৪. রাজধানীর প্রশস্ত রাজপথ

রাজধানীর প্রশস্ত রাজপথ দিয়া একদল পদাতিক সৈন্য চলিয়াছে। চারিজন করিয়া সারি, সৈনিকদের কাঁধে বন্দুক, কোমরে কিরিচ। তাহাদের আগে আগে অশ্বপৃষ্ঠে সর্দার তেজ সিং চলিয়াছেন। বলিষ্ঠ উন্নত দেহ, বুদ্ধিদীপ্ত গম্ভীর মুখ, মাথায় পাগড়ির আকারে বাঁধা টুপি, সর্দার তেজ সিংকে দেখিলে মনে শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমের উদয় হয়। ইনি রাজ্যের একজন উচ্চপদস্থ সেনানায়ক এবং সম্ভবত রাজসরকারে একমাত্র কর্তব্যনিষ্ঠ ন্যায়পরায়ণ লোক। তাঁহার বয়স ত্রিশের কিছু অধিক।

রাস্তার দুই পাশে লোক জমিয়াছিল, কিন্তু সকলেই নীরব, সকলের মুখেই অপ্রসন্নতার অন্ধকার। প্রতাপকে সৈন্যদল ধরিতে যাইতেছে ইহাতে রাজ্যের আপামর সাধারণ কেহই সুখী নয়। কিন্তু রাজা ও রাজপরিষৎ মহাজনদের মুঠার মধ্যে, তাই রাজ্যের দণ্ডনীতিও প্রকৃত অপরাধীর বিরুদ্ধে প্রযুক্ত না হইয়া সমাজের কল্যাণকামীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হইয়াছে।

পথপার্শ্বের জনতার মধ্যে প্রভু দাঁড়াইয়া ছিল; তাহার মাথার উপর প্রকাণ্ড একটা পাগড়ি তাহার মুখখানাকে একটু আড়াল করিয়া রাখিয়াছিল। সৈন্যগণ মশমশ শব্দে চলিয়া গেল; জনতাও ছত্রভঙ্গ হইয়া আপন আপন পথে ছড়াইয়া পড়িতে লাগিল। কেবল প্রভু বক্ষ বাহুবদ্ধ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

একটি ন্যুব্জদেহ বৃদ্ধ ভিক্ষুক প্রভুর পাশে আসিয়া হাত পাতিল

ভিক্ষে দাও বাবা

প্রভু ভিক্ষুকের দিকে ফিরিতেই ভিক্ষুক চোখ টিপিল।

প্রভু নিম্নকণ্ঠে বলিল,-লছমন?

লছমন বলিল,-হ্যাঁ বাবা, যা আছে তাই ভিক্ষে দাও বাবা— গরীবের পেটে অন্ন নেই, ঘরে ঘরে কাঙালী

প্রভু কোমর হইতে কয়েকটি মোহর বাহির করিয়া লছমনের হাতে দিল, লছমন মোহরগুলি মুঠিতে লইয়া বস্ত্রের মধ্যে লুকাইল।

বেঁচে থেকো বাবা রাজা হও

ছদ্মবেশী লছমন আশীর্বাদ করিতে করিতে চলিয়া গেল।

.

রাত্রিকাল। শহরের উপকণ্ঠে একটি কুটিরের অভ্যন্তর। ঘরের কোণে ম্লান তৈল-দীপ জ্বলিতেছে। একটি অকালবৃদ্ধা অনাহারজীর্ণা রমণী মেঝেয় বসিয়া ছিন্ন কাঁথা সেলাই করিতেছে।

একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ ঘরে প্রবেশ করিতেই রমণী তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইল। পুরুষের চক্ষু কোটর-প্রবিষ্ট, জঠর মেরুদণ্ড-সংলগ্ন, সে টলিতে টলিতে আসিয়া ঘরের কোণে চারপাইয়ের উপর বসিয়া দুহাতে মুখ ঢাকিল। রমণী তাহার কাছে গিয়া উদ্বেগ-ঋলিত কণ্ঠে বলিল,-

এ কি! তুমি একলা ফিরে এলে যে! রমণিক কোথায়?

পুরুষ হাত হইতে মুখ তুলিয়া কিছুক্ষণ উদভ্রান্তভাবে চাহিয়া রহিল—

রমণিক! না, সে ফিরে আসেনি

রমণী ব্যাকুলভাবে পুরুষের কাঁধ নাড়া দিতে দিতে বলিল,–

ওগো, ঐটুকু ছেলেকে কোথায় ফেলে এলে? শহরে গিয়েছিলে শাক-ভাজী বিক্রি করতে, ছেলেকে কোথায় রেখে এলে?

পুরুষ রুদ্ধ কণ্ঠে বলিল,-তাকে—তাকে মহাজনের লোকেরা টেনে নিয়ে গেল

অ্যাঁ—

রমণী সেইখানেই বসিয়া পড়িল, পুরুষ উদভ্রান্তবৎ আপন মনে বলিতে লাগিল,

শাক-ভাজীর ঝুড়ি নিয়ে বাজারে বেচতে বসেছিলাম এমন সময় মহাজনের পেয়াদা এল–ঝুড়ি নিয়ে গেল। সেই সঙ্গে রমণিককেও হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। বলে গেল, যতদিন না শেঠের সুদ চুকিয়ে দিতে পারবি ততদিন তোর ছেলে আটক থাকবে—শুধু জল খাইয়ে রাখব, তাড়াতাড়ি টাকা শোধ করতে না পারিস তোর ছেলে না খেয়ে মরবে।

রমণী উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া উঠিয়া উপুড় হইয়া পড়িল, পুরুষ তেমনি বিহ্বলভাবে বলিয়া চলিল,

কি করব? কোথায় টাকা পাব? কত লোকর কাছে টাকা চাইলাম, কেউ দিলে না। অ্যাঁ–ওকি! ওকি!

রমণী ধড়মড় করিয়া উঠিয়া পুরুষের দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া দেখিল, ঘরের ক্ষুদ্র জানালা দিয়া একটা হাত প্রবেশ করিয়া জানালার উপর কিছু রাখিয়া দিয়া আবার অন্তর্হিত হইয়া গেল। রমণী ব্যাকুলত্রাসে পুরুষের পানে চাহিল।

রমণী ত্রাসবিকৃত স্বরে বলিল,-ওগো, ও কে? কার হাত?

পুরুষ মাথা নাড়িল, তারপর উঠিয়া সঙ্কোচ-জড়িত পদে জানালার দিকে গেল। জানালার উপর দুইটি মোহর রাখা রহিয়াছে, দীপের আলোকে যেন চিকমিক করিয়া হাসিতেছে।

রমণী পুরুষের পিছু পিছু আসিয়াছিল, দুজনে কিছুক্ষণ বুদ্ধিভ্রষ্টের মত মোহরের দিকে চাহিয়া রহিল, তারপর রমণী হাত বাড়াইয়া মোহর দুটি তুলিয়া লইল

ওগো, এ যে সোনার টাকা–মোহর! কে দিলে? কোথা থেকে এল?

পুরুষ যখন কথা কহিল তখন তাহার কণ্ঠস্বর থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল—

বুঝেছি—এ প্রতাপ! আমাদের বন্ধু—গরীবের বন্ধু প্রতাপ।

.

রাত্রিকাল; আর একটি জীর্ণ কক্ষ। একটি পাকা ঘর; কিন্তু দেয়ালের চুনবালি খসিয়া গিয়াছে। একটি ভাঙা তক্তপোশের উপর পাঁচ বছরের একটি শিশু শুইয়া আছে, মাথার শিয়রে কালিপড়া লণ্ঠনের আলোতে তাহার অস্থির দেহ দেখা যাইতেছে। তাহার মা—একটি শীর্ণকায়া যুবতী-পাশে বসিয়া তাহার গায়ে হাত বুলাইয়া দিতেছে। রুগ্ন শিশু বায়না ধরিয়াছে

মা, দুধ খাব খিদে পেয়েছে

মা বলিতেছে,—ছি বাবা, তোমার অসুখ করেছে— এখন ওষুধ খেতে হয়—

শিশু বলিল,–না, ওষুধ খাব না—দুধ খাব

এই দ্যাখো না, তোমার বাপু এখনি তোমার জন্যে কত মুসম্বি আর ওষুধ নিয়ে আসবে— ঘুমিয়ে পড় বাবা

মা শিশুর মাথায় হাত বুলাইয়া দিতে লাগিল, শিশু ঝিমাইয়া পড়িল। শিশুর কঙ্কালসার দেহের দিকে চাহিয়া যুবতীর চোখ দিয়া টপ্ করিয়া জল পড়িতে লাগিল, সে অধোচ্চারিত ভগ্নস্বরে বলিল,-

ভগবান, অন্ন দাও—আমার ছেলে না খেয়ে মরে যাচ্ছে, তাকে অন্ন দাও

ঠুং করিয়া শব্দ হইল। গলদশ্রুনেত্রা যুবতী চুপ করিয়া শুনিল—কিসের শব্দ! আবার ঠুং করিয়া শব্দ হইল। যুবতী তখন পাশের দিকে চক্ষু নামাইয়া দেখিল, মেঝের ওপর চকচকে গোলাকার দুটি ধাতুখণ্ড পড়িয়া রহিয়াছে। অবশভাবে যুবতী সে দুটি হাতে তুলিয়া লইল, একাগ্রদৃষ্টিতে ক্ষণেক তাহাদের দিকে চাহিয়া থাকিয়া সহসা মোহর দুটি বুকে চাপিয়া ধরিল, বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলিয়া উঠিল,-

এ তো আর কেউ নয়— প্রতাপ। প্রতাপ। গরীবের তুমিই ভগবান!

.

পূর্বে বলা হইয়াছে, চিন্তার জলসত্রের পিছনে কিছুদূরে একটি ঝরনা আছে; পাহাড় গলিয়া এই প্রস্রবণের জল একটি ক্ষুদ্র অথচ গভীর জলাশয়ে সঞ্চিত হইয়াছিল। চারিদিকের ঝোপঝাড়ের মধ্যে স্বচ্ছ সবুজ সরোবরের দৃশ্যটি বড় নয়নাভিরাম।

প্রাতঃকালে চিন্তা কলস লইয়া জল ভরিতে যাইতেছিল। নির্জন উপল-বিপর্সিত পথ দিয়া যাইতে যাইতে সে আপন মনে গাহিতেছিল—

মনে কে লুকিয়ে আছে—মন জানে
        মরমের কোন্ গহনে কোন্‌খানে
        মন জানে।
        মনের মানুষ মনের মাঝে রয়
        মনে তাই মলয় বায়ু বয়
        চাঁদ ওঠে ফুল ফোটে বন্ধুর সন্ধানে
        সেকথা কেউ জানে না–মন জানে।

সরোবরের কিনারায় কয়েকটি শিলাপট্ট ঘাটের পৈঠার মত জলে নামিয়া গিয়াছে। চিন্তা কলস রাখিয়া একটি শিলাপট্টে নতজানু হইয়া নিজের চোখে মুখে জল দিল, তারপর কলস ভরিয়া কাঁখে তুলিবার উপক্রম করিল।

সহসা অদূরে মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। চিন্তা কলস না তুলিয়া সচকিতে পিছু ফিরিয়া চাহিল। ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়া দুইজন মানুষ কথা কহিতে কহিতে আসিতেছে; তাহাদের কাঁধে বাঁক, বাঁকের দুই প্রান্ত হইতে বড় বড় তামার ঘড়া ঝুলিতেছে।

মানুষ দুটি স্থূলকায়; মুখে বুদ্ধির নামগন্ধ নাই। তাহারা হাস্য-পরিহাস করিতে করিতে হঠাৎ চিন্তাকে জলের ধারে দেখিয়া থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল, তারপর শঙ্কাবর্তুল চোখ মেলিয়া তাহার পানে চাহিয়া রহিল।

চিন্তা ইতিপূর্বে এই নির্জন অঞ্চলে কখনও মানুষ দেখে নাই, তাই অবাক হইয়া গিয়াছিল; কিছুক্ষণ নীরবে কাটিবার পর সে প্রশ্ন করিল,-

কে তোমরা?

মানুষ দুজন দৃষ্টি বিনিময় করিল, নিজ নিজ ঠোঁটের উপর আঙুল রাখিয়া পরস্পর সতর্ক করিয়া দিল, তাহারা সন্তর্পণে চিন্তার দিকে অগ্রসর হইল। কিছুদুর আসিয়া তারপর আবার দাঁড়াইল, আবার দৃষ্টি বিনিময় করিয়া ঠোঁটে আঙুল রাখিল, তারপর একজন জিজ্ঞাসা করিল,–

তুমি কে?

চিন্তা বলিল—কাছেই পরপ আছে, আমি পানিহারি্ন।

দুইজন তখন স্বস্তির নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বাঁক নামাইল।

প্রথম মানুষ বলিল,-ও-পানিহারিন! আমরা ভেবেছিলাম

দ্বিতীয় মানুষ বলিল,—আমরা ভেবেছিলাম, তুমি পাহাড়ের উপদেবতা

চিন্তা একটু হাসিল, লোক দুটিকে বুঝিতে তাহার বিলম্ব হইল না।

সে বলিল,—কিন্তু তোমরা কোথা থেকে এলে? এখানে কাছেপিঠে কেউ তো থাকে না।

প্রথম মানুষ বলিল,-আমরা ভিস্তি— আমরা—

সে আরও কিছু বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু দ্বিতীয় ভিস্তি তাড়াতাড়ি তাহাকে বাধা দিল,—স্ স্ স।

সঙ্গে সঙ্গে প্রথম ভিস্তি ঠোঁটে আঙুল রাখিয়া শীৎকার করিয়া উঠিল,—স্ স্ স;

প্রথম ভিস্তি তাহার প্রতিধ্বনি করিল,—স্ স্ স্—আমরা এখানে নতুন এসেছি

চিন্তার মন সন্দিগ্ধ হইয়া উঠিল।

ও-তা কাজে এসেছ বুঝি?

প্রথম ভিস্তি বলিল,-কাজ? হুঁ—আমরা এসেছি

দ্বিতীয় ভিস্তি বলিল,-স্ স্ স্—কি কাজে এসেছি তা বলা বারণ। আমরা ফৌজীভিস্তি কিনা—একদল সিপাহীর সঙ্গে এসেছি।

প্রথম ভিস্তি বলিল,-স্ স স—

দ্বিতীয় ভিস্তি বলিল,-স্ স্ স্

চিন্তা আরও উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল—

সিপাহী? কোথায় সিপাহী?

প্রথম ভিস্তি বলিল,-স্ স্ স্—এখান থেকে আধক্রোশ দূরে পাহাড়ের মধ্যে তাঁবু ফেলেছে সর্দার তেজ সিং

দ্বিতীয় ভিত্তি বলিল,—স স স—বেন, তুমি জানতে চেয়ো না, এসব ভারি গোপনীয় কথা—

চিন্তা বলিল,—আমি জানতে চাই না, জেনেই বা আমার লাভ কি? আমি শুধু ভাবছি এই পাহাড়ের মধ্যে এত সিপাহীর কি কাজ?

প্রথম ভিস্তি গম্ভীর মুখে বলিল,—কাজ আছে বেন, ভারি জবর কাজ। সর্দার তেজ সিং পঞ্চাশজন সিপাহী নিয়ে এসেছে

দ্বিতীয় ভিস্তি বলিল,-স্ স্ স্—এসব গোপনীয় কথা

চিন্তা বলিল,-না, তাহলে বোলো না—আমি যাই। আমার কলসী তুলে দেবে?

প্রথম ভিস্তি তাড়াতাড়ি বলিল,—দেব বৈ কি বেন— এই যে

কলসী চিন্তার কাঁখে তুলিয়া দিতে দিতে প্রথম ভিস্তি খাটো গলায় বলিল,–

ভারি গোপনীয় কথা বেন, কেউ জানে না— আমরা প্রতাপ বারবটিয়াকে ধরতে বেরিয়েছি — স্ স স–

আর অধিক সংবাদের প্রয়োজন ছিল না। চিন্তা পাংশু অধরে হাসি টানিয়া ঠোঁটে আঙুল রাখিল, বলিল,-

স স্ স্

উভয় ভিস্তি একসঙ্গে বলিল,—স স স—

চিন্তা আর দাঁড়াইল না, কলস কাঁখে ফিরিয়া চলিল।

.

গিরিচক্রের মাঝখানে একটি ছোট্ট প্রচ্ছন্ন উপত্যকা। তেজ সিং এইখানে শিবির ফেলিয়াছেন। সিপাহীরা ময়দানের মত সমতল স্থান ঘিরিয়া তাঁবু তুলিয়াছে; সর্দার তেজ সিং ঘুরিয়া ঘুরিয়া সকলের কাজ তদারক করিতেছেন। চারিদিকে কর্মব্যস্ততা, কিন্তু চেঁচামেচি নাই।

সিপাহীদের বন্দুকগুলি একস্থানে মন্দিরের আকারে জড়ো করা রহিয়াছে; যেন উহাকে কেন্দ্র করিয়াই এই বস্ত্ৰনগরী গড়িয়া উঠিয়াছে।

চিন্তার পরপের পাশে বংশদণ্ডের মাথায় ছত্রের উপর বসিয়া কপোত দুটি রোদ পোহাইতেছে—পুরুষ কপোতটি থাকিয়া থাকিয়া গলা ফুলাইয়া গুমরিয়া উঠিতেছে।

চিন্তা পরপের প্রকোষ্ঠ হইতে বাহির হইয়া আসিল, তাহার হাতে একটুকরা কাগজ। সে বারান্দার নীচে নামিয়া উর্ধ্বমুখে ডাকিল,

আয়-চুনি—আয়–

পুরুষ কপোতটি তৎক্ষণাৎ উড়িয়া আসিয়া তাহার কাঁধে বসিল। চিন্তা তাহাকে ধরিয়া তাহার পায়ে কাগজটি জড়াইয়া বাঁধিতে বাঁধিতে হ্রস্বকণ্ঠে বলিতে লাগিল,

চুনি—দেরি করো না—শিগগির যেয়ো–তোমার ওপর জীবন-মরণ নির্ভর করছে

চিন্তা দূত-কপোতকে ঊর্ধ্বে নিক্ষেপ করিল। কপোত শুন্যে একটা পাক খাইয়া পক্ষবাণ তীরের মত বিশেষ একটা দিক লক্ষ্য করিয়া উড়িয়া চলিল। যতক্ষণ দেখা গেল, উৎকণ্ঠিত চিন্তা সেই দিকে তাকাইয়া রহিল।

.

অপরাহ্নে প্রতাপের গুহা-ভবনের সম্মুখে ভস্মাচ্ছাদিত আগুন জ্বলিতেছিল। অগ্নিহোত্রীর যজ্ঞকুণ্ডের মত এ আগুন কখনও নেভে না, অতি যত্নে ইহাকে জ্বালাইয়া রাখিতে হয়। কারণ, এই লোকালয়বর্জিত স্থানে একবার আগুন নিভিলে আবার আগুন সংগ্রহ করা বড় কঠিন কাজ।

অগ্নিকুণ্ড ঘিরিয়া প্রতাপ প্রমুখ পাঁচজন বসিয়া ছিল। সকলেই চিন্তায় মগ্ন। প্রতাপ ললাট কুঞ্চিত করিয়া তরবারির অগ্রভাগ দিয়া মাটিতে খোঁচা দিতেছিল; প্রভু গালে হাত দিয়া আগুনের দিকে চাহিয়া ছিল; নানাভাই থাকিয়া থাকিয়া শুষ্ক গাছের ডাল অগ্নিতে নিক্ষেপ করিতেছিল; পুরন্দর কিছুই করিতেছিল না, কেবল নিজের আঙুলগুলিকে পরস্পর জড়াইয়া বিচিত্র জটিলতার সৃষ্টি করিতেছিল। সর্বশেষে ভীমভাই একটু স্বতন্ত্র বসিয়া একটা খড়ের অগ্রভাগ নিজের নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করাইবার চেষ্টা করিতেছিল। এই সকল বিবিধ কার্যকলাপ সত্ত্বেও তাহারা যে নিজ নিজ চিন্তায় নিবিষ্ট হইয়া আছে তাহা বুঝিতে কষ্ট হয় না।

অকস্মাৎ প্রচণ্ড হাঁচির শব্দে সকলের চিন্তাজাল ছিন্ন হইয়া গেল। সকলের ভর্ৎসনাপূর্ণ দৃষ্টি ভীমের দিকে ফিরিল, ভীম কিন্তু নির্বিকার চিত্তে আবার নাকে কাঠি দিবার উপক্রম করিল।

প্রভু বলিল,—ভীম, তোমার আর অন্য কাজ নেই?

ভীমভাই একটা হাত তুলিয়া সকলকে আশ্বাস দিল

থামো। মাথায় একটা মতলব আস্ব আস্ব করছে। যদি সাতবার হাঁচতে পারি তাহলেই মাথাটা সাফ হয়ে যাবে।

নানাভাই বলিল,-খবরদার। আমার মাথায় একটা বুদ্ধি উঁকি ঝুঁকি মারছিল, তোমার হাঁচির ধমকে ভড়কে পালিয়ে গেল।

ভীমভাই বলিল,-কিন্তু বলতে নেই মাথাটা কিঞ্চিৎ সাফ হওয়া যে দরকার।

প্রতাপ হাসিয়া বলিল,-দরকার বুঝলে তলোয়ার দিয়ে তোমার মাথা সাফ করে দিতে পারব—তোমাকে আর হাঁচতে হবে না।

ভীমভাই বিমর্ষভাবে বলিল,—বেশ, তবে বলতে নেই হাঁচব না।

খড় ফেলিয়া দিয়া ভীম নির্লিপ্তভাবে বসিল। প্রভু প্রতাপের দিকে ফিরিল—

কিছু মাথায় আসছে না। কী করা যায়?

প্রতাপ কহিল,—আমার মাথায় একটা মতলব এসেছে। কিন্তু মুশকিল এই যে, তেজ সিং কোথায় আছে জানতে না পারলে কিছুই করা যায় না।

প্রভু বলিল,-সেই তো। আশ্চর্য ধড়িবাজ লোক। সেদিন স্বচক্ষে দেখলাম শহরের ভিতর দিয়ে কুচকাওয়াজ করে গেল। তারপর রাতারাতি সারা পল্টন কোথায় লোপাট হয়ে গেল, আর পাত্তাই নেই।

পুরন্দর বলিল,—কোথায় আস্তানা গেড়েছে জানতে পারলে—

নানাভাই বলিল,—জানতে পারলে রাতারাতি কচুকাটা করে দেওয়া যেত—লোকজন জড়ো করে দুপুর রাত্রে রে রে রে করে হানা দিতাম, ব্যস! ঘুম ভাঙবার আগেই কেল্লা ফতে।

প্রতাপ একটু হাসিয়া মাথা নাড়িল—

নানাভাই, ব্যাপার অত সহজ নয়। রাজার সিপাহীরা তো আমাদের শত্রু নয়, তারা রাজার নিমক খায় কর্তব্যের অনুরোধে আমাদের ধরতে এসেছে। তারা আমাদের জাতভাই, আমাদের দেশের লোক তাদের প্রাণে মারা আমাদের উচিত নয়। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে কৌশলে তাদের পরাস্ত করা, যাতে তাদের ক্ষতি না হয় অথচ আমাদের কার্যসিদ্ধি হয়।

ভীমভাই বলিল,-কিন্তু বলতে নেই সেটা কি করে সম্ভব?

প্রতাপ বলিল,—সেই কথাই তো ভাবছি। যদি জানতে পারতাম তেজ সিং তার পল্টন নিয়ে কোথায় লুকিয়ে আছে।

এই সময় তিলু গুহার ভিতর হইতে বাহির হইয়া আসিল। বলিল,—ঢের ভাবনাচিন্তে হয়েছে, এবার সব খাবে চল। পেটে রুটি পড়লেই মাথায় বুদ্ধি গজাবে।

সকলে উঠিয়া দাঁড়াইল।

নানাভাই বলিল,-খাঁটি কথা বলেছ তিলুবেন। —পেট খালি তাই মাথা খালি।

নানাভাই পরম আরামে দুই হাত তুলিয়া আলস্য ভাঙিতে গিয়া সেই অবস্থায় রহিয়া গেল, তাহার চক্ষু আকাশে নিবদ্ধ হইয়া রহিল।

আরে, চিন্তাবেনের পায়রা মনে হচ্ছে—

দেখিতে দেখিতে চুনি আসিয়া প্রতাপের স্কন্ধে অবতরণ করিল। ত্বরিতহস্তে চিঠি খুলিয়া প্রতাপ পড়িল, তাহার মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল—

চিন্তা লিখেছে—পঞ্চাশজন সিপাহী নিয়ে তেজ সিং পরপ থেকে আধ ক্রোশ দূরে তাঁবু ফেলেছে।

সকলে অবরুদ্ধ নিশ্বাস ত্যাগ করিল।

প্রভু বলিল,-যাক, তেজ সিংয়ের হদিস পাওয়া গেছে। এবার তোমার মতলবটা শুনি প্রতাপভাই।

প্রতাপ দুই বাহু প্রসারিত করিয়া সকলকে কাছে আহ্বান করিল,—কাছে সরে এস, বলছি।

সকলে প্রতাপকে ঘিরিয়া ধরিল, প্রতাপ একদিকে ভীমভাইয়ের এবং অন্যদিকে তিলুর কাঁধে হাত রাখিয়া বলিতে আরম্ভ করিল,-

আমি যে মতলব করেছি, ভীমভাই আর তিলু হবে তার নায়ক নায়িকা

তাহার কণ্ঠস্বর গোপনতার প্রয়োজনে ক্ৰমে গাঢ় ও হ্রস্ব হইয়া আসিল। সকলে পুঞ্জীভূত হইয়া শুনিতে লাগিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *