৪. যন্ত্র গণতন্ত্র জনসমাজ ও বুদ্ধিজীবী

যন্ত্র গণতন্ত্র জনসমাজ ও বুদ্ধিজীবী

বিদ্যাবুদ্ধির বেসাতি করে বেঁচে থাকা ক্রমেই বুদ্ধিমানদের সমাজে এক সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সমস্যাটা যে কত জটিল ও গভীর তা আজ আর বিদ্যার ব্যাপারীদের বুঝতে বাকি নেই। তবু বুদ্ধিমান সমস্ত জীবের মধ্যে মানুষই যেহেতু নিজের বুদ্ধি সম্বন্ধে সবচেয়ে বেশি সচেতন, তাই তার নিশ্চিদ্র অহমিকার লৌহবর্ম ভেদ করে সহজে এই সমস্যা কোনো নূতন চৈতন্য সঞ্চার করতে পারে না। বিদ্যাবুদ্ধির ব্যাপারে মানুষের মতো এমন অঘোর অচৈতন্য আত্মপ্রেমিক জীব আর কেউ নেই। তার কারণ, বুদ্ধি থাকলেও মানুষ ছাড়া আর কোনো জীবের বিদ্যার্জনের সুযোগ নেই এবং অর্জিত বিদ্যার অহংকারও নেই কারও। নিজের বুদ্ধির শূন্যকুম্ভের শব্দঝংকার নিজের কানেই অপূর্ব শ্রুতিমধুর মনে হয় এবং ঘুমপাড়ানি গানের মতো সেই শব্দে নেশায় বিভোর হয়ে থাকতে ভালো লাগে। রাস্তার রাম—রহিম থেকে আরম্ভ করে বিদ্যাবুদ্ধির দুর্ভেদ্য সাধনচক্রের সিদ্ধপুরুষ পর্যন্ত সকলকেই সমান স্তরের আত্মকামুক বলা যায়। তাই কবি এজরা পাউন্ডের এই বীতরাগকে মনে হয় ব্যতিক্রম :

O God….patron of thieves,
Lend me a little tobacco-shop,
Or instal me in any profession
Save this damn’d profession of writing,
Where one needs one’s brain all the time.

প্রবন্ধকদের পৃষ্ঠপোষক ভগবানকে আহ্বান করে কবি যে তামাকের দোকান ভিক্ষা করেছেন তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। দেহের সমস্ত অঙ্গের মধ্যে মাথার উপর অনেকের আস্থা অগাধ। মাথাটাকে অন্যান্য ‘কমোডিটি’র মতো তাঁরা বাজারস্থ করতে চান না, যদিও গোটা জগৎটাই বাজার এবং বুদ্ধিজীবী ও তাঁর বুদ্ধি ধনতান্ত্রিক বাজারের পণ্য। বাজারদরের কথা যদি নিতান্তই ওঠে তাহলে ‘প্রফেসার’ নিশিকান্ত (সংগীতজ্ঞ), ‘প্রফেসার’ পঞ্চানন (জাদুকর), ‘প্রফেসার’ রামচন্দ্র (ব্যয়ামবীর পালোয়ান) ও ‘প্রফেসার’ প্রফুল্লকুমার (কলেজ মাস্টার), সকল শ্রেণির ‘প্রফেসার’ একবাক্যে মাথার দর সমান দাবি করবেন। মুশকিল হল, মাথা এমনই এক পদার্থ যা বিল্বফলের মতো ফাটিয়ে দেখে যাচাই করা যায় না। মগজের ব্যাপারীদের সবচেয়ে বড় সুবিধা সেইখানে। বাকি থাকে, মগজের ‘প্রোডাক্ট’ দেখে যাচাই করার পন্থা। কিন্তু সেখানেও প্রশ্ন উঠবে, কে যাচাই করবে কার ‘প্রোডাক্ট’। কোন কৃতী কার কীর্তি বিচার করবেন?

এক মাথা যখন অন্য মাথার বিচার করবে, তখনই মাথায় মাথায় ঠোকাঠুকি লাগবে। একই পণ্যের দুই ব্যবসায়ী যেমন নিজের পণ্যের শ্রেষ্ঠতা প্রতিপন্ন করতে ব্যস্ত থাকেন, মস্তিষ্কের কীর্তির ক্ষেত্রেও তেমনি প্রতিযোগীর সেই হীন আত্মশ্রেষ্ঠতা প্রকাশের ব্যস্ততা সর্বক্ষেত্রে প্রকট হয়ে ওঠে। মাথা থাকা সত্ত্বেও মাথা নিয়ে যাঁদের মাথাব্যথা নেই, সেই সব সাধারণ লোক, মস্তিষ্ক—প্রধানদের অন্তরের দৈন্য দেখে শিউরে উঠবেন। নানা আকারের অগুণতি গোলাকার মাথার চকমকিঘর্ষণে যে অগ্ন্যুদগীরণ হবে, তাতে দেখা যাবে শেষপর্যন্ত সকলের বিদ্যাবুদ্ধিই ভস্মীভূত হয়ে গেছে। অর্থের মূলধন সমাজে কত অনর্থ ঘটাতে পারে, তা নিয়ে উনিশ শতকের মধ্যভাগে কার্ল মার্কস যুগান্তকারী গবেষণা করেছিলেন। কিন্তু বিদ্যাবুদ্ধির মূলধনও যে সমাজের কত অকল্যাণ, কত অনিষ্ঠ করেছে এবং করছে, তা নিয়ে বিশ শতকের মধ্যভাগে আজ রীতিমতো চিন্তা করার সময় এসেছে। বর্তমানে সমাজের চিন্তামণিরা তা নিয়ে অবশ্য চিন্তা করছেন, কিন্তু সমস্যা এত বেশি যে চিন্তার কোনো কিনারা খুঁজে পাচ্ছেন না তাঁরা। একালের ধাবমান সমাজের দিকে চেয়ে মগজসর্বস্ব এলিটশ্রেণি বা বিদ্বৎশ্রেণি সম্বন্ধে কোনোরকম উজ্জ্বল ভবিষ্যদ্বাণী করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। বিদ্যাবুদ্ধির কোনো বিশেষ উপরিসমাদর, স্বীকৃতি ও সম্মান ভবিষ্যৎ সমাজে আদৌ লভ্য হবে কিনা, সে বিষয়েও অনেকের মনে সন্দেহ জাগছে, যত দিন যাচ্ছে এবং বুর্জোয়া সমাজের গণতান্ত্রিক গতির বেগ যত বাড়ছে, ততই এই সন্দেহের কৃষ্ণছায়া দীর্ঘতর হচ্ছে তাঁদের মনে।

বুদ্ধিজীবীর বা এলিটশ্রেণির সত্তার স্বাতন্ত্র্য ভবিষ্যতের জনসমাজে স্বীকৃত হবে না। কোনো বিশেষ সমাদর ও সামাজিক উচ্চমর্যাদার অধিকারী হবেন না তাঁরা। তাঁদের সমস্ত কীর্তি, ভেলকির মতো অত্যাশ্চর্য ব্যাপার হলেও দৈনিক সংবাদপত্রের চমকপ্রদ সংবাদের মতোই গৃহীত হবে এবং ক্ষণিকের স্থায়িত্বই হবে তার প্রাপ্য। কীর্তিমানেরা সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় প্রাতঃকালে সমুদ্ভাসিত হয়ে উঠে, সেইদিন অপরাহ্নে বিস্মরণের অন্ধকারে বিলীন হয়ে যাবেন। বহু কীর্তিমানের অজস্র ছোট—বড়—মাঝারি কীর্তির তলায় পূর্বের কীর্তি সমাধিস্থ হয়ে যাবে। ছোট—বড়—মাঝারি সকল রকমের মাথাই থাকবে সমাজে, কিন্তু কেবল তাদের আকারগত নৃতাত্ত্বিক গুরুত্ব ছাড়া আর কোনো ‘গুরুত্ব’ আরোপ করা হবে না। খ্যাতির বাতি জ্বলে উঠতে উঠতে ফুৎকারে দপ করে নিভে যাবে। পয়লা কার্তিকের কীর্তিমানদের পয়লা অগ্রহায়ণ চিনতে পারবে না কেউ। বিদ্যাবুদ্ধির নার্সিসাসদের তখন একমাত্র সান্ত্বনা হবে (যদি অবশ্য সমাজের গতির সঙ্গে তাঁরাও নিজেদের মানসিক গড়ন না বদলান)—’আমার কীর্তির চেয়ে আমি যে মহৎ’—এই মন্ত্র জপ করে বেঁচে থাকা। ক্রমে তাঁরা দেখবেন, তাঁদের কীর্তি তো দূরের কথা, তাঁদের ব্যক্তিত্বের মহত্ত্বও তাঁদের বিদ্যাবুদ্ধি কর্ষণ—সাধনের গুহ্যচক্রের একশত বর্গ ফুট (১০ ফুট x ১০ ফুট একটি ঘরের আয়তন) এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ, তার জৌলুষের একটা রশ্মিও তার বাইরে ঠিকরে পড়ছে না, এবং বৃহত্তর সমাজে তা নির্মমভাবে উপেক্ষিত। দুদ্দাড়গতি বর্তমান জনসমাজের রথচক্রের সমস্ত রহস্যময় ইন্টিলেকচুয়াল সাধনচক্র চূর্ণ হয়ে যাবে। এক—একজন সিদ্ধপুরুষ ও তাঁর দু—চারজন মন্ত্রশিষ্য নিয়ে যে সব elite group গড়ে ওঠে সমাজে এবং মধ্যে মধ্যে তাঁরা যে সব ফতোয়া জারি করেন, তার মূল্য নির্ধারিত হবে বাইরের সমাজের প্রতিদিনের অসংখ্য হ্যান্ডবিল ইশতেহারের মতো চাঞ্চল্য যদিও বা জাগে কোনো কারণে, তাহলেও বাইরের বিচিত্র চাঞ্চল্যের প্রবল ঘূর্ণিতে সেই একটিমাত্র ইন্টিলেকচুয়াল চাঞ্চল্যের কোনো আকর্ষণই থাকবে না। চাঞ্চল্যের প্রতিযোগিতায় বিদ্যাজীবীরা সকলের পাশ্চাতে পড়ে থাকবেন।

চলচ্চিত্র রাজনীতি খেলাধুলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যেখানে জনতার কাছে প্রত্যক্ষ চমকপ্রদ কৃতিত্ব প্রদর্শনের সুযোগ আছে, সেখানে কৃতী ব্যক্তিরা উত্তেজনা সঞ্চার করতে পারেন অনেক বেশি। আজকের সমাজে তাই অভিনেতা খেলোয়াড় ও রাজনৈতিক নেতার আবেদন হাজারগুণ বেশি জনসমাজে, বিদ্বৎজনের তুলনায়। কারণ বিদ্বানদের সঙ্গে জনসমাজের সংযোগ প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষ। এই পরোক্ষতার খেসারত দিতে হবে তাঁদের, হয় পর্দার আড়ালে ক্রমে অদৃশ্য হয়ে গিয়ে, অথবা ঠিক খেলোয়াড় অভিনেতাদের মতো ক্রমাগত তাৎক্ষণিক উত্তেজনার খোরাক জুগিয়ে। অর্থাৎ বিদ্যাবুদ্ধির ক্ষেত্রেও খেলোয়াড় হতে হবে, জবরদস্ত জিমন্যাস্ট। একবার খেলা দেখালেই হবে না, ক্রমাগত উত্তেজনা সৃষ্টি করতে হলে ক্রমাগত খেলা দেখাতে হবে, নিত্যনূতন খেলা। বিদ্যার ক্ষেত্রে নিত্যনূতন খেলা দেখানো যে কত কঠিন, তা বিদ্যাজীবী মাত্রই জানেন। তার উপর বিদ্যাসমাজ আধুনিক গণশিক্ষার ফলে যত প্রসারিত হবে এবং বিদ্যা—ব্যবসায়ীদের প্রতিযোগিতা যত তীব্র হবে, তত তাঁদের নূতন নূতন লেবেন—আঁটা পণ্য সরবরাহের দিকে নজর দিতে হবে। তা না হলে, তথাকথিত অবাধ প্রতিযোগিতায় তাঁদের উচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী। মোদ্দাকথা, যেদিক থেকেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিচার করা যাক না কেন, বিদ্যাবুদ্ধিজীবীদের সামাজিক ভূমিকা, তাঁদের কীর্তিকর্মের মূল্যায়নের মানদণ্ড, খ্যাতিমর্যাদা ইত্যাদি সব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। একদিকে মানুষেরই বুদ্ধিজাত যন্ত্র, অন্যদিকে তারই আকাঙ্ক্ষিত বুর্জোয়া বারোয়ারি গণতন্ত্র (mass democracy), এই দুই বস্তু আজ বুদ্ধিজীবীদের স্বাতন্ত্র্য আত্মম্ভরিতা গোষ্ঠীসংকীর্ণতা বিদ্যাগৌরব, এমনকী সুকীর্তি পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন করতে সমুদ্যত। যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সমাজের আদর্শের রূপায়ণে বুদ্ধিজীবীরা অন্তত দুই শতাব্দী ধরে তাঁদের বিদ্যাবুদ্ধিপ্রতিভা নিয়োগ করছেন, সেই সমাজ আজ তাঁদের বিশাল বুদ্ধিহীন যন্ত্রের নাটবলটুতে পরিণত করে তাঁদের স্বাতন্ত্র্যভিমান গ্রাস করতে উদ্যত। ইতিহাসের এক বিচিত্র পরিহাস।

আজও যাঁরা সমাজচিন্তায় নিযুক্ত, তাঁরা সকলে এই ধরনের সব এমন কথা বুদ্ধিজীবীদের সম্বন্ধে বলেন যাতে হতাশ হয়ে যেতে হয়। বহুযুগের উন্নত মাথার হঠাৎ এমন শোচনীয় পতনের কথা ভেবে অনেক মাথাওয়ালা ব্যক্তি নিশ্চয় বিমর্ষ হবেন, কেউ কেউ হয়তো বিদ্রোহীর মতো আস্ফালনও করবেন। কিন্তু আস্ফালন বৃথা। সমাজের নিশ্চিত গতি মস্তিষ্কের ডিভ্যালুয়েশনের দিকে। ক্রমবর্ধমান আমলাতান্ত্রিক যন্ত্রের মজবুত বলটু হিসেবে তার দাম বাড়বে, কিন্তু সামাজিক দাম কমবে। অবশ্য সামান্য একটু দার্শনিক দৃষ্টি দিয়ে দেখলে, মস্তিষ্কের বাজারের এই তেজিমন্দার সমস্যা নিয়ে চিন্তিত হবার কিছু থাকে না। কোনো মাথাই যখন চিরদিন স্থায়ী হবে না, তখন সেই মাথার কর্মকীর্তির স্থায়িত্ব নিয়ে এত মাথা ঘামানো কেন? গির্জাপ্রাঙ্গণের গোরস্থানে হ্যামলেটের কথা মনে পড়ে।

There’s another : way may not that be the skull of a lawyer? Where be his quiddits now, his quiliets, his cases, his tenures, and his tricks? Why does he suffer this rude knave now to knock him about the sconce with a dirty shovel, and will not tell him of his action of battery?

কিন্তু এই অদার্শনিকের সমাজে, দুঃখের বিষয়, দার্শনিক দৃষ্টি অতিশয় দুর্লভ। বিত্তের পুঁজিপতিদের তো নেই—ই, বিদ্যার পুঁজিপতিদেরও নেই। সুতরাং তা নিয়ে আমাদের আলোচনারও প্রয়োজন নেই। সব মাথার খুলির শেষ পরিণতি যে একই, তা আমরা বিস্মৃত হতে পারি বলেই মস্তিষ্কচেতনা জীবদ্দশায় আমাদের এত প্রখর। আমাদের প্রতিপাদ্য হল, বিদ্যাচেতনার এই প্রাখর্য ভবিষ্যতের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক জনতাসমাজে স্তিমিত হয়ে আসবে, এবং বনগ্রামে শৃগাল—রাজত্বকালের ‘প্রতিভা’র যে সংজ্ঞা তাও অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যাত হবে।

কেন হবে?

হবে প্রধানত দুটি কারণে, একটি যান্ত্রিক বা টেকনোলজিক্যাল, এবং আর একটি সামাজিক।

যন্ত্র ক্রমে মানসলোকের দিকে এগিয়ে চলেছে, এবং মন্থরগতিতে নয়, দ্রুতগতিতে। মানবমনের যা কিছু ধর্ম ও কর্ম, যা নিয়ে এত দর্প এবং এতকালের রহস্যাচ্ছন্ন ইন্দ্রপুরী রচনা, তা সমস্তই আজ যন্ত্র অধিকার করতে উদ্যত। যে বুদ্ধি দিয়ে মানুষ যন্ত্র গড়েছে, সেই বুদ্ধির বিনাশের পথ আজ প্রস্তুত করছে যন্ত্র। ‘Cybernetics’ বা যন্ত্রমানসবিদ্যা নামে এক নূতন সাধনোপযোগী বিদ্যারই বিকাশ হয়েছে সম্প্রতি। আজও যাঁরা স্বতন্ত্রভাবে বিদ্বান—বুদ্ধিমান বলে পরিচিত তাঁরা বলছেন যে ভবিষ্যতে এই সাইবারনেটিক্সই অতীতের সমস্ত বিদ্যার জৌলুষ আচ্ছন্ন করে ফেলবে। যান্ত্রিক সমাজে, যান্ত্রিক মানুষ প্রধানত যন্ত্রমানসবিদ্যার চর্চা করবে। সেই ভবিষ্যৎটা আর কত দূরে যদি জানা যেত, তাহলে হয়তো ক্রমবিলীয়মান বুদ্ধিজীবীদের মস্তিষ্কস্ফীতির দুরারোগ্য ব্যাধির খানিকটা উপশম হত। কিন্তু তা সঠিকভাবে জানবার উপায় নেই। তাই পদে পদে ব্যর্থ হয়েও অপদার্থ বুদ্ধিজীবীদের আশার অন্ত নেই। নৈষ্কর্ম্যের নামান্তর বুদ্ধিবিলাসের আত্মতৃপ্তিও তাঁদের অফুরন্ত। কিন্তু তাহলেও যন্ত্রের অনিবার্য নিপীড়ন থেকে নিষ্কৃতি নেই। Cybernetics—এর একখানি পপুলার বইয়ের মুখবন্ধে সম্পাদকরা লিখেছেন :

একদা এক সাধুপুরুষ এমন একটি যন্ত্র উদ্ভাবন করেছিলেন, যা দিয়ে দেবতার অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায়। খুব বুদ্ধিমান যন্ত্র না হলে এ রকম কাজ করতে পারে না। কিন্তু তার চেয়েও বুদ্ধিমান হলেও সাধুপুরুষটি, এত বুদ্ধিমান যে আজ পর্যন্ত কোনো যন্ত্র তাঁর চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান প্রমাণিত হয়নি। কোনো যন্ত্রের সাহায্যে আজ পর্যন্ত এমন একজন সাধুপুরুষ তৈরি করা সম্ভব হয়নি যিনি যাই হোক কিছু প্রমাণ করতে পেরেছেন।

তাহলেও, একথা স্বীকার করতেই হবে যে বর্তমান শতাব্দীতে যন্ত্র ও মনের ব্যবধান অনেক কমে গেছে। হিসেব—নিকেশ, সমস্যাপূরণ ইত্যাদি নানারকমের কাজ যা এতদিন মানবমনের অন্যতম কর্ম বলে পরিগণিত হতো, আজ তা বিচিত্র সব যান্ত্রিক ও বৈদ্যুতিক কর্মে রূপান্তরিত হয়েছে। এই সব কর্মরত যন্ত্রগুলি সত্যই ভয়াবহ। তাদের দিকে তাকালে মনে হয়, মনোরাজ্যে এই যন্ত্রের অভিযান কতদূর পর্যন্ত চলবে এবং কোথায় এর শেষ হবে! কেউ আজ নিশ্চিত বলতে পারেন না যে ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক দাবা খেলায় যন্ত্রে যন্ত্রে প্রতিযোগিতা হবে কি না। কেউ এমন কথাও বলতে পারেন না যে যন্ত্রই ভবিষ্যতে ভাল ভাল সনেট ও কবিতা লিখবে কি না এবং সেগুলি ছাত্রদের পাঠ্য হিসেবে সংকলনে স্থান পাবে কি না। শিল্পীদের মতো ভাল ভাল ছবিও যে যন্ত্র আঁকতে পারবে না, যা রয়াল আকাদেমির প্রদর্শনীতে স্থান পাবে, এমন কথাও কেউ বলতে পারেন না আজ। অনেক শিল্পীচক্রের জটিল সাধনারও প্রতিদ্বন্দ্বী হবে যন্ত্র! এই সব ঘটনা হয়ত সুদূর ভবিষ্যতে ঘটবে। আরও অনেক দূর এগোতে হবে যন্ত্রকে। কিন্তু তাতেও নিশ্চিন্ত হবার কিছু নেই, কারণ যন্ত্র দূরন্ত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। যন্ত্রকে আজ উপেক্ষা করলে চলবে না, মানুষ মতো তাকেও বুঝতে চেষ্টা করতে হবে। যন্ত্রকে না বুঝলে মানুষ নিজেকেও বুঝতে পারবে না।*

যন্ত্রের দুর্ধর্ষ অগ্রগতির এই চিত্র নিঃসন্দেহে ভয়াবহ। কিন্তু আজ আমাদের কাছে যা ভয়াবহ, ভবিষ্যৎ সমাজের মানুষের কাছে তা স্বাভাবিক ও সুখাবহ হতে পারে। যন্ত্রযুগের শৈশবকালে যেসব যন্ত্র মানুষের কাছে ভীতিপদ মনে হয়েছিল, আজ তা এককণা বিস্ময়ও উদ্রেক করতে পারে না। মনোযন্ত্র ও বুদ্ধিযন্ত্র আজ যতই তাজ্জব মনে হক, ভবিষ্যতে তা মানুষের মনসহা হয়ে যাবে। তার বৈপ্লবিক সামাজিক প্রতিক্রিয়ার সূত্রপাতেই আজ আমরা স্তম্ভিত ও মর্মাহত হলেও, ভবিষ্যতের মানুষ আমাদের মনোভাবকে অর্ধবর্ষর মনে করে মুচকি হাসবে। সমাজের আর কোনো জনশ্রেণির এই সর্বাত্মক যান্ত্রিকতায় বিশেষ ক্ষতিবৃদ্ধি হবে বলে মনে হয় না, বরং লাভেরই সম্ভাবনা বেশি। সমূহ ক্ষতি হবে বুদ্ধিজীবীদের, তাঁদের একুল—ওকুল দুকুল যাবে। মগজের রহস্যলোকের সূক্ষ্মতম স্নায়ুচক্র যদি বাইরের অভিনব যন্ত্রের জটিল কলকবজায় রূপান্তরিত হয় এবং তার আধিভৌতিক ক্রিয়ার সমস্ত বাহাদুরি যদি সেই দানবীয় যন্ত্র আত্মসাৎ করে বসে, তা হলে বেচারি বুদ্ধিজীবীর সমস্ত দম্ভ চূর্ণ হয়ে যাবে। যন্ত্র যদি সনেট লিখতে বসে, দুর্বোধ্য ইন্টিলেকচুয়াল কবিতা অনর্গল রচনা করে যায়, বড় বড় অঙ্ক ফরমূলা স্ট্যাটিষ্টিক্স এক নিমেষে সমাধান করে ফেলে, অতীতে কবে কী হয়েছিল, সন তারিখ বসিয়ে দিলে যদি তার ঘটনাপঞ্জি তৈরি করে দেয় কয়েকটি চরিত্র (যেমন একটি ছেলে দুটি মেয়ে, দুটি ছেলে সাতটি মেয়ে তেরোটি ছেলে একটি মেয়ে ইত্যাদি) ফানেলের মধ্যে কাগজের টুকরোয় লিখে পুরে দিলে যদি সেই যন্ত্র পার্মুটেশন—কমবিনেশন করে হাজার রকমের উপন্যাস—কাহিনি রচনা করে ব্রডকাস্ট করতে পারে, তা হলে বুদ্ধিজীবীদের এতদিনের কারসাজি এবং সৃজনশীল (creative), মননশীল (intellectual) ইত্যাদি সাহিত্যকর্মের সমস্ত বুজরুকি ধরা পড়ে যাবে। বুদ্ধিজীবীরা তখন কী করবেন?

কবি এলিঅটের ভাষায়—‘Birth and Copulation and Death’  ছাড়া—অর্থাৎ যান্ত্রিক উপায়ে ‘জন্মগ্রহণ’, যান্ত্রিক উপায়ে ‘রমণ’ এবং যান্ত্রিক উপায়ে ‘মরণ’ ছাড়া তাঁদের করণীয় আর কিছু থাকবে না। স্বজন—মননের যাবতীয় কর্ম তখন যন্ত্রই করবে, কেউ বুদ্ধিজীবী, কেউ শ্রমজীবী, কেউ কৃষিজীবী, এই ধরনের সনাতন সামাজিক শ্রেণিভেদ আর থাকবে না। সকলেই একশ্রেণির মানুষ হবে—যন্ত্রজীবী। সে গলদঘর্ম হয়ে চার লাইন কবিতা লিখবে বা উপন্যাস নামে কাহিনি রচনা করবে সে সৃজনশীল, এবং যে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে চিন্তাশীল বিষয় রচনা করবে যে মননশীল, শোনা যাচ্ছে যে বুর্জোয়া যুগের এই সব বস্তাপচা বিচারভেদ ধূলিসাৎ করে দেবে আগামীকালের মহাযন্ত্র। বুদ্ধিজীবীদের একশত বর্গফুটের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বৈদ্যুতিক বুদ্ধিচক্র থেকে যদি কোনো সিদ্ধপুরুষ কয়েক হাজার ভোল্টেরও বুদ্ধির খেলা দেখান, তাহলেও সমাজের লোক নির্বাক বিস্ময়ে তাঁকে আর প্রাগৈতিহাসিক যাদুকরের মর্যাদা দেবে না।

সেই মহাযন্ত্রের যুগ আসছে বললেও ঠিক হবে না, তার পদধ্বনি ক্রমেই জোরে শোনা যাচ্ছে। সশরীরে আবির্ভাবের আগে তার অশরীরী যান্ত্রিক আত্মা সমগ্র সমাজকে এর মধ্যেই প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে। এখন আর কোনো মানুষের সামগ্রিক (total) সত্তা বলে কিছু নেই। যে—কোনো ক্ষেত্রের যে—কোনো মানুষ এখন ‘অংশ’ (part) মাত্র, নাট—বলটু মাত্র, সম্পূর্ণ মানুষ নয়। এখনকার ‘সাহিত্যিক’ বলতে এমনকী সেদিনকার বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের মতো পূর্ণাঙ্গ সাহিত্যিক বোঝায় না। সকলেই ভগ্নাঙ্গ (বা বিকলাঙ্গ) ‘লেখক’ মাত্র। কেউ গল্প, কেউ কবিতা, কেউ উপন্যাস, কেউ রম্যরচনা, কেউ সমালোচনা—প্রবন্ধ—নিবন্ধ ইত্যাদির ‘লেখক’। অথচ এর মধ্যেও কাহিনিলেখক ও পদ্যলেখকরা সৃজনশীলতার আত্মম্ভরিতাটুকু শেষ পুঁজিপাটার মতো আঁকড়ে ধরে আছেন। টুকরো—টুকরো হয়ে গেছেন, তবু প্রাণটুকু ধুকধুক করছে। আজ আর ‘ঐতিহাসিক’ বলে কেউ নেই। কেউ অষ্টাদশ, কেউ ঊনবিংশ শতাব্দীর, কেউ মোগলযুগ, কেউ ব্রিটিশ যুগ, কেউ গুপ্তযুগের, কেউ রাজনৈতিক ইতিহাসের, কেউ সামাজিক, কেউ বা অর্থনৈতিক ইতিহাসের, কেউ আবার একই শতাব্দীর একটি মাত্র পর্বের (যেমন ১৭০০ থেকে ১৭২৫ খ্রিঃ) ‘বিশেষজ্ঞ’। আজ আর ‘ডাক্তার’ বলেও কেউ নেই। চোখ নাক দাঁত গলা হৃৎপিণ্ড ইত্যাদির স্বতন্ত্র সব ‘বিশেষজ্ঞরা’ আছেন। কোনো ব্যাধির জন্য হয়তো চোখ গলা দাঁত পেট ও ফুসফুস যন্ত্রণা দিচ্ছে। তার জন্য পাঁচজন বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হবে, তাঁরা পাঁচখানা প্রেসক্রিপশন দেবেন। কিন্তু সবকটি মিলিয়ে আসল ব্যাধিটা কী হয়েছে তা জানতে গেলে, পাঁচখানা প্রেসক্রিপশন নিয়ে কার কাছে যেতে হবে জানা নেই। এইভাবে বিচার করলে দেখা যাবে, সমাজের সর্বক্ষেত্রের কর্মই যান্ত্রিক হয়ে উঠেছে, খণ্ডিত হয়ে যন্ত্রের কলকবজার মতো টুকরো হয়ে গেছে। সব মানুষই বিকলাঙ্গ, পূর্ণাঙ্গ মানুষ নেই যান্ত্রিক সমাজে। এহেন অবস্থায় বুদ্ধিজীবীর ভবিষ্যৎ গোবি মরুভূমির মতো ধূসর, চেরাপুঞ্জি থেকে একখানা মেঘও সেখানে আর উড়ে আসবে না কোনোদিন, অন্তত বর্তমান ধনতান্ত্রিক শ্রেণিসমাজের আকাশে।

সবার উপর বুর্জোয়া যন্ত্রযুগের বারোয়ারি গণতন্ত্রের (mass democracy) ধাক্কা তো আছেই। সব ঘটনার গুরুত্ব ও কীর্তির মহত্ত্ব আজ স্নায়ুমণ্ডলীর সাময়িক শিহরণ—সুড়সুড়ি দিয়ে মেপে দেখে বিচার করা হয়। খ্যাতি—অখ্যাতি, প্রিয়তা—অপ্রিয়তা, প্রশস্তি—নিন্দা, সবই এ সমাজে সোডার জলের মতো বজবজিয়ে উঠে বিলীন হয়ে যায়। রাজনীতির নির্বাচনের (election) ক্ষেত্রে, নেতানুগমনের ক্ষেত্রে, সর্বদাই এই দৃশ্য নজরে পড়ে। যন্ত্রভিত্তিক স্নায়ুশিহরণ—সর্বস্ব বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক জনতাসমাজের এটি একটি উল্লেখ্য উপসর্গ। সাহিত্য অথবা বুদ্ধিজীবীদের বেচাকেনার ‘পণ্য’ সামজবহির্ভূত বস্তু নয়। সুতরাং উপসর্গ সাহিত্যের ক্ষেত্রেও প্রকট হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর সমস্ত দেশে হয়েছে, বাংলা দেশেও এই উপসর্গ একজন সমাজতত্ত্ববিদ এইভাবে ব্যাখ্যা করেছেন :*

The elites are not in direct contact with the masses, Between the elites and the masses stand certain social structures, which, although they are purely temporary, have neverthless a certain inner articulation and constancy. Their function is to mediate between the elites and the masses. Here, too, it can be shown that the transition from the liberal democracy of the few to real mass-democracy destroys this intermediate structure and heightens to significance of the completely fluid mass.

ম্যানহাইম বলেছেন, বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে জনসমাজের প্রত্যক্ষ সংযোগ নেই। সেই সংযোগ মধ্যবর্তী কয়েকটি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ভিতর দিয়ে স্থাপিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলির একটা যে নিজস্ব চরিত্র থাকে তা হঠাৎ বদলায় না। সংখ্যা—লঘিষ্ঠের উদার গণতন্ত্রের যুগ থেকে যতই আমরা বারোয়ারি গণতন্ত্রের যুগে এগিয়ে যাচ্ছি, ততই সমাজের এই মধ্যবর্তী প্রতিষ্ঠানগুলির গড়ন ও চরিত্র দুইই বদলে যাচ্ছে। অর্থাৎ ম্যানহাইম যে কথাটি পরিষ্কার করে বলেননি, সেটি হল প্রতিযোগী ধনতন্ত্রের যুগ থেকে যত একচেটিয়া ধনতন্ত্রের যুগে সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে, তত এই সমস্ত উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। সব ভেঙেচুরে নৈরাকার হয়ে গিয়ে সমস্ত সমাজটা একটা চেনাপরিচয় হীন নামগোত্রহীন জনস্রোতে পরিণত হচ্ছে। সাহিত্য শিল্পকলা সবই সেই স্রোতের অনুগামী। তার ভয়াবহ ফলাফল সম্বন্ধে ম্যানহাইম বলেছেন : *

It is in a society in a stage of dissolution that such a public supplants the permanent public which was formerly selected out of well-established and stable groups. Such an inconstant, fluctuating public can be reassembled only through new sensations. For authors, the consequence of this situation is that only their first publications tend to be successful, and when the authors, have produced a second and a third book the same public which greeted their first work may no longer exist. Wherever the organic publics are disintegrated, authors and elites turn directly to the broad masses. Consequently they become more subject to the laws of mars psychology…

এই ধরনের সদাপ্রবাহমান সমাজে স্থিতিশীল বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকা সম্ভব নয়। জনতাসমাজের যেমন স্থিতি নেই, তেমনি তাদের আদর্শ আচার চিন্তাভাবনা রুচি রীতিনীতি কোনোটারই স্থিতি নেই। স্থিতিহীন জনগোষ্ঠীকে বারংবার নূতন নূতন উত্তেজনার বৈদ্যুতিক ‘শক’ দিয়ে নাড়া দেওয়া প্রয়োজন এবং সেইভাবে নাড়া না দিলে তাদের একত্রে জড়ো করা যায় না। সেইজন্য দেখা যায়, একালের সাহিত্যিক—লেখকরা যাঁরা হঠাৎ একখানা বই লিখে রাতারাতি ‘বিখ্যাত’ হয়ে গেলেন, ‘গরম কেকে’র মতো যাঁদের বই বিক্রি হল, দুদিন পরে পাঠকজনগোষ্ঠী তাঁদের ততোধিক দ্রুতগতিতে ভুলে গেল এবং তাঁদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বই আর বিকলো না তেমন। জনমনের গতি লক্ষ্য করে লেখকরা তখন তারই পরিতুষ্টির পথে অগ্রসর হলেন। সস্তা ‘stunt’, বিচিত্র সব উত্তেজনা, তাঁদের সাহিত্যের প্রধান উপজীব্য করতে হল। সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যের ধারায় এই উপসর্গ যেমন প্রকট হয়ে উঠছে, তেমনি অন্যান্য দেশের সাহিত্যেও হচ্ছে। প্রতিভা বুদ্ধি মননশক্তি অথবা তথাকথিত ‘সৃষ্টিশক্তি’, সবই যদি ক্ষণিকের চমক ও উত্তেজনা সঞ্চারের কর্মে নিয়োগ করতে হয়, তা হলে বুদ্ধিজীবীরা সনাতন স্বাতন্ত্র্যভিমান আর টিকে থাকে না। সেকালের ম্যাজিসিয়ান পুরোহিতদের সগোত্র একালের বুদ্ধিজীবী ও তথাকথিত ‘সৃষ্টিশীল’ শিল্পীরা, তাই মনে হয়, যন্ত্র ও বারোয়ারি গণতন্ত্র দুই—এর নিষ্ঠুর নিষ্পেষণে লোপ পেয়ে যেতে বাধ্য। ফরাসি মনীষী পল ভ্যালেরী (Paul Valery) তাঁর ‘Our Destiny and Literature’ রচনায় এই সম্ভাবনারই ইঙ্গিত করে গেছেন। দেশ—বিদেশের আরও অনেক চিন্তাশীল মনীষী স্বগোষ্ঠীর এই অবশ্যাম্ভাবী বিলোপের কথা বলেছেন। সমাজবিদরা তো বলছেনই। বুর্জোয়া যন্ত্র—গণতন্ত্রের যুগে কেবল বুরোক্রাটিক বিপুল রাষ্ট্রযন্ত্র, অর্থনৈতিক উৎপাদনযন্ত্র এবং নিত্য—উদ্ভাবিত সব বুদ্ধিকর্মযন্ত্র থাকবে, এবং মানুষ থাকবে তার কবজা—বলটু হয়ে। অনুভূতি বুদ্ধি প্রতিভা এসব কথার তাৎপর্যের আমূল পরিবর্তন ঘটবে। ‘মস্তিষ্ক’ মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ বরেণ্য অঙ্গ হলেও, দেশের হস্তপদাদি অন্যান্য অঙ্গের সঙ্গে তার গুণগত কোনো পার্থক্য থাকবে না। যন্ত্রদেবতা মানবসমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করবে। মনোপলিস্ট ক্যাপিটালিস্টদের রজতমুদ্রার যাদুতে যান্ত্রিক সমাজে সমস্ত মনন—চিন্তাভাবনা কাজকর্ম চেতনা অনুভূতি যন্ত্রবৎ পরিচালিত হবে। আমরা এই সামাজিক পরিবেশেই আজ বাস করছি। তাই বুদ্ধিজীবীরা স্বাতন্ত্র্য ও অহমিকা আজও আমরা তৃণখণ্ডের মতো আঁকড়ে আছি, মস্তিষ্কের ঐন্দ্রজালিক মোহ কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছি না। এ মোহ যখন কাটবে, এবং দৈহিক ও মানসিক মেহনতের পার্থক্য যখন আমরা ভুলতে পারব, তখন আমরা নূতন সমাজের উপযোগী মানুষ হয়ে উঠতে পারব।

রচনাকাল : ১৩৬৫ সন

…..

* W. Sluckin, Minds and Machines; Harmondsworth:Penguine, 1954 Foreward.

* Mannheim, Karl, Man and Society, pp. 96-97.

* Ibid.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *