৪. রমেন সোমের জীবন

এইভাবেই রমেন সোমের জীবন চলে। ঘোট তিনখানা ঘরের ফ্ল্যাটে বাস করেও বিরাট সংসারের রূপ দেখেন। দুজনের ঘোট সংসার। এক মাত্র মেয়ে বিয়ের পরই জামাইয়ের সঙ্গে কানাডা চলে গেছে। তবু ওদের সংসার দুজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ঐ ছোট একটা সাইনবোর্ডের কল্যাণে এ সংসার বেশ বড় হয়েছে।

প্রবীরবাবুর প্রমোশন হয়েছে। তাকে মাঝে মাঝেই কলকাতায় যেতে হয়। ভি. আই. পি. রোডের ফ্ল্যাটে সুমিত্রা একলা থাকতে পারেন না বলে এখানেই চলে আসেন। সাবিত্রী এর আগে স্বামীকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারেন নি। এখন তিনি মাঝে মাঝে প্রবীরবাবুর সঙ্গে দুচার দিনের জন্য এদিক ওদিক চলে যান। সাবিত্রী সুমিত্রাকেও সঙ্গে টানতে চেষ্টা করেন কিন্তু উনি যান না। বলে, না বৌদি, বিয়ের আগে এত ঘুরেছি যে এখন আর ইচ্ছে করে না। আমরা ভাইবোনে বেশ থাকব, তুমিই ঘুরে এসো।

সাবিত্রী সাতাশ বছর বিবাহিত জীবনে স্বামীর সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর বেলুড় মঠ বাদ দিয়ে শুধু দার্জিলিং আর কাশী দেখেছেন, কিন্তু এই কবছরের মধ্যে প্রবীরবাবুর সঙ্গে ছোট বড় অনেক জায়গা ঘুরেছেন।–তাই তো উনি মাঝে মাঝেই ঠাট্টা করে বলেন, বুঝলে সুমিত্রা, তোমার দাদার হাতে না পড়লে আমার কিছুই দেখা হতো না।

মিঃ সোম বলেন, হিন্দুদের সবচাইতে পবিত্র তীর্থস্থান আর কুইন অব হিল স্টেশনস দেখবার পর এ দেশে আর কি দেখাব?  সাবিত্রী বলেন, এ ছাড়া আর তো কোথাও বেড়াবার জায়গা নেই।

সুমিত্রা বলে, দাদার সঙ্গে বিয়ে না হলে তুমি তোমার প্রবীর ঠাকুরপোকে পেতে কোথায়?

সাবিত্রী সঙ্গে সঙ্গে বলেন, তোমার দাদার সঙ্গে বিয়ে না হলে তো আমি নিজেই ম্যারেজ অফিসার হতাম।

ওর কথায় সবাই হো হো করে হেসে ওঠেন।

প্রবীরবাবু অল্প কথার মানুষ। এতক্ষণ ওদের সবার কথা শোনার পর বললেন, বৌদি, এভাবে দাদার পিছনে লাগলে আমরা দাদার আবার বিয়ে দেব।

মিঃ সোম হাসতে হাসতে বললেন, আমি রাজী।

সাবিত্রী বললেন, তুমি রাজী হলেও তোমার মত টেকোকে কোন মেয়ে বিয়ে করবে না।

ওর কথায় আবার সবাই হাসেন।

সুমিত্রা বলে, দাদার এমন কিছু টাক পড়েনি যে……

মিঃ সোম সঙ্গে সঙ্গে একটা হাত মাথায় দিয়ে বলেন, সত্যি, আমার এমন কিছু টাক পড়ে নি যে কোন মেয়ে

সাবিত্রী চুপ করে থাকতে পারেন না। বলেন, না, না, তোমাকে দেখে মধুবালা-মীনাকুমারী হুমড়ি খেয়ে পড়বে।

এর উপর যেদিন নন্দিতা, সুবীর আর ঐ ছোট গুণ্ডা তুতুল আসে সেদিন এ বাড়ী আনন্দে ফেটে পড়ে।

তুতুলের জন্য নন্দিতা বা সুবীরকে কলিংবেল বাজাতে হয় না। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই তুতুল চিৎকার করে, নতুন দাদু, নতুন দিদি, দরজা খোলো। আমি এসেছি। নতুন দাদু…….

সাবিত্রী আর সুমিত্রা দরজা খুলতেই তুতুল এক গাল হাসি হেসে সুমিত্রাকে বলে, তুমিও এখানে? ছোট দাদু তো আজ দুপুরে আমাদের বাড়ী এসেছিল।

সুমিত্রা প্রায় লাফ দিয়ে ওকে কোলে তুলে নিয়ে বলে, তোমার ছোট দাদুর সঙ্গে আমার আড়ি হয়ে গেছে।

তুতুল দুহাত দিয়ে সুমিত্রার গলা জড়িয়ে ধরে বলে, কেন? দাদু বুঝি তোমাকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে যায় নি?

না।

ছোট দাদু তো আমাকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাবে। সেদিন তুমিও যেও।

ঘরে ঢুকে তুতুলকে কোলে বসিয়ে সুমিত্রা বলে, ছোট দাদু যদি আমাকে বকে?

না, না, ছোট দাদু বকবে না। ছোট দাদুর সঙ্গে গেলে তোমাকে আইসক্রীম খাওয়াবে। তুমি আইসক্রীম ভালবাসো?

খুব ভালবাসি?

এবার তুতুল সাবিত্রীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে, নতুন দিদি, তুমি আইসক্রীম ভালবাসো?

সাবিত্রী ঠোঁট উল্টে মাথা নেড়ে বললেন, আমি আইসক্রীমও ভালবাসি না, তোমাকে ভালবাসি না।

তুতুল ঝাঁপ দিয়ে সাবিত্রীর কোলে গিয়ে বলে, তাহলে তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে সন্দেশ খাওয়াও কেন?

ঠিক আছে, আমি আর কোনদিন তোমাকে সন্দেশ খাওয়াব না।

কেন খাওয়াবে না? না খাওয়ালে আমি কাঁদব।

সাবিত্রী ওর মুখের উপর মুখ রেখে বলেন, আমি কি আমার ঘোট দাদাকে সন্দেশ না খাইয়ে থাকতে পারি?

বাইরে থেকে ঘুরে এসে মিঃ সোম এঘরে ঢুকেই বলেন, ঘোট দাদা, আমি ট্রামে চড়ে বেড়িয়ে এলাম।

ব্যস। সঙ্গে সঙ্গে তুতুল ওকে জড়িয়ে ধরে বলে, আমাকেও ট্রামে চড়াতে হবে।

নন্দিতা আর সুবীর ওকে প্রণাম করে, কিন্তু মিঃ সোম তুতুলকে নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে ওদের মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদও করারও অবকাশ পান না। ট্রামে চড়তে তুতুলের খুব ভাল লাগে। তাই মিঃসোম ওকে নিয়ে সত্যি সত্যি ট্রামে চড়তে যান।

মিঃ সোম ছোট মামার বন্ধু বলে নন্দিতার নতুন মামা হয়েছেন, সাবিত্রী নতুন মামী। প্রবীরবাবু আর সুমিত্রাকে দেখতে অত্যন্ত সুন্দর বলে তারা হয়েছেন সুন্দর মামা-সুন্দর মামী। তবে তুতুল বলে ছোট দিদি।

তুতুলকে নিয়ে মিঃ সোম বেরিয়ে যাবার পরই নন্দিতা সুমিত্রাকে বলে, তুমি ছেলেটার স্বভাব এমন করে দিয়েছ যে রোজ রাত্রে আমাকে জ্বালাতন করে মারে।

সুমিত্রা একটু হেসে জিজ্ঞাসা করে, কেন, আমি কী করলাম?

তোমার ওখানে গিয়ে ও তোমার কাছে এত সুন্দর সুন্দর গল্প শোনে যে সব সময় আমাকে বলবে, ছোট দিদির মত গল্প বলল।

সাবিত্রী চা করতে গিয়েছেন। সুবীর পাশের ঘরে বসে বই পড়ছে।

সুমিত্রা বলে, ওকে গল্প শোনাবি।

আমি গল্প জানি নাকি?

বাচ্চাদের গল্প জানতে হয় নাকি?

তুমি সুন্দর মামাকে পাবার সাধনায় পঞ্চাশ বছর বাচ্চাদের পড়িয়েছ বলে তুমি গল্প জানতে পারে কিন্তু আমি পলিটিক্যাল সায়েন্সের ছাত্রী। গল্প জানব কেমন করে?

সুমিত্রা হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করে, তাহলে কি করিস?

সুর করে খবরের কাগজ পড়ে ভোলাবার চেষ্টা করি কিন্তু……

সুমিত্রা ওর কথায় খুব জোরে হাসে। তারপর হাসি থামলে হঠাৎ একটু গম্ভীর হয়ে নন্দিতাকে বুকের কাছে টেনে নেয়। নন্দিতার মাথায় হাত দিতে দিতে বলে, একদিন ভগবান আমার সব সুখ-শান্তি একসঙ্গে কেড়ে নিয়েছিলেন কিন্তু তখন ভাবতে পারি নি, এমন করে সব ফিরিয়ে দেবেন।

শুধু তুমি কেন? আমিও কোন দিন স্বপ্নেও ভাবি নি, এতখ, এত শান্তি, এত ভালবাসা…

সাবিত্রী এক প্লেটভর্তি খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, তোমরা যে যাই বলো, সবচাইতে বেশী লাভ হয়েছে আমার। ওরা দুজনেই প্রায় একসঙ্গে জিজ্ঞাসা করে, কেন? কেন?

সাবিত্রী খাবার প্লেট নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, আমি তোমাদের মত ম্যারেজও করি নি, ম্যারেজ অফিসারও না। অথচ আমি একটা লক্ষণ দেওর পেলাম, তোমার মত কুৎসিত আর হিংসুটে জা পেলাম, সুন্দর মেয়ে জামাই ছাড়াও তুতুলকে বোনাস পেলাম।

সাবিত্রীর কথায় ওরা হাসে।

সাবিত্রী একটু হেসে বলে, তোমাদের না পেলে কবে আমি ঐ টেকো রমেন সোমকে ডিভোর্স করে……

সুমিত্রা দুম করে ওর পিঠে একটা কিল মারে।

সাবিত্রী তবু দমে যায় না। বলে, হাজার হোক সাবিত্রী। রক্ত মাংসের মধ্যে পতিভক্তি মিশে আছে। তা নয়ত কবে গণেশ উল্টে দেবানন্দের কাছে ছুটে চলে যেতাম।

ওরা তিনজনেই হাসিতে ফেটে পড়ে।

.

নীতা চৌধুরী আর কনক ঘোষের বিয়ে হয়ে যাবার পর ওদের অফিসের মিঃ ঘোষাল হাসতে হাসতে মিঃ সোমকে বললেন, আমাদের অফিসে যে কটি ঘোষ ব্যাচেলার ছিল, তাদের সবার বিয়েই আপনি দিলেন।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। এবার মিঃ ঘোষাল বললেন আরো মজার কথা। প্রত্যেকটি মেয়েই ব্রাহ্মণ।

মিঃ সোম জিজ্ঞাসা করলেন, আমার এখানে যাদের বিয়ে হয়েছে, তারা সবাই ভাল আছেন?

হ্যাঁ, প্রত্যেকটা বিয়েই সাকসেসফুল। এবার মিঃ ঘোষাল একটু আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে বললেন, আমাদের অফিসের ছেলেমেয়েরা আমাদের মত বুড়োদের বেশ সম্মান করে। তাই প্রত্যেক বিয়ের আগেই আমরাও একটু দেখাশুনা-খোঁজখবর নিই।

শ্ৰীধরবাবু বললেন, আমাদের অফিসে আমরাই অনেক নিয়ম কানুন তৈরী করেছি।……

মিঃ সোম জিজ্ঞাসা করেন, কিসের নিয়মকানুন?

শ্রীধরবাবু বলেন, আমরা নিয়ম করেছি, আমাদের অফিস-স্টাফের বাড়ীতে অন্নপ্রাশন, পৈতেতে আমরা সবাই দু-টাকা করে চাঁদা দেব, অফিস-স্টাফের ভাইবোন বা ছেলেদের বিয়েতে পাঁচ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। আর অফিস-স্টীফের বা তাদের মেয়ের বিয়েতে দা দিই দশ টাকা করে।

মিঃ সোম চুপ করে শোনেন।

এইসব টাকা আমরা নগদ দিই। কোন জিনিসপত্র প্রেজেনটেশন দিই না।

খুব ভাল!

মিঃ ঘোষাল বললেন, সবাই চাদা দিলেও সবাই নেমন্তন্ন খেতে যাই না। অন্নপ্রাশন-পৈতে বা ভাইবোনের বিয়েতে পাঁচ থেকে দশ জন আর স্টাফের বিয়েতে কুড়িজন নেমন্তন্ন খেতে যায়।

বেশ ভাল লোগ।

মিঃ ঘোষাল বললেন, আসল কথা, আমরা সবাই অত্যন্ত মধ্যবিত্ত। একটু হিসেব-টিসেব না করে চললে বাঁচব কি ভাবে?

অমূল্যবাবু নীতাকে দেখিয়ে বললেন, ওর বাবা পোস্ট অফিসের ক্লার্ক। তিন বোনই বেশ বড় হয়েছে, কিন্তু বিধবা পিসীর পুরো সংসার সামলাতে গিয়ে নীতাদের দু বোনকে চাকরি করতে হচ্ছে। মিঃ সোমের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বললেন, আপনিই বলুন, বিশ পঁচিশ হাজার টাকা খরচ করে কি এসব মেয়েদের বিয়ে দেওয়া সম্ভব?

মিঃ সোম নীতাকে দেখিয়ে অমূল্যবাবুকে জিজ্ঞাসা করলে এই রকমভাবে বিয়ে দিতে ওর বাবা-মা আপত্তি করলেন না?

মিঃ ঘোষাল বললেন, সামনের যোলই ওদের আনুষ্ঠানিক বিয়ে হবে। তবে আমরাও কণক নীতার বাবাকে স্পষ্ট বলেছি, এক হাজার টাকার এক পয়সা বেশী খরচ করতে পারবেন না।

মিঃ সোম একটু হেসে বললেন, মেয়ের বিয়ের কথা তো বাদই দিলাম। সমস্ত বাঙ্গালী জামাইষষ্ঠীতে যে টাকা ব্যয় করে, তা দিয়ে বোধহয় প্রত্যেক বছর একটা নতুন স্টীল প্ল্যান্ট বা একটা শহর তৈরী করা যায়।

ওরা দু-তিনজনে একসঙ্গে বললেন, ঠিক বলেছেন।

.

হঠাৎ মেয়েটি প্রণাম করতেই মিঃ সোম চমকে উঠলেন। তাকিয়ে দেখলেন, মেয়েটি বেশ ডাগর-ভোগর। বয়স বড়জোর ছাব্বিশ-সাতাশ। মিসমিসে কালো রং কিন্তু মুখশ্রী বেশ সুন্দর। পরনে ছাপা শাড়ী। কানে রূপোর দুল।

বাবুজি, আপনি সাদির লাইসেন দেন?

ওর বোঝার সুবিধের জন্য মিঃ সোম বললেন, হ্যাঁ, আমি বিয়ের লাইসেন্স দিই।

মেয়েটি বেশ ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করল, বাবুজি, আমাকে সাদির লাইসেন দেবেন?

নিশ্চয়ই দেব। কিন্তু তুমি কাকে বিয়ে করবে?

আমার সাহেবকে।

কে তোমার সাহেব?

গুলসান সাহেব।

কোন্ গুলসান সাহেব?

যে গুলসান সাহেবের বাঁচীতে কারখানা আছে, এখানে দপ্তর আছে, বোম্বাইতে দপ্তর আছে…। মেয়েটি পুরো কথা শেষ না করে মিঃ সোমকে জিজ্ঞাসা করে, আপনি সাহেবকে চেনেন তো?

না, আমি চিনি না।

যে গুলসান সাহেব হাওয়াই জাহাজে ঘুরে বেড়ায়, কালো রংয়ের বিরাট মোটর আছে…

না আমি চিনতে পারছি না।

কিন্তু বাবুজি, অমোর সাহেবকে তত কলকাত্তার সবাই চেনে। সবাই সাহেবকে রোজ টেলিফুন করে।

মিঃ সোম এবার ওকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার নাম কী?

আমাকে সবাই সরলা বলে।

তোমার দেশ কোথায়?

রাঁচীর ওদিকে।

তোমার বাবা-মা ওখানেই থাকেন?

বাপ আবার সাদি করে কোথায় চলে গেছে। মা তো সিং সাহেবের বাড়ীতে ছিলেন। তারপর আর খবর পাইনি।

মেয়েটার ব্যাপার খুব স্বাভাবিক নয় সন্দেহ করে মিঃ সোম জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কী বরাবর গুলসান সাহেবের বাড়ীতে কাজ করছ?

না, না। আগে আমি আরো তিনটে সাহেবের বাংলোয় কাজ করেছি। তারপর গুলসান সাহেব মেমসাহেবকে সাদি করলে…

এইরকমই সন্দেহ করছিলেন মিঃ সোম। তাই বললেন, গুলসান সাহেবের মেমসাহেব কোথায়?

সরলা সরলভাবেই বললো, মেমসাহেবের তো আবার লেড়কা হয়েছে। তাই তো মেমসাহেব চার মাহিনা দিল্লী আছে।

গুলসান সাহেব তোমাকে সাদি করবেন?

সরলা হেসে বললো, সাহেব আমাকে খুব প্যার করে।

তাই নাকি?

সরলা গর্বের হাসি হেসে বললো, সত্যি বাবুজি সাহেব, আধাকে খুব প্যার করে। সাহেব শটাকা দিয়ে শাড়ী কিনে দিয়েছে। আমাকে খুব ভাল খানা খাওয়ায়, মোটর চড়ায়। তারপর মুহূর্তের জন্য একটু থেমে বললো, মেমসাহেব না থাকলে আমি ত সাহেবের ঘরে রাত্তিরে থাকি।

মিঃ সোম একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তাহলে তোত তোমার সাহেব তোমাকে খুব প্যার করেন।

সরলা মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ।

কিন্তু সাহেব তোমাকে সাদি করবেন তত?

জরুর করবে। আমার যে বাচ্চা হবে। সাহেবকে তো সাদি করতেই হবে।

তোমার বাচ্চা হবে?

সরলা খুশির হাসি হেসে বললো, হ্যাঁ বাবুজি।

মিঃ সোম চুপ করে মাথা নীচু করে বসে থাকেন। কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞাসা করেন, তোমার সাহেব কোথায়?

সাহেব হাওয়াই জাহাজে চড়ে বোম্বাই গেছে।

কবে ফিরবেন?

সাহেব কালই ফিরবেন।

ঠিক আছে। সাহেবকে নিয়ে এসো। আমি তোমার বিয়ের লাইসেন্স দিয়ে দেব।

আনন্দে খুশিতে হাসতে হাসতে সরলা বেরিয়ে গেল।

মিঃ সোম আপন মনে বললেন, তোমার সাহেবও আসছেন না,, আমাকে বিয়ের লাইসেন্সও দিতে হবে না।

সত্যি সরলা আর এলো না।

সরলার কথা প্রায় ভুলতেই বসেছিলেন, এমন সময় সরলা আবার হাজির।

কেমন আছো সরলা?

খুব ভাল আছি বাবুজি।

তোমার গুলসান সাহেবের খবর কী?

সাহেবও খুব ভাল আছেন?

তোমার বাচ্চা ভাল আছে?

আমার বাচ্চা হলো না বাবুজি।

কেন?

আমাকে সাহেব মস্ত বড় বিলাইতি পাস ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার সাহেব আমাকে কত দাবাই দিলেন, সুই ফোঁটালেন, পেটে কত কি করলেন, কিন্তু বাচ্চা দেখতে পেলেন না।

মিঃ সোম না হেসে পারেন না। বলেন, তোমার সাহেব তত খুব ভাল মানুষ।

সাহেব তো আমার দেবতা আছে।

মেমসাহেব জানেন সাহেব তোমাকে প্যার করেন?

সাহেব আমাকে হর মাসে একশো টাকা দেয়। আমি তাই মেম সাহেবকে কিছু বলি না।

খুব ভাল করো।

যে সাহেব আমাকে এত প্যার করে, এত খুশী রাখে, এত টাকা দেয়, তার কথা আমি জরুর শুনব। বাবুজি, আমরা বেইমানি করি না।

মিঃ সোম একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলেন, না, না, সরলা, কারুর সঙ্গেই বেইমানি করা ভাল নয়।

নেই বাবুজি, আমি কারুর সঙ্গে বেইমানি করি না। সরলা একটু থেমে মিঃ সোমকে জিজ্ঞাসা করল, বাবুজি, আপনি চোপড়া সাহেবকে চেনেন?

কোন্ চোপড়া সাহেব?

বালীগঞ্জের চারতলা বাড়ীতে থাকে।…….

না, ঠিক চিনতে পারছি না।

এ চোপড়া সাহেবেরও কারখানা আছে, নিজে মোটর চালায়……

তুমি বুঝি ওকে চেনো?

খুব ভাল করে আমি চিনি।

হঠাৎ মিঃ সোমের মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, উনিও কী তোমাকে প্যার করেন?

সরলা সঙ্গে সঙ্গে জিভ কামড়ে বললো, নেই বাবুজি। এই চোপড়া সাহেব আমার সাহেবের দোস্ত আছেন। আমার সাহেব হাওয়াই জাহাজে চড়ে বাইরে গেলেও চোপড়া সাহেব জরুর আসবেন।

তারপর?

মেমসাহেবের সঙ্গেও চোপড়া সাহেবের খুব দোস্তি।

তাই নাকি?

চোপড়া সাহেব মেমসাহেবের সঙ্গে দু-তিন ঘণ্টা গল্প করে যাবার সময় আমাকে জরুর বিশ-পঁচিশ রুপেয়া দিয়ে বলবেন কিসীকে মাত বোলনা, হাম আয়ীথী।

তুমি কাউকে বলো নাকি?

নেই বাবুজি, কাউকে বলি না।

তোমার মেমসাহেব তোমাকে টাকা দেন না?

সব সময় দেন না, তবে চোপড়া সাহেবের সঙ্গে পিকচার দেখতে গেলে আমাকেও পিকচার দেখার টাকা দেন।

তাহলে তুমি তো ভালই আছে।

সরলা হেসে বললো, বড়া আদমীর কোঠীতে নোকরি করে আরাম আছে।

তোমার নিশ্চয় অনেক টাকা জমেছে?

সরলা চোখ দুটো বড় বড় করে বলে, ঐ শালা হরভজন চুরি না করলে আমার অনেক টাকা……

হরভজন আবার কে?

সাহেবের ড্রাইভার। সাহেব না থাকলেই ঐ শালা হরভজন রাত্রে আমার ঘরে আসবে।…….

মিঃ সোম হেসে ফেলেন।

সরলাও হাসে। বলে, ও শালা আমাকে প্যারও করে, আমার টাকাও চুরি করে।

তুমি বিয়ে করবে না?

দো-এক সাল বাদ সাদি করব।

কাকে বিয়ে করবে?

বোধহয় হরভজনকেই সাদি করব।

সোম সাহেব একটু হেসে বললেন, কিন্তু হরভজন যে তোমার টাকা চুরি করে।

সরলা একটু সলজ্জ হাসি হেসে বললো, বাবুজি, আমার তো টাকার দরকার নেই, কিন্তু ওর টাকার জরুরত আছে।

কেন? হরভজন কী গুলসান সাহেবের কাছ থেকে মাইনে পায় না?

সরলা বেশ চিন্তিত হয়ে বললো, গাঁওতে ওর বিবি-বাচ্চারা আছে আর ওদের অসুখবিসুখ লেগেই আছে।

সোম সাহেব মনে মনে হাসলেও বেশ গম্ভীর হয়ে বললেন, তাই বুঝি ও তোমার টাকা নেয়?

হ্যাঁ, বাবুজি।

আচ্ছ৷ সরলা, হরভজন এমনি বেশ ভাল লোক, তাই না?

হ্যাঁ বাবুজি, হরভজন আচ্ছা আদমী আছে। এবার ও চোখ দুটো বড় বড় করে বললো, ওর মোটর চালান দেখলে আপনার দিলখুশ হয়ে যাবে।

আচ্ছা!

সরলা সহজ সরল আদিবাসী মেয়ে। মানুষকে সে বিশ্বাস করে, ভালবাসে। নগরজীবনের নোংরামী বা কুটিলতাকেও সে সহজভাবে গ্রহণ করে, মেনে নেয়। শুধু দুমুঠো অন্ন আর একটু আশ্রয়ে জন্য আজ কোথা থেকে সে কোথায় এসে পৌঁচেছে। তার সারল্যের সুযোগ নিচ্ছে প্রভু ভৃত্য সমানভাবে কিন্তু এরপর? যেদিন সরলার মধু ফুরিয়ে যাবে? যখন ওদের নেশা কেটে যাবে? তখন?

ভাবতে গিয়েও সোম সাহেবের মাথা ঘুরে যায়।

হঠাৎ সরলা বললো, বাবুজি!

কী?

এক রোজ হরভজনকে নিয়ে আসব?

নিশ্চয়ই।

সরলা আরো পাঁচ-দশ মিনিট গল্প করার পর চলে গেল।

মিঃ সোম নিজের মনে মনেই ভাবেন। না ভেবে পারেন না। আমাদের মধ্যে কত গুলসান আর চোপড়া লুকিয়ে রয়েছে, তা ভেবেই উনি চমকে ওঠেন।

সরলা বিয়ে না করলেও সমাজের যে ছবি তার কাছে প্রকাশ করল, তার জন্য তিনি মনে মনে ঐ মেয়েটিকে ধন্যবাদ না জানিয়ে পারেন না।

.

বাঘ-ভাল্লুক পশু-পক্ষীর মধ্যে ভালবাসার বিশেষ মরশুম আছে। মানুষের ভালবাসার, প্রেম করার কোন মরশুম নেই। তাইতো গ্রীষ্ম বর্ষা, শরৎ-হেমন্ত, শীত-বসন্তে মানুষের জন্ম হয়। এখন বিয়েও হয়।

ভাদ্র মাসের প্রথম দিনেই যিনি বিয়ের নোটিশ দিতে এলেন তিনিও এক সাহেব। পাত্রী প্রতিবেশীর আয়া। তবে ইনি গুলসান সাহেবের মত ছোঁকরাও নন, বিবাহিতও নন। এ সাহেব যৌবনের শুরুতে প্রেম করলেও বিবাহ করতে পারেন না বলে মনের দুঃখে সুদূর ত্রিবাঙ্কুর-কোচিন থেকে কলকাতা চলে আসেন।

এ অনেক কাল আগেকার কথা। তখন কলকাতায় ঘোড়ার ট্রাম না চললেও রাইটার্স বিল্ডিং আর লাট সাহেবের বাড়ীর মাথায় ইউনিয়ন জ্যাক উড়ত। এই ম্যাথুজ সাহেব কয়েক দিনের জন্য কোট্টায়ামের এক পরিচিতি ভদ্রলোকের ভবানীপুরের বাড়ীতে অতিথ্য গ্রহণ করলেন। সে পরিবারের আতিথ্য উপভোগের সম্মান বেশী দিন না পেলেও ঐ ভদ্রলোকের সুপারিশে একটা সত্যিকার সাহেবী কোম্পানীতে একটা চাকরি পেলেন।

বিলিভ মী, মিঃ সোম, আমি ওকে ঠিক আমার ফাদারের মত রেসপেক্ট করতাম। উনি আমাকে বাড়ীতে থাকতে না দিলেও আই এ্যাম ভেরী ভেরী গ্রেটফুল টু হিম।

মিঃ সোম বললেন, যিনি আপনাকে প্রথম আশ্রয় দেন, যিনি চাকরি দেন, তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকাই তো উচিত।

মিঃ সোম আমার বাসায় কার কার ফটো আছে জানেন?

কার কার?

নম্বার ওয়ান মাদার মেরী এ্যাণ্ড ফাদার জিসাস, নাম্বার টু আমার বাবা-মার এ্যাণ্ড নাম্বার থী এই ভদ্রলোকের।…….

মিঃ সোম অত্যন্ত খুশী হয়ে বললেন, ভেরী গুড। * মিঃ ম্যাথুজ আজ বিয়ে করতে এসে পুরানো দিনের স্মৃতি রোমন্থন না করে পারেন না। বলেন, বিলিভ মী মিঃ সোম, আমি কমলাকে সত্যি দারুণ ভালবাসতাম এ্যাণ্ড পসিবলি আই স্টিল লাভ হার। কিন্তু বিয়ের প্রস্তাব করায় কমলা এ্যাণ্ড হার আংকল আমাকে এমন অপমান করল যে রাগে, দুঃখে, অপমানে আই স্টার্টেড গোয়িং টু প্রসটিটিউট।…

আপনি বেশ্যা বাড়ী যেতেন?

ইয়েস মিঃ সোম। এবার একটু হেসে মিঃ ম্যাথুজ বললেন, ডোন্ট ফরগেট ব্যর্থ প্রেমিক প্রাণ দিতেও পারে, নিতেও পারে। সুতরাং বেশ্যাবাড়ী যাওয়া তো কিছুই না।

একটু চুপ করে থাকার পর মিঃ সোম জিজ্ঞাসা করলেন, কমলার সঙ্গে কোথায় আপনার ভাব হয়?

ম্যাথুজ সাহেব একটু হেসে বললেন, শুনবেন কমলার কথা?

মানুষের সুখ-দুঃখের কাহিনী শুনতে আমার ভালই লাগে।

ভেরী গুড! তাহলে শুনুন।

.

সে অনেক বছর আগেকার কথা।

ফাদার চেরিয়ান চার্চের সামনেই পায়চারী করতে করতে বাইরেল পড়ছিলেন। ছেলেটি দৌড়ে এসে ওর সামনে থমকে দাঁড়াতেই ফাদার চেরিয়ান একটু হেসে বললেন, ইয়েস মাই সন।

ফাদার, আমি পাস করেছি।

বৃদ্ধ ফাদার চেরিয়ান সঙ্গে সঙ্গে দুটো চোখ বন্ধ করে আপন মনে বললেন, ও লর্ড! তুমি সত্যি করুণার সাগর।

পরম পিতা যীশুকে ধন্যবাদ জানাবার কারণ আছে ফাদার চেরিয়ানের। পরমপিতার অপার করুণা না হলে পিতৃ-মাতৃহীন শিশুটিকে উনি কিছুতেই বাঁচাতে পারতেন না। সেদিনের সেই শিশুটি আজ বি. এ. পাস করল।

ভাবতে গিয়েই ফাদার চেরিয়ানের চোখে জল আসে। . আই এ্যাম রিয়েলি সস হ্যাঁপি মাই সন…

ছেলেটির চোখেও জল। সে কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, আমি তা জানি ফাদার।

ফাদার চেরিয়ানও নিজেকে সামলে নেন। ছেলেটির কাঁধে একটা হাত রেখে বললেন, মাই সন, গো ইনসাইড। প্রার্থনা করে এসো।

কয়েক দিন পরে ফাদার চেরিয়ান ওকে জিজ্ঞাসা করলেন, এবার কী করবে?

ভাবছি, চাকরি-বাকরি করব।

কোথায়?

আমাদের এই পালঘাটে কি আর চাকরি পাব; তাই ভাবছি, কোন বড় শহরে চলে যাব।

কোন্ বড় শহরের কথা ভাবছ? মাদ্রাজ না বোম্বে? নাকি কলকাতা?

মনে হয় বোম্বে যাওয়াই ভাল।

ইয়েস ইউ ক্যান গো দেয়ার। চেষ্টা করলে অত বড় শহরে নিশ্চয়ই কোন ভাল কাজ পেয়ে যাবে। তাছাড়া ঈশ্বরকে মনে রেখো; তিনি নিশ্চয়ই তোমাকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করবেন।

.

মিঃ ম্যাথুজ একটু হেসে বললেন, বি. এ. পাস করার এক সপ্তাহের মধ্যেই আমি বোম্বে হাজির; আর বোম্বে আসার তিন দিনের মধ্যেই একটা চাকরিও জুটে গেল।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। তবে দুমাস পরেই ঐ চাকরি ছেড়ে দিলাম।…

কেন?

নেভির ষ্টোরে একটা চাকরি পেলাম।

কোথায় থাকতেন?

থাকতাম চেম্বুরের এক মেসে।

তারপর কি হলো বলুন।

দুবছর বোম্ব ছেড়ে কোথাও যাই নি। দুবছর পর হঠাৎ খবর পেলাম, ফাদার চেরিয়ান খুব অসুস্থ। তাই তাকে দেখার জন্য ছুটেগেলাম পালঘাট। মিঃ ম্যাথুজ খুব জোরে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, আমি পৌঁছবার পরদিন ভোরবেলায় ফাদার চেরিয়ান মারা গেলেন।

মারা গেলেন?

হ্যাঁ।

ওঁর কত বয়স হয়েছিল?

সেভেনটি ফোর। মিঃ ম্যাথুজ একটু থেমে বললেন, উনি আমার বাব-মা শিক্ষক ভাই-বন্ধু সবকিছু ছিলেন। তাই সাত দিনের ছুটি নিয়ে গেলেও পুরো একমাস পড়ে রইলাম ঐ পালঘাটে।

তারপর?

ফাদার চেরিয়ানের ছোটভাই ব্যাঙ্গালোরে থাকতেন। উনি আমাকে জোর করে ব্যাঙ্গালোর নিয়ে গেলেন এবং সেখানেও দুসপ্তাহ কাটিয়ে দিলাম।

তারপর বোম্বে ফিরলেন?

হ্যাঁ। মিঃ ম্যাথুজ একটু ম্লান হাসি হেসে বললেন, আমার ঐ দুঃখের দিনেই কমলার দেখা পেলাম।

কোথায়?

ট্রেনেই।

কী ভাবে আলাপ হলো?

ট্রেনে প্রায় সামনা-সামনি বসে থাকলেও আলাপ হয়নি। আলাপ হলো, দিন দুয়েক পরে চেম্বুর স্টেশনে।

.

দুজনেই দুজনকে দেখে অবাক। দুজনেই একটু হাসেন। তারপর ম্যাথুজই দুএক পা এগিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি এখানে?

আমি তো এই চেম্বুরেই থাকি।

তাই নাকি?

হ্যাঁ।

আমিও তো চেম্বুরে থাকি।

সে কি?

সেদিন আর বিশেষ কথা হল না। ট্রেন আসতেই দুজন হারিয়ে যায়।

কদিন আবার এই চেম্বুর ষ্টেশনেই দেখা। আবার কিছু কথা। তারপর পর পর কদিন দেখা। আরো কিছু কথা কখনও কখনও একই ট্রেনে পাশাপাশি বসে যাতায়াত। মাঝে মাঝে দেখা হয় না।

এইভাবেই মাস ছয়েক কেটে গেল।

তারপর একদিন ম্যাথুজ কমলার অফিসে ফোন করল, ঠিক বুঝতে পারছি না আপনাকে একটা অনুরোধ করা উচিত হবে কিনা।

এত দ্বিধা করছেন কেন। কি বলতে চান বলে ফেলুন।

ম্যাথুজ তবু একটু দ্বিধা করে। আস্তে আস্তে বলে, এ সংসারে আমার কোন আপনজন নেই।…

কমলা বিশ্বাস করতে পারে না। বলে, তাই কখনো সম্ভব।

সত্যি আমার কোন আপনজন নেই।

আপনার বাবা-মা নেই।

না, ওরা আমার ছোটবেলায় মারা যান।

ভাইবোন।

না, আমার কোন ভাইবোনও নেই।

মামা-কাকারাও নেই।

থাকলেও আমি জানি না।

কমলা সঙ্গে সঙ্গে কোন কথা বলতে পারে না। একটু ভেবে জানতে চায়, আপনি কার কাছে থেকে লেখাপড়া করলেন।

আমাদের পালঘাটের ফাদার চেরিয়ানই আমাকে মানুষ করেছেন, লেখাপড়া শিখিয়েছেন।

তাহলে উনিই তো আপনার আপনজন।

উনিও মারা গেছেন। ম্যাথুজ একটু থেমে বলে, ওর মৃত্যুর পর যখন আমি ফিরছিলাম তখনই তে ট্রেনে আপনাকে প্রথম দেখি।

তাই নাকি।

হ্যাঁ।

কিন্তু আমাকে তো তা কোনদিন বলেন নি।

আমার দুঃখের কথা বলে অন্যের মন ভারাক্রান্ত করার ইচ্ছা আমার হয় না।

কমলা একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, সত্যি, আপনি অদ্ভুত মানুষ। এবার বলুন কি অনুরোধ করতে চান?

আগামী শুক্রবার আমার জন্মদিন। তাই ভাবছিলাম আপনি যদি সেদিন আমার সঙ্গে ডিনার খান, তাহলে…..

আপনার জন্মদিনে আপনি কেন খাওয়াবেন।

আমিই আপনাকে খাওয়াব।

না, না, আমিই…..

কেন? আমি খাওয়ালে কী আপনি খাবেন না।

না, না, তা বলছি না।…..

কাল অফিস ছুটির পর আপনি আমার অফিসে চলে আসবেন। তারপর একসঙ্গে বেরুব।

.

মিঃ ম্যাথুজ একটু ম্লান হাসি হেসে বললেন, জানেন মিঃ সোম, কমলা আমার জন্মদিনে কি করেছিল।

কী?

সেদিন সকালে একই ট্রেনে দুজনে বোম্বে এলাম। নিজেও অফিস গেল না, আমাকেও যেতে দিল না। দুজনে মিলে খুব ঘুরে বেড়ালাম, সিনেমা দেখলাম। তারপর ডিনার খেয়ে বেশ রাত্রে চেম্বুর ফিরে গেলাম।

মিঃ সোম শুধু একটু হাসেন।

আরো মজার কথা শুনবেন?

কী?

সেদিন কমলা আমাকে একটা পয়সা খরচ করতে দিল না। উপরন্তু আমাকে একটা শেফাস ফাউন্টেন পেন প্রেজেন্ট করেছিল।

মিঃ সোম এবারও কোন প্রশ্ন করেন না। শুধু ম্যাথুজ সাহেবের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

ম্যাথুজ সাহেব আপন মনে বলে যান, একদিন নয়, দুদিন নয়, দীর্ঘ পাঁচটি বছর কমলা আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ভরে রেখেছিল। তারপর হঠাৎ একদিন মনে হলো, আমাদের দুজনের সম্পৰ্ক এত গভীর, এত নিবীড় হয়ে উঠেছে যে এবার আমাদের বিয়ে না হলে হয়ত কোন কেলেঙ্কারী ঘটে যাবে।

এতক্ষণ পরে মিঃ সোম প্রশ্ন করেন, এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও আপনাদের বিয়ে হলো না?

মিঃ ম্যাথুজ হেসে বললেন, আমি যে ক্রিশ্চিয়ান আর কমলা যে হিন্দু!

কি দুঃখের কথা।

মিঃ ম্যাথুজ আবার একটু হাসেন। বলেন, না, না, মিঃ সোম, একটুও দুঃখের কথা নয়। এ সংসারের অধিকাংশ মানুষই লুকিয়ে চুরিয়ে সব কিছু করতে রাজী কিন্তু প্রকাশ্যে অনেক কিছুই করবে না।

যাগে ওসব কথা ভুলে যান।

না, না, মিঃ সোম, এসব কথা কিছুতেই ভুলে যাওয়া যায় না।

কিন্তু তাই বলে আপনি বেশ্যাবাড়ী যেতেন কেন?

রাগে, দুঃখে, হতাশায়।

নিয়মিত যেতেন?

হ্যাঁ।

তারপর?

তারপর একদিন পকেটে বিশেষ টাকাকড়ি ছিল না কিন্তু তবু সেই পুরানো বেশ্যার কাছে গেলাম এ্যাণ্ড সী ইনসালটেড মী লাইক এনিথিং।

মিঃ সোম হাসেন।

ঐ বেশ্যার কাছে অপমানিত হয়ে মনে মনে ঠিক করলাম, আর কোনদিন কোন মেয়েকে স্পর্শ করব না। এইটুকু বলেই মিঃ ম্যাথুজ টাই-এ নট ঢিলা করলেন, পট পট করে জামার বোম খুললেন। তারপর গলায় ঝোলান ক্রশ বের করে হাতের মুঠোর মধ্যে ধরে বললেন, ফাদার জিসাসের নামে শপথ করে বলছি, তারপর আর কোন মেয়ের কাছে যাই নি।

পাত্রী এতক্ষণ চুপ করে বসেছিল। এবার সে মিঃ সোমের দিকে তাকিয়ে বললো, ইয়েস স্যার, হি ইজ ভেরী অনেস্ট।

এবার মিঃ সোম হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলেন, এখন বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলেন কেন?

মিঃ ম্যাথুজ এবার এক গাল হাসি হেসে বললেন, ইয়েস। নাউ আই মাস্ট টেল দ্যাট। এবার উনি আয়াকে দেখিয়ে বললেন, কান্তম্মার দেশ মাদ্রাজ। চোদ্দ বছর বয়সে বিয়ে হয়। স্বামী বছর খানেক স্ফুর্তি করেই পালিয়ে যায়। তার দু-তিন বছর পর ওদের দেশের একটা ছোঁড়া কলকাতা থেকে মাদ্রাজ গেল। কান্তম্মাকে দেখে তার খুব ভাল লাগল। ও বিয়ে করবে বলে ওকে কলকাতা নিয়ে এলো।

বিয়ে করল?

মিঃ ম্যাথুজ মাথা নেড়ে বললেন, এমনিই যদি ফুর্তি করা যায় তহেলে বিয়ে করবে কেন? সে হারামজাদা বছর খানেক মধু খাবার পর কোথায় উড়ে গেল।

তারপর?

তারপর থেকেই ও আমার পাশের ফ্ল্যাটে আয়ার কাজ করছে। যতদিন ও বাড়ীর বুড়ো-বুড়ী বেঁচে ছিল ততদিন কান্তম্মা ভালই ছিল কিন্তু বুড়ো-বুড়ীর ছোট দুটো ছেলে বড় বদ। ও বাড়ীতে কান্তম্মার কাজ করা সত্যি নিরাপদ নয়…….

তাই আপনি ওকে বিয়ে করছেন?

না, না, শুধু এজন্য ওকে বিয়ে করছি না। আজ যে বারো বছর কান্তম্মা আমার পাশের ফ্ল্যাটে কাজ করছে, তার মধ্যে আমার তিন চারবার মারাত্মক অসুখ হয়েছে এবং এই মেয়েটার জন্যই আমি বেঁচে উঠেছি।

মিঃ সোম মুগ্ধ হয়ে ওদের দুজনকে দেখেন।

এবার মিঃ ম্যাথুজ বলেন, আই এ্যাম ফর্টিনাইন এ্যাণ্ড শী ইজ থার্টিফোর। একবার ভেবেছিলাম, ওকে বোনের মত আমার কাছেই রাখব কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম, তাতে দুজনেরই বদনাম।…….

ঠিক বলেছেন।…..

আই ডোন্ট কেয়ার ফর মাই রেপুটেশন কিন্তু মেয়েদের মর্যাদা নিয়ে ছেলেখেলা করা ঠিক নয় বলেই ঠিক করলাম, কান্তাম্মাকে বিয়ে করব এবং আমি গ্রেটফুল যে কান্তাম্মা আমার কথা মেনে নিল।

মিঃ সোম ওদের দুজনকে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, আচ্ছা মিঃ ম্যাথুজ, আপনি এত ধার্মিক হয়েও চার্চে গিয়ে বিয়ে করলেন না কেন?

আই কান্ট। আমি খ্ৰীষ্টান কিন্তু কান্তাম্মা তো হিন্দু। এবার উনি একটু হেসে বললেন, আমি ওকে বিয়ে করছি বলেই ওর ধর্ম পরিবর্তন করারো কেন?

ঠিক।

ওরা বিয়ের নোটিশ দিয়ে চলে যাবার সময় মিঃ সোম ম্যাথুজকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আপনাকে দেখে আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভাল লাগল। ভগবান নিশ্চয়ই আপনাদের সুখী করবেন।

মিঃ ম্যাথুজ ওর একটা হাত নিয়ে কান্তাম্মার মাথায় দিয়ে বললেন, মিঃ সোম, আপনি এই মেয়েটাকে আশীর্বাদ করুন আর আপনাদের গডেস মা কালীকে বলুন, এই মেয়েটাকে যেন আমি সুখী করতে পারি।

আপনি নিশ্চয়ই ওকে সুখী করতে পারবেন।

.

বিয়ের দিন ওদের দুজনকে দেখেই মিঃ সোম অবাক। মিঃ ম্যাথুজ নতুন স্যুট পরেছেন। সঙ্গে নতুন জামা, নতুন টাই, নতুন জুতত। দেখে মনেই হয় না, ওর বয়স ঊনপঞ্চাশ, মনে হয় বড় জোর পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ। নতুন সিল্কের শাড়ী-ব্লাউজ পরে কান্তাম্মাকেও অপূর্ব লাগছে। দুজনেরই মুখে হাসি, চোখে বিদ্যুৎ, হাতে ফুল।

যে তিনজন সাক্ষী দিতে এসেছেন, তারাও যেন বিয়ে বাড়ীর নেমন্তন্ন খেতে এসেছেন। তিনজনেই বিশিষ্ট ভদ্রলোক ও ম্যাথুজ সাহেবের অফিসেই কাজ করেন।

পাঁচ মিনিটের মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ হলো। মিঃ সোম টেবিলের ড্রয়ার থেকে ছোট্ট দুটো প্যকেট বের করে ম্যাথুজ আর কান্তাম্মার হাতে দিয়ে বললেন, মাই টোকন প্রেজেনটেশন…

মিঃ ম্যাথুজ মাথা নত করে উপহার গ্রহণ করেই আঙ্গুল দিয়ে বুকের উপর ক্রশ একে বললেন, আমরা সত্যি সুখী হবে। তা না হলে ঈশ্বর আমাদের আপনার কাছে পাঠাতেন না।

মিঃ সোম একটু হাসেন।

এবার ম্যাথুজ জিজ্ঞাসা করেন, আপনি কি সবাইকেই প্রেজেনটেশন দেন?

না। আপনাদেরই প্রথম দিলাম।

মিঃ ম্যাথুজ মিঃ সোমকে জড়িয়ে ধরে বললেন, উই আর সো লাকী, উই আর সো হাপি……

মিঃ সোম হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলেন, এবার কী প্ল্যান।

মিঃ ম্যাথুজ একটু আনমনা হয়ে বললেন, আমি সারা জীবন চাকরি করেছি, বিয়ার খেয়েছি আর তাস খেলেছি। আর এই মেয়েটা ত জীবনে একদিনও প্রাণভরে হাসতে পারে নি। তাই ঠিক করেছি, এবার আমরা একটু আনন্দ করব। এবার উনি একটু হেসে বললেন, দার্জিলিং-কালিম্পং-কার্শিয়াং-এ একমাস ধরে হনিমুন করব।

নিশ্চয়ই আনন্দ করবেন।

এবার মিঃ ম্যাথুজ দু হাত উঁচু করে বললেন, জেন্টলমেন, নাউ উই ডিসক্লোজ আওয়ার ফাইন্যাল প্ল্যান। আমরা দুজনে আপনাদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি এই হনিমুনের সময়ই কান্তাম্মা উহল বী প্রেগন্যান্ট।

আরো কত ছেলেমেয়ে, মেয়ে-পুরুষ এলেন, গেলেন কিন্তু মিঃ ম্যাথুজ আর কান্তাম্মা মিঃ সোমের মনে যে আবেশ সৃষ্টি করেছিলেন, তা মুছে গেল না।

পচা ভাদ্দর প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আকাশ-বাতাস মাঝে মাঝেই জানিয়ে দিচ্ছে, শরৎ এসে গেছে।

শেষ রাত্রির থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কিন্তু ভোর থেকেই মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বাড়ীতে মিঃ সোম একা। সাবিত্রী কদিন আগে ওর মাসতুতো বোনের বিয়েতে গেছেন, এখনও ফেরেন নি।

হঠাৎ এই বৃষ্টির মধ্যে কলিং বেল বাজাতেই মিঃ সোম যেন চমকে উঠলেন। আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলেন, দুটি ছেলেমেয়ে। উনি অবাক হয়ে বললেন, এই বৃষ্টির মধ্যে এসেছেন?

ছেলেমেয়ে দুটি কোন জবাব না দিয়ে ওর পিছন পিছন ঘরে এসেই মিঃ সোমের পায় হাত দিয়ে প্রণাম করল।

মিঃ সোম একটু অবাক হয়ে বললেন, প্রণাম করছেন কেন?

ছেলেটি ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো, কলকাতায় এসেছি শুধু আপনাকে প্রণাম করতে।

এবার মেয়েটি বললো, সেদিন আপনি সাহায্য না করলে তোত আমাদের আত্মহত্যা করতে হত।

মিঃ সোম ওদের দুজনকে একবার ভাল করে দেখেও ঠিক চিনতে পারলেন না। বললেন, আমি আপনাদের কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।

ওরা দুজনে প্রায় এক সঙ্গে বললো, আমাদের আপনি বলছেন কেন?

আচ্ছা, আচ্ছা, তোমাদের নাম কি?

ছেলেটি বললো, আমার নাম প্রবাল—

মিঃ সোম চমকে উঠে বললেন, তুমি প্রবাল?

হ্যাঁ।

বছর চার-পাঁচ আগে এই রকমই বর্ষার মধ্যে–

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন।

এবার মেয়েটি একটু হেসে বললো, আমি বাণী।

মিঃ সোম এবার একটু হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার দাদুভাই ভাল আছে?

প্রবাল বললো, হ্যাঁ। সে এখন স্কুলে পড়ছে।

এত বড় হয়ে গেল?

বাণী বললো, এত বৃষ্টি হচ্ছে বলে ওকে আনতে পারলাম না। কাল-পরশু ওকে দেখিয়ে নিয়ে যাব।

এতক্ষণ পরে মিঃ সোমের খেয়াল হলো, ওরা সবাই দাঁড়িয়ে। বললেন, বো, বসো।

সবাই বসলেন।

বসার পরই প্রবাল বললো, আপনার একটা কথা আমরা কিছুতেই ভুলতে পারি না।

মিঃ সোম একটু বিস্ময়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন, কোন কথা?

বাণী বললো, আপনি আমাদের বলেছিলেন, আমি চাই না কোন শিশু কলংকের বোঝা মাথায় নিয়ে এই পৃথিবীতে আসুক।

মিঃ সোম একটু হেসে বললেন, বলেছিলাম নাকি?

প্রবাল বললো, হ্যাঁ।

মিঃ সোম আপন মনে ভাবতে ভাবতে কোথায় যেন তলিয়ে যান। আস্তে আস্তে সেই হারিয়ে যাওয়া পুরানো স্মৃতি ওর মনে পড়ে।

.

সেদিনও ঠিক এই রকমই বৃষ্টি হচ্ছিল। প্রবাল আর বাণী পাগলের মত কাঁদতে কাঁদতে ওর পা জড়িলে ধরল।

আপনি আমাদের বাঁচান, তা নইলে আমাদের আত্মহত্যা করতে হবে।

কেন? কী হয়েছে তোমাদের?

প্রবাল বললো, আমরা দুজনেই দারুণ অন্যায় করেছি।…

বাণী আর চেপে রাখতে পারল না। বললো, আমি প্রেগন্যান্ট।

মিঃ সোম চমকে উঠলেন, প্রেগন্যান্ট।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি প্রেগন্যান্ট। আপনাকে এখুনি আমাদের বিয়ে দিতে হবে।…

কিন্তু…

না, না, কোন কিন্তু শুনব না। আপনি বিয়ে না দিলে আজ রাত্রেই আমাদের…

চুপ করো, চুপ করো। ওসব কথা বলো না।

ওরা দুজনে আরো অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করল, আরো অনেকক্ষণ অনুনয়-বিনয় করল।

খুব জোরে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মিঃ সোম বললেন, আমি শুনেছি কোন কোন ম্যারেজ অফিসার একটু বেশী টাকা পেলেই…

বাণী কঁদতে কাঁদতে হঠাৎ গলার মোটা হার খুলে ওর সামনে রেখে বললো, আপনি যা চান…

মিঃ সোম একটু হেসে বললেন, আমি বেআইনী কাজ করি না কিন্তু…

ওরা দুজনে প্রায় একসঙ্গে বললো, কিন্তু কী?

আমি চাই না, কোন শিশু কলংকের বোঝা মাথায় এই পৃথিবীতে আসুক!…

.

প্রবাল বললো, আপনার কাছ থেকে সার্টিফিকেট পাবার পরই আমরা কলকাতা থেকে সরে পড়লাম।

মিঃ সোম জিজ্ঞাসা করলেন, তখন কী তুমি বি. এ. পাস ছিলে?

বি-কম পার্ট টু পরীক্ষা দিয়েছিলাম। তবে জব্বলপুরে যাবার মাসখানেক পর খবর পেলাম, পাস করেছি।

বাণী বললো, আপনার আশীর্বাদে আমিও সেবার পাস করি।

খুব ভালো।

প্রবাল বললো, প্রথমে ছোট মামার ওখানেই উঠেছিলাম কিন্তু মাস দেড়েকের বেশী থাকতে পারলাম না; কটা মাস কিভাবে যে আমরা বেঁচেছিলাম, তা শুধু ভগবানই জানেন।

মিঃ সোম জিজ্ঞাসা করলেন, তারপর?

বাণী হেসে বললো, যে রাত্রে আমার ছেলে হলো তার পরদিনই ও সাড়ে চারশ টাকা মাইনের চাকরি পেল।

খুব ভাল।

প্রবাল একটু হেসে বললো, একদিন যে সন্তানকে অভিশাপ বলে মনে হয়েছিল, সেই ছেলের কল্যাণেই আমরা বেঁচে গেলাম। তাইতো আমরা ছেলের নাম রেখেছি সৌভাগ্য।

মিঃ সোম একটু হেসে বললেন, নাইট ইজ দ্য ডার্কেস্ট বিফোর ভন।

প্রবাল বললো, ঠিক বলেছেন। কলকাতা থেকে রওনা হবার সময় আমার দুই বন্ধু আমাদের রেলের টিকিট কেটে দেয়। বাণীর এক বন্ধু ওর হাতে তিরিশটা টাকা গুঁজে দেয়। এ ছাড়া আমাদের দুজনের কাছে ঠিক নব্বই টাকা ছিল।

বাণী বললো, আমরা সারা রাস্তা শুধু শুকনো পাউরুটি আর চা খেয়েছি।

প্রবাল বললো, মাস দেড়েক ছোট মামার ওখানে কি অপমান সহ্য করেছি, তা ভাবলেও চোখে জল আসে। তারপর মামী একদিন সোজাসুজি চলে যেতে বললেন।

মিঃ সোম উৎকণ্ঠার সঙ্গে প্রশ্ন করেন, তখনও তোমার কোন চাকরি-বাকরি হয় নি?

না।

টাকাকড়িও নিশ্চয়ই ফুরিয়ে গিয়েছিল?

প্রবাল একটু হেসে বললো, মাত্র আঠারো টাকা সম্বল করে ছোট মামার বাড়ী থেকে বেরিয়ে এলাম।

তারপর কোথায় গেলে?

একটা ধর্মশালায় গেলাম।…

নিজেরাই রান্না করতে?

বাণী হেসে বললো, বাসন-কোসন তো কিছুই ছিল না। রান্না করব কিভাবে?

প্রবাল সঙ্গে সঙ্গে বললো, তাছাড়া পয়সাকড়িও তো ছিল না।

তাহলে কি করতে? প্রবাল একটু হেসে বললো, এক শিখ গুরুদ্বারে গিয়ে খেতাম।

রোজ?

হ্যাঁ, রোজ দুবেলা।

তারপর?

দিন দশ-বারো পরে ঐ গুরুদ্বারের এক বৃদ্ধ শিখ আমাদের বললেন–

আচ্ছা বেটা, তোমরা বাঙ্গালী, তাই না?

প্রবাল জবাব দেয়, হ্যাঁ।

তোমাদের নতুন সাধী হয়েছে?

হ্যাঁ।

বাড়ী কোথায়? কলকাত্তা?

হ্যাঁ।

হঠাৎ জব্বলপুর চলে এলে কেন?

প্রবাল সত্যি কথাই বললো, আমাদের বিয়েতে আমাদের বাড়ীর মত ছিল না। তাই…

বুঝেছি, বুঝেছি। বৃদ্ধ একটু থেমে প্রশ্ন করেন, তোমরা নিশ্চয়ই পড়ালিখা জানো?

তাঁ, দুজনেই গ্র্যাজুয়েট।

হ্যাঁ।

বহুত আচ্ছা, বহুত আচ্ছা। বৃদ্ধ শিখ আবার কি ভাবেন। তারপর জানতে চান, তোমরা কোথায় থাকো?

একটা ধর্মশালায়।

দুটো ছেলেমেয়েকে আংরেজি পড়াবে?

নিশ্চয়ই পড়াব।

ওরা তোমাদের থাকার ঘর আর কিছু টাকা দেবে।

তাহলে তো খুব ভাল হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *