পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
সেই দিনই রাত্রি প্রায় সাড়ে আটটার সময় অপরূপ সুন্দর পোশাকে সেজে আর কয়েকটি “পারমা” ভায়লেট ফুল কোটের বুকে স্টুডে ডোরিয়েন গ্রে লেডি নরবোরোর বাড়িতে এসে হাজির হলেন; ভদ্রমহিলার চাকররা সসম্ভ্রমে অভ্যর্থনা জানিয়ে তাঁকে তাঁর বসার ঘরে নিয়ে গেল। তাঁর কপালের শিরাগুলি তখন ধকধক করছে; একটা ভীষণ উত্তেজনা বুকের মধ্যে নাচানাচি করছে; কিন্তু তা সত্ত্বেও যখন তিনি গৃহস্বামিনীর হাতটি চুম্বন করার জন্য ঝুঁকে পড়লেন তখন মনে হল সেই চিরাচরিত, সুন্দর, নিষ্পাপ ডোরিয়েন গ্রে ছাড়া আর তিনি নন। সম্ভবত, কোনো অভিনেতাই অভিনয় করার সময় এতটা সাবলীল হতে পারেন না। সেদিন রাত্রিতে কেউ যদি ডোরিয়েন গ্রেকে ভালোভাবে লক্ষ করতে তাহলে সে কিছুতেই বুঝতে পারত না যে তাঁর জীবনে কিছুক্ষণ আগেই এমন একটি ভয়ঙ্কর ট্র্যাজিডি নেমে। এসেছে যাকে আমাদের আধুনিক যুগের যে কোনো ট্র্যাজিডির সঙ্গেই তুলনা করা যায়। ওই সুন্দর আঙুলগুলি পাপ কাজ করার জন্যে কখনো ছুরি ধরতে পারে, অথবা ওই সুস্মিত ঠোঁট দুটি কখনো ভগবানের বিরুদ্ধে, সত্যের বিরুদ্ধে ডেহাদ ঘোষণা করতে পারে একথা কেউ বিশ্বাস করতে চাইত না। নিজের শান্ত ভাব দেখে তিনি নিজেই কেমন যেন বিস্মিত হয়ে গেলে এবং এই দ্বৈত জীবনের জন্যে মুহূর্তের জন্যে তিনি যে একটা নির্মম আনন্দও পেলেন না সেকথাও সত্যি নয়।
পার্টিটা খুব ছোটোই ছিল। লেডি নরবোরো খুব তাড়াতাড়িই আয়োজনটি করেছিলেন। অত্যন্ত চতুর ছিলেন লেডি নুরবোরো। লর্ড হেনরির ভাষায় এই জাতীয় মহিলারা হচ্ছেন সত্যিকার কুৎসিত আদর্শের উচ্ছিষ্ট ছাড়া আর কিছু নয়। ব্যবহারিক জীবনে একটি অসামাজিক রাষ্ট্রদূতের তিনি ছিলেন সুযোগ্য পত্নী। স্বামীর কবরের ওপরে তিনি একটি মর্মর সৌধ নির্মাণ করিয়েছিলেন; এই সৌধের পরিকল্পনা তাঁর নিজেরই। তাঁর মেয়েদের বিয়ে দিয়েছিলেন বস্তু ভদ্রলোকদের সঙ্গে। এইভাবে আদর্শ পত্নী আজ জননীর কর্তব্য শেষ করে। বর্তমানে তিনি সময় কাটান ফরাসি উপন্যাস পড়ে, ফরাসি রান্নার সরঞ্জাম নিয়ে, আর সুযোগ পেলে ফরাসি মদ্যপান করে।
তাঁর বিশেষ প্রিয় পাত্রদের মধ্যে ডোরিয়েন ছিলেন বিশেষতম এবং ভদ্রমহিলা তাঁকে সব সময়েই বলতেন যে যৌবনে যে তাঁদের পরিচয় হয়নি এতে তিনি খুবই খুশি হয়েছেন। তিনি বলতেন: আমি জানি, তোমার সঙ্গে দেখা হলে উন্মাদের মতো তোমাকে আমি ভালোবেসে ফেলতাম; আর তোমার জন্যে সব কিছু ছাড়তাম আমি। খুবই সৌভাগ্যের বিষয় যে তখন। তোমরা কথা আমার মনে হয়নি। আসল কথা হচ্ছে আমাদের যুগটা এতই অখাদ্য আর শাসন এতই কড়া ছিল যে কারো সঙ্গে যে একটু প্রেম করব সে-সুযোগও আসেনি আমার। অবশ্য সবটাই রবোরোর দোষ। তার দৃষ্টির প্রসারতা ছিল না; আর যে স্বামী কিছুই দেখে না তাকে বিয়ে করার মধ্যে কোনো আনন্দ নেই।
সেদিন সন্ধ্যায় তাঁর বাড়িতে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের কেউ প্রায় প্রাণ খুলে আসর জমাতে পারেননি। এর কারণটা নোংরা ফ্যান-এর আড়ালে তিনি অবশ্য ডোরিয়েনকে বলেছিলেন। কারণটা হচ্ছে সেদিনই তাঁর একটি বিবাহিতা কন্যা হঠাৎ তাঁর বাড়িতে এসে হাজির হয়েছে তার চেয়েও খারাপ ব্যাপারটা হচ্ছে সেই কন্যাটি তার স্বামীটিকেও সঙ্গে নিয়ে এসেছে।
ঠিক এই সময় মেয়েটার এখানে আসাটা ঠিক হয়নি, বুঝতে পারছি; অবশ্য আমি হামবার্গ থেকে ফিরে প্রতিটি গ্রীষ্মে ওদের বাড়িতে গিয়ে ক’টা দিন কাটিযে আসি; কিন্তু আমার মতো বৃদ্ধা মহিলার মাঝে-মাঝে ফাঁকায় থাকাটা দরকার; আর তা ছাড়া, আমি তাদের কিছুটা চাঙ্গা করে তুলি। ওরা যে কী ভাবে দিন কাটায তা তুমি জান না। যাকে বলে একেবারে নির্ভেজাল গ্রাম্য জীবন। সংসারে অনেক কাডই ওদের করতে হয়; তাই ওরা খুব সকালে উঠে পড়ে; গভীর কিছু চিন্তা করার ক্ষমতা ওদের নেই। তাই ওরা সন্ধে-সন্ধে ঘুমিয়ে পড়ে। রানি। এলিজাবেথের সময় থেকে ও অঞ্চলে কারো কোনো কলঙ্ক রটনি; ফলে ডিনার খেয়েই সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। ওদের কারো পাশেই তোমার বসার দরকার নেই; তুমি বসবে আমার পাশে, আনন্দ দেবে আমাকে।
একটু হেসে ডোরিয়েন তাঁর বদান্যতার স্বীকৃতি জানালেন, তারপরে, ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, ভদ্রমহিলা সত্যি কথাই বলেছেন। আসরটা মোটেই জমাট বাঁধেনি। আগন্তকদের মধ্যে দুজন তাঁর অপরিচিত, অন্যান্যদের মধ্যে রয়েছে আর্নেস্ট হ্যাঁরোডেন; মধ্যবয়সী অতি সাধারণ মানুষ; লন্ডনের ক্লাবগুলিতে এই জাতীয় নিরপরাধ শান্তশিষ্ট অনেক গোবেচারা দেখা যায়, এরা হল অজাতশত্রু; কিন্তু এদের বন্ধুরা মোটেই এদের পছন্দ করে না। আর। রয়েছেন অনাবশ্যক বেশভূষায শরীর-ঢাকা সাতচল্লিশ বছর বয়সের লেডি রাক্সটন, সুচোল। নাক; অন্য লোকে যা বলে সব সময়েই তিনি তা মেনে নেন; কোনো প্রতিবাদ করেন না। কিন্তু এত সাদাসিধে যে তাঁর বিরুদ্ধে কারও কোনো অভিযোগ নেই, থাকলে যেন তিনি একটু খুশিই হতেন। আর আছেন মিসেস আরলিন, মিষ্টি ঠোঁট আর ভেনিস দেশের মতো লাল তাঁর। চুলের গোছা। রয়েছেন লেডি অ্যালিস চ্যাপম্যান। ইনি হচ্ছেন লেডি নরবোরোর কন্যা। চেহারা কদাকার, বোকা-বোকা মুখের আদল; ব্রিটেনের জাতীয় বৈশিষ্ট্য তাঁর মুখ–এ মুখ একবার দেখার পরে আর কারও মনে থাকে না। রয়েছেন তাঁর স্বামী, গন দুটি লাল, সাদা। গোঁফ ডোড়া, আচারে-ব্যবহারে তাঁরই সমগোত্রীয়দের মতো। তাঁর ধারণা অনাবশ্যক উজ্জ্বলতা উঁচু আদর্শের পরিপন্থী।
এইরকম একটি ভোজে আসার জন্যে ডোরিয়েন-এর আপসোস হল। লেডি নরবোরো শেলফ-এর ওপরে ঝোলানো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বেশ চেঁচিয়েই বললে: কী আশ্চর্য! হেনরির এত দেরি হচ্ছে কেন? আজ সকালে সে আসবেই।
সান্ত্বনার কথা এই যে হেনরির আসার কথা রয়েছে। তারপর দরজা খোলার সঙ্গে-সঙ্গে যখন মিথ্যা অড়হাতের সঙ্গে তাঁর মিষ্টি গলার স্বর শোনা গেল তখনই ডোরিয়েন-এর মন থেকে অবসাদ কেটে গেল; তিনি কিছুটা চাঙ্গা হয়ে উঠলেন।
কিন্তু ডিনারের সময় কিছুই খেতে পারলেন না তিনি। প্লেটের পর প্লেট নিয়ে ফিরে চলে গেল বেয়ারা। লেডি নরবোরো মৃদু ধমক দিলেন তাঁকে বললেন: বেচারা অ্যাডোলফকে তুমি অপমান করছ ডোরি মি যা ভালোবাস সেই খাবারই বেচ্ছেবেছে ও রান্না করেছে।
লর্ড হেনরিও মাঝে-মাঝে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর অস্বাভাবিক রকমের চুপচাপ ভাব আর বিভ্রান্ত দৃষ্টি দেখে কেমন যেন অবাক হয়ে গেলেন। মাঝে-মাঝে বাটলার খালি গ্রাসে শ্যাম্পেন ঢেলে দিতে লাগল। সেইটাই তিনি আগ্রহের সঙ্গে খেতে লাগলেন; তৃষ্ণা যেন বাড়তে লাগল তাঁরা।
শেষ পর্যন্ত লর্ড হেনরি প্রশ্ন না করে পারলেন নাঃ কী ব্যাপার বল তো ডোরিয়েন; আজ যেন কেমন-কেমন দেখাচ্ছে তোমাকে।
লেডি নরবোরো বললেন, ‘মনে হয় ছেলেটা প্রেমে পড়েছেপাছে আমি হিংসে করি এই জন্যে ওর প্রেমিকার নামটা আমাকে বলতে ভয় পাচ্ছে না বলে ভালোই করেছে। আমি হিংসাই করতাম।
হাসতে-হাসতে ডোরিয়েন বললেন: প্রিয় লেডি, গোটা একটা সপ্তাহ আমি কারো প্রেমে পড়িনি, বিশেষ করে মাদাম দ্য ফেরোল শহর ছাড়ার পর থেকে।
বৃদ্ধা একটু চেঁচিয়ে মন্তব্য করলেন: বুঝতে পারিনে ওই মহিলাটির সঙ্গে প্রেমে পড় কী করে?
লর্ড হেনরি বললেন: তার একমাত্র কারণ, আপনি যখন শিশু ছিলেন তখনকার কথা তাঁর মনে রয়েছে। আপনার ছোটো ফ্রক আর আমাদের মধ্যে তিনিই একমাত্র যোগসূত্র।
আমার ছোটো ফ্রকের কথা মোটেই তাঁর মনে নেই, লর্ড হেনরি কিন্তু তিরিশ বছর আগে। তাঁকে যে অবস্থায় আমি ভিয়েনাতে দেখেছিলাম সে-কথা আমার এখনো মনে রয়েছে। সেই সময় তিনি কাঁধ আর গলা খোলা জামা আর অস্বাভাবিক রকমের ছোটো স্কার্ট পরে ঘুরে বেড়াতেন।
তাঁর লম্বা আঙুলের ভেতরে একটা অলিভ ফুল ধরে তিনি বললেন: এখনো তিনি সেইভাবেই ঘুরে বেড়ান; যখন তিনি চৌকস গাউন পরে স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করেন তখন তাঁকে দেখলে মনে হবে একটা অখাদ্য ফরাসি উপন্যাসকে যেন মরক্কো চামড়া দিয়ে বাঁধাই করে রাখা হয়েছে। সত্যিই তিনি বড়ো অদ্ভুত; কখন যে তিনি কী ভাবে মানুষকে চমকে দেবেন সে-কথা কেউ জানে না। আত্নীয়স্বজনদের ভালোবাসতে তাঁর জোড়া আর নেই। তৃতীয় স্বামী মারা। যাওয়ার পরে শোকে-দুঃখে তাঁর মাথার চুলগুলি একেবারে রক্তবর্ণ ধারণ করল।
ডোরিয়েন চেঁচিয়ে বললেন: এসব কথা কী বলছ, হ্যারি?
লেডি নরবোরো হেসে বললেন, নিঃসন্দেহে খুব রোমান্টিক ব্যাখ্যা। কিন্তু তৃতীয় স্বামীর কথাটা কী বললেন, লর্ড হেনরি? ফেরোল কি তাহলে তার চতুর্থ স্বামী?
হ্যাঁ, লেডি-চতুর্থা
আপনার একটি কথাও আমি বিশ্বাস করিনে।
ঠিক আছে; মিঃ গ্রেকে জিজ্ঞাসা করুন। ও তাঁর একটি অন্তরঙ্গ বন্ধু।
মিঃ গ্রে, কথাটা কি সত্যি?
ডোরিয়েন বললেন; সেই কথাই তিনি আমাকে বলেছেন। মারগিরাইট দ্য নাভারার মতো তিনি মৃত স্বামীদের হৃদযগুলি সুগন্ধী পুষ্পধারে রেখে দিয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বললেন: না। কারণ হৃদয় বলে কোনো পদার্থ তাদের কারুরই ছিল না।
চার-চারটে স্বামী! তবে যে কোনো কাজ করার মতো দুর্দান্ত মানসিক অবস্থা তার রয়েছে। কিন্তু ফেরোল কেমন দেখতে? তার সঙ্গে তো আমার কোনো আলাপ নেই।
মদের পাত্রে চুমুক দিতে দিতে লর্ড হেনরি হেসে বললেন: সুন্দরী মহিলাদের স্বামীদের জাত একটাই–তারা হচ্ছে ক্রিমিন্যাল।
লেডি নরবোরো হাত-পাখার খোঁচা দিলেন তাঁকে বললেন: লর্ড হেনরি, বিশ্বের লোক যে আপনাকে প্যলা নম্বরের দুষ্টু বলে অভিহিত করে তাতে আমি মোটেই অবাক হইনে।
চোখ দুটো ওপরে তুলে জিজ্ঞাসা করলেন লর্ড হেনরি: কিন্তু কোন বিশ্বের লোকেরা বলে? নিশ্চয় অন্য বিশ্ব; কারণ এই বিশ্বের সঙ্গে আমার যথেষ্ট সৌহার্দ্য রয়েছে।
লেডি নরবোরো ঘাড় নেড়ে বললেন: উ। আমার সঙ্গে যাদের পরিয় রয়েছে তারা সবাই ওই কথা বলে।
কয়েক মুহূর্ত গম্ভীরভাবে থেকে লর্ড হেনরি বললেন; এইভাবে মানুষে যে আজকাল অপরের সম্বন্ধে নির্ভেজাল সত্যিকথাটা তাদের পেছনে বলে চলেছে তা সত্যিই বড়ো ভয়ঙ্কর।
চেয়ারে হেলান দিয়ে ডোরিয়েন বললেন: ওর সঙ্গে কথায় আপনি পারবেন না।
লেডি নরবোরো হেসে বললেন:আমারও তাই মনে হয়। কিন্তু আপনারা সবাই যদি মাদাম দ্য ফেরোলের এইভাবে স্মৃতি করেন তাহলে বাজারে বিকোবার জন্যে দেখছি আমাকেও আবার বিয়ে করতে হবে।
লর্ড হেনরি বললেন: বিয়ে আর আপনি করবেন না। আপনি অনেক সুখী। কোনো মহিলা যখন দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন তখন ধরে নিতে হবে যে প্রথম স্বামীকে তিনি ঘৃণা করতেন। পুরুষ যখন দ্বিতীয় বার বিয়ে করেন তখন বুঝতে হবে তিনি তাঁর স্ত্রীকে ভালোবাসতেন। মহিলারা ভাগ্যকে যাচাই করেন; পুরুষরা নেন ঝুঁকি।
বৃদ্ধাটি বললেন: নরবোরো খাঁটি ছিল না।
তিনি খাঁটি হলে আপনি তাঁকে ভালোবাসতে পারতেন না। খুঁত থাকে বলেই মহিলারা আমাদের ভালোবাসে। আমাদের দোষ যত বেশি থাকবে ততই মহিলারা আমাদের ক্ষমা করবে, এমন কি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি পর্যন্ত। এই কথা শোনার পরে ভবিষ্যতে নিশ্চয় আর আপনি আমাকে ডিনারে আসতে নিমন্ত্রণ করবেন না; কিন্তু কথাটা সত্যি।
আপনাদের ভালো না বাসত তাহলে আপনাদের অবস্থা কী হত? আপনাদের একজনেরই বিয়ে হত না। ঝাঁকে-ঝাঁকে আপনারা অবিবাহিত থেকে যেতেন। তাতে অবশ্য আপনাদের অবস্থার কোনো হেরফের হত না। আজকাল সব বিবাহিত পুরুষরাই অবিবাহিত পুরুষদের মতো দিন কাটায়; আর সব অবিবাহিত পুরুষরাই দিন কাটায় বিবাহিতদের মতো।
লর্ড হেনরি বললেন: একেই বলে জীবনের উচ্ছ্বাস।
লেডি নরবোরো বললেন: একেই বলে জীবনের পরিহাস।
ডোরিয়েন বললেন: জীবন একটা বিরাট ধোঁকা।
দস্তানাগলি হাতে পরে লেডি নরবোরো বললেন জীবনটা যে তোমার শেষ হয়ে গিয়েছে একথা নিশ্চয় তুমি আমাকে বলতে চাই না। মানুষ যখন তোমার মতো কথা বলে তখন মনে হয় সে বুঝতে পেরেছে যে তার জীবন, শেষ হয়ে এসেছে। লর্ড হেনরি দুষ্ট প্রকৃতির; মাঝে-মাঝে মনে হয় আমিও যদি ওই রকম হতাম। কিন্তু ভগবান তোমাকে সুন্দর করে সৃষ্টি। করেছেন–এত সুন্দর তুমি দেখতে তোমার জন্যে একটি সুন্দর পাত্রী খুঁজে দেব আমি। লর্ড হেনরি, আপনার কী মনে হয় মিঃ গ্রের বিয়ে করা উচিত নয়?
লর্ড হেনরি বললেন: সেকথা আমি ওকে অনেকবার বলেছি, লেডি নরবোরো।
বিয়ের যোগ্য পাত্রীদের একটা তালিকা আভই আমি তৈরি করে ফেলব।
তাদের বয়সসুদ্ধুও তো?-জিজ্ঞাসা করলেন ডোরিয়েন।
নিশ্চয়, নিশ্চয়। একটু রদবদল করে আর কী! কিন্তু তাড়াতাড়ি কিছু করব না। আমি চাই তোমরা দুজনেই সুখী হও।
লর্ড হেনরি বললেন: বিয়ে করে সুখ! কী আলতু-ফালতু কথাই না মানুষ বলে! পুরুষ যে-কোনো নারীকে নিয়েই সুখী হতে পারে যদি না সে তাকে ভালোবেসে ফেলে।
চেয়ারটাকে সরিয়ে লেডি রাক্সটনের দিকে চেয়ে লেডি নরবোরো বললেন: দেখেছ–একেবারে পাকা সিলিকা তোমাকে তাড়াতাড়ি আমার এখানে একদিন আসতেই হবে; আর ডিনার-ও খেতে হবে। টনিক হিসাবে সত্যিই তোমার তুলনা নেই স্যার অ্যানড্র আমাকে যে টনিক দেন তার চেয়েও অনেক বেশি উপাদেয়। সেদিন এখানে কার কার সঙ্গে তুমি দেখা করতে চাও তাও তুমি আমাকে বলবে কিন্তু। মজলিসটা জমজমাট হোক আমিও তাই চাই।
তিনি বললেন, আমি সেই সব পুরুষদের সঙ্গে আলাপ করতে চাই যাদের ভবিষৎ রয়েছে; আর আলাপ করতে চাই সেই সব মহিলাদের সঙ্গে যাদের রয়েছে অতীত; আপনার কি মনে হয়। এরকম মজলিস বেশ জমাটি হবে না?
দাঁড়িয়ে হাসতে-হাসতে লেডি নরবোরো বললেন: আমার তাই মনে হয়। ক্ষমা করবেন লেডি রাক্সটোন, আপনার যে এখনো সিগারেট খাওয়া শেষ হয়নি তা আমি বুঝতে পারিনি।
কিছু না, কিছুনা; লেডি নরবোরো, সিগারেটটা আমি খুব বেশি খাই। ভবিষ্যতে সিগারেট আমি কম খেতে মনস্থ করেছি।
লর্ড হেনরি বললেন: আমার অনুরোধ, লেডি রাক্সটোন, ও-কাজটি আপনি করবেন না। পরিমিত ব্যবহারের মতো জঘন্য, মারাত্মক জিনিস আর নেই। মিতাচার জিনিসটা হচ্ছে দৈনন্দিন খাওয়ার মতো খারাপ; অমিতাচার ভোজন-উৎসবের মতো উপাদেয়।
তাঁর দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে লেডি রাক্সটোন বললেন, লর্ড হেনরি, একদিন বিকালে আমার বাড়িতে এসে ব্যাপারটা আমাকে ভালো করে বুঝিয়ে দেবেন তো! আপনার মতবাদ বড়োই চমৎকার।
এইটুকু বলেই তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে লেডি নরবোরো বেশ চেঁচিয়েই বললেন: মনে রেখ তোমরা রাজনীতি আর কুৎসা নিয়ে বেশিক্ষণ মেতে থেক না থাকলে তোমাদের ভেতরে একটা হট্টগোল বেঁধে যাবে।
পুরুষ অতিথিরা হাসলেন। মিঃ চ্যাপম্যান গম্ভীরভাবে টেবিলের ধার থেকে উঠে সামনের দিকে এগিয়ে এলেন। ডোরিয়েন গ্রে স্থান পরিবর্তন করে লর্ড হেনরির পাশে এসে বসলেন। হাউস অফ কমনস-এর ঘটনা নিয়ে মিঃ চ্যাপম্যান বেশ জোর গলায় আলোচনা শুরু করলেন। তাঁর চিন্তাধারার মানমন্দিরের ওপরে তিনি ইউনিয়ন জ্যাক পতাকা উড়িয়ে দিলেন। ব্রিটিশ জাতির বংশগত মূর্খতাকে তিনি খুশ মেজাজে অভিজ্ঞ “ইংলিশ কমনসেন্স” বলে চিহ্নিত করলেন। তাঁর মতে সেইটাই হচ্ছে সমাজের আসল কাঠামো।
লর্ড হেনরির দুটি ঠোঁট হাসিতে বেঁকে উঠল; তিনি ঘুরে ডোরিয়েন-এর দিকে তাকালেন; জিজ্ঞাসা করলেন: শরীর ভালো তো? ডিনারের সময় তোমাকে যেন কেমন-কেমন দেখাচ্ছিল।
হ্যারি, না, আমি ভালোই আছি। আমি একটু ক্লান্ত–এই যা।
গতরাত্রিতে তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। ডাচেস তো তোমার ভক্ত হয়ে উঠেছেন। তিনি বলছিলেন একদিন তিনি তোমার সেলবি-র বাড়িতে হাজির হবেন।
কুড়ি তারিখে যাবে বলে তিনি আমাকে কথা দিয়েছেন।
মনমাউথও কি যাবে?
হ্যাঁ, নিশ্চয়-হ্যারি।
ওই মানুষটাকে আমার মোটেই ভালো লাগে না; যেমন ভালো লাগে না ডাচেসেরা মহিলা হিসাবে তিনি চতুর, অত্যন্ত চতুর। দুর্বলতার যে অদ্ভুত একটা সৌন্দর্য রয়েছে সেই দুর্বলতা তাঁর নেই। কাদার পা থাকার জন্যেই সোনার মূর্তির কদর। তাঁর পা দুটি সুন্দর; কিন্তু সেগুলি কাদার নয়। বরং সাদা পোরসিলিন-এর বলতে পার। অনেক আগুনের ওপর দিয়ে তাদের। হাঁটতে হয়েছে এবং আগুন যাকে পোড়াতে পারে না তাকে শক্ত করে দেয়। অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর।
ডোরিয়েন জিজ্ঞাসা করলেন: কতদিন তাঁর বিয়ে হয়েছে?
তাঁর মতে অনন্তকাল। আমার বিশ্বাস, তাঁর পিয়ারেজ পাওয়ার সময় থেকে যদি ধর তাহলে, বিয়ে হয়েছে তাঁদের বছর দশেক কিন্তু মনমাউথের সঙ্গে দশ বছর ঘর করা অনন্ত সময়েই সামিল। আর কারা আসছেন?
উইলোবায় দম্পতি, লর্ড রাগবি এবং তাঁর স্ত্রী, আমাদের লেডি নরবোরো, জিয়োফ্রি ক্লোসিটন, আর ওই জাতীয় মানুষ যাঁরা সাধারণত আমাদের পার্টিতে এসে থাকেন। লর্ড গ্রোসিযেনকে আমি আসতে বলেছি।
লর্ড হেনরি বললেন: ভদ্রলোকটিকে আমি পছন্দ করি। অনেকের তাঁকে ভালো লাগে না বটে; কিন্তু আমার তো মনে হয় ভদ্রলোক বেশ চমৎকার মানুষ। মাঝে-মাঝে তিনি পোশাকে নিজেকে ভারাক্রান্ত করে তোলেন; সেই পাপের সব সময় প্রায়শ্চিত্ত করেন বিদ্যার প্রাচুর্যে। আধুনিক বলতে যা বোঝা যায় তিনি তাই। তিনি আসতে পারবেন কিনা জানি নে, হ্যারি; তাঁর বাবার সঙ্গে হয়তো তাঁকে মন্টি কার্লোতে যেতে হবে।
হায়রে, মানুষের আত্মীয়স্বজনরা কী জঘন্য, ডোরিয়েন! তিনি যাতে সেদিন আসেন তার উল্যে চেষ্টা কর। আচ্ছা ডোরিয়েন, গতকাল রাত্রিতে তুমি তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছিল, রাত্রি এগারোটা বাড়ার আগেই। তারপর কী করলে তুমি? সোডা বাড়ি গিয়েছিলে?
ডোরিয়েন তাঁর দিকে চকিতে একবার তাকিয়ে ভ্রু কুঞ্চিত করলেন; শেষকালে বললেন: না হ্যারি; রাত্রি প্রায় তিনটের আগে আমি বাড়িতে ঢুকিনি।
তুমি কি ক্লাবে গিয়েছিলে?
হ্যাঁ।
তারপরেই তিনি ঠোঁট কামড়ালেন: না; তা নয়। ক্লাবে আমি যাইনি, ঘুরে বেড়িয়েছি। কী করেছি তা আমার মনে নেই। সব জিনিসে তোমার এত আগ্রহ কেন হ্যারি? অন্য লোকে কী করে সব সময়েই তুমি তা জানতে চাও। আমি কী করছি তা আমি সব সময়েই ভুলে যেতে চাই। ঠিক কখন কাল রাত্রিতে আমি বাড়িতে ফিরেছি তা যদি তুমি জানতে চাও তাহলে বলব রাত্রি আড়াইটা। ‘ল্যাচ কী’-টা আমি বাড়িতে ফেলে এসেছিলাম; চাকরটা আমাকে দরজা খুলে দিয়েছিল। যদি প্রমাণ চাও-তার সঙ্গে কথা বলতে পারা।
কাঁধটা কোঁচকালের লর্ড হেনরি: না, না বন্ধ; তমি কখন ফিরছ তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র কৌতূহল নেই। চল আমরা ড্রয়িংরুমে যাই। মিঃ চ্যাপম্যান, ধন্যবাদ; আর শ্যেরি ন্য। ডোরিয়েন, নিশ্চয় কিছু একটা তোমার হয়েছে। কী হয়েছে বল। আজ তোমার চালচলনটা ঠিক আগেকার তোমার মতো নয়।
ওসব ছেড়ে দাও, হ্যারি। আমার মেজাজটা আজ ভালো নেই; কেমন যেন চটে উঠছি। আমি কাল বা পরশু তোমার সঙ্গে দেখা করবা লেডি নরবোরোর কাছে আমার হয়ে তুমি তুমা। চেয়ে নিযো; ওপরে আর আমি যাচ্ছিনে। আমি বাড়ি যাব-বাড়ি আমাকে যেতেই হবে।
ঠিক আছে ডোরিয়েন; কাল চা খাওয়ার সময় নিশ্চয় তোমার সঙ্গে দেখা হচ্ছে। ডাচেসও আসছেন।
আসতে চেষ্টা করব হ্যারি।
এই বলেই ডোরিয়েন ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বাড়িতে ফেরার পথে তাঁর মনে হল যে ভীতিটার গলা টিপে হত্যা করেছিলেন বলে এতক্ষণ তিনি ভেবেছিলেন সেই ভীতিটা আবার তাঁর ফিরে এসেছে। কথায়-কথায় লর্ড হেনরি তাঁকে যে প্রশ্ন করেছিলেন তাতেই তাঁর স্নায়ুগুলি সাময়িকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সেই স্নায়ুগুলিকে তাঁর ঠিক করতে হবে। ধ্বংস করতে হবে তাঁর কাছে যেগুলি বিপজ্জনক হতে পারে সেই জিনিসগুলি, ভ্রূকুটি করলেন তিনি। জিনিসগুলি সপর্শ করতেও তাঁর ঘৃণা বোধ হল।
তবু সে-কাজগুলি তাঁকে করতেই হবে। করতে যে হবে সেদিক থেকে তাঁর মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। লাইব্রেরিতে ঢুকে তিনি ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন; তারপরে একটা। গোপন ড্রয়ার খুললেন; এরই ভেতরে বেসিল হলওয়ার্ড-এর কোট আর ব্যাগটা তিনি লুকিয়ে রেখেছিলেন। ঘরের ভেতরে বিরাট একটা চুল্লিতে আগুন জ্বলছিল; আরো কয়েকটা কাঠের গুঁড়ি তিনি তার মধ্যে ফেলে দিলেন। পোড়া কাপড় আর চামড়ার উগ্র গন্ধে ঘর ভরে উঠল, সব কিছু পুড়িয়ে ফেলতে তিনি কোয়ার্টারের মতো সময় লাগল তাঁর। কেমন যেন অবশ হয়ে উঠলেন তিনি। কপালটা ভিজিয়ে নিলেন ঠান্ডা সুগন্ধী ভিনিগারে।
হঠাৎ তিনি চমকে উঠলেন; তাঁর চোখ দুটো অস্বাভাবিক ভাবে জ্বলজ্বল করতে লাগল; ভয়। পেযে নীচের ঠোঁটটা কামড়ালেন তিনি। দুটি দরজার মাঝখানে হাতির দাঁতের কাজ করা। আবলুস কাঠের তৈরি বিরাট একটা কেবিনেই ছিল। সেইটির দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে। রইলেন তিনি। জিনিসটা তাঁকে কেবল চমৎক্তই করেনি যথেষ্ট সন্ত্রস্তও করেছিল তাঁকে। আকর্ষণ আর ঘৃণা দুটিই তাঁকে অভিভূত করে ফেলেছিল। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের দ্রুততা বৃদ্ধি পেল তাঁরা একটা উন্মত্ত কামনা গ্রাস করে ফেলল তাঁকে। একটা সিগারেট ধরিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন তিনি। তাঁর চোখের পাতা এল নেমে। তবু তিনি কেবিনেটের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপরে সোফা থেকে উঠে তিনি সেটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। চাবিটি খুলে গোপন একটা বোতামে চাপ দিলেন। তিনকোনা একটা ড্রয়ার বেরিয়ে এল ধীরে-ধীরে, তাঁর আঙুলগুলি তার মধ্যে ঘুরে-ঘুরে একটা জিনিসের ওপরে গিয়ে পড়ল; কালো আর সোনালি গুঁড়ো মেশানো ল্যাকারের ছোটো একটা চিনে বাক্স। ডালাটা খুলতেই খানিকটা চটকটে সবুজ পদার্থ তাঁর নজরে পড়ল। গন্ধটাও তার বড়ো তীব্র।
মুখটা হাসিতে ভরে উঠল তাঁর। কয়েকটি মুহূর্ত দ্বিধা করলেন তিনি। ঘরের আবহাওয়া যথেষ্ট গরম হওয়া সত্ত্বেও তিনি কাঁপতে লাগলেন; তারপরে পিছিয়ে এসে ঘড়ির দিকে তাকালেন। বারোটা বাজতে কুড়ি মিনিট বাকি। বাক্সটা যথাস্থানে রেখে ড্রযারটি বন্ধ করে তিনি শোওয়ার ঘরে চলে এলেন।
ধোঁয়াটে আকাশে মধ্যরাত্রির সংকেত বেজে উঠতেই ডোরিয়েন গ্রে বেশ সাধারণ ভাবেই পোশাক পরলেন, গলায় জড়ালেন মাফলার; তারপরে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। বনড স্ট্রিটে গিয়ে একটা বেশ ভালো ঘোড়ার গাড়ি দেখতে পেলেন। তার ভেতরে উঠে নীচু গলায় বিশেষ একটা জাযগায় যাওয়ার জন্যে নির্দেশ দিলেন গাড়োয়ানকে।
গাড়োয়াল ঘাড় নেড়ে বলল: অনেক দূর স্যার।
ডোরিয়েন বললেন, একটা সোভারেন না। তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারলে আর একটা পাবে।
লোকটি বলল: আচ্ছা স্যার। একঘন্টার মধ্যে সেখানে পৌঁছে দেব আপনাকে।
.
ষোড়শ পরিচ্ছেদ
বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছিল; ঠান্ডা কনকনে বৃষ্টি। সেই ঝিরঝিরে ঝাপটায় রাস্তার আলোগুলি ভূতের মতো বিবর্ণ হয়ে উঠেছিল। বেশ্যাপাড়ায় লোকজন কমে এসেছিল; ভাঙা-ভাঙা দলে। তখনো কিছু বারবনিতাদের দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। কিছু কিছু সরাইখানা থেকে উঁচু হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। অন্য জায়গা থেকে ভেসে আসছিল মাতালদের ঝগড়া আর চিৎকার।
গাড়ির মধ্যে বসে মাথার টুপিটা কপালের ওপরে নামিয়ে ডোরিয়েন গ্রে উদাসীন দৃষ্টিতে সেই বিরাট শহরের নির্লজ্জ খেলা দেখছিলেন। প্রথম পরিচয়ের দিনে লর্ড হেনরি ‘প্রবৃত্তি দিয়ে আত্মার পরিশোধন, আর আত্মার সাহায্যে প্রবৃত্তির বিশুদ্ধিকরণের’ যে কথাটা তাঁকে বলেছিলেন সেই কথাগুলিই নিজের মনে-মনে বারবার তিনি উচ্চারণ করতে লাগলেন। হ্যাঁ, ওইটাই হল গোপন কথা; সেইভাবে চলতে এর আগেও তিনি অনেকবার চেষ্টা করেছেন। এখনো তাই করতে যাচ্ছেন। সেখানে আফিঙের আস্তানা রয়েছে, ওখালে মানুষে ভুলে থাকার ওষুধ কিনতে পায়। সেখানে পুরনো পাপের ভয়ঙ্কর স্মৃতির আস্তাবল রয়েছে, ওইখানে মানুষ। নতুন পাপের স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে পুরনো পাপের কথা ভুলে যেতে পারে।
হলদে মড়ার মাথার মতো নীচ-আকাশে ঝুলে পড়তে চাঁদকে দেখা যাচ্ছে। মাঝে-মাঝে বিরাট বিকলাঙ্গ মেঘের কোনো হাতকে দেখা যাচ্ছে সেই চাঁদকে ঢেকে দিতে আলোর সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে, রাস্তাগুলি সরু আর অন্ধকারাচ্ছন্ন। একবার পথের নিশানা ভুল করায় আধ মাইল পিছিয়ে আসতে হল গাড়োয়ানকে। পাশের জানালার শার্সিগুলি ধূসর রঙের কুশায ভরে উঠেছিল।
“প্রবৃত্তি দিয়ে আত্মার পরিশোধন, আর আত্মার সাহায্যে প্রবৃত্তির বিশুদ্ধিকরণ!” কথাগুলি তাঁর কানের ভেতরে গুনগুন করতে লাগল। নিঃসন্দেহে তাঁর আত্মা ক্লান্তিতে জর্জরিত। সত্যিই প্রবৃত্তি তাঁর আত্মাকে বাঁচাতে পারবে? নিরপরাধ মানুষকে তিনি হত্যা করেছেন। এরই বা প্রায়শ্চিত্ত কী? হায়রে, কোনো প্রায়শ্চিত্তই এই পাপ থেকে তাঁকে রেহাই দিতে পারবে না। কিন্তু মা পাওয়ার যোগ্যতা তাঁর নেই, তবু এখনো তিনি সব কিছু ভুলে থাকতে পারেন। এবং সব কিছু ভুলে যেতে তিনি বদ্ধপরিকর; যে সাপ তাঁকে ছোবল দিয়েছে সেই সাপকে একেবারে পিষে মেরে ফেলতে তিনি পণ করেছেন। আর ওভাবে কথা বলার কী অধিকার ছিল বেসিলের? অন্য লোকের বিচার করার অধিকার কে তাঁকে দিয়েছিল? তিনি যে সব কথা বলেছিলেন সেগুলি যে কেবল ভয়ানক আর বিপজ্জনক তাই নয়; অসহ্য।
গাড়িটি গড়িয়ে গড়িয়ে চলতে লাগল। তিনি বেশ বুঝতে পারলেন গাড়ির গতি বেশ শ্লথ হয়ে আসছে লোকটিকে তিনি তাড়াতাড়ি গাড়ি চালাতে বললেন। আফিঙের নেশায় অস্থির হয়ে উঠছিলেন তিনি। তাঁর গলা জ্বলতে লাগল, কাঁপতে লাগল হাতগুলি। হাতের ছড়ি দিয়ে। ঘোড়াগুলিকে উন্মাদের মতো তিনি পিটতে লাগলেন। গাড়োয়ান হেসে চাবুক কোল তাদের পিঠে। প্রত্যুত্তরে তিনি হেসে উঠলেন; লোকটি চুপ করে গেল।
পথের যেন আর শেষ নেই। মাকড়শার জালের মতো পথটা কেবল জট পাকিয়ে চলেছে। একঘেয়ে চলা আর তাঁর সহ্য হচ্ছিল না। কুয়াশা ঘন হয়ে এল। ভয় পেয়ে গেলেন তিনি।
নির্জন ইট-পাঁজার পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল গাড়ি। এখানে কুয়াশা পাতলা। বোতলের মতো গনগনে আগুনে চুল্লিগুলি এবার তিনি দেখতে পেলেন। বেশির ভাগ ডানালাই অন্ধকার; মাঝে-মাঝে কোনো ডানালার ভেতর থেকে অদ্ভুত-অদ্ভুত ছায়া দেখা গেল। একটা কুকুর চেঁচিয়ে উঠল; আর অনেক দূরে অন্ধকারে কোনো ভ্রাম্যমান শৃগালের চিৎকার শোনা গেল। একটা কুঁড়ের সামনে ধাক্কা খেয়ে বেঁকে আবার ছুটতে লাগল গাড়িটা।
একটা উন্মত্ত ক্রোধ তাঁর মনের মধ্যে দাপাদাপি করতে লাগল। একটা কোণে গাড়িটা এসে পৌঁছতেই একটা মেয়ে চিৎকার করে উঠল, সঙ্গে-সঙ্গে দুটো লোক প্রায় একশ গজের মতো তাদের পেছনে ছুটে এল। গাড়োয়ান তাদের পিঠে তার চাবুক বসিয়ে দিল।
শোনা যায় কামনা নাকি বৃত্তাকারে মানুষের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। ডোরিয়েন গ্রে-ও তা থেকে। অব্যাহতি পেলেন না। তাঁর মাথার একটি রন্ধ্র থেকে আর একটি রন্ধ্রে কেবল একটি চিন্তাই ঘুরে বেড়াতে লাগল। মানুষের সমস্ত আকাঙ্ক্ষার মধ্যে সবচেয়ে উন্মাদ আর বিপজ্জনক হচ্ছে বেঁচে থাকা। আকাঙ্খাই তাঁর প্রতি স্নায়ু আর তন্ত্রীকে উগ্র উত্তেজনায় কাঁপিয়ে তুলল। বাস্তব সত্য বলে একদিন কুৎসিত জিনিসকে তিনি ঘৃণা করতেন; আর ঠিক সেই কারণেই আজ কুৎসিত তার প্রিয়। চারুকলা আর সঙ্গ তের চেয়ে অপরিচ্ছন্ন সরাইখানা, ঘৃণ্য বস্তী, বিশৃঙ্খল জীবনের নগ্ন হট্টগোল, এমন কি চোর আর অসামাজিক মানুষের নোংরামিও অনেক বেশি বাস্তব। আর তিনি দিনের মধ্যে মুক্তি পাবেন তিনি।
একটি অন্ধ গলির মোড়ে এসে লোকটি ধাক্কা দিয়ে হঠাৎ গাড়িটা থামিয়ে দিল। নীচু ছাদ আর ঘরের চিমনির স্কুপের ওপরে জাহাড়ের কালো-কালো মাস্তুলগুলি দেখা যাচ্ছিল। উঠোনে সাদা কুয়াশার মালা ভুতুড়ে পালগুলির ওপরে ছড়িয়ে পড়েছিল।
লোকটি বলল: এই জায়গাটাই নয় স্যার?
চমকে উঠলেন ডোরিয়েন, মুখ বার করে চারপাশে তাকালেন।
ঠিক আছে।
এই বলে তিনি তাড়াতাড়ি নেমে পড়লেন; গাড়োয়ানকে কথামতো বাড়তি ভাড়া দিলেন; তারপরে জাহাজঘাটার দিকে দ্রুত এগিয়ে চললেন। এখানে-ওখানে বিরাট সওদাগরী জাহাজের গায়ে লাল লণ্ঠন জ্বলছিল।
বাঁ দিক ধরে তিনি দ্রুত হাঁটতে লাগলেন। কেউ তাঁকে অনুসরণ করছে কি না জানার জন্যে মাঝে-মাঝে পেছন ফিরে তাকালেন। সাত থেকে আট মিনিটের মধ্যে তিনি একটা নোংরা বাড়ির সামনে এসে হাজির হলেন। বাড়িটা দুটো বিরাট ফ্যাকটরির মাঝখানে।ওপরের একটা জানালায় একটা লণ্ঠন বসানো ছিল। তিনি থামলেন সেইখানে এবং বিশেষ রকম ধাক্কা। দিলেন দরজায।
কিছুক্ষণ পরে ভেতরে একজনের পায়ের শব্দ তাঁর কানে এল; শব্দ হল শেকল খোলার। নিঃশব্দে খুলে গেল দরজা। কোনো কথা না বলে তিনি সোজা ভেতরে ঢুকে গেলেন। লম্বা হল-এর শেষ প্রান্তে সুবজ রঙের একটা ছেঁড়া পর্দা ঝুলছিল। তিনি ঘরে ঢোকার ফলে রাস্ত থেকে যে একটা দমকা বাতাস ঘরের মধ্যে ঢুকে এসেছিল তারই ধাক্কায় পর্দাটা উড়তে লাগল। পর্দাটাকে একপাশে সরিয়ে তিনি একটা লম্বা নীচু ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন দেখলে মনে হবে ঘরটি একসময় এই তৃতীয় শ্রেণির নাচঘর ছিল। দেওয়ালের চারপাশে ছিল গ্যাস-ডেট আর বিবর্ণ আরশি। মেঝের ওপরে ছড়ানো ছিল করাত গুঁড়ো; এখানে-ওখানে কিছু মাটি, আর মদ ছড়ানোর দাগ। ছোটো ক্যুলার স্টোভের ধারে বসে কয়েকটি মালয় দেশের লোক বাজনা বাজাচ্ছিল–আর ক’জন সাদা দাঁত বার করে দিচ্ছিল তালা হাতের মধ্যে লুকিয়ে একজন নাবিক টেবিলের ওপরে ঝুঁকে বসেছিল আর একপাশ দিয়ে টানা ছিল নোংরা ‘বার’; সেইখানে দুটি শীর্ণ চেহারার মেয়ে একটি বুড়ো মানুষকে দেখে ঠাট্টা করছিল। ডোরিয়েন তাকে পেরিয়ে যেতেই লোকটি তাঁকে উদ্দেশ্য করে গজগজ করতে লাগল।
ঘরের শেষে একটা ছোটো সিড়িঁ। সেই সিড়িঁ পেরিয়ে একটা অন্ধকার ঘর। সর-মর তিনটে সিঁড়ি ওঠার পরেই ডোরিয়েনের নাকে আফিঙের গন্ধ এসে লাগল। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলেন তিনি; আরামে তাঁর চোখ দুটি ফুলে উঠল। তিনি ঘরে ঢুকতেই একটি যুবক দ্বিধা-জড়িত কণ্ঠে তাঁর দিকে তাকাল।
ডোরিয়েন ফিল-ফিস করে বললেন: আদ্রিয়েন, তুমি এখানে?
উদাসীনভাবে উত্তর দিল আদ্রিয়েন: আর কোথায় যাব? কোনো লোকই আজ আর আমার সঙ্গে কথা বলবে না।
আমি ভেবেছিলেম ইংলন্ড ছেড়ে তুমি চলে গিয়ে।
ডারলিংটন কিছু করতে রাজি নয়। শেষকালে আমার ভাই টাকাটা মিটিয়ে দিয়েছে। জর্ড আমার সঙ্গে কথা বলে না; আমি গ্রাহ্য করিনে কিছু।
একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল তার; বলল: যতক্ষণ মানুষের কাছে এই জিনিসটা থাকবে ততক্ষণ কোনো বন্ধুর দরকার তার নেই। আমার ধারণা, আমার বন্ধুর সংখ্যা অনেক।
ভ্রুকুটি করলেন ডোরিয়েন; ছেঁড়া মাদুরের ওপর অদ্ভুতভাবে যে সব কিম্ভুতকিমাকার বস্তুগুলি পড়ে রয়েছে সেগুলির দিকে তাকিয়ে দেখলেন। সেই বাঁকানো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, মুখব্যাদন, আর বিবর্ণ দৃষ্টিগুলি তাঁকে অভিভূত করে ফেলল। কী অদ্ভুত স্বর্গে তারা যন্ত্রণা ভোগ করছে তিনি তা জানতেন। কোন নরক যন্ত্রণা তাদের কাছে নতুন আনন্দের গোপন রহস্যের দ্বার খুলে দিয়েছে তা জানতে তাঁর অসুবিধে হয়নি। তাদের অবস্থা তাঁর চেয়ে অনেক ভালো। তিনি দুশ্চিন্তার কারাগারে বন্দি; ভয়ঙ্কর কোনো ব্যাধির মতো স্মৃতি তাঁর আত্মাকে কুরে কুরে খেয়ে শেষ করে ফেলছে। মাঝে-মাঝে তাঁর মনে হল বেসিল হলওয়ার্ডের চোখ দুটি যেন তাঁর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তিনি স্পষ্টভাবে দেখতে পেলেন। তবু তাঁর মনে হল তিনি আর অপেক্ষা করতে পারেন না। আদ্রিয়েন সিঙ্গলটনের উপস্থিতি তাঁকে অস্থির করে তুলল। তিনি এমন একটা জায়গায় যেতে চান যেখানে কেউ তাঁকে চিনতে পারবে না। নিজের কাছ থেকেই তিনি পালিয়ে যেতে চান।
একটু থেমে তিনি বললেন: আমি অন্য ঘরে যাচ্ছি।
জেটির দিকে?
হ্যাঁ।
সেই পাগল বেড়ালটা নিশ্চয় ওখানে রয়েছে। এখন এখানে তারা আর তাকে রাখে না।
ডোরিয়েন অগ্রাহ্যভরে স্রাগ করলেন; বললেন; প্রেমিকাদের নিয়ে আমি অস্থির হয়ে উঠেছি। যে সব মেয়েরা অপরকে ঘৃণা করে তারাই সবচেয়ে উপাদেয়। তা ছাড়া, জিনিস হিসাবেও তারা উৎকৃষ্ট।
একই রকম।
ওদেরই আমি বেশি পছন্দ করি। এস; একটু ড্রিঙ্ক করে যাবে। আমারও কিছু চাই। যুবকটি বিড়বিড় করে বলল: না; আমার কিছু দরকার নেই।
ঠিক আছে। এস।
ক্লান্তভাবে আদ্রিয়েন সিঙ্গলটন উঠে দাঁড়াল; ‘বার’ পর্যন্ত ডোরিয়েন-এর পিছু পিছু গেল। ডো পাগড়ি আর ময়লা কোট পরে একজন বেয়ারা বিকৃত মুখে অভিনন্দন জানিয়ে এক বোতল ব্র্যান্ডি আর দুটো মগ তাদের সামনে রেখে দিল। মেয়েরা ভয়ে টলতে-টলতে সরে গিয়ে কিচির-মিচির করতে লাগল। ডোরিয়েন তাদের দিকে পেছন করে দাঁড়ালেন, আদ্রিয়েন সিঙ্গলটনকে ফিসফিস করে কী যেন বললেন।
মেয়েদের একটি মুখের ওপরে বাঁকা হাসি খেলে গেল। সে নাক বাঁকিয়ে ব্যঙ্গের ছলে বলল আজ আমাদের সৌভাগ্যের দিন।
মেঝের ওপরে পা ঠুকে চিৎকার করে উঠলেন ডোরিয়েন: ভগবানের দোহাই, আমাদের সঙ্গে কথা বলো না। কী চাই তোমাদের? টাকা? এই নাও। ভবিষ্যতে আর কখনো আমার সঙ্গে কথা বলো না।
মেয়েটির ভিজে চুপসানো চোখ দুটির ভেতর থেকে দুটো লাল ফুলকি চকচক করে উঠল। তারপরে যথারীতি সেগুলি মিলিয়ে গেল। মাথা ঝাঁকানি দিয়ে কাউন্টার থেকে সে লোলুপ ভাবে মুদ্রা দুটি প্রায় ছোঁ দিয়ে তুলে নিল। হিংসার চোখে তার বন্ধুরা ব্যাপারটা লক্ষ করল।
আদ্রিয়েন সিঙ্গলটন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল: কোনো লাভ নেই। আর আমি ফিরে যেতে চাইনে। আর ফিরে গিয়েই বা লাভ কী? আমি এখানে সুখেই রয়েছি।
একটু চুপ করে থেকে ডোরিয়েন বললেন, তোমার যদি কখনো কিছু দরকার হয় আমাকে তা ডানাবে তো? না কি?
সম্ভবত
তাহলে, এখন চলি।
শুকনো মুখ রুমাল দিয়ে মুছে চলে যেতে-যেতে সে বলল: শুভরাত্রি।
ডোরিয়েন দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁর দৃষ্টির মধ্যে একটা যন্ত্রণার চিহ্ন ফুটে উঠেছে। পর্দাটা সরিয়ে দিতেই একটা মেয়ে বীভৎস গলায় হেসে উঠল। এটি সেই মেয়ে যে কাউন্টারের উপর থেকে টাকা নিয়ে গিয়েছিল।
মোটা গলায় সে চেঁচিয়ে বলল: শয়তানটা যাচ্ছে।
তিনি বললেন: তুমি গোল্লায় যাও। আমাকে ও নামে ডেকো না। মেয়েটা বাতাসে হাতের ঝাপটা দিয়ে বলল: তোমাকে প্রিন্স চার্মিং বলে ডাকতে হবে, তাই না?
একটা নাবিক ঝিমোচ্ছিল। এই কথা শুনে সে লাফিয়ে উঠে উত্তেজিতভাবে চারপাশে তাকাতে লাগল। দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার শব্দ তার কানে এল। সে দৌড়ে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে মনে হল, ডোরিয়েন-এর পিছু নিয়েছে সে।
পিটপিটে বৃষ্টির ভেতর দিয়ে ডোরিয়েন দ্রুত জাহাজঘাটার দিকে এগিয়ে গেলেন। আদ্রিয়েন-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ তাঁকে অদ্ভুতভাবে নাড়া দিয়েছে। তিনি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন বেসিল হলওয়ার্ড যে জন্যে তাঁকে অপমান করেছিলেন তা কি সত্যি? অর্থাৎ, আদ্রিয়েন-এর অধঃপতলের জন্যে কি তিনিই দায়ী? নিজের ঠোঁটটা কামড়ালেন তিনি; কয়েক মুহূর্তের জল্যে চোখ দুটো বুড়িয়ে দিলেন। কেমন যেন বিষণ বোধ করলেন তিনি। তবু, তাঁরই বা কি যায় আসে? অন্য লোকের ভ্রান্তির বোঝা নিজের ঘাড়ে নিয়ে বয়ে বেড়ানোর মতো সময় মানুষের কোথায়? প্রতিটি মানুষ নিজের জীবন নিয়েই বেঁচে থাকে, আর তার জন্যে তাকে যথেষ্ট খেসারৎ দিতে হয়। সবচেয়ে দুঃখের কথা হচ্ছে একই ভুলের জন্যে অনেকবার প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় মানুষকে অনেকবার নয; বার বার। মানুষের সঙ্গে হিসাব-নিকাশের খতিযান কোনোদিনই ভাগ্য শেষ করে দেয় না। মনস্তত্ত্ববিদদের মতে, জীবনে এমন সময়। আসে যখন পাপ, অথবা মানুষ যাকে পাপ বলে, করার প্রবৃত্তি মানুষকে এমনভাবে গ্রাস করে বসে, যে তার দেহের প্রতিটি স্নায়ু বা মাথার প্রতিটি কোষ একটা ভয়ঙ্কর উন্মাদনায় থরথর করে কাঁপে। সে-সময় মানুষ তার ইচ্ছার স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলে। স্রোতের টানে অসহাযের মতো এগিয়ে যায় ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে। বিবেচনা করার শক্তি তখন তার থাকে না; নষ্ট হয়ে যায় বিবেক। অথবা, নষ্ট যদি নাই হয়ে থাকে তো বিদ্রোহ করাই তার আসল সৌন্দর্য। হয়ে দাঁড়ায় এবং অবাধ্যতাই হয়ে দাঁড়ায় তার আসল হাতিয়ার। সমস্ত ধর্মযাজকরা বারবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে আবাধ্যতাই হচ্ছে চরম পাপ। বিশ্বের প্রথম অমঙ্গলের প্রতীক শয়তানের যখন স্বর্গচ্যুতি ঘটেছিল তখন সে বিদ্রোহী হয়েই নেমে এসেছিল।
সব কিছুর সম্বন্ধে উদাসীন হয়ে অন্যায় করার জন্যে সমস্ত শক্তি সংগত করে, কলঙ্কিত মন আর বিদ্রোহের অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ডোরিয়েন গ্রে তাঁর চলার গতি বাড়িয়ে দিলেন; পতিতালয়ে যাওয়ার পথটা ছোটো করার জন্যে তিনি অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা সরু গলির মধ্যে ঢুকে গেলেন; কিন্তু এই সময়ে পেছন থেকে অতর্কিতে দুটো হাত ধাক্কা দিয়ে তাঁকে দেওয়ালের গায়ে ঠেলে দিল; তারপরে, একটা হাত প্রচণ্ড শক্তিতে তার টুঁটিটা চেপে ধরল। সতর্ক হওয়ার এতটুকু সময় তিনি পেলেন না।
বাঁচার জন্যে পাগলের মতো চেষ্টা করলেন তিনি এবং কোনোরকমে তাঁর গলা থেকে আক্রমণকারীর হাতটা সরিয়ে দিলেন। মুহূর্তের মধ্যে রিভলভার বার করার একটা শব্দ তাঁর কানে গেল, তিনি দেখতে পেলেন একটা রিভলভারের মুখ চকচক করছে আর দেখলেন সেই মুখ তাঁর মাথাটা লক্ষ্য করে উঁচিয়ে রয়েছে। আবছায়ার মধ্যে তাঁর নজরে পড়ল একটা স্বাস্থ্যবান বেঁটে লোক তাঁর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
হাঁপাতে-হাঁপাতে জিজ্ঞাসা করলেন তিনিঃ কী চাও?
লোকটি বলল: চোপ। একটু নড়লেই তোমাকে আমি গুলি করে মারব।
তুমি পাগল। আমি তোমার কী করেছি?
উত্তর এল: তুমি সাইবিল ভেন-এর জীবন ধ্বংস করেছ। সাইবিল আমার বোন ছিল। সে আহত্যা করেছে। আমি তা জানি তোমার জন্যেই সে আত্মহত্যা করেছে। প্রতিজ্ঞা। করেছিলাম তোমাকে হত্যা করে তার বদলা নেব আমি। বছরের পর বছর ধরে আমি তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। কোনো সন্ধান পাইনি তোমার। যে-দুজন তোমাকে চিনিয়ে দিতে পারত তারা আজ মৃত। যে প্রিয় নামে সে তোমাকে ডাকত সেইটুকু ছাড়া তোমার সম্বন্ধে আর কিছুই আমি জানতাম না। আজই হঠাৎ সেই নামটা আমার কানে এল। ভাবানের কাছে শেষবারের মতো প্রার্থনা করে নাও, কারণ, আজ তোমাকে মরতেই হবে।
ভয়ে কাঠ হয়ে গেলেন ডোরিয়েন গ্রে। তিনি তোতলাতে-তোতলাতে বললেন: আমি তাকে কোনোদিনই চিনতাম না। তার নাম কোনোদিনই আমি শুনিনি। তুমি একটি উন্মাদ।
তার চেয়ে বরং নিজের দোষ স্বীকার কর। কারণ আমি যেমন সত্যি-সত্যিই জেমস ভেন, তেমনি সত্যি-সত্যিই তোমাকে মরতে হবে।
কয়েকটি ভয়াবহ মুহূর্ত। কী করা উচিত বা কী বলা উচিত কিছুই ভেবে পেলেন না ডোরিয়েন।
গর্জন করে উঠল লোকটি। হাঁটু মুড়ে বসা প্রার্থনা করার জন্যে এক মিনিট সময় তোমাকে আমি দিচ্ছি। তার বেশি নয়।
ডোরিয়েনের হাত দুটি নেতিয়ে পড়ল। ভয়ে হিম হয়ে গেল তাঁর দেহ। কিকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন তিনি। হঠাৎ তাঁর মগজে একটা আশার বিজলি খেলে গেল।
তিনি চিৎকার করে বললেন: থাম। কত বছর আগে আমার বোন মারা গিয়েছে। তাড়াতাড়ি বল।
লোকটি বলল: আজ থেকে আঠারো বছর আগে। একথা জিজ্ঞাসা করছ কেন? বয়সে কী আসে যায়?
বিজয়ীর মতো ডোরিয়েন হেসে বললেন: আঠারো বছর! আঠারো বছর! আলোর নীচে চল; আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখা।
কথাটা বুঝতে না পেরে জেমস ভেন একটু ইতস্তত করল। তারপরে তাঁকে টানতে-টানতে সেই গলির বাইরে নিয়ে এল।
বাতাসে আলোর শিখাগুলি কাঁপছিল সত্যি কথা, তবু সেই আলোতেই নিজের বিষম ভুলটা সে বুঝতে পারল। কারণ যে লোকটিকে সে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল সে যুবক, তার মুখের ওপরে নিষ্পাপ শিশুর অকলঙ্কিত পবিত্রতা। দেখলে মনে হবে তার বয়স বছর কুড়ির বেশি। নয়; যদি একটু বেশিই হয় তাহলে, অতগুলি বছর আগে ছাড়াছাড়ি হওয়ার সময় তার দিদির বয়স যা ছিল তার চেয়ে হয়তো সামান্য একটু বেশি। এটা স্পষ্ট বোঝা যায়, যে মানুষটি তার দিদির মৃত্যুর জন্যে দায়ী এ সে-মানুষ নয়।
হাত ছেড়ে দিয়ে সে পিছু হটে বলল, হায় ভগবান, হায় ভগবান; আর একটু হলে আমি তোমাকে খুন করে ফেলতাম।
দীর্ঘ একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন ডোরিয়েন। তার দিকে তাকিয়ে বেশ রূঢ়ভাবেই তিনি। বললেন, আর একটু হলে তুমি প্রায় নরহত্যা করে ফেলতে হে! এ থেকে একটা শিক্ষা তোমার হোক। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার ইচ্ছেটা কখনো নিজের হাতে রেখ না।
জেমস ভেন বিড়বিড় করে বলল, আমাকে ক্ষমা করুন স্যার। আমি প্রতারিত হয়েছি। ওই নোংরা বস্তিতে হঠাৎ একটা নাম শুনে আমি ভুল করে ফেলেছি।
পেছন ফিরে এগোতে এগোতে ডোরিয়েন বললেন, বরং বাড়ি যাও। পিস্তুলটাকে সরিয়ে রাখা না হলে, বিপদে পড়তে পার।
ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জেমস ভেন রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়ে রইল। পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঠকঠক করতে লাগল তারা একটা কালো ছায়া ভিজে দেওয়ালের পাশ দিয়ে খুঁড়ি দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে আসছিল এতক্ষণ। একটু পরেই সেই ছায়া আলোর সামনে বেরিয়ে এল তারপরে নিঃশব্দে সেটি কাছে এসে দাঁড়াল তার। একটি হাত তার হাতের ওপরে এসে পড়তেই চমকে উঠে সে পিছনে ফিরে তাকালা বার-এ যে সব মেয়েরা মদ খালি এটি সেই দলেরই।
তার সেই কদাকার মুখটা তার মুখের কাছে ধরে মেয়েটা ফিসফিস করে বলল, শয়তানটাকে তুমি খুন করলে না কেন? ড্যানির কাছে থেকে তুমি যখন ছুটে বেরিয়ে এলে তখনই আমি। জানতাম তুমি ওর পেছনে ছুটেছো। ওকে তোমার খুন করা উচিত ছিল। লোকটার অনেক টাকা রয়েছে, ব্যাটা একেবারে শয়তানের শিরোমণি।
জেমস বলল, আমি যাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি এ সে-লোক নয়। আমি কারো টাকা চাই না। আমি একটি মানুষের জীবন চাই। যে-লোকটিকে আমি খুন করতে চাই তার বয়স এখন চল্লিশের কাছাকাছি হবে। এই লোকটির শিশুর চেয়ে বড়ো। ওর রক্ত যে আমার হাতে লাগেনি তার উল্যে ভগবানকে ধন্যবাদ।
মেয়েটা চিবিয়ে চিবিয়ে হেসে উঠল, শিশুর চেয়ে কিছু বড়ো! তাই বটে! কী বলছ তুমি! আমার যে অবস্থা দেখছ তার জন্যে দায়ী ওই প্রিন্স চার্মিং! আঠারো বছর আগে ওই লোকটা আমাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
জেমস ভেন চিৎকার করে উঠল, মিথ্যে কথা বলছ তুমি।
আবেদন করার ভঙ্গিতে আকাশে হাত দুটি তুলে মেয়েটি বলল, ভগবানের দিব্যি, আমি সত্যি কথা বলছি।
ভগবানের দিব্যি!
আমার কথা যদি সত্যি না হয় তাহলে আমি যেন বোবা হয়ে যাই। এখানে যারা আসে ও হচ্ছে তাদের মধ্যে নিকৃষ্ট। লোকে বলে সুন্দর মুখের জন্যে মানুষটা শয়তানের কাছে নিজেকে। বিক্রি করে দিয়েছে। প্রায় আঠারো বছর আগে ওর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হ্য। সেই থেকে ওর চেহারার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। যদিও আমার হয়েছে অনেক।
তুমি দিব্যি করে বলছ?
তার সেই চওড়া থ্যাবড়ানো মুখের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটা প্রতিধ্বনি; আমি দিব্যি করছি। আমি ওকে বড়ো ভয় করি। আজকের জন্যে আমাকে কিছু টাকা দাও।
একটা কুৎসিত কথা বলে সে ঘুরে দাঁড়াল, দৌড়ে বেরিয়ে গেল রাস্তায়। কিন্তু ততক্ষণে ডোরিয়েন গ্রে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছেন। পিছু ফিরে তাকাল জেমস। মেয়েটিও তখন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।
.
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
সপ্তাহখানেক পরের কথা। সেলবি রয়্যাল-এর বাড়িতে এসে ডোরিয়েন গ্রে মনমাউথ-এর সুন্দরী স্ত্রী ডাচেস-এর সঙ্গে গল্প করছিলাম। পাশে ছিলেন তাঁর স্বামী লর্ড মনমাউথ, বয়স ষাটের কাছাকাছি, মনে হচ্ছে পরিশ্রান্ত। সময়টা চা খাওয়ার টেবিলের ওপরে ঢাকনি দেওয়া বিরাট বাতিদান থেকে একটা মিষ্টি আলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই সান্ধ্য মজলিসে সভানেত্রীর আসন গ্রহণ করেছিলেন ডাচেস স্বয়ং। তাঁর সাদা হাত দুটি লঘুভাবে কাপের। ওপরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ডোরিয়েন গ্রে ফিসফিস করে তাঁকে যা বলছিলেন তাই শুনে তাঁর ঠোঁট দুটি ভরে উঠেছিল হাসিতো তাঁদের দিকে তাকিয়ে লর্ড হেনরি একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিলেন। পিচ রঙের একটি সোফার ওপরে বসেছিলেন লেডি নরবোরো; ব্রেডিল থেকে যে শেষ পোকাটা ডিউক সংগ্রহ করে এনেছিলেন তাঁরই মুখ থেকে সেই কাহিনীটি শোনার ভান করছিলেন তিনি। তিনটি যুদক ধোপদুরস্থ পোশাক পরে মহিলাদের চা পরিবেশন করছিল। মজলিসে উপস্থিত ছিলেন বারোজন। পরের দিন আরো কিছু অতিথিদের আসার কথা। টেবিলের কাছে হেলতে-দুলতে এগিয়ে গিয়ে এবং কাপটি নামিয়ে রেখে লর্ড হেনরি জিজ্ঞাসা করলেন, কী গল্প হচ্ছে তোমাদের? আশা করি আমি যে সকলের নতুন করে নামকরণের পরিকল্পনা করেছি তা বোধ হয় তুমি শুনেছ, গ্ল্যাডিস? পরিকল্পনাটা বড়ো সুন্দর।
অপরূপ সুন্দর দুটি চোখ তাঁর দিকে তুলে ডাচেস বললেন, আবার আমার নতুন নামকরণ করতে আমি রাভিদ লুই, হেনরি, আমার নিজের যা নাম তাতেই আমি খুশি] এবং মিঃ গ্রে-ও যে তাঁর নামে খুশি সে-বিষয়েও আমি নিশ্চিত।
ডোরিয়েন গ্রে বললেন, প্রিয় গ্ল্যাডিস, পৃথিবীতে এমন কিছু জিনিস নেই যার লোভে আমি দুটি নামের একটিও পরিবর্তন করতে রাজি হব। দুটিই নিখুঁত। বিশেষ করে আমি ফুলের কথা চিন্তা করছিলাম। গতকাল বাটনহোল-এ গোঁজার জন্যে আমি একটা অর্কিড ফুল কেটেছিলাম। ফুলটা কী সুন্দর; সাতটা ভয়ঙ্কর সাপের মতো গোটা গায়ে তার সুন্দর-সুন্দর ফুটকি কোনো কিছু না ভেবেই মালিকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ফুলের নামটা কী। সে। আমাকে বলল রবিন সোনিয়ানা বা ওই জাতীয় কোনো ভয়ঙ্কর জিনিস সেটি। কথাটা সত্যি; কিন্তু নামটা শুনে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু সুন্দর জিনিসের সুন্দর নাম দেওয়ার শক্তি আমরা হারিয়ে ফেলেছি। নামই তো সব, কাজ নিয়ে আমি কোনোদিন কলহ করি না। আমার একমাত্র বিবাদ শব্দের সঙ্গে। সেই জন্যে সাহিত্যে অশ্লীল নগ্নতাকে আমি ঘৃণা করি। যে লোক কোনো জিনিসকে তার আসল নামে চিহ্নিত করে সে কোদালকে কোদাল বলেই ডাকে। এ ছাড়া অন্য কোনো গুণ তার নেই।
ডাচেস জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে, তোমাকে কী নামে ডাকব, হ্যারি?
ডোরিয়েন বললেন, ওর নাম প্রিন্স প্যারাজক্স।
ডাচেস বললেন, আমি তো ওকে এক নজরে চিনে ফেলতে পারি।
একটা চেয়ারে ওপরে গাটা এলিয়ে দিয়ে লর্ড হেনরি বললেন, থাক, থাক, আর আমি শুনতে চাই না। দুর্নাম থেকে মুক্তি নেই মানুষের। আমি এ উচ্ছ্বাস পছন্দ করি না।
সুন্দরী ঠোঁট থেকে সাবধান বাণী একটা উচ্চারিত হল: রাজতন্ত্র সিংহাসনচ্যুত না হতে পারে,…
তুমি চাও আমি আমার সিংহাসন রক্ষা করি?
হ্যাঁ।
আগামীকাল যেটা সত্য হয়ে দাঁড়াবে আজকে আমি সেই কথাই বলি।
ডাচেস বললেন, আজকের ভুলগুলিকেই আমি পছন্দ করি বেশি।
তুমি আমাকে অস্ত্রহীন করে ফেলছ গ্ল্যাডিস।
তোমার বর্মটা সরিয়ে দিচ্ছি, বর্শটা নয়।
হাতটা আমনের দিকে ঘুরিয়ে তিনি বলবেন, সৌন্দর্যের ধাক্কায় মুখ থুবড়ে পড়ি না আমি।
বিশ্বাস কর হেনরি, ওটাই তোমার ভুল। সৌন্দর্যের দাম তোমার কাছে খুব বেশি।
একথা তুমি বলছ কী করে? স্বীকার করছি আমার কাছে ভালো হওয়ার চেয়ে সুন্দর হওয়া অনেক বালো। কিন্তু তবু সবার আগে এটাও আমি স্বীকার করি যে কুৎসিত হওয়ার চেয়ে ভালো হওয়া অনেক ভালো।
ডাচেস বললেন, তাহলে কি তুমি বলতে চাও যে সাতটি ভয়ঙ্কর পাপের মধ্যে কুৎসিত জিনিস একটি মারাত্নক পাপ? অর্কিডের সম্বন্ধে তোমার উপমাটা কী?
যাকে তোমরা কুৎসিত বলছ সেটা হচ্ছে সাতটি মারাম্লক গুণের একটি, গ্ল্যাডিস, সাঁচ্চা টোরি হিসাবে ওদের তুমি হেলাফেলা করতে পার না। বিষয়, বাইবেল আর ওই সাতটি মারাত্মক গুণই আমাদের ইংলন্ডকে বর্তমান অবস্থায় নিয়ে এসেছে।
ডাচেস জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি তাহলে তোমার দেশকে পছন্দ কর না?
আমি এই দেশেই বেঁচে রয়েছি।
এই জন্যে যে এর অপগুণ তুমি ভালো করে প্রচার করতে পার?
তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এ সম্বন্ধে ইউরোপ কী বলে তাই কি তুমি শুনতে চাও?
কী বলে তারা?
টার্টুফি ইংলন্ডে এসে দোকান খুলে বসেছে।
এটা কি তোমারই কথা, হ্যারি?
আমি এটা তোমাকেই দিলাম।
আমি তা কাজে লাগাতে পারতাম না। জিনিসটা ভয়ঙ্কর রকমের সত্যি।
ভয় নেই তোমার। আমাদের দেশের লোক কোনো বর্ণনাকেই স্বীকার করে না।
তারা বাস্তবধর্মী।
তারা যতটা বাস্তকবধর্মী তার চেয়ে অনের বেশি চতুর। হিসাবের খাতা লিখতে বসে তারা মূর্খতার জের টানে অর্থের প্রাচুর্য দিয়ে, আর পাপের জের টানে শঠতা দিয়ে।
তবু, আমাদের অনেক বড়ো জিনিস রয়েছে।
বড়ো জিনিস আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, গ্ল্যাডিস।
সে-বোঝা আমরা বয়ে এনেছি।
সেকথা সত্যি, তবে আমাদের দৌড় ওই স্টক এক্সচেঞ্জ পর্যন্ত।
ঘাড় নাড়লেন ডাচেস, বললেন, ইংরেজ জাতের ওপরে আমার আস্থা রয়েছে।
ইংরেজ জাতটা বেঁচে রয়েছে কেবল অপরকে ল্যাঙ মারার চেষ্টায়।
উন্নতির পথে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
ধ্বংসই আমাকে আকর্ষণ করে বেশি।
কিন্তু আর্ট?
ওটা একটা রোগ।
প্রেম?
ওটা ভাঁওতা ছাড়া আর কিছু নয়।
ধর্ম?
ওটা হচ্ছে বিশ্বাসের একটা শৌখিন প্রতীক।
তুমি একটি নাস্তিক।
কভি নেহি। নাস্তিকবাদ দিয়েই বিশ্বাসের শুরু।
তোমার কাজটা কী বল তো?
ব্যাখ্যা করার অর্থই হচ্ছে সীমাবদ্ধ করা।
আমাকে একটা ধরতি দাও।
দড়ি ছিঁড়ে যায়। অনন্তু গহ্বরে তুমি পথ হারিয়ে ফেলবে।
তুমি আমাকে বিভ্রান্ত করে তুলেছ। অন্য আলোচনা করা যাক এস।
যাঁর বাড়িতে আমরা আজ অতিথি হয়ে এসেছি তাঁকে নিয়ে আলোচনা করলে আনন্দ পাবে। অনেকদিন আগেই তাঁর নতুন নামকরণ হয়েছে। সেই নামটা হচ্ছে প্রিন্স চার্মিং।
ডোরিয়েন গ্রে বললেন, ওকথাটা আর আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ো না।
একটু লাল হয়ে ডাচেস বললেন, মিঃ গ্রেকে আজ একটু যেন কেমন-কেমন দেখাচ্ছে। আমার বিশ্বাস ও মনে করে নিছক বৈজ্ঞানিক স্পৃহা চরিতার্থ করার জন্যে মনমাউথ আমাকে বিয়ে করেছে। ওর ধারণা আমাকে বিয়ে করে মনমাউথ আধুনিক প্রজাপতির শ্রেষ্ঠ একটি নিদর্শন সংগ্রহ করেছে।
ডোরিয়েন হেসে বলেলন, আশা করি মনমাউথ তোমার বুকে পিন ফুটিয়ে দেবেন না ডাচেস।
সে-কথা যদি বল তাহলে আমার চাকরানিই চটে গেলে আমার বুকে পিন ফুটিয়ে দেয় মিঃ গ্রে।
কিন্তু তোমার ওপরে বিরক্ত হওয়ার তার কারণটা কী ডাচেস?
আমি তোমাকে নিশ্চয় করে বলতে পারি মি: গে, একেবারে বাড়ে কারণ সাধারণত আমি নটা বাড়তে দশ মিনিটে বাড়িতে ঢুকে তাকে বলি আমাকে সাড়ে আটটার মধ্যে সাজিযে দাও। এই আমার অপরাধ।
সত্যিই কী অন্যায়। তোমার তাকে সতর্ক করে দেওয়া উচিত।
সাহস পাই নে, মিঃ গ্রে। কী করে পাব বলুন? সে আমার জন্যে নতুন রকমের টুপি তৈরি করে। লেডি হিলটনের গার্ডেন পার্টিতে আমি যেটা পরেছিলাম সেই টুপিটার কথা তোমার মনে রয়েছে? মনে নেই, কিন্তু মনে থাকার ভান যে করছ তাই যথেষ্ট। সেই টুপিটা সে তৈরি করেছিল তেমন কিছু মালমশলা না দিয়েই। সব ভালো টুপিই এইভাবে তৈরি হয়।
লর্ড হেনরি মাঝপথে বলে উঠলেন, হ্যাঁ, গ্ল্যাডিস, ঠিক যশের মতো। প্রতিটি যশ অর্জন করার সঙ্গে-সদে মানুষ একটি করে শত্রু তৈরি করে। জনপ্রিয় হতে গেলে মানুষকে চরিত্র আর দক্ষতার দিক থেকে মাঝামাঝি ধরনের হতে হবে।
মাথা নেড়ে ডাচেস বললেন, উঁহু। ও কথা মহিলাদের সম্বন্ধে খাটে না; আর বিশ্ব শাসন করে এই মহিলারাই। কে যেন বলেছে, আমরা মহিলারা কান দিয়ে ভালোবাসি যেমন পুরুষরা। ভালোবাসে চোখ দিয়ে, যদি অবশ্য সত্যিকার ভালোবাসার মত পুরুষদের থাকে।
ডোরিয়েন বিড়বিড় করে বললেন, আমার তো মনে হয় এক ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই আমরা করিনে।
দুঃখের ভান করে ডাচেস বললেন, তাহলে মিঃ গ্রে, তুমি সত্যি-সত্যিই ভালোবাস।
লর্ড হেনির বললেন, প্রিয় গ্ল্যাডিস, একথা তুমি বললে কেমন করে? পুনরাবৃত্তির ওপরেই প্রতিটিবার মানুষ যখন প্রেমে পড়ে একমাত্র তখনই সে সত্যিকার ভালোবাসে। বস্তুর পার্থক্য। আকাণ্ডহষ্কার অকাগ্রতাকে পরিবর্তন করতে পারে না; বরং বাড়িয়ে তোলে। জীবনে আমরা একবারই মহৎ অভিজ্ঞতা লাভ করি আর জীবনের রহস্য হচ্ছে যতবার সম্ভব সেই অভিজ্ঞতাকে বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা।
একটু চুপ করে থেকে ডাচেস প্রশ্ন করলেন, মানুষ আহত হলেও, হ্যারি?
লর্ড হেনরি উত্তর দিলেন, আলবৎ।
মুখ ঘুরিয়ে চোখের ওপরে একটা অদ্ভুত দৃষ্টি ফুটিয়ে ডাচেস ডোরিয়েন গ্রের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
মিঃ গ্রে, তুমি কী বল?
একটু দ্বিধা করলেন ডোরিয়েন; তারপরে মাথাটা পেছনে সরিয়ে হেসে বললেন, হ্যারির সঙ্গে আমি সব সময়েই একমত, ডাচেস।
যখন সে অন্যায় কথা বলে তখনো?
হ্যারি কখনো অন্যায় কথা বলে না, ডাচেসা।
ওর দর্শন কি তোমার ভালো লাগে?
সেকথা কোনোদিনই আমি ভাবিনে। কে সুখ চায়? আমি খুঁজে বেড়িয়েছি আনন্দ।
এবং তা তুমি পেয়েছ?
হ্যাঁ; নিশ্চয়।
একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল ডাচেস-এর বললেন, আমি শান্তি খুঁজেছি। আমি যদি এখনই গিয়ে পোশাক পরিবর্তন না করি তাহলে আজ সন্ধ্যায় আমাকে শান্তি পাওয়ার আশা ছেড়ে দিতে হবে।
দাঁড়িয়ে উঠে ডোরিয়েন বললেন, তোমাকে কয়েকটা অর্কিড এনে দিই, ডাচেস।
লর্ড হেনরি তাঁর আত্মীয়াকে বললেন, তোমার চালচলনটা বেশ জুৎসই হচ্ছে না। খুব সাবধান। ওকে দেখে মেয়েরা মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আকর্ষণ করার শক্তি ওর অসীম।
সে-ক্ষমতা ওর না থাকলে, কোনো লড়াই হত না।
তাহলে বলতে চাও সেয়ানে-সেখানে কোলাকুলি চলছে তোমাদের?
আমি ট্রোজানদের দলে। একটি মহিলার জন্যে তারা লড়াই করেছিল।
পরাজিত হয়েছিল তারা।
ডাচেস বলেলন, বন্দিনী হওয়ার চেয়ে খারাপ জিনিস রয়েছে।
তুমি বলগা ছেড়ে দিয়ে লাফাচ্ছে।
দ্রুতগতিই তো বেঁচে থাকারই অঙ্গ।
আমার ডায়েরিতে আজ রাত্রিতে কথাটা আমি লিখে রাখব।
কোন কথাটা?
যে আগুনে পোড়া শিশু আগুনকে ভালোবাসে।
পোড়া দূরের কথা, আমার গায়ে আঁচও লাগেনি। আমার পাখা পোড়েনি।
এক উড়ে যাওয়া ছাড়া, ওই পাখা দিয়ে তুমি সব কাজই কর।
সাহস আজকাল পুরুষদের কাছ থেকে মেয়েদের কাছে এসে পড়েছে। এটা আমাদের কাছে একটা নতুন অভিজ্ঞতা।
তোমার একটি প্রতিদ্বন্দিনী রয়েছেন।
কে?
তিনি হেসে বললেন, লেডি নরবোরো। ভদ্রমহিলা ওকে একেবারে পুজো করো।
তুমি আমাকে ভয় পাইয়ে দিল। আমাদের মতো যারা রোমান্টিক তাদের কাছে প্রাচীনত্ব ভয়ানক রকমের বিপজ্জনক।
তুমি নিজেকে রোমান্টিক বলছ! তোমার সব কটি ছলাকলাই তো দেখছি বৈজ্ঞানিক।
পুরুষরাই আমাদের সব কিছু শিখিয়েছে।
কিন্তু তোমাদের আত্মাকে উদ্ঘাটিত করেনি।
জাতি হিসাবে আমাদের নারীদের ব্যাখ্যা কী?
তোমরা হচ্ছ স্ফিংকস-এর জাতি; তফাৎ এইটুকু যে গোপন রহস্য বলতে তোমাদের কিছু নেই।
তাঁর দিকে তাকিয়ে ডাচেস একটু হেসে বললেন, মিঃ গ্রের এত দেরি হচ্ছে কেন? চল, তাঁকে সাহায্য করিগে। আমার ফ্রকের রঙটা এখনো তাঁকে বলা হয়নি।
তার ফুলের রঙের সঙ্গে তোমার ফ্রকের রঙটা মিলাতেই হবে তোমাকে, গ্ল্যাডিস।এর অর্থই হচ্ছে বেশি তাড়াতাড়ি নিজেক সমর্পণ করা।
রোমান্টিক আর্টের শুরুই হচ্ছে শেষ থেকে।
কিন্তু বেরিয়ে আসার পথএকটা খোলা রাখতে হবে তো।
পার্থিয়ানদের মতো?
তারা তো মরুভূমির মধ্যে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিল। আমার পক্ষে তা সম্ভব হবে না।
লর্ড হেনরি কথা শেষ করার আগেই ফুলগাছগুলি যে ঘরে থাকে সেই দিক থেকে একটা চাপা আর্তনাদ শোনা গেল। একটা ভারী জিনিস মাটিতে পড়ে যাওয়ারও শব্দ এল কানে। সবাই চমকে ছুটে গেল সেইদিকে। ভয়ে চলচ্ছক্তিহীনা হয়ে গেলেন ডাচেস। ভয়ে বিহ্বল হয়ে উঠলেন লর্ড হেনরি। পাম গাছের পাতার ভেতর দিয়ে দৌড়ে গিয়ে দেখলেন ডোরিয়েন গ্রে মেঝের ওপরে মুখ থুবড়ে পড়ে মূৰ্ছা গিয়েছেন।
তাঁকে তক্ষুনি বসার ঘরে তুলে নিয়ে আসা হল; শুইয়ে দেওয়া হল সোফার ওপরে। সামান্য কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর জ্ঞান ফিরে এল। বিভ্রান্তের মতো চারপাশে তাকাতে লাগলেন তিনি।
জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে বল তো? হ্যাঁ, হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি। হ্যারি, এখানে কি আমি নিরাপদ?
এইটুকু বলেই তিনি কাঁপতে লাগলেন।
লর্ড হেনরি বললেন, প্রিয় ডোরিয়েন, তুমি মূৰ্ছা গিয়েছিলে মাত্র। এ ছাড়া আর কিছু তোমার হয়নি। নিশ্চয় তুমি খুব বেশি পরিশ্রম করছ। ডিনারের তোমার না যাওয়াই ভালো।
দাঁড়ানোর চেষ্টা করে ডোরিয়েন বললেন, না, না; আমি যাব। আমার নীচে যাওয়াই ভালো। আমি একলা থাকব না।
ঘরে গিয়ে তিনি পোশাক পরিবর্তন করলেন। খেতে বসে খুশির অকারণ উচ্ছ্বাসে মেতে উঠলেন। কিন্তু মাঝে-মাঝে ভয়ে তিনি শিউরে উঠতে লাগলেন। তাঁর মনে হল ফুল গাছ রাখার ঘরের দেওয়ালের গায়ে সাদা রুমালের মতো, জেমস ভেন-এর মুখ তিনি দেখেছেন। জেমস যেন তাঁর গতিবিধি লক্ষ করছে।
.
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
পরের দিন তিনি আর ঘর ছেড়ে বেরোলেন না। সত্যি কথা বলতে কি যদিও জীবনের বিষয়ে তিনি উদাসীন ছিলেন, তবু আসন্ন মৃত্যুর ভয়ে আচ্ছন্ন হয়ে বেশির ভাগ সময়টাই তিনি ঘরের মধ্যে কাটালেন। কেউ যে তাঁর পিছু নিয়েছে, তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছে–এই রকম একটা ধারণা তাঁকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলল। বাতাসে কিছু নড়াচড়ার শব্দ হলেই তিনি কেঁপে উঠতেন। জানালার শার্সিত মরা পাতার ঝাপটা শুনে তাঁর মনে হত সেগুলি বুঝি বা তাঁরই ব্যর্থ প্রতিজ্ঞা আর অর্থহীন অনুশোচনা ছাড়া আর কিছু নয়। চোখ দুটো বুজলেই তিনি দেখতে পেতেন একটি নাবিকের তীক্ষ্ণ দুটো চোখ তাঁর সমস্ত গতিবিধি লক্ষ করছে। তখনই ভয়ে তাঁর অন্তরাত্মা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেত।
কিন্তু সম্ভবত সত্যিই কেউ তাঁর পেছনে ঘোরেনি। সেদিন রাত্রিতে যে দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল, যে শান্তি তাঁকে নিতে হচ্ছিল এটা হয়তো তারই একটা প্রতিচ্ছবি। বাস্তব উদীবনটাই হচ্ছে কেমন যেন গণ্ডগোলে। কিন্তু আমাদের কল্পনার মধ্যে একটা সুশঙুল নীতি রয়েছে। এই কল্পনাই পাপের অনুশোচনায় আমাদের পরিচালিত করে এই কল্পনার ভেতরে প্রতিটি পাপ প্রতিফলিত করে নিজেকে। বাস্তব জগতে পাপীরা শাস্তি পায় না, পুরস্কৃত না সাধুরা। সবলরা সাফল্য অর্জন করে, অসাফল্যের সমস্ত কালিমা চাপানো হয় দুর্বলের মাথায়। এ ছাড়া আর কিছু নয়। তাছাড়া যদি কোনো অপরিচিত মানুষ তাঁর বাড়ির আশেপাশে ঘুরে বেড়াত তাহলে নিশ্চয় চাকর-বাকরদের কেউ তাকে দেখতে পেত। কারো পায়ের মাপ যদি বাগানে। পড়ত তাহলে মালিই ব্যাপারটা কালে তুলত তাঁর। হ্যাঁ; ওটা তাঁর কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। তাঁকে হত্যা করার জন্যে সাইবিল ভেন-এর তাঁর পেছনে ঘুরে বেড়াচ্ছে না। সে নিশ্চয় সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছে এতক্ষণে। যেমন করেই হোক, তার হাত থেকে তিনি রেহাই পেয়েছেন। তাছাড়া তিনি কে সেকথা জানতও না, জানার কোনো উপায়ও তার ছিল না। যৌবনের মুখোশ তাঁকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু তবু ব্যাপারটা যদি নিছক দৃষ্টিভ্রমই হত তাহলে তাঁর বিবেক কি অত ভয়ঙ্কর ছায়ামূর্তির কল্পনা করতে পারত! ভাবতেও গা কেমন ছমছম করে। এইভাবে দিনের পর দিন। যদি প্রতিটি অলিগলি থেকে, পথে-প্রান্তর থেকে তাঁর খাওয়ার টেবিলের পাশ থেকে আতঙ্ক স্থির চক্ষু দুটি মেলে তাঁর দিকে তাকিয়ে থআকে, তাঁর সাধারণ গতিকে বিভ্রান্ত করে তোলে তাহলে শেষ পর্যন্ত তাঁর জীবনের পরিণতি কী দাঁড়াবে? এই চিন্তাটা তাঁর মাথার মধ্যে ঢোকার সঙ্গে-সঙ্গে তিনি ভয়ে হিম হয়ে যান; বাতাস হঠাৎ হিমেল হয়ে যায়। হায়রে, উত্তেজনার কী এক উন্মাদ মুহূর্তে তিনি তাঁর বন্ধুকে হত্যা করেছিলেন? সেই হত্যার দৃশ্যটা কী মর্মান্তিক! সবই যেন তিনি আবার দেখতে পেলেন। সে রাত্রির প্রতিটি ঘটনার ভয়ঙ্কর খুটিনাটিগুলি তাঁর। ভীতি আরো বাড়িয়ে দিল। কালের কালো গুহা থেকে তাঁর পাপ রূপায়িত হয়ে তাঁর চোখের সামনে দাঁড়াল। সন্ধে ছটার সময় লর্ড হেনরি যখন তাঁর বাসায় এসে পৌঁছলেন তখন তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েছেন।
পর-পর তিন দিন ঠিক এইভাবেই কাটালেন তিনি। তারপর ঘর থেকে বেরোলেন। সেই পরিচ্ছন্ন পাইন গাছের গন্ধে ভরা শীতের সকাল তাঁর মন আনন্দে ভরিয়ে তুলল, বাঁচার নতুন স্বাদ পেলেন তিনি। কিন্তু এই পরিবর্তনের কারণ নিছক প্রাকৃতিক পরিবেশই নয় যে দুঃখবোধ তাঁর বাঁচার পথে বাধার সৃষ্টি করেছিল, ভারাক্রান্ত করে তুলেছিল তাঁর মনকে, তারই বিরুদ্ধে তাঁর চরিত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। যাঁদের মন সুচারু শিল্পের রেশমে গড়া তাঁদের এই রকমই হয়। তাঁদের তীক্ষ্ণ উচ্ছ্বাস হয় আহত হয়, না হয় আত্মসমর্পণ করে। তারা হয় অপরকে হত্যা করে, না হয় তো হত্যা করে নিজেদের। মহৎ প্রেম অথবা মহৎ দুঃখ এইভাবে নিজেদের প্রাচুর্যের উচ্ছ্বাসেই বিনষ্ট হয়। ছোটো দুঃখ অথবা অগভীর প্রেমই বেঁচে থাকে। তাছাড়া, তিনি যে একটা অমূলক বিভ্রান্তির শিকার হয়ে পড়েছিলেন সে-বিষয়ে তাঁর কোনো সন্দেহ ছিল না। তাঁর ভীতিকে তাই তিনি কৃপার দৃষ্টিতে না দেখে পারলেন না; কেবল কৃপা নয়, ঘৃণার দৃষ্টিতেও।
প্রাতরাশ শেষ করে ঘন্টাখানেক তিনি ডাচেস-এর সঙ্গে বাগানে বেড়ালেন; তারপরে গাড়িতে চেপে পার্ক পেরিয়ে তিনি শিকার পার্টিতে যোগ দিলেন। পাইন বলের একধারে দেখা হল ডাচেস-এর ভাই স্যার জিয়োফ্রি ক্লাউসটন-এর সঙ্গে। ভদ্রলোক তখন বন্দুকের ভেতর থেকে দুটো টোটা বার করছিলেন। ডোরিয়েন গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে এলেন; তারপরে সহিসের হাতে ঘোড়াটাকে ছেড়ে দিয়ে তিনি শুকনো গাছের ডালের ভেতর দিয়ে সেই দিকে এগোতে লাগলেন।
জিজ্ঞাসা করলেন, জিয়োফ্রি, ভালো শিকার মিলেছে?
না; তেমন আর মিলল কোথায়, ডোরিয়েন? আমার ধারণা বেশির ভাগ পাখিই বাইরে বেরিয়ে গিয়েছে। আশা করি লাঞ্চের পরে আমরা যেখানে যাব সেখানে নিশ্চয় অনেক ভালো। শিকার পাব।
হঠাৎ তাঁর কাছ থেকে কুড়ি গজের মতো দূরে একটা পুরনো ঘাসের ঝোপ থেকে কালো ডোরা কাটা একটা খরগোশ কান উঁচু করে সামনে বেরিয়ে এল। সে পাশের একটা ঝোপের দিকে দৌড়ে যেতেই স্যার জিয়োফ্রি কাঁধের ওপরে বন্দুকটা বাগিয়ে ধরলেন কিন্তু খরগোশটার চেহারার মধ্যে এমন একটি সৌন্দর্য দেখা গেল যে ডোরিয়েন মুগ্ধ না হয়ে পারলেন না; তিনি চেঁচিয়ে বললেন, ওকে মেরো না, জিয়োফ্রি। ওটা বাঁচুক।
তাঁর সঙ্গীটি হেসে বললেন, দুত্তোর! কী আজেবাজে বকছ?
খরগোশটা পাশের ঝোপের মধ্যে লাফিয়ে পড়ার আগেই স্যার জিয়োফ্রি ঘোড়াটা টিপে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে দুটো আর্তনাদ শোনা গেল;খরগোশের মৃত্যুযন্ত্রণার কাতরানি, আর তার চেয়েও ভয়াবহ একটি মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের আর্তনাদ।
স্যার জিয়োফ্রি চিৎকার করে উঠলেন, হায় ভগবান, যারা ভালোযার তাড়াচ্ছিল তাদেরই। একজনের গায়ে গুলি লেগেছে। লোকটা কী গাধা বল তো! বন্দুকের নলের মুখোমুখি কখনো কেউ দাঁড়ায়?
তারপরে তিনি চেঁচিয়ে সাবধান করে দিলেন, এই গুলি ছোঁড়া বন্ধ কর সব। একটা লোক আহত হয়েছে।
হাতে করে একটা ছড়ি নিয়ে প্রধান দারোয়ান ছুটে এল।
কোথায় স্যার? লোকটা কোথায়?
ঠিক সেই সময় চারপাশে বন্দুক ছোঁড়া বন্ধ হয়ে গেল।
ঝোপের দিকে দ্রুত এগিয়ে যেতে-যেতে স্যার জিয়োফ্রি রেগে বললেন, এদিকে।
লোকগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখ না কেন বলত? সারাটা দিন আমার নষ্ট করে দিলো
তারা দুজনে ডালপালা সরিয়ে ঝোপের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ডোরিয়েন তা দেখলেন। একটু পরে একটা লোককে তারা বাইরে টেনে আনল। ভয়ে তিনি মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। তাঁর মনে হল দুর্ভাগ্য তাঁর পিছু নিয়েছে। জিয়োফ্রি জিজ্ঞাসা করলেন লোকটা সত্যি সত্যিই মারা গিয়েছে কিনা দারোযাল বলল–হ্যাঁ। দুজনের কথাই কানে এল তাঁর মনে হল অরণ্য হঠাৎ জনাকীর্ণ হয়ে উঠেছে। চারপাশ থেকে লোক ছুটে আসছে। তাদের গলার অস্পষ্ট স্বর শোনা গেল।
কয়েকটি মুহ্নত একটা অনির্বচনীয় যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে কেটে গেল তাঁরা মনে হল সময় যেন আর কাটে না। তারপরেই কে যেন তাঁকে কাঁধের ওপরে হাত রাখল। চমকে উঠে ফিরে দাঁড়ালেন তিনি।
লর্ড হেনরি বললেন, ডোরিয়েন, আজকের মতো শিকার বন্ধ করতে আমি বরং ওদের বলে দিই। শিকার চালিয়ে যাওয়াটা ভালো দেখাবে না।
তিক্তভাবে তিনি বললেন, হ্যারি, আমার ইচ্ছে শিকার চিরদিনের মতো বন্ধ হয়ে যাক। সমস্ত জিনিসটাই হচ্ছে জঘন্য ভয়াবহ। লোকটা কি…
কথাটা শেষ করতে পারলেন না তিনি।
লর্ড হেনরি বললেন, আমার তাই ভয় হচ্ছে। গুলিটা তার বুকে লেগেছে। লোকটা সম্ভবত সঙ্গে-সঙ্গেই মারা গিয়েছে। এস আমরা বাড়ি যাই।
কোনোরকম কথা না বলে রাস্তা দিয়ে পাশাপাশি তাঁরা দুজনে প্রায় পঞ্চাশ গজ হেঁটে গেলেন। তারপরে লর্ড হেনরির দিকে তাকিয়ে ডোরিয়েন বললেন, ঘটনাটা অশুভ, হেনরি।
লর্ড হেনরি জিজ্ঞাসা করলেন, কোনটা ওঃ, এই দুর্ঘটনার কথা বলছ? বন্ধু, একে এড়ানো যেত না। দোষ ওই লোকটারই। বন্দুকের নাগালের মধ্যে ওর যাওয়ার দরকারটা কী ছিল? তাছাড়া, আমাদের কী? অবশ্য ডিমোক্রির ব্যাপারটা খারাপ লাগার কথা। শিকার যারা খেদাই করে। আনে তাদের হত্যা করার অর্থ নেই কিউ। লোকে ভাববে ডিযোফ্রি বন্দুক ছুঁড়তে জানে না। কিন্তু জিয়োফ্রি সে-জাতের মানুষ নয়। ও সোজাসুজি গুলি ছোঁড়ে মরুক গে, ওকথা নিয়ে আর আলোচনা করে লাভ নেই।
মাথা নাড়ালেন ডোরিয়েন, ঘটনাটা অশুভ হ্যারি-ও তুমি যাই বল? মনে হচ্ছে, আমাদের মধ্যে কারো বিপদ ঘনিয়ে আসছে।
যন্ত্রণায় মুখটা তাঁর বিকৃত হয়ে উঠল; চোখ দুটোর ওপরে হাত বুলিয়ে তিনি কথা শেষ করলেন তাঁর, হয়তো আমারই। বয়স্ক মানুষটি হাসলেন, ডোরিয়েন, পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র ভীতিপ্রদ জিনিস হচ্ছে ক্লান্তি। ওটা হচ্ছে এমন একটা পাপ যার কোনো ক্ষমা নেই। কিন্তু ও নিয়ে আমাদের কিছু ভাবতে হবে। না যদি ভদ্রলোকেরা ডিনারের সময় ওইটা নিয়ে কচকচি না করেন। আমি তাঁদের নিয়ে দেব যে আলোচনাটা নীতিগতভাবেই আমাদের বন্ধ করা উচিত। আর অশুভ ঘটনার কথা যদি বল তো সত্যিকার অশুভ বলে কোনো বস্তু নেই। আমাদের সতর্ক করে দেওয়ার জন্যে। দুর্ভাগ্য কোনো সংবাদ পাঠায় না। সেদিক থেকে ভদ্রমহিলা অনেক বেশি জ্ঞানী অথবা নিষ্ঠুর, তাছাড়া, তোমার সঙ্গে স্থান পরিবর্তন করতে পারলে যে কোনো মানুষই খুশি হবে।
হ্যারি পৃথিবীতে এমন কোনো মানুষ নেই যার সঙ্গে স্থান পরিবর্তন করতে আমি রাজি না। হব। আমার কথা শুনে অমন করে হেস না তুমি। তোমাকে আমি সত্যি কথাই বলছি। যে হতভাগ্য চাষিটা আজ মারা গেল তার অবস্থাও আমার চেয়ে ভালো। মৃত্যুকে আমার ভয় নেই মৃত্যুর বদধ্বনিই আমাকে সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। হাঘ ভগবান, তুমি কি লক্ করনি গাছের পেছনে একটা লোক আমাকে লক্ষ করছিল, অপেক্ষা করে বসেছিল আমার জন্যে?
যেদিকে তাঁর কম্পিত হাতটা বাড়ানো ছিল লর্ড হেনরি সেইদিকে তাকিয়ে দেখলেন। হেসে বললেন, হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি। মালি তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে। আমার ধারণা আজ রাত্রিতে টেবিলে কোন কোন ফুল রাখা হবে সেই কথাটাই সে জানতে চায়। তোমার ভয় দেখে। অবাক লাগছে আমার। শহরে ফিরে গিয়ে আমার ডাক্তারকে দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নিয়ো।
মালিকে তাঁদের দিকে আসতে দেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন ডোরিয়েন। লোকটি তার টুপিটা তুলে দ্বিধার সঙ্গে লর্ড হেনরির দিকে তাকিয়ে তার মনিবের হাতে একখানা চিঠি দিয়ে বলল: চিঠির উত্তর নিয়ে যাওয়ার জন্য মাদাম আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন।
চিঠিটা পকেটে ফেলে দিয়ে বেশ বিরক্তির সঙ্গে ডোরিয়েন বললেন, মাদামকে বলো আমি এখনই আসছি।
উত্তর পেয়ে লোকটি ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুতগতিতে বাড়ির পথে এগিয়ে গেল।
লর্ড হেনরি হেসে বললেন, বিপজ্জনক কাজ করতে মহিলারা কত ভালোবাসে। অনেক গুণের মধ্যে তাদের এই গুণটাকে আমি সবচেয়ে বেশি প্রশংসা করি। যতক্ষণ সবাই তাকিয়ে থাকে ততক্ষণই তারা পুরুষদের সঙ্গে খোলাখুলিভাবে প্রেমের অভিনয় করে।
হ্যারি, তুমি নিজেও বিপজ্জনক কথা বলতে কম ভালোবাস না। বর্তমান ক্ষেত্রে তুমি ভুল করেছ। ডাচেসকে আমার খুব ভালো লাগে সত্যি কথা; কিন্তু আমি তাকে ভালোবাসিনে।
এবং ডাচেস তোমাকে খুব ভালোবাসে কিন্তু পছন্দ করে কম। তোমাদের মিলটা হল তাই রাজযোটক।
তুমি কুৎসা রটনা করছ হ্যারি। কুৎসা রটনা করার মতো কোনো কাজ আমরা করিনি।
একটা সিগারেট ধরিয়ে হাসতে-হাসতে লর্ড হেনরি বললেন, প্রতিটি কুৎসার ভিত্তি হচ্ছে নীতিহীন নিচযতা।
কথা বলার মোহে সবাইকে তুমি জবাই করতে পার, হ্যারি।
উত্তর এল: কারো সাহায্যের প্রয়োজন নেই। জবাই হওয়ার জন্যে সবাই হাঁড়িকাঠের দিকে এগিয়ে চলেছে।
স্বরে গভীর দুঃখের একটা আমেজ মিশিয়ে ডোরিয়েন: আমি যদি ভালোবাসতে পারতাম। কিন্তু ভালোবাসার প্রবৃত্তি আমার নষ্ট হয়েছে, আকাঙ্খাও তেমন আর নেই। নিজেকে নিয়েই আমি বড়ো ব্যস্ত। আমার ব্যক্তিত্ব আমার নিজের ওপরেই একটা বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি মুক্তি চাই, পালিয়ে যেতে চাই, চাই ভুলতে। এখানে আসাটাই আমার বোকামি বয়েছে। মনে হচ্ছে হার্ভেকে জাহাজ ঠিক করার জন্যে এখনই এখটা টেলিগ্রাম করে দেব। জাহাড়ের ওপরে মানুষ নিরাপদ।
কার কাছ থেকে নিরাপদ, ডোরিয়েন? তুমি বিপদে পড়েছ। বিপদটা কী জাতীয় তা আমাকে তুমি বলছ না কেন? তুমি জান আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি।
বিষণ্ণভাবে তিনি বললেন, সেকথা তোমাকে আমি বলতে পারব না। আমার ধারণা ওটা। আমার একটা কল্পনা। এই অবাঞ্ছিত দুর্ঘটনাটা আমাকে বিভ্রান্ত করেছে। আমার ভয় লাগছে এই ধরনের কোনো একটা দুর্ঘটনা হয়তো আমারও ঘটবে।
পাগল কোথাকার!
তাই যেন হয়; কিন্তু দুশ্চিন্তা না করে আমি পারছিনে। ওই তো ডাচেস আসছে। দেখ, আমরা ফিরে এসেছি।
ডাচেস বললেন, মিঃ গ্রে, আমি সব শুনেছি। বেচারা জিয়োফ্রি খুব ঘাবড়ে গিয়েছে। শুনলাম খরগোশটাকে গুলি করতে তুমিই তাকে নিষেধ করছিলো কী কাণ্ড!
সেই রকমই বটে। কেন তাকে নিষেধ করতে গেলাম তা আমিই জানিনে। খরগোশ দেখতে বড়ো সুন্দর ছিল। কিন্তু লোকটার কথা তোমার কানে গিয়েছে শুনে আমি দুঃখিত। ঘটনাটা ভয়ালকা।
লর্ড হেনরি বললেন, বিরক্তিকর। এর মনস্তাত্ত্বিক কোনো মূল্য নেই। জিয়োফ্রি যদি ইচ্ছে করে এই কাজটা করত তা হলেও না হয় এর একটা সদর্থ খুঁজে পাওয়া যেত। কেউ সত্যি-সত্যি হত্যা করেছে এই রকম একটি লোকের সঙ্গে পরিচিত হলে খুশি হতাম।
ডাচেস চিৎকার করে উঠলেন, হ্যারি, কী ভয়ঙ্কর মানুষ তুমি! তাই না, মিঃ গ্রে? হ্যারি, মিঃ গ্রে আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মূৰ্ছা যাবেন বলে মনে হচ্ছে।
অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে ডোরিয়েন হেসে বললেন, ও কিছু নয়। আমার শরীরটা কেমন নড়বড়ে হয়ে উঠেছে। এছাড়া আর কিছু নয়। ভয় হচ্ছে আজ সকালে অনেকটা হেঁটেছি। হ্যারি কী বলল তা শুনিনি। খুব বাজে কথা বুঝি? যাই হোক, অন্য সময় বলো। এখন আমি বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়ি। তোমরা কিছু মনে করো না, কেমন?
এই বলে ডোরিয়েন ভেতরে ঢুকে গেলেন।
হেনরি ঘুরে দাঁড়িয়ে তন্দ্রালু চোখে ডাচেসের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি ওকে খুব ভালোবাস?
কিছুক্ষণ কোনো উত্তর দিলেন না ডাচেস; সামনের দিকে তাকিয়ে রইলেন; তারপরে বললেন, তাই যদি জানতাম।
মাথা নাড়লেন হেনরি বললেন, জানাটা মারাত্মক। অনিশ্চয়তাই মানুষকে মুগ্ধ করে। কুয়াশার অস্পষ্টতাই চমৎকার।
তাতে পথ হারানোর সম্ভাবনা বেশি।
প্রিয় গ্ল্যাডিস, সব পথেরই লক্ষ্য এক জায়গায়।
সেটা কী?
ভ্রান্তির অবসান।
স্ট্রবেরির পারা ঘেঁটে আমি ক্লান্ত।
ওগুলিই তোমায় ভালো মানায়।
বাইরের জীবনে।
লর্ড হেনরি বললেন, ওগুলিকে তুমি শেষ পর্যন্ত হারিয়ে ফেলবে।
না, একটিও হারাব না।
মনমাউথের কান রেযেছে।
বৃদ্ধ বয়সে কানে কম শোনে মানুষ।
অপরের সঙ্গে তোমাকে মিশতে দেখলে ও রাগ করে না?
তাই যদি করত!
লর্ড হেনরি চারপাশে একবার তাকিয়ে দেখলেন। মনে হল কী যেন খুঁজছেন তিনি।
ডাচেস জিজ্ঞাসা করলেন, কী খুঁজছ?
তোমার মনের চাবিকাঠিটা। তুমি সেটা ফেলে দিয়েছ।
ভয় নেই। এখনো মুখোশ রয়েছে আমার মুখে–হেসে বললেন ডাচেস। তোমার চোখগুলি বড়ো সুন্দর।
মুক্তার মতো দাঁতগুলি বের করে আবার হাসলেন ডাচেস।
ওপরে তাঁর নিজের ঘরে একটা সোফার ওপরে শুয়েছিলেন ডোরিয়েন। যন্ত্রণায় তাঁর অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি কুঁকড়ে-কুঁকড়ে উঠেছিল। হঠাৎ মনে হল জীবনের এই ভয়াবহ বোঝা আর তিনি বইতে পারছে না। বনের ভিতর জন্তু-জানোয়ারের মতো সেই হতভাগ্য লোকটির মৃত্যু তাঁর মন অস্বস্তিতে ভরিয়ে দিয়েছিল।
বিকাল পাঁচটার সময় বেল বাজালেন তিনি। চাকর ঘরে এসে ঢুকতে সেই রাত্রির ট্রেনেই শহরে ফিরে যাওয়ার জন্যে চাকরকে নির্দেশ দিলেন তিনি। সব জিনিসপত্র গোছগাছ করে। নিতে বললেন, সেই সঙ্গে বলে দিলেন ঠিক সাড়ে আটটার সময় গাড়ি যেন তৈরি থাকে। আর একটি রাতও তিন এ বাড়িতে কাটাবেন না। বাডিটা অলক্ষণে এখানে দিনের বেলায় প্রকাশ্যে মৃত্যু হেঁটে বেড়াচ্ছে। এখানে অরণ্যের ঘাসগুলি রক্তে লাল হয়ে উঠেছে। তারপরে একটা চিঠি লিখলেন লর্ড হেনরিকে; জানালেন যে ডাক্তার দেখানোর জন্যে তিনি শহরে যাচ্ছেন; সেই সঙ্গে অনুরোধ করলেন তাঁর অনুপস্থিতিতে তিনি যেন তাঁর অতিথিদের দেখাশোনা করেন। চিঠিটা লিখে খামে মুড়তে যাবেন এমন সময় চাকর এসে জানাল যে। ‘হেড-কিপার’ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চায়। ধ্রুকুটি করলেন তিনি; ঠোঁটটাও একেবার কামড়ালেন, তারপরে একটু ভেবে বললেন, পাঠিয়ে দাও।
হেড-কিপার ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ড্রয়ারের ভেতর থেকে একটা চেকবই বার করলেন ডোরিয়েন; তারপরে বইটি তার সামনে খুলে বললেন, আজ সকালে যে দুর্ঘটনা ঘটেছে তারই জন্যে তুমি এসেছ-তাই না থ্রনটন?-কমলটা তুলে নিলেন তিনি।
হ্যাঁ, স্যার।
লোকটা কি বিয়ে করেছে? ওর কোনো পোষ্য রয়েছে? থাকলে, তারা কেউ অভাবে পড়ুক তা আমি চাইনে। কত টাকা তাদের দিতে হবে বল। আমি তাদের পাঠিয়ে দেব।
লোকটা যে কে তা আমরা কেউ বুঝতে পারছিনে, স্যার। সেই জন্যেই আপনার কাছে এসেছিলাম।
তোমরা জান না? কী বলছ? ও কি তোমাদের লোক নয়?
না, স্যার। কোনোদিন ওকে আমরা দেখিনি। নাবিক বলে মনে হচ্ছে স্যার।
ডোরিয়েন গ্রে-র হাত থেকে কলমটা পড়ে গেল; মনে হল, হঠাৎ তাঁর রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তিনি চিৎকার করে উঠলেন, কী বললে? নাবিক?
হ্যাঁ, স্যার। চিহ্ন দেখে সেই রকমই মনে হয়েছে আমাদের।
বিভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ওর কাছ থেকে এমন কিছু পাওনি যা থেকে ওর নামটা কী জানা যায়?
সামান্য কিছু টাকা, আর ছ’নলা একটা পিস্তল। কোনো নাম নেই। চেহারাটা ভালোই, তবে একটু উগ্র। আমাদের ধারণা, নাবিক।
চমকে দাঁড়িয়ে উঠলেন ডোরিয়েন, দেহটা কোথায়? চল–এখনই; আমি দেখব।
মৃতদেহটা হোম ফার্মে রাখা হয়েছে স্যার।
মিনিট পনেরোর মধ্যেই দেখা গেল ডোরিয়েন গ্রে ঘোড়ার পিঠে চডে লম্বা-চওড়া রাস্তা ধরে মুটে চলেছেন হোম ফার্মের দিকে। নির্ধারিত ভাযগায় পৌঁছেই তিনি দেখতে পেলেন দুটি লোক বাইরের উঠোনে পায়চারি করছে। ঘোড়া থেকে লাফিয়ে পড়লেন তিনি;তারপরে ওই দুটি লোকের হেপাজতে ঘোড়া আর চাবুকটা রেখে তিনি শেষ প্রান্তের একটা আস্তাবলের দিকে এগিয়ে গেলেন। ঘরের মধ্যে একটা আলো জ্বলছিল। সেই দেখেই তিনি বুঝতে পারলেন। ওখানে একটা মৃতদেহ রয়েছে। দরজার সামনে গিয়ে তিনি তালার ওপরে হাত রাখলেন, একটু থামলেন। মনে হল লোকটিকে যেন তিনি চিনতে পেরেছেন। মনে হল এই আবিষ্কার হয় তাঁর জীবনকে বাঁচাবে না হয় ধ্বংস করে ফেলবে। তারপরেই তিনি দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেলেন।
ঘরের এক কোণে জঞ্জালের স্তূপের ওপরে একটা মৃতদেহ শোওয়ানো রয়েছে। তার দেহে মোটা শার্ট পরনে এক জোড়া নীল ট্রাইজার। তার মুখের ওপরে একটা ডোরা কাটা রুমাল। বোতলের মুখে লাগানো একটা বাতি জ্বলছে তার পাশে।
কেঁপে উঠলেন ডোরিয়েন গ্রে। মনে হল নিজের হাতে রুমালটা কিছুতেই তিনি সরাতে পারবেন না। একজন চাকরকে ডেকে তিনি বললেন, রুমালটা সরিয়ে নাও। আমি দেখতে চাই লোকটা কে?
চাকরটা রুমাল সরিয়ে নিল। তিনি দেখার জন্যে সামনে এগিয়ে এলেন। একটা আনন্দের আর্তনাদ তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে এল। মৃত লোকটি ডেমস ভেন।
মৃতদেহটির দিকে তাকিয়ে কয়েক সেকেন্ড তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন। বাড়ি ফেরার পথে তাঁর চোখ দুটি জলে ভরে উঠল। তিনি বুঝতে পারলেন এবার তিনি নিরাপদ।
.
ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
গোলাপ জলে আঙুল ডোবাতে-ডোবাতে লর্ড হেনরি বললেন, তুমি ভালো হতে যাচ্ছ একথা আমাকে বলে লাভ নেই ডোরিয়েন। তুমি এমনিতে নিখাদ সোনা। অনুগ্রহ করে নিজেকে পরিবর্তন করো না।
ঘাড় নাড়লেন ডোরিয়েন, না হ্যারি। জীবনে আমি অনেক খারাপ কাজ করেছি। আর আমি করব না। গতকাল থেকেই আমি ভালো কাজ করতে শুরু করেছি।
গতকাল তুমি কোথায় ছিলে?
গ্রামে। একটা ছোটো সরাইখানা-একা।
লর্ড হেনরি হেসে বললেন, বন্ধু, গ্রামে যে-কোনো লোক ভালো থাকতে পারে। সেখানে কোনো প্রলোভন নেই। সেইডন্যই যারা শহরের বাইরে থাকে তারা অত অসভ্য। সভ্যতা অর্জন করা। সহজ ব্যাপার নয়। সভ্য হওয়ার উপায় রয়েছে দুটো: একটা হচ্ছে কৃষ্টি অর্জন করে আর একটা হচ্ছে নোংরামি করে। গ্রাম্য লোকের দুটোর মধ্যে একটা সুযোগও পায় না। তাই তাদের। জীবনের গতি রুদ্ধ।
ডোরিয়েন-এর কণ্ঠে প্রতিধ্বনি শোনা গেল, কৃষ্টি আর নোংরামি! দুটির কিছু কিছু আমি জানি। ওদের দুটি যে একসঙ্গে থাকে সেটাই আমার কাছে এখন ভয়ঙ্কর বলে মনে হয়। কারণ, এখন আমি নতুন আদর্শে বিশ্বাসী। আমি আমার পথ পরিবর্তন করার চেষ্টা করছি; করেওচ্ছি। কিছুটা।
কী ভালো কাজটা তুমি করেছ সেকথা এখনো তুমি বলনি। অথবা, একটার বেশি ভালো কাজ তুমি করেছ তাই কি তুমি বললে?
তোমাকে বলছি, হ্যারি। একথা আর কাউকে আমি বলতে পারব না। একজনকে আমি ছেড়ে দিয়েছি। আত্মম্ভরিতা বলে মনে হবে, কিন্তু আমি কী বলতে চাই তা নিশ্চয় তুমি বুঝতে পেরেছ। মেয়েটা খুবই সুন্দরী, সাইবিলের মতো অপরূপা। মনে হয়, তার লাবণ্যই আমাকে প্রথম আকর্ষণ করেছিল। সাইবিল ভেনকে তোমার মনে রয়েছে? ওঃ, কতদিন আগের কথা! অবশ্য হেটি ঠিক আমাদের সমাজের ন্য। সে হচ্ছে সরল একটি গ্রাম্য বালিকা। সত্যি সত্যিই আমি তাকে ভালোবেসেছিলাম। হ্যাঁ, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সারা মে মাস থেকে প্রতি সপ্তাহেই দু’বার করে আমি সেই গ্রামে যেতাম তার সঙ্গে দেখা করার জন্যে। গতকাল একটা ছোটো বাগানে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আপেলের ফুলগুলি লুটিয়ে পড়েছিল তার চুলের ওপরে। সে হাসছিল। আজ সকালেও আমাদের দুজনের এক জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল। হঠাৎ আমি মনস্থির করে ফেললাম–না, থাক। নিষ্পাপ কুসুম আর আমি ছিড়ব না।
বাধা দিয়ে লর্ড হেনরি বললেন, আমার ধারণা, ভাবাবেগের নতুনত্বে তোমার মনে সত্যিকার আনন্দের বান ডাকছিল। যাই হোক, এই রূপকথার উপসংহার আমি টেনে দিতে পারি। সৎ উপদেশ দিয়ে তুমি তার হৃদ্যটিকে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। তুমি যে আত্মশুদ্ধির পথ ধরে এটাই তার প্রথম পদক্ষেপ।
ছিঃ, ছিঃ; হ্যারি–এরকম ভয়ঙ্কর কথা বলা উচিত নয় তোমার হেটির হৃদয় ভাঙেনি। সে অবশ্য কেঁদেছিল ঠিক কথা। কিন্তু কোনো অসম্মানের বোঝা তার ঘাড়ে চাপেনি। সে তার স্বপ্নের উদ্যালে পারদিতার মতো বেঁচে থাকত পারে।
এবং অবিশ্বাসী ফ্লোরিজেলের কথা ভেবে কাঁদবো প্রিয় ডোরিয়েন, তুমি একেবারে ছেলেমানুষ। তুমি কি ভেবেছ সে আর কোনোদিন নিজের সমাজের কাউকে বিয়ে করে সুখী হবে? হয়তো কোনো রুক্ষ মেজাডি অথবা বদরাগী কোনো চাষিকে সে বিয়ে করবো তোমাকে ভালোবাসার ফলে সে তার স্বামীকে ঘৃণা করতে শুরু করবে। ফলে, সারা জীবন ধরেই কষ্ট পাবে মেয়েটা। নীতির দিক থেকে তোমার এই আত্মশুদ্ধির কোনো দাম নেই। এমন কি সূচনার দিক থেকেও এটা নগণ্য। তাছাড়া, তুমি কী করে জানলে যে সে এতক্ষণ ওফিলিয়ার মতো জলে ভাসছে না?
হারি, তোমার বাণী অসহ্য। প্রতিটি ব্যাপারেই তুমি ব্যঙ্গোক্তি কর; তারপরে উপসংহার কর করুণতম পরিণিতর কথা বলে কথাটা তোমাকে বলা উচিত হয়নি আমার। তুমি যা ইচ্ছে তাই বলতে পার; আমি জানি, আমি যা করছি তা ঠিক। যাক ওসব কথা এখন থাকা আমাকে তুমি বোঝাতে চেয়ো না যে আমার জীবনের প্রথম ভালো কাজ, স্বার্থত্যাগ তা যত নগণ্যই হোক-পাপ ছাড়া আর কিছু নয়। আমি আরো ভালো হতে চাই এবং হবও। এখন তোমার কথা বলা শহরে কী ঘটছে? অনেকদিন আমি ক্লাবে যাইনি।
এখনো লোকে হতভাগ্য বেসিলের অন্তর্ধানের কথা আলোচনা করছে।
কিছুটা মদ গ্লাসে ঢালতে ঢালতে ডোরিয়েন বললেন, ভেবেছিলেম, ওই আলোচনা করতে-করতে এতহষ্কণ হয়তো তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
প্রিয় বন্ধু, মাত্র দুটি সপ্তাহ তারা এই আলোচনা করছে আর ব্রিটিশ ভাত তিন মাসের আগে কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে ক্লান্ত হয় না। সেদিক থেকে বর্তমানে তারা কিছুটা। ভাগ্যমান। তাদের আলোচনার বিষয় অনেক। আমার বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে তারা মশগুল, তারপর অ্যালেন ক্যাম্পবেলের আত্মহত্যা। সঙ্গে সঙ্গে আবার একটি আর্টিস্টের রহস্যময় অন্তর্ধান। ব্রিটিশ ভাত এখন উদ্ধ্যস্ত হয়ে উঠেছে। স্কটল্যান্ডে ইয়ার্ড নিশ্চিত যে ধূসর রঙের আলেস্টার চাপিয়ে নভেম্বর মাসের ন’তারিখে মধ্যরাত্রিতে যে লোকটি ট্রেনে চেপে প্যারিসের দিকে যাত্রা করেছিল সে লোকটি হতভাগ্য বেসিল ছাড়া আর কেউ নয়। ফরাসি পুলিশ ঘোষণা করেছে যে বেসিল কখনো প্যারিসে নামেননি। আমার ধারণা আর পনেরো দিনের মধ্যে আমরা শুনতে পাব যে বেসিলকে স্যান ফ্রান্সিসকোতে দেখা গিয়েছে। মজার কথাই বটে। যারাই অদৃশ্য হয়ে যায় তাদেরই নাকি স্যান ফ্রান্সিসকোতে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। শহরটা নিশ্চয় খুব সুন্দর। পরলোকের সমস্ত কিছু আকর্ষণ নিশ্চয় ওখানে রয়েছে।
ব্যাপারটা নিয়ে কেমন করে অত সহজভাবে তিনি আলোচনা করতে পারছেন সেই ভেবে অবাক হয়ে ডোরিয়েন জিজ্ঞাসা করলেন, বেসিলের কী হয়েছে বলে তোমার মনে হচ্ছে?
আমি কিছু ভাবতেই পারছিনে। বেসিল যদি নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চায় তাতে আমার কিছু যায় আসে না। সে যদি মারা গিয়ে থাকে তার সম্বন্ধে আমি কিছু চিন্তা করতেও চাইনে। মৃত্যুটাকেই আমি ভয় করি। ঘৃণা করি মৃত্যুকে।
কেন?-ক্লান্তভাবে প্রশ্ন করলেন ডোরিয়েন।
কারণ–একমাত্র মৃত্যু ছাড়া মানুষ সবকিছুই কাটিয়ে উঠতে পারে। মৃত্যুর আর অশ্লীলতা–উনবিংশ শতাব্দীর এই দুটি বাস্তব সত্যকে মানুষ কিছুতেই ব্যাখ্যা করতে পারেনি। চল, কফি খাওয়ার ঘরে যাই। সেখানে তুমি আমাকে ‘কপি’ বাজিয়ে শোনাবে। আমার স্ত্রী যার সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছে সেই ছোকরা চমৎকার ‘কপিন’ বাড়ত, বেচারি। ভিকটোরিয়া! তাকে আমার খুব ভালো লাগত। সে চলে যাওয়ার পর থেকে বাড়িটা কেমন নিডল হয়ে গিয়েছে। অবশ্য বিবাহিতা জীবন একটা অভ্যাস ছাড়া আর কিছু নয়-বদ অভ্যাসও বলতে পার। কিন্তু তবু মানুষ তার নিকৃষ্ট অভ্যাসকে হারানোরও দুঃখ করে। কেবল দুঃখই করে না; খুব বেশি দুঃখ করে। তবদ অভ্যাসগুলি মানুষের জীবনের অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ ছাড়া আর কিছু নয়।
কিছুই বললেন না ডোরিয়েন। কফি খাওয়ার ঘরে উঠে গিয়ে কিছুক্ষণ পিয়ানো বাজালেন; তারপরে কফি আসার পরে তিনি থামলেন; হেনরির দিকে তাকিয়ে বললেন, আচ্ছা হ্যারি, বেসিলকে কেউ খুন করেছে একথা কি তোমার কখনো মনে হয়েছে?
লর্ড হেনরি হাই তুলে বললেন, বেসিল খুব ভনপ্রিয় ছিল। তার হাতে থাকত সব সময় একটা ওযাটারবেরি ঘড়ি। তাকে লোকে খুন করবে কেন? কারো সঙ্গে শত্রুতা করার মতো চালাক সে ছিল না। তবে অবশ্য অদ্ভুত সুন্দর দুবি আঁকার হাত ছিল তার। তাছাড়া মানুষকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা ছিল না তার। কেবলমাত্র একবারই তাকে আমার ভালো লেগেছিল। সে-সময়টা তোমার ছবি আঁকতে-আকতে সে আমাকে বলেছিল তোমাকে সে পুজো করে, আর তার চিত্রকলার তুমিই হচ্ছ প্রধান প্রেরণা।
বিষণ্ণ সুরে ডোরিয়েন বললেন, বেসিলকে আমি ভালোবাসতাম। কিন্তু তাকে কেউ হত্যা। করেছে একথা কি লোকে বলছে না?
অবশ্য কিছু কিছু কাগজে সেই রকম কথাই বলছে। আমার কিন্তু তা মনে হয় না। আমি জানি প্যারিসে অনেক বিপজ্জনক জায়গা রয়েছে, কিন্তু সে-সব জায়গায় যাওয়ার মানুষ সে নয়। কোনো বিষয়েই তার কোনো কৌতূহল ছিল না। এইটাই তার চরিত্রের দোষ।
ডোরিয়েন বললেন, আমি যদি বলি তাকে আমি হত্যা করেছি তাহলে তুমি কী বলবে হ্যারি?
আমি বলব, প্রিয় বন্ধু যে চরিত্রের অভিনয় করার চেষ্টা তুমি করছ সেই চরিত্রটা তোমায় মানাবে না। সমস্ত পাপই নোংরা, যেমন সমস্ত নোংরাই পাপা হত্যা করা ডোরিয়েন তোমার কর্ম নয়। এই কথা বলে তোমার অহঙ্কারকে আমি আঘাত করছি বলে দুঃখিত, কিন্তু তোমার পষ্কে ওইটাই সত্যি। সমাজের নীচু স্তরের মানুষরাই এই ধরনের কাজ করে। তার জন্যে আমি তাদের দোষ দিইনে। আমার বিশ্বাস, আমাদের কাছে আর্টের যা দাম, ওদের কাছে। খুন-খারাপির দাম সেই রকম–অদ্ভুত চমক ডজাগানোর উপায় মাত্র।
চমক জাগানোর উপায় মাত্র? তুমি কি তাহলে মনে কর যে একবার খুন করেছে সে। দ্বিতীয়বার খুন করবে না? ওকথা আমাকে বলো না।
লর্ড হেনরি হেসে বললেন, বারবার করতে-করতে যেকোনো জিনিসই মানুষকে আনন্দ দেয়। এইটাই হচ্ছে মানুষের জীবনের একটা অতি প্রয়োজনীয় রহস্য। আমার ধারণা, হত্যা করাটা ভুল। ডিনারের পরে যা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করা যায় না এমন কোনো কাজ মানুষের করা উচিত নয়। কিন্তু বেচারা বেসিলের কথা থাক। তুমি যা বললে সেই রকম রোমান্টিক পরিণতি যদি তার ঘটে থাকে তাহলে তো ভালোই। কিন্তু আমি তা ভাবতে পারছিলো আমার ধারণা বাসে করে যেতে-যেতে সে সিন নদীতে পড়ে গিয়েছে বাস কন্ডাকটর চেপে দিয়েছে ব্যাপারটা। হ্যাঁ, ওই ধরনেরই কিছু একটা ঘটেছে তার। তুমি কি জান, আর ভালো ছবি আঁকার হল্কমতা তার ছিল না। গত দশ বছরের মধ্যে তার ছবির মান অনেকটা নেমে গিয়েছে।
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন ডোরিয়েন। লর্ড হেনরি ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগলেন কিছুক্ষণ পায়চারি করার পরে বললেন, হ্যাঁ, তার ছবির মান অনেক নেমে গিয়েছে। মনে হচ্ছে কিছু যেন অভাব রয়ে গিয়েছে তার ছবিতে আদর্শ হারিয়ে ফেলেছে সে। তোমার সঙ্গে তার। নিবিড় বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার পর থেকেই তার এই অধঃপতন শুরু। তোমাদের মধ্যে ভাঙন ধরল। কেন? আমার ধারণা, তাকে আর তোমার ভালো লাগত না। তাই যদি হয় তাহলে সে তোমাকে কখনো হস্কৃমা করতে পারবে না। বিরক্তিকর মানুষদের স্বভাবই ওই রকম। আচ্ছা, তোমার যে ছবিটা সে এঁকেছিল সেটা কোথায় বল তো? ছবিটা শেষ হওয়ার পরে আর সেটা দেখেছি বলে তো মনে হয় না! হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে। অনেক দিন আগে তুমি একবার। বলেছিলে ছবিটাকে তুমি সেলবিতে পাঠিয়ে দিয়েছ। পথে সেটা হারিয়ে গিয়েছে। তাই না? সেটা কি ফিরে পেয়েছে? পাওনি। হায়-হায়! ছবিটা সত্যিই বড় সুন্দর। আমিই সেটা কিনতে চেয়েছিলাম। বেসিলের ওটা একটা প্রথম শ্রেণির ছবি। তারপর থেকেই তার ছবির মান নামতে শুরু করেছে; তারপর থেকে তার ছবিগুলি হয়েছে সৎ বাসনা আর নিকৃষ্ট শিল্পের নিদর্শন–একবারে নির্ভেজাল ব্রিটিশ চিত্রকরদের চিত্রকলার প্রতীক। ছবিটা পাওয়ার জন্যে কাগডে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলে? দেওয়া উচিত তোমার।
ডোরিয়েন বললেন, ভুলে গিয়েছি। সম্ভবত দিয়েছিলাম। কিন্তু ছবিটা সত্যিই আমার ভালো লাগেনি। আমি দুঃখিত যে ওই ছবির মডেল হয়েছিলাম আমি। ছবিটা দেখে হ্যামলেট নাটকের দুটো লাইন আমার মনে পড়ে যায়-লাইন দুটো হচ্ছে–
“দুঃখের চিত্রের মতো
হৃদয়হীন একটা মুখ।”
হ্যাঁ, আমার প্রতিকৃতিটা ওই রকমই।
লর্ড হেনরি হেসে বললেন, জীবনকে যে চিত্রকরের দৃষ্টি দিয়ে দেখে তার কাছে মস্তিষ্কটাই হচ্ছে তার হৃদয়।
তারপরে তিনি চোখ দুটি অর্ধেক বুড়িচযে ডোরিযেলের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আচ্ছা ডোরিয়েন, মানুষ সারা পৃথিবী জয় করল কি হারাল তাতে কী যায় আসে? কে যেন বলেছিল–তার নিজের আত্মা?
ডোরিয়েন এতক্ষণ ঠুং ঠুং করে পিয়ানোর সুর তুলছিলেন, প্রশ্নটা শুনে তিনি তাঁর দিকে চোখ। দুটো বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইলেন; জিজ্ঞাসা করলেন, এ- প্রশ্ন কেন?
লর্ড হেনরি বললেন, প্রশ্নটা করেছি এই ভেবে যে তুমি হয়তো এর উত্তর দিতে পারবে। এ ছাড়া আর কিছু নয়। গত সোমবার আমি পার্কের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। মার্বেল আর্চের পাশে নোংরা পোশাক পরে একদল লোক ততোধিক নোংরা একটি ধর্মযাজকের বাণী শুনছিল। যেতে-যেতে শুনলাম ধর্মযাজকটি চিৎকার করে তাঁর শ্রোতাদের ওই প্রশ্নটি করছেন।
ব্যাপারটা আমার কাছে নাটকীয় বলে মনে হল। এই ধরনের কৌতুককর ঘটনা লন্ডন শহরে হামেশাই ঘটছে। ভিড়ে রবিবার, নোংরা ম্যাকিনটস পরা কোন ক্রিশ্চান পাদরী, তাঁর। চারপাশে ছাতা মাথায় দিয়ে একদল বিবর্ণ শ্রোতা দাঁড়িয়ে। ঠিক সেই সময় পাদরীর এই ধরনের উচ্ছ্বাসভরা প্রশ্ন তীক্ষ্ণভাবে সবাইকে গিয়ে আঘাত করছে। একদিন দিয়ে। ভালোই–পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে প্রশ্নটা সত্যিই আমাদের ভাবিয়ে তোলে। সেই ভবিষ্যৎ বক্তাকে আমি বলব বলে ভেবেছিলাম যে আর্টের আত্মা রয়েছে, তাঁর নেই। কিন্তু ভয় হল, মানুষটি সম্ভবত আমার বক্তব্যের নিগুঢ় তত্ত্বটি বুঝতে পারবে না।
থাক, থাক হারি। আত্মা হচ্ছে ভয়ঙ্কর বাস্তব সত্য। একে কেনাও যায় না, বিক্রি করাও যায় না; একে নিয়ে খেলা যায় না ছিনিমিনি। একে বিষাক্ত করা যায় অথবা করা যায় নিখুঁত। আমাদের প্রত্যেকেরই আত্মা রয়েছে। আমি তা জানি।
ডোরিয়েন, এ বিষয়ে তুমি নিশ্চিত?
নিশ্চয়।
তাহলে ওটা একটা মরীচিকা ছাড়া আর কিছু নয়। যে জিনিস মানুষ একেবারে সত্যি বলে। বিশ্বাস করে তা কোনোদিনই সত্যি হতে পারে না। বিশ্বাসের মারাত্মক পরিণতি আর রোমান্সের শিক্ষা হল ওই। খুব গম্ভীর হয়ে পড়লে দেখছি। না, না, অতটা সিরিয়াস হওয়ার দরকার নেই। আমাদের যুগের কুসংস্কারদের নিয়ে তোমার কী করার রয়েছে; আমারই বা। রয়েছে কী? কিছু নেই। আয়ায় আমরা বিশ্বাস হারিয়েছি। ওসব কথা থাক। তুমি বরং কিছু বাজাও বাড়াতে বাজাতে বল, তোমার ওই যৌবনের গোপন রহস্যটা কী? তোমার চেয়ে আমি মাত্র বছর দশেকের বড়ো। আমাকে দেখ, আমি একেবারে বুড়িয়ে গিয়েছি। হয়ে গিয়েছি, ফ্যাকাশে। কিন্তু তোমার সৌন্দর্যের আগুণ এতটুকু কমেনি। আজ তোমাক যেমন সুন্দর দেখছি চিরকালই তুমি সেইরকম। পরিবর্তন তোমার হয়েছে, কিন্তু চেহারায় ন্য। তোমার। গোপন রহস্যরটা কী জানলে আমি খুশি হতাম। শারীরিক পরিশ্রম করা, সকালে ওঠা, আর সম্ভ্রান্ত হওয়া ছাড়া, যৌবন ফিরে পাওয়ার জন্যে আমি সব কিছু করতে পারি। যৌবনের মতো জিনিসু আর নেই। যৌবনের অজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করা হাস্যকর। একমাত্র তাদের কথা আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে শুনি যারা আমার চেয়ে বয়সে কম। মনে হয় তারাই আমার পথিকৃৎ। ভীবন তার নতুনতম সঞ্চযের ভাণ্ডার তাদের কাছে খুলে দিয়েছে। নীতিগতভাবেই, বৃদ্ধদের আমি প্রতিবাদ করি। গতকাল কী ঘটেছে সে সম্বন্ধে যদি তাদের মতামত চাও তাহলে তারা গম্ভীরভাবে যে মতামত দেবে তা হচ্ছে ১৮২০ সালের থেম না, বাডাও। আভা রাত্রিতে আমি সঙ্গীতে ডুবে থাকতে চাই। আজ মনে হচ্ছে তুমি যেন যুবক অ্যাপোলো; আর আমি। মার্সিয়াস, তোমার গান শুলে মাতোয়ারা। আমারও দুঃখ রয়েছে, ডোরিয়েন; এমন দুঃখ যা তুমি ভান না। বার্ধক্যের ট্র্যাজেডি এই নয় যে সে বৃদ্ধ; ট্র্যাভেডি হচ্ছে আর একজন যুবক। মাঝে মাঝে নিজের সৎ ভাষণে আমি নিজেই চমকে উঠি। আঃ, ডোরিয়েন, তুমি জীবনের সব সুরা তুমি পান করেছ। আঙুরের নির্যাসে ভরিয়ে দিয়ে তোমার আত্মা। কিছুই তোমার কাছে গোপন লেই। সবই তুম সঙ্গীতের মতো উপভোগ করেছা এত ভোগের পরেও তোমার ক্লান্তি নেই, বিকৃতি ঘটেনি চোমার চেহারায়। তুমি সেই আগের মতো অপরূপ সুন্দর।
আমি সেই আগের মানুষ আর নেই, হ্যারি।
আছ; সেই আগের মতোই অবিকল। তোমার বাকি জীবনটা কীভাবে কাটবে তাই আমি অবাক হয়ে ভাবি। আত্নত্যাগ করে এ জীবনকে তুমি নষ্ট করে দিয়ো না। তুমি একেবারে নিখুঁত ঘাড় নেড়ে আমার কথার প্রতিবাদ করে লাভ নেই। তুমি জান আমার কথাই ঠিক। তাছাড়া, প্রতারণা করো না নিজের সঙ্গে। ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরে জীবন নির্ভর করে না। জীবনটা হচ্ছে স্নায়ু আর তন্নীর ঘন সন্নিবেশ; এদের মধ্যে মানুষের চিন্তারা লুকিয়ে থাকে। কামনা বা স্বপ্নের জাল বোনে। নিজেকে তুমি নিরাপদ অথবা সবল বলে ভাবতে পার; কিন্তু আমি তোমাকে বলছি ডোরিয়েন আমাদের জীবন দাঁড়িয়ে রয়েছে ছোটো ছোটো মুহূর্তের ওপরে-ঘরের বিশেষ কোনো রঙ, সকাল বেলাকার আকাশের মোহ, বিশেষ কোনো সুগন্ধ, একটা ভুলে যাওয়া কবিতা–এরাই আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে তোমার সঙ্গে জায়গা পরিবর্তন করতে পারলে আমি খুশি হতাম ডোরিয়েল। আমাদের দুজনের বিরুদ্ধেই পৃথিবী সোচ্চার হয়ে উঠেছে–কিন্তু সে সব সময়েই তোমার জন্যে পূজার উপকরণ সাজিযে রেখেছে। আমি খুশি যে তুমি কোনোদিন কোনো মূর্তি গড়নি, কোনো ছবি আঁকনি, নিজেকে বাদ দিয়ে আর কিছুই সৃষ্টির কাজে অনর্থক সময় নষ্ট করনি তুমি। জীবনটাই হচ্ছে তোমার কাছে একটা আর্ট; তোমার দিনগুলিই তোমার সনেট।
পিয়ানো থেকে উঠে নিজের চুলগুলির ভেতর দিয়ে আঙুল বুলিয়ে নিলেন ডোরিয়েন; বললেন, হ্যাঁ, জীবনটা আমার কাছে সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে দেখা দিয়েছে। আমি সেই জীবন আর চাইলে, হ্যারি। তাছাড়া, আমাকে নিয়ে তুমি আর ওই উচ্ছ্বাস দেখিযো না। আমার সম্বন্ধে তুমি কিছুই জান না। যদি জানতে তাহলে বিষ্ণায় তুমি মুখ ঘুরিয়ে নিতে। হাসছ তুমি, হেস না।
তুমি বাজনা থামালে কেন, ডোরিয়েন? যাও, বাজাও। ওই ধোঁয়াটে আকাশের বুকে যে মধুচাঁদ উঁকি দিয়েছে তার দিকে একবার তাকিয়ে দেখা তোমার সঙ্গীতসুধা পান করার জন্যে ও অপেহষ্কা করছে তোমার গান শুরু হলেই ও পৃথিবীর কাছাকাছি নেমে আসবে। গাইবে না? তাহলে ক্লাবে চল। ক্লাবে তোমার সঙ্গে আলাপ করার জন্যে একজন ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। সে হচ্ছে যুবক লর্ড পোল-বুর্নেসাইথ-এর বড়ো ছেলে। ইতিমধ্যেই সে তোমার নেকটাই পরার ঢঙটা রপ্ত করে নিয়েছে।
বিষণ্ণভাবে ডোরিয়েন বললেন, না, থাক। আজ আমি বড়ো ক্লান্ত, হারি। ক্লাবে আজ আর যাব না। প্রায় এগারোটা বাজে। আমি আজ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ব।
আর একটু থাক। আজকের রাত্রিতে যে বাজনা তুমি বাজালে এমন সুন্দর বাজনা আর কখনো আমি শুনিনি।
ডোরিয়েন হেসে বললেন, তার কারণ, আমি ভালো হতে যাচ্ছি।
আমার কাছে তুমি পালটাতে পার না ডোরিয়েন। সব সময়েই আমরা পরস্পরের অচ্ছেদ্য বন্ধু।
তবু একবার একখানা বই পড়তে দিয়ে আমার মনকে তুমি বিষাক্ত করে তুলেছিলো তার জন্যে আমি তোমাকে মা করব না। হ্যারি প্রতিজ্ঞা কর, ওই বই তুমি আর কাউকে পড়তে দেবে না? এতে মানুষের ক্ষতি হয়।
হেনরি বললেন, বন্ধু, এবারে তুমি নীতি আওড়াতে শুরু করলো মনে হচ্ছে যে সব পাপ করে তুমি নিজে ক্লান্ত হয়ে পড়েছ সেই পাপ মানুষ যাতে না করে সেই বাণী প্রচার করার জন্যে পাদরীদের মতো তুমি শীঘ্রই রাস্তায় বেরিয়ে পড়বে। নিশ্চয় ওরকম কিছু করার মতো গাদ্যিক তুমি হবে না। তা ছাড়া লাভও নেই। তুমি আর আমি যা তা-ই এবং ভবিষ্যতেও তা-ই থাকব। আর বই পড়ে নষ্ট হওয়ার কথা যদি বল, ওটা কিছু নয়। মানুষের কাজের ওপরে আর্টের কোনো প্রভাব নেই। আর্ট একেবারে বন্ধ্যা। যে বইগুলিকে পৃথিবী জঘন্য বলে প্রচার করেছে সেগুলি পৃথিবীর লজ্জাকর ইতিহাস। যাকগে, বর্তমানে সাহিত্য নিয়ে আমরা আলোচনা করছিনে। কাল এস–এগারোটার সময় আমরা ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে যাব। আমরা একসঙ্গে লাঞ্চ খাব। তারপরে আমি তোমাকে লেড ব্রাহ্মসালের বাড়িতে নিয়ে যাব। কিন্তু আমর ডাচেসের সঙ্গেও লাঞ্চ খেতে পারি। সে বলছিল আজকাল তোমার সঙ্গে তার নাকি আর দেখা হয় না? গ্ল্যাডিসকে তোমার কি আর ভালো লাগে না? জানি তার চত্বর কথা মানুষকে কষ্ট দেয়। যাই হোক, কাল বেলা এগারোটার সময় এখানে থেক।
সত্যিই কি আসতে হবে, হ্যারি?
নিশ্চয়। পার্ক এখন বড়ো মনোরম। আমার ধারণা তোমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকে এত সুন্দর লিল্যাক আর কখনো ওখানে ফোটেনি।
তাই হবে। কাল এগারোটার সময় এখানে আমি আসবা শুভরাত্রি, হ্যারি।
দরজার কাছে গিয়ে তিনি একটু দাঁড়ালেন; মনে হল, আর কী যেন বলবেন। তারপরে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে গেলেন।
.
বিংশ পরিচ্ছেদ
বড়ো সুন্দর রাত্রি, গরম। এত গরম যে কোটটা খুলে তিনি হাতের ওপরে চাপালেন; গলায় সিল্ক স্কার্ফও উড়ালেন না। সিগারেট ফুঁকতে-ফুঁকতে যখন তিনি বাড়ির দিকে হেঁটে আসছিলেন সেই সময় দুটি যুবক সান্ধ্য পোশাক পরে তাঁর পাশ দিয়ে চলে গেল। একজন আর একডনিকে বলল, এই লোকটি ডোরিয়েন গ্রো সেই কথা কানে গেল তাঁরা কেউ তাঁকে নির্দেশ করলে, অথবা তাঁর দিকে তাকালে বা তাঁর সম্বন্ধে আলোচনা করলে তিনি যে বেশ খুশি হতেন সেকথাটা তাঁর মনে পড়ল। অন্য লোকের মুখে নিজের নাম শুলে এখন তাঁর ভালো লাগল না। এই ছোটো গ্রামটিতে তিনি প্রায়ই আসতেন। এখানে আসতে তিনি ভালোবাসতেন এই জন্যে যে এখানে তাঁকে কেউ চিনত না। তাঁকে ভালোবাসতে যে মেয়েটিকে তিনি প্রলুব্ধ করেছিলেন তাকে বলেছিলেন যে তিন দরিদ্র। মেয়েটি সে-কথা বিশ্বাস করেছিল। তিনি তাকে একবার বলছিলেন যে তিনি দুষ্ট প্রকৃতির; সেকথা শুনে মেয়েটি হাসত: বলত দুষ্ট লোকেরা চিরকালই বড় ত্রার কদাকার। কী হাসিই না সে হাসত! মনে হত থ্রাস পাখি গান করছে তুলোর পোশাক পরা আর মাথার ওপরে বড়ো টুপি চাপানো মেয়েটিকে কী সুন্দরই না দেখাত। মেয়েটি কিছুই জানত না; কিন্তু সমস্ত সম্পদই তার ছিল; সে-সব তিনি হারিয়েছেন।
বাড়িতে ফিরে দেখলেন তাঁর চাকর তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে। তাকে শুতে বলে লাইব্রেরির সোফাতে গিয়ে তিনি বলেন। তারপরে লর্ড হেনরি যে-সব কথা তাঁকে বলেছিলেন সেই সব কথা নিয়ে তিনি ভাবতে লাগলেন।
মানুষের কোনোদিন পরিবর্তন হয় না এটা কি সত্যি কথা? শিশুকালের কলঙ্কহীন শুচিতা আর গোলাপ-শুভ্র শৈশবের দিনগুলি ফিরে পাওয়ার জন্যে প্রাণ তাঁর আকুল হয়ে উঠল। তিনি জানতেন যে নিজেকে তিনি কলুষিত করেছেন, আবর্জনায় বোঝাই করেছেন নিজের মনকে, তাঁর কল্পনাকে করে তুলেছেন ভয়ঙ্কর। অপরের ওপরে কুৎসিত প্রভাব বিস্তার করেছেন। তিনি; আর সেজন্যে ভয়ানক আনন্দও পেয়েছেন তিনি। আর তাঁর সহচর্যে যে-ই এসেছে, সে। যত সুন্দর অথবা সম্ভবনামযই হোক না কেন, তারই জীবনে অপমানের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছেন। এরকম একটা জীবনকে কি সংশোধন করা যায় না? তাঁর কি কোন আশা নেই?
হায়রে, গর্ব আর কামনার কী ভয়ঙ্কর একটি মূহৃর্তেই না তিনি প্রার্থনা করেছিলেন যেন তাঁর জীবনের সমস্ত ঝড়-ঝাপটা আর কামনার কলঙ্ক বুকে ধরে দাঁড়িয়ে থাকুক তাঁর প্রতিকৃতি, আর চির যৌবনের স্বাস্থ্য আর সৌন্দর্য নিয়ে বেঁচে থাকবেন তিনি। তাঁর জীবনের সমস্ত ব্যর্থতার জন্যে দায়ী সেই প্রার্থনাটি। প্রতিটি পাপ তাঁর ওপরে তার কলঙ্কের ছাপ রেখ। যাক–উচিত হত সেইটাই। শাস্তির মধ্যে দিয়েই হত তাঁর শুদ্ধি। ন্যায়পরায়ণ ভগবানের কাছে মানুষের সত্যিকার প্রার্থনা হচ্ছে আমাদের অপরাধের শাস্তি দাও প্রভু। আমাদের পাপ ক্ষমা কর–এরকম কোনো প্রার্থনা ভগবানের কাছে করা উচিত নয়।
অনেকদিন আগে লর্ড হেনরি অদ্ভুতভাবে খোদাই করা একটা আরশি তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন। সেটি দাঁড় করানো ছিল তাঁর টেবিলের পাশে। সেটাকে তিনি তুলে নিলেন। ঠিক এমনিভাবে আর এক বিভীষিকামযী রাত্রিতেও তিনি এটিকে তুলে নিয়েছিলেন; অশ্রুতে ভরা চোখ দিয়ে এর চকচকে মুকুরের মধ্যে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে সেদিন তিনি আঁতকে উঠেছিলেন। একজন তাঁকে খুব ভালোবাসত, সে একবার তাঁকে উদ্দেশ্য করে পাগলের ভাষায় লিখেছিল, তোমার চেহারা হাতির দাঁত আর সোনা দিয়ে গড়া; তাইতো আমার চোখে পৃথিবীর এই পরিবর্তন। সেই কথাগুলি আবার তাঁর মনে পড়ে গেল। মনে-মনে বারবার আওড়াতে লাগলেন তিনি। হঠাৎ নিজের সৌন্দর্যের ওপরে তাঁর ঘৃণা জন্মাল। মুখ বিকৃত করে সেই রুপোর আরশিটাকে সজোরে আঘাড় দিলেন মেঝের ওপরে ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে গেল আরশিটা। এই সৌন্দর্য আর যৌবনের জন্যে তিনি ভগবানের কাছে প্রার্থনা। করেছিলেন। সেই সৌন্দর্য আর যৌবনই তাঁকে ধ্বংস করে ফেলল। ওই দুটি বস্তু না থাকলে তাঁর জীবন কলঙ্কমুক্ত হতে পারত। সৌন্দর্য তাঁর কাছে মিথ্যা একটা আবরণ ছাড়া আর কিছু নয়, যৌবন কিছু নয় বিদ্রূপ ছাড়া। আসলে যৌবনটা কী? একটা সবুজ, কাঁচা সময় কিছুই নয়। যৌবনে ভাবও গভীর নয়, চিন্তাও বড়ো রুগ্ন। সেই যৌবনের পোশাক তাঁর গায়ের ওপরে কেন? ওই যৌবনই তাঁকে নষ্ট করে দিয়েছে।
অতীতের কথা চিন্তা না করাই ভালো। কোনো কিছু দিয়েই তাকে বদলানো যাবে না। নিজের কথা, ভবিষ্যতের কথাই ভাবতে হবে তাঁকে। সেলবি কবরখানার একটা বেনামী গর্তের মধ্যে ডেমন্স ভেন-এর মৃতদেহ লুকানো রয়েছে। নিজের ল্যাবরেটরিতে অ্যালেন ক্যাম্পবেল একদিন রাত্রিতে নিজের বুকে গুলি করে আত্মহত্যা করেছে, কিন্তু যে গোপন সংবাদ জানতে সে বাধ্য হয়েছিল সেটিকে বাইরে প্রকাশ করে দেয়নি। বেসিল হলওয়ার্ড-এর অন্তর্ধান নিয়ে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে তা শীঘ্রই মিলিয়ে যাবে। এখনই তা স্তিমিত হয়ে এসেছে। সেদিক থেকে তিনি নিরাপদ। তা ছাড়া, বেসিল হলওয়ার্ড-এর মৃত্যুটাও তাঁর মনের ওপরে বোঝা দাঁড়ায়নি। আসলে যে জিনিসটা তাঁকে কষ্ট দিচ্ছে সেটা হচ্ছে তাঁর আত্মার অপমৃত্যু। বেসিল যে প্রতিকৃতিটা এঁকেছিলেন সেইটিকে তাঁর জীবন নষ্ট করে দিয়েছে। তার জন্যে তিনি তাঁকে ক্ষমা করতে পারবেন না। এই প্রতিকৃতিটাই যত নষ্টের মূল। বেসিল তাঁকে সব কথা বলেছিলেন যেগুলি তিনি সহ্য করতে পারেননি। সেই কথাগুলি আজও তিনি ধৈর্যের সঙ্গে সহ্য করে চলেছেন। হত্যাটি সংগঠিত হয়েছে নিছক মুহূর্তের উত্তেজনাযা অ্যালেন। ক্যাম্পবেলের কথা যদি ধরা যায়, তাহলে নিজেকেই নিজে সে হত্যা করেছে। এ-পথটা বেছে নিয়েছে সে নিজেই। এর জন্যে তিনি দায়ী নন।
একটি নতুন জীবন! এইটিই তিনি চেয়েছিলেন। তারই জন্যে তিনি অপেক্ষা করেছেন। সেদিক থেকে প্রথম পদক্ষেপ তিনি আগেই ফেলেছেন। যাই হোক, একটি নিষ্পাপ জীবনকে তিনি কলুষিত করেননি। আর কখনো নিষ্পাপকে তিনি পাপের পথে টানবেন না। তিনি সৎ হবেন।
হেটি মার্টনের কথা ভাবতে-ভাবতে হঠাৎ আর একটা কথা তাঁর মনে এল, বন্ধ ঘরের মধ্যে যে প্রতিকৃতিটা রয়েছ সেটার ওপরেও কি পরিবর্তন দেখা দিয়েছে? আগের মতো এখন নিশ্চয় সেটা অতখানি ভয়ঙ্কর দেখাবে না। তিনি যদি পবিত্র হতে পারেন তাহলে সম্ভবত ছবিটার মুখ থেকে এ যাবৎ যত কালিমা জমেছে তা ধীরে ধীরে মুছে যাবে। ব্যাপারটা নিজের চোখে একবার দেখে আসবেন তিনি।
টেবিল থেকে বাতিটা নিয়ে পা টিপে টিপে তিনি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলেন। দরজা খোলার সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর যৌবনোদ্দীপ্ত মুখের ওপরে একটা আনন্দের জ্যোতি ফুটে বেরোল। তাঁর ঠোঁটের চারপাশে সেই জ্যোতি মুহূর্তের জন্যে পড়ল ছডিযে। হ্যাঁ, তিনি সৎ হবেন, ভালো হবেন, যে ভীতিপ্রদ জিনিসটাকে তিনি ঘরের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন সেটা আর। তাঁর কাছে ভোল মুর্তিতে দেখা দেবে না। মনে হল বুকের ওপর থেকে একটা ভারী বোঝা যেন অনেকদিন পরে নেমে গেল।
যথারীতি ভেতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে তিনি নিঃশব্দে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলেন; তারপরে প্রতিকৃতির সামনে থেকে লাল পর্দাটা দিলেন সরিয়ে। যন্ত্রণার আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি, ঘৃণায় রি-রি করে উঠল তাঁর সারা শরীর কোনো পরিবর্তন ঘটেনি প্রতিকৃতিটির–একমাত্র চোখ দুটি ছাড়া, চোখ দুটোর ভেতর থেকে একটা ধূর্ত চাহনি ফুটে বেরিয়েছে, মুখের ওপরে ছড়িয়ে পড়েছে প্রবঞ্চকের তির্যক বলিরেখা। ছবিটা আরো জঘন্য হয়েছে, আগের চেয়েও কদাকার। যে লাল ফুটকিগুলো তার হাতের ওপরে কায়েমি হয়ে বসেছিল সেগুলো আরো বেশি লাল হয়ে উঠেছে–মনে হচ্ছে নতুন কোনো রক্তপাতের স্বাক্ষর তারা। ভয়ে কাঁপতে লাগলেন তিনি। তাহলে যে ভালো কাজটা তিনি করেছেন সেটা কি নিছক দম্ভ প্রকাশ করার জন্যে? কিন্তু ঠাট্টা করে লর্ড হেনরি না বলেছিলেন–নতুন কোনো অনুভূতির আকাঙ্খায়? অথবা হৃদয়ের পরিবর্তন না হওয়া সত্ত্বেও মানুষ মাঝে মাঝে ভালো কাজ করে ফেলে। এটা কি সেই ধরনেরই কিছু একটা কাজ। কিন্তু এর পেছনে রয়েছে সব কিছুর সমষ্টি? আচ্ছা, ওই লাল ছাপটা আরো বড়ো হয়েছে কেন? ওর ওই জরাগ্রস্ত বিকৃত আঙুলগুলির ওপরে ওই লাল ছোপটা রোগের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। রঙ দিয়ে আঁকা পায়ের ওপরে রক্ত ঝরে-ঝরে পড়েছে–হাতের ওপরেও রক্তের ছিটে–অথচ ওই হাতে তার কোলো ছোরা নেই। স্বীকার করবেন? এর অর্থ কী এই যে যে-পাপ তিনি করেছেন তা নিজের মুখে স্বীকার করতে হবে? আত্মসমর্পণ করে ফাঁসিকাঠে বাডিয়ে দিতে হবে তাঁর গলাটা? হেসে ফেললেন তিনি; ওই রকম কিছু করার চিন্তাটাই তাঁর কথা বিপজ্জনক বলে মনে হল। তা ছাড়া, স্বীকার করলেই বা তাঁর কথা বিশ্বাস করবে কে? নিহত মানুষটির কোথাও কোনো চিহ্ন নেই। তার সমস্ত জিনিসপত্র নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। নীচের ঘরে সে সব জিনিস ছিল সেগুলি তিনি নিজেই পুড়িয়ে ফেলেছেন। বিশ্বের লোক বলবে তিনি একটি উন্মাদ। তা সত্ত্বেও যদি তিনি তাঁর কাহিনিটা বলতে থাকেন। লোকে তাঁকে ঘরের মধ্যে আটকে রাখবে…তবু, অপরাধ স্বীকার করে জনসাধারণের দেওয়া অপমান নিজের ঘাড়ে তুলে নেওয়াই তাঁর কর্তব্য প্রকাশ্যে প্রায়শ্চিত্ত করার প্রযোভনীয়তা রয়েছে তাঁর। স্বর্গ আর মর্ত্য দু’জায়গাতেই পাপের কথা স্বীকার করার জন্যে ভগবান মানুষকে নির্দেশ দিয়েছেন। যাই তিনি করুন না কেন, যতক্ষণ না তিনি তাঁর পাপ স্বীকার করছেন ততক্ষণ তিনি নিজেকে পরিচ্ছন্ন করতে পারবেন না। পাপ! অবহেলায় কাঁধ কোঁচকালেন তিনি। বেসিল হলওয়ার্ডের মৃত্যুটা তাঁর কাছে কিছু নয়। তিনি ভাবছিলেন হেটি মার্টনের কথা। কারণ তাঁর হৃদ্যমুকুর–যার দিকে তাকিয়ে নিজেকে বোঝার চেষ্টা করছিলেন তিনি–সেই মুকুরটা ভেজাল। দম্ভ? কৌতূহল? প্রবঞ্চনা? তাঁর তথাকথিত আত্মত্যাগের মধ্যে সত্যিকার কিছু আর কি নেই? আরো কিছু ছিল–অন্তত তাই তিনি ভেবেছিলেন। কিন্তু কে বলবে না। আর কোনো প্রবৃত্তি ছিল না। দম্ভের খাতিরেই তিনি মেয়েটিকে ছেড়ে দিয়েছেন। প্রবঞ্চনা করার প্রয়োজনে তিনি ভালোমানুষের মুখোশ পরেছেন। কৌতূহলই তাঁকে আত্মত্যাগে প্ররোচিত করেছে। এতক্ষণে সব বুঝতে পারলেন তিনি।
কিন্তু এই হত্যা? এটা কি চিরজীবন তাঁর পিছু পিছু ঘুরবে? চিরদিনই কি অতীতের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে তাঁকে? সত্যিই কি শেষ পর্যন্ত তাঁক সবকিছু স্বীকার করতে হবে? কক্ষণো না কিছুতেই না। তাঁর অপরাধের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেওয়ার জন্যে মাত্র একটা জিনিস এখনো বেঁচে রয়েছে। সেটা হল ওই প্রতিকৃতি। হ্যাঁ, ওটাই হল শেষ সাক্ষী। ওটাকেই তিনি নষ্ট করে ফেলবেন। ওটাকে এতদিন তিনি রেখেছেনই বা কেন? একদিন ছবিটা দেখে তিনি আনন্দই পেতেন। কেমন করে ওটা দিন-দিন পালটে যাচ্ছে, বৃদ্ধ হচ্ছে দিন-দিন তাই তিনি দেখতেন। সম্প্রতি সেরকম কোনো আনন্দ আর তাঁর হয় না। ওটার কথা ভেবে ভেবে দুশ্চিন্তায় সারা রাত তিনি জেগে থাকেন। বাইরে গেলে ভয়ে তাঁর বুকটা ধড়ফড় করে–পাছে কেউ যদি তাঁর অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে সেই ছবিটা দেখে ফেলে এই আশঙ্কায় সব সময় তিনি বিব্রত হয়ে থাকেন। তাঁর অনেক আনন্দের মুহূর্তগুলি এইভাবে বরবাদ হয়ে গিয়েছে। বিবেকের মতো ওটা তাঁকে চাবুক কষাচ্ছে। হ্যাঁ; ওটাই যেন তাঁর বিবেক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওটাকে তিনি ধ্বংস করে ফেলবেন।
চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন তিনি। যে ছোরা দিয়ে বেসিলকে হত্যা করেছিলেন সেই ছোরাটা তাঁর চোখ পড়ে গেল। ওটাকে তিনি অনেকবার পরিষ্কার করেছেন। এখন আর কোনো চিহ্ন নেই ওর গায়ে। চকচক করছে ছোরাটা। ওটা একদিন চিত্ৰকরকে হত্যা করেছে; এখন হত্যা করবে তাঁর ছবিকে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর অতীত নিহত হবে। তারপরেই তিনি মুক্ত, স্বাধীন। এই ভয়ঙ্কর আত্মিক জীবনটা ধ্বংস হয়ে গেলে প্রতিদিন যে সতর্কতার বাণী ও উচ্চারণ করছে তা চিরদিনের জন্য স্তব্ধ হয়ে যাবে। শান্তি আসবে তাঁর জীবনে। তিনি ছোরাটাকে তুলে নিয়ে ছবিটার বুকে বসিয়ে দিলেন।
একটা আর্তনাদ শোনা গেল; সেই সঙ্গে একটা জিনিস ভেঙে পড়ার শব্দ হল, আর্তনাদটা যন্ত্রণার আর্তিতে এতটা জোরালো হয়ে উঠল যে ঘুম ভেঙে গেল চাকরদের। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে নিঃশব্দে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল তারা। নীচে পার্কের ভেতর দিয়ে দুটি ভদ্রলোক যাচ্ছিলেন। সেই আর্তনাদ শুনে তাঁরাও থমকে দাঁড়ালেন তাকিয়ে দেখলেন সেই বিরাট বাড়িটার দিকে। হাঁটতে-হাঁটতে একটা পুলিশের সঙ্গে দেখা হল তাঁদের। তাকে সঙ্গে নিয়ে এলেন তাঁরা। পুলিশের লোক বারবার বেল বাজাল; কোনো উত্তর এল না ভেতর থেকে। একেবারে ছাদের কয়েকটা জানালা থেকে কিছুটা আলো বাইরে ছড়িয়ে পড়েছিল। ওইটুকু ছাড়া গোটা ঘরটাই অন্ধকারে ঢাকা। কিছুক্ষণ পরে লোকটি সেখান থেকে সরে গিয়ে পাশের একটা বারান্দার ওপরে দাঁড়িয়ে বাড়িটাকে দেখতে লাগল।
দুজনের মধ্যে বয়স্ক ভদ্রলোকটি জিজ্ঞাসা করলেন, বাড়িটা কার কনস্টেবল?
মিঃ ডোরিয়েন গ্রের স্যার।
ভদ্রলোক দুটি দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন না করে পরস্পরের দিকে একবার তাকিয়ে নাসিকা কুঞ্চিত করে নিজেদের পথ ধরলেন। তাঁদের মধ্যে একজন হচ্ছেন স্যান হেনরি অ্যাসটনের কাকা।
বাড়ির ভেতরে যেখানে চাকররা থাকে সেখানে নীচু গলায় আলোচনা শুরু হল। বৃদ্ধা মিসেস লিফ নিজের হাত মোচড়াতে-মোচড়াতে কাঁদতে লাগলেন; ভয়ে নীল হয়ে গেল ফ্রান্সিস। কী যে ঘটল কেউ তা বুঝতে পারল না।
মিনিট পনেরো পরে সহিস আর একজন চাকরকে সঙ্গে নিয়ে সে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেল। দরজায় ধাক্কা দিল তারা। ভেতর থেকে সাড়া পাওয়া গেল না কারো। তারা চিৎকার করে ডাকল। চারপাশ চুপচাপ। দরজা খোলার ব্যর্থ চেষ্টার পরে, তারা ছাদের ওপরে উঠে লাফিয়ে পড়ল বারান্দায়। গ্রিল পুরানো হওয়ার ফলে, জানালাটা সহজেই খুলে গেল।
ভেতরে ঢোকার পরে প্রথমেই নজরে পড়ল তাদের মনিবের প্রতিকৃতির দিকে। প্রথম যেদিন ছবিটিকে তারা দেখেছিল, যৌবন আর সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে সেই ছবিটি তখনো ঠিক তেমনিভাবেই ভাস্বর হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর দেখল মেঝেতে পড়ে রয়েছে একটি মৃতদেহ; পরনে তার সান্ধ্য পোশাক বুকের মধ্যে আমূল বিদ্ধ একটা ছোরা। শরীরটা তার শুকনো; গোটা গায়ে তার বার্ধক্যের কুঞ্চন; দেখলে ঘৃণা হয় মানুষের; কদাকার হাতের আঙটিটা পরীক্ষা করার আগে তারা কিছুতেই বুঝতে পারেনি ওই মৃত কদাকার মানুষটি আসলে কে?