মিস্টার সরকার বাড়ি ফিরতেই খোকন প্রণাম করল। ছেলেকে একবার ভালো করে দেখে নিয়ে বললেন, এই মাসে তুই বেশ লম্বা হয়েছিস তো।
শিবানী বললেন, ছেলের পায়ের দিকে তাকালেই বুঝবে কেন এত লম্বা হয়েছে।
মিস্টার সরকার ছেলের পায়ের দিকে তাকাতেই সোনালী বলল, হোস্টেলে গিয়ে খোকনদার অনেক কায়দা বেড়েছে।
খোকন সঙ্গে সঙ্গে ওর মাথায় একটা চাটি মেরে বলল, আবার ফড় ফড় করছিস?
তোমার কায়দা বেড়েছে, বলব না?
কিছু কায়দা বাড়েনি।
তোমার মাথার চুল আর পায়ের জুতো দেখে তো আমি প্রথমে…
আবার?
ড্রইংরুমে চা খেতে খেতে গল্প গুজব হয়। হঠাৎ মিস্টার সরকার বললেন, শিবানী চলল আমরা সবাই মিলে সপ্তাহ খানেকের জন্য পুরী ঘুরে আসি।
তুমি ছুটি পাবে?
তা পেয়ে যাব।
খোকন বলল, আগে জানলে আমি পুরী পর্যন্ত কনসেশন নিতে পারতাম।
মিস্টার সরকার বললেন, সে আর কি হবে।
শিবানী বললেন, রেল কোম্পানিকে অযথা কতকগুলো টাকা দিতে হতো না।
সোনালী বলল, পুরী তো এক রাত্তিরের জার্নি। আমি আর খোকনদা থ্রী টায়ারে চলে যাব। তোমরা?
খোকন সঙ্গে সঙ্গে সোনালীকে বলল, আবার খোকনদাকে টানছিস কেন? কেন? তোমার থ্রী টায়ারে যেতে লজ্জা করবে? ছাত্রজীবনে বেশি বাবুগিরি করা ভালো।
দ্যাখ সোনালী বুড়ীদের মতো ফালতু উপদেশ দিবি না।
মিস্টার সরকার বললেন, খোকন, সোনালী কিছু অন্যায় বলেনি। আমি তোমাদের ফার্স্ট ক্লাসে নিয়ে যেতে পারি ঠিকই কিন্তু দশ-বারো ঘন্টার জার্নির জন্য অযথা এক গাদা টাকা ব্যয় করার কোনো দরকার আছে কি?
খোকন হেসে বলে, আমি একবারও বলিনি থ্রী টায়ারে যাব না। তবে এবার এসে দেখছি সোনালী বড্ড পাকা পাকা কথা বলছে।
এতক্ষণ পরে শিবানী বললেন, তুই ভুলে যাস না খোকন, সোনালী ক্রমশ বড় হচ্ছে।
খোকন সোনালীর দিকে তাকিয়ে বলল, শাড়ি পরেই তোর মাথাটা গেছে।
পরের দিন দুপুরে মিস্টার সরকার টেলিফোনে টিকিট হয়ে যাবার খবর দিতেই বাড়িতে উত্তেজনার ঢেউ বয়ে গেল।
শিবানী বললেন, সোনালী কাল সুটকেশ-টুটকেশ গুছিয়ে ফেলতে হবে।
আচ্ছা।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর, শিবানী একটু বিশ্রাম নিতে-গেলেন।
খোকন নিজের ঘরে যেতেই সোনালী এসে জিজ্ঞাসা করল, দেশলাই আনতে হবে?
দেশলাই আছে। অ্যাসট্রেটা নিয়ে আয়।
সোনালী ড্রইংরুম থেকে অ্যাসট্রে আনতেই খোকন সিগারেট ধরাল। সিগারেটে একটা টান দিয়েই জিজ্ঞাসা করল, সোনালী, পুরী তোর কেমন লাগে রে?
সমুদ্র বা পাহাড়ে কারুর খারাপ লাগে নাকি?
পুরী আমার তত ভালো লাগে না।
কেন?
ওখানে ভোরবেলায় আর সন্ধ্যেবেলায় ছাড়া তো বেড়াবার উপায় নেই।
তা ঠিক। রোদ্দুর উঠলে আর সমুদ্রের ধারে যাওয়া যায় না।
তাছাড়া পুরীতে তো আর কোথাও বেড়াবার জায়গা নেই।
জগন্নাথের মন্দির?
মন্দিরে কি লোকে সারাদিন পড়ে থাকবে?
তাহলে অন্য কোথাও যাবার কথা তুমি জ্যাঠামণিকে বললে না কেন?
ধারে কাছে আর যাবার জায়গা কোথায়? তাছাড়া বাবা-মার পুরী খুব ভালো লাগে।
পুরী তোমার একেবারেই ভালো লাগে না?
পুরীর সমুদ্রে চান করতে খুব ভালো লাগে।
দু-এক মিনিট পরে খোকন জিজ্ঞাসা করল, সমুদ্রে চান করতে তোর কেমন লাগে?
ভালো, তবে এবার আর করব না।
কেন?
এখন ওই অত লোকের সামনে চান করা যায়? লজ্জা করবে না?
খোকন সিগারেট টানতে গিয়েও পারে না। হাসে।
হাসছ কেন?
তোর কথা শুনে।
এমন কি হাসির কথা বললাম?
তুই এমনই বড় হয়ে গেছিস যে পুরীর সমুদ্রে আর চান করতেই পারবি না?
গায়ে অত কাপড়-গামছা জড়িয়ে চান করতে বিরক্ত লাগে।
তুই তাহলে সত্যি বড় হয়েছিস?
ভুলে যেও না আমি সামনের বার হায়ার সেকেন্ডারি দেবো।
খোকন সিগারেট টানতে গিয়েও মাথা নেড়ে জানায়, সে ভুলে যায়নি।
তাছাড়া জানো, আমাদের ক্লাসের দুটো মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে।
চোখ দুটো বড় বড় করে খোকন বলে, সত্যি?
বড়মাকে জিজ্ঞাসা করো।
তোদের ক্লাসের মেয়েরা বিয়ের কি বোঝে?
আমাদের ক্লাসেও অনেক পাকা পাকা মেয়ে আছে। শিউলিটা তো ভীষণ বদ হয়ে গেছে।
বদ হয়েছে মানে?
সুকুমার বলে একটা লোফার ছেলের সঙ্গে ওর খুব ভাব। যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ায়।
তুই কী করে জানলি?
অনেক বন্ধুরা দেখেছে। তাছাড়া দুজন দিদিমণি দেখে ওকে খুব বকাবকি করেছেন।
তাহলে তোর বন্ধুরাও ওস্তাদ হয়ে উঠেছে।
একটু চুপ করে থাকার পর সোনালী চাপা হাসি হাসতে হাসতে বলল, আমার এক বন্ধুর তোমাকে খুব ভালো লাগে।
সত্যি?
তুমি বড়মাকে বললো না।
বলব না, কিন্তু মেয়েটা কে?
মায়া।
সে আমাকে দেখল কোথায়?
ও তো দু-তিন দিন পর পরই আমার কাছে আসে। আজ সকালেও তো এসেছিল।
ওই মায়া?
হ্যাঁ।
বিয়ে করবে?
জানি না।
তবে আর কী ভালো লাগল?
সোনালী আবার হেসে বলে, শুধু তোমাকে দেখার জন্যই ও আজ সকালে এসেছিল।
তাই নাকি?
সত্যি বলছি।
আবার কবে আসবে?
তা কি আমাকে বলে গেছে?
.
দুদিন পর পুরী এক্সপ্রেস হাওড়া স্টেশন ছাড়ার পরই খোন একটা সিগারেট ধরিয়ে সোনালীকে বলল, বাবা-মার সঙ্গে ফার্স্ট ক্লাসে না গিয়ে ভালোই হয়েছে।
কেন, সিগারেট খেতে পারতে না বলে?
হ্যাঁ। খোকন সিগারেটে টান দিয়ে বলল, ট্রেনে উঠেই সিগারেট ধরাতে না পারলে আজকাল একদম ভালো লাগে না।
তবে তখন যে খুব রেগে গিয়েছিলে?
মোটেও রাগিনি।
মিথ্যে কথা বোলো না খোকনদা। নিতান্ত জ্যাঠামণি আর বড়মা আমাকে সাপোর্ট করলেন, নয়ত…
দ্যাখ সোনালী বাবা-মার চাইতে আমি তোকে কম ভালোবাসি না…
তা জানি।
তোর উপর ঠিক রাগ করতে পারি না।
তবে যখন-তখন আমাকে যা তা বলো কেন?
সিগারেটে খুব জোরে একটা টান মেরে খোকন বলল, ও তোকে একটু রাগাবার জন্য।
তুমি বড্ড আমার পিছনে লাগো।
তবে কি বাবা-মার পিছনে লাগব?
সোনালী হাসে।
.
ট্রেন ছুটে চলেছে। অনেক প্যাসেঞ্জার এর মধ্যেই শোবার ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। অনন্যরা কেউ বা খাওয়া-দাওয়া করছেন অথবা গল্প-গুজব করছেন।
খোকন আবার সিগারেট ধরায়। বলে, দ্যাখ সোনালী, আজকাল বাবা-মা আমার চাইতে তোকে বেশি ভালোবাসেন।
আমি অত বেশি-কম বুঝি না।
তুই কাছে না থাকলে তো বাবার মুখের চেহারাই বদলে যায়।
কি জানি? আমি দেখিনি।
মা একটু চাপা। ঠিক প্রকাশ করতে চান না কিন্তু প্রতি মুহূর্তেই ধরা পড়ে যান।
তুমি জ্যাঠামণি-বড়মার একমাত্র ছেলে। তোমাকে কি ওঁরা কম ভালোবাসতে পারেন?
কিছুক্ষণ পরে খঙ্গপুর আসে। খোকন দুটো কফি কিনে একটা সোনালীকে এগিয়ে দিতেই ও বলল, এখন কফি খেলে রাত্তিরে ঘুমোব কখন?
একটু অনিয়ম, একটু অত্যাচার না করলে বাইরে বেড়াবার আনন্দ কি?
তুমি এই দু বছর হোস্টেলে থেকে বেশ বদলে গেছ।
হোস্টেলে না গেলেও এই পরিবর্তন হতো।
পরিবর্তন হলেও এতটা হতো না।
এই বয়সটাই পরিবর্তনের বয়স।
তা ঠিক।
এই বয়সে সব ছেলেমেয়েরাই হঠাৎ অদ্ভুতভাবে সব ব্যাপারেই সচেতন হয়ে ওঠে। সবকিছু জানতে চায়, বুঝতে চায়, এক্সপেরিমেন্ট করে দেখতে চায়।
সোনালী মুগ্ধ হয়ে খোকনের কথা শোনার পর বলে, তুমি আজকাল কত সুন্দর করে কথা বলো।
খোকন হেসে বলল, তাই নাকি?
সত্যি খোকনদা তোমার কথাবার্তার ধরনটা একেবারে বদলে গেছে।
খোকন একটু হাসে। কিছু বলে না।
সোনালী বলল, খোকনদা, পুরীতে গিয়ে আমরা সারা রাত গল্প করব।
আমার সারা রাত আড্ডা দেওয়া অভ্যাস আছে কিন্তু তুই পারবি না।
খুব পারব।
বারোটা-একটার পর তুই ঠিক ঘুমিয়ে পড়বি।
তুমি গল্প করলে আমি কিছুতেই ঘুমোব না।
আর যদিও বা একটা রাত কোনোমতে জেগে থাকিস তাহলে আর তার পরের দিন সকালে তো…
কিচ্ছু হবে না।
আচ্ছা দেখা যাবে।
একটু চুপ করে থাকার পর সোনালী জিজ্ঞাসা করল, কি খোকনদা, তোমার ঘুম পাচ্ছে নাকি?
খোকন হেসে বলল, এখুনি?
এখন কটা বাজে?
মোটে এগারোটা কুড়ি।
এখনও সাড়ে এগারোটাও বাজেনি?
না।
সোনালী একবার চারপাশে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, সবাই কী ঘুম ঘুমোচ্ছ!
আমাদের দেশের কটা মানুষ জীবন উপভোগ করতে জানে? কোনমতে খেয়েদেয়ে বউকে জড়িয়ে শুতে পারলেই…
শুনতেও সোনালী লজ্জা পায়। খোকনের মুখের উপর হাত দিয়ে বলল, চুপ করো!
চুপ করবো?
হ্যাঁ।
কেন? আমি কি মিথ্যে কথা বলছি?
তা বলছি না তবে…
সোনালী কথাটা শেষ না করে খোকনের দিকে তাকায়।
কথাটা শেষ না করে আমার দিকে তাকিয়ে কি দেখছিস?
দেখছি আর ভাবছি। একটু থেমে সোনালী আবার বলল, দেখছি তোমাকে আর ভাবছি তোমার কথা।
খোকন কিছু বলল না, শুধু একটু হাসল।
সোনালী ওর সিগারেটের প্যাকেটটা নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, সত্যি খোকন, তুমি কত বড় হয়ে গেছ। মনে হয় এইতো সেদিনও তুমি বাবার কাঁধে চড়ে…
তুই যে দিদিমা-ঠাকুমার মতন কথা বলছিস!
সোনালী একটু হেসে বলে, তুমি যখন এখানে থাকে না তখন সময় পেলেই আমি পুরনো অ্যালবামগুলো দেখি।…
কেন?
তোমার-আমার ছোটবেলার ছবিগুলো দেখতে মজা লাগে।
ছেলেবেলার ছবি দেখতে সবারই মজা লাগে।
আমি কি শুধু ছবি দেখি?
তবে?
যখন একলা একলা ভালো লাগে না, তখন তোমার ছবিগুলো দেখতে দেখতে তোমার সঙ্গে কত কথা বলি।
খোকন হাসতে হাসতে বলে, তুই কি পাগল নাকি?
এতে পাগলের কি আছে?
ছবির সঙ্গে কি কেউ কথা বলে?
একলা একলা ভালো না লাগলে কি করব?
তাই বলে অ্যালবামের ছবিগুলোর সঙ্গে কথা বলবি?
বলব না কেন? কিছুক্ষণ অ্যালবামের ছবিগুলো দেখার পর মনটা বেশ ভালো হয়ে যায়।
অতি উত্তম কথা।
সোনালী খোকনের একটা হাত ধরে একটু টান দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তারপর কি করি জানো?
কি?
তোমাকে চিঠি লিখতে বসি।
হা ভগবান!
সোনালী একটু রাগ করেই বলে, তুমি এ রকম হা ভগবীন, হা ভগবান করবে না।
করব না?
না।
তুই এত সেন্টিমেন্টাল হলে বিয়ের পর স্বামীর ঘর করবি কি করে?
তোমার মতন আমি চট করে বিয়ে করব না।
আমি বুঝি চট করে বিয়ে করতে চাই?
তোমার কথাবার্তা শুনে তাইতো মনে হয়।
খুব ভালো কথা। কিন্তু তুই বিয়ে করবি না কেন?
বিয়ে করব না, তা তো বলিনি। তাই বলে তোমার মতন আমি চটপট বিয়ে করে পালাতে চাই না।
কেন?
কেন আবার? তোমাদের ছেড়ে চলে যাবার কথা আমি ভাবতেও পারি না।
আচ্ছা সোনালী, একটা কথা বলবি?
বলব না কেন?
বাবা-মা আর আমার মধ্যে সব চাইতে কাকে বেশি ভালোবাসিস?
ওঁদের দুজনের সঙ্গে কি তোমার তুলনা হয়?
কেন হয় না?
ওঁদের একরকম ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি আর তোমাকে অন্য রকম ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি।
অন্যরকম মানে?
আমি অতশত বোঝাতে পারব না।
হঠাৎ গাড়ির গতি কমে আসতেই খোকন হাতের ঘড়ি দেখে বলল, পৌনে একটা বাজে। তোর ঘুম পাচ্ছে না?
না।
আস্তে আস্তে চলতে চলতে গাড়ি থামল।
সোনালী জিজ্ঞাসা করল, এটা কোন্ স্টেশন?
বালাশোর।
তার মানে বাংলাদেশ ছাড়িয়ে এসেছি?
হ্যাঁ।
জানলার পাশ দিয়ে চাওয়ালা যেতেই খোকন ওকে জিজ্ঞাসা করল, চা খাবি?
এত রাত্তিরে চা খাব?
চা না খেলে রাত জাগবি কিভাবে?
চায়ে চুমুক দিতেই সোনালী বলল, আমি বোধহয় জীবনে এত রাত্রে আর চা খাইনি।
জীবনে এতকাল যা করিসনি, এখন তো তাই করার বয়স আসছে।
তুমি হোস্টেলে থেকে বড় ওস্তাদ হয়েছ।
এখনও ওস্তাদ হবে না?
চা খাওয়া শেষ। গাড়িও ছেড়ে দিয়েছে।
খোকন জিজ্ঞাসা করল, হারে তুই কি সত্যিই ঘুমুবি না?
চা খাবার পরই কারুর ঘুম পায়?
শুয়ে পড়। আস্তে আস্তে ঘুম এসে যাবে।
না, আমি শোব না।
কেন রে?
এমন করে সারারাত তো কোনোদিন জাগিনি, তাই বেশ লাগছে।
সত্যি বলছিস?
সত্যি বলছি। সোনালী একটু থেমে বলল, তাছাড়া তোমাকেও তো অনেক কাল এভাবে পাই না।
তাহলে আমার সঙ্গে ঝগড়া করিস কেন?
ভালো লাগে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। সামনের বার্থের এক ভদ্রমহিলা ঘুম থেকে উঠে বাথরুম গেলেন।
খোকন বলল, দেখলি, উনি কিভাবে আমাদের দেখলেন?
ওসব তুমি দ্যাখো।
কি অদ্ভুত সন্দেহের দৃষ্টিতে উনি আমাদের দেখলেন, তা তুই ভাবতে পারবি না।
অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখার কি আছে?
এ দেশে ছেলেমেয়েদের গল্প করতে দেখলেই তো বুড়োদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই।
সোনালী হেসে বলল, তা ঠিক।
.
গাড়ি এগিয়ে চলে। রাত আরো গম্ভীর হয়। খোকন ঘন ঘন সিগারেট ধরায়।
আর কত সিগারেট খাবে?
খোকন সিগারেটে টান দিয়ে হেসে জিজ্ঞাসা করল, খুব বেশি সিগারেট খাচ্ছি নাকি?
এইতো পাঁচ মিনিট আগেই…
মাত্র তিন প্যাকেট সিগারেট নিয়ে তো গাড়িতে উঠেছি।
ছি, ছি, এত কম সিগারেট কেউ খায়?
খোকন কিছু না বলে সিগারেটে আবার একটা টান দিল।
সোনালী জিজ্ঞাসা করল, ফেরার সময় জ্যাঠামণি যদি তোমাকে আলাদা আসতে না দেন? যদি ওঁদের সঙ্গেই ফার্স্ট ক্লাশে আসতে হয়?
ছাত্র জীবনে বিলাসিতা করা আমি একটুও পছন্দ করি না।
সোনালী হাসতে হাসতে খোকনের গায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ল।
ভদ্ৰক পার হতেই ওরা শুয়ে পড়ল।
.
রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর বারান্দায় বসে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করার পর মিস্টার সরকার পরপর দুবার হাই তুলতেই শিবানী বললেন, চলো শুতে যাই। খোকন আর সোনালীর দিকে তাকিয়ে বললেন, যা তোরাও শুতে যা।
খোকন বলল, এখুনি?
এগারোটা বেজে গেছে। আর রাত করিস না।
কিরে সোনালী, তোর ঘুম পেয়েছে নাকি?
সোনালী জবাব দেবার আগেই ওর মা বললেন, ঘুম না পাবার কি হয়েছে? সারাদিন ধরে এত ঘোরাঘুরির পর ঘুম পাবে না?
সবাই উঠে দাঁড়াতেই শিবানী সোনালীকে বললেন, হয়, টেবিল লাইট না হয় বাথরুমের আলোটা জ্বালিয়ে রাখিস।
আচ্ছা।
ঘরে ঢুকেই খোকন জিজ্ঞাসা করল, কিরে সোনালী, ঘুমোবি নাকি?
ঘুমোব না তবে শুয়ে শুয়ে গল্প করব।
কেন?
সারাদিন ঘোরাঘুরি করে পা-দুটো বড় ব্যথা করছে।
তার মানে তোর ঘুমোনোর মতলব।
মোটেও না।
আমি সারারাত জাগব বলে দশ প্যাকেট সিগারেট কিনে এনেছি।
দশ প্যাকেট!
এক রাত্রেই দশ প্যাকেট লাগবে না তবে চার-পাঁচ প্যাকেট লাগবে।
খোকনদা, তুমি এত সিগারেট খেও না।
আবার বুড়ীদের মতন হিতোপদেশ দিচ্ছিস? হোস্টেলে কত ছেলে মদ খায় জানিস?
মদ!
হ্যাঁ মদ। হুইস্কী, রাম।
মদের নাম রাম? সোনালী হাসতে হাসতে প্রশ্ন করে।
হাসছিস কিরে!
মদের নাম রাম শুনেও হাসব না?
সোনালীর বিছানায় পাশাপাশি বসেই ওরা চাপা গলায় কথা বলে। খোকন বলল, আমাদের হোস্টেলে মদ খাবার কথা কিভাবে বলা হয় জানিস?
কিভাবে?
বলা হয়, আজ অত নম্বর ঘরে রাম নাম।
সোনালী শুনে হাসে। তারপর জিজ্ঞাসা করে, তুমি কোনোদিন খেয়েছ নাকি?
খাইনি তবে অনেকেই জোর-জুলুম করে।
না না, তুমি কক্ষনো খাবে না। জ্যাঠামণি-বড়মা জানতে পারলে ভীষণ কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
খাব না ঠিকই কিন্তু খেলেও কি ওরা জানতে পারবে?
একদিন না একদিন ঠিক জানতে পারবে।
খোকন আর একটা সিগারেট ধরিয়ে একটা টান দিয়ে বলল, দ্যাখ সোনালী, ছেলেমেয়েরা বড় হবার পর কত যে ফাজিল, কত বদ হয় তা বাবা-মারা ঠিক আন্দাজ করতে পারে না।
না, পারে আবার না?
সত্যিই পারে না। ছেলেমেয়ে সম্পর্কে বাপ-মার এমনই অন্ধ স্নেহ থাকে যে তাদের বেশি খারাপ ভাবতে পারে না।
সোনালী ভাবে।
খোকন সিগারেটে টান দিয়ে জিজ্ঞাসা করে, কি ভাবছিস?
তোমার কথা।
বেশি দূর যাবার কি দরকার? এই যে আমি আর তুই এখনও গল্প করছি বা আমি একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছি তা কি বাবা-মা পাশের ঘরে থেকেও জানতে পারছেন?
তা ঠিক।
তাহলে ভেবে দ্যাখ, বাড়ির বাইরে বা হোস্টেলে থেকে ছেলে-মেয়েরা কি করে তা বাবা-মা জানবে কি করে?
ঠিক বলেছ। সোনালী আবার কি যেন ভাবে। তারপর খোকনের একটা হাত ধরে বলে, তুমি আমার একটা কথা রাখবে খোকনদা?
কী কথা?
আগে বলো রাখবে কিনা।
জেনে কী করে বলব?
অসম্ভব কিছু বলব না।
তাহলে নিশ্চয়ই রাখব।
ঠিক?
আগে থেকে প্রতিজ্ঞা না করিয়ে কী কথা রাখতে হবে, সেটা তো বল।
তুমি অন্য ছেলেদের মতন খারাপ হবে না।
খোকন হেসে বলে, খারাপ হবে না মানে?
মানে এমন কিছু করবে না যাতে তোমাকে কেউ খারাপ বলে।
এ কথার কোনো মানেই হল না।
কেন?
সব কাজই একজনের কাছে ভালো, অন্যের কাছে খারাপ।
তবুও মাঝামাঝি একটা কিছু তো আছে।
সেটাও এক-এক জনের কাছে এক-এক রকম।
সোনালী খোকনকে একটা ধাক্কা দিয়ে বলে, তুমি বড় তর্ক করো।
খোকন হেসে বলে, আচ্ছা তর্ক করব না কিন্তু তুই কী করতে বারণ করেছিস, তা তো বলবি।
বলছি যে তুমি বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে কোনোদিন মদ-টদ খাবে না।
হুজুগে পড়ে যদি কোনোদিন খাই?
হুজুগে পড়েও খাবে না।
কেন খেলে কি হয়েছে? একদিন মদ খেলেই কি আমি খারাপ হয়ে যাব?
আমি বলছি তুমি খাবে না।
তুই আমার কে যে তোর কথা আমাকে শুনতে হবে?
সোনালী চমকে উঠল, কী বললে? আমি তোমার কে?
তোর কথা শুনতেই হবে?
না। তুমি শুতে যাও, আমি এবার ঘুমোব।
সারারাত গল্প করবি না?
না, তুমি শুতে যাও।
সোনালী রাগ করে মুখোনা ঘুরিয়ে রাখে। খোকনও একটু ঝুঁকে পড়ে ওর মুখের সামনে মুখ নিয়ে জিজ্ঞাসা করে, তুই সত্যি রাগ করেছিস?
সোনালী কোনো জবাব দেয় না।
খোকন আবার জিজ্ঞাসা করে, কিরে, কথা বলবি না?
তুমি শুতে যাও।
তুই জবাব না দিলে আমি শুতে যাব না।
না রাগ করিনি, খুশি হয়েছি।
খোকন হাসে।
সোনালী রেগে যায়। বলে, আর দাঁত বের করে হাসতে হবে না।
হাসব না?
নিজের বিছানায় গিয়ে যা ইচ্ছে কর। এবার আমি শোব।
সত্যি শুবি?
হ্যাঁ।
দু-এক মিনিট চুপ করে থাকার পর খোকন নিজের বিছানায় চলে গেল।
হঠাৎ খোকনের ঘুম ভেঙে গেল। প্রথমে ঠিক বুঝতে পারল না। বেশ কিছুক্ষণ পরে বুঝল, কেউ কাঁদছে। এত রাত্রে কোথায় কে কাঁদছে, তা ভেবে পেল না। আরো ভালো করে কান পেতে শুনল। খোকন চমকে উঠল, সোনালী কাঁদছে?
তাড়াতাড়ি উঠে ওর কাছে যেতেই কান্নার শব্দ আরও স্পষ্ট হল।
খোকন ডাকল, সোনালী!
কোনো জবাব নেই।
আবার ডাকল, সোনালী কাদছিস কেন, কী হয়েছে?
সোনালী কোনো জবাব দেয় না, দিতে পারে না। উপুড় হয়ে শুয়ে আগের মতনই কাঁদে।
সোনালী, তোর শরীর খারাপ লাগছে, মাকে ডাকব?
কাঁদতে কাঁদতেই ও জবাব দিল, না, তুমি শুতে যাও।
এবার খোকন ওর পাশে বসে মাথার উপর হাত রেখে বলল, তুই কাঁদছিস আর আমি শুয়ে থাকব?
আমি তোমার কে যে আমার কান্নার জন্য তোমাকে জেগে থাকতে হবে?
এতক্ষণে ওর কান্নার কারণ বুঝতে পেরে খোকন হাসতে হাসতে বলল, হা ভগবান! তুই আমার এই কথার জন্য কাঁদছিস?
ছি, ছি, খোকনদা, তুমি ও-কথা বললে কেমন করে? এতকাল পরে তুমি জানতে চাইলে আমি তোমার কে?
খোকন ওর মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, আমার ওই সামান্য একটা কথার জন্য…
ওটা তোমার সামান্য কথা হল?
আচ্ছা আর ও-কথা বলব না। তুই ঠিক হয়ে শো, আমি তোকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।
আমার জন্য তোমাকে কিছু করতে হবে না। তুমি শুতে যাও।
তুই না ঘুমুলে আমি এখান থেকে উঠছি না।
আমি তোমার কে?
খোকন ঝুঁকে পড়ে ওর মুখের ওপর মুখ রেখে কানে কানে বলল, তুই আমার সোনা, সোনালী!
সোনালী মুখ তুলেই বলল, এখন আর গরু মেরে জুতো দান করতে হবে না।
গরু মেরে জুতো দান করছি নাকি?
এর আগে যা তা বলে এখন আর আমাকে সোনা সোনালী বলে ভোলাতে হবে না।
সত্যি বলছি তোকে ভোলাবার জন্য বলিনি। তোকে আমি কত ভালোবাসি, তা জানিস না?
হাতের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলল, ঘণ্টা ভালোবাসো।
নারে সোনালী, তোকে আমি সত্যি ভালোবাসি।
মা কালীর নামে দিব্যি করে বল।
আমি মা কালীর নাম করে বলছি তোকে আমি ভালোবাসি।
সোনালী আর পারে না। এক মুহূর্তে কান্না থেমে যায়, অভিমান চলে যায়। হঠাৎ দু-হাত দিয়ে খোকনের কোমর জড়িয়ে ধরে ওর পায়ের উপর মাথা রেখে বলে, যেমন তুমি আমাকে দুঃখ দিয়েছ, তেমন তুমি সারা রাত এইভাবে বসে থাকবে। আমি তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমোব।
খোকন একটু অস্বস্তি বোধ করে কিন্তু কিছু বলতে পারে না। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, এই ভাবে সারারাত বসে থাকা যায় পাগলী?
আমি কিছু জানি না।
তুই ঠিক হয়ে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়। আমি তোকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।
সোনালী আরো জোরে ওকে আঁকড়ে ধরে বলে, তোমাকে আমি ছাড়ছি না। ঠিক এইভাবে বসে থাকতে হবে।
এইভাবে কি বেশিক্ষণ বসে থাকা যায়?
আমি জানি না।
তুই জানিস না?
না।
খোকন কিছু বলে না। চুপ করে বসে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। বোধহয় আধঘণ্টা-পঁয়তাল্লিশ মিনিট।
সোনালী মুখ তুলে খোকনের মুখের দিকে তাকিয়ে, একটু হেসে বলল, কেমন জব্দ!
সোনালী পা-টা ব্যথা হয়ে গেছে।
হোক।
ওর কথায় খোকন না হেসে পারে না। বলে, সত্যিরে বড় ব্যথা করছে।
তোমার কথায় আমার আরো অনেক বেশি ব্যথা লেগেছিল।
সোনালী, তুই বালিশে মাথা রাখ। আমি একটু হেলান দিয়ে বসি।
তারপর তুমি পালিয়ে যাবে?
সত্যি পালাব না।
ঠিক?
আমি বলছি তো পালাব না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সোনালী বলল, অনেক দিন পর তোমার কোলে মাথা রেখে শুয়েছি, তাই না খোকনদা?
হ্যাঁ, অনেক দিন পর।
আগে আমরা একসঙ্গে শুয়ে কত রাত পর্যন্ত গল্প করতাম। আর বড়মা ঘরে ঢুকলে আমরা ঘুমের ভান করতাম, তাই না?
সত্যি সেসব দিনগুলোর কথা ভাবলে ভারি মজা লাগে।
আচ্ছা খোকনদা, হোস্টেলে থাকার সময় আমার কথা তোমার মনে পড়ে?
কেন মনে পড়বে না?
কি মনে পড়ে?
অনেক কিছু।
অনেক কিছু মানে?
অনেক কিছু মানে সবকিছু। আমাদের হাসি-ঠাট্টা ঝগড়া-মারামারি…
আমি তো মাঝে মাঝে লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার জন্য কাঁদি।
কেন?
কেন আবার? একলা একলা ভালো লাগে না বলে।
তাহলে আমি এলে ঝগড়া করিস কেন?
আমি মোটেও ঝগড়া করি না।
আবার একটু চুপচাপ।
আচ্ছা খোকনদা, আমি তোমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি বলে তোমার ভালো লাগছে না?
তোকে সব সময়ই আমার ভালো লাগে। বিশেষ করে হোস্টেলে চলে যাবার পর তোকে বোধহয় বেশি ভালোবাসতে শুরু করেছি।
সত্যি?
এখন বাবা-মার চাইতে তোর জন্য বেশি মন খারাপ লাগে।
পুরী এসে ভালোই হয়েছে, তাই না?
হ্যাঁ।
তুমি সমুদ্রে চান করবে?
করতেও পারি, ঠিক নেই। তুই তো সমুদ্রে চান করবি না বলেছিস।
না আমি সমুদ্রে চান করব না।
সত্যি সোনালী, তুই যেন হঠাৎ বড় হয়ে গেছিস।
এখন আমাকে দেখলে বেশ বড় মনে হয়, তাই না?
তা একটু হয় বৈকি।
তোমাকেও আজকাল বেশ বড় দেখায়। সোনালী একবার ওর দিকে তাকিয়ে বলল, আজকাল তোমাকে যে দেখে সেই ভালো বলে।
তুই ঠিক উল্টো কথা বললি। মেয়েরা বড় হলে ভালো দেখায়। ছেলেরা না।
আমি ঠিকই বলেছি। আমি বড় হয়েছি কিন্তু আমি যেরকম ছিলাম, সেই রকমই আছি। একটুও বদলাইনি।
অনেক বদলে গেছিস।
কি বদলেছি?
খোকন হেসে বলল, সে কথা আমি বলতে পারব না।
কেন?
কেন আবার? বলতে নেই।
সোনালী আর প্রশ্ন করে না। চুপ করে থাকে। ভাবে।
খোকনদা, আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।
ঘুমো।
সনালী খোকনের হাত দুটো চেপে ধরেছিল। আস্তে আস্তে ওর হাত দুটো আলগা হয়ে গেল। সোনালী ঘুমিয়ে পড়ল।
হঠাৎ সোনালীর ঘুম ভেঙে গেল। খোকন তখনও ওইভাবে পাশে বসে আছে!
কটা বাজে খোকনদা?
আবছা আলোয় খোকন হাতের ঘড়িটা ভালো করে দেখে বলল, সোয়া চারটে।
এ রাম! তোমাকে সারারাত জাগিয়ে রাখলাম। তুমি এখানেই শুয়ে পড়ো। আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।
আমি আমার বিছানায় যাই।
এখানেও শোও। চিরকাল তো এক বিছানায় শুয়ে মারামারি করেছি। এখন এত লজ্জা কেন?
খোকন শুয়ে পড়ল কিন্তু এতকাল পরে সোনালীর পাশে শুয়েই ওর সারা শরীরের মধ্যে দিয়ে একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে গেল।