জারাস আর তার লোকজন শক্তিশালী উটগুলো নিয়ে আমার কাছে এলো। অল্পদূরত্বে বেদুঈনের ঘোড়াগুলো আমাদের উটগুলো থেকে এগিয়ে থাকলেও দুই তিন ঘন্টার বেশি তা পারবে না। তাছাড়া আমাদের উটগুলো সারাদিন বালুর উপর চলতে পারে। উটগুলো মাত্র পানি খেয়েছে। কাজেই আরও দশ কিংবা তার চেয়েও বেশি দিন পানি ছাড়া চলতে পারবে। এই পরিস্থিতিতে পানির পিপাসা, গরম আর পিঠে আরোহি নিয়ে বালুর উপর দিয়ে চলতে গিয়ে ঘোড়াগুলো কাল ভোরের আগেই নেতিয়ে পড়বে। অথচ উটগুলো আরও এক সপ্তাহ ছুটতে পারবে।
জারাস আসতেই তাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলাম। অস্ত্রসহ উট থেকে নেমে তার অর্ধেক লোককে হেঁটে গুহায় ফিরে যেতে বললাম। ওরা সেখানে বাকি দুই মেয়েদেরকে পাহারা দেবে।
জারাস বুদ্ধি করে প্রত্যেক উটের পিঠে পানি ভর্তি মশক নিয়ে এসেছিল। এর জন্যই তার আসতে দেরি হয়েছিল। এখন আমাদের অর্ধেক উট সওয়ারিহীন হল। এতে সুবিধামতো উটগুলোকে বিশ্রাম দেওয়া যাবে। জারাস আমাদের প্রধান পথ প্রদর্শক আল-নামজুকে সাথে নিয়ে আসায় আমি খুশি হলাম। তার চেয়ে ভালো কেউ এই পথ চিনতে পারবে না।
সবাই যার যার উটে চড়ে পেছন পেছন একটি করে খালি উট দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে রওয়ানা দিলাম। অতিরিক্ত পানির মশকগুলো থাকায় আমি একটু নিশ্চিন্ত হলাম।
সূর্যের অবস্থান দেখে সময় আন্দাজ করলাম। আর তিন ঘন্টা পর দেখলাম খুব একটা বেশি এগোতে পারিনি। একটু থেমে উট বদল করলাম আর প্রত্যেককে দুই মগ পানি খেতে দিলাম। তারপর আবার স্বাভাবিক গতিতে চলতে শুরু করলাম।
আরও দুই ঘন্টা চলার পর প্রমাণ পাওয়া গেল যে, আমরা পলাতকদের তুলনায় দ্রুতই চলছি। পথের পাশে দেখলাম দস্যু-শেয়ালের পরিত্যক্ত একটি ঘোড়া খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। আমাদের অগ্রগতি দেখে খুশি হলাম আর জারাসকে বললাম আশা করি রাতের আগেই ওদেরকে ধরে ফেলতে পারবো।
তবে আমার আন্দাজ সঠিক হল না। এটা বলার এক ঘন্টা পর আমরা দস্যুরা যেখানে দুটি অংশে ভাগ হয়েছে সেখানে পৌঁছলাম। জারাসকে বললাম, লোকদেরকে বল এবার একটু থেমে জিরিয়ে নিতে। প্রত্যেককে দুই মগ করে পানি দাও। তবে সাবধানে পিছিয়ে বসতে বল যেন পায়ের ছাপগুলো নষ্ট না হয়। আমি ওগুলো পরীক্ষা করবো।
অনুসরণ করার সময় সমান দুই ভাগে ভাগ হয়ে চলা বেদুঈনদের একটি পুরোনো কৌশল। এরপর দুটি দল আলাদা হয়ে দুই দিকে যাবে। এতে আমাদের বুঝা অসম্ভব হবে কোন দলটির সাথে তেহুতি রয়েছে। তাদের দুই দলের পিছু নিতে গিয়ে আমাদেরকেও বিভক্ত হতে হবে।
উট থেকে নেমে লাগামটি জারাসের হাতে দিয়ে হেঁটে সামনে এগোলাম। কিছুদুর যাওয়ার পর খুঁজে পেলাম, কোন জায়গায় ওরা দুই দলে আলাদা হয়েছে। দেখলাম ওরা ঘোড়া থেকে নামেনি। কাজেই তেহুতির পায়ের ছাপ খুঁজে পেলাম না। আমি আবার মাটিতে বসে দেবতার শরণাপন্ন হলাম।
হে মহান হোরাস, আমাকে দেখিয়ে দাও। এই দুর্বল অন্ধ চোখদুটো খুলে দিয়ে আমাকে পথ দেখাও। মিনতি করছি আমার দুচোখ খুলে দাও হে দেবী হাথোর। তোমার নামে আমি একটি বলি দেব।
চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ নিজের হৃৎস্পন্দন শোনার পর চোখ খুললাম। চারপাশে সাবধানে তাকালাম। কোনো স্বচ্ছ আলো এসে বালুকে আলোকিত করলো না, কোনো ছায়া নেচে নেচে এসে আমাকে পথ দেখাল না।
তারপর একটা গলার আওয়াজ শুনে কান খাড়া করলাম। তবে এটা ছিল বালিয়াড়ির মধ্য দিয়ে যাওয়া বাতাসের শন শন শব্দ। ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে বাতাসটাকে কানের পাশ দিয়ে যেতে দিলাম। তারপর মৃদু পরিষ্কার কণ্ঠস্বরটি শুনতে পেলাম।
তেহুতির কণ্ঠস্বর, হাথোর তোমাকে পথ দেখাবে। দ্রুত চতুর্দিকে তাকালাম, তবে তাকে দেখতে পেলাম না। চোখ বুজে অলৌকিক কিছু ঘটার জন্য অপেক্ষা করে রইলাম। নিঃশব্দে মাথা নত করে হাথোর দেবীর কাছে প্রার্থনা করতে লাগলাম।
হে দেবী হাথোর, তোমাকে এখন চাই। আমার আর তেহুতির দুজনেরই এখন তোমাকে প্রয়োজন।
অনেক বছর আগের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। একদিন তেহুতি আর আমি নলখাগড়ার নৌকায় চড়ে পবিত্র নীল নদীর বুকে ভেসে বেড়াচ্ছিলাম। তার প্রথম রজঃদর্শনের দিনটিতে আমি তাকে যে উপহারটি দিয়েছিলাম, সেটা পেয়ে হাতে ধরে খুশিতে সে মৃদু হাসছিল। এটি ছিল একটি চমকার রত্ন যাতে আমি আমার সমস্ত ভালোবাসা আর কারিগরি ঢেলে দিয়েছিলাম। একটা চিকন হারের মাথা থেকে ভালোবাসা ও কুমারীত্বের দেবী হাথোরের ছোট্ট একটি শিংওয়ালা সোনালি মাথা ঝুলছে।
মৃদু মৃদু হেসে তেহুতি হারটা গলায় পরলো। তার বুকের মাঝখানে সোনালি মাথাটা ঝুলছিল আর দেবীর মাথাটাও আমার দিকে তাকিয়ে হেঁয়ালীপূর্ণ হাসি দিচ্ছিল।
তেহুতির কথাগুলো আমার মনে পড়লো, আমি এটা সবসময় পরে থাকবো তায়তা। যখনই এটা আমার চামড়ার সাথে লেগে থাকবে তখনই তোমার আর তোমার ভালোবাসার কথা আমার মনে পড়বে। আর তোমার প্রতিও আমার ভালোবাসা দিন দিন বেড়ে যাবে। সে কথা রেখেছিল। কয়েকদিন দেখা না হওয়ার পর যখন দেখা হত তখনই হারের মাথায় ঝুলন্ত লকেটটা দেখাত, তারপর ঠোঁটে ছোঁয়াত।
এমন একটি সঙ্কটময় মুহূর্তে এই কথাটা কেন এখন আমার মনে পড়লো, বুঝে উঠতে পারলাম না। মন থেকে চিন্তাটা ঠেলে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করলাম। তারপরও স্মৃতিটা জেগে রইল। হঠাৎ একটি উত্তেজিত ভাবনা মনে জেগে উঠলো, এই রত্নটিই এখন তেহুতিকে পাইয়ে দেবে। তারপর বাতাসে ভেসে আসা একটি কণ্ঠস্বর আমি যা মনে মনে ভেবেছিলাম তা নিশ্চিত করলো।
হাথোরকে খুঁজো, তাহলে আমাকে পাবে।
এক লাফ দিয়েই দেখলাম, দস্যুরা যেখান থেকে দুদলে আলাদা হয়েছিল সেখানে তখনও আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি। এবার লক্ষ্য করে দেখলাম একটি দল উত্তরদিকে ঘুরে গেছে। আমি প্রথমে এইদিকেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ঘোড়ার খুরের ছাপের একপাশ দিয়ে ধীরে ধীরে চলতে শুরু করলাম।
তেহুতি কিংবা হাথোরের কাছ থেকে পথ নির্দেশ পাওয়ার জন্য আমি আমার মনের ভেতরের অনুভূতি মেলে ধরলাম। তবে কিছুই অনুভব করলাম না। প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে সাথে হতাশা আর একাকীত্ব আমাকে গ্রাস করতে শুরু করলো।
ঘুরে আবার যেখান থেকে হাঁটা শুরু করেছিলাম সেদিকে চললাম। সাথে সাথে অপ্রীতিকর ভাবনাটা মন থেকে সরে যেতে লাগলো, যখন আগের জায়গায় পৌঁছলাম তখন খারাপ ভাবনাটা উবে গেল।
দস্যুদের দ্বিতীয় দলটি দক্ষিণদিকে গিয়েছিল, এবার সেই পথ ধরলাম।
প্রায় সাথে সাথে মনে একটি ইতিবাচক ভাবনা জেগে উঠলো। প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে সাথে মন হালকা হতে লাগলো আর অনুভব করলাম যেন একটি ছোট্ট উষ্ণ হাত আমার হাতের মুঠো চেপে ধরেছে। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম কিছুই নেই, কিন্তু আমার মনে স্থির বিশ্বাস ছিল, কেউ আমার পাশে থেকে আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে।
দৌড়ে সামনের দিকে একশো পা যাওয়ার পর দেখলাম সামনে মাটিতে কিছু একটা চক চক করছে। অর্ধেকটা হলুদ বালুতে চাপা পড়ে আছে, দেখেই সাথে সাথে জিনিসটা চিনতে পারলাম। হাঁটু গেড়ে বসে হাত দিয়ে আলগা বালু এক পাশে সরালাম। তারপর ছোট হলুদ সোনার টুকরাটি তুলে ঠোঁটে ছোঁয়ালাম।
ঘুরে জারাসের দিকে তাকালাম। সে তার উটের পাশে দাঁড়িয়ে আমাকে লক্ষ্য করছিল। এক হাত উঠিয়ে তাকে ডাকলাম। সাথে সাথে সে উটে চড়ে এক হাতে রশি ধরে আমার উটটা নিয়ে আসতে শুরু করলো।
উটের রশি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সে বললো, আপনি কী করে নিশ্চিত হলেন যে, তেহুতি এই পথ দিয়েই গেছে?
তুমি এই ছোট্ট অলঙ্কারটা চেনো? তারপর হাতের মুঠো খুলে হাতের তালুতে দেবীর মাথাটা দেখালাম। সে নিঃশব্দে মাথা নাড়লো।
সে চিহ্ন হিসেবে এটা আমার জন্য রেখে গেছে।
সে শ্রদ্ধামিশ্রিত কণ্ঠে বললো, তিনি কী অপূর্ব মানুষ। এই পৃথিবীতে তার সাথে তুলনা দেবার মতো আর কোনো নারী নেই।
এরপর আমরা দুই ঘন্টা চলার পর বেদুঈনদের আরেকটা অচল ঘোড়া পথে পেলাম। মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে ঘোড়াটা দাঁড়িয়ে রয়েছে, এক পাও চলতে পারছে না। পরিত্যক্ত করে ফেলে যাবার আগে এর আরোহী নির্দয়ভাবে এর পিঠে চাবুক মেরেছে। ঘোড়াটার পাছায় চাবুকের দাগ দেখা যাচ্ছে, আর ক্ষতস্থানগুলোতে রক্ত জমাট বেঁধে কালো হয়ে চকচক করছে।
আমি বললাম, এটাকে পানি দাও। জারাস নিজে নেমে একটা চামড়ার বালতিতে পানি ভরে সামনে এলো। একই সাথে আমিও নেমে পশুটির কাঁধের পেছনে অবস্থান নিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর তলোয়ার বের করলাম। জারাস পানির পাত্রটি পশুটির মুখের কাছে ধরতেই এটি মুখ নামিয়ে দিল। কয়েক চুমুক পানি খেতে দিলাম, তারপর আমি দুইহাতে তলোয়ারটা ধরে মাথার উপর তুললাম। পশুটি তখনও পানি পানরত অবস্থায় সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রচণ্ড জোরে তলোয়ার তুলে একটা কোপ মারলাম।
কাটা মাথাটা দেহ থেকে আলাদা হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। তারপর হাঁটু ভেঙে দেহটাও মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
তলোয়ারের ধারালো পাতটার রক্ত ঘোড়ার কাঁধে মুছে নিয়ে জারাসকে বললাম, বাকি পানিটা নষ্ট করো না।
লক্ষ্য করলাম জারাস বাকি পানিটা মশকে ঢেলে রাখলো। নিজেকে ঠিক করে নিতে আমার কয়েকটি মুহূর্ত দরকার। আমার নির্দয় আঘাতের আগে ঘোড়াটি যে যন্ত্রণা ভোগ করছিল ঠিক একই রকম মানসিক যন্ত্রণা আমিও ভোগ করছিলাম। বিনা কারণে নিষ্ঠুরতা আর কাউকে যন্ত্রণা দেওয়াটা আমি অপছন্দ করি। যাইহোক বর্তমান পরিস্থিতিতে মনের এই ভাব চেপে রাখলাম।
সূর্য দিগন্ত ছুঁতেই আমরা পথে আরও তিনটা অচল ঘোড়া পার হলাম। আর বালুতে খুরের গভীর ছাপ দেখে বুঝতে পারলাম, কিছু আরব দস্যু এক ঘোড়ার পিঠে দুজন করে সওয়ার হয়েছে। অন্যরা হেঁটে চলেছে।
প্রতি ঘন্টায় আমরা আরও দ্রুত ওঁদের কাছাকাছি হচ্ছিলাম। সূর্যাস্তের পরও আমি অনুসরণ চালিয়ে গেলাম। পরিশেষে পূর্ণচন্দ্র এসে আমাদের পথ আলোকিত করলো। উজ্জ্বল রূপালি আলোয় আরবদের ফেলে যাওয়া খুরের ছাপ পরিষ্কার দেখা গেল। এবার আরও দ্রুত চলতে শুরু করলাম।
এরপর পথের ধারে আরও দুটো বিধ্বস্ত ঘোড়া পেলাম। তবে এবার আর ওগুলোর পেছনে সময় নষ্ট করলাম না। তারপর পথের মাঝখানে একটা মানুষের দেহ পড়ে রয়েছে দেখতে পেলাম। লোকটাকে দেখে পরিচিত মনে হচ্ছিল। আমি উট থামিয়ে নিচু হয়ে লক্ষ্য করলাম।
জারাস উদ্বিগ্ন কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো, সাবধান তায়তা, এটা একটা ফাঁদ হতে পারে। হয়তো সে মারা যাবার অভিনয় করছে। সম্ভবত হাতে একটা ছুরি ধরে রয়েছে।
আমি তার সাবধান বাণী উপেক্ষা করে তলোয়ার বের করলাম। লোকটার কাছাকাছি আসতেই সে নড়ে উঠলো আর মাথা তুলে অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। ঠিক তখনই আমি তাকে চিনতে পারলাম।
তার দিকে তাকিয়ে আমি এতো হতবাক হলাম যে, আমার মুখ থেকে কোনো কথা বের হচ্ছিল না।
জারাস চিৎকার করে উঠলো, কী হয়েছে তায়তা? আপনি এতো চিন্তিত কেন? লোকটাকে চেনেন নাকি? সাথে সাথে তার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলাম না।
জারাসের দিকে না তাকিয়ে বললাম, আল-নামজুকে আমার কাছে পাঠাও। পায়ের কাছে পড়ে থাকা লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছিল। তারপর সে ছেঁড়া কেফায়ার একটি অংশ দিয়ে মুখের নিচের অংশ ঢেকে মুখটা অন্য দিকে ফেরাল।
জারাস আল-নামজুকে ডাকতেই সে উট নিয়ে আমার পেছনে এসে দাঁড়াল।
আমি কঠিন কণ্ঠে বললাম, আমার কাছে এসো। সে আমার কাছে এসে দাঁড়াতেই পেছনে বালুতে তার পায়ের মচমচ শব্দ শোনা গেল। আমি ফিরে তাকালাম না।
মৃদুকণ্ঠে সে বললো, আমি এখানে প্রভু।
স্যান্ডেলের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা লোকটাকে স্পর্শ করে বললাম, এই লোকটাকে চেন?
না প্রভু, লোকটির মুখ দেখতে পাচ্ছি না… সে বিড়বিড় করে বললো, তবে তার গলা কেঁপে গেল, বুঝলাম সে মিথ্যা বলছে। আমি নিচু হয়ে কেফায়ার এক প্রান্ত ধরে টান দিয়ে লোকটার মুখ থেকে তুলে নিলাম। আল নামজু আঁতকে উঠলো।
এবার আমি বললাম, এবার মুখটা দেখতে পাচ্ছো? কে সে?
কিছুক্ষণ নীরবতা, তারপর লোকটি হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। আমাদের দিকে আর তাকাতে পারছিল না।
বল আল-নামজু, এই শুওরের মলটি কে? আমার রাগ আর তিক্ততার পরিমাণ বুঝাতে আমি ইচ্ছা করেই এই শব্দটা ব্যবহার করলাম।
বুড়ো লোকটি ফিসফিস করে বললো, সে আমার ছেলে হারুন।
সে কেন কাঁদছে, আল-নামজু?
আমি যে বিশ্বাস তার উপর রেখেছিলাম তা সে ভঙ্গ করেছে তাই কাঁদছে।
কীভাবে সে বিশ্বাসঘাতকতা করলো? সে শেয়াল আল-হাওয়াসাঈকে জানিয়ে দেয় কোথায় আমাদেরকে পাওয়া যাবে। তারপর ওদেরকে পথ দেখিয়ে পানির গুহার কাছে নিয়ে আসে।
এই বিশ্বাসঘাতকতার উপযুক্ত শাস্তি কী হওয়া উচিত আল-নামজু?
তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আপনি হারুনকে মেরে ফেলুন প্রভু।
আমি তলোয়ারটা বের করে বললাম, না বুড়ো। আমি তাকে মারবো না। সে তোমার সন্তান। তুমিই তাকে হত্যা করবে।
সে ভয়ে পিছিয়ে গিয়ে বললো, আমি আমার নিজের ছেলেকে মারতে পারবো না প্রভু। এটা হবে অচিন্তনীয় খারাপ এবং ঘৃণ্য একটি কাজ। আমি আর আমার ছেলে অনন্তকাল শেঠের অন্ধকার নিম্ন জগতে দণ্ডিত হয়ে পড়ে থাকবো।
তুমি তাকে মেরে ফেল, তারপর আমি তোমার আত্মার জন্য প্রার্থনা করবো। তুমি তো জান আমার ক্ষমতা আছে। তুমি জানো দেবতাদের সাথে মধ্যস্থতা করার ক্ষমতা আমার আছে। হয়তো ওরা আমার প্রার্থনা শুনবেন। এই সুযোগটা তোমাকে নিতে হবে।
এবার সে নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে বললো, হে প্রভু, অনুগ্রহ করে এই ভয়ঙ্কর দায়িত্ব থেকে আমাকে রেহাই দিন। তার দাড়ি বেয়ে চোখের পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে আমার পায়ে চুমু খেল।
কিন্তু তার অনুনয় বিনয়ে আমার মন গললো না। আমি বললাম, পিতার হাতে মৃত্যুই তার উপযুক্ত শাস্তি। ওঠো আল-নামজু। তাকে মেরে ফেল, আর নয়তো আমি প্রথমে তোমার ঘোট দুই ছেলে তালাল আর মুসাকে মারবো। তারপর হারুন আর সবশেষে তোমাকেও হত্যা করবো। তোমার বাড়িতে আর কোনো পুরুষ থাকবে না। তোমাদের জন্য প্রার্থনা করার মতো কেউ বেঁচে থাকবে না।
সে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল, আমি তার হাতে আমার তরবারিটা ধরিয়ে দিলাম। সে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলো আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এরপর আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে চোখ নিচের দিকে নামাল।
আমি আবার জোর দিয়ে বললাম, চালাও এটা! সে দুই হাত দিয়ে মুখ থেকে চোখের পানি মুছলো। মন শক্ত করে চিবুক উঁচু করলো। তারপর আমার হাত থেকে তলোয়ার নিয়ে শক্ত হাতে বাঁটটা ধরলো। আমাকে পাশ কাটিয়ে হারুনের উপর এসে দাঁড়াল।
আবার আমি বললাম, চালাও! সে তলোয়ারটা উঁচু করলো তারপর আঘাত করলো একবার, দুবার এবং তিনবার। তারপর তলোয়ারটা মাটিতে ফেলে দিয়ে তার বড়ছেলের মৃতদেহের উপর লুটিয়ে পড়লো। ছিন্ন মুণ্ডটা বুকে চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো।
তলোয়ারটা তুলে আমি রক্তের দাগ লাশের দেহে মুছলাম। তারপর আমার উটের কাছে ফিরে গিয়ে উটের পিঠে চড়ে বসলাম। আল-নামজুকে তার পুত্র শোক করার সুযোগ দিয়ে আবার দস্যু শেয়ালের পেছনে ছুটার জন্য তৈরি হলাম।
আমার সমবেদনার অনুভূতি সমগ্র মানজাতিকে ঘিরে নেই। আর যারা আমার বিরুদ্ধে অপরাধ করে তাদের সব অপরাধের প্রতি আমি মহানুভবতা দেখাতে পারি না।
.
ভোরের প্রথম আলো দেখা দিতেই আমরা সেই জায়গায় পৌঁছলাম যেখানে দস্যু আল-হাওয়াসাঈ দ্বিতীয়বার তার দলকে বিভক্ত করেছিল। এবার সে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে সে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে প্রথমবার দুদলে বিভক্ত হওয়ার পরও আমি তার পিছু ছাড়িনি।
মাটিতে নেমে বেদুঈনদের সংখ্যাটা আন্দাজ করার চেষ্টা করলাম।
এবার এক দলে ছয়টি ঘোড়া আর অন্য দলে চারটি ঘোড়া রয়েছে। প্রতিটি ঘোড়ার পিঠে দুজন করে সওয়ারি ছিল। তার মানে মোট বিশজন লোক। এছাড়া পাঁচজন লোক হেঁটে চলছিল।
উত্তর দিকে যে বড় দলটি মোড় নিয়েছিল আমি সেটার পথরেখা পরীক্ষা করলাম। তারপর আমার মন নেচে উঠলো যখন দেখলাম একটি ছোট সুন্দর পায়ের ছাপ তাদেরকে অনুসরণ করছে। এরাই তেহুতিকে তাদের সাথে নিয়েছে।
অবশ্য এবার ওরা তাকে মাটিতে নামিয়ে হাঁটাচ্ছে আর চিহ্নগুলো দেখে। আমি বুঝতে পারলাম দুজন আরব জোর করে তাকে টেনে নিয়ে চলেছে। দৌড়ে সামনে এগিয়ে কাছ থেকে তার পায়ের ছাপগুলো পরীক্ষা করলাম। রেগে ফেটে পড়লাম যখন দেখলাম একটা খালি পা থেকে রক্ত ঝরছিল। বালুতে ছোট ছোট পাথরের ধারাল টুকরায় তার পা কেটে গেছে।
পায়ের ছাপগুলো পরিষ্কার। আর কোনো সন্দেহ নেই যে উত্তরমুখি দলটির সাথেই তেহুতি গিয়েছে। তারপরও আমি ভাবলাম রাগের বশে হয়তো আমি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারি। আমাকে ভালোভাবে নিশ্চিত হতে হবে।
জারাসকে ডেকে বললাম, আমি ডাকা পর্যন্ত এখানে অপেক্ষা করো। তাকে সেখানে রেখে পায়ের ছাপগুলো অনুসরণ করে সামনে এগিয়ে চললাম। একশোবিশ পা যাওয়ার পর তেহুতির পায়ের ছাপ আর দেখা গেল না। তবে এনিয়ে আমি বেশি কাতর হলাম না।
বুঝতে পারলাম সম্ভবত আল-হাওয়াসাঈ কিংবা অন্য কোনো আরব তাকে ঘোড়ার পিঠে তুলে নিয়েছে। শুধু পায়ের ছাপগুলোই যে পরিষ্কার তা নয়, আমার ডান হাতে ধরা হাথরের সোনার মাথা থেকে যে অলৌকিক আভা বের হচ্ছে সেটিও এতে সমর্থন দিচ্ছে।
পেছন ফিরে জারাসকে কাছে আসতে ইশারা করলাম। সে আমার উট নিয়ে এলো। উটের পিঠে চড়ে আমি তেহুতিকে নিয়ে উত্তরমুখি চলা আরবদের ফেলে যাওয়া পায়ের ছাপ অনুসরণ করে এগিয়ে চললাম।
মরুভূমির সামান্য উঁচুনিচু জমির উপর দিয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর পরবর্তী বালিয়াড়ির উপর উঠার পর অনুভব করলাম, তেহুতির সোনার অলঙ্কারটির আভার বিচ্ছুরণ কমে এসেছে। সাথে সাথে লাগাম টেনে ধরে উটটি থামালাম। ধীরে ধীরে চারপাশের বিশাল বালিয়াড়িগুলোর দিকে তাকালাম।
জারাস কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে প্রভু?
তেহুতি এপথে আসেনি। শেয়াল আমাদের সাথে চালাকি করেছে।
সে বললো, এটা কী করে সম্ভব তায়তা? আমিও তার পায়ের ছাপ দেখেছি। এতে কোনো সন্দেহ নেই।
উটের মুখ ফিরিয়ে আমি বললাম, অনেক সময় মিথ্যা পরিষ্কার দেখা যায় আর সত্য লুকিয়ে থাকে।
বুঝতে পারলাম না, প্রভু।
আমি বললাম, আমি ভালোভাবেই বুঝেছি জারাস। অনেক বিষয় আছে। যা তুমি কখনও বুঝতে পারবে না। কাজেই এ-বিষয়ে তোমার কাছে ব্যাখ্যা দিয়ে সময় নষ্ট করবো না।
আমার লোকেরা বিরক্ত হলেও কোনো কথা না বলে পেছনে ঘুরলো।
যে জায়গায় তেহুতির খালি পায়ের ছাপটি হারিয়ে গিয়েছিল সেই জায়গায় আবার ফিরে এলাম। উটের পিঠ থেকে নেমে লাগাম একজনের হাতে তুলে দিলাম।
আমি জানি কিছু একটা আমার নজর এড়িয়ে গেছে। কিন্তু সেটা কি তা ধরতে পারছি না।
আরও পিছিয়ে যেখানে বেদুঈনরা দুইদলে ভাগ হয়েছিল সেখানে পৌঁছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলাম। উল্টো দিকে যাওয়া কোনো পথরেখা কি দেখা যাচ্ছে? একটু থেমে ভাবলাম। উত্তর হল, না নেই। এই জায়গাটি থেকে ওরা দুই দলে ভাগ হয়ে দুই দিকে সোজাসুজি চলে গেছে; কেউ আর পেছন ফিরে আসেনি।
যাইহোক এই অস্বাভাবিকতার উত্তর খুঁজার চেষ্টা করেও ঠিক ধরতে পারছিলাম না।
মনে মনে বললাম, সে নিশ্চয়ই ফিরে গেছে। দ্বিতীয় দলটির সাথে সামনের দিকে আর যায় নি, তার মানে সে নিশ্চয়ই পেছন দিকে গিয়েছে।
আবার একটু থামলাম, আচ্ছা আমি, পেছন দিকে গিয়েছে এই কথাটা কেন ব্যবহার করলাম? এই পরিস্থিতিতে এই কথাটা ঠিক নয় আর আমি তো সাধারণত ভুল বাক্য ব্যবহার করি না।
সমাধানটির খুব কাছাকাছি পৌঁছার পর এবার জোরে জোরে বলে উঠলাম, একজন মানুষ পেছন দিকে যায় না। হয় পেছন দিকে ঘুরে কিংবা পেছন পেছন হাঁটে… আবার থামলাম। হুঁ, আচ্ছা! এবার বুঝেছি!
যেখানে তেতির খালি পায়ের ছাপটি শেষ হয়েছিল সেইজায়গায় আবার ছুটে গেলাম।
এবার আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি কী খুঁজতে হবে। সাথে সাথে তা পেয়েও গেলাম। এখানে আরেক জোড়া পুরুষ মানুষের পায়ের ছাপ ছিল যা আপাত দৃষ্টিতে দলটির অন্যান্যদের মতো উত্তরদিকেই যাচ্ছিল। তবে এখানে কিছু পার্থক্য ধরা পড়লো।
তেহুতির পায়ের ছাপ যেখানে শেষ হয়েছিল, ঠিক সেই জায়গা থেকেই এই একটি পুরুষ মানুষের পায়ের ছাপ শুরু হয়েছে। পায়ের এই ছাপজোড়া অন্য সব পায়ের ছাপ মাড়িয়ে চলেছে। যে লোকের এই পায়ের ছাপ, সে ভারি কোনো ওজন বহন করছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল প্রতি পদক্ষেপে এই লোকটির স্যান্ডেলের পেছনে গোড়ালির দিকে ধুলা উড়িয়ে চলছিল…অথচ সামনের দিকে হাঁটলে স্যান্ডেলের বুড়ো আঙুলের সামনের দিকে ধূলা উড়ার কথা।
মনে মনে ভাবলাম, সম্ভবত শেয়ালই এই পায়ের ছাপ ফেলেছিল। প্রথমে যেখানে দলটি দুই ভাগ হয় সেখানে সে তেহুতিকে মাটিতে নামিয়ে দেয়। তারপর উত্তরমুখি দলটির ঘোড়াগুলোর সামনে তাকে জোর করে কয়েক পা হাঁটায়। দুইশো পা যাওয়ার পর সে ঘোড়া থেকে নেমে পড়ে। তার ঘোড়াটি উত্তর দিকে যাওয়া দলটির সাথে পাঠিয়ে দেয়। তারপর মাটি থেকে তেহুতিকে তুলে নিয়ে যেখানে প্রথম দলটি তার জন্য পেছনে অপেক্ষা করছিল সেখানে ফিরে যায়। তবে এক্ষেত্রে সে তেহুতিকে কাঁধে তুলে পেছন দিকে হেঁটে চলে। প্রথম দলটি তার আর তেহুতির জন্য আরেকটি ঘোড়া নিয়ে অপেক্ষা করছিল। এইখানে এসে সে তেহুতিকে নিয়ে দক্ষিণমুখি দলটির সাথে চলে যায়। আর আমাদেরকে উত্তরমুখি দলটির অনুসরণ করতে বাধ্য করে। অত্যন্ত শয়তানি বুদ্ধির জটিল একটি ধূর্তামি। আমি মৃদু হাসলাম।
তারপর খুশি হয়ে বেশ জোরে বলে উঠলাম। তবে অতো চালাক নয়।
জারাস আর তার লোকজন হতবুদ্ধি হয়ে আমাকে লক্ষ্য করছিল, ওরা আরও অবাক হয়ে গেল যখন আমি তেতির খালি পায়ের ছাপগুলো পেছনে ফেলে উল্টো দিকে বেদুঈনরা দুই দলে ভাগ হয়ে যে জায়গা থেকে দুই দিকে যেতে শুরু করেছিল সেদিকে ফিরে চললাম।
দিক বদল করে দক্ষিণ দিকে যাওয়া শুরু করার পর জারাস কিংবা তার লোকজন কোনো ধরনের প্রতিবাদ করতে সাহস পেল না। এদিকে প্রতি লিগ দূরত্ব পার হওয়ার সাথে সাথে আমার হাতে ধরা দেবীর মাথার সোনার অলঙ্কারটি থেকে বিচ্ছুরিত উষ্ণ আভা আরও শক্তিশালী হতে লাগলো।
.
আমি জানি তেহুতি এখন কীরকম দুর্দশায় আছে। দস্যুরা যখন তাকে অপহরণ করেছিল তখন তার পরনে কেবল একটি সুতির জামা ছিল। উটের পিঠের কাঠের জীনের উপর বসা কিংবা উপরে প্রখর রোদের তাপে এই পোশাক কোনো কাজে আসবে না। যখন সে খালি পায়ে হাঁটছিল তখন তার পা কেটে যে রক্ত ঝরছিল তা আমি দেখেছি। একজন মিসরীয় রাজকুমারীর পা একটি কৃষক কন্যার পায়ের চেয়ে অনেক নাজুক।
আমার মনে শুধু এইটুকু সান্ত্বনা ছিল যে, শেয়াল তার দস্যুদলের কাউকেই তেহুতির গায়ে হাত তুলতে অনুমতি দেবে না। একটি কুমারী মেয়ে হিসেবে তার মূল্য অনেক বেশি। এতোটুকু বুদ্ধি তার নিশ্চয়ই আছে যে, তেহুতির দামে সে দশ হাজার সুন্দরী ক্রীতদাসী কিনতে পারবে। ইচ্ছা হচ্ছিল উটগুলোকে আরও জোরে চালিয়ে নিয়ে মেয়েটিকে উদ্ধার করে একদুই ঘন্টা কষ্ট পাওয়া থেকে রেহাই দেই।
তবে ভাবলাম শেয়াল নিশ্চয়ই আরও কিছু চালাকি করার চেষ্টা করবে আর সেক্ষেত্রে আমাকে তা সামলাবার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। কাজেই স্বাভাবিক গতিতেই উট চালিয়ে নিয়ে চললাম। তবে পানি খাওয়ার জন্য কোথাও না থেমে সারা সকাল চললাম।
একঘন্টা পর দুপুরের সূর্য যখন মাথার উপর, তখন আমি একটা বেলেপাথরের পাহাড়ের চূড়ায় উঠলাম। নিচের দিকে তাকিয়ে বেশ চওড়া কয়েক লিগ দীর্ঘ একটি খাড়ি দেখতে পেলাম। পুরো উপত্যকাটি জুড়ে বহুকাল থেকে বাতাসের আঘাতে দৈত্যাকৃতির প্রাকৃতিক স্থাপত্য গড়ে উঠেছে। লাল বেলে পাথরের সুউচ্চ চূড়াগুলো যেন নীল আকাশের পেট ছুঁয়ে রয়েছে। তবে গোড়ারদিকে বাতাসে ক্ষয়ে যাওয়ায় সরু স্তম্ভগুলোর উপর বিশাল মাথাগুলো ভারসাম্য বজায় রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
দলের মধ্যে আমি সবচেয়ে বয়স্ক হলেও আমার দৃষ্টিশক্তি সবচেয়ে তীক্ষ্ণ ছিল। সবার আগে আমিই পলাতকদের দেখতে পেলাম। বেলেপাথরের দৈত্যাকৃতির একশিলা স্তম্ভগুলোর গোড়ার ছায়ায় মানুষগুলোকে আমিই প্রথম জারাস আর তার লোকজনদের দেখালেও প্রথমে ওরা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। রোদে পোড়া পাথরগুলো থেকে গরম বাষ্প উঠে মরীচিকা হয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছিল আর এতে ওদের দৃষ্টিবিভ্রম হচ্ছিল।
তারপর একটি বর্শা বা তলোয়ালের পাতে রোদ প্রতিফলিত হয়ে ঝিকমিক করে উঠতেই ওদের চোখে পড়লো। আমার পেছন থেকে দলের সবাই উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলো। তবে আমি জানি আরও খারাপ ঘটনা ঘটার বাকি আছে। এখন আমরা মরিয়া হয়ে ওঠা এক লোকের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি আর শেয়াল তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তেহুতি এখন আরও বিপদের মধ্যে রয়েছে।
সবাইকে চুপ করতে বলে নিঃশব্দে পাহাড়ের পেছন দিক দিয়ে নামতে শুরু করলাম। বেদুঈনদের গতিবিধির প্রতি নজর রাখার জন্য দুজন লোকসহ একজন বিশ্বাসী সার্জেন্টকে পাহাড় চূড়ায় রাখলাম। তারপর অন্যদেরকে নিয়ে নিচে নামার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে অস্ত্রশস্ত্রসহ প্রস্তুত হতে বললাম।
উটের পিঠে বেধে রাখা আমার পোটলাটা থেকে চামড়ার ব্যাগে রাখা যুদ্ধের ধনুক আর তূণীর বের করে আনলাম। জারাসকে সাথে নিয়ে একটা পাথরের উপর বসে তাকেও পাশে বসতে বললাম।
তারপর তাকে নির্দেশ দিতে শুরু করলাম, ওদের ঘোড়াগুলো পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে, আর চলতে পারবে না। এবার শেয়াল শেষ লড়াই চালাবার জন্য অবস্থান নিয়েছে। তারপর তাকে বুঝিয়ে বললাম শেয়ালের কবল থেকে তেহুতিকে আহত না করে উদ্ধার করতে হলে আমাদেরকে কী করতে হবে। একবার বলার পর তাকে বললাম পুরো পরিকল্পনাটা আমাকে শুনাতে যাতে কোনো ধরনের ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ না থাকে।
কথা বলতে বলতে আমি আমার ধনুকের ছিলা টেনে পরীক্ষা করছিলাম। তূণীর থেকে সবচেয়ে ভালো তিনটি তীর বেছে নিলাম। হাতের তেলোতে গড়িয়ে নিয়ে দেখে নিলাম কোনো ধরনের অমৃসণতা আছে কিনা। খুব ভালোভাবে পরীক্ষা করার পর তীর তিনটি কোমরবন্ধে খুঁজে নিলাম। বাদবাকি তীরগুলো তূণীরে ঢুকিয়ে কাঁধে বেঁধে নিলাম। হয়তো একবারের বেশি তীর ছুঁড়ার সুযোগ পাবো না, তাও আবার এতো দূরের নিশানায়। আর যদি দ্বিতীয় সুযোগ আসে তখন তীর বাছাই করতে গিয়ে একটি মুহূর্তও নষ্ট করতে চাই না।
উঠে দাঁড়িয়ে জারাসের পিঠে একটা চাপর দিয়ে বললাম, আমি প্রস্তুত জারাস। তুমি তৈরিতো?
সে একলাফে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, হ্যাঁ তায়তা! রাজকুমারীর জন্য আমি প্রাণ দিতে প্রস্তুত। নাটুকেপনা হলেও তার কথাটির মধ্যে যথেষ্ট আন্তরিকতা ছিল। তরুণ হৃদয়ের ভালোবাসার নিজস্ব একধরনের চমৎকারিত্ব রয়েছে।
আমি শুষ্ক মন্তব্য করলাম, আমার মনে হয় রাজকুমারী তেহুতি আর আমি দুজনেই তোমার জীবিত থাকাটাই শ্রেয় মনে করবো।
জারাস তার লোকজনদেরকে যথারীতি নির্দেশ দিতে শুরু করলো। আর আমি একটা কুমিরের চামড়ার বর্ম আর ব্রোঞ্জের শিরস্ত্রাণ পরে নিলাম যাতে আমার বিশেষ আলখাল্লা আর লম্বা চুল ঢাকা পড়ে। আমি আমার লোকজনের মাঝে নিজেকে আলাদা করে দেখাতে চাই না।
সবধরনের প্রস্তুতি নেওয়ার পর আমরা উটের পিঠ থেকে নেমে উটগুলোকে টেনে নিয়ে পাহাড়ের পেছন দিকে গেলাম। তারপর নিচে বেলেপাথরের একশিলা স্তম্ভের উপত্যকায় নামতে শুরু করলাম। শেয়াল তার দস্যুদের নিয়ে সেখানেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল।
এবার আমার বামবাহুতে চামড়ার বাহুবন্ধনীটিা লাগিয়ে নিলাম, যাতে ধনুকের ছিলার আঘাতে গতবারের মতো কেটে না যায়।
দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিল জারাস। তার বিশ পা পেছনে অন্যান্যরা একজোট হয়ে চলেছে। এবার আমি জারাসের পাশাপাশি নেই।
কুমিরের বর্ম পরে আমি দ্বিতীয় সারির বামদিকে একেবারে শেষ প্রান্তে রয়ে গেলাম। ধনুকটা উটের গদির কাপড়ের মাঝে লুকালাম, যাতে একেবারে শেষ মুহূর্তে যখন এটা তুলবো, তার আগে শত্রুপক্ষের কারও চোখে না পড়ে।
আমাদের অবস্থান থেকে জারাস খানিকটা সামনে এগিয়ে গেল, যাতে তার উপর শেয়ালের নজর পড়ে। সে তলোয়ারটা উল্টো করে তলোয়ারের হাতল মাথার উপরে উঁচু করে রেখেছে। এটা ছিল সাময়িক যুদ্ধবিরতীর সর্বজনীন প্রতীক।
আমি জানতাম শেয়াল এটাকে শর্তসাপেক্ষে আলোচনার একটা আমন্ত্রণ হিসেবে ধরে নেবে, কেননা আমরা সবাই ইতোমধ্যেই অচলাবস্থায় আটকে পড়েছি। সে পালাতে পারছে না, কেননা তার ঘোড়াগুলো অচল হয়ে পড়েছে, আর তার লোকদেরও খেলা সাঙ্গ হয়েছে।
আবার আমরাও সরাসরি আক্রমণ করে ব্যাপারটা নিষ্পত্তি করতে পারছি না, কেননা সে তেহুতির গলায় একটা ছুরি ধরে রেখেছে।
আমি জারাসের উপর নির্ভর করছিলাম, যাতে সে শেয়ালকে আমার তীরের পাল্লার মধ্যে নিয়ে আসে। আরেকটু কাছাকাছি হতেই, আমি পরিস্থিতিটা আরও ভালোভাবে নিরীক্ষণ করলাম।
পায়ের ছাপ থেকে আমি জানতে পেরেছিলাম, দুই দলে ভাগ হয়ে আর মরুভূমির বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণে আল-হাওয়াসাঈর দস্যুদের সংখ্যা এখন পনেরোতে নেমে এসেছে। আর এদিকে জারাসসহ আমার রয়েছে ছাপান্নজন রক্ষী। ওরা সবাই এখন সতেজ আর লড়াই করার জন্য উন্মুখ হয়ে রয়েছে।
শেয়াল বেশ সর্তকতার সাথেই বেলেপাথরের বিশাল একশিলা স্তম্ভটির নিচে তার শেষ অবস্থানটি বেছে নিয়েছিল। শিলাটি দুই দিক দিয়ে তাকে আড়াল করে রেখেছে। তারপরও এটি তাকে অতিরিক্ত সুবিধা দিয়েছে। তার মাথার উপরে সামনের দিকে ছড়ানো একটি তাকের মতো বেলেপাথরের ছাদটি আমার তীর ছোঁড়ার পাল্লাকে সীমাবদ্ধ করেছে। এই দূরত্ব থেকে উঁচু করে তীর ছুঁড়লে সেটা শেয়ালের গায়ে বেঁধার আগে তার মাথার উপরে ছাদের পাথরে লেগে যেতে পারে। আমাকে আরেকটু এগিয়ে ক্ষেপণাস্ত্রের মতো বাঁকা পথে তীর ছুঁড়তে হবে যা ছাদ এড়িয়ে তার গায়ে বিঁধতে পারে।
তবে পাহাড়টি শেয়ালের জন্য একটি কারাগারের দেয়ালও হয়েছে। তার পালাবার আর কোনো পথ নেই। তাকে আমাদের সাথে একটা বোঝাঁপড়ায় আসতেই হবে: তার নিজের আর লোকজনের জীবনের বদলে আমাদের রাজকুমারীর জীবন অদলবদল করতে হবে।
জারাসকে অনুসরণ করে আমরা ধীরে ধীরে যেখানে শেয়াল অপেক্ষা করছে সেদিকে এগোতে লাগলাম।
এবার আমি দেখলাম বেদুঈন সর্দারের ঘোড়াগুলো পিপাসায় কাতর হয়ে আর অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে মারা পড়েছে। আরবরা কয়েকটি ঘোড়ার মৃতদেহ সামনের দিকে টেনে এনে অর্ধচন্দ্রাকার দেয়ালের মতো সাজিয়ে রেখেছে। এর আড়ালে ওরা হামাগুড়ি দিয়ে অবস্থান নিয়েছে। লোকগুলোর শুধু মাথার উপরের অংশ, বর্শার ডগা আর বাকা তলোয়ারের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে।
আরেকটু কাছে এগিয়ে আমি লক্ষ্য করলাম যে, অন্তত তিনজন আরব ধনুকে তীর জুড়ে আমাদের দিকে ছুঁড়বার জন্য প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। তবে বেদুঈনরা ভালো তীরন্দাজ নয়। এগুলোর পাল্লা অত্যন্ত দুর্বল, আমার হাঁটুর কাছে উটের গদীর কাপড়ের নিচে যে শক্তিশালী বাঁকা যুদ্ধের ধনুকটি রয়েছে তার তুলনায় এর পাল্লা অর্ধেক হবে।
এখন সবকিছু নির্ভর করছে আল-হাওয়াসাঈ আমাদেরকে থামতে বলার আগে জারাস কতোটুকু দুরত্ব কমাতে পারবে। উটের প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে আমি কমে আসা দূরত্বের পাল্লাটা পরিমাপ করছিলাম।
তারপর আমরা ঠিক মোক্ষম জায়গায় পৌঁছলাম, যেখান থেকে আমার ধারণায় উপরের দিকে বাঁকা করে তীর ছুঁড়লে তীরটি নিচু হয়ে ওদের মাথার উপরের ছাদে না লেগে যে কোনো একজন আরবের কাছে পৌঁছাবে। এবার একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এরপর সামনের দিকের এগিয়ে যাওয়া প্রতিটি পদক্ষেপ আমাকে আরও ভালো অবস্থানে নিয়ে চলেছে।
আমার সামনে যে রক্ষীরা ছিল, ওরা আমাকে আড়াল করে রেখেছিল। আমি নিচু হয়ে ধনুকটা ধরলাম। তারপর নিচের দিকে না তাকিয়ে অন্য হাত দিয়ে কোমরবন্ধ থেকে একটা তীর বেছে নিলাম। ধনুকটা যেখানে হাতে ধরেছিলাম তার উপর তীরের মাথা রেখে বাম হাতের তর্জনী দিয়ে তীরটা চেপে ধরে রাখলাম।
আমার উটটি আমাকে নিয়ে ধীরে ধীরে আরও পাঁচ পা সামনে এগোল। ঠিক তখনই বেদুঈনদের সারি থেকে একজন লোক উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের মুখোমুখি হল। সে মুখটাকা কাপড়টি সরিয়ে আরবীতে গর্জে উঠলো।
থামো! আর কাছে এগোবে না! তার কণ্ঠস্বর মাথার উপরের ছাদে প্রতিধ্বনিত্ব হয়ে গমগম করে উঠলো।
কালো দাড়িওয়ালা শয়তান লোকটাকে দেখেই আমি চিনতে পারলাম। তিনদিন আগে তেহুতিকে ঘোড়ার পিঠে ফেলে পালিয়ে যাওয়ার সময় সে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসছিল। সে চিৎকার করে বলে উঠলো,
আমি আল-হাওয়াসাঈ, বেদুঈন সর্দার। সবাই আমাকে ভয় পায়!
তারপর সে নিচু হয়ে ঘোড়ার মৃতদেহগুলোর পেছনে যেখানে তেহুতিকে লুকিয়ে রেখেছিল, সেখান থেকে তাকে টেনে দাঁড় করাল।
সে এমনভাবে তেহুতিকে ধরে রাখলো যেন আমরা তার মুখ দেখে তাকে চিনতে পারি। একহাত দিয়ে সে তেহুতির গলা শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে রেখেছে, যাতে সে নড়াচড়া বা চিৎকার করতে না পারে। তার ডান হাতে একটা নাঙ্গা তলোয়ার ধরা রয়েছে। তেহুতির দেহ দিয়ে সে নিজের দেহ আড়াল করে রেখেছে।
আল-হাওয়াসাঈ তেহুতির পরনের সমস্ত পোশাক খুলে ফেলেছে। আমি জানি সে এটা করেছে তাকে অপমান করার জন্য আর দেখাতে যে সে সম্পূর্ণভাবে তার উপর কর্তৃত্ব খাঁটিয়েছে। তার গলা পেঁচিয়ে ধরা দস্যুর বিশাল লোমশ হাতের তুলনায় তেহুতির অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো কীরকম কমনীয় আর শিশুর মতো দেখাচ্ছে। ভয়ে তার চোখদুটো বড় বড় হয়ে রয়েছে।
জারাস এক লাফে উটের পিঠ থেকে নামলো। তখনও উল্টো করে ধরা তলোয়ারটা হাতে নিয়ে সে আল-হাওয়াসাঈয়ের দিকে ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করলো। আল-হাওয়াসাঈসের মতো সেও তার শিরস্ত্রাণের মুখের ঢাকনা খুলে নিজের চেহারা প্রকাশ করে রেখেছে।
জারাসকে চেনার সাথে সাথে তেহুতির মুখ থেকে আতঙ্ক সরে গিয়ে আশার আলো জেগেছে আর তার সাহস ফিরে এসেছে। জারাসের নাম নিতে চেষ্টা করে তার ঠোঁট নড়ে উঠলো, তবে দস্যু শেয়াল শক্তহাতে তার গলা পেঁচিয়ে ধরায় কোনো শব্দ বের হল না।
তার জন্য আমি গর্ব বোধ করলাম, যেরকম তার মায়ের জন্যও করতাম। তবে এখন এসব ভাবনা থেকে আমার মন সরিয়ে নিলাম। দুই চোখ দিয়ে দূরত্বটা মেপে আমার উড়ন্ত তীরের উচ্চতা আর তারপর নিচু হয়ে লক্ষ্যের দিকে যাওয়ার গতিপথটি মনে মনে পরিমাপ করলাম।
অনুভব করলাম বাম কাঁধের পাশ দিয়ে মৃদু হাওয়া বয়ে যাচ্ছে, তবে দেখলাম যেখানে আল-হাওয়াসাঈ দাঁড়িয়ে রয়েছে সে স্থানটি বড় একটি পাথরের টুকরা দিয়ে আড়াল করা রয়েছে। শুধু মাত্র একজন ওস্তাদ তীরন্দাজই এখানে তার লক্ষ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবে। প্রথমে হাওয়ায় ডান দিকে মোড় নেবে, তারপর বাতাসহীন জায়গাটিতে গিয়ে তীরটি নিচের দিকে শেষ কয়েক কিউবিট নিচে নেমে লক্ষ্যে আঘাত হানবে।
আল-হাওয়াসাঈ প্রচণ্ড আক্রোশে জারাসের উদ্দেশ্যে গালি দিতে দিতে তাকে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে বলছিল আর সামনে না এগোতে সাবধান করছিল। ডান হাতে ধরা ছোট তরোয়ালের ব্রোঞ্জের ধারাল পাতটি সে তেহুতির চিবুকের নিচে নরম গলার সাথে চেপে ধরে রেখেছিল।
সে চিৎকার করে জারাসকে বললো, ওখানেই থাম আর নয়তো আমি এই কুত্তির গলা কেটে পুরো দেহ টুকরো টুকরো করে ফেলবো।
জারাস শান্ত কণ্ঠে বললো, কারও মারা যাবার প্রয়োজন নেই। আমরা কথা বলতে পারি। সে আরও এগোতে লাগলো। জারাস আমাকে মূল্যবান সুবিধা দিচ্ছিল। প্রতিটি পদক্ষেপে আমার তীরের পাল্লা আরও সুবিধাজনক জায়গায় পৌঁছাচ্ছে।
আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তার মুখোমুখি হতে গিয়ে আল-হাওয়াসাঈ একটু সরে গিয়ে আমার তীরের লক্ষ্য আরও উন্মুক্ত করে দিচ্ছিল।
এখন শুধু দরকার শেয়ালের মনোযোগ কয়েক মুহূর্তের জন্য অন্য দিকে সরানো যাতে সেই ফাঁকে আমি ধনুকে তীর লাগিয়ে গুণ টেনে তীরটি ছুঁড়তে পারি।
মাথা না সরিয়ে আমি একটি শিকারী বাজপাখির মতো তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ডেকে উঠলাম। আমার জীবনের প্রতীক হচ্ছে আহত বাজপাখি আর আমি এই ডাকটি নিপুণভাবে আয়ত্ব করেছিলাম। এমনকি সবচেয়ে অভিজ্ঞ বাজপাখির শিকারীও আমার ডাক আর আসল পাখির ডাকের মধ্যে পার্থক্য বের করতে পারবে না। চতুর্দিকে পাথরের দেয়ালে প্রতিধ্বনিতৃ হয়ে শব্দটি আরও জোড়ালো হয়ে উঠলো।
সমস্ত বেদুঈন বাজপাখি খুব পছন্দ করে। আর আল-হাওয়াসাঈও এই স্মৃতি জাগানিয়া ডাকটি শুনে নিজেকে সামলাতে পারলো না। গালাগালি থামিয়ে সে উপরের দিকে তাকিয়ে খুঁজতে লাগলো কোথা থেকে এই ডাকটি এসেছে। মুহূর্তের জন্য সে মনোযোগ অন্য দিকে সরিয়েছিল, তবে সেটাই আমার জন্য যথেষ্ট ছিল।
আমি ধনুক আর ভালো তীরটি এক সাথে করে ছোঁড়ার জন্য প্রস্তুত হলাম। ধনুকের গুণ টেনে ছেড়ে দিতেই তীরটা উড়ে গেল। লক্ষ্য করলাম তীরটা উপরের দিকে উঠে এর সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছলো। শেয়ালের মাথার উপরের পাথরের ছাদটি না ছুঁয়ে এর উপর দিয়ে পার হল, তারপর নিচের দিকে পড়তে শুরু করলো।
আমার মনে হচ্ছিল যেন এটি একটি রাজকীয় ভঙ্গিতে চলছে, তবে আমি জানি কেবল আমার মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সম্পন্ন লোকই তা জানতে পারে।
তারপর আমি লক্ষ্য করলাম শেয়ালের দুই চোখ তার কোটরে ঝির ঝির করে কেঁপে উঠলো। অসম্ভব ব্যাপার, হয় সে এটা সে দেখেছে কিংবা একটি বন্য পশুর মতো অনুভব করেছে যে, আমার ছোঁড়া তীরটা তাকে আঘাত করতে যাচ্ছে। সে মাথাটা সামান্য ঝাঁকি দিল আর তার শরীরটি ঘুরতে শুরু করলো। তারপর আমার তীরটি তার বুকের উপরের অংশের এক পাশে বিধলো। আমার লক্ষ্যভ্রষ্ট করার জন্য সে একটু নড়েছে, আমি বুঝতে পারলাম তীরটি তার হৃৎপিণ্ডে লাগেনি।
তবে যাই হোক তীরের ধাক্কায় সে পেছনের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। সাথে সাথে দুই হাত উপরের দিকে তুলে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করলো। তারপর তার পা দুটো ভেঙে পড়তেই সে মাটিতে পড়ে গেল।
তেহুতি তার হাত থেকে ফসকে ঘুরে পড়ে গিয়েছিল। আমি দেখলাম সে হাওয়ার মাঝে এক পাক ঘুরে একটি বিড়ালের মতো ক্ষিপ্রগতিতে মাটিতে দুপা রেখে দাঁড়াল। তাৎক্ষণিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মুহূর্তের জন্য একটু হকচকিয়ে গেলেও নিজেকে সামলিয়ে নগ্ন দেহে সুন্দর মেয়েটি একটি মোহনীয় ভঙ্গিতে দাঁড়াল।
আমাদের আগেকার পরিকল্পনা মোতাবেক জারাস বাজপাখির ডাকটির জন্য অপেক্ষা করছিল। আমি পাখির ডাক শুরু করার সাথে সাথে সে যেখানে তেহুতি দাঁড়িয়েছিল সেদিকে ঝাঁপ দিল।
শিকারী চিতার মতো ক্ষিপ্র গতিতে সে লাফ দিয়েছিল। তেহুতির কাছে পৌঁছাবার জন্য তাকে মাটিতে পড়ে থাকা শেয়ালের দেহ পার হতে হচ্ছিল। সে দেখতে পেল আমার তীরটি শেয়ালের বুকের উপরের অংশে বিধে রয়েছে, তাই সে মনে করলো দস্যুটি মরে গেছে। তাই সে তার দিকে আর মনোযোগ দিল না। কী ঘটছে, অন্য বেদুঈনরা তা বুঝে উঠার আগেই সে তেহুতির কাছে পৌঁছে গেল। তেহুতিকে জাপটে ধরে পেছনে ঠেলে নিয়ে তার সামনে নিজের দেহ দিয়ে তাকে আড়াল করে দাঁড়াল। সাথে সাথে উল্টো করা তলোয়ারটা শূন্যে ছুঁড়ে আবার মাটিতে পড়ার আগেই তলোয়ারের বাট ডান হাতে ধরে তেহুতির সামনে প্রহরীর মতো দাঁড়াল। সামনের দিকে থেকে আরবরা আক্রমণ করলে তাদের মোকাবেলার করার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।
ওদেরকে রক্ষা করার জন্য আমি রক্ষীদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠলাম, এগিয়ে যাও! আক্রমণ কর! উট নিয়ে সামনের দিকে এগোতে এগাতে আমি ধনুকে আরেকটা তীর জুড়লাম। লক্ষ্য করলাম একজন আরব তীরন্দাজ জারাসের দিকে তীর ছুঁড়ার জন্য তার ধনুক উঁচু করেছে।
আরব লোকটির আগেই আমি তীর ছুঁড়লাম। ঠিক সময়ে আমার তীরটা তার গলায় বিঁধলো। তার তীরটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পড়ে যেতেই সে হাঁটু ভেঙে মাটিতে পড়ে দুই হাত দিয়ে গলায় বেঁধা আমার তীরটা আঁকড়ে ধরলো। মুখ থেকে গল গল করে লাল টকটকে রক্ত বের হতে লাগলো।
আরেকজন আরব জারাসের দিকে ছুটে গিয়ে মাথার উপর তলোয়ার তুলে জারাসকে আঘাত করতে উদ্যত হল। জারাস এক ধাক্কায় লোকটির তলোয়ারটা একপাশে সরিয়ে দিয়ে তার নিজের তলোয়ার দিয়ে লোকটির তলোয়ার ধরা হাতটা এক কোপে বিচ্ছিন্ন করে দিল। আরব লোকটি আর্তচিৎকার করে কাটা হাতের মুড়োটি অন্য হাতে ধরে পেছনের দিকে পড়ে গেল। সে গলায় তীর বেঁধা অন্য আরবটির গায়ের উপর উল্টে পড়লো।
আমি তৃতীয় তীরটি ছুঁড়ে আরেকজন বেদুঈন দস্যুকে ঘায়েল করলাম। জারাস আমার দিকে ফিরে দাঁত বের করে তাকিয়ে হাসতে লাগলো। মনে হল বোকা ছেলেটি এই লড়াই বেশ উপভোগ করছে।
আমি চিৎকার করে তাকে বললাম, তেহুতিকে নিয়ে এখানে চলে এসো!
সে দুহাত দিয়ে তেহুতিকে ছোট্ট একটি শিশুর মতো মাটি থেকে তুলে তার বাম কাঁধে ফেলে নিয়ে চললো।
তেহুতি পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে চিৎকার করতে লাগলো, আমাকে নামিয়ে দাও! জারাস তার প্রতিবাদে কোনো কান না দিয়ে তাকে কাঁধে নিয়ে আমার কাছে আসতে শুরু করলো। আমরাও তার দিকে এগোতে লাগলাম।
আল-হাওয়াসাঈ তখনও তীর বেঁধা অবস্থায় একই জায়গায় মাটিতে পড়েছিল। তার দিকে কোনো খেয়াল না করে আমরা আক্রমণরত অন্যান্য বেদুঈনদের সামলাতে ব্যস্ত ছিলাম। অন্যান্যদের মতো আমিও সমান দোষী। আমি জানতাম আমার তীরটি শেয়ালের হৃদপিণ্ডে আঘাত করেনি, হয়তো সে এখনও জীবিত আছে। তবে আমি ভেবেছিলাম তাকে আমি পঙ্গু করে ফেলায় তার তরফ থেকে কোনো বিপদের আশঙ্কা নেই। হাতপা দুই দিকে ছড়িয়ে সে মাটিতে পড়েছিল আর তার তলোয়ারটিও তার দেহের নিচে আটকা পড়েছিল।
তাকে পার হয়েই জারাসকে তেহুতির কাছে পৌঁছতে হয়েছিল। এখন সে আবার পিছিয়ে তার দিকেই আসছিল। জারাসের সমস্ত মনোযোগ ছিল তার চারপাশ ঘিরে থাকা অন্যান্য আরবদের দিকে।
হঠাৎ আল-হাওয়াসাঈ মাটিতে এক গড়ান দিয়ে ঘুরে বসলো। ডান হাতে তলোয়ারটি ধরা রয়েছে, তবে তার উঠে দাঁড়াবার শক্তি নেই।
আমি চিৎকার করে উঠলাম, সাবধান জারাস! পেছনে দেখো জারাস! শেয়াল তোমার পেছনে!
লড়াইয়ের কোলাহলে হয়তো সে আমার চিৎকার শুনতে পায় নি কিংবা আমার সাবধান বাণীর অর্থও ঠিকমতো বুঝতে পারেনি। তাই সে আরেক কদম পিছোতেই আল-হাওয়াসাঈয়ের তলোয়ারের আওতায় চলে এলো।
হতাশায় অসংলগ্ন এক চিৎকার করে শেয়াল তাকে আঘাত করলো। আঘাতটা এলো নিচে আর পেছন দিক থেকে। আঘাতটি সেরকম জোরদার না। হলেও তলোয়ারের ধারাল ডগাটি জারাসের চামড়ার পোশাক ভেদ করে তার দুই পায়ের মাঝখানে ঢুকে গেল।
আল-হাওয়াসাঈ দুর্বল হাতে তলোয়ারটি জারাসের শরীর থেকে টেনে বের করতে চেষ্টা করলো, কিন্তু টেনে বের করার মতো শক্তি তার ছিল না। সে পেছন দিকে হেলে এক কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে বসলো। তারপর নিঃশ্বাস নেবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতেই বুকে বেঁধা তীরটি ঠিক তখনই এক হ্যাঁচকা টানের চোটে তার নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিল। মুখের এক পাশ দিয়ে রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
এদিকে জারাসের পুরো দেহ বেঁকে উঠে তারপর শক্ত হয়ে দাঁড়াল। তার ডান হাত থেকে তলোয়ারটা মাটিতে খসে পড়লো। তেহুতি তার বাম হাতের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে মাটিতে পা রেখে দাঁড়াল।
যন্ত্রণার মাঝে সে কোনোরকমে তেহুতিকে বললো, তায়তার কাছে চলে যান। আমি মারা যাচ্ছি। তায়তা আপনাকে রক্ষা করবে। তারপর সে বাঁকা হয়ে তলপেটের যে জায়গায় তলোয়ারের ডগাটা বিঁধেছে তা অনুভব করলো।
তেহুতি তার উপদেশ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলো। সে জারাসের পাশে অবশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলো জারাসের পোশাকের নিচ দিয়ে তলোয়ারের ডগাটা বের হয়ে রয়েছে আর দুই পায়ের মাঝখান দিয়ে টপটপ করে রক্ত ঝরছে।
জারাস হাঁটু ভেঙে সামনের দিকে পড়ে গেল। মাথা নিচু করে কপাল মাটিতে ঠেকাল।
তার সামনে দাঁড়িয়ে তেতির মুখ রাগে কাঁপছিল, সে আল হাওয়াসাঈর উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলতে লাগলো, তুমি জারাসকে মেরে ফেলেছ! তুমি আমার মানুষকে মেরে ফেলেছ! সে মাটি থেকে জারাসের তলোয়ারটা তুলে নিল। তারপর এমন প্রচণ্ড শক্তিতে শেয়ালের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, যা তার কমনীয় দেহের তুলনায় সম্পূর্ণ অসম্ভব বলা চলে। তলোয়ারের ডগাটি সোজা শেয়ালের কণ্ঠনালীর মধ্য দিয়ে ঢুকিয়ে দিল।
শেয়ালের গলা থেকে হিশশ করে নিঃশ্বাস বের হল, সে দুই হাতে তলোয়ারের ধারাল ফলাটা ধরে থামাতে ব্যর্থ চেষ্টা করে চললো। পাগলের মতো শক্তিতে তেহুতি তলোয়ারটি তার গলা থেকে টান দিয়ে বের করতেই, ধারাল ফলায় শেয়ালের হাড় শুদ্ধ দুটো আঙুল কেটে গেল।
তারপর শেয়ালের দেহের উপর দাঁড়িয়ে তেহুতি একের পর এক তলোয়ারের কোপ মেরে চললো বুকে, পাঁজরের মাঝে আর অন্যান্য জায়গায়।
আমার লোকেরা তেহুতিকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে বাদবাকি জীবিত বেদুঈনদেরকে তাদের বর্শা দিয়ে বিদ্ধ করতে লাগলো।
আমি তাদেরকে ছেড়ে দিয়ে তেহুতির পাশে এসে উটের পিঠ থেকে নামলাম। তাকে বুকে জড়িয়ে চেপে ধরে রাখলাম যতক্ষণ না সে শান্ত হয়, তারপর হাত থেকে তলোয়ারটা নিলাম।
তাকে বললাম, তুমি তাকে দশবার মেরে ফেলেছ। এখন জারাসের আমাদের সাহায্য দরকার। আমি জানি তার নামটি তার রাগ শান্ত করবে আর মনকে স্থির করতে সাহায্য করবে।
.
আমি জারাসকে নড়াচড়া করতে চাচ্ছিলাম না, কেননা তার যখমের যে অবস্থা, এতে অবস্থার আরও অবনতি হতে পারে। লোকজনের সাহায্যে সে যেখানে শুয়েছিল তার উপরে একটা আচ্ছাদন তৈরি করলাম।
তারপর রক্ষীবাহিনীর সার্জেন্টকে বললাম মৃত আরবদের শরীর থেকে পরিষ্কার আর খুব কম রক্তমাখা আলখাল্লাগুলো খুলে নিয়ে আসতে। এগুলো দিয়ে তেহুতির জন্য সূর্যের প্রচণ্ড তাপ আর আমার লোকদের নজর থেকে রক্ষা পাবার জন্য একটা মোটামুটি আলখাল্লার মতো তৈরি করে দিলাম।
তারপর মৃত ঘোড়া আর শেয়ালসহ আরবদের দেহগুলো টেনে নিয়ে একলিগ দূরে মরুভূমিতে ফেলে আসতে বললাম। প্রচণ্ড তাপে এক ঘন্টার মধ্যেই এগুলোতে পচন ধরবে।
আমি আমার জিনিসপত্রের সাথে চিকিৎসার সাজসরঞ্জাম, সামান্য পরিমাণ ভেষজ আর ওষুধ নিয়ে এসেছিলাম। এগুলো সবসময় আমি যেখানে যাই সেখানে আমার সাথেই থাকে, যেন এগুলো আমার দেহের একটি অংশ। তবে জারাসের ক্ষতটি পরীক্ষা শুরু করার আগেই আমি বুঝতে পারলাম, যে কঠিন কাজ আমার হাতে রয়েছে তার জন্য ওষুধের এই পরিমাণ যথেষ্ট নয়।
এখানে কেবল তেহুতির উপর আমার আস্থা আছে। আহত ঘোড়া আর অন্যান্য গৃহপালিত পশুর চিকিৎসার সময় সে আমাকে সাহায্য করেছিল। তারপরও তাকে আমি নিতান্ত শিশুই মনে করি। জারাসের মৃত্যু হবে আর আমি চাই না যে সে তা তাকিয়ে দেখুক। তবে আমার হাতে কোনো উপায় ছিল না।
লাল শেপ্পেন (আফিম) ফুলের এক ঢোক রস বানাতে বানাতে আমি তাকে বললাম, রাজকুমারী, আমাকে তোমার সাহায্য করতে হবে। শক্তিশালী এই রসটি একটি ষাঁড়কেও অচেতন করে ফেলতে পারে।
অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে সে উত্তর দিল, পিরবো। শুধু বল কী করতে হবে।
একটা তামার পেয়ালায় মাদক তরলটি তার হাতে তুলে দিয়ে বললাম, প্রথমে এই রস পুরোটা তাকে খাওয়াতে হবে। সে জারাসের মাথা তার কোলে তুলে নিল। পাত্রটি তার ঠোঁটের কাছে ধরে তার নাক চেপে ধরলো যাতে সে পুরো তরলটা গিলে ফেলে। এদিকে আমি অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি সাজালাম।
জারাসের দুই চোখ বুজে এলো আর শক্তিশালী মাদকের প্রভাবে সে প্রায় অসাড় হয়ে পড়তেই আমরা তার গায়ের বর্ম আর কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত পরনের আঁটোসাট চোগাটা খুলে ফেললাম। মাটিতে ঘোড়ার জিনের কম্বলের একটা বিছানা পেতে তাকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে উপুড় করে শুইয়ে দিলাম। আমি আগেও জারাসকে নগ্নদেহে দেখেছি, তবে সবসময়ের মতো এবারও তার চমৎকার দেহসৌষ্ঠব দেখে মুগ্ধ হলাম। তবে মনে দুঃখ পেলাম ভেবে যে, এতো শিগগরই প্রকৃতির এই অপূর্ব সুন্দর কীর্তিটিকে আবার মাটিতেই শুইয়ে দিতে হবে।
আমি তার দুই পা ফাঁক করলাম, যাতে শেয়ালের তলোয়ারের ডগাটি যেখান দিয়ে ঢুকেছে সে পর্যন্ত পৌঁছতে পারি। তলোয়ারের ডগাটি তখনও ক্ষতস্থানের মুখে রয়েছে। আমি জানি শল্যচিকিৎসক দাবীদার অনেকেই কোনো কিছু না ভেবে এই অবস্থায় তলোয়ারের ডগাটি টেনে খুলে ফেলবে। এটা করার সাথে সাথে ওরা রোগীর ভাগ্য নির্ধারণ করে ফেলবে।
তলোয়ারের ডগাটির ঢোকার মুখে এর কোণ আর গভীরতা পরীক্ষা করতে করতে আমি দেখলাম তলোয়ারটি তার পুরুষাঙ্গকে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে গেছে। এই বিষয়টি নিয়ে আমার মিশ্র অনুভূতি হল।
জারাস আর তেহুতির জন্য মনে আনন্দ হল। তবে আমার নিজের সম্পর্কে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত নই। ভালোই হতো যদি জারাসের এই অঙ্গটি তলোয়ারের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হতো, তাহলে অনেক বিষয়ে আমার দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যেত। তবে এই অশুভ চিন্তাকে মন থেকে দূর করে দিয়ে ক্ষতস্থানটি থেকে তলোয়ারের ডগাটি বের করার দিকে মনোযোগ দিলাম।
এটি তার বাম নিতম্বের পাশ দিয়ে চলে গেছে। মেরুদণ্ডের নীচের অংশে শ্রোণীর ভারী অস্থিকাঠামোতে আঘাত করলে হয়তো ডগাটি বেশি দূর যেতে পারতো না।
তবে তা হয়নি। একটা পথ করে নিয়ে ডগাটি জারাসের নাড়িভূঁড়ি পাকস্থলীর যে অস্থি-গামলায় থাকে সেখানে ঢুকেছে। আমার শত শত মানব শবদেহ ব্যবচ্ছেদ করে পরীক্ষা করার সুযোগ হয়েছিল। আমি জানি আমরা যে খাবার গ্রহণ করি তা কীভাবে, এই মোটা বা মাংসল নলের ভেতর দিয়ে ঢুকে নিচের দিকে যায়। তারপর নিতম্বের মাঝে স্থাপন করা ভিত্তিগত বহির্মুখ দিয়ে বর্জ্য ত্যাগ করে খালি হয়।
এবার আমি আতঙ্কিত হলাম। শেয়ালের তলোয়ারটি যদি জারাসের নাড়িভূঁড়ির এই নলগুলির কোনো একটি ছিদ্র করে থাকে, তাহলে বর্জ্যগুলো তার পাকস্থলিতে ঢুকে পড়তে পারে। এই বর্জ্য যাকে আমরা সাধারণত পশুর মল বলে থাকি, এতে বিশেষ ধরনের দুর্গন্ধময় দূষিত রস বা ধাতু থাকে। এই রসটি মারাত্মক বিষাক্ত, দেহে ছড়িয়ে পড়লে জখম স্থানের মাংসে পচন ধরে গ্যাংগ্রিন হয়। পরিণতিতে মৃত্যু অবধারিত।
তলোয়ারটি এক টানে বের করতে হবে। আমি ছয়জন শক্তিশালী লোককে ডেকে আনলাম, কেননা তার যে যন্ত্রণা হবে তাতে আমি যে শক্তিশালী আফিম খাইয়েছিলাম তাও অকার্যকর হয়ে পড়বে।
তেহুতি তার মাথা কোলে নিয়ে বসলো। সে জারাসের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে একজন মা যেমন তার শিশুকে গুণগুণ করে গান শোনায় সেরকম করতে লাগলো। অন্যরা বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নিয়ে তার হাত পা মাটিতে চেপে ধরলো। আমি তার দুই পায়ের মাঝে হাঁটুগেড়ে বসে শক্ত করে দুই হাতে তলোয়ারের হাতলটা ধরলাম।
আমি নির্দেশ দিলাম, ধরে থাক! তারপর একটু পেছনে হেলে শরীরের সমস্ত ভার আর শক্তি প্রয়োগ করলাম। তলোয়ারের পাতটা যখমের মুখে একটু বাঁকা করে রাখলাম যাতে মাংসপেশিতে আর ভেতরে কোনোধরনের ক্ষতি না হয়।
জারাসের পুরো দেহ শক্ত হল। তার সমস্ত মাংসপেশি মার্বেলের মতো শক্ত হল আর প্রচণ্ড যন্ত্রণায় সে একটা আহত ষাঁড়ের মতো চেঁচিয়ে উঠলো। ছয়জন বলশালী মানুষও তাকে চেপে ধরে রাখতে পারছিল না। দীর্ঘ একটি মুহূর্ত কিছুই হল না। ব্রোঞ্জের তলোয়ারের পাতটি ভেতরের মাংসপেশিতে আটকে রয়েছে। তারপর হঠাৎ ঝটকা মেরে তলোয়ারটি বের হয়ে আসতেই আমি পেছন দিকে উল্টে পড়লাম।
কাঁপতে কাঁপতে জারাস শেষ আরেকবার গোঙানী দিয়ে জ্ঞান হারাল। আমি একটা ভেড়ার লোমের পট্টি বানিয়ে রেখেছিলাম। এবার পট্টিটা ক্ষতস্থানের উপর রেখে তেহুতিকে নির্দেশ দিলাম, সমস্ত শক্তি দিয়ে এটা এজায়গায় চেপে ধরে রাখ, যেন রক্ত বের না হয়। তারপর জারাসকে ধরে রাখা লোকদেরকে বললাম, এবার ছেড়ে দাও ওকে।
তারপর হাতে ধরা তলোয়ারটার দিকে তাকিয়ে পরিমাপ করলাম ডগাটা কতটুকু ভেতরে ঢুকেছিল।
পরিমাপটি আন্দাজ করার পর বললাম, দেড় হাত পর্যন্ত ভেতরে ঢুকেছিল। বেশ গভীরই মনে হচ্ছে।
ক্ষতস্থানে তেহুতি যে পট্টিটা ধরে রেখেছিল সেটা তুলে নিচু হয়ে জখমটা পরীক্ষা করলাম।
বেশ মোটা হয়ে কেটেছে। পট্টি সরাতেই রক্তের চিকন ধারা গড়িয়ে পড়লো। দেখে মনে হচ্ছে পরিষ্কার আর স্বাস্থ্যকর রক্ত। একটু কাছে মুখ নিয়ে শুকলাম। কোনো পুঁজের গন্ধ নেই।
এবার একটু ক্ষীণ আশার আলো অনুভব করলাম। হয়তো তলোয়ারের ধারাল ফলাটি কোনো নাড়িভূড়ি কাটে নি।
তেহুতি জিজ্ঞেস করলো, কী দেখছো?
দেখছি কতটুকু আশা আছে।
ভেড়ার লোমের পট্টিটা জখমের উপর রেখে একটা শক্ত বাঁধন দিলাম আর বদ রস প্রতিরোধ করতে সামান্য কয়েকফোঁটা মদ ছড়িয়ে দিলাম। এরপর জারাসের পেছন দিকে গিয়ে দুই নিতম্বের উপর হাত রাখলাম। তারপর শরীর শক্ত করে নিতম্ব দুদিকে টেনে ফাঁক করলাম। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। মলদ্বার পরিষ্কার আর এঁটে রয়েছে।
আরেকটি পরীক্ষা করতে হবে। ওর পেছনে হাত রেখে নিচের দিকে জোরে চাপ দিলাম। অন্ত্র থেকে ফুত ফুত শব্দ করে বায়ু বের হল, তারপর মলদ্বার থেকে ফিনকি দিয়ে তরল বিষ্ঠা আর তাজা রক্ত বের হল। দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়তেই আমি আর তেহুতি দুজনেরই মুখ কুঁচকে উঠলো।
এবার আমি নিশ্চিত হলাম তলোয়ারটি আসলেই অন্ত্রে আঘাত করেছে। এতে বেশ হতাশা অনুভব করলাম। জারাসের আর কোনো আশা নেই। পৃথিবীর কোনো শল্যচিকিৎসক, এমনকি আমিও তাকে বাঁচাতে পারবো না। সে এখন দেবতা শেঠের হয়ে গেছে।
তেহুতির দিকে না তাকালেও অনুভব করছিলাম, সে ঠিকই আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
ফিসফিস করে সে বললো, তায়তা দয়া কর। তুমি কি তার প্রাণ বাঁচাতে পারো না? আমার জন্য কি জারাসকে বাঁচাতে পারো না? একটা উত্তর তাকে আমার দিতে হবে। এভাবে তাকে আর যন্ত্রণা দেওয়া যায় না।
মাথা তুলে ওর দিকে তাকালাম। তার চেহারায় এমন দুঃখ বেদনা কখনও দেখিনি।
মনে আর ঠোঁটের ডগায় না বলার জন্য প্রস্তুতি নিলাম, এমনকি মাথাও নাড়লাম। তবে না শব্দটি আর উচ্চারণ করা হল না। এই দুই তরুণ-তরুণীকে পরিত্যাগ করতে পারলাম না।
হ্যাঁ! তোমার জন্য আমি তাকে বাঁচাতে পারবো তেহুতি। জানি একথা বলাটা অত্যন্ত নিষ্ঠুরতা। মিথ্যা আশ্বাসের চেয়ে চূড়ান্ত অবস্থা অবশ্যই ভালো। তবে আমি তার দুঃখ সহ্য করতে পারছিলাম না।
তাই মিথ্যা বলার জন্য নীরবে ভালো দেবতার কাছে ক্ষমা চাইলাম। তারপর জারাসের আত্মার জন্য শেঠের সাথে লড়াই শুরু করলাম।
.
এটুকু আমি নিশ্চিত জানতাম যে, আমাকে খুব দ্রুত কাজ করতে হবে। কোনো মানবদেহই দীর্ঘক্ষণ নিদারুণ যন্ত্রণা সহ্য করে টিকে থাকতে পারে। কীভাবে কি করতে হবে তার কোনো নির্দেশনামা আমার কাছে নেই। আমি এখন যা করতে যাচ্ছি পৃথিবীর আর কোনো শল্যচিকিৎসক তা কখনও করতে সাহস করেনি।
আর যে এক পাত্র লাল শ্যাপ্পেন আছে তা দিয়ে জারাসকে বড়জোর এক ঘন্টা অজ্ঞান রাখা যাবে। এর পুরোটাই এখন লাগবে।
তলপেট কেটে দেখতে হবে জারাসের নাড়িভূঁড়ির কোনো জায়গায় কেটেছে। তারপর তলোয়ার কাটা অংশটিতে সেলাই করতে হবে। আর অন্ত্র থেকে পেটে যে বদ রসটি ঢুকেছে তা ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে।
সৌভাগ্যবশত ময়াগুহা থেকে বের হবার সময় অন্য সবার মতো জারাসও কম খাবার খেয়ে বের হয়েছিল। খাবার কম থাকায় সবার খাবারের পরিমান কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। তার অন্ত্রে খুব বেশি বর্জ্য থাকার কথা নয়। আমার কাছে উইলো গাছের ছাল আর সেডার গাছের নির্যাসের মিশ্রণ ছিল, তবে বিষ ধুয়ে ফেলার মতো যথেষ্ট পরিমাণে ছিল না। তবে সবচেয়ে ফলপ্রসু ছিল চোলাই করা মদের পাতন। কেবল ছোট একটি চামড়ার মশক ভর্তি চোলাইকরা মদ ছিল। মূল্যবান এই তরল একটি ছোট বাটিতে ঢেলে আমি আর তেহুতি হাত ধুয়ে নিলাম।
আমি অনেক আগে আবিষ্কার করেছিলাম তাপে জীবদেহ নিঃসৃত রস ধ্বংস না হলেও পরিমাণে কমে যায়। আমার নির্দেশে দুজন লোক বড় একটি পাত্র আগুনে চড়াল। পানি যখন টগবগ করে ফুটতে শুরু করলো তখন আমি আমার ব্রোঞ্জের শল্য কাঁচি, সুচ আর যন্ত্রপাতি আর ক্ষতস্থান সেলাইয়ের সুতা ফুটন্ত পানিতে ডুবালাম।
বড় আরেক মাত্রা লাল শ্যাপ্পেন ফুলের রস জারাসের গলা দিয়ে জোর করে ঢুকালাম। আর এদিকে তেহুতি চোলাই মদ দিয়ে তার পেট স্পঞ্জ করতে শুরু করলো।
তারপর রক্ষীরা আবার জারাসকে শক্ত করে মাটিতে শুইয়ে ধরলো। তার দাঁতের ফাঁকে দুই স্তর চামড়ার ফালি রাখলাম, যাতে প্রচণ্ড বেদনা উঠলে তার দাঁত কপাটি লেগে দাঁত ভেঙে না যায়। সবকিছুই প্রায় প্রস্তুত হয়েছে, আর দেরি করার কোনো কারণ নেই।
প্রথমে নাভির ঠিক নিচে থেকে শুরু করে তলপেটের নিচের হাড় পর্যন্ত লম্বা করে কাটলাম। চামড়ার ফালির মধ্য দিয়ে জারাস গোঙাতে শুরু করলো আর মাথা এপাশওপাশ করতে লাগলো।
তেহুতিকে দেখালাম কীভাবে লম্বা কাচির দুই প্রান্তে আঙ্গুল ঢুকিয়ে ক্ষতস্থানের মুখটা টেনে খুলে রাখতে হবে। এবার আমি কব্জিসহ দুই হাত তার পেটের ভেতরে ঢুকালাম। তলোয়ারের ফলাটি কোন পথ দিয়ে ঢুকেছিল, তার একটা ছবি আমি মনে মনে এঁকেছিলাম। এখন সেই পথে হাত চালিয়ে কাজ শুরু করলাম।
প্রায় সাথে সাথেই অন্ত্রের পিচ্ছিল দড়ির মতো অংশে আমার কড়ে আঙুলের সমান একটি ছিদ্র খুঁজে পেলাম। ছিদ্রটা দিয়ে তীব্র কটু গন্ধ ছড়ানো পরিপাক করা খাদ্যকণা বের হয়ে আসছিল।
বাঁকা ব্রোঞ্জের উঁচ আর শল্যসুতা দিয়ে কয়েকটা সেলাই দিয়ে কাটা অংশটা বন্ধ করলাম। আর কোনো ছিদ্র রয়ে গেল কি না তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য রাবারের সাপের মতো অন্ত্রটা দুই হাতের মাঝে ধরে চিপলাম। আমার সেলাই পানি নিরোধক হলেও চাপের ফলে অন্ত্রের আরও গভীরে তিনটি কাটা জায়গা থেকে বাদামি রংয়ের ঘোলা ময়লা চুঁইয়ে বের হতে লাগলো।
এই ছোট কাটা জায়গাগুলোতেও দ্রুত সেলাই করে ছিদ্রগুলো বন্ধ করলাম। আমি দেখতে পেলাম এই কঠিন শল্য চিকিৎসার চাপে জারাস ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে আসছে।
যখন আমি সন্তুষ্ট হলাম যে, তলোয়ারের আর কোনো জখম নেই তখন আমার আর তেহুতির উভয়েরই বিষ্ঠার দুর্গন্ধ সয়ে এসেছে। তবে এতে সচেতন হলাম যে, কাটা পেট আবার সেলাই করে বন্ধ করার আগে তার দেহ থেকে সমস্ত দূষিত রস ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে। এরকম দুর্গন্ধময় রস নিশ্চয় খারাপই হবে।
তেহুতি তখনও তার পেট ফাঁক করে ধরে থাকা অবস্থায় আমি মুখভর্তি চোলাই মদ নিয়ে তার অন্ত্রের গর্ত আর কুণ্ডলীগুলোর মধ্যে কুলি করে ফেললাম। তারপর তাকে একপাশে কাত করে তরলটি পেট থেকে বের করে দিলাম।
তারপর পানি ফুটিয়ে শরীরের তাপমাত্রার সমমাত্রায় ঠাণ্ডা করার পর সেই পানি দিয়ে আমরা তার নাড়িভূড়ি ধুয়ে পানিটা আবার পেট থেকে বের করে দিলাম।
সবশেষে আমরা আমাদের প্রস্রাব দিয়ে তার পেটের ভেতরটা ধুয়ে দিলাম। দেহনিঃসৃত রসের জন্য এটি সবচেয়ে কার্যকর একটি ঔষধ। তবে প্রস্রাবটি টাটকা হতে হবে এবং অন্য কোনো তরল অথবা শরীরের অন্য কোনো বস্তুর মিশ্রণ দিয়ে দূষিত হওয়া চলবে না। সবচেয়ে ভালো হয়, যদি এটি একটি সুস্থ মুত্রথলি থেকে আসে আর দাতার দেহের বাইরের যৌনাঙ্গ: অর্থাৎ পুরুষের লিঙ্গ এবং লিঙ্গের অগ্রভাগের আবরক তৃক কিংবা নারীর ওষ্ঠ্যের সাথে স্পর্শ না হয়।
আমার জন্য তেমন সমস্যা হল না। তবে তেহুতি প্রথমে একটা পশমের পট্টি চোলাই করা মদে ভিজিয়ে সেটা দিয়ে তার গোপনাঙ্গ ধুয়ে নিল। তারপর আমি অন্যপাশে সরে দাঁড়ালে সে জারাসের উপর বসে তার ভোলা পেটের ভেতরে প্রস্রাব করলো। তারপর তৃতীয়বারের মতো আবার জারাসের অচেতন দেহটি এক পাশে কাত করে শেষবারের মতো তার পেট থেকে তরলটি বের করে দিলাম।
এবার পেট সেলাই করে বন্ধ করলাম, প্রতিটা সেলাই করার সময় তার জখম শুকাবার জন্য প্রার্থনা করলাম।
হে অশুভ বিষয়ের দেবতা শেঠ, আমি তোমার নিষ্ঠুর রক্ত লাল মুখ বন্ধ করে দিলাম! এ স্থান থেকে চলে যাও। আমি আদেশ দিচ্ছি যাও!
কবরের দেবতা শেয়ালমাথাওয়ালা আনুবিস, আমার কাছ থেকে সরে যাও। একে বাঁচতে দাও।
হে দয়ালু হৃদয় হাথোর, এর জন্য কাঁদো। এর প্রতি দয়া দেখাও আর তার যন্ত্রণার উপশম কর। একে বাঁচতে দাও!
সবশেষে আমার লিনেনের আলখাল্লা ছিঁড়ে সেই টুকরা দিয়ে তার পেট বাঁধার পর তাকে বহন করার জন্য একটা পালকির মতো বানিয়ে তার উপর তাকে শোয়াতে শোয়াতে অন্ধকার হয়ে এলো। তেহুতি আর আমি তার দুই পাশে বসে থাকলাম, তাকে আরাম দিতে কিংবা যদি কোনো প্রয়োজন হয়।
জ্বরের প্রকোপে জারাস যখন প্রলাপ বকতে লাগলো আর তার শয্যার চতুর্দিকে কল্পিত আর আসল দানবের সাথে লড়াই করতে শুরু করলো, তখন তেহুতি তার পাশে শুয়ে তাকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে থাকলো। সে তাকে শক্ত করে ধরে ঘুম পাড়ানি গান শুনাতে লাগলো।
আমি গানটি চিনতে পারলাম। এটি সেই ঘুম পাড়ানি গান যা গেয়ে রানি লসট্রিস ছোটবেলায় তেহুতিকে ঘুম পাড়াতেন। ধীরে ধীরে জারাস শান্ত হল।
আমাদের আশ্রয় শিবির ঘিরে জারাসের লোকেরা আগুন জ্বেলে তার চতুর্দিকে গোল হয়ে বসলো। আমার মনে হল ওরাও আমাদের মত তার জন্য প্রার্থনা করছে। সারাত রাত আমি ওদের গুণগুণ করা শুনলাম।
ভোরের দিকে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
.
ছোট্ট গরম একটি হাত আমার কাঁধ ধরে টানাটানি করতেই ঘুম ভেঙে গেল। আমাদের অস্থায়ী আশ্রয়ের ছাদের ফাঁক দিয়ে দেখলাম ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই। মাত্র কিছুক্ষণ ঘুমিয়েছি, তারপরও অপরাধবোধে মন ছেয়ে গেল; মনে হল যেন আমি একটা খুন করেছি।
বহুকষ্টে কান্না থামিয়ে তেহুতি আমাকে বললো, তায়তা ওঠো। আমাকে সাহায্য কর।
কী হয়েছে রাজকুমারী?
ওর সারা শরীর আগুনের মতো গরম। মনে হচ্ছে ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে। এমন গরম যে গায়ে হাত দেওয়া যাচ্ছে না।
চুঙির মতো একদিকে সরু হয়ে যাওয়া একটা সেডার কাঠের টুকরা আমার কাছে ছিল। এর ডগাটা নিভু নিভু আগুনের কাঠকয়লার উপর ঠেসে ধরে ফুঁ দিলাম। আগুন ধরতেই বিছানার মাথার কাছে একটা তেলের প্রদীপ জ্বেলে জারাসের উপর কুঁকলাম।
সারা মুখ ঘামে চকচক হয়ে আছে। চোখ খোলা তবে জ্বরের ঘোরে আচ্ছন্ন। হয়ে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। আমরা তাকে ধরে স্থির করার চেষ্টা করতেই সে এক ঝটকা মেরে আমাদেরকে সরিয়ে দিল। মাথা এপাশ ওপাশ করতে করতে চিৎকার করে আমাদেরকে অভিশাপ দিতে লাগলো।
আমি এটা আশা করেছিলাম। আমি ভালোভাবেই জানতাম খারাপ রসে আক্রান্ত হওয়ার কারণে জ্বর খুব বেড়ে যেতে পারে। এরকম আরও কয়েকটি ঘটনা আমি আগে দেখেছিলাম। সব ক্ষেত্রেই রোগী শেষ পর্যন্ত মারা গিয়েছিল। তবে এর জন্য প্রাথমিক প্রস্তুতি আমি আগে থেকেই নিয়ে রেখেছিলাম।
আবার ছয়জন বলিষ্ঠ রক্ষীকে ডেকে সবাই মিলে জারাসকে ঘোড়ার কম্বলগুলো দিয়ে পেচিয়ে জোরে চেপে ধরলাম যেন সে মাথা ছাড়া আর কিছু নড়াচড়া করতে না পারে। তারপর বালতি দিয়ে পানি ঢেলে কম্বলগুলো ভেজালাম আর হাওয়া দিতে থাকলাম যাতে পানি শুকিয়ে যায়। এতে জারাসের গায়ের তাপ কমতে কমতে এক পর্যায়ে সে ঠাণ্ডায় কাঁপতে শুরু করলো।
এভাবে সারা সকাল করে চললাম, তবে দুপুরের দিকে তার শক্তি কমে এল। এর আগে আমার এ-ধরনের রোগীদের যা হয়েছিল সেসব লক্ষণ তার মাঝে ফুটে উঠলো। আমি যে চিকিৎসা পদ্ধতি তার উপর জোর করে চাপিয়ে দিচ্ছিলাম তা সহ্য করার ক্ষমতা সে হারিয়ে ফেলেছে।
মুখ দিয়ে কোনো শব্দ না বললেও সে দাঁতে দাঁত লেগে কিড়মিড় করছিল। গায়ের চামড়া বিবর্ণ নীল হয়ে যাচ্ছিল।
গা থেকে কম্বল সরিয়ে দেবার পর তেহুতি আবার তাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি বলেছিলে তাকে বাঁচিয়ে তুলবে তায়তা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তা হয়তো পারবে না।
তার হতাশার গভীরতা আমাকে ছুরির মতো বিদ্ধ করলো।
হাইকসোদের মিসর আক্রমণের মুখে দেশ ছেড়ে পালাবার সময় আমরা আফ্রিকার দূরতম প্রদেশের মধ্য দিয়ে পাড়ি দিয়েছিলাম। অনেক বছর ধরে আমরা গহীন জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছি। তারপর আবার শক্তি সঞ্চয় করে নিজভূমিতে অধিকার রক্ষায় ফিরে এসেছিলাম। সে সময়ে আমি কালো উপজাতিদের সাথে মিশে ওদেরকে জানতে আর শিখতে পেরেছিলাম। তাদের শক্তি আর বিশেষ দক্ষতা দেখে আমার ঈর্ষা হত। বিশেষত আমি শিলুক উপজাতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাদের অনেকের সাথে বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলাম।
এদের মধ্যে উমতাগ্নাস নামে প্রাচীন এক ওঝা ছিল। আমাদের দলের লোকেরা তাকে একজন আদিম ডাকিনীবিদ্যা চর্চাকারী ওঝা মনে করতো যে প্রেত সাধনা করতো। তাকে ওরা বন্য পশুর চেয়ে এক ধাপ উঁচু মনে করতো। এ-ধরনের লোক দূর দক্ষিণাঞ্চলে অনেক রয়েছে। তবে আমি বুঝতে পেরেছিলাম সে ছিল একজন জ্ঞানীলোক যার অনেক বিষয়ের জ্ঞান রয়েছে, যা উত্তর থেকে আসা আমাদের নজর এড়িয়ে গেছে। সে আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছিল।
বয়সের ভারে ন্যুজ হয়ে যখন সে মৃত্যুর কাছাকাছি হয়েছিল তখন সে। আমার হাতে একটা চামড়ার থলে গুঁজে দিয়েছিল। এতে রোদে শুকানো একধরনের কালো ব্যাঙের ছাতা ছিল যা, আমি এর আগে কখনও দেখিনি। এটি গাঢ় মোটা সবুজ ছত্রাক জাতীয় বস্তু দিয়ে মোড়ান ছিল। সে আমাকে সতর্ক করে বলেছিল উপরের আবরণটি যেন না সরানো হয়, কেননা এটি এই ওষুধের রোগ নিরাময় ক্ষমতার একটি অতি প্রয়োজনীয় উপাদান। তারপর সে আমাকে শেখালো এই ছত্রাক দিয়ে কীভাবে এক ফোঁটা তরল তৈরি করা যায়। আরও সাবধান করে জানাল যতটা না রোগ নিরাময় করা যায় তার চেয়ে বেশি এই তরলটি বরং মানুষের প্রাণহানি করতে পারে। এটি তখনই ব্যবহার করা যাবে যখন রোগী আর শূন্যতার মাঝে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
মিসরে ফেরার পর এত বছরে আমি কেবল সাতবার এই ঔষধটি ব্যবহার করেছিলাম। প্রতিটি ক্ষেত্রে আমার রোগী মরণোন্মুখ ছিল। আরেকটু হলেই শেষ হয়ে যেত। ঠোঁটের ফাঁক গলে এক ফোঁটা তরল যাওয়ার প্রায় সাথে সাথে পাঁচজন মারা যায়। ষষ্ঠজন দশ দিন মরণাপন্ন অবস্থায় থাকার পর ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি হতে থাকে, তারপর হঠাৎ একসময় সে মারা যায়।
ফুসফুঁসে তীর বেঁধা সপ্তম রোগীটি কেবল বেঁচে উঠে। সে আবার সুস্থ এবং শক্তিশালী হয়ে উঠে। এখন থিবসে রয়েছে। প্রতিবছর তার আরোগ্য হওয়ার এই অলৌকিক দিনটিতে সে তার সমস্ত নাতিনাতনিসহ আমার সাথে দেখা করতে আসে।
আমি জানি সাতজনের মধ্যে একজন রোগী ভালো হওয়ার পরিসংখ্যান গর্ব করার মতো বিষয় নয়। তবে আমি দেখতে পাচ্ছি জারাসের জীবনের আয়ু আর মাত্র এক ঘন্টা রয়েছে আর তেহুতি আমার দিকে ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে।
হরিণের চামড়ার থলেটিতে আর একমুঠো মাত্র ছত্রাক রয়েছে। একটা তামার পাত্রে পানি নিয়ে তাতে ছত্রাকটি ফুটাতে শুরু করলাম। নির্যাসটা একেবারে কালো আর থকথকে হওয়া পর্যন্ত ফুটালাম। তারপর ঠাণ্ডা হতে দিলাম। এর আগে জারাসের চোয়ালের ফাঁকে একটা কাঠের গেজ দিয়ে মুখটা খোলা রেখে তারপর চামচ দিয়ে নির্যাসটা তার মুখের ভেতরে ঢেলে দিলাম। এর আগে একবার এই মহৌষধের এক ফোঁটা আমি স্বাদ নিয়েছিলাম। এটি ছিল একটি পরীক্ষা তবে আর দ্বিতীয়বার এটা করার ইচ্ছা আমার নেই।
আরকটা মুখে দেওয়ার পর জারাসের প্রতিক্রিয়া আমার মতোই হল। সে এমন ছটফট করতে শুরু করলো যে, ছয়জন শক্তিশালী মানুষ আর তেহুতি মিলেও তাকে ধরে রাখতে পারছিল না। জোর করে যতটুকু গেলান হয়েছিল তার অর্ধেকের বেশি আরক সে বমি করে মুখ থেকে ফেলে দিল। ফেলে দেওয়া অংশটুকু কাচিয়ে নিয়ে আমি দ্বিতীয়বার তার মুখে ঢেলে দিলাম। তারপর চোয়ালের মধ্য থেকে কাঠের গোঁজটা বের করে তার মুখ বন্ধ করে ধরে রাখলাম যাতে দ্রবণটা গলা দিয়ে নিচে চলে যায়। তবে সে বেশ কয়েকবার ছটফট করে বমি করার চেষ্টা করলো।
তারপর তেহুতি আর আমি দুজনে তাকে কম্বল দিয়ে মুড়িয়ে দিয়ে অন্যদেরকে সরে যেতে বললাম। আমরা দুজনে তার দুই পাশে বসে তার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।
ভোরের দিকে তার অবস্থা প্রায় মৃতপ্রায় হল। কম্বল মুড়ি দেওয়া সত্ত্বেও তার তাপমাত্রা নেমে এল আর জালে আটকানো একটা কই মাছের মতো সে ছটফট করতে লাগলো। নিঃশ্বাসের শব্দ প্রায় শোনাই যাচ্ছে না। আমরা দুজনেই একজন একজন করে তার মুখের কাছে কান রেখে তার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে চেষ্টা করছিলাম।
মাঝরাতের একটু পর যখন চাঁদ ডুবে গেল, তখন তেহুতি আমাকে বললো, তার শরীর একটা মরা মানুষের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, তার শরীর গরম রাখতে হলে আমাকে তার সাথে শুতে হবে। সে তার পোশাকটা খুলে জারাসের পাশে কম্বলের ভেতরে ঢুকে পড়লো।
গত তিনদিন আমরা ঘুমাইনি, তবে এখনও ঘুমালাম না আর কোনো কথাও। বললাম না। বলার মতো আর কিছু নেই। সমস্ত আশা ছেড়ে দিয়েছি।
সমাধিক্ষেত্রের সময় এলো: রাতের সবচেয়ে অন্ধকার সময়। আমাদের মাথার উপর দুটো কম্বল জোড়া দিয়ে যে আচ্ছাদন তৈরি করা হয়েছিল তার মাঝে একটা ছিদ্র ছিল। উপরের দিকে তাকিয়ে আমি বিশাল লাল তারা দেখতে পেলাম–আমি জানি এটা শেঠের চোখ।
অশুভের দেবতা আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমার মনে ভয় এলো। আমি জানি জারাস লড়াইয়ে হেরে গেছে আর শেঠ তাকে নিতে আসছে।
তারপর একটি আজব এবং চমৎকার ঘটনা ঘটলো। হঠাৎ তারার আলোটা নিভে গেল। আমার বুক ধক করে উঠলো। ঠিক বুঝতে পারলাম না এটা কি, তবে বুঝলাম যে এটা শুভ কিছু। নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালাম। তেহুতিকে না জাগিয়ে কম্বলের আচ্ছাদনের নিচ থেকে বাইরে এসে উপরে রাতের আকাশের দিকে তাকালাম।
সমস্ত আকাশে অসংখ্য তারা জ্বল জ্বল করছে-কেবল ঠিক আমার মাথার উপরে যেখানে আমি দেবতা শেঠের লাল চোখটি দেখেছিলাম সেই স্থানটি ছাড়া। এখন সেই চোখটি অস্পষ্ট হয়ে এসেছে।
ছোট্ট কালো একটি মেঘ একে ঢেকে ফেলেছে। পুরো আকাশে এটিই একমাত্র মেঘ। আমার হাতের মুঠোর চেয়ে বড় হবে না, তবে এটিই এই ক্ষতিকর শেঠের চোখ অন্ধ করে দিয়েছে।
তারপর একটা গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। উপরের তারাভরা আকাশ থেকে নয়, শব্দটা আসছে নিচে কম্বলের আচ্ছাদনের ভেতর থেকে।
জারাস ফিস ফিস করছে, আমি কোথায়? আমার পেটে কেন এতো ব্যথা করছে?
তারপর আমার অত্যন্ত পরিচিত কণ্ঠস্বরটি সাথে সাথে উত্তর দিল, দাঁড়াতে চেষ্টা করো না বোকা জারাস। চুপ করে শুয়ে থাকো। তোমার খুব বড়ধরনের জখম হয়েছে।
জারাসের কণ্ঠস্বর সচকিত আর হতবাক শোনাল, রাজকুমারী তেহুতি! আপনি আমার বিছানায়। আর আপনার গায়ে কোনো পোশাক নেই। তায়তা এঅবস্থায় আমাদেরকে দেখতে পেলে দুজনকেই মেরে ফেলবে।
খুশিতে নাচতে নাচতে আমি আবার কম্বলের ছাউনির নিচে ঢুকে তার বিছানার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে তাকে আস্বস্ত করে বললাম, এবার নয় জারাস। তবে এরপর হলে কিন্তু ছেড়ে দেবো না।
.
দিনের আলোয় জারাসকে আবার ভালোমত পরীক্ষা করলাম। তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় তার শরীর আমার হাতের মতো ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। পেটের বিরাট ক্ষতের উপরে যে সেলাইটা আমি দিয়েছিলাম সেখান থেকে ফুলে ওঠা কমে এসেছে। গন্ধ শুঁকে দেখলাম, পরিষ্কার মনে হল।
জারাসের খুব পানি পিপাসা পেয়েছিল, তেহুতি ওর জন্য বড় একজগ পানি নিয়ে এলো। সে পুরোটা খেয়ে শেষ করে আরও পানি চাইলো। আমি স্বস্তিবোধ করলাম। এটা একটা নিশ্চিত লক্ষণ যে তার অবস্থা উন্নতি লাভের পথে রয়েছে। তবে সেই সাথে মনে পড়ে গেল পানির বোতলগুলো প্রায় খালি আর সবচেয়ে কাছে পানি রয়েছে কেবল গুহায়, যেখানে বেকাথা আর অন্যান্যদের ফেলে এসেছি।
জারাস প্রতিবাদ করা সত্ত্বেও আমরা তাকে হাঁটতে বা উটে চড়তে দিলাম না। ওর জন্য একটা ঠেলাগাড়ির মতো বিছানা তৈরি করলাম। দুটো লম্বা বর্শার মাঝে ঘোড়ার কম্বল দিয়ে এটা তৈরি করলাম। একটা উটের হাওদার দুইপাশে পেছন দিকে বর্শাদুটার ডগা আটকিয়ে ঝুলিয়ে দিলাম। জারাসকে এই ঠেলার বিছানায় শোয়ালাম।
তেহুতি সেই উটে চড়ে বসলো। সে পেছনদিকে মুখ করে বসলো, যাতে জারাসের প্রতি নজর রাখতে পারে। উঁচুনিচু কিংবা পাথুরে জায়গা এলেই সে উটের পিঠ থেকে লাফিয়ে নেমে জারাসের পাশে এসে তাকে ধরে রাখলো যাতে তার বেশি ঝাঁকুনি না লাগে।
সারাপথ সে জারাসকে ধমকে চললো তাকে সাবধান হওয়ার জন্য।
তৃতীয়দিন বিকেলে জারাস জোর করে বিছানা থেকে নেমে কিছুক্ষণ হাঁটার চেষ্টা করলো। দু-দুবার হোঁচট খাওয়ার পর একজন বুড়ো মানুষের মতো হাঁটতে লাগলো। ঠেলার গায়ে একহাত আর অন্য হাত তেহুতির কাঁধে রেখে সে চলার চেষ্টা করলো। তেহুতি নানারকম উৎসাহব্যঞ্জক কথা বলে তাকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করলো। হাসি উঠলেই সে থেমে দুইহাতে পেট চেপে ধরলো, তবে সেজন্য হাসি থামাল না।
আবার বিশ্রামের জন্য থামতেই আমি আবার উদ্বিগ্ন হয়ে তার ক্ষত পরীক্ষা করে দেখলাম, না ঠিক আছে। শেষ একঢোক আফিমের যে আরকটা ছিল সেটা তাক খাইয়ে দিতেই সে একটা শিশুর মতো ঘুমাল।
পরদিন আরও শক্তিসঞ্চয় করে বেশ দ্রুত অনেকদুর হাঁটলো। আমি জানতাম তেতির সঙ্গ তাকে যথেষ্ট শক্তি যোগাচ্ছে, তাই আমি সামনে এগিয়ে দলের মাথায় গিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। ওদের কথা শুনতে না পেলেও বুঝতে পারছিলাম কি নিয়ে ওরা কথা বলছে।
ওরা জানতো না যে আমি খুব ভালোভাবে ঠোঁট নাড়া দেখে কথা বুঝতে পারি। কাজেই ওরা মনখুলে কথা বলছিল। মাঝে মাঝে তাদের রসিকতা এমন পর্যায়ে পৌচ্ছাছিল যা তার মতো একজন উচ্চবংশীয় মেয়ের জন্য মানানসই। ছিল না। তবে এ-মুহূর্তটা ওদেরকে উপভোগ করতে দিলাম, কেননা আর হয়তো এরকম সুযোগ নাও আসতে পারে।
জারাসের অবস্থার কারণে আমাদের ময়াগুহায় ফিরতে দেরি হচ্ছিল। পঞ্চম দিনেও আমরা সেখানে পৌঁছতে পারিনি। পানি আনার জন্য পাঁচটি উট আমি আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু সেগুলো এখনও ফিরে আসেনি অথচ এদিকে আমাদের পানিও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আমি সবার পানি আর খাবার কমিয়ে দিয়ে প্রতিদিন ছোট মগে তিন মগ পানি আর অর্ধেক রুটি বরাদ্দ করলাম। অবশ্য রাজকুমারীর জন্য নয়। সে যত ইচ্ছা খেতে পারবে। শুধুমাত্র তার জন্য আমি আধা টুকরা পনির আর সামান্য শুকনো লোনা গরুর মাংস বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু সে এই সুবিধা প্রত্যাখ্যান করে সবার মতো সমানভাবে খেতে লাগলো।
চতুর্থদিন সন্ধ্যায় আমি লক্ষ্য করলাম তেহুতি সবার নজর এড়িয়ে একটুকরা শক্ত পনির আর কিছু গরুর শুকনো মাংস তার আলখাল্লার হাতা থেকে বের করে জারাসকে খেতে সাধলো।
তুমি অসুস্থ জারাস। তোমার শক্তি সঞ্চয়ের জন্য এগুলো দরকার।
সে প্রতিবাদ করে বললো, আমি একজন সাধারণ সৈনিক, রাজকুমারী। আপনি আমার প্রতি অশেষ দয়া দেখিয়েছেন। আমি সত্যি কৃতজ্ঞ আপনার দয়ার জন্য, তবে আমার মোটেই ক্ষিদে পায়নি।
সে খুব মৃদুকণ্ঠে বললো, বীর জারাস, তুমি আমার প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে ফেলতে যাচ্ছিলে। তুমি যা চাও আমি খুশি মনে তা দিতে চাই।
আমার মন নরম হয়ে এল। ওদের অঙ্কুরিত ভালোবাসা দেখতে খুব চমৎকার মনে হচ্ছিল। জানি কিছুকাল পরই কঠিন দায়িত্বের কারণে তা ভেঙে চুরমার করে ফেলা হবে।
.
শেষ পর্যন্ত আমরা ময়াগুহায় এসে পৌঁছলাম। আমাদের দলের যারা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল সবাই ছুটে এলো আমাদের স্বাগত জানাতে। উল্লাসে চিৎকার করতে করতে চারপাশ থেকে আমাদেরকে ঘিরে ধরলো, তারপর রাজকুমারী তেহুতির পায়ের কাছে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে তাকে শ্রদ্ধা জানাল। তারপর ওরা তাকে কাঁধে উঠিয়ে তার বোন বেকাথা, সেনাপতি রেমরেম আর কর্নেল হুই যেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছিল সেখানে নিয়ে চললো।
পর পর তিনরাত ভোজ চললো। তিনটি বাচ্চা উট জবাই করে সুস্বাদু মাংসগুলো পঞ্চাশটা অগ্নিকুণ্ড জ্বেলে তাতে ঝলসানো হল। প্রতি সন্ধ্যায় রাজকুমারী তেহুতি পনেরোটি বিয়ারের বড় পিপা খুলে সবার মধ্যে বিতরণ করতে নির্দেশ দিলেন। আমার কাছে এটা একটু বেশি বাড়াবাড়ি মনে হলেও, কিছু বললাম না। বরং আমি নিজেও দুএক মগ খেলাম। তবে ফারাওয়ের প্রাসাদের মাটির নিচের ভাণ্ডার থেকে আনা মদের ব্যাপারে আমি যত্নবান ছিলাম। কেননা আমি জানি এই অমৃত সুধা সাধারণ সৈন্যদেরকে দেওয়া মানে শুধু শুধু অপচয় করা।
রাজদরবারের যন্ত্রীরা আমাদের জন্য যন্ত্রসংগীত পরিবেশন করলো আর সবাই আগুনের চারপাশে নেচে গেয়ে কাটাল। রাজকুমারীরা আমাকে গান গাইতে অনুরোধ করতেই আমি জারাসকে ডেকে নিলাম। এর আগে যখনই সুযোগ পেতাম তখনই আমি তাকে গানের তালিম দিতাম। গান গাওয়ার তার যে স্বাভাবিক প্রতিভা ছিল, আমি তা ঘসে মেজে আরও পরিশীলিত করে তুলেছিলাম। যখন আমরা যুগলবন্দী গান গাইতে শুরু করলাম তখন শ্রোতারা বাকরুদ্ধ হয়ে শুনতে লাগলো। ওরা নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গিয়েছিল পাছে গানের একটা কলিও বাদ না যায়।
.
বেশ খুশিমনে আমি ঘুমাতে গেলাম। প্রায় সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লাম। সাধারণত আমার গভীর ঘুম হয় না। যেহেতু আমার মন সবসময় কর্মতৎপর আর সতর্ক থাকে তাই গভীর ঘুম হওয়ার মতো বিলাসিতা আমার পোষায় না।
একটু পরই ঘুম ভেঙে যেতেই বুঝতে পারলাম কেউ চুপিচুপি আমার তাঁবুতে ঢুকেছে। ঘুটঘুঁটে অন্ধকারের মধ্যে সে আমার বিছানার উপর ঝুঁকে রয়েছে। আমি তার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। দরজার পাহারা এড়িয়ে যে লোক রাজকীয় তাবুর মধ্যে ঢুকতে পেরেছে সে নিশ্চয়ই সাংঘাতিক লোক এবং তার উদ্দেশ্য ভালো হওয়ার কথা নয়।
কোনো ধরনের শব্দ কিংবা নড়াচড়া না করে আমার বিছানার মাথার কাছে সবসময় বিশেষ খাপে যে ড্যাগারটা ঝুলছে তার দিকে হাত বাড়ালাম।
তাঁবুর কাপড়ের মধ্য দিয়ে তারার আলো ভেতরে ঢুকেছে আর রাতের বেলা আমার দৃষ্টিশক্তি অত্যন্ত প্রখর হওয়ায় আমি আততায়ীর মাথার অবয়ব আন্দাজ করতে পারলাম। ডানহাতে ড্যাগারটা খাপ থেকে টেনে বের করার সাথে সাথে বাম হাত দিয়ে আততায়ীর গলা শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরলাম।
আমি তাকে সাবধান করে বললাম, নড়াচড়ার চেষ্টা করলেই আমি তোমাকে মেরে ফেলবো। আগুন্তুক একটি ছোট মেয়ের মতো গুঙিয়ে উঠলো। সেই সাথে তার নিঃশ্বাসের মিষ্টি গন্ধ আর বুকের স্ফিতি অনুভব করলাম।
আমাকে মেরো না তায়তা। আমি বেকাথা! আমি এমনিতেই মরে যাচ্ছিলাম। তোমার কাছে এসেছি যাতে তুমি আমাকে বাঁচাও। রক্তপাত হয়ে আমি মরে যাচ্ছি। দয়া করে আমাকে মরতে দিও না।
সাথে সাথে তাকে ছেড়ে লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামলাম। একমিনিটের মধ্যে তেলের প্রদীপটা জ্বালালাম। বেকাথা ইতোমধ্যে আমার বিছানায় কুঁকড়ে শুয়ে তলপেট চেপে ধরে কাতরাতে শুরু করেছে। খুব ব্যথা করছে তায়তা। দয়াকরে ব্যথাটা ভালো করে দাও।
আমি তাকে দুইহাতের মধ্যে যত্ন করে ধরে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় রক্ত ঝরছে বল?
আমার দুপায়ের মাঝখানে রক্ত ঝরছে। এটা বন্ধ করে দাও। আমি মরতে চাই না।
এবার আমি মনেমনে গুঙিয়ে উঠলাম। তাহলে এবার আমাকে একজনের জায়গায় দুজন রজঃস্বলা চঞ্চলা স্বাস্থ্যবতী বালিকাকে সামলাতে হবে।
তার মানে খুব শিগগিরই খাবার টেবিলের ওপার থেকে ছুঁড়ে মারা রুটির টুকরা আর খেজুরের বদলে কর্নেল হুইকে অন্য কিছু নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে হবে।
.
জারাসের জখম পুরোপুরি নিরাময় হওয়া পর্যন্ত আমি ময়াগুহায় অপেক্ষা করলাম। সে সুস্থ হলে দুই নদীর দেশ আর ব্যবিলনের পথে শেষ যাত্রাটি শুরু হবে। আমাদের সফরের এই অংশটুকু হবে সবচেয়ে দীর্ঘ আর কষ্টকর, তাই আমি তার শরীরের অবস্থা নিয়ে কোনোরকম ঝুঁকি নিতে চাইনি।
আমি অনেক সময় অবাক হতাম দেখে যে, একটি তরুণ শরীর কতটুকু কষ্ট সহ্য করতে পারে আর কত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠতে পারে। মাত্র কয়েকদিন আগে শেয়াল তার নিতম্ব বরাবর তরবারি চালিয়ে দিয়েছিল, তারপর আমি তার পেট ফেঁড়ে নাড়িভূঁড়ি বের করে আবার সেলাই করে দিয়েছিলাম, অথচ তা সত্ত্বেও জারাস এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন সে থিবসে ফসল কাটার উৎসবে ফারাও যে বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন তাতে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
প্রথম প্রথম সে তেহুতিকে সাথে নিয়ে পাহাড়ের চারপাশ ঘিরে হাঁটতো। পঞ্চাশ পদক্ষেপ যাওয়ার পরই পেট চেপে ধরে থামতে বাধ্য হত। তেহুতি সাহায্য করার জন্য হাত বাড়ালেও সরিয়ে দিত। আমি বার বার সাবধান করা সত্ত্বেও সে প্রতিদিন হাঁটার মাত্রা বাড়িয়ে দিত। কিছুদিন পর পুরো বর্ম পরে কাঁধে বেলেপাথরের একটি বড় টুকরা নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো।
প্রতিদিন আমি তাকে পুরোপুরি নগ্ন করে তার ক্ষতের অবস্থা পরীক্ষা করতাম। মনে হল ক্ষতটা শুকিয়ে একটা হালকা দাগের মতো হয়ে যাচ্ছে। শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করার অসম্ভব ক্ষমতা ছিল তার। জোর করে সে তার আহত পেশিগুলো সঞ্চালন করতো, এতে আরও দ্রুত সে আরোগ্যলাভ করে উঠতে লাগলো।
জারাসের প্রতি আমার এক ধরনের সহজাত স্নেহ জেগে উঠছিল আর সে আমার রোগ নিরাময় ক্ষমতার একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার শারীরিক দুর্বলতার কারণে আমি ভাবলাম ওরা আমার পরিকল্পনা বানচাল করার আগেই আমি এই সুযোগে তাকে রাজকুমারী তেহুতির কাছ থেকে আলাদা করে নিতে পারবো। অর্থাৎ মিসরের অস্তিত্বের স্বার্থে ক্রিটের সর্বাধিরাজ মিনোজ আর ফারাও ত্যামোসের মাঝে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য সযত্নে যে পরিকল্পনা করেছিলাম মাঝ পথে এসে তা যেন আবার ভেস্তে না যায়।
সুতরাং ময়াগুহায় পুনরায় ফেরার পঞ্চম দিনে আমি সেনাপতি রেমরেম আর কর্নেল হুইকে আমার নতুন নির্দেশ জানাবার জন্য আমার তাঁবুতে ডেকে পাঠালাম। জারাসকেও সভায় উপস্থিত হতে বললাম। স্বভাবতই আমার উদ্দেশ্য ছিল যে, সে আর হুই কেবল শ্রোতা হিসেবে থাকবে, কোনো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় অংশ নিতে পারবে না।
আমরা চারজন সবেমাত্র আলোচনার টেবিলে বসে চমৎকার মদের গ্লাসে চুমুক দিতে যাবো, ঠিক তখনই আমি অনুভব করলাম কেউ আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। পেছন ফিরে দেখলাম রাজকুমারী তেহুতি তার বিশেষ সুগন্ধী গায়ে মেখে যেন ভাসতে ভাসতে তাবুর দরজা দিয়ে ঢুকেছে।
আমার কারণে আপনাদের আলোচনা থামাবেন না। আমাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে আপনাদের আলোচনা চালিয়ে যান। আমি একটি কথাও বলবো না। চুপ করে বসে থাকবো, আপনারা টেরও পাবেন না যে আমি এখানে রয়েছি।
সে একটি চমৎকার সোনালি রঙের মিহি রেশমী পোশাক পরে রয়েছে। এটা আমি অনেক দাম দিয়ে থিবসের বাজার থেকে তার জন্য কিনেছিলাম। তখন সে নিজেই আমাকে বলেছিল ক্রিটে পৌঁছার পর যখন তাকে সর্বাধিরাজ মিনোজের সামনে প্রথম হাজির করা হবে, তখন সে এই পোশাকটি পরবে। হয়তো আমাদের মধ্যেকার সেই চুক্তিটি সে ভুলে গেছে।
তার পায়ে রূপার স্যান্ডেল। গলায় ঝুলছে একটি হাথোরের হার আর অন্য আরেকটি উজ্জ্বল চকচকে, সম্ভবত নীলকান্ত মণি আর পান্নার হার। সুন্দর পরিপাটি চুল আর মুখে চমৎকার হাসি।
এরকম সুন্দর তাকে আমি আর কখনও দেখিনি।
সোনালি পোশাকের ঘের উড়িয়ে সে আমার পায়ের কাছে বসলো। দুই কনুই হাঁটুতে রেখে চিবুক দুই হাতের মাঝে রাখলো, যাতে আমি যে হীরার আংটিটা দিয়েছিলাম তার উপর আলো ঠিকরে পড়ে জ্বলজ্বল করে উঠলো। তারপর এক পাশে জারাসের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে নিরীহ চেহারা নিয়ে মৃদু হাসলো।
বুঝি না মেয়েরা কীভাবে সবকিছু আগেভাগে জেনে ফেলে? এই সভা সম্পর্কে আমি তাকে জানাইনি; সত্যি বলতে কী সভার মাত্র এক ঘন্টা আগে অন্যদের ডেকেছিলাম। আর কী আলোচনা হবে তাও বিন্দু বিসর্গ কাউকেই জানাইনি। সে নিশ্চয়ই জানতো না এখানে কী হতে যাচ্ছে। তারপরও সে এখানে যুদ্ধের সাজে সেজে এসেছে আর তার চোখের দৃঢ় দৃষ্টি দেখে আমার তাই মনে হল।
তোমাদের যা আলোচনা চালিয়ে যাও তায়তা। আমি কথা দিচ্ছি মাঝখানে কিছু বলবো না।
আমি ইতস্তত করে বললাম, ধন্যবাদ, মহামান্য রাজকুমারী। ভাবলাম তার সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়াবার কি কোনো উপায় আছে? অবশ্যই আছে। আমি ফারাওয়ের সিলমোহর বহন করছি। আমি একজন রাজার কন্ঠ হয়ে কথা বলছি। কেউ আমার বিরুদ্ধাচরণ করার সাহস করবে না? কাজেই সাহস সঞ্চয় করলাম।
ভদ্রমহোদয়গণ, আমি আমাদের পথপ্রদর্শক আল-নামজু আর রাজকীয় আস্তাবলের প্রধান রক্ষকের সাথে কথা বলেছি। ওরা সবাই আমার সাথে একমত হয়েছে যে আমাদের এই বিশাল দলটি আর বেশিদিন ময়াগুহায় থাকতে পারবে না। মনে রাখবেন আমাদের সমস্ত লোকজন আর রাজকুমারীরা ছাড়াও তিনশোর বেশি ঘোড়া আর উট রয়েছে। প্রতিদিন যে হারে আমরা এই পানি ব্যবহার করছি তাতে আর কিছু দিন পরই এই কুপের পানি সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যাবে। বুঝতেই পারছেন এর কী ভয়াবহ পরিণতি হবে।
দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে রেমরেম বললো, অবশ্যই! এ-বিষয়ে কোনো প্রশ্ন নেই, আমাদের এগোতেই হবে। তার দাড়ি রূপালি ধূসর রঙের হলেও আমি জানি তার আসল বয়স লুকোতে সে মেহেদি কলপ ব্যবহার করে উজ্জ্বল আদা রঙ করে রেখেছে। সে একজন মহান ব্যক্তি। একজন কুশলী আর সাহসী যোদ্ধা। একজন ভাইয়ের মতো তাকে আমি ভালোবাসি।
আমি তার দিকে তাকিয়ে সায় দিয়ে মাথা নেড়ে বলে চললাম, তবে ব্যাপারটা এতো সহজ নয় সেনাপতি রেমরেম। আল-নামজু আমাকে জানিয়েছে এর পরবর্তী মরুদ্যানের নাম হল জয়নাব অর্থাৎ দামী রত্ন। এটা আমাদের দুইশো লিগ সামনে রয়েছে। এই দূরত্ব যেতে দশদিন লাগবে। তার মানে যখন আমরা সেখানে পৌঁছাবো তখন আমাদের পশুগুলো পথশ্রমে ক্লান্ত আর তৃষ্ণায় কাতর হয়ে বিধ্বস্ত হয়ে পড়বে। ফলে তাদেরকে আবার যাত্রার উপযোগী করতে অন্তত দুই সপ্তাহ জয়নাব মরুদ্যানে বিশ্রাম দিতে হবে। কিন্তু জয়নাব একটি ছোট মরুদ্যান। ওতে যে পরিমাণ পানি আছে তা দিয়ে আমাদের মতো একটি বিশাল কাফেলার কয়েকদিনের বেশি চলবে না। কথাটা বলে এই কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থার একটি যৌক্তিক সমাধান বাতলাবার জন্য আমি রেমরেমের প্রতি তাকালাম। এতে হয়তো কিছুটা দোষ আমি অন্যের ঘাড়ে চপাতে পারবো, যখন রাজকুমারী তেহুতি আমার পরিকল্পনার সবদিক আঁচ করতে পেরে তুমুল হট্টগোল শুরু করবে। তবে সবাই নিশ্চুপ থাকায় বাধ্য হয়ে আমাকে সমস্ত দায়দায়িত্ব নিজ ঘাড়ে নিয়ে বিষয়টা খোলসা করতে হল।
এর একমাত্র সমাধান হল আমাদের দলকে দুই ভাগ করে অর্ধেক মানুষ আর পশুর দলটিকে আগেই জয়নাব পাঠিয়ে দেওয়া। অন্যদলটি এখানে আরও দুই সপ্তাহ থেকে আগের দলকে তৈরি হওয়ার সুযোগ দেবে। সফরের অবশিষ্ট অংশে আমাদেরকে এই বিভক্তি চালিয়ে যেতে হবে। দুই নদীর দেশে পৌঁছাবার পর আমরা আবার একত্রিত হব। এই উপায়ে আমরা কখনও পরিশ্রান্ত হয়ে পড়বো না আর পুরো দলকে একটি মাত্র মরুদ্যানে গিয়ে পানি নিয়েও কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না।
আবার সবাই চুপ থেকে বিষয়টা নিয়ে ভাবলো। শেষ পর্যন্ত রেমরেম তার ভারী গলায় বললো, আপনার পরিকল্পনাটা বেশ ভালো তায়তা। আর আমার বিশ্বাস আপনি নিশ্চয়ই দলকে বিভক্ত করার পরিকল্পনাটাও ঠিক করে ফেলেছেন। আমি মৃদু হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলাম।
সেনাপতি রেমরেম, আপনি অগ্রবর্তী দলের অধিনায়কত্ব নিয়ে যাবেন। এই দলে অর্ধেক মানুষ আর উটগুলো থাকবে। এছাড়া রাজকুমারী তেহুতি আর বেকাথাও আপনার সাথে যাবেন। ক্রেটান মেয়েটি-লক্সিয়াসও ওদের সাথে যাবে।
রেমরেম গদগদ কণ্ঠে বললো, আমি সত্যি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ মহান তায়তা। আমার প্রতি আস্থা স্থাপন করে আপনি আমাকে বাধিত করেছেন।
তারপর আমি একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আবার বললাম, দুই সপ্তাহ পর ঘোড়াগুলো নিয়ে আমি আপনাদের অনুসরণ করবো। দ্বিতীয় দলে আমার সাথে ক্যাপ্টেন জারাস আর কর্নেল হুই থাকবেন। ঘোড়াগুলো সামলাতে আমার হুইকে প্রয়োজন হবে। তার দিকে তাকাতেই সে ঘাড় কাত করে সায় দিল। তার প্রিয় ঘোড়াগুলো থেকে আলাদা হওয়াটা তার সহ্য হবে না। তারপর জারাসের দিকে তাকিয়ে বললাম, আর এখন থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে আশা করি নিরাপদ সফরের জন্য তোমার ক্ষত ভালোভাবে সেরে উঠবে।
আর এটাই ছিল আমার পরিকল্পনার ভেতরের বৈশিষ্ট্য। রাজকুমারীরা রেমরেমের সাথে আগেই চলে যাবে। আর আমি দ্বিতীয় দলে আমার সাথে ক্যাপ্টেন জারাস আর কর্নেল হুইকে রাখবো। এক চালে আমি মেয়েদেরকে ছেলেদের কাছে থেকে আলাদা করলাম আর সেই সাথে জারাস আর সমস্ত পশু সঠিক পরিমাণে পানি পান করে ভালো অবস্থায় ব্যবিলন পৌঁছাবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আমার রাজকুমারীও গায়ে কারোও স্পর্শ না নিয়ে সেখানে পৌঁছাবে।
আমি তেহুতির দিকে তাকাতে চাচ্ছিলাম না। আশা করছিলাম এখানে সে কোনো ধরনের চালাকি খাটাতে পারবে না।
তবে পরিষ্কার কণ্ঠে সে বললল, না। আমার মনে হয় এটা মোটেই ভালো পরিকল্পনা হল না তায়তা। আবার সে আমাকে তাতা না বলে তায়তা বলে সম্বোধন করলো।
আমি জামার হাতার ভেতর থেকে রাজকীয় বাজপাখির সীলমোহরটা বের করলাম। এটা সবসময় আমার সাথেই রাখি। যখনই প্রয়োজন তখনই সর্বোচ্চ ক্ষমতাটি দেখাতে হবে।
কথাটা শুনে দুঃখিত হলাম রাজকুমারী। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, সেনাপতি রেমরেমের মতো আপনিও এই ব্যবস্থা গ্রহণের গুরুত্বটি বুঝতে পারবেন। এই কথাটি বলার সময় বাজপাখির সীলমোহরটা হাতের দুই আঙুলের মাঝে নিয়ে ঘষতে লাগলাম।
ওহো, তুমি এই বাচ্চাদের খেলনাটা আমাকে দিতে চাচ্ছো? আমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই সে হাত বাড়িয়ে ছোঁ মেরে সীলমোহরটা আমার হাত থেকে নিয়ে নিল। হঠাৎ এই কাণ্ডে আমি এততাই হতচকিত হয়ে গিয়েছিলাম যে কোনো বাধা দেওয়ার আগেই জিনিসটা আমার হাতছাড়া হয়ে গেল।
এটার সম্পর্কে লোকে যা বলে তা কি সত্যি তায়তা?
লোকে কী বলে রাজকুমারী?
ওরা বলে এটা যার হাতে থাকে সে ফারাওয়ের কণ্ঠস্বরে কথা বলে।
হ্যাঁ, রাজকুমারী, কথাটা সত্যি।
তাহলে দেখো, এটা এখন কার হাতে আছে তায়তা।
ইতোমধ্যে তাঁবুর মাঝে থাকা অন্য তিনজনও বুঝতে পারলো যে এখানে একটা ইচ্ছাশক্তির লড়াই চলছে। ওরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর আমিও বুঝতে পারলাম আমাকে কীরকম হাস্যকর দেখাচ্ছে। অনুভব করলাম আমার ভ্রু কুঁচকাতে শুরু করছে, সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিয়ে কপাল মসৃণ করে তেহুতির দিকে মাথা নত করে বললাম, আমি আপনার কাছ থেকে মহান ফারাওয়ের কণ্ঠস্বর শোনার জন্য অপেক্ষা করছি রাজকুমারী। রসিকতার সুরে কথাটা বলার চেষ্টা করলেও তা খুব একটা কাজে এলো না। এবার তেহুতির মুখের হাসি মুছে গিয়ে দুচোখ ভরে পানিতে টলটল করে উঠলো।
সে ফিস ফিস করে প্রায় বাষ্পরুদ্ধকণ্ঠে বললো, ওহো, তায়তা। আমার প্রতি এমন নিষ্ঠুর হয়ো না। তোমাকেই আমি আমার বাবা হিসেবে জানি। দয়া করে এভাবে আমাকে ফিরিয়ে দিও না। তুমি আমার ভাই আর আমার মাকে কথা দিয়েছিলে যে, সবসময় আমার দিকে খেয়াল রাখবে। তুমিই একমাত্র মানুষ যাকে আমি ভালোবাসি আর বিশ্বাস করি। তারপর সীলমোহরটা আমার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে ফুপাতে ফুপাতে, নাও এটা ধর! দরকার মনে হলে আমাকে দূরে পাঠিয়ে দাও। তুমি যা আদেশ করবে তাই আমি পালন করবো।
ঔৎসুক্য নিয়ে তাকিয়ে থাকা উপস্থিত শ্রোতাদের মুখের হাসি মুছে গেল। এবার ওদের চেহারায় হতাশার অনুভূতি আর আতঙ্ক দেখা গেল। সবাই একযোগে পাল্টা অভিযোগের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। হঠাৎ আমি একজন দুর্জন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছি।
অবশ্য ওরা কেউ ধারণাই করতে পারেনি যে, আসলে সে কি নিখুঁত একজন অভিনেত্রী। আমাকে পুরোপুরি একজন কাপুরুষ বানিয়ে ছেড়েছে। মুহূর্তের মধ্যে আমি প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়েছি।
আমাকে ক্ষমা করো তেহুতি। বল তুমি কী চাও, আমি তাই দেবো তোমাকে।
সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললো, বেকাথা আর আমি আমাদের আসল বাবা, শুধু তোমার সাথে থাকতে চাই। ব্যস এই। তবে সে জানে সে জিতেছে। যে লোককে নিয়ে আসল দ্বন্দ্ব চলছে, তার নাম উচ্চারণ না করেই সে তার কার্যোদ্ধার করতে পেরেছে।
.
চারদিন পর বিকেলে সেনাপতি রেমরেম দলের অর্ধেক মানুষ আর পশু নিয়ে দুইশো লিগ উত্তরে জয়নাব মরুদ্যানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। তেহুতিকে সাথে নিয়ে আমি পাঁচ লিগ পর্যন্ত রেমরেমকে এগিয়ে দিলাম। তারপর তাকে বিদায় জানিয়ে আমরা দুজন ময়াগুহার দিকে ফিরে চললাম। একটু পেছনে আমাদের দেহরক্ষী দল-নীল কুমির বাহিনীর বিশজন সদস্য আমাদের অনুসরণ করছে।
ময়াগুহা ছেড়ে বের হওয়ার সময় আমি বেকাথাকেও আমাদের সাথে ঘোড়ায় চড়ে যেতে বলেছিলাম। কিন্তু আমাকে অবাক করে সে এই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে জানিয়েছিল, আমি তাকে যে প্রাচীন মিসরীয় লিপির লেখ্যপট দিয়েছিলাম, সে তা নিয়ে কাজ করতে চাচ্ছে। বেকাথা খুব একটা মনোযোগী কিংবা পরিশ্রমী ছাত্রী নয়, তাই তার একথায় বেশ অবাক হয়েছিলাম। অবশ্য এখন আমি জানতে পেরেছি কে তাকে হঠাৎ লেখার দিকে মনোযোগ দিতে আগ্রহী করেছে।
প্রথম লিগ আমি আর তেহুতি পাশাপাশি নীরবে ঘোড়ায় চড়ে চলতে লাগলাম। তারপর হঠাৎ সে জিজ্ঞেস করলো, তুমি আমার বাবাকে খুব ভালো করে জানো তাই না? অথচ আমি কিছুই জানি না। তুমি এর আগে কখনও তার সম্পর্কে কিছুই বলে নি। এখন বল না তায়তা।
মিসরের সবাই তোমার বাবা সম্পর্কে ভালো করেই জানে। তিনি ছিলেন স্বর্গীয় দেবতা ফারাও ম্যামোস। বংশধারার অষ্টম পুরুষ। তিনি ছিলেন সাম্রাজ্যের স্তম্ভ, ন্যায়পরায়ণ, মহান, সর্বদ্রষ্টা, দয়ালু…।
সে সরাসরি অস্বীকার করে বললো, না, তিনি তা ছিলেন না। দয়া করে। আমাকে মিথ্যা বলো না তায়তা। হঠাৎ এই অভিযোগে আমি হতবুদ্ধি হয়ে তার দিকে ঘুরে তাকালাম।
হেসে বিষয়টার পরিসমাপ্তি করার চেষ্টা করে বললাম, তাহলে আমি হয়তো ভুল জেনেছি! ফারাও না হলে তোমার মতো একজন মেয়ের পিতা তাহলে কে সেই সৌভাগ্যবান লোক। আমার সত্যি তাকে হিংসা হচ্ছে।
আমার আসল বাবা ছিলেন মহান তানুস। আর তার বাবা ছিলেন পিয়াংকি, প্রভু হারাব। তার মা ছিলেন একজন মুক্ত তেহেনু ক্রীতদাসী। যার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে আমি সোনালি চুল আর নীল চোখ পেয়েছি। লোকে বলে তিনি খুবই সুন্দরী ছিলেন। আমার বাবাও তার মায়ের কাছ থেকে অপরূপ দৈহিক সৌন্দৰ্য্য পেয়েছিলেন। সবাই বলে তিনি ছিলেন মিসরের সবচেয়ে সুন্দর পুরুষ।
আমি বললাম, কে তোমাকে এসব আজেবাজে কথা বলেছে?
আমার নিজের মা লসট্রিস বলেছেন। এখন বল তিনিও মিথ্যা বলেছেন।
আমি হতভম্ব হয়ে পড়লাম। ফারাওয়ের সিংহাসন আর মিসরের অস্তিত্বের ভিত্তি পর্যন্ত কেঁপে উঠতে শুরু করেছে। আর আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়তে যাচ্ছে। এমন বিপজ্জনক কথা আমি কখনও শুনিনি।
হা করে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, একথা আর কাকে বলেছে?
কাউকেই না; শুধু তোমাকেই বললাম।
তুমি কি জানো একথা আর কাউকে বললে কি পরিণতি হতে পারে?
ঘোড়ার জিন থেকে ঝুঁকে এক হাত বাড়িয়ে আমার হাত ধরে সে সান্ত্বনার সুরে দিয়ে বললো, প্রিয় তায়তা। আমি এতো বোকা না।
এবার আমি বেশ জোরে বললাম, তুমি কি নিশ্চিত যে, তোমার ভাইকে একথা বলনি? ফারাও কি একথা জানেন? আর বেকাথা? তাকে বলেছো?
এবার সে শান্ত কণ্ঠে আমাকে আস্বস্ত করে বললো, না। বেকাথা এখনও ছোট্ট একটি মেয়ে। আর মেমতো মরেই যাবেন, যদি তিনি জানতে পারেন যে তিনি সত্যিকার ফারাও নন।
এবার আমি সত্যি আতঙ্কিত হলাম। তার হাত ধরে জোরে জোরে নাড়তে নাড়তে বললাম, একথাও তোমার মা তোমাকে বলেছিলেন? তিনি তোমাকে
সবকিছু বলেছিলেন? দয়া করে বল আমি তোমার কথা ভুল শুনছি, তাই না?
তুমি আমার কথা ঠিকই বুঝেছো। আমার মা আমাকে বলেছেন যে, আমরা তিনজনই ফারাও ম্যামোসের নয়–মহান তানুসের সন্তান। আমরা তিনজনই অবৈধ সন্তান।
এসব কথা এখন আমাকে কেন শোনাচ্ছো তেহুতিঃ
কেননা আমিও শিঘ্রই একই অবস্থায় পড়তে যাচ্ছি যাতে আমার মা ধরা পড়ে গিয়েছিলেন। আর তুমি তাকে বাঁচিয়েছিলে। সে আমার দিকে তাকাতেই আমি অস্বীকৃতি জানিয়ে মাথা নাড়লাম।
সে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো, এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ো না তায়তা। তুমি আমার মাকে বাঁচিয়েছিলে, এবার একই কাজ আমার জন্যও করবে।
এতোটুকু আসলে সত্যি। রানি লসট্রিস ছিলেন আমার জীবনের একমাত্র সত্যিকার ভালোবাসা। তবে এখন তিনি আর নেই আর তার জায়গায় তেহুতি রয়েছে। তার কোনো অনুরোধই ফেলতে পারবো না। তবে এক্ষেত্রে অন্তত আমার নিজের মতো শর্ত আরোপ করতে পারবো। নিশ্চিত তার মায়ের মতোই সে তা উড়িয়ে দেবে। তবে আমাকে অন্তত চেষ্টা করতে হবে।
বল আমার কাছ থেকে তুমি ঠিক কি চাও তেহুতি? আমার মার একজন রাজার সাথে বিয়ে হয়েছিল, তবে তার নিজের পছন্দমতো স্বামী ছিল। রাজার নয়, তিনি তার সন্তান গর্ভে ধারণ করেছিলেন। তবে তার নিজের পক্ষে তা করা সম্ভব ছিল না। তুমিই তাকে এসব করতে সাহায্য করেছিলে। তাই না?
আমি স্বীকার করলাম, হ্যাঁ তাই হয়েছিল। একথা বলা ছাড়া আর কোনো পথ আমার জন্য ভোলা ছিল না।
তেহুতি বলে চললো, জীবনের বেশিরভাগ সময় আমি আমার ভাইয়ের হেরেমে কাটিয়েছি। তার দুইশো জন স্ত্রী রয়েছেন, অথচ তিনি কেবল একজনকে ভালোবাসেন। মাসারা ছিলেন তাদের মধ্যে প্রথম স্ত্রী। তিনি তাকে তিনটি পুত্রসন্তান দিয়েছেন। তিনি যা পেয়েছেন সেরকম পেলে আমিও সন্তুষ্ট থাকতাম। তবে আমি অন্যান্য স্ত্রীদের দূরবস্থা দেখেছি। ওরা স্ত্রী হওয়ার পর বেশির ভাগের ক্ষেত্রে সারা জীবনে ভাই একবার কি দুবার তাদের কাছে গিয়েছেন। তুমি জান ওরা কী করে, তায়তা? একথা জিজ্ঞেস করতেই আমি মাথা নেড়ে না করলাম। ওরা নিজেদের মধ্যে খেলা করে। নিজেদের সন্তুষ্টির জন্য একজন পুরুষ না পেয়ে জঘন্য কাজকারবার করে। তার গা শিউরে উঠলো। তারপর সে বললো, কী দুঃখজনক। আমি ওদের মতো হতে চাই না।
আমি দেখলাম দুঃখে আর হতাশায় তার চেহারা বদলে যাচ্ছে। লক্ষ্য করলাম হঠাৎ তার চোখের কোনে পানি টলটল করে উঠছে। এখন আর সে অভিনয় করছে না।
আমি জানি তুমি আমাকে অচেনা বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে একজন বৃদ্ধলোকের হাতে আমাকে তুলে দেবে, যার সারা শরীরের চামড়া কুঁচকানো আর বিবর্ণ; হাতগুলো ঠাণ্ডা। আর তার নিঃশ্বাসের দুর্গন্ধে বমিতে আমার পেট গুলিয়ে উঠবে। সে আমার সাথে নোংরা কাজ করবে… আবার কান্নার দমক থামিয়ে বলে চললো, এগুলো ঘটার আগে আমার মাকে তুমি যা দিয়েছিল তা আমি একবারের জন্য চাই। আমি এমন একটি মানুষকে চাই, যে আমার মুখে হাসি এনে দেয় আর যার কারণে আমার হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়। আমি এমন একজন মানুষকে চাই যে আমাকে সত্যিকার ভালোবাসে আর যাকে আমিও সত্যিকার ভালোবাসি।
আমি মৃদু কণ্ঠে বললাম, তুমি জারাসকে চাও। সে চিবুক তুলে সজল চোখে আমার দিকে তাকাল।
হ্যাঁ আমি জারাসকে চাই। শুধু একবার ভালোবেসে সেই মূল্যবান বস্তুটিকে বুকে চেপে ধরে রাখতে চাই। আমি জারাসকে আমার স্বামী হিসেবে চাই। শুধু সামান্য সময়ের জন্য যদি তুমি এটুকু আমাকে দাও, তাহলে আমি সানন্দে গিয়ে ফারাও, মিসর আর তোমার জন্য আমার অতি প্রিয় তায়তার জন্য যেকোনো দায়িত্ব পালন করবো।
তাহলে প্রতিজ্ঞা কর তেহুতি। একথা কখনও কাউকে বলবে না, এমনকি তোমার নিজ সন্তানদেরও বলবে না।
সে শুরু করলো, কিন্তু আমার মা… কিন্তু আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, তোমার মায়ের বেলায় ভিন্ন পরিস্থিতি ছিল। তোমার বেলায় তা হবার নয়। তোমাকে কথা দিতে হবে।
তারপর সে রাজি হয়ে বললো, ঠিক আছে আমি কথা দিচ্ছি। তার কথা আমার বিশ্বাসযোগ্য মনে হল।
তবে তোমাকে বুঝতে হবে তুমি কোনোদিন জারাসের সন্তান গর্ভে নিতে পারবে না।
এরকম না হলে ভালো হত তায়তা। ছোট্ট একটি নিজের জারাস পেলে আমি খুবই খুশি হতাম। কিন্তু আমি জানি তা হবার নয়।
প্রত্যেক মাসে যখন তোমার নারীত্বের লাল ফুলটি ফোঁটার সময় হবে, তখন আমি তোমাকে একটি নির্যাস খেতে দেবো। শিশুটি তখন তোমার রক্তস্রাবের সাথে বের হয়ে আসবে।
একথা ভেবে আমি কাঁদবো।
সর্বাধিরাজ মিনোজের স্ত্রী হওয়ার পর জারাসকে সারাজীবনের জন্য ভুলে যেতে হবে। তুমি ক্রিটের রাজকীয় হেরেমে থাকবে। জারাস মিসরে যাবে। তুমি আর কখনও তার দেখা পাবে না। বুঝতে পেরেছ তেহুতি? সে ঘাড় নেড়ে সায় দিল।
আমি আদেশের সুরে বললাম, উচ্চারণ করে বল, যে আমার কথা বুঝেছ।
সে পরিষ্কার কণ্ঠে বললো, হ্যাঁ বুঝেছি।
মিনোজের সাথে বিয়ের রাতে আমি ভেড়ার রক্ত ভরে একটা রবারের ব্যাগ তোমাকে দেবো। সে যখন তোমাকে বিছানায় নেবে তখন এটা ফেটে যাবে। এটা তাকে তোমার কুমারীত্ব সম্পর্কে নিঃসন্দেহ করবে।
সে ফিসফিস করে বললো, বুঝতে পেরেছি।
আমি জোর দিয়ে বললাম, কাউকে একথা বলো না। বিশেষ করে বেকাথাকে অবশ্যই বলবে না। তার ছোট বোনটি সারাদিন গল্প করে বেড়ায় আর কোনো কথা গোপন রাখতে পারে না।
সে বললো, ঠিক আছে, কাউকে একথা জানাবো না। এমনকি আমার ছোট বোন বেকাথাকেও না।
তুমি কি জানো কি বিপদের মধ্যে তুমি পড়তে যাচ্ছো তেহুতি? তোমার জীবন মরণ তখন মিনোজের হাতে থাকবে। একজন রাজার সাথে প্রতারণা করা খুবই হঠকারিকতাপূর্ণ ব্যাপার। তোমাকে খুব সাবধানে থাকতে হবে যাতে ব্যাপারটা কোনোদিন জানাজানি হয়।
আমি বুঝতে পেরেছি। আমি জানি তুমিও আমার মতো একই ঝুঁকি নিচ্ছ। আর তাই আমি তোমাকে আরও ভালোবাসি।
অবশ্যই এই কাজটা একটা পাগলামি, তবে জীবনে আমি অনেক পাগলামো করেছি। শুধু একটি সান্ত্বনা যে এখনও হাতে প্রস্তুতি নেওয়ার কিছু সময় আছে। জারাসের জখম এতে একটি বাধা হয়ে আছে। ভালোবাসার এই উন্মাদনার কর্মকাণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো সুস্থ সে এখনও হয়নি। তবে যাইহোক সে দ্রুত আরোগ্যের পথে রয়েছে।