ঘুমের ঘোরেই জানি–আমায় জাগালে না। পা টিপে টিপে এল, পা টিপেই চলে গেল।
হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল। ভোর হবার দেরি নেই, হাসপাতালের আলো নিষ্প্রভ হয়ে এসেছে–কিন্তু ঘন কালো মেঘে আকাশ ঢাকা, দিনের আলো যদিও একটু থাকে, বোঝা যাচ্ছে না। দাদার খাটের দিকে চেয়ে আমি বিস্ময়ে কেমন হয়ে গেলাম। এখনও ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি নাকি? দাদার খাটের চারিপাশে অনেক লোক দাঁড়িয়ে। অর্ধচন্দ্রাকারে ওরা দাদার খাটটাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। শিয়রের কাছে মা, ডানদিকে বাবা, বাবার পাশেই আটঘরার সেই হীরু রায়–স্যালাইনের টিনটা যেখানে ঝোলানো, সেখানে দাঁড়িয়ে আমাদের চা-বাগানের নেপালী চাকর থাপা, ছেলেবেলায় দাদাকে যে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছিল। তার পরই আমার চোখ পড়ল খাটের বাঁ-দিকে, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে ছোট কাকীমার মেয়ে পানী। এদের মূর্তি এত সুস্পষ্ট ও বাস্তব যে একবার আমার মনে হ’ল ওদের সকলেই দেখছে বোধ হয়। পাশের খাটের রোগীর দিকে চেয়ে দেখলুম, সে যদিও জেগে আছে এবং মাঝে মাঝে দাদার খাটের দিকে চাইছে–কিন্তু তার মুখ-চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল মুমূর্ষ দাদাকে ছাড়া সে আর কিছু দেখছে না। অথচ কেন দেখতে পাচ্ছে না, এত স্পষ্ট, প্রত্যক্ষ, সজীব মানুষগুলোকে কেন যে ওরা দেখে না–এ ভেবে ছেলেবেলা থেকে আমার বিস্ময়ের অন্ত নেই।
আমি জানি এসব কথা লোককে বিশ্বাস করানো শক্ত। মানুষ চোখে যা দেখে না, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় যা পারে না–তা বিশ্বাস করতে সহজে রাজী হয় না। এই জন্য হাসপাতালের এই রাত্রিটির কথা আমি একটি প্রাণীকেও বলি নি কোনদিন।
দু-তিন মিনিট কেটে গেল। ওরা এখনও রয়েছে। আমি চোখ মুছলাম, এদিক-ওদিক চাইলাম–চোখে জল দিলাম উঠে। এখনও ওরা রয়েছে। ওদের সবারই চোখ দাদার খাটের দিকে। আমি ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে পানীয় কাছে দাঁড়ালাম। ওরা সবাই হাসিমুখে আমার দিকে চাইলে। কত কথা বলব ভাবলাম মাকে, বাবাকে, পানীকে–থাপা কবে মারা গিয়েছে জানি নে–সে এখনও তাহলে আমাদের ভোলে নি?…তাকে কি বলব ভাবলাম–কিন্তু মুখ দিয়ে আমার কথা বেরুল না। এই সময়ে নার্স এল। আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবছি নার্স কি এদের দেখতে পাবে না? এই ত সবাই এরা এখানে দাঁড়িয়ে। নার্স কিন্তু এমন ভাবে এল যেন আমি ছাড়া সেখানে আর কেউ নেই। দাদার মুখের দিকে চেয়ে বললে–এ তো হয়ে গিয়েছে।–এ কুলি, কুলি–
কুলি খাটটাকে ঘেরাটোপ দিয়ে ঢেকে দিতে এল।
তখনও ওরা রয়েছে …..
তারপর আমার একটা অবসন্ন ভাব হ’ল–আমার সেই সুপরিচিত অবসন্ন ভাবটা। যখনই এ-রকম আগে দেখতাম, তখনই এ-রকম হ’ত। মনে পড়ল কত দিন পরে আবার দেখলাম আজ–বহুকাল পরে এই জিনিসটা পেয়েছি–হারিয়ে গিয়েছিল, সন্ধান পাই নি অনেক দিন, ভেবেছিলুম আর বোধ হয় পাব না–আজ দাদার শেষশয্যার পাশে দাঁড়িয়ে তা ফিরে পেয়েছি। আমার গা যেন ঘুরে উঠল–পাশের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লাম।
নার্স আমার দিকে চেয়ে বললে–পুওর বয়!
জীবনে নিষ্ঠুর ও হৃদয়হীন কাজ একেবারে করি নি তা নয়, কিন্তু বৌদিদিকে দাদার মৃত্যুসংবাদটা দেওয়ার মত নিষ্ঠুর কাজ আর যে কখনও করি নি, একথা শপথ করে বলতে পারি। বেলা দুটোর সময় দাদার বাড়ি গিয়ে পৌঁছলাম। পথে দাদার শ্বশুরবাড়ির এক শরিকের সঙ্গে দেখা। আমার মুখে খবর শুনেই সে গিয়ে নিজের বাড়িতে অবিলম্বে খবরটি জানালে। বোধ হয় যেন বৌদিদির ওপর আড়ি করেই ওদের বাড়ির মেয়েরা– যারা দাদার অসুখের সময় কখনও চোখের দেখাও দেখতে আসেনি–চীৎকার করে কান্না জুড়ে দিলে। বৌদিদি তখন অত বেলায় দুটো রেঁধে ছেলেমেয়েকে খাইয়ে আঁচিয়ে দিচ্ছে। নিজে তখনও খায় নি। পাশের বাড়িতে কান্নার রোল শুনে বৌদিদি বিস্ময়ের সুরে জিজ্ঞেস করছে–হ্যাঁ রে বিনু, ওরা কাঁদছে কেন রে? কি খবর এল ওদের? কারও কি অসুখ-বিসুখ?
এমন সময়ে আমি বাড়ি ঢুকলাম। আমায় দেখে বৌদিদির মুখ শুকিয়ে গেল। বললো ঠাকুরপো! তোমার দাদা কোথায়?
আমি বললাম–দাদা নেই, কাল মারা গিয়েছে।
বৌদিদি কাঁদলে না। কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল আমার মুখের দিকে চেয়ে। পাশের বাড়িতে তখন ইনিয়ে-বিনিয়ে নানা ছন্দে ও সুরে শোক-প্রকাশের ঘটা কি! পাড়ার অনেক মেয়ে এলেন সান্ত্বনা দিতে বৌদিদিকে। কিন্তু একটু পরে যখন বৌদিদি পুকুরের ঘাটে নাইতে গেল, সঙ্গে একজন যাওয়া দরকার নিয়মমত–তখন–এক একটা অজুহাতে যে যার বাড়িতে চলে গেল। আমি বিস্মিত হলাম এই ভেবে যে এরা তো বৌদিদির বাপের বাড়ির লোক! তার একটু পরে বৌদিদি খানিকটা কাঁদলে। হঠাৎ কান্না থামিয়ে বললে, শেষকালে জ্ঞান ছিল ঠাকুরপো? সেই ত মরেই গেল–হাসপাতালে না নিয়ে গেলেই হ’ত! তবু আপনার জন কাছে থাকত!
আমি বললাম,–বৌদিদি তুমি ভেবো না, এখানে যে রকম গতিক দেখছি তাতে এখানে থাকলে দাদার চিকিৎসাই হত না। এখানে কেউ তোমায় তো দেখে না দেখছি। হাসপাতালের লোকে যথেষ্ট করেছে। বাড়িতে সে রকম হয় না। আমাদের অবস্থার লোকের পক্ষে হাসপাতালই ভাল।
বৌদিদির বাবা মা কেউ নেই–মা আগেই মারা গিয়েছিলেন–বাবা মারা গিয়েছিলেন আর-বছর। একথা কলকাতাতেই বৌদিদির ভায়ের মুখে শুনেছিলাম। বৌদিদির সে ভাইটিকে দেখে আমার মনে হয়েছিল এ নিতান্ত অপদার্থ–তার ওপর নিতান্ত গরীব, বর্তমানে কপর্দকহীন বেকার–তার কিছু করবার ক্ষমতা নেই। বয়সও অল্প, কলকাতা ছেড়ে আসে নি, সেখানে চাকুরির চেষ্টা করছে।
ভেবে দেখলাম এদের সংসারের ভার এখন আমিই না নিলে এতগুলি প্রাণী না খেয়ে মরবে। দাদা এদের একেবারে পথে বসিয়ে রেখে গেছে। কাল কি করে চলবে সে সংস্থানও নেই এদের। তার উপর দাদার অসুখের সময় কিছু দেনাও হয়েছে।
এদের ছেড়ে কোথাও নড়তে পারলুম না শেষ পর্যন্ত। কালীগঞ্জেই থাকতে হ’ল। এখান থেকে দাদার সংসার অন্য স্থানে নিয়ে গেলাম না, কারণ আটঘরাতে এদের নিয়ে যাবার যো নেই, অন্য জায়গায় আমার নিজের রোজগারের সুবিধা না হওয়া পর্যন্ত বাড়িভাড়া দিই কি করে?
এ সময়ে সাহায্য সত্যি সত্যিই পেলুম দাদার সেই মাসীমার কাছ থেকে–সেই যে বাতাসার কারখানার মালিক কুণ্ডু-মশায়ের তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী–সেবার যিনি আমাদের নিমন্ত্রণ করে খাইয়েছিলেন। এই বিপদের সময় আমাদের কোন ব্রাহ্মণ প্রতিবেশীর কাছ থেকে সেরকম সাহায্য আসে নি।
ক্রমে মাসের পর মাস যেতে লাগল।
সংসার কখনো করি নি, করবো না ভেবেছিলাম। কিন্তু যখন এ-ভাবে দাদার ভার আমার ওপর পড়ল, তখন দেখলাম এ এক শিক্ষা মানুষের দৈনন্দিন অভাব-অনটনের মধ্যে দিয়ে, ছোটখাটো ত্যাগ স্বীকারের মধ্যে দিয়ে, পরের জন্যে খাটুনি ও ভাবনার মধ্যে দিয়ে, তুচ্ছ অকিঞ্চিৎকর পারিপার্শ্বিকের মধ্যে দিয়ে এই যে এতগুলি প্রাণীর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও জীবনযাত্রার গুরুভার নিজের ওপর নিয়ে সংসার-পথের চলার দুঃখ–এই দুঃখের একটা সার্থকতা আছে। আমার জীবনে এর আগে চলেছিল শুধু নিজেকে কেন্দ্র ক’রে, পরকে সুখী করে নিজেকে পরিপূর্ণ করার শিক্ষা আমায় দিয়েছে মালতী। পথে বেরিয়ে অনেক শিক্ষার মধ্যে এটিই আমার জীবনে সবচেয়ে বড় শিক্ষা।
কত জায়গায় চাকুরি খুঁজলাম। আমি যে লেখাপড়া জানি বাজারে তার দাম কানাকড়িও না। হাতের কোন কাজও জানি নে, সবতাতেই আনাড়ি। কুণ্ডু-মহাশয়ের স্ত্রীর সুপারিশ ধরে বাতাসার কারখানাতেই খাতা লেখার কাজ যোগাড় করলাম–এ কাজটা জানতাম, কলকাতায় চাকুরির সময় মেজবাবুদের জমিদারী সেরেস্তায় শিখেছিলাম তাই রক্ষে। কিন্তু তাতে ক’টা টাকা আসে? বৌদিদির মত গৃহিণী, তাই ওই সামান্য টাকার মধ্যে সংসার চালানো সম্ভব হয়েছে।
ফাল্গুন মাস পড়ে গেল। গাংনাপুরের হাটে আমি কাজে বেরিয়েছি গরুর গাড়ি করে। মাইল-বারো দূর হবে, বেগুন পটলের বাজরার ওপরে চটের থলে পেতে নিয়ে আমি আর তনু চৌধুরী ব’সে। তনু চৌধুরীর বাড়ি নদীয়া মেহেরপুরে, এখানকার বাজারের সাহেবের পাটের গদির গোমস্তা, গাংনাপুরে খরিদ্দারের কাছে মাল দেখাতে যাচ্ছে।
গল্প করতে করতে তনু চৌধুরী ঘুমিয়ে পড়ল বাজরার উপরেই। আমি চুপ করে বসে আছি। পথের ধারে গাছে গাছে কচি পাতা গজিয়েছে, ঘেঁটুফুলের ঝাড় পথের পাশে মাঠের মধ্যে সর্বত্র।
শেষরাত্রে বেরিয়েছিলুম, ভোর হবার দেরি নেই, কি সুন্দর ঝিরঝিরে ভোরের হাওয়া, পূব আকাশে জ্বলজ্বলে বৃশ্চিক রাশির নক্ষত্রগুলো বাঁশবনের মাথায় ঝুঁকে পড়েছে–যেন ওই দুযতিমান তারার মণ্ডলী পৃথিবীর সকল সুখদুঃখের বাস্তবতার বন্ধনের সঙ্গে ঊর্ধ্ব আকাশের সীমাহীন উদার মুক্তির একটা যোগ-সেতু নির্মাণ করেছে–যেন আমাদের জীবনের ভারক্লিষ্ট যাত্রাপথের সংকীর্ণ পরিসরের প্রতি নক্ষত্র-জগৎ দয়াপরবশ হয়ে জ্যোতির দূত পাঠিয়েছে আমাদের আশার বাণী শোনাতে–যে কেউ উঁচু দিকে চেয়ে দেখবে, চলতে চলতে সে-ই দেখতে পাবে তার শাশ্বত মৃত্যুহীন রূপ। যে চিনবে, যে বলবে আমার সঙ্গে তোমার আধ্যাত্মিক যোগ আছে–আমি জানি আমি বিশ্বের সকল সম্পদের, সকল সৌন্দর্যের, সকল কল্যাণের উত্তরাধিকারী–তার কাছেই ওর বাণী সার্থকতা লাভ করবে।
এই প্রস্ফুট বন-কুসুম-গন্ধ আমার মনে মাঝে মাঝে কেমন একটা বেদনা জাগায়, যেন কি পেয়েছিলুম, হারিয়ে ফেলেছি। এই উদীয়মান সূর্যের অরুণ রাগ অতীত দিনের কত কথা মনে এনে দেয়। সব সময় আমি সে-সব কথা মনে স্থান দিতে রাজী হই নে, অতীতকে আঁকড়ে ধরে বসে থাকা আমার রীতি নয়। তাতে দুঃখ বাড়ে বৈ কমে না। হঠাৎ দেখি অন্যমনস্ক হয়ে কখন ভাবছি, দ্বারবাসিনীর আখড়া থেকে সেই ভোরে যে আমি চুপি চুপি পালিয়ে এসেছিলাম–কাউকে না জানিয়ে, মালতীকে তো একবার জানাতে পারতাম–মালতীর ওপর এতটা নিষ্ঠুর আমি হয়েছিলুম কেমন করে!
ওকথা চেপে যাই–মন থেকে ঝেড়ে ফেলবার চেষ্টা করি। আগে যতটা কষ্ট হ’ত এসব চিন্তায়–এখন আর ততটা হয় না, এটা বেশ বুঝতে পারি। মালতীকে ভুলে যেতে থাকি–কিছুদিন পরে আরও যাব। এক সময়ে যে এত কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল সে আজ সপ্তসিন্ধুপারের দেশের রাজকন্যার মত অবাস্তব হয়ে আসছে। হয়ত একদিন একেবারেই ভুলে যাব। জীবন চলে নিজের পথে নিজের মর্জিমত–কারও জন্যে সে অপেক্ষা করে না। মাঝে মাঝে মনে আনন্দ আসে–যখন ভাবি বহুদিন আগে রাঢ়ের বননীল-দিগ্বলয়ে-ঘেরা মাঠের মধ্যে যে দেবতার স্বপ্ন দেখেছিলুম তিনি আমায় ভুলে যান নি। তাঁরই সন্ধানে বেরিয়েছিলাম, তিনি পথও দেখিয়েছিলেন। এই অনুদার রুদ্ধগতি জীবনেও তিনি আমার মনে আনন্দের বাণী পাঠিয়েছেন।
এতেও ঠিক বলা হ’ল না। সে আনন্দ যখন আসে তখন আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি, তখন কি করি, কি বলি কিছু জ্ঞান থাকে না–সে এক অন্য ব্যাপার। আজও ঠিক তাই হ’ল। আমি হঠাৎ পথের ধারে একটা ঝোপের ছায়ায় নেমে পড়লুম গাড়ি থেকে। তনু চৌধুরী বললে–ও কি, উঠে এস। তনু চৌধুরী জানে না আমার কি হয় মনের মধ্যে এ সব সময়ে, কারও সাহচর্য এসব সময়ে আমার অসহ্য হয়, কারও কথায় কান দিতে পারি নে–আমার সকল ইন্দ্রিয় একটা অনুভূতির কেন্দ্রে আবদ্ধ হয়ে পড়ে–একবার চাই শালিখের ছানাগুলো খাদ্যকণা খুঁটে খাচ্ছে যেদিকে, তাদের অসহায় পক্ষ- ভঙ্গিতে কি যেন লেখা আছে–একবার চাই তিসির ফুলের রঙের আকাশের পানে–ঝলমল প্রভাতের সূর্যকিরণের পানে, শস্যশ্যামল পৃথিবীর পানে–কি রূপ! এই আনন্দের মধ্যে দিয়ে আমার দ্বিজত্ব, এক গৌরব-সমৃদ্ধ পবিত্র নবজন্ম।
মনে মনে বলি, আপনি আমায় এ-রকম করে দেবেন না, আমায় সংসার করতে দিন ঠাকুর। দাদার ছেলেমেয়েরা, বৌদিদি আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকে ওদের অন্নের জন্যে, ওদের আমি তো ফেলে দিতে পারব না! এখন আমায় এ-রকম নাচাবেন না।
বৈকালের দিকে পায়ে হেঁটে গাংনাপুরের হাটে পৌঁছলাম। তনু চৌধুরী আগে থেকে ঠিক করেছে আমার মাথা খারাপ। রাস্তার মধ্যে নেমে পড়লাম কেন ও-রকম?
ফিরবার পথে সন্ধ্যার রাঙা মেঘের দিকে চেয়ে কেবলই মনে হ’ল ভগবানের পথ ঐ পিঙ্গল ও পাটল বর্ণের মেঘপর্বতের ওপারে কোনো অজানা নক্ষত্রপুরীর দিকে নয়, তাঁর পথ আমি যেখান দিয়ে হাঁটছি, ওই কালু-গাড়োয়ান যে পথ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে–এ পথেও! আমার এই পথে আমার সঙ্গে পা ফেলে তিনি চলেছেন এই মুহূর্তে– আমি আছি তাই তিনি আছেন। যেখানে আমার অসাফল্য সেখানে তাঁরও অসাফল্য, আমার যেখানে জয়, সেখানে তাঁরও জয়। আমি যখন সুন্দরের স্বপ্ন দেখি, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের আদর করি, পরের জন্যে খাটি–তখন বুঝি ভগবানের বিরাট শক্তির স্বপক্ষে আমি দাঁড়িয়েছি–বিপক্ষে নয়। এই নীল আকাশ, অগ্নিকেতন উল্কাপুঞ্জ, বিদ্যুৎ আমায় সাহায্য করবে। বিশ্ব যেন সব সময় প্রাণপণে চেষ্টা করছে শিব ও সুন্দরের মধ্যে নিজের সার্থকতাকে খুঁজতে, কিন্তু পদে পদে সে বাধা পাচ্ছে কি ভীষণ! বিশ্বের দেবতা তবুও হাল ছাড়েন নি–তিনি অনন্ত ধৈর্যে পথ চেয়ে আছেন। নীরব সেবাব্রত সূর্য ও চন্দ্র আশায় আশায় আছে, সমগ্র অদৃশ্যলোকে চেয়ে আছে–আমিও ওদের পক্ষে থাকব। বিশ্বের দেবতার মনে দুঃখ দিতে পারব না। জীবনে মানুষ ততক্ষণ ঠিক শেখে না অনেক জিনিসই, যতক্ষণ সে দুঃখের সম্মুখীন না হয়। আগে স্রোতের শেওলার মত ভেসে ভেসে কত বেড়িয়েছি জীবন-নদীর ঘাটে ঘাটে–তটপ্রান্তবর্তী যে মহীরূহটি শত স্মৃতিতে তিলে তিলে বর্ধিত হয়ে স্নানার্থিনীদের ছায়াশীতল আশ্রয় দান করেছে–সে হয়ত বৈচিত্র্য চায় নি তার জীবনে–কিন্তু একটি পরিপূর্ণ শতাব্দীর সূর্য তার মাথায় কিরণ বর্ষণ করেছে, তার শাখা-প্রশাখায় ঋতুতে ঋতুতে বনবিহঙ্গদের কৌতুকবিলাস কলকাকলি নিজের আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে–তার মৃদু ও ধীর, পরার্থমুখী গম্ভীর জীবন-ধারা নীল আকাশের অদৃশ্য আশীর্বাদতলে এই একটি শতাব্দী ধরে বয়ে এসেছে–বৈচিত্র্য যেখানে হয়ত আসে নি– গভীরতায় সেখানে করেছে বৈচিত্র্যের ক্ষতিপূরণ। প্রতিদিনের সূর্য শুক্রতারার আলোকোজ্জ্বল রাজপথে রাঙা ধূলি উড়িয়ে রজনীর অন্ধকারে অদৃশ্য হন–প্রতিদিনই সেই সন্ধ্যায় আমার মনে কেমন এক প্রকার আনন্দ আসে–দেখি যে পুকুরের ধারে বর্ষার ব্যাঙের ছাতা সূর্যের অমৃত কিরণে বড় হয়ে পুষ্ট হয়ে উঠেছে–দেখি উইয়ের ঢিবিতে নতুন পাখা ওঠা উইয়ের দল অজানা বায়ুলোক ভেদ করে হয়েছে মরণের যাত্রী, শরতের কাশবন জীবন-সৃষ্টির বীজ দূরে দূরে, দিকে দিগন্তে ছড়িয়ে দিয়ে রিক্ততার মধ্যেই পরম কাম্য সার্থকতাকে লাভ করেছে–দারিদ্র্য বা কষ্ট তুচ্ছ, পৃথিবীর সমস্ত বিলাস লালসাও তুচ্ছ, আমি কিছুই গ্রাহ্য করি নে যদি এই জাগ্রত চেতনাকে কখনও না হারাই–যদি হে বিশ্বদেবতা, বাল্যে তুষারাবৃত কাঞ্চনজঙ্ঘাকে যেমন সকালবেলাকার সূর্যের আলোয়। সোনার রঙে রঞ্জিত হতে দেখতুম–তেমনি যদি আপনি আপনার ভালবাসার রঙে আমার প্রাণ রাঙিয়ে তোলেন–আমিও আপনাকে ভালবাসি যদি–তবে সকল সংকীর্ণতাকে, দুঃখকে জয় করে আমি আমার বিরাট চেতনার রথচক্র চালিয়ে দিই শতাব্দীর পথে, জন্মকে অতিক্রম করে মৃত্যুর পানে, মৃত্যুকে অতিক্রম করে আবার আনন্দ-ভরা নবজন্মের কোন অজানা রহস্যের আশায়।
.
১৫.
দাদার মৃত্যুর মাস তিনেক পরে বাতাসার কারখানার কুণ্ডুমশায় হঠাৎ মারা গেলেন। এতে আমাকে বিপদে পড়তে হ’ল। কুণ্ডুমশায়ের প্রথম পক্ষের ছেলেরা এসে কারখানা ও বাড়িঘর দখল করলে। কুণ্ডুমশায়ের তৃতীয় পক্ষের স্ত্রীকে নিতান্ত ভালমানুষ পেয়ে মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে তার হাতের হাজার দুই নগদ টাকা বার করে নিলে। টাকাগুলো হাতে না আসা পর্যন্ত ছেলেরা বৌয়েরা সৎশাশুড়ীকে খুব সেবাযত্ন করেছিল, টাকা হস্তগত হওয়ার পরে ক্রমে ক্রমে তাদের মূর্তি গেল বদলে। যা দুর্দশা তার শুরু করলে ওরা! বাড়ির চাকরাণীর মত খাটাতে লাগল, গালমন্দ দেয়, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। আমি একদিন গোপনে বললাম- মাসীমা, পঞ্চুকে ডাকঘরের পাস-বই দিও না বা কোন সই চাইলেও দিও না। তুমি অত বোকা কেন তাই ভাবি! আগের টাকাগুলো ওদের হাতে দিয়ে বসলেই বা কি বুঝে?
ডাকঘরের পাস-বইয়ের জন্যে পঞ্চু অনেক পীড়াপীড়ি করেছিল। শেষ পর্যন্ত হয়ত মাসীমা দিয়েই দিত–আমি সেখানা নিজের কাছে এনে রাখলাম গোপনে। কত টাকা ডাকঘরে আছে না জানতে পেরে পঞ্চু আরও ক্ষেপে উঠল। বেচারীর দুর্দশার একশেষ ক’রে তুললে। কুণ্ডুমশায়ের স্ত্রীর বড় সাধ ছিল সৎছেলেরা তাকে মা বলে ডাকে, সে সাধ তারা ভাল করেই মেটালে! একদিন আমার চোখের সামনে সৎমাকে ঝগড়া করে খিড়কীদোর দিয়ে বাড়ির বার করে দিলে। আমি মাসীমাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলাম, চিঠি লিখে তার এক দূরসম্পর্কের ভাইকে আনালাম–সে এসে মাসীমাকে নিয়ে গেল। আমার অসাক্ষাতে মাসীমা আবার বৌদিদির হাতে একখানা একশো টাকার নোট খুঁজে দিয়ে বলে গেল যাবার সময়–জিতু মাসীমা বলেছিল, আমি তিলির মেয়ে, কিন্তু বেঁচে থাক সে, ছেলের কাজ করেছে। আমার জন্যেই তার কারখানার চাকরিটা গেল, যতদিন অন্য কিছু না হয়, এতে চালিয়ে নিও, বৌমা। আমি দিচ্ছি এতে কিছু মনে করো না, আমার তিনকুলে কেউ নেই, নিতুর বৌয়ের হাতে দিয়ে সুখ যদি পাই, তা থেকে আমায় নিরাশ ক’রো না।
পঞ্চু কারখানা থেকে আমায় ছাড়িয়ে দিলেও আমি আর একটা দোকানে চাকরি পেলাম সেই মাসেই। সৎমায়ের সঙ্গে ওরকম ব্যবহার করার দরুন কালীগঞ্জে কেউই ওদের ওপর সন্তুষ্ট ছিল না, মাসীমার অমায়িক ব্যবহারে সবাই তাকে ভালবাসত। তবে পঞ্চুদের টাকার জোর ছিল, সব মানিয়ে গেল।
ইতিমধ্যে একদিন সীতার শ্বশুরবাড়ি গেলাম সীতাকে দেখতে। দাদা মারা যাওয়ার পরে ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি, কারণ এক বেলার জন্যেও ওরা সীতাকে পাঠাতে রাজী হয় নি। সীতা দাদার নাম করে অনেক চোখের জল ফেললে। দাদার সঙ্গে ওর শেষ দেখা মায়ের মৃত্যুর সময়ে। তার পর আমার নিজের কথা অনেক জিজ্ঞেস করলে। সন্ধ্যাবেলায় ও রান্নাঘরে বসে রাঁধছিল, আমি কাছে বসে গল্প করছিলাম। ওর শ্বশুরবাড়ির অবস্থা ভাল না, বসতবাটিটা বেশ বড়ই, কিন্তু বাস করবার উপযুক্ত কুটুরী মাত্র চারটি, তাদেরও নিতান্ত জীর্ণ অবস্থা, চুনবালিখসা দেওয়াল, কার্নিসের ফাটলে বট অশ্বত্থের গাছ। রান্নাঘরের এক দিকের ভাঙা দেওয়াল বাঁশের চাঁচ দিয়ে বন্ধ, কার্তিক মাসের হিম তাতে আটকাচ্ছে না। সীতার বড়-জা ওদিকে আর একটা উনুনে মাটির খুড়িতে টাটকা খেজুর রস জ্বাল দিচ্ছিলেন, তিনি বললেন–যা হবার হয়ে গেল ভাই, এইবার তুমি একটা বিয়ে কর দিকি? এই গাঁয়েই বাঁড়ুয্যেবাড়িতে ভাল মেয়ে আছে, যদি মত দাও কালই মেয়ে দেখিয়ে দি।
সীতা চুপ করে রইল। আমি বললাম–একটা সংসার ঘাড়ে পড়েছে, তাই অতি কষ্টে চালাই, আবার একটা সংসার চালাব কোথা থেকে দিদি?
সীতা বললে–বিয়ে আর কাউকে করতে বলিনে মেজদা, এ অবস্থায় বড়দারও বিয়ে করা উচিত হয় নি। তোমারও হবে না। তার চেয়ে তুমি সন্নিসি হয়ে বেড়াচ্ছিলে, ঢের ভাল করেছিলে। আচ্ছা মেজদা, তুমি নাকি খুব ধার্মিক হয়ে উঠেছ সবাই বলে?
আমি হেসে বললাম–অপরের কথা বিশ্বাস করিস নাকি তুই? পাগল! ধার্মিক হলেই হ’ল অমনি-না? আমি কি ছিলাম, না-ছিলাম, তুই তো সব জানিস সীতা। আমার ধাতে ধার্মিক হওয়া সয় না, তবে আমার জীবনের আর একটা কথা তুই জানিস নে, তোকে বলি শোন।
ওদের মালতীর কথা বললুম, দু-জনেই একমনে শুনলে। ওর বড়-জা বললে–এই তো ভাই মনের মত মানুষ তো পেয়েছিলে–ওরকম ছেড়ে এলে কেন?
আমি বললাম–এক তরফা। তাতে দুঃখই বাড়ে, আনন্দ পাওয়া যায় না। সীতা তো সব শুনলি, তোর কি মনে হয়?
সীতা মুখ টিপে হেসে বললে–এক তরফা বলে মনে হয় না। তোমার সঙ্গে অত মিশত না তা হলে–বা তোমার সঙ্গে কোথাও যেত না।
একটু চুপ করে থেকে বললে–তুমি আর একবার সেখানে যাও, মেজদা। আমি ঠিক বলছি তুমি চলে আসবার পরেই সে বুঝতে পেরেছে তার আখড়া নিয়ে থাকা ফাঁকা কাজ। ছেলেমানুষ, নিজের মন বুঝতে দেরি হয়। এইবার একবার যাও, গিয়ে তাকে নিয়ে এস তো?
সীতা নিজের কথা বিশেষ কিছু বলে না, কিন্তু ওর ওই শান্ত মৌনতার মধ্যে ওর জীবনের ট্র্যাজেডি লেখা রয়েছে। ওর স্বামী সত্যিই অপদার্থ, সংসারে যথেষ্ট দারিদ্র্য, কখনও বাড়ি থেকে বেরিয়ে দু-পয়সা আনবার চেষ্টা করবে না। এক ধরনের নিষ্কর্মা লোকেরা মনের আলস্য ও দুর্বলতা প্রসূত ভয় থেকে পুজো-আচ্চার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে, সীতার স্বামীও তাই। সকালে উঠে ফুল তুলে পুজো করবে, স্নানের সময় ভুল সংস্কৃতে স্তবপাঠ করবে, সব বিষয়ে বিধান দেবে, উপদেশ দেবে। একটু আদা-চা খেতে চাইলাম–সীতাকে বারণ করে বলে দিলে–রবিবারে আদা খেতে নেই। দুপুরে খেয়ে উঠেই বিছানায় গিয়ে শোবে, বিকেল চারটে পর্যন্ত ঘুমুবে–এত ঘুমুতেও পারে! এদিকে আবার ন’টা বাজতে না বাজতে রাত্রে বিছানা নেবে। সীতা বই পড়ে বলে তাকে যথেষ্ট অপমান সহ্য করতে হয়। বই পড়লে মেয়েরা কুলটা হয়, শাস্ত্রে নাকি লেখা আছে!
দেখলাম লোকটা অত্যন্ত দুর্মুখও বটে। কথায় কথায় আমার মুখে একবার যীশুখৃষ্টের নাম শুনে নিতান্ত অসহিষ্ণু ও অভদ্র ভাবে বলে উঠল–ওসব ম্লেচ্ছ ঠাকুর দেবতার নাম করো না এখানে, এটা হিন্দুর বাড়ি, ওসব নাম এখানে চলবে না।
সীতার মুখের দিকে চেয়ে চুপ করে রইলাম, নইলে এ কথার পর আমি এ বাড়িতে আর জলস্পর্শ করতাম না। সীতা ওবেলা পায়েস পিঠে খাওয়াবার আয়োজন করছে আমি জানি, তাঁর আদরকে প্রত্যাখ্যান করতে কিছুতেই মন সরল না। আমি রাগ করে চলে গেলে ওর বুকে বড় বিঁধবে। ওকে একেবারেই আমরা জলে ভাসিয়ে দিয়েছি সবাই মিলে। সীতা একটাও অনুযোগের কথা উচ্চারণ করলে না। কারুর বিরুদ্ধেই না। বৌদিদিকে ব’সে ব’সে একখানা লম্বা চিঠি লিখলে, আসবার সময় আমার হাতে দিয়ে বললে–আমায় পাঠাবে না কালীগঞ্জে, তুমি মিছে বলে কেন মুখ নষ্ট করবে মেজদা! দরকার নেই। তার পর জল-ভরা হাসি হাসি চোখে বললে–আবার কবে আসবে? ভুলে থেকো না মেজদা, শীগগির আবার এসো।
পথে আসতে আসতে দুপুরের রোদে একটা গাছের ছায়ায় বসে ওর কথাই ভাবতে লাগলুম। উমপ্লাঙের মিশন-বাড়ির কথা মনে পড়ল, মেমেরা সীতাকে কত কি ছুঁচের কাজ, উল-বোনার কাজ শিখিয়েছিল যত্ন করে। কার্ট রোডের ধারে নদীখাতের মধ্যে বসে আমি আর সীতা কত ভবিষ্যতের উজ্জ্বল ছবি এঁকেছি ছেলেমানুষী মনে–কোথায় কি হয়ে গেল সব! মেয়েরাই ধরা পড়ে বেশী, জগতের দুঃখের বোঝা ওদেরই বইতে হয় বেশী করে। সীতার দশা যখনই ভাবি, তখনই তাই আমার মনে হয়।
মনটাতে আমার খুব কষ্ট হয়েছে সীতার স্বামীর একটা কথায়। সে আমায় লক্ষ্য করে একটা শ্লোক বললে কাল রাত্রে। তার ভাবার্থ এই–গাছে অনেক লাউ ফলে, কোন লাউয়ের খোলে কৃষ্ণনাম গাইবার একতারা হয়, কোন লাউ আবার বাবুর্চি রাঁধে গোমাংসের সঙ্গে।
তার বলবার উদ্দেশ্য, আমি হচ্ছি শেষোক্ত শ্রেণীর লাউ। কেননা আমি ব্রাহ্মণ হয়ে ব্রাহ্মণের আচার মানি নে, দেবদেবীর পুজো-আচ্চা করি নে ওর মত। এই সব কারণে ও আমাকে অত্যন্ত কৃপার চক্ষে দেখে বুঝলাম এবং বোধ হয় নিজেকে মনে মনে হরিনামের একতারা বলেই ভাবে।
ভাবুক, তাতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু তার মতের সঙ্গে মিল না হলেই সে যদি আমায় ঘৃণা করে তবে আমি নিতান্ত নাচার। কোন অপরাধে আমি বাবুর্চির হাতে-রাঁধা লাউ? ছেলেবেলায় হিমালয়ের ওক পাইন বনে তপস্যাস্তব্ধ কাঞ্চনজঙ্ঘার মূর্তিতে ভগবানের অন্য রূপ দেখেছিলাম, তাই? রাঢ়দেশের নির্জন মাঠের মধ্যে সন্ধ্যায় সেবার সেই এক অপরূপ দেবতার ছবি মনে এঁকে গিয়েছে, তাই? সেই অজানা নামহীন দেবতাকে উদ্দেশ করে বলি–যে যা বলে বলুক, আমি আচার মানি নে, অনুষ্ঠান মানি নে, সম্প্রদায় মানি নে, কোন সাম্প্রদায়িক ধর্মমত মানি নে, গোঁড়ামি মানি নে,–আমি আপনাকে মানি। আপনাকে ভালবাসি। আপনার এই বননীল দিগন্তের রূপকে ভালবাসি, বিশ্বের এই পথিক রূপকে ভালবাসি। আমার এই চোখ, এই মন জন্মজন্মান্তরেও এই রকম রেখে দেবেন। কখনও যেন ছোট করে আপনাকে দেখতে শিখি নে। আর আমার উপাসনার মন্দির এই মুক্ত আকাশের তলায় যেন চিরযুগ অটুট থাকে। এই ধর্মই আমার ভাল।
বাড়ি ফিরে দেখি বৌদিদি অত্যন্ত অসুখে পড়েছে।
মহাবিপদে পড়ে গেলাম। কারও সাহায্য পাই নে, ছেলেমেয়েরা ছোট ছোট–দাদার বড় মেয়েটি আট বছরের হ’ল, সে সমস্ত কাজ করে, আমি রাঁধি আবার বৌদিদির সেবাশুশ্রষা করি। রোগিণীর ঠিকমত সেবা পুরুষের দ্বারা সম্ভব নয়, তবুও আমি আর খুকীতে মিলে যতটা পারি করি।
বৌদিদির অসুখ দিন দিন বেড়ে উঠতে লাগল। সংসারে বিশৃঙ্খলার একশেষ– বৌদিদি অচৈতন্য হয়ে বিছানায় শুয়ে, ছেলেমেয়েরা যা খুশী তাই করছে, ঘরের জিনিসপত্র ভাঙছে, ফেলছে, ছড়াচ্ছে–এখানে নোংরা, ওখানে অপরিষ্কার–কোন জিনিস কোথায় থাকে কেউ বলতে পারে না, হঠাৎ অসময়ে আবিষ্কার করি ঘড়ায় খাবার জল নেই, কি লণ্ঠন জ্বালাবার তেল নেই। বাজার নিকটে নয়, অন্তত দেড় মাইল দূরে এবং বাজারে যেতে হবে আমাকেই। সুতরাং বেশ বোঝা যাবে অসময়ে এসব আবিষ্কারের অর্থ কি।
প্রায় এক মাস এই ভাবে কাটল। এই এক মাসের কথা ভাবলে আমার ভয় হয়। আমি জানতুম না কখনও যে জগতে এত দুঃখ আছে বা সংসারের দায়িত্ব এত বেশী। রাত দিন কখন কাটে ভুলে গেলাম, দিন, বার, তারিখের হিসেব হারিয়ে ফেলেছিলুম– কলের পুতুলের মত ডাক্তারের কাছে যাই, রোগীর সেবা করি, চাকরি করি, ছেলেমেয়েদের দেখাশুনো করি। এই দুঃসময়ে দাদার আট বছরের মেয়েটা আমাকে অদ্ভুত সাহায্য করলে। সে নিজে রাঁধে, মায়ের পথ্য তৈয়ারী করে, মায়ের কাছে বসে থাকে–আমি যখন কাজে বেরিয়ে যাই ওকে ব’লে যাই ঠিক সময় ওষুধ খাওয়াতে, কি পথ্য দিতে।
মেজাজ আমার কেমন খারাপ হয়ে গিয়েছিল বোধ হয়, একদিন কোথা থেকে এসে দেখি রোগিণীর সামনের ওষুধের গ্লাসে ওষুধ রয়েছে। খুকীকে বলে গিয়েছি খাওয়াতে কিন্তু সে ওষুধ গ্লাসে ঢেলে মায়ের পাশে রেখে দিয়ে কোথায় চলে গিয়েছে। দেখে হঠাৎ রাগে আমার আপাদমস্তক জ্বলে উঠল আর ঠিক সেই সময় খুকী আঁচলে কি বেঁধে নিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকল। আমি রুক্ষ সুরে বললাম–খুকী এদিকে এস–
আমার গলার সুর শুনে খুকীর মুখ শুকিয়ে গেল ভয়ে। সে ভয়ে ভয়ে দু-এক পা এগিয়ে আসতে লাগল, বারবার আমার চোখের দিকে চোখ রেখে। আমি বললাম–তোর মাকে ওষুধ খাওয়াস নি কেন? কোথায় বেরিয়েছিলি বাড়ি থেকে?
সে কোনো জবাব দিতে পারল না–ভয়ে নীলবর্ণ হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ কি যে রাগ হল চণ্ডালের মত তাকে পাখার বাঁট দিয়ে আতালি পাতালি মারতে লাগলাম–প্রথম ভয়ে মার খেয়েও সে কিছু বললে না, তার পরে আমার মারের বহর দেখে সে ভয়ে কেঁদে উঠে বললে–ও কাকাবাবু আপনার পায়ে পড়ি, আমায় মারবেন না, আর কখনও এমন করবো না–
তার হাতের মুঠো আলগা হয়ে আঁচলের প্রান্ত থেকে দুটো মুড়ি পড়ে গেল মেজেতে। সে মুড়ি কিনতে গিয়েছিল এক পয়সার, খিদে পেয়েছে বলে। ভয়ে তাও যেন তার মনে হচ্ছে কি অপরাধই সে করে ফেলেছে!
আমার জ্ঞান হঠাৎ ফিরে এল। মুড়ি ক’টা মেজেতে পড়ে যাওয়ার ঐ দৃশ্যে বোধ হয়। নিজেকে সামলে নিয়ে ঘর থেকে বার হয়ে গেলাম। সমস্ত দিন ভাবলাম–ছি, এ কি করে বসলাম! আট বছরের কচি মেয়েটা সারাদিন ধরে খাটছে, এক পয়সার মুড়ি কিনতে গিয়েছে আর তাকে এমন ক’রে নির্মমভাবে প্রহার করলাম কোন প্রাণে?
জীবনে কত লোকের কত বিচার করেছি তাদের দোষগুণের জন্যে–দেখলাম কাউকে বিচার করা চলে না–কোন অবস্থার মধ্যে পড়ে কে কি করে সে কথা কি কেউ বুঝে দেখে?
বৌদিদির অসুখ ক্রমে অত্যন্ত বেড়ে উঠল। দিন-দিন বিছানার সঙ্গে মিশে যেতে লাগল দেখে ভয়ে আমার প্রাণ উড়ে যাচ্ছে। এদিকে এক মহা দুশ্চিন্তা এসে জুটল, যদি বৌদিদি না-ই বাঁচে-এই ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে আমি কি করব? বিশেষ করে কোলের মেয়েটাকে নিয়ে কি করি? ছোট খুকী মোটে এই দশ মাসের–কি সুন্দর গড়ন, মুখ, কি চমৎকার মিষ্টি হাসি! এই দেড় মাস তার অযত্নের একশেষ হচ্ছে–উঠোনের নারকোলতলায় চটের থলে পেতে তাকে রোদ্দুরে শুইয়ে রাখা হয়–বড় খুকী সব সময় তাকে দেখতে পারে না–কাঁদলে দেখবার লোক নেই, মাতৃস্তন্য বন্ধ এই দেড় মাস– হর্লিকস খাইয়ে অতি কষ্টে চলছে। রাত্রে আমার পাশে তাকে শুইয়ে রাখি, মাঝরাত্রে উঠে এমন কান্না শুরু করে মাঝে মাঝে–ঘুমের ঘোরে উঠে তাকে চাপড়ে চাপড়ে ঘুম পাড়াই–বড় খুকীকে আর ওঠাই নে। রাত্রে তো প্রায়ই ঘুম হয় না, রোগীকে দেখা-শুনো করতেই রাত কাটে–মাঝে মাঝে একটু ঘুমিয়ে পড়ি। পাড়ায় এত বৌ-ঝি আছে–দেখে বিস্মিত হয়ে গেলাম কেউ কোনদিন বলে না খুকীকে নিয়ে গিয়ে একবার মাইয়ের দুধ দিই। আমি একা কত দিকে যাব–তা ছাড়া আমার হাতের পয়সাও ফুরিয়েছে। এই দেড় মাসের মধ্যে সংসারের রূপ একেবারে বদলে গিয়েছে আমার চোখে–আমি ক্রমেই আবিষ্কার করলাম মানুষ মানুষকে বিনাস্বার্থে কখনও সাহায্য করে না–আমি দরিদ্র, আমার কাছে কারুর কোনো স্বার্থের প্রত্যাশা নেই, কাজেই আমার বিপদে কেউ উঁকি মেরেও দেখতে এল না। না আসুক, কিন্তু কোলের খুকীটাকে নিয়ে যে বড় মুশকিলে পড়ে গেলাম! ও দিন-দিন আমার চোখের সামনে রোগা হয়ে যাচ্ছে। ওর অমন কাঁচাসোনার রঙের ননীর পুতুলের মত ক্ষুদে দেহটিকে যেন কালি মেড়ে দিচ্ছে দিন দিন–কি করবো ভেবে পাই নে, আমি একেবারেই নিরুপায়! স্তন্যদুগ্ধ আমি ওকে দিতে তো পারি নে!
কিন্তু এর মধ্যে আবার মুশকিল এই হল যে স্তন্যদুগ্ধ তো দূরের কথা, গরুর দুধও গ্রামে পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠল। গোয়ালারা ছানা তৈরি করে কলকাতায় চালান দেয়, দুধ কেউ বিক্রী করে না। একজন গোয়ালার বাড়িতে দুধের বন্দোবস্ত করলাম–সে বেলা বারোটা-একটার এদিকে দুধ দিত না। খুকী ক্ষিদেতে ছটফট করত, কিন্তু চুপ করে থাকত–একটুও কাঁদত না। আমার বুড়ো আঙুলটা তার মুখের কাছে সে সময়ে ধরলেই সে কচি অসহায় হাত দুটি দিয়ে আমার আঙুলটা তার মুখের মধ্যে পুরে দিয়ে ব্যগ্র, ক্ষুধার্ত ভাবে চুষত–তা থেকেই বুঝতাম মাতৃস্তন্য-বঞ্চিত এই হতভাগ্য শিশুর স্তন্যক্ষুধার পরিমাণ।
ওকে কেউ দেখতে পারে না–দু-একটি পাড়ার মেয়ে যারা বেড়াতে আসত, তারা ওকে দেখে নানারকম মন্তব্য করত। ওর অপরাধ এই যে ও জন্মাতেই ওর বাবা মারা গেল, ওর মা শক্ত অসুখে পড়ল। খুকীর একটা অভ্যাস যখন-তখন হাস্য–কেউ দেখুক আর না-ই দেখুক, সে আপন মনে ঘরের আড়ার দিয়ে চেয়ে ফিক করে একগাল হাসবে। তার সে ক্ষুধাশীৰ্ণ মুখের পবিত্র, সুন্দর হাসি কতবার দেখেছি–কিন্তু সবাই বলত, আহা কি হাসেন, আর হাসতে হবে না, কে তোমার হাসি দেখছে? উঠোনের নারকোলতলায় চট পেতে রৌদ্রে তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। কত দিন দেখেছি নীল আকাশের দিকে চোখ দুটি তুলে সে আপনমনে অবোধ হাসি হাসছে। সে অকারণ, অপার্থিব হাসি কি অপূর্ব অর্থহীন খুশিতে ভরা! ছোট্ট দেহটি দিন-দিন হাড়সার হয়ে যাচ্ছে। অমন সোনার রং কালো হয়ে গেল, তবুও ওর মুখে সেই হাসি দেখছি মাঝে মাঝে–কেন হাসে, কি দেখে হাসে।
এক এক দিন রাত্রে ঘুম ভেঙে দেখি ও খুব চেঁচিয়ে কাঁদছে। মাথা চাপড়াতে চাপড়াতে আবার ঘুমিয়ে পড়ত। বড় খুকীকে বলতাম–একটু দুধ দে তো গরম করে, হয়ত খিদেয় কাঁদছে। সব দিন আবার রাত্রে দুধ থাকত না। সেদিন আঙুল চুষিয়ে অনেক কষ্টে ঘুম পাড়াতে হত। একদিন সকালে ওর কান্না দেখে আর থাকতে পারলাম না–রোগীর সেবা ফেলে দু-ক্রোশ তফাতের একটা গ্রাম থেকে নগদ পয়সা দিয়ে আধসের দুধ যোগাড় করে নিয়ে এসে ওকে খাওয়ালুম। গোয়ালাকে কত খোশামোদ করেও বেলা বারোটার আগে কিছুতেই দুধ দেওয়ানো গেল না।
মানুষ যদি বিবেচনাহীন হয়, নির্বোধ হয়, তবে বাইরে থেকে তাকে পশুর চেয়েও নিষ্ঠুর মনে করা দোষের নয়। যখন খুকীর দুধের জন্যে আমি সারা গ্রামখানার প্রত্যেক গোয়ালাবাড়ি খুঁজে বেড়িয়েছি যদি সকালের দিকে কেউ একটু দুধ দিতে পারে–যে বলেছে হয়ত ওখানে গেলে পাওয়া যাবে সেখানেই ছুটে গিয়েছি, আগাম টাকা দিতে চেয়েছি কিন্তু প্রতিবারই বিফল হয়ে ফিরে এসেছি–সে সময় ঠিক আমার বাড়ির পাশেই সুরপতি মুখুজ্যের বাড়িতে দেড় সের করে দুধ হত। সুরপতি সস্ত্রীক বিদেশে থাকেন, বাড়িতে থাকেন তাঁর বিধবা ভাজ নিজের একমাত্র বিধবা মেয়ে নিয়ে। এঁদের অবস্থা ভাল, দোতলা কোঠা বাড়ি, ছ-সাতটা গরু, জমিজমা, ধানভরা গোলা। সকালে মায়ে ঝিয়ের চা খাবার জন্যে দুধ দোয়া হত, মেয়েটা নিজেই গাই দুইতে জানে, সকালে আধ সের দুধ হয়, দুপুরে বাকী এক সের। ওঁরা জানেন যে দুধের জন্যে খুকীর কি কষ্ট যাচ্ছে, তাঁদের সঙ্গে আমারও এ সম্বন্ধে কথাও হয়েছে অনেকবার। আমায় অনেকবার প্রৌঢ়া মহিলাটি জিজ্ঞেসও করেছেন আমি দুধের কোন সুবিধা করতে পারলাম কি না–দু-চার দিন সকালে ডেকে আমায় চা-ও খাইয়েছেন, কিন্তু কখনও বলেন নি, এই দুধটুকু নিয়ে গিয়ে খুকীকে খাওয়াও ততক্ষণ। আমিও কখনও তাঁদের বলি নি এ নিয়ে, প্রথমত আমার বাধ-বাধ ঠেকেছে, দ্বিতীয়ত আমার মনে হয়েছে, এঁরা সব জেনেও যখন নিজে থেকে দুধের কথা বলেন নি, তখন আমি বললেও এঁরা ছলছুতো তুলে দুধ দেবেন না। তবুও আমি এঁদের নিষ্ঠুর বা স্বার্থপর ভাবতে পারি নে–বিবেচনাহীনতা ও কল্পনাশক্তির অভাব এঁদের এরকম করে তুলেছে।
কতবার ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানিয়েছি–ওর কষ্ট আমি আর দেখতে পারি নে, আপনি ওকে একটু দুধ দিন।
ওর মুখের সে অবোধ উল্লাসের হাসি প্রতিবার ছুরির মত আমার বুকে বিঁধেছে। কতবার মনে মনে ভেবেছি আমি যদি দেশের ডিকটেটর হতাম, তবে আইন করে দিতাম শিশুদের দুধ না দিয়ে কেউ আর কোন কাজে দুধ লাগাতে পারবে না।
কতবার ভেবেছি বৌদিদি যদি না বাঁচে, এই কচি শিশুকে আমি কি করে মানুষ করব? স্তন্যদুগ্ধ একে কেউ দেবে না এই পাড়াগাঁয়ে, বিলিয়ে দিলেও মেয়েসন্তান কেউ নিতে চাইবে না–নিতান্ত নীচু জাত ছাড়া। আটঘরাতে থাকতে ছেলেবেলায় এরকম একটা ব্যাপার শুনেচিলুম–গ্রামের শশীপদ ভটচাজের কেউ ছিল না–এদিকে শিশু দুটিই মেয়ে, অবশেষে যদু মুচির বৌ এসে মেয়ে দুটিকে নিয়ে গিয়েছিল।
এই সোনার খুকীকে সেই রকম দিতে হবে পরের হাতে? কত বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছি ঘুমন্ত শিশুর মুখের দিকে চেয়ে এই ভাবনায়। এই বিপদে আমার প্রায়ই মনে হয়েছে মালতীর কথা। মালতী আমায় এ বিপদ থেকে উদ্ধার করবে, সে কোন উপায় বার করবেই, যদি খুকীকে বুকে নিয়ে তার কাছে গিয়ে দাঁড়াই। সে চুপ করে থাকতে পারবে না। তার ওপর অভিমান করে চলে এসেছিলাম, দেখা পর্যন্ত করে আসি নি আসবার সময়–আর তার পর এতদিন কোন খোঁজখবর নিই নি–একখানা চিঠি পর্যন্ত দিই নি, আমার বিপদের সময় সে আমার সব দোষ ক্ষমা করে নেবে।
কিন্তু খুকী আমায় সব চিন্তা থেকে মুক্ত করে দিলে। তার যে হাসি কেউ দেখতে চাইত না, একদিন শেষরাত্রি থেকে সে হাসি চিরকালের জন্য মিলিয়ে গেল। অল্পদিনের জন্যে এসেছিল কিন্তু বড় কষ্ট পেয়ে গেল। কিছুই সে চায় নি, শুধু একটু মাতৃস্তন্য, কি লোলুপ হয়ে উঠেছিল তার জন্যে, তার ক্ষুদে ক্ষুদে হাত দুটি দিয়ে ব্যগ্রভাবে আমার আঙুলটা আঁকড়ে ধরে কি অধীর আগ্রহে সেটা চুষত মাতৃস্তন্য ভেবে! আমারও কি কম কষ্ট গিয়েছে অবোধ শিশুকে এই প্রতারণা করতে? জগতে কত লোক কত অসঙ্গত খেয়াল পরিতৃপ্ত করবার সুযোগ ও সুবিধা পাচ্ছে, আর একটি ক্ষুদ্র অস্ফুটবাক শিশুর নিতান্ত ন্যায্য একটা সাধ অপূর্ণ রয়ে গেল কেন তাই ভাবি।
.
১৬.
বৌদিদি ক্রমে সেরে উঠলেন। কিছুদিন পরে আমার হঠাৎ একদিন একটু জ্বর হ’ল। ক্রমে জ্বর বেঁকে দাঁড়াল, আমি অজ্ঞান অচৈতন্য হয়ে পড়লাম। দিনের পর দিন যায় জ্বর ছাড়ে না। একুশ দিন কেটে গেল। দিনের রাতের জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি যেন, কখন রাত কখন দিন বুঝতে পারি নে সব সময়। মাঝে মাঝে চোখ মেলে দেখি বাইরের রোদ একটু একটু ঘরে এসেছে, তখন বুঝি এটা দিন। বিছানার ওপাশটা ক্রমশ হয়ে গেল বহুদূরের দেশ, আফ্রিকা কি জাপান, ওখানে পৌঁছনো আমার শরীর ও মনের শক্তির বাইরে। অধিকাংশ সময়ই ঘোর-ঘোর ভাবে কাটে–সে অবস্থায় যেন কত দেশ বেড়াই, কত জায়গায় যাই। যখন যাই তখন যেন আর আমার অসুখ থাকে না, সম্পূর্ণ সুস্থ, আনন্দে মন ভরে ওঠে, রোগশয্যা স্বপ্ন বলে মনে হয়। ছেলেবেলাকার সব জায়গাগুলেতে আবার গেলাম যেন, আটঘর বাড়িও বাদ গেল না। হঠাৎ ঘোর কেটে যায়, দেখি কুলদা ডাক্তার বুকে নল বসিয়ে পরীক্ষা করছে।
একবার মনে হ’ল দুপুর ঝাঁঝাঁ করছে, আমি দ্বারবাসিনীতে যাচ্ছি খুকীকে কোলে নিয়ে। দুর্গাপুরের ডাঙা পার হয়ে গেলাম, আবার সেই কাঁদোড় নদী, সেই তালবান, রাঙা মাটির পথ। মালতী বড় ঘরের দাওয়ায় বসে কি কাজ করছে। উদ্ধবদাস আমায় দেখে চিনলে, কাছে এসে বললে–বাবু যে–কি মনে করে এতদিন পরে? আপনার কোলে কে? মালতী কাজ ফেলে মুখ তুলে দেখতে গেল উদ্ধবদাস কার সঙ্গে কথাবার্তা কইছে। তারপর আমায় চিনতে পেরে অবাক ও আড়ষ্ট হয়ে সেইখানেই বসে রইল। আমি এগিয়ে দাওয়ার ধারে গিয়ে বললাম–তুমি কি ভাববে জানিনে মালতী, কিন্তু আমি বড় বিপদে পড়েই এসেছি। এই ছোট খুকী আমার দাদার মেয়ে, এর মা সম্প্রতি মারা গিয়েছে। একে বাঁচিয়ে রাখবার কোন ব্যবস্থা আমার মাথায় আসে নি। আর আমার কেউ নেই– একমাত্র তোমার কথাই মনে হল, তাই একে নিয়ে তোমার কাছে এসেছি। একে নাও, এর সব ভার আজ থেকে তোমার ওপর। তুমি ছাড়া আর কারও হাতে একে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হতে পারব না।
মালতী তাড়াতাড়ি খুকীকে আমার কোল থেকে তুলে নিলে। তার পর আমার রুক্ষ চুল ও উদভ্রান্ত চেহারার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। পরক্ষণেই সে দাওয়া থেকে নেমে এসে বললে–আপনি আসুন, উঠে এসে বসুন।
আখড়ায় আর যেন কেউ নেই। উদ্ধবদাসকেও আর দেখলাম না। শুধু মালতী আর আমি। ও ঠিক সেই রকমই আছে–সেই হাসি, সেই মুখ, সেই ঘাড় বাঁকিয়ে কথা বলার ভঙ্গি। হেসে বললে–তারপর?
আমি বললাম–তারপর আর কি? এই এলাম।
—এতদিন কোথায় ছিলেন?
—নানা দেশে। তারপর দাদা মারা গেলেন, আমার ওপরে ওদের সংসারের ভার।
—উঃ, কি নিষ্ঠুর আপনি! তারপর সে বললে–আপনি বসুন, খুকীর সম্বন্ধে একটা ব্যবস্থা তো করতে হবে। একবার নীরদা-দিদিকে ডাকি।
আমি বললাম–আমি কিন্তু এখনই যাব মালতী। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ফেলে রেখে এসেছি পরের বাড়িতে। আমাকে যেতেই হবে।
মালতী আশ্চর্য হয়ে বললে–আজই?
আমি বললাম–আমার কাজ আমি শেষ করেছি, এখন তুমি যা করবে কর খুকীকে নিয়ে। আমি থেকে কি করব? আমি যাই।
মালতী স্থিরদৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে বলল–আমায় নিয়ে যান তবে।
আমি অবাক হয়ে বললাম–সে কি মালতী? তুমি যাবে আমার সঙ্গে? তোমার এই আখড়া?
মালতীর সঙ্গে যেদিন ছাড়াছাড়ি হয়েছিল, সেদিনটি যেমন ও চোখ নামিয়ে কথা বলেছিল–ঠিক তেমনই ভঙ্গিতে চোখ মাটির দিকে রেখে স্পষ্ট ও দৃঢ় সুরে বললে– আপনি আমায় নিয়ে চলুন সঙ্গে যেখানে আপনি যাবেন। এবার আপনাকে একলা যেতে দেব না।
একচল্লিশ দিনে জ্বর ছেড়ে গেল। সেরে উঠলে বৌদিদি একদিন বললেন–জ্বরের ঘোরে মালতী মালতী বলে ডাকতে কাকে, মালতী কে ঠাকুরপো?
আমি বললাম–ও একটি মেয়ে। বাদ দাও ও-কথা। রোজ বলতাম? কত দিন বলেছি?
এই অসুখ-বিসুখে মাসীমার দেওয়া সেই একশো টাকা তো গেলই, বৌদির গায়ের সামান্য যা দু-একখানা গহনা ছিল তা-ও গেল। নতুন চাকুরিটাও সঙ্গে সঙ্গে গেল।
এখান থেকে তিন ক্রোশ দূরে কামালপুর বলে একটা গ্রাম আছে। নিতান্ত পাড়াগাঁ এবং জঙ্গলে ভরা। সেখানকার দু-একজন জানাশোনা ভদ্রলোকের পরামর্শে সেখানে একটা পাঠশালা খুললাম। বৌদিদিদের আপাতত কালীগঞ্জে রেখে আমি চলে গেলাম কামালপুরে। একটা বাড়ির বাইরের ঘরে বাসা নিলাম–বাড়ির মালিক চাকুরির স্থানে থাকেন, বাড়িটাতে অনেকদিন কেউ ছিল না। বাড়ির পিছনে একটা আম-কাঁঠালের বাগান।
পাঠশালায় অনেক ছেলে জুটল–কতকগুলি ছোট মেয়েও এল। যা আয় হয়, সংসার একরকমে চলে যায়।
সময় বড় মনের দাগ মুছে দেবার মন্ত্র জানে। আবার নতুন মন, নতুন উৎসাহ পেলাম। সঙ্গে সঙ্গে জীবনের একটা নতুন অধ্যায় কি রকমে শুরু হ’ল তাই এখানে বলব।
পাঠশালা খুলবার পরে প্রায় দু-বছর কেটে গিয়েছে। ভাদ্র মাস। বেশ শরতের রোদ ফুটেছে। বর্ষার মেঘ আকাশে আর দেখা যায় না। একদিন আমি পাঠশালায় গিয়েছি, একটা ছোট মেয়ে বলছে–মাস্টার মশায়, পেনো হিরণদিদির হাত আঁচড়ে কামড়ে নিয়েছে, ওই দেখুন ওর হাতে রক্ত পড়ছে।
যে মেয়েটির হাত আঁচড়ে নিয়েছে তার নাম হিরণ্ময়ী, বয়স হবে বছর চৌদ্দ, পাঠশালার কাছেই ওদের বাড়ি–কিন্তু মেয়েটি আমার পাঠশালায় ভর্তি হয়েছে বেশী দিন নয়। ওর বাবার নাম কালীনাথ গাঙ্গুলী, তিনি কোথাকার আবাদের নায়েব, সেইখানেই থাকেন, বাড়িতে খুব কমই আসেন।
আমি লক্ষ্য করেছি এই মেয়েটি সকলের চেয়ে সজীব, বুদ্ধিমতী, অত্যন্ত চঞ্চলা। সকলের চেয়ে সে বয়সে বড়, সকলের চেয়ে সভ্য ও শৌখীন। কিন্তু তার একটা দোষ, কেমন একটু উদ্ধত স্বভাবের মেয়ে।
একদিন কি একটা অঙ্ক ওকে দিলাম, সবাইকে দিলাম। ওর অঙ্কটা ভুল গেল। বললাম–তুমি অঙ্কটা ভুল করলে হিরণ?
অঙ্কটা ভুল গিয়েছে শুনে বোধ হয় ওর রাগ হল–আর দেখেছি সব সময়, অপর কারোর সামনে বকুনি খেলে ক্ষেপে ওঠে। খুব সম্ভব সেই জন্যই ও রাগের সুরে বললে–কোথায় ভুল? কিসের ভুল বলে দিন না?
আমি বললাম–কাছে এস, অতদূর থেকে কি দেখিয়ে দেওয়া যায়?
আমি দেখে আসছি যে কদিন ও এসেছে, আমার কাছ থেকে দূরে বসে।
ও উদ্ধতভাবে বললে–কেন, ওখান থেকেই বলুন না? আপনার কাছে কেন যাব?
আমার মনে হ’ল ও বড় মেয়ে বলে আমার কাছে আসতে বোধ হয় সঙ্কোচ অনুভব করে। কিন্তু তার জন্যে ওরকম উদ্ধত সুর কেন? বললাম–কাছে এসে আঁক দেখে নিতে দোষ আছে কিছু?
ও বললে–সে-সব কথার কি দরকার আছে? আপনি দিন অঙ্ক ওখান থেকেই বুঝিয়ে।
রাগে ও বিরক্তিতে আমার মন ভরে উঠল। আচ্ছা মেয়ে তো? মাস্টারদের সঙ্গে কথাবার্তার এই কি ধরন? আর আমায় যখন এত অবিশ্বাস তখন আমার স্কুলে না এলেই তো হয়? সেদিন আমি ওর সঙ্গে আর কোন কথাই বললাম না। পরদিনও তাই, স্কুলে এল, নিজে বসে বসে কি লিখলে বই দেখে, একটা কথাও কইলাম না। ছুটির কিছু আগে আমায় বললে–আমার ইংরেজিটা একবার ধরুন না?
আমি ওর পড়াটা নিয়ে তারপর শান্তভাবে বললাম–হিরণ, তোমার বাড়িতে বলো, আমি তোমাকে পড়াতে পারব না। অন্য ব্যবস্থা করতে বলো কাল থেকে।
হিরন্ময়ীর মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল, বললে–কেন?
আমি বললাম–না–তুমি বড় মেয়ে, এখানে তোমার সুবিধে হবে না।
ও বললে–রাগ করেছেন নাকি? কি করেছি আমি?
আমি বললাম–কাল তোমার ও-কথাটা কি আমায় বলা উচিত হয়েছে, হিরণ? কি বলে তুমি বললে, আপনার কাছে কেন যাব?…ওখান থেকেই বলুন না? তুমি আমার কাছে তবে পড়তে এসেছ কেন?
হিরন্ময়ী হেসে বললে–এই! তা কি এমন বলেছি আমি? তা যখন আপনি বলছেন দোষ হয়েছে বলাতে, তখন দোষ নিশ্চয়ই হয়েছে।
–কেন তুমি বললে ওরকম? তোমার দুঃখিত হওয়া উচিত ওকথা বলার জন্যে, তা জান?
হিরণয়ী বললে–হাঁ, হয়েছি। হল তো? এখন নিন।
তারপর যখন ওর অঙ্ক দেখছি, তখন হঠাৎ আমার মুখের দিকে কেমন একটা বুঝতে না পারার দৃষ্টিতে চেয়ে বললে–উঃ, আপনার এত রাগ?…আগে তো কখনও রাগ দেখি নি এরকম?…তখনও সে আমার মুখের দিকে সেইরকম দৃষ্টিতে চেয়ে কি যেন বুঝবার চেষ্টা করছে। ওর রকম-সকম দেখে আমি হাসি চাপতে পারলাম না–সঙ্গে সঙ্গে সেই মুহূর্তে হিরন্ময়ীকে নতুন চোখে দেখলাম। দেখলাম হিরন্ময়ী অত্যন্ত লাবণ্যময়ী, ওর চোখ দুটি অত্যন্ত ডাগর, টানা-টানা জোড়া ভুরু দুটি কালো সরু রেখার মত, কপালের গড়ন ভারী সুন্দর, চাঁচা, ছোট, অর্ধচন্দ্রাকৃতি। মাথায় একরাশ ঘন কালো চুল।
ও তখনও আমার দিকে সেই ভাবেই চেয়ে আছে। এক মিনিটের ব্যাপারও নয় সবটা মিলে।
পরদিন থেকে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, হিরন্ময়ী আমার কাছ থেকে তত দূরে আর বসে না–আর না ডাকলেও কাছে এসে দাঁড়ায়।
একদিন আমায় বললে–জানেন মাস্টার মশায়, আমার সব দল এরা–আমায় এরা ভয় করে।
অবাক হয়ে বললুম–কারা?
হাত দিয়ে পাঠশালার সব ছাত্রছাত্রীদের দেখিয়ে দিয়ে বললে-–এরা। আমার কথা না শুনে কেউ চলতে পারে না।
–ভয় করে কেন?
—এমনি করে। আমি যা বলব ওদের শুনতেই হবে।
পাঠশালার সকলেরই ওপর সে হুকুম ও প্রভুত্ব চালায়। এটা এতদিন আমার চোখে পড়ে নি–সেদিন থেকে সেটা লক্ষ্য করলাম। তবে পেনো যে সেদিন ওর হাত আঁচড়ে দিয়েছিল সে আলাদা কথা। দেশের রাজার বিরুদ্ধেও তো তাঁর প্রজারা বিদ্রোহী হয়।
রোজ রাত্রে বাসায় এসে সন্ধ্যাবেলা পরোটা গড়ি। দু-একদিন পরে সন্ধ্যাবেলা ময়দা মাখছি একা রান্নাঘরে বসে, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার বেশী নয়, একটা হ্যারিকেন-লণ্ঠন জ্বলছে ঘরে। কার পায়ের শব্দে মুখ তুলে দেখি ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে হিরন্ময়ী। শশব্যস্তে উঠে বিস্মিত মুখে বললাম–হিরণ! এস, এস, কি মনে করে?
হিরন্ময়ীর একটা স্বভাব গোড়া থেকে লক্ষ্য করেছি, কখনই প্রশ্নের ঠিক জবাবটি দেবে না। আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে বললে–ময়দা মাখেন বুঝি নিজে রোজ? এই বুঝি ময়দা মাখা হচ্ছে?
আমি বিপন্ন হয়ে পড়লুম–চোদ্দ বছরের মেয়েকে পাড়াগাঁয়ে বড়ই বলে। আমার কাছে এ রকম অবস্থায় আসাটা কি ঠিক হল ওর? এসব জায়গার গতিক আমি জানি তো।
বললাম–তুমি যাও হিরণ, পড় গে।
হিরন্ময়ী হেসে বললে–তাড়িয়ে দিচ্ছেন কেন? আমি যাব না–এই বসলাম।
বেজায় একগুঁয়ে মেয়ে, আমি তো জানি ওকে। বললে–একটা অঙ্ক কষে দেবেন? না-থাক, একটা গল্প বলুন না!…ও, আপনি বুঝি ময়দা মাখবেন এখন! সরুন, সরুন দিকি। আমি মেখে বেলে দিচ্ছি। কি হবে–রুটি, না লুচি?..আপনি এই পিঁড়িটাতে বসে শুধু গল্প করুন।
সেই থেকে হিরন্ময়ীর রোজ সন্ধ্যাবেলা আমাকে সাহায্য করতে আসা চাই-ই। মৃদু প্রদীপের আলোতে হাসি-হাসি মুখে সে তার খাতাখানা খুলে নামে অঙ্ক কষে–কাজে কিন্তু সে আমার রুটি-পরোটা তৈরী করে দেয়। কিছুতেই আমার বারণ শোনে না–ওর সঙ্গে পারব না বলে আমিও কিছু আর বলিনে। ওর মায়ের বারণও শোনে না, একদিন কথাটা আমার কানে গেল।
শুনলাম একদিন মাকে বলছে ওদের বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে–কেন, যাই তাই কি? আমি অঙ্ক কষতে যাই। বেশ করি–যাও।
হিরন্ময়ীকে বললাম–শোন হিরণ, আমার এখানে সন্ধ্যাবেলা আর এস না, যখন তোমার মা বকেন। মার কথাটা অন্তত তোমার মানা উচিত। বুঝলে?
পরদিন হিরন্ময়ী সত্যিই আর এল না। আমার সন্ধ্যাটা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। ওর না আসাতে, সেদিন প্রথম লক্ষ্য করলাম। সাত-আট দিন কেটে গেল–হিরন্ময়ী পাঠশালাতে রোজই আসে। তাকে জিজ্ঞাসা করি না অবিশ্যি কেন সে সন্ধ্যাবেলা আসে না।
একদিন সে পাঠশালাতেও এল না। দু-তিন দিন পরে জিজ্ঞেস করে জানলাম সে মামার বাড়ি গিয়েছে তার মায়ের সঙ্গে।
দেখে আশ্চর্য হলাম যে আমার পাঠশালা আর সে পাঠশালা নেই–আমার সন্ধ্যাও আর কাটে না। হিরণের বিয়ের সম্বন্ধ হচ্ছে ওর মামার বাড়ি থেকে, মেয়ে দেখাতে নিয়ে গিয়েছে–বরপক্ষ ওখানে মেয়েকে আশীর্বাদ করবে।
মানুষের মন কি অদ্ভুত ধরনের বিচিত্র! হঠাৎ কথাটা শুনেই মনে হল ও গাঁয়ের পাঠশালা উঠিয়ে দেব, অন্যত্র চেষ্টা দেখতে হবে। কেন, যখন প্রথম পাঠশালা খুলেছিলাম এ গাঁয়ে, তখন তো হিরণের অপেক্ষায় এখানে আসি নি, তবে সে থাকলো বা গেল– আমার তাতে কি আসে যায়?
মাসখানেক কেটে গিয়েছে। আমি কলের মত কাজ করে যাই, একদিন সামান্য একটু বাদলা মত হয়েছে–পাঠশালার ছুটি দিয়ে সকাল-সকাল রান্না সেরে নেব বলে রান্নাঘরে ঢুকেছি, বেলা তখনও আছে। এমন সময় দোরের কাছে দেখি হিরন্ময়ী এসে হাসি-হাসি মুখে দাঁড়িয়েছে। আমি বিস্ময়মিশ্রিত খুশীর সুরে বলে উঠলাম–এস, এস হিরণ,-কখন এলে তুমি? বসো।
হিরন্ময়ী বললে–কেমন আছেন আপনি? তারপর সে এগিয়ে এসে সলজ্জ আড়ষ্টতার সঙ্গে ঝপ করে আমার পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করে আবার সোজা হয়ে দোরের কাছে দাঁড়ালো।
আমি এত খুশী হয়েছি তখন, ওকে কি বলবো ভেবে পাইনে যেন। বললাম–বসো হিরণ, দাঁড়িয়ে কেন?
হিরণ্ময়ী বোধ হয় একটু সঙ্কোচের সঙ্গেই এসেছিল, আমি ওর আসাটা কি চোখে দেখি–এ নিয়ে। আমার কথা শুনে হাজার হোক নিতান্ত ছেলেমানুষ তো–ও যেন ভরসা পেল। ঘরের মধ্যে ঢুকে একটা পিঁড়ি পেতে বসল। আমার মুখের দিকে চেয়ে বললে–কি সেই শিখিয়ে দিলেন, ‘নয় পরিত্যাগ-প্রণালী’ না কি? সব ভুলে গিয়েছি–হি হি–
দেখলাম ওর বিয়ে হয় নি।–ওকে আর কোন কথা বলি নি অবিশ্যি তা নিয়ে। দেনা পাওনার ব্যাপার নিয়ে সে-সম্বন্ধ ভেঙে গিয়েছে–দু-চার দিন পরে অপরের মুখে শুনলাম। আবার হিরন্ময়ী আমার পাঠশালাতে নিত্য আসে যায়–সন্ধ্যাবেলাতেও রোজ আসে–ঝড় হোক বৃষ্টি হোক, তার সন্ধ্যায় আসা কামাই যাবে না। কেন তার মা এবার তাকে বকেন না–সেকথা আমি জানি নে–তবে বকেন না যে, এটা আমি জানি।
বরং একদিন হিরন্ময়ী বললে–আজ আলো জ্বেলে একটা বই পড়ছি, মা বললে আজ যে তুই তোর মাস্টারের কাছে গেলিনে বড়? তাই এলুম মাস্টার মশায়।
আমি বললাম–তা বেশ তো, গল্পের বই পড়লেই পারতে। মা না বলে দিলে তো আজ আসতে না?
কথাটা বলতে গিয়ে নিজের অলক্ষিতে একটা অভিমানের সুর বার হয়ে গেল– হিরন্ময়ী সেটা বুঝতে পেরেছে অমনি। এমন বুদ্ধিমতী মেয়ে এইটুকু বয়সে! বললে– নিন, আর রাগ করে না। ভেবে দেখুন, আপনি না আমায় এখানে এলে তাড়িয়ে দিতেন আগে আগে?
দুঃখিত ভাবে বললাম–ছিঃ ও-কথা বলো না হিরণ, তাড়িয়ে আবার তোমায় দিয়েছি কবে? ও-কথাতে আমার মনে কষ্ট দেওয়া হয়।
হিরন্ময়ী মুখে কাপড় দিয়ে খিল খিল করে উচ্ছ্বসিত ছেলেমানুষি হাসির বন্যা এনে দিলে। ঘাড় দুলিয়ে দুলিয়ে বলতে লাগল–না–না দেন নি? বটে? একদিন–সেই– তাড়ালেন না! আজ আবার বলা হচ্ছে—-। পরে আমার সুরের নকল করতে চেষ্টা করে—‘ওতে আমার মনে কষ্ট দেওয়া হয়’–কি মানুষ আপনি!—হি-হি-হি-হি–
আমি মুগ্ধদৃষ্টিতে ওর হাসিতে উদ্ভাসিত সুকুমার লাবণ্যভরা মুখের দিকে চেয়ে রইলাম–চোখ আর ফেরাতে পারি নে–কি অপূর্ব হাসি! কি অপূর্ব চোখমুখের শ্রী!
যখন চোখ নামিয়ে নিলাম তখন সে আমার বেলুনটা তুলে নিয়ে রুটি বেলতে বসে গিয়েছে। সেদিন ও যখন চলে যায়, ঝোঁকের মাথায় অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই ওকে আবার বললাম–এ রকম আর এস না, হিরণ! না, সত্যি বলছি তুমি আর এস না।
মনকে খুব দৃঢ় করে নিয়ে কথাটা বলে ফেলেই ওর মুখের দিকে চেয়ে আমার বুকের মধ্যে যেন একটা তীক্ষ্ণ তীর খচ করে বিঁধলো। দেখলাম ও বুঝতে পারে নি আমি কেন একথা বলছি–কি বোধ হয় দোষ করে ফেলেছে ভেবে ওর মুখ বিবর্ণ হয়ে গিয়েছে উদ্বেগ ও ভয়ে।
আমার মুখের দিকে একটুখানি চেয়ে রইল–যদি মুখের ভাবে কারণ কিছু বুঝতে পারে। না বুঝতে পেরে যাবার সময় দেখলাম শুষ্ক বিবর্ণ মুখে বললে–আমায় তাড়িয়ে দিলেন তো, এই দেখুন–তাড়ালেন কি না।
দুঃখে আমার বুক ফেটে যেতে লাগল। নিমগাছটার তলা দিয়ে ও ওই যাচ্ছে, এখনও বেশী দূর যায় নি, ডেকে দুটো মিষ্টি কথা বলব? ছেলেমানুষকে একটু সান্ত্বনা দেব?
ডাকলুম শেষটা না পেরে।–শোনো ও হিরণ-শোনো–
ও দাঁড়াল না–শুনেও শুনল না। হন হন করে হেঁটে বাড়ি চলে গেল। পরদিন খুব সকালে উঠে বারান্দাতে বসে ব্রাউনিঙের A Soul’s Tragedy পড়ছি–হিরণ এসে দাঁড়িয়ে বললে–কি খাচ্ছেন?
–এস এস হিরণ। কাল তোমাকে ডাকলাম রাত্রে, এলে না কেন? তুমি বড় একগুঁয়ে মেয়ে–একবার শোনা উচিত ছিল না কি বলছি?
মুখরা বালিকা এবার নিজমূর্তি ধরলে। বললে–আমি কি কুকুর নাকি, দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবেন, আবার তু করে ডাকলেই ছুটে আসব? আপনি বুঝি মনে ভাবেন আমার শরীরে ঘেন্না নেই, অপমান নেই–না? আমি বলতে এলাম সকালবেলা যে আপনার পাঠশালায় আমি পড়তে আসব না।—মা অনেক দিন আগেই বারণ করেছিল–তবুও আসতাম, তাদের কথা না শুনে। কিন্তু যখন আপনি কুকুর-শেয়ালের মত দূর করে তাড়িয়ে—
ওর চোখে জল ছাপিয়ে এসেছে–অথচ কি তেজ ও দৰ্পের সঙ্গে কথাগুলো সে বললে! আমি বাধা দিয়ে বললাম–আমায় ভুল বুঝো না, ছিঃ হিরণ–আচ্ছা, চেঁচিও না বেশী, কেউ শুনলে কি ভাববে। আমরা কথা শোন–রাগ করে না ছিঃ!
হিরণ দাঁড়াল না এক মুহূর্তও। অতটুকু মেয়ের রাগ দেখে যেমন কৌতুক হল, মনে তেমনই অত্যন্ত কষ্টও হল। কেন মিথ্যে ওর মনে কষ্ট দিয়েছি কাল? আহা, বেচারী বড় দুঃখ ও আঘাত পেয়েছে। আমার জ্ঞান আর হবে কবে? ছেলেমানুষকে ও-কথাটা ওভাবে বলা আমার আদৌ উচিত হয় নি।
মন অত্যন্ত খারাপ হয়ে গেল–ভাবলাম, এ গ্রামের পাঠশালা তুলে দিয়ে অন্যত্র যাবই। এদিকে হিরন্ময়ীও আর আমার পাঠশালাতে আসে না। মাসের বাকি আটটা দিন পড়িয়ে নিয়ে পাঠশালা তুলে দেব ঠিক করে ফেললাম। সবাইকে বলেও রাখলাম কথাটা। আগে থেকে যাতে সবাই অন্য ব্যবস্থা করে নিতে পারে।
যাবার দু-দিন আগে জিনিসপত্র গোছাচ্ছি–হঠাৎ হিরণয়ী নিঃশব্দে ঘরের মধ্যে এসে কখন দাঁড়িয়েছে। মুখ তুলে ওর দিকে চাইতেই হেসে ফেললে। বললে–আপনি নাকি চলে যাবেন এখান থেকে?
আমি বললাম–যাবই তো। তার পর, এত দিন পরে কি মনে করে?
হিরন্ময়ী তার অভ্যাসমত আমার প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে বললে–কবে যাবেন?
—বুধবার বিকেলে গাড়ি ঠিক করা আছে, চাকদাতে গিয়ে উঠবো।
হিরন্ময়ী একবার ঘরের চারিধারে চেয়ে দেখল। বললে–আপনার সে বড় বাক্সটা কই?
–সেটা কানুর বাবার কাছে বিক্রী করে দিয়েছি। অত বড় বাক্স কি হবে? তা ছাড়া সঙ্গে টেনে টেনে নিয়ে বেড়ানোও মুশকিল।
হঠাৎ হিরন্ময়ী ঝপ ক’রে মেঝেতে বসে পড়ল–কর্তৃত্ব ও আত্মপ্রত্যয়ের সুরে বললে–না, আপনি যেতে পারবেন না। দেখি দিকি কেমন যান?
আমার হাসি পেল ওর রকম দেখে। খুব আনন্দও হল–একটা অদ্ভুত ধরনের আনন্দ হল। বললাম–তোমার তাতে কি, আমি যাই আর না-যাই? তুমি তো আর এতদিন উঁকি মেরেও দেখতে আস নি হিরণ, তুমি আমার পাঠশালা পর্যন্ত যাওয়া ছেড়েছ।
–ইস! তাই বৈ কি?
—তুমি ভেবে দেখ তাই কি না। উড়িয়ে দিলে চলবে না হিরণ, আমি যাবই ঠিক করেছি, তুমি আমায় আটকাতে পারবে না। কারুর জন্যে কারুর আটকায় না–এ তুমি নিজেই আমায় একদিন বলেছিলে।
হিরন্ময়ী বালিকাসুলভ হাসিতে ঘর ভরিয়ে ফেলে বললে–ওই! কথা যদি একবার শুরু করে দিলেন তো কি আর আপনার মুখের বিরাম আছে? কারুর জন্যে কারুর আটকায় না, হেন না তেন না–মাগো–কথার ঝুড়ি একেবারে!।
–সে যাই হোক, আমি যাবই।
—কখখনো না। উঃ, বললেই হল যাব!
আমি চুপ করে রইলাম–ছেলেমানুষের সঙ্গে তর্ক করে আর লাভ কি?
দেখি যে বিকেলে পাঠশালায় হিরন্ময়ী বইখাতা নিয়ে হাজির হয়েছে। সে এসে সব ছেলেমেয়েকে বলে দিলে আমার পাঠশালা উঠবে না, আমি কোথাও যাব না, সবাই যেন ঠিকমত আসে। এমন সুরে বললে যে সে যেন আমার দণ্ডমুণ্ডের মালিক। বললে–এই হাঁদু, মাস্টার মশায় তোমায় বলেছিলেন না ধারাপাত আনতে–কেন আন নি ধারাপাত? এই সোমবারের হাট থেকে আনতে বলে দেবে। বুঝলে?
হাঁদু বোকার মত দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে বললে–মাস্টারমশাই যে সোমবারে চলে যাবেন এখান থেকে?
হিরন্ময়ী তাকে এক তাড়া দিয়ে বললে–কে বলেছে চলে যাবেন? মেরে হাড় ভেঙে দেব ছোঁড়ার! যা যা বলছি তা শোন। বাঁদর কোথাকার–
আমি বললাম–কেন ওকে মিথ্যে বকছ হিরণ, ছেলেমানুষকে–ওর দোষ কি, আমি যাবই, কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না।
হিরন্ময়ী ঝঙ্কার দিয়ে বললে–আচ্ছা আচ্ছা হবে। যাবেন তো যাবেন।
সেদিন সন্ধ্যাবেলা অনেকদিন পরে ও রান্নাঘরে এসে ঢুকল। বললে–গুড়ের ভাঁড়টা কই!
–সেটা তিনকড়িদের দিয়ে দিইছি। দু-দিনের মত খানিকটা গুড় ওই বাটিতে রেখেছি–দুটো দিন ওতেই চলে যাবে।
হিরন্ময়ী অন্য দিনের মত বসল না দাঁড়িয়ে রইল। একবার বাইরে যাবার সময় ও সরে দরজার কপাটের আর দেওয়ালের মধ্যের যে জায়গাটুকু, সেখানটাতে দেখি জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বলতে গেলাম–ওখানে না, ওখানে না,–কাপড়ে কালিটালি লেগে যাবে কি না–বার হয়ে এস–
ওর মুখের দিকে চেয়ে দেখি ওর ডাগর চোখ দুটি জলে ভরে টল টল করছে।
হিরন্ময়ীর চোখে জল! অবাক, এ দৃশ্য তো কখনও দেখি নি! ও জল-ভরা ধরা-গলায় বললে–আপনি বলুন, যাবেন না মাস্টার মশায়। আমি তখন পাঠশালায় বলতে পারলাম না ওদের সামনে। ওরা হাসবে তাহলে। আর কেউ নয়–আর সবাই আমায় ভয় করে, কেবল ওই মন্টুটা বড় দুষ্টু!
তারপর আমার দিকে চোখের জল আর হাসি মিশানো এক অপূর্ব দৃষ্টিতে চেয়ে বললে–যাবেন না, কেমন?
হিরন্ময়ী এই প্রথম দুর্বলতা প্রকাশ করলে–এর আগে কখনও দেখি নি। ছেলেমানুষ, ও কথা তো তেমন জানে না, কিন্তু ওর ডাগর সজল চোখের মিনতিপূর্ণ দৃষ্টি ওর ভাষার দৈন্য ঘুচিয়ে দিয়ে এমন কিছু প্রকাশ করলে–এক জাহাজ কথাতে তা প্রকাশ করা যেত না।
আমার মনে অনুতাপ হল–কেন ওকে মিথ্যে কাঁদালাম সন্ধ্যাবেলাটিতে?
জীবনের এই-সব মুহূর্তেই না মানুষে ভগবানকে প্রত্যক্ষ করে? ব্রাউনিঙের ‘পলিন’ কবিতার সেই সর্বহারা লোকটির মত আমার মনও ভরে উঠল— I believe in God and Truth and Love!…
ওর হাতটি ধরে দরজার কপাটের ফাঁক থেকে বার করে এনে আস্তে আস্তে পিঁড়ির ওপর বসিয়ে দিয়ে বললাম–ওখানে সন্ধ্যাবেলা দাঁড়াতে নেই। বিছেটিছে বেরুতে পারে-এখানে বোস। রুটিগুলো বেলে দাও দিকি, লক্ষ্মী মেয়ে। আমি যাব না–বলছ তুমি যখন, তখন আর যাব না। চোখের জল ফেলতে আছে অবেলায়? ছিঃ–
তার পরই রুটি তৈরি করতে বসে যে হিরন্ময়ী সেই হিরন্ময়ী–সেই মুখরা বালিকা, যে সকল কথা এমন কর্তৃত্বের সুরে বলে যেন ওর কথা না মেনে চললে ও ভয়ঙ্কর একটা কিছু শাস্তির ব্যবস্থা করবে, সেটা আবার খুব কৌতুকপ্রদ এবং ভেবে দেখলে করুণ বলেই মনে হয়, যখন বুঝতে পারা যাচ্ছে যে মুখের বুলিটুকু ছাড়া ওর হুকুমের পেছনে ওর কোন জোর খাটাবার নেই–নিতান্ত অসহায় ও নিরুপায়।
প্রেম আসে এই সব সামান্য তুচ্ছ খুঁটিনাটি সূত্র ধরে। বড় বড় ঘটনাকে এড়ানো সহজ, কিন্তু এই সব ছোট জিনিস প্রাণে গেঁথে থাকে–ফলুই মাছের সরু চুল-চুল কাঁটার মত। গায়ের জোরে সে কাঁটা তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিতে গেলে, বিপদের সম্ভাবনা বাড়ে বৈ কমে না।
পুরুষমানুষ প্রেমের ব্যাপারে আত্মরক্ষা করে চলতে পারে না যেটা অনেক সময়ে মেয়েরা পারে। যেখানে যা হবার নয়, পাবার নয়, সেখানেও তারা বোকার মত ধরা দিয়ে বসে থাকে–এবং নাকাল তার জন্যে যথেষ্ট হয়। কিন্তু পুরুষমানুষই আবার বেগতিক বুঝলে যত সত্বর হাবুডুবু খেতে খেতেও সাঁতরে তীরের কাছে আসতে পারে–মেয়েরা গভীর জলে একবার গিয়ে পড়লে অত সহজে নিজেদের সামলে নিতে পারে না।
তবুও আমি হিরন্ময়ীকে দূরে রাখবার চেষ্টাই করলাম।
একদিন দুপুরের পরে হিরন্ময়ীদের বাড়িতে পুলিস এসেছে শুনলাম। পুলিশ কিসের? একে ওকে জিজ্ঞেস করি কেউ সঠিক উত্তর দেয় না অথচ মনে হ’ল ব্যাপারটা সবাই জানে। এগিয়ে গেলুম–ওদের বাড়ির সামনের তেঁতুলতলায় বড় দারোগা চেয়ার পেতে ব’সে–পাড়ার লোকদের সাক্ষ্য নেওয়া চলেছে। দেখলাম গ্রামে ওদের মিত্র বড় কেউ নেই। আমি আগেও যে একথা না জানতাম এমন নয়–তবে পাড়াগাঁয়ের কানাঘুষোতে কান দিই নি।
বিকেলের দিকে হিরন্ময়ীর মা আর বিধবা দিদিকে থানায় ধরে নিয়ে গেল। কাছারির মুহুরী সাতকড়ি মুখুয্যে আমার কাছেই দাঁড়িয়েছিল। সে বলতে–ও মেয়েটার তত দোষ দিই নে–মা-ই যত নষ্টের গুরুমশাই। ওই তো ওকে শিখিয়েছে। নইলে মেয়েটার সাধ্যি কি,–কিন্তু মাগী কি ডাকাত! মেয়েটার প্রাণের আশঙ্কা করলি নে একবারও?
ব্যাপারটা বুঝতে আমার দেরি হল না। সাতকড়ি আরও বলল–কালীনাথ গাঙ্গুলী কি গ্রাম ত্যাগ করেছে সাধে? এইজন্যেই সে বাড়িমুখো হয় না, ওদের সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখে না।
এত কথা আমি কিন্তু জানতাম না–এই নতুন শুনলাম। আমি মুশকিলে পড়ে গেলাম–আমি এখন কি করি? হিরন্ময়ীর মা আর দিদি দোষী কি দোষী নয়–সে বিচারের ভার আছে অন্য বিচারকের ওপর–সাতকড়ি মুখুয্যের ওপর নয়। কিন্তু এদের মোকদ্দমা উঠলে উকীল নিযুক্ত কে ক’রে, এদের স্বার্থ বা কে দেখে, এদের জন্যে পয়সা খরচই বা কে করে?
এদিকে আর এক মুশকিল। ওর মা আর দিদিকে যখন ধরে নিয়ে গেল, হিরন্ময়ী তখন ওদের বাড়ির সামনে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে। সামনে অন্ধকার রাত, সেরাত্রে সে একাই বা বাড়িতে থাকে কেমন করে, বাড়িতে আর যখন কেউই নেই–অথচ সন্ধ্যা পর্যন্ত কেউ তাকে নিজের বাড়িতে ডাকলে না। সন্ধ্যার সময় ও-পাড়ার কৈলাস মজুমদারের স্ত্রী এসে ওকে ও-অবস্থায় দেখে বললেন–ওমা, এ মেয়েটা এখানে একা দাঁড়িয়ে আছে যে! ছেলেমানুষ, বাড়িতে একা থাকবেই বা কি করে? ওর মা দিদি কি করেছে জানি নে– কিন্তু ওকে আমি চিনি। ও পাগলী, আনন্দময়ী। এস ত মা হিরণ, তোমাদের হারিকেনটা বাড়ির ভিতর থেকে নিয়ে ঘরে চাবি দিয়ে এস। ওকে জায়গা দিলে যদি জাত না থাকে–তবে না থাকল তেমন জাত!
মজুমদার-গিন্নী যদি কোন কথা না বলে নিঃশব্দে হিরন্ময়ীকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতেন তবে হয়ত কোনই গোলযোগ বাধতো না–কিন্তু শেষের কথাটি বলে ফেলে তিনি নিতান্ত নির্বোধের মত কাজ করে বসলেন। কাছেই গ্রামের সমাজপতি আচার্যি-মশায়ের বাড়ি। তাদের সঙ্গে বাধলো তুমুল ঝগড়া। শশধর আচার্যের স্ত্রী অনেকক্ষণ নিজের মনে একতরফা গেয়ে যাবার পর উপসংহারে বললেন–ও বড় ভাল মেয়ে–না? মুখ খুললেই অনেক কথা বেরিয়ে পড়বে। সব জানি, সব বুঝি। চুপ করে থাকি মুখ বুজে–বলি মাথার ওপর একজন আছেন, তিনিই দেখবেন সব–আমি কেন বলতে যাই?
মজুমদার-গিন্নী বললেন–যা কর ন-বৌ, আবার এ মেয়েটার নামে কেন যা তা বলছ? সেটাই কি ভগবান সইবেন?
আচার্যি-মশায়ের স্ত্রী বারুদের মত জ্বলে উঠলেন–আরও দ্বিগুণ চেঁচিয়ে বললেন–ধর্ম দেখিও না বলে দিচ্ছি, ভাল হবে না। ওই রয়েছে মুখুয্যেরা, ভটচায্যিরা, জিজ্ঞেস কর গিয়ে। ওই মেয়ে ওই পাঠশালার মাস্টার-ছোকরার কাছে রাত বারোটা অবধি কাটিয়ে আসে–রোজ তিনশ তিরিশ দিন। সারারাত্তিরও থাকে এক এক দিন। বলুক ও মেয়েই বলুক, সত্যি না মিথ্যে। ভেবেছিলুম কিছু বলব না–মরুক গে, যার আঁস্তাকুড়, সেই গিয়ে ঘাঁটুক, না বলে পারলাম না। কে ও মেয়েকে ঘরে জায়গা দিয়ে কালকে আবার একটা হাঙ্গামা বাধাতে যাবে?
আমি এতক্ষণ চুপ করে ছিলুম, কথা বলি নি–কোন পুরুষমানুষ উপস্থিত ছিল না বলে। চেঁচামেচি শুনে আচার্য-মশায়, সাতকড়ি ও সনাতন রায় ঘটনাস্থলে এসে দাঁড়াতেই আমি এগিয়ে গিয়ে বললুম–আপনারা আমার মায়ের মত–আপনাদের কাছে একটা অনুরোধ, হিরণকে এ ঝগড়ার মধ্যে মিথ্যে আনবেন না। ও আমার ছাত্রী, ছেলেমানুষ, আমার কাছে যায় সন্ধ্যেবেলা গল্প শুনতে–কোনোদিন পড়েও। রাত নটা বাজতেই চলে আসে। একটা নিষ্পাপ নিরপরাধ মেয়ের নাম এ-সবের সঙ্গে না জড়ানোই ভাল। মা আপনি ওকে বাড়িতে নিয়ে যান।
এতে ফল হ’ল উলটো। ঝগড়া না থেমে বরং বেড়ে উঠল। মজুমদার মশায়ের দুই ছেলে ও ছোট ভাই এসে মজুমদার-গিন্নীকে বকাবকি করতে লাগল–তিনি কেন ওপাড়া থেকে এসে এই-সব ছেঁড়া ল্যাটার মধ্যে নিজেকে জড়াতে যান? এ বয়সেও তাঁর জ্ঞান যদি না হয় তবে আর কবে হবে…তিনি চলে আসুন বাড়ি। এ-পাড়ার ব্যবস্থা এ-পাড়ার লোকে বুঝবে, তিনি কেন মাথাব্যথা করতে যান ইত্যাদি।
যাকে নিয়ে এত গোলমাল, সে ভয়ে ও লজ্জায় কাঠ হয়ে দাঁড়িয়েই আছে ওদের বাড়ির সদর দরজায়। ওর চোখে একটা দিশেহারা ভাব, লজ্জার চেয়ে চোখের চাউনিতে ভয়ের চিহ্নই বেশী। ওর সেই কথাটা মনে পড়ল–জানেন মাস্টার মশায়, আমায় সবাই ভয় করে, সবাই মানে এ পাড়ায়–আমার সঙ্গে লাগতে এলে দেখিয়ে দেব না মজা?
বেচারী মুখরা হিরন্ময়ী!
শেষ পর্যন্ত কৈলাস মজুমদারের স্ত্রী ওকে না নিয়েই চলে গেলেন। তাঁর দেওর ও ছেলেরা একরকম জোর করেই তাঁকে সরিয়ে নিয়ে গেল।
আমি তখন এগিয়ে গিয়ে বললুম–হিরণ, তুমি কিছু ভেবো না। আমি এতক্ষণ দেখছিলাম এরা কি করে। যে ভয়ে তোমাকে ডাকতে পারি নি, সে ভয় আমার কেটে গিয়েছে। তুমি একটু একলা থাক–আমি কাওরাপাড়া থেকে মোহিনী কাওরাণীকে ডেকে আনছি। সে তোমার ঘরের বারান্দাতে শোবে রাত্রে। তাহলে তোমার রাত্রে একা থাকবার সমস্যা মিটে গেল। আর এক কথা–তুমি রান্না চড়িয়ে দাও চাল-ডাল সব আছে তো?
কাওড়াপাড়া থেকে ফিরে আসতে আধ ঘণ্টার বেশী লাগল। মোহিনী বুড়ীকে চার আনা পয়সা দিয়ে রাত্রে হিরণদের বাড়িতে শোবার জন্য রাজী করিয়ে এলুম। ফিরে এসে দেখি দালানের চৌকাঠে বসে হিরন্ময়ী হাপুস নয়নে কাঁদছে। অনেক করে বোঝালুম। বড় কষ্ট হল ওকে এ অবস্থায় দেখে। বললে–মার আর দিদির কি হবে মাস্টার মশায়? আপনি কালই বাবাকে একটা চিঠি লিখে দিন। ওদের ফাঁসি হবে না তো?
হেসে সান্ত্বনা দিলাম। বললাম- রাঁধ হিরণ। খাওয়াদাওয়া কর। কিছু ভেবো না– আমি কাল রাণাঘাট যাব। ভাল উকীল দিয়ে জামিনে খালাস করে নিয়ে আসবার চেষ্টা করব, ভয় কি?
হিরণ কিছুতেই রাঁধতে চায় না–শেষে বললে–আপনিও এখানে খাবেন কিন্তু। ঠিক তো?
ও রাঁধছে ব’সে, আমাকে রান্নাঘরেই বসে থাকতে হল–ও যেতে দেয় না, ছেলেমানুষ, ভয় করে। কেবল জিজ্ঞেস করে, মা আর দিদির কি হবে!
রান্না হয়ে গেল, ঠাঁই করে আমায় ভাত বেড়ে দিল। এদিকে হিরণ বড় অগোছালো, কুটনো-বাটনা, এঁটো-কাঁটা, ভাতের ফেন, আনাজের খোসাতে রান্নাঘর এমন নোংরা করে তুলেছে! ভাত বাড়তে গিয়ে উনুনের পাড়ে আঁচল লুটিয়ে পড়েছে–নিতান্ত আনাড়ি।
বললাম–দিনমানে কোনরকমে একা থেকো। আমি সন্ধ্যের আগেই রাণাঘাট থেকে ফিরবো। রেঁধে খেও কিন্তু। না হলে বড় রাগ করব।
মোহিনী কাওরাণী এল রাত ন’টার পরে। তার পরে আমি আমার বাসায় চলে এলুম। পরদিন রাণাঘাটে গিয়ে দেখি কেস ওঠে নি আদালতে। উকীল ঠিক করে তার সঙ্গে জামিনের কথাবার্তা বলে এলুম। ফিরবার সময় হিরন্ময়ীর জন্যে দু-একটা জিনিস কিনে নিলুম ওকে একটু আনন্দ দেবার জন্যে। ফিরে দেখি ও ব’সে ব’সে আবার কাঁদছে কালকের মত। সারাদিন বোধ হয় রাঁধে নি, কিছু খায় নি। স্নানও করে নি, দু-এক গাছা রুক্ষ চুল মুখের আশেপাশে উড়ছে। মহা বিপদে পড়ে গেলুম ওকে নিয়ে। কি করি এখন? ওর বাবাকে আজ রাণাঘাটে পৌঁছেই টেলিগ্রাম করেছি, যদি তা পেয়ে থাকেন, তবে কাল তিনি এসে পৌঁছলেও তো বাঁচি। নইলে হিরন্ময়ীকে ভাবছি কালীগঞ্জে বৌদিদির কাছে রেখে আসব। কারণ, এসে শুনলুম মোহিনী বুড়ী ব’লে গিয়েছে সে রাত্রে এখানে আর শুতে আসতে পারবে না।
ও আমায় দেখেই ছুটে এসে বললে–মাকে দিদিকে দেখে এলেন মাস্টারমশাই? তারা কেমন আছে? খালাস পেলে না?
আমি ওদের নিজে দেখতে যাই নি, উকীলের মুখে হিরন্ময়ীর সংবাদ পাঠিয়ে বলেছিলুম হিরন্ময়ীর জন্যে যেন তারা কিছু না ভাবে। বললাম সেকথা।
তার পর হিরন্ময়ী আমাকে বালতি ক’রে জল তুলে দিলে স্নানের জন্যে–ঘরে প্রদীপ জ্বেলে উনুন ধরিয়ে চায়ের জল চড়ালে। রাণাঘাট থেকে ওর জন্যে কিছু খাবার এনেছিলুম, তার বেশী অর্ধেক আমায় রেকাবিতে ক’রে চায়ের সঙ্গে জোর করে খাওয়ালে–তার পর রান্না চাপিয়ে দিলে। ওর মনে সুখ নেই, কেমন যেন মুষড়ে পড়েছে, ছেলেমানুষ, নইলে ওর মত হাস্যময়ী আনন্দময়ী চঞ্চলা মেয়ে এতক্ষণ কত কথা বলত, হাসি-খুশীতে ঘর ভরিয়ে তুলত।
একবার জিজ্ঞেস করলে–রাণাঘাটে নাকি সার্কাস এসেছে সবাই বলে? দেখেছেন আপনি? এত দুঃখের মধ্যেও ওর ছেলেমানুষি মন সার্কাসের সম্বন্ধে কৌতূহলী না হয়ে পারে নি ভেবে আমার হাসি পেল।
এ রাত্রে মোহিনী বুড়ী এল না–আমি ওকে ঘরের মধ্যে রেখে বাইরের বারান্দাতে শুয়ে রইলাম। বারান্দায় বিছানা পাতছি, ও আবার এত সরলা, নিষ্কলুষ–আমায় অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলে, আপনি বাইরে শোবেন কেন?
কোন নীতিবাদের সঙ্কোচ এনে ফেলে ওর নিষ্পাপ মনে দাগ দিতে আমার বাধল। বললাম–দেখছ না কি রকম গরম আজ? বাইরে শোওয়াই আমার অভ্যেস, তা ছাড়া–
সারারাত দু-জনে গল্প করে কাটালুম। ও ঘর থেকে কথা বলে, আমি বারান্দা থেকে তার উত্তর দিই।–বাবা বোধ হয় কাল আসবেন, না? মা, দিদি কবে আসবে? সার্কাসওয়ালা কোথায় তাঁবু ফেলেছে? কলকাতায় কখনও যাই নি–একবার যাবার ইচ্ছে আচ্ছে। কলকাতার থিয়েটার দেখতে কেমন? চৌধুরীরা বোধ হয় মোহিনী বুড়ীকে বারণ করে দিয়েছে এখানে আসতে। আমার শীত করছে কিনা। রাত বেশী, ঠাণ্ডা পড়েছে, গায়ে দেবার একটা মোটা চাদর দেবো? আরব্য-উপন্যাসের মত গল্প আর নেই। আচ্ছা, অঙ্ক কতদূর শেখা যায়? বিদ্যার শেষ নেই–না? এম-এ পাস করে আরও পড়া যায়, পড়বার আছে?
ওর বাবা এলেন পরদিন সকাল দশটার সময়। তাঁর মুখে শুনলুম পুলিস থেকে তাঁকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে শীঘ্র বাড়ি এসে মেয়ের ভার নিতে। তিনি অত্যন্ত বদমেজাজী লোক, দু-একটা কথা শুনেই বুঝতে দেরি হ’ল না। আমার ওপর আদৌ তিনি প্রসন্ন হতে পারলেন না–তাঁর মেয়ের তত্বাবধান করার জন্যে একটা ধন্যবাদ দেওয়া তো দূরের কথা, সেটাকেই তিনি আমার একটা অপরাধ বলে গণ্য করে নিলেন এবং যে মুখুয্যে ও চৌধুরীরা পরশু সন্ধ্যেবেলা হিরন্ময়ীকে বাড়িতে জায়গা দিতে চায় নি, তাদেরই বাড়িতে খোশামোদ করে তাদের সঙ্গে এ বিপদে পরামর্শ চাইতে গেলেন।
আরও একটা ব্যাপার দেখলুম, তিনি হিরন্ময়ীকে আদৌ দেখতে পারে না। আমার সামনেই তো তাকে তাড়না, তর্জন-গর্জন যথেষ্ট করলেন এ নিয়ে যে সে রাত্রে চৌধুরী গিন্নীর পায়ে পড়ে কেন অনুরোধ করে নি তাকে জায়গা দেবার জন্যে। কারণ, তারা দেখলুম লাগিয়েছে যে তাদের কি আর ইচ্ছে ছিল না ওকে জায়গা দেবার? ও মেয়ের তা ইচ্ছে নয়। হিরণের অপরাধ সে মুখ ফুটে কারও কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে নি। এ ওরা কেউ বুঝল না যে হিরণের বয়সের মেয়েরা মুখে কোন নাটুকে-ধরনের কথা বলে আশ্রয় চাইতে পারে না পরের কাছে–বিশেষ করে হিরন্ময়ীর মত একটু তেজী মেয়েরা।
আমি হিরন্ময়ীর ভার থেকে মুক্ত হয়ে কালীগঞ্জে চলে এলুম পরদিনই সকালেই। শুনেচিলুম হিরন্ময়ীর মা ও দিদি রাণাঘাট থেকে প্রমাণাভাবে খালাস পেয়ে এসেছেন।
কালীগঞ্জে এসে বসলুম বটে, কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলুম, মনের কি অদ্ভুত পরিবর্তন হয়েছে। হিরণ্ময়ীর সেই শুকনো মুখখানা কেবলই মনে পড়ে, সেদিন সন্ধ্যার সময় ওর যে মুখ দেখেছিলাম, যেদিন ওর মাকে আর দিদিকে থানায় নিয়ে গেল। হিরণ্ময়ীর ব্যথা,…হিরণ্ময়ীর দুঃখ,…ওই রকম বাড়িতে, ওই গাঁয়ের আবহাওয়ায় হিরন্ময়ীর মত মেয়ে শুকিয়ে ঝরে পড়বে। কে-ই বা দেখবে, বুঝবে ওকে? একদিন মালতীর সম্বন্ধেও ঠিক এই কথাই ভাবতুম। কত ভেবেছি। এখন বুঝি কি দুর্জয় অভিমান করেই চলে এসেছিলাম ওর কাছ থেকে কিছুতেই সে অভিমান ভাঙলো না। তার পর দাদা মারা গেলেন, দাদার সংসার পড়ল ঘাড়ে, নইলে হয়ত আবার এতদিনে ফিরে যেতাম। কিন্তু বৌদিদিদের নিয়ে তো দ্বারবাসিনীর আখড়াতে গিয়ে উঠতে পারি নে? একসময় যার ভাবনায় কত বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছিলে বটেশ্বরনাথ পাহাড়ে, সেই মালতী এখন আমার মনে ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে আসছে–হয়ে এসেছে। আর তো তাকে চোখে দেখলুম না? ক্রমে তাই দূরে গিয়ে পড়ল। কি করব, মনের ওপর জোর নেই–নইলে আমি কি বুঝতে পারি নে কত বড় ট্র্যাজেডি এটা মানুষের জীবনের? শ্রীরামপুরের ছোট-বৌঠাকরুণ আজ কোথায়? কে বলবে কেন এমন হয়!
.
১৭.
একদিন আবার হিরন্ময়ীকে দেখবার ইচ্ছে হ’ল। তখন মাস দুই কেটে গিয়েছে, কামালপুরে আর যাই নি, সেখানে আমার বাসায় জিনিসপত্র এখনও রয়েছে–সেগুলো আনবার ছুতো করেই গেলুম সেখানে। মাস দুই পরে, গ্রাম ঠাণ্ডা হয়েছে, কেবল শুনলুম হিরণ্ময়ীরা একঘরে হয়ে আছে। হিরণ্ময়ী আগের মতই ছুটে এল আমি এসেছি শুনে। এখানে ওর চরিত্রের একটা দিক আমার চোখে পড়ল–লোকে কি বলবে এ ভয় ও করে না–এখানে মালতীর সঙ্গে ওর মিল আছে। কিন্তু মালতীর সঙ্গে ওর তফাৎও আমি বুঝতে পারি। হিরণ্ময়ী যেখানে যাবে, সেখানে পেছন ফিরে আর চায় না–মালতীর নানা পিছুটান। সবাই সমান ভালোবাসতেও পারে না। প্রেমের ক্ষেত্রেও প্রতিভার প্রয়োজন আছে। খুব বড় শিল্পী, কি খুব বড় গায়ক যেমন পথেঘাটে মেলে না–খুব বড় প্রেমিক বা প্রেমিকাও তেমনি পথেঘাটে মেলে না। ও প্রতিভা যে যে-কোনো বড় সৃজনী-প্রতিভার মতই দুর্লভ। এ কথা সবাই জানে না, তাই যার কাছে যা পাবার নয়, তার কাছে তাই আশা করতে গিয়ে পদে পদে ঘা খায় আর ভাবে অন্য সবারই ভাগ্যে ঠিকমত জুটছে, সে ই কেবল বঞ্চিত হয়ে রইল জীবনে। নয়ত ভাবে তার রূপগুণ কম, তাই তেমন ক’রে বাঁধতে পারে নি।
হিরন্ময়ীর তনুলতায় প্রথম যৌবনের মঞ্জরী দেখা দিয়েছে। হঠাৎ যেন বেড়ে উঠেছে এই দু মাসের মধ্যে। আমায় বললে–কখন এলেন? আসুন আমাদের বাড়িতে। মা বলে দিলেন আপনাকে ডেকে নিয়ে যেতে। কতদিনের ছুটি দিয়েছিলেন পাঠশালাতে, দেড় মাস পরে খুললো?
–ভাল আছ হিরণ? উঃ, মাথায় কত বেড়ে গিয়েছ?
—এতদিন কোথায় ছিলেন? বেশ তো লোক। সেই গেলেন আর আসবার নামটি নেই?
হয়ত দু-বছর আগেও এ কথা কেউ বললে বেদনাতুর হয়ে ভাবতাম, আহা, দ্বারবাসিনীতে ফিরলে মালতীও আমায় এ-রকম বলত। কিন্তু সময়ের বিচিত্র লীলা। এ সম্পর্কে মালতীর কথা আমার মনেই এল না।
দু-দিন কামালপুরে রইলাম। হিরন্ময়ী এ কথা ভাবে নি যে, আমি আমার জিনিসপত্র আনতে গিয়েছি ওখানে, সে ভেবেছিল আমি আবার পাঠশালা খুলব। ওখানেই থাকব। এবার কিন্তু সে আসবার সময় তর্ক, ঝগড়া করলে না, যেমন করে থাকে। শুধু শুকনো মুখে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল আমার যাওয়া। ওর সে আগেকার ছেলেমানুষি যেন চলে গিয়ে একটু অন্য রকম হয়েছে। তবুও কত অনুরোধ করলে ওখানে থাকবার জন্যে–গাঁ এখন ভাল হয়ে গিয়েছে, কেন আমি যাচ্ছি, গাঁয়ের ছেলেরা তবে পড়বে কোথায়?
কামালপুর গাঁ পিছু ফেলেছি, মাঠের রাস্তা, গরুর গাড়ির আস্তে আস্তে চলেছে। কি মন খারাপ যে হয়ে গেল! মাঠের মধ্যে কচি মটর-শাক, খেসারি-শাকের শ্যামল সৌন্দর্য, শিরীষগাছের কাঁচা শুঁটি ঝুলছে, বাসুদেবপুরের মরগাঙের ভাগাড়ে নতুন ঘাসের ওপর গরুর দল চরে বেড়াচ্ছে। হিরণ্ময়ীর নিরাশার দৃষ্টি বুকে যেন কোথায় বিঁধে রয়েছে, খচ খচ করে বাজছে। বেলা যায়-যায়, চাকদার বাজার থেকে গুড়ের গাড়ির সারি ফিরছে, বোধ হয় বেলে কি চুয়াডাঙ্গার বাজারে রাত কাটাবে। জীবনটা কি যেন হয়ে গেল, এক ভাবি আর হয় আরেক, কোথায় চলেছি আমিই জানি না। কেনই বা অপরের মনে এত কষ্ট দিই? এই রাঙা রোদমাখানো মটর-মুসুরির মাঠ যেন বটেশ্বরনাথের দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। এই সন্ধ্যায় গঙ্গার বুকে বড় বড় পাল তুলে নৌকোর সারি মুঙ্গেরের দিকে যেত, আমি মালতীর স্বপ্নে বিভোর হয়ে পাষাণ-বাঁধানো ঘাটের ওপর বসে বসে অন্যমনস্ক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতুম। সব মিথ্যে, সব স্বপ্ন। ঐ মরাগাঙের ওপারে জমা সন্ধ্যার কুয়াশার মত–ফাঁকা, দু-দিনের জিনিস। এখানে ফল পাকে না। জেরুসালেম পাথরের দেশ।
এর কিছুদিন পরে হিরন্ময়ীর বাবা আমার কাছে এলেন কালীগঞ্জে। আমায় একবার তাঁদের ওখানে যেতে হবে, হিরন্ময়ী বিশেষ করে বলে দিয়েছে। আর একটা কথা, মেয়ের বিয়ে নিয়ে তিনি বড় বিপদে পড়েছেন। তিনি গরীব, অবস্থা আমি সবই জানি, গ্রামের সমাজে একঘরেও বটে। দু-তিন জায়গা থেকে সম্বন্ধ এসেছিল, নানা কানাঘুষো শুনে তারা পেছিয়ে গিয়েছে। মেয়েও বেজায় একগুঁয়ে, তাকে দেখতে আসছে শুনলেই সে বাড়ি থেকে পালায়। অত বড় মেয়ে, এখনও জ্ঞান-কাণ্ড হল না, চিরকাল কি ছেলেমানুষি করলে মানায়? সুতরাং তিনি বড় বিপদে পড়েছেন, আমি যদি ব্রাহ্মণের এ দায় উদ্ধার না করি তবে তিনি কালীকান্ত গাঙ্গুলী, সম্পূর্ণ নিরুপায়। আমার কি মত?
আমি আর কিছুই ভাবলাম না, ভাবলাম কেবল হিরন্ময়ীর আশাভাঙা চোখের চাউনি আর তার শুকনো মুখ, সেদিন যখন জিনিসপত্র বাঁধছি সেই সময়কারের।
একদিন হিরন্ময়ী বললে–একটা কথা শোন। যেদিন তুমি প্রথম পাঠশালাতে পড়াতে এলে, আমি তোমার কাছে গেলাম, সেদিন থেকে তোমায় দেখে আমার কেমন লজ্জা করত। সেই জন্যে কাছে বসতে চাইতাম না। তার পর তুমি একদিন রাগ করলে, তাতে আমারও খুব রাগ হল। তুমি তার পর বললে–আমাদের গাঁ ছেড়ে চলে যাবে। সেদিন ভয়ে আমার প্রাণ উড়ে গেল। এত কান্না আসতে লাগল, কান্না চাপতে পারি নে, পাছে কেউ টের পায়, ছুটে পেছনের সজনেতলায় চলে এলাম। সব যেন ফাঁকা হয়ে গেল মনের মধ্যে। উঃ মাগো, সে যে কি দিন গিয়েছে।
হিরন্ময়ী গুছিয়ে কথা বলতে শেখে নি এখনও।
ভগবান জানেন বিয়ের সময় কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলুম। সপ্তসমুদ্র পারের কোন দেশে অনেক দূরে এই সব সন্ধ্যার অস্পষ্ট অন্ধকারে একটি হাস্যমুখী তন্বী কিশোরী প্রদীপ হাতে ভাঙা বিষ্ণুমন্দিরে সন্ধ্যা দেখাতে যেত কত যুগ আগে…পুকুরপাড়ের তমালবনের আড়ালে তার সঙ্গে সেই যে সব কত সুখ-দুঃখের কাহিনী, কত ঠাকুর দেবতার কথা, সে সব সত্যি ঘটেছিল, না স্বপ্ন? কোথায় গেল সে মেয়েটি? আর তাকে তেমন ক’রে তো চাই না? যেন কত দূর-জন্মে তার সঙ্গে সে পরিচয়ের দিনগুলো কালের কুয়াশায় অস্পষ্ট হয়ে এসেছে–তাকে যেন চিনি, চিনি, চিনি না। কেন তার স্মৃতিতে মন আর নেচে ওঠে না? কোথায় গেল সে-সব দিন, সে-সব প্রদীপ-দেখানো সন্ধ্যা?
বছরখানেক পরে একদিন রাণাঘাট স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছি। মুর্শিদাবাদের ট্রেন থেকে অনেকগুলো বৈষ্ণব নামলো। তারা যাবে খুলনার গাড়িতে। তাদের মধ্যে একজনকে পরিচিত বলে মনে হল। কাছে গিয়ে দেখি দ্বারবাসিনীর আখড়ার সেই নরহরি বৈরাগী–যে একবার জীবগোস্বামীর পদাবলী গেয়েছিল। সে পয়লা নম্বরের ভবঘুরে, মাঝে মাঝে আখড়ায় আসত, আবার কোথায় চলে যেত। নরহরিও আমায় চিনলে, প্রণাম করে বললে–এখানে কোথায় বাবু? এটা কি দেশ নাকি? আপনি তো অনেক দিন দ্বারবাসিনী যান নি? আর যাবেনই বা কি, সব শুনেছেন বোধ হয়, আখড়া আর সে আখড়া নেই। দিদিঠাকরুণ মারা যাওয়ার পরে—
–কে?
–কেন আপনি জানেন না? মালতী দিদিঠাকরুণ তো আজ বছর চারেক মারা গিয়েছেন।
আমি ওর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলুম। নরহরি আপন মনেই বলে যেতে লাগল– এখন উদ্ধবদাসের এক ভাইপো তার সেবাদাসী নিয়ে কোথা থেকে এসে জুটেছে। সে-ই এখন কর্তা। উদ্ধবদাস তো বুড়ো হয়েছে, সে কিছু দেখে-শোনে না। এখন অতিথি বোষ্টম গেলে আর জায়গা হয় না। মালতী দিদিঠাকরুণ তো মানুষ ছিলেন না, স্বর্গের দেবী ছিলেন, কি বাপের মেয়ে! তিনি স্বর্গে চলে গিয়েছেন, এখন তাঁর অত সাধের আখড়ার কি দশা হয়েছে এই চার বছরে, দেখে চোখে জল আসে বাবু। তাই বড়-একটা সেখানে যাই নে।
ওরা চলে গেলে আমি স্টেশনের বাইরে সেগুন বাগানে গিয়ে কতক্ষণ বসে রইলাম। কতক্ষণ…কতক্ষণ। হিসেব করে দেখলাম আমি যখন বটেশ্বরনাথ পাহাড়ে তখনই সে মারা গিয়েছে। অর্থাৎ আমি আখড়া ছেড়ে আসবার এক বছর পরেই।
আজ হঠাৎ মনে হল তার ওপর কি সুবিচার করেছিলুম? অভিমান ভাঙবার সুযোগও তাকে আর একবার দিই নি। আমার জীবনে সে মরে গিয়েছে অনেক দিন, যদিও খবরটা আজ পেলাম! আমার মন অলক্ষিতে আত্মরক্ষা করেছে, বেদনার স্থানে শক্ত আবরণ গড়ে তুলেছে–শামুক যেমন আত্মরক্ষার জন্যে খোলা তৈরি করে। আজ সে খোলা হয়ে পড়েছে। শক্ত অনুভূতিহীন–অন্তত এতদিন তাই ভাবতাম। কিন্তু খোলার আবরণের তলায় ব্যথার জায়গাটা আজ মনে হচ্ছে একেবারে সম্পূর্ণরূপে সারে নি।
কে আজ উত্তর দেবে–আমি চলে এলে গোপনে একটুখানি চোখের জলও কি ফেলে নি সে কোনদিন? বিষ্ণুমন্দিরে প্রদীপ দিতে গিয়ে কখনো একদিনও কি অন্যমনস্ক হয় নি? দিনের কাজ মিটে গেলে সে যখন ‘পাষণ্ড-দলনের অনুকরণে’ বই লেখবার উদ্দেশ্য নিয়ে তার সেই খাতাখানা খুলে বসত, একদিনও কি আমার কথা মনে পড়েনি…কত ঠাট্টা যে করতুম তার সেই বই লেখা নিয়ে! আমার যদি আজ দশ হাজার টাকা থাকত, আমি চাইলেই সব টাকাই দিয়ে দিতে পারতাম, যদি এই খবরগুলো আমায় কেউ দিতে পারতো। টাকার মায়া করতুম না–করি নি কোনদিন। এই খবরের বদলে আমি কি না দিতে পারি!
পাগলের মত কি ভাবছি যা তা বসে! লাভ কি আজ এ-সব ভাবনার? ভালই হয়েছে মালতী, তোমার সঙ্গে আর আমার দেখা হয় নি। সুন্দর জ্যোৎস্নারাতে পল্লীপ্রান্তের বনে মরচে-লতায় ফুল ফোটে, সুবাসে পথচারীদের মন আনন্দে ভরিয়ে তোলে কিন্তু কতদিন তার আয়ু? জ্যোৎস্না লুকিয়ে আঁধার পক্ষ নামে, বনফুল ঝরে যায়, পুষ্পসুরভি হিমের রাত্রির ঘন কুয়াশায় চাপা পড়ে, নয়ত অকাল বর্ষার বারিধারায় ধুয়ে মুছে যায়। মানুষের অনেক সেবা তুমি করেছিলে, মানুষের মনে তোমার রূপ ভগবান ম্লান হ’তে দিলে না। ফুলের সুবাস চলে গেলে বনলতা পাছে অনাদৃতা হয়! তোমার বেলা ভগবান তা সহ্য করবেন না।
সেগুনবাগান থেকে উঠে এলুম, তখন রাত হয়ে গিয়েছে।
একটা কথা হঠাৎ মনে পড়ল। একবার মালতীকে বলেছিলুম–আমাদের গাঁয়ে একটা হাতভাঙা বিষ্ণুমূর্তি আছে। ছেলেবেলায় তাঁকে বড় ভালবাসতুম। ভগবান যদি দিন দেন, তাঁকে নিয়ে এসে তোমার বাবার মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করব।
দেখতে দেখতে কত দিন হয়ে গেল।
তার পর সাত-আট বছর কেটে গিয়েছে …
আমার সে অল্প বয়সের ভবঘুরে জীবনের পূর্ণচ্ছেদ পড়েছে অনেকদিন। তবু সে-সব দিনের ছন্নছাড়া মুহূর্তগুলোর জন্যে এখনও মাঝে মাঝে মন কেমন করে ওঠে, যদিও এখন বুঝেছি হারানো-বসন্তের জন্যে আক্ষেপ করে কোন লাভ নেই। মহাকালের বীথিপথ অনাগত দিনের শত বসন্তের পাখির কাকলিতে মুখর, যা পেলুম তাই সত্য, আবার পাব, আবার ফুরিয়ে যাবে..তার চলমান রূপের মধ্যেই তার সার্থকতা।
মালতীও চলে গিয়েছে কত দিন হ’ল, পৃথিবী ছেড়ে কোন প্রেমের লোকে, নক্ষত্রদের দেশে, নক্ষত্রদের মতই বয়সহীন হয়ে গিয়েছে।
কেবল মাঝে মাঝে গভীর ঘুমের মধ্যে তার সঙ্গে দেখা হয়। সে যেন মাথার শিয়রে বসে থাকে। ঘুমের মধ্যেই শুনি, সে গাইছে—
মুক্ত আমার প্রাণের মাঠে
ধেনু চরায় রাখাল কিশোর
প্রিয়জনে লয় সে হরি
ননী খায় সে ননীচোর।
সেই আমার প্রিয় গানটা…যা ওর মুখে শুনতে ভালবাসতুম।
চোখাচোখি হ’লেই হাসি হাসি মুখে পুরনো দিনের মত তার সেই ছেলেমানুষি ভঙ্গিতে ঘাড় দুলিয়ে বলছে–পালিয়ে এসে যে বড় লুকিয়ে আছো? আখড়ার কত কাজ বাকী আছে মনে নেই?
তখন আমার মনে হয় ওকে আমি খুব কাছে পেয়েছি। দ্বারবাসিনীর পুকুরপাড়ের কাঞ্চনফুল-তলার দিনগুলোতে তাকে যেমনটি পেতুম, তার চেয়েও কাছে। গভীর সুষুপ্তির মধ্যেই তন্দ্রাঘোরে বলি–সব মনে আছে, ভুলিনি মালতী। তোমার ব্যথা দিয়ে, ব্যর্থতা দিয়ে তুমি আমাকে জয় করেছ। সে কি ভোলবার?
অসাধারণ
বিভূতিভূষণবাবুর একটি লেখাও আমি বাদ দিইনি। আমার পড়া সবচেয়ে দারুণ উপন্যাস দৃষ্টিপ্রদীপ। আল্লাহর কাছে দোয়া করি তার আত্মাকে শান্তিতে রাখুন।