৪. শরিফাদের বাড়ি

৪.

শরিফাদের বাড়িটি সে চিনতে পারে, পলেস্তারা খসে গেছে, তবু সেই বারান্দা সেই সদর দরজা সেই খিড়কি ভুল হবার নয়। দীপনের হাত ধরে সোজা সেই বারান্দায় উঠে আসে কল্যাণী, দরজায় কড়া নাড়ে। দরজার কড়া যখন নাড়ে তার মনে পড়ে এরকম যখন তখন কড়া নাড়ত সে, ঘরে অপেক্ষা করত শরিফা, সকাল নেই বিকেল নেই শরিফা ও শরিফা খেলতে আয়, ও শরিফা জাম পড়েছে আয়, ও শরিফা সাপ খেলা দেখবি আয়, বানর নাচ আয়, ওরে শরিফা দাড়িয়াবান্ধা কোট কাটা হইছে শিগরি আয়। শরিফাও পাখির মত উড়ে আসত। শরিফার মা ভেতর থেকে চেঁচাত শসাটা কাট উঠানটা ঝাঁট দে বিছানাটা গুছা, কে শোনে কার কথা। এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ায় ফাঁক পেলেই দৌড় দৌড়। এর বাড়ির করমচা ওর বাড়ির কদবেল নিয়ে আরেক বাড়ি বসে হা হা হি হি করে সাবাড় করা। কড়ায় হাত ধরেই দাঁড়িয়েছিল কল্যাণী যেন আগের সেই শরিফা পাখির মত এক্ষুনি ছুটে আসবে, কল্যাণীও বলবে চল যাই ঘুট্টি ওড়াই। ঘুট্টি? কল্যাণী আকাশ দেখে, এখন কি ঘুড়ি ওড়াবার সময়? আকাশে মেঘ ভাসছে, কোন মাসে যেন ওড়াতে হয় ঘুড়ি? শরৎ নাকি বসন্ত?

দীপন ফিসফিস করে বলে—এটিই বুঝি তোমাদের বাড়ি ছিল!

—আরে না না। আমাদের বাড়ি ছিল পাশে। অনেক বড় বাড়ি। এ পাড়ার সবচেয়ে বড়। দু বিঘা জমির ওপর। এ রকম বাড়ি কলকাতার কোথাও নেই।

—অশেষদাদের বাড়ির মত বড়?

—দূর, অশেষদের বাড়ি কোনও বাড়ি হল? আমাদের বাড়ি ওদের চেয়ে দশগুণ।

কল্যাণী আড়চোখে দেখে বাড়িটি নেই, কতগুলো নতুন বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে। সে আড়ে দেখে কারণ ভয় লাগে তার। ভয় লাগে যদি সত্যি সত্যি বুঝতে হয় বাড়িটি নেই। কল্যাণীর চোখে সব ঝাপসা লাগে। এত বদলে গেছে সব, এত কেন বদলাবে, মরা নদীর মত হাড় জিরজিরে বাড়িঘর, গাছগুলো বোধ হয় জল না পেয়ে মরে গেছে। কল্যাণী চোখ মুছে আবার তাকায়। বারবার তার ঝাপসা লাগে সব।

ভেতর থেকে সতেরো আঠারো বছর বয়সের এক ছেলে দরজা খুলে দেয়। পাজামা আর শার্ট পরা, লিকলিকে। ছেলেটি কোনও প্রশ্ন করবার আগেই কল্যাণী বলে—শরিফা আছে?

—শরিফা?

—এটা শরিফাদের বাড়ি নয়?

—ছেলেটি দুপাশে মাথা নাড়ে।

—অনেক আগে এ বাড়িতে শরিফারা ছিল না? শরিফা, মুন্নি?

—হ্যাঁ।

—তাই বল। তুমি তো আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে গো। এত বছর আগের, তাতে কি হয়েছে? আমার তো ভুল হবার কথা নয়। সেই বাড়ি, সেই দরজা, জানালা। ভুল হবে কেন?

ছেলেটি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। সে কিছু বুঝে ওঠার আগে কল্যাণী আবার বলে—শরিফা কোথায় এখন?

—নওমহল। ছেলেটি নির্লিপ্ত কণ্ঠে উত্তর দেয়।

—এ বাড়িতে এখন কে থাকে?

—আমরা। শরিফা আমার ফুপু হয়।

—ফুপু হয়। তার মানে তুমি আনিস ভাইয়ের ছেলে। তুমি কি আনিস ভাই-এর ছেলে?

—হ্যাঁ।

কল্যাণী ছেলেটিকে কাছে টেনে পিঠে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে—তোমার নাম কি বাবা?

—ইয়াসির।

—তোমার বাবাকে বল কল্যাণী এসেছে, কলকাতা থেকে।

—আব্বা চিটাগাং গেছে।

—ও, আর তোমার মা?

—আম্মা ঘুমায়।

—ঘুমোচ্ছে? ও। আচ্ছা, শরিফাকে একবার খবর পাঠানো যায় না?

ইয়াসির চুপ হয়ে থাকে।

—ঠিক আছে, তুমি একটু নিয়ে যেতে পারবে আমাকে ওর বাড়িতে?

এবারও ইয়াসির কথা বলে না। ও সম্ভবত ভাবছে কোথাকার কে, এসে বলল চল, আর সে চলে যাবে এ হয় নাকি।

কল্যাণী হেসে বলে—তোমার মাকে ডাকো, বল আমার নাম কল্যাণী। পাশেই আমাদের বাড়ি ছিল। আমার বাবার নাম হরিনারায়ণ। হরিনারায়ণ রায়।

ইয়াসির এবার মুখ খোলে। বলে—ভিতরে আইসা বসেন।

কল্যাণী দীপনকে নিয়ে ঘরে ঢোকে। এখন একটু হাত পা ধোয়া দরকার, ক্ষিধেও পেয়েছে খুব। বিকেল গড়াচ্ছে, সারাদিনে দুটো কলা-বিস্কুট ছাড়া দীপনের পেটে কিছু পড়েনি। বেচারা ক্ষিধের জন্যও মোটে কাতরাচ্ছে না। সল্টলেক হলে ও এতক্ষণে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করত। আর কল্যাণীর তো ক্ষিধের বোধই নেই। ক্ষিধে তার মনে। চোখে। ক্ষিধে তার পেটে নয়।

—মুন্নি শাহানা ওরা থাকে কোথায়? কল্যাণীর কণ্ঠে আগ্রহ উপচে পড়ে।

ইয়াসির দাঁতে নখ কাটতে কাটতে বলে—ছোটফুপু সৌদি আরব থাকে।

—আর মুন্নি?

—ঢাকায়।

—ঢাকার কোথায় গো?

—ধানমণ্ডি।

—ধানমণ্ডি? ছোটবেলায় ধানমণ্ডি যেতাম। কী বড় বড় মাঠ আছে ওখানে, তাই না? বাবা নিয়ে যেতেন, আমরা ওখানে দৌড়তাম। একদিন মনে আছে, দৌড়চ্ছি দৌড়চ্ছি, বাবা বললেন, চল ঘোড়দৌড় দেখি গিয়ে। রেসকোর্সের মাঠে নিয়ে গেলেন বাবা। বাবা আমাকে একটি ঘোড়ার পিঠে চড়িয়েছিলেন, উফ খুশিতে চিৎকার করেছিলাম।

ইয়াসির নখ কাটে দাঁতে। দীপন মায়ের আরও কাছে সরে এসে বলে—আমি রেসকোর্সে যাব।

—ভয় পাবে না ঘোড়ার পিঠে চড়তে?

—বাহ আমি কি দিদি যে ভয় পাব? সেদিন দেখলে না সাইকেল রাইডিং-এ দিদিটা কেমন পিছিয়ে গেল। ও তো একটা ভীতুর ডিম। জু-তে হাতির পিঠে দু দিন চড়েছি। ঘোড়ার পিঠে পারব না বুঝি?

—ঠিক আছে দেখি শরিফার কাছে আগে তো যাই। তারপর কোথায় কোথায় যাব প্রোগ্রাম সেট হবে।

ইয়াসির আড়চোখে তাকায় কল্যাণীদের দিকে। কল্যাণী তাকে কাছে বসিয়ে জিজ্ঞেস করে—ইয়াসির, তুমি আমার নাম শোননি কখনও? কেউ বলেনি? তোমার বাবা, ফুপুরা?

ইয়াসির না বোধক মাথা নাড়ে। কল্যাণী হেসে বলে—আসলে তুমি বোধ হয় শোননি। এই বয়সের ছেলেরা কি আর বাবাদের গল্পে বসে! তুমি বসলে শুনতে আমরা মানে আমি আর শরিফা কি ভীষণ দস্যি ছিলাম। আচ্ছা তোমার বয়স কত হবে ইয়াসির? তুমি কোন বছর জন্মেছ বল তো? আনিস ভাইয়ের বিয়ে তো আমরাই দিয়েছি। তোমার বাবা হাতির পিঠে চড়ে বিয়ে করতে গিয়েছিল জানো তো? আমরা ছোটরা হাতির পিছন পিছন সে কী দৌড়! সঙ্গে ব্যান্ডপার্টি ছিল। গান বাজছিল বিউগলে। বিয়ে হল গোলপুকুর পাড়। এই যে দরজাটা, এই দরজায় আমরা সব দাঁড়িয়েছিলাম বধূবরণ করব বলে। বউ এল লাল বেনারসি পরে। মনে হয় এই সেদিনের ঘটনা। আমি আর শরিফা সেদিন সারারাত ছাদে বসে গল্প করেছি। নতুন বউকে আমরা কী কী গান শোনাবো সে নিয়ে উদ্বেগের সীমা নেই আমাদের। নাকের ওপর বউয়ের জরুল ছিল একটি। তাই না ইয়াসির নাকের ওপর তোমার মার একটি জরুল…অনিলকাকা, সৌমেন? রুখসানা, সেলিম ওরা কেমন আছে ইয়াসির?

—জানি না।

শরিফা, মুন্নি, শাহানা ওরা কেমন আছে, কাদের সঙ্গে বিয়ে হল, ছেলেমেয়েরা কী করে, কী পড়ে ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর দিতে ইয়াসির উদাসীনতা দেখায়। আনিসের স্ত্রীকে ডেকেও যদি গল্প করা যেত, অন্তত তিনি তো শরিফাদের খোঁজ রাখেন। ভাইফোঁটার সময় পরিমল আর জ্যোতিপ্রকাশের মত আনিসের কপালেও কল্যাণী চন্দনের ফোঁটা দিত। সরলাবালা বলতেন—‘ভাই কি কেবল মায়ের পেটের ভাইরাই হয়, কত পরকে আপন হইতে দেখলাম, কত আপনকে পর।’

পাশের এই ভিটেয় ছিল হরিনারায়ণ রায়ের বাড়ি। নামকরা লোক ছিলেন রায়বাবু, এক ডাকে সবাই চিনত। কালিবাড়ির প্যাঁড়ার দোকান থেকে প্রতি সকালে এক সের প্যাঁড়া আসত বাড়িতে। ইসলামপুর থেকে জগৎ ঘোষাল ফি সপ্তাহে দেড় সের ঘি পাঠাত। কালিজিরা চাল আসত মোহনগঞ্জ থেকে। আর মিঠে পুকুরের মাছ তো সারাবছর লেগেই থাকত। নিজের ছেলেমেয়েকে বিদেশ পাঠিয়ে হরিনারায়ণ যাবেন বলেও কেন যাননি? কেবল কি অসুস্থতাই তাঁর না যাবার কারণ? কল্যাণী অনুমান করে হরিনারায়ণ আসলে দেশের মায়াই ছাড়তে পারেননি। ছেলেমেয়ে আত্মীয়-স্বজনের চেয়ে তাঁর কাছে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল দেশ, দেশের মাটি, তাঁকে টেনেছিল সেই মাটির তলে খুব গোপনে রয়ে যাওয়া একটি শক্ত শেকড়। নিজের বাবা-মা’র মৃত্যুতে যে কাছে থাকতে পারে না, তার মত দুর্ভাগা আর কে আছে! কল্যাণী বড় একটি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে। ইয়াসির ভেতর-ঘরে চলে যায়, সম্ভবত তার মাকে ডাকতে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করবার পরও আনিসের স্ত্রীর পায়ের শব্দ শোনা যায় না। তার শ্বশুরবাড়ির পাশের বাড়িতে কবে কোন কল্যাণী বাস করত—তাকে নিয়ে তার কোনও আগ্রহ থাকবার কথা নয়। কল্যাণী অস্থির হাঁটে বারান্দায়। সুতোয় টান পড়লে ঘুড়ি যেমন বাতাসে গুঁতো খেয়ে খেয়ে নাটাইয়ের দিকে যায়—কল্যাণী তেমন চৌকাঠে, সিঁড়িতে হোঁচট খেতে খেতে পাশের দালানগুলোর দিকে এগোয়। হলুদ রঙের এইসব বাড়ি কোনও চিহ্ন বহন করে না তার স্মৃতির। দালানগুলোর ধার ঘেঁষে যে ঘাসে ছাওয়া মাটি, কল্যাণী সেই মাটিতে নেমে দাঁড়ালেই কচি নেবু পাতা আর বাতাবি ফুলের ঘ্রাণ পায় হাওয়ায়। রান্নাঘরের পিছনে ছিল কাগজি নেবুর গাছ, সরলাবালা নেবু পাতা দিয়ে ছোটমাছ রাঁধতেন, জ্যোতিপ্রকাশ হাসি চেপে বলত—‘কী মা, মাছ বুঝি নরম ছিল?’ সরলাবালা বলতেন—‘আরে না, কাটবার সময় মাছগুলা ফাল পারতাছিল। এক্কেরে তাজা মাছ।’ মাছের দোষ নিজের কাঁধে নিয়ে আরও বলতেন—‘রান্দা ভাল হয় নাই বোধহয়। হলুদ বেশি হইয়া গেছে।’ সিঁড়িতে সকালের রোদ এসে পড়ত, সরলাবালা ছেলেমেয়েদের গায়ে চাদর পেঁচিয়ে ঘাড়ের পেছনে গিঁট দিয়ে দিতেন, সেই চাদর পরে শীতের রোদে জলচৌকিতে বসে কল্যাণীরা গা পোহাত, সরলাবালা ধোঁয়া ওঠা চা এনে দিতেন, সঙ্গে মুড়ি, জ্যোতিপ্রকাশের মুখে কখনও মেছোভূত মামদোভূত কখনও নিউটন আইনস্টাইনের গল্প শুনতে শুনতে কল্যাণীরা চায়ে মুড়ি ভিজিয়ে চামচে তুলে তুলে খেত। রান্নাঘরটি নেই। রোদ পড়া সিঁড়িটিও নেই। মনে আছে তিন সিঁড়ি রোদ নেমে এলে কল্যাণী স্কুলে যাবার জন্য তৈরি হত। উঠোনে তুলসীর বেদি ছিল, বেদির সামনে নত হয়ে শাদা শাড়ি পরে সরলাবালা সন্ধে-প্রদীপ জ্বালাতেন, উলু দিতেন, তুলসীতলাটি নেই, কল্যাণীর ইচ্ছে করে বেদির জায়গাটি খুঁড়ে দেখতে—যদি কিছু খোয়াও মেলে! হরিনারায়ণ রায়ের এক পিসতুতো দাদা অখিলচন্দ্র সরকার, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হোমিওপ্যাথি প্র্যাকটিস করতেন, তিনি কার্তিক মাসের এক দুপুরে পুকুরের পশ্চিম দিকে একটি তালগাছ লাগিয়েছিলেন, এই গাছ ছিল কল্যাণীদের চোর চোর, গোল্লাছুট আর বৌচি খেলার গোল্লা। এর গোড়ায় বসে জ্যৈষ্ঠের কড়া দুপুরে জিহ্বায় ট্টা ট্টা শব্দ করে তারা নুন লঙ্কামাখা তেঁতুল খেত। সরলাবালাকে লুকিয়ে খেতে হত, তিনি দেখলেই বলতেন—‘তেঁতুল ফালা। তেঁতুল খাইলে শইলের রক্ত জল হইয়া যায়।’ হঠাৎ হঠাৎ তাল পড়ত গাছ থেকে। কুড়িয়ে নিয়ে মাকে দেওয়া মানে রান্নাঘরের বারান্দায় গামছায় তালের রস ঝুলে থাকা আর টুপ টুপ করে গামলায় সারারাত ধরে পড়া, সেই রস জাল দিয়ে মা পিঠে তৈরি করতেন। এখনও জিভে সেই স্বাদ লেগে আছে। তালের পিঠে কলকাতায় কখনও খেয়েছে কল্যাণী—মনে করতে পারে না! সুপুরি গাছগুলো এখন আর নেই, আগে সুপুরিগাছের পাতা পড়লে এক ধরনের মজা হত। খোলের ওপর কল্যাণী বসত, আর পরিমল পাতা ধরে টেনে টেনে পুরো মাঠ ঘুরত। আবার কখনও পরিমল বসত, কল্যাণী টানত। খোলটা মাটির ঘষায় ঘষায় না ছেঁড়া অবধি খেলা চলত। আহা এখনও কি মাটিতে সেই দাগ নেই সুপুরির খোলের? কল্যাণী সবুজ ঘাসের ফাঁকে আঙুল ডুবিয়ে মাটিতে সেই খোলের দাগ খোঁজে। এই মাটিতে জল পড়লে সোঁদা ঘ্রাণ বেরোত, খুব বড় করে শ্বাস টানলে সেই ঘ্রাণ এখনও পায় সে। কল্যাণী জল পড়া মাটি থেকে এক খাবলা মাটি তোলে। আগে এমন মাটি তুলে তারা রান্নাবাড়ির চুলো বানাতো। স্কুলের ড্রয়িং স্যার আম কাঁঠাল বানাতে দিতেন, মাটি শুকিয়ে ওর ওপর রং করতে হত। স্কুল থেকে ফিরেই কল্যাণী দৌড়ে চলে যেত পুকুর পাড়ে। পুকুরের ধার থেকে এঁটেল মাটি তুলে পুতুল বানাত, অষ্টমী স্নানের দিন মেলায় যেরকম পুতুল পাওয়া যায়, সেরকম পুতুল। আম কাঁঠাল পেঁপে বানিয়ে রোদে শুকোতে দিত। এখন পুকুর পাড়ের সেই এঁটেল মাটি নেই। কল্যাণী তার হাতের মাটিটি হাতের তেলোয় চেপে চেপে দেখে এটি ঠিক কমলালেবুর মত লাগছে। স্কুলে ভূগোল স্যার পড়াতেন পৃথিবী হচ্ছে গোল, ওপর নিচে কমলালেবুর মত সামান্য চ্যাপ্টা। হাতের গোল মাটিটুকুর দিকে তাকিয়ে ভূগোল স্যার প্রদীপ কুমার বিশ্বাসের মুখখানা মনে পড়ে। স্যার কি বেঁচে আছেন? একবার যদি পায়ের ধুলো নেওয়া যেত!

টুকরো মাঠে দাঁড়িয়ে মনে পড়ে দল বেঁধে এই মাঠে বন্দি বন্দি, গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্ধা, গোলাপ পদ্ম খেলত ওরা—দুজন হাত উঁচু করে ধরলে হাতের নিচ দিয়ে লাইন করে বাকিরা যেত আর হাত উঁচু করারা সুর করে বলত—অপেনটো বায়স্কোপ নাইনটেন তেইস্কোপ চুলটানা বিবিয়ানা সাহেব বাবুর বৈঠকখানা…, মনে হয় খুঁজলে এখনও এক্কাদোক্কা, ষোলগুটির দাগ পাওয়া যাবে, হাওয়ায় এখনও গায়ের সেই ঘ্রাণ পাওয়া যাবে। পুকুর নেই, পুকুরের পাড়ে ছিল একটি কাঠগোলাপের গাছ, নক্ষত্রের মত শাদা শাদা ফুল ফুটত—নেই, বাড়ির পেছনে বাঁশঝাড়—বাঁশঝাড়ের উত্তরে ছিল গোপালভোগের দুটো আর ফজলি আমের চারটে গাছ, নেই; পেয়ারা আতা কামরাঙা কিছু নেই। খেজুরগাছও ছিল একটি, শীতের সময় গাছ কেটে মাটির কলসি বেঁধে রাখা হত, ভোরের ঘন কুয়াশায় দাঁড়িয়ে থিরথির কেঁপে রসের কলসি নামানো দেখত কল্যাণীরা, কথা বললে মুখ থেকে শাদা ধোঁয়া বেরোত। মাঠে একটি শিউলি ফুলের গাছ ছিল, শীতের ভোরে ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথত সইরা মিলে। সরলাবালা শিউলির হলুদ বোঁটা রোদে শুকিয়ে রঙ বানাতেন, পোলাও-এ জাফরানের মত ছিটিয়ে দিতেন। কামিনী ফুলের গাছটিও নেই, রাতে কামিনী ফুলের গন্ধে ম ম করত ঘর, সরলাবালা গভীর রাতে দরজায় টোকা দিয়ে বলতেন—‘ও কল্যাণী, জানলা বন্ধ কইরা দে, ফুলের গন্ধে সাপ আসে।’

কিছু নেই। বাড়ি নেই। বৃক্ষ নেই। সামনের মাঠে জামগাছটি কেবল আছে। একা নিঃসঙ্গ জামগাছ। কল্যাণী তার পূর্বপুরুষের ভিটেয় দাঁড়িয়ে নিজেও বড় একা বোধ করে। বড় একা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *