৪. মেঘ করে আসে

০৪.

দিন যায়। মাঝে মাঝে খুব মেঘ করে আসে৷ বৃষ্টি হয়। কখনও রোদ উঠে নীল জলের মতো আকাশ দেখা যায়। ঘরে ভাল লাগে না। স্পষ্টই বোঝে, বাড়িতে কুমারী-জীবনে যেমন ছিল সে, তেমনটি আর নেই। বিবাহিতা অবস্থায় যেমন ছিল, তেমনটাও নেই। দাদাই যা একটু সহজ। কিন্তু সীতার সঙ্গে দাদার দেখা হয় কতটুকু সময়। মক্কেল আর কোর্টকাছারি নিয়ে দাদা বড় ব্যস্ত।

মনোরম জামাই হিসেবে এ বাড়ির কারও পছন্দের ছিল না। তবু সবাই একরকম তাকেই হোট জামাই হিসেবে মেনে নিয়েছিল। সীতা ভুল করেছে, এ কথা সবাই বুঝত। সীতাও বুঝেছে, একটু দেরিতে।

বাবা ইদানীং কানে বড় কম শোনে। একটা যন্ত্র আছে কানে পরবার। তাতেও খুব একটা কাজ হয়নি। একটু চেঁচিয়ে বললে শোনে।

“মেয়ে, কখনও পরপুরুষের সঙ্গে একা রাস্তায় হেঁটো না।”

“মেয়ে, বাবা আর ভাই ছাড়া কোনও পুরুষের উপহার নিয়ো না।”

বিয়ের আগে এ সব কথা একটা ক্ষুদে বই থেকে বাবা তাকে মাঝে মাঝে পড়ে শোনাত। বইটার নাম ছিল, নারীর নীতি। উপদেশ দুটো সীতা মানেনি। শিমুলতলার প্রকৃতিতে কী একটা ছিল, মাদকতাময়, বাধা ছিন্ন করার নিমন্ত্রণ।

বিয়েটা পছন্দের না হোক, বাবা তবু বিয়ের পর সেই বইটা থেকেই আবার শোনাত স্ত্রী হচ্ছে পুরুষের বিশ্রামের জায়গা। যখন খেটেখুটে সে ফিরে আসবে, তখনই তাকে অভাব-অভিযোগের কথা বোলো না। তাকে সেবা দিয়ে, সুস্থ করে তুলল, তারপর মৃদু নম্র ভাবে যা বলার বলল। মনে রেখো, তুমি তাকে তোমার দিকে আকৃষ্ট করে রাখার চেষ্টা করলে সে জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আসবে। সার্থক হবে না সে। বরং তাকে আদর্শের দিকে ঠেলে দিয়ে, সে পৃথিবী জয় করবে…ইত্যাদি। বয়সে অনেক বড় ছিল মনোরম, সীতার চেয়ে প্রায় দশ বছরের বড়। বাবাকে এ ব্যাপারটা খুব খুশি করেছিল, স্বামীর সঙ্গে বয়সের বেশি তফাত থাকাই নাকি ভাল, এগুলো মনে রাখার কথা নয়। সীতা রাখেনি। উপদেশ হচ্ছে পেটেন্ট ওষুধের মতো। রোগ কী তা না জেনেই কিনে এনে খাও। সকলেরই তো একই রোগ নয়। বিশেষ অসুখের জন্য বিশেষ ওষুধ দরকার। তার জীবনে উপদেশটা ঠিক খাটেনি। তবু বিয়ের পর বহুকাল বাবা তাকে নারীর নীতি পড়ে শুনিয়েছে। মনোরমকে কোনও আদর্শের দিকেই ঠেলে দিতে পারেনি সীতা। তারা প্রেম করেছে, রতিক্রিয়া করেছে, খেয়েছে, ঘুরেছে। ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে, আবার ভাবও। সন্দেহ এবং অবিশ্বাস এসেছে, আবার প্রেমও করেছে। এবং তারপর ক্লান্তি এসেছিল। এল নিস্পৃহতা। যত বয়স বাড়ছিল, ততই মনোরম পুরোপুরি বাধ্য পরিচারিকা তৈরি করতে চেয়েছিল সীতাকে। প্রেমের কথা, ভালবাসার স্পর্শ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। অনেক সময়ে শরীর ঘাঁটত না একনাগাড়ে সপ্তাহভর। কেবল বুকের মাঝখানে কামগন্ধহীন মাথাটা এগিয়ে দিত। সীতা মাঝে মাঝে সে মাথাটা সন্তর্পণে বালিশে তুলে দিয়ে পাশ ফিরে শুয়েছে। মানস এসে বসত বাইরের ঘরে। একটু দূরত্ব বজায় রেখে বসত, কিন্তু তার হাসি, আন্তরিকতাময় কথাবার্তা শরীরের দূরতটুকু অতিক্রম করত অনায়াসে। কিন্তু এগুলো কারণ নয়। আসল কারণ ওই সন্দেহ। মাঝেমধ্যে একটা অস্পষ্ট যৌনঋণ-এর কথা উল্লেখ করতে থাকে মনোরম। চিৎ কদাচিৎ যখন তারা শরীরে শরীর মেলাত, তখন মনোরমের ছিল শাসকষ্টের মতো দম ফেলতে ফেলতে ওই প্রশ্ন-বলো তো, আমি কে?

–তুমি! তুমি তো তুমিই! আবার কে?

না, না, ঠিক করে বলল। ঠিক করে বলো। আমি কে?

তা হলে জানি না।

–তা হলে আমি বলি?

বলো!

 রাগ করবে না?

কী এমন বলবে যে রাগ করব?

–আমি এখন-আমি বোধ হয়-মানস লাহিড়ি!

কী বলছ?

 নই?

–তুমি অন্য লোক হতে যাবে কেন?

–আমি অন্য লোক নই। কিন্তু তুমি যাকে ভাব?

 –ভাবব? ভাবব আবার কী? কেন ভাবব?

-আমি তো পুরনো হয়ে গেছি। আমি তো আর উত্তেজক নই! এই বয়সেই স্বামী-স্ত্রী অন্য মানুষকে ভাবতে শুরু করে।

স্তব্ধ হয়ে থেকেছে সীতা। বুকের ওপর মানুষ, কত কাছের মানুষ, তবু কী অস্বস্তিকর জটিলতা।

কোনওদিন বা সুখকর ঘনিষ্ঠতার মুহূর্তে

মানুষের মন, তার কোনও ছবি দেখা যায় না।

কী বলছ?

–মানুষ মনে যে কে কাকে ভাবে!

সীতা ঝাঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করেছে–স্পষ্ট করে বলো।

 –আমি এখন তোমার মনের ভিতরটা দেখতে চাই।

–কেন?

—দেখতে চাই, সেখানে কে আছে!

-তুমি কি পাগল?

–কেন?

–তুমি আমাকে সন্দেহ কর?

 মনোরম চুপ।

সীতা দুহাতে মনোরমের বাহু খামচে ধরে বলেছে-বলো, সন্দেহ করার মতো তুমি কী দেখেছ! কী করেছি আমি?

–কিছু দেখিনি। শুধু দেখেছি, তোমরা বাইরের ঘরের টেবিলের দুপাশে দুজন বসে আছ। তুমি উল বুনছ. মানস তোমার দিকে চেয়ে আছে। আর কিছু না।

-তবে?

–কিন্তু আমার মনে হয়েছে, তোমাদের দুজনের মাঝখানে একটা অদৃশ্য সার্কল। বিদ্যুৎ তরঙ্গের মতো কী একটা যাতায়াত করছে। একটা বলয়, সেটা শূন্য, অদৃশ্য, কিন্তু আছে। তোমরা ভালবাসার কথা বলো না। কিন্তু ও তোমাকে কমপ্লিমেন্ট দেয়, যা আমি আগে দিতাম তোমাকে, এখন আর দিতে পারি না। আমার স্টক ফুরিয়েছে। তোমাকে পেয়েছি যখন, তখনই হারিয়েছি। রহস্য শেষ হয়ে গেছে আমাদের। কিন্তু ও নতুন, বাইরে থেকে এসেছে। ওর দেওয়ার আছে অনেক। তুমিও নিচ্ছ। জমে উঠছে ঋণ। সে ঋণ কী ভাবে শোধ হবে?

সীতা কেঁদেছে, না বুঝে।

মনোরম তবু বলেছে–সেই ঋণ শোধ হয় কল্পনায়। আমার শরীরে চলে আসে মানস লাহিড়ি।

কাঁদতে কাঁদতেও সীতা রেগে গিয়ে বলেছে-কল্পনা। সে তো তোমারই! তুমি মেয়েদের নিয়ে কল্পনা করতে না?

–এখনও করি। করি বলেই ধরতে পারি।

 –না, আমি তোমার মতো স্বপ্ন দেখি না। আমার অত কল্পনাশক্তি নেই। কারও ধার আমি ধারি না।

এইভাবে মাঝরাতে উঠে তাদের ঝগড়া হত। প্রচণ্ড ঝগড়া। মনোরম ভুল করেছিল তার নিজের কল্পনাশক্তিই খেয়ে ফেলেছে তাকে। নিজের দোষ সে সীতার ওপর আরোপ করতে শুরু করেছিল।

কিন্তু মানস আসত। উল বুনত সীতা। মানস বসে থাকত। না, দূরত্বটা কখনও অতিক্রম করত না মানস। তার আছে নিজেকে ধরে রাখার অমানুষিক ক্ষমতা। কিন্তু থেমে-থাকা স্টার্ট-দেওয়া মোটরগাড়ি যেমন কাঁপে, তেমনই কি কেঁপেছে মানস! বিবাহ-বিচ্ছেদের পরও সে সীতার শরীর আক্রমণ করেনি বহুদিন। অপেক্ষা করেছে। মাত্র সেদিন সে..

কিন্তু ঘুরেফিরে সেই মানসই এল। মনোরম ভুল বলেছিল বটে, তবু ভুলটাকে সত্যি করে দিল নাকি সীতা! এখন যদি মনোরম কখনও সামনে এসে দাঁড়ায়, যদি প্রশ্ন করে, তবে মূক হয়ে মাথা নত করে নেবে না কি সে?

.

বাবা সেই ক্ষুদে বইটা থেকে তাকে উপদেশ শুনিয়েছে কুমারী অবস্থায়। বিবাহিত জীবনে। কিন্তু যখন এই তৃতীয় অবস্থায় সে ফিরে এসেছে বাপের বাড়িতে, তখন আর বাবা সেই ক্ষুদে বইটা পড়ে তাকে শোনায় না। বেশির ভাগ সময়েই কানের যন্ত্রটা বাবা আজকাল খুলে রাখে।

গোপন কোনও কথা বলতে হলে দাদা বাবাকে ছাদে নিয়ে যায়। সেখানে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে। সীতা এবার এলেও দাদা ওরকমভাবে বাবাকে ছাদে নিয়ে গিয়ে ব্যাপারটা বুঝিয়েছে। বাবা সীতাকে কিছু বলেনি। কেবল তাঁর দন্তহীন মুখে বার বার ঠোঁট জোড়া গিলে ফেলেছে বাবা। চারদিকে চেয়ে কী যেন খুঁজেছে। এ সময়ে বোধহয় মৃত স্ত্রীকেই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল মানুষটার। ছেলেমেয়েদের কথা বাবা আর বুঝতে পারে না। স্ত্রী বেঁচে থাকলে একমাত্র তার কথাই মানুষটা বুঝতে পারত।

নীচে দাদার অফিসঘরে টেলিফোন আছে। ওপরের হলঘরে তার এক্সটেনশন। কল এলে দুটো ফোনই বাজে। নিয়ম হল টেলিফোনে রিং হলে নীচে দাদা ধরে, ওপরে সীতা, বাবা কিংবা বউদি। দাদার কল হলে ছেড়ে দেয়, নিজেদের কল হলে দাদা ছেড়ে দেয়।

.

সেদিন বউদি কালীঘাট গেছে, সীতা বাথরুমে। বাবা হলঘরে বসে কাগজটা খুঁটিয়ে পড়ছে। সে সময়ে টেলিফোন বাজছিল। বাবা ধরল না। সীতার গায়ে তখন সাবান। সে চেঁচিয়ে বলল–বাবা, ফোনটা ধরো। শোনার কথা নয় বাবার। বেজে বেজে টেলিফোন থেমে গেল। নীচে দাদা ধরেছে। একটু পরেই দাদা সিঁড়ির গোড়ায় এসে চেঁচিয়ে বলল-সীতা, ফোনটা ধর। তোর কল।

কোনওক্রমে গায়ে কাপড় জড়িয়ে বেরিয়ে এসছিল সীতা। ফোন কানে নিল। কোনও শব্দ হল না। হ্যালো, হ্যালো, অনেকবার করল সে।, কোনও উত্তর নেই। বোধহয় ছেড়ে দিয়েছে। ফোনটা রেখে দেওয়ার আগে তার অস্পষ্টভাবে মনে হল, ওপাশে যেন একটা দীর্ঘশ্বাসের অস্ফুট আওয়াজ হল। জ্ব কোঁচকাল সীতা। ভুলই হবে। রেখে দিল। বাবাকে বলল-ফোনটা ধবনি কেন বাবা, দেখ তো লাইনটা কেটে গেল।

বলেই লক্ষ করল, বাবার কানে যন্ত্রটা নেই। বাবার ঘর থেকে যন্ত্রটা নিয়ে এল সীতা। বাবার কানে লাগাতে লাগাতে বলল–কেন যে যন্ত্রটা পরে থাক না!

বাবা হঠাৎ মুখ তুলে আঁতকে উঠে বলে–না, না! ওটা লাগাস না।

সীতা অবাক হয়ে বলল–কেন?

বাবা সীতার ঠোঁট নড়া দেখে বলে–ওটার আর দরকার নেই।

বাঃ! তুমি যে এটা হলে শুনতে পাও না!

 বাবা চোখটা সরিয়ে নিয়ে বলে অনেক শুনেছি। সারা জীবন। আর কিছু শুনতে চাই না। ঠাকুর করুন, যে কটা দিন বাঁচি, আর যেন কিছু শুনতে না হয়। এটা ফেলে দে।

এইভাবেই বাবা তার পরিপূর্ণ নিস্তব্ধতার জগতে চলে গেছে। স্বেচ্ছায় নির্বাসন। মাঝে মাঝে বাবার ঘরে যেতে ইচ্ছে করে সীতার। যায়। বাবা চোখ সরিয়ে নেয়। আর বারবার দন্তহীন মুখে নিজের ঠোঁটজোড়া গিলে ফেলতে থাকে। কচ্ছপের মুখের মতো। কথা বলে না। বলতে পারে না। বাঁধানো। দাঁতের পাটিজোড়া বাবা ছেড়ে রেখেছে, খাওয়ার সময় ছাড়া পরে না। চশমাও খুলেই রেখে দেয় বেশির ভাগ সময়। একটু বুড়োটে, আর কুঁজো হয়ে বসে থাকে ঘরে। যেন বা নকল দাঁত, নকল চোখ, নকল কান, কিছুরই আর প্রয়োজন নেই বাবার। ঠাকুর যা করেন মঙ্গলের জন্যই–এরকম বিশ্বাসে সব নির্মোক ঝেড়ে ফেলে প্রতীক্ষায় বসে আছে বাবা। কীসের? এক পরিপূর্ণতম নিস্তব্ধতার? নিচ্ছিদ্র এক অন্ধকারের? অন্তহীন ঘুমের? বাবা কিছুই শোনে না। চারধারে এক নিস্তব্ধতার ঘেরাটোপ। সীতা মাঝে মাঝে যায়। বসে থাকে। ক্ষুদে বইটা থেকে উপদেশগুলো বাবা আর কোনওদিনই শোনাবে না, বুঝতে পারে। বাবার নিস্তব্ধতার কাছে ক্ষণেক বসে থাকে সে। ঠিক সহ্য করতে পারে না। অসহ্য হয়ে উঠে আসে।

.

নতুন কেনা একটা শাড়িতে ফলস লাগাচ্ছিল সীতা। বউদি এসে একটু দাঁড়িয়ে দেখল।

নতুন শাড়ি?

–হুঁ।

–কে দিল?

–কে দেবে? নিজেই কিনলাম।

শাড়িটার অনেক দাম নিয়েছে?

–মন্দ না।

 –আশি নব্বই?

–ওরকমই।

বউদি একটা খাস ছাড়ে, বলে-ঠাকুরঝি, তোমার কত টাকা! তুমি কত স্বাধীন।

-তুমি কি গরিব? পরাধীন?

–তা নয়। তবে ইচ্ছেমতো কিছু কিনে আনব, তার তো উপায় নেই! যা করব, সব অনুমতি নিয়ে করতে হবে। তুমি বেশ আছ।

–এরকম বেশ থাকতে চাও নাকি?

চাই-ই তো।

-কেন?

মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে সব সংসারটা হাটকে মাটকে দিয়ে চলে যাই। মেয়েমানুষ হওয়া একটা অভিশাপ।

ওরকম সবাই বলে। আবার এ সব নিয়েই থাকে।

তুমি তো থাকোনি।

 সীতা দাঁতে ঠোঁট চাপে। আস্তে বলে–এ সব কথা থাক বউদি। তুমি ঠিক বুঝতে পারবে না। বউদি চলে গেলে অনেকক্ষণ জ কুঁচকে ফলসটার দিকে চেয়ে থাকে সীতা। ফুটপাতের দোকান থেকে কেনা ফলস মাপে অনেকটা ছোট হল, শাড়ির পুরো কুঁচিটা ঢাকা পড়বে না। খুব ঠকে সীতা। দেখেশুনে কেনে, তবু ঠিক ঠকে যায়। বরাবর। মনোরম খুব রাগ করত, বলত–মেয়েদের অভ্যাসই হচ্ছে সস্তা খোঁজা। সারা কলকাতা দুনম্বর মালে ছেয়ে গেছে, আসল-নকল চিনবার উপায়ই নেই, কেন নিজে নিজে কিনতে যাও?

ফলসটায় ঠকে গেছে বলে সীতার মনটা খারাপ হয়ে গেল খুব। এতটাই খারাপ হল যে, উঠে বিছানায় গিয়ে শুল। এবং একটু পরে কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে সে মনে মনে প্রাণপণে তার কান্নার গূঢ় কারণটাও বোধহয় খুঁজে দেখছিল। কারণটা খুঁজে পেল একটু পরে। বউদি একটা কথা বলেছিল–তোমার কত টাকা! তুমি কত স্বাধীন। কথাটার মধ্যে কিছু নেই। তবু আছে। মনোরমের সর্বস্ব কেড়ে না নিলেও পারত সে। বীরু সেদিন বলছিল, মনোরম তার কৃপণ মামার কাঠগোলায় চাকরি করছে। বীরু ছেলেটা মুখ-পলকা। হেসে বলেছিল আমার বাবার কাছে কাজ করা মানে কিন্তু সুখে থাকা নয়। জানো তো! না জানলেও বোঝে সীতা। সুখে নেই।

.

মানস আবার কাল চলে যাবে দিল্লি। চার-পাঁচ দিন পরে ফিরবে ফোন করল দুপুরে।

–আজ বিকেলে ফ্রি থেকো মৌ।

আমি তো সব সময়ে ফ্রি।

–একটু ঘুরব।

–আচ্ছা।

—দিল্লি যাচ্ছি।

জানি তো।

–ভাল লাগে না।

সীতা হাসল। শব্দ করে। যাতে মানস ফোনে হাসিটা শোনে।

–বেশি দিন তো নয়।

–তা নয়। দুঃখিত গলায় মানস বলে কিন্তু সারাজীবনই এরকম মাঝে মাঝে আমাকে চলে যেতে হবে। ছেড়ে থাকতে পারব তো?

সীতা শ্বাস ফেলল, এবং সেটাও শুনতে পেল মানস। আবেগের সঙ্গে বলল-মাঝে মাঝে তোমাকেও নিয়ে যাব।

-যেয়ো।

 –আমি সেই ক্লাবটা থেকে ফোন করছি।

 –কোন ক্লাব?

 –সেই ক্লাবটা, যেখানে সেদিন..হাসিটা ফোনে শোনাল মানস।

সীতা একটু হাসল।

 মানস বলল–ইচ্ছে করলে আজ আবার আমরা এখানে আসতে পারি।

সীতা উত্তর দিল না।

–রেডি থেকো। পাঁচটায়।

কথা শেষ হয়ে যায়। তবু একটু ফোন ধরে থাকে দুজন। পরস্পরের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শোনে।

ফোনে খাসের শব্দ শুনলে সীতার কেমন একটু অন্যমনস্কতা আসে। কদিন আগে একটা ফোন কল কেটে গিয়েছিল। কেটে গিয়েছিল? নাকি কেউ সত্যি ছিল ওপাশে? একটা অস্পষ্ট দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনেছিল সীতা। ভুল? তাই হবে। কিন্তু একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায় সে।

ফোন রেখে দেয়।

.

ছুটন্ত ট্যাক্সিতে বার বার সিগারেট ধরাতে চেষ্টা করছিল মানস। হাওয়ায় দেশলাইয়ের কাঠি নিবে যাচ্ছে বার বার। সীতা হাসছিল।

–ওভাবে নয়। হাত দুটো কাপ করে নাও। সীতা বলে।

কাপ? সেটাই তো হচ্ছে না। আঙুলের ফাঁক দিয়ে বাতাস ঢুকছে।

 –থাক, খেতে হবে না।

–খাবই! এই ড্রাইভার রোকে।

 ট্যাক্সি দাঁড়ালে সিগারেটটা ধরাতে চেষ্টা করে মানস। সীতা দেশলাই কেড়ে নেয়। নিজে যত্নে ধরিয়ে দেয়। ট্যাক্সি আবার চলে।

–কেন যে ছাই লোকে খায় এটা। কী আছে সিগারেটের মধ্যে?

বোধহয় ভালবাসা। মনে মনে এই কথা বলে সীতা। মুখ টিপে হাসে। দেখে, ধোঁয়া লেগে মানসের দুই হরিণ-চোখ ভরা জল।

–আর খেয়ো না।

–কেন?

 –অভ্যেস নেই। কাশবে।

–আমার মুখে কি কোনও দুর্গন্ধ আছে সীতা?

–সীতা নয়, মৌ। তুমিই নাম দিয়েছিলে।

সিগারেটের ধোঁয়ায় মাথা আবছা হয়ে গেছে। কিছু ভাবতে পারছি না। গন্ধ নেই তো?

 না তো! তোমার মুখের গন্ধ সুন্দর।

 তবে কেন সিগারেট খেতে বললে আমাকে?

–পুরুষেরা সিগারেট খায়, দেখতে আমার ভাল লাগে।

 –শুধু দেখার জন্য একজনের না-খাওয়ার অভ্যাস নষ্ট করছ?

খেয়ো না।

–রাগ করে বলছ?

না, আমার অত সহজে রাগ হয় না।

 –সিগারেট তো আমি খাচ্ছিই। অভ্যাস করে নেব।

না। মাঝে মাঝে খেয়ো। পুরুষের মুখ কাছাকাছি এলে একটুখানি সিগারেটের গন্ধ পাওয়া যায়, সেটা ভীষণ ভাল লাগে।

-আচ্ছা! মনোরম খুব খেত না?

 –খেত। কিন্তু তার সঙ্গে এটার কোনও সম্পর্ক নেই।

জানি। সেদিনকার ওই লম্বা ছেলেটা কে?

 বীরু। আমার মামাশ্বশুরের ছেলে।

–তোমার মামাশ্বশুর? বলে মানস চেয়ে থাকে। খুব অবাক চোখ। সীতা অবাক হওয়ার মতো কিছু খুঁজে না পেয়ে বলে কী হল?

-মামাশ্বশুরের ছেলে?

–হ্যাঁ। দেওর।

কী বলছ মৌ?

 হঠাৎ খেয়াল হতে সীতা জিভ কাটে। ঠিক তো। তার আর কোনও মামাশ্বশুর নেই, দেওর নেই।

মুখ নিচু করে একটু লাজুক ভঙ্গি করল সীতা।

ভুল হয়ে গিয়েছিল।

 মানসকে একটু পাঁশুটে দেখায়। সিগারেটটা আধখাওয়া করে ফেলে দিয়ে বলে–ঠিক আছে।

না, ঠিক নেই। তুমি রাগ করেছ। সীতা একটু ঘন হয়ে বসে।

–রাগ করিনি। তবে কেমন একটু লাগে। তুমি ঠিক ভুলতে পারছ না।

ভূলছি। এইমাত্র সব ভুলে গেলাম। দেখ, আর এরকম হবে না।

 মানস একটু থমথমে মুখে বলে- ভুলবে কী করে, যদি কলকাতাময় মনোরমের আত্মীয়তা ছড়ানো থাকে!

–ওর বেশি আত্মীয় নেই।

–নেই?

না। ওর বুড়ো বাবা বলে তাকিয়ে একটু হাসে সীতা, বলে–দেখ, শ্বশুর বলিনি কিন্তু।

মানস হাসে।

ওর বুড়ো বাবা ওর ছোটভাইয়ের কাছে থাকে দূরের এক মফস্বল শহরে। সে বাড়িতে আমি মোটে বার দুই গেছি। ও বেশি সম্পর্কও রাখত না। মা নেই। এখানে যারা আছে, তারা সব মামা, মাসি, পিসি গোছের। সে সব সম্পর্কও আলগা হয়ে গেছে।

–তোমাকে আমি খুব দুরে নিয়ে গিয়ে থাকব।

–কেন? ওর আত্মীয়দের ভয়ে?

 –হু। আমার রেলের চাকরি। ইচ্ছে করলেই বদলি হতে পারি।

আমার কলকাতা ভাল লাগে।

–কেন?

–আমার লাগে। একটা শখ আছে আমার, ঘুরে ঘুরে এ-জায়গা সে-জায়গা থেকে জিনিসপত্র কেনা। কিনতে যে কী ভীষণ ভাল লাগে! কলকাতা ছাড়া এরকম দোকান আর দোকান তো কোথাও নেই!

–আচ্ছা, তা হলে কলকাতাতেই থাকব। ফ্ল্যাট তো পেয়েছিই।

আমি কিন্তু খুব জিনিস কিনি, আর ঠকে আসি।

 –কিনো।

 –ঠকলে বকবে না তো?

না। মেয়েরা তো ঠকেই। কলকাতায় এই যে এত দোকান, এত ফিরিঅলা, এরা তো মেয়েদের ঠকিয়েই বেঁচে আছে।

তুমি কত মেয়ে চেনা!

একজনকে তো চিনি। তাকে চিনলেই সব চেনা হয়ে যায়।

 আমি একটা গ্লাটন। সামনে আস্ত একটা মুরগির রোস্ট, নিচু হয়ে সেটার গন্ধ শুঁকে বলল মানস।

–গ্লাটন মানে কী?

–লোভী। পেটুক।

যা। তুমি কি তাই?

–নয়?

একদম নয়। তোমার শরীর আন্দাজে ওইটুকু আবার খাওয়া নাকি। একটা তো এইটুকুন মাত্র মুরগি।

আস্ত মুরগি। –

-হোকগে।

–খাওয়া কমাব, বুঝলে মৌ?

–কেন?

তুমি খাবে এইটুকুন, আমি খাব অ্যাতো, সেটা কি ভাল দেখাবে?

–মোটেই তুমি অতো খাও না।

—খাই।

-খাও তো খাও।

তবে তুমি খাওয়া বাড়াও।

–মেয়েরা বেশি খেতে পারে না।

–কে বলেছে? এসপ্ল্যানেডে বিকেলের দিকে মেয়েরা যা গপাগপ ফুচকা খায় না, দারা সিং অত তে পারবে না।

 সীতা মুখে আঁচল তুলে হাসল।

–তুমি খাও না বলেই রোগা হয়ে অ্যানিমিক।

–স্লিম থাকাই তো ভাল। মোটা মেয়েরা বেশি ভোগে। আমার কোনও অসুখ নেই।

–তোমার ঠিক অ্যানিমিয়া আছে। ডাক্তারের কাছে গেলেই ধরা পড়বে।

 –থাকলে আছে।

থাকবে কেন?

–থাকলে অপছন্দ নাকি? বিয়ে বাতিল করবে?

দুজনে দুপলক পরস্পরের দিকে চেয়ে থেকে হেসে ফেলে।

—আইসক্রিমটা নাড়াচাড়া করছ মৌ, খাচ্ছ না।

–ভীষণ ঠাণ্ডা, দাঁত শিরশির করে। গলা বসে যাবে।

–তবে পকৌড়া খাও।

 –ভাল লাগছে না। তুমি খাও, আমি দেখি।

আস্তে ধীরে খাচ্ছিল মানস, মাঝে মাঝে তাকিয়ে হাসছিল। একদৃষ্টে চেয়েছিল সীতা। সুন্দর মেদহীন চৌকো পুরুষ মুখশ্রী। কাঁধ দুটো কতদূর ছড়ানো। মস্ত হাত। দেখতে ভাল লাগে। অনেকদিন ধরে দেখছে সীতা। তবু এ নতুন করে দেখা। এ ভাবে দেখা হয়নি। এই ডবলডেকারের মতো মানুষটার কাছে সে পাখির মতো ছোট্ট। বোধহয় মানসের মাথা কোনওদিনই বুকে নিতে হবে না সীতার। এবার উল্টো নিয়ম হবে। তাকেই পাখির মতো বুকে নিয়ে শুয়ে থাকবে লোকটা। সারা রাত।

হঠাৎ সীতা আস্তে করে বলে তুমি স্বপ্ন দেখ না?

–স্বপ্ন? একটু হাঁ করে চেয়ে থাকে মানস। তারপর অনেকক্ষণ বাদে হাসে–স্বপ্ন, মৌ? না, দেখি না। আমি খুব সাউন্ড স্লিপার। কেন?

-এমনিই। অনেকে ঘুমের মধ্যে কথা বলে।

আগে থেকে সাবধান হচ্ছ? ভয় নেই, ও সব হয় তাদের যারা স্নায়ুর রোগে ভোগে।

–তাই!

আবার চুপ। দুজনেই। সীতা সাদা আঙুলে কাঁচের টেবিলে একটা শূন্য আঁকল। তারপর মুখ তুলে হাসল।

ট্যাক্সিটা বাঁক ঘুরতেই অন্ধকারের মধ্যে স্টিমারের মতো ঝলমল করে ওঠে ক্লাব। চারধারে যেন বা কালো নদী। স্টিমার চলেছে।

গাছগাছালিতে বাতাস মর্মরধ্বনি তুলেছে। আলোকিত টেনিস লন। সাইটস্ক্রিনের আড়ালে বলে দেখা যায় না কিছু। হঠাৎ পক করে বলের শব্দ আসে।

আজও কেউ বড় একটা ফিরে তাকায় না। তারা সিঁড়ি বেয়ে ওঠে। টেবল-টেনিসের টেবিলে খুব ভিড় আজ। বহু খেলোয়াড়। চারদিকে বেয়ারাদের দ্রুত আনাগোনা।

মানস মুখ ফিরিয়ে হাসল। বলল–আজ শনিবার।

–তাতে কী?

–ভিড়।

 –ও।

–শনিবারে কলকাতার মানুষ পাগল হয়ে যায়।

 –আমরাও কি শনিবারের পাগল?

–না। চিরকালের।

 করিডোরে একজন তোক শ্লথ পায়ে আগে আগে হাঁটছিল। কথা শুনেই বোধহয় ফিরে তাকাল। অচেনা লোক। খুব ফরসা সুন্দর চেহারা, অবিকল সাহেবদের মতো। লালচে একজোড়া গোঁফ, লালচে চুল এলোমেলো হয়ে আছে মাথায়। মুখে সামান্য ক্লান্তির ছাপ। একটু হাসল কি লোকটা?

সীতা সিটিয়ে যাচ্ছিল। তারপর হঠাৎ মনে পড়ল, সে কিছু অন্যায় করছে না। সে কোনও অপরাধ করেনি।

পিঠে মানসের আলতো হাত তাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিছু ভয় নেই।

ঘরটা খালিই ছিল। ঠিক আগের দিনের মতো। মানস দরজাটা আগেই বন্ধ করে দিল। ফিরে ইঙ্গিতময় হাসি হাসল একটু। ঠিক সেই মুহূর্তেই সীতার মনে পড়ে, কদিন আগে কেটে যাওয়া টেলিফোন কল। লাইনটা কি কেটে গিয়েছিল সত্যিই? না কি কেউ দীর্ঘশ্বাসই কেবল শুনিয়েছিল তাকে?

ভ্রূ আপনা থেকেই কুঁচকে গেল সীতার।

কী হল? কিছু ভাবছ? মানস প্রশ্ন করে।

সীতা উত্তর দেয় না। শুনতেই পায় না প্রশ্নটা।

ঘরের একদিকে চমৎকার একটা পুরনো আমলের ড্রেসিং টেবিল। বেলজিয়ামের মসৃণ কাঁচ বসানো। সীতা ধীর পায়ে উঠে গিয়ে একটু দাঁড়াল আয়নার সামনে। অ্যানিমিক? বোধ হয়। তাকে খুব রোগা আর ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। মিছে কথা বলেছিল সীতা মানসকে। তার আজকাল খুব অম্বল হয়, মাথা ধরে। হয়তো খুব শিগগিরই অসুখ হবে। আমার অসুখ নেই, এ কথাটা খুব ভেবে বলেনি সে। একটু পিছনে দাঁড়িয়ে আছে মানস। এতক্ষণে ওর পোশাকটা লক্ষ করেনি সীতা তেমন করে। খুব ঝকঝকে একটা চেক প্যান্ট পরনে, গায়ে সাদা স্পোর্টস গেঞ্জি। বুকের চৌকো পাটা ফুটে আছে গেঞ্জির ওপর। বাঁ কাঁধটা ভাঙা, একটু নোয়ানো। খুবই বড় শক্তিমানের চেহারা। ওর পাশে সে কি আধখানা, না সিকিভাগ?

মানস এগিয়ে আসে।

 সীতা আস্তে করে বলে–তোমাদের দুজনের খুব অদ্ভুত মিল।

-কাদের দুজনের কথা বলছ?

–তোমার আর ওর।

–ও কে?

–মনোরম।

 –মিল?

দুটো খুব অদ্ভুত মিল।

কী?

–তোমাদের দুজনের নামই ম দিয়ে শুরু। আর…

–আর?

–তোমাদের দুজনেরই একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল।

 মানস এগিয়ে এসেছিল অনেকটা, তবু দূরত্ব ছিল একটুখানি। সেই দূরত্বটা রয়েই গেল। মানন্সের মুখটা আস্তে আস্তে একটু গম্ভীর হয়ে যায়।

বলল–মৌ, আমাকে তুমি সিগারেট খাওয়া শিখিয়েছ কেন?

এমনিই। ভাল লাগে।

না।

 তবে কেন? অবাক হয়ে প্রশ্ন করে সীতা।

–মনোরমের সঙ্গে আমার আরও মিল বের করতে।

তার মানে?

তুমি কি আমার মধ্যে মনোরমকেই চাও?

 সীতা মূক হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *