যদু জানে, মায়ের কু সন্দেহ সেই জন্যেই জেগেছিল। ও নিজে নিমদহের ঘটনা মা’কে কিছুই বলেনি। বাবা আর ঠাকুরদা কী বলেছে, তাও জানে না। নিমদহের ঘটনা থেকেই, মায়ের সন্দেহ হয়েছিল, যদু জটার বোনের সর্বনাশ করে প্রতিশোধ নেবে। মা কী ভেবেছিল? যদু উমিকে ধর্ষণ করেছিল? তারপর থেকে, যদুকে বিয়ে দেবার জন্য মেয়ে দেখা শুরু হয়েছিল। যদু পরিষ্কার বলে দিয়েছিল, ও চেষ্টা পেইয়ো না। মেয়ে যা হবার হবে।
যদুর দিকে খুড়ো অধর বারবার তাকাচ্ছিল। ভাইপোর দিকে তার দৃষ্টিতে বিস্ময় ও সম্ভ্রম। দোহন শেষ হবার আগেই, গদাধর আর শ্রীবাস ফিরে এল। সঙ্গে জনাতিনেক ভিন গাঁয়ের লোক। দুধ নিতে এসেছে। তাদের হাতে দুধের ধোয়া পাত্র। এসেই জানিয়ে দিল, সব দুধ তারা নেবে। বিয়ে বাড়ির দই মিষ্টির বায়না নিয়েছে। তারপর উঠোনে বসে জটার খুনের আলোচনা শুরু হল। গদাধর হেঁকে বলল, দুগা, একটু তামুক সেজে দে দেখি।তারপর নারকেল গাছের নীচে বসে বড় নিশ্বাস ফেলল, এ খুন যেমন তেমন খুন না। যে কইরেচে, বিষম আকোচে কইরেচে। জটা ত মানুষ ভাল ছিল না। কার কী ক্ষেতি কইরেছিল, কে জানে?
বড় আঁটঘাট বেঁইধে খুন কইরেচে। শ্রীবাস ক্রেতাদের সামনেই দুধের প্রত্যেক পাত্রে অল্প বিস্তর জল ছিটিয়ে দিচ্ছে। একেবারে জল না দিয়ে দুধ বিক্রি করা যায় না। বলল, আত্তিরে কালী ঘোষের সমস্ত গোরু বাছুর মোষ ছেড়ে দিয়ে, জটাকে ঘরের বার কইরে মেইরেচে। লাশ পেইয়েচে কোথায় যেন?’
তোমাদের গাঁয়েরই শিবের পোড়োয়। একজন দুগ্ধক্রেতা বিড়িতে আগুন ধরিয়ে বলল, পুলিশের বড়বাবু বইলছিল, দড়ির ফাঁস দিয়ে মেইরেচে, ঠগিদের মতন।
তোপা হীরা বাছুরগুলোর দড়ি খুলে দিয়েছিল। প্রাণীদের খাওয়া আগেই হয়ে গিয়েছে।
যদু বলল, তোরা গাই বাছুর লিয়ে বেরিয়ে পড়, অনেক বেলা হয়েছে।
প্রাণীরা নিজেরাই মুক্ত হয়ে, ঘণ্টার শব্দে পুবের পথে রওনা হল। যদুর মা ঘোমটায় মুখ ঢেকে, কলকে সাজানো হুঁকা এনে দিল গদাধরকে। গদাধর জিজ্ঞেস করল, দুগা কোথায়?
শরীর খারাপ, জ্বর হইয়েচে। যদুর মা নিচু স্বরে বলল, উইঠতে পাইরচে না।’
গদাধর ঘাড় ঝাঁকাল, হুঁ, সেজন্যেই কাল থেকে গুঁড়িকে দেইখতে পাইচ্ছি না। খুব বেশি জ্বর নাকি?
না। ওষুধ দেচি। যদুর মা গোয়ালের দিকে গেল।
অধর দুধ মেপে, ক্রেতাদের পাত্রে ঢালছে। শ্রীবাস হিসাব রাখছে মাটিতে দাগ কেটে। ক্রেতাদের এক জনও হিসাব রাখছে। বাকি দু জন জটার খুনের কথা বলাবলি করছে, পুলিশ বড় সোজা পাত্তর নয়। ঠিক দেইখবা, খুনিকে খুঁজে বের কইরেচে। শুনলাম, কলকাতা থেকে খুনি ধরা কুকুর আইনবে।
যদু সকলের কথা শুনছে। মনে ওর কৌতূহল, জটার বাড়িতে মন টানছে। গোয়ালের চালার বাতা থেকে আলোকলতার গোছা পেড়ে নিল। মা এল, চোখে উদ্বেগ, ফিসফিস স্বরে উৎকণ্ঠা, যদু, আমার বড় ভয় নাইগচে বাবা।
ভয় পেইও না। যদুর নিচু স্বরে উদ্বেগের লেশ নেই, এই আলোকলতা আগুনে ফেইলে, বাদল খোড় গাইটাকে সেঁক দিবা। খুড়িকে বইলবা, ওর শিঙে যেন চূর্ণ মাখিয়ে দেয়। আমি কালী ঘোষের বাড়ি যাচ্ছি।’
মা যেন আঁতকে উঠল, তুই সে বাড়ি যাবি?
হ্যাঁ, এক বার ঘুইরে আসি। যদু গোয়াল থেকে বেরিয়ে পুবের ঘরে গেল।
দুর্গা মেঝেয় মাদুরের ওপর শোয়া। চোখ বোজা, কোঁকাচ্ছে। মুখটা ব্যাথাকাতর। যদু দেখল। কুলুঙ্গি থেকে বিড়ির কৌটা দেশলাই কোমরের কাপড়ের কষিতে গুঁজল। বাড়ি থেকে বেরোবার আগে সবাইকে শুনিয়ে বলে গেল, আমি এক বার কালী ঘোষের বাড়ি যাচ্ছি।
উঠোনের মাঝখানে ননীবালা। তার সঙ্গে বড় জায়ের চোখাচোখি হল। দুজনের চোখে উৎকণ্ঠিত সংকেত। যদু বাড়ির বাইরে গিয়ে, বিড়ি ধরাল। পথে যার সঙ্গেই দেখা হল, সবাই কালী ঘোষের বাড়ি-ফেরত। সকলের মুখে জটার খুনের কথা। গোয়াল পাড়ার শেষ প্রান্তে কালী ঘোষের বাড়ি। উঠোনে বিস্তর লোক। বাড়ির সামনে রাস্তার ওপর পুলিশের জিপ গাড়ি। গোয়ালের গোরু বাছুর-মোষ সব গোয়ালেই বাঁধা। দোয়া হয়েছে কি না কে জানে। একজন মুনিষ প্রাণীদের এত বেলায় খাবার দিচ্ছে, যদু লোকের ভিড় কাটিয়ে, ঘরের দাওয়ার দিকে গেল। দেখল, জটার বউয়ের ঘোমটা খোলা। বুকের আঁচল খসা। দুজন স্ত্রীলোক তাকে ধরে আছে। সে মাথা ঝাঁকাচ্ছে, আর করুণস্বরে বিলাপ করছে, আঁ-আঁ-ওগো, কে এমন সব্বনাশ কইরলে গো আমার? ক্যানে কইরলে? তার কি বউ বেটা-বেটি নাই গো? ভগমান কি তার আঁতে শেল হাইনবে না?
যদু দেখল, শুনল। জটার বউকে ও বউদি বলে ডাকে। যদুর চোখের সামনে দুর্গার মুখ ভেসে উঠল। তারপরেই উমির মুখ। কেন উমির মুখ ভেসে উঠল? যদুর অন্তর কি শেল হানা? ওর সমস্ত মন জুড়ে, জটার হত্যা ঘটনা। জটার বউকে দেখে, মনটা কেমন টাটিয়ে উঠল। বউয়ের কোলের কাছে, জটার দ্বিতীয় আর শেষ সন্তান, ছোট ছেলেটার সামনে মুড়ি ছড়ানো। এক বছর বয়সও হয়নি। ছেলেটা একটা একটা করে মুড়ি মুখে দিচ্ছে। বউয়ের এমন কিছু বয়স হয়নি। আঠারো-উনিশ হবে। দেখতেও খারাপ না, দোহারা, মাজা রং, চোখ মুখ সুশ্রী। যদুকে সে দিকে তাকাতে দেখে, জটার খুড়ি বউয়ের বুকে আঁচল তুলে দিল। বউ যদুকে দেখে, আর্তস্বরে ডুকরে উঠল, ওই গো যদু ঠা’রপো, আমার ভরা ঘরের আজা খুন হইয়ে গেল। তোমাদের সঙ্গে আর কোনও দিন সে বাথানে যাবে না।’
যদুর মনে পড়ল, কীভাবে ও জটাকে রাত্রে মেরেছে। জটাকে মারতে ওর হাত কাঁপেনি। এখন মনটা কেমন মোচড়াচ্ছে। বউয়ের ভরা ঘরের রাজা নেই। সে আর কোনও দিন যদুর সঙ্গে বাথানে যাবে না। সেই কারণে যদুর মনে কোনও কষ্ট নেই। জটার কামবায়ু এত বেড়ে উঠেছিল, যদুর বোনকে দিনের বেলা ধর্ষণ করেছিল। জটা মদ মেয়েমানুষে আসক্ত ছিল। বাছবিচারহীন। যদু বোনের জন্য, শপথ করে জটাকে খুন করেছে। অবাক কথা, উমিকে মনে পড়ছে! সেই জামালপুরের দিঘির জঙ্গলে, বেলেরহাটের ভাঙা বাড়ির পোড়োয়। বৃষের উন্মত্ত রক্ত দাপিয়েছিল বুকে। কিন্তু সেই মেয়েকে যদুনগ্ন করেনি। উমি রতিপ্রতিমা। যদু মদন বিগ্রহ। উভয়ের রক্তে কাম, দুরন্ত উত্তপ্ত নিশ্বাসে পুড়িয়েছে। স্পর্শে দগ্ধে মরেছে। কেউ নগ্ন হয়নি। প্রাণে সেই দাগা। এখন কেন উমিকে মনে পড়ছে? জটার বউয়ের কথা শুনে, বুকে মোচড় দিচ্ছে। জটার পাপের শাস্তি বউ ভোগ করছে। এ কথা যদুর আগে মনে আসেনি। মন যখন স্থির করে, তখন আশেপাশের কিছুই চোখে পড়ে না। শত্রুবিনাশী মন, লক্ষ্যভেদ স্থির। এখন বুকে মোচড় লাগছে।
যদু ঘরের দাওয়ার কাছ থেকে সরে এসে, ভিড়ের মধ্যে এল। দারোগা সাহেব বসে ছিলেন একটা চেয়ারে। তার পাশে আর দুই চেয়ারে বামুন পাড়ার প্রৌঢ় চন্দ্রকান্ত চক্রবর্তী, আর মুসলমান পাড়ার মোড়ল কলিমুদ্দিন শেখ। দুজন সেপাই পাশে দাঁড়িয়ে। দুটি জলচৌকিতে বসে আছে সুরীন মণ্ডল আর কালী ঘোষ। লাল চোখের কোল বসা। মাথার ধূসর চুল এলোমেলো। ধ্বসে পড়া চেহারা। পাশে মাটিতে বসে আছে জটার ভাই বটা। যদুরই বয়সি। আর জটার খুড়ো জ্যাঠারা। সকলের মাঝখানে পড়ে আছে জটার লাশ। চোখ দুটো আধ-বোজা। মুখ হা করা। জিভটা ভিতরে উলটে রয়েছে। কষে রক্তের দাগ। গলায় স্পষ্ট দড়ির দাগ, এখন কালো হয়ে ফুলে উঠেছে। ডান হাতের ডানায় একটা মাদুলি বাঁধা। কোমরে জড়ানো লুঙি।
যদুর মনে কোনও আক্ষেপ নেই। কিন্তু জটার বউ ছেলের কথা মনে এলেই, মোচড় লাগছে। দারোগার কোলে খাতা, হাতে কলম, তা কেউ যদি তোমরা কিছু বলতে না পার, আমি কেসটা করব কার বিরুদ্ধে? তোমরা এমন এক জনের কথাও বলতে পারছ না, যাকে সন্দেহ হয়, তোমাদের ছেলেকে খুন করতে পারে? একটা হদিস না দিতে পারলে, আমরা কাজে লাগব কেমন করে? গাঁয়ের সব লোককে তো আর কোমরে দড়ি বেঁধে থানায় নিয়ে যেতে পারিনে।
জটার বাবা ভাই খুড়ো জ্যাঠা নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করল। জটার বাবা বলল, কী বইলব দারোগাবাবু? জটার এমন শত্রুর ছিল, কোনদিন জাইনতাম না। সেও কোনও দিন কিছু বলে নাই। শুইনলেন তো আমার বউমাকেও জটা কোনদিন ঠার-ঠোরেও কিছু বলে নাই। সুরীন ঘোষ, আমাদের মোড়ল, তার কথাও শুইনলেন। এ্যাজাহারও অনেক হল দারোগাবাবু, কিন্তু এ এ্যাক্কেবারে বিনা মেঘে বজজোঘাত।
কালী ঘোষ কপাল চাপড়ে ছেলেমানুষের মতো কেঁদে উঠল। সুরীন মণ্ডল তার কাঁধে বুকে হাত বুলিয়ে দিল, কেঁদ না কালী, কাঁদবার সোময় অনেক পাবে। এখন একটা বিহিত কইরতেও হয়।
আরে বিহিতটা কী করবে তোমরা?’ দারোগাবাবু বিরক্ত মুখে ধমক দিয়ে উঠলেন, সেই কোন ভোরে এসেছি, তোমরা একটা কোনও হদিস দিতে পারছ না। এ এজাহার নেবার দাম কী আছে? তিনি চন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর দিকে তাকালেন, আপনি তো সব শুনলেন। জটা কারও গোরু বাছুর বিষ খাইয়ে মারেনি, কারোর কাছে টাকা ধার করেনি, ধার দেয়নি। জমি-জিরেত নিয়ে কারোর সঙ্গে বিবাদ ছিল না। কারোর বউ-ঝি নিয়ে টানাটানি করেনি। বাপ ভাই খুড়ো জ্যাঠা মা বউ বোন, গাঁয়ের লোকজন, সবার মুখে এক কথা। তবে কি ভূতে এসে জটাকে মেরে গেছে? এতক্ষণ ধরে তো কারোর মুখ থেকে আমি একটা তেমন কথা আদায় করতে পারলুম না।’
চন্দ্রনাথ চক্রবর্তী হতাশভাবে মাথা ঝাঁকালেন, সেই ত কথা। আমিও ত ছাই এদের কথার মাথা মুণ্ডু কিছু বুইজতে পাইরচি না দারোগাবাবু। আমি বলি, আপনি পুলিশ কুকুর আনার বাওস্তা করুন।
আরে মশাই, পুলিশ কুকুর কি তু বলে ডাকলেই আসে নাকি?’ দারোগাবাবু বিরক্ত মুখে ঝঝলেন, এখন থানায় গিয়ে কেষ্টনগরে টেলিফোন করে খবর দিয়ে–আবার কেষ্টনগর থেকে কলকাতার লালবাজারে খবর করে, পুলিশ কুকুর আনতে আনতে, খুনির সব সুলুকসন্ধান গায়েব হয়ে যাবে। পুলিশ কুকুরের কথা আমিই তুলেছিলাম। তা হয়ে উঠবে বলে মনে হচ্ছে না। চেষ্টা করে দেখব। তবে এটাও জানবেন, পুলিশ কুকুর কারোকে ধরলেই যে সে শাস্তি পাবে, তা নয়। কোর্টের বিচারে কুকুরের সাক্ষীর কোনও মূল্য নেই। তবে হ্যাঁ, সময়মতো কুকুর আনতে পারলে আমাদের তদন্তের একটু সুবিধে হয়। সে সুবিধে আর পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না। এমনিতে এ বাড়ি বা রাস্তায় খুনির পায়ের ছাপ, গোর মানুষের পায়ের ছাপের সঙ্গে মিশে গেছে। শিবের পোড়োয় যে গাছতলায় জটাকে খুন করা হয়েছে, সেখানেও খুনির পায়ের ছাপের সঙ্গে অনেক মানুষের পায়ের ছাপ পড়েছে। কোথাও আলাদা করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় পুলিশ কী করে খুনির হদিস করবে, বলুন?’দারোগাবাবু কলিমুদ্দিন শেখের দিকে তাকালেন, তুমি বলছ, গঙ্গার ওপার থেকে কেউ এসে মেরে যেতে পারে। সে কে হতে পারে? জটা কি গঙ্গার ওপারে বিশেষ কারোর বাড়ি যাতায়াত করত? মেয়েমানুষ রেখেছিল? টাকার লেনদেন করত? সে রকম কোনও খবর থাকলে বলল, সেখানে আমরা খোঁজ-খবর করব।
কলিমুদ্দিন শেখ দাড়িতে হাত বুলিয়ে চিন্তিত মুখে বলল, ওটা আমার আনজাদে ঢিল মারা দারোগা সায়েব। ওপারে যাতাত আমাদের সারই আছে। কিন্তু আপনি যা বইলচেন, জটার বিষয়ে সে রকম কিছু খবর নাই।
তা হলে?’ দারোগাবাবু কবজির ঘড়ি দেখে উঠে দাঁড়ালেন। আর বসে থাকা যায় না। সেই ভোর সাড়ে ছ’টায় এসেছি, এখন দশটা বেজে গেছে। মড়া পচিয়ে লাভ নেই, লাশ আমরা কেষ্টনগরের মর্গে চালান করে দেব। সেখানে ময়না তদন্তের পর, তোমরা লাশ ফিরে পাবে। আমি এ বার চলি। তিনি সেপাইদের দিকে তাকালেন, লাশ তোলার ব্যবস্থা করো।
চন্দ্রকান্ত চক্রবর্তী বিনীত হেসে বললেন, একটু আমার বাড়ি হয়ে চলেন, সামান্য জলযোগ–।
এই তো একটু আগে অনেক দুধ মিষ্টি খেয়েছি। দারোগাবাবু বললেন, পেটে আর জায়গা নেই মশাই। আমাকে তাড়াতাড়ি থানায় ফিরতে হবে। রাস্তাঘাটের যা অবস্থা, জিপ গাড়ি যেতেও সময় লাগবে। কেস লিখে নিয়ে গেলাম। যদি এর পরে কারোর কিছু বলার থাকে, থানায় খবর করবেন। আর সবাই মিলে খোঁজ করে দেখুন, গতকালই জটার সঙ্গে কারোর কোনও বিবাদ বিসম্বাদ হয়েছিল কি না। সে রকম কারোকে পেলেও খবর দেবেন।’
দুই সেপাই জটার হাত পা ধরে তুলল। জটার ঘাড় শক্ত হয়ে গিয়েছে। সেপাইদের মুখ দেখে বোঝা গেল, লাশের ওজন বেশ ভারী। গাড়ির ড্রাইভার গাড়ির পিছন দিকের ঢাকনা খুলে দিল। সেপাইরা লাশ গাড়িতে ঢুকিয়ে দিল। জটার বউ পাগলের মতো ছুটে এল, অগো, আমার বুক খালি কইরে কোথায় যাচ্চ গো। তোমার ছেলে-মেয়েদের এক বার দেইখে যাও।
জটার খুড়ি জেঠি বউকে চেপে ধরল। উদাস শরীরে শাড়ি সাব্যস্ত করে দিল। জটার মা নেই। বাকিদের মধ্যে কান্নার রোল উঠল। উঠোনের সবাই জিপ গাড়ির কাছে ভিড় করল। সেপাইরা লাশের সঙ্গে পিছনে উঠল। দারোগাবাবু ড্রাইভারের সামনে বসলেন। কালী ঘোষের উদ্দেশে বললেন, নতুন। খবর না থাকলে আজ থানায় আসবার দরকার নেই। লাশ পেতে পেতে পরশু-তরশু হয়ে যাবে। তখন যাবে।
গাড়ি গর্জন করে, পুবের কঁচা র স্তায় নেমে, চলে গেল। কিছু ছোট ছেলেমেয়ে, আর দুটো কুকুর ঘেউ ঘেউ করে গাড়ির পিছনে ছুটল। যদু দেখছিল জটার বউ বোনকে। দুর্গার বয়সি জটার বোন, নাম পূর্ণিমা। কালোর মধ্যে সুশ্রী দেখতে। কেঁদে কেঁদে দু চোখ ফুলে লাল হয়ে উঠেছে। জটার বউ অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। তাকে সবাই ধরাধরি করে দাওয়ায় নিয়ে গিয়ে শোয়াল। যদু দেখল, জটার ছেলেটা প্রস্রাব করেছে। আর সেই প্রস্রাব থেকে ভেজা মুড়ি কুড়িয়ে মুখে দিচ্ছে। যদু ছেলেটাকে নিজের কোলে টেনে নিল। ল্যাংটা ছেলেটা বড় বড় চোখ করে যদুর মুখের দিকে তাকাল। যদুও তাকাল। ছেলেটা মায়ের মতো দেখতে হয়েছে। যদু ওকে পিতৃহীন করেছে। বড় হয়ে বাবার মুখ কোনও দিন মনে করতে পারবে না। কেবল শুনবে, ওর বাবাকে কেউ ফাঁস দিয়ে হত্যা করেছিল। কেন? তা হয়তো কোনও দিনই জানবে না।
যদুদা, দাওয়ায় এইসে বস। পূর্ণিমা কাছে এসে ডাকল।
যদু পূর্ণিমার দিকে তাকাল। এই পূর্ণিমাকে নিয়েই মায়ের সন্দেহ হয়েছিল, জটা দুর্গাকে যা করেছে, যদু পূর্ণিমাকে তাই করে শোধ নেবে। মা, তুমি তোমার গর্ভের সন্তানকে চিনতে পারনি। জটার খুনের সংবাদ শুনে, ছেলের জন্য তোমার বুকে বড় গরব। ভয়ও পেয়েছ। কিন্তু মা, দেখ, আমার বুক কেমন টাটাচ্ছে, আমি তো তখন ভাবিনি, জটার বউ ছেলেমেয়েকে এমন করে আমাকে দেখতে হবে। জটাকে মেরে আমি অন্যায় করিনি। অথচ এদের দেখে আমার প্রাণ পুড়ছে। সংসারের কী বিধি। দেখ, জটার অবোধ ছেলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে। ওর নরম শরীর বুকে করে জ্বলে মরছি। ও পূর্ণিমাকে বলল, বইসব না পুনি। তোর বউদি আর ছেলেমেয়েকে দেখে আমার মনটা পুড়ে যাচ্ছে।’
পূর্ণিমা হু হু করে কেঁদে উঠে, মুখে হাত চাপা দিল, যদুদা, কে এমন শঙ্কুর, দাদাকে ওই রকম কইরে নিকেশ কইরেচে? কেন কইরেচে? ভগবান কি তাকে কোন সাজা দেবে না?
ভগবান যদি তা মনে করেন, যদুর সাজা হবে। এ রকম সাজা তো ভগবান তার বুকে হেনে রেখেছেন। সারাদিনের কাজেকর্মে, প্রাণীদের সেবায়, আহারে নিদ্রায়, সেই সাজা বুকের মধ্যে আঁচড়ায়। ঠাকুরদার সেই গানটা মনে পড়ে, আর কি দেখা পাব গ শ্যামের ছিচরণের। …উমি তো তা-ই। গোকুল অন্ধকার করা শ্যাম আর কি তার দেখা পাবে? যদুকে কি তার মনে পড়ে? যার কাছে সে কলঙ্ক চেয়েছিল? কুমারী গর্ভবতী হতে চেয়েছিল। তুমি কি ছিট-গঙ্গার জলে সাঁতার কেটে, সেইখানে আর যাও? তরঙ্গ তোল? ডাকো না কেন মনে মনে? বাবার মারে মরিনি। তুমি মায়ের মারে মরোনি। এ কি জ্যান্তে মরা হয়ে রইলাম?
যদু দেখল, ওর মা আর খুড়ি একগলা ঘোমটা টেনে, উত্তরের খিড়কি দিয়ে ঢুকছে। মা দেখছে, যদুর কোলে জটার ছেলে। ক্যানে, কী দেখতে এসেছ তোমরা? গ্রাম-সমাজ-সামাজিকতা, জাতের ঘরে দুর্দশায় আসতে হয়, তাই?
সুরীন মণ্ডল, চন্দ্রকান্ত ঠাকুর, কলিমুদ্দিন শেখ, কালী ঘোষ, তার ভাই দাদাদের সঙ্গে বসে নানা রকম কথাবার্তা পরামর্শ চালাচ্ছে। ঠাকুর বলছে, এ একেবারে ভগবানের মার বইলে মনে হচ্ছে। ও অপোঘাতে মৃত্যু, তিন দিন অশৌচ পালন কইরে শ্রাদ্ধ শান্তি কইরতে হবে।
তিনদিনে যদি জটার লাশ না মেলে, ত?’ সুরীন মণ্ডল জিজ্ঞেস করল।
চন্দ্রকান্ত চিন্তিত মুখে মাথা ঝাঁকাল, সেই তো কথা। আমি বলি, তোমরা বাড়ির লোকেরা কেউ নাকাশিপাড়ার থানায় গিয়ে বইসে থাক। দরকার হলে কেষ্টনগরে যাবা, বুঝয়ে বইলবা বাবুদের।
হ্যাঁ, ঠাকুরমশাই যা বইলচেন, তাই কর কালীদাদা। কলিমুদ্দিন চন্দ্রকান্তকে সায় দিল, আর কী বলো, ছেরাদ্দ। এ ছেরাদ্দে ত তোমাদের বাটা বের করাটরা হবে না, না কি?
গোপদের শ্রাদ্ধ এক বড় কাজ। বাবা মা মারা গেলে, ছেলে বাটা নিয়ে গোপদের ঘরে ঘরে যায়। সে রকম ঘটনা হলে, মোড়ল পিতৃমাতৃ দায়গ্রস্তের বিচার করে। বিচারে সাজাও পেতে হয়। মেনে নিলে ভাল, নইলে একঘরে। তবে তেমন বুঝলে, দায়গ্রস্তকে সবাই সাহায্য করে। মন মন দুধ দেয়, পুকুরের মাছ দেয় আঁশমুখের দিন। সুরীন মণ্ডল বলল, এখেনে ত দোষ বিচারের কিছু নাই। জটার এক বছরের ছেলে বাটা বের কইরতে যাবে না। ঠাকুর মশাই মঙ্গল শান্তি কইরবেন।
যদুর এ সব কথা শুনতে ভাল লাগছিল না। ও পুনির কোলে ছেলেকে দিয়ে বলল, যাই, আবার আইসব।
বটা উঠে এল যদুর কাছে, চইললি?
হ্যাঁ যাই। গঙ্গায় যাব, গোরু-মোষগুলানকে নাওয়াব। যদু বাড়ির বাইরে রাস্তায় এসে পড়ল। বটা সঙ্গে চলেছে।
বটা রাস্তায় এসে জিজ্ঞেস করল, তোর কাছে বিড়ি আছে?
আছে। যদু বটাকে বিড়ি দেশলাই বের করে দিল কোমরের কষি থেকে। দুজনেই বিড়ি ধরাল।
বটা বলল, তোর কী মনে নেয় যদু? দাদাকে কে এমন কইরে মাইরতে পারে? আমারও মাথাটা খারাপ হয়ে যাইচ্চে। বোশেখে বাথান লিয়ে তোরা একসঙ্গে গেচিলি। তখন ওপারের কোনও লোকের সঙ্গে দাদার কিছু আকচা-আকচি হইয়েছিল?
না, সে রকম কিছু দেখি নাই। যদু জোরে পা চালাল, তবে তুই ত তোর দাদার চরিত্তির ভাল জাইনতিস। চুপচাপে কারুর কোন ক্ষতি কইরেছিল কি না, কে জানে?
বটা কথা না বলে যদুর সঙ্গে হাঁটতে লাগল। তারপরে বলল, তা কী জানি। হতেও পারে। তা এমনকী ক্ষেতি কইরতে পারে, একেবারে ফঁস দিয়ে মেইরে ফেইলল?
সে কথা জটা ছাড়া আর কেউ বইলবার নাই। যদু ঘন ঘন বিড়ি টানল।
বটা থামল, তা’লে তুই যা, আমি ফিরি।
আয়গা। যদু বিড়ি ফেলে দিল।
বটা ফিরে গেল। যদু এক বার পিছন ফিরে বটাকে দেখল। বাড়ি ফিরে দেখল, গদাধরের সামনে বসে আছে শ্রীবাস, বিজয় পাল। বিজয় পাল সৎ চাষি, অবস্থা ভাল। যদুদের কাছ থেকে বলদ খাটাতে নেয়। নগদে কারবার হয় না। ধান চাল অথবা রবি শস্যের মধ্যে। বেশির ভাগ মুসুর আর কলাই হিসাব করে নেওয়া হয়। কেবল বিজয় পাল না। বলদ আরও অনেকেই জমি চাষের জন্য ভাড়া নেয়। বলদদের খাওয়ানো দেখাশোনা করা তাদের কাজ। গোপদের নজর রাখতে হয়। প্রাণীকে ঠিকমতো রাখে কি না। এমন না, যে ছেলে দুষ্টামি করলে, দু-চার ঘা মারবে না। তা বলে হাল চষতে গিয়ে কথায়। কথায় বেড়ন দেবে, তা সহ্য করা যায় না। খেতে দিলে হয় তো দু-এক আঁটি খড়। নিজের ঘরের প্রাণী তো না। কাজ চলা গোছের, অল্পবিস্তর খাওয়ালেই হল।
তা হয় না। গোপের যত্নের বলদ। তার খাওয়া থাকার ব্যবস্থা আলাদা। চাষির বাড়ির গাই বাছুর বলদ মহিষের চেহারা, আর বাথান ঘোরা গোপদের প্রাণীদের চেহারা দেখলে বোঝা যায়। গোপের ঘরের বলদ দেখে তোমাদের চোখ ভরে যায়, তাই জমির কাজের জন্য নিয়ে যাও। নিয়ে গিয়ে, তড়িক ঘড়িক হাল চষার জন্যে পিঠে পাঁচনবাড়ি ভাঙবে, এঁদো জলা নোংরা জায়গায় রাখবে, পেট ভরে খেতে দেবে না, তা হবে না। সেই জন্যে নিজেদের গিয়ে দেখে আসতে হয়, তত্ত্বতালাশ করতে হয়। সে রকম দেখলে, গোপ কোনও যুক্তি-চুক্তি মানবে না। নিজের প্রাণীদের ঘরে নিয়ে চলে আসবে। বসে খাবার জন্যে সংসারে কেউ আসেনি। প্রাণীরাও না। দেওয়া-নেওয়া সকলের মধ্যে।
যদু দেখল তিনজনকে। খুড়ো অধর আর পঞ্চানন গিয়েছে ওপারে দুধ নিয়ে। বিক্রিবাটা কেনা-বেচা সেরে ফিরবে গড়ানো দুপুরে। গোয়ালের কাছে গিয়ে দেখল, খোঁড় ব্যামো গাইটি জাব খাচ্ছে। দেখলেই বোঝা যায়, ব্যামো সেরেছে। ও পুবের ঘরে গেল। দুর্গা মাদুরের ওপর বসে ছিল। খোলা চুল রুক্ষ। মুখটা ফ্যাকাশে। এক পা মাদুরে গুটিয়ে, আর এক পায়ের হাঁটুতে মুখ রেখে বসে ছিল। কেমন উদাস, বাছুর মরা গাভির মতো করুণ চোখে তাকিয়ে ছিল। যদুকে দেখে, মুখ তুলে তাকাল। উদাস করুণ চোখে ফুটে উঠল একটা কেমন ত্ৰাসচকিত বিস্ময়। কেন? দুর্গা ক্ষীণ উৎকণ্ঠিত স্বরে ডাকল, বড়দা?
কী?’ যদু জিজ্ঞেস করল।
দুর্গার স্বরে সভয় জিজ্ঞাসা, সত্যি?
যদু ভুরু কুঁচকে দুর্গার দিকে তাকাল। ও জানে না, দুর্গার কী কষ্ট হচ্ছে। জিজ্ঞেস করতেও পারে না। এ সব কষ্ট মা খুড়িই ভাল বোঝে। দুর্গার কথার কোনও জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুই আছিস কে
দুর্গা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে, নিজের হাঁটুতে মুখ গুঁজল। যদুর ভ্রুকুটি চোখে জিজ্ঞাসা। দুর্গার কান্না জড়ানো স্বর শোনা গেল, আমার বড় ভয় কইরচে রে বড়দা।
ক্যানে, ভয় কীসের?’ যদুর স্বরে গম্ভীর জিজ্ঞাসা।
দুর্গা হাটুতে গোঁজা মাথা নাড়ল। কান্না-অস্ফুট স্বর শোনা গেল, জানি না, জানি না।
তুই খুশি হস নাই?’ যদুর স্বরে সন্দিগ্ধ জিজ্ঞাসা।
দুর্গা মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ল, আহ, বড়দা তুই আমাকেও মের্যা ফেইললি না ক্যানে? এ পোড়া মুখ নিয়ে আমার আর বাঁইচতে ইচ্ছা করইচে না।
যদুর বিভ্রান্ত চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি। দেখল, দুর্গার শরীর ফুলে ফুলে উঠছে। যদু দুর্গার মনের কথা বুঝতে পারছে না। ও শরীরের কষ্টের কথা বলছে না। ও মরতে চায়। কেন? যদুর বিভ্রান্ত মনে একটা অজ্ঞাত উৎকণ্ঠা অন্ধকারের মতো ঘিরে আসতে থাকে। ও ঘর থেকে বেরিয়ে এল। গদাধর বলছিল, জটা অপঘাতে মইরেচে, মানুষের হাতে। গোপ আর গোপের জীব পেরানিদের মরণ যে কতর’মে হয়, তা কেউ বইলতে পারে না।
গদাধর হুঁকায় টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল।
.
অগ্রহায়ণ মাস। শালি ধান উঠে গিয়েছে। পায়রা চাষের লকলকে খেসারির সবুজ ডগা ভোরবেলা শিশিরে চিকচিক করছে। দিসারার গোপেরা দক্ষিণের মাঠে প্রাণীদের জড়ো করেছে। বাথানের যাত্রা দক্ষিণে। যদু নিজেদের প্রাণীদের খেসারির মাঠে ছেড়ে দিয়ে, খাইয়ে নিচ্ছে। শ্রীবাস ভেড়ার পাল নিয়ে আগে আগে। গদাধর হাঁক দিচ্ছে, যদু, দেরি করিস না। তাড়া দে। সব উইপড়ে খেইলে চাষ নষ্ট হবে।
চার কুড়ি প্রাণী গলার ঘণ্টার শব্দে, খেসারির কচি ডগার স্বাদ নিচ্ছে। ফোঁস ফোঁস শব্দে সুখের আমেজ। এ বড় পরম আহার। তবুও যদু তাড়া দিল। গ্রামের ভিতর দিয়ে, প্রাণীদের নিয়ে চলল দক্ষিণের মাঠে। সেখানে গাঁয়ের গোপ ঘরের প্রাণীরা জমায়েত হয়েছে। বারোয়ারি তলার বিরাট মাঠ। মাঠে ঘাস আছে, ধুলাও আছে। সূর্য মাত্র উঁকি দিয়েছে পুবের আকাশে। বহু ঘণ্টা বাজার সঙ্গে ধুলা উড়ছে। অগ্রহায়ণের রক্তিম রোদে, ধুলো যেন আবিরের মতো উড়ছে। একসঙ্গে কয়েকজন আওয়াজ করল, হা হা, যা যা সোনারা যা। মানুষের স্বরের এ সব সংকেত প্রাণীদের জানা আছে। তবু দেখ, রওনার মুখে হঠাৎ কয়েকটি মারামারি লাগিয়ে দিয়েছে। শিঙে শিঙে গুঁতোগুঁতি, মাথায় মাথায় ঠোকাঠুকি কয়েকটি সব বলদের কাণ্ড। সঙ্গে দু-চারটে গাই গরুও যে নেই, তা না। সহদেব ঘোষ লাঠি উঁচিয়ে, দঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল। ঘোরতর মারামারির মধ্যে ধুলা উড়ছে। প্রাণীরা যে দিকে চোখ যায়, সে দিকে ছুটছে। সহদেবকে দেখা যাচ্ছে না। গদাধর ক্ষ্যাপার মত লাঠি চালিয়ে প্রাণীদের সরিয়ে দিল। দেখা গেল, সহদেব মাটিতে পড়ে ছটফট করছে। একটা বলদের শিং ভেঙে রক্ত পড়ছে। আর একটার চোখের কোণ থেকে রক্ত ঝরছে।
প্রাণীরা মাঠের চারদিকে বিশৃঙ্খল ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। কয়েকজন লাঠি উঁচিয়ে তাদের তাড়া করছে। আর শোন এখন গোপের ভাষা, শালা, মামারানীর পো, গাঁড়ে বড় রস হইয়েচে। মেরে পাট পাট কইরব না! কয়েকটির ঘাড়ে পড়লও বেশ কয়েক ঘা। অনেকের সঙ্গে যদুও নিজেদের প্রাণীদের দেখছে। ধুলা উড়ছে, শত শত ঘণ্টা বাজছে। ভেড়ার পালের সঙ্গে গোরু মহিষরাও ডাকাডাকি করছে। গাভিন প্রাণীদের দিকেই সকলের বিশেষ লক্ষ্য। মারামারি গুঁতোগুতির মধ্যে পড়লে, তাদের ক্ষতি হবার সম্ভাবনা। তবে গর্ভবতীরা নিজেরাই হুশিয়ার। জানে, পেটে তার সন্তান আছে। সহজে কারোকে কাছে ঘেঁষতে দেয় না।
যদু দেখল, ওদের একটা বলদের চোখের কোণ দিয়ে রক্ত ঝরছে। ও চিৎকার করল, তোপা, শীগগির জল লিয়ে আয়।
গদাধর সহদেবকে তুলে বসাল। মুখ যন্ত্রণায় বিকৃত। দেখা গেল, তার নাভির কাছে পটলের মতো ফুলে উঠেছে। সে হাত দিয়ে চেপে ধরে আছে আরও নীচের দিকে। সহদেবের ছেলে নারায়ণ ছুটে এল। গদাধর জিজ্ঞেস করল, আর কোথায় নেইগেছে সদেব–অণ্ডকোষে?
সহদেব কোনও রকমে ঘাড় কঁকিয়ে বলল, হু। আমি যেইতে পাইরব না গদাধরদাদা।
না পার না পাইরবা! গদাধর বলল, গোঁয়ারগুলানের দঙ্গলে ঢুইকতে গেলে ক্যানে? জান না, পইড়ে গেলে, ওরা মাড়িয়ে গুইতে চইলে যাবে? খাড়া না থাইকলে চলে? যাকগা, যা হবার হইয়েছে। ওরে লারাণ ধর, বাপকে তুলে ঘরে লিয়ে যা।
আরও কয়েকজন এগিয়ে এল। গদাধর নির্বিবাদে সহদেবের কাপড়ের তলায় হাত ঢুকিয়ে দিল। হু, শির ফুইলে উইটেচে। লারাণ বাপকে ঘরে লিয়ে গিয়ে তোর মা’কে বইলবি, আগে ঠাণ্ডা জল দিয়ে পেটে, তলায় একটু মালিশ কইরে, চুন চিনি মাখাতে।
ওদিকে তখন জটা যে প্রাণীকে হাতের কাছে পাচ্ছে, তাকেই বেদম পিটছে। শিং ভেঙেছে ওদের একটা বলদের। তোপ জল নিয়ে এল এক বালতি। যদুর মুখ শক্ত। ক্রুদ্ধ চোখে জটার ক্ষ্যাপামি দেখছে। তোপাকে বলল, তুই এটার চখটা ভাল কইরে ধোতা পরে নিশিঙ্গে পাতা কিছু লিয়ে আয়, রস কইরে চখে দিতে হবে। বলেই ছুটে গেল জটার দিকে, বাজের মতো কল, কী কইরাচিস তুই। যাকে পাইচ্চিস, তাকেই মাইরচিস?’
শালাদের সব কটাকে আজ যমের বাড়ি পাঠাব। জটা যদুর দিকে ফিরেও তাকাল না।
যদু ঝটিতি জটার হাতের লাঠি চেপে ধরল, ক্যানে তুই যাকে খুশি মাইরবি। তোর গোঁয়ারটাকে গে পেটা। সবাইকে মাইরবার হক নাই তোর।
ছাড় বইলচি যদু। জটা ক্ষ্যাপা লাল চোখে যদুর দিকে তাকাল, লইলে তোর ঘাড়ে লাঠি পইড়বে।
যদু জটার হাত ছাড়ল না, ত তাই পড়ুক। কিন্তু পেরানিদের আর মাইরতে দেব না। আমাদের একটা বলদের চোখে খোঁচা লেইগে অক্ত পইড়চে, আমি ত তোর মতন পরের পেরানিদের মাইরচি না। তুই ক্যানে মাইরবি? নিজেদের বলদটাকে গে দ্যাখ, শিং ভেঙে পইড়ছে।’
জটা যদুর হাত থেকে লাঠি ছাড়িয়ে নেবার জন্য হ্যাঁচকা টান মারল। ছাড়াতে পারল না। রেগে। যদুর উরতে একটা লাথি মারল। যদুর চোখ লাল হয়ে উঠল। লাঠিটা এক হ্যাঁচকায় টেনে নিয়ে, জটার মাথার ওপর তুলল। শ্রীবাস দৌড়ে এসে যদুর হাতের লাঠি চেপে ধরল, কী কইরচিস তোরা, অ্যাঁ?
কালী ঘোষ নিজে এগিয়ে এসে জটার গালে একটা থাপ্পড় কষাল, হারামজাদাকে ত্যাখন থেকে দেইখচি, এলোপাতারি পিটচে, আবার যদুর গায়ে নাতি মাইরলে। জটাকে মারল এক ধাক্কা।
যদু তখনও তাকিয়ে ছিল জটার দিকে। লাঠি তখন শ্রীবাসের হাতে। জটার কালো মুখ আমসি। তবু চলে যেতে যেতে বাবার উদ্দেশে বলল, যাও, তুমি বাথান লিয়ে যাও, আমি যেইতে পাইরব না।’
হ্যাঁ তাই যাব রে শোর খোর।‘ কালী ঘোষ খেঁকিয়ে উঠল, চিরকাল তুই যাস নাই, আমিই গেচি। বেজাত বদমাইশ।
যদু ফিরে গেল, ওর মুখে এখন রাগ নেই। শ্রীবাস লাঠি তুলে দিল কালীর হাতে, লাও খুড়ো। বেলা হইয়ে গেল। দুকুরের মধ্যে ধমমোদ তক গিয়ে পৌঁচতে পাইরব না মনে হচ্চে।
তোপা ইতিমধ্যে নিশিঙ্গার পাতার রস বলদের চোখে লাগিয়ে দিয়েছে। প্রাণীরা আবার নিজেদের কাছাকাছি হয়ে, ঠিক পথে চলতে আরম্ভ করেছে। দেখলে বোঝা যায় না, একটু আগেই একটা খণ্ডযুদ্ধ লাগিয়েছিল। মায়েরা ডাকছে বাছুরদের। বাছুরেরা সাড়া দিয়ে ছুটছে মায়ের কাছে। ভেড়ার দল আগে আগে চলেছে। ঘণ্টা বাজছে গলায় গলায়। অগ্রহায়ণের ধুলা উড়ছে, দক্ষিণে যাচ্ছে। কোনও কোনও মহিষের পিঠে বোঁচকা বুচকি ঝোলাঝুলি বেঁধে দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণে শীতের যাত্রায়, বাথানের সঙ্গে একটা গাড়িও থাকে। হাঁড়ি কড়া ডেয়ো ঢাকনা চাল ডাল, দু-একদিনের খাবার মতো গাড়িতে যায়। দুধের ক্যানেস্তারার বড় বড় পাত্র আর বাঁকও থাকে।
গ্রামের কিছু লোক মাঠে জড়ো হয়েছিল। ছোট ছেলেমেয়েরা শীতের রোদে দৌড়োদৗড়ি, ধুলা ছোঁড়াছুড়ি করছে। সহদেবকে কয়েকজন ধরে বাড়ি নিয়ে চলে গিয়েছে। নারায়ণ চলেছে বাথানের সঙ্গে। মতিলালের সঙ্গে তার বারো বছরের ছেলে চাদুও চলেছে।
প্রাণীদের নিয়ে এ সময়ে সাবধানে চলতে হয়। এখনও মাঠে কিছু কিছু শালি ধান রয়েছে। কোনও কোনও মাঠে আলুর চাষ হয়েছে ইতিমধ্যেই। রবি শস্যের প্রস্তুতিও মাঠে মাঠে। প্রাণীরা কখন কার মাঠে ছুটে যাবে, বলা যায় না। হুঁশিয়ার, বাথান রাখাল। তোমার বিপদ পদে পদে। সামলে চল। প্রাণীদের বাঁচাও, নিজে বাঁচো।
সকলেই ভোরবেলা ভরপেট খেয়ে বেরিয়েছে। ধর্মদহে গিয়ে, গঙ্গার ধারের কাছাকাছি আজকের মতো বাথানের ড্যারা হবে। বয়সে ছোট যারা, ওরা দৌড়ে আগে আগে চলেছে। যেখানে জলা, ঘাস, তার সন্ধান নিতে ছোটা। বাথানের দেখা পেলে, চিৎকার করে ডাক দিচ্ছে। প্রাণীরা সেই ডাক চেনে। ঘণ্টার শব্দে ধুলা উড়িয়ে, ওরা ছুটে চলেছে সেই দিকে। বড়দের নজর সব দিকে। এখনও আকাটা ধান মাঠ দেখলেই লাঠি হাতে কয়েকজন সে দিকে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। হাঁকছে, যা দুরে যা সোনারা।
হ্যাঁ, কোনও কোনও প্রাণীর চোখে লোভের হাতছানি। পেকে ওঠা ধান ক্ষেত দেখলে, মুড়িয়ে খেতে ইচ্ছা করে। ভাল খাবার দেখলে, সকল প্রাণীরাই খেতে ইচ্ছা করে। ইচ্ছা করলেই পাওয়া যায় না। সকলের জন্য সংসারে নিয়ম আছে। গদাধর, কালী ঘোষ পিছনে পড়েছে। রোদে বসে কলকেয় তামাক সেজে, টিকায় আগুন ধরিয়ে, হুঁকায় শুকনো টান। পথ চলতে, হুঁকার খোলে জল থাকে না। দড়ি দিয়ে কোমরেই ঝুলিয়ে নেয়। জল থাকলে অসুবিধে। কলকে গোঁজা থাকে কোমরের ছোট থলিতে। বেশির ভাগেরই বিড়ির নেশা।
পথে কোথাও গ্রাম। কোথাও ধুধু মাঠ। কাছেপিঠে গ্রামের লোকজন সবাই মোটামুটি চেনা। যেতে যেতে কুশল জিজ্ঞাসা। চাষবাদের খবর নেওয়া। ভাল-মন্দ সংবাদ দেওয়া নেওয়া। প্রাণীরা চলেছে তাদের নিজেদের মতো। যেখানে ঘাস, সেখানেই ঠেক। খাওয়ানোর জন্যই বাথান নিয়ে বেরোনো। কারোর তাড়া নেই। ঘাস জল পেলেই সেখানে বাথানওয়ালারা একটু বিশ্রাম পায়। নজর অবশ্যই রাখতে হয়। তিনশোর মতো প্রাণী। মহিষ জল দেখলেই এক বার গা ডোবাবার তাল করে। শীত হলেও।
ধর্মদহে যখন পৌঁছাল, সূর্য তখন গঙ্গার পশ্চিমের ওপারে চলেছে। এখানে এক রাত্রির ড্যারা। যদুর লক্ষ দুটি গাভিন গাইয়ের দিকে। একটির গর্ভ প্রায় পূর্ণ। এক সপ্তাহের মধ্যেই প্রসব করতে পারে। গদাধরও তাই বলেছে। গঙ্গার চরার ওপরের জমিতে ঘাস ভালই আছে। চাষের জমি আরও ফারাকে। চাষের মাঠ শূন্য। পায়রার ঝক উড়ে কোথাও বসছে। আবার আকাশে, অগ্রহায়ণের নরম রোদে, ময়ূরকণ্ঠী পাখায় ঝলক দিয়ে উড়ছে। চড়ুইরাও ঝাক বেঁধে নিচু দিয়ে উড়ে ধান কাটা মাঠের বুকে মিশে যাচ্ছে। নদীর চরার বকেরা বাথান দেখে উড়ে এল। যে সব প্রাণীরা বসে ছিল, তাদের চোখ নাক কান সাফ করতে লেগে গেল। কাক শালিকরাও বাদ নেই।
এক রাত্রির ড্যারা হলেও, ড্যারাই। বেলা ছোট। দিনের আলো থাকতে থাকতে দোহন পর্ব শেষ করতে হবে। তার আগেই রান্নার উনোন করা, অন্যান্য ব্যবস্থায় হাত লাগাল সবাই। কিছু কাঠ আর দু বস্তা ঘষি ছিল সঙ্গেই। আগুন জ্বালানো হল আগেই। ধোঁয়ার ব্যবস্থা না করলে, উঁশদের শায়েস্তা করা যায় না। অবিশ্যি গ্রীষ্মে বর্ষায় ডাঁশ মাছিদের উৎপাত বেশি। শীতের সময়ে রাত্রে হায়নার উপদ্রবের সম্ভাবনা। শেয়াল তো আছেই।
ড্যারা করেই, দুজন সব বাছুরগুলোকে আলাদা করে, প্রত্যেকের সামনের এক পায়ের সঙ্গে আর একটি পায়ে দড়ি বেঁধে আলাদা করে ফেলল। চাঁদুর উৎসাহ দেখে যদুর মজা লাগছিল। ওর এই প্রথম বাথানে আসা। সব কাজেই হাত লাগানো চাই। কাজ এখন ওর খেলা। দোহন পট শেষ হতেই, চার জন। ক্যানেস্তারার বড় পাত্রে দুধ নিয়ে বাঁক কাঁধে চলে গেল মুড়াগাছা। অন্ধকার ঘন হয়ে আসবার আগেই প্রাণীদের সকলের পা বাঁধা শেষ। আগুনের শিখার আলো ছড়িয়ে পড়ল দূরান্তরে। যদু বোঁচকা খুলে একটা সুতির চাদর জড়াল জামার ওপরে।
পরের দিন ভোররাত্রে আবার দোহন। ড্যারা গুটিয়ে যাত্রা রূপদহে। নাকাশিপাড়ার থানার সীমানা পেরিয়ে, গুড়গুড়ে নদী পার হওয়া। কৃষ্ণনগর থানার সীমানা তার আগেই পড়ছে। পাথর আলকাতরার পাকা রাস্তা ধরা নেই। মুড়াগাছা বাঁয়ে রেখে, চুয়াখালির ওপর দিয়ে, কঁচা রাস্তায় পড়বে আমঘাটা। ধুবুলিয়া স্টেশন। বাথান স্টেশনের দিকে যাবে না। দক্ষিণে কিছুটা নেমে, রেল লাইন পার হয়ে, রূপদহ। গ্রাম। বাথানের গন্তব্য রূপাই বিল।
ড্যারা গুটিয়ে বাথানের সঙ্গেই দু জন বাঁক কাঁধে দুধ নিয়ে চলল মুড়াগাছার দিকে। দুধ বিক্রি করে, কেনাকাটা করে, চুয়াখালির কাছেই তারা বাথানের নাগাল পেয়ে যাবে। তবে, বাথানের সময় বাঁধা নেই। পথে ঘাসের বিস্তৃতির ওপর সময়ের নির্ভর। প্রাণীরা সেখানে যতটা পারে, খেয়ে নেবে। সকাল একটু চড়লেই, জলাশয় পেলে মহিষেরা এক বার জলে নামবে। নামতে দিতেই হবে। রাত্রের রাখা কড়কড়ে ভাতে কাঁচা দুধ মিশিয়ে সবাই খেয়ে নিয়েছে। সুদেব আর শ্রীবাসের চাল মেপে নিতে ভুল হয় না।
ধুবুলিয়া বাঁয়ে রেখে, বাথান এসে দাঁড়াল রেল লাইনের ধারে। রেল লাইন পার হবার আগে সাবধান। সময় ঘোর দুপুর। বরং তার থেকে বেশি। সূর্য ইতিমধ্যেই পশ্চিমে ঢলতে আরম্ভ করেছে। রূপদহে গ্রামের বাইরে দিয়ে, বাথান যখন রূপাই বিলের ধারে মাঠে এসে পৌঁছুল, অগ্রহায়ণের বেলায় তখন সোনার রং ধরেছে। এখানে ড্যারা থাকবে কম করে সাত দিন। বিলের আশেপাশে বিস্তর ঘাসের সমারোহ। মিষ্টি জলের অভাব নেই। প্রাণীদের শত শত ঘণ্টার শব্দে, সোনালি রোদে ধুলা উড়তে দেখেই গ্রামবাসীরা জেনে যায়, বাথান এসেছে। অচেনা জায়গা না। তবে প্রাণীদের চোখে চোখে রাখতে হয়। রবি শস্যের চাষ শুরু হয়ে গিয়েছে কোথাও। বড় গ্রাম, সম্পন্ন গ্রাম।
বাছুর বাঁধা দোহন পর্ব আগে। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। দুধ নিয়ে কয়েকজন চলে যাবে ধুবুলিয়া। দোহনের কাজ সবাইকে দিয়ে হয় না। তিনশো প্রাণীর সঙ্গে বারো জন মানুষ দোহনের লোক সাত জন। বাকিরা অন্য কাজে লেগে যায়। এখানে প্রাণীদের পা বাঁধা হবে না। সেই জন্যে বলদের গাড়িতে বাঁশ এসেছে। খুঁটি এসেছে। খুঁটি পুঁতে, বাঁশ দিয়ে ঘিরে ফেলার কাজ শুরু করে দিয়েছে তিনজন। সুদেব আর শ্রীবাস উনোন করে, আগুন জ্বালাবার ব্যবস্থা করছে।
দোহন শেষ হতে না হতেই, অগ্রহায়ণের ছোট বেলা। লাল অষ্টমীর চাঁদ আকাশে। গদাধর চাদর মুড়ি দিয়ে, উনোনের আগুনের কাছে বসল। একা না, অনেকেই। প্রাণীদের বাঁশে ঘেরা হয়ে গিয়েছে। গদাধর তেপাকে বলল, আমাকে একটু তামুক খাওয়া ভাই। তামুক খেইয়ে এক বার কাটরি পীরের থানে যাব। মানত ত চেরকালই থাকে।
ক্যানে, বল ত ঠাকুদ্দা। কাটারি পীরের থানে ক্যানে মানত কর তোমরা?’ চাঁদু একটা পাতলা কথা গায়ে জড়িয়ে, বাবা মতিলালের পাশে বসেছে। আর এক পাশে গদাধর।
|||||||||| যদুর সব কথাই শোনা। গাছের আড়ালে বিড়ি খেতে খেতে গদাধরের কথা শুনছে। অনেক বার । শুনেও, কাটারি ফকিরের গল্প পুরনো হয় না। গদাধর বলছে, তুই পেখম এইসেচিস, শুনিস নাই। রূপদ’র পাশে সায়েবতলা গাঁ। তা বোধ হয় হাজার বছর হবে, সেখেনে এক মোচলমান ফকিরের ড্যারা ছিল। খুব বড় সাধক ছিল, সেই ড্যারাতেই উনি দেহ রাখেন। ওঁয়ার ছিল দুটো ষাঁড়। একটা সোনার, আর একটা রুপোর। তা একদিন কী হল, সোনা রুপোর দুই ষাঁড়ে লেইগে গেল মারামারি। সে যে-সে মারামারি না, যাকে বলে যুদ্বু। দুজনের যুদূতে, পায়ের খুরের ঘায়ে, সাত সাতটা দ’ হইয়ে গেচিল। কাল দিনমানে দেইখবি, এখনও আশেপাশে সাতটা দ’ আছে। কালীয়াদ’ সোনাদ’ গোবিন্দ’ বেলেদ’ পাথরদ’ আমলাদ’ আর রূপারদ। পীর সায়েব পেরানিদের ভালবাসতেন। সেজন্যে পেরানিদের অসুখ ব্যামো হলে–তা সে তোর গোরু ভেড়া মোষ পাখি পাখালি–যারই যে ব্যামো হোক, ওঁয়ার থানে মানত কইরলে, সবাই ভাল হয়।
তা সে যুদ্ধুর কী হল?’ চাঁদুর মুখে কাঠের আগুনের আলো কঁপছে। চোখ দুটো চক চক করছে।
গদাধর তোপার হাত থেকে হুঁকা নিল, যুদূর আর কী হবে? যুদু শুরু হইয়েছিল, শেষও হইয়েছিল।
সোনা রুপোর ষাঁড় নড়ই কইরতে পারে?’ চাদুর অবাক জিজ্ঞাসা।
গদাধর হুঁকার ছিদ্রে বার কয়েক টান দিল, পাইরবে না ক্যানে? সে ষাঁড়েরা যেমন তেমন ষাঁড় লয়। সাধক পীরের ষাঁড়। উনি নিজেই তো ছিলেন সাক্ষেৎ দেণ্ঠা। ওঁয়ার ষাঁড়েরা ত জ্যান্তই ছিল।
তা, সেই সোনা রুপোর ষাঁড় দুটোর কী হল? চাঁদুর জিজ্ঞাসা আর শেষ হয় না, তারা কি যুদ্বু কইরেই মইরেছিল?
যদু বিড়ি টানতে টানতে হাসছে। চাদুর মতো যদুও গদাধরকে এই রকম জিজ্ঞেস করত। যদুর ভাইয়েরা জিজ্ঞেস করেছে। বাপ খুড়ো জিজ্ঞেস করেছে। ঠাকুরদাও তার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছে। কত কাল ধরে এই জিজ্ঞাসা চলে আসছে। যদুর এখনও জিজ্ঞাসা। সে সোনা রুপোর ষাঁড় দুটোর কী হল? পীর যদি দেহ রাখেন, তবে নিশ্চয়ই ষাঁড় দুটোও দেহ রেখেছিল। কিন্তু না, সে ষাঁড়েরা কখনও মরেনি। গদাধর এক মুখ ধোয়া ছেড়ে হাসল, তাই কখনও মরে? ওঁয়ারা ত পীরের সাধনায় দেবতাদের কাছ থেনে এইসেছিল। পীর দেহ রাখলেন, ওঁয়ারাও দেবতাদের কাছে ফিরে গেল। তা আসল ব্যাপারটা কী হল, তা বুইজতে পাইরলি কি?
চাদু মাথা নাড়ল। যারা চাদর গামছা মুড়ি দিয়ে বসে ছিল, সবাই গদাধরের কথা শুনছে। হাসছে, কিন্তু এ কাহিনী তাদের কাছেও কোনও দিন পুরনো হয় না। গদাধর মতিলালের হাতে হুঁকা বাড়িয়ে দিল, পীর যে পেরানিদের বড় ভালবাইসতেন। তাই দেবতা খুশি হইয়ে ওঁয়াকে দুটো সোনা রুপোর ষাঁড় দেচিলেন। সেজন্যে পেরানিদের অসুখ ব্যামো হলে, কাটারি পীরের থানে লোকে মানত করে। মানসিক পেইলে, উনি পেরানিদের ভাল কইরে দেন। আর এই যে দেইখচিস রূপাই বিল, রূপাদ’ থেকেই এই বিল হইয়েচে, গায়ের নামও হইয়েছে রূপদ। কাল দেইখতে পাবি, য্যাখন বাথান লিয়ে যাবি। রূপারদ’র কাছে মস্ত মস্ত হিজলি গাছ। সেখেনে রূপাইকালীর পূজা হয়। আর একটা কথা জেইনে আয়। এই রূপদ’ গায়ে পেখম গোপেরাই এইসে বসত কইরেছিল। এখেনে গোয়ালপাড়া আছে। এখেনে গোপদের কয়েক ঘরের অবস্থা বামুন কায়েতদের থেনে অনেক ভাল। কোন এক আজার দেশ থেনে নাকি এই গোপেরা এইসেছিল। কিন্তু আমি বুঝি, আমাদের মতনই তাদের বহু পুরুষ আগে, বেন্দাবন থেকেই এইসেছিল।
হ্যাঁ, এটা হাজার কথার এক কথা। মতিলাল হুঁকায় টান দিয়ে বলল, আমরা সব বেন্দাবন থেনেই এইসেছি।’
মতিলালের কথা শেষ হবার আগেই দূর থেকে ঢাকের শব্দ ভেসে এল। যদু তাকাল আকাশের দিকে। কালী ঘোষ বিড়িতে টান দিয়ে বলল, আজ অষ্টমী। কাল নবমী-জগদ্ধাত্রী পুজো। রূপদ’র জগদ্ধাত্রী পুজো খুব ঘটা কইরে হয়।
আমরা দেইখতে যাব না?’ চাঁদুর দুই চোখে উৎসুক কৌতূহল।
গদাধর হাসল, মতিলালের ব্যাটা পেখম এইসেচে, বড় ভাল সোময়ে এইসেচে। সে চাঁদুর মাথায় হাত দিল, যাবি বইকী, আমরা সবাই যাব। তা, কে কে যাবে হে কাটারি পীরের থানে? চল ঘুইরে আসি।’
আমি যাব বাবা। চাঁদু বায়না ধরল।
মতিলাল খ্যাক করে উঠল, না, এ আত্তিরে আর যেইতে হবে না। কাল দিনমানে যাবি।
গদাধর মতিলাল কালী ঘোষ, তিনজনে চাদর মুড়ি দিয়ে চলে গেল। জটা কারোর সঙ্গে কোনও কথা না বলে, গায়ে মাথায় চাদর জড়িয়ে চুপচাপ মাঠের অন্ধকারে মিশে গেল। যদু জানে, জটা যাচ্ছে। বাগদিপাড়ায়, রসের সন্ধানে। ওখানে চোলাই রস পাওয়া যায়। জটার সঙ্গে অনেকের ভাবও আছে। জগদ্ধাত্রী পূজা উপলক্ষে রূপদহ গ্রাম এখন এমনিতেই জমজমাট। কাল তো মেলা বসে যাবে। কিন্তু চৈত্র সংক্রান্তির গাজনের মেলা সবথেকে বড় হয়। যদু রূপদহের গাজন দেখেছে। তখন যেমন ভিড়, তেমনি দোকানপাটও বসে। বৈশাখে রূপাই কালীর পূজার মেলাও বড়।
.
একাদশীর জ্যোৎস্না রাত। সকলের খাওয়া হয়ে গিয়েছে। কাঁথা চাদর যার যা আছে, সবাই আগাপাশতলা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে। ঘুম নেই চাঁদুর চোখে। যদুও জেগে রয়েছে ওর চটের বিছানায়। কাঠের আগুন জ্বলছে, অল্প তার দু-এক শিখা। প্রাণীদের গলার ঘণ্টা মাঝে মাঝে বেজে উঠছে। বিল দহের চারপাশে বিস্তর ঘাস। খাবার অভাব নেই। যে-জমিতে বাথানের ড্যারা হয়েছে, মালিক ব্রাহ্মণ। গদাধর, কালী ঘোষ, সকলের সঙ্গেই পুরনো চেনা পরিচয়। কিছু চাল ডাল তেল নুন। দিয়েছে। নিজেরা রোজ তিন-চার সের দুধও কেনে।
গতকাল জগদ্ধাত্রী পূজার বিসর্জন হয়ে গিয়েছে। গত দু দিনে রূপদহ গ্রামে পূজা উৎসবে খুব হইচই হয়েছে। যদুরা পালা করে পূজা দেখতে গিয়েছিল। বাথান ছেড়ে সবাই একসঙ্গে যেতে পারে না। যদু বিলের দিকে পাশ ফিরে শুয়েছিল। ফুটফুটে জ্যোৎস্নায়, রূপাই বিলকে দূর থেকে একটা ঝাপসা আয়নার মতো দেখাচ্ছে। বাদুড়েরা মাঝে মাঝে উড়ে যাচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে। বাথান ড্যারা বাঁশ দিয়ে। ঘেরা। অতএব সারা রাত্রি ঘুরে ঘুরে পাহারা দেবার দরকার নেই। ঘুম যা হবার প্রথম রাত্রেই হয়। মাঝ রাত পর্যন্ত ঘুম গাঢ়। তারপরেই ঘুম পাতলা হয়ে আসে। বিশেষ জ্যোৎস্না রাত্রে, কাক পক্ষীরা সারা রাতই থেকে থেকে ডেকে ওঠে।
এক সময়ে জ্যোৎস্না রাত্রের স্তব্ধতাকে কাঁপয়ে দিয়ে, প্রেতিনীর খিলখিল হাসি বেজে উঠল বিলের কাছ থেকে। অলৌকিক খিলখিল সেই হাসি উত্তর থেকে পুবের দিকে চলে যেতে লাগল। শুনলে বুকের মধ্যে কেঁপে ওঠে। জ্যোৎস্না রাত্রেও গা ছম ছম করে। ভেড়ারা একসঙ্গে ডেকে উঠল। ওই ডাককে ওরাই বেশি ভয় পায়। হায়নার ডাক। গদাধর বলে, হায়নার কাম চাগানি ডাক ওটা। যে-ডাকই হোক, সেই প্রেতিনীর খিলখিল হাসির মতো ডাক রাতের স্তব্ধতাকে যেন খান খান করে দূরে মিলিয়ে যেতে থাকে। ভেড়াদের সঙ্গে অন্য প্রাণীরাও কেউ কেউ সাড়া দিল। মানুষরা কেউ কেউ কাশল, গলা। খাঁকারি দিল।
রাত আবার নিঝুম হয়ে এল। যদুর চোখ বুজে আসছিল। হঠাৎ যেন স্বপ্নের মতোই দেখল, একটা কালো বলদ বাঁশ ঘেরার বাইরে চলে গিয়েছে। কী করে যাবে? ঘুম ঘুম চোখে, দেখেও, তেমন প্রত্যয় হল না। আবার চোখ বুজতে যাবে। দেখল চাদু নিঃশব্দে উঠে, একটা লাঠি নিয়ে বলদটাকে বাথানে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে চেষ্টা করছে। কিন্তু বলদটা গ্রামের দিকে জোর কদমে ছুটছে। চাঁদুও ছুটছে। যদু কি স্বপ্ন দেখছে? ও ঝটিতি উঠে বসল। চোখ বড় করে তাকাল। না, স্বপ্ন না। পরিষ্কার আকাশের বুকে। একাদশীর চাঁদ। জ্যোৎস্নায় পরিষ্কার দেখল, কালো বলদের পিছনে চাদু ছুটছে। লাঠি থাকে হাতের। কাছেই। যদু লাঠি নিয়ে ছুটল।
কালো বলদ তখন গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। দুও। যদু অনেক দেরি করে ফেলেছে। দুজনেই ওর চোখের আড়ালে চলে গেল। যদু মনে মনে বিপদ গনল। বলদটা নিশ্চয়ই দিনের বেলা কোথাও। খাবার কিছু দেখে রেখেছে। প্রাণীদের এই রকম হয়। হয়তো কোথাও লকলকে আলুর চাষ দেখে রেখেছে। অথবা ঘাস। কিংবা গৃহস্থের দুয়ারে খড়ের গাদা। ভোলে না কিছুতেই। বেপরোয়া হয়ে, সময়মতো সেদিকে ছোটে।
যদু গ্রামের মধ্যে ঢুকে বলদ বা চাদুকে দেখতে পেল না। কোথায় গেল? ও গ্রামের পথে পথে ঘুরতে লাগল। নিশুতি রাতের ঘুমন্ত গ্রাম। গত দু দিনের মাতামাতির পর, আজ সব অকাতরে ঘুমোচ্ছে। ঘুমোয় না কেবল কুকুরেরা। যদুকে দেখে, কোনও কোনও পাড়ার কুকুর ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে এল। যদু না দৌড়ে, প্রতি পাড়ায় পাড়ায় বলদ আর চাদুকে খুঁজতে লাগল। এত রাত্রে, চিৎকার করে ডাকতেও বাধছে। লোকে ভাববে, ডাকাত পড়েছে। বলদ আর চাদু রূপদহ ছেড়ে সাহেবতলায় চলে যায়নি তো?
যদু ঘামতে আরম্ভ করেছে। গায়ের চাদরটা জামার ওপরে কোমরে জড়াল। রূপদহের কোথাও না পেয়ে, সাহেবতলা গাঁয়ে গেল। জ্যোৎস্না রাত্রে, গৃহস্থের বাড়ি, আনাচে কানাচে, গাছের ছায়ার অন্ধকারে। আঁতিপাতি করে খুঁজল। বলদ চাদু কেউ নেই। নিশির ডাক নাকি? যদু ঠিক দেখেছিল তো?
ঘুরতে ঘুরতে রাত প্রায় শেষ হয়ে এল। একাদশীর চাঁদ পশ্চিমের দূরান্তে ঢলে পড়েছে। গাছপালা, ঘরবাড়ির ছায়া ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে। দোহনের সময় প্রায় হয়ে এল। সাহেবতলার আশেপাশে দু-এক গ্রাম ঘুরে, যদু আবার এল রূপদহে। রূপদহের গোয়ালা পাড়া দিয়ে যেতে গিয়ে, যদু এক বাড়ির সামনে থমকে দাঁড়াল। প্রায় শেষ রাত্রের জ্যোৎস্নায়, যদু দেখল, বাড়ির সামনে, খোলা জায়গায়, খড়ের বিশাল স্থূপ৷ যেমন আঁটি থাক করে রাখা হয়, তেমন নেই। দেখলেই বোঝা যায়, বিশাল উঁচু খড়ের গাদা হুড়মুড় করে ভেঙে, ঝড়ে পড়ে যাওয়া চালার মতো বেঁকে আছে। যদুর মনে পড়ল, এ খড়ের উঁচু গাদা ও দিনেরবেলা দেখেছে। বড় মই বেয়ে ওঠবার মতো বিরাট গাদা। কেউ কি চুরি করতে এসেছিল?
কে, ওভেনে দাঁড়িয়ে কে? মোটা ভারী গলায় জিজ্ঞাসা ভেসে এল।
যদু বাড়ির দিকে তাকাল। বাড়ির সামনে খোলা জায়গা বেড়া দিয়ে ঘেরা নেই। এক রকম, বাইরের। উঠোন বলা যায়। চাদর মুড়ি দিয়ে এক জন এগিয়ে আসতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল। যদুর হাতে লাঠি দেখে ভয় পেয়েছে বোধ হয়। যদু বলল, আমি বাথানের লোক, বিলের ধারের মাঠে আমাদের ড্যারা হইয়েচে।
অ!’ লোকটি ভরসা পেয়ে এগিয়ে এসেই, ভেঙে পড়া খড়ের গাদার দিকে তাকিয়ে থমকে গেল, অই, এ কী কাণ্ড? এ নিচ্চয় কোনও ছাড়া গোরু মোষের কাণ্ড। সে ভেঙে পড়া খড়ের স্তূপের দিকে। এগিয়ে গেল।
যদু বলল, আমাদের ড্যারা থেনে একটা বলদ এ গাঁয়ে পলাই আইসচে। তার পেছু একটা—
হা–ওই কী সব্বনাশ গো!’ লোকটা খড়ের গাদায় হাত দিয়ে কয়েকটা আঁটি সরিয়েই, আর্তস্বরে বলে উঠল। দু হাতে খড়ের আঁটি ছুঁড়ে ফেলতে লাগল। যদু দেখল, খড়ের নীচে সেই কালো বলদ শুয়ে। আছে। তার পাশেই চাদু। হাতে তখনও লাঠি ধরা। যদু ঝাঁপিয়ে পড়ল সঁদুর ওপর। চাঁদু, ওই চাদু রে!
বলদটা খড় চাপায় মরে গেছে। লোকটা উৎকণ্ঠিত স্বরে বলল, ছেলেটা–?
যদু ছেলেমানুষের মতো ফুঁপিয়ে উঠল, চঁদুর বুকে ধুকধুকি নইড়চে না।
লোকটি চিৎকার করে হাকল, ওই গোলক, গোলক, শিগগির এইসে দ্যাখ। লোকজন ডাক। এখেনে সর্বনাশ হয়ে গেছে।
দেখতে দেখতে আশেপাশের বাড়ির লোকজন ছুটে এল। যদু স্বপ্ন দেখেনি। ঠিকই দেখেছিল। কিন্তু এমন ভয়ংকর ঘটনা ঘটতে পারে, মনেও আসেনি। জীবনে কোনও দিন দেখেনি। পেরানির লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। কিন্তু চাদু কী পাপ করেছিল? বলদ মানুষ পাশাপাশি মরে পড়ে আছে। যদু যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল, বলদ মুখ বাড়িয়ে গাদার আঁটি ধরে টানছে। পরের বাড়ির খড়। চাঁদু বলদটাকে পিটছে। লোভী বলদ চাদুর মার খেয়েও বাগ মানছিল না। তারপরেই হঠাৎ বিশাল উঁচু খড়ের গাদা ভেঙে পড়েছিল দুজনের ওপর। আর বোধ হয় আসতে পারেনি। চাঁদুর গায়ে মুখে কোথাও কোনও দাগ নেই। বলদটারও। দুজনে এক রকম জড়াজড়ি করে পড়ে আছে। চাঁদুর হাতের মুঠিতে লাঠি তখনও ধরা।
আকাশ ফরসা হয়ে এল। দিনের আলো দেখা দিল। কাক পাখিরা ডাকতে আরম্ভ করেছে। গোটা গ্রাম ভেঙে পড়েছে সেখানে। মতিলাল আর শ্রীবাস এসে হাজির হল। মতিলাল খড়ের গাদায় বসে, চাঁদুকে নিজের কোলে তুলে নিল। চাঁদুর চোখের পাতা মেলে দেখল। ঘুমন্ত মানুষের মতো চোখ। মতিলাল চিৎকার করে কাঁদতে পারল না। তার গলা দিয়ে অস্ফুট কথা উচ্চারিত হল, আ-ওই রে চাঁদু, তোর মা তোকে আইসতে দিতে চায় নাই। তোর বড় শখ, বাথানে আইসবি। তোর মাকে গিয়ে
যদুর চোখে কেবল না, জমায়েত সব মানুষের চোখে জল। বউঝিরাও কান্নাকাটি করছে, আহা, এতটুনি ছেলে, মায়ের বুক খালি করে, কী অপঘাতে চলে গেল!…
যে লোকটি প্রথম বাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে এসেছিল, নাম দুলাল ঘোষ। বাড়ির কর্তা। বলল, দশ আঁটি খড় খেয়ে গেলেও, আমি কিছু কত্তেম না। আ আমার খড়ের গাদা, দুটো পেনিরে চাপা দিয়ে মারলি!’
খবর চলে গেল বাথানে। বলদটা মতিলালেরই ছিল। চাঁদু চিনত। দু-চারজন কৃষ্ণনগর কোতোয়ালি থানায় খবর দেবার কথা বলল। গদাধর নাকচ করে দিল, পুলিশ দিয়ে কী হবে? কেউ খুন ত করে নাই। আমি বলি, মতিলাল বাঁশের চালি কইরে ছেলে নিয়ে দিসারায় যাও। চঁদুর মা এক বার দেইখবে।’
তাই যাওয়া হল। মতিলাল, শ্রীবাস, দুলাল ঘোষের ছেলে, আর একজন পড়শি, চাদুকে চালিতে তুলে দিসারায় চলে গেল। মরা বলদের পায়ে দড়ি বেঁধে যদুরা টেনে নিয়ে গেল রূপদহের ভাগাড়ে। বাথান ড্যারার জীবন যেমন, তেমনি চলতে লাগল। দোহন, বাথান চরানো, কেনাবেচা রান্না খাওয়া, কিছুই পড়ে রইল না।
পাঁচ দিন পরে, আর এক ঘটনা ঘটল। যদুও বাথান নিয়ে বেরিয়েছিল। রূপাইকালীর হিজলি গাছ অনেক। রূপাইকালীর থান সেখানে। কোনও মন্দির নেই, বিগ্রহ নেই। বড় বড় হিজলি গাছের এক জায়গায় একটি বেল গাছ। তার তলায় আছে একটি শিলাখণ্ড। এই পাথরই দক্ষিণা কালী। কিংবা বলো। রূপাই কালী। বৈশাখের শুক্লপক্ষে মঙ্গলবার রূপাইকালীর পূজা হয়। বিলের ধারে খোলা মাঠে মেলা বসে। যদু দেখেছে। এখন সেখানে, চাষের মাঠ ছাড়াও, চারদিকে সবুজ ঘাসের ছড়াছড়ি। বাথানের প্রাণীরা চরছিল সেখানেই। যদু লক্ষ রেখেছিল আসন্ন গাভিন গাইটির দিকে। আর একটি গাভিন গাইয়ের প্রসবের দেরি ছিল।
যদু বসে ছিল রোদে, রূপাইকালীর বেলতলার কাছে। বাথানের সবাই কাছেপিঠে দূরে, প্রাণীদের দিকে নজর রেখেছিল। যদুর কয়েক হাত দূরেই ছিল আসন্নপ্রসবা গাভি। এক বার ভেবেছিল, ওকে ড্যারায় রেখে আসবে। গদাধর গাভিকে দেখে বলেছিল, নিয়ে যা। এখনও তেমন লক্ষণ দেইখচি না। কিন্তু যদু বাথান নিয়ে বেরিয়ে লক্ষণ দেখেছিল। উত্তরে গিয়ে, পুবে বিলের ধার দিয়ে দক্ষিণে গিয়ে প্রাণীদের আর বেশি দূর নিয়ে যাবার দরকার ছিল না। সারা বেলা সেখানেই কেটে যাবে। প্রাণীরা ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে।
যদু দেখল, আসন্নপ্রসবা গাভিন গাই নিজে থেকেই দাঁড়িয়ে পড়েছে। ও আর সেখান থেকে নড়েনি। গাভিটি দাঁড়িয়ে ছিল একটি বড় হিজলি গাছের নীচে। দু-একবার গলা থেকে শব্দ করতে শুনল। তারপরেই বসল। যদু দেখছিল। গাভি বেশ খানিকটা সময় বসে রইল। যদুর চোখে ভেসে উঠল চাঁদুর মুখ। মতিলাল ফেরেনি। শ্রীবাস ফিরেছে। তার মুখেই শুনেছে, সঁদুর মা চাঁদুকে বুকে তুলে নিয়ে হা হা করে কেঁদে উঠে বলেছিল, অই গো চঁদুর বাপ, এ কোন চাদুকে নিয়ে এইলে? ওরে চাঁদু, বাথানে যাবার শখ মিটাইয়ে ফিরলি। এক বার ক্যানে মায়ের কথা শুইনলি না?’….
হ্যাঁ, কেউ কি বলতে পারে, কার জীবন কোথায় শেষ হবে। চাদু বড় হলে বাথানে আসত। কিন্তু প্রথম যাত্রাতেই ওর আয়ুষ্কালের নিদান ছিল। চাঁদুর কথা ভাবতে ভাবতে, যদু খেয়াল করেনি, গাভি মাঝে মাঝেই উঠে দাঁড়াচ্ছিল। আবার বসছিল। যখন লক্ষ পড়ল, গাভি তখন শয়নে। জন্মদ্বারে নতুন। বাছুরের মাথা। যদু ঝটিতি উঠে দাঁড়িয়ে, একটা হাক দিল, ওই বাবা… ওই তোপা… গাইয়ের বিয়েন হইচ্চে।…
কোথাও থেকে কোনও সাড়া এল না। যদু দেখল, গাভির রক্তাক্ত জন্মদ্বার অতিকায় রূপ নিয়েছে। নতুন বাছুরের গলা বেরিয়ে আসতেই গাভি উঠে দাঁড়াল। খানিকক্ষণ পর আবার বসল। বাছুরের কাধ, সামনের পা জোড়া বেরিয়ে এল। এসে থমকে গেল। গাভির স্বরে কষ্টের ফোঁসফেঁসানি। আবার উঠে দাঁড়াল। যদু নতুন বাছুরের মাথার নীচে হাত রাখল। ও একলা কোনও দিন গাভির প্রসবের সময় ছিল না। এই প্রথম। তখন আর বাবাকে চিৎকার করে ডাকতে ভুলে গিয়েছে। দাঁড়ানো অবস্থায় বাছুরের রক্তমাখা শরীরের কোমর পর্যন্ত বেরিয়ে এল। গাভি সেই অবস্থায় আবার বসল। যদু ঠিক করতে পারছে না, বাছুরের শরীর ধরে টানবে কি না। গাভি আর এক বার উঠে দাঁড়াবার উপক্রম করতেই, নই বাছুরের পিছনের পা জোড়া সহ পূর্ণ শরীর বেরিয়ে এল।
যদুর করবার কিছু নেই। এখন ফুল বেরিয়ে এলেই নিষ্কৃতি। গোরুর ফুল হল ঝুলান। সারা গায়ে রক্ত মাখা বাছুরের রং সাদা। মায়ের মতোই। আরও সুখের কারণ, বাছুরটি কন্যা। এ বার যদু দাঁড়িয়ে আর এক বার হাক দিল, ওই বাবা…গাই বিইয়েচে…।’
..কোনও সাড়া নেই কারোর। শালারা সব কোথায় গিয়ে মইরেচে?’ যদুর মুখে উৎকণ্ঠা। ফুল পড়লে, নাড়ি কাটার কিছু নেই কাছে। গাভি তখন শুয়ে, পেট থেকে ফুল খসাবার অপেক্ষায়। বাছুরটি নিশ্চল পড়ে আছে। কিন্তু জীবিত। ফুল পড়লে, নাড়ি কেটে, বাছুরের গায়ে যে একটু নুন ছিটিয়ে দেবে, তাও সঙ্গে নেই। বাবা বা তোপা এলে, যে-কেউ একজন ড্যারা থেকে নুন নিয়ে আসতে পারত। বাছুরের গায়ে একটু নুন ছিটিয়ে, মায়ের মুখের কাছে ধরলেই, সন্তানকে চাটতে আরম্ভ করে। নবজাতক তখন কচি গলায় ছোট ছোট ডাক দেয় বা বাঁ।
যদু বিভ্রান্ত উৎকণ্ঠায় একটা বাঁশের বাখারি খুঁজতে লাগল। বিদে কাটির মতো ধারালো না হলেও তা দিয়ে নাড়ি কাটতে পারবে। অথচ বেশি দূর যেতেও ভরসা পাচ্ছে না। চারপাশে তাকিয়ে, উত্তরের। কিছুটা দূরে দেখল ঘেঁচা বেড়ার একটা হাত দুয়েক চওড়া ফালি পড়ে আছে। ওটা কাজে লাগতে পারে। ও এক বার গাভির দিকে দেখে, উত্তরে ছুটে গেল। বেড়ার টুকরো তুলে মন খারাপ হয়ে গেল। একেবারে পচা। ছাড়িয়ে খুলে নিলেও ভেঙে যাবে। আশেপাশে উৎকণ্ঠিত বিভ্রান্ত চোখে তাকাল। কিছুই চোখে পড়ছে না। গাভির দিকে তাকাতে গিয়ে, হঠাৎ চোখে পড়ল, বিলের ধারে একটা কঞ্চি পোঁতা। তার ডগায় একটা দুর্গা টুনটুনি পুচ্ছ নাচিয়ে ডাকছে। যদু সেদিকে ছুটে যাবার আগে, আর এক বার গাভির দিকে তাকাল। আর বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। যে ভয় করেছিল, তাই ঘটেছে। ফুল বেরিয়ে আসতেই গাভি সেটি মুখে তুলে নিয়েছে।
গাভির এই এক ভয়ংকর ঝোঁক। ফুল খেয়ে ফেলতে চায়। খেলেই বুকের কাছে আটকে যায়। তখন তার মরণ আটকানো শিবেরও অসাধ্য। যদু ছুটে গেল গাভির কাছে, গলায় চিৎকার, ও সব্বনাশী, খাস না, খাস না, ঝুলান খাস না।’
যদু যখন গাভির মুখের কাছে ঝাঁপিয়ে পড়ল, অনেকটা নাড়িসহ ফুল তখন মুখের ভিতর চলে গিয়েছে। বিভ্রান্ত যদু নাড়ি ধরে মুখ থেকে ফুল টেনে বের করার চেষ্টা করল। গাভির বুকে তখন ফুল গিয়ে ঠেকেছে। সেই সময় তোপা এল। দেখেই যদু গর্জে উঠল, কোথায় ছিলি শোরের বাচ্ছা, তোর জ্যাঠাই বা কোথায়? আমার বাপ শালা? শিগগির নাড়ি কাইটবার কিছু একটা লিয়ে আয়।
হ্যাঁ, ক্ষ্যাপা গোপের মুখ এই রকমই হয়। তোপা ওর কোমরের কষি থেকে বের করল একটা বাঁটে মোড়া ছোট ছুরি। এটা দিয়ে হবে?
যদু বলল, খোল। ছুরিটা আমার হাতে দিয়ে, নাড়িটা চেপে ধর। মনে হচ্ছে, ফুলটা গিলে ফেইলেচে।
তোপা ছুরির ফলা খুলে যদুর হাতে দিল। যদু বলল, শক্ত কইরে নাড়ি ধর। জানি না, রাক্ষুসী মইরবে কি বাঁইচবে।’
যদু বাছুরের নাভির কাছে, নাড়ির খানিকটা বাদ দিয়ে, ভোঁতা ছুরি দিয়ে ঘষে কাটল। গাভির গলায় তখন কোঁথ পাড়ার শব্দ। শরীর কাঁপিয়ে বড় বড় নিশ্বাস ফেলছে। চোখ লাল। চার পা ক্রমশ ছড়িয়ে দিচ্ছে। যদুর চোখে তীব্র উৎকণ্ঠা, তোপা, বাবাকে ডাইকবার দরকার নাই। তুই ড্যারা থেকে একটু নুন লিয়ে আয়।
তোপা ছুটল। কিন্তু অসহায় যদুর চোখের সামনে, দম বন্ধ হয়ে নবপ্রসূতি গাভি ছটফট করে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করল। যদুর চোখ ফেটে জল এল। গাভির গায়ে বুকে গলায় হাত বোলাল, এ বারের। যাত্রা বড্ড খারাপ দেইখচি। চাদু গেল বলদের লোভে। তুই গেলি ফুল খাওয়ার লোভে। ক্যানে মা খেইতে গেলি। তোর মেয়েকে কে বাঁচাবে?’
তোপা যখন নুন নিয়ে এল, তখনও নবজাত বাছুর কন্যার প্রাণ আছে। ওর গায়ে একটু নুন ছিটিয়ে, কোলে তুলে নিয়ে গেল অন্য গাভির কাছে। নিজের বাছুর সবাই চেনে। সহজে কেউ মুখ দিতে চাইল না। একটা বকনা মহিষী বাছুরকে চাটতে আরম্ভ করল। আর যদুর প্রাণে আশা জাগিয়ে বাছুর ক্ষীণ স্বরে ডেকে উঠল, বাঁ বাঁ। শ্রীবাস তখন উপস্থিত। বিস্তর শুকনো কাঠ মাথায় বহে এনেছে। যদু একটা কথাও বলল না। মনে মনে পঁাত পিষল, শালার এখন আইসবার সাময় হল।
শ্রীবাসকে গাভির মৃত্যু সংবাদ দিল তোপা। শ্রীবাস কাঠের বোঝা ফেলে ছুটল গাভির কাছে। মহিষী। বাছুরকে চেটে চেটে, গা থেকে সব রক্তরস পরিষ্কার করে ফেলল। যদু মহিষীকে নিয়ে ড্যারায় পা বাড়াল। কিন্তু সেও বৃথা। বাছুরটি মারা গেল তিন দিন বাদে। ওর মাকে যে ভাগাড়ে ফেলে আসা। হয়েছিল, মেয়েকেও সেখানেই রেখে আসা হল। সাহেবতলার ডোমেরা তখন গাভির ছাল ছাড়িয়ে নিয়েছে। রক্তাক্ত মাংসের শরীর নিয়ে পড়েছিল মা। মেয়েকে রেখে আসা হল সেইখানে। মাথার ওপরে শকুন উড়ছে। দিনের বেলায় শেয়াল দূর থেকে উঁকি দিচ্ছে। কয়েক দিন আগে ফেলে যাওয়া বলদটার গায়ে আর প্রায় মাংস ছিল না। কেবল কঙ্কাল।
অগ্রহায়ণের সন্ধ্যায়, গদাধর দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, রূপাই বিলের মাঠ ও ঠ্যাকারের মাঠ লয়। এ মাঠ আমাদের চেরকাল ভাল কইরেচে, মন্দ করে নাই।
হাঁ, যদুও জানত, রূপাই বিলের মাঠে কোনও অমঙ্গল হয় না। হয়নি কোনও দিন। এ বারে হল।