৪. রবার্ট কনকোয়েস্ট এর ‘গ্রেট টেরর’ এর প্রতারণার সারসংকলন

আমরা বলিঃ আমাদের লক্ষ্য হলো সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা অর্জন করা, যা, শ্রেণিতে শ্রেণিতে মানবজাতির বিভক্তিকে বিলোপ করে, মানুষ কর্তৃক মানুষের উপর আর এক জাতি কর্তৃক অন্য জাতির উপর সমস্ত শোষণের অবসান ঘটিয়ে, অপরিহার্য রূপে যুদ্ধের খোদ সম্ভাবনাকেই বিলুপ্ত করে। — ভ.ই. লেনিন।

৪. রবার্ট কনকোয়েস্ট এর ‘গ্রেট টেরর’ এর প্রতারণার সারসংকলন

1. Making comments with no proof.

2. When he does cite, it’s a rogue’s gallery of anti-Stalinist fanatics. Relies very heavily on the most rabid Rightists

3. He ticks off shootings, jailings, and exilings as if the persons were automatically innocent.

4. Almost never goes into the details or facts of any cases.

5. Never allows the prosecution’s evidence to be presented.

6. Particularly absurd accounts come from Orlov and Kravchenko.

7. Overwhelming use of secondary sources.

8. Uses all the rumors and scuttlebutt he can find.

9. Never shows one example of where Stalin caused a killing of an innocent person whom he knew was innocent.

10. Many times he gives a very superficial, biased presentation of an incident and quickly moves on.

11. Gives a trivial incident and then says the person involved was later arrested, implying he was arrested for the trivial incident. For example: At a meeting of the Kiev Academy of Sciences, for example, someone denounced professor Kopershinsky. Another Communist scientist, Kaminsky remarked, “Where class instinct speaks, proof is unnecessary.” He, too, was later arrested. Moreover, readers simply must accept the assertion that someone was arrested.

12. Uses the word “purged” incorrectly and doesn’t know what a purge is.

13. A lot of reports from anti-Stalin (glasnost) papers but not quoted from the original source.

14. Almost never do two sources report the same act.

15. Statements are not from opening archives but opening up archives to Rightists to spread their poison.

16. The trials really bother Conquest.

17. Always an assumption that anyone in jail is there for political reasons.

18. He often ignores testimony in the major Moscow trials as if it didn’t exist

19. Jumps from topic to topic topic with quick insinuations and no proof’s

20. Uses material in novels as if it were actual history

21. Conquest’s writings reek with words like: seems, probable, probability, appears, presumption, perhaps, probably, no doubt (when there is doubt), presume, might have, implausible, we can envisage, possible, reported, reportedly, stories, unofficial reports, believed to have been, is said to have been, rumors have emerged, seem to have been, presumed, if, it has recently been speculated, and are said to have.

অবশেষে এরকম একটি সিদ্ধান্তে আসা যায় যে রবার্ট কনকোয়েস্ট স্ট্যালিনের বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ হাজির করেছিলেন তার ভিত্তি ছিল অনুমান, ধারণা এবং অনুমতিনির্ভর।

CONQUEST MAKES ALLEGATIONS RESTING ON GUESSES, ASSUMPTIONS, & SPECULATIONS.

On Sept. 23, 1932, Ryutin was again expelled from the Party and arrested. Stalin seems to have hoped that the OGPU might shoot Ryutin without involving the political authorities.

a) “seems” is reliable historical terminology? Conquest, Robert. The Great Terror. New York : Oxford University Press, 1990, p. 24

.

স্তালিনকে উত্তরাধিকার হিসেবে অস্বীকার এবং তাঁর অবদানকে অগ্রাহ্য করা

এই পরিচ্ছদ বিদ্বৎসমাজের মুখে কিছু উচ্চমার্গের নির্বোধের হাসি এনে দিতে পারে! সমালোচনার খোঁচা, প্রায় ঘৃণাতুল্য শিক্ষিত সমাজ থেকে ছুঁড়ে ফেলা হতে পারে, হেয় করা হতে পারে, তীব্র ভাষায় গালিগালাজও করা হতে পারে সেইসব মানুষদের যারা সাম্প্রতিক প্রতিবিপ্লবের আতঙ্কজনক এবং প্রলয়ঙ্কারি বিজয় সত্ত্বেও সমাজতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাস হারাননি। সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত অঞ্চলে আলোড়ন দেখা দিয়েছে, যা জনপ্রিয় শক্তির নতুনভাবে উত্থানের ক্ষমতার ইঙ্গিত দেয়। স্পষ্টই বোঝা যায় প্রতিবিপ্লব ঘটার পরে এবং কিছুটা প্রতিবন্ধী সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রাথমিক পর্যায়ের কাঠামোকে উল্টে দেয়ার ফলে সাধারণ মানুষের জীবনে যা ঘটেছে তার অভিজ্ঞতা স্মরণে রেখে এই শক্তিসমূহ কিছুটা মার্জিত ও সংশোধিত হয়েছে। কমিউনিস্ট নৈতিকতা থেকে বিচ্যুতি, বিকৃতি অধঃপতন নিশ্চয়ই পুঞ্জীভূত হয়েছিল পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নে এবং পূর্ব ইয়োরোপের দেশগুলোর সমাজতান্ত্রিক গোষ্ঠীতে কিংবা ‘পেরেস্ত্রৈকা’ এবং আরও উন্মুক্ত, আরও গণতন্ত্র, আরও সমাজতন্ত্রের নামে (১৯৮৮ সালে প্রাভদায় প্রকাশিত বহুল প্রচারিত প্রবন্ধের শিরোনাম) স্বেচ্ছাকৃত এবং সুপরিকল্পিতভাবে তাকে ভেঙে দেয়া সম্ভব হতো না। ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা এখন পর্যন্ত অনিশ্চিতের গর্ভে, কিন্তু মার্কসবাদীরা অবশ্যই তাদের জীবন ও সমাজ সম্পর্কে বিশ্ববীক্ষা অনুসারে মানব জাতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কখনোই আশা হারান না। শেলীর কবিতার ভাষায়- “to hope till hopecreates/ From it’s own wreck the thing it contemplates”. (আশা করা যতক্ষণ আশা সৃষ্টি হয়/ নিজের বিনাশ থেকে যা অভিপ্রায় করা যায়!)

