৪. শীতের সকাল

১৬.

শীতের সকাল ফুরিয়ে বেলা গড়িয়ে কখন যে দুপুর হল বোধনরা জানতে পারল না। বাড়ি একেবারে স্তব্ধ, নিঃসাড়। গলা উঠছে না কারও। কী যেন হয়ে গিয়েছে বাড়িতে। আশপাশের ফ্ল্যাট থেকে দু একজন এসেছিল। দাঁড়িয়ে থেকে প্রায় নিঃশব্দে চলে গিয়েছে। সুমতি তাঁর ঘরে। বিছানায়। অদ্ভুতভাবে শুয়ে আছেন, দুপা দুদিকে ছড়ানো, দুহাত বিছানায় যেন লুটিয়ে রয়েছে, কোনও রকমে গায়ে শাড়িটা জড়ানো, চোখের পাতা বন্ধ। খাস আছে। কোনও চেতনা নেই।

সকালে, মেয়ের সঙ্গে ঝগড়াঝাটির পর সুমতি তাঁর ঘরে বিছানায় কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর একবার উঠেছিলেন। উঠে বাথরুমে গেলেন। তারপর হঠাৎ বমি তোলার বিকট শব্দ করতে করতে দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন, টলে পড়ছেন, শাড়িটাও পরা হয়নি, ধরে রেখেছেন কোনও ভাবে, কী যেন বলার চেষ্টা করছিলেন, হয়তো বলছিলেন–অফিস যাবেন না, কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল, টলতে টলতে গিয়ে শুয়ে পড়লেন বিছানায়।

বোধন বাড়িতেই ছিল। শিবশংকর চুপচাপ তাঁর জায়গায় বসে কখনও কপাল আড়াল করছিলেন, কখনও দু আঙুলে চোখের ভুরু টিপে মুখ নিচু করে বসে ভাবছিলেন কিছু, মাথার চুল তুলছিলেন অন্যমনস্কভাবে। চুয়া তার ঘরে। দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। তার কান্না তখনও ঘরের ভেতর থেকে মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছিল।

জবা নীচের তলায় কাজ সেরে ওপরে এসে বাড়ির অবস্থা দেখে কী বুঝল সেই জানে, রান্নাঘরে গিয়ে খুটখাট কিছু করছিল।

সুমতিকে ওইভাবে বাথরুম থেকে বেরিয়ে ঘরের দিকে যেতে দেখে বোধন মার ঘরে ছুটল।

 ততক্ষণে সুমতি বিছানায় শুয়ে পড়েছেন!

বাবা! বোধন ডাকল।

 শিবশংকর ক্রাচ টেনে নিয়ে লাফাতে লাফাতে ঘরে এলেন।

 মা কী বলছে?

সুমতি যে কী বলছিলেন কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না, অসম্ভব জড়ানো, অনেকটা তোতলানো কথা; জিব যেন জড়িয়ে বেঁকে যাচ্ছে। বোধ হয় মাথার যন্ত্রণার কথা বোঝাতে চাইছিলেন।

বোধন তাড়াতাড়ি জল এনে চোখে কপালে দিল। পাখা খুলে দিল ঘরের। পাখা চলল না। শিবশংকর হাতপাখা চাইলেন।

চাপা গলায় শিবশংকর ছেলেকে বললেন, রাত্তিরে ঘুমোতে পারেনি, সকালে এই চেঁচামেচি, মাথার আর দোষ কী!

কথা জড়িয়ে যাচ্ছে কেন?

বুঝতে পারছি না। শিবশংকর বিছানার একপাশে, স্ত্রীর মাথার কাছে বসে পাখার বাতাস করতে লাগলেন। হাত দিলেন কপালে। কী হয়েছে, সুমু? ও সুমু?

যে-যন্ত্রণা বোঝানো যায় না–অথচ বোঝাতে চান সুমতি অনেক কষ্টে চোখের কাতরতার মধ্যে দিয়ে বোঝাতে চাইলেন, তারপর সুমতির চোখের পাতা বন্ধ হল। গালের একটা দিক কেমন মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছিল, বেঁকে যাচ্ছিল, গলার মধ্যে থুতু জমে শব্দ হল অদ্ভুত।

সামান্য পরেই সমস্ত থেমে গেল; আর কোনও শব্দ নয়, অস্থিরতা নয়, একেবারে স্থির। শুধু শাস প্রশ্বাস পড়ছিল।

ভয় পেয়ে গেল বোধন। সাহা ডাক্তারকে ডেকে আনি, বাবা! মা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। ভীত, উদ্বিগ্ন গলায় শিবশংকর বললেন, হ্যাঁ, আনো৷বলেই তাঁর টাকার কথা মনে পড়ল। ডাক্তারের টাকা? সুমতির ব্যাগে কী আছে তিনি জানেন না।

বোধন আর দাঁড়াল না।

সাহা ডাক্তার বেলা নটা পর্যন্ত এ পাড়ায়, তারপর চলে যান পুরনো পাড়ার চেম্বারে। ঘণ্টা দুই আড়াই পরে আবার ফেরেন। বোধন সাহা ডাক্তারকে পেল না। নরেন ডাক্তার আটটার পর বেরিয়ে যান হাসপাতালে, ফেরেন দুপুরে। সুকুমারকে দোকানে ধরতে পেরেছিল বোধন। সুকুমার ছোটছুটি করছিল বোধনের সঙ্গে। তার আবার আজকেও ব্যাঙ্কে যাবার কথা। সেই চিঠি নিয়ে ছোটাছুটি করছে কদিন। শেষ পর্যন্ত হাতুড়ে দে-ডাক্তারকেই নিয়ে ফিরল বোধন। সুকুমার বলল, কী করবি, ওকেই নিয়ে যা। আমি কাজ সেরে আসছি। দে-ডাক্তার এল আর গেল। পাঁচটা টাকা পকেটে পুরল। দুটো ওষুধের নাম লিখে দিল।

সুমতির নাকের কাছে আঙুল ধরলে নিশ্বাসপ্রশ্বাসের বাতাসটুকু অনুভব করা যায়, বুকে হাত রাখলে হৃৎপিণ্ডের ধাক্কাটুকু হাতে বোধ করা সম্ভব, নয়তো মানুষটাকে মৃত বলেই মনে হত।

শিবশংকর স্ত্রীর মাথায় বাতাস দিচ্ছেন মাঝে মাঝে, চুলে আঙুল বুলিয়ে দিচ্ছেন, কপালে হাত রাখছেন, হঠাৎ হঠাৎ নিচু গলায় ডাকছেন, সুমু? তাঁর চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছিল তিনি উন্মুখ হয়ে প্রত্যাশা করছেন, সুমতি যে-কোনও সময়ে চোখ খুলে তাকাবেন।

বোধন অস্থির হয়ে পড়ছিল। ঠায় মার ঘরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। একবার মার ঘরে আবার বাইরে খাবার জায়গায়। চুয়ার ঘরের দরজায় ধাক্কাও দিল বার কয়েক। দরজা খুলল না চুয়া। সে দরজা খুলবে না।

জবার কিছু করার ছিল না। সে সবই দেখেছে। অত কিছু বুঝতে না পারলেও নীচে গিয়ে খবর দিয়ে এসেছে। মাঝে মাঝে সুমতির ঘরে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। দেখছে সুমতিকে। আবার ফিরে আসছে। বোধনকে জিজ্ঞেস করেছে বার কয়েক সুমতির কথা।

দাদা, আমি দুটো ডালভাত করে দিয়ে যাব? উনুনে আঁচ চলে গেল?

 না জবাদি, থাক। তুমি বরং যাও। বিকেলে একবার এসো।

বোধন আর দেরি করল না। হাতুড়ে দে-ডাক্তারকে বিশ্বাস নেই। শালা কিছু বোঝে না। আবার সাহা ডাক্তারের কাছে ছুটল। সুকুমারদার কাছ থেকে সে দশ বারোটা টাকা নিয়েছিল। আর কটা মাত্র আছে। দু তিনটে টাকার কথা পরে ভাবা যাবে।

সাহা ডাক্তার এলেন অনেকটা বেলায়। দেখলেন। কখন হয়েছে?

সকালে। বাথরুমে গিয়েছিল… শিবশংকর বললেন বিহ্বল গলায়।

একটা ইনজেকশান শেষ করে আর-একটা তৈরি করছিলেন। প্রেসার চেক করতেন?

শিবশংকর চুপ। সুমতি কিছুই করত না। করতে পারত না।

হসপিটালাইজ করতে হবে, সাহা বললেন। তাঁর চোখের তলায় ঘন উদ্বেগ।

হাসপাতাল? শিবশংকর ভীত, অসহায় চোখে তাকালেন।

অ্যাজ আরলি অ্যাজ পসিবল, সাহা ডাক্তার দ্বিতীয় ইনজেকশানটা দিতে লাগলেন। সাবধানে, যত্ন করে।

বোধন বিছানার পায়ের দিকে দাঁড়িয়ে। তার বুক ভয়ে কাঁপছিল। মাকে হাসপাতালে পাঠাতে হবে! কেন? কোন হাসপাতালে? কেমন করে পাঠারে? হাসপাতাল কি ভর্তি করবে? বোধন শুনেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন ধরনা দিয়েও হাসপাতালে জায়গা পাওয়া যায় না। বড় কাউকে ধরলে হয়। বোধন তেমন কাউকে জানে না। এ-দিককার এম এল এ-কে সে চোখে দেখেনি কখনও।

ইনজেকশানের ছুঁচ বার করে নিলেন সাহা ডাক্তার। সুমতির দিকে তাকিয়ে বসে থাকলেন কয়েক মুহূর্ত। কিছু লক্ষ করছিলেন। তারপর সিরিঞ্জ পরিষ্কার করতে লাগলেন। মুখ দেখে মনে হচ্ছিল ভাবছেন।

বাড়িতে– শিবশংকর কিছু বলতে যাচ্ছিলেন।

না না, বাড়িতে নয়। বাড়িতে কখনও নয়।

হাসপাতালে নেবে? বোধনের গলা শুকিয়ে প্রায় বসে গিয়েছিল।

 আমি লিখে দিচ্ছি। এমার্জেন্সি কেস। নেবে। আর জি কর-এ যাও, কাছাকাছি হবে।

 শিবশংকর ঝুঁকে পড়ে স্ত্রীর মুখ দেখছিলেন। যেন দু দুটো ইনজেকশানের পরও কি সুমতি একবার চোখ খুলে তাকাবেন না? ব্যাকুল, অসহায়, বিভ্রান্ত দৃষ্টি।

ঘরে কেমন একটা গন্ধ উঠছিল অ্যালকোহল কিংবা রেকটিফায়েড স্পিরিটের। গন্ধটা বোধনের নাক থেকে যেন মাথায় চলে যাচ্ছিল। সমস্ত ঘর কী ঠাণ্ডা!

সিরিঞ্জ সাবধানে রেখে সাহা ডাক্তার আবার একবার স্টেথস্কোপ কানে লাগালেন। ঝুঁকে পড়ে সুমতির বুক পরীক্ষা করার সময় মুখ গম্ভীর হচ্ছিল। নাড়ি দেখলেন। ভাবলেন কিছু। নিজের ডাক্তারি ব্যাগ দেখলেন, হাতড়ালেন, বিড়বিড় করে কিছু বললেন, নিজের মনেই।

ভাবলেন আবার। সিরিঞ্জ স্টেরিলাইজ করতে লাগলেন।

বোধনের নীলুর কথা মনে পড়ল। নীলু হাসপাতালে চাকরি করে। নীলুর কাছে যেতে পারলে কিছু হয়। কিন্তু নীলুর এখন ডিউটি, কি ডিউটি নয় বোধন জানে না। তা ছাড়া, অতবড় হাসপাতালে কোথায় সে নীলুকে খুঁজে পাবে! যদি নীলু বাড়িতে থাকত বোধন গিয়ে বললে, নীলু যতটা পারত করত। এখন এসময়ে নীলুর জন্যে ছোটাছুটি করা বৃথা। অনর্থক সময় নষ্ট হবে, কাজ হবে না।

সাহা ডাক্তার তৃতীয় ইনজেকশানের জন্যে তৈরি হলেন।

বোধন জানলার কাছে সরে গেল। নীচে মাঠে চড়ুইয়ের ঝাঁক ঘূর্ণির মতন উড়ে কাঁটা ঝোঁপের গায়ে বসল। আবার উড়ে গেল। প্রতিমাদি ফিরে আসছে। জংলি সাইকেল চড়া শিখছে। বাইরে সব সেইরকম যেমন নিত্যদিন থাকে। তাদের বাড়িতে আচমকা সব পালটে গেল। বোধনের বুক ভারী, ভীষণ ভারী লাগছিল।

সাহা ডাক্তার কখন যে ইনজেকশান শেষ করে প্যাডে খস খস করে লিখছেন বোধন খেয়াল করেনি। খেয়াল হল তাঁর কথায়। লিখে দিয়েছি। এই নাও। …যত তাড়াতাড়ি পারো শিফট করো।

একটা ট্যাক্সি…?

না না, ট্যাক্সিতে নয়। নেভার। ইট মাস্ট বি বাই অ্যাম্বুলেন্স। উইথ অল কেয়ার।

সাহা ডাক্তার তাঁর জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে লাগলেন।

 কী হয়েছে ডাক্তারবাবু? শিবশংকর ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করলেন।

 সেরিব্রাল হেমারেজ।

শিবশংকর নির্বাক। চোখের পাতা পড়ছিল না। শেষ পর্যন্ত উদ্বেগ, ভয়, বেদনা গলার তলায় আটকে রেখে বললেন, বাঁচবে তো?

সাহা ডাক্তার উঠে দাঁড়ালেন। হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন। যত তাড়াতাড়ি পারেন। তারপর ভগবান…। চলো বোধন, আমায় একটু নীচে নামিয়ে দাও।

শিবশংকর এমন করে নিশ্বাস ফেললেন, মনে হল তিনি যেন হাহাকার করে কেঁদে উঠলেন। বোধন বাবার দিকে তাকাল। এমন নিঃস্ব, রিক্ত মূর্তি বাবার সে দেখেনি। বাবার চোখে জল ভরে উঠছিল।

নীচে নেমে হাউসিংয়ের বাইরে আসতেই সাহা ডাক্তার সাইকেল রিকশা পেয়ে গেলেন। ডাকলেন।

ডাক্তারবাবু আপনার.. বোধন আড়ষ্ট গলায় কিছু বলতে যাচ্ছিল।

ঠিক আছে, এখন ওসব নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। একটা অ্যাম্বুলেন্সের চেষ্টা করো। মাকে হাসপাতালে পাঠাও। আগের কাজটা আগে করো। সময় নষ্ট করো না। ..পাঠাও। বিকেলে আমায় একটা খবর দিয়ো।

 মা বাঁচবে না?

হ্যাঁ, হ্যাঁ। বাঁচবে না কেন! আগে অ্যাম্বুলেন্স ডাকো।

সাইকেল রিকশা করে সাহা ডাক্তার চলে গেলেন।

অ্যাম্বুলেন্স কোথায় পাবে বোধন? কেমন করে পাবে? অ্যাম্বুলেন্স সে রাস্তায় দেখেছে আকছার, কিন্তু কোথায় গিয়ে কেমন করে তাদের আনতে হয় সে জানে না। সুকুমারদা থাকলে এসব ভাবতে হত না। নিশ্চয় জানে। তাদের হাউসিংয়ের কাজের লোক কাউকে এখন পাওয়া যাবে না, সব অফিস বেরিয়ে গিয়েছে। বুড়ো রিটায়ার্ড দু একজনকে পাওয়া যাবে। লাহিড়ি জ্যাঠাকে মনে পড়ল তিনি বলতে পারবেন।

বাবাকে একবার বলে আসা উচিত বোধন অ্যাম্বুলেন্সের খোঁজে যাচ্ছে।

বোধন দিশেহারার মতন ছুটতে ছুটতে ফ্ল্যাটে ছুটল। সিঁড়ি উঠল লাফ মেরে মেরে।

 খোলা দরজা। বোধন হাঁফাতে হাঁফাতে ঘরে ঢুকল। অ্যাম্বুলেন্স কেমন করে আনতে হয়?

 ফোন করতে হবে।

ফোন? বোধন ফোনের কথা ভাবছিল। কোথা থেকে ফোন করবে? ঘোষ কাকাদের ফোন আছে। বাদলদাদের আছে। ওষুধের দোকানেও আছে। সাহা ডাক্তারকেই বললে হত। তিনি বাড়ি থেকে ফোন করে দিতেন।

নম্বর?

ফোন গাইডে পাবে। প্রথমের দিকেই আছে।

আমি তা হলে যাচ্ছি। তুমি একলা থাকবে? চুয়াকে ডেকে দেব?

না। একলাই থাকব।

বোধন চলে যাবার সময় দেখল, চুয়ার ঘরের দরজা খোলা। বাথরুমে জল পড়ার শব্দ হচ্ছে। চুয়া বেরিয়েছে।

চুয়ার ওপর রাগে গা-মাথা জ্বলে যাচ্ছিল বোধনের। কত বড় অসভ্য, শয়তান মেয়ে! বদমাশ, পাজি, উল্লুক কাঁহাকার! তুই এ কী করলি? তোর কি কোনও বোধ বুদ্ধি নেই? এত স্বার্থপর, নোংরা হয়ে গিয়েছিস? তুই বাবাকে অপমান করলি, গালাগাল দিলি। তুই মার সঙ্গে ছোটলোকের মতন ঝগড়া করলি? হাত তুললি মার গায়ে। মাকে বললি, তুমি মরো। কী করে বললি? থিয়েটার করে করে থিয়েটারি কথা শিখেছিস? এত ইতর, এত ছোটলোক হয়ে গিয়েছিস? বস্তি বাড়ির মেয়েরাও তাদের মার সঙ্গে এমন করে কথা বলে না তুই বললি। ঠিক আছে। এর শোধ তুই পাবি। দাঁড়া, মা একটু ভাল হয়ে উঠুক তারপর আমি তোকে দেখব। তোর বড় বড় কথা, থিয়েটারি মেজাজ আমি বার করে দেব। হতচ্ছাড়া, পাজি, বদমাশ মেয়ে কাঁহাকার।

বোধন ছুটছিল। টেলিফোন করবে ঘোষদার বাড়ি থেকে।

 সুকুমারদা কখন ফিরবে কে জানে! সুকুমারদা কাছে থাকলে বোধন সাহস পেত। গৌরাঙ্গও নেই। অফিসে।

আচমকা বিনুর মার কথা মনে পড়ল বোধনের। আজ শুক্রবার। বিনুর মাকে নিয়ে আজ বিকেলে তার সোনার দোকানে যাবার কথা। বিনুর মা অপেক্ষা করবেন। হাতে আর সময় নেই বিনুর মার। আসছে শুক্রবারে বিনুর বিয়ে। আজ বিনুও তাকে যেতে বলেছিল। তার কী কথা আছে!

কিন্তু বোধন তো যেতে পারবে না। সে অ্যাম্বুলেন্স ডাকবে। মাকে নিয়ে হাসপাতালে যাবে। কতক্ষণ থাকতে হবে হাসপাতালে কে জানে। কে বলতে পারে মার কী হবে?

বোধনের হঠাৎ ঠাকুর দেবতা ভগবান কালী শিব জগদ্ধাত্রী কত কী মনে পড়ল। ভগবান কী বিপদ থেকে বাঁচাবেন না? বোধন দুহাত কপালে ঠেকাল। আমার মাকে তোমরা বাঁচিয়ে দাও, ঠাকুর। আমার বাবাকে তোমরা শাস্তি দিয়েছে। মাকে আর দিয়ো না। আমার মাকে বাঁচিয়ে দাও, বাঁচিয়ে দাও।

বোধন শীতের দুপুরে কাঁদতে কাঁদতে ছুটছিল। হাঁফাচ্ছিল। তার কপাল গাল ঘাড় গলা দিয়ে অনবরত ঘাম গড়িয়ে পড়ছে।

ছেলেমানুষের মতন বোধন ফোঁপাচ্ছিল আর ছুটছিল।

.

১৭.

বিকেল কখন এসেছিল, এসে চলে গেল বোঝা গেল না। হালকা অন্ধকার দেখতে দেখতে গাঢ় হয়ে আসছিল। শেষ মাঘের শনশনে হাওয়া বিকেল থেকে আরও জোর হয়ে উঠেছে। ৪৮৬

বোধনের অস্থিরতা এখন কেমন যেন শান্ত হয়ে আসছে। হয়তো আর সহ্য হচ্ছিল না বলে, বা শারীরিক অবসাদের জন্যে। আর কতক্ষণ সহ্য করা যায়? কতক্ষণ আর বসে থাকা যায় ধৈর্য ধরে?

সুকুমার বলল, কীরে, এখনও পাত্তা নেই?

বোধনের জবাব দেবার মতন কিছু ছিল না। সেই দুপুর থেকে, বড় জোর দুপুরের শেষ থেকে চেষ্টা করছে, তবু অ্যাম্বুলেন্স এল না। দু তিন বার, অপেক্ষা করে, অধৈর্য হয়ে সে ছুটে গিয়েছে ফোন করতে। প্রত্যেক বারই এক কথা: গাড়ি এলে পাঠাচ্ছি। একটু তাড়াতাড়ি করুন প্লিজ, আমি কত বার ডাকছি বলুন, দুপুর থেকে বসে আছি। কিছু করার দরকার নেই, দাদা; গাড়ি কম। সকাল থেকে দুটো গাড়ি ব্রেক ডাউন। রাস্তায় পড়ে আছে। তারপর শহরের হাল দেখছেন তো। গাড়ি এলে যাবে। অত তাড়া থাকলে সেন্ট জনস-এ ফোন করুন, রিলিফ সোসাইটিতে খোঁজ নিন।

বোধন খোঁজ করে করে তাও করেছে। সব জায়গাতেই একই অবস্থা। গাড়ি নেই। অপেক্ষা করতে হবে। অপেক্ষা করছিল বোধন। কিন্তু আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবে? দুপুর ফুরোল, বিকেল শেষ হল, সন্ধে হতে চলেছে।

তুই ঠিক মতন বলেছিস? রাস্তা বুঝিয়ে দিয়েছিস? সুকুমার বলল।

 হ্যাঁ, মাথা নাড়ল বোধন।

তা হলে এত দেরি করছে কেন? ঘণ্টা চারেক হয়ে গেল?

কোনও জবাব দিল না বোধন। সে কেমন করে জানবে কেন অ্যাম্বুলেন্স দেরি করছে।

আমি একবার যাই, দেখি– সুকুমার বলল।

বোধন তাকাল। কী ভাবল। মাথা নাড়ল ধীরে। তুমি বরং বোসো, আমি আর-একবার দেখছি।

কেন, তুই থাক। আমি দেখছি।

না, না। তুমি থাকো। আমার বাড়িতে থাকতে বড় ভয় করছে। বোধন ভীত, বিহ্বল মুখে তাকাল সুকুমারের দিকে। বাড়িতে থাকলেই তাকে মা আর বাবাকে দেখতে হচ্ছে। সে পারছে না। অচৈতন্য মা আর অসহায় বাবাকে সে আর চোখে দেখতে পারছে না।

বেশ। তবে যা তুই। কিন্তু কতবার যাবি আসবি?

বোধন উঠল। উঠে ঘরে গেল। বাতি জ্বালিয়ে দিল। মা সেই একই রকম। সেই ভাবেই বিছানায় পড়ে আছে। বাবা বোধ হয় মার মাথাটা আরও একটু উঁচু করে দিয়েছে নিজের বালিশটা গুঁজে দিয়ে। হাত দুটোকে কোলের কাছে সরিয়ে দিয়েছে সামান্য। পায়ের দিকের কাপড় গুছিয়ে রেখেছে। মার মাথার কাছে চুপ করে বসে আছে বাবা। বসে থেকে কখনও মার কপালে গালে হাত রাখছে, কখনও মাথার চুলে। সেই কখন থেকে বাবা এই একই ভাবে মার মাথার কাছে বসে। সারাদিন মুখে কিছু দেয়নি। বাবাও নয়, বোধনও না। নীচে থেকে ঝমরুর মা মুখে দেবার জন্যে কিছু পাঠিয়েছিলেন, বোধনরা খায়নি, খেতে পারেনি। জবাদি বিকেলের গোড়ায় গোড়ায় এসে খানিকটা চা করে দিয়েছিল, সেটা বোধনরা খেয়েছে।

এই ঘর ওই বিছানা-বোধনের আর সহ্য হচ্ছিল না। সে আর দেখতে পারছিল না মার ওই একই ভাবে অচেতন হয়ে বিছানায় পড়ে থাকা, বাবার ওই স্থির হয়ে পুতুলের মতন বসে থাকা–ঘণ্টার পর ঘন্টা। সমস্ত ঘরটাও কেমন অসাড়, অচেতন হয়ে আছে। বড় বেশি ঠাণ্ডা, কনকনে লাগছিল। সকালের সেই গন্ধ কখন চলে গিয়েছে বাতাসে, এখন অন্য কোনও গন্ধ উঠছিল, যেন মার বিছানায় কীসের এক দুর্গন্ধ জমে উঠেছে।

বোধন ঘরের চারপাশে অন্যমনস্কভাবে, শূন্য চোখে তাকাল। হলুদ, মিটমিটে আলো। মার শখের দেরাজের মাথায় কত কী পড়ে আছে, আয়না, চিরুনি, চুলের কাঁটা,কাঁচি, মোমবাতি। বেখাপ্পা ভাঙা আলনার ওপর মার শাড়ি, সায়া, জামা। দেওয়ালে ঠাকুমার ছবি। মা বাবা ছেলেমেয়ের মেশানো একটা ধূর ফটো। কালীঘাটের পট। সেলাই মেশিন মা বেচে দিয়েছিল, কিন্তু তার পাদানির ওপর নানা রকম জঞ্জাল জমিয়ে রেখেছে মা।

বোধন আবার বাবাকে দেখল। মানুষটা যেন এখন অনেক ধাতস্থ। কিংবা সমস্ত ভয়-ভাবনা ভুলে গিয়ে বাইরে বাইরে শান্ত ধৈর্যশীল হয়ে উঠেছে। ব্যাকুলতা ততটা নেই যতটা বেদনা; বেদনা যেন শতগুণ হয়ে বাবার মুখ পাথর করে রেখেছে।

সহ্যের সীমা আছে, চোখে দেখার একটা মাত্রা। বোধন আর সহ্য করতে পারছিল না, চোখে দেখতে পারছিল না এই প্রাণহীন, বুক ভাঙা দৃশ্য। তার ভয় করছিল। আর হয়তো মাকে বাঁচানো গেল না। হয়তো ওই ভাবে বাবার কোলের কাছে শুয়ে থেকে থেকে মা চলে যাবে। কেউ কিছু বুঝবে না। কিন্তু বোধন কী করবে? সে তো যা করার করেছে। অ্যাম্বুলেন্স যদি না আসে কী করতে পারে বোধন?

আমি আর-একবার যাচ্ছি বোধন বলল। তার গলা শোনা যায় না।

 তাকালেন শিবশংকর। যেন কথাটা শুনতে পাননি।

বোধন আবার বলল, আমি এগিয়ে গিয়ে দেখি। মোড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব। যদি ভুলটুল করে থাকে, দেখি। এত দেরি কেন করবে?

শিবশংকর স্ত্রীর মুখ গাল থেকে মশা তাড়াতে তাড়াতে বললেন, আয়।

সুকুমারদাকে রেখে যাচ্ছি।

 বোধন যাচ্ছিল, শিবশংকর বললেন, চুয়া গেল কোথায়?

জানি না। আমি তো সেই দুপুরের পর থেকে আর ওকে বাড়িতে দেখিনি।

শিবশংকর আর কিছু বললেন না।

বোধনও বুঝতে পারছে না চুয়া কোথায় গেল? সাহা ডাক্তারকে রিকশায় উঠিয়ে বাড়ি ফিরে বোধন চুয়ার ঘরে দরজা খোলা দেখেছে। চুয়া বাথরুমে ছিল। বাবাকে অ্যাম্বুলেন্সের কথা বলে বোধন সঙ্গে সঙ্গে আবার বেরিয়ে গেল। ফিরে এসে চুয়াকে আর বাড়িতে দেখেনি। সে কি সত্যিই বাড়ি ছেড়ে চলে গেল এসময়?

ঘরের বাইরে এল বোধন। সুকুমার খাবার জায়গায় চেয়ারে বসে আছে। ব্যাঙ্কের কাজ সেরে সে বিকেলের আগেই বোধনের কাছে এসেছে। বসে আছে তখন থেকেই। বসে বসে বোধনকে ভরসা দিচ্ছিল। অবশ্য সে জানে না, সুমতির অসুখটা ঠিক কী!

সুকুমারদা, তুমি তা হলে একটু বসো, আমি ঘুরে আসি, বোধন বলল।

হ্যাঁ, তুই যা। …একেবারে বড় রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াবি। মুখটাতে। এখানে অনেক সময় রাস্তা ভুল করে।

বোধন চলে যাচ্ছিল। সুকুমার আবার বলল, দোকানে একটু বলে দিবি, বাড়িতে একটা খবর দিয়ে যেন বলে দেয় আমি এখানে আছি।

সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামল বোধন। হাউসিংয়ের ছোট ছোট টুকরো মাঠে বাচ্চারা খেলা শেষ করে ফিরে গেছে, জলের ট্যাঙ্কের ওপাশে জনা দুই বৃদ্ধ বাড়িতে ঢোকার মুখে শেষ কিছু কথাবার্তা বলছেন। অফিস ফেরত দু এক জনকে চোখে পড়ল!

হাউসিং পেরিয়ে একদিকে খানিকটা মাঠ মতন, অন্যদিকে ঘরবাড়ি। বেশ অন্ধকার হয়ে এল এরই মধ্যে। কুয়াশা জমা শুরু হল। এখনও কাছাকাছি জিনিস চোখে পড়ছে। সামান্য পরে আর পড়বে না। একেবারে অন্ধকার হয়ে যাবে। অ্যাম্বুলেন্সটা এখনও চলে আসতে পারে। আসা উচিত। কখন সে ফোন করেছে অথচ ঘণ্টা চার কেটে গেল। যদি বিপদের সময় না আসে তবে অ্যাম্বুলেন্স কেন? সাজিয়ে রাখার জন্যে? কলকাতায় অ্যাম্বুলেন্স কত কম! আবার বলা যায় না, বোধনদের যেরকম দুর্ভাগ্য তাতে অ্যাম্বুলেন্স আসতে গিয়ে রাস্তায় কোথাও ভেঙে পড়ে আছে কি না!

বোধন সামনের দিকে চোখ রেখে হাঁটছিল, লক্ষ করছিল গাড়ি-টাড়ি কী আসছে! মনুয়াকে দেখতে পেল। সেই একই ভাবে আপন মনে হেঁটে যাচ্ছে, একা একা, খেপার মতন, কোনও দিকে চোখ নেই। মনুয়াকে দেখে বোধনের হঠাৎ কেমন মনে হল, বোধন অ্যাম্বুলেন্সের জন্যে মনুয়াদের বাড়ি যেতে পারত। ওদের ফোন আছে। মনুয়া তাকে সাহায্য করত। তাড়াহুড়োয় অত মনে থাকে না সব কথা। এত দেরিই যখন হল, বোধন নীলুর খোঁজে গেলেও কাজের কাজ হত। তা হলে অ্যাম্বুলেন্স আর হাসপাতাল দুয়েরই ঝঞ্জাট হয়তো মিটে যেত।

বাজার ছাড়িয়ে যাবার সময় বোধন দেখল, রাস্তার সব বাতি দপ করে নিবে গেল। তার মানে লোডশেডিং। আজ এখনই? অবশ্য লোডশেডিংয়ের তোত কোনও ঠিক নেই। মার ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। বাবা লণ্ঠনটা জ্বেলে নেবে।

শীতের হাওয়ার সঙ্গে ধুলো, কয়লা, ধোঁয়া সব যেন মেশানো, আগাছার, ডোবার, কতক বা বড়বড় গাছপালার গন্ধও। বিনুদের বাড়ির দিক থেকে ধোঁয়া বেশি আসে রেল লাইনের জন্যে। বিনুর মাকে খবর দেওয়া গেল না আর। বোধনের যে কী হল উনি জানতে পারলেন না।

হন হন করে আরও খানিকটা এগুতেই বোধন একটা শব্দ শুনল। বিকট শব্দ। আর সঙ্গে সঙ্গে দেখল বেশ খানিকটা তফাতে কিছু মানুষজন যেন রাস্তায় নেমে দুরে তাকাচ্ছে। কেউ কেউ গলিটলিতে ঢুকে পড়ছে। রিকশা সোঁ সোঁ করে চলে গেল।

একটা শব্দ থামতে না থামতেই আবার একটা। বোমা। বোমা মারামারি হচ্ছে তবে কি ওরাই রাস্তার বাতি নেবাল? ঘর বাড়ির বাতিও তো জ্বলছে না। লোডশেডিং-ই। রজনী আর শান্তদের যে-যুদ্ধ কাল শুরু হয়েছিল, হয়ে বন্ধ হয়েছিল, দু তরফের সুযোগ-সুবিধে বুঝে এখন আবার কি তা শুরু হল? কিন্তু দু দলের যুদ্ধক্ষেত্র তো বাজার নয়, বা এই রাস্তাটও নয়, ইটখোলার কাছে, পাম্প হাউসের দিকে– যেখানে গোটা দুয়েক ভাঙা লরি পড়ে থাকে, আর গেঞ্জি কারখানার কাপড় শুকোয়।

বোধন কিছু বুঝল না। সামান্য ভয়ও হল।

ওই তো একটা গাড়ি এল হেডলাইট জ্বালিয়ে, রিকশাও আসছে একটা। দোকানপত্রও বন্ধ হয়নি। বোধন এগিয়ে চলল। আর কিন্তু বোমা পড়ছে না। ব্যাপারটা কী? এত সহজে যুদ্ধ তো থামে না। ভাবতে ভাবতে আরও কয়েক পা এগুতেই আবার একবার শব্দ। তার পরই হল্লার মতন চিৎকার। এদিকে ওদিকে। দূরে কিছু একটা হচ্ছে। লোকজন এ-পাশেই চলে আসছিল।

বোধন থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

কিন্তু তার দাঁড়িয়ে থাকার উপায় নেই। মোড় পর্যন্ত যাওয়া দরকার। অ্যাম্বুলেন্স গাড়িটা যদি দেখতে পায়!

একটু ভাবল বোধন। তার ভয় কীসের? সেনা রজনীদের না শান্তদের দলের লোক। সে এই পাড়ার ছেলে। সবাই তাকে চেনে। সে আজ সাঙ্ঘাতিক এক বিপদে পড়ে রয়েছে। তার মা সকাল থেকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে বাড়িতে। মাকে হাসপাতালে পাঠাতে হবে। বোধন অ্যাম্বুলেন্স অ্যাম্বুলেন্স করে দুপুর থেকে পাগলের মতন ছোটাছুটি করছে। তার ওপর কে বোমা ছুড়বে, কেনই বা ছুড়বে! বোধন তো কারও শত্রু নয়। তা ছাড়া অ্যাম্বুলেন্স সব কিছুর বাইরে। অসুস্থ, মুমূর্ষ, মানুষকে বয়ে নিয়ে যায় হাসপাতালে। অ্যাম্বুলেন্সের গায়ে কেউ বোমা ছুড়বে না।

আর বোমা-টোমা পড়ছিল না। তবে হললা ছিল।

 বোধন এগুতে লাগল দুপাশে চোখ রেখে। গঙ্গাপদর দোকান আধ-খোলা, লণ্ঠন জ্বলছে, মতি স্টোর্স মোমবাতি জ্বালিয়েছে গোটা কয়েক। এক জোড়া কুকুর ছুটছে। সবই যে বন্ধ তা নয়। তবে সবই খানিকটা তটস্থ হয়ে আছে।

এগুতে এগুতে বোধন প্রায় মোড়ের কাছে চলে এল।

বড় রাস্তা দিয়ে বাস যাচ্ছে। হর্ন শোনা গেল। গাড়ির আলো ছুটছে বড় রাস্তায়।

আরও কয়েক পা এগিয়ে আসতেই বোধন দেখল, তার মনে হল, একটা অ্যাম্বুলেন্স গাড়ি ঠিক মোড় পেরিয়ে এসে দাঁড়িয়ে আছে। তা হলে শেষ পর্যন্ত এসেছে। সারা দুপুর আর বিকেলের উৎকণ্ঠা আর ভার যেন বুক থেকে হালকা হয়ে গেল। আবার পরমুহূর্তে বুকটা টনটন করে উঠল। তার মাকে নিতে গাড়ি এসেছে। মা চলে যাবে। এতক্ষণ তবু মা বাড়িতে ছিল। ঘরে। চোখের সামনে। ওই গাড়িটা এসে গিয়েছে। আর মা থাকবে না।

বোধনের গলার কাছে ভয় আর কান্না লাফ মেরে উঠে এল। তারপর তার মনে হল, কেঁদে লাভ নেই। ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে মা বাঁচবে না। বাবাও তো হাসপাতালে ছিল কত দিন! গাড়িটা এসেছে। মাকে নিয়ে যাবে। মা বাঁচবে। এই গাড়ির জন্যে তো তারা দুপুর থেকে পথ চেয়ে বসে আছে।

প্রায় ছুটতে ছুটতে বোধন অ্যাম্বুলেন্সের সামনে এসে দাঁড়াল।

অ্যাম্বুলেন্সের কাছাকাছি, গাড়ি ঘিরে রজনীর কয়েক জন সাকরেদ দাঁড়িয়ে আছে। কচাকেও তার মধ্যে চোখে পড়ল। কচা, মাধব, তিনু, গোপাল আরও কেউ কেউ। তারা কেন অ্যাম্বুলেন্স ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে বোধন বুঝল না। বোধ হয় পাড়ার মধ্যে গণ্ডগোল হচ্ছে বলে তারা অ্যাম্বুলেন্সকে এই সময় ঢুকতে বারণ করছে। বা অন্য রাস্তা বুঝিয়ে দিচ্ছে। ঘুরে যেতে বলছে।

বোধন একেবারে গাড়ির কাছে গিয়ে বলল, এই যে আমি! মার জন্যে অ্যাম্বুলেন্স ডেকেছিলাম। আমি ওদিকের রাস্তা দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি গাড়ি।

বোধনের কথা কেউ শুনল বলে মনে হল না। আগেই দেখেছিল তাকে। গ্রাহ্য করল না। নিজেদের মধ্যে কিছু বলাবলি করছিল। ব্যস্ত, উত্তেজিত।

বোধন কিছু বুঝতে পারছিল না। গাড়িটাকে এরা অনর্থক দাঁড় করিয়ে রেখেছে কেন? সামনেই মাধব। মাধবকে বলল বোধন, বাপার কী! গাড়িটা আটকে রেখেছে কেন? আমি নিয়ে যাচ্ছি রাস্তা ঘুরিয়ে।

মাধব তাকাল। তুমি অন্য গাড়ি দেখো।

বোধন অবাক হয়ে গেল। তার মানে? এ-গাড়ি তবে কার? বোধন বলল, আমি দুপুর থেকে অ্যাম্বুলেন্স ডাকছি। আমার মা অজ্ঞান হয়ে বাড়িতে পড়ে আছে। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।

মাধব কচাদের কী বলতে লাগল, বোধনের কথা কানেই তুলল না।

ব্যাপারটা কী? বোধন চটে গেল।

 কীসের?

 গাড়িটা ছেড়ে দাও। মাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে আমায়।

 অন্য গাড়ি দেখো।

কেন এ গাড়ি কার?

 মাধব কোনও জবাবই দিল না।

বোধনের কি তবে ভুল হল? এ-গাড়ি তার নয়? ছুটে সে গাড়ির ড্রাইভারের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। পাকা পাকা চুল ড্রাইভারের, বুড়োটে মুখ। পাশে একটা লোক। ব্যাকুল, বিভ্রান্ত গলায় বোধন বলল, দাদা, আমি গভর্নমেন্ট হাউসিং থেকে ফোন করছিলাম। দুপুর থেকে অ্যাম্বুলেন্সের জন্যে ফোন করছি। বোধন চৌধুরী ব্লক সি, দোতলা। আমার মাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।

ওহি লোকদের বলুন। আমি বাবু অর্ডার মাফিক এসেছি, লোকটা বলল। বোধ হয় অবাঙালি।

আমাদের জন্যে তো! গাড়ি আমাদের জন্যে…

হ্যাঁ হ্যাঁ, বুধন চৌধুরী…

তবে চলুন।

ইসলোক রাস্তামে পাকড়ে নিল। আমি আমি কী করব! রোকতে বলল। রোকে দিলাম। গাড়ি লিয়ে হামলায় পড়ব! সিসাউসা তোড়ে দেবে। বলে খুব নিচু গলায় বলল, রংবাজ পার্টি। হরবখত হামলা মাচায়।

গাড়ি বোধনদের জন্যেই পাড়ায় এসেছে। মাধবরা আটকে রেখেছে। কেন? বোধনের মাথা গরম হয়ে উঠছিল। ব্যাপারটা কী?

বোধন আবার মাধবের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। গাড়ি তো আমাদের জন্যে এসেছে। মাকে হাসপাতালে পাঠাতে হবে। আটকে রাখছ কেন?

ফটিকদা জখম হয়েছে, হাসপাতালে নিয়ে যাব, কে একজন বলল।

পা থেকে মাথা পর্যন্ত রাগে জ্বলে উঠল বোধনের। দুপুর থেকে ফোন করে করে বসে বসে সে শেষ পর্যন্ত অ্যাম্বুলেন্স পেল এই সন্ধেবেলায়, আর সেই অ্যাম্বুলেন্স আটকে, কেড়ে নিয়ে ওরা ওদের ফটিকদাকে হাসপাতাল নিয়ে যাবে।

বোধন বোঝাবার মতন করে বলল, আমি দুপুর থেকে ছোটাছুটি করছি অ্যাম্বুলেন্সের জন্যে। মার অসুখ। সাহা ডাক্তার সেই তখনই হাসপাতালে পাঠাতে বলেছে।

ট্যাক্সি করে লিয়ে যাও,মাধব বলল তাচ্ছিল্যের গলায়।

ট্যাক্সি করে নিয়ে যাওয়া যাবে না।

তো অন্য গাড়ি দেখো।

বাঃ, এ আমার গাড়ি। …তুমি কেন বুঝছ না, আমার মা সকাল থেকে বেহুশ।

ঝামেলা কোরো না। হাসপাতাল যাবার বহুত গাড়ি আছে। বলে মাধব বোধনকে ঠেলে দিয়ে চেলাদের দিকে তাকিয়ে বলল, কীরে তোরা শালা লড়তে চড়তেই রাত কাবার করবি। ফটিকদাকে লিয়ে আয়।

আসছে। রজনীদা সবুর করতে বলল। রজনীদা ফটিকদাকে লিয়ে আসবে।

বোধন বুঝতে পারল, তার গাড়ি কেড়ে নিয়ে এরা ফটিককে হাসপাতালে পাঠাচ্ছে। বোধনের মা কিছু নয়। তার মা বাঁচুক বা মরুক রজনীদের কিছু আসে যায় না, ফটিক গোপাল কচা এরা অনেক দামি মানুষ। প্রাণের দাম ফটিকদের। যে-ফটিক বোমা বাঁধে, বস্তির ডাগর মেয়েদের নিয়ে রং করে, পুলিশ যাকে মেরে কাঁধের হাড় ভেঙে দিয়েছিল।

রাগে, দুঃখে, হতাশায় বোধনের হুঁশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। মাধবরা তার মাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেবে না। তাদের গাড়ি কেড়ে নিয়ে নিজেদের লোক পাঠাবে। শালা, শয়তানের বাচ্চা সব।

আচমকা বোধনের মাথায় রক্ত চড়ে উঠল। কী মনে করেছে এরা। বোধন মাধবের মুখের সামনে হাত তুলে বলল, না, এ-গাড়ি আমার। আমি নিয়ে যাব।

 মাধব তাকাল, ঝামেলা কোরো না।

কীসের ঝামেলা! আমি তোমাকে বলছি, আমার মা সকাল থেকে অজ্ঞান হয়ে বাড়িতে পড়ে আছে। দুপুর থেকে অ্যাম্বুলেন্স ডাকছি। আর তুমি আমার গাড়ি কেড়ে নিচ্ছ। আমার মাকে মারতে চাও?

মাফা বাদে হবে। ফালতু কথা বাড়িয়ো না।

কীসের ফালতু কথা?

 এ-গাড়ি যাবে না। কিছু বলার থাকে, থানায় যাও।

কথা তুমি বাড়াচ্ছ। …গাড়ি আমার। আমাদের জন্যে এসেছে। রাইট আমাদের। আমায় ছেড়ে দাও।

তোমার বাবার গাড়ি।

বোধন হুঁশ হারাল। তোমাদের বাবারও নয়।

বলার সঙ্গে সঙ্গে বোধন বুঝল মাধব তাকে মারবে। সরবার চেষ্টাও করল। পারল না। মাধব প্রচণ্ড জোরে এক চড় মারল বোধনের মুখে। চড়টা সামান্য সরে বোধনের গলা আর ঘাড়ের কাছে লাগল। ভীষণ লাগল তার। মাধবের হাত লোহার মতন। শালা শুয়ারের বাচ্চা…,বানচোত তুমি শালা আমার বাপ তোলো৷ মাধব এবার জোরে লাথি কষাল বোধনের কোমরে।

লেগেছিল বোধনের। যন্ত্রণায় শব্দ করল। কিন্তু মুহূর্তে সে সমস্ত ভুলে গেল। ভুলে গেল তার ক্ষমতার কথা, যন্ত্রণার কথা। মাধবের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শালা, শয়তান…।

জামা ছিঁড়ে গেল মাধবের। বোধন ঝাঁপ মেরে জামাটাই ধরতে পেরেছিল মাধবকে নয়।

এবার ঘুষি চালাল মাধব। হারামির বাচ্চা, তুই আমার ওপর হাত তুলিস। রোয়াবি। তোকে বানচোত তোর মার গভভে পাঠাব আজ। মাধব আবার লাথি মারল। বোধনের বুকের পাঁজরায়।

বোধনও ছাড়বে না। মুখ নিচু করে দু হাতে মাধবের জামা ধরে টানছে। জামা আরও ছিঁড়ে গেল। ঘুষি চালাল বোধন। মাধবের হাতে লাগল।

গোপাল বলল, আবে এই শালা বোধন হটে যা… খুন চড়িয়ে দিচ্ছিস বেকার। হঠে যা। মরে যাবি।

বোধন হটবে না। না, আজ সে হটবে না। মানুষ কত হঠতে পারে। সে প্রায় খেপার মতন একটা লাথি চালাল। মাধবের কুঁচকিতে লাগল।

এতক্ষণ মাধব তেমন যেন পাত্তা দেয়নি বোধনকে। দুটো চড় কষিয়ে, লাথি মেরে বেটাকে হটিয়ে দেবে ভেবেছিল। কুঁচকির কাছে লাথি খেয়ে সে কাণ্ডজ্ঞান হারাল।

মাধব মানুষকে মারতে জানে। বোধন জানে না।

এবার মাধব মারতে লাগল। ঘুষি, লাথি, চড়। কোনও দিক দিয়ে বোধন নিজেকে বাঁচাতে পারছিল না। বোধনের হাত মুচড়ে দিল মাধব, ঘাড়ের কাছে কনুই দিয়ে জোর মারল, কোমরে পেছনে লাথি মারতে মারতে ছিটকে ফেলে দিল।

বোধন রাস্তায়, মাটিতে ছিটকে এসে পড়ল। লাগল ভীষণ। ছড়ে গেল খানিকটা।

মাধব দু পা এগিয়ে এল! তোর পেটে লাথি চেপে মেরে ফেলব শালা। দেখি কে তোকে বাঁচায়। তোর কোন বাপ! আমার কাছে রংবাজি করতে এসেছিস। চুতিয়া কাঁহাকার।

মাধব বোধনের পেটে পা তুলতে আসছিল।

 গোপাল বলল, ছেড়ে দে, মাধব। ও শালা মেয়েছেলে।

কচা বলল, সুকুমারের চামচা, মাধবদা।

 মাধব তার চটি সমেত পা বোধনের পেটে চাপাল। শোন শালা, আমার নাম মাধব। তোর সুকুমার নই। বেচাল করবি তো খালের জলে লাশ পড়ে থাকবে। তোর মা বাপ দাদা মারাতে আসিস না। মরে যাবি। হ্যাঁ, গাড়ি আমার। আমার বাবার। তোর হিম্মত থাকে তুই ওই গাড়ি নিয়ে যা।

বোধন মাধবের পায়ের তলায় শুয়ে শয়তানটাকে দেখছিল। পেটে লাগছে। চোখ বুজে ফেলল।

পেট থেকে পা সরিয়ে মাধব বোধনের পাছায় একটা লাথি মেরে ছেড়ে দিল তাকে। যেন নেহাতই দয়া করল।

চোখ খুলল বোধন। যন্ত্রণা এবং ঘোরের মধ্যে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখল সব। মাধব আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা সামান্য তফাতে দাঁড়িয়ে। অ্যাম্বুলেন্স গাড়িটা আরও হাত কয়েক দূরে। গাড়ির সাদা রং এই অন্ধকারেও বোঝা যায়। বোধন কুমার বিল্ডার্সের সামনে রাস্তায় পড়ে আছে। তার মাথার দিকে সুরকির তৃপ, ইটের পাঁজা। কাছাকাছি রাস্তা দিয়ে এখন আর লোকজন যাচ্ছে না, পাশের পথ দিয়ে হন হন করে পালাচ্ছে।

বোধন বুঝতে পারল, এই গাড়ি সে পাবে না। তার ক্ষমতা নেই মাধবদের হাত থেকে গাড়ি ছাড়িয়ে নেয়। মাকে আর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া গেল না। মা বাড়িতে বিছানায় শুয়ে বিনা চিকিৎসায় মরবে। বোধন মাকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছিল; পারল না। কিন্তু কেন? ওই গাড়ি তো বোধনের। তারই পাবার অধিকার। কিন্তু কে তার অধিকার দেখছে? শালা শুয়ারের বাচ্চা মাধবরা বোধনের গাড়ি কেড়ে নিল।

পিঠে, কোমরে, পেটে–কোথায় না যন্ত্রণা হচ্ছিল বোধনের? বুক ভেঙে যাচ্ছে। বাঁ হাতের কাঁধের কাছটার হাড় সরে গিয়েছে কিনা কে জানে। চোয়াল টনটন করছে। বোধ হয় গাল চোখ সব ফুলে যাচ্ছে মারের চোটে।

বোধন খানিকটা উঠে বসল। বসে প্রায় ঘোরের মধ্যে জোরে জোরে শ্বাস নিল। কপালের তলায় চোখের ভেতরে টুকরো টুকরো কত কী লাফ মেরে মেরে উঠে আসছে। মা, বাবা। মা অচৈতন্য হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। বাবা মার মাথার কাছে চুপ করে বসে। অ্যাম্বুলেন্স আসার অপেক্ষা করছে। বাবা জানে না, বোধন এখন রাস্তায় পড়ে রয়েছে। বিনুর মার কথাও মনে পড়ল। বিনুর মা সারা বিকেল অপেক্ষা করেছিলেন সে আসবে বলে। বোধন যেতে পারেনি। বিনুও এখন তার অপেক্ষা করছে হয়তো। কে জানে? সুকুমারদা বোধনের জন্যে হাঁ করে বসে আছে।

কিন্তু বোধন কোথায়? বেদম মার খেয়ে জখম-হওয়া কুত্তার মতন পড়ে আছে। তার সারাদিনের অত চেষ্টায় ছোটাছুটি করে পাওয়া অ্যাম্বুলেন্স বেহাত। কী কপাল করেই এসেছিল সে। তারা। বাবা অক্ষম, অকর্মণ্য হয়ে গেল। মা দুটো ভাতের জন্যে কত কী করল। ছেলে মেয়ে স্বামীকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে করতে মার গায়ের রক্ত জল হল। আজ মা মরছে। দিদিও বাঁচবার জন্যে ঘর ছেড়ে পালিয়ে শেষ পর্যন্ত বেশ্যা। চুয়াও চলে গেল আজ…. কেন, কেন এরকম হবে?

বোধন ধুঁকতে ধুঁকতে কাঁদতে কাঁদতে উঠে পড়ছিল। আচমকা তার চোখে পড়ল, তার ডান পাশে ভাঙা দুধের বোতল পড়ে আছে। তলার দিকটা ভাঙা। কাচের ফলাগুলো ছোরার মতন তীক্ষ্ণ। বোধন আর হাতখানেক এপাশে পড়লে ওই ফলাগুলো তার গলায় মাথায় ঢুকে যেত।

হঠাৎ বোধনের মাথায় কী যেন হয়ে গেল। তার চেতনার তলা থেকে অদ্ভুত এক হিংস্রতা, জ্বালা সারা জীবনের, সমস্ত কিছুর ক্রোধ যেন মাথার মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে দিল দপ করে। বোধন আর-একবার দেখল। বোতলের মুণ্ডুটা ধরা যায় হাতে।

বেহুশের মতন বোধন বোতলটা টেনে নিল। মুণ্ডুটা ধরল।

টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল বোধন। পা শক্ত করল প্রাণপণ। সামনে তাকাল। ওই তো মাধবরা। তবে আয় শালা, শুয়ারের বাচ্চারা। চলে আয়। তোরা ভেবেছিস কী? সব তোদের, আমাদের কিছু থাকবে না?

মাধবের দিকে ছুটে যাচ্ছিল বোধন। শালা, শয়তানের বাচ্চা।

 চারদিকে কেমন একটা আঁতকে ওঠার শব্দ হল। কারা যেন সরে গেল। বোধন কোনওদিকে খেয়াল করে সমস্ত শক্তি দিয়ে ডান হাতটা ছুড়ল মাধবের দিকে।

পেছন থেকে অন্ধকারে কার হাত নেমে আসছে বোধন জানতে পারল না। হঠাৎ অনুভব করল পেছন থেকে তার কাঁধের কাছে ধারালো ভয়ংকর কী বিধে গেল, গিয়ে তলার দিকে হাতের পাশ দিয়ে নেমে গেল। ভাঙা বোতল পড়ে গেল হাতের মুঠো থেকে।

চিৎকার করে উঠল বোধন। বিকটভাবে।

বোধন দুলছিল, পড়ে যাচ্ছিল, কুঁজো হয়ে হাঁটু ভেঙে পড়ে যেতে অন্ধের মতন তাকাচ্ছিল। কিছু নেই। সবই শূন্য। কানে এল, কে যেন চিৎকার করে কিছু বলছে, ভীষণ চিৎকার করে: হাঠো সব। হাঠ যাও। সামনে সে হাঠ যাও।

গাড়ির শব্দ উঠল আচমকা। গর্জনের মতন।

মুখ থুবড়ে, বেহুঁশ হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়তে পড়তে বোধনের মনে হল, অ্যাম্বুলেন্স গাড়িটা দপ করে বাতি জ্বালিয়ে দিয়েছে। ধীরে ধীরে তারই দিকে এগিয়ে আসছে যেন।

ততক্ষণে বোধন মাটিতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *