৪
রাত কত ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। পৃথু, অকাজে কোনওদিনও এত রাত করে বাড়ি ফেরেনি। কাজেও যদি রাত হয়েছে, তখনও রুষার পারমিশান্ নিয়েই গেছে। আজকে নির্ঘাৎ ওর কোর্ট-মার্শাল হবে।
জমিটা এবং বাড়িটাও রুষারই নামে। রুষার ব্যাচেলর বড়মামার সম্পত্তি ছিল। রুষাকে দিয়ে গেছেন উনি। কথায়-কথায়ই রুষা পৃথুকে আজকাল গেট-আউট করে দেয়। বলে, এক্ষুণি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও।
ও বলে, পৃথু শোনে। কিন্তু আজ অবধি সত্যি সত্যি বের করে দেয়নি। যে স্বামী, বলতে গেলে প্রায় স্ত্রীর আশ্রয়েই থাকে; তাকে মাঝে মাঝে দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতিতে পড়তে যে হয়ই এই সরল সত্যটিকে পৃথু অম্লান বদনে মেনে নিয়েছে। সত্য যা, তাকে মেনে নেওয়াই ভাল। এই রাতেই বোধহয় সেই গৃহনির্গমনের অশুভ মুহূর্তটি ঘনিয়ে আসছে।
বাড়ির কাছাকাছি আসতেই খুব ভয় করতে লাগল পৃথুর। নিজের জন্যে যতখানি নয়, এস. ডি. ও. সাহেবের জন্যে তার চেয়েও বেশি। রুষার চিৎকার চেঁচামেচিতে এস. ডি. ও. সাহেবের মেমসাহেব হঠাৎই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে তাঁর উপর হামলা চালাতে পারেন। দুর্বল চিত্ত সব স্বামীদেরই কি প্রকৃতির পরিহাসে অত্যন্ত সবলচিত্ত স্ত্রী জোটে কপালে? এই বাবদে পৃথু এস. ডি. ও. সাহেবের একজন সমব্যথী। কী যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে কভু আশীবিষে দংশেনি যারে? এস. ডি. ও. সাহেবের বিপুলা স্ত্রী যখন গুড়ের হাঁড়িতে পড়ে-যাওয়া নেংটি ইঁদুরের মতো চেহারার সাহেবকে ‘ডাস্ট্’ করেন, ‘থ্রাশ্’ করেন তখন পাথরের চোখেও জল আসে। পৃথুর যা হয় হোক, এস. ডি. ও সাহেবের প্রাণটা বাঁচা খুবই দরকার। কারণ প্রাণটা সাম্প্রতিক অতীত থেকে ভদ্রলোকের কাছে হঠাৎই খুব দামী হয়ে উঠেছে। আগামী মাসেই তাঁর প্রি-প্রমোশন সি-সি-আর ফাইন্যাল হবে। তিনি এ-ডি. এম. হলেও হতে পারেন এবারে। ডাইরেক্ট রিক্রুট তো নন। এইরকম ‘প্রেগন্যান্ট উইথ পসিবিলিটিজ-এ’র সময়ে নিজের মৃত্যুর দুঃখটা ভদ্রলোককে বড়ই বাজবে।
গেটটা খোলা। আশ্চর্য! আলোও জ্বলছে না, বাগানে, বা বাগানের শেষে বসবার ঘরে ঢোকার দরজার সামনেও নয়।
ব্যাপার কী বুঝতে পারল না। না বোঝার অন্য কারণও ছিল। ওর অবস্থা এখন তুরীয়। ঠিক এইরকম কোনও অনুভূতির শরিক ও আগে কখনওই হয়নি।
রুষা কি বাড়ি নেই? ডাকাত পড়েছিল কি? নাকি, বসবার ঘরে ওর জন্যে জেগে বসে বসে সে ঘুমিয়েই পড়ল, ঈসসস। নিজেকে নিজে লাথি মারা যায় না, গেলে, মারত পৃথু। রুষা! বেচারী।
চামারটোলীর দিকের মহল্লার প্রায় সব কুকুর-কুকুরীকেই পৃথু চেনে। এখন কার্তিক মাস। কুকুর আর চোরা-শিকারিদের মরশুম।
দরজাটা বন্ধই। দরজায় এসে যখন কড়া নাড়ল, তখন কেউ যে ওর জন্যে সহাস্য অভ্যর্থনায় দাঁড়িয়ে থাকবে না, তা ও জানত। কখনও সখনও মদ খেয়ে এলে, ওর বুকে তাও একটু সাহস থাকে। ভাবে, আজও খারাপ ব্যবহার করলে একটা ইস্পার-উস্পার হয়ে যাবে। মদ বোধহয় শরীরকে উত্তেজিত করে। বোধহয় নয়; নিশ্চয়ই করে। তবে কালে-ভদ্রেই খাওয়া হয়। নেমন্তন্ন থাকলেও রুষা কোথাওই প্রায় যায় না, গেলেও এসব খায় না। এবং পৃথু যে খায়; তাও পছন্দ করে না। মদ তো উত্তেজিত করে কিন্তু সিদ্ধি? সিদ্ধি শরীরকে কী করে? সিদ্ধি বোধহয় শরীরকে হাপিস্ না করলেও বিলক্ষণ নিস্তেজ করে দেয়। সিদ্ধি; সিদ্ধ করে।
গণ্ডার এবং খাণ্ডার রমণীদের সামনে সাহস দেখানো অতীব মূর্খের কাজ। যাঁরাই পৃথুর মতো অসহায় অবস্থায় মাঝে মাঝে পড়েন সেই সমস্ত হতভাগ্য স্বামীদের প্রত্যেককেই একটি অনুরোধ করবে ভাবে, পৃথু। অনুরোধ করবে, সিদ্ধি খেতে। স্বয়ংসিদ্ধ হবার এমন চমৎকার পথ আর নেই।
ব্যোম্শংকর।
সারা বাড়িটা অন্ধকার। ভাগ্যিস সামান্য চাঁদের আলো ছিল।
দরজায় ধাক্কা দিল পৃথু। ধাক্কা দিতেই উল্টোদিকের বাড়ির বারান্দা থেকে এস. ডি. ও. সাহেবের পেডিগ্রী, ধব্ধবে শাদা জোয়ান অ্যাল্শেসিয়ান এবং চামারটোলির লালমাটির রাস্তায় রাতময় ঘুরে-বেড়ানো বিনিমাইনের পাহারাদার বেজন্মা নেড়ী কুত্তার দল একই সঙ্গে ঘেউ ঘেউ করে উঠল।
নেড়ীরা মুদারায়; অ্যাল্সেশিয়ান তারায়।
পৃথু ভাবল, পাথর তুলে মারে। তারপর ভাবল, ব্যাপারটা বড়ই নিষ্ঠুরতা হবে। মাসটা কার্তিক। ও কারও মিলনেই বাধা দেয়নি, দেয় না। খামাকা কুকুরদের মিলনেই বা দেবে কেন?
দরজাটা নিঃশব্দে ভিতর থেকে খুলে গেল। এবং খুলে যেতেই, পৃথুকে প্রায় গোঁত্তা মেরেই একটা গাঁট্টা-গোঁট্টা নর্-পাট্টা পেল্লায় শুয়োর সাঁ করে বেরিয়ে এল ভেতর থেকে। পৃথু তার ছড়িয়ে পড়া বুদ্ধির টুকরো-টাক্রাগুলোকে কুড়িয়ে নিতে না নিতে শুয়োরটা ঠিক শুয়োরেরই মতো ঘোঁৎ ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে দৌড়তে লাগল। দৌড়তে দৌড়তে পড়্ তো পড়্ সোজা পড়ল গিয়ে একেবারে কার্তিক মাসের দারুণ দুর্দৈবে জোড়া-লেগে-যাওয়া এক জোড়া থম্কানো-পুলকের ঘাড়ে। বেচ্চারারা অসহায় অবস্থায় ঘ্যাঁকাৎ! ঘ্যাঁকাৎ! ঘ্যাঁকাৎ! বলেই তিনপাক ঘুরে গেল।
শুয়োরটা তীব্রগতিতে ভেজা ধুলো আর শুকনো পাতা মাড়িয়ে ছুটে গেল মহুয়াটিলার দিকে।
যাক্গে।
শুয়োরটাকে চেনার ইচ্ছা পৃথুর আদৌ ছিল না। শুয়োরদের আবার চেনাচিনি কী? শুয়োরের আমি, শুয়োরের তুমি তো হয় আর হয় না। ভাবল, পৃথু।
আল্তো করে ঠেলা মারতেই ভুতুড়ে শব্দ করে, বন্ধ হয়ে যাওয়া গভীর রাতের দরজাটা আবার খুলে গেল। রুষ দরজার কবজায় ওকে পোড়া মবিল দিতে বলেছিল বার বার। মনে পড়ল পৃথুর। ভুলেই গেছে। ইস্স্…আছে কপালে।
বসবার ঘরে ঢুকে দেওয়াল হাতড়ে সুইচ্ টিপতেই আলো জ্বলে উঠল।
তাহলে লোডশেডিং হয়নি!
আশ্চর্য। ঘরের ভিতরেও কেউই নেই। পৃথু দরজাটা বন্ধ করল। রুষা এবং টুসুর ঘরের কাছে গিয়ে ডাকল, রু…।
বন্ধ দরজা, অন্ধকার ঘরের ভিতর থেকে গাঢ় ঘুমের ভারী নিশ্বাসের ঘষটানো শব্দ এল। ওর হঠাৎই মনে পড়ল, মিলি আর টুসু চলে গেছে মণিবাবুদের বাড়ি। ঝুম্কিরা এসেছে পরশু কলকাতা থেকে; তাই। কাল ভোরে ফিরবে ওরা।
রুষা একা ছিল?
ইয়েস। রুষা একা ছিল। মাথার মধ্যে যেন কে বলল।
থাকুক। পৃথু ভাবল। ও নিজে তো চিরদিনই একা। রুষাও একটু থাকুক। মাঝে মাঝে একা না থাকলে মানুষের মানুষী বুদ্ধিগুলো সব নষ্ট হয়ে যায়। বুদ্ধি-সুদ্ধি শুয়োরের মতো হয়ে যাবার প্রবণতা দেখা দেয়।
সন্ধেবেলা ও যখন রাতমোহানার দিকে যাওয়ার জন্যে বাড়ি থেকে বেরোয় তখন কি রুষা বাড়ি ছিল? তাকে কি বলে গেছিল পৃথু যে, ফিরতে রাত হবে ওর? কে জানে? কিছুমাত্রও মনে পড়ছে না। কোনও কথাই। মস্তিষ্কর মধ্যে দুর্ভেদ্য ঝাঁটি-জঙ্গল গজিয়ে গেছে যেন। মাত্র দুটি ঘণ্টায়। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সকলে সিদ্ধি খেলে অ্যাফরেস্টেশ্ন দ্রুত হবে। নাঃ, কিছুই মনে পড়ছে না। মনে পড়ছে শুধু বিজ্লীর কথা, শুধুই বিজ্লীর কথা। ওঃ বিজলি। আঃ বিজলি। বড় পিপাসা পেয়েছে।
শরীর পৃথুর যাইই বলুক না কেন, মন বলছে, সিদ্ধির নেশাটা ভারী ভাল নেশা। মন মেজাজ কেমন ঠাণ্ডা, পৃথিবীশুদ্ধ সকলকেই ক্ষমা করে দিই ক্ষমা করে-দিই ভাব। পৃথু নিজেকে তবুও শুধোল, নিরুত্তাপে; রুষা! আমার বউ, আমার লোকাল এবং পার্মানেন্ট গার্জেন কি…কিছু…হুজ দ্যাট পিগ? পৃথুর বউ-এর সঙ্গে এতরাতে সে কি বউ-বর খেলতে এসেছিল? একেই বলে ডলস্-হাউস।
কে বউ? কার বউ? দুদিনের এই পৃথিবী!
মনে পড়ে গেল। ঠিক সময়ে। কবি-সম্মেলন শেষ হয়ে যাওয়ার পর ডঃ চৌধুরীকে নিয়ে এসেছিলেন হাটচান্দ্রার “বেঙ্গলী ক্লাব”। চমৎকার বক্তৃতা দিয়েছিলেন ডঃ চৌধুরী। বক্তৃতা শেষ করার সময় বলেছিলেন, আনন্দম্! আনন্দম্! আনন্দম্!
খুব ভাল লেগেছিল পৃথুর। উনি বলেছিলেন, সবসময় আনন্দে থাকতে হয়। আনন্দে থাকবে।
আনন্দম্!
ব্যোম্শংকর।
“দেওয়া-নেওয়া ফিরিয়ে দেওয়া জনম জনম এই চলেছে তোমায় আমায়, মরণ কভু তারে থামায়?” গানটা ভগবানকে নিয়ে। বিজ্লীর খোদা। “রভীন্দর্ সংগীত”। রুষা ঠাট্টা করে বলে। ও ভোপালের মেয়ে। রবীন্দ্রসঙ্গীত পছন্দ করে না। তাতে কী হয়েছে? প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত মতামতকে শ্রদ্ধা করার আরেক নামই তো শিক্ষা। ফাদার টমকিন বলেছিলেন। পৃথু নিজেকে শিক্ষিত বলে জেনে, অন্তত এই মুহূর্তে খুব শান্তি পায়।
সিদ্ধিটা বড় ভাল ছিল হে! সক্কলের ভাল হোক। সকলেই আনন্দে থাকো। রুষা, পৃথু নিজে, পৃথুকে অন্ধকারে পেটে গোঁত্তা মেরে চলে যাওয়া হাট্টা-কাট্টা-নরপাট্টা অচেনা আগন্তুক শুয়োরটা। দৈব-দুর্বিপাকে জোড়া লেগে-যাওয়া, অর্গাজমিক্ আনন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়া জোড়া জোড়া কুকুর এবং কুকুরীরা। আহাঃ! ওদের বোধহয় বড্ড লেগেছে গো।
আর বিজ্লী! আহ্ বিজ্লী। নাঃ বিজ্লী। ঈঃ বিজ্লী। জানি, বিজ্লী, তুমিও বিজ্লীই থাকবে। বিদ্যুৎ চমকের পরই ঘোর অন্ধকার। পৃথু ভাবে।
আসলে, কোনও কিছুই বোধহয় মূল অবয়বে থাকে না। থাকে কি? রুষা নেই। পৃথু, তুমি নিজে নেই। বিজ্লীও থাকবে না। এইই নিয়ম। আদিবাসী ছেলেমেয়েরা জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে লাক্ষা সংগ্রহ করে আনে। তারপর সীড-ল্যাক্। শেলাক্। বাটন্ ল্যাক্, গার্নেট্, ল্যাক্, স্টিক্ ল্যাক্ তৈরি হয়ে চলে যায় সব রাশিয়া, আমেরিকা, চায়না, পৃথিবীর কত কত জায়গায়। আদিবাসী ছেলেমেয়েদের বাঁশির ঘুমপাড়ানি সুর আর মেয়েদের বুকের ঘাম-এর ঝাঁঝাল গন্ধ কিছুমাত্রই বেঁচে থাকে না। সেই বাণিজ্যিক দ্রব্যের মধ্যে। নাঃ। কিছুই থাকে না মূল অবয়বে। পণ্য, চিন্তা, মানুষ নিজেও। অবিরতই রূপান্তর ঘটে চলেছে। গ্রহনক্ষত্র-খচিত অনুভবের ব্রহ্মাণ্ডর মধ্যে, অনুভূতিসম্পন্ন মানুষের মনের মধ্যে। মন তো নয়, যেন এক একটি ক্রসিবল্। কেউই কোনও মুহূর্তেই স্থির হয়ে নেই; থেমে নেই। ভিতরে, বাইরে, দৃশ্যমানে এবং অদৃশ্যে এক প্রচণ্ড সচল অথচ শব্দহীন বিবর্তন ঘটে চলেছে। কখনও কখনও এই নৈঃশব্দ্যর শব্দময়তা পৃথুকে বড় নাড়া দিয়ে যায়।
কখনও কখনও।
জামা-কাপড় ছুঁড়ে ফেলে পৃথু কম্বলের তলায় ঢুকে গেল বাড়িতে পরার পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে। রাত কত কে জানে? কারখানার প্ল্যান্টের ঝিরঝিরে শব্দ এখন শোনা যাচ্ছে। রাত গভীর। বড় রাস্তা দিয়ে জবলপুর আর রায়পুরের দিকে বিপরীতমুখী ট্রাক ছুটে চলেছে মাঝে মধ্যে শীতল কালো হাইওয়ের শিশির ভেজা অ্যাসফাল্টে প্যাচ্প্যাচ্ শব্দ তুলে। পথের দুপাশের গভীর জঙ্গলে শব্দটাকে ধুলোর মতো চারিয়ে দিয়ে। রাতের ধুলো বড় অলস। শিশিরে ভিজে থাকে বলে নড়তে চড়তে চায় মা, পৃথুরই মতো।
গাঢ় ঘুমে এলিয়ে পড়ল পৃথু। অথচ জেগেও রইল। আশ্চর্য এক অনুভূতি। পৃথুর চোখের সামনে কে যেন চাঁদের আলোর মধ্যে নানা রঙা আলোর সুতো টান টান করে টাঙিয়ে দিয়েছে। রূপোলি সুতো টাঙিয়ে, তাতে সোনার গুঁড়ো দিয়ে ক্রমাগত মাঞ্জা দিচ্ছে। বিশ্বকর্মা পুজো কবে গো? শিউলি ফুলের হালকা কমলা রঙ, অগ্নিশিখার গাঢ় কমলা, জীরহল্-এর হালকা বেগুনী, সেই টানটান মাঞ্জা লাগানো বহুবর্ণ সব সুতোর উপর এক এক করে চাপিয়ে দিচ্ছে ডিমের কুসুমগুলে তাতে মিশিয়ে। আর সেই সুতোর ওড়ানো শতরঞ্জির উপর নানা রঙা চাঁদিয়াল আর শতরঞ্জ ঘুড়ি সোঁ সোঁ করে গোঁত্তা খেয়ে খেয়ে পড়ছে এসে।
পৃথুর সব অঙ্গ শিথিল। কোনও সাড়া নেই। ওর হাত ওর হাতে নেই। পুরুষাঙ্গও! হাউ ডেঞ্জারাস! উর্দ্ধাঙ্গ, নিন্মাঙ্গ পুরোপুরি অন্যের হেপাজতে চলে গেছে। কে জানে, কার হেপাজতে? ওর ইমপোটেন্ট বন্ধু শ্যামাপদ কি ধার নিয়ে গেল?
মস্তিষ্ক কিন্তু সজাগ। মস্তিষ্কর বাকুলে আকুলকরা চাঁদের আলোর মধ্যে রূপের হাট মেলে বিজ্লী বসে আছে। একা। শুধুই বিজ্লী। সামনে পিছনে ডাইনে বাঁয়ে আর কেউই নেই। কেন বিজ্লী? বিজ্লী না কুর্চি? কেন? কুর্চি কেন?
হঠাৎই পৃথুর মনে হল, কে যেন তার বাঁ পেট ফাঁসাবে। পাঁজরের কাছে খোঁচাচ্ছে।
কে? কি ব্যাপার? খেয়েছে! শুয়োরটা নাকি?
দাঁত দিয়ে পেট ফাঁসাবে? চাঁপাফুলের গন্ধে চাঁদের আলোয় এমন দেবদুর্লভ সুসিদ্ধ পর্বে এই বেরসিকটি কে? কার এমন আস্পর্ধা যে ঠিক এখনই পৃথুকে খোঁচাখুঁচি করে?
পৃথু পাশ ফিরতে চেষ্টা করল; কিন্তু পারল না। পৃথু আর পৃথুতে নেই। তারপরই পরিচিত হাতের ছোঁয়ায় ও বুঝল যে, রুষা। ওমাঃ।
নাইলনের নাইটি! খরগোশের গা-এর মতো। “ফর হুম্ দ্যা বেল টোল্স” এর র্যাবিট মনে হল পৃথুর।
বিয়ের পর ও খড়কে-ডুরে শাড়ি পরেই শুতে। রুষার মতো কিছু কিছু মেয়ে থাকে, যাদের সব কিছুই বোধহয় লেট্-এ হয়। লেট-এই আসে, নানা আগন্তুক তাদের জীবনে নাইলনের প্যান্টি ও নাইটিরই মতো! রুষা সেরকমই। আধুনিকতাও খুবই দেরি করে এল ওর জীবনে। বাইরের আধুনিকতা। ভেতরে বোধহয় কোনওদিনও তা ঢুকতে পাবে না। জায়গা নেই সেখানে। বাজে জিনিসে বোঝাই। ল্যাজারাস কোম্পানির ফার্নিচার। জার্মানীর রোজেন্থাল্-এর ফ্লাওয়ার-ভাসস্, জাপানীজ ক্রকারি এটা সেটরা এটসেটরা।
জেগেছ? জেগে আছ?
পৃথু নিরুত্তর। মগজ উত্তর দিচ্ছে, দিতে চাইছে। ডাঙায় ভোলা কই মাছের মতো ধড়ফড় করছে। কিন্তু মুখে সাড় নেই। ভয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে সে তার মধ্যের এহেন দুর্বিনীত মানুষটির দুঃসাহসে। চিৎকার করে জবাব দিতে চাইছে। একটিও শব্দ নেই পৃথুর ভাঁড়ারে।
কে ডাকে? রুষ? নাকি নিশির ডাক?
কি হল? জেগে আছ নাকি?
বলেই, পৃথুর কম্বলের নিচে আদুরে বেড়ালনির মতো মসৃণ, পেলব ঢেউ তুলে ঢুকে গেল রুষা।
অনভ্যস্ত পৃথুর বুকের মধ্যে আরও বেশি কষ্ট হতে লাগল।
কে ডাকে? জেগে আছি কি?
কী? কথা বলছ না কেন?
হুঁ।
কোথায় গেছিলে? এত রাত হল?
উত্তর দিল না তবুও পৃথুর মুখ। আবার। জিভে একটুও সাড় নেই। ডেবিট-ক্রেডিট মারাত্মক গড়বর করে মস্তিষ্ক থেকে হঠাৎই একটি শব্দ ছিটকে বেরুল : শুয়োর।
শুয়োর? ওমা! কোথায়?
মগজ বলল : আই নিউ অ্যাজ্মাচ্। ইয়েস্। ডিফারেন্স ইন ট্রায়াল ব্যালান্স।
আতঙ্কিত গলায় রুষ আবারও বলল, বল না? কেমন শুয়োর? সাদা না কালো? সুইস্ না অস্ট্রেলীয়ান? নাকি? ম্যাগো! চামারটোলীর? ম্যাগো! তুমি নিশ্চয়ই ড্রিঙ্ক করে এসেছ। গেছিলে কোথায়? আশ্চর্য।
আশ্চর্য নিশ্চয়ই। কারণ, রুষার গলায় রাগ নেই, বিস্ময় নেই, অভিমান নেই। ভাবল পৃথু।
ইনভেস্টিগেশানের কেস্।
রুষ ঝুঁকে পড়ে মুখের কাছে মুখ নিয়ে মুখ শুঁকল।
হিঃ হিঃ মাই ডার্লিং। সিদ্ধি, স্বয়ং-সিদ্ধ। গন্ধহীন। হুঁ। হুঁ। শোঁকো, শুঁকেই যাও। তবু গন্ধ কিছুতেই বেরুবে না গর্ত । থেকে এপ্রিল ফুল! ওগো গন্ধ গোকুল!
পৃথু মুখ ফস্কে বলল, উঁহু!
কেমন দেখতে! শুয়োরেরই মতো?
রুষার মুখের রঙ কি বদলে গেল? অন্ধকার ঘরে দেখা গেল না। একজোড়া লাল আপেলের মতো তার বুক-দুটি জোরে জোরে ওঠানামা করতে লাগল।
কাঁপা কাঁপা ভয়-পাওয়া গলায় বলল, সত্যি?
তারপরই বলল, ওমা! শুয়োর? অবাক করলে। বাড়ির মধ্যে থেকে বেরুল! কী যে বলো!
পৃথুর মস্তিষ্ক নিরুচ্চারে বলল, ওহে মূর্খা! শুকরীর কাছে কি বাঘ আসে?
মুখ, তখনও বিমুখ।
নীরবতা! দীর্ঘ নীরবতা। দীর্ঘতর নীরবতা!
ক্ষমা। শুকরদের প্রতি ক্ষমা। বরাহজাতিকে ক্ষমা!
মেরী, মেরী, মেরী বলে নাইটির ফাঁস আঁটতে আঁটতে ঘরের আলো জ্বেলে রুষা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে নিমেষে। ঘর থেকে; যে ঘরের জোড়া খাটে প্রেমের কফন্ শোয়ানো আছে কালো কাপড়ে ঢাকা। খালি চোখে দেখা যায় না।
মেরী!
কে এই মেরী? মেরী মেরী কোয়াইট্ কনট্রারী?
মেরীর গলাও শোনা গেল। চোখে এখনও দেখা হয়নি। গলা ভাল। সি-শার্প-এ বলে। গভীর রাতেও। এস. ডি. ও-র ডিম ফুটে, খাণ্ডেলওয়াল সাহেবের আর এ. ডি. এম. হওয়া হল না। সব ডিম থেকে ডি. এম. হয় না। হওয়া উচিতও নয়। ক্যুড নট্ কেয়ারলেস্।
মেরী মেরী কোয়াইট কনট্রারী খুব সম্ভব কাল সন্ধে থেকেই বহাল হয়েছে। সেরকমই কথা ছিল। ছিল কি? সিদ্ধি, মনের সব সুতো নিয়ে গুটিয়েছে মনের লাটাইয়ে। টাইট্ করে। হাঁটি, হাঁটি পা পা। টাইট-রোপ্ওয়াকিং। এন্ড দ্যাট টু ইন স্লিপ্। ইন স্লীপ।
বিজ্লী। হাই। ওপাশে দাঁড়িয়ে হাতছানি দিচ্ছে। সী উ্য এগেইন্। কিছুক্ষণ পর রুষা ফিরে এসে লাইট নিবিয়ে দিয়ে বলল, যা ভেবেছিলাম। তুমি ঠিকই বলেছ।
পৃথুর মুখ বলল, কি কি?
মন বলল, ইয়েস! আমি সব সময় ঠিকই বলি।
শুয়োর।
এটা কী পিগারী? ঘরের মধ্যে শুয়োর!
ছিঃ ছিঃ। ন্ ন্না। ঘরের মধ্যে কেন, ঘরের মধ্যে নয়।
নয়?
ঘরে নয় গো। পিছনে।
পেছনে? শুয়োর? হাউ ডেঞ্জারাস্।
আঃ! পিছনের কপিক্ষেতে।
পৃথুর কানে এই ‘গো’ কথাটা নতুন শোনাল। বিয়ের পর পর কিছুদিন যখন ভালবাসা বেঁচেছিল, বেঁচেছিল ঢং-ঢাং, পারফ্যুমের গন্ধ, চোখ-চিবুকের চকিতচুমু ফষ্টিনষ্টি, তখন স্বল্পদিন রুষা এমন করে “হ্যাঁ গো”, “না গো” বলত। এখন ভান করছে। কোনও অন্যায় করলেই করে। রুষাটা দু’নম্বর হয়ে গেছে। ভেরী স্যাড।
পৃথু নিশ্চিত হল, যে শুয়োর এসেছিল। শুয়োরের, নাম হারাম। শুয়োরের মেয়ের নাম হারামজাদী! কজন জানে?
রুষা আবার বলল, পিছনের কপিক্ষেতে এসেছিল। জান গো, একেবারে তচ্নচ্ করে গেছে। বোধ হয় মেরীর, মানে…
পৃথুর দু’ চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছিল। মানে, মেরীর কপিতে। কচ্কচ্। তচ্নচ্।
তুমি জেগে ছিলে নাকি আমারই জন্যে? মানে, ফিরিনি বলে? তা আমার বদলে শুয়োরটা এল? পৃথুর কথা ফুটল এতক্ষণে। এনাস্থেসীয়ার ঘোর কাটার মতন মনে হল। সিদ্ধি, চৈতন্যের স্টপকক্ খুলে দিল, নিজেরই খেয়ালে।
না। দুটো ক্যাম্পোজ খেয়েছিলাম। বড় টেন্সানে আছি। রুষা বলল।
কেন?
বাঃ! কাল আমাদের ‘শো’ না? ত্রিপাঠি হলে। কিন্তু শুনছি, তার কাছেই বাঈজী নাচ হবে। জবলপুর, থেকে বাঈজী আসছে। আনিয়েছেন মিসেস চক্রবর্তীর লোকেরা, যাতে আমাদের ‘শো’ ডিস্ক্রেডিটেড হয়। হাইট অফ্ মীননেস্। যেখানে বাঙালি, সেখানেই দলাদলি। অ্যাভারেজ বাঙালিরা এখন যা আন্কালচারড্ হয়ে পড়েছে যে, দেখবে সকলেই হয়ত আমাদের “শো” ছেড়ে বাঈজীদের নাচ-গান শুনতেই চলে যাবে। বাঈজীর খেমটা নাচ দেখতে যাবে। নামেই বাঈজী, গানেওয়ালী। আসলে তো বাজনাও বাজায়।
বাঙালির থাকার মধ্যে ছিল এক কালচার, তাও গেল।
না, না। যেতে দিও না। শক্ত করে ধরে রাখো।
হুঁ! আমার হাতে আর কতটুকু জোর?
তোমাদের “শো”তে কী হবে?
ভদ্রলোকদের “শো”তে যা হয়। যা হওয়া উচিত। মিসেস চ্যাটার্জী পিয়ানোতে মোৎজার্ট বাজাবেন। টুসু এবং ওদের চেয়ে বড় বয়সী যারা, তাদের অর্কেস্ট্রা আছে। পিয়ানো, অ্যাকোর্ডিয়ান, গীটার, বঙ্গো, ড্রাম ইত্যাদি নিয়ে। মিলিদের স্কুলের মেয়েরা একটা ইংলিশ ড্রামা করবে। মিসেস রোহ্তাগী ডাইরেক্ট করবেন। লিখেছেনও উনি। ডি সি আসছেন সস্ত্রীক। তাঁর স্ত্রী আর্ট ফিল্মের সমস্যার উপরে কিছু বলবেন। অপর্ণা সেন ওঁর পিসতুতো বোনের কীরকম ডিসন্ট্যান্ট্ রিলেশান্ হন যেন! ন্যাচারালী, শী নোজ্ কোয়াইট আ লট্ বাউট্ দ্যা ওয়র্লর্ড অফ্ আর্ট-ফিল্মস্—!
পৃথুর চোখের পাতা বুঁজে আসছিল।
শ্রাবণী ওপেনিং সং গাইবে, “ও গঙ্গাআ তুমি-ইই বইচোও কেন ও ও ও ও…”। তোমার কিন্তু যেতেই হবে। আমি আমাদের সমিতির অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারী। আমার আবদার।
পৃথু শুনল, অর্ডার। আবদারে আদৌ অভ্যস্ত নয় ও।
যাবে তো! কাল তো রবিবার।
আমার তো এখন রোজই রবিবার।
পৃথুর মাথার ঘন কালো চুলে হাত দিয়ে বিলি কাটতে কাটতে হাত বুলিয়ে রুষা বলল, ঈসস্, চুলগুলো কী বড় হয়ে গেছে গো। হ্যাভ্ আ নাইস্ হেয়ারকাট্।
একটু চুপ করে থেকে বলল, অ্যাই শোনো। সাদা একটা ট্রাউজার বের করে দিয়ে যাব। সঙ্গে ইয়ালো-ইয়কার শার্টটা। ফুলহাতা শার্টটা পরে যাবে কিন্তু, যেটা দেব। বুজেচো? আর তার উপরে সেই ভোপালে বানানো কোটটা। হাফ-হাতা শার্টের সঙ্গে কোট পরবে না, কেরানী কেরানী লাগে। ম্যাচিং টাইও বের করে দেব। শ্যাবী ড্রেস-এ যাবে না। আমার প্রেস্টিজই থাকবে না তাহলে।
আমাকে কি এই জন্যেই জাগালে?
ঠিক এই জন্যে নয়।
তাহলে?
কী আর বলব। এত বছর বিয়ে হল, এখনও যদি…। তুমি যেন জান না? শেষ রাতেই…আমি…।
অন্ধকারে গায়েব হয়ে যাওয়া হোঁৎকা শুয়োরটার পশ্চাৎদেশ লক্ষ্য করে ছোটবেলা থেকে শেখা যত অশ্রাব্য গালাগালি ছিল সব নিরুচ্চারে উগরে দিল পৃথু। ঝাঁক ঝাঁক তীরের মতো গালগুলি ছুটতে লাগল শুয়োরটার পিছন পিছন। তার গুহ্যদেশ নির্মমভাবে বিদ্ধ করবে বলে।
আমার মন কখন কি চায় তার…
তুমি মনের কথা বলছ? পৃথু বলল। মনের কথা রুষা?
তারপরই, নিজের পায়জামার দড়ি ধরে এক টান লাগাল। ব্যোমশংকর।
রিপু অথবা অনুশোচনা-তাড়িত ক্বচিৎ-রুষা পাশ ফিরে উদাস পৃথুর শরীরের উপর তার আধখানা উদোম্ উচ্ছিষ্ট শরীর উপুড় করে দিল। উচ্ছ্বাসে।
কিন্তু শুয়োরটা কার? যে কপি খেতে এসেছিল? ভাবছিল পৃথু। কার কপিক্ষেতে?
মুখ হঠাৎ বলল, আচ্ছা! কী কপি? ফুল না বাঁধা?
রুষার বাম স্তনবৃন্তে তর্জনী দিয়ে তাড়ন করতে করতে পৃথু শুধোল।
ফিল্ম ফেস্টিভালের একটি ফরাসী ছবিতে এইরকম আদর দেখেছিল। অনেকদিন আগে। কোলবালিশের উপর শ্যাডো-প্র্যাকটিস্ করে করে আঙুল পাকিয়েছে।
তারপরই হল এক কাণ্ড! কাণ্ড বলে কাণ্ড! ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে দু’ হাতের পাতা, পাতায় পাতায় জড়ো করে, পৃথুকে দু পাতার মধ্যে নিয়ে স্বর্ণচাঁপাকে দেখতে দেখতে গ্রাণ্ড ম্যাগ্নোলিয়া গ্রান্ডিফ্লোরা করে তুলল রুষা।
নারীদের আসলে বোধ হয় কোনও শ্রেণীভেদ নেই। পৃথুর মনে হল। এক নারীই বিভিন্ন পুরুষের অঙ্কশায়িনী হয়ে বিভিন্ন রাতে পদ্মিনী, হস্তিনী বা শঙ্খিনী হয়ে ওঠে। বহুরূপীর মতো। অঙ্কশায়িনী নারীর অঙ্কর উত্তর কখনও মেলে, কখনও মেলে না।
রুষা, উথাল-পাথাল, ভারী উষ্ণ নিঃশ্বাসের সঙ্গে বিরক্তির গলায় বলল, এত বছরেও…চিনলে না, সত্যি!…চিনলে না তুমি না…ইন্করিজিবল্…
পৃথু মুখে কিছু না বলে সমস্ত মনকে কেন্দ্রীভূত করে ভেড়া গুণতে লাগল। এখন কথা বলার সময় নয়, স্বামীদের প্রাণান্ত পরিশ্রম ও প্রচণ্ড বিপন্নতার কন্সেনট্রেশানের সময় এখন। কন্সেনট্রেশান্ যার নেই; তার কোনওদিনই সিদ্ধিলাভ হয় না। ইয়েস্। সিদ্ধি খেলেও না। পৃথু বিষন্ন, বিপন্ন হয়ে ভাবছিল, জীবনে কোনও একটা, একটামাত্র ব্যাপারও কি টেন্শান-ফ্রী হতে পারত না? পরীক্ষা সবসময়ই?
না, না, কথা নয়। অ্যাই চোপ্!
বেড়া ডিঙোচ্ছে এখন ভেড়ারা। দ্রুত বেগে ডিঙোচ্ছে। পাঁচশ, চারশ-নিরানব্বুই, চারশ-আটানব্বুই…
পথ?
যার পথ; সেই-ই চেনায়।
হাত ধরে তুমি নিয়ে চল সখা, আমি যে পথ জানি না।
পৃথু চোখ বন্ধ করে ফেলল। ভয়ে। ভেড়ার ভিড়। তাদের খুরে খুরে ধুলো উড়ছে। দুস্স…লাইন চুজ্ করাই ভুল হয়ে গেছে ওর। মেকানিকাল এঞ্জিনীয়ারিং না পড়ে, অ্যানিমাল-হাজবেন্ড্রী পড়া উচিত ছিল।
চোখ বন্ধ। বিজ্লী ওর সামনে বসে আছে। বিজ্লী? না কুর্চি? চাঁদের আলোয়, নদীর জলের পাশে, গরম ভাত, গাওয়া ঘি, আলু সেদ্ধ, ডিম সেদ্ধর গন্ধর সঙ্গে বিজ্লীর শরীরের আতরের গন্ধ মিশে গেছে। ফির্দৌস? না অম্বর? কোন ঈত্বর?
হবে, একটা।
বিজ্লী না কুর্চি?
শারীরিক নেগেটিভ্ পজেটিভ ততক্ষণে সংযুক্ত হয়েছে। অনেক মননশীলতার পর আলো জ্বলছে। হৃদয়হীন, অনুতাপহীন, বিবেকহীন, উষ্ণতাহীন, প্রেমহীন, কাঠিন্যময় শিরাসমষ্টি কঠিন মনোরম কর্তব্যে ব্যাপৃত হয়েছে।
কর্তব্য! সারাজীবনই কর্তব্য করছে পৃথু! জীবনে কবিতার মতো একটি কবিতাও লেখা হল না। লেখেনি, এই জোড়া খাটেও। ও প্রকৃতই ব্যর্থ কবি।
পৃথু ভাবছিল, এই গলদঘর্ম করুণ কবিতাতেও অন্য অনেক কবিতারই মতো ছন্দ আছে, লয় আছে, কিছু কিছু অন্ত্যমিলও আছে; নেই শুধু প্রাণ। পরিচিত, মৃত, প্রেমহীন পথে তবু ক্লান্তিকর কুচ্কাওয়াজ্। কোম্পানী, আইইজ্ রাইট্! কোম্পানী, হল্ট! স্ট্যান্ড, অ্যাট্ ইজ্!
হঠাৎই দৈববাণীর মতো, ঊষার আলো ফোটার একটু আগেই নৈর্ব্যক্তিক গলায় রুষা বলল : তোমার হলে বোল : আমার হয়ে গেছে।
অ্যাব্সুল্যট্, আলটিমেট স্টেটমেন্ট!
কিছুই করার নেই। স্টেটমেন্ট অফ ফ্যাক্ট। প্রেগন্যান্ট নয়; টোটালী ব্যারেন, ওয়েল, তবু…
পৃথুরও পথ চলা শেষ হল। সব পথই শেষ হয় একসময়। সুরম্য পথ, অগম্য পথ, ফুল-ফোটা, প্রজাপতি-ওড়া পথ; এমনকী কুচকাওয়াজের পথও। বাইরে আলো ফুটল। কী আশ্চর্য সীন্ক্রোনাইজেশান। কী মিক্সিং! ক্যামেরাম্যান সুব্রত মিত্র, সৌমেন্দ্যু রায়রাও লজ্জা পাবেন। একেবারে পারফেক্ট। বিশ্বচরাচর উদ্ভাসিত করে, ভাঁটি-দেওয়া সাগরের ঢেউ যেমন অবলীলায় পেলব তটে গিয়ে মেশে, গুটিয়ে-নেওয়া-পা বুকে করে যেমন অনবধানে জল ছেড়ে উড়ে যায় সাইবেরীয়ান্ রাজহাঁস, ঠিক তেমনি করে পৃথিবী ছেড়ে উড়ে গেল রাত; দিন এল, শীতার্তকে উষ্ণতায় ভরে দিতে।
পৃথিবী অথবা সুর্য এদের কারওই আগে পরের কোনও ব্যাপারই নেই। একজনের সঙ্গে অন্যজন কেমন অণুতে অণুতে পরমাণুতে পরমাণুতে মিশে গেল! বোঝা পর্যন্ত গেল না। একজনের জন্যে অন্যজন দাঁত-কিড়মিড় বিরক্তিতে অপেক্ষা করল না।
সব আরম্ভই বোধ হয় শেষে পৌঁছে আবার আরম্ভেই ফিরে যায়। এবং আরম্ভে পৌঁছে আবারও শেষে!
রুষা বাথরুমে গেল। লাইট জ্বলল। জলের শব্দ হল। ফ্লাশ টানার শব্দ। পৃথু পাশ ফিরে ঘুমোল, কোলবালিশটা টেনে নিয়ে। আরও একটা ঘটনাবিহীন, ম্লান, উদ্দেশ্যহীন দিন যাপনের জন্যে সকালে জেগে উঠবে বলে।