৪. মিদ্রাশ
জেরুজালেম অবরোধের শেষদিকে, কথিত আছে, তোরণ পাহারায় থাকা উগ্র ইহুদিদের চোখে ধুলো দিতে ফারিজিদের নেতা র্যাবাই ইয়োহানান বেন যাক্কাইকে কফিনে করে শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। গোটা যুদ্ধের সময় তিনি নাকি যুক্তি দেখিয়েছিলেন, রোমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ কেবল অর্থহীনই নয়, বরং আত্মবিধ্বংসীও; এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার চেয়ে ধর্মের সংরক্ষণ ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শহরের বাইরে আসার পর রোমান শিবিরে চলে যান তিনি। সেখানে ভেস্পায়ানকে জেরুজালেমের দক্ষিণের উপকূলীয় শহর ইয়াভনেহকে ইহুদি পণ্ডিতদের নিরাপদ আশ্রয় হিসাবে রেয়াত দেওয়ার অনুরোধ জানান। জেরুজালেম ও এর মন্দির ধ্বংসের পর ফারিজি, লিপিকার ও পুরোহিতগণ ইয়াভনেহতে মিলিত হতে শুরু করেন, ষাট বছর যাবৎ এই শহরটি উল্লেখযোগ্য ধর্মীয় সংশ্লেষের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। ইয়োহানানের নাটকীয় পলায়নের কাহিনীর সুস্পষ্ট সন্দেহজনক উপাদান রয়েছে, কিন্তু অভিশপ্ত শহরের বাইরে কফিন থেকে র্যাবাইয়ের বের হয়ে আসার শক্তিশালী ইমেজ ছিল ভবিষ্যদ্বাণীসুলভ, কেননা ইয়াভনেহ পুরোনো ইহুদিবাদের ধ্বংসস্তূপ থেকে নতুন রূপের পুনরুজ্জীবনের নিশ্চয়তা দিয়েছিল
আমরা ইয়াভনেহ যুগ সম্পর্কে অবশ্য তেমন কিছু জানি না। পণ্ডিতদের কোয়ালিশনের নেতৃত্বে ছিল ফারিজিরা, গোড়ার দিকে আর. ইয়োহানান ও তাঁর দুজন মেধাবী শিষ্য আর. এলিয়েযার ও আর. জোশুয়া এবং পরে আর. আকিবা নেতৃত্ব দিয়েছেন। ৭০-এর করুণ পরিণতির অল্পদিনের ভেতরই ফারিজিরা সাধারণ মানুষকে এমনভাবে জীবন যাপনে উৎসাহিত করে তুলেছিল যেন তারা মন্দিরের সেবা করছে, যেন প্রতিটি অগ্নিকুণ্ড বেদীতে এবং গৃহকর্তা পুরোহিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু তারপরেও ফারিজিরা সত্যিকারের মন্দিরেও উপাসনা অব্যাহত রেখেছিল, চিন্তাও করেনি যে কোনও একদিন ইহুদিদের এটা ছাড়াই চলতে হবে। এমনকি ইয়াভনেহতে থাকার বছরগুলোতেও তাঁরা যেন বিশ্বাস করছিল, ইহুদিরা একটা নতুন মন্দির নির্মাণে সক্ষম হবে, কিন্তু তাদের আদর্শ ৭০ পরবর্তী বিশ্বে বেশ মানানসই ছিল, কারণ তারা, বলা হয়ে থাকে, একটা কাল্পনিক মন্দির ঘিরে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নির্মাণ করেছিল, যা কিনা তাদের আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। এখন আর. ইয়োহানান এবং তাঁর উত্তরাধিকারীগণ এই কাল্পনিক মন্দিরকে আরও বিস্তারিত রূপে নির্মাণ শুরু করবেন।
ইয়াভনেহর র্যাবাইদের প্রথম কাজ ছিল প্রথাগত ধর্মের যা কিছু স্মৃতি, আচার ও অনুশীলন খুঁজে পাওয়া যায় তাকে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা, যাতে মন্দির পুনর্নির্মিত হলে নতুন করে কাল্ট শুরু করা যায়। অন্য ইহুদিরা রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে নতুন বিদ্রোহের পরিকল্পনা করে থাকতে পারে; ক্রিশ্চানরা জোরের সাথে বলতে পারে, জেসাস মন্দিরকে প্রতিস্থাপন করেছেন; কিন্তু ইয়াভনেহতে তাদের সাথে যোগদানকারী লিপিকার ও পুরোহিতদের সাথে নিয়ে ফারিজিরা তাদের মনে হারিয়ে যাওয়া মন্দিরের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয় তুলে রাখার এক নায়োকোচিত প্রয়াস পাবে; একই সময়ে তাদের ব্যাপকভাবে বদলে যাওয়া বিশ্বের চাহিদা মেটাতে তোরাহর পরিমার্জনা করার সময় ফারিজিদের নতুন ইহুদিবাদের অবিসম্বাদিত নেতায় পরিণত হতে অনেক বছর লেগে যাবে। কিন্তু ৮০-র দশকের শেষের দিকে ও ৯০-র দশকে, আমরা যেমন দেখেছি, ক্রিশ্চানদের কেউ কেউ ইয়াভনেহর কারণে নিজেদের মারাত্মকভাবে হুমকীর মুখে মনে করেছে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক ইহুদির কাছে গস্পেলের চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয় ও সত্যি মনে হচ্ছিল। তারপরেও সত্যি বলতে ফারিজি উদ্যোগের সাথে আদি ক্রিশ্চান চার্চসমূহের অনেক ক্ষেত্রেই মিল ছিল। ফারিজিরাও ঐশীগ্রন্থে তল্লাশি করে আরেক ধরনের ব্যাখ্যা উদ্ভাবন করবে ও নতুন পবিত্র টেক্সট রচনা করবে-যদিও তারা কখনওই এগুলো ‘নিউ টেস্টামেন্ট’ গঠন করেছে বলে দাবি করবে না।
দুই বা তিনজন ফারিজি সমবেতভাবে তোরাহ পাঠ করার সময়- ক্রিশ্চানদের মতো-আবিষ্কার করেছিল যে শেখিনাহ তাদের মাঝে অবস্থান করছেন। ইয়াভনেহতে ফারিজিরা এমন এক আধ্যাত্মিকতার গোড়াপত্তন করেছিল যেখানে তোরাহ গবেষণা ঐশী সত্তার অস্তিত্ব অনুভব করার ক্ষেত্রে প্রধান উপায় হিসাবে মন্দিরকে প্রতিস্থাপিত করেছিল। কিন্তু আধুনিক বাইবেলিয় পণ্ডিতদের বিপরীতে তারা কোনও নির্দিষ্ট ঐশীগ্রন্থীয় অনুচ্ছেদের মূল তাৎপর্যের অনুসন্ধান করত না। দানিয়েলের মতো তারা নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সন্ধান করছিল। তাদের দৃষ্টিতে ঐশীগ্রন্থের কোনও একক কর্তৃত্বমূলক পাঠ নেই। পৃথিবীর বুকে বিভিন্ন ঘটনা উন্মোচিত হওয়ার সময় এমনকি ঈশ্বরকেও এর পূর্ণ তাৎপর্য আবিষ্কার করার জন্যে তাঁর নিজের তোরাহ নিয়ে গবেষণায় লেগে থাকতে হয়।’ র্যাবাইগণ তাদের ব্যাখ্যাকে বলতেন মিদ্রাশ, যা, আমরা দ্বিতীয় অধ্যায়ে যেমন দেখেছি, ক্রিয়া পদ দারাশ থেকে উদ্ভুত: অনুসন্ধান করা; খোঁজ করা। টেক্সটের অর্থ প্রকাশিত নয়। ব্যাখ্যাকারকে এর খোঁজে অগ্রসর হতে হতো, কারণ প্রতিবার একজন ইহুদি ঐশীগ্রন্থে ঈশ্বরের বাণীর মোকাবিলা করার সময় ভিন্ন কিছু তুলে ধরে তা। ঐশীগ্রন্থ অক্ষয়। র্যাবাইগণ এটা বলতে পছন্দ করতেন যে, রাজা সলোমন তোরাহর প্রতিটি শব্দ ব্যাখ্যা করতে হাজারখানেক উপকথা ব্যবহার করেছেন-যার মানে ঐশীগ্রন্থের প্রতিটি অংশের তিন মিলিয়ন পনের হাজার সম্ভাব্য তর্জমা থাকতে পারে। প্রকৃতপক্ষেই কোনও টেক্সটকে সময়ের প্রয়োজনে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে পুনর্ব্যাখ্যা করা না গেলে তা মৃত: ঐশীগ্রন্থের লিখিত বাণীকে অব্যাহত ব্যাখ্যার ভেতর দিয়ে পুনরুজ্জীবীত করে তোলার প্রয়োজন ছিল। কেবল তখনই সেগুলো তোরাহয় সুপ্ত ঈশ্বরের ঐশী সত্তাকে তুলে ধরতে পারে। মিদ্রাশ সম্পূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধান ছিল না, এবং গবেষণাও কখনও শেষ কথা ছিল না, এর ভেতর দিয়ে জগতে বাস্তব কর্মকাণ্ড অনুপ্রাণিত হওয়ার প্রয়োজন ছিল। ব্যাখ্যাকারদের বিশেষ পরিস্থিতিতে তোরাহকে প্রয়োগ করে সম্প্রদায়ের প্রতিটি সদস্যের অবস্থার সাথে খাপ খাওয়ানোর একটা দায়িত্ব ছিল। কোনও একটা অস্পষ্ট অনুচ্ছেদকে কেবল স্পষ্ট করে তোলাই লক্ষ্য ছিল না, বরং কালের জ্বলন্ত ইস্যুগুলোর সমাধান যোগাতে হতো। বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগের একটা উপায় না পাওয়া পর্যন্ত আপনি টেক্সট বুঝতে পারেননি।o র্যাবাইগণ ঐশীগ্রন্থকে বলতেন মিকরা: ইহুদি জনগণকে কর্মে আহবান জানানো সমন।
সবার উপরে মিদ্রাশকে অবশ্যই সহানুভূতির নীতিতে পরিচালিত হতে হবে। প্রথম শতাব্দীর গোড়ার দিকের বছরগুলোয় মহান ফারিজি সাধক হিল্লেল বাবিলোনিয়া থেকে জেরুজালেমে এসেছিলেন, সেখানে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী শাম্মাইয়ের সাথে প্রচারণা চালাতেন, ফারিজি মতবাদের তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি অনেক কঠোর ছিল। বলা হয়ে থাকে, একদিন এক প্যাগান হিল্লেলের কাছে এসে সে এক পায়ে দাঁড়ানো অবস্থায় গোটা তোরাহ মুখস্থ করতে পারলে ইহুদিবাদে দীক্ষা(নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। হিল্লেল জবাব দেন: ‘তোমার নিজের কাছে যা ঘৃণিত সেটা অন্যের সাথে করো না। এটাই গোটা তোরাহ, বাকিটা স্রেফ ধারাভাষ্যমাত্র। যাও, পড়ে দেখ।” এটা বিস্ময়কর ও পরিকল্পিতভাবে বিতর্কিত মিদ্রাশ। তোরাহর মুল সুর অন্য মানুষের প্রতি যন্ত্রণা সৃষ্টি করার সুশৃঙ্খল প্রত্যাখ্যান। ঐশীগ্রন্থের বাকি সমস্ত কিছুই স্রেফ ‘ধারাভাষ্য,’ স্বর্ণবিধির উপর ব্যাখ্যা। ব্যাখ্যার শেষে হিল্লেল মিকরা: কর্মের আহ্বান রেখেছেন: ‘যাও, পড়ে দেখ!’ তোরাহ পাঠ করার সময় র্যাবাইদের ঐশীগ্রন্থের সব বিধি-বিধান ও বিবরণের মূলে অবস্থিত সহানুভূতির অস্তিত্বকে তুলে ধরার প্রয়াস পেতে হবে–তাতে টেক্সটের মুল অর্থ ঘোরাতে হলেও। ইয়াভনেহর র্যাবাইগণ হিল্লেলের অনুসারী ছিলেন, শেষ ইয়াভনেহ যুগের নেতৃস্থানীয় সাধু আর. আকিবা ঘোষণা করেছিলেন যে, তোরাহর শ্রেষ্ঠ নীতি রয়েছে লেভিটিকাসের নির্দেশনায়: ‘প্রতিবেশীকে নিজের মতো ভালোবাসিবে।’৬ মাত্র একজন র্যাবাই এর বিরোধিতা করেছিলেন, তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, সাধারণ কথা ‘আদমের বংশাবলি পত্র এই’ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তা গোটা মানবজাতির ঐক্য প্রকাশ করে।
আর. ইয়োহানান হিল্লেলের শিষ্যদের কাছে শিক্ষা লাভ করেছিলেন, ৭০- এর বিপর্যয়ের অব্যবহিত পর তিনি এই অন্তর্দৃষ্টি মন্দির পরবর্তী বিশ্বে প্রয়োগ করেন। একদিন আর. জোশুয়াকে সাথে নিয়ে ভস্মীভূত মন্দির অতিক্রম করে যাচ্ছিলেন তিনি। আর. জোশুয়া কেঁদে উঠে বললেন, ইহুদিরা এখন মন্দিরে উৎসর্গের আচার পালন করতে না পারায় কেমন করে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবে? আর. ইয়োহানান তাঁকে ঈশ্বর হোসিয়াকে যা বলেছিলেন সেকথা বলেই সান্ত্বনা দিলেন: ‘শোক করো না, আমাদের মন্দিরের সমান প্রায়শ্চিত্ত আছে, যেমন বলা হয়েছে: “কারণ আমি দয়াই (হেসেদ) চাই, বলিদান নয়।”““ সমবেদনার কাজ পুরোহিতসুলভ যা প্রাচীন প্রায়শ্চিত্তের আচারের চেয়ে বেশি কার্যকরভাবে পাপ মোচন করতে পারে এবং ভিন্ন পুরোহিত শ্রেণীর আয়ত্তের বিষয় হওয়ার বদলে সাধারণ জনগণই এর চর্চা করতে পারে। কিন্তু আর. ইয়োহানানের ব্যাখ্যা সম্ভবত হোসিয়াকেও বিস্মিত করত। নিবিড়ভাবে মূল টেক্সটের দিকে নজর দিলে র্যাবাই হয়তো বুঝতে পারতেন যে, ঈশ্বর হোসিয়াকে বদান্যতার কাজের কথা বলছিলেন না। হেসেদ-এর সঠিক অনুবাদ হওয়া উচিত ছিল ‘আনুগত্য’, ‘দয়া’ নয়। ঈশ্বর মানুষের প্রতি মানুষের যে ভালোবাসা প্রকাশ করা উচিত তা নিয়ে ভাবিত ছিলেন না, তিনি চেয়েছেন ইসরায়েলের তাঁকে প্রদেয় কাল্ট আনুগত্য
কিন্তু এটা আর. জোশুয়াকে বিব্রত করতে পারত না, কারণ তিনি ঐতিহাসিক ব্যাখ্যার সন্ধান করছিলেন না, বরং নিজের আচ্ছন্ন সম্প্রদায়কে সান্ত্বনা দেওয়ার প্রয়াস পাচ্ছিলেন। মন্দিরের জন্যে লোক দেখিয়ে কান্নার কোনও প্রয়োজন নেই, বাস্তব দানশীলতা প্রাচীন উৎসবের আচারের জায়গা নিতে পারবে। তিনি হোরোয–একটা শৃঙ্খল তৈরি করছিলেন যা আদিতে সম্পর্কহীন তবে একবারে ‘শৃঙ্খলিত’ করলে তাদের অন্তস্থ ঐক্য প্রকাশকারী বিভিন্ন উদ্ধৃতিকে একসূত্রে গ্রন্থিত করছিল।” তৃতীয় বিসিই শতাব্দীর একজন খুবই সম্মানিত পুরোহিত সাইমন দ্য জাস্টের একটা বহুল পরিচিত প্রবাদ দিয়ে শুরু করেছেন তিনি।১০ ‘তিনটি জিনিসের উপর পৃথিবী টিকে আছে: তোরাহ, মন্দিরের আচার এবং প্রেমময় কর্মের সম্পাদন।১১ হোসিয়ার উদ্ধৃতির মতো এটা প্রমাণ করে যে, বাস্তব সহানুভূতি তোরাহ ও মন্দিরের উপাসনার মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। প্রেমময় দয়া, যেমন বলা হয়েছে, গোটা পৃথিবীকে ধরে রাখা ত্রি-পায়ার একটা আবিশ্যিক পায়া, এখন মন্দির না থাকায়, তোরাহ ও দয়া আগের চেয়ে ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই দর্শনের পক্ষে সমর্থনের জন্যে আর. ইয়োহানান উদ্ধৃতি দিয়েছেন-বা খানিকটা ভুলভাবে উদ্ধৃতি দিয়েছেন-সামিস্টকে, ‘জগৎ নির্মিত হয়েছে ভালোবাসা দিয়ে।’১২ এই তিনটি সম্পর্কহীন টেক্সটকে পাশাপাশি বসাতে গিয়ে আর. ইয়োহানান হিল্লেলের দাবির মতোই দেখিয়েছেন যে, দয়া সত্যিই ঐশীগ্রন্থের কেন্দ্রিয় বিষয়: ব্যাখ্যাকারের দায়িত্ব হচ্ছে গোপন নীতির উপর আলোকপাত করে একে প্রকাশ্যে নিয়ে আসা।
রাব্বিনিক মিদ্রাশের পক্ষে হোরোয গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ব্যাখ্যাকারীদের তা সামগ্রিকতা ও সম্পূর্ণতার অনুভূতি যোগাত: শালোমের অনুরূপ ছিল সেটা, ইহুদিরা যা মন্দিরে আবিষ্কার করত ও ক্রিশ্চানরা পেশার ব্যাখ্যায় যে কোইনসিদেনিয়া অপোজিতোরামের অনুভূতি লাভ করত তার অনুরূপ। ক্রিশ্চানদের মতো র্যাবাইগণ আইন ও প্রফেটস ভিন্নভাবে পাঠ করছিলেন, সেগুলোকে এমন অর্থ দিচ্ছিলেন যার সাথে মূল লেখকদের মনোভাবের সামান্যই সম্পর্ক ছিল। আর. আকিবা এই উদ্ভাবনীমূলক মিদ্রাশের সম্পূর্ণতা দান করেন। আকিবার মেধার খ্যাতি স্বর্গে মোজেসের কাছেও পৌঁছে গিয়েছিল। শিষ্যগণ তাঁর সম্পর্কে একটা গল্প বলতে পছন্দ করতেন। একদিন শিক্ষাকক্ষে যোগ দিতে আকাশ থেকে নেমে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। অন্য ছাত্রদের পেছনে অষ্টম সারিতে বসলেন। হতাশার সাথে আবিষ্কার করলেন আর. আকিবার ব্যাখ্যা তাঁর কাছে দুর্বোধ্য ঠেকছে, যদিও একে সিনাই পর্বত চূড়ায় তাঁর প্রাপ্ত প্রত্যাদেশের অংশ হিসাবে উল্লেখ করা হচ্ছিল। “আমার সন্তানরা আমাকে ছাড়িয়ে গেছে,’ স্বর্গে ফিরে যাবার সময় দুঃখের সাথে ভাবলেন মোজেস, গর্বও বোধ করলেন। কিন্তু কেন, জানতে চাইলেন তিনি, ঈশ্বর তাঁকে তোরাহর দায়িত্ব দিয়েছিলেন, যেখানে আকিবার বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যায়ের একজন মানুষকে বেছে নিতে পারতেন?” আরেকজন র্যাবাই আরও অল্প কথায় বর্ণনা করেছেন: ‘মোজেসের কাছে প্রকাশ করা হয়নি যেসব বিষয় সেগুলো আর, আকিবা ও তাঁর সহযোগীদের কাছে প্রকাশ করা হয়েছে।’ প্রত্যাদেশ কেবল সিনাই পর্বত চূড়ায় প্রথম ও শেষবারের মতো ঘটেনি, এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া এবং যতদিন দক্ষ ব্যাখ্যাকারগণ টেক্সটে সুপ্ত অসীম প্রজ্ঞার সন্ধান করে যাবেন ততদিন অব্যাহত থাকবে। ঐশীগ্রন্থ ভ্রূণাবস্থায় মানুষের সকল জ্ঞানের সমগ্র ধারণ করে: এখানে ‘সমস্ত কিছু’ আবিষ্কার করা সম্ভব।’১৫ সিনাই ছিল স্রেফ সূচনামাত্র। প্রকৃতপক্ষে মোজেসকে তোরাহ দেওয়ার সময় ঈশ্বর জানতেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মসমূহকে একে শেষ করতে হবে। লিখিত তোরাহ সম্পূর্ণ বিষয় ছিল না; একে সম্পূর্ণ করে তুলতে মানবজাতির মেধা প্রয়োগের কথা ছিল, যাতে একে পূর্ণ করা যায়, ঠিক যেভাবে লোকে গম থেকে ময়দা বের করে ও সুতো দিয়ে কাপড় তৈরি করে।১৬
র্যাবাইদের কেউ কেউ ভেবেছিলেন, আর. আকিবা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন। সহকর্মী আর. ইশমায়েল তাঁর বিরুদ্ধে ঐশীগ্রন্থে নিজের অর্থ আরোপ করার অভিযোগ তোলেন: ‘সত্যিই আপনি টেক্সটে “আমি ব্যাখ্যা না দেওয়া পর্যন্ত নীরব থাকো,” বলেন।১৭ একটা ভালো মিদ্রাশ মূল অর্থের যতদূর সম্ভব কাছাকাছি থাকে। আর. ইশমায়েল যুক্তি দেখিয়েছেন যে কেবল জরুরি প্রয়োজনেই একে পরিবর্তন করা উচিত।’১৮ আর. ইশমায়েলের পদ্ধতিকে সমীহ করা হয়েছে, কিন্তু আর. আকিবার পদ্ধতিই আগে বেড়েছে, কারণ ঐশীগ্রন্থকে তা উন্মুক্ত রেখেছে। আধুনিক পণ্ডিতের কাছে এই পদ্ধতি অনধিকার চর্চা মনে হয়: মিদ্রাশ সব সময়ই অনেক দূর আগে বেড়েছে, যেন টেক্সটের সামগ্রিকতা লঙ্ঘন করতে চেয়েছে এবং মূল অর্থকে বিসর্জন দিয়ে অর্থের সন্ধান করেছে।১৯ কিন্তু র্যাবাইদের বিশ্বাস ছিল ঐশীগ্রন্থ যেহেতু ঈশ্বরের বাণী তাই তা অন্তহীন। যেকোনও অর্থ নতুন অন্তর্দৃষ্টি বয়ে আনে ও সম্প্রদায়ের পক্ষে লাভজনক প্রমাণিত হয়, তবে তা ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই হয়ে থাকে।
তোরাহ ব্যাখ্যা করার সময় র্যাবাইগণ নিয়মিতভাবে শব্দ পরিবর্তন করতেন, ছাত্রদের বলতেন, ‘এটা পড়ো না…ওটা পড়ো। এভাবে টেক্সটের পরিবর্তন ঘটিয়ে অনেক সময় ঐশীগ্রন্থের মূলে অনুপস্থিত ছিল এমন সমবেদনার সুর সংযোজন করতেন তাঁরা। আর. আকিবার অন্যতম বিখ্যাত শিষ্য আর. মেয়ার ডিউটেরোনমির উপর একটা সিদ্ধান্ত দেওয়ার সময় এমনটা ঘটেছিল:
যদি কোন মনুষ্য প্রাণদণ্ডের যোগ্য পাপ করে, আর তাহার প্রাণদণ্ড হয়, এবং তুমি তাহাকে গাছে টাঙ্গাইয়া দেও, তবে তাহার শব রাত্রিতে গাছের উপরে থাকিতে দিবে না, কিন্তু নিশ্চয়ই সেইদিনই কবর দিবে; যে ব্যক্তিকে টাঙ্গান যায়, সে ঈশ্বরের শাপগ্রস্ত [কিলেলাত এলোহিম]; তোমার ঈশ্বর ইয়াহওয়েহ অধিকারার্থে যে ভূমি তোমাকে দিতেছেন, তুমি তোমার সেই ভূমি অশুচি করিবে না।২১
এই আইনে নিজ স্বার্থ ছিল, কারণ ইসরায়েলিরা ভুমি অশুচি করলে তাদের তা হারাতে হবে। কিন্তু আর. মেয়ার অনুপ্রাসের সাথে এক নতুন পাঠের পরামর্শ দিয়েছেন: ‘কিলেলাত এলোহিম পড়ো না,’ বলেছেন তিনি, ‘পড়বে কাল্লাত এলোহিম (‘ঈশ্বরের বেদনা’)।’ আর. মেয়ার ব্যাখ্যা করেছেন, নতুন টেক্সট সৃষ্টির সাথে কষ্ট সওয়া ঈশ্বরের করুণা প্রকাশ করেছে: ‘মানুষ যখন ভীষণ বিপদে পড়ে, তখন শেখিনাহ কী বলে? বলে, যেমন বলা হয়ে থাকে, ‘আমার মাথা ব্যথা করছে, আমার বাহু ব্যথা করছে।২২ তোরাহর সবচেয়ে অসম্ভব অংশেও প্রেম ও স্বর্ণবিধির সন্ধান মিলতে পারে। একজন আধুনিক পণ্ডিত যেমন মন্তব্য করেছেন: “মিদ্রাশিয় মাকু কঠিন আইনি সিদ্ধান্ত ঘিরে সমবেদনার বস্ত্র বুনেছে’; কারণ শিষ্যদের টেক্সট পরিবর্তনের আহবান জানিয়েছেন র্যাবাই, তারাও অন্তহীন নবতর্জমার সক্রিয় প্রক্রিয়ায় সম্পর্কিত হয়ে গেছেন।২৩ আর. জুদাহ’র যাকারিয়ার উদ্দেশে দেওয়া ঈশ্বরের বাণীর ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে: ‘তোমাকে [অর্থাৎ ইসরায়েল] যে-ই আঘাত দিক সে নিজের (আইনো) চোখে আঘাতকারীর মতোই কেউ।’ ‘আইনো (‘তার’) পড়ো না, পড়বে আইনি (‘আমার’) চোখ,’ সতীর্থদের নির্দেশ দিয়েছেন আর. জুদাহ; টেক্সট এখন দাবি করছে যে, প্রেমময় একজন ঈশ্বর তাঁর আপন জাতির বেদনায় অংশ নেন। ইসরায়েলকে আঘাতকারী যে কেউ আমার [আইনি] চোখে আঘাতকারীর মতো। ‘২৪
ঐশীগ্রন্থের কোনও স্থির ব্যাখ্যা থাকতে পারে না। অনেক আগে আর এলেইযার যখন সহকর্মীদের সাথে তোরাহর একটা আইনি সিদ্ধান্তের (হালাখাহ) ব্যাপারে দুর্বোধ্য বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন তখনই ইয়াভনেহতে এই যুক্তিটি স্পষ্ট করে তোলা হয়েছিল। সহকর্মীরা তাঁর যুক্তি মেনে নিতে অস্বীকার করলে আর. এলেইযার ঈশ্বরের কাছে অলৌকিক ঘটনার মাধ্যমে তাঁকে সমর্থন জানানোর আবেদন রাখেন; এবং-মিরাবাইল দিও–একটা কারোব গাছ আপনাআপনি চারশো কিউবিট দূরে সরে গেল, খাড়ির পানি উজানে বয়ে যেতে লাগল ও পাঠাগারের দেয়াল এত জোরে কাঁপতে শুরু করল মনে হলো বুঝি ধসে পড়বে। কিন্তু অন্য র্যাবাইরা এই অতিপ্রাকৃত শক্তির প্রদর্শনীতে সন্তুষ্ট হলেন না। হতাশার সাথে আর. এলেইয়ার বাত কোল (‘স্বর্গীয় কণ্ঠস্বর’)-এর রায় শুনতে চাইলেন। এবং এক স্বর্গীয় কণ্ঠস্বর বাধ্যগতের মতো ঘোষণা করল: ‘আর. এলেইযারের বিরুদ্ধে তোমাদের কী বলার আছে? হালাখাহ সব সময়ই তার মতানুযায়ীই ছিল।’ কিন্তু র্যাবাই জোশুয়া ডিউটেরোনমি থেকে একটা পঙক্তি আবৃত্তি করলেন: “তাহা স্বর্গে নহে। সিনাই পর্বতে উচ্চারিত হওয়ার পর তোরাহ এখন আর মহাজাগতিক বিশ্বে নেই, এখন আর ঈশ্বরের কাছে নয়, বরং অবিচ্ছেদ্যভাবে প্রতিটি ইহুদির আওতাধীন। তো, পরবর্তীকালের এক র্যাবাই নির্দেশ দিয়েছেন, ‘আমরা স্বর্গীয় কোনও কণ্ঠস্বরে আমল দিই না।’ তাছাড়াও, সিনাই পাহাড়ে এটা ঘোষণা করা হয়েছিল: ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের মত অনুযায়ী তোমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তো একজনের সংখ্যালঘু জনপ্রিয় ভোট অস্বীকার করতে পারেননি। ঈশ্বর যখন জানতে পারলেন যে তাঁর মত নাকচ করে দেওয়া হয়েছে, তিনি হেসে বললেন, ‘আমার সন্তানগণ আমাকে জয় করিয়া লইয়াছে। ২৭
মিদ্রাশের যেকোনও সীমাবদ্ধতা ব্যাখ্যাকারের দুর্বলতার জন্যেই হয়ে থাকবে, যার কোনও নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে টেক্সটের ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা ছিল না বা নতুন অর্থ খুঁজে বের করতে পারেননি।২৮ স্বর্ণবিধি এও বুঝিয়েছে যে, ঘৃণার বিস্তার ঘটায় এমন কোনও মিদ্রাশ বেআইনি। অন্য সাধুদের অপদস্থ করার উদ্দেশ্যে তাদের প্রতি ঘৃণা ছড়ানো সংকীর্ণ ব্যাখ্যা অবশ্যই এড়িয়ে যেতে হবে।২৯ মিদ্রাশের লক্ষ্য সম্প্রদায়ের সেবা করা, ব্যাখ্যাকারদের অহমকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলা নয়, যাদের উচিত হবে, আর. মেয়ার ব্যাখ্যা করেছেন, ‘তোরাহর খাতিরেই’ তোরাহ পাঠ করা, নিজের লাভের জন্যে নয়। ভালো মিদ্রাশ, বলেছেন র্যাবাই, মতানৈক্যের চেয়ে সুসম্পর্ক দেখায়, কারণ সঠিকভাবে ঐশীগ্রন্থ পাঠকারী যে কেউ ভালোবাসায় পরিপূর্ণ এবং সে অন্যদের জন্যে আনন্দ বয়ে আনে: সে ‘স্বর্গীয় সত্তা ও সকল সৃষ্টিকে ভালোবাসে, স্বৰ্গীয় সত্তাকে খুশি করে, খুশি করে সকল সৃষ্টিকে।’ তোরাহ পাঠ ব্যাখ্যাকারকে বদলে দেয়, তাকে বিনয় ও ভয়ে আচ্ছন্ন করে, ঋজু, ধার্মিক, ন্যায়নিষ্ঠ ও বিশ্বাসী করে তোলে, ফলে তার চারপাশের প্রত্যেকে লাভবান হয়। ‘তোরাহর রহস্য তার মাঝে প্রকাশিত হয়,’ উপসংহারে বলেছেন আর. মেয়ার। ‘সে তখন উপচে পড়া ফোয়ারা ও অন্তহীন প্রবাহে পরিণত হয়…তাকে তা মহান করে তোলে ও গোটা সৃষ্টির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে দেয়।
‘আমার বাক্য কি অগ্নির তুল্য নয়?’ জেরেমিয়াহকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ইয়াহওয়েহ।১ মিদ্রাশ তোরাহর লিখিত বাণীতে সুপ্ত স্বর্গীয় স্ফুলিঙ্গকে মুক্ত করেছে। একদিন আর. আকিবা শুনতে পেলেন, তাঁর শিষ্য বেন আযযাই তোরাহ ব্যাখ্যা করার সময় চারপাশে জ্বলে ওঠা আগুনের মেঘে আবৃত হয়ে গেছেন। অনুসন্ধান করতে দ্রুত ছুটে গেলেন তিনি। বেন আযযাই তখন জানালেন যে, স্রেফ হোরোয চর্চা করছিলেন তিনিঃ
আমি কেবল তোরাহর এক শব্দ অন্য শব্দের সাথে, তারপর পয়গম্বরদের বাণীর সাথে, এরপর পয়গম্বরের বাণীর সাথে লিপি জুড়ে দিচ্ছিলাম, আর সব শব্দ ঠিক সিনাইতে অবতীর্ণ করার সময়ের মতোই এক হয়ে গেছে, তা ছিল মিষ্টি, তাদের মুল রূপে।৩২
যখনই কোনও ইহুদি টেক্সটের মুখোমুখি হয়, সিনাই প্রত্যাদেশ নবায়িত হয়, নিজেকে সে তার কাছে উন্মুক্ত করে, আপন পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করে। ইযেকিয়েলের মতো মিদ্রাশিস্ট আবিষ্কার করে, সে যখন একে আত্মস্থ করে এবং তাকে অনন্যভাবে আপন করে নেয়, ঈশ্বরের বাণী মধুর মতো মিষ্টি লাগে, সারা বিশ্বে আগুন ধরিয়ে দেয়।
বেশ কয়েক জন আদি র্যাবাইয়ের মতো বেন আযযাইও অতীন্দ্রিয়বাদী ছিলেন। তাঁরা অনুশীলনের সময় ঈশ্বরের ‘প্রতাপ’ (কাসোদ) সম্পর্কিত তাঁর দিব্যদৃষ্টি নিয়ে ধ্যান করতে পছন্দ করতেন–উপবাস, দুই হাঁটুর মাঝখানে মাথা রেখে ঈশ্বরের নাম জপা ও ফিসফিস করে ঈশ্বরের প্রশংসা বাক্য উচ্চারণ-এসব তাদের এক পরিবর্তিত মানসিক অবস্থায় স্থাপন করত। তখন মনে হতো যেন তাঁরা সাত আসমান ফুঁড়ে উড়ে চলেছেন-স্বর্গীয় সিংহাসনে ‘প্রতাপে’র দেখা না পাওয়া পর্যন্ত। কিন্তু অতীন্দ্রিয়বাদী এই সফর ছিল নানা বিপদে পরিপূর্ণ। বেশ গোড়ার দিকের এক কাহিনী আমাদের বলছে চারজন সাধু কীভাবে–ইডেনের স্বর্গীয় উদ্যানের অনুরূপ প্রতীকী ‘উদ্যান’ পারদিসে প্রবেশের প্রয়াস পেয়েছিলেন। বেন আযযাই মৃত্যুর আগেই এই আধ্যাত্মিক অবস্থায় পৌঁছতে পেরেছিলেন, কিন্তু অন্য অতীন্দ্রিয়বাদীদের দুজন এই অভিজ্ঞতার ফলে আধ্যাত্মিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। কেবল আর. আকিবারই অক্ষত বের হয়ে আসার মতো পরিপক্বতা ছিল, এই কাহিনী বর্ণনার জন্যে বেঁচেছিলেন তিনি।৩৩ আর. আকিবা স্বয়ং তাঁর এক্কলেসিয়ার পক্ষে সং অভ সংসকে বিশেষভাবে অনুকূল আবিষ্কার করেছিলেন; এটা মানুষের জন্যে ঈশ্বর যে ভালোবাসা অনুভব করেন তাকে কেবল তাৎপর্যমণ্ডিতই করে না বরং তাকে অতীন্দ্রিয়বাদীর অন্তরে জ্বলন্ত বাস্তবতায় পরিণত করে। ‘ইসরায়েলকে যেদিন সং অভ সংস দেওয়া হয়েছে সেই দিনটির সমান হতে পারে না গোটা মহাকাল,’ ঘোষণা দিয়েছেন আর. আকিবা। ‘সকল রচনা (কেসুভিম) পবিত্র। কিন্তু সং অভ সংস মহাপবিত্র। আর. আকিবার অন্তস্থ জগতে গীতিগুলো মন্দিরের অন্দরমহলকে প্রতিস্থাপিত করেছে, যেখানে প্রাচীন সিংহাসনে স্বৰ্গীয় সত্তা বিশ্রাম নিতেন।
অন্য র্যাবাইগণ ভেতরে বাইরে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো ইয়াহওয়েহর আত্মার বোধ লাভ করেছেন। একবার আর. ইয়োহানান শিষ্যদের সাথে ইযেকিয়েলের দিব্যদর্শন নিয়ে আলোচনার সময় স্বর্গ থেকে আগুন নেমে আসে, তারপর এক বাত কোল ঘোষণা করে যে, ঈশ্বরের নিকট থেকে তাঁর জন্যে বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু আগুন রূপে পবিত্র আত্মা আর. ইয়োহানান ও আর. এলেইযারের উপরও অবতরণ করেছিলেন-ঠিক যেভাবে পেন্টাকস্টে জেসাসের শিষ্যদের উপর অবতীর্ণ হয়েছিলেন–তারা তখন হোরোযে মগ্ন ছিলেন, ঐশীগ্রন্থের পঙক্তিসমূহকে একসূত্রে গাঁথছিলেন।
এই পর্যায়ে র্যাবাইগণ তখনও তাদের দর্শনকে লিখিত রূপ দেননি। মনে হয় সংগৃহীত বিভিন্ন ট্র্যাডিশন অন্তর দিয়ে মুখস্থ করে মৌখিকভাবে প্রচার করছিলেন তাঁরা, যদিও আর. আকিবা ও আর. মেয়ার বিভিন্ন উপাদানকে গুচ্ছে পরিণত করেছিলেন যার ফলে তা মনে রাখা সহজ হয়েছিল।৩৭ অমূল্য লোককথা লিখে রাখাকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়েছে। বইকে মন্দিরের মতো পুড়িয়ে ফেলা যেতে পারে, বা ক্রিশ্চানের হাতে পড়তে পারে, সাধুদের মনেই তা নিরাপদ থাকবে। কিন্তু র্যাবাইগণ উচ্চারিত বাণীকে মূল্য দিতেন তার ভিত্তিতেই। মৌখিক টেক্সট আবৃত্তির সাহায্যে মুখস্থ করতে পেরেছিলেন যেসব ইয়াভনেহর স্নাতক, তাদেরকে বলা হতো তান্নাইম, ‘প্রতিবেদক’। এরা উচ্চকণ্ঠে তোরাহর কথা বলতেন ও কথোপকথনের ভেতর দিয়ে মিদ্রাশ নির্মাণ করতেন। প্রাণবন্ত আলোচনা ও শোরগোলময় বিতর্কে গমগম করত বিদ্যাপীঠ।
১৩৫ সাল নাগাদ র্যাবাইরা আরও স্থায়ী লিখিত রেকর্ড রখার প্রয়োজন মনে করলেন। ইহুদিদের আধুনিক গ্রেকো-রোমান বিশ্বে তুলে আনার প্রয়াসে সম্রাট হাদ্রিয়ান ঘোষণা করেছিলেন যে, তিনি জেরুজালেমের ধ্বংসাবশেষ মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে সেই পবিত্র স্থানে একটা আধুনিক শহর গড়ে তুলতে চান। আইন করে খত্না, র্যাবাইদের প্রশিক্ষণ ও তোরাহর শিক্ষা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। মাথা গরম ইহুদি সৈনিক সিমিয়ন বার কোসেবা রোমের বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন, তিনি জেরুজালেম থেকে দশম লিজিয়নকে বিতাড়িত করতে সফল হলে আর. আকিবা মেসায়াহ হিসাবে তাঁর তারিফ করেন। স্বয়ং আর. আকিবা শিক্ষা দান বন্ধ রাখতে অস্বীকার করেন; বলা হয়ে থাকে, রোমান কর্তৃপক্ষ তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ১৩৫ সালে হাদ্রিয়ান বার কোসেবার বিদ্রোহ নিষ্ঠুরভাবে দমন করেন। হাজার হাজার ইহুদি প্রাণ হারিয়েছিল, জুদাহয় অবস্থানে ইহুদিদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল, প্যালেস্তাইনের উত্তরে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল তাদের। ইয়াভনেহর একাডেমি ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়, রাব্বিনিক ক্যাডার ভেঙে যায়। তবে সম্রাট আন্তোনিয়াস পায়াসের (১৫৮-১৬১) অধীনে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে; তিনি ইহুদি বিরোধী বিভিন্ন কালাকানুন শিথিল করেন, র্যাবাইগণ নিম্ন গালিলির উশায় আবার সমবেত হন।
বার কোসেবার বিদ্রোহের বিপর্যয়কর পরিণতি র্যাবাইদের রীতিমতো সন্ত্রস্ত করে তুলেছিল। অতীন্দ্রিয়বাদী আর. সিমিওন বার ইয়োহী-এর মতো রেডিক্যালরা রোমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন, কিন্তু বেশিরভাগই নিজেদের রাজনীতি থেকে প্রত্যাহার করে নেন। র্যাবাইগণ এখন মেসিয়ানিজম সম্পর্কে সতর্ক হয়ে উঠেছিলেন, আত্মার বিপজ্জনক যাত্রার চেয়ে সুশৃঙ্খল পড়াশোনাকে বেছে নিয়ে অতীন্দ্রিয়বাদের অনুশীলন নিরুৎসাহিত করছিলেন তাঁরা। উশায় তাঁরা দ্বিতীয় মন্দির কালের বিভিন্ন রচনার (কেসুভিম)-এর মধ্য থেকে চূড়ান্ত বাছাইয়ের মাধ্যমে হিব্রু বাইবেলের অনুশাসন স্থির করেন। অধিকতর সুবোধ্য ঐতিহাসিক রচনা বাছাই করে প্রলয়বাদী কল্পকথা প্রত্যাখ্যান করেন, ক্রনিকলস, এস্থার, এযরা ও নেহেমিয়াহ নির্বাচিত করেন এবং প্রজ্ঞা প্রকৃতি থেকে প্রোভার্বস, সং অভ সংস এবং জব নেন, কিন্তু বেন সিরাহ নয়। বর্তমানে তোরাহ, নেভিন (প্রফেটস) ও কেসুভিম নিয়ে রচিত বাইবেল তা-নাখ (TaNaKh) নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
১৩৫ থেকে ১৬০ সাল পর্যন্ত সময়কালে র্যাবাইগণ সম্পূর্ণ নতুন একটা ঐশীগ্রন্থও সৃষ্টি করেছিলেন, একে তাঁরা বলতেন মিশনাহ, ইয়াভনেহতে র্যাবাইদের সংগৃহীত বিভিন্ন ট্র্যাডিশনের সংকলন; আর. আকিবা ও আর মেয়ারের প্রকল্প অনুযায়ী বিন্যস্ত করা হয়েছিল এগুলো। এসব লিখতে শুরু করেছিলেন তাঁরা।[৪০] অবশেষে র্যাবাইগণ স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে, আর কখনওই মন্দির নির্মিত হবে না, তো টাটকা উপাদানের বিশাল অংশ যোগ করেছিলেন তাঁরা, এগুলোর বেশিরভাগই কাল্ট ও বিভিন্ন উৎসবের সাথে সম্পর্কিত ছিল। হিব্রু পরিভাষা মিশনাহর মানে ‘পুনরাবৃত্তির ভেতর দিয়ে শিক্ষা,’ লিখিত রূপ নিলেও নতুন ঐশীগ্রন্থ তখনও মৌখিক বিষয় বিবেচিত হচ্ছিল। ছাত্ররা মুখস্থ করছিল তা। ২০০ সালের দিকে গোত্রপিতা আর. জুদাহ কর্তৃক মিশনাহ সম্পূর্ণ হয় এবং র্যাবাইদের নিউ টেস্টামেন্টে পরিণত হয় ক্রিশ্চানদের ঐশীগ্রন্থের মতো তানাখকে তা চিরকালের মতো বিদায় নেওয়া ইতিহাসের একটা পর্যায়ের বিবেচনা করে, তবে মন্দির পরবর্তী ইহুদিবাদকে বৈধতা দিতে কাজে লাগানো যেতে পারে তাকে। তবে মিলের শেষ এখানেই মিশনাহ স্রেফ কিছু আইনি বিধানের ভয়ঙ্কর সংকলন, ছয়টি সেদেরিমে (ধারা) বিন্যস্ত: যেরাইম (‘বীজ’), মোয়েদ (‘উৎসব’), নাশিম (‘নারী’), নিযিকিন (‘ক্ষতি’), ক্বাদেশিম (‘পবিত্র বস্তু’) ও তোহোরদ (‘পবিত্রতার বিধান’)। এগুলোকে আবার তেষট্টিটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
নিউ টেস্টামেন্টের বিপরীতে-হিব্রু ঐশীগ্রন্থের কথা উল্লেখের কোনও সুযোগই হাতছাড়া করেনি-মিশনাহ তানাখ থেকে অহঙ্কারের সাথে বিমুক্ত থেকেছে, বিরল ক্ষেত্রে বাইবেলে থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছে বা এর শিক্ষার কাছে আবেদন রেখেছে। মিশনাহ মোজেসের কাছ থেকে কর্তৃত্ব লাভ করার দাবি করেনি, কখনওই এর উৎস বা সত্যতা আলোচনায় যায়নি, কিন্তু মর্যাদার সাথে ধরে নিয়েছে যে এর কর্তৃত্ব প্রশ্নাতীত।৪১ তোরাহর মন্ত্রে শ্বাস প্রশ্বাস ফেলে বেঁচেছিলেন যেসব র্যাবাই তাঁরা দারুণভাবে ঈশ্বরের ইচ্ছার ব্যাখ্যার কাজে ছিলেন ওস্তাদ, তাঁদের বাইবেলের সমর্থনের প্রয়োজন হয়নি। ৪২মিশনাহ ইহুদিরা কী বিশ্বাস করে তা নিয়ে ভাবিত ছিল না, এর বিবেচনার বিষয় ছিল তাদের আচরণ। মন্দির শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু শেখিনাহ এখনও ইসরায়েলের মাঝে অবস্থান করছেন। র্যাবাইদের দায়িত্ব ছিল ইহুদিদের পবিত্রতার মাঝে বসবাসে সাহায্য করা, যেন মন্দির এখনও দাঁড়িয়ে আছে।
ছয়টি ধারা মন্দিরের মতো করে নির্মিত হয়েছিল।৪৩ প্রথম ও শেষ ধাপ-যেরাইম ও তোহোরদ-যথাক্রমে জমিন ও জাতির পবিত্রতার সাথে সংশ্লিষ্ট। একেবারে অন্তস্থ দুটি ধাপ-নাশিম ও নিযিকিন–ইহুদিদের ব্যক্তিগত, সাংসারিক জীবন ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক নিয়ে বিধান দেয়। কিন্তু দ্বিতীয় ও পঞ্চম ধাপের বিষয়বস্তু-মোয়েদ (‘উৎসব’) ও ক্বাদেশিম (‘পবিত্র বস্তু’)-হচ্ছে মন্দির। প্রায় সম্পূর্ণই উশায় রচিত এ দুটি সেদেরিম ছিল দুটো সমদূরত্বের ভারবহনকারী স্তম্ভ যার উপর গোটা কাঠামো নির্ভরশীল ছিল। তারা হারানো মন্দিরের জীবনের ঘরোয়া বিস্তার স্মৃতিচারণ করত: কত সমৃদ্ধ কামরা ব্যবহার করো হতো, প্রধান পুরোহিত কোথায় তাঁর মদ রাখতেন। কীভাবে রাতের প্রহরী আরাম করত? দায়িত্ব পালনের সময় কোনও পুরোহিত ঘুমিয়ে পড়লে কী হতো? এভাবে ইহুদিদের মনে মন্দির বেঁচে থাকত, ইহুদি জীবনের মন্ত্র হয়ে থাকত। মিশনাহয় লিপিবদ্ধ অচল মন্দির আইন সত্যিই আচার পালনের অনুরূপ ছিল। ৪৫
মন্দির অক্ষত থাকার সময় ফারিজিদের পক্ষে পুরোহিতের মতো দিন কাটানো ছিল এক রকম, কিন্তু সেটা তুচ্ছ ছাইভষ্মে পরিণত হওয়ার পর সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম। নতুন আধ্যাত্মিকতা বীরত্বসূচক ব্যাখ্যামূলক প্রত্যাখ্যান দাবি করেছে। কিন্তু মিদ্রাশ কেবল পেছনে চোখ ফেরায়নি। হাজার হাজার নতুন বিধিবিধান মন্দিরের কার্যকর উপস্থিতির তাৎপর্য খুঁজে বের করেছে। ইহুদিরা পুরোহিতসুলভ জীবন যাপন করতে চাইলে, জেন্টাইলদের সাথে কেমন আচরণ করবে তারা? নারীদের কী ভূমিকা হবে? বাড়িঘরের পবিত্রতার বিধি কে দেখভাল করবে? র্যাবাইগণ কখনওই সাধারণ লোকদের ভয়ঙ্কর আইন অক্ষরে অক্ষরে পালন করাতে পারবেন না যদি না তা তাদের সন্তোষজনক আধাত্মিক অভিজ্ঞতা দেয়।
মিদ্রাশ সম্পূর্ণ হওয়ার মোটামুটি পঞ্চাশ বছর পরে এক নতুন টেক্সট এই মৌখিক ট্র্যাডিশনকে সিনাই পর্বত পর্যন্ত বিস্তৃত আধ্যাত্মিক ধারার যোগান দিয়েছিল।৪৬ পারকে আভোদের (চ্যাপ্টার অভ দ্য ফাদারস) লেখক হিল্লেলের কাছে তোরাহ শিক্ষাকারী আর. ইয়োহানান বেন যাক্কাই শাম্মাই উশা ও ইয়াভনেহর র্যাকাইদের ধারাক্রম পর্যন্ত চিহ্নিত করেন। তারপর দেখান কীভাবে শিক্ষা দ্বিতীয় মন্দির কালের বিশিষ্ট সাধুদের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে ‘মহান সভা’র মানুষদের মাঝে এসে শেষ হয়েছে, যারা পয়গম্বরদের কাছ থেকে তোরাহ গ্রহণ করেছে, পয়গম্বরগণ ‘প্রবীনদে’র কাছ থেকে নির্দেশনা লাভ করেছেন, যারা প্রতিশ্রুত ভূমি অধিকার করেছিলেন, ৪৮ প্রবীনরা জোশুয়ার কাছে, জোশুয়া মোজেসের কাছ থেকে, যিনি ছিলেন ট্র্যাডিশনের উৎস, ঈশ্বরের কাছ থেকে তোরাহ পেয়েছিলেন।
এই ধারাক্রম বাস্তবিক হওয়ার প্রয়োজন ছিল না; অন্য সব মিথোসের মতো এটা ঐতিহাসিকভাবে সঠিক অর্থের চেয়ে বরং অর্থের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ছিল ও ধর্মীয় অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছে। মিশনাহ অনুযায়ী ইহুদিরা যখন তোরাহ পাঠ করে, তাদের মনে হয়ে বুঝি অতীতের মহান সব সাধু ও খোদ ঈশ্বরের সাথে এক অবিরাম কথোকথনে লিপ্ত রয়েছেন। এটাই রাব্বিনিক ইহুদিবাদের চার্টার মিথে পরিণত হবে। একটা নয়, দুটো তোরাহ ছিল-লিখিত ও মৌখিক–দুটোই সিনাই পাহাড়ে মোজেসকে প্রদান করা হয়েছিল। তোরাহকে একটা টেক্সটে আবদ্ধ রাখা সম্ভব নয়, প্রত্যেক প্রজন্মের সাধুদের জীবন্ত কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে একে অবশ্যই নতুন করে জীবন দান করতে হবে। তোরাহ পাঠ করার সময় র্যাবাইগণ মনে করেন যেন তাঁরা সিনাই পাহাড়ে মোজেসের পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। প্রত্যাদেশ ক্রমাগত উন্মোচিত হতে থাকে, ও অতীত, বর্তমান ও ভষ্যিতের সকল ইহুদিদের অন্তর্দৃষ্টি ঈশ্বরের কাছ থেকে অর্জিত হয়, ঠিক যেভাবে মোজেসকে লিখিত তোরাহ দেওয়া হয়েছিল।
রোমান সাম্রাজ্যে ৩১২ সালে সম্রাট কন্সতান্তাইনের ক্রিশ্চান ধর্মে ধর্মান্তরের পর ইহুদিদের অবস্থান বদলে যায়। বার কোসেবা অঘটনের পর, ক্রিস্তোস ফিরে আসতে ব্যর্থ হওয়ায় ইহুদি-ক্রিশ্চানের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছিল, চার্চগুলোয় জেন্টাইলদের প্রাধান্য বেড়ে ওঠে। দ্বিতীয় থিওদোসেসাস (৪০১- ৫০) ক্রিশ্চান ধর্মকে সাম্রাজ্যের সরকারী ধর্মে পরিণত করলে ইহুদিদের সরকারী বা সামরিক বাহিনীতে চাকুরি নিষিদ্ধ হয়ে যায়। সিনাগগে হিব্রু ভাষা নিষিদ্ধ হয়, এবং ইস্তারের আগে পাসওভারের উৎসব পড়ে গেলে সঠিক দিনে ইহুদিদের তা পালন করতে দেওয়া হতো না। র্যাবাইগণ পারকে আভোদে দেওয়া সাধুদের নির্দেশনা পালন করে এর প্রতি সাড়া দিয়েছিলেন। শিষ্যদের তাঁরা ‘তোরাহর জন্যে প্রাচীর নির্মাণ করার কথা বলেছেন। তাঁরা বিজ্ঞ নিবেদিত ধারাভাষ্যের মাধ্যমে তোরাহকে ঘিরে আরও অনেক ঐশীগ্রন্থ রচনা করেন, বৈরী বিশ্ব থেকে একে রক্ষা করেন, যেভাবে মন্দিরের দরবার মহাপবিত্রকে সুরক্ষা দিয়েছিল।
মিশনাহর ‘সম্পূরক’ তোসেফতা ২৫০ ও ৩৫০ সালের ভেতর প্যালেস্তাইনে সম্পন্ন করা হয়েছিল। এটা ছিল মিশনাহর উপর ধারাভাষ্য, ধারাভাষ্যের ধারাভাষ্য। প্রায় একই সময়ে প্যালেস্তাইনে রচিত সিফরা ইহুদিদের তানাখ থেকে সরিয়ে নেওয়ার যে প্রবণতা শুরু হয়েছে বলে মনে হচ্ছিল তাকে ঠেকানোর চেষ্টা করেছে, এবং সমীহের সাথে মৌখিক তোরাহকে লিখিত তোরাহর অধীনে নিয়ে আসতে চেয়েছে। কিন্তু দুটো তালমুদ এটা স্পষ্ট করে দিয়েছিল যে, ইহুদি জনগণই পথ বেছে নিতে আগ্রহী ছিল না। ইহুদি সম্প্রদায়ের পক্ষে খুবই খারাপ একটা সময়ে পঞ্চম শতাব্দীর গোড়ার দিকে প্যালেস্তাইনে ইয়েরুশালমি নামে পরিচিত জেরুজালেম তালমুদ শেষ হয়েছিল। তালমুদ মানে গবেষণা, কিন্তু ইয়েরুশালমি বাইবেল নয়, মিশনাহ নিয়ে গবেষণা করেছে, যদিও তা তানাখ থেকে মিশনাহর গর্বিত স্বাধীনতাকে হ্রাস করেছিল।৫১ ইয়েরুশালমি অনেক বেশি করে বাইবেল থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছে ও প্রায়শই আইনি বিধি-বিধানের পক্ষে ঐশীগ্রন্থের প্রমাণ দাবি করেছে-যদিও তা বাইবেলকে কখনও আইনের একমাত্র ফয়সালাকারী হওয়ার সুযোগ করে দেয়নি। আইনি বিষয়গুলোয় বাস্তব বিষয়ের পাশাপাশি নীতিমালারও ব্যাপার থাকে। তানাখ প্রয়োজনীয় এই তথ্য যোগাতে পারেনি। কিন্তু ইয়েরুশালমির ছয় ভাগের এক ভাগই মহান র্যাবাইদের সম্পর্কে বিভিন্ন কাহিনী ও ঐশীগ্রন্থের ব্যাখ্যা ধারণ করেছে, কঠিন আইনি সংগ্রহকে মানবীয় রূপ দিতে সাহায্য করেছে।
প্যালেস্তাইনের হত দরিদ্র অবস্থা হয়তো ইয়েরুশালমির সমাপ্তিতে বাদ সেধে থাকবে, যাকে হয়তো প্রক্রিয়াধীন বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ষষ্ঠ শতাব্দীতে বাবিলোনিয়ার ইহুদিরা আরও সন্তোষজনক ও পরিশীলিত তালমুদ সৃষ্টি করে।৫২ প্যালেস্তাইন ও বাবিলোনিয়ার র্যাবাইদের ভেতর অব্যাহত বিনিময় ছিল। ইরানি শাসকগণ ক্রিশ্চান সম্রাটদের চেয়ে ঢের বেশি উদার ছিলেন, ফলে বাবিলোনিয়ার ইহুদিরা একজন সরকারীভাবে নিযুক্ত এক্সিলার্কের (বংশধারার শাসক) অধীনে জীবন যাপনের স্বাধীনতা লাভ করেছিল। প্যালেস্তাইনি ইহুদি সম্প্রদায়ের অবনতি ঘটার সাথে সাথে বাবিলোনিয়া ইহুদি বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্রে পরিণত হয় এবং বাভলি নামে পরিচিত বাবিলোনিয় তালমুদ-এর বেশ চড়া আত্মবিশ্বাস ছিল যেখানে এই অধিকতর অনুকূল পরিবেশের প্রতিফলন ঘটেছে। এটাই রাব্বিনিক ইহুদিবাদের মূল টেক্সটে পরিণত হবে। ইয়েরুশালমির মতো এটা মিশনাহর উপর ধারাভাষ্য (গেমারা) ছিল, তবে মৌখিক তোরাহকে সমর্থন করার জন্যে ব্যবহৃত তানাখকে অস্বীকার করেনি। কোনওভাবে বাভলি অনেকটা নিউ টেস্টামেন্টের মতো এই অর্থে যে লেখক-সম্পাদকগণ একে হিব্রু বাইবেলের সমাপ্তি বিবেচনা করেছেন- পরিবর্তিত বিশ্বের জন্যে এক নতুন প্রত্যাদেশ। ৩ নিউ টেস্টামেন্টের মতো বাভলি প্রাচীন ঐশীগ্রন্থের বিবেচনার বেলায় দারুণভাবে নৈর্বাচনিক ছিল, তানাখের কেবল সেইসব অংশ গ্রহণ করেছে যেগুলো কাজের লাগার মতো মনে হয়েছে, বাকি সব বাদ দিয়েছে।
বাভলির ধারাভাষ্য পদ্ধতিগতভাবে অংশ অংশ করে মিশনাহ হয়ে অগ্রসর হয়েছে। গেমারা কেবল বাইবেলরই উল্লেখ করেনি, বরং র্যাবাইদের মতামত, কিংবদন্তী, ইতিহাস, ধর্মতাত্ত্বিক চিন্তাভাবনা ও আইনি কাহিনীরও উল্লেখ করেছে। এই পদ্ধতির কারণে একজন ছাত্র লিখিত ও মৌখিক ট্র্যাডিশনসমূহকে সমন্বিত করতে বাধ্য হয়েছে যাতে তা তার মনে একসূত্রে গ্রন্থিত হয়। বাভলি এমন কিছু উপাদান ব্যবহার করেছে যা মিশনাহর চেয়ে প্রাচীন, তবে এর বেশিরভাগ রসদই ছিল নতুন, ফলে ছাত্র একটা নতুন দৃষ্টিকোণ লাভ করত যা মিশনাহ ও বাইবেল সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিয়েছিল। বাভলি প্রাচীন টেক্সটসমূহকে সম্মান করত, কিন্তু কোনওটাকেই পবিত্র মানতে হবে বলে স্বীকার করেনি। লেখক-সম্পাদকবৃন্দ তাদের ভাষ্যে অনেক সময় মিশনাহর আইনি বিধান পাল্টে দিতেন, এক র্যাবাইর বিরুদ্ধে আরেকজনকে লেলিয়ে দিতেন এবং মিশনাহর যুক্তিতে মারাত্মক ফাঁক আবিষ্কার করতেন। বাইবেল নিয়েও তারা একই কাজ করেছেন, বাইবেলিয় টেক্সটে ফাঁকফোকর চিহ্নিত করেছেন”, অনুপ্রাণিত লেখকরা আসলে কী বলতে পারেন তার পরামর্শ দিয়েছেন, এবং নিজের মতো করে আরও গ্রহণীয় করে তোলার জন্যে এমনকি বাইবেলিয় আইনকে বদলে দিয়েছেন।৫৬ বাভলির সাথে মিলিয়ে পড়া হলে ক্রিশ্চানরা ‘নিউ টেস্টামেন্ট’ পড়ার সময় যেভাবে ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’ বদলে যায়, সেভাবে বাইবেল বদলে দেয়। গেমারায় বাইবেলিয় টেক্সট অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকলে সেগুলোকে কখনওই নিজস্ব পরিপ্রেক্ষিতে ও বাইবেলির পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করা হয়নি, বরং সব সময়ই মিশনাহর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়েছে। হাইফার আর. আবিদিনি যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, র্যাবাইরা ছিলেন নতুন পয়গম্বর: ‘মন্দির ধ্বংস হওয়ার দিন থেকে পূর্বাভাসের দায়িত্ব পয়গম্বরদের কাছ থেকে নিয়ে সাধুদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।৫৭ এভাবে তোরাহ হচ্ছে দুর্ভেয় বাস্তবতা যা দুটি পার্থিব রূপে মূর্ত: লিখিত ঐশীগ্রন্থ ও মৌখিক ট্র্যাডিশন।৫৮ দুটোই ঈশ্বরের কাছ থেকে এসেছে, দুটোই প্রয়োজনীয়, র্যাবাইগণ মৌখিক তোরাহকে প্রাধান্য দিয়েছেন তার কারণ লিখিত টেক্সট শিথিলতা ও পশ্চাদমুখী দৃষ্টিভঙ্গি উৎসাহিত করতে পারে, কিন্তু মৌখিক বাণী, মানুষের চিরন্তন পরিবর্তনশীল ভাবনা প্রবাহ পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রতি ঢের বেশি সংবেদনশীল। ৫৯
বাভলিতে আমরা বহু কণ্ঠস্বর শুনতে পাই: আব্রাহাম, মোজেস, প্রফেটস, ফারিজি ও র্যাবাই। ঐতিহাসিক কালে বন্দি নন তাঁরা, বরং তাঁদের একই পৃষ্ঠায় নিয়ে আসা হয়েছে, যাতে মনে হয় যুগ অতিক্রম করে পরস্পরের সাথে বিতর্ক করছেন তাঁরা-প্রায়শই ভীষণভাবে মতানৈক্য প্রকাশ করছেন। এভাবে বাভলি কোনও নির্দিষ্ট উত্তর যোগায় না। কোনও যুক্তি অচলাবস্থায় শেষ হলে, সেক্ষেত্রে ছাত্রকে শিক্ষকের সাহায্যে নিজের সন্তোষ অনুযায়ী সমাধান খুঁজে বের করতে হতো। বাভলিকে প্রথম মিথষ্ক্রিয়াসুলভ টেক্সট হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এর পদ্ধতি খোদ র্যাবাইদের গবেষণা প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি করে ছাত্রদের একই আলোচনায় সংশ্লিষ্ট হতে বাধ্য করে নিজস্ব অবদান রাখতে বাধ্য করেছে। প্রতিটি পৃষ্ঠার বিন্যাস ছিল গুরুত্বপূর্ণ: মিশনাহর আলোচ্য অংশটুকুকে স্থান দেওয়া হতো পৃষ্ঠার মাঝখানে, চারপাশে রাখা হতো অতীত ও একেবারে সাম্প্রতিক কালের সাধুদের গেমারাও। বাইবেলের পয়গম্বর ও গোত্রপিতারা আদি প্রত্যাদেশে অংশ গ্রহণ করেছিলেন বলে অতিমর্যাদাবান মনে করা হতো না। আর. ইশমায়েল যেমন আগেই ব্যাখ্যা করেছেন: ‘ঐশীগ্রন্থে কোনও পূর্বপুরুষ বা উত্তরপুরুষ নেই।’৬১ প্রত্যেক পৃষ্ঠায় ছাত্রের নিজস্ব ধারাভাষ্য যোগ করার জায়গা থাকত। বাভলির সাহায্যে বাইবেল পাঠ করার সময় ছাত্র শিখত যে, শেষ কথা বলার মতো নেই কেউ, সত্যি অবিরাম পরিবর্তিত হচ্ছে এবং ট্র্যাডিশন বিপুল ও মূল্যবান হলেও একে বিচার বিবেচনার নিজস্ব শক্তিকে বাধা দিতে দেওয়া যাবে না। ছাত্রকে অবশ্যই পবিত্ৰ পৃষ্ঠায় তার গেমারা যোগ করতে হবে, নইলে ট্র্যাডিশনের ধারা থেমে যাবে। ‘তোরাহ কী?’ প্রশ্ন করেছে বাভলি, ‘এটা হলো: তোরাহর ব্যাখ্যা।
তোরাহ পাঠ কোনও একক অনুসন্ধান ছিল না। প্যালেস্তাইনের সপ্তম শতাব্দীর সাধু আর. বেরেচিয়াহ রাব্বিনিক আলোচনাকে শাটল ককের সাথে তুলনা করেছেন: “যখনই কোনও বিজ্ঞজন পাঠ কক্ষে তোরাহ আলোচনা করার জন্যে আসেন, এপাশ ওপাশ কথা চালাচালি হতে থাকে, একজন তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে, আরেকজন আবার ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলে।’ কিন্তু তবুও একটা মৌল ঐক্য ছিল, কারণ সাধুগণ কেবল তাদের নিজস্ব মতামত তুলে ধরছিলেন নাঃ ‘এইসব সাধু ও আরও অনেকের কথা রাখাল মোজেস দিয়েছিলেন, যিনি মহাবিশ্বের অনন্য একজনের কাছ থেকে এসব গ্রহণ করেছিলেন। এমনকি উত্তপ্ত বিতর্কে লিপ্ত থাকলেও সত্যিকারের নিবেদিত ছাত্র সচেতন থাকত যে সে ও তাঁর প্রতিপক্ষ একই পথের যাত্রী, একটা আলোচনায় অংশগ্রহণ করছে যেটা সেই মোজেস পর্যন্ত বিস্তৃত, যা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে এবং তাদের দুজনকেই আগেই ঈশ্বর দেখেছেন ও আশীর্বাদ করেছেন।
এখন ইহুদিবাদের প্রতিপক্ষ বিবেচিত হলেও ক্রিশ্চানরা একই রকম আধ্যাত্মিকতা গড়ে তুলছিল।