ইতোমধ্যে জনগণের দুর্দশা বাড়ছে এবং বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন, সাময়িক হলেও লাইনচ্যুত হয়েছে, অনিবার্যভাবে সঠিকখাতে নিয়ে আসতে অসহায়ভাবে পথ হাতড়াচ্ছে। স্বভাবতই সমাজতন্ত্র অচিরেই সারা বিশ্বকে গ্রাস করার ভয় থেকে মুক্ত সমাজতন্ত্রের শত্রুদের শিবিরে আনন্দের জোয়ার বইছে। তাই পুরনো ‘সোভিয়েতবিদ মার্কিন-পোলিশ তাত্ত্বিক ব্রজজিনিস্কি তার “নিদারুণ ব্যর্থ: বিংশ শতাব্দীতে সাম্যবাদের জন্ম ও মৃত্যু” (১৯৮৯) গ্রন্থে সমসাময়িক ঘটনায় হর্ষোৎফুল্ল হয়েছেন। অবশ্য তিনি এই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতেই পারেন, কিন্তু তার এই পরমানন্দ খুব শিগগিরই যেমন সব পরমানন্দের ক্ষেত্রেই ঘটে, প্রবঞ্চনায় পরিণত হবে। কী হবে যদি বিশ্ব প্রত্যক্ষ করে আবার এক সমাজতন্ত্রের পুনর্জীবন কোনোমতেই যা মৃতপ্রায় নয় (সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন অঞ্চলে ইতোমধ্যেই দেখা দিয়েছে) এবং সমস্ত ভীতিকে অতিক্রম করে বীর কিউবায় ও চীনে, তাদের নিজস্ব দৃঢ়তার মধ্যে এখনও উজ্জ্বল।

বর্তমান দুঃখজনক দিনগুলোতে সারা বিশ্বে আমাদের মনে রাখা অবশ্য কর্তব্য যে সমাজতন্ত্র কোনো অন্ধ বিশ্বাস নয়, তা জন্ম দেয় (মার্কসবাদের মৌলিক তত্ত্ব আয়ত্ত করতে পারলেই) যুক্তি ও বাস্তবতায় নিরন্তর পরীক্ষিত এক আস্থা, যা প্রকৃতই যখন জাগ্রত হয় তখন জনগণ সর্বত্রই লোভ ও শোষণের ঐতিহাসিক শৃঙ্খল চূর্ণ করে দেবে। অতএব মানুষই অবসান ঘটাবে যাকে মার্কস বলেছেন, “পুঁজিবাদের অমানবিকতা, লজ্জা ও পঙ্কিলতার” এবং পরবর্তীকালে লেনিন যাকে “সাম্রাজ্যবাদের লুণ্ঠনজীবী অপরিহার্য অংশ হিসেবে নিন্দা করেছিলেন। আজকের নয়া সাম্রাজ্যবাদ তাতে আরও সূক্ষ্মভাবে বিষ নিষিক্ত করেছে, যে কারণে স্তালিন হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, এমনকি সমাজতন্ত্রের যত অগ্রগতি ঘটে ততই আন্তর্জাতিক শ্রেণিযুদ্ধ বিলীন না হয়ে আরও তীব্রতর হয় এবং সেই হুঁশিয়ারির প্রতি বহুকাল কর্ণপাত করা হয়নি, যা “প্রকৃত বিদ্যমান সমাজতন্ত্রের পক্ষে ক্ষতি ও ধ্বংস ডেকে এনেছে। কার্যত একই হুঁশিয়ারি জানিয়েছিলেন মাও সে তুঙ তার বলিষ্ঠ ও প্রগাঢ় অনুশাসন বাক্যে : “শ্রেণিসংগ্রামকে কখনো ভুলিও না”। এই হুঁশিয়ারির প্রাসঙ্গিকতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে যখন প্রকাশ হয়ে গেছে সোভিয়েত ইউনিয়নে ও পূর্ব ইয়োরোপের দেশগুলোতে নির্বাধের মতো মেনে নেয়া হয়েছে সমাজতন্ত্র থেকে বিচ্যুতি এবং আত্মসন্তুষ্টির উত্থান ও জনগণের দুর্দশার প্রতি উপেক্ষা যা একটা নতুন দিকে মোড় নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল, বিশেষত ১৯৮৫ থেকে পরবর্তী সময়ে যখন মিখাইল গর্বাচভ সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতায় এসেছিলেন। আলেকজান্ডার ইয়াকভলেভ, তথাকথিত ‘পেরেস্ত্রৈকার জনক’, এবং অন্যান্য সহকারীদের সঙ্গে নিয়ে গর্বাচভ কার্যত এক ধূর্ত মুখোশে ঢাকা প্রতিবিপ্লবী প্রক্রিয়া (এমনকি যারা বেশি ভালো জানতেন তাদেররও প্রতারণা করেছে) রূপায়ণে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।

কমিউনিস্ট আস্থা এত দুর্বল নয় যা একরকম নীতিহীন হেঁচকা টানে উপড়ে যাবে। মার্কসবাদে গভীর বিশ্বাসী একজনকে প্রস্তুত থাকতে হবে আন্দোলনের মন্দাবস্থা এবং বারংবার অগ্নিপরীক্ষার জন্য। কোনো বিপ্লবই, এমনকি মহান অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবও প্রতিবিপ্লরে বিপদ থেকে মুক্ত নয়। সমাজে মানুষ ও তার জীবনের পুনর্গঠন একটা খেলা নয় যা উত্তেজক কিন্তু অচিরেই একধরনের উজ্জ্বল সোমবারে সকাল এনে দেবে যখন বিপ্লব বিজয়ী হয়েছে, শোষণ নিশ্চিহ্ন হয়েছে এবং সবকিছুই কম-বেশি বাগানে সুন্দর হয়ে ফুটে উঠেছে। তাছাড়া কোনো বিশ্বাসই সময়োপযোগী নয় যদি কেউ তা হারিয়ে ফেলে যেহেতু সময়টা বড় দীর্ঘ এবং পথের শেষ দেখা না পর্যন্ত কেউ জীবিত না থাকেন। মার্কসবাদ যা শ্রেণিহীন সমাজের জন্য অনিবার্য বলে ঘোষণা করে, যা কোনো গনকারের বাণী বা জ্যোতিষীর আগাম ঘোষণা নয়।

চেয়ারম্যান মাও সে তুঙ তার নিজের প্রাচীন দেশের দীর্ঘ ইতিহাস চেতনা থেকে অর্জিত মানসিক স্থিরতার সঙ্গে, আপাতদৃষ্টিতে সরস কিন্তু খুবই গম্ভীর মেজাজে কি একদা আক্ষেপ করেননি যে সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরকরণ কয়েক শতাব্দী, এমনকি কয়েক সহস্রাব্দ লাগতে পারে? (একসময় তাকে ২০০ বছরের প্রাচীন ১৭৮৯ সালের মহান ফরাসি বিপ্লবের মূল্যায়ন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছিলেন, তার সময় এখনও আসেনি।)

আমাদের যুগ এবং ব্যক্তি সমাজতন্ত্রী হিসেবে আমদের কাছে ইতিহাসের কোনো দায় নেই যে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের ইচ্ছা আমাদের সময়েই সাধিত হতে হবে। তবুও আমাদের দায়িত্ব, নির্দিষ্ট বাধ্যবাধকতা পালন করতে হবে, আমাদের আদর্শ সফল করতে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে এবং ইতিহাসের দ্বারা নির্ধারিত লক্ষ্য পূরণে পেছিয়ে যাওয়া বা ব্যর্থ হওয়া চলবে না। এটা খুব সরল উদ্ধৃতি বলে মনে হতে পারে, কিন্তু আমরা যখন আজকের অথবা যে কোনো সময়ের একজন কমিউনিস্ট সম্পর্কে ভাবছি ও লিখছি, তখন রবার্ট ব্রাউনিং-এর কয়েক ছত্র উদ্ধৃত করা আবশ্যক হয়ে উঠছে।

“One who never turned his back bout marched breast-forward/ Never doublted clouds would bread/ Never dreamt, though right were worsed, wrong would triumph/Held, we fall to rise, are baffled to fight better; sleep, to wake!” (যে কখনো পেছু হটেনি, বুক চিতিয়ে এগিয়ে গেছে? কখনো আশঙ্কা করেনি আকাশ ভেঙে পড়বে? কখনো কল্পনা করেনি, ন্যায় পরাস্ত হলেও অন্যায় বিজয়ী হবে/ অটল থেকো, আমরা ওঠার জন্যই পড়ি, হতবুদ্ধিকর হই আরও ভালোভাবে লড়াই করার জন্য; জাগবার জন্যই ঘুমোই)।

কেবল কমিউনিস্টদের কাছেই নয়, সমগ্র মানব জাতির কাছে মহান অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ইতিহাসে এক অক্ষয় কীর্তি রেখে গেছে তার পঞ্জিতে ঠিক যেন সূর্য কিরণের মতো যা কখনোই মুছবে না। সেদিন পর্যন্ত এটা অচিন্তনীয় ছিল যে, ১৯১৭ সাল থেকে ৭০ বছরের মধ্যেই এর আলোকরশ্মি ক্ষীণ হতে শুরু করবে। এটা অবশ্য সর্বকালের ঘটনা নয়, কারণ অদূর ভবিষ্যতে বর্তমানের প্রতিবিপ্লবী শক্তিরা ব্যর্থ হবেই এবং সমাজতন্ত্রের ‘শোকসভা করা বর্তমানে যে ফ্যাশন হয়েছে তা সম্পূর্ণ অনাবশ্যক হয়ে যাবে। মহান অক্টোবর বিপ্লবের উত্তরাধিকার হলো। এমন এক সম্পদ যা পোকায় কেটে বা মরচে পড়ে তার ক্ষতিসাধন করতে পারে না এবং এমনকি আমাদের বিশ্বাসঘাতকতা, যদি আমরা এর প্রতি বিশ্বাসঘাতক হই একে নোংরা করতে পারে না। এই কথাগুলো বহুকাল আগে ভিন্ন এক প্রসঙ্গে বলেছিলেন জন রাস্কিন।

এই বিপ্লবের প্রধান স্থপতি- যদি কোনো একক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে হয় তিনি হলেন অতুলনীয় লেনিন এবং তাঁর পেছনে একমাত্র যোসেফ ভিসারিয়োনভি স্তালিন। যত বিদ্বেষই তাঁর উপর বর্ষিত হোক না কেন লেনিনের পরেই এবং আপাতদৃষ্টিতে আরও প্রতিভাধর বলশেভিকদের ছাড়িয়ে মহান অক্টোবর বিপ্লবের এক প্রতীক হিসেবে, পতাকা বাহক হিসেবে, ঢাল ও তরবারি হিসেবে তাঁর যুগের উপর ছাপ রেখে গেছেন।

স্তালিনের প্রথম দিককার অন্যতম ছদ্মনাম ছিল ক্যাটো (কোবা’ থেকে ধাপে ধাপে উত্তরণ করে স্তালিন, ইস্পাত মানব’)- ক্যাটো ছিলেন প্রাচীন ইতিহাসে এক রোমান কনসাল যাকে রোম সাম্রাজ্যের আগ্রাসনকে রুখে দাঁড়ানো কের্থিজ-এর অনমনীয় শত্রু হিসেবে স্মরণ করা হতো। ক্যাটোর প্রতিটি ভাষণ শেষ হতো। ‘কের্থিজ নিপাত যাক’ ধ্বনি দিয়ে। একই রকম অনমনীয় ঘৃণার সঙ্গে স্তালিন তাঁর যৌবনের শুরু থেকে মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে শিখিয়েছিলেন। বিশ্ব নিন্দুকদের কাছে এটা গতানুগতিক বলে মনে হতে পারে, কিন্তু তার যৌবনের প্রারম্ভ থেকেই সমাজতন্ত্র ছিল তার ধ্যান ও জ্ঞান । এটা ছিল তার এক মহৎ আবেশ যা হয়তো কখনো বিচারবুদ্ধি প্রয়োগে ও কাজে তাঁকে বাড়াবাড়ির দিকে এবং সর্বোচ্চ সমাজতান্ত্রিক স্থির প্রজ্ঞা থেকে (যা একমাত্র লেনিনের মতো মহান ব্যক্তিরই আয়ত্তে ছিল) বিচ্যুতির পথে ঠেলে দিয়েছিল। তথাপি একমাত্র স্তালিনই অক্টোবর বিপ্লবের সঙ্গে এমনভাবে একীভূত হয়ে গিয়েছিলেন যার তুল্য হতে পারেনি কেউ। সেজন্যই, সাম্প্রতিক বিপর্যয় সত্ত্বেও যদি এখনও ইতিহাসের মঞ্চে মহান অক্টোবর বিপ্লবের আলোর বিকিরণ, লেনিনের নামকে ঘিরে অগ্নিশিখা এবং তার পেছনে, এবং তাঁরই একমাত্র পেছনে,

স্তালিনকে ঘিরে এমন ঔজ্জ্বল্য বিচ্ছুরণ করে যা তারাই হৃদয়ে লালিত করেন যাঁরা। গভীর অর্থেই চিন্তাভাবনা করেন “জনগণের উৎসব” সম্পর্কে, এঙ্গেলস একদা বিপ্লবকে যে আখ্যা দিয়েছিলেন।

.

ভারত উপমহাদেশ সম্পর্কে স্তালিনের মূল্যায়ন

স্তালিনের সঙ্গে ভারতীয় কমিউনিস্টদের এই সরাসরি আলোচনার মারফত যা জানা গিয়েছিল, তা হলো উপকথার নায়কস্বরূপ এই বিশ্বনেতা (যার শারীরিক সান্নিধ্য, যারা তার পরামর্শ নিতে গিয়েছিলেন, তাঁদের অভিভূত করে দিয়েছিল!)।

খুব সহজ সরল মর্যাদা ও কমরেডসুলভ আন্তরিকতার সঙ্গে আচরণ করেছিলেন এবং ভারতের আন্দোলনের সামনে উপস্থিত সমস্যা সমাধানে ধীর। স্থিরভাবে সাহায্য করেছিলেন। এই পরামর্শ-আলোচনা সম্পর্কে গোপনীয়তা (তখন সাধারণভাবে গোপন রাখা হয়েছিল এবং এখনও অনেকের কাছে অজানা) সেই সময়ে ছিল সহজবোধ্য, কিন্তু আবার খুবই দুঃখদায়ক যে সে সম্পর্কে বেশি কিছু কেউই জানেন না।

বোধ হয় কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর গোপনীয় কর্মধারার এটাই প্রকৃতি, এবং এই বাড়তি সতর্কতা, কোনো নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে যুক্তিযুক্ত হলেও, মনে হয় অনেক ক্ষেত্রেই বিরূপ ফলদায়ক হয়েছে। কিন্তু, মনে হয় এক সচেতন পরিকল্পনা অনুসারে, গ্লাসসনস্ত-এর আহ্বান নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সুপরিকল্পিত এক অসৎ চরম সীমায়, এবং সোভিয়েত ব্যবস্থার কেবল কাঠামোরই নয়, এমনকি তার মর্মবস্তুকেও চরম ক্ষতি করা হয়েছিল ।

“এই চমৎকার জর্জিয়ান” (তরুণ স্তালিনের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকারে লেনিন তাকে যে আখ্যা দিয়েছিলেন)।

অনমনীয় বিপ্লবী শিক্ষানবিশির পর প্রথম সোভিয়েত সরকারে জাতিসমূহের কমিশার পদে উন্নীত হয়েছিলেন। তিনি ইতোমধ্যেই পরিচিত হয়েছিলেন তাঁর তৎকালীন অসাধারণ গ্রন্থ ‘মার্কসবাদ ও জাতিসমস্যা’ মারফত। এটা তাই তখন খুবই সময়োপযোগী ছিল, ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’- এর কিছুকাল পরেই ১৯১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে লেনিনের সঙ্গে স্তালিন স্বাক্ষর করেছিলেন রাশিয়া ও প্রাচ্যের শ্রমজীবী মুসলিমদের প্রতি বিখ্যাত ঘোষণাপত্রে।

এই পটভূমিতেই রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপের মতো ভারতের লড়াকু দেশপ্রেমিক বরকতুল্লাহ ওবেদুল্লাহ এবং অন্যান্যদের সঙ্গী করে বিদেশে স্বাধীন ভারতের অস্থায়ী সরকার গঠন করেছিলেন কাবুলে। এই তীব্র আবেগের বাতাবরণে ভারতীয় মুহাজারিনসরা (মুজাহিদিনস?) সোভিয়েত দেশে আশ্রয় নেন যা ১৯১৯ ২০ সালে স্বরাজের জন্য মহাত্মা গান্ধীর খিলাফৎ ও অসহযোগ আন্দোলনে প্রেরণা যুগিয়েছিল এবং যা শেখ- উল- হিন্দ’ মাহমুদ হাসান ও মৌলানা আবুল কালাম আজাদের মতো খ্যাতনামা মুসলিম ব্যক্তিত্বকে পরস্পরের কাছাকাছি টেনে এনেছিল এবং দেশব্যাপী অভ্যুত্থানে হিন্দু-মুসলিম সকলেই হাত মিলিয়েছিলেন যা ইতোপূর্বে কখানোই ঘটেনি। তখন বিপ্লবী জাতীয়তাবাদীদের বিভিন্ন গোষ্ঠী (যাদের ব্রিটিশরা প্রায়ই সন্ত্রাসবাদী বলে আখ্যা দিত) মার্কসবাদের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছিল। ১৯২০ সালে তাসখন্দে প্রবাসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন ছিল এমন একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা যা জাতিসমূহের কমিশার হিসেবে স্তালিন নিশ্চয়ই লক্ষ করেছিলেন।

১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে সোভিয়েত সরকার, তাদের দেশ আক্রমণের লক্ষ্যে হস্তক্ষেপকারী শক্তি ১৪ রাষ্ট্রের জোটের চাপ উপেক্ষা করে, একটি অভূতপূর্ব সম্মেলন, প্রাচ্যের জনগণের কংগ্রেস অনুষ্ঠিত করেছিল, যেখানে ৩৭টি জাতির ১,৮১৯ জন প্রতিনিধি যোগ দিয়েছিলেন এবং স্তালিন সেখানে ভাষণ দেন। ২০-এর দশকে যথাক্রমে পেশোয়ার ও লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা- বিখ্যাত মিরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলার (১৯২৮-৩৪) পূর্বানুসারী, ছিল আলোড়নের দৃষ্টান্ত যা ভারতকে কাঁপাতে শুরু করেছিল।

তখন মস্কোয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক-এর সদর দপ্তরে ছিলেন এম এন রায়ের মতো ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী, যিনি দেশে ঘনিষ্ঠভাবে লড়াইয়ে অংশ নিয়ে বিদেশে পালিয়ে গিয়েছিলেন। রায় প্রথম মেক্সিকোতে আবিষ্কার করেছিলেন। সাম্যবাদের মধ্যে বিশ্বব্যাপী মুক্তির আদর্শ এবং সেখানে পার্টির নেতা হিসেবে কাজ করেছিলেন ও সূচনাকালে তিনি ছিলেন কমিনটার্নে তার প্রতিনিধি। স্বাভাবিকভাবেই তাকে সেখানকার ভারতীয় ব্যুরোর দায়িত্ব দেয়া হয় এবং ভারতের লড়াই-সংগ্রাম সম্পর্কে সংগৃহীত খবরাখবরের ভিত্তিতে মস্কো বোঝার চেষ্টা করেছে ভারতের ঘটনাবলি এবং যতটা সম্ভব ক্ষমতাধর সব বিপ্লবী প্রবণতাকে সাহায্য করেছে।

১৯০৮ সাল থেকে যখন স্টুটগার্টে অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ম্যাডাম কামা কিছু কারণবশত, কেউ তাকে ভারতের একজন গোড়ার যুগের কমিউনিস্ট বলে দাবি করতে পারেন, স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন এবং লেনিন গণ্য হয়েছিলেন ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতের পূর্ণ মুক্তির সরব সমর্থক হিসেবে। এটা ছিল লক্ষণীয় বৈপরীত্য যা ম্যাডাম কামা নিজেই প্রমাণ দিয়েছেন

পশ্চিমা সোস্যাল ডেমোক্র্যাটদের (এমনকি প্রকৃতই সহৃদয় ব্যক্তিত্ব জঁ জোর সহ) দৃষ্টিভঙ্গির, যারা ভারতের মতো উপনিবেশের ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানাতে অস্বীকার করেছিল। এমনকি এর আগেও বালগঙ্গাধর তিলকের গ্রেপ্তার ও কারাবাস (১৯০৮) প্রসঙ্গে লেনিন ভারতে ব্রিটিশ শাসনের তীব্র নিন্দা করে জ্বালাময়ী ভাষায় লিখেছিলেন। ১৯২০ সালে লেনিন তার চিরায়ত রচনা, “বামপন্থী সাম্যবাদ– শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা”-এর জালিয়ানবাগ হত্যাকাণ্ডকে (এপ্রিল ১৯১৯) কশাঘাত করেছেন এবং দেশকে মুক্ত করার জন্য তাঁর ভাষায় ‘ভারতের বলশেভিকদের’ অবশ্যম্ভাবী উত্থানকে স্বাগত জানিয়েছেন।

অসহযোগ আন্দালনের (১৯১৯-২২) পর, সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়ার কিছু অপ্রীতিকর বহিঃপ্রকাশ সত্ত্বেও, এটা লক্ষণীয়, স্তালিন নিজে ১৯২৪ সালে ‘লেনিনবাদের ভিত্তি প্রসঙ্গে তাঁর বিখ্যাত ভাষণে আশা প্রকাশ করেছিলেন যে শিগগিরই ভারতে বিপ্লব সংঘটিত হবে এবং রাশিয়ার পর বিশ্ব- সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খলের পরবর্তী বৃহৎ যোগসূত্র ছিন্ন করবে। সেই প্রত্যাশা অবশ্য পূরণ হয়নি, কিন্তু এই বিখ্যাত উক্তি নজির হয়ে আছে স্তালিনের এবং সমগ্র সোভিয়েত জনগণের পুনরুত্থানকারী ভারতের কাছ থেকে প্রত্যাশা ও চাহিদার ।

নিরন্তর কুৎসা ও নিন্দা সত্ত্বেও স্তালিন কষ্টভোগ, বিয়োগ ও বিজয়ের তিন দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতাঁকে পরিণত হয়েছিলেন, এবং তাঁর প্রতি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ছিল গভীর শ্রদ্ধা। তাঁর সমালোচকও ছিল নিঃসন্দেহে; কখনো কখনো অবরুদ্ধ সোভিয়েতের স্থায়িত্বের ভার উদ্বেগ ও সতর্কতা হেতু ভারতীয় মুক্তি সংগ্রামে আরও বেশি সাহায্য করতে না পারায় ভারতের কিছু প্রগতিশীল শক্তিও খেদ প্রকাশ করেছেন। যেমন, সুভাষচন্দ্র বসু, ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করতে তার অসাধারণ একনিষ্ঠ উৎসাহবশত সোভিয়েত নীতি সম্পর্কে কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি ছিল (তার ‘দ্য ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল’ গ্রন্থ দ্রষ্টব্য)। তাঁর মতোই জাতীয় বিপ্লবীদের অনুশীলন দলের মধ্যেও একধরনের ভুল বোঝাবুঝি ছিল, যারা যথাযথ উপলব্ধি করতে পারেননি ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের লেনিনীয় নীতি, যা সোভিয়েত ইউনিয়নের অবরুদ্ধ অবস্থায় অপরিহার্য ছিল। নিজের দেশের জনগণের প্রতি এবং একই সঙ্গে সারা বিশ্বের জনগণের প্রতি মাথা ঝিমঝিম করা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে স্তালিনের প্রয়োজন হয়েছিল সিংহের মতো মনোনিবেশ ও বিচক্ষণতা’ ( যে গুণ তাঁর মধ্যে দেখেছিলেন মহান ফরাসি লেখক অঁরি বারব্যুস)। যাই হোক বিপ্লব তো রপ্তানি করা যায় না এবং প্রতিটি দেশকেই, বিপ্লবে আগ্রহী যারা, নিজের পথ ও পদ্ধতি স্থির করে নিতে হয়। সোভিয়েত বাধ্য হয়েছিল নিজের শক্তি সংহত ও সুরক্ষিত করার কাজে মনোনিবেশ করতে, যাতে বিশ্ব শত্রুতাকে উপেক্ষা করে দৃষ্টান্তস্বরূপ সমাজতন্ত্রের সাফল্য সোভিয়েত ইউনিয়নকে তুলে ধরতে পারে। স্তালিন তাই সর্বদাই সোভিয়েত জনগণকে দৃঢ় পরিশ্রম করতে আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে তাদেরকে বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষ নিজেদের রক্ষা করতে’ ও ‘শ্রমজীবী জনগণের পিতৃভূমি’ বলে গণ্য করেন। সোভিয়েতের ক্ষমতার উপর চাপিয়ে দেয়া সোভিয়েত বিদেশ নীতির বাধ্যবাধকতা সব সময়ে সকলে যথাযথ উপলব্ধি করতে পারেননি, কিন্তু মধ্য ত্রিশের দশকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সোভিয়েতই ছিল প্রকৃত মিত্র। তাই ১৯৩৬ সালে লক্ষ্মৌতে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসে সভাপতিত্ব করতে গিয়ে জওহরলাল নেহরু সোভিয়েতের “বিশাল দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বিস্তারকারী ভূমিকা”-র কথা উল্লেখ করেন এবং জোরের সঙ্গে বলেন যে, কোথাও ‘ইতিহাসে গণতান্ত্রিক নীতির এমন বাস্তব প্রয়োগ ঘটেনি এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্বিমত থাকলেও তুলে ধরেছিলেন একটি মহান ও আকর্ষণীয় নতুন ব্যবস্থার এবং আমাদের অন্ধকারময় যুগে এক ভবিষ্যৎ সম্ভবনাপূর্ণ নতুন সভ্যতার অভ্যুদয় ।

.

সমালোচকের প্রশংসা!

প্রসঙ্গত, তিরিশের দশকের গোড়ায় সিডনি ও বিয়েত্রিচ ওয়েব, সাধারণভাবে ইংরেজভাষী বিশ্বে প্রখ্যাত সমাজতান্ত্রিক গবেষক বলে গণ্য, সোভিয়েত সাম্যবাদ’-এর উপর আধুনিক যুগের বৌদ্ধিক ইতিহাসে এক যুগান্তকারী কাজ করেছিলেন, যা কয়েক দশক যাবৎ শিক্ষিত মহলে ও অন্যত্র প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিরা হেয় করার চেষ্টা করেছে। ওয়েব দম্পতি ছিলেন প্রভাবশালী ফেবিয়ান সোসাইটির অন্যতম নেতা। বলশেভিকদের প্রতি অনীহা তারা কখনো গোপন করেনি। তথাপি দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর তারা সোভিয়েত সাম্যবাদ এক নতুন সভ্যতা?’ শিরোনামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন (১৯৩৫ সংস্করণ), প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই সর্বত্র প্রগতিশীল মহলে অভিনন্দিত এবং প্রতিক্রিয়াশীল অভিমতে নিন্দিত। এই গ্রন্থের। প্রথম সংস্করণ খুব দ্রুতই শেষ হয়ে যায় এবং ওয়েব দম্পতি সংশোধিত সংস্করণ সম্পূর্ণ করে ঘোষণা করেছিলেন। তারা শিরোনাম থেকে প্রশ্নবোধকটি তুলে দিচ্ছেন। এবং আরও বলেছিলেন, যদি কেউ প্রশ্ন করেন এই নতুন সভ্যতা স্থায়ী ও প্রসারিত হবে কিনা, তাহলে তাদের উত্তর হবে, ‘হ্যাঁ’। গ্রন্থটির এই সংস্করণ বর্তমানে সুপরিকল্পিতভাবে সাধারণের এবং শিক্ষিত মহলের দৃষ্টি থেকে আড়াল করা হয়েছে, প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪১ সালে, যে বছর হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে। সেই সংস্করণে বিয়েত্রি ওয়েব একটি দীর্ঘ বিশেষভাবে রচিত ভূমিকা লেখেন, যাতে তিনি স্তালিনের নেতৃত্ব, ষড়যন্ত্র মামলা (যা তখনকার তীব্র সোভিয়েত বিরোধী প্রচারের ভিত যুগিয়েছিল), গোঁড়ামির রোগ প্রভৃতি বিষয়গুলো গভীরভাবে সমালোচনা করেছিলেন এবং দৃঢ়ভাবে সত্য হিসেবে প্রতিপাদন করেছিলেন যে, সবকিছু মিশিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল বিশ্বের সবচেয়ে ব্যাপক এবং সমতাপূর্ণ গণতন্ত্র। প্রসঙ্গক্রমে স্তালিন যুগ’ কথাটা আনা লুই স্ট্রং রচিত বিখ্যাত গ্রন্থের শিরোনাম যা সঠিক তথ্য পরিবেশনে খুবই মূল্যবান বলে গণ্য হয়েছিল, যখন সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতিতম কংগ্রেসে (১৯৫৬) নিকিতা ক্রুশ্চভ তথাকথিত ব্যক্তিপূজার অভিযোগে স্তালিনের বিরুদ্ধে জেহাদ শুরু করেছিলেন।

একটি বিকাশমান বিপ্লবের বিভিন্ন পর্যায়ের ঐতিহাসিক মূল্যায়ন অবশ্যই করণীয়। কিন্তু তার পর থেকে স্তালিন নেতৃত্বের উপর তীব্র কষাঘাত ভয়ংকর ফ্যাশনে রূপ নিয়েছে (সমাজতান্ত্রিক শত্রুদের হাতে সর্বত্র)। এটা প্রতিবিপ্লবের রসদ যুগিয়েছে, শুরুতে ধূর্ততার মুখোশের আড়ালে, ১৯৮৫-৮৭ সালে গর্বাচভ অ্যান্ড কোম্পানি দ্বারা এবং পরবর্তীকালে যথেষ্ট মারাত্মক হয়ে ওঠে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় ঘটাতে।

.

স্তালিনের ভারত বিষয়ে আগ্রহ

এই আলোচনার পরবর্তী অধ্যায়ে দেখা যাবে এশিয়া ও ইয়োরোপের সংযোগস্থল জর্জিয়ায় জন্ম পৃথিবীর এক ঐতিহাসিক মঞ্চে পৌরাণিক ও প্রায়শই যুদ্ধ-বিধ্বস্ত এক সভ্যতার গর্বিত উত্তরাধিকারী, একই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী পশ্চিমা দুনিয়ার কর্তৃত্ব সম্পর্কে সচেতন, স্তালিন কখনো লেনিন ব্যতিরেকে অন্য বেশিরভাগ বলশেভিক নেতার মতো ‘ইয়োরোপ-কেন্দ্রিক হয়ে ওঠেননি। স্তালিনের চিন্তা ভাবনা ছিল মার্কস এঙ্গেলসের অনুসারী যারা সেই ১৮৫৯ সালের আগস্ট মাসেই পরস্পরের প্রতি চিঠিপত্রে জোর দিয়েছিলেন এই ছোট্ট কোণে অর্থাৎ ইয়োরোপে বিপ্লব বাঁচবে না যদি পুঁজির সাম্রাজ্য সারা পৃথিবীজুড়ে বাড়তে থাকে। স্তালিন কখনো ইয়োরোপীয় পোশাক পরেননি এবং নিশ্চয়ই তার কিছুটা প্রাচ্যজাতীয় গর্ব ছিল যা তাঁর প্রথম দিককার একটি লেখায় তাঁকে ভূষিত করেছিল প্রাচ্যের আলোক বলে। মার্কস-এঙ্গেলসের রচনা পড়ে তিনি নিশ্চয়ই তাদের পত্রাবলিতে আনন্দের সঙ্গে লক্ষ করেছিলেন যে সেই ১৮৮২ সালেই উল্লিখিত হয়েছিল ভারত ও আলজেরিয়ায় আসন্ন বিপ্লবের প্রত্যাশা। এখন উদ্ভট শোনাতে পারে, কিন্তু মার্কস যার কাছে সারা বিশ্বই ছিল স্বজন, হয়তো পড়েছিলেন সেই ঘটনার কথা যখন গুরুচরণ সিং নামধারী’ শিখদের প্রতিনিধি হিসেবে (যাদের মধ্যে কয়েকজন শ্রেষ্ঠদের ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে অংশ নেওয়ায় শাস্তি হিসেবে কামানের সামনে দাঁড় করানো হয়েছিল) বন্ধুর পথ অতিক্রম করে ১৮৭৯ সালে ভারতের স্বাধীনতার জন্য জারের সাহায্য চাইতে গিয়েছিলেন (যা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল)। কিন্তু স্মরণ করা যেতে পারে, ১৮৭৯ সালের মে মাসে বোম্বাইয়ে রুশ যুদ্ধ জাহাজের রুটিনমাফিক ভিড়বার ঘটনায় রাশিয়া ও নানাসাহেব (১৮৫৭ সাল খ্যাত) কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত ব্রিটিশ সরকারের দ্রুত পতন সম্পর্কে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছিল এবং বোম্বাই বন্দরে বিপুল সংখ্যক মানুষের সমাগম ঘটিয়েছিল। (অক্টোবর ১৯১৭) ব্রিটিশরা, উইনস্টন চার্চিলের ভাষায় শিশু সোভিয়েতকে গলা। টিপে হত্যা করতে আগ্রহী, লেনিন ও তার বলশেভিকরা হলো ‘শয়তানের শরীরী রূপ’ আখ্যা দিয়ে বুর্জোয়া প্রচার ভারতবর্ষে চালান দিত। এমনকি মহাত্মা গান্ধী, যিনি ১৯১৯ সালে দেশের নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন, প্রকাশ্যে বলেছিলেন যে তিনি তথাকথিত ‘রুশ জুজু’-দের ভয় করেন না।

তবে বিশ্বব্যাপী প্রসার ও প্রভাবসহ অক্টোবর বিপ্লব এবং ভারতের স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ের মধ্যে গভীর সম্পর্ক ছিল। দুটোই ছিল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় প্রভৃতি সবরকম শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। আশ্চর্য হওয়ার কিছু ছিল না যে ব্যাপক সাম্রাজ্যবাদী প্রচার ভারতীয়দের চোখে লেনিন এবং শুরুতে ট্রটস্কি ও পরে সবার সেরা স্তালিনসহ বলশেভিকদের কলঙ্কিত করতে পারেনি।

এমনকি যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রথম পর্যায়ে অনেকের মনেই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সম্পর্কে ভুল ধারণা ছিল (কারণ ফ্যাসিবাদ ছিল ব্রিটেনের বলতে গেলে, “আমাদের শত্রুর শত্রু” এবং সেজন্য অবাঞ্ছিত ‘বন্ধু’ নয়), সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের মৌলিক মিত্রতা গুরুতরভাবে বিঘ্নিত হয়নি। সোভিয়েত যদি ধ্বংস হয় তাহলে বিশ্বের দরিদ্র মানুষদের পক্ষে কে দাঁড়াবে? এই ছিল গান্ধীর প্রতিক্রিয়া যা ১৯৪১ সালের শেষ দিকে লেখা হয়েছিল। বহু বছর ধরে অবরুদ্ধ ও হিটলারের আক্রমণে বিপদগ্রস্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে ভারতের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে বাস্তবিকভাবে সাহায্য করার ক্ষমতা প্রয়োগে কিছুটা অসুবিধা ছিল। তাছাড়া বিপ্লব রপ্তানিযোগ্য পণ্য নয়; একটা স্যুটকেসে ভরে তা এক দেশ থেকে আরেক দেশে নিয়ে যাওয়া যায় না।

তবুও ভারতের পক্ষে খুব আনন্দদায়ক সংবাদ ছিল যখন ১৯৪১ সালের আগস্ট মাস নাগাদ স্তালিনের বিদেশমন্ত্রী মলোটভ স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, সময় আসছে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সোভিয়েত জনগণ তাদের মহান নেতা জে ভি স্তালিনের নেতৃত্বে নিশ্চিতভাবে কেবল ইয়োরাপের নয়, সমগ্র বিশ্বের জনগণকে মুক্ত করবে। কিন্তু ইতিহাসে জাতীয় মিত্রতা হলো এক বিষয়গত উপাদান এবং স্তালিন ও তার সোভিয়েত দেশের সঙ্গে ভারতের মিত্রতার সংযোগ গড়ে তুলেছে সযত্নে লালন করার মতো এক উত্তরাধিকার।

দেশের জাতিসমূহ সম্পর্কিত নীতির প্রধান প্রণেতা ও প্রয়োগকারী যা এক সময় শত্রু-মিত্র উভয়ের দ্বারাই প্রশংসিত, স্তালিনের উপর পরবর্তীকালে প্রচণ্ড প্রতিহিসাপূর্ণ আক্রমণ সত্ত্বেও সারা বিশ্ব জানে অথবা অন্তত জেনে নেয়া উচিত যে, লেনিনের প্রথম জাতিসমূহের কমিশার (একই সঙ্গে শ্রমিক ও কৃষকদের তদারকি কমিশার) ছিলেন স্তালিন যাঁর ককেশীয় পটভূমি এবং তৃণমূল স্তরে ব্যাপক বৈপ্লবিক অভিজ্ঞতা ছিল আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক পরম সম্পদ।

১৯৪৭-এর ১৩ এপ্রিল কূটনৈতিক আদান-প্রদানের চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার আগে জওহরলাল নেহরু, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভাইস-প্রেসিডেন্ট (ব্রিটিশ ভাইসরয় ছিলেন প্রেসিডেন্ট) হওয়ার অব্যবহিত পরেই চেয়েছিলেন বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ আলোচনা করতে মস্কোয় একটি মিশন পাঠাতে। অবশ্য তার প্রয়োজন হয়নি, কারণ মলোটভ ভারতের পরিকল্পনা জানতে পেরে, ভারতের প্রতিনিধি দলকে সানফ্রান্সিসকোয় এক ভোজসভায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এবং নিঃসন্দেহে স্তালিনের নির্দেশে, তাঁদের জানিয়েছিলেন মস্কো সফর না করেও সব কিছু সুসম্পন্ন হবে।

রাধাকৃষ্ণন যখন স্তালিনকে বিদায় জানাতে গিয়ে তাঁর পিঠ চাপড়িয়ে (তার সকল বন্ধুরাই জানেন সেটাই ছিল রাধাকৃষ্ণনের অভ্যাস) বলেছিলেন : “নিজের প্রতি নজর দিয়ো, মার্শাল, ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুক।” এটাই ছিল স্তালিনের প্রাপ্য, যিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ এমনকি তার খ্যাতির মধ্যেও এক বিস্ময়করভাবে নাড়া দেয়া আচরণ যা তার সঙ্গী-সাথিদেরও কেউ দেখাতে সাহস পেত না। রাধাকৃষ্ণন বলেছিলেন যে মুহূর্তের জন্য হলেও এই ‘ইস্পাত মানবের চোখে তখন জল এসে গিয়েছিল। এটা প্রায় তারই পুনরাবৃত্তি, যদিও ভিন্ন পটভূমিকায়, তেহরানের এক দৃশ্যে (১৯৪৩) যখন স্তালিনগ্রাদের বীরদের সম্মানে ইংল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ জর্জ প্রদত্ত সোনার তরবারি চার্চিলের কাছ থেকে স্তালিন গ্রহণ করেছিলেন। মার্কিন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট নিজে লিখে গেছেন যে, স্তালিন স্পষ্টতই আবেগাপ্লুত হয়ে এগিয়ে এসেছিলেন তরবারিটি গ্রহণ করতে, চুম্বন করেছিলেন ও তাঁর সহকারী ভবোশিলভের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, কঠিন হৃদয় কমিউনিস্টের চোখেও তখন অশ্রু চক চক করছিল। বোধহয় সোভিয়েত ইতিহাস রচনায় বাঁক ফেরা ও মোড় ঘোরার ফলে যে অন্ধকারের ছায়া পড়েছে তা সঠিকভাবে যদি কখনো লেখা হয় তাহলে জানা যাবে স্তালিন কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন।

.

গ্রন্থপঞ্জী

১। মেমেরায়্যারস অ্যান্ড মিউজিংস- দিল্লি ১৯৭৯,

২। Reflections on a Ravaged Century- Robert Conquest

৩। Stalin: Breaker of Nations– Robert Conquest

৪। Gulag: A History –Anne Applebaum

৫। Parenti, Michael. Blackshirts and Reds, San Francisco: City Light Books, 1997

৬। Medvedev, Roy. Let History Judge. New York: Columbia University Press, 1989

৭। Rybin, Aleksei. Next to Stalin: Notes of a Bodyguard. Toronto: Northstar Compass Journal, 1996

৮। Ritterspom, Gabor. Stalinist Simplifications and Soviet Complications, 1933-1953. New York: Harwood Academic Publishers, c1991

৯। Service, Robert. Stalin. Cambridge, Mass.: Belknap Press of Harvard Univ. Press, 2005

১০. Cummings, Arthur. The Moscow Trial (Metro-Vickers). London: Victor Gollancz, 1933

১১. Conquest, Robert. The Great Terror. New York : The Macmillan Co., 1973

১২. Chuev, Feliks. Molotov Remembers. Chicago: I. R. Dee, 1993

১৩. Martens, Ludo. Another View of Stalin. Antwerp, Belgium: EPO, Lange Pastoorstraat 25-27 2600

১৪. Brar, Harpal. Trotskyism or Leninism. 1993

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *