৪
শ্যামলাল ওঁদের পেছনে পেছনে চললো। স্টেশন থেকে বেরিয়েই সামনে বাজার, খোলার চালার নিচে চায়ের দোকান, ঘেঁষাঘেঁষি বসতি, নোংরা রাস্তা, হনুমানজীর মন্দির, শ্যামলাল অবাক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলো। বাজার ছাড়িয়ে একটা ফাঁকা জায়গা, বড় একটা গাছের ছায়ায় একটা বাংলো ঘর, সামনে হিন্দীতে একটা কাঠের তক্তার গায়ে লেখা আছে, রেঞ্জ অফিস, করমপদা রেঞ্জ ধুরুয়াডিহি। এই বাংলো ঘরের পেছনেই একটা গির্জাঘর এবং আর একটা ভালো সাহেবী ধরনের ছোট বাড়ি। শ্যামলালের মনে হল গির্জার পাদ্রি সাহেবের থাকবার বাসা। গির্জার পরেই একটা বড় দোতলা বাড়ি, তার সামনে ফুলবাগান, ছোট্ট একটা পুকুর। পেছনে অনেকখানি জায়গা উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, অনেক ফলের গাছ তার মধ্যে। এমন জায়গায় ও ধরণের একখানা শৌখিন বাগানবাড়ি কাদের? প্রশ্নটা শ্যামলালের মনে উঠলেও সাহস করে জিগ্যেস করতে পারলে না মামাবাবুকে।
এইবার বাঁক ঘুরেই পথের পাশে বড় একটা খোলার বাড়ি পড়লো, নিচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। শরৎকালী বাবু বললেন—এই গরীবের কুঁড়েঘর ভায়া। এসো এসো। ও পিন্টু, পিণ্টু—
একটি গিন্নীবান্নি ধরনের মহিলা রামলালের সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বললেন—কি, এত কাল পরে মনে পড়লো? ঠাকুরঝি ভাল আছে? এ কে? খোকন বুঝি? এসো এসো বাবা, বেঁচে থাকো, দীর্ঘজীবী হও—চলো বাড়ির মধ্যে। বড্ড গরম। আগে নেয়ে-ধুয়ে ঠাণ্ডা হয়ে নাও, এসো ঠাকুরজামাই।
অবস্থা যে বেশ সচ্ছল এদের, শ্যামলালের বুঝতে দেরি হল না, ঘরের আসবাবপত্র দেখে। খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা খুবই ভালো। দেশের বাড়িতে এ ধরনের খাবার কালেভদ্রেও জোটে না। রামলাল বললে—দাদা, এ ঘি আমাদের দেশে চক্ষেও দেখবার জো নেই! বড় চমৎকার ঘি—
শরৎকালীবাবু বললেন—এখানকার ঘি নয় ভায়া। আমার এক রুগীকে দিয়ে দেহাত থেকে আনিয়েচি—একেবারে খাঁটি—চার টাকা সের।
—এ সব বাংলাদেশে চক্ষে দেখবার উপায় নেই আজকাল দাদা—
—বাড়িতে গরুও আছে আমার। সের-তিনেক দুধ হয়। একটু করে গাওয়া ঘি করেন তোমার বৌদিদি—আসল কথা, এদেশে আছি একরকম মন্দ নয়।
—বাংলা দেশের জন্যে মন-কেমন করে না?
—করে বইকি ভায়া। কিন্তু ছেলেমেয়েদের এদেশেই জন্ম, ম্যালেরিয়ার দেশে গেলে ওদের শরীর একদিনও টিকবে না। সেই জন্যেই যাওয়া হয় না। বিষয়-সম্পত্তি যা আছে, খুড়তুতো ভাই শচীন আর যামিনী খাচ্চে। খাক গে। এতকাল পরে যামিনী জমি বিক্রির দরুণ দেড়শোটি টাকা দয়া করে পাঠিয়েছিল। সে তার দয়া, না পাঠালেই বা কি করচি? পাকিস্তান থেকে নাকি বহু লোক এসে পড়েচে গ্রামে, তাদের কাছে জমি বিক্রি করেচে।
—এখানে আসেনি পাকিস্তানের লোক?
—না। এতদূরে এ জঙ্গলের দেশের সন্ধান পায়নি। কিন্তু এলে ভালো করতো। এখানে মাথা খাটালে পয়সা রোজগার হয়। বাংলাদেশ থেকে আজকাল বেরিয়ে পড়া দরকার, দেশে মাটি আঁকড়ে থাকলে আর অন্ন হবে না। বহুৎ লোক বেড়ে গিয়েচে।…একে বলে বোম্বাইয়ের কলা, রং দেখতে খারাপ কিন্তু খেয়ে দ্যাখো। বাড়িতে ছ’সাত ঝাড় লাগিয়েচি পেছনদিকে। এ মাটিতে খুব ভালো ফলে—
খাওয়া-দাওয়া শেষ হল। রোদ বড্ড চড়েচে। বাংলাদেশের চেয়ে অনেক গরম। ওদের ট্রেনে ভাল ঘুম হয়নি। দুপুরে লম্বা ঘুম দিয়ে বিকেলের দিকে বাইরের বারান্দায় বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে দেশের খুঁটিনাটি গল্প করতে লাগলো রামলাল। শরৎকালীবাবুই নানারকম প্রশ্ন করতে লাগলেন ওকে, দেশের সংবাদ বড্ড ভালো লাগছিল বাংলা দেশ থেকে সদ্য আগন্তুক একজন লোকের মুখে। কতদিনের তৃষ্ণা, এমন টাটকা জল আকণ্ঠ পুরে পান করেও আশা মেটে না। বলো বলো, শুনি! মহাভারতের কথা অমৃত সমান!
রামলাল বললে—যতই যা বলি, আজ এয়েচি আজই মন-কেমন করচে দেশের জন্যি।
শ্যামলাল বললে—আমারও।
শরৎকালীবাবু হেসে উঠে বললেন—সব সেরে যাবে ভায়া, পয়সার মুখ দেখবে যেদিন থেকে, সেদিন থেকে সব সেরে যাবে। আমার হত না ভাবচো? ভেবে দেখলাম আমার মত সেকেলে কোয়ালিফিকেশন নিয়ে দেশে ফিরে খাবো কি? না খেয়েই মরে যেতে হত। কাজেই রয়ে গেলাম।
—আপনি আমার সম্বন্ধে কিছু ভেবেছেন?
—কিছু ভাবচি বইকি। নইলে কি আর আসতে লিখি?
—কি বলুন না? একটু শুনে মনটা ঠাণ্ডা করি। এই বাজার, তার ওপর চাকরিটা গেল। সংসার চালাই কি করে সেই হল ভাবনা! বিদেশে কি আর ইচ্ছে করে কেউ আসে দাদা!
—এসেচ খুব ভাল করেচ। ঘরবোলা হয়ে না থেকে তুমি যে এ বয়সে বেরিয়ে পড়েচ এটাই মস্ত কথা। শ্যামলালকেও বলি, তোমার বয়েস কম, এই খাটবার বয়েস—লেগে যাও কাজে।
—কাজটা কি দাদা?
—সে আমি জানিনে। তোমরা দেখে নাও। আমি সাহায্য করবো পেছন থেকে। এখানে হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারি চলে, কাঠের ব্যবসা চলে, কোনো কাঠের আড়তে কেরানীগিরি করা চলে।
রামলাল যেন একটু দমে গেল। শ্যালকের কাছে এসেচে সে অনেকখানি আশা নিয়ে। এ ধরনের কথাবার্তা তার ভালো লাগলো না।
শ্যামলাল বললে—মামাবাবু ঠিকই বলেচেন বাবা। আমাদের জিনিস আমাদের নিজেদের ঠিক করে নিতে হবে বইকি। আচ্ছা মামাবাবু, একটা বাগানবাড়ি ওখানে কাদের?
—ও হল কলকাতার জগৎ চৌধুরী বলে এক বড়লোকের।
—কেউ থাকে এখানে ওঁদের?
—থাকে।
হঠাৎ যেন এ প্রসঙ্গকে চাপা দেবার জন্যেই শরৎকালীবাবু বললেন—তা হলে এইবার একটু বেড়াতে যাওয়া যাক, কি বলো?
রামলাল বললে—যা বলেচেন, চলুন।
শরৎকালীবাবু ওদের নিয়ে কিন্তু বেশিদূর গেলেন না। স্টেশনের উল্টোদিকের উঁচু টিলা মতো জায়গায় গিয়ে খানিকটা বসলেন। শ্যামলাল মুগ্ধ দৃষ্টিতে পশ্চিম দিগন্তের নীল পর্বতমালার দিকে চেয়ে বললে—ওটা কি পাহাড়? ওতে বাঘ আছে? ভালুক আছে?
শরৎকালীবাবু হেসে বললেন—নাঃ, বাবাজী এখনো দেখচি নিতান্ত ছেলেমানুষ! কথাবার্তাও ছেলেমানুষি! এখানকার সব পাহাড়ে বুনো হাতী, বাঘ, ভালুক আছে, হরিণ আছে, বাইসন আছে।
রামলাল বললে—বাইসন কি?
—একরকমের বুনো মোষ। তা ছাড়া বড় বড় সাপ আছে।
—কি সাপ?
—পাহাড়ী ময়াল সাপ যাকে বলে। বিষাক্ত সাপ-আছে।
—এদেশে থাকতি ভয় করে না দাদা?
—সাহস না করলে লক্ষ্মীলাভ হয়? এক-একজন মাড়োয়ারি—
শ্যামলাল এসব কিছু শুনছিল না। সে একদৃষ্টে চেয়ে ছিল দূর পূর্বদিগন্তে। এখান থেকে অনেক দূর তাদের দেশ। তার মা নিশ্চয় তার কথা ভাবচে। এতদূরে সে এসে থাকতে পারতো না বাবা সঙ্গে না এলে। বই পড়ে পড়ে দূর বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন কত দেখে এসেচে এতদিন! কিন্তু বিদেশ ভালো জায়গা নয়। বিদেশে এলে বাড়ির জন্যে মন-কেমন করে। পরের বাড়ি ভালো জায়গা নয়। যতই তারা আদর করুক, যত্ন করুক, তবু সেখানে আড়ষ্ট-আড়ষ্ট লাগে। পরের বাড়িতে থাকতে না হলে বোধ হয় বিদেশ খানিকটা ভালো লাগতো।
শুক্লপক্ষের চতুর্থীর এক ফালি চাঁদ উঠেচে মাথার ওপরে। ছোট্ট টিলাটার গাছপালায় ক্ষীণ জ্যোৎস্না পড়েচে। সেইটুকু মাত্র জ্যোৎস্নায় সমস্ত জায়গাটা যেন মায়াময় হয়ে গিয়েচে। বড় অদ্ভুত দেশ। একে পাহাড় বলে? দূরের ঐ বড় পাহাড়গুলোতে কি আছে? শ্যামলাল ও সব পাহাড়ে উঠে দেখবে কি আছে।
শ্যামলাল বললে—পাহাড়টা কত দূরে মামাবাবু?
—তিন মাইলের কম নয়। পাথরগাঢ়া বলে একটা ফলস আছে ঐ বনের মধ্যে, মাইল তিনেক দূরে। একদিন দেখিয়ে আনবো।
—কবে যাবেন?
—দু-একদিন যাক। তাড়াতাড়ি কি? নিয়ে যাবো। এসব দেখতে ভালো লাগচে?
—ওঃ, কি চমৎকার! আমি কখনো ভাবিনি যে এমন জায়গা আছে। ঐ সমস্ত আমি একা একা বেড়াবো।
—বেড়িও বাবা। তার আগে দু-পয়সা রোজগার যাতে হয়, তার চেষ্টা পেতে হবে।
শ্যামলাল খুব বুঝেচে। এই বাজারে দুটি প্রাণী একজনের ঘাড়ে বসে বসে খাবে, হলই বা সে আপন মামা, এতে বড় বাধ-বাধ ঠেকে। অবিশ্যি মামাবাবু খুব ভালো লোক, তিনি কিছু মনে করবেন না। কিন্তু তাদের তো একটা বিবেচনা আছে। নাঃ, সে চলবে না।
.
দু-তিন দিন পরে শ্যামলাল বিকেলের দিকে একা বেড়াতে বেরিয়েছে, স্টেশনের ওপারে একটি বৃদ্ধ লোককে নিচু হয়ে কি খুঁজতে দেখে কাছে গিয়ে বললে—কিছু হারিয়েচে আপনার?
বৃদ্ধ লোকটির গায়ে মেরজাই, মোটা থান পরনে, পায়ে নাগরা জুতো। মুখ তুলে বললে—হাঁ বাবুজী, একঠো রূপেয়া গির গিয়া। আভি গিরা—
শ্যামলাল হিন্দী না জানলেও আন্দাজে ব্যাপারটা বুঝলে। একটু খুঁজবার পরে শ্যামলালই একটা পাথরের তলা থেকে টাকাটা পেলে। বৃদ্ধ হেসে ওর দিকে চেয়ে বললে—বহুৎ আচ্ছা বাবুজী। আপকো তো নেহি দেখা ইঁহা পর? আপ, নয়া আয়া?
—আমি শরৎকালীবাবুর বাড়ি এসেছি।
—আচ্ছা! শরৎবাবুকা মকান মে? আপ চলিয়ে না মেরা গরীবখানাপর!
শ্যামলাল শেষ কথার অর্থ ভালো রকম বুঝতে না পারলেও কোথাও যেতে বলচে, এ কথাটা বুঝলে। সে বললে—চলুন।
—চলিয়ে বাবুজী, আপকা কৃপা।
শ্যামলাল দেখলে, চলতে চলতে ওরা সেই দোতলা বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়িয়েচে। বৃদ্ধ বিনম্র হেসে বললে—মেরা গরীবখানা। আপ পধারিয়ে—
এত কেতাদুরস্ত বিনয় শ্যামলাল সহ্য করতে পারছিল না। একে সে আদৌ হিন্দী জানে না, তার ওপর তার বাবা-মামার বয়সী একজন বৃদ্ধ লোকের এতটা বিনয়পূর্ণ কেতাকায়দা! বাড়িতে ঢোকবার তার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু গরীবখানা শব্দের অর্থ না বুঝে সে যখন একেবারে বুড়োর বাড়ির সামনে এসে পড়েচে, তখন আর ফেরা চলে না। কি বিপদেই পড়ে গেল আজ! মামাবাবু শুনে হয়তো বকবেন!
বৃদ্ধ শ্যামলালের হাত ধরে বৈঠকখানায় নিয়ে ঢোকালে। জোড়া তক্তপোশের ওপর জাজিম আর সাদা চাদর পাতা, বড় বড় গোটা-পাঁচ-ছয় তাকিয়া, দু-তিনখানা চেয়ার ছোট একটা টেবিল। দেওয়ালে একটা ক্লকঘড়ি টক টক করচে। একটা অদ্ভুত ধরনের সেকেলে বনিয়াদি আবহাওয়া ও পুরনো মরচে-পড়া গন্ধ ঘরের মধ্যেটায়। শ্যামলাল কখনো এমন দেখেনি। তার ভারি ভালো লাগলো।
ওকে বসিয়ে রেখে বৃদ্ধ বাড়ির মধ্যে ঢুকেই মিনিটখানেক পরে বার হয়ে এসে ওর পাশে বসলো।
বললে—আপকা নাম বাবুজী?
নাম শুনে বললে—শরৎবাবু আপকো কৌন লাগতা?
—কোথায় থাকেন?
—না না, আপনার উনি কে আছেন?
—ও, উনি আমার মামা।
—তব তো ঠিকহি হ্যায়। হামিও আপনার মামা হোয়ে গেলো। শরৎবাবুসে বহুৎ দোস্তি আছে হামার।
—আজ্ঞে!
—হামার নাম আছে রামজীবন পাঠক। হামার কারবার আছে টিম্বারকা। সমঝা? সাড়ে দশ টাকা লিয়ে কছসে আয়া থা বাবুজী, আজ সোই ছত্তিষ বরষ বীত গিয়া—সমঝা? আজ পরমাত্মাকো কৃপা সে আউর আপলোগোকা কৃপা সে—
এই সময় একজন চাকর একখানা কানাউঁচু পিতলের বগিথালার ওপরে দুটো কাঁচের গ্লাস ভর্তি চা এবং চিনেমাটির প্লেটে নিমকি গজা জাতীয় কি খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকলো। বৃদ্ধ কথা বন্ধ করে বললে—বাবুজী, থোড়া চা পিজিয়ে কৃপা করকে—
বৃদ্ধ শুধু চা খেতে লাগলো, খাবারের প্লেট শ্যামলালের সামনে ধরে দিলে। নিমকি-গজাগুলো ভারি সুন্দর খাস্তা, বাজারে এমন চমৎকার ঘিয়েভাজা খাবার আজকাল—উঁহু— এ এই বুড়োর বাড়ির তৈরী, হাজার হোক বড়লোক তো! সত্যিকার বড়লোক। চায়ের সঙ্গে দারচিনি সেদ্ধ করেচে কেন? আর এত চিনি খাওয়া যায় চায়ের সঙ্গে? চা নয়, এ এক ধরনের গরমমশলার শরবৎ!
—বাবুজী আউর থোড়া নমকী—
শ্যামলালের চটকা ভেঙে গেল। ওকি, আর এক প্লেট গরম নিমকি-গজা ভাজা এনেছে যে চাকরটা! না না, অতগুলো নিমকি-গজা এই অবেলায়—
—থোড়া খাইয়ে বাবুজি। আপকো উমর তো আভি বহুৎ কম হ্যায়। এ সময় খাবেন না তবে কি হামার মত বুডঢা হোলে তবে খাবেন? খান খান—থোড়া দহি খাবেন?
—আজ্ঞে না না। চায়ের সঙ্গে দই খেলে বাঁচবো না!
রামজীবন পাঠক হো হো করে হেসে উঠে বললে—নেহি বাঁচিয়েগা! একদম মরিয়ে যাবেন! নেহি, তব রহনে দিজিয়ে। পান মাগায়েঙ্গে?
—আজ্ঞে, পান খাইনে।
—বিড়ি সিগ্রেট?
—আজ্ঞে, মাপ করবেন। ও সব খাইনে কখনো।
রামজীবন পাঠক সন্ধ্যের পর পর্যন্ত ওকে বসিয়ে প্রধানত বলতে লাগলো নিজে সে কি করে বড় ব্যবসাদার হয়েচে। কেমন করে পিটহেড সাহেবের আমলে তিন হাজার টাকায় সত্তর একর জমির শালবন নিলাম ডেকে সাতষট্টি হাজার টাকায় বিক্রি করে!
—ও বখত জঙ্গল কোই নেহি লেতা।
—কেন?
—আরে বাবুজী, জঙ্গল ইসসে বহুৎ ঘন থা, জানোয়ার ভি বহুৎ কিসিম থা!
—জানোয়ার কি এখন নেই?
—বহুৎ হ্যায়। আজকাল হাঁথি বড় গয়া, বাইসন কমতি হুয়া। শের ইধারসে উড়িষ্যা স্টেট ফরেস্ট মে ঘুষ গিয়া—শের সমঝালেন? বাঘ উঘ—
—বুঝেচি। শের মানে বাঘ ইতিহাসে পড়েছিলাম, শের শার কথা পড়বার সময়।
—ঠিক হ্যায়। ইলিমদার আদমিয়েঁানে সব কুছ সমঝতা। আপনি এখানে কেতোদিন আছেন?
—কিছু কাজ করবো বলে এসেছি।
—কৌন কাম?
—যে কোনো কাজ হয়। বাবা ইস্কুলে মাস্টারি করতেন। ষাট বছর বয়েস হল বলে রিটায়ার করতে হল। এখন দেশে কি করে চলবে? তাই মামাকে চিঠি লেখা হল, মামা আসতে লিখলেন, এসেও পড়লাম। আজ চারদিন হল। কি করবো এখনো ঠিক হয়নি।
—আপনি আংরেজি লিখাপঢ়া জানেন জরুর?
—হুঁ।
—চিট্টি-উট্টি আনেসে পঢ়নে সেক্তা?
—খুব। তবে খুব শক্ত ইংরিজি জানিনে। মোটামুটি জানি মন্দ নয়। অনেক বই পড়েচি। খবরের কাগজ পড়ে বুঝতে পারি।
কথা শেষ করে শ্যামলাল সলজ্জ হাসল।
—ঠিক হ্যায় বাবুজী। আপনি এখনো বহুৎ ছেলেমানুষ আছেন। আচ্ছা, আমার গরীবখানায় কাল কৃপা করকে থোড়া আইয়ে গা? এহি সময় পর? ইঁহা পর চা পিজিয়ে গা। বাৎ হ্যায় আপকো সাথ। বৈঠিয়ে বৈঠিয়ে—
শ্যামলাল বিদায় নিতে বাধ্য হল। তার বেশ লাগছিল এই বৃদ্ধের সঙ্গ। বেশ সরলপ্রাণ লোকটি। কিন্তু অনেকক্ষণ সে বাড়ি থেকে বার হয়েচে। পরের বাড়ি, কে কি মনে করবে হয়তো! মামাবাবু লোক ভালো বলেই মনে হচ্ছে, কিন্তু মামীমা যেন তেমন নয়। ওরা এসে পড়তে মামীমা যে খুশিতে উপচে পড়চেন এমন মনে করবার কারণ নেই।
বাড়ি ঢুকতেই তার কিঞ্চিৎ পরিচয়ও পাওয়া গেল। ওর বাবা ও মামাবাবু কোনদিকে বোধহয় বেরিয়েছিলেন, বাইরের ঘরে ওঁদের দেখা গেল না। মামীমা রান্নাঘর থেকে বললেন—কে?
—আমি শ্যাম।
—এসো বাবা। দু-দু’বার চা করলাম, দুবারই তুমি বাড়ি নেই। যেখানে যাবে, সময়মতো এসো বাবা। চায়ের কেটলি আর ভাতের হাঁড়ি গলায় পড়েচে বিয়ের রাত্তির থেকে—সে তো আর নামলো না! দিন দিন কোথায় হালকা হবো, না ঝঞ্ঝাট বেড়েই চলেচে—এখন চা চড়াবো?
—আমি মামীমা চা খেয়ে আসচি রামজীবন পাঠকের ওখান থেকে। রাস্তায় বেড়াতে বেড়াতে বুড়োর সঙ্গে দেখা। ধরে নিয়ে গেল তার বাড়িতে। এতক্ষণ বসিয়ে বসিয়ে শুধু গল্প করছিল—ছাড়ে না। কালও গিয়ে চা খেতে বলেচে বিকেলে।
—রামজীবনবাবুর সঙ্গে আলাপ হয়েচে! বেশ, বেশ। মস্ত বড় ধনী এদিককার। তা যেও বাবা, ওদের সঙ্গে আলাপ রাখা খুব ভালো। দাঁড়াও, চা করে আনচি। ভাতের হাঁড়িটা নামিয়ে দিচ্ছি করে। একবার খেয়েচ তাই কি, আর একবার খাও। আমিও একটু খাই তোমার দৌলতে।
মামীমা আদর করে চা খেতে দেওয়ার একটু পরেই বাইরের ঘর থেকে শরৎকালীবাবু ডাক দিলেন—ও শ্যামলাল—
শ্যামলাল চায়ের পেয়ালা হাতে করেই বাইরের ঘরে গেল। রামলাল ছেলেকে বেশীক্ষণ না দেখে থাকতে পারে না। ওকে দেখে খুশী হয়ে বললে—কোথায় গিয়েছিলে বাবা? আমার ভাবনা হয়েছিল। পাহাড়-জঙ্গলের রাজত্বে বেশিদূর কোথাও যেও না।
শ্যামলাল রামজীবন পাঠকের ঘটনা বলাতে শরৎকালীবাবু বললেন—কাল যেতে বলেচে? যেও। লোক বেশ ভালো। ওর সঙ্গে আলাপ রাখা দরকার।
তারপর দুই বুড়োতে গল্পের আড্ডা বসে। অনেকদিন পরে শ্যালক ভগ্নিপতির পরস্পর মিলন। বাঙালীর মুখ দেখা যায় না এদেশে। তার ওপর রামলাল একজন গল্প-বলিয়ে লোক। শরৎকালীবাবু এমন লোক অনেকদিন পাননি। সন্দেবেলাটা আগে আগে কাটতে চাইতো না। পোস্টমাস্টার রঘুবীর সহায় এসে মাঝে মাঝে বক বক করতো বটে—কিন্তু রামলাল খাঁটি বাংলায় পাড়াগাঁয়ের একশো ঘটনা রসান দিয়ে দিয়ে যেমন বলতে পারে—এমন শরৎকালীবাবু আর কোথাও কখনো শোনেননি। কাল থেকে তিনি ভাবচেন, এদের এখানে রেখে দিতে হবে, দুটো কথা বলবার লোক নেই, সন্দেবেলা কোথাও গিয়ে একটু বসি সে জায়গা নেই। বাঁচা গিয়েচে এরা এসে!
শরৎকালীবাবু বললেন—বাবাজী, দু-পেয়ালা চা আনতে পারো বাড়ির মধ্যে থেকে?
—আনচি মামাবাবু।
মনে মনে প্রমাদ গুনলো শ্যামলাল। চা নিয়ে এইমাত্র এক গোলযোগ হয়ে গিয়েচে, আবার চা! যাই হোক মামীমার অপ্রসন্ন মুখে তৈরি করা চায়ের পেয়ালা নিয়ে কিছুক্ষণ পরেই সে বৈঠকখানায় আবার ঢুকলো। বাবাকে গরম চা দিয়ে সুখ। আর এমন সুন্দর চা! দেশের বাড়িতে বাবা চা খেতে পেতো না—না জোটে দুধ, না জোটে এ বাজারে চিনি। কনট্রোলে মাসে তাদের সংসারে আধসের চিনি বরাদ্দ। কে কত চা খাবে! ভেলিগুড়ও আট আনা সের। গরীব ইস্কুল-মাস্টারের সংসারে দিনে ক’বার চা খাওয়া চলে? বাবা চা খেয়ে বাঁচলো এখানে এসে।
শ্যামলাল ওদের কাছেই বসে। রামলাল সামান্য একটু চা খেয়ে পেয়ালাটা ছেলের সামনে দিয়ে বললে—খাও বাবা।
শ্যামলাল বললে—তুমি খাও না? বাঃ, আমি মামীমার কাছ থেকে খেয়ে এসেচি যে! তুমি ভালো করে খাও না।
রামলাল এবার আষাঢ়ে গল্প ফাঁদলো। সে পল্লীগ্রামের মানুষ, অনেক খুঁটিনাটি ঘটনা জানে পল্লী অঞ্চলের। সামান্য একটা বেগুনের ক্ষেত নিয়ে এমন অদ্ভুত গল্প ফাঁদবে, লোকে হাঁ করে শুনবে নাওয়া-খাওয়া ফেলে। শ্যামলাল বাবার এই গল্প বলার ক্ষমতার উত্তরাধিকারী এবং বাবাকে সে কত ভালবাসে তার এই ক্ষমতার জন্যে। ছেলের মতো মুগ্ধ শ্রোতা ও ভক্ত একজনও নেই রামলালের গল্পের।
পাহাড়ে পাহাড়ে অন্ধকারময়ী রাত্রি মুখর হয়ে উঠেচে বনচর শৃগাল ও পক্ষীদের ডাকে। কি সুন্দর ঠাণ্ডা বাতাস রাত্রির! এমন রাত্রে গল্প বলেও সুখ, শুনেও সুখ। এক অতিথিপরায়ণ গরীব গেরস্ত অতিথিদের রুই মাছ আর সন্দেশ খাইয়ে কি করে সর্বস্বান্ত হয়ে গেল সে গল্প শুনে শরৎকালীবাবুর চোখে জল এল। বললেন———এমন লোকও আছে আজকালকার বাজারে ভায়া!
—না থাকলি আজও আকাশে চন্দ্রসূর্যি্য উঠবে কেন দাদা?
শ্যামলাল বাবার উত্তরে খুশী হল। সে কি আর এমনি কবি হয়েচে? বাবার মধ্যে, ঐ গরীব ইস্কুল-মাস্টারের মধ্যে এই দৃষ্টিভঙ্গীর এই চৈতন্যের বীজ সুপ্ত না থাকলে ছেলের মধ্যে আসে?