৪. রসূল ফরযের আগে-পরে যেসব নামায পড়তেন

৪. রসূল (ﷺ) ফরযের আগে-পরে যেসব নামায পড়তেন

[এ অধ্যায়ে সেসব নামাযের কথা আলোচিত হয়েছে, যেগুলো রসূলুল্লাহ (ﷺ) নফল হিসেবে ফরযের সাথে (অর্থাৎ ফরযের আগে পারে) পড়তেন। যেহেতু রসূল (ﷺ) নিজে এসব নামায পড়েছেন এবং উম্মতকে পড়তে বলেছেন, উৎসাহিত করেছেন, সেজন্যে এই নামাযগুলো উম্মতের জন্যে সুন্নাত।]

ফরযের আগে পরে তিনি কয় রাকাত পড়তেন?

রসূলুল্লাহ (ﷺ) আবাসে (অর্থাৎ মুকীম অবস্থায়) ফরযের আগে পরে নিয়মিত দশ রাকাত নামায পড়তেন।

আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. এই দশ রাকাতের বর্ণনা এভাবে দিয়েছেন “আমি রসূলুল্লাহ (ﷺ) –এর (ফরযের আগে পরের) দশ রাকাত নামায স্মৃতিতে ধরে (হিফজ করে) রেখেছি। তিনি :

-যুহরের আগে দুই রাকাত পড়তেন।

-যুহরের পরে দুই রাকাত পড়তেন।

মাগরিবের পরে ঘরে দুই রাকাত পড়তেন।

-ফজরের আগে দুই রাকাত পড়তেন।” (বুখারি ও মুসলিম)

সফর সাড়া তিনি এই দুই দুই রাকাত নিয়মিত পড়তেন। যুহরে একবার দুই রাকাত বাদ পড়েছিল, তখন তিন সেই দুই রাকাত আসরের পরে পড়েন। এই দুই দুই রাকাতের ব্যাপারে তাঁর নিয়ম স্থায়ী ছিলো। তিনি একবার কোনো নিয়ম চালু করলে সেটা চালিয়ে যেতেন। তবে দশের স্থলে কোনো কোনো বর্ণনায় বার রাকাতের উল্লেখও রয়েছে।

ইমাম মুসিলম তাঁর সহীহ মুসলিমে উম্মুল মু’মিনীন উম্মে হাবীবার সূত্রে একটি হাদিস উল্লেখ করেছেন। উম্মে হাবীবা রা. বলেন, আমি রসূলুল্লহ (ﷺ) –কে বলতে শুনেছি: যে ব্যক্তি দিন রাতে ফরযের অতিরিক্ত বার রাকাত নামায পড়বে, সেগুলোর বিনিময়ে তার জন্যে জান্নাতে একটি ঘর তৈরি হবে।”

ইমাম তিরমিয এই বর্ণনায় এই কথাগুলোও যোগ করেছেন:

-যুহরের আগে চার রাকাত।

-যুহরের পরে দুই রাকাত।

-মাগরিবের পরে দুই রাকাত।

-ইশার পরে দুই রাকাত।

-ফজরের আগে দুই রাকাত।”

ইবনে মাজাহ উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা. থেকে মারফু হাদিস উল্লেখ করেছেন, তাতে উম্মে হাবীবা রা. –এর অনুরূপ বার রাকাতের কথা উল্লেখ হয়েছে।

সহীহ মুসলিমেও আয়েশা রা. –এর অনুরূপ বার রাকাতের কথা উল্লেখ হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে শাকীক বলেন, আমি মা আয়েশাকে রসূলুল্লাহ (ﷺ) –এর নফল নামায সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি জবাবে বলেন: রসূলুল্লাহ (ﷺ) যুহরে আগে আমার ঘরে চার রাকাত নামায পড়তেন। তারপর মসজিদে গিয়ে লোকদের নামায পড়িয়ে আবার আমিার ঘরে প্রবেশ করতেন এবং দুই রাকাত নামায পড়তেন। তিনি লোকদের মাগরিবের নামায পড়িয়ে আমার ঘরে প্রবেশ করতেন এবং দুই রাকাত নাময পড়তেন। লোকদের ইশারা নামায পড়িয়েও আমার ঘরে প্রবেশ করতেন এবং দুই রাকাত নাময পড়তেন। ….. আর ফজরের সূচনাতে দুই রাকাত নামায পড়তেন।”

সব নফলের (সুন্নতের) মধ্যে রসূল (ﷺ) ফজরের আগের দুই রাকাত এবং বিতর নামাযের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিতেন।

যুহরের আগে চার রাকাত, না দুই রাকাত?

যুহরের আগের রাকাত সংখ্যা সম্পর্কে দুই প্রকার বর্ণনা পাওয়া গেলো। আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. –এর বর্ণনা থেকে জানা যায়, রসূল (ﷺ) যুহরের আগে দুই রাকাত পড়তেন। অপরদিকে আয়েশা এবং উম্মে হাবীবকা রাদিয়াল্লাহ আনহুমার বর্ণনা থেকে জানা যায়, চার রাকাত পড়তেন।

হয়তো তিনি কখনো দুই রাকাত এবং কখনো চার রাকাত পড়তেন। দুইটি বর্ণনাই সহীহ। বর্ণনাকারী ইবনে উমররা. এবং আয়েশা ও উম্মে হাবীবা রা. যে যা দেখেছেন, তাই বর্ণনা করেছেন।

ব্যাপারটা এমনো হতে পারে যে, এই চার রাকাত যুহরের আগের নামায ঘরে পড়লে চার রাকাত পড়তেন, আর মসজিদে পড়লে দুই রাকাত পড়তেন।

-হাদিস থেকে একথা স্পষ্টই মনে হয়।

আবার এমনটিও হতে পারে যে, এই চার রাকাত যুহরের সুন্নাত নয়, বরং স্বতন্ত্র নাময এবং সূর্য হেলার পর এই চার রাকাত তিনি পড়তেন। -বিভিন্ন হাদিস থেকে এ মতের পক্ষে ইংগিত পাওয়া যায়। মেযন, মুসনাদে আহমদে আবদুল্লাহ ইবনে সায়েব থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন রসূলুল্লাহ (ﷺ) সূল্য হেলার পর চার রাকাত নামায পড়তেন।” তিনি বলেছেন সূর্য হেলার পরের সময়টা এ রকম যে, তখন আমনানের দরজা সমূহ খুলে দেয়া হয়, তাই আমার বড়ই পছন্দ যে, ঐ সময় আমার কিছু আমল উপরে উঠুক।”

সুনান গ্রন্থ সমূহে আয়েশা রা. থেকে একথাও উল্লেখ হয়েছে যে, রসূল (ﷺ) যদি কখনো কোনো কারণে যুহরের আগে চার রাকাত নামায আদায় করতে না পারতেন, তখন তিনি তা যুহরের পড়ে নিতেন।” ইবনে মাজাহ-তে উল্লেখ হয়েছে, যুহরের আগে চার রাকাত নাময কখনো পড়তেন না পারলে আসরে পরে পড়ে নিতেন।

তিরমিযিতে আলী রা. থেকেও যুহরর আগে চার রাকাত এবং পরে দুই রাকাতের উল্লেখ হয়েছে।

ইবনে মাজায় আয়েশা রা. থেকে এক বর্ণনায় উল্লেখ হয়েছে, রসূল (ﷺ) যুহরের আগে চার রাকাত পড়তেন। তাতে লম্বা কিয়াম করতেন আর রুকূ-সাজদা উত্তমভাবে (দীর্ঘভাবে) করতেন।”

-এসব বর্ণনা থেকে ইংগিত পাওয়া যায়, যুহরের আগের চার রাকাত আসলে স্বতন্ত্র চার রাকা, যা রসূলূল্লাহ (ﷺ) সূর্য হেলার পরে পড়তেন। আল্লাহই ভালো জানেন।

যুহরের পূর্বের সুন্নত মূলত দুই রাকাত, যা আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বর্ণনা করেছেন। এটা অন্যান্য নামাযের সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ যে, সব নামাযেরই সুন্নাত দুই রাকাত। এমন কি ফজরের পূর্ব প্রচুর সময় থাকা সত্ত্বেও রসূল (ﷺ) ফজরের সাথে শুধু দুই রাকাত পড়তেন।

যুহরের পূর্বের চার রাকাত নামায মূলত স্বতন্ত্র নাময, সূর্য হেলার নামায।

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. সূর্য হেলার পর আট রাকাত নামায পড়তেন। তিনি বলতেন, এ নামায দুপুর রাতের পর আমরা যে নামায (তাহাজ্জুদ) পড়ি, তার সমমর্যাদা সম্পন্ন। আল্লাহই ভালো জানেন।

আসরের আগে কি তিনি কোনো নামায পড়তেন?

কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, রসূল (ﷺ) আসরের আগে চার রাকাত নামায পড়তেন। যেমন বর্ণনায় এসেছে, রসূল (ﷺ) আসরের আগে চার রাকাত নামায পড়তেন। যেমন-

১. আহমদ, তিরমিযি ও আবু দাউদ আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. –এর সূত্রে আসরের আগে চার রাকাত (সুন্নাত) নামাযের কথা উল্লেখ করেছেন।

২. তিরমিযি আলী রা. –এর সূত্রে আসরের আগে চার রাকাত নামাযের কথা উল্লেখ করেছেন। তিরমিযি আলী রা. –এর সূত্রে আসরের আগে দুই রাকাত নামায পড়ার কথাও উল্লেখ করেছেন।

প্রথম বর্ণনাটির বিশুদ্ধতা নিয়ে মতভেদ আছে। শুধু ইবনে হিব্বান ওটিকে সহীহ বলেছেন। বাকী সব মুহাদ্দিস এটিকে ত্রুটিপূর্ণ বলেছেন। আসলেই এই বর্ণনাটি দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য। তাছাড়া আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে সহীহ সূত্রে যেসব বর্ণনা পাওয়া গেছে, তাতে তিনি বলেছেন, “আমি রসূল (ﷺ) থেকে দিনে রাতে দশ রাকাত নামাযের কথা মনে রেখেছি।” তার দশ রাকাতের মধ্যে আসরের আগে চার রাকাত নামাযের কোনো উল্লেখ নেই। – ফলে এখানে চার রাকাতের আগে চার রাকাত যে বর্ণনা তাঁর প্রতি আরোপ করা হয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়।

দ্বিতীয় বর্ণনাটির ব্যাপারে আমি শুনেছি, শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া এটিকে হাদিস বলতে অস্বীকার করতেন। তিনি এটির প্রতিবাদ করতেন। তিনি এটিকে মওজু (মনগরা) বলতৈন। আবু ইসহাক জুযেজানীও এটিকে অস্বীকার করতেন।

-ফলে আসরের আগে রসূল (ﷺ) কোনো নফল নামায পড়েছেন বলে সহীহ শুদ্ধভাবে জানা যায় না।

মাগরিবের আগে কি কোনো নামায আছে?

আনাস রা. থেকে বর্ণি ত, তিনি বলেন: মদীনায় যখন মুয়াযযিন মাগরেবের আযান দিতো, লোকেরা তাড়াতাড়িগ করে মসিজদের খুঁটি সমূহের দিকে যেতো এবং দুই রাকাত নামায পড়তো। এতো বেশি লোক তখন দুই রাকাত নামায পড়তে থাকতো যে, হঠাৎ কোনো লোক এলে মনে করতো্, জামাত বুঝি শেষ হয়ে গেছে।” (সহীহ মুসলিম)

মারসাদ ইবনে আবদুল্লা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি একবার উকবা ইবনে আমেরআল জুহহানী রা. –এর কাছে এলাম। আমি তাকে বল্লা, আমি আপনাকে আবু তামীম সম্পর্কে একটি আজব কথা শুনাবো কি? সেটা হলো: তিনি মাগরিবের আগে দু’রাকাত নামায পড়েন।” আমার কথা শুনে উকবা বললেন আমরা রসূলুল্লাহ (ﷺ) –এর সময় এই দুই রাকাত পড়তাম। আমি বললাম: এখন পড়েন না কেন? তিনি বললেন: ব্যস্তার কারণে।” (সহীহ বুখারি)

মুখতার ইবনে ফুলফু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি একবার আসরের পরে দুই রাকাত নফল নাময পড়া সম্পর্কে আনাস রা. –কে জিজ্ঞাসা করি। জবাবে তিনি বলেন: আসরের পরে নাময পড়ার জন্যে হাত বাঁধতো, উমর রা. তাদের হাতে আঘাত করতেন। অবশ্য রসুলুল্লাহ (ﷺ) –এর সময় নামায পড়তাম। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামও কি এই দুই রাকাত পড়তেন? জবাবে তিনি বলেন: তিনি আমাদের পড়তে দেখতেন। তবে পড়তে নির্দেশও দেন নাই, নিষেধও করেন নাই।” (সহী মুসলিম)

-এসব বর্ণনা থেকে বুঝা যায়, মাগরিবের আগে দুই রাকাতম নামায রসূলুল্লাহ (ﷺ) কর্তৃক অনুমোদিত।

সুন্নাত নামায ঘরে পড়া সুন্নত

রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: “হে লোকেরা, তোমরা ঘরে নামায পড়ো। জেনে রাখো, ফরয ছাড়া অন্যান্য নাময ঘরে পড়া উত্তম।”

রসূলুল্লাহ (ﷺ) –এর রীতি ছিলো যে, কোনো অসুবিধা না থাকলে তিনি সুন্নত ও নফল নামায ঘরেই পড়তেন। ঠিক তেমনি সফর, অসুস্থাতা ইত্যাদি কোনো কারণ না ঘটলে তিনি নামায মসজিদেই পড়তেন।

আমরা ইতোপূর্বে সহীহ মুসলিম উদ্ধৃত হযরত আয়েশার বর্ণনা উল্লেখ করেছি। তাতে তিনি বলেন: রসূলুল্লাহ (ﷺ) যুহর নামাযের আগে আমার ঘরে চার রাকাত পড়তেন। তারপর মসজিদে গিয়ে লোকদের নাময পড়াতেন। তারপর ঘরে ফিরে এস দুই রাকাত নামায পড়তেন। তিনি লোকের মাগরিবের নামায পড়িয়ে আমার ঘরে প্রবেশ করতেন এবং দুই রাকাত নামায পড়তেন। লোকদের ইশার নাময পড়িয়ে তিনি আমার ঘরে প্রবেশ করতেন এবং দুই রাকাত নামায পড়তেন। (সহীহ মুসলিম)

তিরমিযি, আবু দাউদ ও নাসায়ীতে কা’আব ইবনে উজরা রা. থেকে হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন একদিন রসূলুল্লাহ (ﷺ) বনি আবদুল্লাহ আশহালের মসজিদে আসেন এবং সেখানে মাগরিবের নামায পড়েন। (ফরয) নামায শেষ হবার পর তিনি দেখতে পেলেন, লোকেরা নফল (সুন্নত) পড়ায় ব্যাপৃত হয়েছে। তখন তিনি বললেন:

“এই নামায তো ঘরের নামায।”

তিরমিযি ও নাসায়ীতে বর্ণিত হাদিসটির ভাষা হলো: ফরয শেষে লোকেরা নফল পড়তে শুরু করে। তখন বনী করীম (ﷺ) তাদের বললেন: তোমাদের উচিত এই নামায ঘরে পড়া।”

বিভিন্ন বর্ণনায় ফজরের সুন্নত সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, রসূল (ﷺ) এ নাময ঘরেই পড়তেন।

ইসলামী বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, কেউ যদি সুন্নত ও নফল নামায মসজিদে পড়ে, তবে তা জায়েয, যেমন কারণবশত ফরয নামায ঘরে পড়া জায়েয। তবে সুন্নত পন্থা হলো তাই, যা উপরে আলোচিত হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *