৪. শাখা ম্যানেজার

চার  

         মাল নিয়ে অতনু যখন গন্তব্যে পৌঁছোল, শাখা ম্যানেজার ওর খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, উস্কোখুস্কো চুল, নোংরা ধুতি পাঞ্জাবি, চোখের কোণে কাহিল অন্ধকার দেখে, মুখে অমায়িক, করমর্দনের শেষে বললেন, হ আর দন্ত্য স মেশানো কেমন যেন অচেনা ইংরেজিতে, চূড়ান্ত ক্লান্তি সত্ত্বেও বিসদৃশ লাগছিল, কাগজগুলো দিন, রিসিভ করে নিচ্ছি । গোনাগুনি কাল থেকে শুরু করলেই হবে । আজকে বরং জিরিয়ে নিন, খুবই ধকল গেছে দেখছি । কাছেপিঠে হোটেল আছে কিনা জিগ্যেস করতে, উনি জানালেন, থাকার ব্যবস্হা করা হয়েছে, বেয়ারা পৌঁছে দেবে।

         বাকসোগুলো তালিকায় টিক দিয়ে ভল্টে রাখা হলে, ক্যাশিয়ারের নিঃশ্বাসে ভক করে মদের গন্ধ ওড়ায় বিচলিত হয় অতনু । পেচ্ছাপ করতে যাওয়ার নাম করে চাবিটা বেঁধে নিল পৈতেতে ।

         বাইরে বেরিয়ে, পিওনের পেছন-পেছন তিন ফার্লংটাক হাঁটার পর যে বাড়িটায় ওরা ঢুকল, তার দেয়ালে ‘ইনডিয়ান ডগস গো ব্যাক’ কালো মোটা বুরুশে, লেখা দেখে হঠাৎ নিজেকে একা বোধ হল অতনুর । আসার সময় রাস্তায় দেখেছে বেশিরভাগই স্হানীয় মহিলা, পুরুষ কম । বাইরে থেকে আসা, কেন্দ্রিয় ভূখণ্ডের একজনকেও দেখতে পায়নি । মনটা চঞ্চল হয়ে উঠল । ওরা ওরা, আমরা আমরা –ওদের আর আমাদের এই বোধের ঝগড়াঝাঁটি থেকে মানুষ বোধহয় কখনও বেরিয়ে আসতে পারবে না । ভিন্ন গ্রহ থেকে বুদ্ধিমান প্রাণী এলে পৃথিবীর মানুষ পারস্পরিক হিংসে থেকে বেরোতে পারে, মনে তো হয় ।

         ‘এ বাড়ির লোকজন আপনার দেখাশোনা করবেন ।’ কাউকে কিছু বলা নেই কওয়ানেই, খোলা সদর দিয়ে ঢুকে দোতলার একমাত্র ঘরটায় ওকে পৌঁছে দিয়ে, সেলাম ঠুকে চলে গেল বেয়ারা বা পিওন । টিপস দেয়া ঠিক হবে কিনা, এই কুন্ঠা থেকে মুক্ত হবার আগেই, চলে গেল লোকটা, পিওনও বেশ ইংরেজি জানে, হ আর দন্ত্য স মেশানো হলেই বা ।

          বাড়ির কেউ খোঁজ নিতে আসবে মনে করে অপেক্ষা করছিল অতনু ।

         ঘরটা সাজানো । পোরোনো অ্যান্টিক খাটে শাদা বিছানা-বালিশ, পায়ের কাছে পাট করা কম্বল, ছোট্ট পড়ার টেবিল, সঙ্গে কুশন-দেয়া চেয়ার, ডান দিকে আলোর তলায় বেতের আরামকেদারা, পাশের দেয়ালে গোল, সামান্য পারা-ওঠা আগেকার কালের সোনালি-ফ্রেম আয়না, টেবিলের ওপর দুটো  ওলটানো কাচের গেলাস, জলভরা ঢাকা-দেয়া জাগ খাটের শিয়রে শাদা পর্দা টানা জানলা । রোমান সংখ্যার পুরোনো দেয়ালঘড়ি । মেঝেতে নস্যিরঙা ড্রাগেট ক্ষয়ে গেছে কয়েক জায়গায় । উনিশ শতকী ছমছমে সব মিলিয়ে । এই প্রথম অতনুর হাতে ঘামা ভয়-ভয় ভাব এলো ।

         এখন সাড়ে তিনটে বেজেছে । এর মধ্যেই বিকেল । সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাইরে বেরিয়ে বাড়ির অবস্হান, ইনডিয়ান ডগস গো ব্যাক লেখা দেয়াল, রাস্তার ওপাশের বাড়ি দুটোর টালির ছাদ আর বাঁশের বারান্দা মগজের স্মৃতিঘরে তুলে রাখল অতনু, যাতে ফেরার পথে হারিয়ে না যায় । মহিলাদের, যারা ওর দিকে অনুসন্ধিৎসু তাকিয়ে পথ দিয়ে যাচ্ছিল, সত্যিই দেখতে ভালো । সমস্ত মোঙ্গোলয়েড নারীর থাকে অপার্থিব চটক, যেন কেউ ছোঁয়নি কখনও, পরাগমাখানো ত্বক । খোকাখুকুগুলোও কেমন গোলাপি । গাল টিপে দিলে কি আক্রান্ত হবে ? কেমন জীবন্ত চনমনে ।

         সবাই তাকেই দেখছে । ইনডিয়ান ডগরা বোধহয় বেরোয় না এ-সময় । গায়ে ধূসর আলোয়ান, ধুতি-পরা ডগ দ্যাখেনি । বুড়ো-জোয়ান সব পথচারীই প্যান্ট পরে বেরিয়েছে । মেয়েরা পরেছে স্কার্ট বা শায়ার মতন কিছু ।

         ভেতরে কিছু পরে ? অন্তর্বাস পাওয়া যায় এখানে ? এমনিতে দেখে তো মনে হচ্ছে দেহের যা কাঠামো, অন্তর্বাসের প্রয়োজন নেই । অফিসে গৃহবধু আর অবিবাহিতা কর্মীদের আঁটো শাড়ি ছাপিয়ে, অনেকেরই জাঙিয়া ফুটে ওঠে ।

         একটা দোকান দেখে থামল অতনু । একটা রাস্তা চলে গেছে পাক খেয়ে দোকানটার ওপরতলার দিকে । সাবান তেল ওষুধ চাল ডাল শুঁটকি মাছ সবই । ক্ষুদে ডিপার্টমেন্টাল দশকর্মা । কোন ভাষায় কথা বলবে অস্বস্তির মাঝেই, দোকানের মহিলা প্রথমে ভাঙা হিন্দি আর তারপর পরিষ্কার ইংরেজিতে জানালেন, যা চাই সবকিছু পাওয়া যাবে, কনডোম থেকে বিশুদ্ধ স্কচ । টুথব্রাশ পেস্ট সাবান চিরুনি সেফটি রেজার ল্যাদার দু-রকম বিদেশি পারফিউম কিনল অতনু ।

          করকরে নোটগুলো হাতে নিয়ে  দোকানি বললেন, ‘ও, তুমি এসেছ এবার ? রোসাংলিয়ানাদের বাসায় উঠেছ ? তোমার আগে মোহন রাজবংশী নামে একজন এসেছিল, একশো চব্বিশ টাকা না দিয়ে চলে গেছে ।’

         ‘আমার থেকে নিয়ে নিন’, অতনু কুন্ঠিত । ‘আমি এসেছি মুম্বাইয়ের হেড অফিস থেকে’, অসৎ লোকের থেকে নিজের পার্থক্য দাঁড় করাতে বেমালুম মিথ্যে বলে ফেলে বিমর্ষ বোধ করল ও । কোথায় যে উঠেছে নিজেই জানে না এখনও । হোটেলের নাম কি ইনডিয়ান ডগস হতে পারে ?  দোকানি জানালেন, টাকাটা উনি ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজারের কাছ থেকে আদায় করেছেন ।

         ঘোরাঘুরি করতে-করতে অতনু টের পাচ্ছিল যে এখানে কায়িক শ্রম করে মেয়েরা । পুরুষরা কী করে কে জানে ! রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে আসছে । তার মানে সন্ধে নামলেই জায়গাটা একদম খাঁ-খাঁ ।

       রাজবংশীটা শালা এখানেও এসেছিল, রেমিট্যান্স নিয়ে । পাটনায় অফিসারদের ছেলেমেয়েদের জন্যে মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষক আর ট্যাবুলেটারদের টাকা খাইয়ে বেশি নম্বর পাইয়ে দেবার কাজ করে । এনজেনিয়ারিং ডাক্তারির পরীক্ষায় টুকলির ব্যবসা ।

         –কবিতা পিসি, আমরা এই রাস্তায় এসেছিলুম গো ।’

         আরে, বাংলা, বাঙালি, এখানে ! অতনু ঘুরে দেখল, হাফপ্যান্ট-পরা কিশোর আর শাদা থানে অশীতিপর বৃদ্ধা, কিশোরের হাত ধরে । কথা বলতে চেয়েও, বলল না, কুন্ঠিত লাগছিল । এই থুথ্থুরে বুড়ির নাম কবিতা । পঁচাত্তর বছর আগে লাগসই ছিল । এখন শুধু পিসি বললেই হয়, রাঙাপিসি ফুলপিসি নতুনপিসি যা হোক । কবিতা নামে যে যুবক ডাকতো সে তো কবিতাকে মর্ত্যে ফেলে রেখে গদ্যের আকাশে । কদমছাঁট ছেলেটির হাত ধরে নেমে গেলেন বৃদ্ধা ।

         ঘরে ফিরে অতনু দেখল টেবিলে রাখা রয়েছে টোস্ট আর একটা ফ্লাস্ক, বোধহয় চা বা কফি । টয়লেটে ঢুকে তোয়ালে সাবান আর লাল প্লাস্টিকের বালতি দেখল, গরম জল, চটি, শ্যাম্পু । দাড়ি কামিয়ে স্নান সেরে নিলো ; হোটেলটায় ব্যবস্হা বেশ ভালো ।

         কফিটা গরম তখনও, খেয়ে ফেলল টোস্ট দিয়ে । গড়াগ্গড় কম্বল টেনে বিছানায়, পার্স আর সুটকেসের চাবি বালিশের খোলে শিয়রের তলায় ।

       ঘুম না আসা ওব্দি ও, অতনু,  ভেবে কুলোতে পারছিল না ইনডিয়ান ডগস কি বাইরের সবাই, ওই কবিতা পিসিও, ডগই বা কেন, বাঁদর গাধা কাক নয় কেন, আমরা বাঙালিরা কাদের ঘেন্না করি, আগে যারা বাঙালিদের ঘেন্না করত তখন তাচ্ছিল্য করে, ধুতি পরে বেরোনো ঠিক হবে না, সুশান্তর দেয়া প্যান্টটা মাপে বড়ো, প্যান্ট দেখে কি ভাববে মা, পৌঁছোনোটা লেখা হল না মাকে, মানসী বর্মণ গায়ে কোথায় লাগাবে পারফিউম, শ্যামলীর বগল শীতকালেও ভিজে থাকে, পচা নোটের গন্ধ ভালো লাগে না, এখানে কদ্দিনে নোট গোনা শেষ হবে, এখানে জমা পচা নোটগুলো  ফেরত নিয়ে যেতে হবে পুড়িয়ে নষ্ট করাবার জন্য…..

         তার পদবি ধরে ডাকা হচ্ছে শুনে ঘুম ভাঙতে অতনু দেখতে পেল, ঘরের টিমটিমে বিজলি আলোয়, তার মাথার কাছে ঝুঁকে সামান্য মোটা অথচ প্রায় বোজা-চোখ কাঁধ ওব্দি চুল, লাল কার্ডিগানে এক যুবতী, আর তার পাশে বেশ ঢ্যাঙা আরেকজন, গায়ে পশমের স্কার্ফ চোখে শ্লেষ মেশানো কৌতূহল যুবতী, চোখ ততো বোজা নয় । উঠে বসল বিছানায় ।

       খাটো মেয়েটা কিছুটা নার্ভাস, বললে, ‘স্যার আজকে নিরামিষই রেঁধেছি, আপনি কি আমিষ খান ?’

      ‘হ্যাঁ,’ অতনু বুঝল পরিষ্কার আওয়াজ বেরোয়নি গলা থেকে, তাই আবার জানাল, হ্যাঁ, শুধু ডিম আর মুরগি খাই ।’

     ‘মাছ খান না ?’ জানতে চাইল ঢ্যাঙা যুবতী, জিনসের ঘাগরা । ‘তুমি তো বাঙালি ?’

            আবোল তাবোল মাংস আর শুঁটকির বোটকা ভয় অতনুর । বরং নিরামিষ খেয়ে চালিয়ে দেবে ।          যুবতীর কন্ঠস্বর কিছুটা ভাঙা ভাঙা, শোনেনি এর আগে। এত কাছাকাছি একজন যুবতীর সঙ্গে, একজন নয় দুজন, সে কথা বলতে পারছে । ছি ছি, মিথ্যে কথা বলা উচিত হয়নি ।

         ‘তুমি ফ্যামিলি আনতে পারতে ।’ বেঁটে মতন যুবতীর খোঁজখবর ।

         ‘বিয়ে করিনি এখনও ।’ বিছানা থেকে নেমে, টেবিলে রাখা ফ্রাইড রাইসে এক নজর লোভী চাউনি, বলল অতনু । এদের ইংরেজি সত্যি কত ভালো, হ আর দন্ত্য স নেই । নিজেরটায় বাঙালি টান, ভজকট ।

         ‘ভালো কথা’, এক সঙ্গে বলে উঠল দুজনে । একজন আরেকজনের মাথায় আলতো চাঁটি মেরে, ‘গুড লাক।’

ওরা চলে গেলে, কাঁটা-চামচ থাকা সত্ত্বেও, হাত দিয়ে খাওয়া আরম্ভ করেছে যখন, টেবিলে বিদেশি স্কচের বোতলটা দেখতে পেল অতনু, কিছুটা খালি, পাশে একটা ফুলকাটা কাচের গেলাস । একটু খাবে কি খাবে না নির্ণয় নিতে অস্বস্তি হচ্ছিল । খেয়ে গলমাল করে ফ্যালে যদি, যুবতীদের সঙ্গে অসদ্ব্যবহার করে ফ্যালে যদি নেশার ঘোরে, পিঠের ছাল ছাড়িয়ে নেবে এই বেঙ্গলি ডগের । খায়নি তো আগে । সুশান্তর মতে মদ খাওয়া খারাপ । দেখাই যাক সামান্য । গেলাসে একটুখানি ঢেলে, যদি মাথা ঘোরে, ঘুম না আসে, আবার বোতলে ফেরত ঢেলে দিল অতনু, এঁটো হাতে ।

          ‘কী হল ? মিশেল দেয়া নয় । আমরা অতিথিদের সঙ্গে জোচ্চুরি করি না ।’ দরোজার কাছ থেকে খাটো মেয়েটার কন্ঠস্বরে অতনু স্তম্ভিত । তার ওপর নজর রাখা চলছে । হোটেল নয় বোধহয় এটা । ধরা পড়ে যাওয়ায় বিব্রত লাগছিল ।

         ‘না, আমি কখনও মদ খাইনি ।’

         ‘খাওনি ? তোমার বয়স তো যথেষ্ট !’

         ‘আমাকে কেউ কখনও খেতে অনুরোধ করেনি । কে জানে কেন খাইনি । ঠিক জানি না ।’

         কাছে এসে অতনুর কাঁধে হাত রাখে মেয়েটি । ‘আমি বলছি, খাও । তুমি বোধহয় কোনো নেশাই করো না, তাই না ? ইনোসেন্স রয়েছে তোমার চোখে মুখে আচরণে ।’

         মেয়েটির স্পর্শে মানসিক শারীরিক বিচলিত অতনু বলল, সত্যি । আমি কিছুই চেষ্টা করে দেখিনি । তোমাদের এই হোটেলটার নাম কি রোসাংলিয়ানা ?’

        ‘না।’ চটে যায় যুবতী । ‘আমরা ইংচুঙার । আর এটা হোটেল নয়, গেস্ট হাউস ।’

         অতনু কাঁচুমাচু, মেয়েটির পারফিউম কিছুটা ধাতস্হ করে ওকে । একগাল খাবার তোলে ।

        ‘বান্ধবী নেই ?’ এবার অতনুর কাঁধে আঙুলের চাপ দিয়ে মেয়েটি সহজ করে তোলার চেষ্টা করে আবহকে।

         ‘না’ । আমূল নড়ে ওঠে অতনুর টনক ।

         ‘কিন্তু তোমার তো বয়েস হয়েছে বেশ ।’ কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে মাথার চুলে বিলি কাটে মেয়েটি ।

         অতনুর গলায় শ্লেষ্মা জমে ওঠে, শরীরে সাড়া বোধ করে । ‘অনুভব করিনি কখনও ; কেউ আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়নি, তাই ততটা অনুভব করিনি ।’

       ‘তুমি তো ভারজিন?’

         অতনু বিস্মিত বিচলিত হতবাক । একই সঙ্গে শীত করে, গরম লাগে । এত কাছ থেকে নারীর শরীরের সুগন্ধ পায়নি এর আগে । দেহের কোন গোপন গ্রন্হি থেকে আসে এই ঘ্রাণের সংকেত । মা-ও এভাবে হাত বুলিয়ে দেয়নি কতকাল । ওকি তাকাবে মেয়েটির দিকে ? তাকালে যদি চোখাচুখি হয় ? মেয়েটি যদি ওর চোখে উদ্দেশ্য খুঁজে পায় ! নাঃ, এখন থাক, পরে সময় মতন খুঁটিয়ে দেখে নেবে দুজনকেই ।

             গেলাসে সামান্য হুইসকি ঢেলে, জল না-মিশিয়েই, গিলে ফেলল, আর গা গুলিয়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে । বাকি ফ্রাইড রাইস খাওয়া যাবে না আর । কী অভাবনীয়! সামান্য এক চিলতে স্পর্শে তার চরিত্রের গিঁটগুলো খুলে যাচ্ছে । অস্তিত্বের অচেনা জটিল দুঃখ জমাট বেঁধে গেছে গলায় । কই, জীবন নিয়ে তো ও অসন্তুষ্ট ছিল না এতকাল । কোথায় আর কেনই বা লুকিয়ে ছিল গোপন ফোঁপানি !

          থালা গেলাস তুলে নিয়ে যেতে-যেতে মেয়েটি জানিয়েছিল, ওরা দু’জনে এই গেস্টহাউসের হাউসকিপার রাঁধুনি ঝি ধোপা সবকিছু । প্রতিদিনের খর্চাখরচ জানিয়ে দিয়েছে তো ম্যানেজার ? অতনু যেন সবাইকে বলে না বেড়ায় ।

         নেশাটা বেশ ভালো লাগছে টের পেয়ে বেশ শিহরিত হচ্ছিল অতনু । বিবেক কাকে বলে ! বিবেকের ভালো লাগছে । পাটনায়, বিহারের পথে শহরে গ্রামে গঞ্জে যা ঘটছে, তা ? দরোজায় ছিটকিনি তুলে, মশারি টাঙিয়ে, আলো নিভিয়ে, শুয়ে পড়ল ও । বাইরে শুরু হয়ে গেছে বৃষ্টির টাপুর । সজ্ঞানে বাড়াবাড়ি করছিল বাতাস । অতনু ভাবছিল লোকে কি করে মিজো নাগা কুকি মণিপুরি নেপালি নেওয়ারি ভুটানি খাসি লেপচা চিনা জাপানি ভিয়েতনামির তফাত করে ? ফর্সা হলে, অনেকটা চ্যাপ্টা চেহারার বাঙালিও গুলিয়ে যাবে ।

          দরোজার কড়া নাড়ানাড়ির শব্দর ঘুম ভাঙতে, কম্বল মুড়ি দিয়ে ছিটকিনি খুলতেই ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার । জিনস, চামড়ার জারকিন, কুতকুতে হাসি, বলল, ‘স্যার দরোজা জানলা বন্ধ করে ঘুমোচ্ছেন ! এখানে চুরি-ডাকাতির ভয় নেই । বাইরে চেয়ে দেখুন তো কি টাটকা বাতাস, বুক ভরে টেনে নিয়ে যান নিজের দেশে, সারা জীবন কাজে দেবে । দেখছেন তো কত শিগগির সকাল হয়। খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতন হয়েছে তো রাত্তিরে ? এরা দুই বোন খুবই ভালো । অসুবিধা হবে না আপনার । ছোটো দেখতে, ও-ই অবশ্য বড়, জুলিয়েট । লম্বা দেখছেন যাকে, ছোটো, জুডিথ ।

           ভোরবেলা উঠেই টাকার কথা পাড়া বিসদৃশ, কে জানে এখানে রোজকার খরচ কত, এমন ঢালাও ব্যবস্হা । লোকটাকে বসতে বলে টয়লেটে ঢুকল অতনু । হেগে, দাঁত মেজে, ঠাণ্ডা জলে মুখ ধুয়ে টয়লেট থেকে বেরিয়ে বলেই ফেলল অতনু, ‘কিন্তু এখানে থাকতে বেশ খরচ পড়বে মনে হয় ।’

         ‘না না, কে বললে ? আপনারা রোজকার যা হলটিং পান, তার চেয়ে অনেক কম। যাবার সময় কেনাকাটার পয়সা থাকবে । একদিন আমাদের অফিসের গাড়িতে ঘুরিয়ে আনব আপনাকে । রবিবার চলুন না । এরপর তো আর এসব জায়গা দেখা হবে না ।’

           যাক, লোকটা বকবক করতে পারে । অতনু আশ্বস্ত । ওকে বেশি কথা বলতে হবে না ।

          ‘যে-জন্যে সাত সকালে এলুম, সন্ধে তাড়াতাড়ি হয়তো, তাই ওভারটাইমটা সকালে হয় । আর ছোটো ডিনোমিনেশানের নোটগুলো গুনটে একটু সময় লাগে । আপনি রেডি-টেডি হয়ে সময়মত আসুন ।’

       ট্রেতে দু’কাপ কফি আর নোনতা বিস্কুট নিয়ে এসে টেবিলে রাখল কালকের খাটো মেয়েটি । কাঁধ ওব্দি কালো চুল আঁচড়ে নিয়েছে এই ভোরেই । নীল কার্ডিগান, পশমবোনা হলুদলাল স্কার্ট । ফিকে হলুদ আর গোলাপির মাঝামাঝি গায়ের রঙ । নখ খায়, কফি এগিয়ে দেবার সময় আঙুল দেখে মনে হল ।

         ‘ঠিকমতো দেখাশুনা করছ তো এনার ? এনারাই বাজারে টাকা ছাড়েন যখন যত ইচ্ছে । পুড়িয়ে নষ্ট করেন যখন যত ইচ্ছে । কী বলেন স্যার ?’

         ‘উনি বেশ ভিতু, দরোজা বন্ধ করে ঘুমোন ।’ রাশভারি যুবতীর কন্ঠস্বর ।

         ‘মুখ ধোবার গরম জল ছিল না’, অতনু বলে ফেলল ।

         ‘এনেছিলাম, দরোজা বন্ধ ছিল ।’ পর্দা সরিয়ে নেমে যায় তরতর ।

         অত গরম কফি সপাসপ চুমুক মেরে উঠে দাঁড়াল ম্যানেজার । ‘আমি তাহলে উঠে, আপনি তাহলে তৈরি হয়ে চলে আসুন ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে ।’

         নিচে থেকে খিলখিল হাসাহাসি শোনা গেল । খাটের শিয়রের দিকের জানলার পাল্লা খুলে অতনু বিমূঢ় । রাতের বৃষ্টি কোনও প্রমাণ রেখে যায়নি । কোঁকড়া কেশদামের মতন ঘন সবুজ পাহাড়ের পাদদেশে আলুলায়িত বাঁশঝাড় । জানলা থেকে ধাপে ধাপে নেমেছে টালির ছাদের চালাঘর । ঝকঝকে আকাশে বেরিয়ে পড়েছে হুড়ো মেঘের দল । প্রায় প্রতিটি পাহাড়েই আধখোলা বিনুনির মতন দোল খাচ্ছে দু-একটা ঝরণা । অনেক নীচে এক চিলতে উপত্যকায় দশ-বারোটা শাদা-কালো ছাগল; গোরুও হতে পারে । ট্রেনে-ভ্যানে সফর করার সময়ে ঘটেনি তো এরকম ভালোলাগা ।

         পৃথিবী এখানে দিন গুজরান করে । চরাচর জুড়ে, এক গৃহবিমুখ নিভৃতি । ভাব বিনিময়ে মশগুল মোহিনী বাতাস । হালকা হাওয়ায় অদৃশ্য বস্তুকণাদের নিঃশব্দ বেতার গুঞ্জন চলছে ।

         –স্যার, আপনার ব্রেকফাস্ট । গরম জল দিয়েছি বাথরুমে । চান করবেন না বেশি, শরীর খারাপ হবে ।

ঢ্যাঙা যুবতী । মেরুন ডেনিমের ফ্রক । বাদামি কর্ডুরয়ের ডাঙ্গারি । ববচুল । কাঁধের ওপর ঝটপট মাথা ঘোরায় । নখে নখপালিশ । টানা ছোটো-ছোটো চোখ । অত ফর্সা নয়, তবুও যথেষ্ট ফর্সা । বেশ আলাদা দেখতে দুজকে ।

         –তোমাদের দু’জনের মধ্যে কে বড় ?

         বলে ফেলে, আনন্দ হয় অতনুর । কথাবার্তা নিজের তরফ থেকে, আরম্ভ করতে পেরেছে । এরকমটা তার কাছে নতুন ।

         –জানি না ।

         অতনু বুঝতে পারল না, এটা উদাসীনতা, বিরক্তি, না সম্পর্ক সহজ করার তারল্য ।

         স্নান সেরে সুশান্তর দেয়া শার্ট-প্যাণ্টে পালটাল নিজেকে । ব্রেকফাস্ট মানে টোস্ট আর ডিম । কানে গানের ঢুলি লাগিয়ে বেরোবার সময়, সিঁড়ির শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে, ভেতরে উঁকি দিয়ে কাউকেই দেখতে পেল না ।

         রাস্তায় আর তেমন দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল না পথচারীদের । আশ্বস্ত লাগল । কারোর ব্যস্ততা নেই । অতনুও নিজের তাড়াহুড়োয় ঢিলে দিলো, দিয়ে আরাম বোধ হল কানে; সুশান্তর প্রিয় গজল, পঙ্কজ উদাসের । ম্যানেজার, কে জানে কী নাম লোকটার, পরিচয় দেয়নি নিজের, জানালো , কর্মচারীরা কেউ আসেনি এখনও, তবে চিন্তার কিছু নেই, যতদিন গুনে বুঝে নিতে সময় লাগে, আরাম করুক অতনু । ইচ্ছে করলে কাছেপিঠে ট্রিপল এক্স ভিডিও পার্লারে যেতে পারে, আফরিকান,আমেরিকান, থাই্যাণ্ডের ফিল্ম । যদি চায় তো অন্য শহরে যেতে পারে । বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে পারে দিন দশেক । যারা রেমিট্যান্স নিয়ে আসে সবাই করে এসব । রাজবংশী তো বর্মায় গিয়ে অনেক কেনাকাটা করেছিল ; টাকাই সীমান্তের পাসপোর্ট-ভিসা।

         –আমি এক জোড়া জুতো কিনতে চাই ।

         –আনিয়ে দেবখন দোকান-টোকান খুলুক । আপনার চটি জোড়া দিয়ে দেবেন, ওই মাপের নিয়ে আসবে ।

         –আমি বরং একটু ঘোরাঘুরি করে আসি ।

         –তা কেন, আমি লোক দিয়ে দেব আপনার সঙ্গে । সকলে তো আর ইংরেজি জানে না । যদিও কেউ ঠকাবে না আপনাকে । বেলা আরেকটু বাড়ুক, তারপর বেরোনো যাবে ।

         কাঁচুমাচু অতনু বসে থাকে চুপচাপ, কানের গানে এবার আশা ভোঁসলে । বাইফোকালে স্হানীয় খবরের কাগজ পড়ে আপাতগম্ভীর ম্যানেজার । কর্মচারীরা একজন-দুজন করে আসতে থাকে, অলস হাত তুলে সুপ্রভাত জানায়, একই ভঙ্গীতে অতনু ।

         জীবন এখানে অতিবাহিত হয় । নির্লিপ্ত নিসর্গ মানুষের সাতে-পাঁচে নেই । এখানে বোধহয় আদিকাল থেকে কেউ কখনও চিৎকার করেনি ।

         –আচ্ছা, একটা মোটর সাইকেল পাওয়া যাবে ? ভাড়ায় ?

         –মোটর সাইকেলে যাবেন কোথায় ? শেষে ছেলে-ছোকরাদের হাতে বিপদে পড়বেন ।

         –তাহলে সাইকেল, জায়গাটা দেখি ।

         –না না, সাইকেলে কী ? দুদিনে সবাই জেনে যাবে । আপনি আমার অতিথি । সাইকেল মানায় না ।

         –এখানেও আছে ওসব ?

         –বড়ো-ছোটো সব জায়গাতেই আছে স্যার । তাড়া কিসের ? জিপে করে সব দেখিয়ে দেবো । এই তো এসেছেন ।: দুচারদিন শরীর এলিয়ে দিন । আরাম করুন । বলেন তো বিয়ার আনাই ।

         –আনান । বলে ফেলতে পারল অতনু । বলে ভালো লাগল ওর, ভারমুক্ত মনে হল । অফিসে বসে বিয়ার জিনিসটা মন্দ নয় । বিয়ার জিনিসটা সম্পর্কে ধারনা হবে । খটকা লাগছিল অতনুর । কাছে-পিঠে চেনা-জানা কেউ নেই বলে কি খোলামেলা অনুভব করছে, নাকি বাঁক দিতে চাইছে নিজের ঘটনাহীণ উদ্দেশ্যহীন জীবনকে, নাকি ও আর অতনু থাকতে চায় না, বিরক্তি ধরে গেছে একঘেয়ে অতনুতে !

         কাচের জাগ উঁচু করে চিয়ার্স হল । বেশ কিছুক্ষণ বসে-বসে কয়েক জাগ । সামনের চেয়ার টেনে তার ওপর ঠ্যাং তুলে চোখ বুজল । ঘুম-ঘুম আমেজে পড়ে রইল ডান কাঁধে নিজের মাথা ফেলে । ঘুমিয়ে পড়েছিল ।

‘আপনার চাবিটা দিন, কাজ আরম্ভ করাই’, ম্যানেজারের কন্ঠস্বর শুনে আচমকা উঠে দাঁড়ায় অতনু, সোয়েটার শার্ট খোলে, চাবিসুদ্দু পৈতে কাঁধ থেকে নামায়, পৈতেটা ম্যানেজারের হাতে দিয়ে সোয়েটার পরে । ঘাড় গুঁজে ঠ্যাং তুলে বসে থাকে, আগের মতো । অপরিচিত ঘূর্ণীঝড়ের ঝিমঝিমে কুয়াশাময় রাজধানি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল মগজে ।

         –ঠাণ্ডা না লাগে ; আপনি আরাম করুন । চিন্তা নেই । ক্যাশিয়াররা সামলে নেবে ।

          যাঃ, হঠাৎ মনে পড়ল অতনুর । পার্স আর সুটকেসের চাবি রয়ে গেছে বালিশের খোলে । ফিরে যাবে কি ? কোনও ছুতো ? ছিঃ, এরকম ভাবনাচিন্তা অনুচিত । জেটজাহাজের ঘনঘোর আওয়াজ বিরক্তি ঘটায় । বহুক্ষণ চুপচাপ ।

         –আমি বাই এয়ার গৌহাটি হয়ে পাটনা ফিরব । একটা ওপন টিকিট কাটিয়ে দেবেন ।

         –আজই কেটে রাখছি । যেদিন যেতে চাইবেন । ভিআইপি কোটায় পেয়ে যাবেন । কোনও চিন্তা নেই ।

          –আচ্ছা, এখানে লাইব্রেরি নেই ?

          –লাইব্রেরি ? চার্চের আছে ।

          –চার্চ ? থাকগে, চাবির সঙ্গে আমার পৈতেটাও দিয়েছি, দেখুন তো, পৈতে মানে ব্রাহমিন’স স্যাকরেড থ্রেড ।

          –এই যে, খামে ভরে রেখে দিয়েছে ক্যাশিয়ার ।

            পৈতের খামটা পকেটে পোরে অতনু । বাবা কালীঘাটে নিয়ে গিয়ে দিয়েছিলেন । মন দিয়ে ভেবে দ্যাখেনি এতদিন, রুটিনের মধ্যে আটক থেকেছে, বোকার মতন পৈতে পরে থেকেছে, মানে হয় না কোনও । অরিন্দম তো পাগল হবার আগেই ফেলে দিয়েছে । সুশান্ত নিচু জাতের কচি মেয়ের সঙ্গে নিশ্চই মানিয়ে নিয়ে সংসার করছে । আমিই যতোসব ফালতু আচার-বিচারে আটকে থেকেছি ।

         –আপনাকে বর্মা মানে মাইনামার আর বাংলাদেশ থেকেও ঘুরিয়ে আনতে পারি । যাবেন নাকি ?

          –আমার তো পাসপোর্ট নেই ।

           –ওসব দরকার হয় না, লোকে দুবেলা যাচ্ছে আসছে ।

গোঁজ হয়ে বসে থাকে অতনু, হাঁ-মুখ সামান্য খোলা, নেশার অনভ্যাস, ভাবছিল । সুযোগ হাতছাড়া করা বোকামি । জীবনে অনেক সুযোগ হারিয়ে যায়, আর আসে না, বুড়িয়ে মরে যায় মানুষ । মুখার্জি ছিল যতদিন, হাতছাড়া করেনি,সুযোগ, জল ঝড় জ্বর ক্লান্তি শরীর খারাপ হাঁচি-কাশি যা-ই হোক, । অরিন্দম নিয়েছে ছোটো-ছোটো সুযোগের সকাল দুপুর সন্ধে, হয়তো না ভেবেই, মেরুর টান এড়াতে পারেনি । অসময়ের ফল আর আনাজ এনে ব্যবসা করত সুশান্ত । সুযোগ, সুযোগ, সুযোগ ।

         –হ্যাঁ, যাবো, যাবার আগে জুতো কিনতে হবে ।

         –চলুন আমার কেবিনে গিয়ে বসবেন । ঠিকমতো আয়েস করতে পারবেন ।

কার্পেট পাতা বিরাট কেবিন । অনেক বড়ো টেবিল । বেশ উঁচু গ্রেডের ম্যানেজার তার মানে । কথাবার্তায় আচরণে টের পাওয়া যাচ্ছিল না । সোফায় আধশোয়া, তন্দ্রার কুয়াশায় ভেসে বেড়াচ্ছিল অতনু । কাচের পার্টিশানের ওধারে, দেখল, আধভেজা চাউনি ভাসিয়ে, পাথরঘষা প্যান্ট আর স্পোর্টস জুতো পরা বাবরিচুল কর্মচারীরা ঢুলু চোখে, জলভেজা স্পঞ্জে আঙুল ছুঁইয়ে, ও নিজে যেমন গুনত চাকরিতে নতুন ঢুকে, অলসচাকা মেশিনের ঢঙে গুনে চলেছে একের পর এক প্যাকেট । কাউন্টারে মহিলা কর্মী সোয়েটার বুনছে সবুজ উলে, সবুজ গোলাটা উল ছেড়ে-ছেড়ে পাক খাচ্ছে মেয়েটার কোলে । ম্যানেজার মগ্ন চারভাঁজ সংবাদে । জীবন সব জায়গায় বোধহয় একইরকম । এই প্রবাহকে বিরক্ত করে এগিয়ে চলে, রেশ কাটাতে-কাটাতে, মানুষের সমাজ । সত্যি, অতনুর মনে হচ্ছিল, বাস্তব ব্যাপাটাই আজগুবি ।

         লাঞ্চ করতে গেস্ট হাউসে ফিরে ভাত আর মুরগির মাংস ভালো লাগল অতনুর । বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওব্দি খাওয়া হয়নি ঝরঝরে গরম ভাত । রুটি পাঁউরুটি চপ সিঙাড়া ওমলেট কাটলেট ফুলুরি লুচি চিনেবাদাম পেঁয়াজ-মুড়ি খেয়েছে, পেলে চার বেলা, না পেলে অভুক্ত । পেটের ভুটভাট ভাতের ধবধবে শরীর দেখে থেমে গেছে । খেতে-খেতে নজরে পড়ল, টেবিলের ওপর পার্স আর চাবি, বিছানা গোছগাছ । হাত ধুতে গিয়ে টয়লেটে দেখল গেঞ্জি আন্ডারওয়্যার কেচে অ্যালুমিনিয়াম আলনায় মেলে দেয়া ।  ট্রেনের ধুতি পাঞ্জাবি নেই । ভালো লেগে উঠল এক ঝলক ।

             আর ব্র্যাঞ্চে ফিরে না গিয়ে, কুঁকড়ে চাদর চাপা দিয়ে, গান শোনার ঠুলি আর যন্ত্র বালিশের পাশে, জামা-ট্রাউজার পরেই শুয়ে পড়ল অতনু । দেয়ালে মুখ গোঁজ করা ঘড়িতে দুপুর একটা, পাটনার দুপুর, এখানে বিকেল হয়ে এসেছে । ঘুমিয়ে পড়েছিল ।

             আবছা রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে, মুখ বের করে দেখল, গোধুলীর আলোরাঙা প্রায়ান্ধকার, জুলি একটা ট্রানজিসটার হাতে, শিয়রে রেখে বলল, ‘ঢাকা, বাংলাদেশ, তোমার গান।’ মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে…

         মেয়েটির কথায় কাঁজি ভাতের স্নিগ্ধ সুরভি । অতনু বলল, প্রায় স্বগতোক্তি, কিন্তু আত্মসমর্পণের স্বরে, ‘তোমার দাঁত কত সুন্দর।’ ধন্যবাদ জানিয়ে চলে যায় মেয়েটি । কেমন রেশমের মতন মসৃণ চুল । যমের তেজ দিয়ে এই চুলই তৈরি হয়েছিল নিশ্চই । বুক ? চাঁদের আলো দিয়ে হয়তো গড়া । বরুণের বরাভয় দিয়ে পায়ের গোছ আর উরু । এ বাড়ির একজন যুবতী সম্পর্কে এরকম চিন্তাধারা অনুচিত । কিন্তু কী করবে, ভেবে ফেলছে যে ! ইনডিয়ান ডগ হয়ে গেছে ভেতরে ভেতরে ।

          জুলির ডাকে ঘুম ভাঙল অতনুর । কপালে হাত রেখে মুখ নামিয়ে আলতো বলেছিল, ‘স্যার।’ এত নিকট থেকে এর আগে কখনও দেখেনি কোনো যুবতীকে, কোনো মহিলাকে, মাকে ছাড়া । কেমন বিসদৃশ অচেনা গন্ধ এর উপস্হিতিতে, বুনো আর তেতোতেতো অথচ আকর্ষক । বিব্রত ও, অতনু । উঠে বসে ধড়মড় ।

‘চলো আমাদের সঙ্গে চা খাবে ; একা-একা তোমার সময় কাটবে না, মুখ ধুয়ে নাও ।’ বলল জুলি, সামান্য হাসি, লিপ্সটিকহীন গোলাপি ঠোঁটে ।

         মুখ ধুয়ে জুলির সঙ্গে নিচে নামল অতনু । নিচের তলাটা দেখার ইচ্ছে ছিলই । কতজন থাকে । কে কী করে । আর ক-জন আছে গেস্ট হাউসে । ঘরগুলো কেমন সাজানো । বাড়ির লোকেরা কোন ভাষায় কথা বলে, কেমন লাগে শুনতে । তাছাড়া, কোনো যুবতীকে সম্পূর্ণ জানতে গেলে তার বাড়িটাও দেখতে ইচ্ছে করে, মনে হল ওর ।

         হলঘর । একপাশে রান্নাঘর । অন্যপাশে বোধহয় দুটো শোবার ঘর । হলঘরে জানলা নেই । হলঘরেই, রান্নাঘরে ঢোকার মুখে, গোল ডাইনিং টেবিল ঘিরে ছটা গথিক ঢঙ চেয়ার, শোবার ঘরের দিকটায় বাদামি ফোমলেদারের ঢাউস সোফার দুপাশে টিপয়ের ফুলদানিতে বেগুনি রঙের অচেনা ফুলের তোড়া, সুগন্ধ বিলোচ্ছে ফুলগুলো, বা হয়তো জুডি । রান্নাঘর থেকে জুডি বেরিয়ে এসে, ‘হভালো’ । অতনুও ‘হ্যালো’ প্রত্যুত্তর দিয়ে সোফার দিকে বসার জন্য এগোতে, জুলি বলে উঠল, ‘স্যার, কিচেনে এসো, আমাদের সাহায্য করবে ।’ রান্নাঘরে ঢুকে, জানলা দিয়ে দেখল অতনু, সন্ধ্যাকাশে গুটিগুটি বেরিয়ে পড়েছেইসকাপন রুইতন চিড়িতন হরতনের দুরি তিরি নওলার দল ।

         অতনু : আমি তো কিছু করতে জানি না, কী সাহায্য করব ?

         ‘কেন ? বাড়িতে কোনও কাজ করো না ?’

         ‘বাড়িতে তোমার কে-কে আছেন ?’

         অতনু : মা আছেন ।

         ‘মাকে সাহায্য করো না ? উনি একলাই সব করেন ?’

        ‘বাবা নেই ? ভাই-বোন ?’

         অতনু : না, কেউ নেই । বাবা আত্মহত্যা করেছিলেন । উনি মারা যাওয়ায় এই চাকরিটা পেয়েছিলুম ।

‘তোমার বাড়ির বেশ দুঃখের গল্প আছে, না ? বোলো আমাদে, পরে । এখন আমাদের সাহায্য করো । বাড়ি ফিরে গেলে মাকে সাহায্য করতে পারবে । এক মাসে আমরা তোমায় অনেক কাজ শিখিয়ে দেবো । তোমার মাকে বলতে পারবে, অনেক সাংসারিক কাজ শিখে এসেছ । মায়ের শরীর খারাপ হলে একাই সামলে নিতে পারবে ।’

‘আচ্ছা, দেয়ালে মিলিটারি পোশাকে ওই ফোটোটা কার ?’ প্রসঙ্গে পালটাতে চায় অতনু । জুলি-জুডির কথা শুনে প্রথমবার ওর মনে হল যে সত্যিই তো, মাকে সাহায্য করা উচিত ছিল ওর; কখনও তো ভেবে দেখেনি যে মাকে সব কাজ একা করতে হচ্ছে ; বাবা তো মাকে কত রকমভাবে সাংসারিক কাজে সাহায্য করতেন ।

         বহুকাল পর, ফিরে যাবার কয়েকদিন আগে, ছুটির দিনের সকালে, ফোটোটা কাছ থেকে দেখে, বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিল ও, অতনু । বিপর্যস্ত আর হতচকিত ।

         ‘ফোটোটা আমার বাবার ।’ জুলি জানিয়েছিল, যে কথার মধ্যে, বলবার ঢঙে, বেশ বোঝা গিয়েছিল, কেমন যেন এক ধাঁচের জাতি-স্বাতন্ত্র্যের অহংকার । জুডি বলেছিল, ইনডিয়ান আর্মির হাতে মারা যান ।’

         এখন, ফোটোর কাছ থেকে সরে এসে, প্রসঙ্গ বদলাতে নিজেকে বাধ্য করল অতনু । চোট্টো ট্রানজিসটারটা দেখিয়ে, ‘এই হিন্দি গানটা সিমন গারফাংকেলের এল কোনডোর পাসার নকল । আর বলে ফেলেই, ফিরে এলো প্রসঙ্গটায়, ‘তোমার বাবার মানে ? জুডি তো তোমার বোন !’

         ‘আমাদের মা এক কিন্তু বাবা আলাদা ।’

         ‘মা-ও মারা গেছেন বুঝি ?’

         ‘না, ঠিক জানি না, মাও আবার বিয়ে করেছিলেন । তুমি কি গানের বিষয়ে পড়াশোনা করেছ ?’

         ‘এস পি মুখার্জি, আমাদের অনেক বড়ো অফিসার, ওনার কাছে হাতেখড়ি ।’ প্রতি রাতে সন্ধে সাতটায় মৃদুমন্দ আলুলায়িত গান, আর নিশি পাওয়া পারফিউম, আর শীতাতপ বিছানা, আর মনমাতানো নারীদের গল্প, দু’জন অবিশ্বাসী কাহিনিখোরের চাউনিকে পুলকিত করে, বিস্ফারিত শোনালো ও, অতনু । দাশগুপ্তের গল্প । অরিন্দমের গল্প ।

         ‘ভালোবাসা চিরকাল ক্ষণস্হায়ী ।’

         ‘আর ক্ষতিকর ।’

         প্রখর মন্তব্যে অতনু থ । হালকান । বোঝার চেষ্টা করে দু’জন যুবতীর অগাধ দৃষ্টির থমথমে চপলতায় অভিজ্ঞতা নাকি শিক্ষা নাকি প্রতিদিনের গতানুগতিক যাপন, কোন ঝড়ের কেন্দ্র জুগিয়েছে এমন আপোশহীন মন্তব্যের আশ্রয় ! নিজেকে কেমন যেন অনুগ্রহভাজন মনে হল । কেমন যেন অবাক শিহরণ । কেমন যেন অকথিত রোমাঞ্চ । কেমন যেন মুক্তির আবেশ । কেমন যেন সমুদ্র-তলদেশের তোলপাড় । কেমন যেন উৎকন্ঠা, উদ্বেগ, শঙ্কা ।

         ‘পেঁয়াজের পাতাগুলো ছোটোছোটো করে কাটব ?’

         কাঠের ক্ষয়ে যাওয়া চৌকো তক্তার ওপর ছুরি দিয়ে পেঁয়াজ কাটে অতনু । বরবটির মতন দেখতে অথচ ছোটোছোটোসবুজ সবজি কাটে । টোমাটো । ডিম ফাটাতে শেখে । চামচে দিয়ে ফেটাতে । আলু আর গাজর ছাড়াতে । শুয়োরের মাংস ধুতে, চাল আর ডাল বাছতে । শুয়োরের মাংসে খিছুড়ি, রেঁথে গর্ব হয় অতনুর । দুজনের দেহের সঙ্গে ছোঁয়ায় অতনু পুলকিত হতে থাকলেও, কাজে উৎসাহিত হতে থাকলেও, ওরা তা নিয়ে  একেবারেই চিন্তিত নয়, অস্বাভাবিক মনে করছে না । অতনুকে সহজ করে তুলতে চাইছে ওরা, বাড়ির একজন সদস্য করে তুলতে চাইছে, মনে হল ওর ।

         কুকারে শুয়োরের মাংস সেদ্ধ হবার নির্ধারিত সময়ের অপেক্ষায় যখন ওরা তিনজন খাবার টেবিল ঘিরে, আলো জ্বালানো হয়নি হলঘরে, নিজের বাড়ির গল্প করে ফেলেছে অতনু, রাঘব আর রমা বৌদির, সুলতানা আর ননীদার, মানসী বর্মণের রূপের, শ্যামলী কর্মকারের ঠেকার আর পিঠে প্রজাপতি-জড়ুলের, পিওন রসিক পাসওয়ানের আঙুলকাটার, ইন্দিরা গান্ধির হাতির শুঁড়ের ধাক্কায় সুশান্তর গরদান ঘুরে যাওয়া, শিমুলতলা, পাপড়ি বোস, নির্মল মাহাতো, তখন হঠাৎ ট্রানজিসটারে একটা হিন্দি গান আরম্ভ হলে অতনু বলল, ‘এই গানটা বিটলসদের অ্যাণ্ড  আই লাভ হার সুরের নকল ।’

         অতনুর এই প্রথম খেয়াল হল যে, গান ওর ভালো লাগত না, গান সম্পর্কে জ্ঞানও, তা ভেবে দ্যাখেনি, আশ্চর্য । এই যুবতী দুজনের ক্ষণিক সঙ্গও ওকে গানের দিকে টেনে নিয়ে চলেছে ; এদের ছোঁয়ায় রয়েছে সঙ্গীতের উৎস । এতকাল ও একাকীত্ব এনজয় করত, নিঃসঙ্গ থাকতে ভালো লাগত, সকলের সঙ্গে কথা বলতে চাইত না । নিজস্ব একাকীত্বের পরিসর তৈরির জন্য কানে গানের ঠুলি দিয়ে রাখত যাতে কেউ যেচে কথা বলতে বিব্রত বোধ করে ।

          রান্নাবান্না হয়ে গেলে অতনু শিখল, যেন ও প্রথম নাচতে শিখছে, কেমনভাবে থালা বাটি গেলাস চামচ ছুরি কাঁটা সাজানো হয় টেবিলে । রান্নাঘর পরিচ্ছন্ন । গোছগাছ । খাবার টেবিলের আসেপাশে মেঝেতে পড়ে থাকা নোংরা পরিষ্কার । ওরা দুজনে হাতমুখ ধুয়ে পরিচ্ছন্ন হতে গেলে, এত সহজে এত কথা বলতে পারছে বলে আত্মতৃপ্তির স্মার্টনেস অনুভব করছিল অতনু ।

         দুজনে প্রায় একই সময়ে বেরিয়ে এলো নিজেদের ঘর থেকে, চুল আঁচড়ে, পোশাক পালটে, পারফিউম লাগিয়ে, লিপ্সটিক বুলিয়ে । দাঁড়িয়ে অপেক্ষারত আনমনা অতনুর দুপাশ থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে, তার দুগালে ঠোঁট চেপে ধরে দু’জনে, দুদিক থেকে একই সঙ্গে, আর তক্ষুণি, হৃৎপিণ্ডের শীতল রক্তউচ্ছ্বাসে, ঝলকের মতন, ও, অতনু, টের পায়, এটা হোটেল নয়, গেস্ট হাউস নয় ; এটা আসলে ভূতল দেহগ্রাহকের গোপন পান্হশালা । ওর মনে হয়, ও গভীর বিপদে পড়তে চলেছে, ও এই বিদেশ-বিভূঁয়ে একবারে একা, আর ফিরে যেতে পারবে না, ওর পায়ের আঙুলগুলো ঠাণ্ডা, বাঁ দিকে গলার কাছ থেকে ফুসফুস হয়ে তলপেটের দিকে নেমে যাচ্ছে হাজার হাজার বরফের পিঁপড়ে ।

         তাহলে তাই হোক, নিজেকে নিঃশব্দে বোঝাল অতনু, দুদিকে দুজনের কাঁধে বাহু রেখে নিজের ভার ওদের ওপর ছেড়ে দ্যায় ও, অতনু । ওরা ওকে এনে যখন সোফায় বসাচ্ছে, ওদের মুখের ভেতর থেকে, একেবারে হাঁ-মুখের আলজিভ থেকে, প্রথম বৃষ্টির সোঁদা মোহক গন্ধে দীপায়িত নিজের শারীরিক সমর্পণ স্বীকার করে অতনু । এই দুটি তরুণীর মাধ্যমে নিজেকে ব্যঞ্জিত করতে পারছে ।

         : তুমি কি নার্ভাস ?

         : না, আমার যেন কেমন ভয় করছে, যেন এক্ষুণি একদল লোক দরোজা ভেঙে ঢুকে পড়বে আমার খোঁজে, জবাবদিহি চাইবে, বলবে আমি সীমালঙ্ঘন করছি ।

         : যাঃ । অনেক রাত হয়েছে, এখন আর কেউ জেগে নেই ।

         : জানি ।

        : অল্প ড্রিংক করো । ওয়াইন খাবে ? শেরি ?

         : আমি বরং একটু হুইসকি খাবো । কালকেরটাই ।

         অতনু অল্প আর ওরা দুজনে তার দ্বিগুন হুইসকি খায়, রয়ে-সয়ে । তারপর গরম গরম খিচুড়ি । আড়ষ্টকন্ঠে বলে ওঠে, ‘ভালো হয়েছে।’

          : তবে ? তুমি বলছিলে শুধু ডিম আর মুরগি খাও ।

          : চুপ করে গেলে কেন ? তোমার গল্প বলো ।

           অতনু : মিথ্যে কথা আমি বলি না । বলে ফেলে খারাপ লাগছিল । আর মা মাছ-মাংস খান না, তাই বাড়িতে হয় না কিছু ।

          : ওসব হোটেলে-রেস্তরাঁয় খাও ?

         মছুয়াটুলির মহংগুর দোকানের গল্প বলে অতনু । পিন্টু হোটেলের গল্প । চাঁইটোলার দাদুর দোকানের আড্ডা । ডাকবাংলো মোড়ে কফিহাউস । আধখ্যাঁচড়া কালীদাস রঙ্গালয় । রবিন্দ্রভবনে নাটক । সালিমপুর হাহারার এই এম এ হল-এ অফিসকর্মীদের নাচগান । লঙ্গরটুলির দুর্গাপুজো । সবজিবাগে চর্বিদার পাঁঠার মাংস । সেই চর্বির পরোটার দোকান । গঙ্গা, গোলঘর, সোমবারী মেলা । এদের মনের পৃথিবীকে অন্য জগতে নিয়ে যেতে চায় অতনু ।

         : তুমি কি সাপের মাংস খেয়েছ ? রাঁধব একদিন ।

          অতনু : ব্যাঙ হরিণ খরগোস কচ্ছপ হাঙর খেয়েছি । গোরু শুয়োর মোষ সাপ বেড়াল কুকুর এসব খাইনি ।

          : আমরা খাওয়াব তোমায়, যদি পাওয়া যায় ।

         : খাবার সময়ে টের পাবে না কিসের মাংস ।

         মুখ ধুতে গিয়ে অতনু বুঝতে পারে, এই যুবতীদের সামনে কুলকুচি করতে ওর লজ্জা করছে । তাই অস্বাভাবিক কায়দায়, যাতে বিশেষ আওয়াজ না হয়, আলতো কুলকুচি করে । পায়ের ধাপ সামান্য ভিন্ন পড়তে, ওর মনে হল টলছি না তো, এরা ভাবছে না তো যে এই সামান্য মদ খেয়ে নিজেকে সামলাতে পারেনা, কেমনতরো মরদ !

         দুজনে দুদিক থেকে টলায়মান অতনুর বাহু আঁকড়ে, ওকে ওপরের ঘরে নিয়ে যায় । সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে, ওর দুই হাত দুই যুবতীর বহরে, ওদের পোশাক ঝাপটাচ্ছে অতনুর গায়ে, একজনের শরীরগ্রন্হির বুনো আর তেতো সুগন্ধ বেসামাল করে ফেলছে, বুকের মধ্যে আবার আরম্ভ হয়ে গেছে অদৃশ্য শুশুকদের জলঘাই।

         ওর ঘরে হিটার চালিয়ে রেখে ঘর গরম করে রাখা হয়েছে । উষ্ণতার তাপে অতনু আশ্বস্ত হয় । কে জুলি আর কে জুডি খেয়াল থাকে না । দুজনের মুখের দিকে তাকালে, তাদের ইশারাময় হাসির সঙ্গে পরিচিত হয় ও, অতনু ।

         শিয়রের বন্ধ জানলার শার্শি তখন দুহাত দিয়ে কচিশীতল কুয়াশা মাখছিল মুখে । অতনুর বুকের বাঁ দিকে নৃত্য পরিবেশন করছিল উদীয়মান ঘুর্ণি ।

         ওরা দুজুনেই সোয়েটার খুলে কাঁধের ওপর থেকে নিজেদের বসন, যেন কোনও আলতো ফাঁসে ধরা ছিল এতক্ষণ, ফেলে দেয় মেঝেতে ।

         বিস্ফারিত শিহরণে স্তম্ভিত অতনু । আজ ওব্দি ও যুবতী শরীরের এতখানি দ্যাখেনি । হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে । দু-বাহু দিয়ে দু-জোড়া করুণাময়ূ উরুর প্রীতিকর তাপ নিজের গাল কপাল ঠোঁটের ওপর চেপে ধরে বারবার, আর চেপে রাখার চেষ্টা সত্ত্বেও, ডুকরে ওঠে নিঃশব্দে ।

         ‘এ কী,কী হল ?’

         তার চোখের জল ওদের সুঠাম সাবলীল উরু থেকে নিজের কপাল দিয়ে মুছে দিল অতনু । ওকে তুলে দাঁড় করায় ওরা । ওর পোশাক খুলতে সাহায্য করে দুজনে, আর বিব্রত উদোম অতনুকে জিগ্যেস করে জুলি, ‘অমন দিশেহারা হয়ে উঠেছিলে কেন ?’ যার উত্তরে অতনু বলতে পেরেছিল, ‘জানি না’ ।

         ব্যাকুল উষ্ণ করে-তোলা শীতের অনুসন্ধিৎসু প্রায়ান্ধকারে, দুজন মানুষীর সারীরিক গর্বের আলোকছটায়, নগ্নভাবে প্রকাশ হয়ে পড়েছিল অতনুর দুর্বল নগ্নতা ।

         ‘তুমি ব্যায়াম করো না ?’

         ‘না’, বলল অতনু, বিচারবুদ্ধি নষ্ট আর ন্যায়-অন্যায় বোধ লোপ পাবার মুহূর্তটায় ঘাপটি মেরে থাকা তীব্র আনন্দের মাঝামাঝি সম্ভাব্য বিপদের প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে ।

        অতনু ওদের পারস্পরিক আর ওকে বলা কথা শুনতে পাচ্ছিল না । বিস্ময়ে, ঢেউ-খেলানো দু-রকমের নয়নাভিরাম বুক, গোলাপি আভায় চোবানো দু-জোড়া ছোটো-বড়ো বৃন্ত, চুনিপাথরের প্রাণপ্রাপ্ত পুঁতি । ঘোরলাগা অসহায় স্পর্শ চালিয়ে, পরখ করে সুডোল নাভি, কোমরের অনর্গল পাক, বুকের পাশ থেকে লতিয়ে ওঠা প্রবাহিত বাহুমূল, মসৃণ থুতনি, তুলতুলে গাল, পিঠ থেকে দৌড়ে নেমে সহসা উঁচু হয়ে ওঠা নরম মাংস, দু-উরুর মাঝখানে সংবেদনশীল সযত্নলালিত রহস্য, আঙুলের ফাঁকে গলে-যাওয়া পশম । ব্রহ্মাণ্ডকে মালিকহীন মনে হয় অতনুর । মায়ের আঁচল ভিজিয়ে মুখ পুঁছে দেবার স্মৃতি, এতকাল পর, একেবারে আচমকা, ফিরে আসে ।

         অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, আলাদা-আলাদাভাবে, নারীশরীরের সমগ্রতা থেকে পৃথক, এত আকর্ষণীয়, এত প্রিয় এরকম স্নিগ্ধ হতে পারে, জানা ছিল না । সত্যি জানত না ও, একজন মেয়েমানুষের রহস্যের সঙ্গে, এমনকি সে যদি বোবা কালা অন্ধ নুলো খোঁড়া হয়, তাহলেও আরেকজনের সঙ্গে মিল হয় না ; প্রত্যেকে সম্পূর্ণ একটি ভিন্ন রহস্যজগত ।

         : কত তফাত তোমাদের দুজনের মধ্যে ।

         : তোমার পছন্দ ?

         : এই অনুভূতিকে বোধহয় পছন্দ বলে না ।

         : এসো, শুয়ে পড়ি ।

         : তিনজনে কুলোবো ?

         : শীতকাল তো ; শীত বাড়তে থাকবে রাতে; শীত তো মানুষের ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে তোলার ঋতু ।

রুমহিটার নিভিয়ে শুয়ে পড়ল তিনজনে । দুজনকে দুপাশে, ফ্যারাওয়ের দুই বাহুতে মাথা রেখে দুই মিশরীয় রাজমহিষী, কম্বলের তলায় শুয়ে পড়ার পর, দুদিক থেকে দুজন হাঁটু তুলে দিল অতনুর উরুর ওপর ।

         : তোমার কিছু হচ্ছে না ? ইচ্ছে করছে না ?

         : করছে । কিন্তু তোমরা যে দুজন ।

         : তুমি কাকে চাও ।

         : দুজনকেই ।

         : আগে কাকে চাও ।

         : একসঙ্গে দুজনকে ।

         : কী করতে হবে জানো ?

         : পেরে যাব মনে হয় ।

         : আগে জুডিথের পালা, ও ছোটো তো, ও তোমাকে দেখিয়ে দেবে । তোমার সামন্য ছড়ে যেতে পারে । জ্বালাও করতে পারে । ভয়ের কিছু নেই । প্রথমবার সকলেরই হয় । তোমাকে গোলাপি রঙের ভ্যানিলা-গন্ধের কনডোম পরিয়ে দেবে । কাল থেকে তুমি নিজের ইচ্ছেমতন কনডোম বেছে নিয়ে পোরো, কেমন?

         : বুঝে গেলে তো জুলি যা বলল ? আমি তোমার ওপর বসব । তোমার কষ্ট হবে না তো, আমার ভারে, অতনু ? যখন তুমি আর আমি উত্তেজিত হতে থাকব, তখন তুমি ওঃ জুডি, আহ জুডিথ, আমি তোমায় ভালোবাসি, কোনওদিন ছেড়ে যাব না, তোমায় ছাড়া বাঁচব না, উঃ ওফ, এই সব আবোল তাবোল বকতে থেকো । আমিও তোমার নামে অমন করেই বলতে থাকব । এটা শিষ্টাচার ।

         জুডি দুই পাশে দুই পা ছড়িয়ে বসলে, ও নির্ধারিত প্রক্রিয়া আরম্ভ করে, প্রতিদানে জুডিও, অতনু ঘামতে থাকে, বলতে থাকে শিষ্টাচারের কথাগুলো, মনে হয় নিজের কথাই বলে চলেছে যা কাউকে কখনও বলা হয়ে ওঠেনি, জমে থেকে গিয়েছে মগজে, এলিয়া পড়ে জীবনের প্রথম নারীকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে । মনে হয় স্ফূর্তির অতীত এই পাথেয় । জুডি নিজের জায়গায় ঢলে পড়ে । অতনু জুডিকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে । জুলি ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে থাকে ।

         কিছু পরে ঘুম ভেঙে যায় সেই তীব্র সন্মোহক সুগন্ধে, বুনো আর তেতোতেতো । পাশ ফিরে শুয়ে আছে জুডি । অগোর । ঘুমন্ত ঠোঁটে চুমু খেয়ে জুলির দিকে পাশ ফিরে ও, অতনু, দ্যাখে, জুলি মিটিমিটি জেগে । হাত ধরে অতনুকে নিঃশব্দে বিছানা থেকে নামায়, আর চিৎ হয়ে হাঁটু উঁচু করে শুয়ে পড়ে মেঝেতে আগে থাকতে পাতা ধূসর তোয়ালের ওপর । শাঁখনীলাভ উপশিরার কারুকাজ করা চাপা অথচ বর্তুল বুকে মাঝে ক্রুশবিদ্ধ যিশুর সোনালি লকেট নজরে পড়ে অতনুর । টের পায় জুডি কেন শ্রমটা নিজের দেহে নিয়েছিল ; যাতে জুলির জন্য অতনুর দেহে যথেষ্ট ক্ষমতা বজায় থাকে । এলিয়ে পড়ে কিছুক্ষণ পর, টের পায় অতনু, গন্ধটা আর নেই । পরস্পরকে জড়িয়ে থাকার সময়ে জুলি অতনুর কানে ফিসফিস করে জানা্য়, কালকে আমরা তোমাকে ফোএপ্লে শিখিয়ে দেবো, মেয়েদের অরগ্যাজম একটু সময় নিয়ে হয়, তাই আমাদের জন্য ফোরপ্লে করতে হয়, তারপর তোমার উৎসার,  ।

         পালঙ্কে উঠে চাপা দিয়ে তিনজনে ঘুমিয়ে পড়ে পাশাপাশি ।

          তারপর, প্রথমে কুন্ঠা বোধ করলেও, অতনু মুখমেহন করতে আর করাতে শেখে ; এ এক নিভৃতির রসিক বালখিল্য । ওরা গিলে ফেলছে দেখে ও, অতনুও গিলেছে ; দুজনের স্বাদ এক্ষেত্রেও আলাদা, যেমন  বৃন্তকে ঘিরে গোলাপি বৃত্তের মাপ আর রঙ দুজনের আলাদা ।

          নিজের সামনে নোট গোনাবার আগ্রহ, কর্মচারীদের গাফিলতির আশঙ্কা, তাড়াতাড়ি কাজ মিটিয়ে ফিরে যাওয়া, এসব উবে গেছে অতনুর ভাবনা থেকে ।

         এসে মাকে পৌঁছানো সংবাদ দিয়েছিল একটা, তারপর আর জানা্য়নি । ম্যানেজারের নাম রোসাংলিয়ানা, ওর একটা হোটেল আছে নেপালি পাড়ায়, তবুও সেখানে থাকতে বলেনি ।

         ওপন এয়ার টিকিট কিনে দিয়েছিল, পাওনা মিটিয়ে দিয়েছে অতনু । বাকি পুরো টাকা, করকরে নোট, দিয়েছে জুলি-জুডিকে । ছুটি বাড়িয়েছে আর মাইনে চেয়ে নিয়েছে স্টেট ব্যাঙ্কের মাধ্যমে, সেই করকরে নোটগুলো দিয়েছে জুলি-জুডিকে । যেদিন ওরা তাড়িয়ে দেবে ফিরে যাবে অতনু । তার আগে ও কিছুতেই ফিরবে না । ছুটি নেবে । দুজনকে একসঙ্গে ভালোবাসবার ছুটি । এই অভিজ্ঞতা ফিরবে না ।

          কাজ শেষ হয়ে যাবার পর, কাগজপত্র বুঝে নেয়া হয়ে গেছে, অসুস্হতার অজুহাতের একমাসের ছুটি ফুরিয়ে যাবার পর, আরও এক মাস ছুটি নিয়েছে অতনু । মাকে জানিয়েছে, জায়গাটা ভালো লেগেছে, মন আর শরীর দুইই ভালো ।

          এখানে এসে অতনু কেবল দাড়ি কামিয়েছে ; চুল কাটায়নি । ওর দীর্ঘ শ্যাম্পু-করা চুল আঁচড়ে পেছন দিকে রাবার-ব্যান্ড বেঁধে দ্যায় জুলি বা জুডি ।

         যৌনতার অপ্রতিরোধ্য অলিগলি দিয়ে, প্রতি রাতের নতুন আঙ্গিক, ফোরপ্লে, কখনও-সখনও ওর আবদার মেটাতে দিন দুপুরে, সম্পূর্ণ আলাদা এক সংস্কৃতির একেবারে মদ্দিখানে, একটু-একটু করে সেঁদিয়ে যায় ও, অতনু — পান-ভোজন, চার্চ, সংস্কার, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, কুসংস্কার, নিয়ম-রীতি, সামাজিক আচার, পোশাক-পরিচ্ছদ, ভয়-ঘেন্না — এ এল আলাদা জগতের সংসার ।

         ওরা বিহারকে ভালো চোখে দ্যাখে না । রোজ খুন ধর্ষণ বজ্জাতি । বলেছে, ‘কী করে থাকো ? ভয় করে না ?’ অথচ আসার সময়ে এই উত্তরপূর্বের অরাজকতার ভয় দেখিয়েছিল অফিসের অনেকে । কোথাও আসলে ভয়ের কিছু নেই । যে ভিতু সে মায়ের গর্ভেও ভয়ে-ভয়ে থাকে, এই বুঝি বাপের জাদুদণ্ড এসে আহত করবে তাকে । স্মৃতিকে বঞ্চনা করে ভয় পায় মানুষ, ভয় তাকে অপরিণতমনা করে তোলে, ভালোবাসতে বাধা দ্যায় ।

         জুডি-জুলির সঙ্গ না পেলে কেবল এই অঞ্চলই নয়, মানবজীবনের বহুকিছু অজানা থেকে যেত ।

         অতনুর মনে হয়েছে, সৌন্দর্য ব্যাপারটা আপেক্ষিক । আকর্ষণও আপেক্ষিক । বিহারি বা বাঙালি যুবতীদের বুক কত তাড়াতাড়ি আদর করার ব্যাপার থেকে দুধ খাবার জিনিস, বিয়ের আগে উনিশ কুড়িতে যেতে যেতেই । এখানের মেয়েমানুষদের আদর করার বুকের সঙ্গে দুথ খাবার বুকের তেমন তফাত নেই । বৃন্তকে ঘিরে বর্তুল চক্রের রঙও তো সকলের এক নয় ।

          মানসী বর্মণের বুক কি ঢাউস । লঙ্গরটুলিতে, রাজেন্দ্রপথের আশ্রমে, গরদানিবাগে, কদমকুঁয়ায়, পুজোর সময়ে ঢাউস বুকের বাঙালি যুবতীরা দুর্গাকে পুষ্পাঞ্জলি দ্যায়, দুর্গার চেয়ে, লক্ষ্মী-সরস্বতীর চেয়ে, তাদের অবিবাহিত পীনোন্নত বুক উঁচিয়ে । গঙ্গাভিলায়, দুর্গা সরস্বতী লক্ষ্মীর বুক কিছুটা বড়ো করা হতো পারিবারিক পরম্পরা অনুযায়ী, কিন্তু ফ্ল্যাট বাড়ি করে পয়সা করার ধান্দায় সে পুজো উঠে গেছে । কলকাতায় পালিয়েছে গঙ্গাভিলার ছেলেরা । হয়তো সেখানে গিয়ে পারিবারিক পরম্পরা দান করেছে কোনো পাড়ার পুজোর প্রতিমাদের। ছটের সময়ে বিহারি বুকেরও একই হাল ।

         গঙ্গা ভিলার নতুন ফ্ল্যাটবাড়িতে অতনুর বাংলা ভাষা-সাহিত্যের অধ্যাপক-অধ্যাপিকা জিতেনবাবু আর বেলাদি থাকতেন, তাঁদের অবিবাহিত লিভ-ইন সংসারে  শ্রীঅরবিন্দ আর শ্রীমার নৈতিক সমর্থন জুগিয়ে । পাটনা শহরের প্রথম যৌনপ্রগতিবাদী । পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সব বাংলা ভাষার অধ্যাপকদের থেকে আলাদা ; এনারা দুজনে ছিলেন বেঁচে থাকার জ্ঞানী । তারপর থেকে এসেছে একের পর এক চাকুরে অধ্যাপক ।        জীবনে ভালোবাসা না পেলে বোধহয় মাতৃভাষাকে ভালোবাসা যায় না ।

         অতনু মূর্খের জীবন চায়নি । চেয়েছে রক্তমাংসের গূঢ় তাৎপর্য ; বর্তমানকে ভালোবাসতে চেয়েছে । অতীতের প্রতি ওর উদাসীনতা নেই, নেই চিন্তার প্রতি অবিশ্বাস । জুলি-জুডিকে সাহায্য করে সংসারের কাজে । কুটনো কোটে, রান্না করে, মশলার আন্দাজ, ভাত রাঁধা, বাসন মাজা, ঝাঁট দেয়া, ঝুল ঝাড়া, কাপড় কাচা, ইসতিরি করা, এমনকি জুলি-জুডির পোশাক আর অন্তর্বাসও, মেঝেতে পাতা রাতের তোয়ালে, সারা দিনমান ব্যস্ত । বাজারে গেলে কানাঘুষোর উৎপাত সম্ভব, তাই ওরে যেতে দেয়নি ওকে ।

         অতনু চেয়েছিল ওদের সঙ্গে নিয়ে বেরোয় । ব্যায়াম করে সকালে । আঁটো পোশাক পরে ওরা দুজনেই করে ; যখন একজন করে না অতনু আঁচ করে তার মেন্সটুরেশান চলছে, কপালে হাত রেখে দ্যাখে ।

         কিনেছে নতুন ট্রাউজার শার্ট রঙিন-টিশার্ট সোয়েটার জুতো । কয়েকটা রবিবার সারাদিন ঘুরেছে পাহাড়তলিতে ভিনশহরে ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজারের জিপে । বর্মা আর বাংলাদেশে লুকিয়ে-চুরিয়ে যেতে চায়নি অতনু । বাংলাদেশে যাওয়াটা, ওই ভাবে, অত্যন্ত অসৎ কাজ হবে, মাতৃভাষার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা ।  সারাদিন ঘুরে এসেও প্রেম করা বাদ দিতে চায়নি । কত করকমের বাঁশের জঙ্গল হয় দেখেছে, নদী আর ঝিল, এখানকার ফুল, পাখির ঝাঁক । সবুজের পর সবুজ, নানা রঙের সবুজ । আর পাহাড়ি বৃষ্টি, যখন-তখন ।

জুলি-জুডির রাঁধা এমন সম্স্ত খাবার ও, অতনু, খেয়েছে, যা আগে ভাবলেও ওর গা গুলিয়ে উঠত । এখন সবকিছু, যা মানুষ খায়, তা ও খেতে পারে । একদিন এগুলো নিশ্চই কাজে দেবে জীবনে । নারীর শরীর আর অদ্ভুত ভালোবাসা ওকে গভীর বোধে তুলে নিয়ে গেছে ।

          তরল ইন্দ্রপতনে কেঁপে উঠেছে প্রতিরাতের মুর্হূমুহু প্রায়ান্ধকার, দুর্নিবার সন্মোহন ঘোরের টান ছাপিয়ে ; দুই স্নিগ্ধতার মাঝে গড়ে তোলা মরুঅঞ্চল হয়ে উঠেছে সবুজ । কখনওবা দুপুরের আলোয় অতনু  আবদার করেছে ও আলোকিত অবস্হায় দেখতে চায়, স্পর্শ করতে চায়, গন্ধ পেতে চায়, কন্ঠস্বর শুনতে চায়, জিভের স্বাদ পেতে চায়, মুখমেহনের স্বাদ পেতে চায় । আর কিছু দিন থেকে যায় অতনু ।

           ফিরে যাবার কয়েকদিন আগে, রান্নাঘরে টাঙানো মিলিটারি-পোশাক ফোটোটা দেখে ও স্তম্ভিত । অবিকল, হুবহু অতনুর বাবার মতন দেখতে । তাহলে কি ইঁদুরের বিষ খেয়ে উনি মারা যাননি, কাপুরুষের মতন ! গুলি খেয়ে বীর দর্পে শহীদ হয়েছেন । মৃত্যুর রকমফেরে যে উদার গরিমা, অতনু তাতে আপ্লুত হয়ে যায় । মৃত্যু মানে তো স্রেফ স্মৃতির বিনাশ ; মানুষ তাই মরতে ভয় পায়, তার স্মৃতি নিশ্চিহ্ণ হয়ে যাক সে চায় না ।

এয়ারপোর্টে বসে অতনুর মনে হয়, একদিন এদের দুজনকেও ভুলে যাবে । যাবে কি ? এখন কত মনকেমন করছে । এরা দুজন ওকে নিয়ে সাময়িক সংসার পেতেছিল । আবার নতুন কেউ আসবে ; তার সঙ্গে সংসার পাতবে । তারা কি অতনুর মতন ভালোবাসবে ওদের ?  ফোঁপানি সামলায় ও, অতনু । জুলি-জুডি তো একদিন বুড়ি হয়ে যাবে । বিয়ে কেন করেনি, জানতে চায়নি । বুড়ো বয়সে, অবসর নেয়া হয়ে গেলে, অতনু আসবে আরেকবার । তখন এখানে মোনোরেল হয়ে যাবে, বহু হাইরাইজ উঠে যাবে, এয়ারপোর্ট উন্নত হয়ে যাবে ।

         কলকাতায় প্লেন বদলে, দমদম বিমানবন্দরে সারা সকাল বসে থেকে পাটনা ফিরেছিল । কলকাতা শহরে ওর কেউই নেই, কোথায়ই বা যাবে ! জ্যামে আটকা পড়ে ফ্লাইট ছেড়ে যেতে পারে । যা মিছিল আর অবরোধ চলছে ।

         পাটনা বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে বুঝতে পারল আজকে দোলপূর্ণিমা, একটা দল এসে এক বালতি নর্দমার জল ঢেলে দিল অতনুর মাথায়, এর চুলে মুখে মাখাল চটচটে অ্যালুমিনিয়াম পেন্ট ।

         চূড়ান্ত অশ্লীল লোকগীতি, ঢোলক বাজিয়ে, গাইতে-গাইতে চলেছে একদল ধেনোমাতাল যুবক, আর কলি শেষ হতেই ধুয়ো উঠছে, আরে ভাই র‌্যা র‌্যা র‌্যা  র‌্যা ।

         গোবরমাখা চেহারা দেখে ওরা অতনুকে রেহাই দিলে, নয়তো এতক্ষণে খাবলে ছিঁড়ে ফেলত ওর জামাকাপড় ।

         অনেক ধরাধরির পর একজন রিকশচালক রাজি হল ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *